গল্প=০৭৮ মন BY (Nandanadas1976) (পর্ব-১)

গল্প=০৭৮

★★★–মন–★★★
BY- Nandanadas1976

পর্ব-১
—————————

এক

—————————

মানুষের মনের হদিস পাওয়া মুশকিল। কার মনের চিন্তা কোন দিকে যায় , ঘোরে, পাক খায় সেটা কেউ বলতে পারে না। সেই জন্যেই সমাজ। কারন চিন্তার কোন সীমা নেই। সেই চিন্তা এবং চিন্তাসুত্রে তৈরি হওয়া অজস্র কর্ম, অপকর্ম কে লাগাম দিতেই এই সমাজের গঠন হয়েছিল। ভালো মন্দের কোন সংজ্ঞা হয় না। কিন্তু তাও সমাজ ভালো বা মন্দের মধ্যে একটা লাইন টেনে রেখে দিয়েছে। আমরা যারা অবুঝ মানুষ তাদের জন্য এই লাইন। চুরি করা পাপ। কিন্তু এখন শুধু আমি কেন, আপনারাও তাকে পাপ বলতে পারেন না, যখন নাচার মা নিজের অভুক্ত বাচ্চার জন্য খাবার চুরি করে বাচ্চার মুখে তুলে দেয় সেই খাবার। কিন্তু সমাজ বলে এটা পাপ। আর সেটার কারনেই, এমন অজস্র ছোট বড় অপকর্ম আটকে যায়। কিন্তু এই নাচার মায়ের মতন অনেক কিছুই তখন ব্যেতিক্রম হিসাবে গন্য হয়। এই রকম অজস্র ব্যাপার আছে, যেখানে সমাজ অবুজের মতন লাইন টেনে রেখে দিয়েছে। কিন্তু হিসাব করলে দেখা যায় এই লাইন গুলো ও মারাত্মক দামী।

আসল গল্পে আসা যাক। আমি একজন মেয়ে। বছর চল্লিশ বয়েস। নাহ থাক গল্পের মাধম্যেই জেনে নেবেন আমার পরিচয় জীবন সব কিছু। হ্যাঁ যেটা বলছিলাম, সব মেয়েদের একটা ব্যাপার থাকে। যাকে ভালোবাসে তার জন্য শেষ অব্দি যেতে পারে। খুব কম মেয়েই আছে যারা এই ব্যাপার টা ইমোশনলেস ভাবে হ্যান্ডেল করে। বাকি মেয়েরা নিজেদের ইমোশন দিয়েই ব্যাপার টা কে হ্যান্ডেল করে। তা সে বর বা প্রেমিক যেমন ই হোক না কেন। ভালোবাসা আর ভালবাসার সাথে শারীরিক সুখ , এই দুটো একসাথে পেলে, মেয়েরা মারাত্মক দুর্বল থাকে , সে নিয়ে সন্দেহ নেই। খুব কঠিন এবং সঠিক মূল্যবোধের মেয়েরা এই দুটো সুখের থেকে বেড়িয়ে এসে, নিজের ভালোবাসা মানুষ টা কে বদলানোর চেস্টা করে, একটা লেভেল বা উচ্চতা অব্দি। যেমন , পশু নয়, মানুষের মতন বাড়িতে থাকা এই ব্যাপার টা শেখানো। বা ভিজে তোয়ালে বিছানায় না রাখা, নিজের জাঙ্গিয়া নিজে কাচতে পারলেও এটলিস্ট কাচতে দেওয়া, নিজেকে পরিষ্কার রাখা, এই সব ব্যাপার গুলো।

উপরোক্ত ব্যাপার গুলো কোন ছেলে এডপ্ট করে নিলে, সাথে ভালোবাসা আর যৌনতা থাকলে মেয়েরা শেষ দিন অব্দি বরের, সতী হয়েই থাকতে পছন্দ করে। ছেলেরা হয়ত একটু উলটো। যেমন ছেলেরা , বউ ছাড়াও, বাকি মেয়েদের ইম্প্রেস করতে পছন্দ করে। সম্পর্ক করবে কি করবে না সেটা বড় কথা না। অন্যের বউ বা অন্য মেয়েকে ইম্প্রেস করতে পারলেই ওদের ইগো স্যাটিসফাই হয়ে যায়। আমাদের মত বউ দের তখন সমস্যা বাড়ে। চোখে চোখে রাখতে হয় , বাচ্ছাদের মতন। না হলে এর তার বউ কে নিয়ে ঝুলে পড়বে। ওয়েল, ব্যাপার টা এতো টা জেনেরালাইসড নয়, তবুও বা সাধারনত এটা হয়ে থাকে। হয়ত পঞ্চাশ শতাংশ ক্ষেত্রে এটাই হয়। আর নিজের প্রেমিক যদি সেক্স এ বেশ ভাল হয় তবে তো খুব চোখে চোখে রাখা দরকার। না হলে সমাজ সেবা করে বেড়াবেন তিনি।
আমার সে ভয় নেই খুব একটা। কারন আমার তিনি টি, পুলিশ অফিসার। ছোট খাট কিছু নন। তবে বিশাল বড় , রোজ খবরে নাম আসে তেমন ও না। মাঝে মাঝে টিভি তে দেখি তেনাকে। বয়েস অল্প এখন, হয়ত ভবিষ্যতে, রোজ টি ভি তে আসতে পারেন। পুরো দিন ই ব্যস্ত। তবে হ্যাঁ কাজের মাঝেও আমার ফোন গেলে ধরে। কারন ওই কাজ দেখানো আর ফোন না ধরার বিড়াল টা আমি মেরে দিয়েছি শুরুতেই। যেদিন প্রথম ফোন ধরে নি আমার, সেদিনেই। আমি ছিলাম দিল্লী তে একটা সায়েন্স মিট এ। আমার এটা অভ্যেস বলতে পারেন, আমি যতই ব্যস্ত থাকি, ফোন আমার খোলা থাকে। আর বাইচান্স, কোন কল মিস করলে, আমি পরে অবশ্যই কল ব্যাক করি। এটা আমার বরের কোন ভাবেই, অভ্যেসের মধ্যে পরে না। ফোন ধরল তো ধরল না হলে নো কল ব্যাক। আমি যখন ফোন করলাম সকালে, মিট শুরু হবার আগে, ও ফোন টা মিস করেছিল। আগের দিন রাতে কথা হয়েছিল। এটা আমাদের বিয়ের, একমাস পরের ঘটনা। তখন ও সবে জয়েন করেছিল চাকরী তে। ট্রেনিং চলছিল ওর। কাজেই আমি ভাবলাম, ব্যস্ত আছে। তারপরে লাঞ্চ এর সময়ে কল করলাম, তখনো ধরল না। সন্ধ্যে বেলায় , হোটেলে ফিরে এসে করলাম তখনো ধরল না। একবার না প্রায় তিন চার বার করে কল করেছিলাম প্রতিবার। মাথা টা তারপরে গরম হয়েছিল আমার।

আমাকে ও ফোন করল রাতে, প্রায় এগারো টায়। এমন চেঁচামেচি আর কান্না কাটি করেছিলাম বলার নয়। শুধু তাই না, ফেরার পরে সাত দিন কথা বলিনি। আমার সামনে বসে প্রতিজ্ঞা করেছিল এই রকম কোনদিন ও করবে না। সেই হয়েছে আর আজ, এর অন্যথা হয় নি। মেয়েরা এই সব ছোট ছোট ব্যাপার গুলো কে বদলাতে পারলেই খুশী হয়ে যায়। আনন্দ পায়। আর বরেরা সেটা মেনে চললে মেয়েদের ভালোবাসা, লক্ষ গুন বেড়ে যায়।

তারপরে আমার পেটে যখন ওর্শী এলো, ও প্রথম প্রথম খুব উদাসীন থাকত। আমার কস্ট হতো। মনে হতো ও কি খুশী নয়? খুব কস্ট পেতাম। ম্যাটারনিটি লিভ এ থাকতাম বাড়িতে। একা। ও কাজে থাকত। আর সারাদিন আমি মনোকস্টে ভুগতাম। আমাদের তো কেউ ছিল না তখন। আমি আর ও। আমি ভেবেছিলাম, যাক ও ছোট ছেলে, কি করবে? তবে হ্যাঁ আমার খবর নিতো। ব্যাপার টা বদলালো, একদিন ডাক্তার দেখাতে গিয়ে। আমাদের ই মতন একটী কাপল এসেছিল। বসে বসে গল্পই হচ্ছিল। তাদের আর‍্যাঞ্জড বিয়ে। কিন্তু বর টা মারাত্মক খেয়াল রাখছিল তার বউ এর। আমার আর ওর দুজনের ই সাত মাস ছিল। যদিও বউ টির এটা দ্বিতীয় বাচ্ছা। আর আমার বর হাঁ কর, সেই বরের , তার বউ টা কে কেয়ার করা দেখছিল। সেই বরটি আমার বর কে দেখে বলেছিল

– না না, প্রথম বারেও আমি আপনার মতই এলুফ ছিলাম। মনে শতেক চিন্তা ঘুরত। মনে হতো, সত্যি পারব তো বাচ্চা টা কে মানুষ করতে? কিন্তু বিশ্বাস কর ভাই, বাচ্চা হবার পরে আর আমার বউ এর কস্ট দেখে মনে হলো, আমি সারা জীবন চেস্টা করেও মা হতে পারব না। এতো কস্ট, মা ই করতে পারে শুধু। নিজের মাকে নতুন করে চিনলাম আমি। আর বউ কে আঁকড়ে ধরলাম। কারন আমার বাচ্চার জন্য সে এতো কস্ট করছে। ভালো না বাসলে, এতো কস্ট হাসি মুখে কি কেউ করতে পারে?
আমার বর টা ভোলাভালা। জানিনা কি হয়েছিল সেদিনে ওর। কিন্তু সেই কম্পাউন্ড থেকে, আমাকে ও ওর কাঁধ টা দিয়ে দিয়েছিল। যখন ই ব্যাথা করত, কস্ট পেতাম, ও আমাকে ভরসা দিয়েছে। বাচ্চা ডেলিভারী অব্দি, রোজ এক দেড় ঘন্টা, আমার পেটে হাত বুলিয়ে দেওয়া ছিলো রুটিন। কি যে আরাম হত বলে বোঝাতে পারব না। ঘুমিয়ে যেতাম আমি। আমি কি খেতে ভালবাসি, সেই গুলো নিয়ে আস্ত সন্ধ্যে বেলায়। রাতে আমি রান্না করার সময়ে, আমাকে হেল্প করত। যাই হোক মানে যেটা বলতে চাইছি সেটা হলো, মেয়েদের কাছে এর থেকে বেশী ভালোবাসার কি প্রয়োজন? আমি ওতেই খুশী। বাকি ও ওর মতন থাকে। রাতে বাড়ি ফিরে আসুক। ইচ্ছে হলে আমাকে করুক ইচ্ছে না হলে আমাকে নিয়ে শুয়ে থাকুক। ব্যস।

এটা নিছক আমার গল্প না। বা এটা একটা কাহিনী কিনা আপনারাই বলতে পারবেন, পরার পরে। কিন্তু জানিনা কেন বলতে ইচ্ছে হলো আমার তাই বলতে শুরু করলাম। বাংলাদেশ থেকে আমার দাদু চলে এসেছিলেন আগে। তারপরে, দাদু, ঠাকুমা, বাবা মা ,কাকা কাকি, আমার বাকি তিন দিদি, কাকার দুই মেয়ে বয়সে বড় তারা আমার থেকে, সবাই মিলে অনেক জায়গা ঘুরে, উত্তর বনগাঁ তে একটা বাড়ি কিনে যখন সেটেল হলেন, সেই বছরেই আমার জন্ম। সব থেকে ছোট মেয়ে আমি। আমার পরে একটা ভাই হয়েছিল আমার। তবে বড় বাড়ি কিনেছিলেন, দাদু বাবা কাকা মিলে। অনেক গুলো ঘর ছিল। প্রায় বারো তেরো টা ঘর ছিল। তো ছয় বোন আর এক ভাই আর সবাই মিলে প্রায় ১৪ জনের সংসার। আমার বরদি অপর্না র সাথে আমার বয়সের ফারাক ছিল প্রায় ১০ বছর। মেজদি, চন্দনার সাথে , ৮ বছরের, আর ছোড়দি, সুবর্না র সাথে ৩ বছরের। আর আমি নন্দনা। কাকার বড় মেয়ে , ইন্দ্রানী, আমার থেকে ৬ বছরের বড় আর ছোট মেয়ে চন্দ্রানী আমার বয়সী ছিল। ভাই আমার থেকে বছর পাচেকের ছোট ছিল। হিসাব মতন, আমার ভাই আর বড়দির ছেলে, অর্জুন, এক ই বয়সের প্রায়। ভাই মাস দুয়েকের বড় ছিল।
ব্যাপার টা হলো, দুটো মেয়ে হয়ে যাবার পরে, আমার বাবার মনে হয় আমার আর ছোড়দির জন্ম পছন্দ হয় নি। মনে হতো এটা আমার, কারন বাবা বড়দি আর মেজদি কে যত টা পছন্দ করত, আমাদের করত না। বরং উলটো টাই ছিল। আমরা অপছন্দের তালিকা তেই ছিলাম বাবার। কাজেই, বাড়ির মধ্যেই একটা গ্রুপ হয়ে গেছিল আমাদের। আমি ছোড়দি আর চাঁদ। চাঁদ মানে চন্দ্রানী। কারন আমরা এক বয়সি ছিলাম। মা এর উপরেও কম কথা শোনানো হয় নি, যত দিন না ভাই নামক একটি পদার্থ কে আমার মা জন্ম দিয়েছিল। একি ভাবে কাকীর উপরে এই যন্ত্রণা চলেছে আজীবন, কারন কাকি আমার মেয়ের মতন সৌভাগ্যবতী হতে পারে নি। কাকির আর ছেলে হয় নি। হয়ত কাকা, মানুষ হিসাবে আমার বাবার থেকে অনেক ভাল , তাই নিজের বউ কে চার চারটে বাচ্চা নেবার কস্ট দেন নি। আমার বাবা কিন্তু মায়ের উপরে সামান্য ও দয়া করেন নি। পাঁচ জন কে পেটে ধরতে হয়েছে আমার মা কে। তাও, শেষের জনা কে তো নিজের বড় মেয়ের সাথে একসাথে। ইশ কি লজ্জা। আমি ভাবছি, যদি আমার মেয়ে ওর্শী আর আমি একসাথেই প্রেগ্ন্যান্ট হই । আমি তো বর কে মেরেই ফেলব। তাও মেনে নিলাম, আনন্দের মুহুর্তে ভুল হয়েছে। একটা ক্ষমা করার জায়গা থাকে। কিন্তু ছেলের জন্ম দিতে হবে বলে যদি বর আমাকে প্রেগ্ন্যান্ট করে, সেটা কি ক্ষমা যোগ্য? মায়ের উপরে রাগ ই হয় আমার। একটু প্রতিবাদ করা যেতো না?

আমার এক মেয়ে এক ছেলে। বড় টা মেয়ে, নাম ওর্শী। স্বভাবে, ওর বাপের মতন। ঠাণ্ডা স্বভাব। হম্বি তম্বি নেই। মা যা খেতে দেবে , চুপ করে খেয়ে নেবে। পড়াশোনা তে তো বলতে নেই, বাবা মা দুজনের গুন ই ভরে ভরে পেয়েছে ও। ওর বাপের মতন দেখতে। বড় বড় চোখ। কিন্তু মজার ব্যাপার, মেয়ে আমি ছাড়া কিছু বোঝে না। ও এখন ৮ বছরের। আর ছেলে টা আমার মতন। গুন্ডা। নাম জিষ্ণু। আমাকেও মানে না। এখন তিন বছর বয়েস ওর। কিন্তু না আমাকে মানে না ওর বাপ কে ভয় পায়। একজন কেই পাগলের মতন ভালবাসে , সেটা হলো ওর দিদি। আমি অনেক সময়ে খেই হারিয়ে ফেলি। রান্না বান্না, মেয়েকে পড়ানো, ছেলেকে খাওয়ানো, কাচা কুচি, ওদের বাপ কে সামলানো। তার পরে আমার কলেজ যাওয়া। উফ মনে হয় নরকে আছি। আজ শেষ করে কলেজ পৌছতে , কালকের আগে আর পারব না। তখন আমি কাঁদি নিঃশব্দে আর কাজ করে যাই। সেই সময়ে আমার মেয়ে, ভাই এর দায়িত্ব পুরো নিয়ে নেয়। আর ভাই ও চুপচাপ দিদির সাথে থাকে, খেয়ে নেয়।

সন্ধ্যে বেলায় এসে দেখি, চুপচাপ পড়তে বসেছে দিদির সাথে। আমার বেশী দেরী হয় না। কারন আমার ক্লাস মোটামুটি শেষ হয়ে যায় চারটের আগেই। এখন সিনিয়র রিডার আমি। দিনে একটার বেশী ক্লাস থাকে না। তবে দুজনাই, মা অন্ত প্রান। ছেলে তা সারা দিন আমার খোঁজ নেয় না। রাতে আমার কাছে ছাড়া শোবেও না। কেউ পারলে শুইয়ে দেখাক। ওর বাপের কোলে থাকতে ও ভালোবাসে। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে আমার কাছে চলে আসবে মাঝ রাতে। তাই সন্ধ্যে বেলা টা, আমি নিশ্চিন্তেই কাজ শেষ করে মেয়েকে পড়াতে বসাই। ওর বাপ আসার আগে পড়িয়ে নিতে হয়। কারন ওর বাপ বাড়ি ফেরার পরে, ছেলের সাথে এমন উৎপাত শুরু করে, যে মেয়ের পড়াশোনা টাই বাকি থেকে যায়। বাড়ি তে থাকলে, ওদের বাপ , ওদের কে বিগড়ে দেবে, আর যত শাসন ফোন করে। যাই হোক, আমি সকাল সকাল বাড়ি এসে ওদের পড়াশোনার ব্যাপার টা ম্যানেজ করে নি।
মাঝে তিন দিন ওদের বাপ ছিল না। কলকাতা গেছিল, আই পি এস মিট এ। বাড়ি টা যেন মনে হচ্ছিল, কি শান্ত। এটাই হয়। ও না থাকলে এক লহমাও আমার ভালো লাগে না। আর থাকলে মনে হয় আপদ, আমাকে খেতে এই পৃথিবী তে এসেছে। আর ছেলে মেয়ে তো বাপ কে না পেলে খুব মন মরা হয়ে থাকে। বিশেষ করে ছেলে টা। বললাম না আমার মতন হয়েছে!
যাই হোক যেটা বলছিলাম, তো আমাদের বাড়িতে হয়ে গেছিল দুটো গ্রুপ। আমার ঠাকুমা দাদু বাবা , বড়দি, মেজদি আর ইন্দু দিদি আর ভাই। আর একটা গ্রুপ এ ছিলাম, আমি ছোড়দি আর চাঁদ আর কাকি। আমার কাকি আমাকে মানুষ করেছিল বলে আমার উপরে কাকির ভালবাসা টা অকৃত্রিম ছিল। পরে ভালবাসা টা আমারি দোষে নষ্ট হয়ে গেছিল। সে আমি পরে বলব ক্ষন। আর আমার মা আর কাকা কোন গ্রুপেই ছিল না। দুটো গ্রুপ ই ওদের কাছে প্রাণের থেকে বেশী প্রিয় ছিল। কি আর করা যাবে। আমার বয়েস যখন পাঁচ, তখন আমার ভাই ও জন্মায় আর বড়দির ছেলে অর্জুনের ও জন্ম হয়। বড়দি আমার দু চোখের বিষ ছিল, কিন্তু ওর ছেলে তো না। ভালোবাসতাম যথেষ্ট। সেই নিয়ে অনেক মার ধর খেতে হয়েছে আমাকে। যাই হোক, বড় আমরা সবাই হচ্ছিলাম একসাথে। বাই চান্স, ছোড়দি আর আমার পড়াশোনার ধাত ছিল মারাত্মক রকমের ভাল। আর আমি পরাশোনার সাথে সাথে খেলাধুলা তেও বেশ পারদর্শী ছিলাম। ছোড়দি, এক্সট্রাওর্ডিনারি ছিল। আমাদের স্কুলের মাস্টারমশাই দের বলতে শুনেছিলাম, এমন ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র/ছাত্রী এই স্কুল এ আগে আসে নি।
দুর্ভাগ্য দেখুন, বাবা বড়দি, মেজদির , বিয়ে দেবার পরে, মাত্র ১৭ বছরের ছোড়দির বিয়ের ঠিক করল। পাত্র চাকরী করে সরকারী। কিন্তু বউ কে পড়াশোনা করাবে না। আমার ছোড়দি বরাবর ই, লক্ষ্মী ছিল। আমার মতন গুন্ডা ছিল না। শুধু বলেছিল আমার মা কে , মা আমি পড়তে চাই আর কিছু চাই না। যাই হোক সে ঘটনায় পরে আসছি। আমি ছোট বেলায় মা কে কম পেয়েছি খুব। কারন চারটে মেয়ের জন্ম দেবার পরে মায়ের শরীর সাস্থ্য বেশ ভেঙ্গে পড়েছিল। আমার কাকি আমাকে আর চাঁদ কে প্রায় একসাথে মানুষ করেছে। আর আমার ছোড়দি। আমার ছেলে যেমন আমার মেয়েকে জ্ঞান করে, আমিও ছোড়দি কে সেই জ্ঞান করতাম। আমি মেয়েদের জামা কাপড় পড়তে পছন্দ করতাম না। না হলে আমার বাড়িতে দিদিদের কোন কমতি ছিল না। পুরোন জামা কাপড় অঢেল ছিল। আমার ছোড়দি আর কাকি, জানিনা কোথা থেকে ছেলেদের প্যান্ট আর জামা নিয়ে এসে সেলাই করে আমার মাপের বানিয়ে দিত। আর আমি সেই গুলো পরে পরে ঘুরতাম। আর গুন্ডামি করতাম।
আমার বড়দি ছিল দারুন দেখতে। কিন্তু মন টা অতো টাও খারাপ ছিল না। মাঝে মাঝে দয়া মায়া করে আমার দিকে কিছু কিছু ছুড়ে দিত। যতই হোক ছোট বোন আমি। আর আমার মেজদি ছিল মারাত্মক সুন্দরী। যেমন ফর্সা, তেমন লম্বা। মাথার চুল ছিল এক ঢাল। আমাদের বাড়িতে অবশ্য সবার চুল ছিল খুব সুন্দর। কিন্তু মেজদি, একেবারে পরী। কিন্তু মন্ টা ছিলো, তার থেকেও কুৎসিত। ওকে দেখলেই মনে হতো, কোন রাক্ষসী, রূপ বদলে আমাদের বাড়িতে এসেছে। কোন না কোন উপায়ে ও আমাকে মার খাওয়াতো বাবার কাছে। আমার ছোড়দি, সাত চড়ে রা কাড়ত না । আমি সহ্য করতে পারতাম না অন্যায়। প্রতিবাদ করতাম রিতিমতন। তাই রাগ টা আমার উপরেই ঝাড়ত। আর বড়দি কে বুঝিয়ে, দুজনে মিলে, বাবাকে দিয়ে আমাকে মার খাওয়াত। আর ছোড়দি, এক অপরূপ মিশ্রন। যেমন মিস্টি দেখতে ছিল ছোড়দি, তেমন বুদ্ধিমতী। কত বার যে দিদির একটা কথায়, বাবার কাছে মার খাওয়া থেকে বেঁচে গেছি বলার না। বস্তুত এটাই বলার যে, আমরা ছয় বোন, বেশ ভাল দেখতে ছিলাম। যদিও আমি তেমন দেখতে নই। বাবার মতন কাঁচ কাঁচ, গায়ের রঙ ছিল আমার। চোখ নাক বেশ কাটা কাটা ছিল মায়ের মতন। বেশ লম্বা হচ্ছিলাম তখন। মানে সব বোনদের যেমন ধাত , তেমন ই ছিলাম। চুল হয়ত ভালই ছিল, কিন্তু সাত বছর অব্দি ন্যাড়াই থাকতাম। পরে ছেলেদের মতন বয় কাট চুল রাখতাম আমি। মোটের উপরে দেখার দিকে আমার তেমন কোন লক্ষ্য ছিল না।
ভাল ফুটবল খেলতাম। পরাশোনায় ভাল না হলে হয়ত, খেলা কোটা তেও চাকরী পেয়ে যেতাম আমি। ছেলেদের সাথেই ফুটবল খেলতাম আমি। খেলতাম ও দুর্দান্ত। নেহাত মেয়ে বলে আমি বাইরে খেলতে যেতে পারতাম না। না হলে পয়সা নিয়ে খেপ খেলার চল তখন খুব ছিল। আমার ছোড়দি আমাকে মানা করেছিল যেতে। আর ছোড়দি আমার কাছে বাইবেল। নিজের টাকা জমিয়ে আমাকে দিদি, স্পাইক, শু কিনে দিয়েছিল। কাকি ও দিয়েছিল সেখানে কিছু। সে জুতো আজ ও আছে আমার কাছে। সযত্নে তুলে রাখা আছে। ততদিনে দুই দিদি, মানে বড়দি মেজদি , দুজনের ই বিয়ে হয়ে গেছিল। বাবা দুজনের ই বিয়ে অল্প বয়সেই দিয়েছিল। যদিও দুজনে বিয়ে করতেও চেয়েছিল। ওরা চিরকাল, কি করে সুন্দর লাগবে, গয়না কি নেবে, ড্রেস কি নেবে সেই সব নিয়ে ছিল ব্যস্ত। মানে ওদের দুনিয়া টা ওই সবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। বাবা দিতো ও ওদের। আর আমরা যেন ফেলনা ছিলাম। মায়ের জোরাজুরি তে, আমাকে আর ছোড়দি কে, একটা গলার হার আর, দুটো কানের ঠাকুমা গড়িয়ে দিয়েছিল। আমি পড়তাম না । কিন্তু ছোড়দি পরে থাকত। বললাম না ,ছোড়দি ছিল পারফেক্ট। আমাকে পরে ছোড়দি পড়াত ওই গয়না গুল। কিন্তু আমি গয়না পড়া টা খুব নোংরা চোখে দেখতাম। মনে হত মেয়ে হয়ে জন্মানোই ভুল আমার। নিজেকে ছেলেদের মতন ভাবে মানুষ করাতে চেস্টা করতাম। ছেলেদের মতন বড় হয়ে চাকরী করব, সংসার চালাবো এটাই ছিল আমার উদ্দ্যেশ্য। সেই জন্যে খেলা ধুলা করতাম ছেলেদের সাথেই। এইটা প্রমান করানোর জন্য, যে আমি অনেক বেটার।
—————————

দুই

আমি যে যে কারোর থেকে অনেক বেটার এই বিশ্বাস টা আমাকে দিয়েছিল আমার ছোড়দি। মাঝে মাঝে আমাকে সাজিয়েও দিত। বলত কি সুন্দরী আমার বোন টা। আমি রেগে খুলে দিতাম সব কিছু।, আর দিদি হাসত। আমাকে নিয়ে পড়াতে বসত। ওখানে ছাড় দিত না। নিজে ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রী ছিল। আর আমাকেও বানিয়েছিল সেই ভাবেই। কিন্তু যেটা ছোড়দি পারত না সেটা আমি খুব ভালো করে পারতাম। সেটা হলো অন্যায় দেখলে ঝাঁপিয়ে পরা। তা সে বাড়িতেই হোক বা বাড়ির বাইরে।

কম ছেলে মার খায় নি ওই সময়ে আমার হাতে। বাড়িতে কমপ্লেন কম আস্ত না। মোটামুটি রোজ সন্ধ্যে বেলায় আমার বাবার হাতে মার খাওয়া বাঁধা ছিল। মার ধর খেয়ে পড়তে বসতাম। আমি যখন ক্লাস সেভেন এ পড়ি, তখন আমার ছোড়দির মাধ্যমিক এর রেজাল্ট বেরোয়। দিদি পুরো জেলায় প্রথম হয়েছিল। পুরো রাজ্যেও একটা র‍্যাঙ্ক এসেছিল, কিন্তু সেটা আমাদের কাছে তেমন কোন ইম্পর্ট্যান্ট ছিল না। কারন আমার বাবার তেমন উৎসাহ ছিল না। আমাদের বাড়িতে তেমন কেউ কোনদিন পড়াশোনা করে নি। কাজেই কেউ জানত ও না বুঝতো ও না। আমাদের বাড়ির মেয়েদের কাছে ঘরের কাজ শেখা টা বেশী গুরুত্বপূর্ণ ছিল, পড়াশোনা শেখার থেকেও। কিন্তু এর মধ্যে একটা ঘটনা ঘটল।

আমি এক সন্ধ্যে বেলায় ফিরছিলাম খেলে ধুলে। বাড়ির পিছন দিকে ঢুকতাম। কারন আমার খেলা টা বাবার পছন্দ ছিল না। বড়দি, মেজদি, বলে দিত বাবাকে। তাই পিছন দিয়ে ঢুকতাম আমি। পিছনে একটা বড় পুকুর ছিল আমাদের। পুকুরের পাশে, দুই দিকে কলাবন আর আম গাছের বড় বাগান ছিল। লোকে ভয় পেত সেখানে। কিন্তু আমার অতো ভয় ডর ছিল না। আমি পিছন দিক থেকেই আসতাম। একদিন সন্ধ্যে বেলায় ফিরছি। অন্ধকার অন্ধকার ভাব হয়ে গেছে। এমন অন্ধকার যে সামনে না এলে কাউকেই চেনা যাবে না। বাড়ি থেকে একটু দূরে মনে হলো কেউ একজন আছে। আমার হাতে আমি একটা ইটের টুকরো তুলে নিয়ে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম।

– কে কে ওখানে।

কথা শেষ না হতেই, হাতের ইট টা বাঁই করে ছুঁড়ে দিয়েছি। উফ একটুর জন্য ফস্কে গেল। সাথে সাথেই আরেক তা ইট তুলে নিয়েছি। আমাকে ইট তুলতে দেখেই সে প্রায় চীৎকার করে উঠল।

– আরে আরে মারিস না। নান্দু, মারিস না রে আমি ললিত দা। কথা ছিল
– অ্যাঁ? ললিত দা? মানে গ্যারেজ এর ললিত দা?
– হ্যাঁ রে। মারিস না বোন আমার।
– না না মারছি না

আমি ভেবে পেলাম না ললিত দা, কেন দাঁড়িয়ে আছে এখানে। আর আমার সাথেই বা কি দরকার? যতদুর জানি, ললিত দা ভালো ছেলে। নিজের কাজ করে। বাবা নেই। মা আছে বাড়িতে। সবাইকে সম্মান করে। অনেক ছেলেই আমার হাতে মার খেয়েছে। কিন্তু ললিত দা কে আমার পছন্দই হয়। এক দুবার তো ললিতদার সামনেই ললিত দার কাকার ছেলে কে মার ধোর করেছিলাম। আমি এগিয়ে যেতেই বলল ললিত দা

– আমি এখানে তোর দিদির জন্য দাঁড়িয়ে আছি?
– মানে?
– মানে হলো, দ্যাখ তোর ছোড়দি মানে সুবর্না কে আমি পছন্দ করি। শুনলাম ওর জন্য ছেলে দেখছে। ওকে নাকি পড়াবে না তারা আর।
– হুম। ঠিক ই শুনেছ। কিন্তু তোমাকে কে বলল? দিদি?
– হ্যাঁ রে।

মনে মনে ভাবলাম দিদি ললিত দা কে বলেছে, এই কথা গুলো? মানে দিদিও পছন্দ করে ললিত দা কে? সত্যি তো।দিদির মতন ভাল মেয়ে এই তল্লাটে আসে নি। এদিকে ললিত দা বলে চলেছে

– বল, ওর এতো ভাল কেরিয়ার। আমি ওকে পড়াব। যত দিন ও পড়তে চায়। ওকে বল আমাকে বিয়ে করতে।
– কি? তুমি বিয়ে করবে? তুমি ও তো খুব একটা তেমন কিছু নউ যে ওকে দেখতে পারবে।
– হয়ে যাবে রে। দিন রাত আমি খাটব। ওকে আর মা কে নিয়ে চলে যাব কলকাতায়। ও জীবনে প্রতিষ্ঠা পাবে না? এতো ভালো পড়াশোনায়? দ্যাখ তোর বাবা বিয়ের ঠিক না করলে ওকে আমি বলতাম ও না কথা গুল।

আমি ভাবতেও পারছি না। ভালোবাসা কি বুঝিনি তখনো। কিন্তু ললিতদার চোখে আমি জানিনা কি দেখেছিলাম সেদিন। কিন্তু একেবারে ফিদা হয়ে গেছিলাম। ললিত দা বলেই চলেছে। আমি এতো কথা জীবনে ললিত দা কে বলতে শুনিনি।

– ও বলছে, ওর যা হয় হোক। আমাকে নাকি ভাবতে হবে না। দ্যাখ আমি লেখা পড়া শিখিনি। আমি হয়ত তোর দিদির যোগ্য ও নই। কিন্তু এটা না করলে ওর জীবন টা যে নষ্ট হয়ে যাবে।

বাড়ি ঢুকলাম যখন তখন আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। যাই হোক আজকে বাবা আর মারে নি। হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বসেছি দিদির কাছে। দিদি কুল। নিজের বই টা পড়ছে। চোখে চশমা টাও নেই। হাসি পেল আমার। আমি বাবা দিদি কেউ ই চশমা ছাড়া বিশেষ দেখতে পেতাম না। দিদি যে পড়ছে না, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ছিলাম। আমি জোরে জোরে পড়তে শুরু করলাম। দিদি অবাক হয়ে তাকালো। কারন আমি জীবনে জোরে জোরে পড়িনি। আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল

– ক্ষেপলি নাকি? – পরা থামিয়ে দিলাম। আমি চাইছিলাম দিদি আমার দিকে তাকাক।
– আচ্ছা দি,
– হুম কি?
– বলছি ললিত দা ছেলে টা ভাল বল?

দিদি চমকে উঠল। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। মনে হচ্ছিল যেন ভিতর টা শুদ্দু পড়ছে দিদি আমার। আমার দিদি মারাত্মক বুদ্ধিমতী। মনে মনে ভাবছি ইশ, কিছু একটা বলে ফেললাম, যেটা বলার দরকার ছিল না। দিদি কি রেগে গেল? দি কোন দিন ও আমার উপরে রাগে নি। কিন্তু রাগলেও, এটা দিদির জীবনের ব্যাপার। বলতে আমাকে হবেই। একটু কঠিন হয়েই বলল আমাকে

– কেন? ললিত দা র কথা কীসের পড়াশোনার সময়ে?
– না বলছিলাম।
– কেন বলবি কেন?
– এমনি।
– হুম ভালো ছেলে।

দিদির কথা উত্তরে মনে হলো দিদিও চাইছে ব্যাপার টা বলতে আমাকে। মানুষ কত অসহায় হলে এই সব কথা ছোট বোনের সাথে আলোচনা করে। আমি বলেই দিলাম

– জানিস দি, আমার মনে হয়, ললিত দা মিথ্যে বলছে না। বিয়ে হলে তোর এটা তো নিশ্চিত, তোর জীবন টা আমার মায়ের মতন হয়ে যাবে। ছেলে না হলে বার বার তোকে বাচ্চা নিতে হবে। ততদিন অব্দি তোকে বাচ্চা নিতে হবে যতদিন না তুই বংশের প্রদীপ আনতে পারছিস। আর ওই লোক টা কে দেখেছি। অনেক বড় তোর থেকে। আর খুব অহংকার। নেহাত তুই সুন্দরী তাই। না হলে কি আর বিয়ে করত? আর ললিত দা কে দেখ, কি সুন্দর মার্জিত।

দিদি হাঁ হয়ে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। এই বয়সে আমার মধ্যে এতো খানি বিষ? দিদি কিছু বলতে যাচ্ছিল আমাকে রেগে মেগে। কিন্তু চুপ করে গেল। খুব মিনমিন করে বলল,

– তাতে কি? বাবা দেখেছে পাত্র, মানে তোর দিদির খাওয়া পড়ার কোন ভাবনা থাকবে না তাই না?

ততক্ষনে কাকি আসাতে, আমরা আলোচনা বন্ধ রাখলাম। ওদিকে বড়দি এসেছে। বড়দির পাশে মেজদিও এসেছে। বড়দির প্রায় নয় বছর তখন বিয়ে হয়ে গেছিল। অর্জুন তখন আট বছরের ছেলে। মেজদির ও বিয়ে হয়েছে গেছিল তিন বছর মতন। বাবার দুই প্রিয় মেয়ে আসার কারনে, বাড়িতে ভালো মন্দ রান্না ও হয়েছে। সে হোক আমাদের ডাক সেই শেষ কালে আসবে। ওরা আসলে আমাদের সাথে বিশেষ কথা বার্তা বলে না। আমিও পছন্দ করি না ওই দুটো রাক্ষসীর সাথে কথা বলতে। ছোড়দি কথা বলে, কারন ছোড়দির স্বভাব টাই মিস্টি।

আরেক জন কথা বলে ওই গ্রুপে আমার সাথে, সে হলো অর্জুন। এখন আট বছর। কিন্তু শুনেছি, ওর বুদ্ধি মামার বাড়ির মাসীদের মতন। পড়াশোনায় মারাত্মক তুখোর। কলকাতায় ইংরাজী স্কুল এ পরে এখন ক্লাস টু তে। রোজ ভোর বেলায় আমি জগিং এ বেরোই, আর দেখি ভদ্রলোক উঠে লাট্টু খেলছেন উঠোনে। আমাদের বাড়ী টা বিশাল। চারদিকে ঘর। তিনতলা বড় বাড়ী, আর মাঝে বিশাল উঠোন। কাজেই যে ঘর থেকেই বেরোন হয় , উঠোণ টা চোখে পরে।

কথা হয় রোজ ই। কিন্তু সেকথা থাক এখন। আসলে এতো স্মৃতি ভিড় করছে, কোন টা বলব আর কোণ টা বলব না বুঝতে পারছি না। সব একটার উপর একটা চেপে যাচ্ছে ঘাড়ে। যাই হোক রাতে খাসীর মাংশ হয়েছিল, দুই মেয়ের জন্য। আমরাও ভাগ পেলাম আরকি।

আমি মা কাকি আর দিদি মিলে যখন খেয়ে উঠলাম, তখন বেশ রাত। দিদি মা আর কাকি বাসন মাজছিল, আর আমি দাঁড়িয়েছিলাম। আমাকে কাকি আর দিদি কিছুতেই ওদের সাথে বাসন মাজতে দেয় না। তাই আমি পাশে দাঁড়িয়ে, কল টিপে দিতাম ওদের জলের জন্য। অনেক ছোট থেকেই এটা আমি করে আসছি। আগে থেকে গিয়ে বালতি তে জল ভরে রাখব বলে আজকে গিয়ে দেখছি, অর্জুন বাবু ওখানে দাঁড়িয়ে জল টিপছে। আমি দৌড়ে গেলাম। ওকে তুলে পাশে দাড় করিয়ে দিলাম। আর নিজে কল টিপতে শুরু করলাম

– কি অর্জুন বাবু? এতো রাত হলো ঘুমোন নি।
– হিহি আমাকে আপনি বলছ কেন মিমি।
– আমাকে মিমি বলতে তোকে কে শিখিয়েছে।
– মনি
– মনি টা আবার কে?

ততক্ষনে দেখলাম, মা কাকি আর ছোড়দি বাসন পত্র নিয়ে এদিকেই আসছে। অর্জুন ছোড়দির দিকে আঙ্গুল তুলতেই বুঝলাম, ছোড়দি শিখিয়েছে।

– ও তা ঘুমোন নি যে?
– ঘুম আসছিল না।
– ও , কেন

উত্তর দিচ্ছে অর্জুন একেবারে বড়দের মতন

– এমনি, মা কে বলেই এসেছি, দিদুন, কাম্মা আর তোমাদের কাছে থাকব বলে
– বাবা, তোর মা আমাদের সাথে থাকতে তোকে ছেড়ে দিল?

ছোড়দি আমার মাথায় একটা টোকা দিল। আমি ঘুরে গেলাম ছোড়দির দিকে। বলল

– ওর কি দোষ। ওকে বলছিস কেন? দেখছিস না এমন নিষ্পাপ মুখ ক জনের হয় বলত?

আমার মা ততক্ষণে, একটা কাপড় কোথা থেকে এনে অর্জুনের মাথায় চাপিয়ে দিল। হিম পরছে নাকি। মা পারেও। পুজো গেল না হিম পড়ছে?
—————————
তিন
যাই হোক রাতে দিদির পাশে শুয়ে দিদিকে বলেই দিলাম, দিদির কথার উত্তর টা।

– দ্যাখ দিদি, এখানে হয়ত তুই খেতে পাবি, এটা নিশ্চিত, কিন্তু সারা জীবন মরে বাঁচবি। আমি তুই কেউ জানিনা, ললিত দা কত টা তোকে পড়াবে। কিন্তু এটা জানি, বাবার দেখা পাত্রে বিয়ে করলে , তুই আর কোন দিন ও পড়তে পারবি না। কি অহংকার লোক টার।

দিদি আমার দিয়ে চেয়ে রইল। জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল। আমিও দিদি কে জড়িয়ে ধরলাম। বলা ভাল আঁকড়ে ধরলাম। বুঝে গেলাম দিদি খুব অসহায়। বুঝে গেলাম আমাকেই যা করার করতে হবে।

বেল বাজতেই, দরজা খুললাম। ঝড়ের আগে এঁটো পাতের মতন মেয়ে আর ছেলে এসে হাজির। ওদের বাপ আসছে। তখন তিনজনে কম্পিটিশন হয় কে আগে দরজায় পৌঁছবে। ছেলেটা আরো সাংঘাতিক। এই বয়সেই, সব রকম গাড়ীর আওয়াজ ওর জানা। ও ঠিক বুঝে যায় যে ওর বাপের গাড়ি এল।

কাজেই আমি আর মেয়ে আসার অনেক আগে ও দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে আর তিড়িং বিরিং করে লাফায় বাপ আসার আনন্দে। বলা বাহুল্য, আমি সবার লেট এর পৌঁছাই। কেউ উপরের ছিটকিনি নাগাল পায় না বলে আমার জন্য অপেক্ষা করে। না হলে হয়ত দেখতাম, ওর বাপ ঘরে ঢুকে পড়েছে আমি জানতে পারার আগেই।
ছেলে বাপ আর মেয়ে তে আদর হয়ে গেল। মা সবার পরে। ছেলে আর মেয়ে একটু দূরে যেতেই ও আমাকে টেনে ধরে চুমু খেল। আমি বড্ড ভালবাসি এটা। মুখে বলি বটে,

– মেয়েটা বড় হচ্ছে না? কি যে কর না তুমি?
– মানু???????

মানু কথা টা ও ছেলে মেয়ে দুজনাকেই বলে। অতএব মানু শুনে দুজনাই তাকাল এদিকে। আবার আমার কোমর ধরে আমাকে টেনে আবার চুমু খেল। চুমু খেয়েই পালাল ভিতরে। আমি কিল টা ছুড়লাম, কিন্তু আগেই ও পালাল।
আমি হাসি মুখে রান্না ঘরে গিয়ে গ্লাসে জল নিয়ে গেলাম ওর কাছে। দেখলাম জুতো খুলে পোশাক টা খুলছে। আমার হাত থেকে জল টা নিয়ে খেল। বললাম

– চা খাবে শুধু, নাকি কিছু খাবে আরো?
– আজকে রাতে কি রান্না?
– রুটি, সব দিয়ে সব্জি, আর ডিম ভাজা।
– তবে দুটি মুড়ি দাও।

ওই রকম ই ও। রাতের খাবার যুত না পেলে, সন্ধ্যে তে কিছু একটা খাবে। তারপরে সারা সন্ধ্যে টাই ছেলে মেয়ে কে খেলাধুলো চলল ওর।

রাতে তিনজনের কেউ ই আমার ছাড়া শোবে না। মানুষ তো আমি একটা। কি করে তিনভাগ হই। সেই জন্য যখন দুটো কে ঘুম পাড়াই, আমি শুই মাঝে। এক দিকে ছেলে আর এক দিকে মেয়ে। ছেলে টা এখনো বুকের দুধ ছাড়ে নি। বর তখন কাজ করে। ফোনে অনেক কথা চলে। মাঝে মাঝে লেট নাইট মিটিং এও ঢুকে পরে। আমাদের বাংলোর মধ্যেই ওর অফিস আছে। সেখানে অনেকে অপেক্ষা করে অনেক রাত অব্দি। ছেলে মেয়ে ঘুমিয়ে গেলে, মেয়েকে ছেলের ওদিকে দিয়ে দি। আর বর এসে আমার পাশে শুয়ে পরে। ওকে ছাড়া আমার ও ঘুম হয় না।

অনেক দিন ছেলে মেয়েকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে, আমিও ঘুমিয়ে যাই। ঘুম ভেঙ্গে দেখি ও পাশে নেই। কারন ও চলে আসলে আমাকে তুলে দেয় ঘুম থেকে। দশ বছর বিয়ে হয়েছে আমাদের। এই দশ বছরে, প্রথম মাস ছয়েক বাদ দিলে, আমার পিরিয়ডের দিন ছাড়া, আর হয় তো কেউ নেই বাড়িতে, সেই রকম দিন ছাড়া, এমন কোন দিন নেই যেদিনে ও আমাকে সেক্স করে না। এটা আমাদের নিয়মিত। সেটাই ভাবি, যে মেয়ে একদিন, এই পুরুষ দের কেই ঘৃনা করত।

সে আজকে নিজের বর কে ছাড়া শুতেই পারে না। সেটাও দুই বাচ্ছার মা হবার পরে। এক ললিত দা আমাকে বুঝতে শিখিয়েছিল, সব পুরুষ, আমার বাবা নয়। সব পুরুষ আমার জামাইবাবু দের মতন না। কিছু মানুষ ললিত দা র মতন ও আছে।

আজকে ঘুম এলো না। আমার বর আমাদের তিনজনা কে চুমু খেয়ে নীচে গেল কাজ করতে। আহা কতই বা বয়েস, এই বয়সেই এত বড় দায়িত্ব ওর কাঁধে। আমি আবার ভাবতে লাগলাম। মেয়েটার মাথায় হাত দিয়ে আছি আর ছেলে টা তো বোঁটা মুখে নিয়ে পড়ে আছে। চোষে না। বা একটা মুখে অন্য টা হাতে। এই হলেই মহারাজ ঘুমিয়ে যাবেন।

আমি তখনই ঠিক করে নিয়েছিলাম, ললিতদা র সাথে দিদি কে ভাগিয়ে দেব। যেদিন প্ল্যান টা হয়েছিল, তার আগে ললিত দা গ্যারাজ বিক্রি করে, মা কে নিয়ে কলকাতায় একটা বাসা ঠিক করে রেখে এসেছিল। দিদি না থাকলে আমি যে একেবারে একা হয়ে যাব এই নিয়ে কোন সন্দেহই ছিল না আমার। কিন্তু আমি জানতাম, আমার মতন মানসিক জোর দিদির নেই। আমি এদের মধ্যে থেকেও অনেক কিছু আদায় করে নিতে পারব। যেটা দিদি পারবে না।

আর আমাকে জোর করে বিয়ে দেওয়া অতো সহজ না। দিদিকে দেওয়া সহজ। দিদি সুখী মেয়ে। দিদির ব্যাপার টা খুব সরল। নিজে ভুল করবেও না আর ঝক্কিও নেবে না। তাই ও অতো চাপ নিতে পারবে না বলেই আমার বিশ্বাস ছিল। সেই বিশ্বাস যে অমূলক ছিল না তার পরিচয় আমি বহুবার পেয়েছি। কিন্তু আমার জীবনের মোক্ষম সময়ে দিদি আমার সাথে ছিল শেষ অব্দি।

সেদিন রাতে সবাই ঘুমলে আমি আর দিদি পিছনের পুকুরের পাড় দিয়ে মেন রোডে এলাম। তখন দেখি, ললিত দা দাঁড়িয়ে আছে, একটা বন্ধুর সাইকেল নিয়ে। এতো রাতে তো বাস পাওয়া যাবে না। তাই সাইকেল এ করে প্রায় কুড়ি কিমি দূরে, সীমানাপুর । সেখান থেকে ট্রেন ধরবে, রাতের। শিয়ালদা পৌছবে ভোর নাগাদ। দিদি সাইকেল এ চড়ে বসতেই , যেন আমার জীবন টা খালি হয়ে গেল মনে হলো। মনে হলো, আমার জীবন থেকে হাসি খুশী সব সাইকেল এ চড়ে বিদায় নিচ্ছে। মন কে শক্ত করলাম। এই সমাজ, আমার বাবা, আমার দিদিদের অত্যাচার সবার বিরুদ্ধে, এক সাথে আমার মন এমন বিদ্রোহ ঘোষণা করল যে আমি এক ফোঁটা কান্না কথা ভাবলাম ও না। বরং, গলার হার আর কানের দুটো নিয়ে এসেছিলাম সাথে করে, দিদির হাতে ধরিয়ে দিলাম। ললিত দা কে বললাম

– যে গুল দিলাম দিদির হাতে, বিক্রি করতে পিছুপা হয়ো না।তোমাদের প্রয়োজনে লাগবে। আমার দিদিকে পড়াশোনা করিও। আর খুব ভালো রেখ। যদি বেঁচে থাকি একদিন না একদিন দেখা হবেই।
ললিত দাও কেঁদে ফেলেছিল। বলেছিল

– কথা দিলাম বোন। তোর দিদি কে নিজের প্রাণের থেকেও বেশী ভালোবাসব আমি। আর ও যতদুর পড়তে চায় আমি পড়াব।

দাঁড়িয়েছিলাম আমি, যতক্ষন ওদের সাইকেল দেখা যায়। দাঁড়িয়ে ছিলাম, যতক্ষন সাইকেলের আওয়াজ শোনা যায়। বাড়িতে এসে দেখলাম মহাশূন্যতা। ঘরে ঢুকে দেখলাম, দুজনে শুতাম , একটা ছোট ঘর, কিন্তু যেন মনে হচ্ছে, কি বিশাল। সেদিন বুঝেছিলাম, একাকীত্বের মানে। বুঝেছিলাম, আনন্দের মানে। এতো শূন্যতা, এতো অন্ধকার?

রাতে ঘুম তো হয় নি। ভোরের দিকে ঘুমিয়ে গেছিলাম হয়ত। আমার ঘরে সহসা অনেক লোকের আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল। দেখি বাবা, কাকা, ঠাকুমা, দাদু মা বড়দি মেজদি দাঁড়িয়ে। সেদিনে বড় জামাইবাবু ও এসেছিল। পছন্দ করতাম না লোক টা কে। মনে হতো, বড়দির গোলাম একেবারে। বাবার রাগ দেখে বুঝে গেছিলাম যে বাবা জেনে গেছে।

তারপরে চড়, থাপ্পড়, লাথি কিছুই বাদ গেলো না আমার। ভাগ্যিস ছোটো করে কাটা, ছেলেদের মতন চুল ছিল আমার। না হলে চুল মনে হয় সব উপড়ে ফেলত বাবা। পাড়া প্রতীবেশি জড়ো হয়ে গেল। উঠোনে আমার বিচার সভা চলল। আর আমার মা আর কাকি। কাকি তো তাও বাবার পায়ে ধরে- দাদা আর মারবেন না মেয়ে টা কে বলে কাঁদছিল। আর আমার মা ডুকরে ডুকরে কাঁদছিল আর জল ভরা চোখে দেখছিল আমার মার খাওয়া। আর কাকা। কোন কালেই বাবার মুখের উপড়ে কথা বলার সাধ্যি হয় নি কাকার। হয়ত নীরবে চোখের জল ফেলেছিল।

এ কী চাট্টিখানি কথা? বাবার মুখ ছোট হলো না? বাবার ঠিক করা পাত্রের বাড়িতে বাবার কত খানি নাম বদনাম হলো। বাংলাদেশ থেকে ভিখারীর মতন আসা আমার বাবা, আজকে যে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, আমি আর দিদি, সেই প্রতিষ্ঠার উপড়ে কলঙ্ক লেপে দিই নি? কিন্তু আমাকে টলাতে পারে কার সাধ্যি। মুখ তো খুলিনি, বরং মেজদির মুখের উপড়ে এক দলা থুতু ছিটিয়ে দিয়েছিলাম। কারন, মেজদি ই বাবাকে বলে দিয়েছিল পুরো টা। কি করে জানতে পারল কে জানে? থুতু ছিটিয়ে দেবার পরে আমি আর দেখিনি কে কে আমাকে মেরেছে। শুধু বুঝছিলাম, আমার পিঠে বেল্ট পড়ছে নির্মম ভাবে। প্রথম মনে হয় আমি কাঁদলাম। বড্ড কস্ট হচ্ছিল আমার। অনেক গুলো বেল্টের মার পড়ার পরে, মনে হচ্ছিল অজ্ঞান হয়ে যাব। – মা গো!!!!! বলে চীৎকার করতেই আমার মা ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল।

মাঝে মাঝেই জ্ঞান ফিরছিল আমার। মুখ ফুলে গেছিল, অনবরত থাপ্পড় খেয়ে। পিঠ কেটে ফালা ফালা হয়ে গেছিল। ভাগ্যিস মিলিয়ে গেছে সেই সব আজকের দিনে। না হলে আমার বর টাই হয়তো আমার বাবাকে খুন করে ফেলত। জ্ঞান ফিরছিল আর যন্ত্রণায় আমি অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলাম। চোখে ভাসছিল, আমার ছোড়দি অনেক বড় হয়েছে। অনেক বড় প্রোফেসর হয়েছে। আর যন্ত্রণা টা কমে যাচ্ছিল আমার। কাকির কোলে মাথা রেখে ছিলাম। ওঠে নি কাকি আমাকে ছেড়ে। সন্ধ্যে বেলায় বড়ই ঠান্ডা হাত পড়ল আমার গায়ে। মনে হলো আমার মা। ইচ্ছে করছিল মা কে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু এতো ব্যাথা যে আমার কথা বলার ক্ষমতা নেই তো উঠে জড়িয়ে ধরব।

পরে শুনেছিলাম, মা আর কাকিমা মিলে সেদিন রান্না ঘর ধর্মঘট করে দিয়েছিল। বাড়িতে জামাই, আর রান্না চাপবে না তাই হয় নাকি? তাই বাবা বাধ্য হয়ে ডাক্তার ডেকে আনিয়েছিল। অনেক ওষুধ পালা দিয়েছিল সেটাই স্বাভাবিক। দুটি খাবার ক্ষমতাও ছিল না আমার। অনেক রাত মনে হয় তখন। বা জানিনা কত রাত। বা রাত ও কিনা জানি না। চোখ তো খুলতেই পারছিলাম না। একটা কচি হাত আমার গালে, পিঠে ঘুরে বেরাচ্ছিল। আর ফোঁস ফোঁস করে কান্নার আওয়াজ আসছিল। এতো যন্ত্রণা শরীরে আমার।

তাও ভালো লেগেছিল। যাক, পাঁকে পদ্মফুল ও ফোটে তবে? ওটা অর্জুন বাবু। সবার নজর এড়িয়ে আমাকে দেখতে এসেছে। কি জানি কিছু তো ছিল, অর্জুনের সেই কান্নায়, সেই স্পর্শে। মন টা ভালো হয়ে গেছিল আমার। ওকে ঘুরে দেখার সাধ্যি ছিল না আমার। কিন্তু ওর স্পর্শ বড্ড ভালো লাগছিল। মনে হচ্ছিল সব ব্যাথা, সব বেদনা আমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
—————————

চার
– আউ!!!!!

ব্যাথা ঠিক পেলাম না। কেমন একটা ঝটকা। ঘুরে দেখলাম আমার বর। ফিসিফিস করে বলল – গুন্ডা আর গুন্ডি ঘুমোল?
– উফ লাগে না? ওই ভাবে কেউ কোমরের চর্বি খামছে ধরে? হ্যাঁ ঘুমিয়েছে।
– উম্মম্ম
বলে আমার পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চির শরীর টা কে পালকের মতন কোলে তুলে ফেলল। আমার বর ও প্রায় ছয় ফুট চার ইঞ্চি লম্বা। ও আমাকে বিয়ে না করলে আমার পাত্র পাওয়া মুশকিল ছিল। যদিও ওর সাথে প্রেম না হলে আমি হয়ত এই জীবনে বিয়েও করতাম না। ওমন পুরুষ না পেলে, আমার এই রকম বউ হয়ে বাচার কোন ইচ্ছে আমার ছিল না। আমাকে চ্যাংদোলা করে তুলে অন্য ঘরে নিয়ে যাচ্ছে আমার বর। এটা রোজ ই হয়।

মাঝে মাঝেই আমার মাথাটা ওর মুখের কাছে এনে কপালে চুমু খায়। আজ ও খেল বেশ কত গুল। আমি ওর গলা টা জড়িয়ে ধরে আছি। আমার চুল টা খুলে গেছে। আমার চুল ও বেশ পছন্দ করে। ওর জন্যেই চুল লম্বা আমার। পাছা অব্দি লম্বা চুল আমার। আর ও পছন্দ করে বলে ডিপ বার্গেন্ডি কালার করাই। বয়েস হয়েছে আমার চল্লিশের কাছে। না করালে ওর সাথে আমাকে মানাবে কেন? যে লেভেলের হ্যান্ডসাম ও বলার না।

ব্লাউজ খোলাই ছিল। আমাকে পাশের ঘরে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে হামলে পড়ল আমার বুকের উপরে। দুধ টা খাবে। কি যে লোভ দুধের উপরে ওর আমি বোঝাতে পারব না। আমিও শুয়ে পড়লাম ওর নিচে চিত হয়ে। ও হামলে পড়ে আমার মাই দুটো কে খেতে লাগল পালা করে। ওতেই আমি ভিজে যাই।

আমি বুঝতে পারলাম, ওর লিঙ্গ বেশ শক্ত হয়েই আছে। ও ট্রাউজার টা খুলে ছুঁড়ে দিল। আমার শাড়ি টা খুলে দিল অভ্যস্ত হাতে। সায়া টা টেনে নামিয়ে বিছানা থেকে নিচে ফেলে দিল। আমি দু হাত প্রসারিত করে ওকে বুকে টেনে নিলাম।

আমার দুটো উরু চিরে যেটা ভিতরে ঢুকল, সেটা আমার খুব চেনা। যেন তেতে ছিল সে আর তার মালিক। উলঙ্গ আমি টা ওদের দুজনের ই বড্ড পছন্দের। একজন আমার যোনি টা কে ফালা ফালা করে আর একজন আমার শরীর টা। আমার বর আমাকে করতে করতে আমার গলা বুকে মারাত্মক আদর করতে শুরু করল। আমি জড়িয়ে ধরলাম পাগলের মতন। কি বিশাল নির্লোম শরীর আমার বরের। আমার সুবিশাল মাই দুটো কে খেয়ে, টিপে আমাকে ভোগ করছে আমার বর। কানের কাছে ফিসিফিসিয়ে বলল

– উপরে আয় আমার

আমি সানন্দে উপড়ে চলে গেলাম। এই সময়ে তুই তুই করে বললে আমি খুব উত্তেজিত হয়ে যাই। খোলা চুল টা দু ভাগ করে সামনে নিয়ে এলাম। ইশ আমার বর টা কীইইই ম্যানলি । ইচ্ছে তো করে, ওকেই আমি খেয়ে নি বিচ্ছিরি ভাবে। কিন্তু আমার তাতে মন প্রান ভরে না। বর যখন আমাকে বিচ্ছিরি ভাবে খায়, তখন মনে হয়, এই জন্ম সার্থক। এই সুখ, এই ভালোবাসার জন্য আমি প্রতি জন্মে এই লোকটার বউ হতে চাই। আমার একদিন মেয়ে হওয়া নিয়ে ক্ষোভ ছিল। আজকে মনে হয়, ইশ ভাগ্যিস আমি মেয়ে। আর সুন্দরী, না হলে এই লোকটার আমার উপরে চোখ পড়ত না। আর আমিও পেতাম না ওকে। আর না পেলে কে আমাকে ভালোবাসত এই ভাবে? বলেছিলাম না মেয়েরা ভালোবাসার কাছে অসহায়।

বিশাল লিঙ্গ টা ধীরে ধীরে ভিতরে নিলাম আমি। যা বড়, আমার দুটো বাচ্চা হবার পরেও, সাবধানে নিতে হয়। হোক বড়, গর্বিত আমি। অনেকদিন বর ক্ষেপে থাকে। আমাকে চেপে ধরে ঢোকায়। ব্যাথা পাই। কিন্তু তখনো মনে হয়, আমি গর্বিত। বরের বিশাল নির্লোম ছাতির উপরে ভর দিয়ে আমি কোমর ওঠানামা করতে শুরু করলাম। আর আমার বর আমার সাথে তাল মিলিয়ে তলা থেকে ধাক্কা দিয়ে শুরু করল। আমি ঝুঁকে গেলাম সামনের দিকে। আমার মোটা লম্বা বোঁটা আমার বর মুখে নিয়ে জোরে টান দিতেই আমি গলে যেতে শুরু করলাম। জল খসিয়ে ফেললাম আমি পাগলের মতন। বুকে মাথা দিয়ে রইলাম আমি পরে। আমার বর আমার ঘাড়ের কাছে চুল মুঠি তে ধরে তলা থেকে আমাকে করতে থাকল।

উফ আমি বরের কাঁধ দুটো কে দুই হাতে ধরে আছি শক্ত করে। ইইইইইইইইইইই করে শীৎকার করছি। খুব প্রিয় জায়গা আর সময়। কিছুই করতে হয় না আমাকে। তবুও তীব্র সুখ। মাঝে মাঝে থেমে যায় ও আমার চুল টা গোঁড়ার কাছে মুঠি করে টেনে ধরে মাথা টা পিছনে করে দেয়। মুখ টা আমার পিছনে হেলে থাকে। ও সেই সময়ে আমার গলায় মুখ টা ঢুকিয়ে ঘ্রান নেয়, চুমু খায়। থুতনী টা কামড়ে ধরে। কান টা মুখে নিয়ে চোষে। আমি আর কি বলব? ওর ছাতি তে ভর দিয়ে ওই ভাবেই থাকি। মনে মনে বলি, শয়তান ছেলে, এই সব করেই তো আমাকে বশ করেছিস। না হলে কারোর বউ হয়ে, তার ছেলে মেয়ের মা হয়ে থাকার মেয়ে এই নন্দনা ছিল না। কিছু ক্ষন ধরে আমাকে তীব্র আদরের পরে , বর বলল বেশ জোরেই

– কুত্তি হয়ে যা মাগী
– ইশ দুষ্টু

মুখে দুষ্টু বললেও, আমি মহানন্দে কুত্তি হয়ে গেলাম। চুল টা সামনে দিকে নিয়ে এলাম। বর আমার সরু কোমর টা ধরে পিছন থেকে ঢোকাল। আমি সামনের হাতে ভর দিয়ে রইলাম। বর মাঝে মাঝেই আমার মাই দুটো কে চেপে ধরছে জোরে। দুধ ফিনকী দিয়ে বেরোচ্ছে। বর রোজ ই এই সময়ে ক্ষেপে যায়। প্রায় আধঘন্টার উপর ও আমাকে করে চলেছে। বেশ কয়েকবার আমার অর্গাজম হয়েছে। মাল্টিপল অর্গাজম করালে আমার মতন মানসিক ভাবে হাফ ছেলেও পাগল হয়ে মেয়ে রূপে ধরা দেবে তার পুরুষের কাছে। আমি তো ব্যেতিক্রম নই। ধরা দিয়েছি। তিন নম্বর কেও পেটে নিতে রাজী আমি। শুধু এই লোকটাকেই আমার দরকার। স্পিড বাড়াতেই বুঝলাম, এবারে ও ফেলবে।

আমি হাপিয়ে গেছি। বললাম
– সুনু, বাইরে ফেলিস, পিক টাইম আমার এখন।
– ধুর মাগী মুখ বন্ধ রাখ তুই।

বলে আমার চুল টা হাতে নিয়ে টেনে ধরলো সজোরে। ইশ কি মুখ খারাপ করে ছেলেটা। করুক। এই সময়ে ওর এই ব্যাপার গুলো আমার পছন্দের।

– উহহহহহ
– থাম কুত্তি

বলে চুলের গোছা টেনে ধরে মারাত্মক জোরে ও আমাকে চুদতে শুরু করল। মাঝে মাঝেই পাছায় থাপ্পড় দিচ্ছে ও আমার। আমার বেশ ভাল লাগছে। কলকল করে জল খসিয়ে ফেললাম আমি সুখে। পরক্ষনেই বর আমার ভিতর থেকে, ওর লিঙ্গ টা বের করে, চুল টা টেনে ধরে পিঠে, পাছায় গলগল করে ফেলল। ওর লিঙ্গ টা আমার পিছনে ঠেসে ধরে আমার পিঠ টা কামড়ে ধরে থাকল যতক্ষন ধরে ও বীর্য ফেলল আমার উপরে।

কোলে করে আবার বিছানায় এনে যখন ফেলল আমাকে, দেখলাম ছেলে কে বেশ জড়িয়ে ধরে মেয়ে আমার ঘুমোচ্ছে।ততক্ষনে, আমি ব্লাউজ সায়া না পরে শাড়ি টা জড়িয়ে নিয়েছি গায়ে। আমাদের বিছানা বেশ বড়। অর্ডার দিয়ে বানানো। আমার বরের সখ ছিল, তিন চারটে বাচ্চার। তাই আট বাই দশের বিশাল বিছানা ও বানিয়েছে। অনেক কস্ট করে মহারাজ কে আটকানো গেছে। আমার বর কারোর শোনে না আমার দিদির ছাড়া। আমি তো বিপদেই পড়ে গেছিলাম। জানিনা কেন আমার ও বাচ্ছা বেশ ভাল লাগে। তাই ও যখন বলেছিল, তৃতীয় বাচ্চার কথা, আমি না করতে পারিনি। দিদি কে বলতেই দিদি তেড়ে এসেছিল আমার দিকে। দিদি জানে আমি কি লেভেলের ভালবাসি বর কে। ও বুঝেছিল, আমার মাথা বলছে – আর না, কিন্তু মন বলছে বাচ্ছা নেবার কথা। তাই আমাকে কিছু না বলে সোজা বর কে বকে দিয়েছিল।

বেচারী বর। কি করবে তখন থেকেই, বাইরে ফেলে বীর্য। এমন পুরুষালী চোদন খাবার পরে কোন মেয়ের না ঘুম আসে। শুয়ে ছিলাম দুজনে সটান হয়ে। আমি ওর একটা হাতে ভর দিয়ে বুকে মুখ গুঁজে। আমার পা দুটোকে ও নিজের পায়ের নিচে নিয়ে নিয়েছে। ওর একটা পা আমার পাছের উপরে, আমাকে জড়িয়ে ধরে পেঁচিয়ে নিয়ে, আরো ঢুকিয়ে নিয়েছে নিজের মধ্যে। আমি আমার হাত ওর পিঠে বুকে বুলিয়ে দিচ্ছি। এতো ক্লান্তি আসছে বলার না। ঘুমাবো এবারে। ওকে তাকিয়ে দেখে, ঠোঁট এ চুমু খেলাম। উম্মম্ম। ক্লান্তি। গুডনাইট সুনু!!!!! অমন বর এর হাতে মাথা রেখে বুকের মধ্যে ঢুকে গিয়ে ঘুমানোর মজাই আলাদা।

বলে না যখন সব চলে যায় মানুষের সাহস আর তেজ দুটোই বেড়ে যায়। আমারো তাই হয়েছিল। কারোর পরোয়া করতাম না। যা মার খেয়েছি তারপরে আর বেশী কিছু হয় না। যার তার মুখের উপরে সটান বলে দিতাম যা মনে আসত আমার। তাতে সে বাবা হোক ঠাকুমা বা দিদিরা। শুধু অর্জুন কে মেপে চলতাম। মনে হতো, ওকে আমি ওমনি করলে , সেও ওদের মতন হয়ে যাবে।

পরের দিকে দিদিরা আসা অনেক কমিয়ে দিয়েছিল। বাবা তো ছোড়দি কে তেজ্য কন্যা করে দিয়েছিল। আমি খবর পেতাম ওদের গ্রামের একটি ছেলের মাধ্যমে। কাউকে বলিনি। লুকিয়ে লুকিয়ে আমাদের গ্রামের , একটি কাগজে দেখে এসেছিলাম, যে দিন উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট বেড়িয়েছিল। দিদি এই রাজ্যে দ্বাদশ হয়েছিল। কাউকে বলিনি। মা কেও না। কাকী কেও না। আমাদের গ্রামে পড়াশোনার চর্চাই ছিল না। শুধু নিজে মনে মনে গর্ব করেছি।
আর এক বছরের মধ্যেই আমার ও মাধ্যমিক ছিল। সেদিনের মার খাবার পরে একটা ব্যাপার হয়েছিল, মা আর কাকি এমন বিদ্রোহ করেছিল যে বাবা প্রতিজ্ঞা করেছিল, আমার গায়ে আর হাত তুলবে না। আর তুললেও আমার কিসসু যায় আসত না। আমার অভ্যেস হয়ে গেছিল। কিন্তু লাভ যেটা হল। আমার সাথে বাবার মার ধর সুত্রে যত টুকু কানেকশন ছিল সেটাও কেটে গেল।

সেদিনের মার টা এতোটাই মারাত্মক হয়েছিল যে, বড়দিও নাকি কান্না কাটি করেছিল। কারন অর্জুন টানা দুদিন কান্না কাটি করে জ্বর বাঁধিয়ে ফেলেছিল। তারপর থেকে ওরাও কেউ আমাকে ঘাটাত না আর আমার তো দরকার ও নেই। আমি কোনদিন কিছু চাই ও নি। যখন ছোড়দি ছিল, ছোড়দি কে কিছু না দিলে ঝামেলা করতাম। আমার নিজের জন্য কিছু চাইতাম না । আমাকে খেলা ধুলা করতে দিলে আর পড়াশোনা করতে দিলে আমার কিছু চাইবার ছিল না।

এদিকে যতই ছেলে সেজে থাকি, যৌবন তো আসবেই। এলো ও। বড়ই বাজে সময়ে এলো। একটা ম্যাচ খেলছিলাম। জানিনা কেন চূড়ান্ত রকম পেট ব্যাথা শুরু হলো আমার। এতোটাই যে আমি হাঁটতে পারছিলাম না। বাড়িতে কাকীমা ছিল। আমাকে সবাই ধরাধরি করে এনে বাড়িতে দিয়ে যাবার পরে, আমি কোন রকমে বাথরুম গেছিলাম। ভেবে ছিলাম পেট খারাপ। কিন্তু আমার শর্টস এ রক্ত দেখে খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম।

রাতে শুয়ে ছিলাম কাকির কোলে মাথা রেখে। কাকি কোমরে সেঁক দিয়ে দিচ্ছিল। জানলাম পিরিয়ড সম্পর্কে। পড়াশোনা তো করেছিলাম আমি। আজকে সেটা আমার জীবনে হলো। ছেলে গুলো ভালই আছে। এসবের কোন ঝামেলা নেই। মা এলো একটু রাতে।
– কই দেখি, গুন্ডি টা কেমন আছে?
বলে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। আহ মা, কি যে আরাম দাও তুমি!!!! কি মহাভারত অশুদ্ধ হতো আমি তোমার একমাত্র মেয়ে হলে? হাতে দেখলাম একটা প্যাকেট। কাকি কে বলল মা

-ছোট, তোর কাছে আমার টাকা রাখা থাকে। আমার মেয়ে যেন, ন্যাকড়া না ব্যবহার করে। ওকে প্যাড কিনে দিস।
প্রথম পিরিয়ড। সারা রাত মা আর কাকি মিলে পিঠে কোমরে তলপেটে সেঁক দিয়ে দিয়েছিল। মা বলছিল

– ওরে, মেয়ে হওয়া মুখের কথা না। ভগবান অনেক যত্ন করে মেয়েদের বানায়। মেয়েরা ছাড়া এতো কস্ট কে সহ্য করে বড় হবে মা? তুই মেয়ে হয়ে জন্মেছিস বলে দুঃখ করিস না। একদিন দেখবি গর্ব হবে।

চুপ করে শুনছিলাম মায়ের কথা আমি। এই প্রথম মনে হলো, আমিও স্পেশাল। হ্যাঁ স্পেশাল ই তো। জড়িয়ে ধরলাম আমার নিজের মেয়েকে ছেলেকে আর যার বুকে আছি তাকে মনে মনে জড়িয়ে ধরলাম আমি।

পরের দিনে যা ব্যাথা বাড়ল, তাতে মায়ের কথা আর মনে পড়ল না আমার। ছটফট করেছিলাম পুরো দিন টা। আমার ভাই যে ভাই, একটা অপদার্থ, সেও মাঝে মাঝে দেখে যাচ্ছিল আমাকে। মনে হচ্ছিল ওকে দেখে, আচ্ছা ভাগ্য পেয়েছে অপদার্থ টা। ওকে দেখছিলাম আর আমার রাগ হচ্ছিল মারাত্মক। কিন্তু কি করব। আমরা স্পেশাল। ভগবানের নাম দিয়ে টুপি অলরেডি আমরা পরে বসে আছি। রইল তিন দিন আরো এই ব্যাপার টা। কিন্তু সারতে পুরোপুরি প্রায় ছয় দিন গেল আমার। আমি তিন নম্বর দিন থেকেই পড়াশোনা শুরু করে দিয়েছিলাম। কিন্তু একটা সমস্যা হলো, সেটা হলো, আমার ভয় করতে শুরু করল। এই যন্ত্রণা, এই ব্যাথা, সব থেকে বড় কথা এই বাধ্যতা টা আমার মেনে নিতে পারছিলাম না।
—————————

পাঁচ

রাতে ঘুম টা ভেঙ্গে গেল আমার। দেখলাম বর এদিক ওদিক করছে অস্থির ভাবে। স্বপ্ন? তুলে দিলাম ওকে।

– এই শুনছো? কি হলো?

বর উঠে পড়ল। দেখলাম ইতিউতি দেখছে । আর আমাকে সামনে পেয়েই আঁকড়ে ধরে নিল। বুঝলাম বাজে স্বপ্ন। ও মাঝে মাঝে ওই সব দেখে। দেখে আমাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে মাঝ রাতে। আমি বুঝি আমাকে নিয়ে ও ইন্সিকিওর থাকে। না আমি চলে যাব ওকে ছেড়ে সেই জন্য না। আমার কিছু হলে ও কি ভাবে থাকবে সেই চিন্তা ওকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। কিন্তু সেটা তো নর্মাল। আমার ও মাঝে মাঝে এই চিন্তা আসে। কিন্তু সেটা নিয়ে তো বসে থাকা যায় না। অনেক কস্টে যে মানুষ টা কে জীবনে মানিয়ে নিয়েছি, তার জন্য এই সব চিন্তা স্বাভাবিক। আজকে আমি যার বাচ্চার মা, সে যে আমার কাছে কত টা প্রিয়, সেটা আমি বুঝলেও, সেই মানুষ টা কে বোঝানো কঠিন হয়ে যায়। এই উপলব্ধি টা ওকে পেতে হবে। আমি চেস্টা করলেও এই উপলব্ধি টা ওকে করাতে পারব না।

সারা রাত আমার পেটে যন্ত্রণা করেছিল। বুঝলাম পিরিয়ড শুরু হবে। রাতে বর আবার ঘুমিয়ে যাবার কিছু পরেই আমার পিরিয়ড শুরু হলো। আমি বাথরুম থেকে প্যাড লাগিয়ে এসে শুলাম। কিন্তু ঘুম আসছিল না। খুব তলপেট ব্যাথা করছিল। বর কে তুলতেও ইচ্ছে করল না ঘুম থেকে। আহা কিছু তো করার ও নেই ওর। শুধু শুধু রাত জাগবে। ভোরের দিকে ক্লান্তি তে ঘুমিয়ে গেছিলাম আমি।

ঘুম যখন ভাঙল দেখলাম অনেক বেলা হয়ে গেছে। ধড়মড় করে উঠে বসতেই, দেখি আমার বর এক গাল হাসি নিয়ে একটা ট্রে তে করে দু কাপ চা নিয়ে আসছে। – গুড মর্নিং!!!
– গুড মর্নিং। সরি আমার উঠতে লেট হয়ে গেল।
– জানি আমাকে বলতে হবে না। আমি বুঝতে পারি সোনা। তুমি বস। চা খাও।
ততক্ষনে আমার খেয়াল পড়ল, এ মা!!!! আমার ছেলে মেয়ে দুটো? ওদের দিকে চাইতেই দেখলাম বিছানা খালি। বর সেটা বুঝে বলল
– নো চিন্তা। তাদের আমি তুলে, ফ্রেশ করিয়ে খাইয়ে দাইয়ে দিয়েছি। ওই যে এলো তোমার গুন্ডা
দেখলাম স্কেট চালিয়ে সোজা বিছানার কাছে এলো আমার ছেলে
– গুড মর্নিং মামমাম।
– গুড মর্নিং সুনু।
মেয়েও এলো। তাকেও গুড মর্নিং করলাম। ওরা চলে গেল। আমি চেয়ে রইলাম বরের দিকে। ও চা ঢালছে আমার কাপ এ। ইশ কি মিস্টি এই লোকটা। কি করে সব বুঝে নেয় আমি না বলতেই। মিত্তি মিত্তি মিত্তি। এতোটাই মিস্টি যে মনে হয় মাঝে মাঝে খেয়ে নি ওকে। উউউহহহহ ওই সবের চিন্তা আসলেই পিরিয়ডের সময়ে তলপেট এ যন্ত্রণা টা বেড়ে যায়। যাক বেড়ে। কি সুন্দর সকাল। আর ততোধিক মিস্টি আমার এই পরিবার। জন্ম জন্ম থাকুক আমার পিরিয়ডের যন্ত্রণা। ভাগ্যিস ছিল আমার পিরিয়ড!! ভাগ্যিস আমি এই ছেলেটাকে ভাল বাসতে পেরেছি।এ না থাকলে আমার কী হতো। কে এভাবে আমাকে ভালোবাসত। ভাগ্যিস!!!!!!!!!!!!

মেয়েরা অভ্যস্ত হয়ে যায় নিজের জীবনের এই বাধ্যতা টা তে। কতজন বোঝে আমার বরের মতন যে, এই সময়ে মারাত্মক দুর্বল থাকি আমি। এই সময়ে কোন কাজ তো করতে ইচ্ছে করেই না, উলটে বর গায়ে হাত দিলেও মনে হয় ঠেলে সরিয়ে দি। এতো টাই দ্বিতীয় দিনে পেটে ব্যাথা করে। আর তার সাথে মারাত্মক ব্লিডিং হয়। সারা দিনে কম করে পাঁচবার আমাকে প্যাড বদলাতে হয়। আমার বর বোঝে, আমাকে স্পেস দেয়। যাদের এই বোঝবার লোক টা নেই, তাদের তো এই সব নিয়েই কাজ কর্ম, ছেলে মানুষ, অফিস আদালত করতে হয়। ট্রেনে বাসে চড়ে অফিস ও যেতে হয়।
সারা দিন একলা বসে। মেয়ে আমার পাশে বসে আঁকছে না হলে পড়ছে। আর না হলে আমার সাথে কথা বলছে। বড্ড পেকেছে মেয়ে টা। মাঝে মাঝেই আমার পেটে হাত বোলাচ্ছে। জিজ্ঞাসা করতেই বলল

– পাপা বলেছে, তোমার পেটে ব্যাথা।
– তাই? আজকে কে রান্না করল রে?
– পাপা আর রিঙ্কু মাসী।
– পাপা কি রাঁধল।
– জানিনা খেতে পারবে কিনা দেখ?

আমার হাসি পেয়ে গেল কথা টা শুনে। আমিও বলি ওর বাপ কে মাঝে মাঝে। ওর বাপ মাঝে মাঝেই আমাকে হটিয়ে রান্না ঘরে ঢুকে হুজ্জুতি করে। রাধে কিছু একটা। হয় চিকেন, না হলে ডিমের ঝোল। আমি বলি তখন কথাটা, মুখে গেলে হয়। কিন্তু রাধে ভালো। আসলে নিজের রান্না খেয়ে খেয়ে আমার ও ভালো লাগে একদিন অন্য হাতের রান্না। আর জানিনা, ওর রান্নায় নুন মিস্টি পারফেক্ট হয়। কি ভাবে হয় বলতে পারব না। আমি হেসে বললাম

– তোর ভাই আর পাপা গেলো কোথায়, দেখছি না বাড়িতে?
– পাপা আর ভাই বেড়িয়েছে।
– তুই গেলি না?
– তোমাকে একলা রেখে?

কথাটা, আমার মনের কোন গভীরে ঢুকে গেল ছুরির মতন। বিঁধল খুব কঠোর ভাবে আমাকে। কারন আমি বাড়ির কারোর ইমোশন কে কোন দিন পাত্তা দি ই নি। পাত্তা দি ই নি, আমার মা কে। ভালো হয়ত বেসেছি খুব ই। কিন্তু আমার মেয়ের মতন করে কোন দিন ভাবিনি। আমি তো শেখাই নি আমার মেয়েকে এই সব কোনদিন। নিজের থেকেই এসেছে এটা ওর। ও আঁকছে, আর আমি ওর থেকেই নিজেকে লোকাতে, উলটো দিকে মুখ ফিরিয়ে শুলাম। ফিরে গেলাম আমার ছেলেবেলায়।

ভগবানের মার। কিছু তো করার নেই। মেনে নিলাম আমি একজন মেয়ে। মেনেও নিলাম আর বুঝতেও শিখলাম আমি ছেলে হতে পারব না। যতই খেলা ধুলা করি, জতই ছেলেদের প্যাদাই, সেই কোন ছেলের সিমেন এ আমার পেটে বাচ্চা আসবে। বলে না যখন কিছু করার থাকে না, তখন সেই না করতে পারা টাকে, জিবনের অঙ্গ বানিয়েই সামনে দেখতে হয়। কেউ শেখায় নি সেটা আমাকে। কিন্তু বুঝে গেছিলাম। তাই ছেলে হতে না পারি, কিন্তু অনেক বেটার হতে পারব এই আশা মনের মধ্যে তৈরি হয়ে গেছিল। মন টা শক্ত হয়ে গেছিল। বুঝে গেছিলাম, এই বাধ্যতা, এই ব্যাপার গুলো কে সামনে নিয়েই আমার এগিয়ে যেতে হবে। অনেক দূর। অনেক অনেক দুর।

ওই সব চিন্তা মন থেকে সরিয়ে ফেললাম। পুরো মাত্রায় কন্সেন্ট্রেট করলাম পড়াশোনায়। সাথে খেলা ধুলা টাও চলত আমার।মাঝে মাঝে, বড়দি আর অর্জুন আসত। তবে ওদের আসা কমে গেছিলো অনেক। সেদিনের আমার মার খাবার পরে, আগের মতন প্রতিমাসেই আসত না। বড়দির সাথে মেজদির সম্পর্ক টাও ভেঙ্গে গেছিল অনেক টা। বড়দি মেজদি আলাদা আলাদা আসত। হয়ত ওদের ছেলে, মেয়েরা বড় হচ্ছিল, পরীক্ষা, আলাদা বোর্ড, সে কারনেও হতে পারে, স্কুল ছুটির সময় আলাদা। কিন্তু পুজো পার্বন ছাড়া, ওদের একসাথে আমি আর কোন দিন ও দেখিনি।

বুঝতে পারছিলাম, বড়দি আসতে আসতে ভেঙ্গে পড়েছিল কোন কারনে। শুনেছিলাম, বড়জামাইবাবুর ব্যবসা তে বেশ বড় রকম সমস্যা চলছে। বাবাও না কি দেদার টাকা ঢালছে সেখানে। যাক ওদের ব্যাপার ওরা বুঝুক। আমার কী? আমি তো বাড়ির ভবিষ্যৎ তেজ্য কন্যা।

মা কে জিজ্ঞাসা করতে বলেছিল, মাস ছয়েকের মধ্যেই নাকি রিকভার করেছিল বড়দি রা। বাবাকে নাকি টাকাও ফেরত দেওয়া শুরু করেছিল জামাইবাবু। ভালো। আমার চিন্তা ছিল অর্জুনের পড়াশোনা নিয়ে। যাক তবে ঠিক আছে। আমার পড়াশোনার টাকা বাবাই যোগায়। কিন্তু সেটা মা আর কাকীমার মাধ্যমে।

আমিও যে দিদির মতই ভাল পড়াশোনা তে সেটা মা আর কাকীমা জেনেছিল। ছোড়দির মতন যেন কোন স্টেপ না নি সেই জন্য, কোন কিছুর অভাব রাখে নি ওরা। যা দরকার হতো সেটা বললেই পেয়ে যেতাম আমি টাকা। ইশ ছোড়দি কে দিলে আজকে সে বাড়িতে থাকত। বাবার উপর থেকে রাগ আমার কোন দিন ই যাবে না। একটা লেজেন্ডারি লেভেলের গোঁয়ার আর অশিক্ষিত একটা লোক।

আমার সাথে অর্জুনের সম্পর্ক টা কথার থেকে বেশি ইশারায় ছিল। কথা খুব কম বলত ও। ভাত দিলে খেয়ে নেবে। না দিলে চাইবেও না। বকলে শুনে নেবে। না বকলেও পরোয়া নেই। যেটা করার সেটা করবে। ওর মা ওকে ডেকে ডেকে না খাওয়ালে , কোন দিন ও দেখতাম না ও খেতে চেয়েছে। বা বলেছে মা খিদে পেয়েছে। আমার ভাই টা ছিল উল্টো। সারাদিন কথার খই ফুটছে মুখে। কিন্তু ও আবার আমাকে ভয় পেত। আমি হয়ত ওকে সহ্য করতে পারতাম না, কিন্তু ও কোনদিন ও আমাকে কোন দুঃখ কস্ট দেয় নি। বরং ওকে নিয়ে বাবা ঠাকুমা দাদু যা আদিখ্যেতা করত তাতে আমার রাগ টা বেশী হত। আমার মায়ের ও আদিখ্যেতা ছিল ভাই কে নিয়ে। আর সেটাই ছিল আমার রাগের কারন। আমি আসলে চিরকাল ই বেশি পজেসিভ। মা কে নিয়ে ছিলাম পজেসিভ। দিদি কে নিয়ে ছিলাম । এখন স্বামী কে নিয়েও মারাত্মক পজেসিভ আমি। আমার ছেলে মেয়েকে নিয়েও পজেসিভ। তাই রাগ হতো ভাই এর উপরে।

অর্জুন আমার থেকে বছর পাঁচ কি ছয়েকের ছোট ছিল। ও যখন এক বছরের ছিল, আমি তখন ছয় বছরের। অমন একটা ফুটফুটে ছেলে থাকলে কার না ইচ্ছে করে কোলে নিতে। আমার ভাই কে তো দেখার সুযোগ ও ছিল না তেমন। সারাক্ষণ ঠাকুমা নিয়ে থাকত। বংশের প্রদীপ বলে কথা। তখন মাঝে মাঝে অর্জুন কে, বড়দি, নিচের তলায় দোলনায় শুইয়ে রাখত। এই রকম ই একদিন সন্ধ্যে বেলায় আমি খেলেটেলে ফিরে দেখি, অর্জুন দোলনায় শুয়ে আর খুব কাঁদছে। বড়দি নেই। আর মেজদি তো বড়দির ফেউ।খালি বড়দির পিছনে পিছনে ঘুরত। কাজেই বাড়িতে দুজনের কেউ ছিল না। মা মনে হয় সন্ধ্যে দিচ্ছিল। আর কাকি কোথায় ছিল মনে নেই। ঠাকুমা তো ভাই কে নিয়ে আছে। নাতনির ছেলে কাঁদছে, তাতে ঠাকুমা এর কি। ছোড়দি, আমাকে বলল, – নান্দু, দেখনা বুনি, পুচু টা কাঁদছে কেন?
আমি গিয়ে দেখি আহা, ছেলেকে কত মশা খাচ্ছে। আমি মশা গুলো কে তাড়িয়ে দিয়ে ইচ্ছে হলো ওকে কোলে নিতে। কি মিস্টি দেখতে ছিল বলার না। ওমা আমি কোলে নিতেই চুপ করে গেল ও। আর আমি তখন নিজেই ছোট। আর সে ছিল বলতে নেই হৃষ্টপুষ্ট একটা বাচ্চা। তাও কস্ট করে নিলাম কোলে। ছেলে চুপ ও করে গেল। আমার বেশ ভাল লাগল। আমি কোলে নিয়ে কত ঘুরলাম। ও হাসছিল। আমার মুখে হাত দিয়ে মারছিল।

ততক্ষনে ছোড়দি এসে গেছে। ছোড়দি ও তখন নয় বছরের মেয়ে। কিন্তু আমার থেকে তো বড়। ছোড়দি আমার থেকে ওকে নেবে সেই সময়ে বড়দি এসে তুমুল চীৎকার শুরু করে দিল। – কে বলেছে তোকে কোলে নিতে? পরে গেলে কি হতো।
আমার মা সন্ধ্যে দিয়ে ফিরে এসেছে ততক্ষনে। বড়দির চিৎকারে ছুটে এসেছে একেবারে। আমি তো হতভম্ভ। করলাম টা কি? মাকে তো দশ কথা শুনিয়ে দিলো বড়দি।

– কই ভাই কে তো দাও না ওর কোলে? আমার ছেলের কোন দাম নেই নাকি? কেন দিয়েছ তুমি ওর কোলে আমার ছেলেকে। বুঝেছি এ বাড়িতে আমার কতখানি দাম।

আর ও হাজারো কথা। আমি বুঝে গেলাম আজকে বাবার বকুনি কিম্বা মার খেতে হবে। ছোড়দি,মা দুজনাই ঘাবড়ে গেছে। অর্জুন তখনো আমার কোলে আছে। মা তড়িঘড়ি এসে আমার কোল থেকে অর্জুন কে নিতেই অর্জুন আবার কাঁদতে শুরু করল। আমি আর ভয়ে নিতে পারছি না। ছোড়দিও নিল অর্জুন কে কোলে। কান্না থামে না। বড়দি নিল, মেজদি নিল। বড়দি ঘরে গিয়ে দুধ দিলো তাও কান্না থামে না ছেলের। আমি তো পালিয়ে এসেছি তখনি। হাত পা ধুয়ে পড়তে বসে গেছি। খাওয়ার কথা বলতেও পারছি না। আর শুনতে পাচ্ছি অর্জুন ঘ্যান ঘ্যান করে কেঁদেই যাচ্ছে।

প্রায় ঘন্টা খানেক পরে আমি আর ছোড়দি যখন পড়ছি ঘরে একসাথে, মা দেখলাম অর্জুন কে নিয়ে এল। আমাকে দেখেই অর্জুন চুপ করে গেল। আমার কোলে ঝাঁপিয়ে চলে এলো একেবারে। ছয় বছরের মেয়ের কোল আর কত টুকু হবে? কিন্তু ওতেই ও চুপ করে গেল। আমি একটু আদর করে দিলাম

– কি গো অর্জুন বাবু কান্না কেন? দুত্তুমি করছ? ওলে বাবালে?

মুখ টা সামনে নিয়ে যেতেই ও হেসে ফেলছিল। খানিক খেলার পরে আমি বললাম

– এবালে মাসী পরু পরু করবে। আবার কালকে খেলব কেমন? এবারে তুমি দিদুনের সাথে যাও?

কি বুঝল কে জানে। মায়ের কোলে উঠে পড়ল। চলেও গেল হাসতে হাসতে। আমি আর দিদি মুখ তাকাতাকি করে খানিক হেসে নিলাম। যদিও পরে বড়দি বলেছিল, আমি নাকি কিছু খাইয়ে দিয়েছি ওকে। আমার মা তেড়ে গেছিল বড়দির দিকে। আমি যে একটা মাত্র ছয় বছরের মেয়ে, সেটা মা দিদিকে বার বার বলছিল। এই কথা একবার না। বার বার অনেকবার নানা সময়ে আমার বড়দি আমাকে বলেছে।

আমি আর অর্জুনের সামনে যেতাম না। কিন্তু এই দেখা হয়ে যাবার ব্যাপার টা প্রায়শই ঘটতে থাকল। আমি জানি ,হয়তো অর্জুনের মা অর্জুন কে বকে। আর আমিও নিজেকে শাসন করি। যাতে অর্জুনের সাথে কথা বলতে না হয় দেখা না হয়। আমার জন্য না। অর্জুন আমার সাথে কথা বললে হয়ত ওর মা ওকে বকবে।

কিন্তু হলো অন্যরকম। মাধ্যমিক দেব আমি সেবারে। কাজেই সারাদিন পড়াশোনা করতাম, তাই ভোর বেলায় আমি দৌড়তে যাবার সময় বের করে ছিলাম। কারন পড়াশোনা চলছিল মারাত্মক রকম, আমি খেলা ধুলা সব তুলে রেখেছিলাম মাথায়। শরীর চর্চা ভালোবাসি বলে সকালে উঠে দৌড়তে যাওয়া টা বন্ধ করিনি আমি। খুব সকালে মানে ভোরে উঠতাম। দাঁত মেজে, নিজেই রান্না ঘরে কিছু বানিয়ে নিতাম। মাধ্যমিক বলে, মা আমার জন্য হরলিক্স কিনে এনেছিল। আমি অনেক আগে উঠতাম তাই, নিজেই বানিয়ে নিতাম। হরলিক্স আর বিস্কুট খেয়ে বেরোতাম দৌড়তে। সে রকম ই একদিন উঠেছি। তখন সবে হালকা হচ্ছে আকাশ। আমি হরলিক্স বানিয়ে উঠোনের দোলনায় বসে হরলিক্স এ বিস্কুট ডুবিয়ে খাব। আর দেখি অর্জুন বেড়িয়ে এলো বাথরুম থেকে। ফ্রেশ হয়ে এলো মনে হয়। আমাকে দেখে এগিয়ে এল আমার দিকে। লজ্জা লাগল। ইশ আমি মাসী হই। হরলিক্স খাচ্ছি আর ছেলেটা কিছু না খেয়ে আছে? বললাম

– কি অর্জুন বাবু, একটু হরলিক্স খাবেন?
– হুম
– কি খাস তুই? এটা খাস না ওন্য কিছু খাস? আমি বানিয়ে দিতে পারি কিন্তু?
– না হরলিক্স ই খাই।

আমি তখনো খাই নি আমার টা। বিস্কুট টাও ডোবাই নি হরলিক্স এ। আমি ওকে দোলনায় বসতে বলে, আমার টা ওকে দিলাম। বললাম

– এটা খা। বিস্কুট দুটোই খাবি কিন্তু
– এটা তো তোমার?
– কে বলল? আমি যে জানতাম, অর্জুন বাবু ঘুম থেকে উঠে আসবেন এখনি। আমি বানিয়ে আনছি আমার টা। এটা অর্জুন বাবুর ই।

এক মুখ হাসি হয়ে গেল। ইশ কি মিস্টি হাসে ছেলেটা। আমি ওকে আমার টা দিয়ে, আবার বানিয়ে নিয়ে এলাম আমার জন্য। ও দোলনায় বসে চমুক দিচ্ছে আর আমি দাঁড়িয়ে খাচ্ছি। যা বুঝলাম, ওর পরীক্ষা হয়ে গেছে । এখানে এসে আছে। ওর মায়ের ও নাকি শরীর টা খারাপ যাচ্ছে। আমি তো এলুফ থাকি আমার বাড়ির ব্যাপারে, তাই এই সব জানিও না। তবে মাধ্যমিকের আগের একমাস , আমার প্রতিদিনের রুটিন ছিল, ভোর বেলায় আমার আর অর্জুনের হরলিক্স বানিয়ে রাখা। কোন দিন ও আগে উঠে পড়ত। কোন দিন লেট করত উঠতে। ছোট ছেলে, ওর মা তো জানত না। ওকে তুলে দেবার ও কেউ ছিল না। লেট হতেই পারে। আমি তো ভয়ে ডাকতেও পারতাম না। কি জানি ওর মা কি বলে দেবে আবার। তাই আমি অপেক্ষা করতাম, মিনিট দশেক। তার মধ্যেই ও বেড়িয়ে আসত। তারপরে দুজনে হরলিক্স ,আর বিস্কুট খেয়ে দুজনে মিলে ঘন্টা খানেক দৌড়তাম। তার পরে এসে যে যার ঘরে। আমি সারাদিন পড়াশোনা। আর ও কি করত কে জানে। সেই মনে হয় শেষ বার ও এসে অতোদিন ছিল আমাদের বাড়িতে।
—————————

ছয়

সমস্যা হয় আমার পিরিয়ড শেষ হবার পরের পাঁচ ছয় দিন। খড়িয়ে থাকি আমি। বর কে সব সময়ে চাই চাই মনে হয়। মনে হয় আমাকে নিয়েই ও পরে থাকুক সব সময়ে। আর এই সময়েই দেখি ওর দুনিয়ার কাজ পরে যায়। তবুও চেস্টা করে রাতে আমাকে সময় দেবার। কি যে রাগ ধরে তখন বলে বোঝাতে পারব না। আর পিরিয়ডের আগের পাঁচ ছয় দিন, একদম ভাল লাগে না শারীরিক সম্পর্ক, তখন বরের যত ফ্রী সময়। এটা রেগুলার না হলেও, বেশীর ভাগ সময়েই হয়।

আমার আগের দিন রাতে পিরিয়ড শেষ হয়েছে। তাই আজকে সকালে উঠেই স্নান করে নিয়েছি আমি। আমাকে কলেজ যেতে হবে আজকে একবার অবশ্যই। আমাদের যে দেখাশোনা করে সেই রিঙ্কু দি থাকবে পুরোদিন বাড়িতে। রিঙ্কু দি কে আমার বর এনেছিল। অভাবের তাড়নায় কোন অপকর্ম করেছিল হয়ত। বর সেখান থেকে বের করে এনে, আমাদের বাড়িতে কাজে লাগিয়েছিল।

রিঙ্কু দির ও দুই মেয়ে। কিছু দুরেই বাড়ি। খুব ভালবাসে আমাদের। আমার কোন বিপদে আমি ছোড়দি আর রিঙ্কু দি ছাড়া কাউকেই খবর দি না। শত কাজ থাকলেও নিজের বাড়িতে চলে আসে আমার কাছে, আমার দরকারে। আমার ছেলে ডেলিভারির সময়ে, আমার মায়ের কাজ টা ওই করেছিল। আমার ছেলেকে ও আমার থেকে কম কিছু ভালোবাসে না।
আমিও রিঙ্কু দি কে কাজের লোক হিসাবে কোনদিন ও দেখিনি। ভালবাসা টা তৈরি হয়ে গেছে একে অপরের প্রতি। যেহেতু সারা দিন রিঙ্কু দি থাকবে তাই রিঙ্কুদি আসবে একটু দেরী তে। আমি রান্না বান্না করে নেব তার আগে। ও এলে আমি কলেজ যাব। আর ও সারাদিন থাকবে ছেলে মেয়ের জন্য। ভাল ডিল। কিন্তু সকাল এ স্নান করে পুজো করার পর থেকেই, ঘুমন্ত বর কে দেখে আমি বার বার ভিজে একসা হয়ে যাচ্ছি।

ওকে চা দিয়ে যখন ঘুম থেকে তুললাম তখন প্রায় সাড়ে ছটা। আমাকে দেখে একেবারে হাঁ হয়ে গেল ও। কিছু বলল না। ও উঠে চা খেয়ে, বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে সোজা রান্না ঘরে। আমি রান্না চাপিয়েছিলাম। বরের আজকে মিটিং আছে ইলেকশন এর। প্রতি বছরেই কোন না কোন ইলেকশন। আর তখন আমার বরের ঘুম উড়ে যায়। আজ ওকে বেড়িয়ে যেতে হবে অনেক আগে। ওর গাড়ির ড্রাইভার তো সকাল সকাল এসে বসে আছে নিচে অফিসে। আমি একবার চা ও পাঠিয়ে দিয়েছি। ওকে দেখে বললাম

– স্নান করে নাও। নাকি আরেক কাপ চা খাবে?

খালি গা, একটা শর্টস পরে আছে। পেশী বহুল এবস যুক্ত শরীর ওর কোন কালেই না। বরং নমনীয় ছিপছিপে শরীর। হাতে পেশীর কারুকার্য নেই, কিন্তু শক্তিশালী হাত সেটা দেখলেই বোঝা যায়। নির্মেদ পেট। শরীর আলগা ছেড়ে রাখলে বেশ নরম নরম লাগে ওর শরীর টা আমার। ওকে দেখছি আর আমার অবস্থা কাহিল। বর ও আমাকে দেখছে। বলল

– চা তো খাব আরেকবার। কিন্তু আজকে আমার বউ কে এতো মারাত্মক সুন্দরী লাগছে কি ব্যাপার?

খুব ভাল লাগল আমার। মুখে বললাম

– সেটা কোনদিন লাগে না??
– না সেটা সব দিন লাগে, কিন্তু আজকে যেন একেবারে কাম দেবী লাগছে। ভিজে চুল, পরিপাটি করে শাড়ি পরা, গা থেকে কি সুন্দর গন্ধ বেরোচ্ছে।

আমি আর তাকিয়ে থাকতে পারলাম না ওর দিকে। উল্ট দিকে ফিরে গেলাম। বুঝলাম ও এগিয়ে এলো আমার দিকে। পিছন থেকে আমার চুলের ভিতরে নাক টা ভরে দিল আমার ঘাড়ে। আমার ওকে আটকানোর কোন ইচ্ছে ছিল না। ওর শরীর টা আমার শরীরে স্পর্শ হচ্ছে আর আমি কেঁপে কেঁপে উঠছি। ভিজে যাচ্ছি বিশ্রী ভাবে। গা থেকে একটা পুরুষালী গন্ধ, যা আমাকে অবশ করে দেয়। আর ও আমার সেই অবশ শরীর টা নিয়ে খেলে।

কখন যে ওর হাতের চাপে আমি স্ল্যাবের উপরে ঝুঁকে গেছি জানি না। শুধু আমার ভিজে চুল টা পিঠ থেকে সরিয়ে ও পিঠে চুমু তে ভরিয়ে দিচ্ছে। ব্লাউজ টা কাঁধ থেকে টেনে নামিয়ে পিছন থেকে কাঁধে চুমু খাচ্ছে। আমার এই স্নান করা শরীর টা কে ভিজিয়ে দিচ্ছে থুতু তে। বুঝতে পারছি আমার শাড়ি টা পা থেকে আসতে আসতে উঠে আসছে পাছা টা উন্মুক্ত করে দিয়ে। বরের পুরুষাঙ্গ টা নির্ভুল ভাবে আমার ভিতরে প্রবেশ করল, অনায়াসে। আমি ভিজে ছিলাম মারাত্মক।

নিজের ইচ্ছে এমন ভাবে সত্যি হলে, কার না ভাল লাগে। মোমের মতন গলে গিয়ে তন্বি শরীর টা কে বেঁকিয়ে, স্ল্যাব টা ধরে ঝুঁকে গেলাম আমি। আমি লম্বা হলেও বর অনেক বেশী লম্বা। কাজেই যাতে ওকে হাটু মুড়তে না হয় সেই জন্য যত টা পারলাম নিজেকে স্ট্রেচ করে নিলাম ।পায়ের পাতার উপরে ভর দিয়ে যত টা সম্ভব তুলে ধরলাম পাছা টা। ও যেন ফুটছিল। আমার কোমরে গোঁজা শাড়ির আঁচল টা খুলে দিয়ে কোমর ধরে সঙ্গমে মনোনিবেশ করল। আমার পাছা, কোমর পিঠে অনবরত হাত বোলানো ব্যাপার টা , এই সঙ্গমের সময়ে আমি খুব পছন্দ করি। ওমনি বড় বড় থাবা দিয়ে পুরুষালী চটকানো, ওই সময়েই আমাকে জল খসাতে বাধ্য করল। আমি জানি এখন ও থামবে না। সেও পায় নি আমাকে গত পাঁচ ছয় দিন…………………

মুখে মুখ লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছি দুজনে। হাঁপাচ্ছি দুজনেই। শরীরে একটা ছটফটানি ছিল আমার। সেটা যেন কমল একটু। আমার ভিজে চুলের গোছা তখন বর ধরে রেখে দিয়েছে শক্ত করে। আমি ওর বগলের তলা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে ওকে জড়িয়ে আছি। বরের বীর্য আমার ভিতর থেকে বেড়িয়ে আসছে উরু দিয়ে, বরের ছোট হতে থাকা পুরুষাঙ্গ এর পাশ দিয়ে জায়গা বের করে নিয়ে। বড্ড ভাল লাগে আমার এটা। আজকে ওকে ভিতরে ফেলতে দিয়েছি, কারন পিরিয়ডের পরের দিনেই ভিতরের এগ তৈরি হয় না। আরে বাবা তার ও তো সময় লাগে সেজেগুজে বাইরে আসতে। প্রেগ্ন্যান্ট হবার ভয় না নেই বললেই চলে। চুমু খাওয়া বন্ধ করে ওর বুকে আমি মাথা রাখলাম। বহুক্ষন কথা নেই দুজনের। শুধু বড় বড় শ্বাস নেবার আওয়াজ পাচ্ছি দুজন দুজনের। কোন রকমে লজ্জার মাথা খেয়ে বললাম

– চুল টা ছাড়। চা চাপাই।
– উম্মম উম্মম্ম।

ওর আদর যেন শেষ হয় না। আমার চুল টা ছেড়ে দিল ও। খানিক বেশ করে চুমু খেয়ে উল্ট দিকে ফিরে রান্না ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল। বললাম চেঁচিয়ে

– শর্টস টা ওয়াশিং মেশিনে দেবে না। নোংরা করেছ ওটা কে। বাইরে রাখ আমি কেচে দেব।
– জানি জানি ,বলতে হবে না আমাকে।

আমি অন্য বাথরুমের দিকে দৌড়লাম। নিজেকেও পরিষ্কার হতে হবে। আমার বরের বীর্য গড়িয়ে পড়ছে, আমার যৌনাঙ্গ থেকে উরু তে, সেখান থেকে পায়ের গোছে। পায়ের পাতায় চলে আসার আগেই আমাকে পৌঁছতে হবে বাথরুম এ।

রিঙ্কুদি আসার পরে আমি বের হলাম। তার আগে মেয়ে কে খাইয়ে দিয়েছিলাম। আর ছেলেকে মেয়ে খাইয়ে দিয়েছিল। ছেলে মেয়ে দুজনাই, বাইরে এল আমাকে সি অফ করতে। এস পি র বাংলো। সব সময়েই পুলিশে ভর্তি থাকে। আজকে বর নেই তাও গার্ডে থাকে আর্মড পুলিশ বেশ কিছু। ওদের যিনি আজকে অফিসার ওনাকে বলে দিলাম, লনে খেলার সময়ে যেন ছেলে মেয়ের দিকে খেয়াল রাখে। গাড়ীতে উঠে বসলাম। ঘন্টা খানেক সময় লাগবে পৌঁছতে। পুজোর সময়। রাস্তায় ভিড় ভাট্টা অবশ্যম্ভাবী। হারিয়ে গেলাম আবার অতীতে।

মার খাবার ঘটনা অনেক ছিল আমার। বেশির ভাগ ই ছিল ছেলেদের প্যাঁদানো সংক্রান্ত ব্যাপার স্যাপার। কিন্তু সে গুল তে, কম সম মার খেতাম। একটা কঞ্চি পাকিয়ে তোলা থাকত উঠোনের শেড এর উপরে। এই সব ক্ষেত্রে কম মার পড়ত। প্যান্টের উপর দিয়ে দু ঘা কঞ্চির বাড়ি খেতাম, বা পিঠে হালকা ফুলকা চপেটাঘাত। সয়ে গেছিল আমার। কিন্তু বড় মার দুটোই পরে ছিল আমার। দিদির কেস টার আগেও একবার মার খেয়েছিলাম আমি। সত্যি বলতে বলি, সেই মার খাওয়া গুলো এখন আর আমাকে কাঁদায় না। বরং মার খাবার কারন টা এতো টাই ভাল ছিল আমার কাছে যে ওইটা ভেবেই আনন্দে ভরে যায় মন।

এই ঘটনা টা অর্জুন কে কোলে নেবার ঘটনার বছর দেড়েক পরের ঘটনা। আর ঘটনা টাও অর্জুন কে নিয়েই। গরম কাল। নিশ্চুপ দুপুর। যেমন গ্রামের দুপুর হয়। চুপচাপ। ছুটির দিন ছিল। আমি তো কোনকালেই দুপুরে ঘুমুতাম না। আমার ছোড়দি অব্দি মা হিসাব রাখত। দুপুরে কটা মেয়ে ঘুমালো। আমার আর চাঁদের হিসেব কেউ রাখতে পারত না আর। এখন ভাবলে হাসি পায়। বড়দি মেজদির বিয়ে হয়ে গেছিল তখন। ওরা দুপুরে ঘুমাতো না। আমার মা কাকি আর পাশের বাড়ির কিছু কাকি জেঠী মিলে তাশ খেলত দুপুরে।

আমাদের দুপুরে খেতে আর বাসন টাসন পুকুরে দিয়ে আসতে দুটো বাজত। আর সাড়ে তিনটে তে বাবা উঠে চা খেত। মা ওই সময় টা ঘুমাতো না। আর কাকি ছিল মায়ের ছায়া সঙ্গী। কাকিও ঘুমাতো না। দিদিদের বিয়ে হয়ে গেছিল, তাই ওরা ও মা কাকিদের দলে ভিড়ে গেছিল। তাই তাশ খেলা চলত। টুয়েন্টি নাইন খেলত ওরা। ডাক চলত। চব্বিশ পঁচিশ। আর আমি বাড়ির পিছনে চলে যেতাম চুপি চুপি। এতোই মত্ত থাকত ওরা ডাক তুলতে যে আমাকে কেউ খেয়াল করত না। বাগানে পেয়ারা গাছ ছিল কিছু। উঠে চড়ে বসে থাকতাম।
আর সাথে থাকত চাঁদ। ও বরাবর ই ভীতু আর সুখী মেয়ে। আমার ভরসায় বেড়িয়ে আসত। জানত জেঠু বকলে নান্দু কে বকবে। আমি পেয়ারা পেড়ে আনতাম । ও নুন লঙ্কা মাখাতো, দুপুরে গাছের ছায়ায় বসে খেতাম। মাঝে মাঝে ও আসত ও না। খেলা সাথী খেলত। আমার সেটা পছন্দের ছিল না। আমি অপেক্ষা করতাম, কখন রোদ টা কমবে আর আমি খেলতে যাব।

সেদিনে চাঁদ আসে নি আমার সাথে। এক সাথে তো বেরোতাম না। আমি আসলে ও চুপি চুপি বেরোত ফাঁক ফোকর দিয়ে। চারদিক মারাত্মক চুপ। পুকুরের ওই পাড় থেকে একটা হাঁসা ডেকে উঠল। গ্রামের মেয়ে হাঁসা হাঁসির ডাক বুঝতেই পারতাম। বাড়ির মেয়েরা কলরব করে এই সময়ে। সেটাও নেই। মা দের খেলা থেকেও আওয়াজ আসছে না। গাছের উপরে উঠে পেয়ারা খুঁজছি। কাছা কাছি নেই কোন পেয়ারা। কত থাকবে? রোজ পাড়লে কি পেয়ারা গাছে থাকে অতো। শুধু মগ ডালের গুল থাকবে। সেখানে উঠতে পারতাম না। ভেঙ্গে যেতে পারে ডাল। পেয়ারা না পেয়ে এই গাছ সেই গাছ করছি।

সেই সময়ে দেখলাম, অর্জুন খালি গায়ে ল্যাঙট পুনু হয়ে বেড়িয়ে এসেছে এক পা এক পা করে। এই রে, ও কি করে বেড়িয়ে এলো? কেউ কি দেখে নি। আমি গাছ থেকে নেমে পড়েছি ততক্ষনে। পকেটে খান চারেক অল্প ডাঁশা পেয়ারা। আমাদের বাড়ির ই একটা হাঁস, সামনেই ছিল। সেটা কে দেখে ও এক গাল হেসে ধরতে গেল। আমি পেয়ারা গুল পকেট থেকে ফেলে দৌড়তে শুরু করেছিলাম তখন ই। মনে মধ্যে কু গাইছিল আমার কোন কারনে। কারন আমাদের পুকুরের পাড় টা বেশ উঁচু। গরম কাল জল অনেক টা কমে , নীচে নেমে গেছে। হাঁস টা ভয় পেয়ে পুকুরের দিকে নেমে যেতেই অর্জুন ও পুকুরের ধারে চলে এল। আমার তখন ও কিছু টা বাকি পৌঁছোতে। পুকুরের ধারে এসে ও হাঁস টাকে ধরবে বলে হাত বাড়াতেই টাল সামলাতে না পেরে, গড়িয়ে গেল পুকুরের দিকে। গড়িয়ে সোজা জলে। আমার আর কিছু ভাবার সময় ছিল না। দৌড়ে এসেই আমিও ঝাঁপালাম। কিন্তু অর্জুন গড়িয়ে যাবার জন্য একটু দূরে চলে গেছিল। আমার পা ততদুর পৌঁছচ্ছে না। আমি ওর কোমরের কার টা হাতে পেয়ে টানতে শুরু করলাম। অর্জুন কে সামনে নিয়ে এলেও আমি তখন চলে গেছি কিছু টা দূরে, যেখানে আমি আর পা পাচ্ছিলাম না নিচে।

ততক্ষনে দেখলাম ছোড়দি কোথা থেকে এসে জলে নেমে অর্জুন কে তুলে নিয়েছে। আর আমি চলে যাচ্ছি দূরে। দিদি খুব চেঁচাচ্ছিল। ভাগ্যিস কাকা, কোথা থেকে দৌড়ে এসে ঝাঁপাল জলে। টেনে আমাকে তুলল, না হলে সেদিনেই শেষ হয়ে যেত এই কাহিনী।

আমার মা ভয়ে আমার কি হয়েছে দেখতে না পারলেও অর্জুন কে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল বেশী। সেটা হয়ত বড়দি কে খুশী করার জন্যেই। আমি তখনো ভিজে কাপড় গুলো ছাড়িনি। বাবা নেমে এলো। বড়দি মেজদির নজর যেন জ্বালিয়ে দেবে আমাকে। বাবাও তার থেকে কম কিছু ছিল না। বড়দি কাঁদছে অর্জুন কে জড়িয়ে ধরে আর গুঙ্গিয়ে চলেছে।
– জানিনা যেন, শয়তানী আমার ছেলে কে ডুবিয়ে মারতে গেছিল। রাক্ষুসী এসেছে আমাদের বাড়িতে। দেখ বাবা দেখ। আর আমি কোনদিন ও আসব না এ বাড়িতে। আমার ছেলেকে ওই রাক্ষসী কোন দিন খেয়ে নেবে……

সপাং সপাং করে পরছিল কঞ্চির বাড়ি আমার পায়ের গোছে, হাতে। খেয়াল ছিল না আমার। আর ছিল বাবার, আর দিদিদের অজস্র প্রশ্নের ঝুলি। হয়ত বাবার ও বিশ্বাস হয় নি যে আমি ডুবিয়ে মারতে পারি বলে। কিন্তু বড়, আর মেজ মেয়ে বলছে মানে সত্যতা থাকতেই পারে। তাই প্রশ্ন করে বাবা দিদিদের সত্যতা যাচাই করে নিচ্ছিল।

– তুই বাইরে কি করছিলি? – আমি চুপ। বললে সবাই জেনে যাবে আমি দুপুরে ঘুমোই না । রোজ ই বাগানে থাকি। বলে দিলে আমার বাগানে যাওয়া বন্ধ করে দেবে। তাই চুপ রইলাম।

– অর্জুন কে, কে বাইরে নিয়ে গেল, ও তো ঘুমচ্ছিল। – আমি তখন তাকিয়েছিলাম বড়দির দিকে। তাশ খেলায় এতোই মত্ত ছিল যে দেখতেই পায় নি, ছেলে কখন বাড়ির বাইরে বেড়িয়ে গেছে। এটা বলা কি ঠিক হবে? এখানেও চুপ রইলাম

উত্তর না পেয়ে তখন ধরেই নিয়েছে বাবা, আমি মারতে গেছিলাম। তারপরের প্রশ্নে আমার মোটিভ জানার চেস্টা
– ওকে মেরে তোর কি হতো?

প্রশ্ন আসছিল আর সপাং সপাং করে শব্দ। এর তো উত্তর নেই আমার কাছে সত্যি করেই। তাই আবার চুপ রইলাম। বাবা ধরে নিল, বাবা যেটা ভেবে নিয়েছে সেটাই আমার মোটিভ। যে আমি হয়ত বড়দির উপরে রাগে হিংসা তে আমার বুনপো কে মেরে ফেলতে চেয়েছিলাম। আমাকে আমার মা কোন শিক্ষা দিচ্ছে না। বাজে ছেলেদের সাথে মিশছি, এই সব বলে বাবা, বাবার রাগ মেটাল।

ছোড়দি কে কিছু বলার সুযোগ ও দেওয়া হলো না। না সুযোগ দেওয়া হলো আমাকে। কঞ্চির ঘা গুলো আমাকে যেন কোন ব্যাথাই দিচ্ছিল না। যত টা ব্যাথা দিচ্ছিল বড়দির কথা গুলো। কাকা এসে বাবা কে থামাতে বাবা কঞ্চি টা ফেলে দুম দুম করে পা ফেলে চলে গেল। যাবার আগে জানিনা কত গুল ঘা পড়েছিল আমার গায়ে। বাবা চলে যেতেই, ছোড়দি আমাকে এসে ধরতেই, আমি ছোড়দি কে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে, নিজের ঘরে গিয়ে ভিজে কাপড় বদলে খেলতে চলে গেছিলাম। খুব খেলেছিলাম সেদিনে আমি। কঞ্চির ঘা গুলো যত চিড়চিড় করছিল, তত বড়দির কথাগুলো বুকে বারি মারছিল আমার আর তত আমি দৌড়চ্ছিলাম।

বাড়ি এসে পড়তে বসেছিলাম ছোড়দির কাছে। মা লুকিয়ে দুটি মুড়ি দিয়ে গেছিল আমাকে। আজকে আমার খাবার বন্ধ, এমন ই হুইপ জারি হয়েছিল সেদিনে বাড়িতে। আমি মুড়ি খাই নি। রেখে দিয়েছিলাম। খেতে ইচ্ছেই করছিল মা এলো কিছু পরে। ছোড়দি মায়ের সামনেই, কাঁদতে কাঁদতে পুরো ঘটনা বলতেই, মা আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। কাঁদছিল অনবরত। আমি কি করব। মায়ের কান্না আমার মাথায় ঢুকছিল না যে। মনের মধ্যে ভেসে বেড়াচ্ছিল,
– আমার ছেলেকে ও খেয়ে নেবে। আমি জানি আমার ছেলেকে ও ডুবিয়ে মারতে গেছিল।
—————————

সাত

মাধমিকের রেজাল্ট মারাত্মক হয়েছিল আমার। পুরো জেলা তে প্রথম তো বটেই। স্কুল এ ছোড়দির নাম্বার কেও পিছনে ফেলে দিল আমার প্রাপ্ত নাম্বার। যদিও দিদির সময়ের নাম্বার আর আমার সময়ের নাম্বার অনেক ফারাক। দিদিদের সময়ে প্রশ্ন ও খুব কঠিন হয়েছিল। আমাদের সময়ে ঠিক ঠাক হয়েছিল। আমি বাইরে গেলাম না। গ্রামেই পরলাম উচ্চমাধ্যমিক। এগারো ক্লাসে চুটিয়ে পড়াশোনা আর খেলা ধুলা দুটোই করেছিলাম আমি।

এই সময়েই লম্বা হলাম মারাত্মক রকম ভাবে। বুক ভারী হয়ে গেলো আমার। যা যা পছন্দ করতাম না, সেই গুলো হলো আমার। সব সময়ে স্পোর্টস ব্রা পরে থাকতাম, শুধু মাত্র শরীর থেকে মেয়েলি ভাব টা সরিয়ে ফেলার জন্য। নেড়া হবার থেকে শুধু একটু বড় আমি চুল করে নিয়েছিলাম। শুধু একটা কালো ভাব ছিল মাথার মধ্যে আমার। কিন্তু রূপ তো আটকে থাকার না। যতই আমি এই সব করতে লাগলাম, ততই লোকে আমার উচ্চতা, আলো পিছলে যায় এমন মিস্টি গায়ের রঙ, বড় বড় চোখ, নাক মুখের প্রশংসা করতে শুরু করল। তারপরে আবার চশমা ছিল চোখে। লোকে বলত, রূপ আর গুনের এমন অদ্ভুত কম্বিনেশন সচরাচর হয় না।

মাধমিকে দুর্দান্ত রেজাল্ট এর পরে, যত ছেলে ছিল , সবাই আমাকে খুব সম্মান দিতে থাকল। যাদের সাথে মারপিট করতাম, তারা যেচে এসে আমার থেকে সব কিছু পড়াশোনা বুঝে যেত। আমার আর দিদির এমন রেজাল্ট এর পরে গ্রামের ছেলেরা পড়াশোনার দিকে নজর দিল। খেলে দুলে গরু চড়িয়ে, দুষ্টুমি না করে, লেখাপড়া র দিকে সবাই ঘুরল। শুধু আমার বাড়িতেই কোন কদর রইল না। আমার বাবা কোনদিন জিজ্ঞাসা করল না কেমন রেজাল্ট হয়েছে। আমার দিদিরা এসে গর্ব বোধ করল না। আমি যদিও আশা করিনি সেটা। কিন্তু আমার মা কাকিমা তো পারলে গোটা গ্রামের লোক খাইয়ে দেয় আনন্দে। আমার কাকা আমাকে নিজের আল্মারির চাবি ই দিয়ে দিয়েছিল। যখন যেটা লাগবে সেটা নিয়ে নেবার জন্য। হ্যাঁ জীবনের শুরু তে যেটা আমি পাই নি সেটা আমি আসতে আসতে পেতে শুরু করেছিলাম। জীবন টা তখন থেকেই পালটাচ্ছিল আমার। ঠিক করে নিলাম, উচ্চমাধ্যমিকের পরে আমি এখানে আর থাকব না। কলকাতায় যাব পড়াশোনার জন্য।

উচ্চমাধ্যমিকে অনেক নাম্বার পেলাম বটে, কিন্তু দিদিকে টপকাতে পারলাম না। যদিও আমাদের স্কুলের ইতিহাসে সেটা বিশাল নাম্বার। আমি বেঙ্গল জয়েন্ট, আই আই টি সবে তেই র‍্যাঙ্ক করে ফেললাম। মেডিকেল এও একশোর নীচে র‍্যাঙ্ক করলাম। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং বা মেডিক্যাল কোন টাই আমার পড়ার ইচ্ছে ছিল না। আমি কাউকে কিছু না বলে কলকাতার সব থেকে পুরোন ঐতিহ্যময় আর সব থেকে ভাল কলেজে এডমিশন নিলাম। আমার স্বপ্ন ছিল ওখানে পড়ার। আমার বাবার তো কম কিছু নেই। আমি চাই পড়তে আর জীবন এ সেটাই করতে যেটা মন চায়। এর বেশী কিছু আমি করব না। হ্যাঁ যদি সায়েন্টিস্ট হতে ইচ্ছে করে তো হব না হলে জানিনা। দেখি কি করা যায়।

আমাদের গ্রাম থেকে কলকাতা যাতায়াত করে পড়াশোনা সম্ভব না। কাকা তাই রাতারাতি আমার নামে একটা এক্যাউন্ট বানিয়ে, যথেষ্ট টাকা পয়সা সেখানে দিয়ে দিল। আমি কলকাতা শিফট করলাম। এক নতুন জীবনে পা দিলাম আমি। ছুটি ছাটায় যেতাম বাড়ি। থাকতাম কিছু দিন। বদলায় নি কিছুই। এখন দিদি রা নেই। তাই একটু বেশী আদর এই আরকি। এর মাঝে একটা ঘটনা ঘটল। আমি বাড়ি গেছিলাম পুজোর সময়ে। ততদিনে বাবা আমাদের বাড়িতে দূর্গাপুজো শুরু করেছিল। ঠিক ই আছে। মা যখন বলল আমাকে বাড়ি পৌঁছনর পরে, যে বাবা দূর্গাপুজো করছে ,আমার আনন্দই হয়েছিল। আমি জানতাম না আমি ছাড়া কেউ ছোড়দি কে নিয়ে ভাবে এই বাড়িতে। আমার ঘরে এসে মা খানিক কেঁদে নিল ছোড়দি কে ভেবে। আমার ও মন টা ততধিক খারাপ হয়ে গেল। সত্যি আজকে আমি ছোড়দি কে মিস করছি ভয়ঙ্কর রকম ভাবে।

আমার যখন ফাইনাল ইয়ার তখন দ্বিতীয়বার পুজো হচ্ছে বাড়িতে। আমার দাদু মারা গেছেন ততদিনে। আমি ভেবে ছিলাম যাব না। এবারে রেজাল্ট টা ইম্পর্ট্যান্ট। যদিও গত দু বছর আমার রেজাল্ট মাত্রাতিরিক্ত ভাল। তবুও রিস্ক নেওয়া ঠিক না। হস্টেলে থাকলে, পড়াশোনা আর শরীর চর্চা দুটোই খুব ভাল হয়। বাড়িতে গেলে হয় না। কিন্তু মা কাকিমা দুজনাই বার বার করে সেদিনে ফোন করে আমাকে বলল। আর ওই দুজনের কথা আমি ফেলতে পারি না।

তইতই করে বড় হয়ে গেলাম আমি। যেমনি লম্বা, তেমনি তন্বী তেমনি সুন্দরী। আমার মা কাকিমা এর কথা নয় এগুলো। ওদের মেয়ে আমি, এমনিতেই ওরা আমার উপরে দুর্বল, কাজেই ওদের কথা আমি ধরতাম না। কিন্তু কথা গুলো বলত আশে পাশের লোক জন। আমি যদি একটু মেয়েদের মতন সাজগোজ করতাম, তবে হয়ত ছেলেরা পাগল হয়ে যেত। নেহাত অতি কাঠখোট্টা ভাবে থাকতাম তাই ওই সবের ব্যাপার থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছিলাম। আর ব্যাপার টা পছন্দ ও করতাম না। নেড়া মাথা, জিন্স শার্ট পরা, হুজ্জুতি করা মেয়েদের সাথে কোন ছেলে ভিড়তে চাইবে?

গতবারে আমার দুই রাক্ষসী দিদি আসে নি। এবারে সবাই সপরিবারে এসে হাজির। সে তো আসবেই। না না ওরা আসুক। জন্ম জন্ম আসুক। ততদিনে আমার মধ্যে একটা মারাত্মক এটিটিউড চলে এসেছে। বাড়িতেই জিন্স পড়ি। কারোর অতো তোয়াক্কা করি না। আমার কাকি আর কাকার তাতে প্রছন্ন মদত আছে।

ততদিনে ইন্দু দি আর চাঁদের ও বিয়ে হয়ে গেছে। বাড়িতে গেলে ওদের ছেলে মেয়েদের নিয়েই আমার সময় কাটে। পড়াশোনার সময় টুকু বাদ দিলে ওদের সাথেই থাকছি আমি। আমি আর বাড়িতে এতো টাও অছ্যুত নই। শুধু আমার ভাই টা আর অর্জুন বেশ বড় হয়ে গেছে। ওরা ওদের মতন থাকে। আমি যদিও বাড়িতে সবাই কে দেখতে পাচ্ছি, শুধু অর্জুন কে পাচ্ছি না দেখতে। মা কে জিজ্ঞাসা করতে বলল, সীমানাপুরে গেছে বাইক নিয়ে, ওর পিসির মেয়ে আর ছেলে আসছে, ওদের কে আনতে।

– বাবাহ সে এতো বড় হয়ে গেলো যে বাইক চালাতে শিখে গেছে?
– হ্যাঁ, সে এখন তোর থেকেও লম্বা। কত দিন দেখিস নি বলতো তুই?
– বলো কি?

আমি যখন সন্ধ্যে বেলায় বাচ্চাদের নিয়ে খেলছিলাম, তখন দেখলাম অর্জুন আর তার পিসির ছেলে মেয়ে এলো বাড়িতে। আমার দিকে তাকিয়ে চলে গেল। আমি ভাবলাম কি হলো কে জানে। হয়ত যত বড় হচ্ছে তত ওর পরিবারের মতন হচ্ছে। জীবনে কখনো আমি কিছু আশা রাখি না। সম্পর্কের দিক থেকে তো নয় ই। ছোড়দি ছাড়া আর ললিত দা ছাড়া কারোর কাছেই কোন আশা আমি রাখি নি। রাখবো ও না।

কিন্তু অর্জুন দেখলো অথচ কথা বলল না এটা আমাকে একটু চুপ করিয়ে দিল। যাক ভালই হয়েছে। হয়ত ওর মা বলেছে কথা না বলতে। আমি আর ভাবলাম না কিছু। কিন্তু ব্যাপার টা আমার জন্য ভাল হলো না। আমি সব ছেড়ে নিজের ঘরে চলে গেলাম। দরজা বন্ধ করে পড়তে বসলাম। পরা তে মন বসল না। কি হলো ছেলেটার। ও তো ওর বাবা মায়ের মতন না। কত মার খেয়েছে মায়ের কাছে, শুধু আমার কাছে আসত বলে। আজকে কি হলো? নাহ আমি হয়ত একটু বেশী আশা করে ফেলেছিলাম। আর আশা করব না। নিজেকে একেবারে গুটিয়ে নেব। এতো দিন ও ছোট ছিল আমি নিজেই যেতাম। এটাও সত্যি ও নিজে থেকে তো কোন দিন কথা বলতে আসে নি। তাও ভেবেছিলাম, এতো দিন বাদে দেখা হলো একটু তো হাসবেও। যাক আর ভাবব না।

রাতে খাওয়া দাওয়ার সময়েও কথা বলল না আমার সাথে। আমি পরিবেশন করে দিয়েছিলাম। ও ছিল না। একটু পরে দেখলাম কোথা থেকে এসে পরিবেশন শুরু করল আমার সাথে। আমার ভাই ও এল। তিন জনে মিলে প্রায় জনা চল্লিশ লোক কে খাইয়ে দিলাম। অর্জুনের পিসির মেয়ে দেখলাম আমাকে চেনে। আর চেনে টপার বলেই। আমাদের কলেজে কোন সেমিনারে এসে আমাকে দেখেছে নাকি। আমার প্রায় নেড়া মাথা দেখে ও আমাকে চিনতে পেরেছে। ভাল।

আমার অভ্যেস ভোর বেলায় উঠে পরা। আমি পরের দিন সকালে ভোর বেলায় উঠে দৌড়তে যাব। ভোর বেলায় উঠে পড়েছি। দেখলাম মা আর কাকি ও উঠে পড়েছে। ওরা উপোস থাকবে আজকে। আমার ওসব পোষায় না। আমি নিজের হরলিক্স বানিয়ে খেতে যাব দেখলাম, অর্জুন বাবু একেবারে ফ্রেশ হয়ে, একটা ট্রাউজার পরে, পায়ে রানিং শু লাগিয়ে দোলনায় দুলছেন। আমি আমার হাতের হরলিক্স টা ওর দিকে বাড়িয়ে দিতেই, এক গাল হেসে নিয়ে নিলো। হাসি টা তেমন ই মিস্টি আছে।

ও কথা বলছে না বলে যে কস্ট টা পাচ্ছিলাম সেটা মাথায় আর রইলই না। আমি রান্না ঘরে এসে নিজের জন্য আরেক গ্লাস বানিয়ে , খেয়ে, ওকে নিয়ে বেরোলাম। দুজনে মিলে দৌড় শুরু করলাম বাড়ি থেকে। মেন রোড ধরে প্রায় চার কিমি দৌড়ে, একেবারে ধান জমির কাছে যে বর্ডার আছে, সেইখানে পৌঁছে গেলাম। রাস্তার ধারে একটা গাছে নিচে দাঁড়িয়ে, ওয়ার্ক আউট করতে লাগলাম দুজনে। ওকে জিজ্ঞাসা করলে বলবে কথা না হলে বলবে না।

– কত লম্বা হয়ে গেছিস তুই?
– হুম এখন নিয়মিত খেলছি, স্কুল টিম এ
– কি খেলিস?
– ফুটবল
– ভালো করিস। পড়াশোনা তে কিন্তু কোন ছুট দিবি না।
– নাহ দি না
– গুড বয়।

বলে গাল টিপে দিলাম আমি। কি লাল লাল গাল হয়েছে। একেবারে আদর করার মতন। ওর জন্য ওর ক্লাস রুমের মেয়ে গুলো মনে হয় পাগল। হাসি পেল ভেবেই। এই একটা পুঁচকে ছেলে ছিল। কোল থেকে নামিয়ে দিলেই কাঁদত। আর আজকে বাইক নিয়ে যাচ্ছে দিদি কে আনতে। ওয়ার্ক আউট করছে। আমার থেকে প্রায় অনেক টা লম্বা হয়ে গেছে।

এটা রুটিন হয়ে গেল। পর পর তিন দিন আমরা সকালে উঠে দৌড়তে গেলাম। অস্টমীর দিন সকালে আমাকে নিয়ে আরো অনেক টা গেল। আরেক একটু করতে করতে পৌঁছে গেলাম প্রায় সীমানাপুরের অর্ধেক রাস্তা। পৌছতে দেরী হবে বলে ওকে নিয়ে ফিরে এলাম আমি।

ঘটনা টা ঘটল সেদিনেই। গ্রামের একটা মেয়ে পুকুরে পরে মরতে বসেছিল। আমি পুজোর আচার অনুষ্ঠান ভাল লাগে না বলে, পিছনে পুকুরের ধারে হাঁটছিলাম। ওখানে আম গাছের বাগান আছে। কোন একটা গাছের নীচে বসে একটা বই পড়ব । সেই সময়ে জলে খলবল করে আওয়াজ পেয়ে দেখি, হীরেন কাকার মেয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। দূর থেকে বোঝা যাচ্ছিল না । কিন্তু ওই রঙের ফ্রক পরে আমি হীরেন কাকার মেয়েকে দেখেছি সকালে ফুল তুলতে। আমি দৌড়ে ওই পারে গিয়ে কাউকে ডাকব কিনা ভাবছি সেই সময়ে দেখলাম আরেক জন জলে ঝাঁপ দিল। আমি জামা কাপড় দেখে বুঝতে পারলাম আমাদের অর্জুন।

সর্বনাশ! ও কেন ঝাঁপ দিল? আর যে সময় নেই। আমিও সাত পাঁচ না ভেবে ঝাঁপ দিলাম জলে। আমি সাঁতার জানি না মোটে। আমি লম্বা ছিলাম, তাই পা পাচ্ছি। ওই ভাবেই এগোচ্ছিলাম আমি। কিন্তু ওকে দেখলাম ও এক্সপার্ট। তীব্র বেগে সাঁতার কেটে মেয়েটির দিকে যাচ্ছে। বুঝলাম সে সাঁতার শেখে। বেশ পোক্ত সাঁতারু। একা জলে ডুবন্ত কাউকে বাঁচানো সোজা না। আমি ও গেলাম। দেখলাম অর্জুন ওকে একলা নিয়ে আসতে পারছে না। সে তো পূর্ণ পুরুষ নয় যে পারবে। বা আমার তূল্য শক্তি ও ধরে না। আমি আর ও দুজনে মিলে তাকে জল থেকে তুললাম। মেয়েটি ছোট তাই জলের তল পায় নি। কিন্তু আমাদের পায়ের নীচে তল আমরা পেয়েছিলাম। তল না পেলে অর্জুন কে আজকে আমাকেও বাঁচাতে হতো। বা আজকে আমার সলিল সমাধি ই হত।

জল থেকে তুলে দেখি মেয়েটি ঠিক আছে। জল খায় নি তেমন। শুধু ভয় পেয়ে গেছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই আবার চনমনে হয়ে গেলো মেয়েটা। ওকে চিনি, ক্লাস এইট এ পরে। দেখতে বেশ সুন্দর। ও বলল পশ্চিম দিকে পুকুরের ধারে একটা জবা গাছ থেকে ফুল তুলতে গিয়ে পরে গেছিল। ওদিক টা বেশ খাল। আর ও প্রথম না। ওই দিকে জলের ধারে কিছু তো একটা আছে। অনেকেই টাল সামলাতে না পেরে জলে পড়েছে। একটি মেয়ে মারাও গেছিল। আমরা যাই না সাধারনত। ও এখানেই থাকে কেন যে জানে না কে জানে? ওকে বলে দিলাম এদিকে আর না আসতে। একলা তো নয় ই। মেয়েটি বলল একলা যেতে পারবে। ওকে ছেড়ে দিলাম আমি। বাড়ি ফিরে এসে নিজের ড্রেস বদলে নিলাম। স্নান তো হয়েই গেল। অর্জুন কে দেখলাম না বাড়িতে।

বিকালে আমি পুজো মন্ডপ থেকে বাড়ি ফিরলাম, সব কটা কচিকাঁচা দের নিয়ে। ওদের নিয়ে সময় কাটাতে মন্দ লাগে না। ওদের মায়েরা সব সাজ গোজে ব্যস্ত। থাক আমার কাছে। আমিও যে বাচ্চাদের পছন্দ করি, এই ব্যাপার টা আমার কাছে এই বারে পরিষ্কার হলো। এসেই দেখি উঠোনে বিচার সভার মতন চলছে। আমি নেই, আর বিচার সভা? দেখলাম অর্জুন চুপ করে মাঝ খানে দাঁড়িয়ে আছে। আর ওর মা হম্বি তম্বি করছে, ওর সামনে, হাত পা নেড়ে কথা বলছে। কি হয়েছে কাকি কে জিজ্ঞাসা করতেই কাকি বলল, অর্জুন নাকি কোন মেয়ের সাথে সকালের দিকে পুকুরে স্নান করছিল। ওর মা রেগে গেছে। ছেলেকে শাসন চলছে সেই জন্য। অর্জুন তো মার খাবে তবু কিছু বলবে না কাউকে। জানিনা আমাদের ছাড়া ও বাইরে কেমন বিহেভ করে। কিন্তু বাড়িতে ওকে মারধোর করলেও একটা কথা ও বলবে না। ওর সাথে আমি নিজেকে রিলেট করতে পারি। ওর মগজের সাথে আমার মগজের মনে হয় কোন যোগ সাজশ আছে। অর্জুন যথারীতি চুপ করে আছে। মাথাটা ভয়ঙ্কর গরম হয়ে গেল আমার।

আমি কাকি কে জিজ্ঞাসা করলাম

– অর্জুন কোন মেয়ের সাথে স্নান করছিল একথা কে বলেছে?
– কে আবার তোমার মেজদি?
– হুম, এই মেয়ে টা বদলাবে না। কে না কে কি বলল, আর ছেলেকে শাসন করছে ওই ভাবে?

আমি এগিয়ে গেলাম। জানিনা কেন, তীব্র রাগ হচ্ছিল আমার। ওর মা ওকে যাতা বলছে। ওর মায়ের তখন রাগের শেষ মুহুর্ত। যে কোন মুহুর্তে গায়ে হাত তুলে দেবে।

– লজ্জা করে না তোর? কি ছেলে পেটে ধরলাম আমি? তুই এই বয়সে, মেয়েদের সাথে পুকুরে স্নান করছিস। নির্লজ্জ। তোকে আমি মেরে ফেলব।

হাত তুলে ওর মা অর্জুন কে মারতে যেতেই আমি হাত ধরে ফেললাম। কোন কথাই বললাম না। শুধু হাত টা ধরে রইলাম। ইচ্ছে তো করছিল মুচড়ে দি। কিন্তু পারলাম না। বড়দি তো বাক্যহারা হয়ে গেল একেবারে। আমার এই রকম সাহস ও তো কল্পনা ও করতে পারে নি। বাড়ির লোক যারা এদিক ওদিক ছিল ওরাও জড়ো হয়ে গেল সামনে। এদিক ওদিক তাকিয়ে জোর করে হাত টা ছাড়ানোর চেস্টা করতেই আমি ছেড়ে দিলাম। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আমাকে সপাটে আক্রমন করে বসল

– তোর স্পর্ধা কি করে হয়? সেদিনের মার ভুলে গেছিস তুই। বাবা কে বলে আবার ওই রকম মার খাওয়াবো বলে দিলাম। আমার ছেলেকে আমি শাসন করছি তুই বলার কে? শয়তান রাক্ষুসী। আমার ছেলেও তোর মতন নষ্ট হবে নাকি? সরে যা বলে দিলাম তোকে শেষ বারের মতন।

বলতে তো ওকে অনেক কিছু ইচ্ছে করছিল। তার থেকেও বেশী ইচ্ছে করছিল, সপাটে থাবড়ে দাঁত কপাটি ফেলে দিতে। কিন্তু ওসবের ধার দিয়েও গেলাম না শুধু অর্জুনের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি। বললাম

– শুধু একবার গায়ে হাত তুলে দেখ তুই ওর।

এবারে বড়দি না, মেজদি বলে উঠল
– দিদি তুই শুনিস না। তুই শাসন কর ছেলেকে। এই বয়সে মেয়ে নিয়ে সাঁতার কাটবে কি? ছেলেকে শাসন করতে হবে না? উহ সবাই যেন ওনার মতন হবে?

শেষ কথা টা আমাকে উদ্দ্যেশ্য করে বলা । আমি বড়দি কে কিছু না বলে, মেজদি কে আক্রমন করে বসলাম

– এই যে ডানাকাটা পরী? ভগবান মন টা কে তোর একটু সুন্দর করে নি কেন রে? তুই বড়দি কে ওসকাচ্ছিস? অর্জুন তোর কেউ না? কেমন মেয়ে তুই? তুই আসিস্ কেন বলত আমাদের বাড়িতে। যতবার তুই আসিস, কিছু না কিছু গন্ডোগোল হয়। খবর্দার, কাউকে ওস্কাবি না বলে দিলাম। আর একটা কথা বললে আমাদের মাঝে, এক থাবড়া তে সব গুলো দাঁত ফেলে দেব এখনি। তারপরে বাবা যা করার করবে আমাকে।পরোয়া করি না আমি কিছুর।একদম চুপ করে থাকবি। শয়তান মেয়ে কোথাকার!!!

আমার মা কাকিমা একেবারে থ হয়ে গেছে। আমার এই রূপ কেউ কোন দিন ও দেখে নি। জানিনা কীসের ভয়ে, মেজদি হাউ হাউ করে কেঁদে উঠে চলে গেলো সেখান থেকে। যাক । বাবা মারলে বকলে, আর কিছু যায় আসে না আমার। আমি বড়দি কে বললাম

– তোকে কে কি বলল, আর তুই আমার ছেলে টা কে মারতে শুরু করলি? আমি ছিলাম সেখানে। ও একা ঝাঁপ দেয় নি জলে, আমিও দিয়েছিলাম। ওই মেয়েটা ডুবে যাচ্ছিল। ও তাকে বাঁচানোর জন্য ঝাঁপিয়েছিল। তোর ওকে বকা দরকার। কিন্তু যে জন্য বকছিস সেটার জন্য না। মানুষ করেছিস নিজের ছেলেকে, এই টুকু বিশ্বাস নেই যে ও এই সব কাজ করতে পারে না? তুই ওকে বক। তুই না বকলেও ওকে আমি বকতাম। কিন্তু এটার জন্য বকিস না যেটার জন্য তুই বকছিস। আমার তো ভেবে লজ্জা লাগছে তুই কেমন মা??

আমার কথায় বড়দি স্তম্ভিত হয়ে গেল একেবারে। খুব অল্প বয়সে মা হয়েছে ও। ছেলে জন্মেছে, কি ভাবে মানুষ করতে হয় সেই জ্ঞান ই হয় নি ওর কোন দিন। ওর দোষ দি না আমি। কিন্তু নিজের ছেলের সম্পর্কে, একটা রাক্ষসী কি বলল, সেটা শুনে ছেলেকে উলটো পালটা বলা ঠিক নয় একদম। আমার চিন্তা অন্য জায়গায় ছিল। ও কেন ঝাপালো। বাড়িতে খবর দিতে পারত। ওর কিছু হয়ে গেলে আমরা কি করতাম?

আমি ঘুরে ওকে বললাম

– অর্জুন, তুই যেটা করেছিস, একদম ভালো করিসনি । কিন্তু তোর যদি কিছু হয়ে যেত আমরা কি করতাম। আমি শুধু তুই ঝাঁপিয়েছিস বলে ঝাঁপ দিলাম। আমি তো সাঁতার ও জানিনা। আমি তো বাড়িতে খবর দিতাম এসে ছুটে। ততক্ষনে তুই ঝাঁপিয়ে পরেছিলি। আমার আর ভাবার সময় ছিল না। তোর কিছু হয়ে গেলে তোর মা কি করত? আমরা কি করতাম? এই টুকু ভাববি না?

দিদি, আমার কথা টা শেষ ও হলো না, ছুটে এসে অর্জুন কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। অর্জুন কিন্তু সেই রকম ই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল মাঝখানে। বলেছিলাম না, ও এমনি ই। আনন্দেও চুপ আর কস্টেও চুপ। আমি দিদি কে বললাম

– এটাই প্রথম না বড়দি। এর আগেও অনেকবার ওই রাক্ষসী তোকে ভুল বুঝিয়ে আমাকে ছোড়দি কে মার খাইয়েছে বাবার কাছে। সেবারেও অর্জুন পা ফস্কে পরে গেছিল পুকুরে। ছোড়দি সাক্ষী। আমি তখন তাকে বাচাতেই পুকুরে ঝাঁপ দিয়েছিলাম। সেদিনে তুই আমার বাবাকে দিয়ে আমাকে মার খাইয়েছিলি। একবার ও ভাবিস নি, আমি ওকে কিভাবে জলে ফেলে দিতে পারি ইচ্ছে করে? ও আমার কেউ নয়? আমি তখনো কিছু বলিনি। আমি আজকেও বল্তাম না। সত্যি বলতে তুই আর মেজদির সাথে কথা বলতেই আমার ঘেন্না করে। কিন্তু তুই ছেলেটা কে মারতে গেলি বলে আমাকে এতো গুল কথা বলতে হলো। এবারে তুই বাবাকে বলে দে আমাকে মার খাওয়া যা খুশী কর। আমিও তৈরি থাকব।

বলে আমি আমার ঘরে চলে এলাম। আমি তখনো হাঁপাচ্ছি।আজকে বড়দির মুখের উপরে এতো গুলো কথা বলে মন টা আমার খুশী। আমি পড়ছিলাম। মানে পড়ার চেস্টা করছিলাম। কিছুক্ষন পড়ার পরে মনে হলো কচিকাঁচা গুলোর প্রোগ্রাম শুরু হয়েছে। ঘরে আর ভাল না লাগাতে ছাদে গেলাম আমি। ছাদ থেকে পুজো মন্ডপ টা দেখা যায় খুব সুন্দর।

ওখানে আজকে কচিকাঁচা গুলো গান আবৃত্তি করছে। আমি শুনতে পাচ্ছি এখান থেকেই। আর মাঝে মাঝে ভাবছি, কি জানি আজকে বাবা কিছু বলল না আমাকে। বাড়িতে নিচে বাবা আসার পরে নিশ্চয়ই দক্ষ যজ্ঞ চলছে। হাসি পেল। বাবা হয়ত আমাকে মারা জন্য বেল্ট নিয়ে ঘুরছে। কি জানি হতেও পারে। সহসা পায়ের আওয়াজে পিছন ফিরে দেখি অর্জুন। এই প্রথম আমার ভয় লাগল। বুক টা ধড়াস করে উঠল। বললাম

– উফ কি ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি তুই।
– আমার মিমি কবে থেকে ভয় পাচ্ছে আবার? ভয় তো তুমি কিছুতেই পাও না।
– কে বলল তোকে।
– আমি জানি। ভয় পেলে সাঁতার না জেনেও মিমি আমার জন্য ঝাঁপ দিত না পুকুরে।
কথাটার উত্তর দিলাম না আমি। অন্য কেউ হলে কি ঝাঁপাতাম নাকি? আর ওর বেলাতেও কেন বার বার ঝাঁপিয়েছি জানিনা । সত্যি বলতে কি এর উত্তর আমার কাছেও নেই। ছোট বেলাতেও কেন ঝাঁপিয়েছিলাম জানিনা, আজকেও কেন ঝাঁপালাম, জানিনা। ওর বেলাতেই কি করে আমার এত সাহস চলে আসে সেই উত্তর তখন ও পাই নি আমি। ও ছোট ছেলে ওর সাথে কি কথা বলব এই ব্যাপারে। বললাম ওকে অন্য কথা।

– তুই যাস নি ওদের ওখানে। ওখানে অনুষ্ঠান হচ্ছে।
– না
– কেন?
– তোমাকে গার্ড দিচ্ছি।
হাসি পেয়ে গেল আমার। বললাম
– আমাকে?
– হুম
– কেন?
– যাতে দাদু কিছু বলতে না পারে তোমাকে বা মারতে না পারে।
– বাবাহ আমার ছোট ছেলেটা এতো বড় হয়ে গেল? মিমির জন্য চিন্তাও করছে?
– হুম। আর মিমি যে সাঁতার না জেনেও ঝাঁপ দিল আমার জন্য?
– ওলে বাবালে। সে তো মিমিদের ধর্ম। কি হবে মিমির জীবনের যদি এই ছেলেটার কিছু হয়ে যায়?
– আচ্ছা মিমি, ছোট বেলাতেও একবার আমাকে পুকুর থেকে তুমি তুলে এনেছিলে না?

মন টা খারাপ হয়ে গেলো শুনে। সেদিনের মার টাও কম ছিল না। উলটো দিকে মুখ ফিরিয়ে বললাম

– হুম

কত কথা মনে পড়ছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। কিন্তু ওকে বলার মতন নয় সে গুলো। কিন্তু জানিনা কেন ওকে বলতেও ইচ্ছে করছে। এই টুকু একটা ছেলের সামনে অভিমান করব? কিন্তু বলেই দিলাম। জানিনা কেন ছোট থেকেই অর্জুন কাছে সেটা হতে ইচ্ছে করেনি যেটা দিদিদের সামনে আমি হয়ে গেছিলাম। নষ্ট, বেপরোয়া আর ঝগরুটে।

ওকে বললাম

– কিন্তু তোর মা আজকেও ভাবে যে আমি সেদিনে তোকে সেদিনে মারতে গেছিলাম ডুবিয়ে। কি করে তোর মা ভাবতে পারে একথা আমি সেটা বুঝি না।

কিছু বলল না অর্জুন। আমার চোখ দিয়ে জল বেড়িয়ে এল। আমি ওকে ডুবিয়ে মেরে দেবো? অর্জুন কিছু না বলে আমাকে জড়িয়ে ধরল। যাকে বলে আঁকড়ে ধরা। আমি অবাক হয়ে গেলাম। অথচ ছেলেটা কে দূরে ঠেলে দিতেও পারছি না আমি। এত ভালবাসার জড়ানো ছিল সেটা বলে বোঝাতে পারব না। সরেও গেলাম না আমি। ওর হাত দুটো কে আমি ধরে রইলাম যতক্ষন আমাকে ও পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ছিল। কিছু পরে ও যেমন ভাবে চুপি চুপি এসেছিল, পালিয়েও গেল। আমি দাঁড়িয়েছিলাম অনেকক্ষণ ছাদে।
—————————

আট

সেদিন আমি রাতে নীচে যাইনি। মন টা ভালো হয়ে গেছিল আরো। পড়াশোনা করছিলাম। পরিবেশন করার ইচ্ছে ছিল না। মনে হচ্ছিল, আমি গেলেই ঝামেলা হবে। যাও বা সব চুপচাপ আছে, গেলেই মেজদি কাঁদবে, বড়দি কাঁদবে। বাবা রেগে যাবে। আমিও রেগে যাব। কি দরকার? আমি বেশ ভাল আছি। আর কোনকালেই তেমন ভাবে তো আমি পরিবারের সাথে মিলে মিশে থাকিনি। কিন্তু অবাক করে দিয়ে শুনলাম বড়দি বলছে ভাই কে,

– ভাই যা তো ছোড়দি কে ডেকে নিয়ে আয়। খাবার গুলো দিয়ে দিক সবাই কে।

ভাবলাম বাবাহ। এতো সুখ ও কপালে ছিল। আমাকে ডাকতে হল না। আমি নিজেই গেলাম। আমি অর্জুন আর ভাই মিলে সবাই কে খাবার দিলাম। আমার মা কে দেখলাম বেশ খুশী। কাকিও। কই বাবা তো চুপচাপ খেয়ে নিল। বড়দি মেজদি সবাই চুপচাপ খেয়ে নিল। নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। কিন্তু আমাকে নিয়ে কোন আলোচনা নেই। ভাবলাম যাক তাহলে নালিশ হয় নি। কিন্তু সেদিন থেকে বড়দি একটু বদলে গেল। আমাকে ডেকে ডেকে কথা বলত। ভাল কিছু হলে, আমি শুনতে পেতাম মা কে বলতে,

– ছোটর জন্য তুলে রেখে দাও। ওর তো ঠিক নেই কখন খাবে। মন মর্জি খাওয়া ওর।

বা বলত

– মা বলতে পারো না ওকে ন্যাড়া হয়ে না থেকে, একটু চুল টা বাড়াতে। কি সুন্দরী ও।

মা ও বলত,

– তুই বল, আমাকে বলতে বলছিস কেন? আমি আর তোর কাকি ওকে সারা দিন বলি। ও শোনে নাকি কারোর কথা?

জানি হয়ত বলতে পারে না আমাকে। আসলে কোন দিন ই তো সুসম্পর্ক ছিল না। আজকে বুঝতে পেরেছে, সেদিনে আমি ওর ছেলেকে বাঁচিয়েছিলাম পুকুর থেকে। তাই একটু মায়া দয়া হয় আমার উপরে। আমি ওসব ভাবি না। আমি সেদিনেও কিছু স্পেশাল করিনি, আজকেও কিছু করিনি। আমার যা মনে হয়েছে আমি করেছি। আর সেটা করব ও।

যেদিন ঠাকুর বিসর্জন হলো, সেদিন দিদি আমাকে আলাদা করে অর্জুন কে দেখতে বলল। বলল যেন ও পুকুর ধারে না যায়। আমার খারাপ লাগে নি সেটা। সবাই কে ছেড়ে দিয়ে আমাকে ওর দেখাশোনার যোগ্য মনে করেছে, এই অনেক। অর্জুন আমার সাথেই ছিল সারাক্ষণ বিজয়ার সময়ে। বাজী ফাটাল খুব। আনন্দ করল খুব। এই ফাঁকে আমার ভাই টাও আমার কাছা কাছি চলে এল। শুধু আমার ছোড়দি টাই নেই। বাকি সব আছে। ইশ একবার দেখা হলে বলতাম

– দিদি এসে দেখ, সবাই কত বদলে গেছে।

হুশ ফিরতেই দেখলাম, ছেলে স্কেট নিয়ে খেলছে। আমার সামনে ওর বই খোলা। পড়ার থেকে খেলায় বেশী মন। আমার মেয়ে কিন্তু নির্লিপ্ত ভাবে পড়ে চলেছে। উফ এই ছেলেকে নিয়ে আমি আর পারি না। আর বাপ হয়েছে দেখ, সারা দিন কাজ। বুঝবে, ছেলে মেয়ে গরু হয়ে থাকবে সারা জীবন। আমার আর কি? মনে মনে গজ গজ করতে করতে ছেলেকে চেঁচিয়ে বললাম,

– কি রে মানু পড়বি না?

আমার ছেলে মুখের উপরে বলে দিল, ও পড়বে না। আমি সামনে হাত জোর করে বললাম

– হে মহারাজ, এই এ থেকে জেড অব্দি পড়ে আমাকে ধন্য করুন।

ব্যস মহারাজ খুশী। বাপ কা বেটা। অনুরোধে কাজ হয়। জোর করলে মার খাবে তবু করবে না সেই কাজ। স্কেট রেখে দিয়ে, আমার কোলে বসে, খানিক চেঁচিয়ে পড়ে নিয়ে, এ থেকে জেড অব্দি ঝড় ঝড় করে মুখস্ত বলে দিয়ে, খাট থেকে নেমে হাওয়া। পরক্ষনেই দেখলাম, স্কেট সাইকেল টা নিয়ে এঘর ওঘর করতে শুরু করল। আর আমি মেয়ে কে নিয়ে শুরু করলাম। ওর এখন ক্লাস থ্রী। মেয়েকে পড়া দেখিয়ে দিয়ে, ওদের বাপ কে ফোন করলাম।

– কি গো কখন আসবে?
– কেন। একটু ব্যস্ত আছি।
– দুটো কে পেটে ভরে দিয়ে এখন উনি ব্যস্ত। আচ্ছা বাপ হয়েছ বাপু।
– ওই দেখ। আচ্ছা আসছি। নীচেই তো আছি। গুণ্ডা টা কে পাঠিয়ে দাও এখানে।
– গুড বয়। পাঠাচ্ছি। খবরদার ওকে যেন লনে ছেড়ে দেবে না বলে দিলাম।
– আরে না রে বাবা আমার কাছে থাকবে।

রাতে আমাকে বেশ করে চিবিয়ে খাবার পরে, আমার বুকের উপড়ে শুয়ে শুয়ে বর বলল

– কি ব্যাপার বলত, গত কয়েক দিন , তোমাকে অন্যমনস্ক দেখেছি একটু
– হুম
– কেন?
– কত পুরোন কথা মনে পড়ছে আমার।
– এতো দিন বাদে?
– হুম। আচ্ছা মা তোমাকে ফোন করে নি এ কদিনে?
– হ্যাঁ রোজ ই করে? তোমার কথা জিজ্ঞাসা করে। পুঁচকে দুটর কথা জিজ্ঞাসা করে।
– উম্মম্মম্ম। জানো আমার না খুব যেতে ইচ্ছে করে বাড়ি। কিন্তু…
– কিন্তু কি, তুমি যেতেই পার।
– আর তুমি?
– না আমি যাব না।
– তবে আমিও না
– এটা তোমার বাড়াবাড়ি।
– হোক। তবুও না। তুমি তোমার বাড়ি যাও না কেন?
– কারন ওখানে তোমাকে অপমান করবে তাই।
– ঠিক, সেই রকম যেখানে তুমি যাবে না সেখানে আমিও যাব না। আমি বলে, স্বর্গেও যাব না তোমাকে ছাড়া। এই একী একী, কি করছ, ছেলে মেয়ে ঘুমোচ্ছে কিন্তু বলে দিলাম। ওদের ঘুম যদি ভেঙ্গেছে না!!!!!

জানি না আমি ওকে উত্তেজিত করার মতন কি বললাম। উফ এই ভাবে আমাকে ঠেসে ধরার কি মানে? এই রে মনে হচ্ছে আজকে রাতে আমাকে আরেকবার সব ধুতে হবে। আমার শাড়ি ব্লাউজ সব টেনে খুলে দিয়ে আমাকে বুকের নিচে পেষা শুরু করতে বেশি সময় নিল না আমার বর।

কলেজ থেকে বের হলাম টপার হয়েই। সেই বছরেই ভর্তি হয়ে গেলাম আমি এম এস সি তে। কমপ্লিটের পরে পি এইচ ডি র জন্য খড়গপুর চলে গেলাম। মাঝের তিন বছর না বাড়ি না কারর সাথে আমি যোগাযোগ রাখিনি। শুধু জানতাম আমার ভাই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে বাংলার সব থেকে ভালো কলেজ থেকে। বাস এই টুকুই। খুব বেশী মনেও নেই এই সময় টা আমার। শুধু মনে পরে, টপার হবার সৌজন্যে, আমি গোল্ড মেডেল নিতে ডায়াসে উঠছি। সামান্য কিছু স্পিচ। ব্যস আর কিছু মনে পরে না আমার।

বেশিদিন লাগত না আমার পি এইচ ডি করতে। আমার এম এস সি র সময়েই আমি পেপার বানিয়ে রেখেছিলাম। পিরিওডিক টেবল এর উপরে কিছু রিসার্চ আমার করাই ছিল। এলিমেন্ট দের আরো কত টা এলিগ্যান্টলি পিরিয়ডাইজড করা যায় যায় নিয়েই কিছু রিসার্চ। বিশেষ করে গ্রুপ ডি এলিমেন্ট দের নিয়ে। ভেবেছিলাম সেইটা সাবমিট করে দেব। আমি যখন এম এস সি পড়ি তখন কার কাজ ছিল এটা আমার। কিন্তু খড়গপুরে যাওয়া টা আমার জীবনের যে সব থেকে বড় টার্নিং পয়েন্ট হবে আমি সেটা ভাবিনি কোন দিন। রিসার্চ করা আমার শুধু প্রয়োজন ই ছিল না স্বপ্ন ও ছিল। আর সেটা করতে গিয়েই আমারি জীবন আমার সাথেই পাল্লা দিয়ে আমার জীবন নিয়ে রিসার্চ করল।

আমার স্বপ্ন ছিল খড়গপুর থেকে রিসার্চ করব আর খুব জান প্রাণ লড়িয়ে দেব, যাতে ওখানে কোন জব অফার আসে। অবশ্যই টিচিং জব। হয়েও গেছিল আমার। ওই দুই বছরে, দুটো ফান্ডামেন্টাল থিয়োরি আমার পেপারের সাথে জূড়ে গেছিল। আরো একটা ছিল, কিন্তু সেটা আমি রেখে দিয়েছিলাম, ভবিষ্যতে কোন ছাত্র/ছাত্রী চাইলে সেটার উপরে গবেষণা করতে বলব। সেখানেও তো আমার নাম থাকবে।

কিন্তু ভাবি এক আর হয় এক। সমস্যা বলব না, বলতে পারি, জীবনের মহার্ঘ্য দুটো বছর আমি কাটিয়েছিলাম ওখানে। কিন্তু সেই দুটো বছর আমার জীবনের সর্বস্ব কেড়ে নিল বড় আদর করে।

আমি ল্যাব থেকে ফিরছিলাম আমার রুম এ। দেরী হয়ে গেছিল অনেক। প্রায় দশ টা বাজবে তখন রাত। ইন্সটিটিউটের ঠিক বাইরেই ছিল আমার ফ্ল্যাট। আমি তখন রিসার্চের জন্য রোজগার ভালই করি। ভালো স্টাইপেন্ড পাই। অর্থের কোন সমস্যা ছিল না। তাছাড়া অনেকের সাথে থাকা আমার কোন কালেই পোষায় নি। তাই নিজেই থাকতাম আলাদা ভাবে।

ইন্সটিটিউটের গেটের বাইরেই একটা বিড়ি সিগারেট, দরকারি, অদরকারী সমস্ত রকম জিনিস পাওয়া যায় এমন একটা দোকান ছিল।
দোকান টা সারা রাতই খোলা থাকত। গেটের বাইরে, দুপাশে দুটো আলো জ্বলছিল। গাছ আছে কিছু। স্বাভাবিক গাছের তলা গুলো অন্ধকার থাকবে। আর সেই অন্ধকারে অনেক সময়ে ছেলেরা সিগারেট ছাড়াও অনেক কিছু খায়। মেয়েরাও থাকে ওই দলে। আমি রোজ ই দোকানের সামনে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকি। মনে করি কিছু নিয়ে আবার দরকার আছে কিনা। মনে পরলে কিনে নিই। সেদিনেও দাঁড়িয়েছিলাম গেটের বাইরে কিছুক্ষন।
সেদিনে না দাঁড়ালে, কি জানি, হয়তো জীবন টা অন্য দিকে মোড় নিত। কিম্বা নিত না। কিন্তু সেদিনের দাঁড়ানো টা যে আমার জীবনের মোক্ষম একটা পয়েন্ট এ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই আমার।
—————————
নয়

দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে, ভাবছিলাম আমি কি কিনব আর এদিক ওদিক চাইছিলাম। সেই রকম ভাবেই চোখ এদিক ওদিক ঘোরাতে ঘোরাতে, মনে হলো ওই অন্ধকারে একটা দলে, আমি অর্জুন কে দেখলাম। ওরকম লম্বা তো সচরাচর দেখা যায় না। কিন্তু মনে হলো ওর কি ইঞ্জিনিয়ারীং পড়ার বয়েস হয়ে গেল? এই তো কবে শুনলাম টেন্থ দেবে। ও নয় মনে হয়। আবার ভাবছি নাহ এতো ভুল তো দেখব না। ওকে চিনতে পারব না তা কি করে হয়? লাস্ট বার যখন ওকে দেখেছিলাম, ওর মুখ টা মনে করার চেস্টা করলাম। আর সাথে সাথেই চোখে ভেসে উঠল ওর হাসি মুখ টা, মায় গালে ওঠা একটা ছোট্ট পিম্পল অব্দি। আর আমি ওকে ভুল করব?
আমি ওকে হাঁ হয়ে দেখছিলাম। ফ্ল্যাশ ব্যাকের মতন সব মাথায় রিকল্ড হয়ে গেল। মার খাওয়া। পুকুর থেকে বাঁচানো। সন্ধ্যে বেলার ওর মায়ের সাথে ঝগড়া আর রাতে ওকে জড়িয়ে ধরে কান্না ও। রোজ সকালে উঠে হরলিক্স খাওয়া, দৌড়তে যাওয়া, সব কিছু।
আমি ফিরে গেলাম ওই জটলার কাছে। চার পাঁচ টা ছেলে রয়েছে। ওদের মধ্যে পিছনে বসে রয়েছে ও। মনের সুখে সিগারেট এ টান দিচ্ছে। আমি তো জানতাম ই না ও এখানে পড়ে। আমি গেটের ভিতরে চলে এলাম। কিকবক্সিং করতাম আমি তখন। মাথায় একটা ফেটি কিম্বা ক্যাপ আমার থাকত। তখনো ন্যাড়া মাথা আমার। সেদিনে মাথায় একটা ফেটি ছিল আমার সেটা খুলে ক্যাপ টা পরে নিলাম আমি। তখন ক্যাম্পাস এ ফুটবল ও খেলি ছেলেদের সাথে। সমস্যা হয় না। পাল্লা দিয়ে খেলতেও পারি।
ও আমাকে দেখতে পায় নি তখনো, অন্ধকার তো রাস্তা টা। আর দোকানের সামনে আলো জ্বলছে। সব থেকে লম্বা সুঠাম চেহারা ওর। দূর থেকে ওকে চেনা যায়। ডাকব? নাহ সিগারেট খাচ্ছে। যদি লজ্জায় পড়ে যায়। কিন্তু ওর সাথে কথা না বলে কি ভাবে থাকব। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি, বাবাহ সেই ছোট ছেলে টা এখন সিগারেট ও খাচ্ছে। অপেক্ষা করলাম কিছুক্ষন। ওদের সিগারেট খাওয়া হয়ে গেলে ওকে ডাকলাম।

আমাকে দেখে বেশ অবাক হলো এতে কোন সন্দেহ নেই। চোখে অবাক হবার সাথে একটা খুশীর ঝলক। আনন্দ পেয়েছে সেটা ওর চোখে মুখে পরিষ্কার। ওর বন্ধু গুলো একটু অবাক। ও পরিচয় করিয়ে দিল আমাকে ওদের সাথে।
– আমার মিমি।
মাসী বা ছোট মাসী বলল না। ও ওদের বন্ধু দের বিদেয় দিয়ে আমার সাথে হাঁটতে লাগল। বললাম
– কোন স্ট্রিম এ আছিস
– মেক। তুমি এখানে?
– পি এইচ ডি
– বাহ। কোন হোস্টেল এ আছ?
– আমি হস্টেল এ থাকি না। ওই যে আমার ফ্ল্যাট।
বলে আঙ্গুল তুলে আমি আমার ফ্ল্যাটের দিকে দেখালাম।
আমি জানি এখন ওদের সিঙ্গেল রুম নয়। ওকে বলে দিলাম, আমার সিঙ্গেল রুম ফ্ল্যাট এবং যথেষ্ট ভাল। ভিতরে সব কিছু ব্যবস্থা আছে। ওর অসুবিধা হলে যেন চলে আসে আমার রুম এ। আমার ভাই ওর বন্ধু। ও বলল আমার ভাই মানে, তুহিন এর সাথে ওর কথা খুব হয়। প্রায় ই ফোন করে একে অপর কে। ওকে দেখে যেন আমি বিহবল হয়ে গেছি। কেমন আছে সব ঠিক ঠাক আছে কিনা, কোনটার পরে কি জিজ্ঞাসা করব খেই হারিয়ে ফেলছিলাম। আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, টাকা পয়সা আছে কিনা। ও সাড়া দিল না। আমি বললাম
– কেন বাবার কাছ থেকে নিস না?
– দিত আগে। কিন্তু এখন কমিয়ে দিয়েছে।
– কেন?
– জেনে গেছে আমি স্মোক করি।
– কটা খাস দিনে?
– বেশী খাই না। হয়ত চার পাঁচটা হয়ে যায়। কিন্তু মায়ের ধারনা আমি অনেক খাই।
– ড্রিঙ্ক করিস না তো?
– নাহ এখনো অব্দি করিনি। তবে ইচ্ছে আছে
– তবে রে দুষ্টু।
– না না এখন না চাকরী বাকরী পেলে করব।
আমি জানি ও মিথ্যে বলে না। ওর জীবন দর্শন টা খুব সিম্পল। কিছু করলে লুকোয় না। আর নিজের করা কোন কাজ মেনে নিতে পিছুপা হয় না। আর কিছুই বেশি বাড়াবাড়ি করে না ও। আমি বললাম
– খেলা ধুলা করছিস?
– হুম , তবে আর ফুটবল খেলি না
– তবে?
– বক্সিং করি
– তাই? আমিও কিক বক্সিং করি। একদিন চলে আয় রিং এ।
– তুমি পারবে না আমার সাথে
– ভারী তোর ক্ষমতা।
– ঠিক আছে দেখো।
কিছুক্ষন গল্প করে আমি চলে এলাম আমার ফ্ল্যাট এ। নিজের পড়াশোনা নিয়ে মত্ত হয়ে গেলাম। তখনো নর্ম্যাল আর ভীষন ক্যাসুয়াল ছিলাম । রোজ ই গেটের বাইরে ওকে দেখি। খানিক গল্প করি আর চলে আসি নিজের ফ্ল্যাট এ। একদিন ওকে দেখলাম জিম এ। সকালে। আমি সাধারনত যেতাম খুব সকালে। আর ও হয়ত একটু পরে। সেদিনে আমার লেট হয়েছিল আর দেখা হলো। দেখলাম বক্সিং গ্লাভস পরে বসে আছে। আমার হয়ে গেছিল ওয়ার্ক আউট। ওর জন্য বসে গেলাম কিছুক্ষন। তারপরে ও বেরোলে দুজনে মিলে কচুরী তরকারি খেয়ে যে যার দিকে হাঁটা।
বড় হয়েছে ও। বন্ধু বান্ধব কত কিছু হবে এই সময়ে। আমি চাইতাম না ওকে বেশি দেখা দিতে বা কথা বলতে। হয়তো ও অপছন্দ করে সেটা। হয়ত চায় না মিমি সারাক্ষণ পিছনে ঘুরঘুর করুক। এভয়েড ঠিক না কিন্তু ওই রাস্তা ঘাটে যত টুকু দেখা হতো তত টুকুই হত। এর বেশী আমি আর ট্রাই নিতাম না। সেই রকম ই একদিন দেখা হলো দুপুর বেলায় ও আর একটা বন্ধু। রাহুল। ছেলে টা কলকাতার ছেলে। দুজনাকেই বললাম
– খেয়েছিস তোরা?
রাহুল বলল
– হ্যাঁ আমি তো খেয়েছি, কিন্তু অর্জুন কোন দিনেই খায় না।
– কেন?
অর্জুন ততক্ষনে রাহুল কে থামাতে চাইছে। রাহুল বলে দিল
– মাসী জানিনা, ওকে আমি কোন দিন ও খাবার শেষ করে উঠতে দেখিনি।
কথা শেষ ও হলো না। অর্জুন ওকে টেনে নিয়ে চলে গেল অন্য ক্লাসে। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম ওখানে। আমি তো চিরকাল ই একটু অন্যরকম। কেউ বলতে না চাইলে জানার কোন ইচ্ছে আমার হয় না। বুঝলাম অর্জুন ওকে কথাটা আমাকে বলতে দেবে না বলেই টেনে নিয়ে চলে গেল। ভাবলাম, বুঝুক গা ওর মা। আমি কি করব। আবার ভাবলাম হস্টেলে না থাকলে এই ব্যাপার গুলো তো ও শিখবে না ও কোন দিন।
হস্টেলে থাকা তো শুধু মজা আর মস্তি না। হস্টেলে থাকা একটা লার্নিং। একটা নিজের উপরে খোঁজ চালানো চার বছর ধরে। এই খোঁজ টাই তাকে স্ট্রং করে পরবর্তী জীবনে। কত কিছু শেখা। নতুন জিনিস এডপ্ট করা। হস্টেলে প্রতিটা মানুষ একা, কিন্তু দেখতে গেলে সবাই একসাথে। এই খোঁজ টা তো ওকেও পেতে হবে। শিখুক। আমি আর বেশি মাথা ঘামাবো না। কিন্তু ও খাওয়া দাওয়া করতে পারছে না, এই ভাবনা টা কে ফেলে দিতে পারলাম না। মনে কোন এক কোনায় রয়ে গেল।
তারপর থেকে দেখা হলে, কোন দোকানে নিয়ে গিয়ে দুজনে খেতাম। বলা ভালো ওকে খাওয়াতাম। চিকেন বেশী করে। ভাবতাম হস্টেল এ যেটা পাচ্ছে না সেটা মাঝে মাঝে পুষিয়ে নিলে ঠিক আছে। জানিনা কেন, আমি যখন ই নিজের ঘরে খেতে বসতাম রাহুলের কথা টা আমার মনে পড়ত। – যে অর্জুন কিছুই খায় না। এই সব মুখ চোরা ছেলের বাইরে না বেরোনোই উচিৎ। ওর মা কিচ্ছু শেখায় নি ওকে।
বুঝতাম না কিছুই। কেন এই ভাবনা। এই আমার সমস্যা। অবসেসড হয়ে পড়ি। ব্যালান্স করতে পারছি না এখনো নিজের ভাবনার সাথে, নিজের মনে সাথে জীবনের। ভাবতাম গত তিন চার বছর তো আমার অর্জুনের কথা মনেও পড়ে নি। এখন ভাবছি কেন। ও তো তখনো এমনি ই ছিল। তখন আমার সমস্যা হয় নি এখন হচ্ছে কেন? ভাবলাম এখানে আমি আছি, ওর মা জানে, ওর কিছু হলে হয়ত ওর মা বলবে ছেলে টা কে দেখতে পারিস নি? সেই ভয়েই কি করছি আমি এমন? হতেও পারে।
এই ভাবে চলল তো কিছু দিন। একদিন সন্ধ্যে বেলায় আমি ওকে দেখলাম না গেটের বাইরে। কিছু মনে হয় নি। ভাবলাম হয়ত আসে নি আজকে। পরের দিন সকালেও ওকে দেখলাম না জিম এ। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম। কি মনে হলো, ও যখন এলো না, ওর হস্টেলে গেলাম খুঁজে পেতে। অনেকক্ষণ পরে একটা ছেলে নেমে বলল,জ্বর এসেছে বেশ। নামতে পারছে না।
– সেকী, ওষুধ খাচ্ছে না সেটাও খায় নি?
– কি জানি।
বলে ছেলেটা চলে গেল। আমি আর রিস্ক নিলাম না। নিজেকে আর নর্ম্যাল আর ক্যাসুয়াল রাখতে পারলাম না। একেই খাওয়া দাওয়া করে না। তার পরে জ্বর। ওকে নিয়ে যাব আমার ফ্ল্যাট এ। কি ছেলে রে বাবা। একটু সাবধানে থাকতে হয় তো। এখানে তোর মা আছে? নাহ ওকে নিয়ে যাই, সারিয়ে আবার দিয়ে যাব এখানে। রাহুল কে ডাকলাম। ও এসেই আমাকে ওয়ার্ডেনের কাছে নিয়ে গেল হস্টেল ওয়ার্ডেন কে নিজের পরিচয় দিলাম। আমি যে ওর মাসী হই সেটা বলতেই ওকে ছেড়ে দিল আমার সাথে। রাহুল আর একটা ছেলে ওকে ধরে ধরে নামিয়ে নিয়ে আসতেই, আমি রিকশা করে ওকে আমার ফ্ল্যাট এ নিয়ে এলাম।
বিছানায় শুইয়ে দিতেই জবুথবু হয়ে শুয়ে পড়ল। মনে মনে ভাবলাম ভাগ্যিস নিয়ে এলাম। গা একেবারে পুড়ে যাচ্ছে। আমার কাছে ছিল প্যারাসিটামল। ওকে একটু গরম চা করে আর দুটো বিস্কুট খাইয়ে, ওষুধ টা গিলিয়ে, বেড়িয়ে পড়লাম, ডাক্তারের খোঁজে। আমাদের জিমের যে ইন্সট্রাক্টার তার একজন বন্ধু ছিল ডাক্তার। তাকে পেলাম, সে এলো আমার সাথে। ওকে চেক করে বলল,
– সাধারন জ্বর। ভাইরাল। ওষুধ দিচ্ছি ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু একটু ভোগাবে। সাবধানে রাখতে হবে।
ডাক্তার কে বিদায় দিয়ে, টাকা পয়সা মিটিয়ে, ওষুধ গুলো কিনলাম।একটা থার্মোমিটার কিনলাম। কিছু ফল কিনলাম। বেশ কিছু ডিম নিয়ে নিলাম। আর চিকেন কিনলাম। হয়ে যাবে আশা করি। বাড়িতে এসে দেখি, জ্বর টা কমেনি। আমি ওকে পাউরুটি আর ডিম সিদ্দ খাইয়ে, ওষুধ দিয়ে শুইয়ে দিলাম। প্যারাসিটামল আগেই দিয়ে রেখেছিলাম আমি।
ভাবলাম পরের ছেলে, ওর বাড়িতে খবর দিয়ে দেওয়াই ভাল? তারপরে ভাবলাম, ওর মা চলে আসবে। ওকে নিয়ে যাবে। এই অবস্থায় মুভ না করানোই ভাল। দেখি কাল অব্দি না কমলে খবর তো দিতেই হবে। আমি রান্না করে নিলাম। খুব যে ভাল করতে পারি সেই নিয়ে কোন বিশ্বাস আমার ছিল না। কেউ তো শিখিয়ে দেয় নি রান্না আমাকে। আর আমার রান্না কেউ খায় ও নি আজ পর্যন্ত। যে, ভালো কি মন্দ কিছু জানব। খুব হালকা চিকেন আলুর ঝোল আর ভাত। ওর জন্য একটু উচ্ছে সিদ্দ। জ্বর টা কিছু বাদেই দেখলাম কমে গেল। ওকে বললাম স্নান করতে হবে না তোকে আজকে। কালকে জ্বর টা না এলে স্নান করিস। উত্তরে বলল
– খিদে পেয়েছে।
খেলো, বলতে নেই অনেক টা ভাত। আমি দেখলাম একে এখন হস্টেলে ছাড়া যাবে না। থাকুক কিছু দিন এখানে। ওর তো কোন কিছু তেই না নেই আর হ্যাঁ ও নেই। বিশেষ করে খাওয়া দাবার ব্যাপারে। উচ্ছে সিদ্দ টাই খেল অনেক টা। দুপুরে খেয়ে দেয়ে আমার ঘরে থাকা একটা দুটো গল্পের বই পড়ল। দুপুরে ফল কেটে দিলাম খেল। আমি চাইছিলাম, তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাক ছোঁড়া।
ও একটু ভালো আছে দেখে ওকে বেরোতে মানা করে আমি গেলাম ক্লাস এ। পি এইচ ডির কাজ তখন ফুল ফ্লেজড চলছে আমার। সময় নষ্ট করার সামান্য ও সময় নেই। ফিরে আসছিলাম তাড়াতাড়ি। ভুলে গেছিলাম বাড়িতে অর্জুন আছে। আর ও অসুস্থ। ভাবলাম রান্না করাই আছে। রুটি নিয়ে নি অর্জুনের জন্য। জ্বর গা, ভাত খাওয়া ঠিক হবে না রাতে। রুটি কিনে ঢুকে দেখি, আরো একটা ছেলে এসেছে। রাহুল।
বলল
– ওই যে মাসী এসে গেছে। এবারে আমি যাই। আর কোন বই লাগলে বলিস দিয়ে যাব।
– আর বেসিক ইলেক এর নোটস?
– কালকে সকালে দিয়ে যাব, না হয় মাসীর ডেপ্ট এ দিয়ে আসব মাসীর কাছে।
কিছু খেয়ে যেতে বললাম। খেলো না রাহুল। আমাকে বলল
‘- মাসী ওকে এখানে এনে ভালো করেছ তুমি। আমার চিন্তা হচ্ছিল। থ্যাঙ্ক ইউ।
রাতে খাইয়ে দাইয়ে ওকে বললাম
– চুপ করে ঘুমোবি। পড়াশোনা দুদিন থাক। আর হ্যাঁ আমি জানি রাহুলের আসার কারনের মধ্যে সিগারেট নিয়ে আসাও একটা কারন। এখন নো স্মোকিং, মনে থাকবে?
কোন কথা বলল না ও। ঘাড় নাড়ল। ওকে শুইয়ে দিলাম মশারী টাঙিয়ে। আর আমি বাইরে ডাইনিং এ আসন পেতে পড়তে বসলাম। মাঝে মাঝেই উঠে দেখে আসছিলাম গায়ে জ্বর আছে নাকি। রাত তখন দুটো, গায়ে হাত দিয়ে বুঝলাম জ্বর টা আসছে। পায়ের পাতাও ঠান্ডা মনে হলো। ওকে তুলে প্যারাসিটামল খাইয়ে দিলাম আমি। ওকে চাপা দিয়ে দিলাম, একটা কম্বল ছিল আমার সেটা দিয়ে । আধ ঘন্টা বসলাম পাশে। দেখলাম একটা সময়ে ঢাকা টা পা দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিল। বুঝলাম ঘামছে ও। জ্বর টা নামছে।
জ্বরের সময়ে করণীয় ব্যাপার গুলো সব আমি জানি। ছোট বেলায় জ্বর আসলে আমার ট্রিট্মেন্ট নিজেই করতাম। ছোড়দি চলে যাবার পরে আমি তো কাউকে বলতাম ও না এই রকম কিছু হলে। মায়ের অতো সময় ছিল না অতো গুলো ছেলে মেয়েকে ধরে ধরে জ্বরের সময়ে কাছে নিয়ে শোবার। আর তাছাড়া, আমি গ্র্যাজুএশন থেকেই একলা থাকি। কাজেই এই ব্যাপার গুলো জানতাম।
আমি ফ্যান টা হালকা চালিয়ে দিয়ে, বাইরে এসে পড়তে বসলাম। জানিনা হয়ত চোখ টা লেগে গেছিল পড়তে পড়তে। চোখ টা খুলল
– গুড মর্নিং মিমি
তাকিয়ে একলাম সেই এক গাল হাসি আর এক হাতে একটা কাপ অন্য হাতে একটা গ্লাস।
– গুড মর্নিং। উঠে পরেছিস কেন? দেখি!
বলে কপালে হাত দিতেই বুঝলাম, জ্বর নেই। ঠান্ডা ওর গা। ও বলল
– জ্বর নেই গো বাবা। জ্বর হলে আমার কোন হুশ থাকে না। মা কে জিজ্ঞাসা কোর বলে দেবে। কিন্তু তোমার না একটাই কাপ, তাই গ্লাসে চা টা আনতে হলো।
আমি ওকে দেখছিলাম। ওর হাত থেকে গ্লাস টা নিতে গেলাম। ও কাপ টা নিতে বলল আমাকে।
– কেন? কাপে তুই খা
– না না গ্লাস টা গরম তুমি পারবে না হাতে নিতে।
– আর তুই খুব পারবি? তুই আমার ছেলে না আমি তোর? দে গ্লাস টা আমাকে।
বলে একবারে ছিনিয়ে নিলাম গ্লাস টা । উফ সত্যি গরম। মেঝেতে রেখে দিলাম গ্লাস টা। ওকে আসন টা এগিয়ে দিলাম আমি। বললাম, খালি মেঝেতে বসিস না। এই আসনে বস। ও বলল,
– ঘরে চল। এখানে বসার ই বা কি দরকার
ঘরে গিয়ে মশারী তুলে দুজনে চা খেতে বসলাম। সকাল হচ্ছে আসতে আসতে। বড্ড ভাল লাগছে। জানি না কেন।
সেই দিন টা খুব ব্যস্ত ছিলাম। সেই অবস্থাতেই ফাঁকে ফোঁকরে, স্যার এর স্কুটি টা নিয়ে ওকে দেখে আসছিলাম আমি। রান্না করে দিয়ে এসেছিলাম সকালেই। শুধু ওকে নিয়ে খেয়ে নিতে হতো। জ্বর টা আসে নি। তাও, আমি যাচ্ছিলাম ওষুধের সময় গুলো তেই, খাইয়ে দিয়ে আসছিলাম ওষুধ।
সন্ধ্যে বেলায় ফিরে ওর সাথেই সময় কাটালাম আমি। ওর সাথে গল্প করে। আমার মা দিদিরা বলে ও কথাই বলে না একদম। কই সে রকম না তো। কত কথাই তো বলল, পুটুর পুটুর করে। কম কথা বলে কিন্তু বলছিল কথা। সাবজেক্ট ডেপথ মারাত্মক। কিন্তু জীবন সম্পর্কে বেশী জ্ঞান না থাকলেও, কথা মন্দ বলে না ও। ওকে আমার ছোট থেকেই ভালো লাগত। কিন্তু আজকে যেন নতুন করে একটা ভালো লাগা তৈরি হলো।
এমন নিঃশব্দ ঘুম আমি কারোর দেখিনি। এতো কাছ থেকে ওকে দেখিনিও আগে আমি। ও ঘুমোল আর আমি সারা রাত পড়ার নাম করে লাইট জ্বেলে আমি ওকে দেখলাম। ভগবান ওকে অনেক যত্ন করে তৈরি করেছে। নিখুঁত শরীর। না না, উপর থেকেই দেখছি। লম্বা নাক। পুরুষালী কিন্তু বেশ মিস্টি একটা মুখ। গালে হালকা দাড়ি। হালকা গোঁফের রেখা। পেশীবহুল নয় কিন্তু শক্তিশালী হাত। এই শক্তিশালী হাতের পরিচয় আমি পেয়েছি জিম এ। এদিকে কাত হয়ে, হাত দুটো কে বুকের কাছে জড় করে স্টাইল করে ঘুমোচ্ছে।
—————————
দশ
ভাগ্যিস আমি ওর খবর নিতাম এদিক ওদিক থেকে। তাই তো জানতে পেরেছিলাম। না হলে ছেলেটা জ্বরের ঘোরে কতদিন পরে থাকত কে জানে। কি যে ছেলে! একটা খবর দিতে পারত আমাকে। আগের দিন রাত থেকে জ্বর এসেছে একটা খবর দিবি না আমাকে? রাহুল কে দিয়েও তো খবর দেওয়াতে পারতিস।
জ্বর কমে গেল, এক দু দিনের মধ্যেই। খানিক দুর্বলতা ছিল কিন্তু সেটা কোন ব্যাপার ছিল না। সেটাও কেটে গেল আস্তে আস্তে। এবারে মনে হলো ওকে বলা উচিৎ এবারে তুই হস্টেলে ফিরে যা। কিন্তু বলতে পারলাম না। ভাবলাম, দুর্বলতা টা কেটে যাক তারপরে বলব। দুদিন ভালো করে খাইয়ে দাইয়ে দি। তারপরে যাবে ক্ষন। একদিন রাতে ও পড়ছিল আর আমি পাশে বসে ওর একটা ড্রয়িং করে দিচ্ছিলাম।
ওকে এমনি ই জিজ্ঞাসা করলাম
– হ্যাঁ রে, আগের দিন রাতে জ্বর এসেছিল, রাহুল কে দিয়ে খবর পাঠাস নি কেন?
– আমি তো জানতাম তুমি আমার খবর নেবে।
চমকে উঠলাম। ভাবলাম এমনি ই কথা টা ও বলে দিল। কিন্তু দেখলাম আমার দিকে তাকিয়েই নেই ও। মন টা একটা অন্য রকম খুশী তে ভরে গেল। সেটা আমার উপরে ও ভরসা করে সেই জন্য নাকি অন্য কোন কারন আমি বুঝিনি। আমি উঠে রান্না টা একবার দেখে এসে বললাম
– যদি না নিতাম? ওখানেই তো পরে থাকতিস।
– হতেই পারত না।
– এতো কনফিডেন্স মিমির উপরে?
– হুম
ও কিছু একটা লিখতে লিখতে হুম টা বলল। বুঝলাম আমার দিকে তাকিয়ে কনফিডেন্স টা জাহির করতে হয়ত লজ্জা পেল। ঠোঁটের কোনায় হাসি টা লেগেই আছে।
– দুষ্টু
বলে আমি আবার ড্রয়িং এর কাজে মন দিলাম। কথা বলে না চুপ থাকে, বললে এমনি ভাবেই মিস্টি করে কথা বলে ও। তারপরে কি মনে হতে বলল
– আমি তো জানি, তুমি সব সময়ে আমাকে নজরে রাখতে। ডিপার্ট্মেন্ট এ আসতে। জিম এ আমাকে দেখতে না পেলে, খবর নিতে। রাস্তায় দেখা হলে আমার না দেখার ভান করতে কিন্তু অনেকক্ষণ আমাকে নজরে রাখতে। আমাকে দেখা না দিয়েও আমার খবর নিতে।
আমি আর কথা বাড়ালাম না। লজ্জায় আমার মুখ টা লাল হয়ে গেছিল হয়ত। ও ছোট ছেলে বুঝতে পারেনি আমার লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া মুখ। কিন্তু আমি উঠে এসেছিলাম সেখান থেকে। রান্নার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম ইচ্ছে করেই। ধরা পড়ার লজ্জা নয় হয়ত। একটা অন্য রকম লজ্জা। বলে বোঝাতে পারব না।
এর মাঝে ওকে একদিন বলে দিলাম। যে তুই ঠিক হয়ে গেছিস। হস্টেলে ফিরে যেতে পারিস। কিন্তু ও ওর মন মর্জি থাকত। কোন দিন হস্টেলে থাকত, আবার কোন দিন ঘরে এসে দেখতাম মহারাজ বিছানায় বসে বসে পড়ছেন। মন টা খুশী হয়ে যেত। সারাদিন ফেরার পরেও ক্লান্তি লাগত না ওর জন্য রান্না করতে। জানি ঠিক সকালে ঘুম থেকে তুলে আমাকে চা টা এগিয়ে দেবে,এক মুখ হেসে। যেহেতু আমার কাছেই থাকত প্রায় ই, আমি আর ওর খোঁজ নিতাম না এর তার কাছ থেকে। নিজের কাজ করতাম আর বাড়িতে তো ওকে পেতাম ই। এই রকম একবার পর পর দুদিন ও এল না। মন টা বলছিল আজকে নিশ্চই আসবে। ফেরার পথে চিকেন নিয়ে ফিরলাম আমি। মন টা খুশী ছিল। দুটো দিন দেখিনি কিন্তু মনে হচ্ছিল কয়েক যুগ দেখিনি আমি।
এসে দেখি ও আসে নি। কেমন একটা অদ্ভুত বিষাদে মন টা ভরে গেল আমার। রাগ হলো ওর উপরে। খবর তো দেওয়া যেত আমাকে একটা। কিন্তু কেনই বা দেবে। ও হয়ত হস্টেলে ফিরে গেছে। আর সেটা আমি ই তো চেয়েছিলাম যে ও হস্টেলে ফিরে যাক। সে গেছে বেশ করেছে। কিন্তু, তাতে আমি এতো ডিস্টার্বড কেন? ওর হস্টেলে ফিরে যাওয়াতে তো কোন সমস্যা নেই। না ওর মা আমাকে বলেছে খেয়াল রাখিস, না অন্য কোন বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু আমি তখনো বুঝতে পারিনি সমস্যা টা ওর হস্টেলে ফিরে যাওয়াতে ছিল না সমস্যা টা লুকিয়ে ছিল আমার ভিতরে। কিছু বুঝতেই পারছি না আমি। সব কিছুই সিলেবাসের বাইরে। পড়াশোনা অনেক সোজা এই সবের থেকে। বুঝলাম না বটে কিন্তু রাগ টা গিয়ে পড়ল অর্জুনের উপরে। সোজা চলে গেলাম ওর হস্টেল এ। ওকে ডেকে পাঠাতেই দেখলাম দৌড়ে নেমে এলো নীচে।
তেড়েফুঁড়ে রাগে অভিমানে বললাম
– কি ভেবেছিস তুই, একটা খবর দিবি না আমাকে? চিন্তা হয় না?
হাসি মুখে ছিল ও কিন্তু আমাকে ওই ভাবে দেখে চুপ করে গেল। হয়ত কিছু বলত, কিন্তু আমার রেগে যাওয়া দেখে কোন কথাই বলল না। মনে পরে গেল আমার, এই ভাবে রেগে বললে আরো গুটিয়ে যাবে ও। কোন কথাই বলবে না আমার সাথে। আর এর পরিচয় আমি অনেকবার পেয়েছি আগে। সামলে নিলাম নিজেকে। ওকে দেখেই মন টা কেমন হয়ে গেল। আমি এতো রেগে গেলাম কেন? আমি ই তো মানতাম, ওকে একলা থাকতে হবে, শিখতে হবে, বন্ধুদের সাথে সময় কাটাতে হবে। আর আজকে আমি ই রেগে গেলাম? আমার তো রাগ এই জন্য হয় নি ও হস্টেলে আছে, আমার রাগ হল আমাকে খবর দেয় নি বলে। মনে মনে মারাত্মক অভিমান হলো বলে দিলাম
– থাক তুই যেখানে খুশী। আমার কি? একটা খবর দিলে চিন্তা করতাম না আমি। আর কিছু না।
ও বেশ ঘাবড়ে গেছিল। মিমি কে কোন দিন ও ওর উপরে রাগ করতে ও দেখে নি। কিন্তু আমি কি ভাবে বোঝাই আমি রেগে নেই ওর উপরে। কেমন যেন একটা কস্ট। থাক ছোট ছেলেকে এই সব গরল বুঝিয়ে কাজ নেই। ও যা ভাবছে সেটাই ভাবুক। তাও বলল
– আমাদের টেস্ট আছে সামনে তাই হস্টেল থেকে পড়াশোনা করছিলাম। ভেবেছিলাম আজকে যাব কিন্তু যাওয়া হলো না।
আবার রাগ হলো। বাস নির্বিবাদে বলে দিল, যাওয়া হলো না। যাক আমার কি? কে হই আমি ওর? মন টা কেমন মুচড়ে উঠল, যখন ভাবলাম, কে হই আমি ওর? আমি বলে দিলাম ওকে
– বেশ করেছিস যাস নি। আমি চলি, খেয়ে নিস সময় মতন। আর টেস্ট ভালো করে দিস।
বলে ওর দিকে না তাকিয়ে হন হন করে চলে এলাম আমার ঘরে। ভাবছি, যাক ভালই হয়েছে চলে গেছে। কালকে ওর জামা কাপড় বইপত্র যা এখানে পরে আছে আমি দিয়ে আসব। রান্না করতে ইচ্ছে করল না। যে উৎসাহ নিয়ে চিকেন টা এনেছিলাম আর সেই উৎসাহ টা নেই। কেন যে মরতে আনতে গেলাম চিকেন টা।
আমার কি দোষ? ওই তো আমাকে বলেছিল দিন কয়েক আগে,
– মিমি জ্বরের সময়ে যে চিকেন টা করেছিলে আমাকে করে আরেকদিন খাইও তো।
আমি তো জানিও না কেমন রান্না হয়েছিল আমার, বা আমি দ্বিতীয়বার সেই রকম করতে পারব কিনা সেটাও জানতাম না। তাও এনেছিলাম চিকেন, চেষ্টা করব যে ভাবে করেছিলাম সেই ভাবে মনে করে করে বানানোর।
কি করে জানব যে ও চলে যাবে এখান থেকে। যাক, কালকে ফেলে দেব। ভালো লাগছিল না কিছুই। পড়তে বসতে ইচ্ছে করছিল না। ভেবেছিলাম, রান্না বান্না করব, দুজনে মিলে গল্প করব। ধুর ভাল লাগে না। হাতে, বাড়িতে পড়ার একটা ট্রাউজার নিয়েছিলাম সারাদিনের পরে থাকা ড্রেস ছাড়ব বলে। রাগে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বসে রইলাম চুপ করে বিছানায়।
রাত তখন কত জানিনা। দরজায় ঠকঠক করে আওয়াজ পেলাম আমি। ওখানে শুধু আমার ই ফ্ল্যাট না। এক ই ইন্সটিটিউটে পড়ে, এমন অনেকেই থাকে। এতো রাতে তো কেউ আসে না। আর অর্জুন তো আসবে না। কিছু ক্ষন অপেক্ষার পরেই আবার আওয়াজে এসে খুললাম দরজা। দেখি অর্জুন দাঁড়িয়ে। মন টা মারাত্মক খুশী হল আমার। আনন্দে নাচতে ইচ্ছে করল। কিন্তু বাইরে দেখালাম না।
ওকে ভিতরে ঢুকিয়ে নিয়ে মুখ গোমড়া করে, দরজাটা বন্ধ করে বললাম
– কি ব্যাপার চলে এলি যে?
সে কথার উত্তর নেই কোন। উত্তর এলো।
– আরে খিদে পেয়েছে। সেই দুপুরে খেয়েছি , খেতে দাও।
আমি চমকে উঠলাম। এই রে আমি তো রান্না বান্না ই করিনি। ঘড়ি দেখলাম, প্রায় বারোটা বাজে। বাবাহ বারোটা অব্দি চুপ করে বসে ছিলাম আমি? বললাম
– তুই খাস নি?
– না আমার তো ঠিক ই ছিল আমি পড়ে টরে এখানে আসব
– আমাকে সেটা বললি না আমি যখন গেছিলাম তোর ওখানে?
– বলতে দিলে কই। রাগ দেখিয়ে দুমদাম করে চলে এলে। তুমি খেয়েছ?
বলতে পারলাম না, যে খাই নি। কেমন শুনতে লাগবে ব্যাপার টা। এই প্রথম আমার লজ্জা করল ওর সামনে কিছু বলতে। কেমন একটা বাধা পেলাম। মনে হল, না আমি ওর মা, না আমি ওর বউ, যে ওর জন্য অপেক্ষা করে থাকলাম না খেয়ে।অতএব না খেয়ে থাকার ব্যাপার টা চেপে গেলাম আমি। বলে দিলাম
– হ্যাঁ খেয়েছি। তুই বস আমি রান্না করি।
– না না তুমি বললে খাবার কিনে নিয়ে আসতে পারি। দোকান খোলা আছে। ঘুগনী রুটি পেয়ে যাব।
– না না তুই জামা প্যান্ট ছাড় আমি রান্না করে দিচ্ছি।
আমি ততক্ষনে স্টোভ জ্বালতে শুরু করে দিয়েছি। ওর আগের বলা কথা মনে করে বললাম ওকে
– এক থাপ্পড় খাবি। আমি কখন রাগ দেখালাম রে তোকে?
বস্তুত এখন আর সেই রাগ টা নেই। সেটা এখন ভালো লাগায় পর্যবাসিত হয়ে গেছে। ওই দেখ! বাস আর কোন কথা নেই। জিজ্ঞাসা করলাম কখন রাগ দেখালাম, তার কোন উত্তর নেই। বুঝলাম প্যান্ট ছাড়ছে। খানিক বাদে এল রান্না ঘরে। দেখল বাটি তে কাঁচা চিকেন আছে। বলল
– পিঁয়াজ কেটে দি?
আমি কিছু বললাম না। নিজেই ছুরি আর পিঁয়াজ নিয়ে কেটে ফেলল। আলু কেটে ফেলল। আমি কোন কথা না বলে তাড়াহুড়ো করছি ওকে তাড়াতাড়ি খাওয়াবো বলে। রাত হয়েছে বেশ।
রান্না বান্না হয়ে গেলে খেতে দিলাম। আমাকে বলল তুমিও নাও। আমি কি বলি। আমি তো বলেছি খাওয়া হয়ে গেছে। আর ও জানে ওর মিমি অল্পই খায় রাতে। বেশী খায় না। আমি বললাম না কিছু শুধু বললাম – তুই খা।
ও দেখলাম উঠে গেল। কিছু ডিস্পোসেবল থালা ছিল। সেখান থেকেই একটা নিয়ে এসে বলল,
– ভাত নাও।
আমি হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে। বলল
– আমি জানি তুমি খাও নি। নাও নাও। খিদে পেয়েছে। ঝোলের গন্ধ টা দারুন হয়েছে।

এর পরে আর কি বলার থাকে। মনের মধ্যে যে অন্ধকার টা ছিল সেটা কেটে গেল। সারাদিন কথা বলে না। কিন্তু যতগুলো বলে তাতেই তার মিমি কাত। ওকে ভালো করে বিছানা করে দিয়ে ভাবলাম, দরকার নেই ওর হস্টেলে থেকে।
ওকে আর ছাড়িনি আমি। ভরসা পাই নি ছাড়তে। ভরসা ওর থেকে পাইনি নি না নিজেই ওকে ছেড়ে থাকতে পারব না, সেই ভরসা পাই নি কে জানে। ভাবলাম পড়াশোনাই তো করবে। আমার কাছে থেকে করলে ক্ষতি কি? করুক সারাদিন কলেজ। এখানে খাবে দাবে। থাকুক হস্টেলে, এখানে এসে আরাম করে ঘুমাবে। কি সমস্যা? আর আলাদা তো কিছু না। আমার ফ্ল্যাট টা মোটামুটি বলা যায় ক্যাম্পাসেই। কোন সমস্যা নেই। ওর বন্ধুরা তো মাঝে মাঝে এখানেই থাকে রাত একটা দুটো অব্দি।
কিন্তু ওকে ছাড়া যাবে না এখন হোস্টেলে একা। সেটা ওকে আমি একটু জোর করে বলতেই হয়ে গেল। প্রতিবাদ তো করত না কোন দিন। একটা অধিকার জন্মে গেছিল আমার ওর উপরে।
সকালে চা দিলাম ওকে। খেতে খেতে বলেই দিলাম ওকে
– শোন , তোকে আর ওখানে থাকতে হবে না বুঝলি? হস্টেল টা ছাড়িস না। ওটা থাক। কিন্তু তুই এখান থেকেই পড়াশোনা কর। এমনি তো আলাদা কিছু না। একি ক্যাম্পাস এ।
ও তাকিয়ে রইল আমার দিকে। মাঝে মাঝে ওর চোখ পড়া বন্ধ করে দি। মাঝে মাঝে তাকাই না ওর চোখের দিকে। কেমন একটা গভীর চোখ মনে হয়। আমি ঘুরে গেলাম উলটো দিকে। ও কিছু বলল না। তারপরে দুজনাই বেড়িয়ে গেলাম স্নান করে খেয়ে দেয়ে।
লাঞ্চের সময়ে ভাবছিলাম, ওকে এখানে থাকতে বললাম, ও আবার কিছু মনে করল না তো। কি জানি ও হয়ত বন্ধু দের সাথেই থাকতে চেয়েছিল। আর আমি ওকে জোর করলাম। নাহ ভালো করলাম না ব্যাপার টা। এই বয়সের ছেলে, অনেক কিছু চাওয়া থাকে। অনেক কিছু থাকে, সেই জন্য ওরা বাড়ির মানুষ জন কে এড়িয়ে চলে। ধুর জানি ও কিছু বলবে না। নাহ আজকে ভালো করে ওকে বলে দেব। ও যা মন চায় ও তাই করতে পারে। স্পেস না দিলে ওই বা সঠিক ভাবে বেড়ে উঠবে কি করে?
ওমা! ঘরে ফিরে দেখলাম, ও নিজের জামা কাপড়, বই পত্র নিয়ে এসে হাজির করে ফেলেছে।মনের আনন্দে বই গুলো কে গোছাতে গোছাতে ভাবলাম, একটা শেল্ফ কিনতে হবে। জামা গুলো কে দড়ি তে, দরজার পিছনে ঝোলাতে ঝোলাতে ভাবলাম একটা ছোট আলমারি ও কিনতে হবে। কিছুক্ষন আগেও আমার ওকে নিয়ে যে সন্দেহ টা ছিল, সেটা একেবারে উড়ে গেল মন থেকে।
পর পর দুটো বছর ও থাকল আমারি ঘরে। আমি রান্না করতাম। ওকে কি খাওয়াবো এই জন্য আমি অনেক রান্না শিখে গেছিলাম। একটাই থালা বাটি ছিল আমার। আরেক টা সেট কিনলাম ওর জন্য। একটু বড় কিনলাম, বাড়ন্ত ছেলে আমার মতন ছোট থালা বাটিতে খাবে নাকি? আরেক টা কাপ কিনলাম। বালিশ কিনলাম দুটো। একটা চেয়ার টেবিল কিনলাম। ওর জামা কাপড় রাখার জন্য একটা পুরোন কাঠের আলমারিও কিনলাম। আমার পড়াশোনা তো চলছিলই। সেও দারুন ভাবে ক্লাসে শাইন করল। সে আমি না থাকলেও করত।
আমরা যে মাসী বুনপো, অনেকেই বিশ্বাস করত না। ওর যারা কাছের বন্ধু তারাই বিশ্বাস করত। কেননা তারা আসত আমার রুম এ। হাজার দিন আমি এসে দেখতাম , আমার ঘরে গ্রুপ স্টাডির আসর বসেছে। আমি এসে ব্যস্ত হয়ে পড়তাম। ওদের কে চা করে দিতাম। কেউ না কেউ ডিস্পোসেবল চায়ের কাপ এনে দিত। ওরা পড়াশোনা করত রাত অব্দি। ওরা ডাইনিং এ কিছু পেতে পড়াশোনা করত। আর আমি রান্না করতে করতে পেপার লিখতাম শোবার ঘরে। আমার সময় ও কি দারুন ভাবে কাটত বলার না।
মাঝে মাঝে কেউ হয়ত বলল, মিমি আজকে রান্না কোর না তোমরা, আমরা চাঁদা তুলে খাবো। চলেও আসত কিছু না কিছু। হয় চাউমিন, না হলে বিরিয়ানি। আমিও চাঁদা দিতাম ওদের কে। একসাথে থাকার এমন আনন্দ আমি কখনো নিই নি। চিরকাল একাই থেকে এসেছি। এমন ও হয়েছে, ওরা সারারাত পড়াশোনা করে ভোরের দিকে হস্টেলে ফিরে গেছে। আর আমি ভোরে দেখতাম অর্জুন আমার জন্য চা করে নিয়ে এসে আমাকে তুলছে। যতদিন ছিল আমাকে এই ভাবে ছোট ছোট খুশী ও দিয়ে গেছে।

আসলে এটা সত্যি কথা যে ও ধীরে ধীরে আমার কাছে অভ্যাস হয়ে গেছিল। কখন হয়েছিল জানিনা । জানলে হয়ত নিজেকে আটকাতাম। কিন্তু কাজ শেষে ফিরে ওকে না পেলে কেমন যে করত মন টা বলে বোঝাতে পারব না। আর কেউ না জানলেও আমি জেনে গেছিলাম আমার ভালবাসা টা নিছক মাতৃ সম ভাল বাসা নয়।
কিন্তু ভালোবাসা তো ভালোবাসাই। এর তো পিতৃ সম বা মাতৃ সম হয় না। কিন্তু মাতৃ সম ভালবাসায়, শারীরিক ভাবে টান টা থাকে না। আমার যে নেই সেই কথা তো বলতে পারি না। বা বুঝতে পারি না। এমন না যে ওর সাথে আমার কোন ভাবে ইন্টার কোর্স করতে ইচ্ছে হয়েছিল। ওই সবে আমার ঘেন্না হয়। সে ইচ্ছে আমার হয় না। আর সে আমি তুলে রেখে দিয়েছি, আমি যাকে বিয়ে করব তার জন্য। যদি করি তবে সেই পাবে। কোন পুরুষের উপরে আমার কোন মোহ নেই। কিন্তু ওকে দেখতে ইচ্ছে করত। শারীরিক মোহ বলতে ওর পাশে শুয়ে ওকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করত। কিন্তু কোন ও দিন ও পারিনি জড়িয়ে ধরতে।
ওকে যে আমি প্রাণের থেকেও বেশী ভালোবাসি, সে নিয়ে আমার মনে কোন সন্দেহ নেই। আমিও দেখেছিলাম ওকে আমার ছেলের, নজর দিয়েই। কিন্তু ওকে আমার দেখতে ইচ্ছে করে সারাক্ষণ। সেটা আমি ব্যাখ্যা করতে পারি না। ওর মা ওকে ফোন করে প্রায় ই। ও কিন্তু বলে না ওর মা কে যে ও আমার কাছে আছে। এটা বলেছে আমরা একি ইন্সটিটিউট এ আছি। দেখা হয়। মাঝে মাঝে আমি ওকে খাওয়াই। কিন্তু আমরা একি ঘরে একি খাটে শুই এটা ও ওর মা কে বলে নি।
আমিও বলি না। বুঝেছিলাম, ও আমার ছেলের মত হলেও, বয়সের ফারাক আমাদের মাত্র ছয় বছর। দুজনাই যুবক যুবতী। এটা কেউ জানলে ভালভাবে মেনে নেবে না। বিশেষ করে বাড়ির লোকজন। কিন্তু আমরা দুজনাই জানি যে আমরা যথেষ্ট দুরত্ব বজায় রাখি। কিন্তু আমি কেমন অবসেসড হয়ে পড়েছি ওর উপরে।
এক এক দিন ও থাকে না রাতে। গ্রুপ স্টাডি করে হোস্টেল এ কিম্বা ল্যাব এ থাকে। আমার ঘুম আসে না ওকে পাশে না পেলে। বললাম না অভ্যেস হয়েছে ও আমার কাছে। কিছুই না কিন্তু পাশে থাকলে আমি ঠিক থাকি। ওকেও দেখি দুদিন গ্রুপ স্টাডি করার পড়ে, তিন দিনের দিন যে কোন অজুহাতে চলে আসে এখানে। আমরা কি একে অপর কে কোন ভাবে ভালোবেসে ফেলছি? হয়ত তাই।
অর্জুন নিজের ক্লাস শেষ হয়ে যাবার পরে চলে আসত, আমার ডিপার্ট্মেন্ট এ। নীচে অপেক্ষা করত। তা সে যত রাত ই হোক। আমি উপর থেকে দেখতাম, কখনো কিছু পড়ছে নীচে বসে, বা সিগারেট খাচ্ছে বা চেনা কাও কে পেলে গল্প করছে। আবার সন্ধ্যে হয়ে গেলে, বিলডিং এর ভিতরে ঢুকে কোন একটা আলোর নীচে পড়াশোনা করত। তবু ফ্ল্যাটে যেত না। আমাকে নিয়েই ফিরবে। কেমন একটা ইলেক্ট্রোভ্যালেন্ট বণ্ড এর মতন। মাঝে ফাঁকা, কিন্তু অসম্ভব টান।
একদিন আমার ডিপার্ট্মেন্ট এর একটা মেয়ে, আমার সাথেই থিসিস লিখছিল, কেলাসের উপরে। আমাদের ল্যাব এ আমরা একসাথেই টেস্ট করতাম। আমি বেসিক পার্টিকলস মুভমেন্ট নোট করতাম আর ও কেলাস এর ডাইভার্সন। আমাকে একদিন ও বলল
– নন্দনা, ওই ছেলেটা কে রে? তোর জন্য অপেক্ষা করে বাইরে প্রায় ই দেখি। তোর বয়ফ্রেন্ড নাকি? কার ভাগ্য খুলল বলা যাচ্ছে না বুঝলি , যেমনি তুই সুন্দরী। তেমনি ছেলে টা। উফফফফফফ মারাত্মক হ্যান্ডসাম। পারফেক্ট জোড়ি।
চোখ টা উলটে গেল সাগরিকার শেষ দুটো কথা বলতে বলতে। বুক টা ধড়াস করে উঠল সাগরিকার কথা শুনে। হ্যান্ডসাম কথা টা বলার সময়ে একটা লালসা আমি দেখলাম যেন। মনে মনে রাগ হলো। মনে মনে গাল ও দিলাম ওকে, ও হ্যান্ডসাম তো তোর কি? মেজাজ টা খিঁচরে গেল। গম্ভীর হয়ে গেলাম আমি।
ঠাণ্ডা স্বরে নিচের দিকে তাকিয়ে, নোটস লিখতে লিখতে বললাম
– ও আমার বোনপো। দিদির ছেলে।
তারপরে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম
– বড়দি।
– উপস, সরি!!!
– ইটস ওকে।
মাথা গরম হয়ে গেছিল। মেশিন অফ করে চলে এসেছিলাম ব্যগ টা নিয়ে দৌড়ে নীচে। এসেই দেখি মহারাজ হাসি মুখে দাঁড়িয়ে। ওই হাসি দেখে আরো মাথা টা গরম হয়ে গেল। আমি যে আমি, সেও ওই হাসি টার জন্য পাগল থাকি। অতো সবার সামনে হাসার কি দরকার? মুখে সে সব বললাম না কিছু। কিন্তু মাথা গরম হয়ে যাবার কারনে অর্জুন কেই বকে দিলাম খানিক।
– শোন, এবারে এলে, পিছন দিকে একটা বট গাছ আছে, সেখানে থাকবি। না হলে ভিতরে লাইব্রেরী তে এসে বসবি। না না লাইব্রেরী নয়। তুই বরং আমাকে কল করে নিবি। আমার কাজ শেষের জাস্ট আগে আসবি। বুঝলি???
ভাবলাম ওখানে আরো অনেক মেয়ে থাকবে। সাগরিকার মতন সরল সাধা সিধা মেয়ের যদি ওকে ভালো লাগে না জানি বাকি রা করবে। আর ও রাগ ধরল। ফেরার রাস্তা টা ওকে আমি আরও বকতে বকতে এলাম।কি দরকার আমার জন্য ওখানে যাবার। ওখানে ও আমাকে নিতে না গেলেও আমি ফ্ল্যাট এ ফিরব। ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু ও যথারীতি নীরব। আর ঠোঁটে এক চিলতে হাসি।
কি করে বলি ওকে যে, আমার পছন্দ নয় ওকে অন্য মেয়েরা ওই সব নজরে দেখুক। কি যে পায় এই শারীরিক খেলায় সবাই কে জানে? আর আমার বুনপো টা কেই পছন্দ হতে হয়? আর সব কি সুন্দরী মেয়ে। ওদের দেখে যদি অর্জুন ভেসে যায়? ছি ছি ছি। সত্যি বলতে আমি এই সেক্স ব্যাপার টা চিরকাল ই অপছন্দ করে এসেছি। আর অর্জুন তো বাচ্চা একটা ছেলে। সাগরিকার উপরে একটা ভালো ধারনা ছিল সেটা ভেঙ্গে গেল আমার একেবারে।

না না সেদিনে আরো বদ্ধমূল হয়ে গেছিলো, ওকে আমার কাছেই রেখে দিতে হবে। আর ওকে ছাড়া যাবে না। মেয়ে গুলো সব কি যে করবে ওকে নিয়ে কে জানে। ভাবতে পারলাম না। আবার রাগ গিয়ে পড়ল অর্জুনের উপরে।
– খবর্দার, কোন মেয়ে বন্ধুত্ব করতে এলে এড়িয়ে যাবি, বুঝলি?
সে চুপ করে আমাকে দেখছে আর হাসছে।
– এতে হাসির কি হলো?

– তুমি এতো রিয়াক্ট করছ কেন মিমি?

– করব না?

– কেন করছ? কি হল হঠাত?
বলতে পারলাম না ওকে সাগরিকার কথা টা। বললাম
– সে তোকে ভাবতে হবে না অতো। যা বললাম করবি বুঝলি? তুই ও কোন মেয়েদের দিকে তাকাবি না। আর ওদের সাথেও বন্ধুত্ব করার দরকার নেই অতো। আর বিশেষ করে মেয়েদের সাথে অতো হেসে কথা বলার কোন দরকার নেই তোর। মনে থাকবে?
– আচ্ছা বাবা বেশ। এখন তাড়াতাড়ি হাঁটো। খিদে পেয়েছে। দশ টা বাজছে।
খেয়ে দেয়ে ও শুয়ে ঘুমিয়ে গেল। রাতে ও ঘুমিয়ে যায় আর আমি ওকে দেখি। আজকেও দেখছিলাম। দেখতে দেখতে ভাবলাম, কেন যে আজকে এতো রাগ হলো আমার কে জানে। সাগরিকার লালসা ভরা চোখ দুটো খুবলে নিতে ইচ্ছে করছিল আমার। কই আমার তো লালসা নেই। ওদের হবে কেন? ও তো আমার বয় ফ্রেন্ড নয় যে হিংসে হবে আমার। তবে সাগরিকার ওই রকম চাহনি তে আমার হিংসে হবার কি আছে। অর্জুনের যখন গার্ল ফ্রেন্ড হবে তখন তো হতেই পারে। এই কথা টা ভাবতেই আমার গা টা যেন জ্বলে উঠল চিড়চিড় করে।
ওকে দেখছি আর ভাবছি। এতো সুন্দর মনে হয় কৃষ্ণ ই ছিলেন। তার পরে এই ছেলে টা। কিন্তু ও তো বিয়ে করবে একদিন। আমি তো সারা জীবন ওর পাশে থাকব না। তখন হলে হবে। যাক সে সব। যবে হবে তবে হবে। এখন তো ওকে বাঁচিয়ে রাখি ওই সব মেয়েদের থেকে। কিন্তু আমার কি? আমি তো ওর মাসী। ওর বিয়ে হচ্ছে ব্যাপার টা ভেবেই আমি চোখ খুলে নিলাম। সেটা ভাবতেও পারছি না কেন?
চোখ বুজলেও ওকে দেখতে পাচ্ছি। যেন অনন্ত সলিলে স্বয়ং নারায়ন সুখ নিদ্রা নিচ্ছেন। বা যেন বাবা ভোলানাথ, মা গৌরীর বকাঝকায় অতিস্ট হয়ে একটু বিশ্রামে আছেন। ঠোঁটের কোনে হাসি। যেন এই উঠে পড়ল বলে। না না এতটা ঠিক না। এ তো অবসেসন। নেশা। এতো কি ভাবে আমি ইনভল্ভড হয়ে গেলাম?
যে উত্তর টা মেনে নিলে এই সব প্রশ্নের উত্তর এক লহমা তেই চলে আসে, সেই উত্তর টা আবার আমার মন মানতে চাইছে না। যত বার আমার মনের মধ্যে আসছে, যে ওকে আমি শুধু মিমি হিসাবে নয়, একটা সাধারন মেয়ে হিসাবে আমি ওকে ভালোবাসছি বা পছন্দ করছি। ততবার ই নিজের উপরে ঘেন্নায় আমি সিটিয়ে যাচ্ছি। আর মন কে প্রবোধ দিচ্ছি, নাহ আমার প্রশ্নের অন্য উত্তর ও আছে। এটাই শেষ উত্তর নয়।
ওকে যত দেখছি ততই মনে তৃষ্ণা বাড়ছে আমার। এতোই তৃষ্ণা যে ভিতরের মিমি টা মরে যাচ্ছে। একটা রাক্ষুসী নারী জেগে উঠছে। কি যে করব ভেবে পাচ্ছি না। এমন অসম্ভব টান তৈরি হলো কি করে আমার মধ্যে? আচ্ছা, ওর কি টান আছে? হে ভগবান সেটা যেন না থাকে। সেটা থাকলে, কোন সম্পর্কই ভরসা যোগ্য থাকবে না আর। আশা করি নেই।আর যদি থাকে? তাহলে নিজেকে ঘেন্না করা ছাড়া আর কি করতে পারি? কারন যদি ও আমাকে ভালো ও বাসে তাহলে বলতে হয়, আমি ওর মিমি হবার সুযোগ নিয়েছি। আমি ওর মিমি না হলে ও কি আমাকে পাত্তাও দিতো? আমার মতন মেয়ে এই খানে অজস্র ঘুরে বেড়াচ্ছে। যারা ওর জন্যে হয়ত আমার মতই পাগল। নাহ ভাবতে পারছি না আর। মনে মধ্যে মারাত্মক ঝড়।
কিছু কিছু মানুষ থাকে, যাদের এমন অদ্ভুত ক্ষমতা থাকে। তাদের সান্নিধ্যের জন্য সবাই পাগল থাকে। জানে পুড়ে মরবে তাও পাগল থাকে। আমার ও সেই হাল হলো। জানি এ অন্যায়, পাপ। জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাব আমি। তাও সেই অনন্ত অনলে নিজেকে নিক্ষেপ করেছিলাম নির্দিদ্ধায়। ভাবিনি আমার কি হবে। র‍্যাদার, এইটাও ভাবিনি ছেলেটার কি হবে। সত্যি ই আমি রাক্ষুসী। বড়দি, মেজদি খারাপ কিছু বলত না আমাকে।
ওর চক্করে আমার দেড় বছরে শেষ হয়ে যাওয়া পেপার আমি দু বছর লাগালাম সাবমিট করতে। ইশ আমার তো ইচ্ছেই করছে না ওকে ছেড়ে যেতে। কিন্তু শেষ মেস আমাকে যেতেই হলো। খড়গপুরের জবের অফার টা ডিক্লাইন করে দিলাম ওর জন্য। ওর জন্য, কথাটা লিখলাম বটে, কিন্তু কারন টা আমি নিজেই। মনে হলো এখানে আমি থাকলে ও আমাকে ছাড়া আর কিছু ভাববে না। কারন যতই আমার ভয় বাড়ছে, অন্য মেয়েরা ওকে ছিঁড়ে খাবে, ওকে নষ্ট করে দেবে, তত ওকে বকাঝকা করছি , ততই দেখি ও বেশি করে আমার কাছে চলে আসছে। অন্য মেয়েদের ও ঘেঁষতেই দেয় না কাছে। আর ততই আমি অপরাধ বোধে ভুগছি। মনে হচ্ছে অন্য মেয়েরা না, ওকে আমিই নষ্ট করে দিচ্ছি।
ভিতরে রাক্ষুসী টা কে মেরে ফেলে, মিমি ই জয়ী হলো। দিন-রাত, শুতে-জাগতে, খেলতে-খেতে লড়াই চলল, এই দুজনের মধ্যে। ভিতরের মিমি টা রাক্ষুসী টা কে ক্ষত বিক্ষত করে একেবারে মেরে ফেলতে চাইল। কিন্তু আমার তখন ও জানতে বাকি ছিল যে, ইভিল মরেও মরে না। ইভিল জেগে থাকে মানুষের, মনে। তার লালসায়, তার লোভে, তার ভয়ে, তার অসততায়। কস্ট সইতে না পারার আকুতি তে বেঁচে থাকে দানব। কৃছসাধনের ভয়ে বেঁচে থাকে, ভোগের ভুত। সেটা সেদিন বুঝিনি, বুঝেছি পরে।
আমাকে চলে যেতেই হবে। এই সম্পর্ক স্থায়ী হলে, যে দগদগে ঘা টা হবে, সেটা সবাই দেখতে পাবে। সেই টনটনানি ব্যাথার কাতরানি, সবাই শুনবে। দুর্গন্ধের আভাস সবাই পাবে। ওর মা, আমার মা কাকি এরা কি ভাববে। ব্যাপার টা এতো মারাত্মক গভীরে ঢুকে যাবে দু বছর আগে ওর জ্বর হবার সময়ে আমি ভাবিনি।
ইউ পি র একটা বিশাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে আমার লেকচারার এর জব লাগল। রিসার্চ ওয়ার্ক ও করা যাবে। আমি কথাটা অর্জুন কে বলতেই ও চমকে উঠল। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল বহুক্ষন। আমি জানতাম না ও আমার থেকেও ব্রিলিয়ান্ট মাইন্ড রিডার। যে ছেলের চোখে হাসি লেগে থাকত, সেই ছেলের চোখে মনে হল, কোন প্রস্তর যুগের আঁধার। বুক টা আমার ধড়াস করে উঠল। পাশা পাশি বসে ছিলাম, কলেজের একটা জায়গায়। আমি অপেক্ষা করছি ও কি বলে সেটা শুনব। ধড়াস ধড়াস করছে আমার বুকটা। যেমন মাধ্যমিক, উচ্ছমাধ্যমিক রেজাল্ট বেরোনর আগে হত। ও চুপ আছে প্রায় অনেকক্ষণ। মনের মধ্যে ঝড় চলছে আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু বাইরে টা শান্ত একেবারে। আমি উদগ্রীব হয়ে আছি ও কি বলে শোনার জন্য। প্রায় ঘন্টা খানেক বাদে বলল
– হ্যাঁ তোমাকে তো যেতেই হবে।
বলে উঠে চলে গেল, আমার দিকে না তাকিয়েই। কোন কথা বলল না আর। চলে গেলো হস্টেলের দিকে, আমার ফ্ল্যাটের দিকে নয়। আমি ওইখানেই বসে রইলাম। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এল। জীবনে বুক টা এতো খালি মনে হয় নি যা আজকে মনে হল। তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে যতক্ষন ওকে দেখতে পাই।
বড্ড মন মরা হয়ে চলে গেলো ছেলেটা। আমার সাথে একটা কথাও আর বলল না। আমি জানি এখনি আবার জোর করে আমার ঘরে নিয়ে গেলেই ও যাবে। কিন্তু সেই জোর টা আমি করতে পারছি না আর। ভরসা পাচ্ছি না নিজের উপরে। ও নিজের জন্য কিচ্ছু বলবে না আমি জানি। বলেও না।
ওই খানে বসেই মনে পড়তে লাগল, কতদিন এমন হয়েছে, আমি পিরিয়ডের যন্ত্রণায় শুয়ে আছি রান্না বান্না করতে পারিনি। ও বেচারী এসেছে অনেক রাতে। না খেয়েই এসেছে এখানে খাবে বলে। এসে দেখে আমি শুয়ে আছি। তখনো বলে নি কিছু। আমি খাই নি তাই সেও না খেয়ে শুয়ে পড়েছে। সকালে উঠে, কিছু কিনে এনেছে আমাদের জন্য। ও ওই রকম ই। সাথে ছিল, সব সময়েই মন ভালো করা ঘটনা ঘটাত ও। কান্না পাচ্ছে খুব আমার। খুউউউউব।
ভালোবাসা কি একেই বলে? আমার নিজের থেকেও বেশী ওর চিন্তা হচ্ছিল তখন। যে রাস্তায় আমরা হাঁটছি, তাতে দুজনের দুঃখ বই তো কপালে কিছুই লেখা নেই। কেন বুঝতে পারছে না ও সেটা? আমার সাথে সারা জীবন থাকা, না ওর মা মেনে নেবে,না আমাদের পরিবার মেনে নেবে। আর কেনই বা মেনে নেবে? কত ব্রিলিয়ান্ট একটা ছেলে। হয়ত বিশাল চাকরী করবে। ওর মায়ের তো ইচ্ছে হবে একটা দারুন সুন্দরী কোন মেয়ের সাথে ওর বিয়ে দেবে। নাতি পুতির মুখ দেখবে। আর কোথায় আমি। কাঠ খোট্টা একটা মেয়ে। আর সব থেকে বড় কথা হলো,আমি ওর নিজের মাসী।
না না এই সব কি ভাবছি আমি। কিন্তু ছেলেটা এমন মন মরা হয়ে গেলে আমি কি ভাবে থাকি? ভাবতে তো পারছি না যে, ও ওর মায়ের ছেলে, ওর মা বুঝে নিক। আমি পালাই। জীবনে এতো কনফিউসড আমি কোন দিন ও হই নি। চিরকাল সোজা সাপটা থেকে এসেছি। ও আমার বুনপো না হলে আমি কবেই ওকে বলে ফেলতাম যে ওকে আমি ভালবাসি। কিন্তু বলতে পারছি না সেটা। এটা যে নিষিদ্ধ সম্পর্ক।
ওকে কোন দিন বলি নি আমার মনের কথা। তাই ও কি ভাবে আমাকে নিয়ে জানিও নি। আমার এই সিদ্ধান্তে ওর রায় কি সেটাও জিজ্ঞাসা করিনি। ওর রায় জানার ও দরকার নেই। ওর রায় জানতে চাইলে যদি জেনে যায়, আমি ওকে কি চোখে দেখি? ও ভয়ংকর স্টাবর্ন। ওর মাথায় এই ভুত টা চাপলে না জানি কি করে ফেলবে। পারছি না কান্নার দমক টা আর ধরে রাখতে বুকের ভিতরে। মনে হচ্ছে ডাক ছেড়ে কেঁদে দি এবারে। জানিনা কত রাত অব্দি আমি সেখানে বসেছিলাম। এসেছিলাম ফ্ল্যাট এ কোন রকম পা দুটো কে নিয়ে টানতে টানতে।
ফ্ল্যাটে ফিরে মনে হলো এ কোন মৃত্যুপুরী তে এলাম আমি। অর্জুন থাকত। সারাক্ষণ গম গম করত এই ছোট্ট বাসা টা। ওর জামা প্যান্ট, বাসি হয়ে যাওয়া শর্টস, বালিশের উপরে গেঞ্জি, বই খাতা পেন ছড়িয়ে রয়েছে। চারদিকে ওর উপস্থিতির চিহ্ন। মায় ওর গায়ের গন্ধ টা অব্দি পাচ্ছি আমি। ও ছিল সাথে, বুঝিনি ওর গুরুত্ব। আজকে যখন নেই এখানে তখন বুঝলাম গত পৌনে দুই বছর ও আমার কাছে কি ছিল।
চোখে আবার জল? রান্না বান্না খাওয়া দাওয়া দূরে থাক আমি সেই যে মেঝেতে বসলাম আর ওঠার ক্ষমতা টুকু রইল না আমার। বুকের মধ্যে যেন কি একটা হচ্ছে। আমি বুঝতে পারছিনা। ছটফট করছি আমি।একবার ভাবলাম, পারছি না এই কস্ট সইতে আমি। যাই ওকে ডেকে নিয়ে আসি। কিন্তু পরক্ষনেই ভাবলাম ডেকে আনা মানে তো ওকে আবার ভুল রাস্তায় নিয়ে আসা।
সারা রাত ভাবলাম। ভেবে এটাই বের করলাম, আমি ওকে পৃথিবীর যে কোন কিছু থেকে বেশী ভাল বাসি। এতোটাই ভালোবাসি যে, ওর ভালোর জন্য ওকে ছেড়ে দিতে আমার কোন দুঃখ হবার জায়গা নেই। আমি যদি ওকে না ছাড়ি ও যদি আমাকে ভালবাসে তবে আমাকে পাবার জন্য ও যা খুশী করতে পারে। আর ওর যদি কোন ফীলিংস না থাকে আমার উপরে তবে তো কাজ মিটেই গেল। কিন্তু যদি ফীলিংস থাকে তবে আমি চলে যাওয়া টা বা ওকে এক্সেপ্ট না করা টা ওর কাছে বড় ধাক্কা হতে পারে। সেক্ষেত্রে ওকে বুঝতে হবে নিজের মাসির সাথে থাকা টা একটা নিষিদ্ধতার মধ্যে পড়ে। এটা সমাজ মেনে নেয় না। আমাদের সম্পর্কের কোন পরিনতি নেই। দুজনের জীবনে অশেষ দুঃখ ছাড়া কেউ কিচ্ছু পাব না।
চলবে —————————



from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/3GOxqLc
via BanglaChoti

Comments