টান BY (ডিমপুচ) (পর্ব-১০)

টান

লেখক – ডিমপুচ
পর্ব-১০
—————————

সঞ্জীব আর পূবার মুখ থেকে যেন কেউ ব্লটিং পেপার দিয়ে সব রক্ত সুসে নিয়েছে
……….পাপা , মা আমি আর কি কি শুনব, দাদা যা বলছে সে কি সত্যি , পাপা তুমি সত্যি ধাক্কা মেরেছিলে, কেন, কেন একটা লোককে তুমি খুন করলে, কেন? চিত্কার করে উঠলো তপতী।দুহাতে মুখ ঢেকে বসে রইলো পূবা
……….সব বানানো কথা, তপু , আমি এতদিন ধরে তোর্ বাবা, বলছি সব মিথ্যা , কিছু প্রমান করতে পারবে না . চেঁচিয়ে উঠলো সঞ্জীব
……….আপনি ঠিক বলেছেন সঞ্জীব বাবু, কিছু প্রমান করতে পারব না কিন্তু আপনি স্ত্রীর কাছ থেকে জেনে নেবেন “আমরনাত কিং সিলম ,রহসী কৃতং দুস্ক্রিতং ” এইটার মানে কি
……..আমি এখানে আর থাকতে চাইনা , পূবা তুমি কি আসবে? চুপ করে মাথা ঝুকিয়ে বসে পূবা , সম্পূর্ণ ভাবে ভেঙ্গে পড়েছে। সঞ্জীব ১-২ মিনিট অপেখ্যা করে রেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। রাধা দু হাতে জড়িয়ে আছে তপতী কে। ac মেশিন এর মৃদু শব্দ খালি শোনা যাচ্ছে। চুপ করে সবাই বসে,,খালি তপতীর কান্নার আওয়াজ।রাধা পিঠে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে, দিপু তপতী কে হাত দিয়ে সান্তনা দিল , তারপর উঠে পূবার পাসে বসে , মুখ টা তুলে ধরল
……..এই কাজ কেন করলে, বাবা তোমাকে এত ভালবাসত, বাড়ির সবাই তোমাকে ভালবাসত আর তুমি হত্যাকারীকে আড়াল করলে কেন ? …হু হু করে কেঁদে পূবা দু হাতে দীপুকে জড়িয়ে ধরল,
……কোনো উত্তর নেই, এ ক্ষমাহীন কাজ, তাই আমি ক্ষমা চাইছিনা, আমি কলকাতা যাইনা, তার কারণ ওই ২ অগ, ১৯৭৬ এর ঘটনা। পঙ্কজের মত সৎ ,নির্লোভ ভালো মানুষের হত্যা আর তাকে আড়াল করা, এর কোনো উত্তর নেই। তুমি যদি পুলিশের কাছে যাও, তাহলে আমি সব স্বীকার করে নেব। আমার সন্তান দের কাছে আমি হত্যার সহযোগী। এর থেকে মৃত্যু ভালো।
……..না, পুলিশের কাছে যাব না। মৃত্যু পর্যন্ত শীলার মত বিদ্ধ করবে আপনাকে সেটাই আপনার শাস্তি।
……..একটাই সান্তনা, তপতী ভালো থাকবে। আমার মৃত্যু হলেও ও ভালো থাকবে। কান্না রুদ্ধ কন্ঠে পূবা বলল।অশ্রু সজল চোখে কান্না রুদ্ধ স্বরে
……তপতী তখন পেটে, আমি সেই সময় সঞ্জীবের সাথে জড়িয়ে পরলাম। পঙ্কজ জানতে পেরে যায়। ও আমাকে রোজ বোঝাত।কিন্তু আমার তখন ২২ বছর বয়েস। সুন্দরী , পুরুষরা এক ইশারায়, পায়ে লুটিয়ে পরে। সঞ্জীব যেমন। ওই মধ্যবিত্ত্য values আমার অসহ্য হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এই সবই দুর্বল যুক্তি। হত্যা করার কোনো কারণ হতে পারেনা।সঞ্জীব কে বলতাম যে পঙ্কজ ডিভোর্স দেবে না। সেই জন্য ও রাগ পুষে ছিল মনে মনে, ধাক্কা মারার কোনো পূর্ব পরিকল্পনাও ছিল না, সেইদিন সঞ্জীব আর আমি লেক এর পাস দিয়ে যাচ্ছিলাম। পঙ্কজ উল্টোদিক দিয়ে স্কুটার চালিয়ে আসছিল। আমাকে দেখতে পায়, সঞ্জীব কে বলতেই ও রাগে হিতা হিত হারিয়ে সোজা গিয়ে ধাক্কা মারে। আমি বারণ করার আগেই ঘটনাটা ঘটে যায়। তারপর পুলিশকে টাকা খাইয়ে রাম লগন কে মারে আর দেশে পাঠিয়ে দেয়। যেহেতু আমি আগে চুপ করে ছিলাম তাই পরে সব বললেও আমি ছার পেতামনা। সেই ভয়েই আমি ওকে বিয়ে করে দিল্লি চলে আসি। তোমাকে ওই বাড়ির স্বত্ত লিখে দেবার জন্য খালি ১ রাত্রির জন্য যাই। আমার বাপের বাড়ির সাথে আমার আগেই মন কষা কষি চলছিল। ওরা পঙ্কজ কে সয্য করতে পারতনা, সেই জন্য। ক্ষমা চাইবার মুখ নেই, দিপু , কান্নায় ভেঙ্গে পরে , তপতী তোর্ নিজের বোন্, যাই হোক তুই ওকে দেখিস।আমরা আরো একটি সন্তান চেয়েছিলাম , কিন্তু হয়নি, তখন জানা যায় যে সঞ্জীবের সন্তান উত্পাদনের ক্ষমতা নেই আর আমরা বুজতে পারি তপু পঙ্কজের মেয়ে। তপু কে নিজের বলেই ও মেনে নেয় । এই ব্যাপারে ওর বিন্দু মাত্র খামতি কোনদিন ছিলনা। তুমি যা ভালো বোঝো কর, আমি সব কিছুর জন্যই প্রস্তুত।
খুব নরম কিন্তু তিক্ততা মেশানো গলায় দিপু

……..আপনি জানেননা, আমি কি ভাবে বড় হয়েছি। ২৪ ঘন্টা জ্বরে তিনতলার ঘরে একা, বাড়ির কেউ জানতেই পারে নি। একমাত্র কাকিমা, তার প্রথম সন্তান নিয়ে সেইদিন বাড়ি আসেন, আমাকে বিকাল পর্যন্ত দেখতে না পেয়ে উপরে এসে দেখেন আমি প্রলাপ বকছি, আপনি শুনলে আশ্চর্য আর কিছুটা স্বান্তনা পাবেন আমি খালি আমার না পাওয়া মা কে খুজছিলাম, মাঝে মাঝে বাবা আর কাকিমা।কোনদিন কাউর কাছ থেকে কিছুটি চাইনি, খেতে ভালো লাগলে একটু আলু ভাজা বা একটু করো মাংস কোনদিন চাইনি। কার কাছে চাইব, আমার তো কেউ নেই। ঠাম্মা সে তো সবার, কাকিমা তার সন্তানদের মা, কিন্তু কেউ একজন যে খালি আমার, ছিলনা। অঙ্কে সারা জীবন ফার্স্ট হয়েছি, লুকিয়ে বলতাম কাকিমাকে পাছে কেউ রাগ করে। একমাত্র কাকিমা আমাকে বুজত আর ছোটকা খানিকটা। ৭ বছরের বালক আমি একা একা স্কুলে যেতাম ওই বাস গাড়ির রাস্তা দিয়ে। আমার কি এটাই প্রাপ্য ছিল? কেন এত অবহেলায় বড় হতে হয়েছে, আপনি কি পারতেন না আমার পাসে দাড়াতে। হতে পারি আমি আপনার unwanted সন্তান, কিন্তু গর্ভে ২৮০ দিন তো আপনারিই ছিলাম, কিছু অধিকার কি আমার থাকতে পারে না? তবে স্বীকার করছি, আপনি আজ আমাকে অবাক করে দিয়েছেন, অত দৃপ্ত ভাবে জন্মদিন বলে আর ওই ইয় ইয় ভাঙ্গার কথা মনে রেখে। কিন্তু অতীত জগদ্দল পাহাড়ের মতন আমাদের উপর চাপা থাকে।কোনো ভাবেই প্রাশচিত্ত্য করা যাবেনা, কোনো ভাবেই compensate করা যবেনা, কোনো ভাবেই ভোলা যাবে না, অতীতের করা কোনো দুস্কর্ম। কোনো টাইমমেশিন ফিরিয়ে আনতে পারবে না সেই কাল,পাত্র, বর্গ বা স্থান কে। . আপনি আজ আমাকে ১০ কোটি টাকা দিতে পারেন, বাকি জীবন খালি আমার জন্যই বাচতে পারেন, কিন্তু কিছুতেই কোন ভাবে ওই বাল্যকাল ফিরিয়ে আনা যাবে না। আপনি যাই করুন ভেঙ্গে ফেলা ইয় ইয় ভাঙাই থাকবে , কিছুতেই অতীতে ঘটে যাওয়া ঘটনা undo করতে পারবেন না। কোন ভাবেই, অতীতের unwanted ঘটনা কে নাকচ সম্ভব নয়। অনাগত ভাবীকাল খালি সময়ের আস্তরণ দিয়ে যাবে , কিন্তু ঘটনা গুলো থেকেই যাবে। আমরণ বিধ্হ করবে, তাইনা? বাবার মৃতুর জন্য আপনি দায়ী না হতে পারেন, কিন্তু আপনি আমার কথা একবার ভাবলেন না, কেন?কৈফিয়ত চাইছিনা ,সুধু জানতে চাইছি। আপনি কি আমার ভিতর আপনার মৃত স্বামীকে দেখতে পেতেন ,সেই জন্যই আমাকে পরিত্যাগ করেছিলেন?

পূবা দু চোখ ভরে দীপুকে দেখছে। চোখে স্নেহ উপচে পড়ছে , সম্পূর্ণ সমর্পিত এইভাবে পূবা
……দিপু কোনদিন, কোনদিন আমাকে ক্ষমা করিসনা, আমি ক্ষমার যোগ্য নই। আমি পঙ্কজের যোগ্য ছিলাম না। পঙ্কজ সত্যি আমাকে ভালবাসত। আর তুই unwanted কে বলল, নারে, আমরা দুজনেই ঠিক করেছিলাম দুই বাড়ি থেকেই যদি মেনে না নয়, আমরা আলাদা থাকব আর তোকে আনব। কোনদিন স্বপ্নেও মনে হয়নি যে আমাদের প্রথম সন্তান থাকবেনা। কিন্তু আজ মা হিসাবে তোকে একটা কথা জানাই , পরমা সুন্দরী কাউকে বিয়ে করিসনা। সুশ্রী দেখে বিয়ে করবি।অতীব সুন্দরীদের মনে প্রছন্ন অহংকার থাকে, একমাত্র intellect দিয়ে তাকে অতিক্রম করা যায়। যা আমার ছিলনা। আমার রূপের খ্যাতি ছিল আর সেটাই কাল হলো। intellectually আমি পঙ্কজের ধারে কাছে আসার যোগ্য নই। ও একেবারে অন্যরকম। বললে বুজতে পারবি। পঙ্কজ ,টিউশন করত। প্রচুর, কিন্তু সব টাকা ও দিয়ে দিত ওর পার্টির যারা underground এ থাকত তাদের জন্য। আমিও চাইতাম, কেননা আমি জানতাম ওর মতন সৎ লোক যেটা করবে তা মানুষের ভালোর জন্য। আমিও খারাপ ছিলাম না। প্রচুর ছেলে রাতের বেলায় আমাদের বাড়িতে রাত কাটাত। তোর্ ঠাম্মা তার নিজের ঘরেও তাদের রাখত। একদিনের ঘটনা আমাদের বাড়িতে ঝড় তুলে দিয়েছিল। একটি ছেলে BE কলেজে পরত। সকালে এসে বাথরুম গেল, আমি খাবার দিলাম, খেল, তারপর কিছু টাকা চাইল, পঙ্কজের কাছে ছিলনা, ও আমাকে বলল, আমি সানন্দে আমার থেকে দিলাম। রাতে শুনলাম আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে ও গড়িয়াহাট মোড়ে একজনের সাথে দেখা করতে গেছিল, সেখানে ওকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর অধ ঘন্টা ধরে নাকি, ৪ জন ভারী বুট পরে ওকে ক্রমাগত পেটে লাথি মারতে থাকে। ছেলেটির পেট এবং বুকের সব কিছু ফেটে যায় আর মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে মারা যায়। পরের দিন কাগজে বেরুলো যে এপেনডিক্স ফেটে নাকি মারা গেছে। আমি আর পঙ্কজ দু দিন খালি কেঁদেছি, তোর্ ঠাম্মা কিছু খায় নি।আমার খালি মনে হচ্ছিল, যে শেষ খাবার আমি দিলাম? তখন পশ্চিম বাংলায় এক অন্ধকারের রাজত্য চলছিল।খালি দর্পণ বলে একটা বাংলা কাগজে খানিকটা, আর Frontier সাপ্তাহিক পত্রিকা, যার সম্পাদক ছিলেন,সমর সেন, এই সবের বিরুদ্ধে লিখত। It was the best of times,It was the worst of times, tale of two cities এর সেই বিখ্যাত উক্তি সেই সময়কে খানিকটা বোঝাতে পারে। আমি রাজনীতি কিছু বুজতাম না কিন্তু পঙ্কজকে বুজতাম, ওকে অনুসরণ করতাম। খুব খারাপ হলে কি করতাম? হাঁ , ওই ১৬ বছরে মা হবার জন্য অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত থেকে গেছিলাম। সেইটা পীরা দিত। তার কিছু তোর্ ওপরে বর্ষিত হত। ওই ইয় ইয় ভাঙ্গার পর তোর্ মুখ দেখে কান্না পেয়েছিল। ঠিক করেছিলাম সন্ধে বেলা তোকে নিয়ে একটা কিনে দেব। কিন্তু প্রণব তার আগেই তোকে কিনে দেয়, আমি কিন্তু আজও ওই ঘটনাটা ভুলিনি। তুই একেবারে পঙ্কজের মতই বলতে পারিস। ঠিক বলেছিস, কোনো কিছুই আর তোর্ বঞ্চিত বেড়ে ওঠা সময় কে ফিরিয়ে আনতে পারবে না। যাই করি ঘটনা গুলো থেকেই যাবে। কিন্তু আর যেন না হয়, সেই শিক্ষা নিতে পারি অতীত থেকে। চাকরিতে ঢোকার পর সুধু সঞ্জীব না , আরো কত পুরুষ যে আমাকে চাইত , বলার না। আমার খুব গর্ব হত আর মনে মনে রাগ হত অল্প বয়েসে মা হবার জন্য,. মাত্র ২১ বছর বয়েস, ভেসে যেতে সময় লাগেনি, কিন্তু আজও ভেসেই চলেছি। কিন্তু আর না, এইবার পূবা বিরজু কে উদ্দেশ্য করে বলল …..”MP সাহেব আমি আর ফার্ম হাউস ভাড়া নেব না” …..
…… সকাল থেকে এই প্রথম একটা ভালো,লাগা কথা শুনলাম/, খবরের কাগজ তো ঠিকই লিখছিল। ওরা কখনই সত্যি লিখবেনা আবার কখনই মিথ্যা লিখবেনা , সুধু অর্ধ সত্য লিখবে, যা মিথ্যার থেকে শত গুনে ভয়ানক।ছেলেটির এপেনডিক্স তো ফেটে গিয়েইছিল, সেটাই লিখেছে। কিন্তু তার সাথে যে ভিতরের সব কিছুই ফেটে গিয়েছিল, সেটা লেখেনি। এটাই অর্ধসত্য। শ্রীমতি মালহোত্রা, আপনি আমাকে অবাক করেছেন, ওই ফ্রন্টিয়ার পত্রিকার কথা বলে। আমি বাংলা পড়তে পারি, খুব ভালো না কিন্তু কাজ চালনোর মত পারি। দুঃখ হয়, যে আর কোনো বিবেকানন্দ মুখার্জি আর সমর সেন পশ্চিম বাংলায় জন্মাবেনা। বাবা ঠাকুরদার সম্পত্তি পেয়ে এখন সব মালিক কাম সম্পাদক। এমনিতে এরা কিছুই করতে পারতনা, সম্পাদক হয়ে দুনিয়া সুদ্ধু লোককে উপদেশ দিয়ে যাচ্ছে। রাজনীতি বলুন বা সংস্কৃতি জগত বলুন বা সাহিত্য বলুন, সব জায়গায় সুধু মধ্য মেধার রাজত্ব, কিন্তু সংবাদ মাধ্যম জগতে নিম্ন মেধাই , ২-৪ জন বাদ দিয়ে, ছড়ি ঘুরিয়ে চলেছে। “এক অদ্ভূত আঁধার এসছে পৃথিবীতে। “বিরজু খুব তিক্ত ভারী গলায় বলল।
…… একেবারে ঠিক বলেছেন। কি লাইফ স্টাইল একেক জনের! MP সাহেব আমার স্বামী একটি কবিতা আবৃতি করতেন, এই সবের বিরুধ্যে , শুনুন ,পূবা একটু গুছিয়ে বসলো,এক দুবার গলা পরিস্কার করলো, তারপর সবাইকে অবাক করে

“সময় যে হলো বিন্ধ্যাচল, ছেড় আকাশের উঁচু ত্রিপল
হানো বিদ্রোহী উপল শত শত ,.
মুখ তোলো বিন্ধ্যাচল, মোছ উদগত অশ্রুজল
,যে গেল সে গেল ,ভোল ক্ষত।”

সম্পূর্ণ কবিতাটি আবৃতি করার পর সবাই সপ্রসংসার দৃষ্টিতে পূবাকে দেখল।“ আমি খারাপ ছিলাম না। আমি নিজেকে পঙ্কজের সহধর্মিনী হিসাবেই তৈরী করছিলাম। কিন্তু পারিনি, একেবারেই পারিনি। এই রাজনৈতিক বা সামাজিক কথাগুলো বলছি যাতে দিপু খানিকটা বুজতে পারে আমাকে। পরিবেশ মানুষকে ভালো বা খারাপ করে। তার সাথে জিন, নিশ্চই একটা ফ্যাক্টর, কিন্তু পরিবেশই আসল। আমার অনেক বদনাম আছে, কিন্তু কেউ বলতে পারবে না আমি মালকিন হিসাবে খারাপ। আমার কারখানার কোনো শ্রমিকের সন্তান যদি ১২ ক্লাসে ভালো রেজাল্ট করে, তার পরের ৩ বছরের কলেজের লেখাপড়ার খরচা আমি দিই। অবশ্যই এটা পঙ্কজের থেকে পাওয়া শিক্ষা। সুধু রূপে ভোলার লোক পঙ্কজ ছিলনা”।একটু থামলেন পূবা, তারপর আবার
…. ‘দিপু, .তখন আমি তোকে আনতে চাইলেও মা দিতেন না। পরে আনা উচিত ছিল, কিন্তু কোনো কিছুই আমার পক্ষে যুক্তি হতে পারেনা। আমাকে এই জন্য কোনদিন ক্ষমা করিসনা। আমি তোকে কোন দিন কিছু দিই নি, আজ দিচ্ছি , এই বলে উঠে তপু কে নিয়ে এলেন, “তপু তোর্, তুই ওর গার্জিয়ান , তুই যা বলবি আজ থেকে তপুর ব্যাপারে সেটাই শেষ কথা, ও খালি তোর্ বোন্, আর কিছু না, সেই পরিচয়ই প্রথম তারপর কার মেয়ে এইসব। তুই ওকে গ্রহণ কর ”
.
…সেটা তুমি না বললেও করতাম।তবে, তপু তোমাদের কাছেই থাকবে। আমার কাছে না। দিপুর এই কথায় , রাধা থাকতে না পেরে ‘” দিপু ,কি বলছিস””
…মাসি আমি সারা জীবন যা পাইনি, পিতা মাতার সান্নিধ্য ,ভালবাসা, স্নেহ , তার থেকে আমি ওকে বঞ্চিত করতে চাইনা। আমি কোনদিন সঞ্জীব বাবুকে ক্ষমা করতে পারবনা, কিন্তু সে তো তপুকে বাবার ভালবাসা, স্নেহ দিয়েছে। তপুর কাছে, তো স্নেহশীল বাবা বা তপুকে মায়ের স্নেহ থেকে কেন বঞ্চিত করব। মাসি তুমি বল? দিপু রাধাকে প্রশ্নটা করে স্থির দৃষ্টিতে পূবার দিকে চেয়ে
……..তোমার সাথে, প্রাণ চাইছে প্রানের সম্পর্ক হোক, কিন্তু বিবেক হতে দিচ্ছেনা, কিছু মনে করনা। জানি

“”দ্যুতপনে না হয় বিক্রয়, বাহুবলে নাহি হারে মাতার হৃদয় —সে যে বিধাতার দান
বিষন্ন কন্ঠে দিপু আস্তে করে আবৃতি করলো। স্নিগ্ধ নয়নে পূবা চেয়ে থেকে

“…….পুত্র মোর ওরে ,
বিধাতার অধিকার লয়ে এই ক্রোড়ে
এসেছিলি একদিন–সেই অধিকারে
আয় ফিরে আয় সগৌরবে,আয় নির্বিচারে —
সকল ভ্রাতার মাঝে মাতৃ-অঙ্কে মম
লহো আপনার স্হান।”

…… কি যন্ত্রণা নিয়ে যে তুই এই কবিতা পরেছিস, আমি অনুধাবন করতে পারি।.দিপু, পঙ্কজ আর আমি প্রায় সমযেই এই কর্ণ কুন্তি আবৃতি করতাম। আমার এখনো সম্পূর্ণ টাই মনে আছে, সত্যি কি মধুর সেই ভালবাসার দিন, ভালোলাগার দিন, স্নেহের দিন, মমতার দিন , আমি নিজের অহংকারে হারিয়েছি
……আপনি খুব ভালো আবৃতি করতে পারেন, এই টুকুই কি সুন্দর উচ্চারণে, আবেগ দিয়ে বললেন। আমার খুব ভালো লেগেছে এই প্রথম রাধা কিছু বলল।
…..পূবা দিদি , তুমি পরশ পাথর হারিয়েছে, কি পেয়েছ জানিনা। আমি প্রার্থনা করি আমার সন্তানেরা যেন দিপুর মত হয়। শোভা বলল।
…. পঙ্কজ শিখিয়েছিল কি ভাবে কোথায় আবেগ, কোথায় আস্তে করে বলতে হবে। আর সত্যি পরশ পাথর,সেই পরশ পাথরের ছোয়ায় আমি গত ২৪ঘন্টায় আমূল পাল্টে গেছি। এই শাড়িটা পঙ্কজ কিনে দিয়েছিল ১৯৭৬ সালে ১লা বৈশাখে। আজ নিয়ে দু দিন পরলাম। তপু আজ সকালে বলছে “মা, তোমাকে আজ goddess লাগছে ” না রে তপু,আমি মা হতে চাই, দেবী নয়। খুব নরম ভাবে পূবা বললেন
……….. শোভা দিদি, রাধাদি , আপনারা বুজবেন। আমিও অনেক কিছু পাইনি। মেয়ে মানুষ করা সহজ। কিন্তু ছেলে কঠিন,সেই কঠিন কাজ আমি করতে পারিনি।ছেলে স্কুলে খেলতে গিয়ে পা মচকে আসবে,মারামারি করে জামা ছিড়বে, আলুকাবলি, ফুচকা খেয়ে জামায় হাত মুছে বাড়ি আসবে, সব জিনিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখবে, অবাধ্যপনা করবে, কেননা এই সবেরই ভিতর মায়ের ভালবাসা ছিটিয়ে আছে। সে জানে বাড়িতে মা আছে , মা জানে ছেলে এইগুলো করবেই, আমি ওকে শাসন করব, কিন্তু ও আবারও করবে।চলতেই থাকবে, মা আর পুত্রের এই শাসন আর অবাধ্যপনা, আর গড়ে উঠবে এক স্বর্গীয় ভালবাসার সম্পর্ক। আমি এই শাসন করা, উত্কন্ঠায় থাকা যে আজ আবার কি করে আসবে, এর কিছুই পাইনি। মায়েরা যতই বলুক “” আমার ছেলে ভিশন দুষ্টু , কোনো কথা শোনে না “,অবচেতন মনে কিন্তু সব মা চান যে ছেলে দুষ্টুমি করুক, না হলে মা হয়ে ওঠা যে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
কথা বলার ভঙ্গিতে বুজতে পারা যায় যে পূবা, মন থেকেই কথা গুলো বলছে। একটু চুপ করে থাকলো, তারপর
……ব্যবসা চালাতে গিয়ে অনেক কিছু করতে হত, নাহলে ১৯৭৭এর মার্চ মাসে টার্নওভার যেখানে ৭৩ লক্ষ্য , সেটা এখন ১৫ কোটি ছাড়িয়ে গ্যাছে। এরজন্য অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। এক রকম প্রতিদিনই মৃত্যু হয়েছে, ওই যে শক্তি চাটার্জীর
‘হ্যান্ডস আপ ‘-হাত তুলে ধরো -যতক্ষণ পর্যন্ত না কেউ তোমাকে তুলে নিয়ে যায় কালো গাড়ির ভিতরে আবার কালো গাড়ি,তার ভিতরে
আবার কালো গাড়ি সারবন্দী জানলা,দরজা,গোরস্থান–ওলটপালট কঙ্কাল কঙ্কালের ভিতর সাদা ঘুন,ঘুনের ভিতরে জীবন ,
জীবনের ভিতরে মৃত্যু –সুতরাং মৃত্যুর ভিতরে মৃত্যু আর কিছু নয় !

…………আমি ঐরকম ভাবে বেচেছি, সেটা কি রকম বাঁচা , তা খুলে না বললেও সবাই বুজতে পারবে। প্রতিদিন মৃত্যু , প্রতিদিন বাঁচা,বাঁচার জন্যই যেন মৃত্যু। সঞ্জীবের দ্বারা বিসনেস চালানো কম্ম নয়। আমাকে তাই বিসনেস বাড়াবার জন্য, অনেক কিছুই করতে হয়েছে। প্রথমে ঘেন্না হত, পরে সেটাই, ব্যবসার অঙ্গ মনে করে চলতাম। এই সমাজে একটি সুন্দরী মহিলা একা বিসনেস চালানো ওই ৭০-৮০ দশকে কি কঠিন সেটা যারা করেছে, তারা জানে। দিপু আমি বিরাট কিছু আশা করি না, সুধু মাঝে মাঝে ফোন করব, আর বাইরে কোথাও হয়ত, ৯ মাসে ৬ মাসে একবার ৩জন একসাথে খাব, এইটুকুই।
…….তুমি যেকোনো প্রয়োজনে ডাকতে পারো , আমি যাব। হয়ত সময়ের সাথে সাথে সম্পর্ক কিছুটা ভালোহবে,তপুকে নিয়ে আমি যদি কলকাতায় যাই? দিপু আন্তরিক ভাবে প্রশ্ন করলো
……যাবি, তোর্ যেখানে খুশি যাবি ও এখন থেকে তোর্।শোভা দিদি ,রাধাদিদী , MP সাহেব, আমার একটা অনুরোধ রাখবেন ?, দয়া করে, দিপুর বিয়েতে আমাকে বলবেন।দীপুকে দিতে পারনি, দিপুর বৌকে অন্তত কিছু দেব।কাতর কন্ঠে পূবা অনুরোধ রাখল
……..কি বলছেন! দিপুর বৌকে আপনি বরণ করবেন, আমি আপনাকে কথা দিলাম।… দিপু অবাক হয়ে রাধার দিকে তাকিয়ে রইলো
…… একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে .” আর একটা অনুরোধ ,পুলিশে যদি না জানাস তাহলে যেন এই কজন বাদ দিয়ে আর কেউ না জানে ,সবাই জেনে গেলে আমি মুখ দেখাতে পারব না। আর আমি এখন যাই,দিপু, একটু কাছে আসবি, একবার, সুধু একবার তোকে জড়িয়ে ধরব” …রাধা দীপুকে ইঙ্গিত করলো যাবার জন্য , দিপু গিয়ে দাড়াতে, আবেগে, ভালবাসা জড়িয়ে দুই হাতে বুকে টেনে নিল। দীপুও একটু ঝুকে মাথাটা টেনে বুকের মাঝে নিল। খুব আস্তে , যাতে কেউ না শুনতে পায় এই ভাবে কানের কাছে মুখ নিয়ে “মা.” একবারই বলল।

……..হাঁ, আপনার তো বাড়িতে খুব একটা সুখকর পরিস্থিতি হবে না, বলে মনে হয়। কি করবেন, প্রাশচিত্ত্য করতেই হবে। বিরজু বলল ….

…….একটু বস , আমি একটু তপুর সাথে কথা বলব, এই বলে দিপু তপুকে নিয়ে ঘরের কোনার দিকে গেল।তপুর দুই কাঁধে দু হাত রেখে
……..এতক্ষণ তুই যা শুনলি, সেইটা নিয়ে বাড়ি গিয়ে ভাববি। একটা কথা মনে রাখবি, কিছু সম্পর্ক কোনদিন শেষ হয়না। ফিকে হতে পারে, সাময়িক ভাবে চিড় ধরতে পারে কিন্তু শেষ হয়না। তুই কি পড়িস , কোন ক্লাস তোর্ ?
…….দাদা আমি এইবার ১১ ক্লাসে উঠেছি। পিওর সাইন্স নিয়ে পড়ি ।
……বাহ, আমি তোকে অঙ্ক করাব। তুই অঙ্কে ফার্স্ট হবি দেখে নিবি। আর তুমি বলবিনা, তুই করে বলবি।কিন্তু তোকে একটা কাজ করতে হবে। এরপর , একটু গম্ভীর হয়ে ” “ তোর্ যতগুলো সুন্দরী বন্ধু আছে , তাদের সাথে আলাপ করিয়ে দিবি, ঠিক আছে ?”” মুখ টিপে হাসলো দিপু। তপু যেন অপেখ্যা করছিল, বাধ ভাঙ্গা হাসিতে ঘর ভাসিয়ে, দিপুর গলা দুই হাতে জড়িয়ে জোড়া পায়ে লাফাতে লাগলো,দীপুও যোগ দিল/. রাধা, অবাক হয়ে দীপুকে দেখছে , এ কোন দিপু , এত উচ্ছ্বল,এত প্রানবন্ত ,এরকম হাসতে রাধা দীপুকে কোনদিন দেখেনি ,মুখে স্মিত হাসির রেখা ফুটে উঠলো।
সবাই মিলে ৩ জনকে বিরজুর গাড়িতে তুলে দিয়ে এসে বসলো। দিপু রাধার দিকে তাকিয়ে
……..মাসি, পাশ করেছি কি?
……..একেবারে ফার্স্ট ডিভিসন, উঠে দাড়াও দিপু , রাধা না বিরজু , কাছে এসে দীপুকে টেনে জড়িয়ে ধরল।
……২২ বছর বয়েসে এইরকম যার ভাবনা সে অনেক দুর উঠবে। দিপু আমি আজ তোমায় এবং তোমার মাকে দেখে অভিভূত। এই বলে বসলো, ” দেখো , আমরা মানুষের সুধু ওপরটা দেখে ধারণা করি, কিন্তু ভিতরের মানুষটি সম্পূর্ণ অন্যরকম।পূবা, আমাকে অবাক করে দিয়েছে”
……দিপু সাবধান। MP সাহেব পুবার প্রেমে পরে গ্যাছে …মুখ টিপে হেসে শোভা টিপ্পনি কাটল।
……এই তোমাদের দোষ, সব মেয়েরা এক রকম। অন্য কোনো মেয়ের প্রসংসা শুনতে পারেনা। আমি আর কিছু বলব না
……আহারে, শোভা, একটু না হয় প্রেমেই পড়েছে, তাই বলে সন্তানের সামনে কেউ বলে,আলাদা করে বলতে পারতে ! এইবার রাধা যোগ দিল
……ব্যাস হয়ে গেল আড্ডা, আমি উঠি ..বলে বিরজু উঠতে যাচ্ছে …..দুই মহিলা টেনে বসিয়ে দিল।
……পালালে চলবে না,বসে থাকতে হবে। দুই মহিলা হাসিতে ফেটে পড়ল।
……সত্যি বলেছেন আপনি, আমিও অবাক হয়ে গেছি, যা ভেবেছিলাম তা না। আন্তরিক ভাবেই সম্পর্ক করতে চাইছেন , কিন্তু আমি কি করে ভুলব যে ওনার জন্য বাবা নেই!
……দিপু তুই ঠিক করেছিস। আসতে আসতে সম্পর্ক হবে, তাড়াহুড়ো করে হবে না। তবে উনি তোকে ভোলেননি, ভিতরের মানুষটা খারাপনা, কি শোভা ? রাধা বলল।
……না, আমার পূবাকে খারাপ লাগেনি। ভিতরে ভিতরে জ্বলেপুরে যাচ্ছেন। তবে রূপ আছে, দিপু তোর্ রূপ কিন্তু ওনার থেকে অনেকটাই পাওয়া ….এইবার শোভা বলল।
……আরে আমিও তো এইটাই বলছিলাম, আর তোমরা দুই সখী আমার পিছনে লেগে পড়লে।
……সার, সম্পর্ক টাতো পিছনেই লাগার …এইবার দিপু
……আমি হাত তুলে সারেন্ডার করলাম ..বিরজুর কথা বলার ভঙ্গিতে সবাই হেসে উঠলো।

চলবে —————————



from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/QDVR6kw
via BanglaChoti

Comments