গল্প=০৭৮ মন BY (Nandanadas1976) (পর্ব-২) [সমাপ্ত]

গল্প=০৭৮

★★★–মন–★★★
BY- Nandanadas1976

পর্ব-২ & শেষ পর্ব
—————————

এগারো

বুকে পাথর বেঁধে, ছেড়ে এলাম খড়গপুর। বলা ভালো পালিয়ে এলাম। ভোর বেলায় কাউকে কিচ্ছু না বলে । কত কিছু করার ছিল। ইন্সটিটিউট যাবার ছিল। কত কিছু এটেস্টেড করানোর ছিল। থিসিস সাবমিশন এর টেম্পোরারি সার্টিফিকেট নেবার ছিল। বন্ধুদের সাথে দেখা হবার ছিল। আর অর্জুন কে বলার ছিল কত কথা। কত কিছু বলে দেবার ছিল। কিছুই পারলাম না। মনে হলো, একবার দেখা হয়ে গেলে ওর সাথে , আমি আর সামলাতে পারব না নিজেকে।

ট্রেনে উঠেও মন বলছিল, ফিরে যাই। থাক আমার ইউ পি র জব। দরকার নেই। যে কাজ আমাকে খুশী করতে পারবে না, সেই কাজ নিয়ে আমি কি করব। ফিরে যাই যেখানে অর্জুন আছে। আর কিছু না পাই খুশী তো থাকব। ট্রেন হাওড়া পৌঁছন ইস্তক মনে মধ্যে এই দ্বন্দ চলেছে। মাথা বলছে দরকার নেই, জীবনে এই দুঃখ যেচে ডেকে আনার। আর মন বলছে – চলে এসে ভালো করলি না কাজ টা, ভালো করলি না।

কারোর থেকে দূরে যেতে এর থেকে বেশী দুঃখ আমি কোন দিন ও পাই নি। দিল্লী যাবার পুরো রাস্তা টা আমি কেঁদেছি। পাগলের মতন কেঁদেছি। জব জয়েন করেও শান্তি পাই নি। বার বার হস্টেলে ফোন করে ওর খবর নিয়েছি। ওর বন্ধুরা বুঝেছিল সেটা। রাহুল বলে একটা বন্ধু ছিল ওর। ওকে ভালবাসত। ওকেই ফোন করতাম বেশি। ভাল ছেলে। আমাকে সব খবর দিত। সোজাসুজি ওকে ফোন করতাম না। আর সত্যি বলতে কি আমার ওকে ফোন করার মুখ ছিল না।

তবে মন ঠিক করে নিয়েছিলাম ও যদি সামলে নেয় নিজেকে তবে খুব ভাল কথা। আর যদি না পারে, তবে আমার কাছে আর কোন রাস্তা খোলা নেই। আমি ফিরে যাব। কিন্তু চাইছিলাম যাতে ও সব কিছু মানিয়ে নিতে পারে। জীবন টা যে, মিমির বাইরেই বেশী আছে সেটা যেন ও বোঝে। আমি তো জীবনে ভাবিনি, আমার জীবনেও এমন একটা পরিস্থিতি আসবে। আর তাতে আমি শেষ দিন অব্দি জ্বলে পুড়ে মরব। তখন যুবতী ছিলাম, মনে জোর ছিল সাংঘাতিক। সে সব এখন হলে আর পারতাম না।

সে এক অন্য রকম জ্বলা। অন্য রকম তিলে তিলে শেষ হওয়া। যে শেষ হচ্ছে সে বোঝেও না। অনেক টা চুল্কুনির মতন। যখন চুলকানো হয়, তখন মনে থাকে না কিছু। আরাম পায় লোকে। ইচ্ছে মতন চুলকে সেই সময়ের মতন আরাম পায়। কিন্তু সেটা যে কখন ঘা হয়ে গেছে টের পাবার পরে আর কিছু করার থাকে না।

হাজার দিন সন্ধ্যে বেলায় দৌড়তে দৌড়তে নিজের কোয়াটার এ ফিরতাম এই ভেবে যে অর্জুন আছে। কি খেল, পড়াশোনা করছে কিনা। সিগারেট বেশী খাচ্চে কিনা। কোয়াটার এর দরজার সামনে এসে ভুল বুঝতে পারতাম। মন টা শত শত খন্ড হয়ে ভেঙ্গে পড়ত আমার। রাতে ঘুমতে ঘুমতে উঠে পড়তাম ধড়মড় করে। পাশে সে নেই কেন। চারদিকে তাকাতাম। মনে পরত, সেই সন্ধ্যে বেলায় মুখ টা কালো করে এক পা এক পা করে ওর চলে যাওয়া। পরক্ষনেই মনে পড়ত সে এখানে নেই। কি যে একটা মানসিক পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গেছি বলার না।

কিছুদিন পরে রাহুল যখন বলল, ওর গুগলে চাকরি হয়েছে আর ও বেশ খুশী হয়ে কলকাতা গেছে সেদিনে আমার বেশ আনন্দ হয়েছিল। পাগল টা কে দেখতে ইচ্ছে করছিল খুব। কিন্তু সেই সাহস আমার আর নেই। আমি জানি ওকে কস্ট দিয়ে এসেছি। আমি ওকে জিজ্ঞাসা ও করে আসিনি যে আমাকে ও কত টা ভালবাসে। হয়ত ওর কোন প্ল্যান ছিল । সেটা আমি জিজ্ঞাসা করার সাহস ও জোটাতে পারিনি। না পারাই উচিৎ। যাতে ওর কেরিয়ার আর জীবনের ক্ষতি হবে তেমন কাজ আমি ওকে ভালবাসার পরেও করি কি করে?আমার রাতের দুঃস্বপ্ন গুলো আর তাড়া করে বেরাতো না। ঘুম ভেঙ্গে যেত না আমার। মনে হতো ও খুশী তে আছে।

ওখানে কাজ তো করতাম, আর মন দিয়েই করতাম। জীবনে শত ঝড় এসেছে আমার, আর ততই আমার জেদ চেপেছে পড়াশোনা আর কাজের উপরে। কিন্তু কোন সম্পর্ক কে মেনে নিতে পারিনি আর। কত পুরুষ আমার রূপে জ্বলেছে। আমি পাত্তাও দিই নি। মনে হয়েছে, যে আসলেই জ্বলছে তার মলম না দিয়ে আমি কারোর হতে পারব না। সেই ইচ্ছেই করেনি। গা ঘিনঘিনিয়ে উঠত অন্য পুরুষের কথা ভাবলে। চোখ বুজলেই, আমার বিছানায় ওর খালি বুক টা মনে পড়ত। ভাবতাম ইশ একবার যদি বুকে মাথা টা দিতে পারতাম।

রাহুলের থেকে আমি নিয়মিত খবর নি। আমি জানি ও ইউ এস এ চলে গেছে জব নিয়ে। রাহুল ও ইউ এস এই আছে। ওদের মধ্যে যোগাযোগ আছে। আমি জিজ্ঞাসা করি ওর কোন গার্লফ্রেন্ড আছে কিনা। রাহুল প্রতিবার ই আমাকে নিরাশ করে। বলে – না গো মাসী, আজকে আমার মনে হয় ও তোমাকে সত্যি করেই চেয়েছিল, বা এখনো চায়। আর কিছু মনে কোর না, তুমিও ওকে খুব ভালবাস।

আমার কি দুর্গতি!! ছোট একটা ছেলের সাথে আমাকে এই সব কথা বার্তা বলতে হচ্ছে। রাহুলের ওই কথার জবাব দিতে পারিনি আমি। কিন্তু ধীরে ধীরে ওকে ফোন করা কমিয়ে দিয়েছিলাম আমি। হয়ত পালিয়েছিলাম রাহুলের প্রশ্ন থেকে। কারন জবাব তো ছিল না। রাহুলের ও সম্ভবত ভাল লাগত না আমি ফোন করলে। তাই সেও আমাকে কোন দিন আর ফোন করে নি।

ইতিমধ্যে, আমার পড়ানোর বেশ নাম ডাক হয়েছে। আমার রিসার্চ নিয়ে বেশ কটা সেমিনার সারা ভারতে আমি এটেইন করেছি। তাই আমার কাছে, দেবতার আশীর্বাদের মতন জব অফার এলো সেখান থেকে যেখান থেকে আমি পাশ করেছিলাম আমার গ্রাজুয়েশন। ভালো লাগছিল না আমার আর ওখানে। আমি লুফে নিলাম অফার টা। কলকাতায় রিসার্চ এর সুযোগ আরো বেশি। আমি কলকাতা চলে এলাম।

ভাবি এখন, তখন সব করেছি, কিন্তু এক রাশ কষ্ট নিয়ে। কস্ট টা বুঝতাম না আমি কাজের মধ্যে থাকলে। বুঝতাম সেটা রাতে শুয়ে। একটা ব্যাথা বুকে। কিন্তু জানিনা কেন, এতোই মিস্টি সে ব্যাথা যে পেতেও ইচ্ছে করত। অর্জুনের সাথে হারিয়ে যেতাম কোন অচিন দেশে। কি যে খুশী হতাম বলার না। বা কোন কাল্পনিক দৃশ্য কল্পনা করে নিতাম। সে সব বলতে বা লিখতে লজ্জাই লাগে। কিন্তু সেই সব কল্পনায় মন টা একেবারে খুশী তে ভরে উঠত। মনে হতো সে তো খুশী তে আছে। সমস্যা কি, মনে মনে ওকে নিয়ে হারিয়ে যেতে? আবার পরক্ষনেই যখন জানতাম যে এটা কল্পনা, একটা ব্যাথায় ভরে যেত মন টা। হয়ত লিখে বোঝাতে পারছি না আমি সেটা।

কিন্তু কলকাতায় এসে আমার লাভ হলো দারুন। এখানে এসে জীবনের অন্যতম খুশির ঘটনা টা ঘটল। আমি যেদিন জয়েন করেছিলাম কলকাতায়। সেদিনে আমি একটা সেমিনার শুনতে গেছিলাম। চমকে উঠেছিলাম এন্যাউন্স টা শুনে। চোখের জল বাগ মানছিল না আমার। ফেলোশিপ দিচ্ছেন, সুবর্না সেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের, পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রধান।

অনুষ্ঠান শেষে, আমি দিদির সামনে দাঁড়াতেই দিদি প্রথম টা চিনতে পারে নি আমাকে। কোন ছোট বেলায় শেষ দেখেছিল আমাকে। রোগা লিকলিকে, ছেলেদের জামা প্যান্ট পরা, মাথা ন্যাড়া, কালো একটা মেয়ে। আর ততদিনে মারাত্মক সুন্দরী হয়ে গেছি আমি। আর ইউ পি তে থাকতে থাকতে, আমি কলেজ করতাম শাড়ি পড়ে। বয় কাট চুল বদলে, ঘাড় অব্দি করে নিয়েছিলাম। কিছুক্ষন পড়ে আমাকে চিনতে পেরে দিদি কি করবে খুঁজে না পেয়ে, দৌড়ে এসে বুকে টেনে নিয়েছিল। ভাবছিলাম, একেই বলে ভালোবাসা।

জানিনা দিদির বুকে কতক্ষন কেঁদেছিলাম। দিদিকে এতো বছর পড়ে খুঁজে পাবার আনন্দের কান্না, নাকি জিবনের সব থেকে ভরসার জায়গায়, নিজের সব কস্ট উজার করার কান্না। শুধু কাঁদছিলাম। দিদির চলে যাওয়া থেকে শুরু করে সব কটা ঘটনা মনে পরছিল তখন আমার। মায় বাবার কাছে মার খাওয়া টা অব্দি। অর্জুনের সাথে ব্যর্থ সম্পর্ক , ওকে হারানো সব ই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল তখন। কান্না যখন থামল আমার অনেকেই আশে পাশে দাঁড়িয়ে গেছে। দুই ম্যাডাম একে অপর কে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে কেন, সেটা তো কেউ বুঝবে না। দিদি আমাকে একবার ও থামায় নি। হয়ত কাঁদতে দিচ্ছিল। জানে, বোন টা তার পাগলী।

একটা ঢাউস গাড়ি দিদির। আমি আর দিদি পিছনে বসে যাচ্ছি। মাঝে মাঝেই দিদি কে জড়িয়ে ধরছি আমি। দিদিও মায়ের মতন আমাকে বুকে টেনে নিচ্ছে প্রতিবার। মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। প্রথম কথা বলল দিদি

– আমার বোন টা যে এমন ভয়ঙ্কর সুন্দরী আমি তো ভাবতেই পারিনি।

কথা টায় আনন্দের বদলে লজ্জাই লাগল বেশি আমার। আমি তখনো ফোঁপাচ্ছিলাম। বললাম

– ললিত দা কেমন আছে?
– নিজেই দেখবি চল।
– গ্যারেজ করে এখনো?
– হুম। করে।

বাড়ি পৌঁছে, ভিতরে ঢুকে দেখলাম, দিদি ললিত দাঁড় জন্য বিশাল বাড়ি বানিয়েছে। দিদি ঢুকতেই, একটা বছর তিনেকের বাচ্চা ছুটে এসে দিদিকে জড়িয়ে ধরল। দিদির ছেলে? ও মা গো কি মিত্তি। আমি হাত বাড়াতেই আমার কোলে ঝাঁপিয়ে চলে এল সে। দিদি বলল তুই একটু বস, আমি তোর ললিত দা কে ডেকে আনি। তা করতে করতেই ললিতদার মা এলেন। আমি প্রণাম করলাম। আমার চিবুকে হাত দিয়ে চুমু খেলেন কাকিমা।

আমি দিদির ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলাম,

– কি নাম তোমার?
– সুবর্ন।
– ও মা কি মিত্তি নাম। আমি কে বলত?
– মিমি।
মিমি ডাক টা শুনে বুকের ভিতর টা কেমন করে মোচড় দিয়ে উঠল , বলে বোঝাতে পারব না। মুখে বললাম,
– অ্যাঁ, তুমি আমাকে চেন?
– হুম চিনি।
– কি ভাবে?
– মা আমাকে দেখিয়েছে তোমাকে টিভি তে।

ললিত দা এল। আমি সুবর্ন কে সোফা তে বসিয়ে, ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম ললিত দা কে। ললিত দা মানুষ নন, উনি দেবতা। চোখের জল বাগ মানছে না আমার। প্রণাম করলাম ললিত দা কে। দিদিকেও করলাম প্রণাম। জীবনে প্রথম। ললিত দা তো কোন কালেই যে খুব কথা বার্তা বলেছে এমন না। কাজেই সে বসে রইল চুপ করে আর হাসি মুখে আমাদের গল্প শুনতে লাগল।

আর সারা রাত ধরে দুজনের সাথে গল্প করলাম আমি। সুবর্ন কে নিজের কাছে রেখে ঘুম পারালাম। কত কথা বললাম দিদি কে। সব বললাম। শুধু অর্জুনের ব্যাপার টা চেপে গেলাম। আর সেই ব্যাপার টাই আমাকে বার বার দিদিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে বাধ্য করছিল।

বললাম ভাই ও কলকাতায় ইঞ্জিয়ারিং পড়ে এখন ভুবনেশ্বর এ আছে। এক এক করে দিদি সব জানল আমার থেকে। বড়দি, মেজদি, ইন্দু দি, চাঁদ কারোর কথাই বাদ গেল না। বাবার কথাও জিজ্ঞাসা করল দিদি। শুধু অর্জুনের ব্যাপার টা দিদি তুলল না। জানিনা কেন। আমিও বললাম না দিদিকে কিছু। কিছু দিনের মধ্যেই আমি নিয়ে গেলাম দিদিকে বাড়িতে। মা কাকিমার তো দিদিকে জড়িয়ে ধরে কান্নার শেষ নেই। ললিত দা যায় নি। কিন্তু মা বাবাকে দিয়ে ফোন করা করিয়েছিল ললিত দা কে। ক্ষমা তো চায় নি, কিন্তু যা হয়েছে ভুলে আসতে অনুরোধ করেছে। ললিত দাও বলেছে সে যাবে।

বয়েস হয়ে গেলো আঠাশ। আর দিদির কথায় এমন সুন্দরী বোনের পাত্র আসবে না তাই কি হয়? অনেক পাত্র আসছিল। আর আমি ইন্টারেস্ট নিচ্ছিলাম না। মা আর দিদিরা মিলে অনেক পাত্রই আনল। সবাই উচ্চ প্রতিষ্ঠিত। পছন্দ না হবার কিছু ছিল না। কিন্তু আমার মনে তো অন্য কোন পুরুষ ছিল না। একজনের ছবি ই আঁকা হয়ে আছে। অমন সর্বাংগ সুন্দর পুরুষ তো আমি আর দেখলাম না। যাকে মন দিয়েছি, তাকে না পেলে আমার আর কিসে মন বসবে? তাকে পাব না জানি। তাই আর আমার কিছুতেই আগ্রহ নেই।

ছোড়দি কে বললাম একদিন

– দিদি আমার জন্য পাত্র দেখিস না প্লিস।
– কেন রে?
– নাহ আমার ভালো লাগে না
– কেন সেটা তো বলবি। কাউকে পছন্দ করিস?
– না না । সে সব না। কিন্তু আমার ভাল লাগে না

দিদিকে বলি কি ভাবে আমার মনের কথা। যাকে ভালো লাগে শুনলে তো বোম্ব ফাটবে। দিদি হয়ত আমাকে মেরেই ফেলবে। দিদি কিছু বলল না। শুধু দিদিদের আর বাড়িতে বলে দিল এখন এই সব বন্ধ রাখতে। আমি দিদির বাড়িতে তো থাকি না। কিন্তু কাছেই ললিত দা একটা খুব দারুন বাড়ি আমাকে দেখে দিয়েছে। সেখানেই থাকি।

সেদিন রাতে দিদির বাড়ি থেকে ফিরে, মনে হলো একবার রাহুল কে ফোন করি। কতকাল খবর পাই না তার। ইশ যদি একবার গলা টা শুনতে পেতাম আমি তার। আবার দু বছর আমার চলে যেত সুখে। কিন্তু করতে পারলাম না ফোন টা। মারাত্মক মিস করছি অর্জুন কে। ঠাকুর কে বললাম, এমন একটা ছেলেকে ভাল লাগালে, সেখানে কিছু করার নেই। এই রকম রোজ ই ভাবি ফোন করব। অর্জুনের নাম্বার টাও আছে আমার কাছে। কিন্তু ভয়ে করতে পারি না। যদি ও কিছু বুঝতে পারে। গোয়ার্তুমি করে আমাকে নিয়ে। কি করব বুঝতেই পারি না। কিন্তু এটা বুঝে গেছি পুরো জীবন টা আমার এই ভাবেই কাটবে।

বলেছিলাম না, পুড়তে অন্য মজা। সেই আনন্দের কোন তূলনা নেই। নিজের মানুষ টার জন্য কস্ট পেতেও অন্য মজা। সে কষ্টের কোন ভাগ আমি কাউকে দেব না। এ হলো মেয়েদের একান্ত নিজস্ব। তাই

একদিন রাহুল কে টেক্সট করলাম। – প্লিস লেট মে নো, হাও ইজ অর্জুন।
—————————

বারো

ভাগ্যের কেমন অদ্ভুত পরিহাস। এখন মনে হচ্ছে সব ঠিক ঠাক। নিজের জব এখানে। দিদি রা এখানে। সবাই কি সুন্দর এক হয়ে গেছি। বাড়িতে আমার বেশ গুরুত্ব এখন। বাবাও বলে নাকি মাকে, নান্দু টা কে আসতে বোল। কতকাল আসে না। এই গুলো শুনলেও কান্না পায়। না না দুঃখে না, আনন্দে। এতো আনন্দ, আর সে নেই। আমি যে কিছুই এর উপভোগ করতে পারছি না। ইশ থাকলে কি ভালই না হতো। ছেলেটা সব সময়ে আমাকে মার খেতেই দেখল। কোন দিন দেখল না তার মিমিও আনন্দে আছে। সত্যি করেই কি তার মিমি আনন্দে আছে? ওকে ছাড়া আনন্দ তো আমার লাগেই না। বরং ও আছে কাছে, শত দুখেও মনে হয় আনন্দে আছি।

যাই হোক, রাহুল কে টেক্সট টা করে অপেক্ষা করে বসে আছি। এক দিন গেলো, দু দিন গেলো, কোন উত্তর এলো না। রোজ ই সকালে উঠে ফোন দেখি। ভাবি কোন উত্তর আসবে। আসে না কোন উত্তর। ভিতরের ছটফটানি টা আমার বাড়ছে। অনেক দিন চুপ থাকার পরে আর পারলাম না । যাকে জীবনে ফোন করতাম না সেই দিদি কে ফোন লাগালাম । মানে বড়দি কে। সবাই কেমন আছে জিজ্ঞাসা করার পড়ে অর্জুনের কথা জিজ্ঞাসা করতেই, দিদি বলল- দিদিও গত দশ দিন তাকে ফোনে পায় নি।

আমার ভিতরের পাগলামো টা বেড়ে গেলো। দিদিকে দেখালাম না ব্যাপার টা কিন্তু তারপর থেকে আমি রোজ ই ফোন করি, কোন উত্তর পেল কি না। আরো দশ দিন গেলো। দিদির প্রায় কাঁদো কাঁদো অবস্থা। আমার অবস্থাও তথৈবচ। দিদি ফোনে কাঁদে। আর আমি ফোন রেখে কাঁদি। কেমন যেন হাত পা আসছিল না আমার শরীরে। ক্লাস করাতে ইচ্ছে করত না। দুজন স্কলার ছিল, ওদের দিকেও মন দিতে পারছিলাম না। রাতে ঘুম উড়ে গেল আমার। নাহ আর অপেক্ষা করা ঠিক না। রাহুল কে ফোন টা করেই দিলাম

– হ্যাঁ মাসী বল
– সরি তোমাকে ডিস্টার্ব করলাম ।
– না না ।
– বলছি, দেখো, অর্জুনকে গত দিন কুড়ি ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। আমাকে বলবে ও কোথায় থাকে? আমি সেখানে যাব
মনস্থির করে নিয়েছি। ছেলেটা ইম্পর্ট্যান্ট, আমার ইগো বা সমাজ নয়।
– ও থাকে মিশিগান এ। কিন্তু ওখানে ওকে কোথায় খুজবে মাসী?
– কেন? ওর অফিসের ঠিকানা দাও। আমি যোগাযোগ করে নেব।
– সে দিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু আমাকে একবার খোঁজ নিতে দাও। আমি পরশু বিকালে তোমাকে জানাচ্ছি। যদি খোঁজ পাই তো বলে দেব, আর না পেলে অফিসের ঠিকানা আর সব কিছু তোমাকে জানিয়ে দেব।
– বেশ

শেষ কথাটা বলতে গিয়ে আমার গলা টা কেঁপে গেল। ফোন টা রেখে হাপুস নয়নে কাঁদলাম। জোরে জোরে ডুকরে ডুকরে। কত অজানা ভয়, কত চিন্তা। বুকের ভিতর টা ধড়াস ধড়াস করছিল মারাত্মক ভাবে আমার। কি জানি কেমন আছে ছেলেটা? কবে যে পরশু সন্ধ্যে বেলা আসবে?

আমি পরের দিন আমার কলেজ কতৃপক্ষ কে আরজেন্ট জানিয়ে ভিসার এপ্লাই করে দিলাম। ওরা ব্যবস্থা করে দেবে। বলে দিলাম যত দ্রুত করতে পারে ততই ভাল। আমি ই যাব। ছোড়া কে কান ধরে নিয়ে আসব। মায়ের ছেলেকে মায়ের কাছে ফেরত দেব। বলব আর যেতে হবে না বাইরে। থাকুক এখানে আমার চোখের সামনে। বিয়ে করুক সংসার করুক। থাকতে হবে না অমন ছেলেকে বাইরে।

যেদিন কে আমাকে খবর জানাবে বলেছিল রাহুল, সেই দিন আমি দুপুর থেকে অপেক্ষা করছি ফোনের। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যে হলো, ফোন আর আসে না। আমি এবারে নিজেই ফোন টা করব ভাবছি। তখন দরজায় কলিং বেল বাজল। দৌড়ে গেলাম আমি দরজা খুলতে। দিদি হবে।

কলিং বেলের আওয়াজে দরজা খুলতেই আমার বর এল। আজকে বেশ তাড়াতাড়ি।
– কি ব্যাপার? আজকে বেশ তাড়াতাড়ি?
আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে খানিক চটকে নিয়ে বলল
– তোমাকে মিস করছিলাম। ভাবলাম তোমার কলেজে চলে যাই। তারপরে ভাবলাম আজকে বুধবার, আমার মহারানীর তো স্টাডি লিভ থাকে
– বাবাহ আমার ও দিন ক্ষনের হিসাব ভালই রাখ দেখি আজকাল?
– হুহু বাওয়া। বললে হবে? আমার গুণ্ডা গুন্ডির মা তুমি
– আহা। কি কথা।
আমি জল দিলাম। জল খেয়ে বলল, চল কোথাও ঘুরে আসি।
আমি অবাক। মানে অবাক ঠিক নই। ও এই রকম ই। কোন প্লান ছাড়াই কাজ করে । বললাম
– কোথায়?
– এই ধর গাড়ি নিয়ে চলে যাব মন্দার মনি।
– পাগলা। কাজ নেই আমার? মেয়েটার সামনে পরীক্ষা, আমার কলেজে ,এক্সাম চলছে, সেই খেয়াল আছে?
– ও তাই বুঝি। ইচ্ছে করছিল তোমাকে আরো কাছে পেতে।
আমি এদিক ওদিক কাজ করছিলাম। ওর গা থেকে পোশাক টা খুলে হ্যাঙ্গারে রাখ ছিলাম। কাজ করতে করতেই বললাম,
– আমি কি ভাবে দূরে আছি, জানতে পারি কি?

– সে তুমি বুঝবে না। তোমার শাড়ির আঁচল উড়বে হাওয়ায়। এই সুন্দর সুগন্ধি কেশ আমার মুখে চোখে পড়বে হাওয়ায় উড়ে। সে একটা আলাদা রোম্যান্টিক ব্যাপার।
– হ্যাঁ আর চুলে জট পড়বে হাওয়া তে। এই শোন তুমি যতবার এই রকম রোম্যান্টিক হয়েছ, ততবার গুণ্ডা গুন্ডি এসেছে আমার পেটে। খবরদার ওই সবের নাম করবে না
– আরে ধুর। সে তো আমি ইচ্ছে করে দিয়েছি। একটা পরিবারে চারটে পুঁচকে না হলে জমে নাকি
– আর তাদের মা কে হাড় জ্বালিয়ে খেতে পারলে আরো জমে!!!
– হুম। তাদের মা পাগল হয়ে ঘুরে বেড়াবে। আর আমি মাঝে মাঝেই তাদের মা কে এই ভাবে জড়িয়ে ধরে কোলে তুলে নেব
এই বলে এগিয়ে এসে আমাকে কোলে তুলে নিল আমার বর। আমিও গলা জড়িয়ে ধরলাম। জানিনা এই জন্যেই হয়ত লোকটার প্রেমে আমি পাগল। আমাকে কাছে পেলেই, কি ভাবে আমার সাথে লেপ্টে থাকবে সেই চিন্তায় ঘোরে। বললাম
– এখন না। দিদি আর ললিত দা আসছে সুবর্ন কে নিয়ে।
আমার চুলে নাক টা ঢুকিয়ে দিয়েছে বর। জড়ানো গলায় বলল
– উম্ম আমি কি করব? আমার এখন তোমাকে দেখেই প্রেম পেয়েছে।
– উফফফ ছাড়ো না। রাতে করেও হয় না?
– সে তো সেক্স করি। এখন প্রেম পাচ্ছে
– আহা ছাড়ো না
– না
কলিং বেল বাজল। দিদিরা এল।

দৌড়ে গিয়ে দরজা খুললাম আমি। ভেবেছিলাম দিদি এলো মনে হয়। কিন্তু খুলেই যা দেখলাম তাতে আমার অজ্ঞান হয়ে যাবার অবস্থা। একী !!! অর্জুন তুই!!!!!!

কোন কথা বলল না অর্জুন। ঢুকে এলো ঘরে। আমি দরজা বন্ধ করে দিলাম। চীৎকার করে উঠলাম। মনের মধ্যে অজস্র প্রশ্ন। ওকে দেখে রাগ হচ্ছে প্রচন্ড, আনন্দ হচ্ছে সীমাহীন। মনে হচ্ছে মাথা ফাটিয়ে দি জানোয়ার টার। আবার মনে হচ্ছে যাক বাবা ফিরল। রেখে দি নিজের কাছে। আবার হচ্ছে তীব্র অভিমান। এতোদিন বাদে মনে পড়ল? আমি তো রোজ ওকে ভেবেছি। পাগলের মতন ভেবেছি। এতো দিনে আমাকে মনে পড়েছে। কিন্তু হলো উলটো টা। চীৎকার করে উঠলাম আমি

– কীরে তুই এতো দিন কোথায় ছিলিস। বাড়ির কেউ তোকে পায় কেন পায়নি? কি পেয়েছিস তুই? সবাই কে এমনি ভাবে তিলে তিলে মারবি?

সাথে একটা ঢাউস ব্যাগ। বুঝলাম ও বাড়ি যায় নি। সোজা এয়ারপোর্ট থেকে আমার কাছে এসেছে। আবার চীৎকার করলাম

– কি রে বাড়ি যাস নি কেন? সব কটা লোক কান্না কাটি করছে। কি রে বল?? কি রে? উত্তর দিচ্ছিস না কেন?? আমি মরে যাব কোনদিন তোর জন্য। কি রে ?????

কাছে গিয়ে রাগে, দুঃখে আনন্দে ওর বুকে কিল মারতে শুরু করলাম আমি। ওকে দেখে খুশী তে পাগল হয়ে গেছিলাম একেবারে।মনের আনন্দে কোথায় বুকে নিয়ে আদর করব তা না, মারতে শুরু করে দিলাম। ও কিছু বলল না আমাকে। কিল গুলো খেল অকাতরে। আমার হাত টাও ধরল না। কেমন একটা ভাব লেশ হীন মুখ। মুখের সেই ঔজ্জ্বল্য যেন হারিয়ে গেছে। চোখে সেই আঁধার।
শুধু আমার দিকে তাকিয়ে বলল

– আমার খুব ঘুম পেয়েছে। তিন দিন ঘুমোই নি।

আমি অবাক হয়ে গেলাম। সাথে ভয় লাগল তীব্র। ওর দিকে তাকিয়ে দেখলাম, এ তো ঠিক লাগছে না আমার। নাহ বেশী প্রশ্ন নয় এখন। ওর ঘুম দরকার। ওকে বললাম স্নান করতে। আমি কোন রকম দুটো গরম ভাত, মাছ ভাজা আর আলুভাতে দিয়ে খাইয়ে দিলাম ওকে। কোন কথা না বলে আমার বেড রুম এ গিয়ে শুয়ে পড়ল। ঘুমিয়ে গেল অকাতরে।

কিন্তু আমি পড়লাম বিপদে। ও যে এখানে এসেছে, সেটা অবশ্যই ওর মা জানে না। ভাবলাম, আমি আগে জানি। চোখ মুখ দেখে ভালো ঠেকল না আমার। ওর মায়ের কাছে না পাঠিয়ে আগে জানা দরকার ও এখানে কেন আগে এল। আমি রাহুল কে টেক্সট করে দিলাম, – অর্জুন ঈন্ডিয়া এ এসেছে। আমার কাছে কাছে। কাউকে কিছু বলার দরকার নেই।

সমস্যা হলো ছোড়দি কে তো বলতে হবে। বাইচান্স দিদি চলে এসে ওকে দেখলে বিপদ বাড়বে বই কমবে না। একবার ভাবলাম ওকে বলি চল পালাই দুজনে। কিন্তু কি জানি, ও কেন এলো আমার কাছে, কি বলবে,কিছুই তো জানি না। কথা কম বলে খুব ও। খুটিয়ে না জানলে সমস্যা হবে। তার আগে কি ছোড়দি কে সব টা জানাবো? না জানাবো না।

কিন্তু ছোড়দি এসে অর্জুন কে এখানে দেখলে কি হবে? নাহ বলেই দি ছোড়দি কে। তারপরে কালকে ওকে দুই বোন এ বুঝিয়ে ওর বাড়ি দিয়ে আসব। দিদিকে ফোন করে বললাম একবার আসতে। আমার গলা শুনে দিদি তো আন্দাজ করেছিল কিছু নিশ্চয়ই। দশ মিনিটে দিদি এসে হাজির।

– কি হয়েছে?

আমি হাত দিয়ে ইশারা করলাম চুপ করতে। দিদি ভয় পেয়ে গেল বেশ। আমি দিদিকে ডেকে এনে দেখালাম দরজা খুলে যে অর্জুন ঘুমোচ্ছে আমার ঘরে। দিদি অবাক তো হলোই, সাথে মারাত্মক ভয় পেয়ে গেল।

অর্জুনের খবর পাওয়া যাচ্ছে না সেটা সবাই আমরা জানতাম। সবাই চিন্তায় ছিলাম। আমার কান্না বা ওর জন্য ভয় কোন টাই আমি দিদির কাছে ব্যক্ত করিনি আগে। দিদি আমাদের ব্যাপার টা কিছুই জানে না। কিন্তু আন্দাজ নিশ্চই কিছু করেছিল না হলে আমার কাঁধ দুটো কে ঝাঁকিয়ে প্রায় চীৎকার করে বলল কেন আমাকে, একেবারে রণচন্ডী মুর্তি। ভয় পেয়ে গেলাম আমি সেটা দেখে।

– কি করেছিস তুই? ও এখানে কেন। নিজের বাড়ি যায় নি কেন??
– দিদি একটু আমার কথা শোন।
– কোন কথা আমি শুনব না। ও এখানে কেন তুই আমাকে বল আগে।
– বিশ্বাস কর আমি ওকে ডাকিনি। ও নিজে এসেছে। এসে বলল তিনদিন ঘুমাই নি আমি ঘুমাবো। আমি রান্না করলাম । ও খেয়েই ঘুমোল। আমি তারপরে তোকে ফোন করলাম।
– ওর মা কে জানাস নি? আমাকে একটা কথা তুই বলতো, ও ওর বাড়ি না গিয়ে তোর কাছে কেন এল?
– আমি জানিনা দিদি আমার কাছে কেন এসেছে

দিদিকে বলতে পারছি না যে কিছু বলতেই ও এসেছে। কিন্তু দিদি আন্দাজ করেছিল ব্যাপারটা। এমন কিছু বলতে এসেছে যেটা সকলের সামনে বলা যায় না। দিদি গর্জে উঠল

– মিথ্যুক। ও তোর কাছে এসেছে কেন নিজের বাড়ি না গিয়ে।

তারপরে খুব গলা নামিয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করল দিদি

– সত্যি করে বলতো, কি সম্পর্কে জড়িয়েছিস তোরা।

আমি আর সামলাতে পারলাম না নিজেকে। জোরে কেঁদে উঠলাম আমি। ওই খানেই মেঝেতে বসে আমি ভুলুন্ঠিতা হয়ে কাঁদছি। দিদি মারাত্মক রেগে গেছে। কিন্তু আমি কান্না থামাতে পারছি না। আর দিদিকে বলতেও পারছি না । দিদি তখনো আমাকে ঝাঁকিয়ে যাচ্ছে। আমার কান্নাতে দিদি বিশ্বাস করে নিয়েছে, আমরা কোন সম্পর্কে আছি। আর আমার সাথে কিছু হবার কারনেই অর্জুন গত বেশ কিছু দিন বাড়ির সাথে কেন, কারোর সাথেই যোগাযোগ রাখে নি। চেঁচিয়ে উঠল দিদি

– কি সম্পর্ক তোদের মধ্যে। নান্দু বল আমাকে। তোকে তো গুলি করে মেরে ফেলা উচিৎ। তুই এতো অমানুষ হলি কি করে? তুই মানুষ নোস তুই শয়তান। তোর মধ্যে শয়তানের বাস। একটা বাচ্ছা ছেলের মাথাটা খেলি কোথায় তুই। খড়গপুরে? কি দিয়ে ভুলিয়েছিস ওকে? রূপ দিয়ে? না শরীর দিয়ে? কোন ছলাকলায় ওকে ধরেছিস তুই রাক্ষুসী??? বল শিগগিরি। তোকে আমি আজকে মেরে ফেলব, ডাইনি।

বুঝে গেলাম, সেদিনে যখন বাড়ি গেছিলাম, বড়দি ছোড়দি কে বলছিল যে অর্জুন খড়গপুর থেকে পড়াশোনা করেছে। আর দিদি জানে আমার ও রিসার্চ খড়গপুর থেকে। দিদির দুয়ে দুয়ে চার করতে সময় লাগে নি। আমি নিজের উপরে ঘেন্নায় সিটিয়ে গেলাম দিদির কথা শুনে। উত্তর দেবার কথা ও মাথায় এলো না ।

আর উত্তর দেবো কি। সেদিনের মতন আজকেও আমার উপড়ে চড় থাপ্পড়ের ঝড় শুরু হলো। দিদি কোথাও বাদ দিলো না আমাকে মারতে। গাল দুটো তো থাপ্পড় মেরে ফুলিয়ে দিল আমার। পিঠে অনবরত মারল। দিদি ভুলে গেল, দিদির জন্যেই আমি এর থেকেও বাজে ভাবে মার খেয়েছিলাম একদিন। সেই দুঃখ আমার নেই। দুঃখ টা হলো, দিদিও শুনল না আমার কথা। বেশ খানিকক্ষণ মারার পরে দিদিও ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ল আমার কাছে। আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করল দিদি। হয়ত মনে হয়েছিল ওর বোনের ভাগ্যে মার খাওয়াই আছে।

মারধোরের পরে চুপ করে বসে ছিলাম আমি আর দিদি। জানিনা কতক্ষন। শুধু শ্বাস প্রশ্বাসের আওয়াজ । নিজেকে খুব অস্থির লাগছে আমার। কেমন একটা ভয় লাগছিল। লোক জানাজানির ভয়। যেটা এতোদিন আমি সবার থেকে আড়ালে লুকিয়ে রেখেছিলাম। মাঝের তিন বছর অসীম কস্ট পেলাম, সেটা বাইরে চলে এলে কার ই বা ভয় না করে? বলেছিলাম না, জ্বলব বলেই হয়ত ওকে ভালবেসেছি। ঝাঁপ দিয়েছি এই আগুনে। মনে হলো দিদি কে না ডাকলেই হতো। ম্যানেজ করে নিতাম আমি হয়ত ব্যাপার টা। দিদি একসময়ে উঠে পড়ল। দেখলাম চলে যাচ্ছে। মনে হলো দিদি কে বলি দিদি আমাকে ছেড়ে যাস না তুই। আজকে আমি বড় একা। আমার আগেই দিদি মুখ খুলল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে,

– তুই মরতে পারছিস না? কোন নির্লজ্জতায় তুই বেঁচে আছিস? কোন ভালো কাজের জন্য তুই আমার সামনে রয়েছিস। তুই মরে যা। ভাবব আমার কোন বোন ছিল না আর।

দিদি চলে গেল আমাকে মরতে বলে। কাঠ হয়ে গেলাম আমি। কেউ বুঝতে চাইছে না আমার দিক টা। কোনরকমে আমি শুধু বলতে পারলাম দিদিকে,

– দিদি লোক জানাস না। আমি ওকে কালকে বুঝিয়ে সুজিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেব।
—————————

তেরো

অকাতরে ঘুমোচ্ছে অর্জুন। সারা রাতেই বার বার ওকে দেখছি আমি দরজা খুলে। আর ভেবে চলেছি আমি। ভেবে দেখলাম মরে যাওয়াই ঠিক। দিদি এতো মেরেছে আমাকে গায়ে বেশ ব্যাথা। মাথায় যন্ত্রণা করছে, গালে এত থাপ্পড় মেরেছে দিদি। দরজা খুলে দেখলাম অর্জুন ঘুমোচ্ছে শিশুর মতন। নাহ ভেবে কিছুই পেলাম না আমি। মরন ছাড়া গতি নেই আমার। ভোরের দিকে মনস্থির করে নিলাম মরেই যাব। ঠিক সেই সময়ে দিদির ফোন এলো একটা। ধরলাম না।

আমি পাশের ঘরে গেলাম একটা চেয়ার নিয়ে। এখন শাড়ি পড়ি খুব, শাড়ি নিলাম একটা সিল্কের। ভাবছি, বাস দু মিনিটের খেলা। একবার দেখে নিয়ে ওকে মরে যাব। দরজা খুলে, অর্জুনের পাশে বসলাম। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। আমার হাতের ছোঁয়ায় আরো মুখ টা হাসি হাসি করে আমার দিকেই পাশ ফিরে শুলো। আমি কপালে চুমু খেয়ে বেড়িয়ে এলাম। কলিং বেলের আওয়াজ টা তখনি হলো। জানি দিদি এলো। ফোন না পেয়ে ছুটে এসেছে। হায় রে। এরা বাঁচতেও দেবে না মরতেও দেবে না। খুললাম দরজা।

ঘরে সাজানো মরনের সরঞ্জাম দেখে বলল
– ও মরতে যাচ্ছিলি?

উত্তর দিলাম না আমি। দিদি সেই সব সরঞ্জাম সরিয়ে দিল চোখে সামনে থেকে। সরিয়ে দেওয়া দেখে মনে মনে বললাম, নাহ আজকে মরব না। আগে অর্জুন কি চায় সেটা দেখি। মরে যাওয়া দু মিনিট। কিন্তু সত্যি বলতে কি আমার কাউকে সহ্য হচ্ছে না এখন। দিদিকেও না। ওকে বললাম

– তুই যা। মরব না আজকে। কালকে ওকে বাড়ি পাঠিয়ে তবে ভাবব মরার কথা। আমি জানিনা এখনো ও কি বলতে আমার কাছে এসেছিল। জানতে হবে আমাকে।

– তোরা পালা

দিদির কথায় আমি চমকে উঠে দিদিকে দেখলাম

– হ্যাঁ তোরা পালা। অর্জুনের সাথে তুই বিদেশে পালিয়ে যা।

হাসলাম আমি। মনে মনে ভাবলাম সে সুযোগ আমার ছিল অনেক আগেই। কিন্তু আমি তো চাইনি সেটা। আমি চেয়েছি ও সুস্থ ভাবে বাঁচুক। সমাজে নাম করুক। দশ জনার এক জন হোক। দিদিকে বললাম

– দিদি সে আমি অনেক দিন আগেই করতে পারতাম। করিনি। ওকে বাঁচিয়ে এসেছি গত চার বছর। বললাম না তুই যা এখন। আমাকে ওর সাথে কথা বলতে হবে।

দিদি চলে গেল বিহ্বল চোখ নিয়ে। আহা বেচারী, না পারছে আমাকে ফেলতে। আর সমাজের ব্যাপার টা তো ওকে চিরকাল ই ভাবায়। বেচারী ভয়ে পুরো কাঁপছে।

এগারো টা বাজে সকাল। আমি কলেজে ফোন করে দিয়েছি। আজকে আর যাব না কলেজ। সকালে উঠে স্নান করে রান্না করে রেখেছি। ছেলেটা উঠে হয়ত দুটী খাবে। মরনের সরঞ্জাম সরিয়ে রেখে দিয়েছে দিদি আপাতত। এর মধ্যে দিদি তিনবার এসেছে। নিজেও যায় নি আজকে ইউনিভারসিটি। ভয় ধরে গেছে, প্রাণের থেকেও প্রিয় বোন হয়ত মরবে। একটা ভালো শাড়ি পড়েছি। জানিনা কেন পড়তে ইচ্ছে হলো আজকে খুব। ভাবলাম দেখি সে কি বলে। মরা তো দুমিনিটের ব্যাপার। তাই রেডী হয়েই রইলাম। ওকে বোঝাতে পারলে ভালো, না এই উনত্রিশ বছরের দৌড় ঝাঁপ, পড়াশোনা, জ্ঞান সব আজকে শেষ হয়ে যাবে। ঘরে ঢুকে দেখলাম, ও উঠেছে।

হাসি মুখ করে বললাম
– কি রে ঘুম হলো।
হাসি মুখে বলল।
– খুব ঘুমিয়েছি।

আহা এই হাসি টাই আমার সব। সহসা আমার মুখের দিকে চেয়ে বলল

– একী এ কি অবস্থা তোমার মুখের। দেখি!!!!!!!
– না কিছু না। কি খাবি চা? নাকি স্নান করে নিবি একেবারে ভাত খাবি?

এক লাফে উঠে এসে আমার মুখ টা ধরে দেখে বলল
– এতো মারের দাগ। কে মেরেছে তোমাকে???????????

বাপরে, এতো বজ্রনাদ? আমি চমকে উঠলাম। মুখে রাগ নেই, কিন্তু চোখে এতো মারাত্মক রাগ যে আমি তাকাতে পারছি না ওর দিকে। মনে হচ্ছে সেই রাগে আমি পুড়ে যাব। কাপছে রাগে থর থর করে।

– শোন আমার কথা।

কে শোনে কার কথা। পাগলের মতন চেঁচাচ্ছে তখন ও।
– তুমি শুনতে পাচ্ছ না কি বলছি আমি? কে মেরেছে তোমাকে???????????
– আমার কথা শোন সোনা। কেউ মারে নি। এগুলো আমার পাপ। তুই একটু শান্ত হ। আচ্ছা তোরা সবাই মিলে আমাকে এমনি করলে আমি কি করব বল তো? একটু স্থির হয়ে বসে আমার কথা শোন। তুই এমনি করলে আমার মরা ছাড়া কোন গতি নেই।

আমি আবার সামলাতে পারলাম না নিজেকে। কথা গুলো বলতে বলতে, কেঁদে ফেললাম অর্জুনের সামনেই। কেঁদে ফেললাম, নিজের অসহায়তায়। ওদিকে দিদি বুঝছে না। আর এদিকে অর্জুন, নিজের অধিকারে চেঁচাচ্ছে আমার উপরে। সেও বুঝছে না। ও ভাবছে খুব সাধারন ব্যাপার ওর আমার কাছে এসে থাকা টা। আমার কান্নার দমকে অর্জুন যেন থমকে গেল। আমাকে দুম করে টেনে নিল নিজের বুকে। আমার ও যেন ঐটার ই দরকার ছিল। অর্জুনের চওরা বুকে নিজের যত কান্না ছিল সব কেঁদে ফেললাম। মনে বহু অব্যক্ত কথা বলে ফেললাম হয়ত কান্না দিয়ে। থামেই না যেন। গত বেশ কয়েক বছরের জমানো , নিজের উপরে , ওর উপরে থাকা অভিমান, কস্ট সব কিছু বেড়িয়ে এল কান্না দিয়ে আমার।

অনেকক্ষন বাদে শান্ত হলাম আমি। অর্জুনের দিকে চেয়ে দেখলাম। রেগে নেই আর ও। বরং ওর চোখ ছলছল করছে। আমাকে কাঁদতে দেখেনি তো আগে। ও উঠে গেল। এদিক সেদিক খুঁজে, নিজের সুট কেস থেকে একটু স্যাভলন জাতীয় কিছু এনে আমার মুখে লাগিয়ে দিল। আমি ওকে দেখছিলাম তখন। সব হয়ে গেলে বললাম

– এবারে বলতো বাবা, কি ব্যাপার তোর।
– ব্যাপারের কিছু নেই। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না। আর আমাকে বাবা বাছা করছ কেন? আমি কি তোমার ছেলের বয়সী নাকি? আমাকে ওই রকম বাবা বাছা করবে না একদম বলেদিলাম ।

কথা টা বলতে বলতে রেগে একেবারে অগ্নিশর্মা অর্জুন। আমি থ হয়ে গেলাম শুনে। মনে মনে ভাবলাম এই টা শোনার ই বাকী ছিল আমার। আস্তে করে বললাম

– তবে আর কি, হয়েই গেল।
– কেন? কি হয়ে গেল?
– তুই বুঝিস না এই সম্পর্ক টা নিষিদ্ধ।
– হুম জানি।
– তবে? আমি জানি তুই জড়াবি তাই চলে এলাম খড়গপুর থেকে। ওখানেই আমাকে অফার দিয়েছিল জবের।
– আমি জানি। আমি এটাও জানি, তুমি আমাকে দেখতে হাঁ করে যখন আমি শুয়ে থাকতাম। আমি এটাও জানি, আমাকে কেন বকাবকি করতে আর বলতে অন্য মেয়েদের সাথে বন্ধুত্ব না করতে। তুমি যেমন আমাকে বাঁচাতে চলে এসেছিলে ওখান থেকে, এটা যেমন সত্যি, তেমনি আমার উপরে তোমার ভালোবাসা, এটাও তো সত্যি। কিন্তু তাতে কি হল? আমি তো তখন থেকে না। সে কোন ছোট থেকে তোমাকে ভালবাসি।

একটু থেমে আবার ও বলতে শুরু করল,

– যে যার নিজের দিক টা ভাবলে তোমরা। তুমি ভাবলে তোমার লজ্জা, কাকে কি জবাব দেবে। সে জবাব নেই বলে আমায় ছেড়ে চলে এলে। মনি ভাবছে সমাজের কথা। আমার মা ও হয়ত ভাববে, যে আমার ছেলেকে বশ করেছে। আমি কি ভাবছি, আমি কি চাই সেটা তোমাদের প্রক্সিমিটি তেই নেই। তুমি তো আমাকে প্রলুব্ধ করনি কোনদিন। একজন মাসীর যা কর্তব্য তাই করেছিলে। দোষ তো তোমার ছিল না। তুমি নিজে জড়িয়ে পড়ছ ভেবে চলে এলে। এক বার জিজ্ঞাসা ও করনি আমাকে, যে আমি কি ভাবছি।

আমি হাঁ হয়ে গেলাম ওর কথাগুলো শুনে। ও জানত ওকে আমি দেখতাম? এটাও বুঝেছিল কেন ওকে আমি মেয়েদের সাথে মিশতে মানা করেছিলাম। লজ্জায় মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল আমার। কিন্তু ছোট থেকে ভালোবাসি মানে কি? আর ও কি ভাবছে সেটা আমি কি করে জিজ্ঞাসা করতাম? সেটা কি সম্ভব ছিল? বললাম

– মানে? ছোট থেকে মানে? আর তুই কি ভাববি? ওই বয়সে তোর ভাবনার মধ্যে থাকতই বা কি?
– মানে অনেক ছোট থেকে। যখন তুমি এতো সুন্দরী ছিলে না। হ্যাঁ বলতে পারো বুঝতে পেরেছি সেটা তুমি খড়গপুর থেকে চলে আসার পরে। কিছুতেই মন লাগত না। প্রায় ই গেট থেকে তোমার ফ্ল্যাট টা হাঁ করে চেয়ে আমি দেখতাম। তুমি তো ছেড়ে চলে এলে আমাকে। আর আমার কস্ট টা একবার ও ভেবেছিলে? কি চলছিল আমার ভিতরে? কত খানি ফাঁকা হয়ে গেছিলাম আমি? তোমার কি মনে হতো আমি কেন যেতাম তোমার ডিপার্ট্মেন্ট এ তোমাকে আনতে? আমার ভালো লাগত না ওই ফ্ল্যাট এ তুমি ছাড়া। আর যেদিন তুমি খড়গপুর থেকে চলে এলে, সেদিনে আমার অবস্থা কি হয়েছিল ভাবতে পার? ভেবেছিলাম ইউ এস এ গিয়ে সামলে নেব। পারিনি। উদ্ভ্রান্তের মতন হয়ে গেছিলাম। তুমি যেমন চেস্টা করেছ আমাকে ভুলতে কিন্তু পারনি, আমিও চেস্টা করেছি তোমাকে ভুলতে কিন্তু পারিনি। আমি বুঝেছি কেন তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেছিলে। আমার ভালোর জন্য। পরিবারের লজ্জার জন্য। তাই আমি কলেজ কমপ্লিট করেছি। না হলে ইচ্ছে করেছিল, চুলোয় যাক পড়াশোনা। তাই আমি তোমাকে ক্ষমা করেছি। আমাকে ফেলে আসার জন্যেও ক্ষমা করেছি। আর কিন্তু করব না। এটাই লাস্ট। আর এখন আমার উপায় ছিল না। তোমাকে দেখতে না পেলে আমার জানিনা কি হতো। তোমার সাথে কথা বলতে না পারলে আমি হয়ত বার্স্ট হয়ে যেতাম।
ও বলেই চলে…
আর না ভাবার কি আছে? কেন সেই বয়সে আমার কিছু ভাবনা ছিল না? না কি ওই বয়সে ভাবনা থাকে না? আমিও তো আর দশ টা ছেলের মতন তোমাকে চেয়েছিলাম। হ্যাঁ বলতে পার আমি তোমার বুনপো হবার ফায়দা নিয়েছি। না হলে পাত্তাও তো দিতে না।

হাঁ হয়ে গেলাম আমি। অনেক প্রশ্নের উত্তর ও আমাকে দিয়ে দিল। কি বলি আমি? বলতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্চে এই ভাবেই আঁকড়ে ধরে থাকি ওকে। ও নিজেই পড়ে নিক আমার অব্যক্ত কথা গুল। চুপ করে রইলাম দুজনে অনেকক্ষণ। আমি কি বলব খুঁজে পাচ্ছিলাম না। শুধু চোখে জল বার বার ছাপিয়ে আসছে। ইশ এতো কস্ট পেয়েছে ছেলেটা। নিজের কস্ট আমি ভুলেই গেলাম। মনে হলো ভালবাসা টা দুই দিক থেকেই ছিল মারাত্মক রকমের।, তাই কেউ কাউকে ভুলতে পারিনি, দুজনাই কেঁদেছি আড়ালে। কিন্তু ওকে এই ভুল থেকে সরাতেই হবে। ওকে বোঝাতেই হবে আমাদের এক হওয়া সম্ভব না। দরকারে ভয় দেখিয়ে সরাতে হবে। মন কে শক্ত করলাম আমি আবার। মনে হলো দরকারে ওকে বোঝাতে হবে আমি ওকে ছাড়াও বাঁচতে পারব। তাতে যদি ওর একটু মেল ইগো জাগে ।

আমি বললাম ওকে
– তবে তো আমাকে মরতে হয়।

তাতে ওর প্রমট উত্তর এলো
– তাতে কি লাভ হবে? আমাকে বাঁচাতেই তো তুমি মরবে। কিন্তু কথা দিচ্ছি, তাতে লাভ কিছু হবে না। আমি হয়ত মরেই যেতাম কিন্তু এখানে চলে এলাম তোমাকে দেখে দুটো দিন বেশী বাঁচব বলে। আর যদি আমাকে বাঁচানো নয়, লজ্জার জন্য মরবে, তবে আমি বলতে পারি, লজ্জা নিয়ে বাঁচতে আমি প্রস্তুত।

কি যে বলছে ছেলে টা। পাগল হয়ে গেছে ও। ও বুঝতে পারছে না কত বড় লজ্জা এটা। ও কোথাও যেতে পারবে না, মিশতে পারবে না। কোন আত্মীয় বাড়িতে কোন অনুষ্ঠানে একেবারে অছ্যুত হয়ে পড়ব আমরা। কেউ মেনে নেবে না আমাদের। এ কি বিপদে পড়লাম আমি। আমিও যে ওকে ছেড়ে বাঁচব এমন না। কিন্তু ও ওর মতন থাকুক। আর আমি আমার মতন। ও বিয়ে করে সুখী হয়ে ঘর কন্না করুক আর আমি আমার মতন। আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম,

– এরকম কথা বলিস না। দয়া কর। তোর জন্যে আমি সব ছাড়তে পারি। আমি এখান থেকে চলে যাব। তুই কাউকে বিয়ে কর। সুখে সংসার কর। দয়া কর আমাকে।
– তাহলে কি ঠিক হলো তুমি মরবে না তাই তো? কারন তুমি মরলে আমিও মরে যাব কথা দিলাম।

আমি ওর মুখ টা হাত দিয়ে চাপা দিলাম। কি যে সব বলছে কে জানে? ভয় লেগে গেল প্রচন্ড। মরে যাবে আবার কি কথা। ভয়ে ময়ে বলে দিলাম ওকে

– নানা মরব না আমি। কোথাও যাব ও না । আমি তোর আশে পাশেই থাকব। কোন দিন বিয়ে করব না। কিন্তু তুই সংসারী হবি বল কাউকে বিয়ে করে।
– না সেটা হবে না। আচ্ছা একটা কথা বলো, তুমি, বিয়ে করতে পারবে না কেন?

চুপ করে রইলাম আমি। কেন বিয়ে করতে পারব না, এই উত্তর টা ওকে দিলে ওর ভালোবাসা অনেক বেশী শক্তি পেয়ে যাবে। সেটা এখন করতে দিলে হবে না। চুপ করে রইলাম আমি। ও বলল

– আমি বলছি, তুমি আমাকে ছাড়া কাউকে ভাবতেও পারো না। তাই তুমি অন্য কাউকে মেনেও নিতে পারবে না। আর যদি জোর দিয়ে বল, যে তুমি অন্য কাউকে বিয়ে করবে কালকেই তবে আমিও কথা দিলাম আমিও বিয়ে করব তার পরের দিন ই। কিন্তু ভেবে দেখ, এতে কি তুমি আরো দুটো জীবন নষ্ট করবে না? তার থেকে বেটার অপশন একটা ডিল হোক

ভাবছি এতো কথা ও বলতে পারে বলে আমার জানা ছিল না। বুঝলাম, কেন প্রতি মুহুর্তে আমি ওর প্রেমে পরি। তাও হারলাম না আমি । ওকে বললাম

– কে বলল আমি বিয়ে করতে পারব না। কত ছেলেকে আমার ভালো লাগে তার ঠিক আছে? তুই না হয় মিমি কে জানিস একটা ভালো মেয়ে হিসাবে। কিন্তু তোর জানা টাই তো সব না।
– মানে? হাও মেনি ইউ হ্যাভ স্লেপ্ট উইথ?
সহসা এমন প্রশ্ন শুনে দুম করে মাথা গরম হয়ে গেল । নিজের ভালোবাসার মানুষের মুখে এই কথা শুনে মেজাজ ঠিক থাকতে পারলাম না আমি। আজকে মনে হয়, সেদিনে এই নিয়ে কথা বার্তা আর একটু চালাতে পারলে লাভ হত। কিন্ত আমি ছিলাম বোকা। তাই সপাটে থাপ্পড় লাগিয়ে দিলাম অর্জুনের গালে। চেঁচিয়ে উঠলাম

– লজ্জা করে না তোর এই কথাটা আমাকে বলতে

অর্জুন গালে সামান্য হাত ও দিল না। আমার দিকে কঠিন ভাবে চেয়ে বলল

– আমার উত্তর আমি পেয়ে গেছি। শোন তোমার কি ইচ্ছে জানার আমার কোন সখ নেই। আমার সিদ্ধান্তই ফাইনাল। দুজনাই বিয়ে করছি না। আমার বেশি চাওয়াও ছিল না। তোমাকে দিনের মাথায় একবার দেখব ব্যস। কাজেই আমি তোমাকে কলেজে দেখে আসব দিনে একবার করে। বা তুমি যেখানে বলবে।

আমি আর কি বলব। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে একেবারে। আর একলা তো আমার জীবন না। আমার একটা স্টেপ ওর জীবন কেই এফেক্ট করবে। কিন্তু বুঝলাম আপাতত ওকে আটকানোর এটাই রাস্তা। না মানলে জানিনা আর কি করে বসবে। পুরুষ মানুষ যখন অধিকার বুঝে যায়, তখন কোন কিছুর তোয়াক্কা করে না। ও বুনপো না হলে আজকেই ফয়সালা করে নিতাম । বয়সে ছোট তো কি হয়েছে। কিন্তু সে তো আর হবার নয়। মেনে নিলাম ওর যুক্তি

– আচ্ছা ডান।আমি রাজী। কিন্তু তোর কাউকে পছন্দ হলে বিয়ে করবি তো?
– তুমি করবে তো কাউকে পছন্দ হলে? বললাম তো, তুমি বিয়ে করলে পরের দিনেই করব।
– আমার কথা আনছিস কেন তুই। তুই পুরুষ মানুষ। মায়ের একমাত্র ছেলে। তোর কিছু হলে যে সর্বনাশ হয়ে যাবে সোনা। আমার কি আছে বল। আমার কথা ভাবিস না অতো। তুই এখন বাড়ি যা। মায়ের কাছে যা।
– প্রথমত এটা জেনে নাও, হ্যাঁ আমরা হয়ত এক হতে পারব না, কিন্তু ভগবান সাক্ষী, তুমি কিন্তু আমার। তুমি ভেব না আমি সেদিনে এমনি এমনি তোমাকে ওখান থেকে আসতে দিয়েছিলাম। আমার ও মনে হয়েছিল, আমার মতই তুমিও জ্বলছ আমাকে না পাবার কস্টে। কিন্তু তোমাকে মার খাবার জন্য আমি ছেড়ে রাখতে পারি না। কাজেই এর পরে থেকে মার খাবে না কিন্তু কারোর কাছে।আমি জানি কে তোমাকে মেরেছে। এই শেষ বারের মতন তাকে আমি ক্ষমা করে দিলাম। আর কিন্তু করব না। তাতে সে আমার মা হলেও না। আজকের পরে , পরে পরে মার কিন্তু তুমি খাবে না। আর আমার সামনে তোমার গায়ে হাত তোলে এমন লোক কে আমি বাঁচিয়ে রাখব না। আর শোণ, এত কথা বলতে আমার ভালো লাগে না। আর কোন দিন ও হয়ত বলব ও না। কিন্তু আমি আশা করব তুমি এর প্রতি টা কথা মেনে চলবে।

হেসে ফেললাম বীর পুঙ্গবের কথা শুনে। বাবাহ আমাকে নাকি ওনার কথা মেনে চলতে হবে। কি একেবারে পুরুষ মানুষ এলেন। অতো কষ্টের মাঝেও জ্বালাতে ইচ্ছে হলো ওকে । দুজন প্রেমী, সর্বক্ষন একে অপর কে পরীক্ষা করে, কে বেশি ভালোবাসে। তাতে নিজের হারে ও দুজনাই খুশী হয়। বললাম

– আর যদি তুই কোন দিন আমার গায়ে হাত তুলিস?
– নিজেকে মেরে ফেলব। কথা দিলাম।
– পাগলা। এই সব কথা বলতে নেই।
– কেন?
– ধর আমি খুব বদমাশ হয়ে গেলাম আর তোর দরকার পড়ল আমাকে মার ধোর করার।
আবার ওর চোখে পুরোন ব্যাপার টা ফিরে এলো। আগের অর্জুনের মতন ভাব ভঙ্গী। লজ্জা পেয়ে বলল
– ধ্যাত। তোমার গায়ে হাত তোলার কথা আমি ভাবতেও পারি না।
– হ্যাঁ রে, ধর আমি অন্য কোন পুরুষের সাথে আমাকে অসভ্যতা করতে দেখলি। তখন
ধরে ছিল ও আমার হাত টা ও । সজোরে টিপে ধরল সেখান টা রাগে। আমি ককিয়ে উঠলাম
– আউ? লাগে না? দেখ কি করলি। আবার নাকি নিজেকে শেষ করে ফেলবে আমাকে মারলে?
– এটা কেমন কথা হলো? আমি কেমন করে সহ্য করি তোমাকে অন্য কারোর সাথে? তুমি এমন করবেই বা কেন? কই আমি তো করতে চাই ও না।
– আচ্ছা আচ্ছা বাবা এবারে ছাড় আমার হাত টা। বড্ড গায়ে জোর বেড়েছে তোর।

ও ছেড়ে দিল। মুখ টা ব্যথিত। বলল
– সরি আর হবে না এমন ভুল।
– ধুর পাগল। আমি কিছু মনে করিনি। ওই সময়ে তুই আমাকে না বকলে আমারি কস্ট হতো।
– তাহলে বল তুমি আমাকে ভালবাস।
– এর পরেও বলে দিতে হবে?
– হ্যাঁ
– আচ্ছা বাসি । খুব ভাল বাসি। এত ভাল আমি আগে কখন কোনদিন কাউকে বাসিনি।
– হুম। আমার কোন শারীরিক লোভ নেই তোমার উপরে। ব্যস এটা বুঝি তুমি ছাড়া আমার জীবনে কোন ভাল জিনিস হতে পারে না
– পাগল। এবারে দুটো খা। খেয়ে মায়ের কাছে যা।
– আচ্ছা।

পাগল টা আনন্দে নাচতে নাচতে বাড়ি চলে গেল। আর আমাকে ফেলে দিয়ে গেল একটা গাড্ডায়। কি যে বলি? বাস আমি ওর, এটা মেনে নিলেই ওর শান্তি। কত সরল। মনের মধ্যে লক্ষ প্রশ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি দরজার সামনে।
—————————

চৌদ্দ

দিদি এল একটু পরেই। এসে দেখল অর্জুন চলে গেছে। মনে একটা না হারানোর আনন্দ ছিল। সে আছে , সেই ভাবনা টা আমাকে জোর দিয়েছিল। দিদিকে বললাম

– আমি মরব না দিদি। এতো ভাবিস না
– জানি কস্ট পেয়েছিস আমি মেরেছি বলে।
– না রে দিদি এর একশ গুন মার খেয়েছিলাম, যেদিন তোকে আর ললিত দা কে আমি ভাগিয়েছিলাম। মুখ টা আমার এর দশ গুন ফুলেছিল।

দিদি আর থাকতে পারল না। আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি বললাম

– কস্ট টা আজকে বেশী পেলাম কারন তুই শুনলি না আমার কোন কথা। আমিও খুব বয়স্কা নই রে। আমিও আঠাশ মাত্র। আমার ও জীবনে, শরীরে প্রেম আছে। প্রেম আসে। বিশ্বাস কর, অর্জুনের সাথে আমি চুমুও খাই নি কোন দিন। সেও চায় নি। আজকেও বলে গেল, কোন শারীরিক মোহ নেই আমার প্রতি ওর। কিন্তু ভালবেসে ফেললে কি করব আমি। আমি তো মরতেও গেলাম। সে বলে গেল, যার জন্যে মরে যাবে, সেও যদি তোমার মরনের পরে স্বেচ্ছা মৃত্যু বেছে নেয়, তোমার মৃত্যু টা ত বিফলে যাবে। দিদি আমি তো লজ্জার ভয়ে মরতাম না। আমি মরতাম ওকে বাঁচাতে। আমার জীবন যদি ওর জীবন হয়, মরনে আমার কি লাভ বলতো? না রে তার থেকে ও একটা ভালো কথা বলে গেল। বলে গেল কেউ কারোর যখন হতে পারব না, তখন একলাই থাকি দুজনে। বাস একবার করে আমাকে দেখতে চেয়েছে দিনে। আপাতত ওকে আটকানোর বেটার অপশন এই মুহুর্তে আর কিছু ছিল না আমার কাছে।

শেষ কথাটা বলতে বলতে আমি হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললাম। দিদিও ততোধিক জোরে কাঁদতে কাঁদতে আমাকে চেপে ধরল বুকের মাঝে। কাঁদতে কাঁদতেই, দিদিকে শুরু থেকে, অর্জুন সম্পর্কিত সব ঘটনাই বললাম। মাঝে একদুবার চা করে খেয়েছি দুজনে। আমার কথা শুনতে শুনতে, দিদি আমাকে বারংবার জড়িয়ে ধরছিল আর গালে চুমু খাচ্ছিল। আমাকে মারা টা যেন দিদি কে বিঁধছিল। আমি কস্ট পাই নি দিদির মারে। দিদি তো আমার লজ্জার কথা ভেবেই যা করার করেছিল। যে কেউ করবে। আমারি নিজের ঘেন্না লেগেছিল নিজেকে, যখন আমি বুঝেছিলাম আমি ওই ছোঁড়া কে ভালবেসে ফেলেছি। দিদিকে বললাম সব কিছু গুছিয়ে যত টা বলা সম্ভব। দিদি সব শুনে বলল

– এখন ওকে আটকেছিস, ভালো করেছিস। টাইম নিয়েছিস ওর থেকে।
আমি সাড়া দিলাম না দিদিকে। দিদি বলেই চলল
– তুই কি সত্যি চাস ও অন্য মেয়েকে বিয়ে করে সুখী হোক।
আমি হাঁ হাঁ করে উঠলাম।বললাম
– যত ঠাকুরের দিব্যি বলবি আমি কাটব। আমি চাই ও সুখি হোক।

বলতে পারলাম না আমি দিদিকে, আমি চাই অন্য মেয়েকে বিয়ে করে ও সুখী হোক। হায় রে মন। দিদি খেয়াল করল না ব্যাপার টা, কিন্তু নিজে বলতে থাকল,

– বেশ তবে শোন, ও তো ওর মনের কথা তোকে বলবেই। তুই কিন্তু তোর মনের কথা ওকে বলিস না। তবে কিন্তু ও দুর্বল হয়ে যাবে তোর উপরে মারাত্মক রকম। তোকে সমঝে চলতে হবে।
– আচ্ছা বলব না আমার মনের কথা।

ওকে মনের কথা বলব না। পরে চিন্তা করে হাসলাম। ও কি আমার বলার উপরে নির্ভর করে রে দিদি? ও চোখ পড়ে নেয়। আমি কোন কালে ওকে বলেছিলাম খড়গপুরে, যে ওকে আমি ভালবাসি? কিন্তু ও জেনে গেছিল। ওকে আটকাতে হলে আমাকে অভিনয় করতে হবে। কিন্তু সে তো আমি শিখিনি। জানিনা কি হবে।

বলে না দিন যায় আসতে আসতে সব সয়ে যায়। আমাদের প্রেম কাহিনী টা দিদির কাছে সয়ে গেল। এতো নিবিড় অথচ সরল প্রেম দেখে দিদিও আসতে আসতে গলতে শুরু করল। বা হয়ত ভেবেছিল, ধীরে ধীরে প্রেম টা কেটে যাবে। বা একটা একটা ষড়যন্ত্রের মতন । আমি খুব চুপচাপ হয়ে গেছিলাম। গন্ধ পাচ্ছিলাম সেই ষড়যন্ত্রের। আর নিজেকে ধীরে ধীরে সেই ষড়যন্ত্রের অংশীদার করে ফেলছিলাম। ওই ছোড়া মাঝে মাঝেই কলেজে আসত। ঘণ্টা দুয়েক হই হই করত, পার্ক বা রেস্টুরেন্ট এ দুজনে বসে গল্প করে আবার যে যার ঘরে। দিদির মনে চলতে থাকল, একটা সহজ সমাধান। যাতে আমরা আলাদা হয়ে যাই।

একবার বসেই, ইউ পি এস সি রিটিন ক্লিয়ার করে ফেলেছে। আই পি এস হতে চান উনি। ওর মা ও খুশী, ও আর বাইরে যায় নি বলে। শুধু জানে না আমাদের ব্যাপার টা। এদিকে আমার দিদি ও মাঝে মাঝে অর্জুন কে ডেকে পাঠায়। তবে একলা আমাদের কে আমাদের বাড়িতে আলাউ করে না। ভয়, সুন্দরী বোন কে দেখে বুনপো যদি নিজেকে সামলাতে না পারে? কি অবস্থা!!!! অপমানিত লাগে নিজেকে। কিন্তু এর থেকে ভাল কিছু আমার ও মাথায় আসে নি। আর অর্জুন টাও ধীরে ধীরে সাহসী হয়ে উঠছিল। সাথে আমার ও মনের লালসা বাড়ছিল, ওর সাথে থাকার ওর সাথে ঘর বাঁধার।

সামনেই পুজো। সবাই বাড়ি যাবে। আমি ঠিক করিনি কিছু। কিন্তু ভালো খবর শুনলাম, সেটা হলো অর্জুনের ইউ পি এস সি ক্লিয়ার হয়ে গেছে। ওর মা আমাকে খবর টা দিল। হায় রে কপাল কি করে বলি, ইন্টারভিউ দেবার আগে ও পরে ও অনবরত আমার সাথেই ফোনে ছিল। আমিও ওর মায়ের মুখে খবর টা শুনে খুশী হবার ভান করলাম। জয়েনিং পুজোর পরে আছে ওর। দিদি এই খুশী তে ওকে ডেকে পাঠিয়ে ছিল দিদির বাড়িতে। আমাকেও খবর টা দিল, আমি যেন সেদিনে থাকি। ভাই ও আসবে।

আমি কলেজ থেকে ফিরে গেছিলাম তাড়াতাড়ি। সাজলাম একটু। বিশেষ কিছু না। ততদিনে চুল টা লম্বা হয়েছিল আমার পিঠ অব্দি। অর্জুনের জোরাজুরি তে পার্লার থেকে শেপ করে এসেছি। সাধারন যা যা না করলেই নয়, সেই সব করলাম। সামান্য কাজল চোখে, হাতে পায়ের নেল পালিশ, হালকা লিপস্টিক। নাকে হীরের নাকছাবি টা পড়লাম, আমাকে অর্জুন দিয়েছে, দিন সাতেক আগে। দুম করেই দেখলাম আমার ব্যাগ এ ঢুকিয়ে দিল। হীরে টা বেশ বড়। আমার টিকালো নাক। মন্দ লাগছে না। একটা দামি অথচ সাধারন শাড়ি পড়লাম। আমার চিরকাল ই হাতে আর গলায় কিছু থাকে না। কিন্তু ললিত দা, সেই পুরোন হারের বদলে আমাকে একটা ভিষন সিম্পল হার গড়িয়ে দিয়েছিল। সেটা পড়লাম। হাতে ঘড়ি থাকে সবসময়েই আমার। তাও অর্জুন একটা ঘড়িও দিয়েছিল আমাকে। সেটা পড়লাম। হালকা পারফিউম লাগালাম।

দিদির বাড়িতে পৌঁছে দেখি, অর্জুন আসে নি ভাই চলে এসেছে। সুবর্ন, ছুটে এসে আমার কোলে উঠে এল। ভাই ও এসে আমাকে প্রণাম করল। আমার খুব ভাল লাগল। আমার দিদি বলল

– হীরে টা বেশ সুন্দর লাগছে আমার বুনির নাকে। আজকে বুঝলাম, আমাদের চার বোনের মধ্যে তোকেই সব থেকে বেশি সুন্দরী লাগে। মেজদি খামখা ই গর্ব করে।

আমি লজ্জা পেলাম। আজকে অর্জুন আসবে আর এই সব কথা বলছে। লজ্জার ব্যাপার। দিদি কি ভাবছে আমি অর্জুনের জন্য সেজেছি? লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করল। আমি বললাম আমি একটু আসছি। দিদি মনে হয় বুঝল, আমি সাজগোজ তুলতে যাব। আমাকে বলল

– কোন দরকার নেই। সাজগোজ তুলে দিলেও, তুই এই রকম ই সুন্দরী থাকবি।

তা করতে করতেই অর্জুন এল। আমার দেওয়া একটা সাদা শার্ট আর নীল ফেড জিন্স টা পরে। কি যে লাগছিল ওকে দেখতে বলার না। দিদি উঠে গিয়ে নজর কাটা দিল ওকে। আমি রান্না ঘরে ছিলাম। জলের বোতল টা নিয়ে যেতেই, ও আমাকে দেখে হাঁ হয়ে গেল। ভাই এসেছে কত দিন পরে, অর্জুন ভাই এর সাথে কথা না বলে আমাকেই দেখতে লাগল। আমার শরীর কেমন যেন শিউরে উঠল। স্বাভাবিক করে দিলাম একটু। ভাই কে বললাম

– কি রে ভাই, কত দিন বাদে দেখলি বদমাশ টা কে?
– অনেক দিন রে দিদি। আচ্ছা অর্জুন এবারে কিন্তু পুজোতে তুই আসবি আমাদের বাড়ি

অর্জুন এর ও যাবার ইচ্ছে ছিল না। কারন আমি বলেছিলাম যাব না। ওর ইচ্ছে ছিল, আমি যাব না তাই ওই চারদিন দুজনে খুব ঘুরব নিজেদের মতন করে। ও বলে দিল

– নাহ যাব না। আমার জয়েনিং আছে পুজোর পরেই। আর তাছাড়া ট্রেনিং এর আগে নিজেকে একটু ফিট করে নিতে হবে।
– সে কী তুই যাবি না? দ্যাখ ছোড়দি, তুই কিছু বল না ওকে।

আমি বললাম অন্য দিকে মুখ করে।

– ও এখন বড় হয়েছে। কারোর কথা কি শুনবে?

ভাই অবাক ই হয়ে গেল। আমি যেমন ভাবে কথা টা বললাম তাতে অবাক হল। ভাই চিরকাল ই দেখেছে আমি ডমিনেটিং। নিজের মত অন্য কে দিয়ে মানাতে জানি। ততক্ষনে দিদি চলে এসেছে, বলল

– কে বলেছে যাবে না? কি অর্জুন যাবি না? আমাকে তো নান্দু বলল, সবাই যাচ্ছি আমরা। আর তুই যাবি না?

অর্জুন অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো। আমি না অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। রেগে গেল বুঝতে পারলাম।
রাতে খাওয়া দাওয়ার পরে অর্জুন মেনে নিল ও যাবে। আমিও দেখলাম ওর মধ্যে রাগ টা নেই। আর ভয়ঙ্কর ভাবে আমাকে দেখেই চলেছিল। কি জানি ভাই কিছু আন্দাজ করল কিনা। রাতে দিদি কে অনুরোধ করেও লাভ হলো না। দিদি আমাদের দুজন কে কোন মতেই আলাউ করল না আমাদের বাড়িতে কিচ্ছুক্ষনের জন্য ও একলা থাকতে । অর্জুনের সামনেই বলে দিল, যখন আমরা ছাদে গল্প করছিলাম ভাই চলে যাবার পরে, যে তোমরা এখান থেকে সোজা যে যার বাড়ি যাবে। অর্জুন তুমি কোন মতেই নান্দুর কাছে যাবে না । অর্জুন বেচারী কি আর করে। মেনে নিল। বলল আচ্ছা ঠিক আছে সোজা চলে যাব এই পাড়া ছেড়ে।

রাতে বাড়ি পৌঁছে, আমি একটা সাদা নাইটি পরে চুল আঁচড়ে, শুয়েছি, আমার ঘরের ব্যাল্কনি দিয়ে একটা ঠক ঠক আওয়াজ পেতেই ভয় পেয়ে গেলাম। আমি উঠে দরজা না খুলে, জানালা টা খুলতে দেখলাম, অর্জুন ব্যাল্কনি তে দাঁড়িয়ে। হাসি পেয়ে গেল। বোঝ কান্ড। আমি দরজা খুলে দিতেই সোজা এসে বিছানায় শুয়ে পড়ল।
বললাম
– এটা কি রকমের দুষ্টুমি?
– আমি মনির কথা শুনেছি আর মেনেওছি। চলে গেছিলাম পাড়া ছেড়ে।কিন্তু যেতে যেতে ভাবলাম ইশ আরেকবার দেখে আসি। তাই পাড়ার বাইরে গাড়ী রেখে, হেটে এসেছি এখান অব্দি। তার পরে পাঁচিল ডিঙিয়ে ঢুকে পাইপ দিয়ে চড়ে তোমার ব্যালকনি তে?
– হুম, তা পুলিশ বাবু, এই রকম চোরের মতন আসার কারন? আমাকে তো পুরো সন্ধ্যে বেলাটাই আপনি দেখলেন খুব বিশ্রী ভাবে তাই না? ভাই যদি বুঝে যায় সুনু, তোকে কিন্তু আমি ছাড়ব না বলে দিলাম।
– আশ মেটেনি। কি দারুন মিস্টি লাগছিল।
– হুম তবে এসে ভালই করেছিস।
বলে গাল টা টিপে দিলাম বেশ করে।
– কেন?
– আমার ইচ্ছে করছিল তোকে দেখতে।
– হুহু দেখলে, আমি সব সময়ে নিজের কথা ভাবি এমন না।
– বেশ, হয়েছে অনেক নিজের ঢাক পেটানো। কোল্ডড্রিঙ্ক খাবি একটু?
– দাও।

খালি গায়ে শুয়ে আছে আমার খাটে। বিছানার পাশে ছোট টেবিল এ কোল্ড্রিঙ্কের গ্লাস টা নামানো। আমি ওর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। ও মাঝে মাঝেই আমাকে জড়িয়ে ধরছে। এতে ওর কোন খারাপ ইচ্ছে নেই সেটা আর কেউ না বুঝলেও আমি বুঝছি। আমার শরীরের নানা পার্টে ওর হাত লাগছে। কিন্তু তার মধ্যে কোন বাজে ইচ্ছে আমি ওর দেখি না। দিদির ফোন এলো।

ধরতেই বলল
– দুষ্টু টা তোর কাছে না?
আমি হেসে ফেলে বললাম,
– হ্যাঁ এসে চিৎপাত হয়ে শুয়ে আছে। ভয় নেই তোর, আমি আর ও কেউ ই এত অপরিনত নই। হলে অনেক দিন আগেই যা হবার হয়ে যেত।
– হুম। ও কি থাকবে আজকে?
– না । ও এখানে থাকলে ওর মায়ের ফোন আসবে তোর কাছে।
– অলরেডি এসেছে। ও পৌঁছায় নি দেখেই তোকে কল দিলাম।
– আচ্ছা আমি ওকে পাঠাচ্ছি

ওকে উঠিয়ে পাঠাতে আমার আরো আধ ঘন্টা গেল। যাবার আগে প্রতিবারের মতন এবারেও ওর হাত ধরে আমাকে বলতে হলো যে আমি ওর ই ছিলাম আছি আর থাকব ও। আমি বলতে বললেও ও বলে দেবে। কিন্তু আমি আমার মনের কথা ওকে বলব না বলে ছোড়দি কে কথা দিয়েছি। আমাকে যখন জোর করে এই কথা টা বলতে বলে আমার ভালো লাগে। খুব লজ্জা করলেও বলে দি ওকে। ও খুশী হয়ে যায়। হয়তো মনে জোর পায়।

ও চলে যাবার পরে, মনটা মারাত্মক খুশী লাগছিল আমার। এটাই বা মন্দ কী। এই জীবন ও তো লিড করা যায়। ওকে দিনের মাথায় ঘণ্টা খানেক কাছে পেলেই আমার শান্তি। কত ভুল ছিলাম আমি। সত্যি প্রেমে পড়লে মানুষের মাথা খারাপ হয়ে যায়।

পুজোতে সেবার সবাই বাড়ি গেলাম। ছয় বোন বাড়িতে। সবাই আমাকেই দেখছে। বুঝতে পারছি রূপ আমার ফেটে বেড়িয়ে আসছে। এই প্রথম বাড়ি গিয়ে আমি বাবাকে প্রণাম করলাম। আর অর্জুন টা এতো বদমাশ, ইচ্ছে করে আমি প্রণাম করার পরেই বাবা কে ছুটে এসে প্রণাম করল। কাউকে তো প্রণাম করে না। আজকে প্রণাম করল দেখে ওর মা বাবা খুশী হলো। কিন্তু আমার ছোড়দি বুঝল, আমার প্রণাম করার পরেই কেন ও বাবাকে প্রণাম করল। ঠিক হয়েছে। এর পরে আমি যতজনা কে প্রণাম করেছি, ওকেও তত জনা কেই করতে হলো। ব্যাপার টা কেউ বুঝতেই পারল না। কিন্তু আমি আর দিদি বুঝলাম।

আমার মা তো আমাকে বার বার নজর কেটে দিচ্ছে। মেজদি কিছু বলতে পারছে না, কিন্তু বার বার আমাকে দেখছে আরে ঠারে। হয়ত বুঝেছে, বাইরের নয়, ভিতরের সুন্দরতাই আসল।আমি এবারে মেজদি কেও প্রণাম করলাম। খুশী হলো কিনা জানিনা। কিন্তু মাথায় হাত দিল আমার। কি আশীর্ব্বাদ করল জানিনা। তবে খারাপ কিছু করে নি। করলে আজকে আমি এতো সুখী হতাম না।

ছয় বোন, পাঁচ জামাই, গোটা সাতেক নাতি নাতনি, এক ছেলে, ছেলের বিয়ের দেখা শোনা, মায়ের খুশীর অন্ত নেই যেন। আমি আর ছোড়দি, সারা দিনেই, মা কাকিমার সাথে লেগে আছি আগের মতই। মা তো কত করে বলছে আমাদের বাইরে যেতে আনন্দ করতে। কিন্তু আমাদের আনন্দ মা আর কাকির সাথেই।

আমার মরন, অর্জুন কে মাঝে মাঝেই দেখে আসতে হচ্ছে। না হলেই মনের ভিতর টা কেমন খালি খালি লাগছে। সে সারা দিন এদিক ওদিক করছে ভাই এর সাথে। ও যা যা পড়বে এই পাঁচদিন আমি সব ওকে কিনে দিয়েছি। কিছু ওকে আগেই দিয়েছিলাম, আর কিছু আমার সুটকেস এ আছে। চাবি ওর কাছেও থাকে।

আজকে সারা দিন এসে থেকে, একটা কালো হাফ টি শার্ট আর আকাশী জিন্স পরে ঘুরছে। হাতে একটা সোনার রিস্টলেট। বা হাতে ঘড়ি। এর সব গুলোই হয় আমার দেওয়া না হলে আমার পছন্দ করে দেওয়া। মা বলছে ছোড়দি কে
– অর্জুন টার স্টাইল বেড়েছে দেখেছিস? ও ছোঁড়া কোন মেয়ের চক্করে পড়েছে পাক্কা।

ছোড়দি আর আমি হেসে উঠলাম জোরেই।
হায় রে, মেয়েটা কে শুনলে মা ভির্মী খাবে। তবে আজকে বুঝলাম, আসলে আমার মা বুদ্ধিমতী, তাই আমরা। আমাদের এই জিন টা মায়ের থেকে আসা। সন্ধ্যে বেলায় চুপি চুপি আমার ঘরে এলো অর্জুন। সবাই তখন বাইরে প্যান্ডেল এ। আমিও যাব বলে শাড়ি রেডী করছিলাম।

আমি বললাম
– এই দুষ্টু, এখানে কি করছিস রে?
– আমার ঘর দেখতে এলাম
– ইইইইইইশ, এটা তোর ঘর কি করে হলো? যা ভাগ, নিজের মায়ের একটা ঘর, নিজের একটা ঘর, আবার এই ঘর টা ও নাকি ওনার ঘর!!!
– কেন নয়?
– শুনি, কি করে এটাও তোর ঘর হলো?
আমি জানি ও কি বলবে। আর সেটা শোনার জন্যেই মরে যাচ্ছি আমি।
– মা মাসী, মনি, ইন্দু, চাঁদ মাসী সবার নিজের ঘরে তাদের বর নিয়ে আছে। আর এটা আমার বউ এর ঘর। অতএব এটা আমার ও।
– একটা থাপ্পড় লাগাবো। আমি কি করে তোর বউ হলাম?
– মনে মনে তো হয়েই আছ। আমিও মনে মনে তোমার বর হয়েই আছি, সেই কবে থেকে
– তবে রে? এ বাড়িতে তোর ও একটা ঘর আছে। সেটা আমার টার থেকে অনেক বড়।
– তাও এই ঘর টাই আমার পছন্দের।
– কেন?
– অনেক কারন।
– কি শুনি।

আমি চুল আঁচড়াচ্ছিলাম আর ওর সাথে বকবক করছিলাম।

– প্রথমত, এই ঘর থেকে পুকুর টা দেখা যায়। একমাত্র এই ঘর থেকেই দেখা যায়। দ্বিতিয়ত, এটা বেশ খোলামেলা ঘর, আর সব থেকে যেটা বড় কারন, এই ঘরে এলে আমি তোমার সুগন্ধ পাই। তোমার গায়ের, তোমার চুলের।
– উফফ হয়েছিস খুব রোম্যান্টিক তুই। যা এখন আমি কাপড় ছাড়ব।
– না আরেক টু থাকি। যা সুন্দরী হয়েছ, ইদানিং দেখি সবাই তোমাকে ঘিরে থাকে। আর কেউ ঘিরে না থাকলে, তুমি রান্না ঘরে দিদুন কে হেল্প কর। আমি কোথায় পাই তোমাকে? এই জন্যেই তো আসছিলাম না মামার বাড়ী। ওখানে থাকলে কি সুন্দর দুজনে থাকতাম
– সেই জন্যেই তো তোর মনি আমাদের নিয়ে এলো এখানে টেনে। হ্যাঁ রে, এতো কথা কি আমার সামনেই বলিস? কই আর তো কথা বলতে দেখি না আমি। বাইরে কথা বললে এতো দিনে তো গার্ল ফ্রেন্ড এর লাইন লেগে যেত।
– সেই জন্যেই তো বলি না। আমার উপরে অধিকার একজনের ই আছে। আর এই বউ টার উপরে অধিকার শুধু আমার।
– খবরদার, আমি কি বউ নাকি?
– হ্যাঁ আমার বউ ই তো।
– আবার? এই সব কথা বাড়িতে কেউ বলে না। কেউ শুনলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। কথা দিয়েছিস তুই আমাকে।
– আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। অতো ব্ল্যাক্মেইল করতে হবে না।

চলে গেল ফুড়ুৎ করে। এই রকম ভাবে মাঝে মাঝে এসে আমাকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়, আর আমি বাকি সময় টা নড়তে থাকি।
—————————

পনেরো

কেমন যেন অদ্ভুত ভালো লাগার সময় এটা। নিজেকে মনে হচ্ছে ওই বদমাশ টার বউ। বউ রা যেমন বর দের খেয়াল রাখে। এখন অস্টমীর আরতি চলছে, বর কি পড়বে? দেখি আমার সব দিদিরা নিজেদের সুটকেস থেকে কেউ পাজামা পাঞ্জাবী, কেউ পাঞ্জাবী ধুতি, তো কেউ শার্ট ট্রাউজার বের করে দিচ্ছে। আমার ও ইচ্ছে করছে, শয়তান টা কে, একটা কোবাল্ট ব্লু রঙের পাঞ্জাবী কিনেছি ওর জন্য, সেটা বের করে দিতে সুটকেস থেকে। ওকে পরলে দারুন লাগবে। সকাল বিকেল একটাই শার্ট আর প্যান্ট পরে থাকে। সেটাও মন্দ লাগে না। কিন্তু পুজো তো। একটু আরো ভ্যারাইটি পড়লে ক্ষতি কি।

বড়দি টাও যাচ্ছেতাই। নিজের ছেলেকে বলতে পারে না কিছু। নিজেই সাজ গোজ করতে ব্যস্ত। আমার কোন কালেই ওই সবে ইচ্ছে, মানে সাজগোজ এ ইচ্ছে ছিল না। এখন খুব রেয়ার, অর্জুনের জন্য সাজগোজ করি। কিন্তু সেটাও কম। ওর ইচ্ছে হলে। না হলে ও বলে আমাকে সাধারন ভাবে থাকলেই সব থেকে সুন্দরী লাগে।

জানিনা, ও হয়ত স্পেশাল। না হলে কেউ সাজতে বলবে আর আমি তার জন্য সাজছি, এটা কোন দিন ও মানতে পারিনি। এখনো ও ছাড়া কেউ আমাকে সাজতে বললে মারাত্মক বিরক্তি লাগে। হ্যাঁ ও যা খুশী আবদার করে আমার কাছে। আমি ওকে দেখি তখন শুধু আর ও যা করতে বলে করেও দি। সেটা সাজ গোজ ই হোক, কোন কবিতা আবৃত্তি ই হোক বা গান। গান তো আমার বাপের জন্মে আমি শিখিনি। কিন্তু ও বললে সব চলে আমার।

কোথায় গেলো সে কে জানে? সারাদিন টইটই করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যখন নিজের ইচ্ছে হচ্ছে, টুক করে একবার এসে দেখে চলে যাচ্ছে। আমার ও ইচ্ছে করে দেখতে সেটা বোঝেই না। অদ্ভুত। ভাই যে ভাই সে ও আজকে সন্ধ্যের পরে পাজামা পাঞ্জাবী পড়েছে। আর সে কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাঁধা গরু ছাড়া পেয়েছে। একবারই তো দেখতে চাই একটু পরে পরে, সেটাও কপালে নেই আমার।

আমি একটা সাধারন হালকা রঙের তাঁতের শাড়ি পড়েছি একটা। পার্পল কালার যদি খুব ফেড হয়ে যায়, যেমন কালার হয় ঠিক সেই কালার। আর ডিপ পার্পল কালারের পাড়। মাঝে মাঝে ছোট বড় হালকা প্যাটার্ন এর কল্কা আঁকা। খুব দামী শাড়ি। ছোড়দি দিয়েছিল। খুব নরম শাড়ি টা। আমাকে খুব এলিগেন্ট লাগে এই শাড়ী টা পড়লে। সাথে ছোট একটা পার্পল কালারের টিপ কপালে। ছোট দুটো ডায়মন্ডের ট্যাপ কানের আর হীরের নাকছাবি টা। চুল টা খুলে রেখেছি। হালকা লিপস্টিক। হাতে কিছু নেই। অর্জুনের গিফট করা একটা রিস্ট ওয়াচ আছে বাম হাতে।

আরতি দেখতে নেমে এলাম নীচে হাতে অর্জুনের জন্য পাঞ্জাবী টা নিয়ে। ছোড়দির ব্যাগে রেখে দিলাম। ওকে দেখতে পেলেই বের করে দেব। আমি দিলে হবে না। ছোড়দি কে দিয়ে দেওয়াতে হবে। না হলে কে কি ভাববে কে জানে? আমি নীচে নামতেই যেন কয়েকশ জোড়া চোখ আমার দিকে ফিরল। কারোর চোখে সমীহ। কারোর চোখে ভালবাসা। কারোর চোখে হিংসা তো কারোর চোখে আনন্দ। পাত্তা দিলাম না। যেদিকে মা কাকিমা আর ছোড়দি, দাঁড়িয়ে ছিল সেই দিকে আমি চলে এলাম।

দিদিকে চুপি চুপি বললাম
– সে এলে তাকে ধরে, এই টা পড়তে বলে দিস।
– কি এটা
– পাঞ্জাবী।

দিদি আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। আর ললিত দা, বড়, মেজো জামাই বাবু, ইন্দু দির বর কে, আর চাঁদের বড় কে দেখে নিল। বুঝে গেল সবাই যখন পাঞ্জাবী পড়েছে। কিছু বলল না। পাঞ্জাবী টা হাতে নিয়ে রেখে দিল নিজের।

সবাই আছে, সে কোথাও নেই। তাকে পেলাম, মন্ডপে গিয়ে। গিয়ে দেখলাম, পাড়ার একটা ছেলের সাথে সাথে গল্প করছে। আমাকে দূর থেকেই দেখতে পেয়েছিল মনে হলো। আমি গিয়ে মা কে প্রণাম করতেই দেখলাম একটু কাছে চলে এলো। আর জাস্ট হাঁ করে দেখতে লাগল। আমার যেন মনে হচ্ছিল, হে ঠাকুর, ধরনীকে দ্বিধা করে দাও আমি ঝাঁপ দিয়ে দি। ইশ কি লজ্জা! ছোড়দি ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।ওদের মধ্যে কিছু কথা হবার পরেই দেখলাম চলে গেলো বাড়ির দিকে। কিছু পরেই, এলো পাঞ্জাবী টা পরে। পাজামা টা পড়েনি। জিন্স এর উপরে গলিয়ে নিয়েছে পাঞ্জাবী টা। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল জাস্ট… নাহ থাক।

ওর মা আমার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। ছেলেকে নতুন সাজে দেখেই এগিয়ে গেল ছেলের দিকে। আঙ্গুল কেটে দিল অর্জুনের। আমি হেসে ফেললাম দেখে। ইইইসশশশশ ধেড়ে ছেলের আবার আঙ্গুল কেটে দিচ্ছে মা। আমিও দিতাম কেটে তবে আঙ্গুল না, ঠোঁট দুটোকে বেশ করে ……

গ্রামের একজন বয়স্ক কে বলছিল বড়দি

– কাকা এই আমার ছেলে। এবারে আই পি এস হয়েছে। আই এ এস ও পেয়েছিল। নেয় নি বদমাশ টা।
সেই বয়স্ক লোকটি বলল- হবে না? ওর মাসী রা কি? সব এক এক টা রত্ন। বা বা বা। খুব ভাল। খুব ভাল থাক তোমরা।

বলে তিনি চলে গেলেন। মধুর উপরে যেমন মৌমাছি ভন ভন করে। দিদির আশে পাশেও মেয়ের বাবা মায়েরা ঘোরাঘুরি করতে শুরু করল। নতুন পাঞ্জাবী টা কে দিয়েছে বলতেই অর্জুন ছোড়দি কে দেখিয়ে দিল। বড়দি , ছোড়দির দিকের তাকিয়ে হাসতেই, ছোড়দি ও একটু হেসে দিল। আমি দাঁড়িয়ে আছি একটু দুরেই। মা কে এখান থেকে ভালই দেখতে পাচ্ছি। দুই মা কেই। প্রতিমার মা তাকিয়ে আছে নির্ভীক, দয়ালু হয়ে সামনে দিকে, আর আমার মা প্রতিমার দিকে ভয় আর সমীহ নিয়ে।

আমার পাশে এসে দাঁড়াল বদমাশ টা। খুব ভাবতে ইচ্ছে করছে এই ছেলেটা আমার , জাস্ট আমার। মেয়ের বাবা মায়েদের বলতে ইচ্ছে করছে। খবর্দার, ভুলেও নিজের মেয়েকে এগিয়ে দিও না। এ আমার। শুধু আমার।

কি যে ভাবছি বাচ্চাদের মতন আমি কে জানে? আমি না একজন প্রফেসর? এই রকম ভাবনা, জেলাসি, পজেসিভনেস কি আমাকে শোভা পায় নাকি? নাকি ভরসা নেই নিজের ভালোবাসার উপরে। খুব আছে। খুব আছে ভরসা। আর ওই ভরসা টাই আমার ভয়। যে ও আমাকে কোনদিন ভুলবে না। গায়ে গা ঠেকিয়ে দাঁড়াল অর্জুন আমার। আমার সামনে সুবর্ন আর চাঁদের ছেলে খেলছে একটা পুড়ে যাওয়া ধানি ফটকা নিয়ে। আমি ই সামলাচ্ছিলাম ওদের কে। আমি ওদের কে দেখছি আর অর্জুনের গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। ঢাকের আওয়াজ। ঘণ্টা, কাঁসর বাজছে। সামনে ধুনুচি নিয়ে নাচছে আমার কাকা। সবাই কলবল করে কথা বলছে। আর আমি শুনতে পাচ্ছি পাশ থেকে অর্জুন বলছে

– কি করে তুমি এতো সুন্দরী?

বুঝলাম ভালোবাসা ছাপিয়ে আমার রূপে নজর পরেছে এখন মহারাজের। কাল থেকে দুবার আমাকে এই কথা টা বলল। লজ্জার সাথে সাথে একটা ভালোলাগা আমারো । তাকালাম ওর দিকে। নিজেকে স্পেশাল লাগে না? যখন এতো সুন্দরী সুন্দরী অল্প বয়সী মেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর ও আমাকে বলতে এসেছে এই কথা? তাও সবার নজর এড়িয়ে।
– কি যে বলিস। দ্যাখ কত সুন্দরী রা এদিক ওদিক আছে।
– কেউ তোমার ধারে কাছে লাগে না। আচ্ছা তুমি কি ভাব, সৌন্দর্য মানে কি বাহ্যিক? কিন্তু ভাব, যে একবার ভিতরে সুন্দরতা টা দেখে নেবে, সে বাইরের সৌন্দর্যে কি ভাবে ভুলবে?
– এই শয়তান, তুই আমার ভিতরের সুন্দরতা কবে দেখলি রে? খুব পেকেছিস না? বলে ছিলিস না, এই সব কথা বলবি না আমাকে কোনদিন?

হেসে উঠল ও আমার কথায়। আমি তাকিয়ে দেখতেই থাকলাম দুষ্টু টা কে। কি মারাত্মক টেম্পটিং। ও বলল

– আরে? আমি মনের সুন্দরতা বলেছি।

ইশ। কি লজ্জা। ও কি বলল আর আমি কি মিন করলাম। আমি হার না মেনে বললাম

– ও। আমি কি ভাবে বুঝব? যে লেভেলের দুষ্টু তুই!!
– ডার্টি মাইন্ড
– কি? মার খাবি কিন্তু সুনু।
– কবে থেকে তো রেডী মার খেতে। সেই ছোট থেকে।
– আবার??
– আচ্ছা পাঞ্জাবী কিনেছ আমাকে বলনি তো
– আমি কিনেছি নাকি? তোর মনি কিনেছে।
– হ্যাঁ সে আমি জানি কে কিনেছে। শোন, ওটা তুমি ই কিনেছ? আমার চয়েস, আমি যে কোয়ালিটি ড্রেস পড়ি, সেটা আমার মা ও জানে না তুমি ছাড়া। আর মনি কি ভাবে জানবে? যেটা আমার একবার দেখেই পছন্দ হয় , হয় সেটা তুমি, আর না হলে তোমার কোন পছন্দ। আর পর্যন্ত এর অন্যথা হয় নি।
– ভারী চিনেছিস তো আমাকে?
– হ্যাঁ চিনি ই তো, ঠিক যেমন তুমি চেন আমাকে। তাই তো বলছি। ভাব ভাল করে ,ডিল টা ভেঙ্গে দিয়ে পালাবে কিনা আমার সাথে।

বড় দুর্বল হয়ে পড়লাম কথা টায়। মানে অর্জুন ও ভেবেছে আমাকে নিয়ে পালানোর কথা। কি অদ্ভুত জীবন। একটা মানুষ আর একটা মানুষের সাথে থাকতে পারবে না। কারন তারা নিষিদ্ধ সম্পর্ক লিড করে। ইচ্ছে করছে ওকে বলি আমার হাত টা ধরে আমাকে নিয়ে পালিয়ে চল। একটু তো জোর করতে পারিস। এতো দায় আমি যে আর একলা নিতে পারছি না রে। আমিও তো বলতে চাই, আমি কি করব, আমাকেই জোর করে বিয়ে করেছিস তুই। জোর করে , জোর করে। আর আমিও সেই অবলা নারী দের মতন হয়ে থাকব। কাঁদব লোক দেখিয়ে।
সেই জোর করার অধিকার তো তুই নিয়ে নিয়েছিস আমার থেকে, সেই রাতেই যে রাতে মিশিগান থেকে এলি আমার বাড়িতে। কিন্তু আমি তো আমার মনের কথা ওকে বলতেই পারি না। পাছে ও আরো দুর্বল হয়ে পরে। আমি ওকে দুর্বল করতে চাই না। ওকে সুস্থ সবল, সৎ ভাবে বাঁচতে দিতে চাই। যেদিনে আমি আমার মনের কথা বলব, সেদিনে ও আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারবে না আমি জানি। তাও ভালো লাগে না, এখানে এসেও সারাদিন টইটই করে ওর ঘুরে বেড়ানো। মাঝে মাঝে এসে তো মুখ টাও দেখিয়ে যেতে পারে। ভাবলাম, ওকে ব্যাপার টা ক্লিয়ার করে দি। বললাম

– কোথায় ছিলিস দুপুরের পর থেকে?
– কেন আমার সাথে পালাতে? টাইমিং মিসম্যাচ হল?
– আবার দুষ্টুমি? কোথায় ছিলি বল?
– তোমার ভাই মাছ ধরতে গেছিল, আমি ছিলাম। দারুন ইন্টারেস্টিং ব্যাপার।

আমি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে। রাগে পিত্তি জ্বলে উঠল আমার। দুপুর থেকে দেখতে পাই নি আর উনি গেছিলেন মাছ ধরতে? কিন্তু রাগ টা রইল না।চোখ দুটো বড়ই রইল, কৃত্রিম রাগ টা কখন যে ওর চোখের গভীরে ডুবে ভালোবাসা হয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি। যে ভাবে ও মাছ ধরা র ব্যাপারে ইন্টারেস্ট পেয়ে আমাকে বলতে শুরু করল, আমি ওতেই হারিয়ে গেলাম। শুনেছিলাম যারা টিনেজ প্রেমিকা তাদের এমন হয়। যাই হোক আমার তো টিনেজে প্রেমের অভিজ্ঞতা নেই। চমক ভাংতেই বললাম

– থাক হয়েছে, আমি মাছ ধরার কাহিনী শুনতে চাই নি।
– তবে?
– তবে আর কি ওই মাছ ধরা নিয়েই তুই থাক, আমি যাই।
– আরে? কোথায় চললে? আচ্ছা বাবা আচ্ছা, এর পর থেকে প্রতি তিন ঘণ্টায় , না না দু ঘন্টায় তোমাকে দেখা দিয়ে যাব একবার করে।

আমি উল্ট দিকে ঘুরে হাঁটতে শুরু করে দিয়েছিলাম। কিন্তু ওর কথায়, বুক টা মোচড় দিয়ে উঠল। মনে হল এতো আনন্দ আগে কোন দিন ও পাই নি। আমি না বলতেই ও বুঝে গেলো আমি কেন রাগ করছি? এই রকম প্রেমিক গুলোর জন্যেই মনে হয় ভগবান লজ্জা নামক জিনিস টা প্রেমিকাদের অলংকার করে দিয়েছেন জন্মগত ভাবে। ঘুরে গেলাম আমি। বললাম

– ইহহহ ভারী আমার রাজকুমার রে! ওকে নাকি আমাকে প্রতি দু ঘন্টায় দেখতে পেতে হবে। আমার দরকার নেই, অমন একটা ভোঁদড় কে প্রতি দু ঘণ্টায় দেখতে। তুই মাছ ধরা নিয়ে থাকগে যা।

বলতে বলতে আমি চলে এলাম। মনে এক রাশ আনন্দ, এক রাশ ভাল লাগা। গায়ে গা লাগিয়ে থাকার সুখ। না না এমন গায়ে গা লাগিয়ে অনেক থেকেছি আমরা, কিন্তু এই সবার সামনে গায়ে গা লাগিয়ে থাকার মধ্যে একটা গ্রহন যোগ্যতা থাকে। প্রেমিক প্রেমিকা নিজেদের প্রেম সবাই কে জানাতে পারলে খুশী হয়। কিন্তু মনে ভিতরে সেটা থাকলেও, আমি নিজেই এ ব্যাপারে আমার সব থেকে বড় শত্রু।

রাতে আমরা খাবার দাবারের জায়গা তে বসে আছি। উঠোনে খাচ্চে সবাই আর আমরা পাশেই একটা উঁচু দাওয়ায় বসে। আমরা সাধারনত, খেয়ে দেয়ে এখানে বসে গল্প করি। মানে দিদিরা, মা কাকি গল্প করে আমি বসে থাকি চুপ করে আর ওদের গল্প শুনি। এবারে আমাকে হাত লাগাতে হয় নি। মেজদির ছেলে, ভাই, চাঁদের বর মিলে পরিবেশন করে দিচ্ছে। জামাই পরিবেশন করছে দেখে আমি উঠেছিলাম। কিন্তু চাঁদের বর ছেলেটা নিতান্তই ভাল ছেলে। আমাকে বলল

– তোমাকে কিচ্ছু করতে হবে না। এ বাড়ির কি কেউ নই আমি? তুমি বস।

আমার ভাল লাগল। কোন দিন ও কথা বলিনি ওর সাথে আমি। মানে ইচ্ছে করে নি। হয়ত ও ভেবেছে আমি একটু অহংকারী। কিম্বা চাঁদ হয়েত বলেছিল, আমার অনেক কাহিনী ওকে। এড়িয়ে চলত সেও আমাকে। বা চলেও অনেকে। যেমন দিদি দের বরেরা, মেজদি, ইন্দুদি। আমি এগোতেই ও কিন্তু আমাকে একেবারে চুপ করিয়ে দিল। বেশ ভাল ছেলে চাঁদের বর টা। চাঁদ আমার কাছেই বসে ছিল। আনন্দে গাল টা টিপে দিলাম আমি ওর একটু ।
ছোড়দি এল আমাদের কাছে।

– কি কথা হচ্ছিল দুটি তে সন্ধ্যে বেলায় আরতির সময়ে?

দিদির ভয় আমরা প্রেমালাপ করছি কিনা। আমি আমার মনের কথা বলে ফেলছি কিনা অর্জুন কে। আমি দিদির দিকে তাকিয়ে নিরস হাসলাম দিদির দিকে। মনে মনে ভাবলাম, ওরে সেটা বললে তুই কি আটকাতে পারবি? কিন্তু মুখে বললাম

– না না তেমন কিছু না। ওর ট্রেনিং কবে থেকে শুরু হচ্ছে এই সব কথাই হচ্ছিল।

ততক্ষনে, চাঁদ বলে উঠল
– বুনপো আমাদের নান্দু ছাড়া কোথাও মুখ খোলে বলে জানা নেই। একমাত্র নান্দুর সাথেই ওর কথা হয়। আমি তো এটাও জানিনা যে ওর গলা কেমন?
– খুব গম্ভীর
– তাই?
– হুম।

কথা আমার শেষ না হতে হতেই, গম্ভীর আওয়াজ টা পেলাম

– মিমি তোমরা এখানে বসে? খাওয়া হয়ে গেল?

আমি তাকালাম চাঁদের দিকে। ইশারায় বললাম, গলা শুনে নে। আমি অর্জুনের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বললাম খাওয়া হয় নি। ও সেটা দেখে সামনের দিকে চলে গেল। চাঁদ তখন বলে উঠল

– ওরে অর্জুন, আমরাও বসে আছি। আমাদের ও জিজ্ঞাসা কর একটু বাবা।

আমার হাসি পেয়ে গেল। অর্জুন দাঁড়িয়ে গেল। আর যথারীতি চুপ করে দাঁড়িয়ে গেল। বুঝে গেলাম ওর কথা বলার ব্যাটারী খতম। আমি হাল ধরলাম। বললাম

– মানে তুই যে তোমরা বলেছিলি তাতেই সবাই ছিল তাই তো? মানে তোমাদের খাওয়া হয়েছে মানে আমাদের সবার টাই মিন করেছিলি, তাই না?

ঘাড় নেড়ে জবাব এল হ্যাঁ। বলেই এগিয়ে গেল সামনের দিকে পরিবেশন করতে। আমি চাঁদ আর ছোড়দি হেসে গড়িয়ে পড়লাম। যে এতো কম কথা বলে সে অফিসার হবার পরে কি করবে, এই নিয়ে চাঁদের বিশাল চিন্তা হয়ে গেল। ওর এতো প্রশংসা করে সবাই। আর আমার সেটা ভালো লাগে। সে ওর সরল মনের কথাই হোক বা ওর মারাত্মক হ্যান্ডসাম দেখাই হোক।

সেবারের পুজোটা আমার জন্য অনেক ভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। হয়ে গেল বহু দিন। কিন্তু তাও ঘটনা গুলো এমন ভাবে আমার মনে কোঠায় সাজানো, মনে হয় এই হয়ত হয়েছে। আমার জীবনের সব থেকে ভালো দূর্গাপুজা। সবাই মিলে আনন্দ করে সেই শেষ দুর্গাপূজা আমি কাটিয়েছি। তার পরেও দশ টা পুজো হয়ে গেল আমার জীবনে। কিন্তু ওই রকম মিস্টি আনন্দে ভরা পুজো, আমি আর কোনদিন কাটাই নি। কত বার যে ধরা পড়তে পড়তে বেঁচেছি সে আমরা জানি।

সেদিনে খেয়ে দেয়ে, আমরা বসে গল্প করছি। পরের দিন ভাই কে দেখতে আসবে পাত্রী পক্ষ। সবার মধ্যে একটা উত্তেজনা। মেয়ে নিজেও আসছে। শশুর বাড়িতে দূর্গাপুজো। যদিও মেয়েটি ভাই এর নিজের পছন্দ করা ছিল। যতদুর জানি অর্জুন ও মেয়েটা কে চেনে। আমার ভাই এখন যথেষ্ট রোজগার করে এবং বেশ ভালো ছেলে। ছোট বেলার মতন ওকে আমার আর কোন ভাবেই অপদার্থ মনে হয় না। আমাকে ভালবাসে খুব। কাল কেও সীমানাপুর গিয়ে আমার জন্য অনেক কিছু নিয়ে এসেছে যেগুলো আমি খেতে পছন্দ করি।

আমি তো ভাবতেও পারি না, এ বাড়িতে আমার জন্য এতো ভাবার লোক জন ও আছে। কাজেই ছোড়দি আমাকে বলছিল কালকে যেন আমি শাড়ি পড়ি। আমার সেটাই সমস্যার। আজকে পড়তে ইচ্ছে করেছিল পড়েছিলাম। দেখা যাক। দিদি বলছে যখন পড়তেই হবে। আমি অর্জুন কে খুজেও পেলাম না এই ভীড় এ। কিছু পরে দেখলাম, সব কিছু গুছিয়ে ও আর ভাই এলো আমাদের কাছে। ইশ ভাল পাঞ্জাবী টা তে বুকের কাছে ডাল কিম্বা তরকারি লাগিয়েছে। ধুয়ে দিতে হবে, না হলে নষ্ট হয়ে যাবে পাঞ্জাবী টা।

ওকে ইশারা করে বললাম ফোন টা দেখতে। ও ফোন টা দেখতেই ওকে লিখলাম

– পাঞ্জাবী তে কি লাগিয়েছিস?
– ইশ ডাল পরে গেছিল তখন।
– খুলে দে আমি কেচে দিচ্ছি।
– সেটা মুখে বললেও হতো।
– ইশ, সবার সামনে বলব খুলে দে আমি কেচে দেব? কেন আমি তোর বউ নাকি?
– হতে তো কেউ মানা করে নি? আর তুমি কেন হবে? আমাকে দেখতেই চাও না। আমি নাকি ভোঁদড়!
– এই বেশ করেছি বলেছি রে। কেন শুনছিস না আমার কথা? খুলে ওই তারে লাগিয়ে রাখ আমি কেচে দিচ্ছি।
– খুলব না
– প্লিস
– না আগে বল, তুমি কার?
– আবার ওই সব ফালতু ইয়ার্কী
– না না এটা ডিল এ ছিল, বলতেই হবে।
– কি করছিস। রাত হচ্ছে খুলে দে না। আর শোন খুলে উপরে চলে যাবি আমার ঘরে। সুট কেস এ একটা ব্ল্যাক, গোল গলা পাতলা টি শার্ট আছে ওটা পরে নিবি। না হলে ঠান্ডা লাগবে কিন্তু।
– কি যে বল। খুব গরম করছে আমার ।
– প্লিস।
– সব করব, আগে যেটা বলতে হয় সেটা লিখে দাও।
– না। ওটা বলব মুখে।
– কখন?
– সেটা তুই বুঝবি।
– আচ্ছা, তখন যেন ভয় পেও না।
– যা ভাগ। যা করতে বললাম কর।
– ঠিক আছে দেখছি দাড়াও।

ও খুলে দিল পাঞ্জাবী টা। আমি চুপচাপ উঠে গিয়ে বললাম, সবাই কে শুনিয়ে

– ইশ কেমন তরকারির ঝোল লাগিয়েছে দেখ। এখনি কেচে দিতে হবে, না হলে আর উঠবে না

আমার বড়দি, তেড়ে এলো একেবারে। এতো বড় ছেলে হয়েছে, কোন কান্ড জ্ঞান নেই। এটা খুলে তো পরিবেশন করবে বল। বক বক করতে করতে উঠে আসছে নিজেই কাচবে বলে। আমি হাত দেখিয়ে বড়দি কে মানা করে দিলাম। বললাম

– তোরা গল্প কর। আমি তো শুধু শুনি। সে কাচতে কাচতেও শুনতে পারব।

ইচ্ছে ছিল আমি ই কেচে দেব ওর পাঞ্জাবী টা। ওর মা পারত না। একটা ভাল পাঞ্জাবী নষ্ট করে দিত। কি সুন্দর লাগছিল এটা পরে আজকে ওকে। জানিনা কেন ওর কোন কাজ করতে আমার আনন্দ হয়। সেটা সে কেচে দেওয়াই হোক, বা হস্টেলে আমার কাছে থাকার সময়ে ওর প্রোজেক্ট লিখে দেওয়াই হোক। বা ওর জন্য জামা প্যান্ট বা কোন এক্সেসারিজ কিনে আনা হোক। বা ওর জন্য রান্না বান্না করাই হোক।

আমি পাঞ্জাবী টা কেচে ,না নিংড়ে , জল সমেত ই মিলে দিলাম উঠোণের তারে।

– কি রে নিংড়ে দিলি না?

বড়দি জিজ্ঞাসা করল আমাকে। আমি বললাম,

– ওর জামা কাপড় সব সুতির। কেচে নিংড়াবি না। কুঁচকে যাবে। এমনি ভাবে মিলে দিস, দেখবি শোকানোর পরেও ভাঁজ ইন্ট্যাক্ট থাকবে অনেক টাই।

আমার কথায় বড়দি এবারে বলতে শুরু করল, নান্দু টা পাকা গিন্নী হয়ে গেছে। বিয়ের জন্য একেবারে প্রস্তুত। মনে মনে ভাবলাম, তোর ছেলের খিদমৎ খেটেই গিন্নী হয়েছি রে।
—————————

ষোল

রাতে অপেক্ষা করছিলাম দুষ্টু টার জন্য। বলেছিলাম, ছোড়দি যেন জানতে না পারে। আমার ঘর টা একদম ধারে। মানে এটাই আমার আর ছোড়দির ঘর ছিল। সেই ছোট খাট এখন আর নেই। আমি একটা ডিভান কিনে এখানে রেখে দিয়ে গেছিলাম বছর তিনেক আগে যখন এসেছিলাম। আমি না থাকলেও মা রোজ এই ঘর টা পরিষ্কার করে। এসেই বুঝেছি। ধুপ ধুনো পরে।

জানালা খুলে শুয়ে আছি আমি। আর হয়ত দিন দিন সাতেক পরেই পূর্নীমা। রাত হয়েছে আকাশে জ্যোৎস্না থই থই করছে। খুব ভালো লাগল আমার। দরজা খোলা রেখে বসে আছি। কি জানি আসতে পারবে কিনা। ভাই এর সাথে তো থাকে সব সময়ে। ভাই না ঘুমোলে আসতে পারবে না। কিন্তু আমার ঘুম আসছে না। ইচ্ছে করছে, এই বিছানায় এসে ও আমার সাথে বসুক। কথা নয় কোন, শুধু ওকে দেখি। নিঃশ্বাসের ঘ্রান নি। অনুভব করি ওর বুকের ধুকপুকুনি। অনেক রাতে এল। মনে হয় তখন একটা দেড়টা বাজবে। চুপি চুপি ঢুকল সে।

– কি গো ঘুমোউ নি? আমি তো ভাবলাম তোমাকে জাগাতে হবে আমাকে ঘুম থেকে।

কোন কথা বললাম না আমি। জানালার দিকে সরে গেলাম আরো, পাশের জায়গা টা ফাঁকা করে দিয়ে। ও টি সার্ট টা খুলে খালি গায়ে আমার পাশে এসে শুলো। হুম এই তো গন্ধ পাচ্ছি ওর। ও পছন্দ করল বলে, আমি শাড়ি টাও ছাড়িনি এখনো। সত্যি কত সাহস বেড়েছে আমার। বাড়ি ভর্তি লোক। আর আমি আর অর্জুন শুয়ে আছি এক বিছানায়।
বললাম
– যাক তোর এই আশাও পূর্ন হয়ে গেল। যত বর বউ আছে আজকে এ বাড়িতে সবার মতন তুই ও এই ঘরে এসে শুলি এক বিছানায়।
এসে আমার হাত টা ধরল ও। হাতে একটা চুমু খেয়ে বলল
– হুম।

খুব ভালো লাগে আমার ও যখন কথায় কথায় আমার হাতে চুমু খায়। বড় ভালবাসা সেই চুমু তে। বললাম

– কি হলো? এতো বড় এচিভমেন্ট আর একটা হুম মাত্র।

চুপ রইল অর্জুন। কিছু পরে বলল
– জানো?
– কি?
– যখন তুমি কালকে সবাই কে প্রণাম করলে, আমিও করলাম। বেশ তোমার বর বর ফিলিং আসছিল আমার।
– তা আর বুঝিনি? দুষ্টু। শুধু আমি কেন, তোর মনিও বুঝেছে
– বুঝুক গে। মনির জন্যেই তো আমরা ঠিক করে প্রেম করতে পারছি না।
– আহা, তোমার মতন মহাদেব কে না আটকালে এতো দিনে বাড়ি সুদ্ধু লোক জেনে যেত।
– যেত যেত। কি হতো? আমাদের তাড়িয়ে দিত। ভালো হত। আমরা চলে যেতাম। আলাদা থাকতাম
– কি বুদ্ধি। সবার আশীর্ব্বাদ না থাকলে সেই জীবন কি সুখের হয়?
– বাজে বোক না তো। কত ইন্টার রিলিজিয়ন বিয়ে হচ্ছে, ইন্টার কাস্ট বিয়ে হচ্ছে। সবাই কি আশীর্ব্বাদ পায় নাকি পরিবারের?
– বাবাহ, খুব কথা বলছিস আজকাল।
– হুম বলি না। বললে ঠিক ই বলি।

আমি কথা ঘোরালাম
– ভাই ঘুমিয়েছে?
– তোমার ভাই হবু বউ এর সাথে ছাদে প্রেমালাপ করছে।
– তোমার ভাই কি? আজকে সন্ধ্যে তেও বললি। তোর মামা হয় না?
– বাল হয়। শালা হয় শালা

এক কিল মারলাম ওর বুকে। কিন্তু রাগে নয়। একটা ভালো লাগায়। কিন্তু বুকের ভয় টা বেড়ে গেল। সত্যি তো আমাদের সম্পর্ক টা পূর্নতা পেলে, আর ও একশো টা সম্পর্ক উলটে পাল্টে একেবারে নষ্ট হয়ে যাবে। শালা কথা টা নিয়ে বেশি জল ঘোলা করলাম না। শুধু বললাম রাগের ভান করে

– আবার মুখ খারাপ করে?
– উহ এতো বকাঝকা কর কেন সবসময়ে? ভুলে যেও না আমিও তোমার হবু বর।
– ভারী বর এলেন আমার।

কিন্তু কথাটা বলে, নিজেই গলে গেলাম। ওর বুকে মুখ গুঁজে দিলাম একেবারে। জীবনে প্রথম বার। যাতে আমার ভয় টা ও ধরতে না পারে। ওকে বলি কি করে আমি যে আমিও সেই ইচ্ছে পোষণ করি মনে মনে। যে ডিল টা ভেঙ্গে ভেগে যাই ওর সাথে। কিন্তু আমার কাছে দুটো দিক ই ভীষণ ইম্পর্ট্যান্ট। যদি পালিয়ে যাই, আমার বাবা মা, দিদিরা, অর্জুনের বাবা মা, কাকে কি জবাব দেবে? সবাই নান্দু অর্জুন কে নিয়ে পালিয়েছে। বদনাম তো হবে এক, উপরে জুটবে অভিশাপ। আমার জীবনে অভিশাপ আসুক। কিন্তু অর্জুন জুড়ে যাবে তখন আমার জীবনে। আমার সাথে সেও অভিশাপ কুড়োবে দশ জনের। সেটা আমি কি করে হতে দি। সাড়া দিলাম না আমি বিশেষ। ওর বুকে এতো ভরসা ছিল বলে বোঝাতে পারব না। বললাম

– বেশ আর পুটপুট করতে হবে না। আরেকটু জড়িয়ে ধরে থাকি, তার পরে তুই ভাগ।
– আর আমি?
– তুই কেন? তুই তো বলেছিস আমাকে জড়িয়ে ধরবি না কোন দিন। আমি তো বলিনি যে ধরব না।
– ইল্লী আরকী।

এই বলে আমাকে চেপে জড়িয়ে ধরল। কতক্ষন ছিলাম জানিনা। মনে হয়, এতো নিশ্চিন্ত কোন দিন ও হইনি, ওকে জড়িয়ে ধরার পরে যত টা নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম। ঘুমিয়ে গেছিলাম মনে হয়। যখন চোখ খুললাম দেখলাম ও আমাকে দেখছে বড় বড় চোখ নিয়ে। বললাম আদুরী গলায়

– কি রে যাবি না? দশ জনা কে না দেখালে কি তোর শান্তি হবে না?
– আমি যেটা শুনি সেটা বলে দাও।

কথাটা ওর শেষ ও হলো না। বাইরে গলা খাঁকারির আওয়াজ পেলাম। মনে হয় কাকা হবে কিম্বা বড় জামাইবাবু। আমি ওকে আলমারির পিছন টা দেখাতেই, এক লাফে উঠে গিয়ে লুকিয়ে পড়ল আলমারির পিছনে। ভয়ে আমার বুকের ধুকপুকুনি বেড়ে গেল অস্বাভাবিক রকমের। আর সাথে সাথে ওর লাফিয়ে চলে যাবার দৃশ্য টা মনে করে মনে মনে হেসেও উঠলাম। বীর পুঙ্গব আমার। এক লাফে আলমারির পিছনে ঢুকে গেল। আমি চুপ করে শুয়ে পড়লাম। ঘর অন্ধকার ই ছিল। কাকাই মনে হলো। আমার ঘরের দরজা খোলা দেখে অবাক হয়ে গেল একটু। কিন্তু সোমত্ত মেয়ের ঘরে ঢুকতে ও পারল না কাকা। বাইরে থেকে বন্ধ করে দিল দরজা টা ঠেসিয়ে। বেশ কিছুক্ষন আমি মরার মতন পরে রইলাম।

পরে কাকা চলে যাবার আওয়াজ পেতেই সে বেড়িয়ে এলো আলমারির পিছন থেকে। ওর বুকে কান পেতে দেখলাম, ধুকপুকুনি আমার মতই হচ্ছে।
ওকে জড়িয়ে ধরলাম আবার। বললাম,

– ইনি নাকি আমাকে নিয়ে পালাবেন। মহাবীর। একটা গলা খাঁকারি তেই এক লাফে আলমারির পিছনে!
– দেখ, চ্যালেঞ্জ নিও না। শুধু তোমার মুখ চেয়ে চুপ করে আছি।
– আচ্ছা আচ্ছা বেশ , এবারে থাম। একটু জড়িয়ে ধরে থাকতে দে।
আমাকেও জড়িয়ে ধরল অর্জুন। বলল
– আর সেটা বলবে না?
– বেশ, আমি তোর । আর কারোর না।
– মনে থাকবে?
– উম্মম্মম্ম । এবারে ভাগ। আর শোন, আমার দু ঘন্টা পরে পরে তোর দেখা না পেলেও চলবে। ওটা কে তুই এক ঘন্টা করে নিস। প্রতি ঘন্টায় হলে আপাতত চালিয়ে নেব।

এক মুখ হাসি নিয়ে তড়াক করে উঠে পালালো। মন টা আনন্দে ভরে গেল। মনে প্রচণ্ড চিন্তা কিন্তু, এই সুখ টা তে সেই চিন্তা কোন ভাগ বসাতে পারল না। দরজা বন্ধ করে এসে, ঘুমিয়ে গেলাম কোন অতলে।

সকালে উঠতে দেরী করে ফেলেছি। নামলাম যখন তখন সাত টা বেজে গেছে। আমার পক্ষে আন- ইউসুয়াল ব্যাপার টা। আসার সময়ে অর্জুনের ঘরের পাশ দিয়ে এলাম। দেখলাম তিনিও ঘুমোচ্ছেন বিছানার এক ধারে। সকালে বেশ ঠাণ্ডা লাগছিল বলে, গায়ে আমার ঘর থেকে একটা চাদর নিয়ে গিয়ে চাপা দিয়ে এলাম। জানিনা ওকে পাব কিনা জীবনে। কিন্তু এই গুলো করে মনের আশ মিটিয়ে নি। আমি বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরোতেই, দেখলাম ছোড়দি, বাচ্ছা গুলো কে হেলথ ড্রিঙ্ক খাওয়াতে খাওয়াতে আমাকে দেখছে। আমি প্রমাদ গুনলাম। বুঝে গেলাম কি ভুল করেছি। আমিও ঘুমিয়েছি দেরী অব্দি আর সেও ঘুমোচ্ছে। দিদির এই সব ক্যাল্কুলেশন এ ভুল হয় না। ইশ আমারি দোষ, আমি যদি উঠে পড়তাম পাঁচটা তে তবে সমস্যা থাকত না। আমি প্রায় আড়াই ঘন্টা বেশী ঘুমিয়েছি আজকে।

কলপারে যখন আমি গেলাম, দিদি শাম্প্যু করছিল বসে। আমিও বসে পড়লাম। আমি রোজ ই শ্যাম্পু করি। আমি দেখেছি এতে আমার চুল বেশ ভালো থাকে। ঝরে না। কলপার টা ঘেরা। বাবা বানিয়েছে একটা ঢাউস চৌবাচ্চা। এমন তিন চার জনা একসাথে স্নান করতে পারে। ঘেরা বাথরুম ও তিনটে আছে। কিন্তু আমরা বোনেরা এই ভাবেই গল্প করতে করতে স্নান করি। আজকে আমি আর ছোড়দি আছি। আমি তো বিশেষ সাড়া দিচ্ছি না। দিদি ই প্রথম কথা বলল
– কি ব্যাপার আমার ডেয়ার ডেভিল বোন, আজকে আমার সাথে চোখে চোখ রাখতে পারছে না কেন?

মাথায় জল ঢেলে তাড়াতাড়ি, শামপ্যু ঘষতে শুরু করলাম, যাতে দিদি আমার চোখ দেখতে না পায়। বললাম,

– কি যে বলিস? কেন চোখে চোখ রাখতে পারব না কেন?
– সে তুই জানিস। এখানে এসে দেখছি, রূপ চর্চায় বেশ মন লেগেছে।
– কি যে বলিস বুঝি না। ওই টুকু আমি ইদানীং করি।
– হুম, যেদিনে অর্জুনের সাথে দেখা হয় সেদিন করিস, আর এখানে রোজ করছিস।
– দিদি, প্লিস।
– তুই কিন্তু প্রচন্ড ভাবে ইনভল্ভ হয়ে পড়ছিস। আমি দেখছি সেটা
– কি রকম? আমি তো থাকি ই না ওর ব্যাপারে। কি খাচ্ছে কোথায় যাচ্ছে কিছুই জানিনা।
– তাই? কালকে ওর পাঞ্জাবী টা কাচতে কে বলেছিল?
– এ মা না হলে দাগ লেগে থাকত।
– ওর মা তো যাচ্ছিল, আটকালি কেন ওর মা কে?
– ওর মা কে চিনিস না? পারত না ঠিক করে।
– হুম সেটাই বোঝাতে চাইছি। নিজেই বোঝ কত টা পজেসিভ তুই ওকে নিয়ে। ওর সামান্য জামা কাপড় নিয়েও তুই কত টা পজেসিভ। আর তুই বলছিস তুই ওতে ইনভল্ভ না? তুই কিন্তু দিব্বি কেটে বলেছিলি যে তুই এই ব্যাপার টা থেকে বেরিয়ে আসবি। কথা দিয়েছিলি।

হুশ হুশ করে জল ঢালতে লাগলাম আমি। সত্যি টা দিদি বলে দেবার পরে, আমার যেন শরীরের গরম বেড়ে গেল। জল ঢালা শেষ হলে দিদি আবার বলল,

– কতক্ষন ছিল কালকে রাতে ও?
– বেশীক্ষন না।
– তাও?
– ঘড়ি দেখিনি।
– হুম আমি দেখেছি। ও শুতে এসেছে প্রায় চারটে।
– অ্যাঁ?

চমকে উঠলাম আমি। এতোক্ষন ছিলো ও আমার কাছে কালকে? হে ভগবান। আমরা কেউ বুঝতেই পারিনি। আমার মনে হচ্ছে আমার এই অদ্ভুত টানের জন্যেই ও আমার থেকে দূরে সরতে পারছে না। কারন আমি ওকে দূরে সরতে দিচ্ছি না। যতই আমার অজান্তে হোক সেটা। আমি তো কোন অসুখে নেই। কিন্তু ওর অসুখ আমি বাড়িয়ে দিচ্ছি। আর সেটা ও বুঝতে পারছে না। যে সম্পর্কে র কোন ভবিষ্যৎ নেই, সে সম্পর্ক নিয়ে ওকে আমি কেন এতোটা ইনভল্ভ করে ফেলছি?

আমি পুরো মাত্রায় দুর্বল একটি প্রানী। যাকে ভালোবাসি তার জন্য আমি এই টুকু কস্ট মেনে নিতে পারছি না? কিন্তু সত্যি ই কস্ট এই টুকু? বুঝতে পারছি না। ওকে যখন ছেড়ে এসেছিলাম আমি খড়গপুর থেকে, এক বছর আমি কেঁদে ছিলাম, আড়ালে আবডালে। কাউকে বুঝতে দিই নি। মনে মধ্যে কি রকম ফাঁকা জায়গা তৈরি হয়েছিল আমি জানি। কারন ওই সময়ের কারোর সাথে আমার আর যোগাযোগ নেই। এর মানে তো পরিষ্কার, আমি ছিলাম ওখানে এটা ঠিক কথা, কিন্তু মন টা ফাঁকা হয়ে গেছিল বলে ভাবতাম, সেটা আসলে ওর ই স্মৃতি তে পরিপূর্ন ছিল। কেউ ঢুকতেই পায় নি ভিতরে।

ওখানে কম করে আমি খান দশ প্রপোজাল পেয়েছিলাম, বিয়ে বা প্রেমের, কিন্তু কারোর মুখ তো দুরের কথা নাম ও মনে নেই আমার আজকে। আমি যেখানে যেখানে ও কে নিয়ে থেকেছি বা ওর সাথে ইন্টার‍্যাকশন হয়েছে, সেখানের কথা আমার মনে আছে। বাকি কথা আমার স্মৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। মজার ব্যাপার যে তিন বছর মাঝের, আমার আমি বাড়ির সাথে কোন যোগাযোগ রাখিনি, খেয়াল করে দেখলাম আমার সাথে অর্জুনের কোন রকম কোন যোগাযোগ ছিল না। এটা বাড়ির সাথে যোগাযোগ রাখিনি বলে হয়েছে, নাকি অর্জুনের সাথে যোগাযোগ নেই বলে আমার কিছু ভাবতেও ইচ্ছে করে নি।

আমি কি ছোট থেকেই ওর উপরে অবসেসড ছিলাম? নাকি সেটা খড়গপুর থেকে হয়েছে? আমার মন বলছে খড়গপুর থেকে, কিন্তু মাথা বলছে হয়ত তার আগে থেকেই। না হলে একটা মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়া বাচ্চা ছেলেকে জড়িয়ে ধরে ছাদে কেন কেঁদেছিলাম? এই সম্পর্কের পিছনে কে বেশি সময় আর নিজের মন দিয়েছে, আমি না অর্জুন?

আমি ভাবতাম, অর্জুন ই সে যে আমাকে বাধ্য করেছে ওকে নিয়ে ভাবতে। কিন্তু অর্জুন কেন? আমার তো ওকে সেই সময় থেকেই ভালো লাগত যে সময়ে আমি আর ও দুজনাই বাচ্চা ছিলাম। কেন ভালো লাগতো? কি কারন?
নিজের ঘরেই ছিলাম চুপ করে বসে আমি। আর বসে বসে মাথা আর মন তোলপাড় করে ভাবছিলাম এই সব কথা। বাড়িতে অনেকে আসবে আজকে। আমি দিদির সাথে স্নানের সময়ে কথা বলে সেই যে ঘরে এসেছি আর নিচে যাই নি। ইচ্ছেও করছে না। দিদির কথা গুলো আমার বুকে বাজছে দামামার মতন। আমি ওকে নিয়ে কি লেভেলের পজেসিভ সেটা দিদি আমাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে আজ দেখিয়ে দিল। লজ্জা লাগছিল খুব, কিন্তু তার থেকেও বুকে লাগছিল, আমার জন্যেই ছেলেটা একটা নর্ম্যাল লাইফ লিড করতে পারছে না।

এই সময়ে ওর হেসে খেলে জীবন কাটানোর কথা। কত বন্ধু বানাবে, মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করবে। হাসি খুশী তে কাটাবে জীবন। ও হয়ত ভাবছে আমাকে চোখে সামনে দেখছে, হাতের কাছে পাচ্ছে, ও খুশী তে আছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি, ওই হাসি খুশীর পিছনে ওর মনে কি ঝড় চলছে। আমাকে না পাবার মারাত্মক যন্ত্রণা ওকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে অনবরত। তাই যতক্ষন আমার সাথে থাকছে ভালো থাকছে আর আমি না থাকলেই চুপ করে যাচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি এটা। কারন আমার ও ঐ এক ই হাল। নাহ ভাবতে পারছি না। কে কার জীবন থেকে সরে গেলে , কার জীবন টা ভালো হবে আমি বুঝতে পারছি না। হয়ত দিদিও পারছে না বুঝতে তাই ধীরে ধীরে আমাদের সম্পর্ক টা ওর মন মেনে নিয়েছে। ও হয়ত ভাবছে, দোষ দুজনার ই। বা দুজনার ই কিছু করার নেই।
মানুষের মন পড়ার ক্ষমতা আমার মারাত্মক। তা সে আমার স্বামী হোক বা ছেলে মেয়ে। মা হোক বা বাবা, দিদি হোক বা ললিত দা। কিন্তু যেদিন বুঝলাম যে আমি অর্জুন কে ভালোবাসি, সেদিন থেকে ওর মন পড়া বন্ধ করে দিয়েছিলাম।

ভয় পেয়েছিলাম। যদি আমি ভুল বুঝি? যদি এমন কিছু বুঝি যেটা তে আমি ওকে ঘেন্না করতে শুরু করি? কি মুশকিল না? সারা জীবন আমি এই মুশকিল বয়ে নিয়ে বেড়িয়েছি। আমি যে রকম দুর্বল ছিলাম, ও চাইলে আমাকে যে কোন মুহুর্তে সব রকম ভাবে পেতে পারত। আমি হয়ত ওকে আটকাতেও পারতাম না। কিন্তু ও এগোয় নি। বিশেষ মুহুর্তে ওকে আমি আমার শরীরের নানা জায়গা জাস্ট গিলতে দেখেছি। ইয়ার্কী মেরেছে। আমি কিল থাবড়া দিয়েছি রেগে। কিন্তু ও লিমিট ক্রস করেনি কোন দিন । আমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থেকে ঘন্টার পর ঘন্টা, কিন্তু একটা ফাউল টাচ করেনি আমাকে কোন দিন। এমনি এমনি ওকে ভালোবেসে ফেলিনি আমি।

আমি অনেক সময়ে মনে করতাম, ছেলেটা কি বীতকাম? এবারে হয়ত ঠিক কিছু করবে। কিন্তু ঠিক সময়ে ও আমাকে ছেড়ে দিয়েছে। এতো বোধ এই বয়সে কি করে এলো ওর মধ্যে। মনে হয়েছিল, এই আমার সেই মানুষ টা। ও জানে লাইন টা ঠিক কোথায় আছে। ও আমাকে বাধ্য করতে চায় নি। আমি নিশ্চিত আমাকে যদি ও সেই সময়ে এই শারীরিক সুখ টা দিত , আমি ই হয়ত ওকে নিয়ে পালাতাম। কিন্তু সেই বাধ্যতা আমার ঘাড়ে ও চাপিয়ে দেয় নি। জানিনা ও কি ভেবেছিল, বা আদৌ ভেবে করেছিল কিনা এটা, কিন্তু এই ব্যাপার টাই আমার আর সম্পর্কের মূল হয়ে গেছিল। বিশ্বাস আর ভরসা। ওকে চোখ বুজে বিশ্বাস করার ইচ্ছে টা আমার সেই থেকেই জন্মে গেছিল।

ও আমার দিদির ছেলে। সন্তান তূল্য। ভালোবাসা তো থাকবেই। কিন্তু ভেবে দেখুন সেই ভালোবাসা কি শুধুই অপত্য নয়? ও আমার থেকে এমন কিছু ছোট নয়। আমি উনত্রিশ তো ও চব্বিশ। দুজনাই মারাত্মক রকম এট্রাক্টিভ। ব্রিলিয়ান্টলি শাইন্ড সমাজে। দুজনের ই শরীর তখন ফুটছে। এই সব ছাড়িয়ে, যে ভরসা আমাকে ও দিয়েছিল, তাতে কি আমি ওকে ভালোবাসতে পারি না? মাসী নয় একটা সাধারন নারীর মতন? হ্যাঁ আমি অসহায়, তাই জিজ্ঞাসা করছি। আমার দোষ আমি খুঁজে পাচ্ছি না। মাঝে মাঝে মনে হয় সেদিনে মরে যাওয়া বেস্ট ছিল। যেদিনে ও আমার বাড়ি চলে এসেছিল সোজা মিশিগান থেকে। মরে গেলেই ব্যস আমার আর কিছু যায় আসত না। কিন্তু আমি শিওর ছিলাম, তারপরে সেও আর থাকত না পৃথিবীতে।
—————————

সতেরো

আমার দিদি, মুখে বলে আত্মহত্যা পাপ। কিন্তু দিদির ফিলসফি তে সেদিন আমি মরে গেলে কোন ঝক্কি আর থাকত না। সেটা আমি বুঝি। কিন্তু ও তো আমাকে তীব্র ভালবাসে, তাই কোনদিন ও মুখে বলে নি একথা। হয়ত আজ ও চায় সেটা। আর এই আশা তেই আছে আমি কোন দিন আত্মহত্যা করে নেব। তাই মাঝে মাঝে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না কাটি করে। বলেছিলাম না, আমি মন পড়তে পারি। বেচারি, শুধু আমার কথা আর অর্জুনের কথাই ভাবে না, ভাবে সবার কথা।

এ তো শুধু আমার সমস্যা না। এটা তো পুরো পরিবারের সমস্যা। এমন একটা সম্পর্ক, যেটা হয় না, কেউ মেনে নিতে পারে না।

– কী রে নিচে আসছিস না কেন? অ্যাঁ, এখনো শাড়ি পরিস নি?

চিন্তায় ছেদ পরল আমার। চোখ টা মুছে নিলাম আমি । তাকিয়ে দেখলাম ছোড়দি। অসম্ভব সুন্দর লাগছে দিদিকে আমার। এক টা লাল শাড়ি। এক গা গয়না। ঠিক লক্ষ্মী প্রতিমার মতন লাগছে। না না, মন্ডপে সাজানো মা দূর্গার মতন লাগছে দিদি কে। বাস হাতে একটা ত্রিশুল দিলেই ষোলকলা পূর্ন হয়। দিদি আমার সামনেই দাঁড়িয়ে। আমি বিছানায় বসে। কল্পনা করলাম দিদির হাতে ত্রিশুল, আর আমি পায়ের কাছে বসে। দিদি ত্রিশুল টা আমার বুকে বিঁধিয়ে দিচ্ছে একটু একটু করে। আর বলছে – তোর মতন আসুরী কে মারতেই আমার ধরায় আগমন।

চমকে উঠলাম। আমি কি দিদির মন পড়লাম? তবে এ কল্পনা এলো কি করে আমার মনে?
দিদি আবার বলল – কি রে চল, সময় নেই ওরা সীমানাপুরে চলে এসেছে তো!
– হুম যাচ্ছি
– কি ভাবছিলি? অর্জুনের কথা?
– মরন আমার। আর কি ভাবার বিষয় নেই নাকি আমার?
– হ্যাঁ, সে তো বটেই, সে আমি জানি, নে রেডি হ।

আমি দিদির দিকে তাকালাম। দিদির চোখে তাকিয়ে যে ঘৃনা দেখলাম, আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম উলটো দিকে। পারলাম না তাকিয়ে থাকতে। এতো তীব্র ঘৃনা? বুঝে গেলাম, দিদিও একি কথা ভাবছিল, যা আমি ভাবছিলাম তখন। আমাকে মেরে ফেলার কথা। অর্জুন তো বংশের প্রদীপ, সবার প্রাণ। ওর জানের দাম ই আলাদা। আমি তো তাকে শেষ করে ফেলব, যে অর্জুনের সামান্য ক্ষতির কথা ভাববেও। তাতে সে যেই হোক। কাজেই বাকি রইলাম আমি। আমার মরণে অর্জুন ছাড়া কারোর কিচ্ছু যায় আসবে না। তাই দিদি আমার মরন চাইছে। দিদি কে বললাম,

– আচ্ছা দিদি, আমার যদি এক্সিডেন্ট এ মৃত্যু হয়, তাহলেও কি অর্জুন শান্ত হবে না?

দিদি চমকে উঠল। বুঝে গেল, আমাদের দুজনের চিন্তা টা একি দিকে চলছে। মুহুর্তেই, দিদির চোখে ঘৃনার বদলে অপরিসীম ভালোবাসা আর ব্যাথা দেখলাম। হাসি পেল আমার। আহা রে, কি মারাত্মক দোলাচালেই না ভুগছে দিদি টা আমার। একদিকে আমার উপরে অপরিসীম ভালবাসা, তার উপরে দিদির জীবনে আমার অবদান, আর একদিকে রাক্ষুসী আমি। এতোগুলো পরিবার এর চিন্তা। রাক্ষুসী আমি টাই দিদিকে সব থেকে চিন্তায় ফেলেছে বলে আমার বিশ্বাস। আমাকে বলল

– কেন মরার কথা কেন?
– না বললাম, তুই কিছু করিস না আমাকে। মানে মারার চেষ্টা করিস না। আমি ভাবছি, এই রকম একটা প্লট বানিয়ে, এক্সিডেন্ট এর মতন করে মরে যাব।

দিদি আমার কাঁধে হাত রেখে কথা বলছিল। আমি শেষের কথা টা বলার সাথে সাথেই, কাঁধ টা খামচে ধরল। তাকিয়ে রইল আমার চোখের দিকে। চোখে একটা সমীহ মাখানো ভয়। মুহুর্তেই বদলে গেল সেটা, স্বাভাবিক হয়ে গেল। সেই আদ্র চোখ, আমার উপরে ভালোবাসা ফিরে এলো চোখে। ঠাণ্ডা গলায় বলল,

– আমি কি ভাবছিলাম, কি করে বুঝলি? বোঝার ভুল নয় তো তোর?

তখন চোখে কৌতুক উঁকি দিচ্ছিল দিদির। বুঝে গেলাম দিদির মনের কোনায় কথাটা এসেছিল, এতো গুলো পরিবার কে বাঁচাতে, আমাকে মেরে ফেলার কথা। হয়ত বুঝেছে, আমার পাষাণ প্রাণ। সহজে মরব না। তাই আমাদের সামনা সামনি কস্ট না দিয়ে অনেক ভিতর থেকে ভাবছে এই সমস্যা থেকে বেরোনর পথ। আমি দিদির কথার উত্তর দিলাম না। বললাম অন্য কথা

– আমাকে মারলে তোর কি হবে? সুবর্ন টা একা হয়ে যাবে। ললিত দা শেষ হয়ে যাবে। তোর সারা জীবনের তপস্যা র ফল তুই যা পাচ্ছিস সব জলাঞ্জলি যাবে। আর সব থেকে বড় কথা, জেলের ভাত তুই খেতে পারবি না।
দিদি হেসে ফেলল আমার শেষ কথা টা শুনে। হাসতে হাসতেই আমার সুটকেস খুলে আমার জন্য শাড়ি বের করে দিল। আমার পাশে রেখে বলল,

– আমি ধরা পড়ব তোকে কে বলল।

আমি শাড়ি টা নিয়ে খুলে ফেললাম। নিজে যে শাড়ী টা পরে ছিলাম, সেটা খুলে, নতুন শাড়ি টা পড়তে পড়তে উত্তর দিলাম
– অর্জুন ঠিক ধরে ফেলবে। ওকে তো চিনিস না। তারপর কি তোকে ও ছেড়ে দেবে ভেবেছিস?
– হুম সেটা ঠিক কথা। তবে কি উপায় বলত?
– তোকে তো বললাম।
– এক্সিডেন্ট?
– হুম।
– আরো একটা ভালো উপায় আছে।

চমকে উঠলাম আমি। মন টা ফাঁকা হয়ে গেলো। মনে হলো উপায় টা ঠিক ঠাক হলে সেটা মেনে নিতেই হবে। কিন্তু তাতে আমার আর অর্জুনের সম্পর্কের মিলন হবে না এটা নিশ্চিত। আমি না চাইলেও, এটা মেনে নেওয়া আমার পক্ষে মারাত্মক কষ্টকর হবে। কিন্তু পিছিয়ে আসলে চলবে না। দিদি কে বললাম কি উপায়? দিদির হাতের চুড়ি,শাঁখা পলার রিন রিনের আওয়াজের মাঝেই দিদি আমার শাড়ির কুঁচি ঠিক করতে করতেই বলল।

– তুই চলে যা অন্য কোথাও।
– আর অর্জুন?
– ওকে আমরা সামলে নেব?
– পারবি না রে দিদি। আমি জানি পারবি না
– তোকে সে সব ভাবতে হবে না।
– কিন্তু।
– কোন কিন্তু না। যদি না যাস ভাবব, তুই ছেলে টাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে দিবি না। ওর উপরে পজেসিভ হওয়া বন্ধ কর। তুই কি করে জানলি, তুই চলে যাবার পরে আমরা ওর খেয়াল রাখতে পারব না?
– না মানে, পারলে তো ভালো, কিন্তু যদি না পারিস।

দিদি আমার চুল টা খুলে দিয়ে আঁচড়াতে লাগল। এখনো হালকা ভিজে আছে আমার চুল টা। দিদি আঁচড়াতে আঁচড়াতে রেগে গেল, বেশ জোরের সাথেই আমাকে বলল,

– না পারলে তখন ভাবব। এখন সে সব তোকে বলতে যাব কেন। মোদ্দা কথা, আমি আর তোর পজেসিভনেস টা মানব না। আমি মানতে পারছি না। আর তুই ভেবে দেখ, এই পজেসিভ নেস টা মাতৃ সুলভ নয়। সব ঘেঁটে দিয়েছিস তুই আমার। ব্যস আমি আর মেনে নেব না । মনে থাকবে?

চুল আঁচড়ানো হয়ে গেলে আমাকে টিপ পড়িয়ে দিল দিদি। ততক্ষনে নিচে বেশ হই হল্লা শুরু হয়েছে। আমার সাজের বাক্স থেকে লিপস্টিক বের করে আমাকে পড়াতে লাগল দিদি। আর বলতে লাগল,

– কিন্তু যদি ও মেনে নেয় পুরো ব্যাপার টা, তবে তোকেও মেনে নিতে হবে, আর জীবনে ফিরতে পারবি না এদিকে, মনে থাকবে?

হ্যাঁ এই প্রপোজাল টা মন্দ না। কিন্তু চোখ আমার জলে ভরে এলো। মনে হচ্ছিল, হাপুস নয়নে কাঁদি। কিন্তু অর্জুনের জন্য এই টুকু করতে পারব না আমি? খুব পারব। এর মধ্যে দিদি আমাকে ধমক দিল,
– আচ্ছা এই ভাবে কাঁদলে আমি কি ভাবে কাজল টা পড়াব?
– পরাস না কাজল আমাকে আর। এই ঠিক আছি।
– আচ্ছা এবারে চোখের জল মোছ, আর নীচে চল। এই ভাবে তোকে অর্জুন দেখলে আমার উপরেই না রেগে যায়।

ঠিক করে নিয়েছি আমি, মণ্ডপের প্রতিমার বিদায় আর আমার বিদায় একসাথেই নেব। বলিনি কাউকে কিছুই। দুপুরে সবাই নিচে খাচ্ছিল, আর আমি সুটকেস থেকে অর্জুনের জন্য কিনে আনা ড্রেস গুলো কে বের করে রাখছিলাম। একে একে খুলে রাখছিলাম, সেই সব গয়না গুলো, যে গুলো আমাকে অর্জুন দিয়েছিল। আজকের দিন টা আছে আর মাঝে। আজকে প্রান ভরে দেখব ওকে। প্রান ভরে বাঁচব।

আজকে ভাই এর পাকা দেখা হয়ে গেল। আমিও ছিলাম কিছু সময় ওখানে। ভাই এর শাশুড়ি তো আমাকে দেখে খুব পছন্দ করেছে। ওর ছেলের জন্য। কিন্তু যখন শুনলো আমি অর ছেলের থেকেও বছর তিনেকের বড় তখন পিছিয়ে গেল। যদিও আমার সামনে এই সব কথা হয় নি। ভাই এর হবু বউ কোন ভাবে আমাকে চেনে। হয়ত কোন দিন ক্লাস নিয়েছিলাম। ও দেখছিলাম ওর মা কে আটকাচ্ছিল যখন ওর মা আমার রুপের প্রশংসা করছিল। আমার ভয়ঙ্কর রাগ ধরছিল। মনে মনে ভাবছিলাম, রূপ ছাড়াও আরো অনেক কিছু আছে আমার মধ্যে, যা তোমার ছেলের মধ্যে নেই।
রাগে চলে এসেছিলাম সেখান থেকে। সেই থেকে উপরেই আছি। কেউ ডাকেও নি আমাকে আর। খেতেও ডাকে নি। আমি অর্জুনের জামা প্যান্ট গুলো ওর ঘরের বিছানায় রেখে দিয়ে নিচে এসে দেখি, খুব হই হল্লা চলছে। খেতে বসেছে অনেকেই। আমিও গেলাম পরিবেশন করতে। চুপচাপ পরিবেশন করছি। দিদিরা সবাই খেতে বসেছে। সাথে জামাইবাবু রা। আজকে খুব ভালো লাগছে। পাশাপাশি সবাই বসেছে। ভাই আর ভাই এর হবু বউ ও বসেছে। আমি মা আর কাকি পরিবেশন করছি। অর্জুন নেই ধারে কাছে। ভাবলাম ওর খাওয়া হয়ে গেছে। সাধারনত খায় না ও আগে। কারন ওকে কেউ না বললে খেতে ও বসে না। কিন্তু ওর মা বসে গেছে দেখে ভাবলাম ও খেয়ে নিয়েছে আগেই। ওর মা ও সাধারনত ও না খেলে খায় না।
কিন্তু ওদের খাবার শেষের মুখে দেখলাম এলো কোথাও থেকে। ছাদে ছিল মনে হয়। কি জানি কি করছিল? এসে আমার সাথে পরিবেশন শুরু করল। ও আসলেই আমার চারিপাশ টা বদলে যায়। দিদির কথা বেমালুম ভুলে গেলাম আমি। ওর সাথে বক বক করতে করতে, সবাই কে খাইয়ে আমিও খেতে বসলাম। ছোড়দি আমাকে খেতে দিচ্ছিল। অর্জুন দেখলাম দূরে বসেছে একটু। ছোড়দি বলতেই চলে এল ও আমার কাছে। ছোড়দি পাশে বসতে বলতেই, পাশে বসে পড়ল এক মুখ হাসি নিয়ে। যেন চাইছিল আমার পাশে এসে বসতে। বাড়ির সব বর বউ যেমন একসাথে বসে খাচ্ছিল, আমারা ও সেই ভাবেই বসলাম।
এবারের পুজো টা যেন আমাকে ভরে ভরে দিচ্ছে সব কিছু। বাস আজকের রাত টা, কালকে আমি চলে যাব। আজকে যেন কিছু গড়বড় না হয়। ছোড়দি, যেন কল্পতরু হয়ে আমার ইচ্ছে পুরন করছে আজকে। সন্ধ্যে বেলায়, আমাকে আর অর্জুন কে ছেড়ে দিল অন্ধকারে, বাড়ির পিছনের বাগানে গল্প করতে। আমি অর্জুনের সাথে গল্প করছি, কিন্তু আমার মনে চলছে কালকের চলে যাওয়া। অর্জুন বুঝেছে কোন কারনে আমি অমনোযোগী। ও চেস্টা করছে আমাকে সব ভাবেই খুশী করার। আমাকে হাসানোর।
জানি না কতক্ষন কাটিয়ে ছিলাম আমি সময় ওর সাথে। তবে বেশির ভাগ টাই ওর বুকে ছিলাম আমি। ওকে চেপে ধরে। ও বুঝছিল না ব্যাপার টা। আজকে আমি ওর উপরে কেন এত দয়া করছি, সেটাই মনে হয় ওর বোধগম্য হচ্ছিল না।আগে কতবার বলেছে, একবার আমার বুকে এস, আর কোনদিন ও বলব না। কোনদিন ও যাই নি আমি। কোনদিন ও ওর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারিনি। কিন্তু গতকাল আর আজকে আর সে সব ভাবিনি আমি। বার বার জড়িয়ে ধরছিলাম, প্রিয় মানুষ টা কে। জানি কাল থেকে আর পাব না। জীবনে দেখা করব না বলে কথা দিয়েছি ছোড়দি কে।বেশী আঁকড়েও ধরতে পারছি না। ওই এক আঁকারেই হয়ত সব ধরে ফেলল। অনেক না বলা কথা ও না শুনেই বুঝে যায়। অনেক না বলা ব্যাথা ও এমনি ই অনুভব করে নেয় আমার। এমনি এমনি কি প্রেমে পড়েছি ওর?
আজকে রাতে আমি ওকে আসতে মানা করেছিলাম।কারন আজকে রাতে একলা থাকলে জানিনা আমি কি করে বসতাম। ওকে বলেছিলাম, আজকে রাতে অনেকে বাড়িতে আছে। ওকে যে আজ সন্ধ্যে বেলায় সময় দিলাম, এর কারন ই হলো রাতে ও আসতে পারবে না। এমনি বললে শুনত না। কিন্তু অনুনয় করলে শোনে। অনেক না শোনা কথাও শুনে নেয়। মন পড়ে ফেলে যে আমি চাইছিনা। আর ওকে সেটা বলতেও পারছি না।
সারা রাত তো ঘুমাই নি। আমার মোবাইল এ থাকা সব সব ছবি গুলো দেখছিলাম। কোন দিন আমরা জোড়ায় ছবি নিই নি। অনেকে থাকলে নিয়েছি।বাকি ওর সব ছবি ওর একলা আছে, আমার মোবাইল এ। কে কোথায় দেখে ফেলবে, আরেক কেলেঙ্কারি হবে। কোন টা একেবারে নায়কের মতন পোজ এ। তো কোন টা মুখ গোমড়া করে। হয়ত কিছু চেয়েছিল আমি দি ই নি। সর্বক্ষন ই তো গায়ে গায়ে লেগে থাকে আমার কাছে থাকলে। তখন ই হয়ত বকে দিয়েছিলাম ওকে। তাই মুখ গোমড়া। হাসি পেয়ে গেলো আমার। একেবারে বাচ্চা। আবার অসম্ভব পরিনত।
সারা রাত ই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলাম ওর ছবি গুলো। নাহ এই ব্রাউন রঙ টা ওকে মানাচ্ছে না। আর এই রঙের ওকে কিছু পড়াবো না। কোবাল্ট ব্লু ওকে দারুন মানায়। টি শার্ট গুলো এই রঙের কিনে দেব এবার থেকে আমি। নিস্ফল ভাবনা। কিন্তু মন কে, কে আটকে রাখতে পারে? আর আটকে রাখলেই বা আমি শুনব কেন? আমার মন ওকে নিয়ে হারিয়ে যায় কোণ স্বপ্ন রাজ্যে। সেখানে আমার আর ওর ঘর। কেউ নেই আর। বাস ও, আর ওর বুকে আমি।
দশমীর সকালে ঘট বিসর্জনের আগে, দেখলাম আমার ট্রেনের টিকিট কনফার্ম এর মেসেজ এলো। কাঁসর টা পড়েছিল সামনেই, কেউ বাজাচ্ছিল না। সবার মন বিষাদে আছে। আজকে মা চলে যাবেন। বাচ্চা গুলো ও বুঝতে পারে এই দূর্গাপূজার গুরুত্ব। অন্যান্য দিন কে কাঁসর নেবে আর কে ঘন্টা নেবে, সেই নিয়ে মারামারি করে রিতিমতন। কিন্তু আজকে কেউ নেই। যে যার মায়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। নিজের মা কে আঁকড়ে ধরে। ওদের কাছে ওদের মা ই দূর্গা। আমি কাঁসর টা হাতে নিয়ে বাজাতে শুরু করলাম। কাই নানা কাই নানা।
অর্জুন সবার আগে ছিল। যে দল টা ঘট বিসর্জন করতে গেল সেখানে ভাই আর তার হবু বউ ও ছিল। অর্জুন সবার আগে। আমার দেওয়া একটা টি শার্ট পরে আছে। প্যান্ট টা মনে হয় পুরোন পড়েছে। চিনতে পারলাম না আমি। সামনে যেটা পায় সেটাই পরে নেয় ও। ওরা চলে যেতে আমি বসলাম মায়ের বেদীর সিঁড়ি তে। সব মেয়েরাই বসে। মা কাকি দিদিরা। পাড়ার সব মেয়ে বউ রা বসে। জামাইবাবু রা এদিক ওদিক ছড়িয়ে আছে। দিদি আমার উপরে রেগে আছে। কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না। আমি যা করেছি সেটা অন্য কেউ থাকলেও করতাম। আর ও খচ্চর ছেলে সব সময়ে আমার পাশে এসে বসলে আমি কি করি?
শান্তি জল দিচ্ছিলেন, পুরোহিত দাদু। আমি শাড়ি পরে ছিলাম। শান্তি জল নেব বলে বসে পড়েছিলাম। আমি সব কটা বাচ্চা কে খুঁজে তাদের মায়ের পাশে বসিয়ে দিয়ে এলাম। অর্জুন আর ভাই ছিল দাঁড়িয়ে। ভাই কে মুচকি হেসে ওর বউ এর দিকে ইশারা করতেই সে ও লজ্জা পেয়ে, হবু বউ এর পাশে গিয়ে বসল। আর অর্জুন কে ওর মায়ের কাছে যেতে বলে আমি বসলাম সবার পিছনে। দাদু , শান্তির জল ছেটাতে শুরু করল সামনের দিকে। আমি ততক্ষনে, শাড়ি টা পিঠে জড়িয়ে মাথা নিচু করে বসে আছি শান্তির জল নেব বলে। হঠাত করে , হুড়ুম করে পাশে এসে বসে পড়ল অর্জুন। আর আমার শাড়ি টা টেনে নিজের পায়ে ঢাকা নিল। বুক থেকে আঁচল টা খসে গেল আমার। আমি তাড়াতাড়ি, বুকের আঁচল টা তুলে কাঁধের কাছে হাত টা চেপে ধরে রইলাম। না হলে আবার টানবে আর বুক থেকে আঁচল টা খসে পড়বে আমার। আমি ওর পা দুটো কে ভাল করে ঢাকা দিলাম। আঁচল টা বুকের উপরে কাঁধের কাছে চেপে ধরে রইলাম মাথা টা নিচু করে। উপর থেকে শান্তির জল পড়তে লাগল আমাদের উপরে। মাথা নিচু করেই বললাম,
– এতো দুস্টূ হয়েছিস কেন তুই? বললাম তোকে তোর মায়ের কাছে বসতে।
– বেশ করেছি তোমার কাছে বসেছি
– ব্যস। হয়ে গেল। কি কথার কি উত্তর। ওই ভাবে কেউ শাড়ি টা টান দেয়? বুক থেকে আঁচল টা খুলে গেলো না আমার?
– ও সরি সরি। আমার জিনিস অন্যে দেখে নিলো না?
– এক থাপ্পড় খাবি।
– কবে থেকে ওয়েট করছি। কবে দেবে বল। আজকে রাতে? গাল নিয়ে চলে আসব
– হয়ে গেছে শান্তির জল, এখন ভাগ পাশ থেকে। মনি দেখছে কিন্তু।
ও তো চলে গেল। আমি হয়ত ওকে এমনি বলার জন্যেই বলেছিলাম। মনি দেখছে। কিন্তু আমার ছোড়দির বাজের চোখ, ঠিক দেখেছে। আদ্যপান্ত দেখেছে।
তখন থেকেই রেগে আছে আমার উপরে ছোড়দি। সবাই যখন বাড়ি ফিরছিল আমি ছোড়দি কে ধরলাম।
– কি রে রেগে আছিস?
– তোর তাতে কি যায় আসে? তুই তো নিজের ইচ্ছে মতন ছেলেটাকে ঘোল খাওয়াবি।
আমি বুঝতে পারলাম না, ওই ঘটনায় আমি কি ঘোল খাওয়ালাম। আমি ওর পা দুটো কে ঢেকে দিয়েছিলাম। এই টা কি আমার অপরাধ। সাড়া দিলাম না। জানিনা আবার কি বোম্বার্ডমেন্ট হবে আমার উপরে। দিদি ই বলল
– কেন আঁচল টা খুলে দিলি ওর সামনে? এতে ঘোল টা তো ওই খাচ্ছে, তাই না?
আমি হেসে ফেললাম দিদির কথায়? বললাম
– আচ্ছা দিদি, এই সবার সামনে ওকে আমি বুকের আঁচল ফেলে প্রলুব্ধ করব? ভুলে যাচ্ছিস পরশু রাতে একসাথে ছিলাম আমরা। কালকে সারা সন্ধ্যে বেলাতেও একসাথে ছিলাম। হলে ওখানেই করতে পারতাম। আশা করি এই টুকু বিশ্বাস তুই করিস আমাকে। আর আজকে , ও এসেই আমার আঁচল টা টেনে নিজের পায়ে ঢাকা নিল। আমি পিন লাগাই নি আজকে শাড়ি তে, তাড়াহুড়ো তে বেড়িয়ে এসেছিলাম বলে। তাই খুলে গেছে বুক থেকে আঁচল টা। আচ্ছা শোন আর বকিস না আমাকে। এই দ্যাখ আমার টিকিট কনফার্ম হয়ে গেছে।
দিদি তাকিয়ে রইল আমার দিকে।
– কোথায় চললি?
– সেটা থাক। কারোর জানার দরকার নেই। মোবাইল টাও থাকবে এখানে। নিয়ে যাব না আমি। যাতে আমার কেউ খোঁজ না পায় আর।
দিদি আবার তাকিয়ে রইল আমার দিকে। হয়ত এটা বুজছে, আমি সত্যি চাইছি, অর্জুন টা স্বাভাবিক জীবন যাপন করুক। কিন্তু আমি না গেলে সম্ভব হবে না সেটা। আমি আর দিদিকে দেখলাম ও না। এতো ভুল বোঝা নিয়ে জীবনে চলা যায় না। দ্রুত হেঁটে চলে এলাম আমি আমার ঘরে।

দুপুরে ঘরে এসে ভাবছিলাম। দিদি ভালো প্রস্তাব ই দিয়েছে। বড়দি আমাকে বেশ ভালবাসে এখন। এই সব জানাজানি হলে, আমাকে আগের থেকেও বেশি ঘেন্না করবে। তুলকালাম হবে। বড় জামাই বাবু, এখন বেশ কথা বলে আমার সাথে। হয়ত ওর ছেলেকে আমি খুব ভালবাসি সেই জন্য। মানে সেই পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে বাঁচানোর ঘটনা জানাজানির পর থেকেই পছন্দ করে। নতুন করে ভালোবাসতে চেস্টা করে। এই সব এক লহমায় নষ্ট হয়ে যাবে। ছোড়দি র বুদ্ধি চিরকাল ই দারুন। বাস আমি চলে যাবার পরে অর্জুন টা সামলে নিলেই সব কিছু ভালোয় ভালোয় মিটবে। এই চলে যাওয়াই ভাল। সেটাই সব থেকে ভাল।
সন্ধ্যে বেলা, বিসর্জন হবে প্রতিমার। দিদি হয়ত চাইছে, আমার সাথে একলা থাকতে, কথা বলতে। জানে চলে যাব আমি। তাই শেষ কিছু কথা দুই বোনের। কিন্তু আমি আলাউ করছি না। আমার আর কিছুই ভাল লাগছে না। সবাই বিসর্জনের তোড়জোড় করছে। অর্জুন তো সবার আগে। ও নাকি কাঁধ দেবে ঠাকুর তোলার সময়ে। দিক। আমি ঠায় তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে। সবাই মিলে ধরাধরি করে ঠাকুর তুলল একটা ট্রাক্টর এ। ভয় ছিল আমার যে ওর কাঁধে না লেগে যায়। সামনেই জয়েনিং ওর। হাড় ভাঙ্গা ট্রেনিং ও হবে। এখন কাঁধে বা হাতে ব্যাথা পাওয়া ঠিক কথা না।
দিদিরা, মা কাকিমা, পাড়ার সব সদবা, সিঁদুর খেলল চুড়ান্ত। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম একটু দূরে পাশে। দিদি আমার দিকে এগোলেই আমি, এটা সেটার নাম করে সরে যাচ্ছিলাম। আমি আমার পার্স টা সাথেই নিয়ে রেখেছিলাম। আমার মোবাইল টা আমি রেখে এসেছি বিছানায়। পুরোন মোবাইল টা নিয়ে নিয়েছি । টিকিট টা ওখানেই আছে। কিছু টাকা তুলে ছিলাম । সেটা নিয়েছি। কার্ড টা নিয়েছি। চলে গিয়ে কলেজে রেসিগ্নেশন টা মেইল করে দেব।
মন্ডপের ভিতরে সিঁদুর খেলা চলছে। অর্জুন মাঝে মাঝে আমাকে দেখছে আর হাসছে। বড়ই ভালোবাসায় মাখানো ছিল সেই দেখা। যেন ও ভাবছে, আমি ওর বউ আর ওর ই কল্যানের জন্য আমিও সিঁদুর খেলছি। ইশারা করছে আর ওদিকের সিঁদুর খেলা দেখছে বার বার। জিজ্ঞাসা টা এমন, যে আমিও খেলছি না কেন? কি করে বোকা টা কে বোঝাই বিয়ে না হলে সিঁদুর খেলতে নেই।
ঢাকের তালে নাচছে ও। সাথে ভাই, চাঁদের বর, আর সব কটা কচিকাঁচা। ইশ কি ভালো লাগছে। চোখে জল এলো কি আমার? এই সব ছেড়ে, অর্জুন কে ছেড়ে নিরুদ্দেশের যন্ত্রণা বুকে? হুম। যতই কুল থাকার চেস্টা করি, পারছি কই থাকতে? চশমা টা খুলে শাড়ির আঁচলে চোখ দুটো মুছব বলে মন্ডপের পিছনে এলাম। আসতে না আসতেই ভুতের মতন অর্জুন এসে হাজির। হাতে কি ছিল জানিনা। আমাকে যেন এসে চেপে ধরল। উফফ বাবাহ গায়ে কি জোর হয়েছে বদমাশ টার।
– এই কি করছিস ছাড়!!!!
ছেড়েও দিল। তারপরে হেসে বলল, দেখ একবার নিজেকে এবারে। মণ্ডপের পিছন টা অন্ধকার খুব, তাই আমি পার্স থেকে মোবাইল বের করে সেলফি ক্যামেরা র আলোতে যা দেখলাম, মনে হলো অজ্ঞান হয়ে যাব। দুই গালে সিঁদুর। আর তার থেকেও বড় কথা, আমার সিঁথি জুড়ে অর্জুনের পরিয়ে দেওয়া সিঁদুর। আমার হাত পা জাস্ট কাঁপতে লাগল। কাঁপা গলায় বললাম,
– অর্জুন!!!!!! একী কি করলি তুই?
– জানিনা। মনে হল এটা করা উচিৎ।
– এর মানে তুই জানিস না? কী ভয়ানক এর মানে? কি রে? তুই কি পাগল হয়ে গেলি?
ঝাঁকাতে লেগেছিলাম আমি অর্জুন কে। তীব্র রাগ আর অভিমানে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম আমি। আমি যেন ওকে শেষ করে ফেলব এবারে। নিশ্চই ও মজা করেছে এটা। আমি ওকে বললাম ওই ভাবেই
– তুই এটা মজা করেছিস তাই না? সত্যি করে বল, এ রকম মজা করতে নেই। এ যে মহাপাপ। এ তুই কি করলি?
অর্জুন থমকে গেল একটু। শান্ত হয়ে গেল আমার ঝাঁকানি তে। একেবারে শান্ত। আমার চিবুক টা ধরল। তুলে ধরল নিজের মুখের দিকে। আমি বাক্যহারা ওর কান্ডে। বলল
– জানি, এর কি মানে। তাই তো দিলাম। আর কোন ভাবেই মজা আমি করিনি। আমি জীবন নিয়ে মজা একদম পছন্দ করি না। থাক, এবারে সারা জীবন আমার হয়ে। আর আমাকে তোমার করে নিয়ে। বড্ড সুন্দরী হয়ে উড়ছিলে। সেটা বন্ধ করে দিলাম। জানিনা আমরা এক হতে পারব কিনা, কিন্তু এ জন্মে না পারি, এই সিঁদুর পরের জন্মে আমাদের এক করে দেবে না সেটা কে বলতে পারে?
আমি তখনো কাঁপছি। জীবনে, শুধু মেয়ে হয়ে বাঁচতে চাই নি আমি। শাঁখা সিঁদুর পরে স্বামী সোহাগী হয়ে বেঁচে থাকার থেকে মৃত্যু ঢের বেশী কামনার ছিল আমার। এই সব সিঁদুর, স্বামী কোন দিন ও মানিনি। মানতে চাইনি। কিন্তু … কিন্তু আজকে ভাবতে পারছি কই, যত্ত সব ফালতু কথা। কেন মুছে ফেলতে পারছি না সিঁদুর টা আমি। চেঁচিয়ে ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে হলো। কেন এই মোক্ষম সময়ে আমি দুর্বল হয়ে পড়ছি। কেন অর্জুনের সামনেই আমি সিঁদুর টা কে সিঁথি থেকে বিলুপ্ত করে দিতে পারছি না? কেন মনে হচ্ছে রাগের মাথায় সিঁদুর মুছে দিলে অর্জুনেরই ক্ষতি হবে?
অর্জুন, তখন ও আমার চিবুক তুলে ধরে আছে। ওই ভাবেই আমাকে বলল
– আজকে এখন কোন কথা নয়। আমি রাতে আসব তোমার ঘরে। অনেক কথা আছে। ভয় নেই, ফুলশয্যা র জন্য নয়। সে সবে আমার লোভ নেইইইইইইইইইইইইইইইই।
কথা গুলো বলতে বলতে চলে গেলো ও। আমার কাছে যেন কথা গুলো কানে বাজতে লাগল। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে আছি মন্ডপের পিছনে। থর থর করে কাঁপছি আমি। জানিনা মাথায় কেউ সিঁদুর পরালে, সব মেয়েদের ই এই হাল হয় কিনা? ওর কথা গুলো আমার কানে বাজছে। কিছু ভিতরে হয়ত গেল বা হয়ত গেল না। কিন্তু এখন কি করব আমি? বাইরে মুখ কি ভাবে দেখাব? এ তুই কি সর্বনেশে খেলায় মাতলি অর্জুন? কেন করলি এটা? তুই কি জানিস না, একটা মেয়ের কাছে এল মূল্য কি?
চীৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হলো। ইচ্ছে ছিল মা কে একবার দেখে আসব। আর হবে না। মন কে শক্ত করলাম। নাহ আর দেরী করা ঠিক হবে না। আরো দুর্বল হয়ে পড়ার আগে আমাকে পালাতেই হবে। ওদিকে ঠাকুর নিয়ে সবাই গ্রাম ঘুরতে বেরল। মিলিয়ে যেতে থাকল ধীরে ধীরে ঢাকের আওয়াজ আমাদের মন্ডপ থেকে দূরে।
আমি শাড়ি টা কোমরে গুঁজে মন্ডপের পিছন দিয়ে হাঁটা দিলাম, দ্রুত। নাহ ওরা ফিরে আসার আগেই আমাকে সীমানাপুরের কোন যান বাহন পেতেই হবে। আমাকে সবাই চেনে এ গ্রামের। মাথায় ঘোমটা টেনে নিলাম। অন্ধকার রাস্তা। পুকুরের ধার ধরে হাঁটছি। উদ্দ্যেশ্য আমাদের বাগান ধরে মেন রাস্তায় পৌঁছে যাওয়া। পুজোর সময়, টইটম্বুর পুকুর টা। দুরের আলো পুকুরের টলটলে জলে প্রতিফলিত হয়ে আমাকে যেন পথ দেখাচ্ছে। আমার কোন খেয়াল নেই। প্রায় দৌড়োচ্ছি আমি।
আমাদের বাগান পেরিয়ে যখন মেন রোড এ এলাম ত, ঠিক তখন ই একটা প্রায় ফাঁকা ট্রেকার এসে হাজির। উঠে বসে পড়লাম আমি। ট্রেকার তীব্র গতিতে এগিয়ে চলল।গ্রাম ছাড়িয়ে ট্রেকার ফাঁকা মাঠে এল। দুই দিকে ধান জমি। নিশ্ছিদ্র অন্ধকার দুই দিকে। আমাদের গ্রামের দিকে চেয়ে দেখলাম, ট্রাক্টর-এ চাপানো আমাদের ঠাকুর ও ধান জমির রাস্তা ভেঙ্গে এগিয়ে চলেছে পুকুরের দিকে। সামনে বেশ কিছু মানুষ নাচানাচি করছে। হয়তো ওখানে অর্জুন, না না আমার বর টা নাচছে আনন্দে। আর ঢাক বাজছে বিসর্জনের – ঠাকুর আসতে যতক্ষন, ঠাকুর যেতে ততক্ষন।
—————————
আঠেরো
আমার বর কে শার্ট পড়লে ভাল লাগে না। খুব রেয়ার আমি ওর জন্য শার্ট কিনি। খুব পছন্দ না হলে কিনি না। শীতকালে এর জন্য আমি কিছু ভাল দেখতে জ্যাকেট কিনে রেখেছি। কিছু পুল ওভার। আর ডিউটি তে থাকলে পুলিশের বিশাল গরম আর বিশাল মোটা পুল ওভার থাকে ওর। তলায় হাফ টি শার্ট আর উপরে বডি সাইজ সোয়েটার এনে রেখেছি অনেক। সেই গুলো পড়াই। হাফ শার্ট পছন্দ হলে হয় সাদা না হলে কাল। ফুল শার্ট পরলেও ও যখন হাতা গুটিয়ে পরে আর ও ভাল লাগে। আর ওর পুলিশের পোশাকের মাপ ও আমি ঠিক করে দি। একদম বডি সাইজ কাটাই ওর জন্য।
মাঝে মাঝে ওর শরীরের মাপ বদলে যায়। তখন সেই মাপের আরো কিছু বানিয়ে রেখে দি। বস্তুত একটা কাবার্ড ওর পুলিশের পোশাকে আমি ভর্তি করে রেখেছি। প্যান্ট শার্ট আর শু। ব্রাউন শু। সেগুলো কে কেচে, আয়রন করে আমি বাগিয়ে গুছিয়ে রেখে দি। এটা আমার অভ্যেস। ইভেন ও যে ঘরে পরে গোল গলা টি শার্ট সেগুলো ও আমি আয়রন করিয়ে রাখি রিঙ্কু দি কে দিয়ে। এমন ও হয়েছে কিনে এনেছি ভালো লাগবে বলে, ওর ভাল লেগেছে, কিন্তু আমার ভালো লাগে নি বলে আমি বদলে এনেছি।
এতো কথা বললাম কারন, ওর এই ব্যাপারে কোন উৎসাহ নেই। শুধু নিজের পোশাকে দাগ থাকলে একটু ক্ষুণ্ণ হয়। সেই জন্য ওর পোশাক আমার দায়িত্বে থাকে। মাঝে মাঝে ছোড়দিও ওকে গিফট করে। সেটা হয়ত ওর পছন্দ হয়, কিন্তু আমার না হলে ফেরত দিয়ে আসি। তাই এখন আর ছোড়দি ওকে কিনে দেয় না, আমাকে টাকা দেয়। আমি কিনে বলে দি ছোড়দি কে কি কিনেছি। ওর মা ওকে দিলে পাজামা পাঞ্জাবী দেয়। আর এক কালারের দেয়। সেটা ওকে যে কোন কালারেই ভালো লাগে বলে আপত্তি করি না।
আর আমার ছেলে মেয়েদের তো আমি ই কিনি। ওদের ঠাকুমা ও আমাকে টাকা দিয়ে দেয়। আমি কিনে সবার নামের স্টিকার লাগিয়ে রাখি। যখন পরে, সবাই কে বলে দি, এটা তোমার দেওয়া। হ্যাঁ মানে আমি ওদের লুকস এর ব্যাপারে পজেসিভ। তাতে কেউ আপত্তি করে না। কারন আমি যখন ওই টাকায় কিনে আনি ওদের ড্রেস, ওরা এতাই বলে, এর থেকে ভালো ওরা কিনতে পারত না।
সামনেই পুজো আসছে তাই এতো কথা বললাম । না হলে বলতাম না। আপনাদের ই বা কি যায় আসবে শুনতে আমার এই ভাট বকা। পুজো আসলেই অনেক আনন্দ, অনেক উত্তেজনা, অনেক ভালোলাগা। আর অনেক ভয়। ভয় কেন পরে বলব। কিন্তু কত কেনাকাটি থাকে! সবাই কে দেওয়া থাকে! ছেলে, মেয়ে, বরের কেনাকাটি। খুব আনন্দ নিয়ে করি আমি এখন এগুলো। যখন ভালো লাগত না, তখন লাগত না।
এখন সে সব ফেইজ জীবনে নেই, এখন ভালো লাগে। তখন আমার মধ্যেকার মেয়েটা ডিস্টার্বড ছিল। এখন সে সুখী। সে তার চাকরী করে এই সময় টা বের করে নিজের মানুষ গুলোর জন্য। আর আমাদের বাজার কম হয় না? ভাবুন পাঁচ দিদি, এক ভাই, তাদের পুরো পরিবার, বাবা, মা কাকা কাকি, কেউ বাকি থাকে না। সবার জামাকাপড় আমি নিজে কিনি। আর শুধু কিনি ই না, আমার বর টা কে নিয়েও যাই কিনতে। বেচারী চুপ করে বসে থাকে হাতে ডেবিট কার্ড টা নিয়ে। ছেলেরা মনে হয় বিয়ের জন্য রিগ্রেট করে এই সময় টা তেই।
পুজো তে আমি বাড়ি যাই না আর। না আমার বর যায়। ওর তো সময় হয় না। পুজোর সময়ে ওর মারাত্মক ব্যস্ততা। আর ও না গেলে আমার ও ভাল লাগে না। ওকে শহরে থাকতেই হয়। আর ওই চার পাঁচ দিন আমরা সন্ধ্যের পরে সবাই মিলে ঠাকুর দেখতে বের হই। বর উচ্চপদস্থ, তাই মন্ডপে ঢুকতে সমস্যা হয় না। আলাদা লাইনে, ভীর ভাট্টা ছাড়াই আমরা দেখে আসি ঠাকুর। বাইরে খাই। ভোরের দিকে বাড়ি ঢোকা। এই আমাদের পুজোর রুটিন। প্রতিদিন সন্ধ্যের পরে বর টাকে পাই, এটাই অনেক আমার কাছে। তাছাড়া আছি আমি আমার মতন আমাদের সাথে। বাড়ি গেলেই কত স্মৃতি। কি দরকার খুঁচিয়ে ঘা করার। সেটা আমি আর বর, কারোর জন্যেই ভালো হবে না। আর আমাকে কেউ অপমান করলে বর খুব রেগে যায়। অনেক কস্ট করে ওকে আটকে রাখি। তবে এবারে বাড়ি থেকে বড়ই জোর আসছে, যাবার জন্য। জানিনা কি করব। বর কে জপানোর চেস্টা করতে হবে। একান্তই যদি ও যেতে না পারে, পরের বারের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
যাই হোক সে রাতে আমি গুয়াহাটির টিকিট কেটেছিলাম। সিয়ালদা থেকে যখন ট্রেন ছাড়ল তখন বেজে গেছে রাত বারোটা। নিজের সিট নাম্বার টা দেখে উঠে বসে আছি। কিছুই খেয়াল নেই। রাতে সবাই শুয়ে পড়েছিল হয়ত। আমি যে ভাবে বসেছিলাম, হেলান দিয়ে সেই ভাবেই বসে রইলাম। সকালে চমক ভাঙল যখন চা ওয়ালা এল। আমার কিছুই ইচ্ছে করছিল না খেতে। শুধু জানি গুয়াহাটি তে গিয়ে আমার এক বন্ধুর কাছে থাকব একদিন। তারপরে ওখানে চাকরী খুঁজতে হবে। দরকারে চলে যাব আপার আসামের দিকে। কেউ খোঁজ না পেলেই হলো। বন্ধুটির বাড়ি আমি গেছিলাম আগে। ওখানে সেকতা সেমিনারে গিয়ে , আমার কলেজের বন্ধুটির বাড়িতে গেছিলাম। সে ওখানে কলেজে পড়ায়। চিনি বাড়ি টা। জায়গা টার নাম মনে করে পৌঁছে গেলাম ওর বাড়ি।
বন্ধুটির নাম ছিল দীপান্বিতা। ও বাঙালী। খুশী হলো আমাকে দেখে। প্রথমে তো চিনতেই পারে নি। কারন আমি শাড়ি পরে গেছিলাম। অর্জুনের জন্য যে বাহ্যিক রূপ আমার ছিল ও সেটাই দেখেছে। অবাক হবার ই কথা। আমি যে কত সুন্দর সেটা কলেজে ও বোঝে নি। সেটাই বার বার আমাকে বলছিল। বার বার আমার সিঁদুরে রাঙানো মুখ নিয়ে কথা বলছিলো ও। বাথরুম এ গিয়ে সিঁদুর টা পরিষ্কার করার সময়ে খুব যত্ন করে রেখে দিলাম সিথির সিঁদুর টা। লুকিয়ে রাখলাম সেটা। ছোট্ট করে চুলের ফাঁকে রেখেদিলাম অর্জুনের মঙ্গল নিজের মাথায় করে। তবে সময় লাগল না আমার বদলে নিতে। পরের দিনেই কোমর অব্দি লম্বা হয়ে যাওয়া চুল কেটে, বয় কাট করে নিয়েছিলাম। শাড়ি ছেড়ে জিন্স, আর শার্ট পড়তে শুরু করে দিয়েছিলাম।
টাকা পয়সার কমতি ছিল না আমার কাছে কোন কালেই। যথেষ্ট উপার্জন করেছি গত পাঁচ বছরে। কাজেই আমি সময় নিয়ে কাজ খুঁজতে শুরু করে দিলাম। এদিকের সমস্যা হলো যাতায়াত। কিছু এয়ারপোর্ট আছে। কিন্তু বাকি যায়গায় যেতে গাড়ী তো লাগবেই। আমি একটা গাড়ি ও কিনে নিলাম। এবারে আমি আমার কেরিয়ার এ মনোনিবেশ করব। আমি এসেই আমার পুরোন কলেজের রেসিগ্নেশন পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। গুয়াহাটি তে একটা কলেজে পেলাম কাজ, কিন্তু সাথে যোরহাট এও পেলাম। শুনলাম যোরহাটের কলেজ টা অনেক বেশী ঐতিহ্য বাহী কলেজ। আমি শিফট করলাম যোরহাট।
কলেজে পড়াই আর বাড়ি এসে রান্না বান্না করে, পড়াশোনা করি। আমার নেট স্লেট দুটোই ক্লিয়ার ছিল। তাই কাজ পেতে অসুবিধা খুব একটা হলো না। কলকাতার মতন না হলেও, এরাও আমাকে খুব একটা কম স্যালারি দিলো না। কিছু দিনের মধ্যেই আমার পড়ানোর খ্যাতি আসামে ছড়িয়ে পড়ল। আবার সেই পুরোন রুটিন। কলেজ, পড়াশোনা আর সকালে দৌড়। শরীরে মেয়ে সুলভ যে কমনীয় তা এসেছিল, সেটা কে ঝেড়ে ফেলার জন্য যেন মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম আমি। চাইছিলাম কাটখোট্টা জীবন। স্যাডিস্ট এর মতন জীবন যাপন ছিল আমার উদ্দ্যেশ্য।
অনেক কস্ট করে মন থেকে ঝেড়ে ফেলেছিলাম আমার বাড়ির চিন্তা। জানিনা, আমি চলে আসার পরে কি অবস্থা হয়েছে বাড়িতে। প্রশ্ন তো উঠবেই। কেন পালিয়ে এসেছি আমি। রোজ স্নানের পরে বিন্দু সম সিঁদুর সিঁথি তে লাগানো আমি অভ্যেস করে ফেললাম। কিছু তো করার নেই। যতই সমাজ না মানুক। আমি তো এই সিঁদুর মিথ্যে বলে ফেলে দিতে পারছি না। একেবারে মুছে ফেলতে পারছি না। মনে হয় আমার থেকেও বেশী ভালবাসে কেউ, ওর নাম করে সিঁদুর যেদিনে পরবে, সেদিন হয়ত আমি এই সিঁদুর মুছতে পারব। তার আগে নয়।
নিজের বাহ্যিক রূপ বদলে ফেললেও, অনেক শান্ত হয়ে গেলাম আমি। বাড়িতে একলা বসলেই মনে হাজারো চিন্তা ভিড় করে আসত আমার। কি জানি, সব ঠিক আছে নাকি? ঠাকুর ডাকতাম মনে মনে, হে ঠাকুর সব যেন ঠিক থাকে। অর্জুন যেন সব টা মেনে নেয়। নিজেকে যেন আমার বাইরে ভাবতে শিখে নেয়। আমি এখানে, আর ওখানে ও যদি কিছু করে বসে তবে জানি না আমি কি করে ফেলব। যে ঠাকুর তুমি রক্ষা কোর সবাই কে।
নিজেকে এতো টাই দূরে সরিয়ে নিয়েছিল্ম বাহ্যিক জগত থেকে যে, খবর, ই মেইল সব কিছু চেক করা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। নিজের ফেস বুক, টুইটার সব রকম আকাউন্ট থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলাম। গত দুমাস আমি ওসব কিচ্ছু করিনি। কলেজেও আমি হার্ড কপি তে কাজ করি। পড়াই, নিজেই খরচা করে নোটস বানিয়ে ক্লাসে দি। ওরা ফোট কপি করিয়ে নেয়। আমার কোন রকম ফোন নাম্বার, কোন আই ডি আমি কাউকে শেয়ার করিনি। প্রফেসর গ্রুপের হোয়াটস এপ এও আমি অনুপস্থিত থাকি।
আমাকে সবাই ভাবে খুব অহংকারি। কিন্তু ওই পিছনেই। কাউকে অতো পাত্তা দি না। আর দেবার ই বা কি দরকার। আমি নন্দনা ডি। যে ইন্সটিটিউট এ পড়েছি, সেখানে প্রথম ছেড়ে কোন দিন দ্বিতীয় হই নি। আমার একাডেমিক কেরিয়ার সেই কথাই বলে। কাজেই, কেউ পছন্দ না করলেও, কারোর বলার ও কিছু ছিল না। নন্দনা ডি র জন্য, কলেজের নাম পুরো আসামে নতুন করে ছড়িয়ে পড়ল বলার অপেক্ষা রাখল না। এমনি করে একটা মাস আরো কেটে গেল।
গত মাসে, তিনটে সেমিনার করেছি। যে থিসিস টা আমি, রেখে দিয়েছিলাম কোন স্টুডেন্ট এর জন্য, সেটা আমি পাবলিশ করিয়েছিলাম নিজের নামেই। বিজ্ঞানী মহলে ভালই সাড়া ফেলেছিল সেটা। আর সেই সুত্রেই সেমিনার। অনেকেই আমাকে চিনত। ওই থিসিসের জন্য আমার কলেজ মেইল আই ডি দেওয়া ছিল। সেখানে অনেকের ই মেইল আসতে লাগল। যে গুলো পছন্দ হতো উত্তর দিতাম, যে গুলো পছন্দ হতো না উত্তর দিতাম না।
কিন্তু একদিন একটা মেইল এলো কলকাতা থেকে। আমার পুরোন কলেজের প্রিন্সিপ্যাল মেইল টা করেছেন। খুললাম। পড়লাম।
মোটামুটি বাংলা করলে যা দাঁড়ায় তা হলো
নন্দনা,
আশা করি সব ঠিক ঠাক চলছে তোমার জীবনে। আমি আজো বুঝলাম না তুমি আমাদের কলেজ ছেড়ে গেলে কেন। তোমার বিয়ে এবং স্বামীর পোস্টিং সংক্রান্ত সমস্যা থাকলে আমাকে বলতে পারতে। তোমাকে আসাম থেকেই আমি অপারেট করাতাম। আমি এবং তোমার কলেজ আজ ও তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছে। তোমার থিসিস টা পড়লাম। গর্ব হয় তোমার জন্য। ভালো থেক। প্রয়োজন হলে আমাকে জানিও। সব সময়ে থাকব তোমার পাশে।
ইতি………….
কি লিখব এই কথার উত্তরে? কিন্তু না লেখা তা কিছু বাজে হয়ে যায়।
তাই লিখে দিলাম
স্যার,
আমার একান্ত কিছু নিজ সমস্যার জন্য আমার এই সিদ্ধান্ত। নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম আমি নিজেদের মধ্যে থেকে। এখানে একান্তে গবেষণা করতে চাই। আপনাকে দুঃখ দেবার জন্য দুঃখিত। আশা করি আপনি ভাল আছেন
ইতি…
আমি একা হলেই মনের মধ্যে শুধু অর্জুন কে নিয়েই ঝড় চলে। তাই নিজেকে যত টা সম্ভব এনগেইজ রাখি। ব্যস্ত রাখি নিজেকে নানান কাজে। খাই না তেমন, কিন্তু রান্না করি অনেক।রান্না করলে অনেক সময় ব্যয় হয় । অতো রান্না খাইয়ে দি আমার বাংলোর পাশে অনেক বাচ্ছাদের। বাংলোর লন টা ভর্তি করে ফেলেছি গাছ লাগিয়ে। ফুল এখনো আসে নি, কিন্তু আসবে খুব শীঘ্র। রাত দশ টা অব্দি এতোই ব্যস্ত থাকি যে কিছু নিয়ে ভাবার অবকাশ থাকে না আমার। বাড়িতে পড়তে বসলে মন বসে না। উলটো পালটা চিন্তায় ব্যাকুল হয়ে যাই, তাই সন্ধ্যে বেলায় রান্নার পরে চলে যাই কলেজ। লাইব্রেরী তে পড়াশোনা করি। এখানে বড্ড তাড়াতাড়ি সন্ধ্যে নামে। তাই সকাল সকাল রান্না করে আমিও কলেজে চলে যাই। ওখানে কোন স্টুডেন্ট থাকলে তাকে বুঝিয়ে দি বা কোন সমস্যার সমাধান করে দি। না হলে নিজেই পড়াশোনা করি।
সব ঠিক আছে, কিন্তু রাতে শোবার সময়ে? তখন কি করব? পুরো বিধ্বস্ত হয়ে না শুলে তো ঘুম আসে না আমার। বিছানায় শুয়েও নিজেকে সেই সুযোগ দিতাম না। উপন্যাস পড়তাম। গল্পএর বই পড়তাম। যতক্ষণ না আমার চোখ টেনে আসত ঘুমের কোলে। এই করেই দিন কেটে যাচ্ছিল আমার। এক একদিন ঘুম আসত না তার পরেও। সেদিনে মনে হত, ও হয়ত আমাকে ভুলে যাবার কথা মেনে নিয়েছে। কিন্তু আমি কেন পারছি না। কেন ওর দেওয়া সিঁদুর মাথায় বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি আমি। চোখে জল আসত। এই জন্য না যে আমি ওকে ভুলতে পারছি না। এই জন্য যে ও আমাকে ভুলে যাবার কথা মেনে নিয়েছে। ওকে ভুলতে আমি পারব না আমি বুঝে গেছি। হয়ত পরের জন্মেই শোধ হবে মাথার সিঁদুরের এই ঋণ।
এখন চিন্তা করলে ভাবি, কি অপরিনত কাজ ই না করেছিলাম। লজ্জা লাগে। লজ্জায় নুয়ে যাই আমি। ইশ কি পাগল ই না ছিলাম। সত্যি বাবা প্রেম কাহিনী লিখেছিলাম বটে দুটো পাগলে। কিন্তু সেই সময়ে এই সব পাগলামো ই খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল আমার কাছে। ওকে মনে পড়লেই আমার মাথায় হাত চলে যেত, যেখানে ওর ই পরিয়ে দেওয়া জায়গায় এক ফোঁটা সিঁদুর আমি ওর নাম করে পরতাম। আর চোখে জল।
শরীর ভেঙ্গে পড়ছিল আমার। সেটা আমি বুঝতে পারছিলাম। সকালে দৌড়তে যেতে আর ভাল লাগে না। ঘুম ই ভাঙ্গে না আমার। ক্লান্তি লাগে সারাদিন। লাগবে না কেন, রাতে তো ঘুম ই হয় না ভাল করে। ভাবলাম এই ভাবেই চলুক কিছু দিন। নিজে নিজেই শেষ হয়ে যাব। আলাদা করে মরার কথা ভাবার ও দরকার নেই। না হলে একা আছি, আত্মহত্যা তো করাই যেত।
আমি তো অর্জুনের জন্যে বাঁচছিলাম। ওই যখন আমাকে ভুলে থাকার কথা মেনে নিয়েছে, তখন বাঁচার তো দরকার নেই। কিন্তু আত্মহত্যা করলে যদি পরের জন্মে এই সিঁদুরের ঋণ শোধ করতে না পারি? তাই শনৈ শনৈ মৃত্যু ই ভাল। পাগলের মতন কাজ করতে শুরু করলাম। এক এক দিনে দুটো করে ক্লাস নিতাম। বাইরে সেমিনার থাকলে, এক দিনে শিলচর থেকে গুয়াহাটি, দুটো সেমিনার। এই রকম ভাবে নিজেকে নিয়ে যাচ্ছিলাম, যেন রাতে শোবার সময় টুকু অব্দি না পাওয়া যায়। শুলেই মাথায় যত বাজে চিন্তা।
বলেছিলাম একটা কথা আগে, যেখানে অর্জুন থাকে বা ছিল, আমার সেই সমস্ত জায়গা, মানুষ জন সবাই কেই মনে থাকে। যোগাযোগ থাকে। কিন্তু যেখানে আমি ওকে পাইনি, সেখানে কিছুই মাথায় থাকে না আমার। আর মনে তো নয় ই। সেদিন ক্লাস শেষে আমি আমার বাংলো তে এসেছি। রান্না করব। ছেলে গুলো কে দেব, আবার কলেজ যাব। পড়ব একটু। সেমিনার আছে চার দিন বাদে একটা, গুয়াহাটি তে। নতুন থিসিসের উপরে। রান্না করছি। জানালা দিয়ে দেখলাম, একটা গাড়ী এলো। এক ভদ্রলোক নামলেন সেখান থেকে। আমি দরজা খুলে যেতেই বলল
– নন্দনা, আই হ্যাভ কাম টু টেক ইউ এট কলেজ নাও।
আমি তো ভদ্রলোক কে চিনতেও পারলাম না। আমি জিজ্ঞাসা করলাম
– উই নো ইচ আদার?
– ও কাম অন, আই এম সুরোজিত বরোগোহাইন। ইওর কলেজ ডিন।
উপস, আমি জানি ওনাকে, দেখেওছি। কিন্তু কি যে হয়েছে। চিনতে পারিনি একদম । বললাম
– সরি স্যার, মাই মিস্টেক। বাট, আই নিড সাম টাইম। আই এম কুকিং রাইট নাও।
– সরি নন্দনা, ইউ হ্যাভ সাম ভিসিটর টু সি। ইটস ইমার্জেন্সী। দে আর ক্রাইং।
– হোয়াট? ওদের কে এখানে আনলেন না কেন?
– আসতে চাইল না। প্লিস চল।
আমি গ্যাস অফ করে, শার্ট এর উপরে, জ্যাকেট টা চাপিয়ে, মাথায় টুপি পরে, স্যার এর গাড়ি তে উঠে বসলাম। কলেজে পৌঁছে ডিনের ঘরে ঢুকে দেখলাম, আমার দুই দিদি বসে আছে। বড়দি আর ছোড়দি। আমার বুক টা ধড়াস করে উঠল। ওরা এখানে কেন? অর্জুন ঠিক আছে তো। নাকি বাড়িতে কারোর কিছু হয়েছে? বাবা না মা? আমি নিশ্চিত কিছু একটা খারাপ খবর শুনব। ডিনের দরজায় আমি নিজেকে হেলান দিয়ে দিয়েছি। ইদানীং শরীরে আর বল পাই না আমি। জানিনা কি শুনব।
দুজনা যখন ফিরে দেখল আমাকে। হাঁ হয়ে গেল। পুজোর সময়ে আমাকে যা দেখেছে তার অর্ধেক ও আমি আর নেই। আর আমি দেখলাম ওদের চোখে জল। আমার মন ক্যাল্কুলেট করতে শুরু করেছে। এই দুজনা এসেছে। মানে মা বাবা র কিছু না। এমন একজনের সম্পর্কিত কোন খারাপ খবর, যেখানে আমরা তিনজন জড়িত। বাবা মা হলে ভাই আসত। না হলে ছোড়দি একলা আসত। বা কেউ ই আসত না। ডিন কে মেইল করে দিত বা বড়োজোর ফোন করে দিত আমাকে বলার জন্য। বড়দি কে নিয়ে আসার দরকার ছিল না। মানে এটা অর্জুন সম্পর্কিত ব্যাপার। নিশব্দে কাঁদছে বড়দি। মানে অর্জুন এখনো আছে পৃথিবী তে। ওর কিছু হলে হাউ হাউ করে কাঁদত বড়দি। হ্যাঁ অর্জুনের ই কিছু হয়েছে। আর দুজনায় এসেছে মানে আমাকে ওরা নিয়ে যেতে চায়। আমি আর থাকতে পারলাম না। ইচ্ছে করছে বসে পড়ি আমি। মাথা ঘুরছে মারাত্মক আমার। বমি বমি পাচ্ছে যেন। বসে পড়লাম আমি দেওয়াল ধরে আসতে আসতে। বড়দি ছোড়দি দুজনাই ছুটে এল আমার দিকে।
—————————
উনিশ

যখন কলকাতায় পৌছুলাম দিদির বাড়িতে, কেমন যেন একটা চোরা কান্নার স্রোত বইছে বাড়িতে। নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের আওয়াজে মনে হচ্ছিল বাড়িতে বেশ কিছু মানুষ আছে। কিন্তু সকলেই চুপ। পা আমার চলছে না। ছোড়দি আমাকে ধরে আছে। আমি জানিও না যে ঘরে আমাকে নিয়ে যাচ্ছে সবাই মিলে সেখানে গিয়ে আমি কি দেখব। উঁকি দিলাম আমি। একটা বেড দেখছি। স্যালাইনের লক্ষ বোতল একটা জায়গায় জড় করা। মুখ টা আরো বাড়িয়ে দেখলাম, বেডে শোয়া একজন। ওটা কে। অর্জুন? একী অবস্থা হয়েছে ওর। সেই ছেলেই আর নেই। শুকিয়ে দড়ি হয়ে গেছে একেবারে।
হে ঠাকুর গত ছয় মাস,মাথায় বয়ে নিয়ে চলা সিঁদুরের ঋণ তুমি এই ভাবে শোধ করলে? মুখের দিকে চাইতে পারছি না আমি। মনে হচ্ছে এবারে পড়ে যাব আমি। মাথা ঘুরছে আমার। কেউ একজন আমাকে ধরল। ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে আমার। মনে হচ্ছে শেষ করে ফেলি এই দুনিয়া কে। ধ্বংস করে দি সব কিছু। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে তছনছ করে দি এই পৃথিবী। সব ঠিক চলছে আর আমার ভালবাসার এই অবস্থা? রাগে ফুঁসতে লাগলাম আমি।
মন শক্ত করলাম। সেই ছোট থেকেই তো মন শক্ত করে আছি। কত বিপদ এই শক্ত মনের ভরসায় আমি কাটিয়েছি। আরো একবার সই। এখনো বেঁচে আছে ও। শেষ চেষ্টা করতেই হবে আমাকে। নিজের জীবন দিয়ে হলেও ওকে ফিরিয়ে আনতে হবে। এ কী রকম প্রেম দিলে তুমি আমার জীবনে ঠাকুর? এমন প্রেম যেন কেউ না করে। যেন কেউ না করে।
বড়দির চোখে শুধু আকুতি আর চরম ভয় ছাড়া কিছুই দেখছি না আমি। ছোড়দির চোখেও মারাত্মক ভয় শুধু। ভয় কি আমি পাই নি? অর্জুনের কাছে গিয়ে দাঁড়াতে পারছি না আমি ভয়ে। জানিনা কি করব আমি।
পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি। মন টা শক্ত করে আছি। বাইরে কাঁদছি না। মনে মনে আকুল হয়ে কাঁদছি। দুর্গা মায়ের মুখ টা মনে পড়ছে। হে মা ভরসা দিও। জীবনে কিচ্ছু চাইনি। আজ চাইছি। আমাকে শক্তি দাও। ওকে ভালো করে তোলার মতন ক্ষমতা দাও।
ব্যস আমার ঠিকানা হয়ে গেল ওই ঘর টা। প্রথম দশ দিন ও কিছু চিনতেও পারে নি। দশ দিন পড়ে মনে হয় বুঝতে পারল আমাকে। হাসতেও যত টুকু শক্তি লাগে সেই টকুও ছিল না ওর কাছে। কিন্তু ঠোটের কোনায় হাসির আভাস আমি বুঝতে পারলাম। বুঝলাম আমাকে ও ক্ষমা করেছে। দশ দিন ওর কোন কিছুই আমি কাউকে করতে দিই নি। নিজেই করেছি সব কিছু। আমাকে চেনার পর থেকে দেখলাম, স্যালাইনের প্রয়োজন বাড়তে শুরু করল।যে প্রয়োজন টা একটা সময়ে কমতে শুরু করেছিল। বডি সামান্য স্যালাইন ও ইনটেক করতে পারছিল না।
আমি নিঃশব্দে ওর কাজ করছি, ওকে খাইয়ে দেওয়া , পাশে থাকা, স্যালাইন বদলে দেওয়া। আর ও ঘুমোলে উল্ট দিকে ফিরলেই কাঁদছি। ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে আমার। কিন্তু সামলে নিচ্ছি ।পরের দিন কুড়ি শুধু স্যালাইনেই চলল ওর। ডাক্তার সকালে বিকালে আসছে। আমি ছোড়দি কে বললাম, ডাক্তারের এর কাছে সকালে বিকালে ওর প্রোগ্রেস বা ডিক্লিনেশন দুটোর ই রিপোর্ট চাই। আমি আমার সমস্ত ডেবিট কার্ড দিদির হাতে তুলে দিলাম। বড়দি কিছু বলল না শুধু কাঁদল।
ওর বাঁচার ইচ্ছে টাই ছিল না। যেমন ভাবে শেষ হয়ে গেছিল আমার। সেটা ফিরে আসলেই আমাদের অর্ধেক কাজ হয়ে যাবে। বাকি টা ওকে সেবা শুশ্রষা, সেটা আমার দায়িত্ব। কাউকে দরকার নেই আমার। আমার জিনিস আমি বুঝে নেব। ছোট বেলার সেই মারাত্মক জেদ টা ফিরে এলো আমার মধ্যে। দিন পনের পরে ডাক্তার বলল, অনেক বেটার। হার্ট বিট স্বাভাবিক এর কাছাকাছি আসছে। তবে এখন ওকে খুব খুব হালকা তরল খাবার দেওয়া যেতে পারে।
আমি সকালে উঠে সব সবজি ভাল করে বেছে ধুয়ে, মিক্সি তে গ্রাইন্ড করে, ভীষণ হালকা সুপ বানাতে শুরু করলাম। প্রতি দু ঘণ্টায় দিতে থাকলাম, ডাক্তারের কথা মতন।
রাতে ওর বেডের পাশেই কোনরকমে শুয়ে পড়তাম। ঘুমতাম না পাছে ওর কিছু দরকার হয়। শুধু কি তাই? চেক করতাম ও বেঁচে আছে তো!
সকালে স্নানের পরে, মোটা করে সিঁদুর টা লাগাতে ভুলতাম না। ওইটাই এখন জোর আমার। বয় কাট চুলে, অমন মোটা সিঁদুর, সবাই দেখতে পেত, কিন্তু কেউ কিছু বলার সাহস পেত না।
আরো দিন পনের পরে, ও প্রথম নর্মাল ইউরিন করল। নর্মাল পায়খানা করল। আমি সব পরিষ্কার করে ডাক্তার কে ফোন করতেই, ডাক্তার এসে দেখে গেল। বলল আর ভয় নেই তেমন। কিন্তু ওর সব অর্গান প্রায় কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছিল। সেগুলো কে যেন ধীরে ধীরে আগের অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়। বেশী ফুড বেশি জল একদম না। এই পরিস্থিতি তে দ্রুত রিকভারি ভাল না। খুব ধীরে ধীরে রিকভারি করাতে হবে আমাদের।
ধীরে ধীরে, অর্জুনের শ্রী ফিরতে শুরু করল। স্যালাইনের জিনিস পত্র আমি বাইরে বের করিয়ে দিলাম। কথা বলতে পারত না কিন্তু আমাকে দেখলেই হাসত। আর চোখ দিয়ে জল গড়াত ওর। আমি হাইজিনিক টিস্যু দিয়ে পরম যত্নে মুছিয়ে দিলাম ওর চোখের জল। আমি পাশে থাকলে হাত টা নিয়ে ঘুমাত। আর বড়দি পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদত।
একদিন বড়দি কে বললাম
– কাঁদিস না, আর তো ভয় নেই। চিন্তা নেই তোর , তোর আগের ছেলেকে আমি তোর কাছে ফিরিয়ে তবে শান্তি পাব।
বড়দি, কথা বলার অবস্থায় ছিল না। শুধু কান্না আর কান্না। ছোড়দি, সকাল বিকাল আসত। বিকালে এসে থাকত রাত অব্দি। বাড়িতে অনেক লোক জমে থাকত। ওদের রান্না বান্না থাকত। আমাদের পরিবারের ই না। অর্জুনের বাবার দিকের অনেক আত্মীয় স্বজন ও আসত অনেক। রোজ ই কেই না কেউ দেখতে আসত। আমি একমাত্র ভিতরে থাকতাম। কাউকে ভিতরে আমি আলাউ করতাম না।
একদিন আমার বাবা মা এল। আমি কথাও বলিনি। ওরা বাইরে থেকে দেখে চলে গেল। আমার কাজ ই ছিল রোজ সকালে অর্জুনের জন্য সুপ তৈরি করা। তারপরে স্নান করে মন্দির যাওয়া। মায়ের কাছে মনের অনেক কথা বলে ফিরে এসে অর্জুন ঘুম থেকে উঠলে দাঁত মাজিয়ে দেওয়া। কিছু টা সুপ খাওয়ানো। তারপরে ওকে তুলে ভাল করে গা স্পঞ্জ করিয়ে দেওয়া। বেড শিট বদলে দেওয়া। সব একার হাতে করতাম আমি। কাউকে ভরসা করতে পারতাম না আমি। ভরসা করে তো দেখলাম একবার।
মাঝে ওর অফিস থেকে দেখতে এসেছিল। ও জয়েন করার সাত দিনের মধ্যেই ওর এই ব্যাপার টা শুরু হয়েছিল। ওকে দেখে রিপোর্ট পাঠানোর দরকার ছিল ওদের। আমিও কথা বললাম। বললাম ওর নর্ম্যাল লাইফ এ ফিরতে আরো মাস ছয়েক তো লাগবেই।
একদিন ডাক্তার বলল, বাচ্চা মুরগীর স্টু খাওয়ালে খুব ভালো হতো। বড় মুরগীর মাংসে, ফাইবার বড় হয়। হজম করতে পারবে না। আমি কাউকে দিয়ে ভরসা পেতাম না। নিজেই যেতাম বাজার। সকালে বাজার থেকে বাচ্চা মুরগী কাটিয়ে আনতাম। রোজ। ফ্রিজে রাখা জিনিস ওকে খাওয়াতাম না। ওকে স্টু বানিয়ে দিতাম।
এই মুরগীর স্টু বানানোর আগে একটা ঘটনা ঘটেছিল। ও কথা বলছিল না বলে আমরা ডাক্তার কে বার বার বলছিলাম। একদিন দুপুরে আমি, ওকে সব্জির গ্রাইন্ডেড সুপ খাওয়াচ্ছি। মুখ টা প্যাঁচার মতন করে খাচ্ছে। দুম করে বলে উঠল – ধুর রোজ রোজ এটা খাওয়া যায় নাকি? আমি আর বড়দি ছিলাম ওখানে। আমি খাওয়াচ্ছিলাম আর বড়দি ওকে তুলে ধরেছিল। আমরা তো আনন্দে খানিক কেঁদেই নিলাম। সন্ধ্যে বেলাতেই ডাক্তার আসায় ডাক্তার কে ওর কথা টা বলতেই, বাচ্চা মুরগীর স্টু এর কথা বলেছিল।
বুঝলাম, দুষ্টু টা ইচ্ছে করেই কথা বলে না। রাতে ওকে শুইয়ে দিয়ে বললাম,
– ইচ্ছে করে কথা না বলে আমাকে কস্ট দেওয়া না?
আমার দিকে তাকিয়ে রইল। চোখে আবার জল ওর। আমি ছুটে এলাম। মুছিয়ে দিলাম টিস্যু দিয়ে বললাম
– চোখে জল কেন?
ও কিছু বলল না, সরু হয়ে যাওয়া হাত টা তুলে বলল
– আজকে কোন মাস?
– জুন চলছে, কেন?
– মানে ছয় মাস থেকে দুমাস বাদ দিলে থাকে চার মাস।
– হ্যাঁ তাতে কি।
– একজন আমার সাথে ছয় মাস কথা বলে নি। আমিও এখন চার মাস বলব না।
আমি তাকিয়ে রইলাম। মনে মনে কত অভিমান জমা করে রেখে দিয়েছে। ইচ্ছে হলো ওকে জড়িয়ে ধরি। কিন্তু এখন ও বেশ দুর্বল। জড়িয়ে ধরা ঠিক হবে না। শুধু ওর মাথার উপরে চুমু খেয়ে বললাম
– কথা দিলাম, কোন দিন ও ছেড়ে যাব না আমি।
– আমিও কথা দিলাম।
– কি?
– মরব না।
– মনে থাকে যেন।
– হুম, এবারে ঘুমাই?
ওকে তো বলে দিলাম হ্যাঁ ঘুমো। কিন্তু মনে মধ্যে ভয় থাকত। রাতে বার বার উঠে দেখতাম ওর বুকের ধুকপুকনি চলছে কিনা। গা হাত পা গরম আছে কিনা। আমার শরীর টাও ভেঙ্গে পরছিল আসতে আসতে। তবে প্রথম দিকের তুলনায়, এই ঘন ঘন চেকিং এর ব্যাপার টা আমার অনেক কমে গেছিল।
ছোড়দি এসে লক্ষ লক্ষ কথা বলে অর্জুনের সাথে। অর্জুন চুপ থাকে। ও কোন কথা বলে না। আর হাত পায়ে হালকা হালকা করে হাত বুলিয়ে দেয়। আমি তখন একটু রিলিফ পাই। ঘুম দরকার আমার ঘুম। দুপুরে বড়দি বসে থাকত ওর কাছে। আমি তখন নিচে ঘুমিয়ে নিতাম একটু। কিম্বা ছোড়দি সন্ধ্যে বেলায় থাকার সময়ে ঘুমিয়ে নিতাম। সারা রাত জাগার এনার্জি তো রাখতে হবে। বিপদ এখনো কাটে নি।
দিন পনের কেটে গেছে আরো। এখন ও বিছানাতেই শুয়ে থাকে কিন্তু মাঝে মাঝে উঠে বসছে। এখন ওকে খাবার দাবার উঠিয়েই খাওয়াই আমি। ও উঠে বসে আর আমি চামচ এ করে খাইয়ে দি। তবে ওই সুপ ই। এর বেশি না। এখন ভালই কথা বলছে। পুটপুট করে। শুধু ওর মা আর আমার ছোড়দির সাথে কথা বলে না। ওরা এলেই বড্ড গুটিয়ে যায় ও।
ভাই এলো একদিন। সকালে এল। রবিবার ছিল। ভাই এর ট্রান্সফার হয়ে গেছিল তখন কলকাতায়। আমি ভাই কে বললাম বসতে ওর কাছে। ওর মা মানে বড়দি রান্না ঘরে ছিল। স্নান করার ছিল আমার। স্নান করে ঢুকব ঘরে, শুনলাম ভাই বলছে
– কি রে একটা খাম্বা কিনেছি তো মামা ভাগ্নে তে খাব বলে। ঠিক করে বল, শালা ভগীনপোত এ খাবি না মামা ভাগ্নে তে খাবি?
ইশ কি লজ্জা। মানে এরা সবাই জেনে গেছে ব্যাপার টা। মনের মধ্যে মারাত্মক ভয় ঢুকল আমার আবার। অর্জুন কি বলল আমার কানে ঢুকল না। কিন্তু আলোচনা টা বন্ধ করে দিতে চাইছিলাম আমি। আমি ঢুকতেই দুজনে চুপ করে গেল। তাই যতই অর্জুনের রিকভারি হচ্ছে, আমার মনেও ভয় ঢুকছে। সেই সব ব্যাপার গুলো আলোচনা হবে এবারে যেগুল আমি এড়িয়ে যেতে চাই। কি দরকার রে বাবা। ছেড়ে দাও না আমাদের কে আমাদের মতন করে। সেটা কেউ দেবে না। শুধু শুধু ওকে এই ছয় মাস ধরে কস্ট দিল সবাই মিলে। আর আমি কাউকে ওকে কস্ট দিতে দেব না।
আমি বুঝে গেছি, এবারে আমাকেই মুখ খুলতে হবে। আমাকেই স্ট্যান্ড নিতে হবে একটা। মোক্ষম স্ট্যান্ড। তাতে যা হবার হোক। কেউ নিজের মুখে বলবে না এখানে, যা তোরা নিজেদের মতন থাক। কেউ বলবে না।
আরো দিন কুড়ি পড়ে, অর্জুন নিজে নিজেই বাথরুম যেতে শুরু করে ছিল। ডাক্তার কে দেখালাম, দীর্ঘদিন শুয়ে শুয়ে ওর স্কিন এর সমস্যা হচ্ছিল। পিঠে অনেক ঘা এর মতন হয়ে গেছিল। অনেক ওষুধ পালা দিল। ওকে স্পঞ্জ করিয়ে দেবার পরে আমি নিয়ম করে ওষুধ গুলো লাগাতে লাগলাম। আগের ছেলে টা কে ফেরাতেই হবে। কি জেল্লা ছিল গায়ের। সব টা পাই টু পাই ফিরিয়ে আনব আমি।
ওকে প্রথমে দেখে যে হাল হয়েছিল, সেখান থেকে এই দুই মাস যাবার পরে, নিজের কনফিডেন্স অনেকটাই ফেরত পেয়েছি আমি। মনে মনেই কথা বলি, ওকে ফিরিয়ে আনতেই হবে। একেবারে আগের মতন। কোন এদিক ওদিক চলবে না। যে ছেলেকে আমি রেখে গেছিলাম, ঠিক তেমন করেই চাই।
আরো মাস খানেক যাবার পরে পরিস্থিতি অনেক টাই স্বাভাবিক হল। অর্জুন এখন সলিড খাবার ও খেতে পারছে। কম দি ওকে কিন্তু বারংবার দি খেতে দি। বড়দির বাড়িতে খুশীর আবহাওয়া। আমি জীবনে বড়দির বাড়ি আসিনি আগে। প্রথম বার এলাম তাও ওই অবস্থায়। অর্জুনের সুস্থতার খবর পেয়ে, অনেকেই দেখা করতে আসছিল। আমি দেখা করতাম না ওদের সাথে। ওরা অর্জুনের ঘরে আসলে আমি থাকতাম না সেখানে। অনেক প্রশ্ন উঠবে।
এতোদিনে তো অনেকেই জেনে গেছে আমি কে আর ওর কি হই। কিন্তু অনেকেই যেটা বুঝতে পারছে না সেটা হলো, এমন কি হলো, যে আমি আসার পরে অর্জুনের বাঁচার ইচ্ছে টা আবার ফিরে এল। আমি জানি এই সব কথা উঠবে। তাই এড়িয়ে চলি। আর আমার মাথার সিঁদুর টা তো বিশাল প্রশ্ন চিহ্ন সবার সামনেই। এক মাত্র অর্জুন ছাড়া কেউ সেটা জানে না।
সেদিনে দুপুরে অনেক লোক ছিল ঘরে। যতই অর্জুন ভালো হয়ে উঠছে, ভিড় বাড়ছে। আর ধীরে ধীরে আমি ব্রাত্য হয়ে পড়ছি। রবিবার ছিল। ছোড়দি, বড়দি বর জামাইবাবু, ভাই, ভাই এর বউ সবাই ছিল ঘরে। আমি ফল কেটে দিচ্ছিলাম অর্জুন কে। সবাই গল্প করছে মনে আনন্দে। অর্জুন কে নিয়ে নয়, নানান ব্যাপারে। আর ওদের চোখ গুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে আমার উপরে। বুঝলাম অনেক প্রশ্ন ওদের মনে। উত্তর তো আমাকেই দিতে হবে। আমার মনেও কম প্রশ্ন নেই। উত্তর না পেলে এদের কাউকেই আমি ছাড়ব না ।
সমস্যা হলো অর্জুনের সামনে এই কথা বলা যাবে না। আর অন্য ঘরে বসে যে কথা বলব সম্ভব হচ্ছে না। ও পনের মিনিট আমাকে দেখতে না পেলে ঘন্টা বাজাচ্ছে বাচ্চাদের মতন। বড়দি গেলেও শুনছে না। আর কেউ গেলে শুনছে না। আমি গেলেই ঘন্টা বাজানো বন্ধ করছে। কিছু না, একবার দেখে একটু হাসে। আমিও একটু হাসি, বাস দরকার শেষ। এখন এমন না যে আমাকেই খাইয়ে দিতে হয়। যে কেউ খাইয়ে দিলে খেয়ে নেয়, কিন্তু প্রতি পনের মিনিটে আমাকে দেখতে পাওয়া চাই।
ধাবকা হয়ে গেছে ওর। হয়ত আবার চলে যাব। ও এখন অনেকটা সুস্থ। তাই ভয় টাও বেশী হয়ে দাঁড়িয়েছে। বড়দির কাছে আমি, সাপের ছুঁচো গেলার মতন অবস্থায় আছি। গিলতেও পারছে না, আর ছেলের জন্য ফেলতেও পারছে না। বললাম না নিজেকে ব্রাত্য লাগছে। মনে হচ্চে সবাই চাইছিল ছেলেটা সুস্থ হয়ে যাক। এখন অনেক টা সুস্থ তাই আমার উপস্থিতি টা সবাই কে লজ্জা আর বিশাল প্রশ্ন চিহ্নের সামনে দাড় করিয়েছে।
কিন্তু আমি ভেঙ্গে পড়িনি এতে। আমি আর ওকে ছেড়ে যাব না ব্যস। সবাই মিলে বললেও না। এবারে আমার জীবনের হাল আমি ধরব। সমাজ যা বলে বলুক। লোকে হাসুক। আমাকে রাক্ষসী বলুক। দানবী বলুক, নষ্টা বলুক। কিচ্ছু যায় আসে না আর আমার। এতোই রেগে আছি ভিতরে ভিতরে ছোড়দির সাথেও কোন কথা বলিনি। শুধু অর্জুনের দিকে তাকিয়ে আমার রাগ আমি চেপে রেখে দিয়েছি। ও কোনদিন ও দেখেনি আমার চন্ডাল রাগ।
ইমিউন সিস্টেম তা অর্জুনের এখনো পোক্ত হয় নি, তাই প্রায়শই জ্বর আসত ওর। ডাক্তার বলে দিয়েছিল, এটা থাকবে, ধীরে ধীরে কমতে থাকবে এই ব্যাপার টা। যত ইমিউন সিস্টেম পোক্ত হবে ততই এই ব্যাপার টা ও স্বাভাবিক হবে। বলতে নেই জ্বর আসার ব্যাপার টা এখন অনেক কম। তিন চার দিন বাদে গা টা দেখি ছ্যাঁক ছ্যাঁক করে। খাইয়ে দাইয়ে ওষুধ দিয়ে দি। ঘুমিয়ে উঠলে ফ্রেশ হয়ে যায় ও। এখন আর ভয় পাই না আমি।
এই রকম ই এক জ্বরের রাতের ঘটনা। ছোড়দি ছিল সেদিন বড়দির বাড়িতে। ললিত দা আসে নি কিন্তু সুবর্ন এসেছিল। ছিল আমার মা। বাড়ি একটু থমথমে। আমি বুঝছিলাম আজকে হবে আলোচনা। কিন্তু আমার ভাল লাগছিল না। আমার মাথার সিঁদুর নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। অর্জুন এর সামনে উঠলে ভালো হত। নাহ থাক, এই অবস্থায় ওর এতো উত্তেজনা ভাল না। আমার কথা বিশ্বাস করলে করবে না করলে তাতেও কিছু যায় আসে না আমার আর। কিন্তু আমি ঠিক করে নিয়েছি, অর্জুন কে ছেড়ে আমি আর চলে যাব না। আর যা সিদ্ধান্ত নেব আমার ব্যাপারে সেটা অর্জুনের সামনে অর্জুনের মতে।
অর্জুন ঘুমোচ্ছে। আমরা বসে আছি, যে বিছানা পেতে আমি নীচে ঘুমোতাম সেই বিছানায়। বড় জামাইবাবু দাঁড়িয়ে আছে। মা বড়দি আর ছোড়দি বসে আছে আমি আছি দাঁড়িয়ে হেলান দিয়ে অর্জুনের পাশেই। এই আড়াই মাসে আমার চুল কিছু বেড়েছে। বার বার চশমার উপরে পড়ছিল চুল গুলো তাই একটা হেয়ার ব্যান্ড পরে নিয়েছি আমি। সবার চোখে একটা ভয়। সাথে ঘেন্না মিশ্রিত রাগ। চোখের ভাষা ভুল আমি পড়ি না। আমি জানি, এই ঘরে সব থেকে বেশি আহত করা হবে আমাকে। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আমার মন টা কে রক্তাক্ত করা হবে। বলার সুযোগ তো দূর, আমার নীরবতা কে নিজের মতন করে উত্তর বানিয়ে সামনে রাখা হবে। পারছি না আর আমি, আমার হাত পা কাঁপছে। কত ঝড় সইব আর? এদের কি মায়া দয়া নেই? গত আড়াই তিন মাস আমি ঠিক করে ঘুমাই নি অব্দি। কি খেলাম সেটাও কেউ দেখেনি। আর আজকে আমাকে নিয়ে বসেছে এই সম্পর্কের মীমাংসা করতে। মরতে তো পারব না। কাজেই, অর্জুনের অলক্ষ্যেই আমি রক্তাক্ত হব সারা জীবন। কেউ না কেউ, প্রতিদিন, জিহ্বার তলোয়ার আমার দিকে চালাবে। রক্তাক্ত হব আমি। সারা জীবন। নাহ আজকে কথা বলব আমি। বলবই।
—————————
কুড়ি

চোখ বুজে এলো আমার শ্রান্তি তে। দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি আর অপেক্ষা করছি তলোয়ারের।
সবাই চুপ করেই আছে। বুঝতে পারছে না কি বলবে। চোখ গুলো সবার বিহবল লাগছে আমার। স্বাভাবিক। কখনো আদ্র, কখনো ঘৃনা আবার কখনো বিহবল। আমার সাথে অর্জুনের সম্পর্কের কথা ভাব্লেই সবাই ঘেন্নায় সিটিয়ে যাচ্ছে। আবার গত আড়াই তিন মাস আমাকে দেখে, আমাদের সম্পর্ক টার গভীরতায় সবাই বিহবল আর আদ্র হয়ে পড়ছে। আমি নিতে পারছিলাম না আর এই নীরবতা কে। দম বন্ধ হয়ে আসছিল। প্রথমে মুখ আমি খুললাম,
– বল কি বলবি তোরা সবাই মিলে আমাকে। মরতে বলিস না , ওকে ছেড়ে চলে যেতে বলিস না। সেটা আমি আর পারব না। অনেক চেস্টা করেছি ওকে ছেড়ে চলে যেতে। কিন্তু বার বার ফিরে এসে এই ভাবে আর ম্যানেজ করতে পারব না। আমার ও ইচ্ছে করছে না আর এই ভাবে বাঁচতে। এই ভাবে লুকিয়ে, পালিয়ে।
সবাই স্থির কঠিন হয়ে বসে। বড় জামাইবাবু আমার দিকে তাকিয়ে। হয়ত ভাবছে আচ্ছা নির্লজ্জ মেয়ে বাপু। মা তো হতবাক হয়ে তাকিয়ে আমার দিকে। কিছুই বুঝতে পারছে না বেচারী। বয়েস হয়েছে মা এর। মা কে না আনলেই ভালো করত ছোড়দি। ছোড়দি বলল প্রথম।
– আমার কথা একটু শোন নান্দু। তুই যা ভাবছিস সেটা নয়।
ছোড়দির গলার আওয়াজেই, গর্জে উঠলাম আমি
– তুই তো একদম চুপ করবি!!
পরক্ষনেই অর্জুনের দিকে তাকিয়ে গলার স্বর নীচে করে বললাম
– কি বলেছিলি তুই আমাকে? তুই চলে যা অর্জুন কে আমরা সামলে নেব। কি সামলালি? ছেলেটা কে তো মেরেই ফেলেছিলি সবাই মিলে। ভরসা করেছিলাম তোর উপরে। রাখতে পারিস নি।
ছোড়দি মাথা নামিয়ে নিল। আমার চোখ ঘুরতে লাগল সবার উপরে। কেউ কথা বলার মতন পরিস্থিতি তে নেই। আমার ও ভালো লাগছে না কথা বলতে। কিন্তু কিছু কথা তো বলতেই হবে। বললাম,
– তোরা বাপু এটা নিয়ে আর জল ঘোলা করিস না। আমি আর উত্তর দিতে পারছি না। আমাকে আর ও কে আমার পুরোন বাড়িতে রেখে দিয়ে আয় তোরা। ওকে আমি আগের মতন অবস্থায় বড়দি কে ফেরত দেব। কথা দিয়েছি আমি। আমি কোন মতেই ভাবছি না সমাজের কথা। কে কি বলবে, কি না বলবে, কিচ্ছু না। শুধু ভাবছি ওর রিকভারি। ও পরিপূর্ন সুস্থ হোক তারপরে গোল টেবিল বৈঠক বসাস সবাই মিলে। আর হ্যাঁ আমার কাউকে লাগবে না । আমি একাই ওকে সামলে নেব।
নিজের ভিতর থেকেই কথা আসছে আমার। অনেক অনেক কথা। এই ভালোবাসা যদি অন্যায় হয়, পাপ হয় তবে এমন পাপ এমন অন্যায় আমি বার বার করব। একশবার করব। আমাকে ভালোবেসে, আমার বিরহে যদি সে মরণাপন্ন হয়ে যায়, তবে গর্বিত আমি আমার ভালোবাসায়। একশবার ভালোবাসব, হাজার বার বাসব। কিন্তু মুখে বললাম,
– কি করি বল তো আমি। আমার দিক টা কেউ দেখছিস না তোরা।
মা কে বললাম,
– মা, আমি একবার নয় দু দু বার ওর জীবন থেকে দূরে চলে গেছিলাম। আর দু বার ই ওর হাল এমন হয়েছে। ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছি। একবার ও এসেছে ফিরে আর এই বারে আমি এলাম। কি করব বলো? মরে গিয়েও তো শান্তি নেই। মা আমার মরণে কোন উপকার হলে অনেক আগেই সেটা করে ফেলতাম আমি। ছোড়দি কে জিজ্ঞাসা কর। কি যে জালে পরেছি আমি আমি ই জানি। না মরে শান্তি, না বেঁচে সুখ। কি করবো বল তোমরা??? চুপ করে থেক না। কোথায় আমার দোষ বল???????
মা একেবারে হতভম্ব হয়ে গেছে। দিদিদের মুখে যা শুনেছে আর আমার মুখ থেকে যা শুনছে, দুটো তো মারাত্মক কন্ট্রাডিক্টরি। বড়দি চিরকাল ই কম ভাবে। এতো ভাবনা ওর পোষায় ও না। ও হয়ত ভাবছে, এমন টা হলো কি ভাবে। কি ভাবে একটা বুনপো তার মাসীর সাথে প্রেমে জড়াতে পারে। বা একটা মাসী কি ভাবে তার বুনপো কে প্রেম করতে পারে। ছোড়দি বড়দি দুজনের কাছেই তো প্রেম একটা ডিল ছিল মাত্র। শুরুর দিকে এটলিস্ট।
বড়দি তো বড়োলোক স্বামী পেয়েই খুশী হয়ে গেছিল। আর ছোড়দি পড়াশোনার জন্য বেরিয়ে এসেছিল বাড়ি থেকে। পরে প্রেম এসেছে মানুষ টার সাথে থাকতে থাকতে। কিন্তু যখন প্রেম এসেছে তখন সামনে সেই মানুষ টাই ছিল, যাদের বাচ্চার মা ওরা। ছোড়দি একটু আলাদা। পেটে বিদ্যে আছে আর প্রেম টা কিছু টা হলেও অনুভব করে। বড়দির কাছে এটা সম্পূর্ন নতুন সাবজেক্ট, যার নাম হয়ত সে শুনেছে, কিন্তু জীবনে পড়াশোনা করেনি সেটা নিয়ে। তাই কথা যখন বলল তখন সেটা আমাকে মারাত্মক রক্তাক্ত করল।
বলল,
– তুই কি কিছু ওকে খাইয়েছিলি? না মানে কোন তুক তাক ধরনের কিছু?
আমি কি বলব খুঁজে পেলাম না। কিন্তু এত আহত হলাম বলার না। আহত হলাম এই জন্য নয়, যে আমাকে বলল আমি কিছু খাইয়ে ওকে দিয়ে আমাকে ভালবাসিয়েছি। সেটা তো সত্যি নয়। কিন্তু আহত হলাম, আমার আর ওর ভালোবাসা টা কে অবিশ্বাস করা হলো বলে। মনে মনে ভাবলাম, আমার ভালোবাসা এতো কম ছিল না যে বাইরে থেকে ডোপ করাতে হবে কোন ক্যাটালিস্ট। বোকা টা যদি ভাবত তাহলেই বুঝত ও যা ভাবছে সেটা ভুল। ওকে ভালোবাসার কথা আমি বুঝেছি খড়গপুরে থাকার সময়ে। যদি ডোপ করাতাম তবে চলে গেছিলাম কেন? আর ডোপ করালে ওকে নিয়েই পালাতাম। ওকে ছেড়ে পালানোর কি দরকার ছিল? কিন্তু বুঝলাম এই ভাষা ও বুঝবে না।
সপাটে উত্তর দিলাম

– তুই উলটে কোন এন্টি ডোট দেওয়াস নি কেন তোর ছেলেকে? ফিরে আসত তোর কাছে। এখনো সময় আছে। নিয়ে যা কারোর কাছে। দেখ কি হয়।
থতমত খেয়ে গেল বড়দি। এতো রেগে গেছিলাম যে আমার হাত পা আবার কাঁপতে শুরু করেছিল। আর পারছি না দাঁড়িয়ে থাকতে আমি। অর্জুনের বেড টা আমি ধরে রইলাম। কিন্তু অবাক করে কথা বলে উঠল বড় জামাইবাবু। দিদি কে এক প্রকার খেঁকিয়েই গেল বড় জামাইবাবু।
– কি সব ফালতু কথা বলছ? তুকতাকের কথা বলছ? গত আড়াই মাস তুমি ওকে দেখনি? ও ঘুমোয় নি অব্দি। তুমি তো রাতে ঘুমোতে। আমার মন মানত না। আমার তো ছেলে! ভাবতাম ওর শ্বাস বন্ধ হয়ে গেল না তো ঘুমের মধ্যে?

গলা ধরে এল বড় জামাইবাবুর। কিন্তু বলতে থাকল,
– বারে বারে উঠে এসে দেখতাম। আর যত বার এসে বাইরে থেকে দেখতাম, দেখতাম নান্দু জেগে, বার বার হাতে হাত দিয়ে পরীক্ষা করছে ছেলেকে আমার। হয়ত সেও দেখত প্রদীপ জ্বলছে না নিভে গেল। তুমি মা, সারা দিন ওর পিছনে খাটতে, বাড়ির কাজ, ছেলের জন্য চিন্তা, ঘুমিয়ে যাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু আমার ঘুম আসত না। ভোর বেলায় নান্দু স্নান করতে বাথরুম যেত, তখন নিশ্চিন্ত হতাম আমি, তারপরে আমার ঘুম আসত। তুমি আর যাই বল ওকে ওই সব বোল না। সেটা অন্যায় হবে।
কথা টা বলে বড় জামাইবাবু উঠে গেল। মনে হয় চোখে জল এসে গেছিল। আমার হল উলটো। এতক্ষন জোর ধরে ছিলাম আমি। আর পারলাম না। কথাটা মনে হয় সত্যি – থাপ্পড় সে ডর নেহি লাগতা হ্যায় সাহিব, প্যার সে লাগতা হ্যায়। যতক্ষন পাশে কাউকে পাইনি জোর ধরে ছিলাম। বড় জামাইবাবুর এই কথা গুল যেন আমার বুকে গিয়ে বিঁধল সোজা। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না আমি। বসে পরলাম। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম আমি। কান্না টা হয়ত বড় জামাইবাবু কে সারা জীবন উলটো বোঝার জন্যেও বটে। আমার কস্ট টা কেউ তো একনলেজ করল।
আর সব থেকে বড় কথা সম্পর্কের ছুৎমার্গ আমাদের মেয়েদের মধ্যে বেশী। ছেলেরা এই সব নিয়ে এতো টা ভাবে না বলেই মনে হয়। ততক্ষনে আমার মা উঠে এল আমার পাশে। আমাকে নিয়ে বসালো অর্জুনের বেডের নিচেই। মা ও বসল। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল আমার মা। ইচ্ছে তো করছে জড়িয়ে ধরতে মা কে। এই সময়ে মায়েরাই মেয়ের সব থেকে বল ভরসা হয়। আজকেও রাগ হলো। ইচ্ছে করলেও জড়িয়ে ধরতে পারছি না। আমি যে ভেঙ্গে পড়ছি সেটা কাউকে বুঝতে দিলে হবে না। মায়ের দিকে চেয়ে মনে হলো, কে মানা করেছিল তোমাকে, একলা আমার মা হতে?
অনেকক্ষণ পরে আমার কান্না থামল। ছোড়দি সেই যে চুপ করেছে, কাঁদা ছাড়া আর কিচ্ছু করেনি। আমার আর কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু বড়দির সেই অমোঘ একঘাতিনী প্রশ্ন টা ধেয়ে এলো আমার দিকে।
– আচ্ছা, আর কোন কথা নয় তুই ও বিশ্রাম নে। কিন্তু এ টা বল, ও কি তোকে বিয়ে করেছিল?
বলে দিলাম ওকে
– তুই মানবি কিনা আমার জানা নেই। কিন্তু আমি সিঁদুর টা মুছে ফেলতে পারিনি। দশমীর ভাসানের আগে সিঁদুর খেলার সময়ে ও পরিয়ে দিয়েছিল আমাকে, এক প্রকার জোর করেই। কিন্তু আমি মুছে ফেলতে পারিনি। আমার সাথেই, কলঙ্কের মতন বয়ে নিয়ে বেরিয়েছি আমি মাথায় এই সিঁদুর। কিন্তু আজকে মুক্ত কন্ঠে স্বীকার করছি, আজকে আমার এই মাথার সিঁদুর আমাকে এতো শক্তি দিয়েছে। না হলে হয়ত আমি যুঝতে পারতাম না গত আড়াই মাস।
বেশ খানিকক্ষণ সবাই ঘরে বসে। শুধুই দীর্ঘশ্বাসের শব্দ। আমার কিছু করার নেই। পাক সবাই দুঃখ। আমার অর্জুন কে কস্ট দেবার সময়ে কারোর মনে ছিল না। আমার কারোর উপরে আর কোন সহানুভুতি নেই। আমি আর ও থাকব আলাদা হয়ে।
হাঁ করে দেখছিলাম ওদের চলে যাওয়া ঘর থেকে বেড়িয়ে। নিজেকে মুক্ত লাগছে অনেক টা। সবাই যেন প্রায় ঝুঁকে গেছে। এটা যে কত বড় একটা সমস্যা, সেটা ওদের মতন আমিও বুঝতে পারছি। কিন্তু কিছু করার নেই আর। এর পরে ওরা অর্জুনের সাথে কথা বলুক। কিন্তু আমি মন থেকে এই সিঁদুর মেনে নিয়েছিলাম সেদিনেই। আমার কিছু করার নেই। আর অর্জুন স্বীকার না করলে তো সব মিটেই গেল।
সেদিনের পর থেকে, বড়দি, জামাইবাবু সবাই অল্প হলেও বদলে গেল। মাঝে অর্জুনের অফিস থেকে লোকজন এলো কিছু। অর্জুনের রিকভারি দেখে ওরা খুশী হয়ে গেল। ওর জয়েনিং নিয়ে সবাই খুব উদ্গ্রীব সেটা বুঝতে পারলাম। ওকে আমি এখন একটা হুইল চেয়ার এ বসিয়ে বিকাল টা ঘোরাই। বাড়িতে যা আলোচনা শুনলাম তাতে সবাই মিলে আমাকে আর অর্জুন কে আমাদের পুরোন বাড়িতে রেখে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

সমাপন
আমাদের এ বাড়িতে রেখে যাবার পরে আমরা আমাদের মতন করে গুছিয়ে নিলাম। আমার প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল ওকে আবার আগের মতন করে তোলা। সামনেই ওর জয়েনিং ছিল। একজন ডায়াটিশিয়ান এর সাথে যোগাযোগ করে সেই ভাবে ডায়াট ফিক্স করলাম আমি ওর। সকালে উঠিয়ে অল্প অল্প করে ফ্রি হ্যান্ড করাতাম। ও একটা কথা বলত না। একবার আমাকে দেখে নিয়ে যা বলতাম করত। শুধু একটাই কথা আমাকে বলেছিল – আর আমাকে ছেড়ে যেও না। এবারে আর ফিরে আসব না আমি।
সে কী আর আমি জানিনা। কে তোকে ছেড়ে যাচ্ছে। এবারে আমার মরন ই তোর থেকে আমাকে আলাদা করতে পারে। মুখে কিছু বলতাম না ওকে। মুখ বুজে ওর সেবা করে যেতাম। মাস দেড়েক পরে ওর দুর্বলতাও অনেক কেটে গেল। তখন রাতে কথা বলত আমার সাথে জেগে। আমি পাশে শুতাম। যখন ও অসুস্থ ছিল তখন পাশে শুতে কোন অসুবিধা হতো না। কিন্তু যতই ও পূর্ন শক্তি তে ফিরতে লাগল, আমার অস্বস্তি হতো। রাতে শুয়ে। ও কেন জানিনা আগের মতন ছিল না। আমাকে পেটে চাইত সব সময়ে ওর কাছে ওর পাশে।
আসলে ওর যখন শরীর দুর্বল ছিল, কত কত রাত ওকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতাম আমি। মাথায় আসত না, ও আমার মাথায় সিঁদুর পরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এখন আমার একটা কেমন লজ্জা করে। অনেক সময়ে হয়, যে স্নান করে বেরিয়ে আমি সিঁদুর পড়ছি আর ও আমাকে হাঁ করে দেখছে।
রাতে বলত আমাকে,
– তোমাকে দারুন লাগে সিঁদুর পড়ার সময়ে।

– আহা। পড়তে তো হবেই। দিয়ে দিয়েছিস মাথায়।

– তবে আমি তোমার বর হলাম বল?

– সে তো হলি ই? কোন সন্দেহ?

– হ্যাঁ সন্দেহ আছে

– কীসের????

– প্রথমত , বউ রা বরেদের তুই তুই করে না। আর দ্বিতীয়, বরেরা বিয়ের পরে বউ দের নিয়ে হানিমুন এ যায়

– আহা ভাআরি বর আমার এলেন। আচ্ছা তুমি টা না হয় চেস্টা করা যাবে। কিন্তু এই রকম রুগ্ন বর হলে হানিমুন এ যায় না কেউ

– আমি আর রুগ্ন নেই।

– হ্যাঁ কিন্তু, এই যে এক বাড়িতে এক ঘরে আমরা আছি, এক বিছানায় শুচ্ছি, এটাই তো হানিমুন

– উফফ একে কি করে বোঝাই। হানিমুন বরের রা বউ দের ওই ওই সব করে।

– মানে? কি করে?

– আরে বাবা ওই সব?

– কি সব।

– বলি?

– বল না রে বাবা

– আবার তুই তুই করছ?

– আচ্ছা আচ্ছা বল।

– হানিমুন এ বরেরা বউ দের হাত ধরে।
গা টা শিরশিরিয়ে উঠল আমার। কত হাত ধরেছে আমার ও। কিন্তু আজকে একটা অন্যরকম অনুভুতি হলো। ওকে থামাতে ইচ্ছে হলো না। ততক্ষনে অর্জুন আমার হাতের আঙ্গুল গুলো নিয়ে খেলছে। আমি সেই খেলা দেখতে
দেখতে বললাম,

– আর?

মাথার পিছনে হাত টা নিয়ে নিয়ে চুল থেকে খামচা টা খুলে চুল টা বালিশে ছড়িয়ে দিয়ে অর্জুন বলল

– বউ যে কত সুন্দরী সেটা বার বার দেখে।

এই বলে ও আমার চুলের ভিতরে নাক টা ঢুকিয়ে দিলো। আমি শিউরে উঠলাম। এমন দুষ্টুমি তো আগে করে নি কোনদিন ও। এ কি করছে? আর আমার ভালো লাগছে? ওর গায়ের গন্ধে, হাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরার আকুতি আমাকে কেমন একটা বাধ্যতার দিকে নিয়ে চলেছে। প্রথম বার এই বাধ্যতা আমার ভালো লাগছে মারাত্মক।
কিন্তু আগের কথার রেশ টেনে বললাম

– আআর?

– বউ কে চুমু খায়।

বলে আমার চিবুক টা তুলে ধরে চোখে কপালে গালে চুমু খেল

– আর?

– আর???? মুখে মুখ দিয়ে চুমু খায়। এই ভাবে।

বলে আমার ঠোঁটে ওর ঠোঁট টা স্পর্শ হতেই ওকে জড়িয়ে ধরলাম আমি। আর কি কি করে জিজ্ঞাসা করার মতন সামর্থ্য রইল না আমার। হারিয়ে গেলাম ওর সাথে……

মুখে দিয়ে অস্ফুট স্বরে বেড়িয়ে এলো

– উম্মম্মম্মম্ম অর্জুন!!!!!!!!!!!

বরের শেষ বিন্দু বীর্য টুকু নিলাম আমি ভিতরে। বর কে জড়িয়ে ধরে তখন ও ওর নীচে আমি কেঁপে কেঁপে উঠছি ওর দমকে দমকে বীর্য ভিতরে পরার ধাক্কায়। মনে মনে ভাবছি, বাবাহ শেষ হয় না শয়তান টার বীর্য। জেদ করেই ভিতরে ফেলল আজকে ও। আমিও কোন দিন ওকে নিরাশ করিনি। করব ও না। ওর আরেক টা গুন্ডা বা গুন্ডির নেবার ইচ্ছে। নিক। ও যা পারে করুক। আমার জীবনএর চাবি তো ওকে ছাড়া আমি আর কাউকে দিই নি। দেবো ও না। আমি আমার স্বামীর বীর্যে পোয়াতি হব, এর জন্যে অন্যের কাছে আমি জবাব দিহি করব কেন? শেষ বিন্দু যখন ঝরল আমার ভিতরে। ও আমাকে আঁকড়ে ধরল ভীষন জোরে। আমিও ততধিক জোরে ওকে আঁকড়ে ধরলাম, মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে এলো
– উম্মম্মম্মম্মম্ম অর্জুন!!!!!!!
এ যে কি শান্তি বলে বোঝাতে পারব না। নিজের লোকটার বাহু ডোরে বন্ধিত থাকা। বড় ক্লান্তি। বড় শ্রান্তি। নাহ আর পারছি না। দু চোখ বুজে এলো আমার সুখে, আনন্দে, শান্তি তে, শ্রান্তি তে। অর্জুন শুয়ে আছে আমার উপরে। তখন ও মথিত করে চলেছে আমার শ্রান্ত দেহ টা। আমার এই সংসার অর্জুনের সাথে। এই তো আমার কাম্য ছিল। জীবনের বেশী লড়াই টাই তো আমি অর্জুনের জন্য করেছি। আজকের এই ঘর, এই বিছানা, ছেলে মেয়ে, আর সর্বোপরী অর্জুন আমার কাছে। আমার থেকে বেশী সুখী কেউ নেই। আমি শুধুই অর্জুনের। আর এটাই আমার সব থেকে বড় সুখ। এখন এই সুখের জল চোখের কোন দিয়ে বালিশে ক ফোঁটা পড়ল, সে অর্জুনের না জানলেও চলবে। এবারে ঘুম , শুধু ঘুম। চোখ বন্ধ হয়ে এলো আমার।

ডায়রি টা বন্ধ করল সুবর্না। থম হয়ে বসে রইল সামনে দিকে চেয়ে। সামনে দাউ দাউ করে জ্বলছে চিতা। কে জানবে, মারত্মক ভালোবাসার একটা অধ্যায় শেষ হলো আজ। তাকিয়ে রইল চিতার আগুনের দিকে। কি মারাত্মক তেজ! ওমনি তেজী ছিল মেয়েটা। সারা জীবন কস্ট পেয়ে গেল। শেষ দিন অব্দি অর্জুনের রইল। হে ভগবান ওদের পরের জন্মে মিলিয়ে দিও। সেখানে যেন কোন বড়দি ছোড়দি না থাকে। সেখানে যেন মেয়েটার সামনে কোন চ্যালেঞ্জ না থাকে। মারাত্মক ক্লান্ত পা নিয়ে সুবর্না উঠে এল গাড়ি তে। গত দু দিন তার ঘুম নেই।
সুবর্নার বাড়িতে সবাই রয়েছে। নন্দনা আর অর্জুনের ছবি রয়েছে সামনে। মালা দেওয়া মোটা রজনীগন্ধার দুটো ছবি তেই। । দুটো ছবি ই যেন বড় জীবন্ত। হাসছে দুটো পাগল। অনেক খুঁজেও দুজনার একসাথে কোন ছবি পায় নি সুবর্না। মেয়েটা কোন দিন ও ছবি তোলেই নি একসাথে। সারা জীবন ওকে দোষ দিয়ে এসেছে সবাই। কিন্তু সুবর্না জানে, নন্দনা সব রকম চেস্টা করেছিল এই ভালোবাসা থেকে বেরিয়ে আসার। কিন্তু পারে নি। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে গেল সুবর্নার। এদিকে বড়দি আছার পাছার করে কাঁদছে।
সুবর্ন মা কাঁদছে দেখে মাকে এসে জড়িয়ে ধরল। কিন্তু সুবর্না একা থাকতে চাইছে। কি হত, ওদের কে এক করে দিলে। দুটো তে বাঁচত খানিক। সুবর্ন কে ছাড়িয়ে ও চলে গেলো ছাদে। বাঁচতে ওর ও আর ইচ্ছে করছে না। যে ভালোবাসা নান্দু টা বাসল সে ভালোবাসার এক কানা কড়িও যদি কেউ কাউকে বাসতে পারে তবে পৃথিবী টা অন্য রকম হয়ে যাবে।
ডায়রির সব কটা কথাই সত্যি, কিন্তু শেষ কয় দিনের নান্দুর লেখা টা পড়ার পরে, সুবর্না নিজের কান্না আটকাতে পরে নি। কারন, যেদিন অর্জুন মারা গেল, সেদিন নান্দু আসার পরে দশ দিন হয়েছিল। ছেলেটা উন্নতি করেছিল। কিন্তু কি যে হলো, দুম করে চলে গেলো। নান্দু কে বিশ্বাস করানো যায় নি সেটা। ওই ঘরেই সে তার নিজের দুনিয়া বসিয়ে নিয়েছিল। অর্জুন কে নিয়ে ওর কাল্পনিক দুনিয়া। বড়দি কাঁদত আর দেখত, নান্দু সকালে উঠে স্নান করে, মোটা করে সিঁদুর পরে, অর্জুনের জন্য সুপ তৈরি করছে।কাকে খাওয়াত কে জানে? ওর কাছে অর্জুন তখন ও বেঁচে। জামাইবাবু রোজ রাতে গিয়ে নান্দু কে দেখে আসত, মেয়েটা ঠিক আছে নাকি। কিন্তু নান্দুর ভুল ভাঙ্গিয়ে দেবার সাধ্যি কারোর হয় নি। সুবর্না এক দুবার চেস্টা করেও সফল হয় নি। গর্জে উঠেছে নন্দনা, ওর সাথে কথা বলতে গেলেই। সাহস পায় নি সুবর্না কিছু বলতে।
যত সেবা যত্নের কথা ও লিখেছে সব ওর মস্তিস্ক প্রসুত। নিজে তো ব্রিলিয়ান্ট ছিল। ছেলেটা আর একটু সাথ দিলে, নান্দু ঠিক ওকে ফিরিয়ে আনত। এই ভালোবাসার মরন নাই বা দিত ভগবান। ওর আগের কলেজের প্রিন্সিপ্যাল এর থেকে ঠিকানা নিয়ে, ওকে যখন আনতে গেছিলাম আমরা যোরহাট, ওর মাথার সিঁদুর দেখে আমি ভয় পেয়েছিলাম খুব। কিন্তু আজকে মনে হচ্ছে সেই সিঁদুর যদি তার ছয় মাস আগে আমি মেনে নিতাম আজকে ছেলেটা আর মেয়েটা আমাদের মধ্যে থাকত।
আজকে ডায়রী পরে বুঝলাম, এই গত দশ বছর ও এই ভাবেই বেঁচেছে। আমরা সবাই ভেবেছি ওর পাগল হয়ে গেছে। কিন্তু ও ওর মতই বেঁচেছে। ও বেঁচেছে অর্জুনের বউ হয়ে। অর্জুনের বাচ্চার মা হয়ে। অর্জুনের সাথে মিলিত হয়ে। বলা ভালো অর্জুনের সর্বস্ব হয়ে। অর্জুন ছাড়া ওর জীবনে আর কিছুই ছিল না। ও ওর বাচ্চাদের নাম ও ঠিক করে রেখেছিল। ওর্শী আর জিষ্ণু। হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল সুবর্না।
গত দশ বছর ও, অর্জুন কি পরবে, কি খাবে, কোথায় শোবে সব কিছু, মানে সব কিছু ও নিজের মতন করে করত। অর্জুন কে ঘুম থেকে তোলা, অর্জুনের ঘুমের পরে তাকে দেখা, সব কিছু ওর মনে ভিতরে চলেছে। সেই ছোট থেকেই, কি মারাত্মক রকম পজেসিভ ছিল অর্জুনের উপরে সেটা আজকে সুবর্নার অন্তরে প্রবেশ করেছে। সেই পজেসিভনেস তা ওর মৃত্যু অব্দি কায়েম রেখেছিলো ও। শুধু কাজের মেয়ে টা, কি যেন নাম, হ্যাঁ রিঙ্কু, এইটার কোন ব্যাখ্যা পাচ্ছে না সুবর্না। এই নাম টা কোথা থেকে ও পেল? থাক কিছু না জানা কথা ওদের ভিতরের। এটা বুঝে গেছে ও , এ ডায়রির প্রতিটা শব্দ কোন পেন নয়, নিজের ভালোবাসা দিয়ে লিখে গেছে নান্দু টা।
অর্জুন হয়ত ভেবেছিল, বেঁচে উঠেও লাভ নেই। সেই তো সমাজের বল্লম ওদের বুকের উপরে থাকবে। তার থেকে মরে যাবার পথ ই ও বেছে নিয়েছিল। সারা জীবন নন্দনা কে খোঁটা খাবার হাত থেকে বাঁচাতে চেয়েছিল হয়ত। ছেলেটাও পাগল। এতো ভালো কি কখনো বাসতে আছে? আমরা তো ঠিক করেই নিয়েছিলাম, তুই ফিরে এলে, বাঁচিস তোরা নিজেদের মতন। আমরা বাধা দিতাম না। নিজের হাত দুটো কে মুঠি করে তীব্র ব্যাথায় সুবর্না প্রায় চীৎকার করে উঠল। আরেকটু আগে কেন বলে দিলাম না অর্জুন কে যে আমরা মেনে নিয়েছি।
শেষ দিকে সুবর্না রোজ যেত নন্দনার কাছে। ক্ষমা করে দিয়েছিলো সুবর্না কে নন্দনা। ক্ষমা করার কারন টা ও ডায়রি পড়ে বুঝেছে। কারন তখন ও ভেবেছিল ও অর্জুন কে পেয়ে গেছে। নান্দু ওকে কাল্পনিক সোফা তে বসতে দিত। নিজের ছেলে মেয়েদের পড়াতে বসাত। অর্জুন কে ফোন করে তাড়াতাড়ি আসতে বলত। ছেলে জ্বালিয়ে খাচ্ছে তাড়াতড়ি এস। মেয়েটার এই লাগবে নিয়ে এস আসার সময়ে। অর্জুন ফিরলে ওকে জল দিত। অর্জুন আর ছেলের নামে একরাশ নালিশ করত। দিদি তুই একটু বকে দে তো। হাড় জ্বালিয়ে খেলো আমার দুটো তে। ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠল সুবর্না । হে ঠাকুর এই সুখ টা কেন ওকে দিতে পারলাম না আমি। আমি তো পারতাম চেস্টা করলেই। কেন আমি সাহসী হলাম না একটু। কেন সেদিনে ওকে চলে যেতে বললাম আমি????????
পরশু দিন যখন সবাই জানলাম নন্দনা আর নেই, বড়দির কান্না চোখে দেখা যাচ্ছিল না। যখন ওর ডেড বডিটা তুলছিল, বড়দি পাগলের মতন করছিল, – খবরদার, ওর যেন ব্যাথা না লাগে, এ বাড়ির বউ ও। সারাক্ষণ আগলে ছিল নান্দুর বডি টা। আছার পাছার করছিল বড়দি। হয়ত মনে পড়ছিল, কত কস্ট নিয়ে মেয়েটা মরল।

হায় রে, সব মানল সবাই, শুধু ছেলে টা আর মেয়েটাই রইল না। বড়দি চিতায় শোয়া নন্দনার মাথায় এক কৌটো সিঁদুর ঢেলে দিয়েছিল। বলেছিল

– যাক, মেয়েটা মাথায় সিঁদুর নিয়েই মরল।

বড়দি টাও পাগল হয়ে গেল মনে হয়।

সমাপ্ত

উপসংহার-
পরিশেষে বলি। প্রাণ চলে যাওয়া কোন কাজের কথা নয়। লেখকের ভালো ও লাগে না সেটা। মিলনের থেকে বড় প্রাপ্তি কিছু হতে পারে না। আসলে সমাজে ঠিক ভুলের কোন ব্যাপ্তি নেই। ঠিক মানলে ঠিক আর ভুল মানলে ভুল। এই রকম কোন ঘটনা আশে পাশে হলে, বা নিজেদের কারোর সাথে হলে সাথে থাকবেন তাদের। আরো ভালোবাসবেন। হয়ত সেই ভালোবাসায় ভুল টা থেকে তারা বিরত থাকল। কিন্তু ক্রমাগত আঘাত নিজের মানুষ কে বড্ড একলা করে দেয়। আমরা সেটা বুঝি না, কিন্তু যে একলা হচ্ছে, বা হয়ে গেছে,কিন্তু সে বোঝে অভাব টা কীসের। আমাদের অধিকার নেই, কাউকে আঘাত করার। আমি নিজেই লক্ষ বার কেঁদেছি, এদের পরিনতি তে। এত আপন সম্পর্কে বিয়ে কেউ সাপোর্ট করে না। করতে পারে না। কিন্তু সাথে থাকা যায়। তাদের বোঝানো যায়। আবার এটা ও মনে হয়, ভুল না করে পস্তানোর থেকে ভুল করে পস্তানো অনেক বেটার অপশন ।
(সমাপ্ত)



from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/3fL2H5Y
via BanglaChoti

Comments