কাজলদিঘী
BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়
তৃতীয় কিস্তি
—————————
মিত্রা আমার কাঁধে মাথা রেখে শরীরে ঢলে পড়লো।
দু-জনেই চুপচাপ। কোনও কথা বলছি না। আমার অজান্তেই আমার ডান হাতটা ওর মাথায় চলে গেল। কপালের এলো চুল সরিয়ে দিলাম। এসি চলছে তবু মিত্রার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
কলেজ লাইফের কত কথা হুড়মুড় করে চোখের সামনে ভেসে উঠছে।
আমি ওর মাথায় আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম। হাল্কা করে সোফায় শরীরটা ছেড়ে দিলাম। মিত্রার মাথাটা আমার বুকে এসে পড়লো। একটা হাতে আমাকে লতা পাতার মতো জরিয়ে ধরেছে। কলেজ লাইফে কতদিন ফাঁকা ঘরে ও আমার কোলে মাথা দিয়ে শুয়েছে। আমিও ওর কোলে মাথা দিয়ে শুয়েছি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা, তার কোনও ইয়ত্তা নেই।
প্রথম ওর শরীরে হাত দিই বীনা সিনেমায়। সেদিন কলেজ কাট মেরে দু-জনে সিনেমা দেখতে গেছিলাম। একবারে পেছনের সিটে দেয়ালের ধারে বসেছিলাম। ও আমার বাঁ দিকে বসেছিল। সিনেমা শুরু হতে আমি বাম হাতটা সিটের ওপর রেখেছিলাম। ও একটু আমার দিকে হেলে বসেছিল। আমাকে ছুঁয়ে। কখন যে আমার বামহাতটা ও টেনে নিয়ে বুকের ওপর রেখেছিল জানি না। আমি তখন গোবিন্দ নিহালিনির আক্রোশ-এর মধ্যে ডুবে গেছি। নাসিরুদ্দিন, স্মিতা পাতিলের ডুয়েট চলছে। একটু নরম নরম স্পর্শের অনুভূতি পেয়ে নড়ে চড়ে বসলাম। পাশাপাশি তাকালাম, কেউ আমাদের দেখছে কিনা। এক অনির্বচনীয় স্পর্শানুভূতি। সামান্য ভয়ভয় মনের মধ্যে কাজ করছে। হঠাৎ কানে দাঁতের স্পর্শ। খিল খিল হাসি। ভীতুরাম। ব্যাশ এই টুকু।
বুকটা ভিঁজে ভিঁজে লাগল। দুহাতে মিত্রার মুখটা তুলে ধরলাম। চোখের পাতা ভিঁজে গেছে। মিত্রা কাঁদছে। ওকে আরও কাছে টেনে এনে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। ওর তুলতুলে নরম শরীরে সেই আগের মতো স্পর্শানুভূতি পেলাম। বুড়ো আঙুল দিয়ে চোখের কোল দুটো মুছিয়ে দিলাম।
এটা কি করছিস!
আমি আর পারছি না বুবুন।
কেন বলবি তো?
আমার সব আছে। কিছুই নেই।
কি পাগলের মতো বকছিস!
তুই বিশ্বাস কর।
মিত্রা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমি ওর মাথাটা আমার বুকের সঙ্গে চেপে ধরে আছি।
মিত্রার চোখের জলে আমার বুক ভেসে যাচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর মুখটা তুলে আমার গালে হাত দিয়ে বললো, তুই তো আমার কাছে কিছু চাইলি না।
আমি ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম। মনে মনে বললাম, না চাইতেই তোর কাছে অনেক পেয়েছি। আর কি দরকার আমার।
মিত্রা আমার দিকে অপলক নয়নে তাকিয়ে আছে। দু-জনেরি চোখের পলক পড়ছে না। আমাকে ও দুহাতের বেষ্টনীতে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। আমার মাথাটা ধীরে ধীরে ওর ঠোঁটের কাছে নিয়ে এসে ঠোঁট রাখল।
আমি কোনও বাধা দিলাম না। প্রথমে খুব ধীরে তারপর আস্তে আস্তে ওর মধ্যে একটা পশু জেগে উঠল। আমি স্থবিরের মতো কিছুক্ষণ ওর হাতের খেলার পুতুল হয়ে রইলাম। ও আমাকে আঁচড়ে কামড়ে একাকার করে দিল।
কিছুক্ষণ পর ও আমার ঠোঁট থেকে ঠোঁট নামাল, ওর ঠোঁট দুটো ভিজে কাদা হয়ে গেছে। আমি ওর কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালাম। ও চোখ বন্ধ করলো। আমি ওর চোখে ঠোঁট ছোঁয়ালাম নোনতা নোনতা স্বাদ, এরপর দুই গালে, তারপর আবার ওর ঠোঁটে ঠোঁট রাখলাম। ও আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো, আমার শরীরের সঙ্গে যেন মিত্রা মিশে যেতে চাইল, আমি ওর ঠোঁট থেকে ঠোঁট তুললাম, চোখে চোখ রেখে বললাম।
মিত্রা আমি রক্তে মাংসের একটা মানুষ। এ তুই কি করছিস!
মিত্রা আমার শরীর থেকে নিজেকে কিছুটা আল্গা করে ঝাঁঝিয়ে উঠলো।
আমিও একটা মানুষ। আমারও শরীর বলে একটা বস্তু আছে।
মিত্রার গলাটা কেমন বুঁজে এলো। ডুকরে কেঁদে উঠলো।
না পাওয়ার বেদনা আমাকে পাগল করে দিয়েছে বুবুন।
কি বলছিস তুই!
ঠিক বলছি।
টেবিলের ওপর রাখা পূর্ণ গ্লাসটা হাতে নিয়ে চুমুক দিল। কিছুটা খেয়ে আবার গ্লাসটা টেবিলে রাখলো। স্বগতোক্তির সুরে বলে উঠলো।
বিয়ের পর থেকে ক-দিন এক বিছানায় শুয়েছি মনে করতে পারি না।
আমি ওর দিকে তাকালাম। ওর চোখ দুটো আবার ছল ছল করে উঠল।
আমার হাতদুটো প্রচণ্ড জোড়ে চেপে ধরলো।
তুই আমাকে ফিরিয়ে দিস না বুবুন। মিত্রার চোখে মুখে ফুট উঠলো করুণ আর্তি।
আমি ওর মুখের দিকে স্থানুর মতো তাকিয়ে আছি।
ও আমার ঠোঁটে আঙুল রাখল। চোখের মনি দুটো আনমনা, কি যেন খুঁজছে।
আমি আজ তোকে আমার মতো করে পেতে চাই।
আমি ওর দিকে তাকিয়ে আছি। কোনও কথা বলার অবস্থায় আমি নেই।
প্লীজ তুই আজ বাধা দিস না।
কেন পাগলামো করছিস!
একবারে বাধা দিবি না। মিত্রা আবার ঝাঁঝিয়ে উঠলো।
আমার বুক থেকে উঠে বসলো, আমাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল ওর সফেদ স্বপ্নিল বিছানায়, আমাকে বিছানার ওপর বসিয়ে, আমার পাঞ্জাবীর একটা একটা বোতাম খুলে দিয়ে পাঞ্জাবীটা খুললো।
মিত্রা যেন পুতুল খেলা করছে।
আমি ওর দিকে তাকিয়ে আছি। ও হাসছে, এ হাসি পরিতৃপ্তির হাসি।
আমাকে ছেড়ে দিয়ে ও ঘরের মাঝখানে দাঁড়াল। কি অনুভব করলো বুঝলাম না। ঘরের কর্নারে গিয়ে, এসিটা একটু কমিয়ে দিয়ে আবার আমার কাছে ফিরে এলো। আমাকে হাত ধরে বিছানা থেকে তুলে নিয়ে এসে, ঘরের মাঝখানে দাঁড়াল, ওর ঘরের মিহি ছোটো আলোটা চাঁদনী রাতের মতো লাগছে।
আমরা দুজন মানব-মানবী।
মিত্রা নাইট গাউনটা শরীর থেকে খসিয়ে মাটিতে ছুঁড়ে দিল। আমি পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছি। এই প্রথম ওর নিরাভরণ শরীরের সুধা পান করছি। ভরাট বুকে সাদা অন্তর্বাস। বেতের মতো নির্মেদ শরীর, কোথাও এতটুকু ভাঁজ পরেনি। একটু চাপা গায়ের রং, শ্যামলা বলা চলে না। সরু কোমরের নীচে দীর্ঘ অববাহিকা। শুধু মাত্র একটা সরু সিফনে জড়ান। আমি ওর দিকে অবাক দৃষ্টে তাকিয়ে আছি।
মিত্রার শরীরটা আমার হাতের নাগালে।
সম্মোহনের মতো পায়ে পায়ে ওর দিকে এগিয়ে গেলাম, সরু কোমরটা জড়িয়ে কাছে টেনে নিলাম, মিত্রার চোখে খুশির ঝিলিক, আমি ওর ডাকে সারা দিয়েছি। পরিচিত মানুষের স্পর্শ সুখ আর অপরিচিত মানুষের স্পর্শ সুখের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য, এটা অনুভব করলাম।
আমি ওর কাঁধ থেক এলো চুলের লম্বা গোছা সরিয়ে দিয়ে আমার উষ্ণ ঠোঁট ছোঁয়ালাম, ও কেঁপে উঠলো।
মিত্রা আমার বাঁদিকের বুকে দাঁত ছোঁয়াল, আমি উঃ করে উঠলাম। ও খিল খিল করে হেসে উঠলো। দু-হাতে ওকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে পেছন থেকে ওর অন্তর্বাসের ফিতেটা খুলে দিলাম, ওর বুক থেকে পাতলা কাপরটা খসে পরলো। আমি ওর বুকের দিকে তাকালাম। অবনত মস্তকে রাঙা হয়ে উঠেছে মুখখানা। আমি স্পর্শ করলাম।
মিত্রা আমার মিত্রা। যাকে নিয়ে একদিন আমি ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছিলাম। হয়তো মিত্রাও দেখেছিল। সে স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেছে পরিপূর্ণতা পায়নি। একদিন হঠাৎই জানতে পেরেছিলাম সে স্বপ্ন আমার কাঁচের স্বর্গের মতো খান খান হয়ে ভেঙে গেছে।
মিত্রা আমার মুখের দিকে তাকাল।
আমি ওর ঠোঁটে ঠোঁট রাখলাম। মিত্রার আয়তো চোখ দুটো বুঁজে এলো। আমি ঠোঁট সরিয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি।
মিত্রা চোখ খুললো। একফালি চাঁদপানা হাসি ওর ঠোঁটে খেলা করছে।
ওর চোখ মুখ বলছে ও জিতে গেছে।
একদিন এই মিত্রা আমার হাতটা ধরে ওর নরম বুকে রাখতে চেয়েছিল আমি হাত সরিয়ে নিয়েছিলাম। তখন আমি ওকে ভালোবাসতাম, নিঃশর্ত সেই ভালোবাসা ছিল পবিত্র, সেখানে কোনও নোংরামি ছিল না। আজ মিত্রা অন্য কারুর স্ত্রী, কিন্তু আমার শরীরে শরীর মিশিয়েছে। তবু এর মধ্যে আমি কোনও নোংরামি দেখতে পাচ্ছি না। এ যেন প্রকৃতি আর পুরুষের মিলন, যুগ যুগ ধরে যা চলে আসছে।
বুবুন।
উঁ।
মিত্রার ভাষা ভাষা চোখে না বলা অনেক কথা। চোখের পাতা থিরি থিরি কাঁপছে।
আমি ওর দুকাঁধে হাত রাখলাম।
ও আমার সামনে নগ্ন অবস্থায়, একটুও সংকোচ নেই। আমি ওর দু-হাত ধরে বিছানায় নিয়ে এলাম।
সত্যি সত্যি আজ ওকে বাধা দিলাম না। মিত্রার হাতের খেলার পুতুল হয়ে গেলাম কয়েক ঘণ্টার জন্য।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হলো।
চোখ মেলে তাকিয়ে প্রথমে ঠাহর করতে পারিনি আমি কোথায় আছি। তারপর বুঝলাম আমি মিত্রার বাড়িতে আছি। শুয়ে শুয়ে বিছানার মধ্যেই আড়মোড়া ভাঙছিলাম।
মিত্রার গলার আওয়াজে তড়াক করে উঠে বসলাম।
বাবাঃ ঘুমতেও পারিস কিছু।
মিত্রার কথায় লজ্জা পেলাম। নিজের জামা কাপড় ঠিক আছে কিনা আগে দেখে নিলাম।
না সব ঠিক আছে।
মিত্রার দিকে তাকালাম। অবাক হলাম। লালপেরে মটকার শাড়ি পরেছে। মাথায় লম্বা করে সিঁদুর দিয়েছে। হাতে ফুলের সাজি। কি অপূর্ব লাগছে ওকে।
আমার মুখ থেকে কোনও কথা সড়ছে না। কালকের মায়াবিনী মিত্রার সঙ্গে এই মিত্রাকে মেলাতে পারছি না। আমি কি ভুল দেখছি! না। মিত্রাই তো! মাঝে মাঝে একা থাকলেই আমি ভাবি, এক নারীর মধ্যে কতো রূপ। কখনও সে কামিনী, কখনও সে যোগিনী। কখনও সন্তানের স্তনদায়িনী মা।
মুখ হাত ধুয়ে নে। ব্রেক ফাস্ট রেডি। মিত্রা ঘর থেকে চলে গেল।
আমি বাথরুমে গিয়ে ফ্রেস হলাম। একটু সময় লাগল। বেরিয়ে এসে দেখলাম মিত্রা সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে।
বাবাঃ তুই তো মেয়েছেলের বেহদ্দ।
মেয়ে আবার ছেলে হলো কবে থেকে?
ওই হলো।
কি হলো! পোষাক বদল?
ওটা ঠাকুর ঘরের জন্য।
দারুন লাগছিল তোকে।
নেকু, আগে যেন দেখেনি।
হাসলাম।
খাবারটা এখানে নিয়ে আসব, না টেবিলে যাবি।
এখানে নিয়ে আয়।
মিত্রা সোফা থেকে উঠে চলে গেল। একটা ঝুম ঝুম আওয়াজ কানে এলো, কেউ যেন মল পরে হাঁটছে। এই মলের আওয়াজটা আমার ভীষণ ভালো লাগে। ফাঁকা ঘরে কিংবা বাড়িতে এই ধরনের আওয়াজ একটা স্বপ্নের পরিবেশ রচনা করে।
মিত্রা ফিরে এল, পেছনে দু-জন আয়া। এ বাড়িতে ঠাকুর চাকরের মনে হয় অভাব নেই।
সেন্টার টেবিলে সমস্ত কিছু নামিয়ে রেখে তারা বিদায় নিল। মিত্রা আমার পাশে এসে বসলো। পরনে একটা কালো রংয়ের ঘাঘরা, আর হলুদ টপ। ওকে অনেকটা কাশ্মীরি মেয়েদের মতো লাগছে। জুইঁ ফুলের গন্ধ চারিদিকে ম ম করছে। আমি মিত্রার দিকে একটু হেলে ওর কাঁধের কাছে মুখ নামিয়ে ঘ্রান নিলাম। মিত্রা ভ্রু কুঁচকে বললো—
কি শুঁকছিস?
তোর গায়ের গন্ধটা। দারুন মিষ্টি।
যাঃ।
একটা কথা বলবো?
বিনয়ের অবতার।
তোর ঘাঘরাটা একটু তুলবি?
যাঃ, কেউ এসে পরলে।
তোকে কি পুরো তুলতে বলেছি?
তাহলে!
হাঁটুর কাছ পর্যন্ত। তোলনা—।
মিত্রা তুললো, আমি ওর পায়ের কাছে বসে মলগুলো দেখলাম। এক একটা ভরি তিনেক হবে।
কি দেখছিস?
তোর মলগুলো। দারুন মিষ্টি আওয়াজ।
তুই একটা পাগল।
ঠিক বলেছিস। আর এই পাগলকে একমাত্র তুইই চিনেছিলি।
এক থাপ্পর।
একটু হাঁট না।
কেন!
তোর মলের আওয়াজটা চোখবন্ধ করে আর একবার শুনবো।
মিত্রা শরীরে হিল্লোল তুলে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতেই শরীরটাকে ভাঁজ করে উঠে দাঁড়াল। আমার অনুরোধ রাখলো।
কাল রাতে তোর পায়ে মল ছিল না?
সকালটা পরি, তারপর খুলে রাখি।
ও।
মিত্রা গরম গরম লুচি আর বাটিচচ্চড়ি করেছে। ওঃ ঘ্রানেন অর্ধভোজনায়।
তুই এসব কি করেছিস!
কেন! তুই খাবি না?
ওর দিকে তাকালাম। মুখটা কেমন যেন হয়ে গেছে। বললাম, তুই জানলি কি করে আমি এই খাবার খেতে ভালোবাসি।
ওর মুখের রং বদলে গেল।
তুই যখন আমাদের বাড়িতে যেতিস, জ্যেঠিমনি তোকে এই খাবার করে প্রায়ই খাওয়াত, আমি জানি।
সে তো কলেজ লাইফের কথা।
কলেজ লাইফের কথা আমারও কিছু কিছু মনে আছে।
হাসলাম। তোকে একটা কথা বলবো।
বল।
মনে কিছু করবি না।
মিত্রা বিস্ময় ভরা চোখে আমার দিকে তাকাল।
কালকের ব্যাপারটার জন্য তোর কাছে ক্ষমা চাইছি।
ও আমার দিকে তাকাল। চোখের মনিদুটো স্থির। আমার চোখে চোখ রাখল।
আমরা কোনও অন্যায় কাজ করিনি। এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
আমি মাথা নিচু করলাম।
যদি আবার কখনও ইচ্ছে হয় আমি করবো, তুই যদি বাধা দিস আলাদা কথা। মানুষের পেট যেমন আছে, শরীরও তেমন আছে। অস্বীকার করতে পারবি। আমার বড়টা ধোয়া তুলসী পাতা নয়। সেখানে আমি আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসার সঙ্গে শরীরে শরীর মিশিয়েছি। কোনও অন্যায় কাজ করিনি।
ওর চোখে মুখে লেলিহান আগুনের ঝলক। কিছুক্ষণ দুজনে নিস্তব্ধে খেয়ে গেলাম। কথা ঘুরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম।
তোর দেবাকে মনে আছে।
কোন দেবা!
পলসাইনসের সেই ফর্সা মতো ছেলেটা। তোর পেছনে প্রথমে ঘুর ঘুর করতো। তুই বলতিস বাবার বখাটে ছেলে।
মিত্রা হো হো করে হেসে উঠলো, হ্যাঁ হ্যাঁ এইবার মনে পড়েছে।
একটু ভেবে নিয়ে।
মুখটা ফেড হয়ে গেছে। কেন বলতো?
ও এখন রিলায়েন্সের ইস্টার্ন জোনের চিফ একজিকিউটিভ।
বাবাঃ আমাদের ব্যাচটা তাহলে দারুন বল।
সত্যি তাই।
কালকে তুই মৈনাকের কথা বললি। আমি জানতামই না ও টাইমস অফ ইন্ডিয়ার ওই রকম একটা পোস্ট হোল্ড করে আছে। জানবই বা কি করে, আমি তো মেয়ে, তোর মতো একটা পুরুষের সান্নিধ্য পাব ভেবেছিলাম, কপাল খারাপ।
আবার কথা ঘোরালাম, খেতে খেতেই ওর সঙ্গে টুকরো টুকরো কিছু কথা হলো সব কলেজ লাইফের।
খাওয়া শেষ করে আমি উঠলাম । মিত্রাকে বললাম, আমি অফিসে যাচ্ছি। তুই ফোন করিস।
ফোন নম্বরটা দে।
ওকে নম্বরটা দিলাম।
শোন।
বল।
ঘরুইবাবুকে একটা ইন্টিমেশন দিয়ে রাখ।
ওই কাজটা তুই কর।
না আমি এখন এসব নিয়ে মাথা ঘামাব না। তাতে ব্যাপারটা খারাপ দেখাবে।
ঠিক আছে তুই যা বলবি। তাহলে আমি এখন অফিসে যাচ্ছি না।
না।
ও আমাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিল। গাড়ির কথা বললো। আমি বললাম না। আমি বাসে চলে যাব।
ভেবেছিলাম অফিসে যাব, গেলাম না। কালকে অনেক রাত পর্যন্ত জেগেছি। অফিসে যেতে ভালো লাগছে না। সোজা ফ্ল্যাটে চলে এলাম। বড়োমাকে একবার ফোন করে বললাম, আমি ফ্ল্যাটে যাচ্ছি। বিকেলে তোমার ওখানে যাব।
অফিসে যাবি না?
না। মোবাইল বন্ধ থাকবে। অতএব ফোন করে লাভ নেই।
দরকার পরলে?
দরকার পরবে না।
ফ্ল্যাটে ঢুকেই ফ্যানটা জোড়ে ছেড়ে দিয়ে বাথরুমে গেলাম।
এসে জামা কাপড় খুলে পুরো উদম অবস্থায় বিছানা নিলাম। প্রায়ই আমি এই অবস্থায় আমার ফ্ল্যাটে থাকি। ব্যাচেলার থাকার অনেক মজা।
কখন ঘুমিয়ে পরেছি জানি না। কড়া নাড়ার খটা খট আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। ঘড়ির দিকে তাকালাম। পাঁচটা বাজে। মানে আমি প্রায় ছয় ঘণ্টা ঘুমিয়েছি। বিছানা থেকে ধরফর করে উঠে পরলাম। কোনও প্রকারে টাওয়েলটা কোমরে জড়িয়ে দরজা খুললাম। একটা দমকা হাওয়া আমার চোখে মুখে এসে লাগল। বাইরে অঝোড়ে বৃষ্টি পড়ছে। তনু ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে। ওর পেছনে আমাদের এই হাউসিংয়ের কেয়ারটেকার।
আরে বাবু বহুত খুন হো গায়া ম্যাডাম….।
তনু কট কট করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ভিজে চান।
এসো এসো।
কেয়ারটেকারের দিকে তাকালাম। বললাম—
ঠিক আছে। তুমি যাও।
তনু ভেতরে এলো।
আমি দরজা বন্ধ করলাম।
তনুর পরনে একটা টাইট জিনস আর গেঞ্জি। সেটাও ভিজে নেতা হয়ে গেছে।
আমার এক কামড়ার ছোট্ট ফ্ল্যাট। একটা ড্রইং কাম ডাইনিং রুম। একটা বেডরুম, কিচেন, বাথ। সামনের ছোট্ট ঘরটায় একটা বেতের সোফা রয়েছে। আর একটা টেবিল।
তনু হাতের ব্যাগটা টেবিলটার ওপর রেখে বলে উঠলো।
সত্যি এইরকম নির্ভেজাল মানুষ আমি চোখে দেখিনি।
আমি মাথা নিচু করে বললাম, জামা প্যান্টটা খুলে নাও। গায়ে জল বসবে।
আমি কি উলঙ্গ হয়ে থাকবো—দরদি।
হেসে ফেললাম।
তা কেন। পাজামা পাঞ্জাবী দিচ্ছি।
আর ঢঙ করতে হবে না। অনেক হয়েছে। আধঘণ্টা বাইরে দাঁড়িয়ে ভিঁজছি। শেষে ভয় পেয়ে কেয়ারটেকারকে ডাকলাম।
সরি।
সরি বললে, সাতখুন মাপ।
তা না।
একটা টাওয়েল ওকে দিয়ে বললাম, চুলটা মুছে নাও। মাথায় জল বসলে সর্দি লাগবে।
আহা, কে আমার প্রাণের ঠাকুর রে।
হাসলাম। আজ তোমায় চা করে খাওয়াচ্ছি।
সূজ্জিমামা কোন দিকে উঠেছে?
পূব দিকে।
হুঁ।
আমি রান্না ঘরে চলে গেলাম।
জল বসালাম। তনুকে ওখান থেকেই বললাম, চা না কফি।
ও বললো, কফি হলে ভালো হয়।
দুধ নেই।
ঠিক আছে, ব্ল্যাক কফি হলেই চলবে।
পাজামা-পাঞ্জাবী কোথায়?
সরি, বার করে দিচ্ছি।
আলমাড়ি থেকে একটা পাজামা-পাঞ্জাবী বার করে ওকে দিলাম। ও বাথরুমে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এলো। আমি পাখাটা পাঁচে করে দিলাম। ও ওর অর্ন্তবাস, গেঞ্জি, প্যান্ট চেয়ারের কোন, আলমাড়ির হাতল, টেবিলের ওপর পেপারওয়েট দিয়ে শুকতে দিল।
আমি রান্নাঘরে গেলাম। গুছিয়ে সব কিছু নিয়ে এলাম।
খাটের ওপর ট্রে নামিয়ে রেখে ওর দিকে তাকালাম। দু-হাত ওপরে তুলে শরীরটাকে বেঁকিয়ে বুঁকিয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে। ভেতরে কিছু পরেনি। আমি একবার তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেললাম।
দাঁড়াও দেখাচ্ছি।
তনু তেরে এলো, আমি একটু পেছনে সরে দাঁড়ালাম।
হাসলাম।
আমার ব্যাগটা একটু নিয়ে এসো।
কোথায়?
ওই ঘরের টেবিলে আছে।
আমি পাশের ঘর থেকে ওর ব্যাগটা নিয়ে এলাম।
ও ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বার করলো।
ঠাণ্ডা মেরে নেতা হয়ে গেছে।
কি।
মটন কাটলেট।
ওঃ এই বর্ষায়….তবে তোমার কাটলেটটা গরম আছে। আগে ঠাণ্ডা খাই তারপর না হয় গরম খাওয়া যাবে।
তনু কটমট করে আমার দিকে তাকাল।
আমি হাসলাম। দাঁড়াও প্লেট নিয়ে আসি।
আবার রান্না ঘর থকে দুটো প্লেট নিয়ে এলাম।
তনু কাটলেট, শস, পেঁয়াজের কুচি পাশে রাখল।
দুজনে কফি আর কাটলেট খেতে আরম্ভ করলাম।
অনি।
উঁ।
আমি কলকাতা ছেড়ে চলে যাচ্ছি।
কোথায়?
লণ্ডন।
ওর দিকে ঘুরে তাকালাম, তনুর চোখে চোখ রাখলাম।
লণ্ডন! কেন?
বিবিসিতে চান্স পেয়েছি।
ওর মুখের দিকে তাকালাম। আমার মুখটা গম্ভীর। আমি মাথা নিচু করলাম। তার মানে তনুর সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না। মনটা খারাপ হয়ে গেল।
কি হলো? গম্ভীর হয়ে গেলে। তুমি চাও না আমি যাই।
ভেতর থেকে না বলছি। কিন্তু মুখে বললাম, কনগ্রাটস।
ও আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকাল।
তোমার সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না।
কবে যাচ্ছ?
কাল সকালে দিল্লী যাব। বাড়িতে কয়েকঘণ্টা কাটিয়ে দুপুরের ফ্লাইট।
অফিসে জানে?
না। তুমি কিছু জান না?
কোন ব্যাপারে?
অফিসের ব্যাপারে।
না।
কালকে অফিসে যা করে এসেছো।
আমি আবার কি করলাম!
তুমি তোমার কাজের কোনও খোঁজ খবর রাখো না?
প্রয়োজন বোধ করি না।
তুমি কাল ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে যা করে এসেছো সেই নিয়ে অফিসে সারা দিন তোলপাড় হয়েছে। সবার মুখে একটা নাম অনি।
সব ভুলভাল।
আজ তো অফিসে যাও নি?
না।
গেলে জানতে পারতে।
যা হবার তা হবে।
দাদার সঙ্গে কথা হয়েছে?
ফিরে এসে সব শুনেছি।
তুমি যেদিন ভাইজ্যাক গেলে তার পরদিন সুনিতদা মাস্টার স্ট্রোকটা দেয়।
অল আর ভোগাস।
আমাকে মুম্বাই ট্রান্সফার করেছিল।
কে?
কে আবার ওই শালা সুনিত।
তনুর মুখের দিকে তাকালাম।
ফিক করে হেসে ফেললাম। তনু এই প্রথম আমার সামনে শালা বললো।
রিজাইন দিলাম। তারপর এই চান্সটা পেয়ে গেলাম।
তারমান অনেকদিন থেকে তুমি চেষ্টা চরিত্র করছিলে।
তনু মাথা দোলাল। হ্যাঁ।
কার থ্রু দিয়ে।
দিল্লীতে আমার এক বন্ধু আছে। ওর থ্রু দিয়ে।
ও।
কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম।
মনে মনে বললাম, আমি যেখানে থাকার সেখানেই পড়ে আছি। সত্যি আমার দ্বারা কিছু হবে না। কত স্বপ্ন দেখেছিলাম নিজেকে নিয়ে। ধুস।
কি চিনতা করছো?
কিছু না। ওর দিকে তাকালাম।
হাঁ করো।
ও নিজের কাটলেটে একটা কামর বসিয়ে আমার মুখের সামনে তুলে ধরলো। আজ তনুকে কোনও বাধা দিলাম না। আমি ওর কাটলেটে একটা কামর দিলাম। ও আবার নিজেরটায় আর একটা কামর দিল।
খাওয়া শেষ হয়ে গেছে। আমি ট্রে-টা বিছানার ওপর থেকে তুলে নিয়ে কিচেনে রেখে এলাম। তনু হেলান দিয়ে খাটের একটা সাইডে পা ছড়িয়ে আধশোয়া অবস্থায়। পাঞ্জাবীর বোতামগুলো আটকায়নি। সেই ফাঁকে আমার চোখ চলে গেল। তনু বুঝতে পারল।
সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো।
উঃ একটু ফ্রি হয়ে বসার জো নেই। যেন চোখ দিয়ে ধর্ষণ করছে।
চোখের আর দোষ কি। সে তো সব সময় সুন্দরের পূজারী।
রাখো তোমার কাব্যি….।
আমি হাসছি।
কি পাগলের মতো হাসছো!
কই হাসলাম।
দেখলাম।
ওর দিকে তাকালাম।
খাটে উঠে ওর ডান দিকে একটা বালিস টেনে নিয়ে শুলাম। মাথার ওপর পাখাটা বন বন করে ঘুরছে। বাইরে এখনও অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে।
অনি।
তনুর মুখের দিকে তাকালাম।
কই তুমি কিছু বললে না?
কি!
আমি বাইরে চলে যাচ্ছি।
বুঝলাম তনু ঘুরে ফিরে সেই একজায়গায় কড়া নেরে চলেছে।
দোষটা আমার, তনুর নয়। ভুল আমি করেছি, প্রায়শ্চিত্ত আমাকে করতে হবে। তনু চেয়েছে, আমি গা ভাসিয়েছিলাম। নিজের মুহূর্তের ভুলের খেসারত আমাকেই দিতে হবে। ওকে মিত্রার কথা বলতে পারি না। ওকে….।
কি হলো চুপ করে রইলে।
তোমাকে ধরে রাখার ক্ষমতা আমার নেই।
কেন?
সে অনেক কথা।
তনু এগিয়ে এসে বুকে মাথা রাখলো। দুজনে চুপচাপ শুয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। কেউ কোনও কথা বললাম না। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলাম তনু কাঁদছে। ওকে বোঝাবার ক্ষমতা আমার নেই। সান্ত্বনা দিয়েই বা কি করবো।
তনু এরপর একতরফা আমাকে অনেক কথা শোনাল। আমি বোবার মতো ওর কথা শুনেছি। একটা কথারও উত্তর দিইনি। একসময় উঠে পড়ে নিজের পোষাক পরেছে। আমাকে জড়িয়ে ধরে কিছুটা কেঁদেছে। তারপর নিজেই চলে গেছে।
শূন্য ঘরে আমি একা। মাথার ওপর বন বন করে পাখাটা ঘুরছে।
ঘরের লাগোয়া ছোট্ট বারান্দায় বেরিয়ে দেখলাম বৃষ্টি থেমে গেছে। আকাশের মুখ ভার।
ঘরে এলাম। তনুর পরণের পাঞ্জাবীটা খাট থেকে তুলে নিলাম।
নাকের কাছে নিয়ে এসে শুঁকলাম। তনুর শরীরের গন্ধ ম ম করছে।
ভাঁজ করে আলমাড়িতে গুছিয়ে রাখলাম।
সকাল বেলা বড়োমার ডাকে ঘুম ভাঙলো। প্রথমে একটু অবাক হয়েছিলাম। তারপর সম্বিত ফিরে পেলাম। কাল অনেক রাতে বড়োমার কাছে এসেছি। কলকাতার রাস্তা কালও ভেসেছে। রাতে কারুর সঙ্গেই বিশেষ কথা হয়নি। খেয়েছি আর নিজের ঘরে চলে এসেছি।
দিন চারেক হয়ে গেল, এই কটাদিন মিত্রার সঙ্গে রেগুলার ফোনে যোগাযোগ রেখেছি।
ওই-ই আমাকে বেশির ভাগ সময় ফোন করেছে। আমার সোর্সগুলোকে কাজে লাগিয়ে অনেক সংবাদ সংগ্রহ করেছি, সব শুনে আমারই মাথা খারাপ।
কাল রাতে আমি আসার আগেই ছোটোমা, মল্লিকদা চলে গেছে। বড়োমা বললো, ওরা কাল সকালে চলে আসবে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম বড়োমা আমার ঘর গোছাচ্ছে। কটা বাজে বড়োমা?
ন-টা বেজেগেছে। সকাল থেকে তোর ফোন শুধু বেজেই যাচ্ছে। কয়েকটা তোর দাদা ধরেছিল। বাকি আর ধরেনি। বিরক্ত হয়ে রেখে দিয়েছে।
ও।
ছোটোমা এসেছে?
হ্যাঁ, তোমার খেঁটনের জোগাড় করছেন।
তুমি কি এবার ঠাকুর নিয়ে ব্যস্ত হবে?
হ্যাঁ। অফিস যাবি না?
না।
কাল তোর একটা চিঠি এসছে।
কোথা থেকে?
তোর বাড়ি থেকে।
আমার বাড়ি!
মনামাস্টার পাঠিয়েছে।
ও। কি লিখেছে?
জানিনা। তোর দাদা খুলে পড়েছে। তোর দাদাকেও একটা দিয়েছে।
কাম সারসে।
হ্যাঁরে, মিত্রার সঙ্গে কি হলো বললি না।
কেন! সব তো বললাম।
তুই কিছু গোপন করেছিস।
এ কথাটা আবার কে বললো?
তোকে বলবো কেন।
ছোটো বলেছে।
না।
সে ছাড়া তোমায় লাগান-ভাগান করার লোক এ ভূ-ভারতে কে আছে বলো।
মিত্রা তোর জন্য একটা বড় বাক্স পাঠিয়েছে।
আমার জন্য!
হ্যাঁ।
বড়সাহেব জানে?
ও নিজে রিসিভ করলো।
বাবাঃ কয়েক দিনেই এতো সব। তার মানে ব্যাপারটা বেশ জটিল কি বলো বড়োমা?
তুই আর ফাজলাম করিস না।
দিদি।
ওই ছোটোম্যাডাম এলেন। একজনে হচ্ছিল এতক্ষণ। এবার দোসর এসে হাজির।
কি বলছে-গো আমর নামে?
না না কিছু না। বাথরুমে যেতে হবে। খাবার রেডি কিনা। আমি বললাম।
কথা ঘোরাস না। ছোটোমা গোল গোল চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে।
এই দেখো জিলিপির প্যাঁচ আরম্ভ হলো।
উরিবাবা এ কি সাংঘাতিক গো দিদি। আমরা কথা বললেই জিলিপির প্যাঁচ।
না না ও….।
তুমি থামো, শাক দিয়ে আর মাছ ঢেকো না। তোমার জন্যই ও….।
আচ্ছা বাবা আচ্ছা, আমার ঘাট হয়েছে।
এই জায়গায় থাকা এই মুহূর্তে নিরাপদ নয়। আমি সুর সুর করে বাথরুমে ঢুকলাম।
ছোটোমা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।
বেরো তারপর হচ্ছে।
বাথরুম থেকে ফ্রেস হয়ে সোজা নিচে চলে এলাম। সবাই আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ার দখল করে বসলাম। খাবার এলো। এই বাড়ির এই একটা মজা। সবাই একসঙ্গে খাবে আর গল্পগুজব হাসি ঠাট্টা চলবে। এর মধ্যে মল্লিকদা অগ্রণীর ভূমিকা নেয়।
বড়োমা।
বল।
কষা আলুরদমের গন্ধটা হেববি ছেড়েছে।
ছোটো করেছে।
তাই বলো। তাহলে মনে হয় ঝালটা একটু বেশিই হবে। একটু চিনি নিয়ে আসবে।
দাদা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।
ছোটোমা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে সোজা আমার পাশে এসে বসে কানটা ধরতে গেল। আমি কানটা সরিয়ে নিলাম।
দুজনেই হাসছি।
বড়োমা এসে আমার আর এক পাশে বসলো। এটাই এবাড়িতে খেতে বসার নিয়ম।
খাওয়া শুরু হলো।
সবে মাত্র একটা ফুলকোলুচি একটা গোটা আলুর সঙ্গে মুখে তুলেছি। মল্লিকদা বললো—কি বুবুনবাবু, নতুন কি খবর সংগ্রহ করলেন বলুন?
মুখ তুললাম। মল্লিকদার দিকে তাকিয়ে আছি। মল্লিকদা মুচকি মুচকি হাসছে। বড়োমা, ছোটোমা দুজনেই হাসছে। দাদা দেখলাম কোনও কথা না বলে মাথা নিচু করে খেয়ে যাচ্ছে। মল্লিকদার কথায় একটু অবাক হোলাম—এই নামটা এরা জানল কি করে!
একটু অবাক হলেন। খবর কি আপনি একাই সংগ্রহ করতে পারেন। আমরাও পারি।
মাথা নিচু করে খেয়ে যাচ্ছি। এখানে কথা বলা মানেই বিপদের হাতছানি।
কালকে মিত্রা তোর জন্য একটা ল্যাপটপ পাঠিয়েছে। অমিতাভদা বললো।
ওই বাক্সটায় ল্যাপটপ আছে! বড়োমা বললো।
তুমি কি ভাবলে সন্দেশ আছে?
মরন।
আমি মাথা নিচু করে মুচকি হাসলাম। শুরু হলো।
ল্যাপটপ কাকে দেয় অফিসের মালকিন। যখন সে বস হয়। মল্লিকদা বললো।
আমি বড়োমার পাশে বসেছিলাম। আলুরদমটা ছোটোমা হেবি বানিয়েছে। বড়োমার পাত থেকে দুটো লুচি আর আলুর দম তুলে নিলাম।
ছোটোমা হাঁই হাঁই করে উঠলো তুই নিবি না। আমি তোর জন্য এনে দিচ্ছি।
ততক্ষণে একটা লুচি আমার মুখে পোরা হয়ে গেছে। বড়োমা বললো, থাক থাক ছোটো। আমি আর কত খাব বল।
সাতখুন মাপ। মল্লিকদা বললো।
যাই বলিস মল্লিক, অনি দারুন ম্যানেজ করতে পারে। অমিতাভদা বললো।
আমি বুঝলাম আজ আমার কপালে দুঃখ আছে। সাতদিন আগে যে স্যাঁতস্যেঁতে পরিবেশটা এই বড়িতে ছিল, আজ সম্পূর্ণ উধাও। এবার প্রেম বিয়ের প্রসঙ্গ আসবে। সেটা তুলবে মল্লিকদা। তাকে সপোর্ট করবে ছোটোমা, বড়োমা। আর আমি অমিতাভদা নির্বাক শ্রোতা।
কি হলো, গেঁট হয়ে বসে রইলে যে, লুচি নিয়ে এসো।
ছোটোমা লাফাতে লাফাত রান্না ঘরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পরে লুচির পাত্র আর আলুর দমের পাত্র নিয়ে এসে টেবিলে বসিয়ে দিল।
এই যে তুই টোনাটা দিলি, এই জন্য এগুলো এলো। না হলে এগুলো বিকেলের জন্য তোলা থাকতো। মল্লিকদা বললো।
কি বললে—ছোটোমা ঘ্যাঁক করে উঠলো।
মল্লিকদা কাঁচুমাচু হয়ে বললো, না কিছু না। লুচি, আলুর দম, সৌজন্যে বুবুন।
ঠিক বলেছিস মল্লিক। বড়োমা বলে উঠলো।
হ্যাঁরে অনি তোর নাম যে বুবুন তুই আগে কখনও বলিস নি?
বুঝলাম ব্যাপারটা ডজ করে বেরিয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু হলো না। এবার বড়োমা চেপে ধরেছে।
তোমরা জানলে কি করে?
ছোটো বললো।
ছোটো জানলো কি করে?
হ্যাঁরে বদমাশ। শুনবি। মিত্রার কাছ থেকে। ছোটোমা ট্যাঁক ট্যাঁক করে উঠলো।
তাই বলো।
এই বার ছোটোমা ব্যাপারটা বললো, মিত্রা কাল ফোন করেছিল। তখন আমি, দিদি বাড়িতে। ফোনটা ধরলাম। একটা মেয়ের গলা। বললো বুবুনকে দিন। তা আমি বললাম, বুবুন বলে এই বাড়িতে কেউ থাকে না। বলে কিনা থাকে। আমি জানি। আচ্ছাই মুস্কিলে পরলাম। বললাম আমার মনে হচ্ছে আপনি রং নম্বরে ফোন করেছেন। নম্বর বললো, দেখলাম আমাদের নম্বর। তারপর নিজে থেকেই ফোনটা রেখে দিল।
আজ সকালে আবার তোর মোবাইলে ফোন এলো। সেই এক গলা। বুবুনকে চাই। আমি তখন আর কোনও কথা না বলে বললাম, ধরুন। দাদার কাছে গিয়ে তোর মোবাইলটা দিলাম। তারপর সব জানা জানি হয়।
হ্যাঁরে, তোর এই মিষ্টি নামটা কে দিয়েছিল? বড়োমা বললো।
একটু চুপ থেকে বললাম, মা এই নামে ডাকত।
হঠাৎ পরিবেশটা কেমন ভারি হয়ে গেল।
কিছুক্ষণ কেউ কোনও কথা বললো না।
আমার যে বাবা-মা নেই এটা সকলে জানে। কিন্তু তার ইতিহাস এরা কেউ আগ বারিয়ে জানার চেষ্টা করেনি। আমিও বলিনি।
আমি নিজেই হাল্কা করে দেবার চেষ্টা করলাম, ছোটোমার উদ্দেশ্যে বললাম, বেশতো নাচতে নাচতে গিয়ে লুচির হাঁড়ি নিয়ে এলে, আমার আর বড়োমার প্লেট যে খালি। ছোটোমা তারাতারি উঠে আমাদের লুচি দিল।
মল্লিকদা বললো, আমি আর বাদ যাই কেন।
ছোটোমা ধমক দিয়ে বললো, এ মাসের কোলেস্টরেলটা চেক করা হয়েছিল।
মল্লিকদা হাসতে হাসতে বললো, দুটো লুচি খেলে কোলেস্টরেল বেড়ে যাবে না, কি বল অনি।
অমিতাভদা গম্ভীর হয়ে বললো, তোর মনাকাকা বিয়ের জন্য আমাকে মেয়ে দেখতে বলেছে।
অমিতাভদা কথাটা এমন ভাবে বললো, সবাই হেসে উঠলো।
বড়োমা নাক সিঁটকে বললো, এই পুঁচকে ছেলেকে কে বিয়ে করবে শুনি—
ঠিক বলেছ বড়ো।
না না দাদা, আপনি দায়িত্বটা আমাকে দিন। মল্লিকদা বললো।
আমি মল্লিকদার দিকে কট কট করে তাকালাম। ছোটোমা মাথা নিচু করে হাসি চাপার চেষ্টা করছে। আমার বিষম খাবর জোগাড়।
ফোনটা বেজে উঠলো।
ওই নাও শ্যামের বাঁশী বেজেছে। ছোটোমা বললো।
তুমি লিঙ্গে বড় ভুল করো, শ্যাম নয়, শ্যাম নয়, রাধার বাঁশী। মল্লিকদা বললো।
রাধা বাঁশী বাজাতে জানতেন নাকি? অমিতাভদা বললেন।
ওই হলো আর কি।
লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাবার অবস্থা। কোনওপ্রকারে পকেট থেকে ফোনটা বার করে কানে দিলাম, সবাই চুপ করে গেল।
হ্যাঁ বল।
কি করছিস?
ফ্যামিলি পিকনিক চলছে।
চলে আসবো?
চলে আয়।
না থাক। পরে যাব। তোর দাদা, তোর সঙ্গে একবার কথা বলতে চায়।
কবে এলেন?
কালকে।
দে।
অপর প্রান্ত থেকে একটা পুরুষালী গলা ভেসে এলো।
হ্যালো।
হ্যাঁ দাদা বলুন।
কেমন আছো?
ভালো। আপনি?
কাজের ভীষণ চাপ নিশ্বাস ফেলার সময় পাই না।
আপনার মতো একজন ডাক্তার….।
থাক। আজ বিকেল একটু ক্লাবে এসো না।
আবার ক্লাব কেন, আমার গরিব খানায় যদি বসা যায়, কেমন হয়?
আমার কোনও আপত্তি নেই, তোমার বান্ধবীকে রজি করাও।
দিন ওকে।
মিত্রা ফোন ধরলো।
বল।
দাদাকে নিয়ে তুই চলে আয়।
না। আমার কেমন যেন….।
দূর পাগলি, তুই চলে আয়, কেউ কিছু মনে করবে না।
দাদা যদি কিছু ভাবেন?
কিচ্ছু ভাববে না।
কখন যাব বল?
লাঞ্চ থেকে ডিনার।
যাঃ।
আমি অফিস যাচ্ছি না। তুই একটা ভালো জিনিস পাঠিয়েছিস। ওটা নিয়ে সারা দিন পড়ে থাকব। এনি নিউজ।
না। সব ঠিক ঠাক চলছে। বাকিটা গিয়ে বলবো।
ঠিক আছে চলে আয়।
এতক্ষণ সবাই আমার মুখের দিকে তাকিয়েছিল। ওরা বেশ বুঝতে পারছিল আমি কার সঙ্গে কথা বলছি। বড়োমা সাথেও নেই পাঁচেও নেই, তাই ফোনটা রাখতে, বড়োমা বললো,— তুই কাকে আসতে বললি।
কেন তুমি বুঝতে পার নি? ছোটোমা বললো।
না।
মিত্রাকে।
মল্লিকদা টেবিলের ওপর চাপর মেরে চেঁচিয়ে উঠলো, কি তোমায় বলিনি।
ছোটোমা চোখ টিপে হাসছে।
আমি লুচি খেয়ে চলেছি।
অমিতাভদা আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। যতই হোক একজন মালিক বলে কথা, তারওপর যে সে হাউস নয়। কলকাতার একট বিগ হাউস।
ও ছোটো, ও তো নেমন্তন্ন করে খালাস, কি খাওয়াবি?
ছোটোমা, বড়োমার দিকে তাকাল।
আমি খেতে খেতেই বললাম এতো চাপ নিয়ো না, শরীর খারাপ করবে।
তুই থাম।
আমি একটা কথা বলবো।
বড়োমা আমার দিকে উত্সুক হয়ে তাকাল।
আজকের মেনুটা আমি যদি বানাই, তোমার আপত্তি আছে।
থাম তুই, কোনওদিন বাজারে গেছিস? ছোটোমা বললো।
যা বাবা। বাজারে না গেলে কি মেনু বানান যায় না।
আচ্ছা বল। অমিতাভদা বললো।
শরু চালের ভাত, ঘন ঘন করে মুগের ডাল, শুক্তো, পাতলা পাতলা আলু ভাজা, পাবদা মাছের ঝোল কিন্তু গোটা গোটা থাকবে, সরষেবাটা হিংয়ের বড়ি আর আমচুর দিয়ে টক, দই, মিষ্টি।
মল্লিকদা, ছোটোমা আমার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে।
বড়োমা আমার কানটা মূলে বললো, ছাগল।
সবাই হেঁসে উঠলো।
অমিতাভদ গম্ভীর গলায় বললো, অনির মেনু ফাইন্যাল।
বড়োমা ছেঁচকিয়ে উঠে বললো, অতো সাউকিরি করতে হবে না।
মল্লিকদা বললো, আমি তাহলে বাজারটা সেরে আসি।
যাও। অমিতাভদা বললো।
আসর ভাঙলো।
চলবে—————————
from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/RrzfXgq
via BanglaChoti
Comments
Post a Comment