কাজলদিঘী (পঞ্চম কিস্তি)

কাজলদিঘী
BY-জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

পঞ্চম কিস্তি
—————————

পাঁচবছর আগে যা দেখেছিলাম, পাঁচবছর পর তার বয়স প্লাস পাঁচ।

এখানেও সংস্কারের অভাব চোখে পড়লো। বারান্দায় উঁকি মারলাম। কয়েকটা কাপর শুকতে দেওয়া আছে। দেয়ালের মাটি খসে পড়েছে। পাশাপাশি দুটো দোতলা মাটির বাড়ি। একটি আমার পৈত্রিক বাড়ি। আর একটি মনামাস্টারের। সামনের আতাগাছটায় ফিঙে, দোয়েল, টুনটুনি নাচানাচি করছে। পাকা আতার গায়ে ওদের ঠোটের পরশ। নিজেদের মধ্যে কথাবলার কিচকিচ শব্দ ভেসে আসছে।

আমার জন্ম ভিটেয় কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম।

বাইরের গেটে শেকল তোলা। বুকের ভেতরটা কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে। একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা। চোখের কোল দুটো কেমন জ্বালা জ্বালা করে উঠলো।

ভেতর থেকে কেউ যেন বললো, অনি এসেছিস। আয় ভেতরে আয়। বাবাঃ কতদিন পরে এলি। মা, বাবাকে একটুও মনে পড়ে না। চারিদিকে চোখ মেলে তাকালাম। না কেউ নেই।

পায়ে পায়ে আমার বাড়ি পেছনে রেখে মনাকাকার বাড়ির দাওয়ায় উঠলাম। কতটা দূরত্ব? হাত পঁচিশেক হবে। ভেতরে এলাম। বাইরের সেই টানা বারান্দায় বেঞ্চটা যেমন ছিল ঠিক তেমনি আছে। দুটো দোলা ঝুলছে। কাকার বসার চেয়ার। পাশে টেবিল।

সামনের দিকে চোখ চলে গেল।

একটা বছর আঠারোর মেয়ে ভেতর বাইরে বসে, মাটিতে ঘসে ঘসে চুনো মাছ বাছছে। আমি একে আগে কখনও দেখিনি। চিনিও না।

পরনে স্কার্ট আর টপ। টপটা ঘটি হাতা। টিপিক্যাল গ্রাম্য পোষাক। অনেকদিন পর এই পোষাক চোখে পড়লো। হাঁটু পর্যন্ত স্কার্টটা তোলা। স্কার্টের ফাঁক দিয়ে ইজের দেখা যাচ্ছে। বেশ দেখতে মেয়েটাকে। টানা টানা চোখ। শ্যামলা গায়ের রং। গোলগাল চেহারা। মেয়েটা প্রথমে আমাকে দেখেত পায়নি। কাঁধ থেকে ল্যাপটপটা বেঞ্চের ওপর রাখতেই, সামান্য আওয়াজে পলকে আমার দিকে ফিরে তাকাল। তারপর হতচকিত হয়ে একটা গঁ গঁ শব্দ করে দৌড়ে ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল।

আমি হতবাকের মতো দাঁড়িয়ে আছি। কেমন যেন নিজেকে অপ্রস্তুত লাগছে। ভেতরে হই হই চাঁচামেচির শব্দ। ধুপ ধাপ আওয়াজ।

মনাকাকার গলা পেলাম। কি হলো গো এত চেঁচামিচি কেন?

কিছুক্ষণ পর কাকিমা বেরিয়ে এল। কাকিমার পাশে আর একজন ভদ্রমহিলা। তার পেছনে সেই মেয়েটি। উঁকি মেরে আমাকে দেখছে। পরিষ্কার দেখতে পেলাম এখনও তার বুকটা কামারশালের হাপরের মতো ওঠা নামা করছে।

কাকিমা বেশ কিছুক্ষণ আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। আমি নিচু হয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম। ঝড় ঝড় করে কেঁদে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো।

এতদিন পর কাকা, কাকিমাকে মনে পরলো।

ভেতর থেকে কাকা তখনও চেঁচিয়ে চলেছে।

কে এসেছে গো কে এসেছে? তোমরা সবাই কথা বলছো না কেন?

কাকিমা কাপরের খুঁট দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ধরা গলায় বললো। অনি এসেছে।

অনি এসেছে! কোথায়! কোথায়! ওকে ভেতরে নিয়ে এসো আগে।

মেয়েটার দিকে তাকালাম। বিদ্যুতের মতন এক ঝলক হাসি মুখের ওপর দেখা দিয়ে আবার মিলিয়ে গেল।

যাচ্ছি কাকা। আমি ভেতরে যাচ্ছি। তোমাকে ব্যস্ত হতে হবে না।

ও সুরমা, সুরমা। ওঃ এরা ডাক দিলে সারা দেয়না কেন—কোথায় যায় এরা?

কাকিমা ধরা গলায় বললেন, এই তো এখানে।

বুঝলাম সুরমা এই ভদ্রমহিলার নাম। গ্রামের রীতি একজনকে প্রণাম করলে সকলকে প্রণাম করতে হয়। আমিও সেই ভদ্রমহিলাকে প্রণাম করলাম। উনি পা-টা সামান্য সরিয়ে নিয়ে বললেন, থাক থাক বাবা। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুণ। যাও ভেতরে যাও। তোমার জন্যই ওই মানুষটা এখনও বেঁচে আছেন।

কাকিমাকে জড়িয়ে ধরে ভেতরে এলাম। এ পৃথিবীতে আমার আপনার বলতে কেউ নেই। কিন্তু আমি একা নই। বুকটা আবার কেমন ভারী হয়ে এলো।

ভেতরে এলাম।

কাকা বিছানায় বসে আছে। আমি পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেই কাকা খাট থেকে নেমে এসে আমায় বুকে জরিয়ে ধরলো। কাঁপা কাঁপা হাতে আমার চোখে মুখে হাত বোলাচ্ছে। যেন কিছু খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা। তারপর ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললো।

তুই কি আমাদের একবারে ভুলে গেলি?

আমার গলাটাও ধরে এসেছে। খুব কান্না পাচ্ছে, কিন্তু নিজেকে শক্ত করে নিলাম।

কোথায় ভুলে গেলাম! তোমার চিঠি পর্শুদিন পেয়েছি। আজই চলে এলাম।

বেশ কিছুক্ষণ এই ভাবে থাকার পর কাকা কাপড়ের খুঁট দিয়ে চোখ মুছে বললো, যাও যাও ওর খাবার ব্যবস্থা করো। ও এখন একটু বিশ্রাম নিক। ও নীপা। উঃ মেয়েটা যায় কুথা বলো তো।

এই তো আমি এখানে।

যা যা অনিদার ঘরটা একটু গুছি দে।

গোছান আছে। তোমাকে হুড়াহুড়ি করতে হবে না।

এবার কাকিমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, এঁদের তো চিনতে পারলাম না।

চিনবি কি করে—সেই কবে ছোটো সময়ে দেখেছিলি। আমার বোন সুরমা। আর ওটা ওর মেয়ে নীপা। এবার বারো ক্লাস দিয়েছে। তুই যখন সুরকে দেখেছিস তখন ওর বিয়েই হয়নি।

আমি নীপার দিকে তাকালাম। নীপা মাথা নিচু করে মুচকি মুচকি হাসছে। আমাকে নিচু হয়ে প্রণাম করলো।

বাইরে বেরিয়ে এলাম। বাঁশবাগানটা যেমন দেখেছিলাম তেমন আছে। চারিদিকে জঙ্গল একটু বেশি হয়েছে। সামনের একটু জায়গায় পালং শাক, সুশনি শাকের বীজ ফেলা হয়েছে। সামনের ছোট্ট খেতটায় কয়েকটা ফুলকফির চাড়াও পোঁতা হয়েছে। ধান সেদ্ধ করার দোপাখা উনুনটার কাছে একরাশ পাঁউশ (ছাই) ডাঁই করে রাখা রয়েছে। গোয়ালঘরটা ফাঁকা। মনে হয় গরুগুলো মাঠে বেঁধে আসা হয়েছে। মনাকাকার ঘরের পুকুরটা ঠিক আছে। জল টলটল করছে। দু-একটা মাছ মাঝে মাঝে ভুঁট মারছে।

স্নান করবে না?

তাকালাম। সেই মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে।

চোখ দিয়ে কথা বলছে। হাসি হাসি মুখ। কাকিমা তখন ওর কি যেন নাম বললো, নীপা।

জামা কাপরটা ছেরে নিই, চলো।

ভেতরে এলাম।

কাকিমা দাঁড়িয়ে আছে।

দেখা হলো।

হাসলাম।

শাক তলা কি তুমি করেছো?

সুরো করেছে। ও আর নীপা জল দেয়।

কোফি বাড়ি?

ওটা বিজয় দেখাশুনা করে।

পান্তা আছে?

কাকিমা আমার দিকে অবাক হয়ে তাকাল।

আছে কিনা বলো?

আছে।

নীপা তো চুনো মাছ বাছছে—

ওটাও তোর চোখে পড়েছে!

হ্যাঁ। ওই তো বাইরের বারান্দায় বসে….।

কাকিমা হাসছে।

ওখান থেকে কিছুটা নিয়ে ভজে দাও। লঙ্কা পেঁয়াজ তো আছেই।

তোর কি এখনও এই সব খাওয়ার অভ্যাস আছে?

জন্ম আমার এই ভিটেতে। বড় হয়েছি এখানে। মাটিটাকে ভুলি কি করে বলো।

কাকা আমার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

ও নীপা আজ হাটবার। তুই এক কাজ কর অনিলকে একবার ডাক। ওকে হাটে পাঠাই। কাকা ঘরের ভেতর থেকে চেঁচাল।

থাক না, আমি যাব খেয়ে দেয়ে। আমি বললাম।

কাকা চুপ করলো।

ভরা পুকুরে অনেকক্ষণ স্নান করলাম। শরীরটা জুড়িয়ে গেল। এর আগেরবার যখন এসেছিলাম। ঘণ্টা খানেক ছিলাম। তারপর চলে গেছিলাম। তার আগে বারো ক্লাস পরীক্ষা দিয়ে। দেখতে দেখতে দশটা বছর কোথা দিয়ে ফুরুত করে চলে গেল। শেষবার এসেছিলাম এমএ পরীক্ষার ফিজ নিতে। সেই শেষ আসা। মনে হয় শেষ চিঠি লিখেছিলাম, কাগজে চাকরিটা পাওয়ার পর। তারপর কাকা চিঠি দিলেও আমি তার কোনও উত্তর দিইনি।

খেতে খেতে একে একে সবার খবর নিলাম।

কাকিমা কখনও কাঁদে, কখনও গম্ভীর হয়ে যায়। সুরমাসি, নীপা বসে বসে সব শুনছে।

কাকার চোখে ছানি পড়েছে। তাই চোখে কম দেখে। বলতে গেলে দেখতেই পায় না। এখানে এক ডাক্তার আছে। সে নাকি বলেছে অনেক টাকা লাগবে। তাই কাকা ছানি কাটাতে চায় না। নীপারা আপাতত এখন এখানেই থাকবে। নীপা এখান থেকেই কলেজে পড়বে।

আমার বন্ধু অনাদি নাকি গ্রামপঞ্চায়েত হয়েছে। আমাদের বাড়িতে লাইট এসেছে। কিন্তু ভোল্টেজ কম। কেরসিনের খরচ আগের তুলনায় কিছুটা বেঁচেছে। আরও সব খবরা-খবর নিলাম। সবচেয়ে আনন্দ পেলাম এখানে নাকি মোবাইল টাওয়ার বসেছে অনেকের কাছে মোবাইলও আছে। এই অজ গ্রামে মোবাইল টাওয়ার!

ব্যাপারটা আমাকে খুব আনন্দ দিল। কিছুক্ষণের মধ্যে নীপার সঙ্গে খুব ভাব জমিয়ে নিলাম। নিজের তাগিদে। এখানে দিন কয়েক যদি থাকতেই হয়, তাহলে আমাকে বোবা হয়ে থাকতে হবে। এই বুড়ো-বুড়িদের সঙ্গে কতো কথা বলবো। বন্ধু-বান্ধব তাদের খুঁজে বার করতেই সময় চলে যাবে। তারপর তারা কে কীরকম অবস্থায় আছে কী জানি। কারুর সঙ্গেই পাঁচ বছর কোনও যোগাযোগ নেই। আমি খোঁজ খবর রাখলে তবে তারা খোঁজ খবর রাখবে।

আমি রেখেছি কি?

খাওয়া শেষ হতে আমি আমার বাড়িতে এলাম। নিচটা ব্যবহার না হওয়ায় নোংরা হয়ে আছে। চারিদিক অগোছাল। নিচের ঘরগুলো তালা দেওয়া। আমি সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় নিজের ঘরে এলাম। পরিপাটি করে ঘরটা সাজানো। যেমনটি দেখে গেছিলাম ঠিক তেমনি। আমার বাবা নাকি এই ঘরটা করেছিলেন তার ছেলের জন্য। নিজেরা বুড়ো-বুড়ি হয়ে নিচে থাকবেন। আর আমি বউ নিয়ে দোতলার এই ঘরে থাকবো।

নিজের মনে নিজে হাসলাম। মনাকাকা সব কিছুই যত্নের সঙ্গে রেখেছে। আমার কন্ট্রিবিউশন বলতে মাসে মাসে তিন হাজার টাকা। অমিতাভদা প্রত্যেক মাসে আমার মাইনে থেকে টাকা কেটে নিয়ে মানিঅর্ডার করে এখানে পাঠিয়ে দিত। বাকিটা কিছুটা বড়োমার হাতে। কিছুটা ব্যাঙ্কে। আমি আমার প্রয়োজন মতো বড়োমার কাছে নিয়ে নিতাম। এখনও এই অবস্থা বর্তমান।

মোবাইলটা অন করতেই অনেকগুলো মিশ কলের ম্যাসেজ এলো। প্রত্যেকটা নম্বর দেখলাম। এর মধ্যে মিত্রার ফোন আছে। বড়োমার আছে। আর নম্বরগুলো বুঝতে পারলাম না। বড়োমাকে ফোন করে শেষ পরিস্থিতি জানালাম। বড়োমার গলায় অভিমানের সুর। বাড়ি গিয়ে আমাদের ভুলে গেছিস। বড়োমাকে সব বোঝালাম। আমাদের এখানের ব্যাপারটা। বড়োমা জানে আমি গ্রামে থাকি। কিন্তু সেই গ্রামটা যে এত অজ গ্রাম তা বড়োমা এখন সবিশেষ জানল। শেষ কথা, সাবধানে থাকিস।

একটা সিগারেট খাওয়ার ইচ্ছে হলো। আসার সময় এক প্যাকেট দামি সিগারেট কিনে এনেছি। জীবনে প্রথম। প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বার করে ধরালাম। বেশ ভালো লাগছে খেতে। দুটো টান দিয়ে পুকুর ধারের জানলাটা খুললাম। বাঁশ ঝাড়ের ফাঁক দিয়ে পুকুরটা পুরোপুরি দেখা যাচ্ছে। নীপাকে দেখলাম, পুকুর ঘাটে, হাতে মুখে সাবান দিচ্ছে।

মেয়েটাকে দেখতে খুব একটা ভালো নয়। একবার দেখলে চোখে পরে যাবে এমন নয়। কিন্তু অনেকক্ষণ তাকিয়ে দেখলে ওকে বেশ ভালো লাগে। ওর মুখে একটা গ্রাম্য সরলতা। আমি জানলার ধার থেকে সরে এলাম। খাটে উপুর হয়ে শুয়ে পূবদিকের জানলায় মুখ রাখলাম। দূরে পালের বাড়ির টংটা দেখা যাচ্ছে। তার পাশের মেঠো রাস্তাটা তেঁতুল গাছের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে। আমি যেন কোথায় হারিয়ে গালাম।

অনি। এই অনি।

সুরমাসির গলা না? সম্বিত ফিরে পেলাম।

আমি বারান্দায় বেরিয়ে এলাম।

জামাইবাবু বললো, বিজয়কে বাজারে পাঠাচ্ছে। তোমাকে যেতে হবে না।

কেন? আমি তো যাব বললাম, কাকার আর তর সইছে না।

সুরমাসি নিচ থেকেই চলে গেল।

বেলা পরে এসেছে। গ্রামের ঘরে বেলা পরতে আরম্ভ করলেই ঝিঁ ঝিঁ পোকা আর জোনাকীর দেখা মেলে। কতদিন জোনাকী দেখিনি। ছোটো বেলায় এই সন্ধ্যের সময় কত জোনাকী ধরেছি। একটা পাতলা কাপড়ের মধ্যে ওদের ধরে রেখে অন্ধকারে ওদের আলো দেখেছি। কি ভালো লাগতো। আমার খাটটা পরিপাটী করে গোছান।

একটু শুয়ে পরলাম। নীপা আমার ব্যাগ ঘরের একটা কোনে রেখেছে। ল্যাপটপটা আসার সময় সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। সময় সুযোগ পেলে একটু লেখালিখি করবো। তনু যাবার সময় একটা পেন ড্রাইভ দিয়ে গেছে। বলেছিল আমি না থাকলে এখানে কয়েকটা নীল ছবি দিয়ে গেলাম, দেখো। একটু পুরুষ হওয়ার চেষ্টা করো।

তনুর দিকে তাকিয়ে বোকা বোকা হাসি হেসেছিলাম। শুয়ে শুয়ে আড়মোড়া ভাঙছিলাম। চোখ দুটো ঘুমে জড়িয়ে আসছে। ঘরটা আধো অন্ধকার।

অনিদা ও অনিদা। বাবাঃ ভূতের মতো কি করছো?

নীপা এরইমধ্যে আমার সঙ্গে অনেকটা সহজ হয়ে গেছে।

আলো জ্বলে উঠলো।

সামনে নীপা দাঁড়িয়ে। ওর পরনে শর্ট শালোয়াড়। বুকগুলো অসম্ভব উদ্ধত লাগছে। ঠোঁটে হালকা প্রলেপ। কপালে ছোট্ট বিন্দির টিপ। আমি ওর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম।

কী দেখছো কী বলো তো তখন থেকে? আমাকে কী নতুন দেখছো?

মাথা দোলালাম।

মনিমা ঠিক বলেছে, যা দেখ ও আবার যায় কিনা?

কেন!

তুমি ভীষণ গেঁতো।

তাই বুঝি। আমার বায়োডাটা এরই মধ্যে জোগাড় হয়ে গেছে?

নীপা মুচকি হাসলো।

আমার প্রতি ওর দুর্বলতা ওর চোখেমুখে ধরা পড়ে যাচ্ছে।

চলো চলো, আর দেরি করলে হাটে লোকজন থাকবে না।

সে তো আরও ভালো।

তা হয় নাকি। আমার আবার কয়েকটা জিনিস কিনতে হবে।

কি কিনবে?

সে তোমায় বলা যাবে না।

আমি উঠে পরলাম।

এই অবস্থায় যাবে নাকি?

হ্যাঁ।

এই একটা আধ ময়লা পাজামা, পাঞ্জাবী পরে!

আধ ময়লা কোথায়! এর রংটাই এরকম।

না। ওই জিনসের প্যান্ট আর গেঞ্জিটা পরো। দারুন স্মার্ট দেখতে লাগে তোমাকে।

হাসলাম।

নীপা জানে না কাকার হাত ধরে একসময় একটা ইজের প্যান্ট আর স্যাণ্ড গেঞ্জি পরে আমি হাটে গেছি। একটু বড়ো হয়ে পাজামা আর হাফ শার্ট। ড্রয়ার কেনা হয়নি কোনও দিন। কাকা বলতেন লেংট পর। পরেওছি। কলকাতা যাওয়ার সময় দু-সেট ফুল জামাকাপড় পেয়েছিলাম। তাও প্যান্ট পাইনি। আজ নীপা আমায় জিনসের প্যান্ট আর গেঞ্জি পরতে বলছে। একটু ইতস্ততঃ করলাম।

ঠিক আছে, ঠিক আছে, আমি নিচে অপেক্ষা করছি, তুমি তারাতারি চেঞ্জ করে নাও।

আমি পাজামা, পাঞ্জাবী খুলে জিনসের প্যান্ট গেঞ্জি চরালাম।

নিচে এসে দেখি বাইরের বারান্দায় বেশ কয়েকজন বসে আছে। কাকা মধ্যমনি হয়ে মাঝখানে। তাঁকে ঘিরে বাকি সকলে। আমাকে দেখেই ওরা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল। আমি কাছে গিয়ে কাকাকে বললাম, আমি একটু নীপার সঙ্গে হাটে যাচ্ছি।

তুই এখনও যাস নি!

না।

ওঃ।

কেন!

নীপা অনেকক্ষণ আগে বেড়িয়ে গেছে।

ওই তো দাঁড়িয়ে আছে।

দেখো দেখি কাণ্ড। আমাকে এক ঘণ্টা আগে বললো হাটে যাবে।

আমি হাসলাম।

যা যা তারাতারি ঘুরে আয়। সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে এখুনি সন্ধ্যা হয়ে যাবে। সবাই চলে যাবে। বেশ কয়েকটা নতুন দোকান হয়েছে। দেখে আয়, ভালো লাগবে।

আমি সবার মুখের দিকে একবার তাকালাম।

এরা তোর জন্য বসে আছে। তোর সঙ্গে দুটো কথা বলবে বলে।

আমার সঙ্গে? কেন!

সে অনেক কথা, আগে তুই ঘুরে আয়, তারপর বলছি। কৈ হে চন্দ্রেরপো, এই হচ্ছে অনি। দেখে চিনতে পারছো। আমার তো চোখ গেছে, ওকে ঠিক মতো দেখতেও পাই না।

হ্যাঁগো বাবাঠাকুর, এককেবারে বাপের মতোন গো। মা-পানা মুখ, বাপ পানা গায়ের রং।

মনটা খারাপ হয়ে গেল। সবাই কোমন হই হই করে উঠলো।

আমি যাই।

এসো। আর শোন একটা টর্চ নিয়ে নে, আস্তে আস্তে অন্ধকার হয়ে যাবে। কোথায় হোঁচোট-ফোঁচট খাবি।

আমি হাসলাম, না না লাগবে না।

ও অনিদা কি হলো। নীপা ওপাশ থেকে চেঁচাল।

যা যা, ওই পাগলী ডাকছে।

আমি বেরিয়ে এলাম। ক্ষেত্রমণির টবার ধার দিয়ে নদী বাঁধে উঠলাম। একটু এগোলেই মৌসুমি মাসির মাটির ঘড়টা মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে। নীপা কখনও আমার পাশে, কখনও আমার থেকে একহাত আগে। নদীর ওপারে বেরা ঘরের খড়ের চালাটা এখনও সেরকম ভাবে হাত পা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নদীতে এখন জল আতোটা নেই চাষের কাজে ব্যবহার হচ্ছে। একটু এগোলেই মদন প্রামানিকের ঘর। ঘরের একটা পাশ ভেঙে পরে গেছে। বাঁধের ওপর দিয়ে মিনিট দশেক হাঁটলে তবে হাটে গিয়ে পৌঁছবো। বাঁহাতে ঝাঁকরা বটগাছের মাথায় জটা হয়েছে। গাছের তলায় অগুনতি লাল লাল বট ফল পরে আছে।

সামনেই বাঁকুড়া ঘর। তারপর জানা ঘর। ওটাই হিন্দুদের শেষ সীমানা। তারপরেই শুরু হয়ে যাবে মুসলমানপাড়া। পাঁচ বছর আগের দেখা পথ ঘাট এখনও সেরকমই আছে। কোনও পরিবর্তন হয়নি।

যেতে যেতে নীপার সঙ্গে অনেক কথা হলো। নীপা এখন এই গ্রামের খুব পরিচিত একটা মেয়ে। একটা সময় আমাকেও এই গাঁয়ের অনেকে চিনত। অনেকে যেতে যেতে আমাকে যেমন তির্যক দৃষ্টিতে দেখছে, তেমনি নীপার সঙ্গে যেচে যেচে কথা বলছে।

নীপা এই গ্রামের মেয়েদের নিয়ে একটা নাচের দল করেছে। এখানে ওখানে নাচতে যায়। সপ্তাহে তিনদিন করে নাচের মহড়া হয়। এখানে এসে প্রথম প্রথম আমার নাম শুনতো, তারপর কাকার কাছ থেকে আমার সব কিছু জেনেছে। আমার বন্ধু-বান্ধবের কাছে আমার বায়োডাটা নিয়েছে। এখনও এই গ্রামে আমাকে নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। প্রত্যেক দিন আমাদের বাইরের লম্বা দালানে আড্ডা বসে, গ্রামের অনেকেই সেই আড্ডায় যোগ দেন। চলে রাত নটা পর্যন্ত। তারপর সকলে ফিরে যায়। আমার লেখা নিয়ে আলোচনা হয়। বাক-বিতণ্ডা চলে। আরও কত কি।

নীপা কল কল করে কথা বলে চলেছে। আমি হুঁ-হাঁ করে যাচ্ছি। এক সময় নীপা বলে উঠলো, মনিমা ঠিক কথা বলেছে, দেখিস ও সাতচড়ে রা করে না।

কে মনিমা?

কেন, তোমার কাকিমা।

বুঝলাম ঊষাকাকিমাকে নীপা মনিমা বলে ডাকে।

আমাকে নিয়ে তোমরা অনেক আলোচনা করো তাই না?

হ্যাঁ। তুমি আমাদের গ্রামের গর্ব। তাছাড়া তুমি আমাদের বাড়ির ছেলে। সেই ফ্লেভারটুকু আমরা সব সময় পাই।

সেই জন্য কলকাতায় খেতে বসে আমি এত বিষম খাই।

তাই বুঝি। ….এঁ কি বললে। ….বিষম খাও, ….আমাদের জন্য, নীপা আমার হাতে একটা রাম চিমটি দিলো।

আমি উঃ করে উঠলাম।

নীপার চোখদুটো কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

সরি অনিদা।

আমি হাসলাম। ওর আয়ত চোখদুটি ঝিরিঝিরি বাতাসের দোলায় কেঁপে উঠলো।

সূজ্জিমামা পশ্চিমদিকে একেবারে হেলে পরেছে। এখন তার রং কমলা। জানা ঘরের কাছে এসে একটা মিহি আওয়াজ কানে এলো, অনেক লোকে একসঙ্গে কথা বললে মিলে মিশে যেমন একটা শব্দ বের হয় ঠিক তেমনি। এরপর বামহাতে মুসলমান পাড়া পরবে তারপর হাট।

অনিদা।

উঁ।

আমার ওপর রাগ করলে।

কেন?

না থাক।

কিছুক্ষণ দুজনে নিস্তব্ধে হাঁটছি। নিজেদের পায়ের শব্দ নিজেরাই শুনতে পাচ্ছি। দূর থেকে হাটের একটা মৃদু গুঞ্জন ভেসে আসছে। আমি নিস্তব্ধতা ভাঙলাম।

নীপা।

উঁ।

তুমি হাটে রেগুলার আসো?

হ্যাঁ। কেন?

একটা সময় ছিল, তোমার বয়সি কোনও মেয়ে হাটে আসত না।

তাই!

হ্যাঁ।

সে অনেক দিন আগের কথা। এখন সব বদলে গেছে।

ওর দিকে তকালাম, নীপা খুব স্মার্ট।

দেখছোনা চারিদিকে।

হাসলাম।

একটা বাইক পাশ দিয়ে হুশ করে বেরিয়ে গিয়ে ক্যাঁচ করে থেমে দাঁড়াল।

অনি না?

আমি দাঁড়িয়ে পরলাম।

আমার বয়সী এক তরুণ যুবক। বাইকটা পায়ে পায়ে ঠেলে পেছন দিকে নিয়ে আসছে।

আমি এগিয়ে গেলাম।

মুখটা চিনি চিনি, কিন্তু ঠিক ঠাহর করতে পারছি না।

কিরে নীপা, আমি ঠিক ধরেছি?

হ্যাঁ।

শালা, ঢেমনা। চিনতে পারছ না?

বলে, আমার হাতটা ধরে এমন জোরে চেপে ধরলো আমি কঁকিয়ে উঠলাম।

আমি নীপার মুখের দিকে তাকালাম।

নীপা বললো, চিনতে পারছ না!

আমি মাথা দোলালাম, হ্যাঁ না-র মাঝখানে।

যার কথা আজ দুপুরে খেতে খেতে বলছিলে, এই সেই বিশেষ ব্যক্তি।

অনাদি!

হ্যাঁরে ঢেমনা, অনাদি।

অনাদি বাইক থেকে নামল।

পথচলতি অনেকে অনাদির পাশে দাঁড়িয়ে পরেছে। নেতা হলে যা হয়। ফেউরা ভিড় করে থাকে। আমি অনাদিকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। দশবছর আগে দেখা অনাদির সঙ্গে এখনকার অনাদির অনেক পার্থক্য। অনেক শার্প।

কেমন আছিস?

ভালো। কদিন থাকবি তো?

হ্যাঁ। তবে পর্শুদিন চলে যাবার ইচ্ছে আছে।

সেকিরে….! আচ্ছা আচ্ছা তুই এখন হাটে যাচ্ছিস?

হ্যাঁ।

নীপা তোরা বাসুর দোকানে থাকিস, আমি এখুনি একটা কাজ সেরে ঘুরে আসছি। চলে যাস না যেন।

আমরা আবার হাঁটতে আরম্ভ করলাম। নীপা আমার পাশে পাশে চলেছে। কখনও মাথাটা মাটির দিকে করে, আবার কখনও মাথাটা সামনের দিকে।

তোমাকে দেখে আমার হিংসে হয়, জানো অনিদা।

কেন?

তোমার পপুলারিটি।

তাহলে বলো, আমি এই গ্রামের একজন সেলিব্রিটি।

সেলিব্রিটি বললে ভুল হবে, তার থেকেও যদি বেশি কিছু থাকে, তুমি তাই।

বাড়িয়ে বলছো।

নাগো, সত্যি বলছি। বারান্দায় যাদের দেখলে, তারা প্রত্যেক দিন এসে মশাইয়ের কাছে তোমার খোঁজ খবর নেবে। তুমি তো কোনওদিন ফোনও করো না, আর চিঠিপত্রও দাও না।

নীপা একটু থামল।

মশাই ওদের প্রত্যেকদিন বানিয়ে বানিয়ে তোমার কথা বলে, তারপর কাগজ বার করে তোমার লেখা পড়া হয়, তুমি নাকি রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ।

আমি নীপার দিকে তাকালাম।

সত্যি তো! গত পাঁচ বছরে আমি একটা চিঠিও লিখিনি। মনাকাকা অফিসের ঠিকানায় কয়েকটা চিঠি লিখেছে। অমিতাভদা আমায় বলেছেন এই মাত্র। তবে নিয়ম করে টাকাটা আসতো, আর আমার খবরা খবর অমিতাভদাই দিতেন।

নীপার দিকে অপরাধীর মতো তাকালাম।

সত্যি নীপা একদম সময় পাই না।

একটা ফোন করার সময় পর্যন্ত পাও না।

ফোন যে এখানে আছে তাইই জানি না।

তুমি জান না!

সত্যি বলছি। আর মাবাইলের কথা বলছো, গত মাসে ভাইজ্যাক গেছিলাম ইলেকশন কভার করতে, তখন অমিতাভদা এটা কিনে দিয়েছে।

ও আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাল।

আমি সত্যি বলছি। তবে এবার দেখো, এ ভুল আর হবে না।

নীপা হাসলো। ওর হাসিটাই বলে দিচ্ছে ও জিতে গেছে।

আমরা হাটে পৌঁছোলাম।

নীপার পাশে আমি। গ্রামের ছেলে হলেও বর্তমানে আমি অপরিচিত। পোষাক পরিচ্ছদও গ্রামের মতো নয়। স্বাভাবিক ভাবেই শেষ বেলায় যারা হাটে রয়েছে তাদের তির্যক দৃষ্টির স্বীকার হলাম।

নীপা বললো, চলো একবার বিউটি স্টেশনার্সে যাব।

সেটা আবার কি!

ওঃ তোমায় বলেছি না, তোমার দশ বছর আগের দেখা হাট, আর এখনকার হাটের মধ্যে অনেক পার্থক্য।

ওখানে কি পাওয়া যায়?

ওখানে সাজগোজের জিনিস পাওয়া যায়।

সে তো মনিহারী দোকানে পাওয়া যায়।

কনসেপ্ট বদলে গেছে।

হাসলাম। সত্যি লোকজন অনেক কমে এসেছে, তবে আগে সন্ধ্যা হয়ে এলে লম্ফ ছাড়া কোনও আলো হাটে দেখা যেত না। এখন দেখছি বেশ কিছু দোকানে নিওন আলো জ্বলে উঠেছে। আগের থেকে অনেক ঝকঝকে। এখন আর হাট বলে মনে হয় না। বাজার বলাই ঠিক হবে।

এসো ভেতরে এসো।

আমি নীপার পেছন পেছন দোকানের ভেতরে এলাম। একটা বছর কুড়ির ছেলে জিনিস দেখাচ্ছে। মেয়েদের ভিড়ই বেশি। এই অজ পাড়াগাঁয়ে, এই ভর সন্ধ্যে বেলা মেয়েদের এত ভিড় দেখে অবাক হয়ে গেলাম। দু-চারজন মেয়ে নীপাকে দেখে এগিয়ে এলো। চোরা চোখে আমাকে দেখে নিচু স্বরে নীপাকে আমার সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলো। নীপা কিছু কথা বলতেই ওদের চোখের চাহুনি বদলে গেল। নীপা খুশিতে ডগমগ করছে, ওর পা যেন মাটিতে পড়তে চাইছে না।

ঋজুদা জিনিসগুলো এনেছো?

সব পাইনি।

তা হলে!

এই দিয়ে কাজ চালিয়ে দাও।

আর দশদিন পর ফাংশন।

এখনও বেশ কিছুদিন বাকি আছে, দেখি যদি কলকাতা যাই, এনে দেব।

তোমায় নিয়ে আর পরা যাবে না।

পিঠে দরাম করে একটা ঘুসি পরলো।

শালা সন্ধ্যের সময় হাটে এসেছো। যাতে কেউ দেখতে না পায়। তাই না।

বড্ড লেগেছে, তবু বুঝলাম এ আমার পরিচিত কেউ হবে। পেছন ফিরে তাকালাম, ভানু, দিবাকর, চিকনা, পাঁচু, পচা, পলা, সঞ্জু আরও অনেকে।

আমার সব স্কুল লাইফের বন্ধু।

হেসে ফেললাম, ভনু আমার হাত ধরে প্রায় মুচড়ে ভেঙেই ফেলবে এমন অবস্থা।

হাত ছাড়তেই ভানুকে জড়িয়ে ধরলাম। কেমন যেন দেখতে হয়ে গেছে। কম বয়সে বুড়োটে মার্কা চেহারা। সেই ভানুর তাগড়াই শরীর কোথায়!

কিরে চেহারার এ কি অবস্থা!

আর বলিস কেন, মাঠে খাটতি খাটতি….।

দোকানের সবাই আমাদের দিকে তাকিয়ে।

দোকানের মধ্যে নয় বইরে চল, যতই হোক ব্যবসার জায়গা।

ওকে তুই চিনিস?

না। চিনবো কি করে?

উনামাস্টারের ছেলে। যাকে তুই হামা দিতে দেখেছিস।

ছেলেটি এবার কাউন্টার থেকে বেরিয়ে এসে আমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো। বাবর কাছে আজ দুপুরে আপনার আসার সংবাদ শুনেছি।

স্যারের সাথে আসার সময় আমার দেখা হয়েছে।

নীপার দিকে তাকালাম। নীপা আমার দিকে বিষ্ময় চোখে তাকিয়ে আছে।

ওর চোখে অহংকারের প্রলেপ। আমি ছেলেটিকে বললাম, ভাই নীপা যা যা জিনিস নেয় দিয়ে দাও। পয়সা নিও না। আমি দেব।

ঠিক আছে।

এই নীপা, শোন আমরা বাসুর দোকানে আছি, তোর সব কেনা কাটা হয়ে গেলে, ওখানে আসবি। অনি ওখানে থাকবে। চিকনা বললো।

নীপা কোনও উত্তর দেবার আগেই আমি ওদের হাতে চালান হয়ে গেলাম।

বাসুর দোকানে এলাম। বাসু আমাদের সঙ্গে ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়েছিল। তারপর ওর বাবা বললো আর পড়তে হবে না বাপ। মাঠে কাজ করো, খাওয়াপরার অভাব হবে না।

শুনেছি বাসু পরে বসন্তপুর কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করেছিল। সেই বাসু এখন বেশ জমপেশ করে রেডিমেড জামা কাপড়ের দোকান করেছে।

আমরা এক দঙ্গল ঢুকতে বাসু এগিয়ে এলো। বুঝলাম আজ ওর বেচা কেনা লাটে।

ভানু স্বভাব সিদ্ধ লিডারের মতো পার্ট নিল। আমি ওদের হাতের পুতুল।

বাসু বললো, অনি তুই আজ অতিথি কি খাবি বল?

তোর দোকান লাটে উঠে যাবে।

দূর, সারাদিন অনেক ব্যবসা করেছি। এবার একটু আড্ডা। কতদিন পরে তোর সঙ্গে দেখা। বললি না কি খাবি?

খাওয়াবি?

অফকোর্স।

পচা বলে উঠলো শালা বাসু ইংরিজি ঝারছে রে চিকনা।

ভানু, পচাটাকে শামলা। বাসু বললো।

একশো গ্রাম ছোলার পাটালি নিয়ে আয়। আমি বললাম।

বাসু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল, ওর চোখে কে যেন হাজার পাওয়ারের বাল্ব জালিয়ে দিল।

তোর কি আর কিছু চাওয়ার নেই। সেই ছোলার পাটালি!

দশবছর খাইনি।

গ্রামে এসেই চুনোমাছের ভাজা দিয়ে কাকীর কাছে পান্তা খেয়েছি। তোর কাছে ছোলার পাটালি চাইলাম।

ভানু চেঁচিয়ে উঠলো পচা, দেখতো জানা ঘরের বুড়ীর কাছে ছোলার পাটালি আছে কিনা। ওখানে যদি না পাস কামারঘরের অশ্বিনীর কাছে থাকবে।

পচা আর একটা জিনিস নিয়ে আসিস, একটু ছোলা সেদ্ধ আর কাঁচা লঙ্কা, আলুভাজা গুলো দেখে নিস। আমি বললাম।

সবাই আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে। ওরা বিশ্বাস করতে পারে না আমি এই ধরনের কিছু ওদের কাছে চাইতে পারি। আমি যেন একটা কেউ কেটা হয়ে গেছি। পুরদস্তুর শহুরে একজন মানুষ।

অবাক হয়ে ওদের দিকে তাকালাম। একটু পরিবর্তন সকলের মধ্যে হয়েছে। সেটা বয়সের ধর্মে কিন্তু মনের দিক থেকে এখনও আমরা সেই স্কুলের বন্ধু। আমি যেন আবার আমার স্কুল জীবনে ফিরে যাচ্ছি। এরইমধ্যে বাসুকে কানে কানে বললাম, নীপার জন্য তোর দোকানে সবচেয়ে দামী যে শালোয়ার কামিজটা আছে প্যাক করে রাখ।

অনাদি এলো, আবার একচোট হই-হুল্লোর হলো, পাটালি আর ছোলাসেদ্ধ এলো, সকলে ভাগ করে খেলাম, শেষে চা।

পয়সা দিতে চাইলাম বাসু, অনাদি তেরে গালাগাল করলো।

আমি, অনাদি, ভানু, বাসু আর চিকনা আলাদা করে কাকার চোখের বিষয় নিয়ে আলোচনা করলাম।

ওরা আমাকে বললো এখানে খুব ভালো একটা নার্সিংহোম হয়েছে। তুই যদি বলিস তাহলে ব্যবস্থা করি। আমি বললাম আমি থাকাকালীন এটা করে যেতে চাই। ওরা আমায় কথা দিল, আগামীকাল দুপুরের মধ্যে সব ব্যবস্থা করে দেবে।

আমি ওদের বললাম, টাকার ব্যাপার নিয়ে ভাববি না। আমি কাকার চোখের আলোটা আবার ফিরিয়ে দিতে চাই। ওরা বললো ঠিক আছে। আর একটা কথা, আমার জমিজমা নিয়ে একটু কথা আছে, কাল তোরা দুপুরের দিকে আয় জমিয়ে আড্ডা মারা যাবে।

অনাদি একটা সিগারেট এগিয়ে দিল। আমি হেসেফেললাম, অনাদির হাতটা চেপে ধরলাম।

এখনও এটা অভ্যাস করিনি। কালেভদ্রে একটা দুটো খাই।

বাসুর চোখ কপালে উঠলো।

কালেভদ্রে খাস যখন এখন একটা খা।

চারিদিক চেয়ে দেখলাম। বড়রা যদি কেউ থাকে।

সতীপনা করিস না, আশেপাশে এখন সিনিয়াররা কেউ নেই। সবাই এখন তোর বাড়িতে। ওখানে আড্ডা মারছে।

আমি অনাদির দিকে তাকালাম। ভানু কোথায় গেল?

আর বলিস না। কাল সব বলবো।

অবাক হলাম!

উনামাস্টারের ছেলের দোকানে কিছু টাকা পাবে, নীপা কিছু জিনিসপত্র কিনেছে।

কাল দিবি।

না না। তুই পচাকে বল একটু দিয়ে আসতে।

অনাদি পচা পচা বলে চেঁচাতেই, পচা এসে হাজির। মানিপার্টস থেকে একটা হাজার টাকার নোট বার করে বাসুর দিকে এগিয়ে দিলাম। তোর দামটা নিয়ে বাকিটা পচাকে দে।

দূর শালা। সকাল থেকে পাঁচশো টাকা বিক্রি হয়নি, তুই হাজার টাকার নোট দেখাচ্ছিস।

আচ্ছা, তোর দামটা নিয়ে দিবি।

না থাক।

তাহলে নেব না।

বাসু আমার দিকে কটমট করে তাকাল। অনিচ্ছা সত্বে উঠে গেল। একটা পাঁচশো টাকার নোট পচার হাতে দিয়ে বললো যা দিয়ে আয়।

আমি পচাকে বললাম, নীপাকে একবার বলে আসিস, এবার উঠবো।

সকলে হো হো করে হেসে উঠলো।

হাসলি যে।

ওই দেখ নীপা দাঁড়িয়ে আছে।

বাইরে দিকে তাকিয়ে দেখলাম নীপা ওর বন্ধুদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছে।

বেশ কিছুক্ষণ হই হই করে কাটল। আমি বললাম এবার উঠবো।

ওরা বললো আর কিছুক্ষণ থাক না।

কাকা তারাতারি যেতে বলেছে, কারা যেন এসেছে।

অনাদি বললো, আজকে ২৫ ভাগ এসেছে, কাল ঠেলা বুঝবি।

হাসলাম।

নীপা মিথ্যে কথা বলেনি। আমি সত্যি সত্যি সেলিব্রিটি।

তুই এক কাজ কর আমার বাইকে বসে যা। অনাদি বললো।

আমি নয় তোর বাইকে বসলাম, নীপা যাবে কি করে?

সে ব্যাবস্থা আমি করে দিচ্ছি।

অনাদি বেরিয়ে এলো। বাসুকে বললাম কাল তাহলে আসিস। ও বললো ঠিক আছে। নীপা বাইরে দাঁড়িয়েছিল, আমি আসতেই বললো, অনিদা এসো আমার বন্ধুদের সঙ্গে তোমায় আলাপ করিয়ে দিই।

অনাদিরা সকলে হাসছে।

নীপা একে একে সবার নাম বলে চলেছে, কেউ আমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে, কেউ আবার হাত জোড় করে। কারুরই মুখ এই আধো অন্ধকারে পরিষ্কার দেখতে পেলাম না। সবাইকে বললাম একদিন এসো, জমিয়ে গল্প করা যাবে। ওরা কল কল করে উঠলো।

আমি অনাদির পেছন পেছন এলাম, নীপা আমার পাশে। অনাদি বাইকে স্টার্ট দিল, বললো তুই আমার পেছনে বোস, নীপা তুই অনির পেছনে বোস।

আমার চক্ষু চড়কগাছ। এই অন্ধকারে তিনজন!

বোস তো, নীপা আছে বলে, না হলে তোকে….।

নীপা খিল খিল করে হেসে উঠল।

ঠিক আছে ঠিক আছে, হাত পা যদি ভাঙে….।

নীপার হাসি থামে না। আমরা অনাদিদার বাইকে চারজনে বসি।

অবাক হলাম।

অনাদির পেছনে বসলাম। নীপা আমার পেছনে।

অনাদি বাইক চালাতে আরম্ভ করলো। বাজার ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। আলো থেকে অন্ধকারে।

চাঁদের আলোয় মাঠ ভরে গেছে। অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যায়।

চাঁদটা বেশ বড়, নীপা আমার শরীরের সঙ্গে সেঁটে আছে। ওর হাত আমার থাইতে।

ওর নরম ভারি বুক আমার পিঠে হুল ফোটাচ্ছে।

বাইকের আওয়াজ চারিদিকের নিস্তব্ধতা ভেঙে এগিয়ে চলেছে।

মাঝে মাঝে দু-একটা পোকা মাকড় ঠকাস ঠকাস করে চোখে মুখে লাগছে। নীপা ওর ঠোঁট দুটো আমার পিঠে ছোঁয়াল। মাথা রাখল। আমার পিঠটা যেন ওর বালিশ। একটা অস্বস্তি আমার সারা শরীরে। আমরা তিনজনেই চুপচাপ।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যে আমরা পৌঁছেগেলাম। মনাকাকা বারান্দায় দাঁড়িয়ে চেঁচামিচি করছে।

তোমরা ছেলেটাকে পাঠিয়ে দিলে, এখনও এলো না। ….কে এলিরে।

স্যার, আমি অনাদি।

অনাদি। দেখতো ছেলেটা হাটের দিকে গেছে, এখনও এলো না।

কে!

কে আবার, অনি।

এই তো আমি ওকে নিয়ে এসেছি।

নিয়ে এসেছিস। আয় আয়। ভেতরে আয়।

অনাদি দাওয়ায় উঠে কাকাকে প্রণাম করলো।

আমি এই সোনাঝরা জ্যোৎস্নায় নীপার দিকে তাকালাম। ওর চোখে এখন অন্য কথা। আমি প্যাকেটটা ওর হাতে দিলাম।

কি এটা?

ভেতরে গিয়ে খুলে দেখো।

নীপা ভেতরে চলে গেল।

আসর ভাঙতে অনেক রাত হলো। খেতে খেত আরও দেরি হলো। প্রায় এগারোটা। আমি কাকাকে চোখের ব্যাপারে বললাম। কাকা হাঁই হাঁই করে উঠলো।

আমি একটা কথাই বললাম, তাহলে কাল সকালে উঠেই আমি এখান থেকে চলে যাব। এ জীবনে আর আমার সঙ্গে দেখা হবে না।

কাকা কেঁদে ফেললো। ঠিক আছে তুই যা বলবি তাই হবে। অনেক টাকা লাগবে।

সে নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। আমার কণ্ঠের দৃঢ়তা কাকাকে সব কিছু মেনে নিতে বাধ্য করালো। সম্পত্তির ব্যাপার নিয়ে কাকাকে বললাম, আমি একটা চিনতা ভাবনা করে রেখেছি, কাল তোমায় জানাব।

সুরমাসি বললেন, হ্যাঁরে অনি, তুই একলা ওবাড়িতে শুতে পারবি?

আমি বললাম, কেন পারব না!

নীপা বলছিল তোর ওখানে শোবে।

আমি নীপার দিকে তাকালাম, ও মাথা নিচু করে আছে।

এমনি সময় এই বাড়িতে কে থাকে রাতে।

ভাট পাড়ার দুটো ছেলে আছে, ওরা এসে রাতে শোয়।

ওই বাড়িতে?

আমি আর নীপা শুই। সুরমাসি বললো।

তুমি কোথায় শোবে?

আমি এই বাড়িতে থাকবো।

ঠিক আছে।

খাওয়া শেষ। আমি উঠে মুখ ধুয়ে ওই বাড়িতে চলে গেলাম। বাইরের বারান্দায় দুটো ছেলেকে বসে থাকতে দেখলাম। আমাকে দেখে উঠে দাঁড়াল।

তোমরা কার ঘরের?

ভাটের ঘরে।

বাবার নাম কি।

একজন বললো বিধান রায়, অপরজন বললো বানু রায়।

আমি অবাক হয়ে ওদের দিকে তাকালাম। এই ছোটো ছোটো দেখেছি। এখন সব সমত্ত বয়স।

নিজের ঘরে এলাম।

ছোটো একটা ডিম লাইট জ্বলছে। তার আলোয় যতটা দেখা যায়। আমি প্যান্ট, গেঞ্জি খুলে পাজামা, পাঞ্জাবী পরলাম। কতদিন এই ঘরে একা একা শুয়ে কাটিয়েছি। তখন কেউ আমার সঙ্গে শুতে আসত না। মাঝে মাঝে ভানু আর চিকনা এসে থাকত, হাঁড়ি পাড়ার বিজনও আসত। একা থাকাটা আমার যেন জন্মগত অধিকার। সেই জন্য আমার কোনও ভয়ডর নেই। রাতের অন্ধকার আমার কাছে ভীষণ প্রিয়।

উঃ তোমাকে নিয়ে আর পারা যাবে না।

নীপা এসে হাজির। এরই মধ্যে পোষাক বদল হয়ে গেছে। একটা হাতকাটা ম্যাক্সি পরেছে। ঘরের লাইটটা জ্বাললো। লো ভল্টেজ টিম টিম করে জ্বলছে। আমি ওর দিকে তাকালাম।

সত্যি অনিদা তুমি একটি লেডিস ফিঙ্গার।

হাসলাম।

হাসছো। তোমার খাটের পাশটা দেখেছো।

না।

দেখো ওখানে তোমার রাতের পোষাক ভাঁজ করে রাখা আছে।

থাক। কাল পরবো।

দাঁড়াও আমি একটু আসছি। বলে নীপা চলে গেল। কিছুক্ষণ পর একটা বড় টর্চলাইট আর একটা জলের মগ নিয়ে এলো। আবার বেরিয়ে গেল। একটা টেবিল ল্যাম্প নিয়ে এলো।

এটা আবার কি হবে।

দেখতেই পাবে। এ তো আর তোমাদের শহর নয়। একটু পরেই লাইট ফুস হয়ে যাবে।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। আমরা সারারাত লাইট জ্বাললে, তোমরা শহরের লোকেরা কারেণ্ট পাবে কি করে।

ওঠো দেখি একটু।

নীপা বেশ টরটরি আছে। কটকট করে কথা বলে। এরই মধ্যে ও যেন আমার কতো আপন। আমাকে শাসন করছে। সোহাগ করছে। নীপা খাটটা ঝেরে দিয়ে নিচে রাখা বাক্স থেকে একটা চাদর বার করে বিছানায় পেতে দিল। চাদরটা চেনা চেনা মনে হলো। আমি ওর দিকে তাকিয়ে আছি।

কার বলো তো চাদরটা?

কার!

মনে করার চেষ্টা করো।

মনে পড়ছে না।

মনিমা বলেছিল, তুমি যখন স্কুল ফাইন্যালে স্টার পেয়েছিলে, সেই সময় মশাই তোমাকে এটা প্রেজেন্ট করেছিল।

চেয়ে চেয়ে দেখলাম, নীপা সত্যি কথা বলেছে। আমি মাদুর পেতে শুতাম। অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। কাকা চাদরটা কিনে দিয়েছিল। আমি এতে শুতাম না। সেটা যে এতো যত্ন সহকারে তোলা আছে জানতাম না। চাদরের শরীরে নেপথলিনের গন্ধ ম ম করছে।

যাও শুয়ে পরো। নীপা বললো।

তুমি কোথায় শোবে?

ভেতর বারান্দায়।

কেন?

সে তুমি বুঝবে না।

নীপা নিজে থেকেই একটা আড়াল তোলার চেষ্টা করছে। কিছু বললাম না।

দরকার পরলে ডাকবে।

আমি ওর দিকে তাকিয়ে।

তাকিয়ে আছো কেন?

তোমার কোনও অসুবিধে হবে না?

হলে বাঁচাবে।

নীপা বাঁকা চোখে আমাকে দেখে ঘরের বাইরে চলে গেল।

আমি বিছানায় টানটান হয়ে শুলাম। আঃ কি আরাম, কলকাতায় আমার গদি ওয়ালা বিছানার থেকে এ বিছানার মাধুর্যই আলাদা। মাথাটা ভীষণ যন্ত্রনা করছে। নিজে নিজেই মাথায় হাত বোলাতে লাগলাম। নীপা বাইরের বারান্দায় বিছানা করছে, ধুপ ধাপ শব্দ হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর ও আবার ভেতরে এলো।

দরজা বন্ধ করবে না?….কি হলো!….মাথা যন্ত্রণা করছে!

আমি ওর দিকে তাকালাম। ওর চোখ দুটো কেমন যেন হয়ে গেল, আমার মাথার শিয়রে এসে বসলো।

আজ সারাদিন তোমার অনেক ধকল গেল।

হ্যাঁ।

দাঁড়াও তোমার মাথায় একটু বাম লাগিয়ে দিই।

না থাক।

থাক কেন?

আমি ওসব লাগাই না।

তুমি না….

নীপা মাথা থেকে আমার হাতটা সরিয়ে দিয়ে নিজের হাত রাখল। নরম হাতের ছোঁয়ায় আমার চোখ বন্ধ হয়ে এলো। নীপা আমার চুলর মধ্যে হাত ঢুকিয়ে বিলি কাটছে। একটা পিন পরলেও এ ঘরে শব্দ হবে।

এখনও কারেন্ট আছে। ডিম লাইটটা মিট মিট করে জ্বলছে। আমার মাথার শিয়রের জানলাটা খোলা। একফালি চাঁদের আলো জানলার ফাঁক দিয়ে বিছানায় এসে পড়েছে। আমার চোখ বন্ধ।

অনিদা।

উঁ।

তুমি আমার জন্য এত দাম দিয়ে ওটা কিনলে কেন?

তোমার পছন্দ হয়েছে?

হ্যাঁ। যেদিন বাসুদা ওটা নিয়ে এসেছিল, আমি দেখেছিলাম, কিন্তু….।

কিন্তু কি?

তুমি তো জানো আমাদের অবস্থা।

একটা কাজ করবে?

কি!

আমার বন্ধু গুলো সব….উঃ, তাড়াহুড়োয় আমার একটা ভুল হয়ে গেছে। কালকে তুমি এক ফাঁকে একবার বাসুর দোকানে যেতে পারবে।

তুমি বললে, নিশ্চই যাব।

তুমি বাসুর দোকানে গিয়ে তোমার পছন্দ মতো সুরমাসির জন্য, কাকিমার জন্য আর কাকার জন্য বেশ কয়েকটা করে কাপড়, শায়া, ব্লাউজ আর তোমরা যা যা পরো নিয়ে আসতে পারবে?

নীপা মুচকি হাসল।

হাসছো কেন?

তোমার কথায়। ওই যে বললে….।

আরে ধ্যুত, আমি কোনও দিন কারোর জন্য কিছু কিনিনি।

জানি।

কি করে জানলে?

তোমার কথায়। তুমিও যাবে আমার সঙ্গে।

না। কাল আমার অনেক কাজ।

জানি।

কি করে জানলে?

মশাই বলছিল। তুমি যা ডিসিশন নেবে তাই ফাইন্যাল। মশাই তোমাকে ছাড়া কাউকে পাত্তা দেয় না। কাল দেখবে সবাই তোমার কাছে আসবে কত কাজ নিয়ে। সত্যি অনিদা তোমায় কোনও দিন দেখিনি। তোমার কথা শুনেছি। আর কল্পনায় তোমাকে দেখার চেষ্টা করেছি।

তোমার কল্পনার সঙ্গে অনিদার মিল খুঁজে পাচ্ছ?

না।

কেন?

তুমি এ্যাত্তো বড় লোক। আর এখন….

এখন?

তুমি আমাদের থেকেও সাধারণ।

তাই।

আজ যত দেখেছি তোমাকে, ততো অবাক হয়েছি।

নীপা।

উঁ।

তোমার কোলে একটু মাথা রাখব?

রাখো।

মনে কিছু করবে না?

ধ্যাত। আমার সৌভাগ্য।

কেন!

আমার বন্ধুগুলোকে দেখছিলে তখন?

হ্যাঁ।

ওদের দেখে তুমি কিছু বোঝোনি?

না!

সত্যি অনিদা তুমি যে কি।

আমি মানুষ।

আমি তাই বলেছি নাকি।

তাহলে।

তুমি চাইলে এখুনি সকলকে পেতে পার।

কি ভাবে।

যে ভাবে চাইবে।

হ্যাঁ।

তোমাকে যদি চাই।

ধ্যাত।

আমি কি সিনেমা আর্টিস্ট।

তা নয়, তবে আমাদের কাছে তুমি তাদের থেকেও অনেক বেশি।

আমি নীপার কোলে মাথা রাখলাম। ওর শরু শরু নরম আঙুলের স্পর্শে আমার মাথা ব্যাথা অনেকটাই সেরে গেছে। অনুভব করলাম নীপা ভেতরে কিছু পরেনি। হাত দুটো দিয়ে নীপাকে একটু কাছে টেনে নিলাম। না ওর কোনও সংকোচ নেই। ও আন ইজি ফিল করছে না।

ওর বুকটা আমার ঠোঁটের খুব কাছে। আমি চোখ বন্ধ করে আছি। নীপা গড় গড় করে ওদের কথা বলছে। কবে ওরা এখানে এসেছে, কেন এসেছে, এই সব। আমি চোখ বন্ধ করে শুনে যাচ্ছি। সবেতেই আমি জড়িয়ে আছি।

এটুকু বুঝলাম, নীপা ক্লাস এইটে যখন পড়ে তখন ওর মা ওকে নিয়ে চলে আসে। তারপর থেকে ওরা এখানেই আছে। নীপার বাবা ভালো নয়, সে কোন এক মহিলার সঙ্গে চলে গেছেন। এখন কাকা-কাকিমার দেখভালের দায়িত্ব ওদের। কাকা-কাকীও ওদের ওপর ভীষণ ভাবে নির্ভরশীল।

নীপা?

উঁ।

যাও এবার শুয়ে পরো।

আর একটু তোমার সঙ্গে গল্প করি।

আমি কিছু বললাম না। ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। নীপার হাতের স্পর্শে ওর শরীরের ওমে আমার চোখ জুড়িয়ে আসছে।

নীপা?

উঁ।

আমি যখন এলাম, তখন আমাকে দেখে ওরকম দৌড়ে চলে গেলে কেন?

ভয় পেয়েছিলাম।

আমি বাঘ না ভাল্লুক?

তুমি বাঘও না ভাল্লুকও না, তবে একজন অপরিচিত….।

এখন?

তুমি আমার। সম্পূর্ণ আমার।

হাসলাম।

বুঝতে পারছি নীপা আমার দিকে হাপুস নয়নে চেয়ে আছে। আমার চোখ বন্ধ। তবু আমি ওর মুখটা দেখতে পাচ্ছি। টিনএজে আমারও অনেক স্বপ্ন ছিল। মনে পোষণ করে রেখেছিলাম। আজ সেই সব স্বপ্ন স্বার্থক করে তোলার চেষ্টা করছি। নীপার অনেক প্রশ্ন, হয়তো তার কিছুটা আমি উত্তর দিতে পারবো। বাকিটা পারবো না।

সাতপাঁচ নানা কথা ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। হঠাত একটা অদ্ভূত স্বপ্নে ঘুমটা ভেঙে গেল। কেউ যেন আমার গলা চেপে ধরেছে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। হাত পা কেমন যেন অসাড় হয়ে গেছে।

চোখ মেলে তাকালাম, ঘরটা ঘুট ঘুটে অন্ধকার। কেরসিনের ডিম লাইটটাও নিভে গেছে। আমি নরতে চরতে পারছি না। কেউ যেন আমাকে আষ্টে পৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আছে। আমি নড়াচড়া না করেই বুঝতে চেষ্টা করলাম।

একটা কোমল শরীরের স্পর্শ অনুভব করলাম। কাল রাতে নীপার কোলে মাথা রেখে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। নীপা কোথায়?

নীপা আমাকে পাশ বালিশের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে জাপ্টে ধরে শুয়ে আছে। ওর মুখ আমার কাঁধের কাছে। ওর উষ্ণ নিঃশ্বাস আমার কানের লতিকে আরো উষ্ণ করে তুলছে। হাতটা আমার বুকের ওপর, ডানপাটা আমার পায়ের ওপর, ওর ভারী বুক আমার শরীর স্পর্শ করে আছে। নরম বুকের ছোঁয়ায় আমি স্নাত। মাথার ওপর জানলাটা খোলা।

ঝিরঝিরে বাতাস ঘরে এসে আছড়ে পড়ছে। চাঁদ মধ্য গগনে। অন্ধকারেও আলোর রেখা দেখতে পেলাম। আস্তে আস্তে ঘরের সমস্ত অংশ পরিষ্কার হয়ে এলো। আমি নীপাকে খুব সন্তর্পণে আমার শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করলাম। বালিশটা ওর মাথার তলায় গুঁজে দিলাম।

খাট থেকে নেমে জলের জগ থেকে একটু জল খেলাম। মিটসেফের ওপরে রাখা সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বার করলাম। আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে বাইরের বারন্দায় এলাম।

সিগারেট ধরালাম। চারিদিক নিস্তব্ধ, চাঁদের আলো গাছের পাতার ওপর রুপোর মতো গলে গলে পরছে। ঝিঁ ঝিঁ পোকার একটানা তারস্বর চিত্কার। পরিবেশটাকে স্বপ্নিল করে তুলেছে। আমি নিজের মধ্যে নিজে হারিয়ে গেলাম।

হঠাৎ আমার স্বপ্নভঙ্গ হলো। কেউ যেন আমাকে পেছন থেকে এসে জাপ্টে ধরেছে, তার নরম বুক আমার পিঠ স্পর্শ করেছে, ঠোঁট দুটো ছবি আঁকছে আমার ঘারের কাছে। আমি হাতদুটো আলগা করে, তার সামনা সামনি হলাম।

নীপা!

এ নীপাকে আমি চিনি না জানি না, ওর চোখের রং বদলে গেছে।

নীপার ঠোঁটদুটো আমার ঠোঁটের খুব কাছে। ওর সুডৌল বুক আমার বুকে আছড়ে পরেছে। থিরি থিরি কাঁপছে ঠোঁট দুটি।

আমি নীপাকে আস্তে আস্তে আমার শরীর থেকে মুক্ত করলাম। ওর মুখটা তুলে ধরে আস্তে করে বললাম, না নীপা না। নীপা আমার হাতদুটো ছিটকে সরিয়ে দিয়ে জাপ্টে ধরলো। আমার ভেতর একটা অস্বস্তি খেলা করে যাচ্ছে। প্রাণপনে নীপাকে ছাড়াবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ নীপা ডুকরে কেঁদে উঠলো। চারদিকে জ্যোৎস্না স্নাত রাত, কোথাও একটা মোরোগ ডেকে উঠলো কঁ কঁকর কঁ।

চলবে —————————



from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/lxctd1T
via BanglaChoti

Comments