কাজলদিঘী
BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রথম কিস্তি
—————————
সকালে ঘুম থেকে উঠতে বেশ দেরি হলো। অফিসে জরুরি কাজ আছে। অমিতাভদা বলেছিলেন একটু তাড়াতাড়ি অফিসে আসিস, তোকে একটা জায়গায় পাঠাব।
দূর—চেষ্টা করেও উঠতে পারলাম না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আমার মুখ শুকিয়ে গেল।
এগারোটা!
আজ নির্ঘাত আমার কপালে ঝাড় লেখা আছে।
মোবাইলটা বালিশের তলা থেকে বার করে বড়োমাকে ফোন করলাম।
বেশ কিছুক্ষণ রিং বাজার পর বড়োমা ধরলো।
হ্যালো।
বড়োমা।
কিরে! কি হয়েছে?
কিছু না, তুমি কি করছো।
কেনো, বল।
একটু দাদাকে….।
তুই অফিসে যাসনি?
রাতে শুতে দেরি হয়ে গেল।
হায় হায়।
কেন গো!
তোর দাদা সেই সাত সকালে দুটো কচুরি আর চা খেয়ে চলে গেছে।
খেয়েছে। কপালে আজ দুঃখ আছে বুঝলে।
তোর নাকি কোথায় যাওয়ার কথা?
হ্যাঁ।
তোকে ফোন করেনি?
করেছিল হয়তো। আমি তো ফোন বন্ধ করে রাখি।
ভালো করেছিস। বড়োমার গলায় স্নেহের সুর।
তাড়াহুড়ো করিস না, ধীরে সুস্থে যা, আমি ফোন করে বলে দিচ্ছি।
সত্যি!
সব সময় হুকুম করলেই যেতে হবে নাকি।
এই জন্যই তোমাকে ফোন করলাম।
সে-কি আমি বুঝিনা।
যা তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়ে চান করে নে, খালি পেটে যাবি না, কিছু খেয়ে নিস। আমি দুপুরের খাবার পাঠিয়ে দেবো।
ঠিক আছে।
ফোনটা রেখেই বাথরুমে দৌড় দিলাম।
পরি-কি-মরি করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রেডি হয়ে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এলাম।
ঘড়ির দিকে তাকালাম, ১১ টা বেজে গেছে। সাড়ে-নটার মধ্যে অফিসে পৌঁছনোর কথা। কি আর করা যাবে।
আজ আর বাস নয়, গড়িয়াহাটের মুখ থেকে একটা ট্যাক্সি ধরে সোজা অফিস।
অফিসে ঢুকতেই রিসেপসনিস্ট ভদ্রমহিলা আমার দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে একবার মুচকি হাসলেন, আমিও হাসলাম। ভদ্রমহিলা বেশ খলবলি।
আমার মতো ফচকে সাংবাদিকরা কম-বেশি সকলেই দিনান্তে একবার ভদ্রমহিলার টাইট শরীরটার দিকে একবার নয় একবার লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকাবেই।
বিবাহিত, তবু শুনেছি এ্যাড-ডিপার্টমেন্টের কার সঙ্গে যেন একটু ইন্টুমিন্টু আছে। মরগে যাক…।
লিফটের সামনে এসে দাঁড়াতেই আমাদের হাউসের সিনিয়ার ফটোগ্রাফার অশোকদা বললেন, এই অনি তোকে অমিতাভদা খুঁজছিলেন। আমি হুঁ বলে লিফটের মধ্যে সেঁদিয়ে গেলাম। হু হু করে লিফট ওপরে উঠে এলো।
লিফট থেকে নেমেই একবার দু-পাশটা ভালো করে দেখে নিলাম।
না ফ্লোরে কাউকে দেখলাম না। শুনশান।
একবার দাদার ঘরের দিকে উঁকি মারলাম। হরিদা চেয়ারে বসে ঝিমুচ্ছে।
নিউজরুমে ঢুকতেই মল্লিকদা চেঁচিয়ে উঠলো, কি হে বৎস আজ মনে হয় একটু বেশি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। যান আপনার জন্য সমন অপেক্ষা করে আছে। আগে গিয়ে একটু মুখটা দেখিয়ে আসুন। তারপর না হয় মুখে চোখে জল দেবেন।
মল্লিকদা, প্লিজ, আজকের দিনটা একটু বাঁচিয়ে দাও, আর কোনওদিন…।
হ তা ঠিক। ফানদে পরলে মল্লিকদা। আর কচিগুলানরে নিয়ে যখন ঘোরাঘুরি করো। তখন মল্লিকদার কথা মনে পড়ে না।
আচ্ছা আচ্ছা এরপর তোমায় ভাগ দেব। তবে শর্ত একটা ছোটোমার পার্মিশন নিয়ে।
এই তো আবার ঘুটি বসালি।
ঠিক আছে, ছোটোমাকে বলবোনা, দাদাকে একটা ফোন করে দাও। আমি এসে গেছি।
মল্লিকদা আমার কথা রাখলো।
মল্লিকদা টেবিলের ওপর রাখা ফোনটা তুলে ডায়াল করলো। কি কথা হলো বুঝতে পারলাম না। খালি হুঁ-হাঁ করে ছেড়ে দিল।
ফোন রেখে মুখ তুলে বললো, যে কাজে তোমার যাওয়ার কথা ছিল তা হয়ে গেছে। আর একটি গুরু দায়িত্ব তোমার প্রতি অর্পন করা হবে। তুমি এখন এডিটর রুমে যেতে পার।
আবার কি গো!
গেলেই জানতে পারবে।
ঠিক আছে। একটু জল খেয়ে নিই।
অমিতাভদা থাকে ট্রাঙ্গুলার পার্কে আর আমি থাকি গড়িয়া হাটের কাছে অফিসের ফল্যাটে।
যতদূর জানি, মল্লিকদা থাকে যাদবপুরে। তবে বেশির ভাগ সময়েই দু-জনে বড়োমার কাছে এসেই থাকে। মল্লিকদা, অমিতাভদা হরিহর আত্মা। বড়োমা, ছোটোমা একে অপরের পরিপূরক। এই রসায়ণটা আমি এখনও ঠিক মতো বুঝে উঠতে পারিনি।
আমার প্রত্যেকদিনের ডিউটি, অফিস থেকে ফেরার পথে কিংবা আসার আগে একবার বড়োমার সঙ্গে দেখা করে আসতে হবে। কলকাতার বাইরে না গেলে শনি, রবি দু-রাত আমাকে ওখানে সবার সঙ্গে কাটাতে হবে। এটা একটা অলিখিত অনুশাসন। নাহলে আমার বিপদ আছে। আমি বিগত ছ-বছর ধরে এই অভ্যাস পালন করে আসছি।
অমিতাভদার স্ত্রী যেমন আমার বড়োমা, তেমনি মল্লিকদার স্ত্রী আমার ছোটোমা।
ইউনিভার্সিটিতে জার্নালিজম নিয়ে পড়া চলাকালীন, এই অফিসের সঙ্গে আমার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আমার কলেজের স্যার শুভঙ্করবাবু এই সুযোগটা করে দিয়েছিলেন। তারপর একদিন অমিতাভদার আনুকূল্যে এই অফিসে চাকরি জোটে, বাড়িতে স্থান পাই। কিন্তু সেই সুখ আমার কপালে বেশিদিন টেকেনি। আবার আমি একা।
তবে বড়োমার কড়া হুকুম। যেখানেই থাকো দিনান্তে একবার মুখ দেখাতে হবে। নাহলে লঙ্কাকান্ড। এই মুহূর্ত পর্যন্ত সেই অলিখিত নিয়ম মনে চলি।
হরিদা অমিতভদার খাস বেয়ারা। প্রায় অমিতাভদারই বয়সী।
গেটের সামনে বসে তখনও মাথা নিচু করে ঝিমচ্ছিল, কাছে গিয়ে আমি একটা ঠেলা মারতেই চোখ খুলে বললো, কি হলো আবার?
সাহেব ভেতরে?
হ্যাঁ। তুমি কোথায় ছিলে এতক্ষন? হরিদার গলায় ধমকের সুর।
কেন!
তোমার আজ হিসেব হবে।
সে আর কি করবো, কপালে থাকলে হবে।
হরিদা আমার দিকে কটকট করে তাকিয়ে।
এই হাউসে আমার নামের পাশে একটা উপাধি আছে। একনম্বরের বখাটে সাংবাদিক।
কেউ কেউ আবার টিজ করে বলে, এডিটরের কোলের ছেলে। আমার থেকেও অনেক সিনিয়ার সাংবাদিক থাকা সত্ত্বেও অমিতাভদা আমাকে একটু বেশি ট্রাস্ট করে। প্রশ্রয়ও দেয়।
ফলে যা হয় আমার সঙ্গে সবার সম্পর্ক খুব একটা মধু মধু নয়।
আমার খুঁটির জোর এই হাউসে একটু বেশি, তাই পেছনে সবাই কপচালেও সামনে কেউ টেঁ-ফুঁ করে না। দেঁতো হাসি হেসে সু-সম্পর্কের ভান করে। পেছনে ছুড়ি চালায়।
তবে হ্যাঁ, আমি আমার দায়িত্ব সম্বন্ধে ভীষণ ভাবে সচেতন। সেখানে কেউ দাঁত ফোটাতে পারে না। আমার কাছে অফিস মানে, আমার দ্বিতীয় ঘর।
আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি।
তোর খুব মজা, তাই না? হরিদা খেঁকিয়ে উঠলো।
হাসলাম।
যা ভেতরে যা।
দরজা খুলে ভেতরে এলাম। একরাস ঠাণ্ডা বাতাস আমার সারাটা শরীর মনকে গ্রাস করলো। দেখলাম একটা চেয়ার দখল করে বসে আছেন আমাদের এ্যাড-ডিপার্টমেন্টের চিফ চম্পকদা। আর একটিতে চিফ রিপোর্টার সুনিতদা।
আমাকে ভেতরে আসতে দেখেই চম্পকদা বলে উঠলেন, এই তো ছোটোসাহেব চলে এসেছেন। কি বাবা ঘুমিয়ে পরেছিলে? এমন ভাবে কথা বললেন, আমার মাথা নত হয়ে গেল।
চম্পকদার প্রতিটা কথার মধ্যে শ্লেষ ঝড়ে পরছে। কানে বেশ খটকা লাগলো কথাটা।
আমার জন্য অমিতাভদাকে এরা এই ভাবে প্রায়ই টিজ করে কথা বলে। তবে দাদা কোনওদিন গায়ে মাখে না। এই হাউসের সবচেয়ে সিনিয়ার মানুষ। সেই কারণে সকলে সম্মান, সমীহ দুই-ই করে।
যার যা সমস্যা দাদ ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে কথা বলে মিটিয়ে দেয়।
সুনিতদা আবার একটু বেশি ফরফর করে। অল্পবিদ্যে ভয়ঙ্করী। শোনা কথা, উনি নাকি খাস ম্যানেজমেন্টের আত্মীয়। সেই জন্য একটু হামবড়াক্কি ভাব সব সময়। এক কথায় সবজান্তা বাঙালি।
পলিটিকস এই হাউসে আছে। সেটা চূড়ান্ত। তবে ওপর থেকে কেউ বুঝতে পারে না।
এক এক মালিকের এক একটা লবি। আমি সব জানি, কিন্তু বোবার শত্রু নেই।
মনে মনে জানি, আমার ভগবান দাদা। দাদার চাকরি নট, আমারও নট। তবে এ টুকু নিজের ওপর বিশ্বাস আছে, কলমের জোরে কলকাতা শহরের যে কোনও কাগজে একটা চাকরি জোগাড় করে নিতে পারবো।
আমি ধীর পায়ে টেবিলটার দিকে এগিয়ে গেলাম।
অমিতাভদা, এবার ওর একটা বিয়ে দেবার ব্যবস্থা করুণ। অনেক নামডাক হয়েছে। হাউস থেকে টাকা পয়সাও খুব একটা কম পায় না। দেখবেন বিয়ের পিঁড়িতে বসলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
অমিতাভদা মুচকি হসে বললো।
ওর বড়োমাকে কয়েকদিন আগে বলছিলাম। তা বাবু বলে এসেছেন, বিয়ের নাম ধরলেই ওই বাড়িতে আর পদার্পন করবেন না। উনি সন্ন্যাস নেবেন।
সকলে হেসে উঠল।
আয় বোস।
আমি একটা চেয়ারে জড়ো-সড়ো হয়ে বসলাম।
তোর বড়োমা ফোন করেছিল, ঘুম থেকে উঠেই চলে এসেছিস।
বোবার শত্রু নেই। আমি মুখে কুলুপ এটেছি।
খাওয়া দাওয়া করেছিস?
মাথা দোলালাম। না।
সঙ্গে সঙ্গে বেলের দিকে হাত চলে গেলো।
এখন একটু চা-টোস্ট খেয়ে নে। তারপর কয়েকটা কপি লিখে দিয়ে বাড়ি চলে যা। তোর বড়োমাকে বলা আছে। আজ তোকে ভাইজ্যাক যেতে হবে, ইলেকসন কভারেজ। দিন পনেরো থাকতে হবে। সেইরকম ভাবে গোছগাছ করে নিস। ওখানে তোর সমস্ত ব্যবস্থা করা থাকবে। সাড়ে সাতটায় ট্রেন।
দাদা রাজধানী এক্সপ্রেসেরে মতো কথা বলে গেলো।
মাথায় রাখিস, ঘুমিয়ে পরিস না। চম্পকদা বললো।
আমি মুখ নিচু করে আছি।
অমিতাভদা আমার পিতৃতুল্য, মুখের ওপর কোনওদিন কথা বলিনি।
ঘুমটা একটু কমা। অতো রাত জেগে পড়াশুনা করতে তোকে কে বলে।
দাদ একটু থামলেন।
টেবিলের ওপর রাখা জলের গ্লাস থেকে এক চুমুক জল খেয়ে, গ্লাসটা টেবিলে রেখে, আস্তে করে বললেন।
যতদিন আমার বাড়িতে ছিলি, ঠিক ছিলি। যে দিন থেকে ওই ফল্যাটে গেছিস, বাউন্ডুলে জীবন-যাপন শুরু করে দিয়েছিস। আমার কাছে সব খবর আসে।
কোনও প্রকারে চা টোস্ট খেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। খেলাম না, যেন গিললাম।
বেরবার আগে দাদার ঘড়ের দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম বারটা বেজে গেছে।
ঘরের বাইরে আসতেই হরিদা কট কট করে উঠলো।
পিঠে কিছু পরলো।
না।
মোবাইলটা বেজে উঠল।
হাতে নিয়ে দেখলাম, তনুর ফোন।
কানে ধরতেই খিল খিল করে গা জালানো হাসি।
কি সাহেব, টিকিট হাতে ধরিয়ে দিয়েছে।
কিসের টিকিট?
ভাইজ্যাকের।
না। ধরাবে।
তুমি কি এখন অফিসে, না বাড়ির দিকে রওনা দিচ্ছ?
এই মাত্র অমিতাভদার ঘর থেকে বেরোলাম। এখনও নিউজরুমে যাইনি। দাদার ঘরের সামনেই দাঁড়িয়ে আছি।
আমি কালীঘাটে। ফল্যাটে গিয়ে একটা মিস কল মেরো, তুমি তো আর ফোন করবে না।
আমার যাবার ব্যাপার তুমি জানলে কি করে?
আরে বাবা, তুমি হচ্ছ সুপার বসের পোষ্য পুত্র বলে কথা। তোমার প্রতি কতজনের বাঁকা নজর আছে তা জান? হাঁদারাম।
ফোনটা কেটে দিলাম।
তনু আমার জীবনের একটা মাইলস্টোন। এই অফিসে আমার প্রথম ঘনিষ্ঠ মেয়ে বন্ধু। আমার জানার বাইরেও অফিশিয়াল এটিকেট ওর কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। আর একজন সন্দীপ। এছাড়া, অফিসে কারুর সঙ্গে আমার সেরকম কোনও একটা সম্পর্ক নেই। আমার তরফ থেকেও রাখার কোনও উৎসাহ অনুভব করিনি। যে দু-চারজনের সঙ্গে সম্পর্ক আছে, তার মধ্যে তনু একজন। আর একজন সন্দীপ।
বড়োমাকে ফোন করলাম। হ্যোলো বলার আগেই বড়োমা তরবর করে উঠলো।
হ্যাঁ বল। সব শুনেছি। তোকে একেবারে গরুর মতো খাটিয়ে মারলে। দাঁড়া আজ আসুক। দেখাচ্ছি মজা। তোদের অফিসে তুই ছাড়া কি আর কাজের লোক কেউ নেই।
তুমি বলো।
তুই কখন আসছিস?
পাঁচটার সময় যাবো।
কেন?
অফিসে কয়েকটা কাজ আছে। একবার ফল্যাটে যাব, তারপর তোমার কাছে।
কি খাবি?
তোমার কাছে গিয়ে ভাত খাব। ছোটোমাকে একবার আসতে বলবে।
ঠিক আছে।
নিউজরুমে আসতেই মল্লিকদা বললো, পেরাইভেট টক হলো?
মল্লিকদার দিকে কটকট করে তাকালাম।
মুখটা ওরকম বাংলার পাঁচ কেন বাবা।
ভালো লাগে বলো। এই দু-দিন আগে ফিরলাম। আজই বলে, তোকে যেতে হবে।
হক কথার এক কথা। আমি একটা কথা বলি।
আমি মল্লিকদার মুখের দিকে তাকালাম। নিশ্চই কোনও বদ বুদ্ধি আছে।
দুই-একটা আর্টিকেল খারাপ কইরা লেইখা দে। ব্যাশ কেল্লা ফতে।
তোমার সব তোলা থাকছে, ঠিক জায়গায় নালিশ হবে মনে রেখো।
এই দেখো গরম খাইলি।
কি আছে দাও, তাড়াতাড়ি লিখে দিয়ে কেটে পরি।
ওই মায়াটার লগে….।
মল্লিকদার দিকে কটকট করে তাকালাম।
ঠিক আছে। ঠিক আছে। তুমি এখন আইতে পার।
আমিতাভদা বললো কি কাজ আছে।
ছিল ডিস্ট্রিবিউট হয়ে গেছে।
চলে যাব?
হ্যাঁ। কবে আসা হচ্ছে?
দিন পনেরোর জন্য যেতে হবে।
ও।
আসি।
যাও, বিকেলে দেখা হবে।
নিউজরুম থেকে বেরোতেই হরিদার সঙ্গে ধাক্কা লাগলো।
কোথায় যাওয়া হচ্ছে?
কেন!
বাবু একবার ডাকছেন।
আবার কি হলো?
আমি কেমন করে জানবো।
হরিদাকে পাশ কাটিয়ে এডিটর রুমে ঢুকতেই দেখলাম, অমিতাভদা একা একা বসে আমাদের হাউসের আজকের কাগজটা পড়ছে। আমাকে দেখেই মুখটা তুললো। একটু আগে যারা ছিল তারা সবাই বেরিয়ে গেছে। আমাকে বললো তুই বোস, তোর সঙ্গে একটু দরকার আছে।
একটু অবাক হলাম। আমার সঙ্গে আবার কিসের গোপন বৈঠক!
সরাসরি মুখের দিকে তাকালাম। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো একটু চা খাবি?
মুডটা খুব একটা ভালো বুঝলাম না। দাদাকে এরকম দেখলে মনটা খারাপ হয়ে যায়। মাঝে মাঝে মনে হয় ক্ষমতা যদি কোনওদিন পাই, যাদের জন্য দাদার আজ এই চাপ, তাদের একবার বুঝিয়ে দেব।
তারপর ভাবলাম আমার ধারনা হয়তো ভুলও হতে পারে।
মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিলাম।
দাদা বেল বাজিয়ে হরিদাকে চা আনতে বললো। আমি চুপচাপ বসে। দাদা কাগজে চোখ বোলাচ্ছে।
হরিদা দু-কাপ চা দিয়ে গেল। চায়ে চুমুক দিয়ে দাদা বললো।
তোর কোনও তাড়াহুরো নেই তো?
দাদার চোখে চোখ রেখে মুখটা পড়ার চেষ্টা করলাম।
তার মানে দাদা অনেকক্ষণ ধরে কথা বলতে চায়! তাহলে কি তনুর ব্যাপার নিয়ে?
মনে মনে ভাবলাম সত্যি সত্যি আজ কপালে আমার দুঃখ আছে। দাদা নিশ্চই তনুর ব্যাপারটা নিয়ে ভুল ভেবেছে, অথবা দাদাকে কেউ রং ইনফর্মেশন দিয়েছে। কে জানাল ব্যাপারটা?
তনু নিশ্চই নয়। তাহলে!
আবার ভাবলাম, গতকাল যে লেখাটা জমা দিলাম, সেই লেখার ব্যাপারে কিছু?
চায়ের কাপে দীর্ঘ চুমুক দিয়ে আমাকে বললো, তুই সংঘমিত্রা ব্যানার্জ্জীকে চিনিস?
দাদার মুখে নামটা শুনে চমকে উঠলাম। কেউ যেন আমার গালে সজোরে একটা থাপ্পর কষালো। এই নামটা দাদা জানল কি করে!
মিত্রার কথা ছোটোমা ছাড়া কারুর জানার কথা নয়। এইসব ব্যাপারে ছোটোমা আমার বন্ধু। দাদা, বড়োমা, মল্লিকদার সাথে কোনওদিন এই ব্যাপার নিয়ে আলোচনা হয়নি। ছোটোমা, বড়োমাকে বলে থাকলে আলাদা কথা। ছোটোমা কি তাহলে দাদার কানে কথাটা তুলেছে? আমি অমিতাভদার চোখে চোখ রেখে কিছু বোঝার চেষ্টা করলাম।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললাম, চিনি। কেনো?
সেদিন ফোন করে তোর কথা জিজ্ঞাসা করছিল। তুই শিলিগুড়িতে ছিলি। আমাকে তোর ফোন নম্বর জিজ্ঞাসা করলো। আমি বলতে পারলাম না। সত্যি তোর ফোন নম্বর আমার কাছে নেই। তোর বড়োমা কিংবা ছোটোমার কাছ থেকে নিয়ে দিতে পারতাম। দিইনি।
আর কি বললো?
না, সেরকম কিছু নয়। অমিতাভদা কথাটা বলে আমার চোখে চোখ রেখে থেমে গেল।
তোর বড়োমা জানে?
বলতে পারবো না।
ওর সঙ্গে যে তোর পরিচয় আছে, আগে কখনও আমাকে বলিসনি?
ও কে, যে ওর কথা তোমাদের বলতে হবে?
নিজের কানে নিজের গলাটা কর্কশ শোনাল।
আরি বাবা! বলিস কি, ওর জন্যই তো আমরা দু-টো খেয়ে-পরে বেঁচে আছি।
তার মানে!
আরে পাগল ও আমাদের এই কাগজ কোম্পানীর অনেকটা শেয়ার হোল্ড করে আছে। আমার মালিক। তোরও মালিক।
মাথাটা বারুদের মতো গরম হয়ে গেল। চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে।
আমি সরাসরি অমিতাভদার চোখে চোখ রাখলাম।
আর কি বলেছে?
না, আর কিছু নয়। বললো তুই এখানে কার সোর্সে এসেছিস। তোকে কে রিক্রুট করেছে। কতদিন আছিস। এই সব।
তুমি কি বললে?
আমি বললাম তুই শুভঙ্করের থ্রু দিয়ে এসেছিস। শুভঙ্কর আমার বন্ধু। তা দেখলাম ও শুভঙ্করকেও চেনে।
আর কি বললো?
বাবাঃ, তুই আমাকে এ ভাবে জেরা করছিস কেন? আমি তোকে জিজ্ঞাসা করলাম….।
ব্যাপারটা যখন আমাকে নিয়ে তখন আমাকে ভালো করে জানতে হবে।
অমিতাভদা আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।
জানে, আমি ভীষণ হুইমজিক্যাল। আমাকে এই মুহূর্তগুলোয় একমাত্র কন্ট্রোল করতে পারে বড়োমা। বড়োমা ছাড়া আমি কাউকে এই পৃথিবীতে পাত্তা দিই না। এরকম একবার হয়েছিল। একটা লেখা নিয়ে আমার সঙ্গে অমিতাভদার মনোমালিন্য হয়েছিল। আমি বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিলাম। এমনকি রিজাইন দেবারও মনস্থির করেছিলাম। সে যাত্রায় বড়োমা শিখন্ডী হয়ে সব সামাল দিয়েছিল। অমিতাভদা ঐ ব্যাপারটা ভালো করে জানে।
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। সংঘমিত্রা আমার ক্লাশমেট। একই ডিপার্টমেন্ট। কলেজের বন্ধু। আমরা একসঙ্গে পড়াশুনা করেছি। শুভঙ্করবাবুর কাছেও একসঙ্গে পড়েছি। এর বেশি কিছু জানতে চাইবে না।
ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। পেছন ফিরে তাকাইনি। সোজা লিফটের কাছে চলে এলাম। দেখলাম লিফট এখন গ্রাউন্ড ফ্লোরে রয়েছে। সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে নীচে নেমে এলাম।
মনটা ভীষণ খারাপ লাগছে। মিত্রা শেষ পর্যন্ত এখানে ফোন করল কেন? ও এই হাউসের মালিক, এইটা বোঝাতেই কি অমিতাভদাকে ফোন করে আমার কথা জিজ্ঞাসা করলো। না অন্য কোনও অনুসন্ধিৎসা।
পায়ে পায়ে বাসস্ট্যান্ডে এলাম। নানা কথা মাথার ভেতর কিলবিল করছে। কেমন যেন একটা লাগছে। ভীষণ খিদে লেগেছে। পেটে ছুঁচো ডন-বৈটকি মারছে। ফ্যাটমামির চাউমিন কারখানাতে ঢুকলাম। অফিসের পাশে বলে প্রায়ই এখানে আসা হয়।
আমাদের অফিসের কেউ এখানে আসে না। এখানে বসে খেলে অফিসের এটিকেট বজায় রাখা যায় না। ওরা আনন্দ রেস্টুরেন্টে যায়। এয়ারকন্ডিশন রুমের হাওয়া খেয়ে খাবর খায়।
আমরা কলেজ লাইফে বন্ধুরা দঙ্গল বেঁধে এখানে আসতাম। যদিও আমার স্পনসরার ছিল। ফ্যাটমামি চাউমিনটা দারুন বানায়। ঘন ঘন আসা হয় বলে সবাই চেনে জানে।
ঘড়ির দিকে তাকালাম। ১টা বাজে। তনু বলেছিল একবার ফোন করতে। বাচ্চাটা কাছে এসে দাঁড়াল। বললাম একপ্লেট চাউমিন আনতে। ফোনটা বেজে উঠল। পকেট থেকে বার করে দেখলাম বড়োমার নম্বর। তারমানে আমার বেগতিক অবস্থার খবর এরই মধ্যে পৌঁছে গেছে। একবার ভাবলাম ধরবো না। তারপর ভাবলাম না থাক।
বলো কি হয়েছে। তোমায় তো বললাম পাঁচটার সময় যাব।
তুই এখন কোথায়?
চাউমিন খাচ্ছি।
ঠিক আছে। পারলে একটু তাড়াতাড়ি আসিস, কথা আছে।
কি কথা?
কেন তুই জানিস না।
আচ্ছা।
চাউমিন খেয়ে একটা ট্যাক্সি ধরে সোজা ফল্যাটে চলে এলাম।
আমার ঘর-দোর আমার মতোই উশৃঙ্খল। কতদিন বিছানা ভাঁজ করিনি মনে নেই।
জামাকাপড় খুললাম। পাখাটা হাল্কা করে খুলে নেংটো হয়ে পাখার তলায় দাঁড়ালাম।
আঃ কি আরাম। মনটা খারাপ লাগছে। শেষ মুহূর্তে অমিতাভদার সঙ্গে ওইরকম ব্যবহার করা উচিত হয়নি। যত রাগ গিয়ে পরছে মিত্রার ওপর। আগে ঘুরে আসি, তারপর ওর সঙ্গে যদি মুখো মুখি হই….।
কেউ আমার দুর্বল জায়গায় আঘাত করলে আমি স্থির থাকতে পারি না। ভীষণভাবে প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে উঠি। প্রতিশোধ না নেওয়া পর্যন্ত নিজের অশান্ত মনকে কিছুতেই শান্ত করতে পারি না।
কি আর করা যাবে। মিত্রার সঙ্গে দেখা হলে ওকে জিজ্ঞাসা করতে হবে, কেন ও অমিতাভদাকে এই ভাবে ক্রস করেছে? ও যে এই হাউসের মালকিন সেটা কি অমিতাভদার মাধ্যমে আমাকে বোঝাতে চেয়েছে? যদি তাই হয় তাহলে আমার সঙ্গে সরাসরি কথা বললো না কেন?
কলকাতায় এখনও সেইভাবে শীত নেই। রাতের দিকে মাঝে মাঝে একটু ঠাণ্ডা লাগে। বেশিক্ষণ পাখার হাওয়া ভালো লাগে না। কেমন যেন শীত শীত করে।
বেলটা বেজে উঠল। ঝটপট বিছানা থেকে টাওয়েলটা টেনে নিয়ে কোনওপ্রকারে কোমড়ে জড়িয়ে নিলাম।
ভেতরের ঘর থেকে বাইরের ঘরে এলাম। দরজা খুলতেই একটা মিষ্টি গন্ধ আমার ঘ্রাণ শক্তিকে অবশ করলো। তনু সামনে দাঁড়িয়ে।
আজকে ও খুব একটা বেশি সাজেনি। হাল্কা মেকআপ করেছে। কপালে ছোট্ট একটা বিন্দির টিপ। চোখের কোলে হাল্কা কাজলের রেখা। শ্বেত করবীর ওপর যেন কালো বোলতা বসে আছে।
আমি একদৃষ্টে ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। ও মিটি মিটি হাসছে।
কি হলো, ভেতরে যেতে বলবে না, এখানে দাঁড়িয়ে ….।
সরি।
তনু ভেতরে এলো। ওর পরনে আজ টাইট জিনস। কোমরবন্ধনীর একটু ওপরে বেল্ট দিয়ে বাঁধা। ওপরে একটা শর্ট গেঞ্জি পরেছে। তনুকে আজ দারুন দেখতে লাগছে। কাগজের অফিসের মেয়েরা এরকমই সাজগোজ করে। তায় আবার ও চিত্র সাংবাদিক।
তনু পায়ে পায়ে ভেতরের ঘরে চলে এলো। কাঁধের ভারি ক্যামেরার ব্যাগটা খাটের ওপর নামিয়ে রাখলো।
কখন ফিরলে?
আধ ঘণ্টা।
তনু আমার দিকে তাকিয়ে আছে আমি তনুর দিকে।
এই তনুই একদিন মল্লিকদাকে নালিশ করেছিল। অনির সঙ্গে আমাকে এ্যাশাইনমেন্টে পাঠাবেন না। ওকে কেউ সাংবাদিক হিসাবে পাত্তাই দেয় না। এক কোনে গিয়ে ভেড়ুয়ার মতো চুপচাপ বসে থাকে। কারুর সঙ্গে আলাপ করতে চায় না।
বলে, কি হবে আলাপ করে। ওর জন্য আমার প্রেস্টিজ নষ্ট।
মল্লিকদা হাসতে হাসতে বলেছিল।
যাই করুক, ওর লেখাটার তারিফ কর, ওই লেখার সঙ্গে তোর ছবি। মাইলেজটা কোথায় বুঝতে পারছিস।
তনু নিজে থেকেই ব্যাপারটা রিয়েলাইজ করেছিল। যখন অনেকেই আমার লেখার ফটো এ্যাশাইনমেন্ট পাওয়ার জন্য মল্লিকদার কাছে হত্যে দিয়ে পরে থাকতো।
তারপর থেকে ও আমার বন্ধু হয়ে গেল।
কি ভাবছো? খাট থেকে ব্যাগটা নিয়ে ছোটো সেন্টার টেবিলে রাখলো।
আমি চুপচাপ।
কিছু খেয়েছো?
মাথা দুলিয়ে বললাম, হ্যাঁ চাউমিন।
জীবনে ওটা ছাড়া আর কিছু খেতে জান? খুব বেশি হলে ছেঁড়া পরোটা, জিলিপি।
আমি চুপ করে রইলাম।
এই ফল্যাটে ওর অবারিত দ্বার। ও ছাড়া এই ফল্যাটে আমার অফিসের দ্বিতীয় ব্যক্তির কোনও প্রবেশাধিকার এখনও পর্যন্ত হয়নি। তনু অগোছালো বিছানার দিকে তাকাল।
সত্যি তোমার দ্বারা আর কিছু হবে না। একটা ঢপ।
কেন!
একটু বিছানাটা পরিষ্কার করতে পারো না?
সময় কোথায়।
ঘুম থেকে উঠে করবে।
আমার দ্বারা হয় না। একটা মাসি ছিল। তা আমারই থাকার ঠিক নেই। মাসিকে রেখে কি করবো। বারন করে দিয়েছি।
বড়োমা কখনও এই ফল্যাটে এসেছেন?
না।
সেই জন্য।
তুমি ছাড়া দ্বিতীয় কেউ এখনও আসেনি।
সত্যি!
একবারে সত্যি।
আমি খুব লাকি বলো।
তা বলতে পারো।
তুমি অফিসের কাউকে নিয়ে আসো নি?
না।
তোমার এ্যাশাইনমেন্ট হয়ে গেছে?
হ্যাঁ। কয়েকটা ছবি তুলতে দিয়েছিল। তুলে নিলাম।
জমা দিয়ে দিয়েছো?
দিলেই তো আবার পাঠাবে।
তারমানে তুমি কাজে ফাঁকি দিয়ে আমার কাছে…।
ভালোলাগছে না। তোমার সঙ্গে গল্প করতে ইচ্ছে করছে।
আমি জানি তনু কেন আমার কাছে বারবার আসে। কিন্তু আমি ওর ডাকে সারা দিই না। আমাদের হাউসে তনুর মতো মেয়েদের লুটেপুটে খাওয়ার লোক প্রচুর আছে। সব হাউসেই থাকে। শুধু একটু চোখ মেলে তাকালেই হলো।
তনু আমার হাতের একবারে কাছে। চাইলেই ও আমার ডাকে সারা দেবে। আমি পারি না। কোথায় যেন বাধো বাধো ঠেকে। এটা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। অনেক ঘাটে জল খেয়েছি। তার চেয়ে বেশ আছি।
একটা জিনিস বারবার লক্ষ করেছি। আমি কোনও মেয়ের সঙ্গে একটু ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেছি। সে আমাকে সেক্স পার্টনার হওয়ার অফার দিয়েছে। বেশ সন্তর্পণে সেখান থেকে সরে এসেছি। জানিনা ঈশ্বর আমার শরীরটায় কি মধু মাখিয়ে রেখেছে।
কি ভাবছো?
কিছু না।
তুমি আমার সেই কথার উত্তর এখনও দিলে না।
কোন কথা?
দুজনে প্রথম যখন এ্যাশাইনমেন্ট নিয়ে বাইরে গেলাম। এক ঘরে থাকলাম। সেই সময় একটা কথা বলেছিলাম।
সত্যি বলবো তনু।
বলো।
একটা ভুল করেছিলাম। ক্ষণিকের জন্য। এরজন্য তোমার থেকেও আমি নিজেকে অনেক বেশি অনুতপ্ত মনে করি।
না। আমি তোমাকে একটু বেশি চেয়েছিলাম সেদিন।
তুমি চেয়েছিলে আমি সারা দিয়েছিলাম।
হ্যাঁ।
তারপর আমার ভুলের জন্য তোমার কাছে ক্ষমাও চেয়েছি।
হ্যাঁ।
যার বাপ-মার ঠিকানা নেই, তাকে তুমি ভালোবেসে কি করবে?
তনু মাথা নিচু করে রইল। বুঝতে পারছি। ওর চোখ দুটো খুব ভারি ভারি।
তনু।
উঁ।
আচ্ছা আমি তোমার খুব ভালো বন্ধু হতে পারি না।
তনু আমার দিকে তাকাল।
তুমি অন্য কারুর, এটা বলছোনা কেন?
বিশ্বাস করো। আমি কারুর নই। আমি একা। কারুর সঙ্গে আমি নিজেকে জড়াতে চাই না। আমাকে অফিসে দেখেছো। আমার কোনও ভালো বন্ধু নেই। তোমার আর সন্দীপের সঙ্গে যা একটু কথা বলি।
সন্দীপদার কাছে তোমার সম্বন্ধে অনেক কিছু জেনেছি।
জানিনা সন্দীপ তোমায় কি বলেছে। যে টুকু বলেছে…., আশা রাখি আমার সম্বন্ধে তোমার জানার চাহিদা মিটে গেছে।
তুমি এত ভালোছেলে, আমাদের হাউসে পরে আছো কেন।
এখনও ভালো সুযোগ পাইনি বলে। পেলে হয়তো চলে যাব। তাছাড়া দাদা-মল্লিকদাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না।
তোমায় আমি খুব বিরক্ত করি।
একবারে না। তুমি এলে ভালো লাগে। আমার কথা বলার কেউ নেই।
তনু আমার মুখের দিকে তাকাল। আমার কাছে এগিয়ে এল। আমার হাত দুটো ধরে বললো। আমি খুব হ্যাংলা তাই না।
মোটেই না।
তা হলে?
কি জানি।
তনু ঘণ্টা খানেক আমার কাছে থাকল। তারপর চলে গেল। যাওয়ার সময় ওর চোখের আর্তি আমার ভেতরটাকে ভীষণ ভাবে নাড়া দিয়ে গেল।
একবার ভাবলাম, মিত্রা আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। সেই জায়গায় তনুকে স্থান দিলে ক্ষতি কি? কিন্তু আমি যে মিত্রার কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম। ওকে ছাড়া আমি পৃথিবীতে কাউকে আমার জীবনে স্থান দেব না।
জামাকাপর পরে ব্যাগটা গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে এলাম। এইটুকু রাস্তা, ইচ্ছে করলনা বাসে যেতে। হাঁটতে হাঁটতে অমিতাভদার বাড়িতে চলে এলাম।
সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে।
গেটের মুখ থেকেই দেখলাম দাদা, মল্লিকদা বাইরের বারান্দায় পায়চারি করছে।
বড়োমাকে দেখলাম না। ছোটোমা আমাকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠল, ওই যে শ্রীমান এলেন এতক্ষণে।
অমিতাভদা পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে বললো, কি-রে শরীর খারাপ নাকি?
আমি মাথা দুলিয়ে বললাম, না।
চোখ মুখটা কেমন যেন লাগছে?
তুমি ভুল দেখছো।
মল্লিকদা বললো, কি বাবা আবার ঘুম?
আমি মল্লিকদার দিকে তাকিয়ে বললাম, ছোটোমাকে বলব নাকি সকালের ব্যাপারটা।
এই তো—আমাদের দুই কলিগের পার্শোনাল টক, সে তো অফিসেই হয়ে গেছে। আবার বাড়িতে কেন?
কিরে অনি, কি হয়েছে? ছোটোমা চেঁচিয়ে উঠলো।
আমি হেসেফেললাম। অফিসে এই ভদ্রলোকদ্বয়ের দাপট দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়। আর বাড়িতে ছোটোমা কিংবা বড়োমার কাছে অমিতাভদা, মল্লিকদা যেন কেঁদবাঘ।
বড়োমা ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো।
কিরে তোর কি হয়েছে! এত দেরি কেন?
কোথায় দেরি হয়েছে। তোমাকে বললাম পাঁচটা নাগাদ আসব, এসেছি সাড়ে পাঁচটা।
চল ভেতরে চল। সব গোছ গাছ করে নিয়েছিস। ছোটো একবার ওর ব্যাগ খুলে দেখে নে। সব ঠিক ঠাক নিয়েছে কিনা।
আমি ভেতরে এসে খাবার টেবিলে বসলাম। দেখলাম তিনজনের জায়গা হয়েছে।
বড়োমার দিকে তাকিয়ে বললাম, এখানে তিনজনের জায়গা দেখছি। আর দুজনের?
খেয়ে নিয়েছে। এখন আমি তুই আর ছোটো খাব।
তুমি কি আমার জন্য না খেয়ে বসে আছ?
বড়োমার চোখ ছল ছল করে উঠল। তুই খেতে চাইলি, তোকে না খাইয়ে খাই কি করে।
ছোটোমা?
তোর জন্য না খেয়ে বসে আছে।
শিগগির ডাকো, আমার ব্যাগ দেখতে হবে না। আমি সব ঠিক ঠিক গুছিয়ে নিয়েছি।
বড়োমা চেঁচিয়ে উঠল, ছোটো চলে আয়। আগে খেয়ে নিই, তারপর না হয় ওর ব্যাগ গুছিয়ে দিস।
একসঙ্গে তিনজন খেতে বসলাম।
বড়োমা আজ দারুন দারুন সব পদ রান্না করেছে। চিংড়ি মাছের মালাইকারি। ট্যাংরা মাছের ঝোল। ভাপা ইলিশ। নিঃশব্দে তিনজন খাচ্ছিলাম। আমি একটা ট্যাংরা মাছ বড়োমার পাতে তুলে দিলাম।
বড়োমা হেইহেই করে উঠল। আর একটা ইলিশ মাছ ছোটোমার পাতে তুলে দিলাম। ছোটোমা কপট গম্ভীর হয়ে বললো, অনি এটা কি হলো—সারাটা দুপুর ধরে আমরা দু-বোনে রান্না করলাম আর তুই যদি….।
আমার যতটা খাওয়ার আমি ঠিক নিয়ে নিয়েছি। বারতিটা তোমাদের দিলাম।
বড়োমা খেতে খেতেই বললো, হ্যাঁরে অনি দুপুরে কি হয়েছিল? তুই নাকি তোর দাদার সঙ্গে রাগারাগি করেছিস।
তোমায় কে বললো?
মল্লিক বললো।
আমি ছোটোমার মুখের দিকে তাকালাম।
ছোটোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক অনেকটা বন্ধুর মতো। অনেক কথাই ছোটোমার সঙ্গে হয়, যা বড়োমার সঙ্গে হয় না। তবে দু-জনকেই আমি ভীষণ ভালোবাসি।
বড়োমাকে আমি শ্রদ্ধাকরি। তাই বড়োমার কোনও কথায় আমি চট করে না বলতে পারি না। অনেক ভেবে চিনতে আমায় উত্তর দিতে হয়।
তুমি বড়োমাকে বলেছো নাকি? ছোটোমার দিকে তাকালাম।
কি!
তোমাকে একদিন গল্পের ছলে বলেছিলাম।
মিত্রার ব্যাপারটা?
হ্যাঁ।
আমি মাথা নিচু করে নিলাম।
তোর গুণের কথা দিদিকে বলবো না!
আজ ওই ব্যাপারটা নিয়ে একটা সমস্যা তৈরি হয়েছিল।
খেতে খেতে মাথা নিচু করেই কথা বলছিলাম।
কিছুক্ষণ সবাই নিঃশব্দ। খাবার থালায় হাপুস হুপুস শব্দ।
তুই জানিস না ও তোদের মালকিন? বড়োমা বললো।
জানতাম না। আজ জানলাম।
বড়োমা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
কয়েক মাস আগে ওর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল বেঙ্গল ক্লাবে। দাদা পাঠিয়েছিল।
কি জন্য?
একটা এ্যাশাইনমেন্টে গেছিলাম। দেখা হলো। ওর হাসবেন্ডের সঙ্গে আমায় আলাপ করিয়ে দিল। তারপর জোর করে ওর বাড়িতে টেনে নিয়ে গেল। অনেক রাত পর্যন্ত ওর বাড়িতে ছিলাম। সেদিন তোমার এখানে আসার কথা ছিল। আসা হয়নি। ছোটোমাকে আমি সব বলেছি।
ছোটো বলেছিল। বয়স হয়েছে, এখন আর খেয়াল থাকে না।
কিরে খাওয়া হলো, সাড়ে সাতটায় ট্রেন। একটু চটপট কর। এতটা পথ যেতে হবে। অমিতাভদার গলায় অভিযোগের সুর।
নিজেরা চব্বচষ্য গিলেছ। আমাদের একটু শান্তিতে খেতেও দেবেনা? বড়োমা খিঁচিয়ে উঠলো।
ছোটোমা হাসছে।
কি হিংসুটে ব্যাটাছেলে-রে বাবা।
বড়োমার কথাবলার ধরণই এরকম।
মল্লিকদা আমার দিকে তাকিয়ে একবার চোখ মারল।
নে নে তোর কাগজপত্র সব বুঝে নে। আমায় আবার অফিসে যেতে হবে। দাদা বলে চলেছে।
খেয়ে উঠে আমি আমার ট্রেনের টিকিট, হোটেল বুকিংয়ের কাগজপত্র, অফিসিয়াল কিছু কাগজপত্র, সব মল্লিকদার কাছ থেকে বুঝে নিলাম।
সবাইকে একে একে প্রণাম করলাম। বড়োমার চোখ ছলছল। আমার হাতে একটা খাম দিয়ে বললো, সঙ্গে রাখ। জানি তোর কাছে আছে। লাগলে খরচ করিস। না লাগলে এসে ফেরত দিস।
আমি হাসলাম। আজ পর্যন্ত বড়োমা আমার কাছে থেকে কিছু ফেরত নেয়নি। শুধু দিয়ে গেছে। আমিও ফেরত দেওয়ার চেষ্টা করেছি বলে মনে পড়ছে না।
আমি মুখের দিকে তাকালাম।
বেরিয়ে এলাম। অফিসের গাড়ি রেডি আছে।
অমিতাভদা বললো, শোন আমাদের একজন কোরেসপন্ডেন্স আছে ওখানে। বালচন্দ্রন নাম। ও কাল তোর সঙ্গে যোগাযোগ করে নেবে। তোর জন্য স্টেশনে অফিসের গাড়ি থাকবে। অফিসিয়াল ফাইলের ওপরে যে চিঠিটা আছে দেখবি ওতে গাড়ির নম্বর লেখা আছে। আমি ওখানকার অফিসে ফোন করে বলে দিয়েছি। তোর কোচ নং টিকিটের নম্বর ওদের দিয়ে দিয়েছি।
মোদ্দা কথা হলো আমার যাতে কোনও অসুবিধা না হয় তার জন্য সমস্ত বন্দবস্তই পাকাপাকি ভাবে তৈরি করা হয়েছে।
বড়োমা, ছোটোমা কাপরের খুঁট দিয়ে চোখ মোছে।
কাছে গিয়ে বললাম, এই শুরু করে দিলে।
সাবধানে থাকিস। বড়োমার গলাটা একটু ধরা ধরা।
দু-জনকে একটু জড়িয়ে ধরলাম।
সবার কাছ থেকে বিদায় নিলাম।
হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে দেখি ট্রেন ছাড়তে আর দশ মিনিট বাকি। নয় নম্বর প্ল্যাটফর্মে ট্রেনটা দাঁড়িয়ে। আমার টিকিট এসি ফার্স্টক্লাস। টিকিটের সঙ্গে কোচ মিলিয়ে নিয়ে ট্রেনে উঠলাম। দেখলাম আমার জন্য একটি কুপ বুক করা হয়েছে। মাত্র দুটি সিট। সেখানে আর একজন যাত্রীকে দেখতে পেলাম না।
যাই হোক আমার একটা মাত্র ব্যাগ। সিটের তলায় ঢুকিয়ে দিয়ে একটু বাইরে বেরিয়ে এলাম। বহু মানুষের দৌড়দৌড়ি। চেঁচামেচি। গাড়ির ড্রাইভার কাছে এগিয়ে এসে বললো, অনিদা আমি এবার যাই।
আমি বললাম, হ্যাঁ যাও। পৌঁছে দাদাকে বলে দিও আমি ঠিকঠিক ট্রেনে উঠেছি।
ছেলেটি হেসে ফেলল। আমি ভেতরে চলে এলাম। ট্রেনটা একটু দুলে উঠেই চলতে শুরু করল।
আমি আমার জায়গায় এসে বসলাম। কুপের দরজাটা খোলাই রেখেছি। একটু পরেই টিটি আসবে। রাতের জার্নি। অতএব ঠেসে ঘুম। খাওয়া দাওয়া বেশ ভালোই হয়েছে। এককাপ গরম কফি পেলে বেশ জমতো। কপাল ভালো থাকলে হয়তো এরা দেবে। না হলে নয়।
বাপের জম্মে কোনওদিন কুপে যাইনি। পেছনে খুঁটির জোর থাকলে কত কিছু হয়। এবার হাড়েহাড়ে বুঝতে পারছি। জানলার ধারে মাথার শিয়রে একটা টেবিল ল্যাম্পের মতো আলো। সুইচ টিপতেই জেলে উঠলো। বেশ ভালো।
যাক ঘুম না আসা পর্যন্ত শুয়ে শুয়ে বই পড়া যাবে। কালকূট সমগ্রের একটা খণ্ড সঙ্গে নিয়ে এসেছি। গোটা আষ্টেক উপন্যাস আছে। ট্রেনটা কতো জোরে যাচ্ছে, কিভাবে যাচ্ছে, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। জানলা দিয়ে বাইরে তাকালাম। অন্ধকার ছাড়া কিছুই ঠাহর করতে পারছি না।
এই কামড়ারই কয়েকজনের চেঁচামিচির শব্দ কানে আসছে। তারা এখনও মনে হয় নিজেদের গুছিয়ে উঠতে পারেনি।
ফোনটা বেজে উঠল। দেখলাম বড়োমার নম্বর। সমস্ত ব্যাপার পঙ্খানুপুঙ্খ রূপে জানিয়ে দিলাম। শেষে বড়োমা বললো, সাবধানে থাকিস।
নিচু হয়ে সিটের তলা থেকে ব্যাগটা টেনে বার করলাম। পাম্পার বালিশটা বার করে ফুলিয়ে নিলাম। যদিও রেল কোম্পানী বালিশ, সাদা চাদর, তোয়ালে দিয়েছে। তবু পাম্পার বালিশটা আমার চাই। উপন্যাস সমগ্রটা বার করে কুপের দরজাটা টেনে দিলাম। টান টান হয়ে শুয়ে পরলাম। আঃ কি আরাম।
আবার ফোনটা বেজে উঠল। দেখলাম তনুর নম্বর।
হ্যালো।
কি হলো বাবাজীবন। ট্রেন ছেড়েছে?
হ্যাঁ।
এখন কোথায়?
জানিনা। ট্রেন চলছে এটুকু বলতে পারি।
কেনো!
আমার টিকিট এসি ফার্স্টক্লাস কোচের একটা কুপে। বলতে পারো আমি নির্বাসিত। সেখানে দুটো সিট আছে। আমি একা।
ইস, ব্যাডলাক। আমি যাব নাকি?
চলে এসো।
শখ দেখো।
তুমি এখন কোথায়?
বাড়ি ফিরছি। বড় সাহেবের মাথাটা বেশ গরম।
আবার কি হলো!
অফিসে একটা ঝামেলা হয়েছে।
কাকে নিয়ে?
আবার কাকে নিয়ে, ওই চিফ-রিপোর্টার।
তোমার এ্যাসাইনমেন্ট জমা দিয়েছ।
হুঁ। অনি ভালো লাগছে না। তোমার কথা বার বার মনে পড়ছে।
মনটাকে বশে আনার চেষ্টা করো।
তনু চুপচাপ।
তনু।
উঁ।
মন খারাপ লাগছে।
একটু লাগছে।
সব সময় কাজের মধ্যে থাকার চেষ্টা করো। আমি তোমাকে সম্পূর্ণ ফিরিয়ে দিইনি।
তনু চুপচাপ।
কি হলো কথা বলছোনা যে—
তনুর ফোঁপানর শব্দ পেলাম। কাঁদছে।
আবার মন খারাপ করে। আরে, আমি মাত্র পনেরো দিনের জন্য এসেছি। আবার ফিরে যচ্ছি।
হয়তো তোমার সঙ্গে নাও দেখা হতে পারে।
এ কথা বলছো কেন?
ফিরে এসো বলবো।
এই বললে দেখা নাও হতে পারে।
তোমার জন্য অপেক্ষা করবো।
আচ্ছা।
ফোনটা তনু নিজেই কেটে দিল।
কুপের দরজাটা কেউ নক করল। শুয়ে শুয়েই বললাম, খোলা আছে, ভেতরে আসুন।
দেখলাম টিটি সাহেব এসেছেন। উঠে বসলাম। ওনাকে ভেতরে এসে বসতে বললাম। উনি ভেতরে এলেন। আমি ব্যাগ থেকে টিকিট বার করে ওনাকে দিলাম। উনি দেখে বললেন, স্যার আপনার কোনও অসুবিধা হলে আমাকে বলবেন।
টিটির কথা শুনে একটু অবাক হলাম। স্যার বলে সম্বোধন করছে! ব্যাপার কি? লেবু কচলালাম না। যদি তেঁতো হয়ে যায়।
একটু কফি পাওয়া যাবে?
অবশ্যই। আমি গিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
টি টি সাহেব একবারে গদো গদো। বুঝলাম ক্ষমতার অপপ্রয়োগ।
এনি প্রবলেম, আমাকে একটু জানাবেন। আমি পাশেই আছি।
ঠিক আছে।
উনি চলে গেলেন।
একটু পরেই দেখলাম একজন এসে একটা ট্রে হ্যাঙ্গিং টেবিলের ওপরে রাখল। কফির পট কাপ ডিস দেখে আমার একটু সন্দেহ হলো। আমি নিশ্চই কোন সাধারণ ব্যক্তি নই। এদের ব্যবস্থাপনা, চাল-চলন সেই কথাই বলছে।
একজন সাধারণ সাংবাদিকের জন্য এরকম ব্যবস্থা! কেমন যেন সন্দেহ হলো। মুখে কিছু বললাম না। পকেট থেকে মানিপার্সটা বার করে পয়সা দিতে গেলাম।
এ্যাটেনডেন্ট ছেলেটি বললো, না স্যার আপনার যখন যা চাই বলবেন, আমরা চলে আসব। পাশেই আছি।
হাঁ করে ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
তারমানে বড়োসাহেব ভালোই খেলেছেন।
কফি খাওয়ার পর বইটা পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে পরেছি খেয়াল নেই।
হঠাৎ দরজায় টোকা মারার শব্দে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। দেখলাম টিটি ভদ্রলোক মুখটা আমসি করে গেটের মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
নিজেরই কেমন লজ্জা লজ্জা লাগলো। তাড়াহুড়ো করে উঠে বসলাম।
সরি স্যার, একটু বিরক্ত করলাম। যদি পার্মিসন দেন তাহলে একটা কথা বলবো।
আবার অবাক হলাম। বিনয়ের অবতার।
বলুন।
স্যার আপনার এই কুপে একটা সিট খালি আছে একজন ভদ্রমহিলাকে যদি একটু লিফট দেন?
আমি লিফট দেবার কে! ফাঁকা আছে। আপনি এ্যালট করবেন।
না স্যার, এই কুপটা আজ রাতটুকু আপনার জন্য। জিএম সাহেবের হুকুম।
জিএম সাহেব!
হ্যাঁ স্যার। আপনার যাতে কোনও অসুবিধা না হয়, তার জন্যও আমাদের বলে দেওয়া হয়েছে।
তাই নাকি! জিএম! মানে সোমনাথ মুখার্জী?
হ্যাঁ স্যার।
এতক্ষণে বুঝতে পারলাম। খেলাটা কোথায় খেলা হয়েছে।
ঠিক আছে, আপনি যান। ওনাকে নিয়ে আসুন।
চোখের নিমেষে ভদ্রলোক গেটের মুখ থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে বছর কুড়ির একজন তরুণীকে নিয়ে এসে হাজির।
দেখেই আমার চোক্ষু চড়কগাছ।
গায়ের রং পাকা গমের মতো। পানপাতার মতো লম্বাটে মুখ। পাতলা ঠোঁটের ঠিক ওপরে একটা বাদামী রং-এর তিল। পিঠময় মেঘের মতো ঘন কালো চুল। মাঝে মাঝে হাইলাইট করা। মুখের সঙ্গে মানানসই চোখে রিমলেশ চশমা। উদ্ধত বুক। পরনে জিনসের প্যাণ্ট। টাইট একটা হাতাকাটা গেঞ্জি। প্রথম দর্শনেই যে কোনও ছেলের মাথা ঘুরিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট।
টিটি ভদ্রলোক আমার পরিচয় দিতেই, আমি বুকের ওপর হাত তুললাম।
আমার নাম ঝিমলি।
আমি হাতজোড় করে মাপছি। বয়সের ধর্ম।
আমি ম্যাডামকে আপনার সব কথা বলেছি। তাছাড়া সোমনাথবাবুও ওঁকে আপনার সম্বন্ধে সব বলেছেন।
বুঝলাম জল অনেক দূর পর্যন্ত গড়িয়েছে।
ঝিমলির বাবা আমাদের ডিভিসনের এজিএম। উনিও আপনাকে খুব ভালোকরে চেনেন। আপনার লেখার খুব ভক্ত।
টিটি ভদ্রলোক গড়গড় করে সব মুখস্থ বলে চলেছেন।
মোবাইলটা বেজে উঠল। পকেট থেকে বার করতেই দেখলাম, বড়োসাহেবের ফোন।
মেজাজ খাট্টা হয়ে গেল।
তুই কোথায়?
যেখানে রেখেছো।
উঃ কোন স্টেশন পেরলি?
কি করে বলবো। একটা কুপের মধ্যে টিকিট কেটেছ। আমি এতটা ভিআইপি আগে জানতাম না।
সারা রাতের জার্নি তোর বড়োমা বললো….।
একটু ধরো।
আমরা এখন কোথায় আছি? টিটি ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
খড়গপুর ছেড়ে এলাম।
এখন খড়গপুর ছেড়ে এলাম।
সোমনাথ ফোন করেছিল। ওদের এক কলিগের মেয়ে….কি পরীক্ষা আছে। তোর স্টেশনেই নামবে। আমাকে রিকোয়েস্ট করেছিল। তোর কুপে পারলে একটু ব্যবস্থা করে দিস। আর শোন।
বলো।
তোর বড়োমাকে বলার দরকার নেই।
হাসলাম। ওনারা আমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন।
আচ্ছা আচ্ছা। দু-একটা ভালো লেখা কাল পরশুর মধ্যে পাঠাস।
আগে পৌঁছতে দাও।
দাদা ফোনটা রেখে দিল।
আমার কথাবার্তা শুনে ওরা বুঝে গেছে আমি কার সঙ্গে এতক্ষণ কথা বলছিলাম।
টিটি ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বললাম, কটা বাজে?
দশটা পনেরো।
কিছু খাবার পাওয়া যাবে? আমার কুপে গেস্ট এলেন—
ওকে স্যার গেস্ট বলবেন না। ঠিক আছে আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।
আর একটু কফি।
আচ্ছা স্যার।
ঝিমলির দিকে তাকালাম। বসুন।
আপনার সঙ্গে একই কুপে যাচ্ছি, নিজেকে খুব ভাগ্যবান বলে মনে হচ্ছে।
লিঙ্গে ভুল করলেন, ওটা ভাগ্যবান হবে না, ভাগ্যবতী।
আমি আপনি নয় তুমি, এটাই প্রথম এটাই শেষ।
দু-জনেই হেসে উঠলাম।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝিমলির সঙ্গে আলাপ জমিয়ে ফেললাম। বোবার মতো বসে থাকার থেকে কিছুটা অন্তত বকবক করার সঙ্গী পাওয়া গেল।
জানলাম ও আমার ওপর বেশ ভালো হোমওয়ার্ক করেই এই কুপে এসেছে। ও উঠেছে হাওড়া থেকেই, একবারে শেষ মুহূর্তে জায়গা না পাবার জন্য প্যানট্রিকারেই ছিল।
তারপর খোঁজ খবর নিয়ে, যোগাযোগ করে, অমিতাভদার পার্মিসন নিয়ে এখানে স্থানান্তরিত হয়েছে। সোর্স থাকলে কি-না হয়। বাঘের দুধ পর্যন্ত পাওয়া যায়।
আমার প্রতি কৃতজ্ঞতায় ঝিমলির দু-চোখ ভড়ে গেছে।
আমি আসাতে আপনার কোনও অসুবিধা হবে না?
এই তো….।
সরি।
এটাই শেষ।
ঝিমলি বেশ মিষ্টি করে হাসছে।
হলে তোমাকে আসতে দিতাম না।
কথায় কথায় জানলাম, ঝিমলি ভাইজ্যাকে একটা মেডিক্যাল এক্সাম দিতে যাচ্ছে। পর্শুদিন ওর এক্সাম।
এ-ও জানলাম ওখানে ওর থাকার কোনও বন্দবস্ত এখনও হয়নি। ওর বাবা ভাইজ্যাকের স্টেশন মাস্টারকে বলে দিয়েছেন। ওরাই সব ব্যবস্থা করে দেবে।
পর্শু পরীক্ষা, তুমি আজ যাচ্ছ!
এখনও এ্যাডমিট হাতে পাইনি।
ঝিমলির দিকে একটু অবাক হয়ে তাকালাম। বলে কি মেয়েটা! ঝিমলি মনে হয় আমার মুখ দেখে মনের কথাটা পড়তে পারলো।
পরীক্ষার ডেটটা মনে ছিল। নেটে দেখে ওদের সব জানালাম। ওরা বললো এখানে চলে আসুন, এ্যাডমিটের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
এখন কতো আধুনিক হয়ে পরেছি আমরা।
ঝিমলি হাসছে।
বাবাকে যখন টিকিটের ব্যবস্থা করতে বললাম, রিজার্ভেসন লিস্ট তৈরি হয়ে গেছে। বাবা খোঁজ খবর নিয়ে জানাল একটা সিট ফাঁকা আছে। তবে সেটা রিজার্ভ। কিন্তু প্যাসেঞ্জার উঠবে না। শুনে কেমন যেন লাগলো। তারপর আমাকে বললো, তুমি আগে ট্রেনে উঠে পরো, একটা ব্যবস্থা নিশ্চই হয়ে যাবে।
সেই একটা সিট আমার কুপে।
ঝিমলি মুচকি মুচকি হাসছে।
খাবার চলে এল। ঝিমলি না করলো না। আমরা দু-জনে একসঙ্গে খেলাম। খেতে খেতে ওর সঙ্গে অনেক গল্প হলো। পড়াশুনর বিষয়, আমার লেখার বিষয়ে। আরও কতো গল্প।
আমার কিন্তু বারবার ওর উদ্ধত বুকের দিকে নজর চলে যাচ্ছিল। ও সেটা ভালো রকম বুঝতে পারছিল। কিন্তু তার কোনও বর্হিপ্রকাশ ওর চোখেমুখে দেখতে পেলাম না। বরং আমার চোখের এই লোভাতুর দৃষ্টি ও বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছিল।
খাওয়া শেষ হতেই একজন এ্যাটেনডেণ্ট এসে সব পরিষ্কার করে নিয়ে চলে গেল। আমি ব্যাগ থেকে একটা পাজামা পাঞ্জাবী বার করে, বাথরুমে চলে গেলাম। একেবারে ফ্রেস হয়ে চলে এলাম।
আমি চলে আসার পর ঝিমলি গেল।
ঝিমলি ফিরে এল একটা ঢলঢলে গেঞ্জি আর একটা ঢলঢলে বারমুডা পরে। মোবাইল থেকে দুটো ম্যাসেজ করলাম। একটা বড়োমাকে আর একটা তনুকে।
রাত হয়েছে। ঘুমিয়ে পড়ছি।
মোবাইলের শুইচ অফ করলাম। রেলের দেওয়া কম্বলটা বার্থে পাতলাম। ব্যাগ থেক একটা চাদর বার করে কম্বলের ওপর বিছিয়ে দিলাম।
বেশ শীত শীত করছে, আর একটা কম্বল বালিশ চেয়ে নিলাম।
ঝিমলি বললো, কি হলো শুয়ে পরবেন নাকি?
হ্যাঁ।
আমি একা একা জেগে বসে থাকব?
জাগবে কেন, ঘুমিয়ে পড়ো।
তারমানে!
তাহলে কি করবে?
কেন! গল্প করবো।
সব গল্প তো শেষ হয়ে গেল।
বারে। আমার আরও জানার বাকি আছে। আপনাকে পেয়েছি গোগ্রাসে কিছুটা গিলি।
উরি বাবা, আমি এত বড়ো আঁতেল এখনও হইনি।
ঝিমলি হাসছে।
আমি টানটান হয়ে শুয়ে পরলাম। ঝিমলি আমার মুখের দিকে কপট রাগ করে তাকাল।
দেখো ঝিমলি তুমি না থাকলেও আমি ঘুমতাম। রাত জাগা আমার অভ্যাসে নেই।
আপনি না সাংবাদিক?
তাতে কি হয়েছে! সারা রাত জেগে কি আমরা সংবাদ লিখি নাকি। কারা লেখে জানি না। এটুকু বলতে পারি আমি লিখি না।
ঝিমলির মুখের দিকে তাকালাম। চোখের থেকে চশমাটা খুলে সামনের টেবিলের ওপরে রাখল। সঙ্গে সঙ্গে ঝিমলির মুখশ্রীটা কেমন বদলে গেল।
ঝিমলির শরীরের বাঁধুনিটা চোখে পরার মতো। সরু কোমর। তানপুরার মতো ভরাট নিতম্ব। তবে ঝিমলি তনুর থেকে অনেক বেশি স্বাস্থ্য সচেতন। দেখলেই বোঝা যায়। বয়সটাও কম। তাছাড়া আজকালকার মেয়েরা স্লিম হওয়ার জন্য কত কিছু করে। আমার জায়গায় আমার অফিসের অন্য কোনও ছেলে থাকলে এরই মধ্যে ঝিমলিকে পটিয়ে নিত।
অফিসে তো দেখি সেক্সটা এখন যেন ডিনার, লাঞ্চের মতো। ডিনারে একরকম খাও আবার লাঞ্চে একটু মুখের স্বাদ বদল করো। আমার দ্বারা এসব হয় না।
তাকিয়ে তাকিয়ে একটু দেখি। ঈশ্বর যখন সুন্দর জিনিস দেখার জন্য চোখ দিয়েছেন।
চুপচাপ ঘুমের ভান করে মরার মতো পরে রইলাম। ঝিমলি একবার দরজা খুলে বাইরে গেল। টিটি ভদ্রলোক সামনই বসেছিলেন তাকে কি যেন বললো। তারপর ভেতরে এসে দরজা লক করে দিল। কূপের বড়ো লাইটটা নিভিয়ে, নীল লাইটটা জ্বালিয়ে দিল।
নিজের ব্যাগ খুলে একটা পাতলা মতন বাক্স বার করল। বুঝলাম ল্যাপটপ।
তারপর আমার দিকে পা করে দরজার দিকে মাথা করে ওর বার্থে শুয়ে ল্যাপটপটা খুলল।
আমি মিটিমিটি চোখে ঝিমলির শুয়ে থাকার দিকে তাকিয়ে আছি। উঃ কি ভরাট পাছা। যদি একবার সেক্স করতে পারতাম জীবন ধন্য হয়ে যেত। মাথার ভেতরটা কেমন ঝিমঝিম করে উঠলো।
তারপর নিজেকে বোঝালাম, সব জিনিস তোর জন্য নয় গাধা। যে টুকু চেয়েচুয়ে দেখেছিস ওটাই যথেষ্ট।
বেশ কিছুক্ষণ একটা গেম খেলার পর ঝিমলি উঠে বসল। আমার দিকে তাকাল। ধীরে আমার দিকে এগিয়ে এলো। খুব সন্তর্পনে মুখের কাছে মুখটা নামিয়ে নিয়ে এল। পরোখ করে দেখতে চাইল আমি সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়েছি কিনা। আমি ওর গরম নিঃশ্বাসের স্পর্শ পেলাম।
ভীষণ ইচ্ছে করছিল ওর মাথাটা ধরে ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়াই। পারলাম না। নিজেকে পুরুষ বলে পরিচয় দিতে সেই মুহূর্তে আমার খুব খারাপ লাগছিল। কুপের ভেতর হাল্কা সবুজ রং-এর ছোটো লাইটটা জ্বলছে।
ঝিমলি ওর বার্থে বাবু হয়ে বসলো। আমার দিকে এরবার তাকাল, আবার যাচাই করে দেখল, আমি জেগে আছি কিনা। আবার একবার উঠে এসে, আমার মুখের কাছে মুখটা নামিয়ে নিয়ে এল।
ওর নিঃশ্বাস এখন আরও ঘন হয়ে পড়ছে। আমি ইচ্ছে করেই জিভটা বার করে আমার ঠোঁটটা চাটলাম। ঝিমলি ত্রস্তে মুখটা সরিয়ে নিল। আমি একটু নড়েচড়ে একটা বড় নিঃশ্বাস ফেললাম।
ওর চোখে মুখে উত্তেজনা ছড়িয়ে পরেছে।
ঝিমলি ওর সিটে গিয়ে বসলো। আমার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে একভাবে বসে রইল। তারপর আস্তে আস্তে আমার দিকে একপাশ হয়ে শুল। ল্যাপটপটা কাছে টেনে নিল। একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে আর একবার ল্যাপটপের দিকে। বেশ কিছুক্ষণ এইরকম করার পর ও একটা ফাইলে গিয়ে রাইট ক্লিক করে ওপেন উইথ করে একটা ফ্লিম চালাল।
ল্যাপটপটা ওর দিকে একটু ঘুরিয়ে নিল। আমি ল্যাপটপের স্ক্রিনটা পুরোটা দেখতে পাচ্ছিনা। তবে কিছুটা দেখতে পাচ্ছি। মনে হলো ও যেন একটা ব্লু-ফ্লিম দেখছে।
আমি আবঝা আবঝা দেখতে পাচ্ছি।
ঝিমলি এবার সিটের ওপর উঠে বসল। আবার ল্যাপটপটা ঘুরিয়ে নিল। হ্যাঁ আমি যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই। একটা টিন এজের বিদেশি ব্লু-ফ্লিম। আমি এবার পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি।
আজকালকার এই ইয়ং জেনারেশনের মেয়েগুলো কেমন যেন।
আমি গ্রামের ছেলে।
এরা কেরিয়ারিস্ট আবার সেক্সটা এদের কাছে জলভাত। ঝিমলি নিশ্চই ধরে নিয়েছে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। নাহলে ও নীল ছবি দেখতো না।
খুব ইচ্ছে করছিল। ছবি দেখে ওর কি রি-অ্যাকসন হয় দেখার জন্য। নিজেকে খুব ছোটো মনে হলো।
কিছুক্ষণ আগেই ওকে নিয়ে যা তা ভাবছিলাম। মনের আর দোষ কোথায়। ঝিমলিকে দেখেই মনে হচ্ছে ওর বাবা-মা ওকে অভাবে রাখেনি। দু-হাত ভরে দিয়েছেন।
আর আমি ক্লাস টেনে ব্যাং কাটার জন্য একটা বায়লজি বক্স কাকার কাছে চেয়ে পাইনি। হয়তো না পাওয়ার জন্য আমার খিদে আরও বেড়ে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত বাবলা কাঁটা, ব্লেড আর মুলি বাঁশের পাতলা কঞ্চি দিয়ে বায়লজি বক্সের কাজ সেরেছিলাম। তাই আর সায়েন্স পড়া হয়ে ওঠে নি। আমি ভেতো বাঙালী।
এখনও ল্যাপটপে হাত দিইনি। অফিসের কমপিউটারে মাঝে মাঝে বসি। আমি পাশ ফিরে শুলাম। মাথার মধ্যে যতসব উল্টপাল্টা চিনতা ভিড় করে আসছে।
বড়োমার মুখটা মনে পড়ে গেল। পৃথিবীতে প্রথম কাউকে মা বলে ডেকেছি।
বড়োমার স্নেহের ছায়ায় আজ আমি এখানে। খুব ভালো করে লক্ষ্য করে দেখেছি। আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্টগুলো সব মেয়েরা দখল করে আছে। কেউ আমার প্রেমিক। কাউকে মাসী জ্ঞানে সম্মান করেছি। আবার কেউ আমার মা। ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না।
একটা নরম হাতের স্পর্শে ঘুম ভাঙলো। মুখের কাছে সুন্দর একটা মুখ।
মিত্রা এখানে কোথা থেকে এলো!
সম্বিত ফিরে পেলাম। না এ মিত্রা নয়। ঝিমলি। তারাহুড়ো করে উঠে বসলাম।
বাবাঃ কিছু ঘুমতে পারেন।
হেসে ফেললাম। কেন তুমি সারারাত জেগেছ নাকি?
তা নয়তো কি।
সত্যিতো একটা সমত্ত পুরুষের সঙ্গে এক কুপে একটা রাত কাটান সত্যি খুব টাফ।
টিজ করছেন।
একবারে না। তবু বুড়ো হাবড়া হলে কথা ছিল। তা নয় একটা সাতাস-আঠাশ বয়সের তরতাজা তরুণ বলে কথা।
ঝিমলির চোখে অনেক না বলা কথা। মাথা নিচু করে নিল।
স্টেশনে এসে গেছি?
না।
আর কতোক্ষন।
আসছে, টিটি আঙ্কেল বললেন।
তাহলে রেডি হতে হয়। তুমি রেডি?
ঝিমলি চোখ তুলেছে, মুচকি মুচকি হাসছে।
আমি ঝিমলির দিকে তাকালাম। ঝিমলি রেডি হয়ে গেছে। কালরাতে প্রথম দর্শনে যে পোষাকে দেখেছিলাম সেই পোষাক। মাথার মধ্যে আবার কেলাটা চাগিয়ে উঠলো।
আমি উঠে বসলাম। ঝিমলি আমার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে। বোঝার চেষ্টা করছে। কাল রাতে কতটা আমি ওকে জেনেছি। না একেবারেই জানতে পারিনি।
আমি বেডকভারটা টেনে নিয়ে ভাঁজ করতে গেলাম।
তুমি বাথরুমের কাজ সেরে এসো, আমি ভাঁজ করে দিচ্ছি।
আমি ঝিমলির দিকে তাকালাম। ঝিমলি মুচকি মুচকি হাসছে।
টুথব্রাস নিজের পরনের পোষাক আর টাওয়েলটা কাঁধে চাপিয়ে বাথরুমে চলে গেলাম।
ফিরে এসে দেখলাম ঝিমলি আমার বার্থে বসে কালকূটের পাতা ওল্টাচ্ছে।
থাকার ব্যবস্থা কি করলে?
ট্রেন থেকে নামি। বাবা বলে রেখেছেন।
আমার সঙ্গে এক হোটেলে থাকতে অসুবিধে আছে নাকি?
ঝিমলির চোখ দুটে চকচক করে উঠল।
না।
তাহলে একবার বাড়ির লোকজনের সঙ্গে কথা বলে নিতে পারো।
সঙ্গে সঙ্গে ঝিমলি ওর বাড়িতে ফোন করে ওর বাবার পার্মিশন নিয়ে নিল।
ট্রেন থামতে টিটি ভদ্রলোক এলেন আমাদের কুপে।
আমরা তখন রেডি হয়েছি নামার জন্য।
একজন ভদ্রলোক ওনার পেছনে এসে দাঁড়াল। জিজ্ঞাসা করল, আমি অনি ব্যানার্জী কিনা।
আমি একটু অবাক হলাম।
উনি বললেন আমি রামাকান্ত। অফিস থেকে আসছি।
ওকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম। ও আমাদের এখানকার অফিসের কর্মচারী। যাক একটা ঝামেলা চুকলো। ওকে সব ব্যাপারটা বলতে ও বললো ও সব জানে। আজ থেকে আমার সঙ্গেই ওর ডিউটি। যতোক্ষণ না আমি এখান থেকে যাচ্ছি।
ঝিমলি আমার দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসল। রামাকান্ত বললো, স্যার আপনার লাগেজটা দিন। আমি গাড়িতে নিয়ে গিয়ে রাখছি। আমি আমার লাগেজ ওকে দিতেই, ও ঝিমলির লাগেজটাও তুলে নিল।
ঝিমলি হাই হাই করে উঠল। আমি ওকে চোখের ইশারায় বারন করলাম।
ট্রেন থেকে নেমে টিট সাহেবকে বিদায় জানালাম।
স্টেশনের বাইরে এসে দেখলাম। গাড়ি রেডি। আমি ঝিমলি পেছনের সিটে উঠে বসলাম। হোটেলে পৌঁছতে মিনিট দশেক লাগল। আমাকে কিছুই করতে হলো না। সব রমাকান্তই করলো। আমি শুধু খাতায় সই করলাম।
হোটেলে চেক ইন করে নিজের রুমে এলাম। রমাকান্ত আমাদের সঙ্গেই আমাদের রুম পর্যন্ত এলো। ঘরেরে মধ্যে লাগেজ রেখে আমাকে বললো, স্যার আমি এখন অফিসে যাচ্ছি। অফিসে খবর দিচ্ছি আপনি চলে এসেছেন। আমি আবার কখন আসবো?
আমি বললাম, তুমি এখন যাও। বালচন্দ্রনকে বলবে, আমাকে একবার ফোন করতে। আমি আমার ভিজিটিং কার্ডটা পার্স থেকে বার করে ওকে দিলাম।
ও সেলাম ঠুকে চলে গেলো।
এতক্ষণ যা কথা হলো সব ইংরাজিতে। ঝিমলি আমাকে দেখছিল।
রমাকান্ত চলে যেতে আমাকে বললো, তুমি খুব ভালো ইংরাজী বলো। তোমার সাউন্ড এবং প্রোনাউনসেশন খুব সুন্দর।
কেন তুমি পারো না?
পারি কিন্তু ইংরাজী বলার কিছু স্টাইল আছে সেটা মেইনটেইন করা বেশ টাফ।
প্র্যাকটিস বুঝলে ঝিমলি। তুমিও পারবে। মানুষের অসাধ্য কিছু নেই, যদি তুমি ভালোবেসে সেই কাজটা কর।
হোটেলের ঘর দেখে আমার চক্ষু চড়কগাছ। এ তো হোটেল রুম নয়। একটা স্যুইট। বিগ-বসরা এলে ম্যানেজমেন্ট এই ধরনের বন্দোবস্ত করে থাকেন। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছিল। আমি কি তাহলে বিগ বস হয়ে গেছি? কিন্তু কার কাছ থেকে জানব।
বড়োমাকে একটা ফোন করলাম। জানিয়ে দিলাম। হোটেলে পৌঁছেছি। বিগ-বসকে যেন জানিয়ে দেওয়া হয়।
বড়োমা জানাল বিগ-বস এরই মধ্যে জেনে গেছেন আমি হোটেলে পৌঁছে গেছি। একটা ম্যাসেজ ঢুকলো। দেখলাম তনুর, কাল রাতে ফোন বন্ধ করে রাখার জন্য অভিমান।
ঝিমলি সোফায় গা এলিয়ে বসেছিল। ওর দিকে তাকাতেই দেখলাম চোখ নামিয়ে নিল। ওকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে।
কি ভাবছ? এ কোথায় এসে পড়লাম?
না।
তাহলে?
ভাবছি এতটা সৌভাগ্য আমার কপালে লেখাছিল।
কিসের সৌভাগ্য?
এখানে এক্সাম দিতে এসে এরকম একটা হোটেলে থাকব।
ধূস, যত সব আজে বাজে কথা।
নাগো অনিদা সত্যি বলছি। তোমার সঙ্গে দেখা না হলে আমার হয়তো অনেক কিছুই অজানা থেকে যেত।
আমারও ঠিক তাই। কি খাবে?
ফ্রেস হয়ে খাব।
ফ্রেস হবার আগে গরম কিছু খেয়ে নাও। তারপর দেখবে ফ্রেস হতে দারুন মজা।
জানি, এ অভিজ্ঞতা তোমার আছে। আমার কাল পরীক্ষা। একবার সিটটা কোথায় জানতে যেতে হবে। এ্যাডমিটের ব্যবস্থা করতে হবে।
টেনশন হচ্ছে।
ঠিক তা নয়, তবে ওই আর কি।
তোমায় চিনতা করতে হবে না। একটু পরেই বালচন্দ্রন আসবে। ও আমাদের এখানকার ব্যুরো চিফ। ওকে বললেই, সব ব্যবস্থা করে দেবে।
ঘরের বেলটা বেজে উঠল। লক ঘুরিয়ে খুলতেই একজন ওয়েটার এসে বললো। স্যার কফি আর কিছু স্ন্যাক্স নিয়ে আসি?
আমি ছেলেটির দিকে তাকালাম। তোমায় কে বললো, আমাদের এই সময় এ গুলো লাগবে?
অফিস থেকে হুকুম আছে স্যার। আমার ওপর এই কামরার দেখভালের দায়িত্ব পড়েছে।
ঝিমলি এককাত হয়ে সোফায় গা এলিয়ে দিয়েছে। ওর দিকে ছেলেটি একবার তাকাল। তাকানোই উচিত। ওর জায়গায় আমি থাকলে, আমিও তাকাতাম।
ঠিক আছে, যাও নিয়ে এস।
মনেহচ্ছে কোনও অবস্থাপন্ন গেরস্থের ড্রইং রুমে বসে আছি। ঝিমলির দিকে তাকালাম। ও এবার পা দুটো ওপরে তুলে টান টান হয়ে শুয়ে পড়েছে। শরীরের চড়াই উতরাই দেখলে সত্যি নেশা লেগে যায়। কালকের রাতের কথাটা মনে পড়ে গেল। সত্যি আমি খুব ভাগ্যবান। না হলে এরকম একটা মেয়ে আমার কপালেই বা জুটবে কেন।
নিজের ব্যাগ থেকে টাওয়েল আর পাজামা, পাঞ্জাবী বার করে নিলাম। সঙ্গে সাবান, শ্যাম্পু। ঝিমলি চোখ বন্ধ করে পড়ে আছে। কাছে গিয়ে দেখলাম ঘুমিয়ে পড়েছে। ওকে আর বিরক্ত করলাম না। ঘরটা ভালো করে ঘুরে ঘুরে দেখলাম।
আবিষ্কার করলাম এই ঘরের ভতরেও আর একটা ঘর আছে। খুলে দেখলাম। ওইটা আরও সুন্দর। দেখে মনে হচ্ছে শোবার ঘর। পলঙ্ক দেখে এখুনি শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে। কিন্তু না। ঝিমলিকে সারপ্রাইজ দিতে হবে। সত্যি ভাগ্য করে জন্মেছিলাম। জানলার পর্দাটা একটু সরাতেই দেখলাম কাছেই একটা ছোটো পাহাড়ের মতো দেখাচ্ছে। কি দারুন দৃশ্য। সত্যি আমি ভাগ্যবান।
হ্যাঁ আজ গলা ফাটিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে, আমি ভাগ্য করেই জন্মেছি।
কিন্তু যেদিন গ্রাম থেকে শহরে পা রাখলাম। একটা অনাথ ছেলে। শুধু স্যারের একটা চিঠি সঙ্গে করে। আর পকেটে স্যারের দেওয়া কিছু টাকা। আসার সময় স্যার বলেছিলেন। কলকাতায় যাচ্ছিস যা। জোয়ারের জলে ভেসে যাস না। নিজের কেরিয়ারটা তৈরি করিস। সেদিন মনাকাকা একটা কথাও বলেনি।
মনাকাকা!
স্কুলের ছাত্ররা বলত মনামাস্টার। নিঃসন্তান মনামাস্টার আমার কারিগর। কাকার কাছেই শুনেছি। আমার বাবা তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তাই দুজনে পাশাপাশি বাড়ি করেছিলেন। জমিজমাও পাশাপাশি কিনতেন। একবছর বন্যায় আমাদের গ্রামে খুব কলেরা হয়েছিল। আমার বাবা-মা সেই সময় একসঙ্গে কলেরাতে মারা যান। সেই থেকেই আমি গ্রামের ছেলে। তবে মনামাস্টারের বাড়িতেই বড় হয়েছি। আরও কতো কি যে হয়েছে। তা বলে শেষ করা যাবে না।
একসময় মনামাস্টার আমার কাকার আসনে বসে পরলেন। আমার অলিখিত-লিখিত গার্জেন।
আগে বছরে একবার গ্রামে যেতাম। অন্নপূর্ণা পূজোর সময়।
আমাদের গ্রামে ঘটা করে এই পূজোটা হয়। গ্রামের লোকেরা বলে বাসন্তী পূজো। বন্ধুরা এই অন্নপূর্ণা পূজোর সময় সবাই পূজো নিয়ে মেতে উঠতো। দেখা সাক্ষাৎ হত। ওই দু-চারদিন বেশ ভালো লাগতো। গত পাঁচ বছর আমি গ্রাম মুখো হই নি।
কেন? তা জানিনা?
আমার পৈত্রিক যা কিছু জমি-জিরেত সবই মনামাস্টারের হেপাজতে। ভিটেটা এখনও মনামাস্টার সারিয়েশুরিয়ে রেখেছে। মাটির দেওয়াল এখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ওখানে কি হচ্ছে, না হচ্ছে তার কোনও খোঁজ খবর রাখি না।
মা-বাবা কাউকেই সেভাবে মনে পড়ে না। তাঁরা সবাই ছবিতে আছেন। আমি যখন কলকাতায় আসছি, মনামাস্টার আমাকে একটা এ্যালবাম দিয়েছিলেন।
জানিনা তোর সঙ্গে আমার আর দেখা হবে কিনা। এটা রাখ। এতে তুই তোর পরিবারকে জানতে পারবি।
কথাটা কানে খটকা লেগেছিল। মনাকাকার মুখের দিকে তাকিয়ে কোনও কথা বলিনি।
উনামাস্টার বরং বলেছিলেন, মনা বেরবার সময় এ সব কথা বলতে নেই।
সত্যি কথা বলতে কি গ্রামে থাকা কালীন, মা-বাবা কি জিনিস বুঝতে পারিনি। কিন্তু কাকা-কাকী ছিলেন। তারা যথেষ্ট স্নেহ করতেন। অমিতাভদার বাড়িতে এসে বুঝতে পারলাম মা কি জিনিস।
কোমল হাতের স্পর্শে চমকে উঠলাম। ঝিমলি পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আমার মুখের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে।
হাসলাম।
ঝিমলি বুঝতে পারলো। আমার হাসির মধ্যে কোনও প্রাণ নেই।
কি ভাবছিলে এতো!
কিছু না।
লুকিয়ে যাচ্ছ।
ওর চোখে চোখ রাখলাম।
আমার জন্য তোমার কোনও অসুবিধে?
দূর পাগলি।
আমার কথায় ঝিমলি শরীরে হিল্লোল তুলে খিলখিল করে হেসে উঠলো।
আবার বলো।
কি?
ওই যে বললে।
বার বার বললেও, প্রথম বারের মতো মিষ্টি লাগবে না।
ঝিমলি আমার নাকটা ধরে ঝাঁকিয়ে দিল।
এই প্রথম ঝিমলি আমার শরীর স্পর্শ করলো।
বেলটা বেজে উঠল।
ঝিমলি ত্রস্ত হরিণীর মতো ছুটে গিয়ে দরজা খুললো।
ওয়েটার এসেছে। ট্রেতে অনেক কিছু সাজিয়ে নিয়ে।
স্যার ব্রেকফাস্ট কখন করবেন?
ঘণ্টা খানেক বাদে একবার এসো।
স্যার রুম সার্ভিসের বেলটা একবার কাইণ্ডলি বাজিয়ে দেবেন।
ঠিক আছে।
ওয়েটার চলে যেতেই, ঝিমলি বলে উঠলো, সরি অনিদা।
আবার কিসের সরি?
একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
কাল রাতে ট্রেনে ঠিক মতো ঘুমোও নি, তাছাড়া….।
ঝিমলির গালে রং ধরেছে। লাজুক চোখে আমাকে যাচাই করে নেওয়ার ঝিলিক।
নিজেই সোফাতে গিয়ে বসে সেন্টার টেবিলটাকে কাছে টেনে নিল।
ট্রে নিয়ে বসল। স্ন্যাক্স আর কফি। ঝিমলি নিজে হাতে কফি করলো। আমায় একটা কাপ এগিয়ে দিয়ে বললো, স্ন্যাক্স নিজে নাও।
বেশ খিদেও পেয়েছিল। দু-জনে গোগ্রাসে গিললাম।
কথাপ্রসঙ্গে জানতে পারলাম ঝিমলিরা দুই বোন। ছোটো বোন এই বারে উচ্চ মাধ্যমিক দেবে। ওরা থাকে গোলপার্কে। বেশ অবস্থাপন্ন পরিবার। মা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য-সংস্কৃতি দফতরের একজন উচ্চপদস্থ আধিকারিক। ঝিমলির কথামতো উনি আমাকে ভালো মতো চেনেন। তাছাড়া কাগজে আমার লেখাও বহুবার পড়েছেন।
ঝিমলি কলকাতাতে জয়েন্ট দিয়েছে। চান্স পাবে কিনা সন্দেহ। তাই এখানে মেডিক্যাল এক্সাম দিতে এসেছে। কথাপ্রসঙ্গে ওকে কালকের কথা বলতেই ওর মুখ চোখ রাঙা হয়ে উঠল।
বললাম, আমি হয়তো ভুল করেছি। ঝিমলি কিছুতেই সেই কথা স্বীকার করলো না।
ব্যাপারটা এই রকম, এ রকম ঘটনা ঘটতেই পারে।
আমি ওর কথা শুনে একটু অবাক হলাম।
ওকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম। আমিই হয়তো অন্যায় কাজ করেছি। তোমাকে ওইভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছি।
ঝিমলি বললো, না অন্যায় নয় অনিদা। তুমি যদি মেয়ে হতে আমি যদি ছেলে হতাম, তাহলে আমিও এই ঘটনা ঘটাতাম। আমিও যে তোমার চোখের চাহুনিটাকে উপভোগ করিনি এটা অস্বীকার করলে মিথ্যে বলা হবে। তবে তোমাকে আমার খুব ভালোলাগছে। তুমি সরাসরি আমাকে বলেফেললে।
আমি ঝিমলির মুখের দিকে তাকিয়ে।
তাছাড়া আমরা এখন ফ্রি-সেক্স নিয়ে অনেক চেঁচা মিচি করি। আদৌ কেউ ব্যাপারটার গুরুত্ব বোঝে। একটু গায়ে হাত দিলাম, চুমুটুমু খেলাম। দু-একবার হাতে গোনা সেক্স করলাম। ব্যাস ফ্রি-সেক্স। আসল কাজের বেলা অন্তসারশূন্য।
আমি আর কথা বারালাম না। ওকে বললাম। তুমি বাথরুমে আগে যাবে না আমি যাব।
ও বললো তুমি আগে সেরে নাও। তারপর আমি যাব।
আমি ওর সামনেই জামাটা খুলে ফেললাম। তারপর লজ্জাপেয়ে আবার পরতে গেলাম। ঝিমলি শরীরটাকে ভাঁজ করে হাসছে।
এতগুলো ঘণ্টা পার হবার পর এখনও লজ্জা যায়নি।
আমিও মুচকি মুচকি হাসছি।
টাওয়েলটা কাঁধে নিয়ে বাথরুমে চলে গেলাম।
মিনিট পনেরো পরে হাত দিয়ে চুলটা ঝারতে ঝারতে বেরিয়ে এলাম।
ঝিমলি একটা ছোটো সর্টস পরেছে আর একটা স্যাণ্ডো গেঞ্জি। আমি একঝলক ওর দিকে তাকিয়েই মাথা নিচু করলাম। এই পোষাকে ওর দিকে তাকান খুব মুস্কিল। চোখ সরিয়ে নিলাম।
তোমার একটা ফোন এসেছিল।
কে করেছিল।
নাম বলেনি। বললো অফিস থেকে বলছি।
ও।
আবার করবে বলেছে। আধঘণ্টা পরে।
ঠিক আছে।
ঝিমলি বাথরুমের দিকে হাঁটা লাগাল।
আসতে না আসতেই কাজের তারা। আমি আমার ব্যাগটা টেনে নিয়ে চেনটা খুললাম। পাজামা পাঞ্জাবী আর পরা যাবে না। ব্যাটারা হয়তো এখুনি এসে পড়বে। আমি একটা জিনসের প্যান্ট আর গেঞ্জি বার করলাম। আমার চিরাচরিত পোষাক।
দরজায় নক করার আওয়াজ। এগিয়ে গিয়ে খুললাম। ব্রেকফাস্ট নিয়ে চলে এসেছে। আমি বললাম, সেন্টার টেবিলে রাখো। ছেলেটি সেন্টার টেবিলে রেখে চলে গেল। আমি জামা প্যান্ট পরে রেডি হলাম।
ঝিমলি বেরিয়ে এলো। টেবিলের ওপর খাবার দেখে বললো।
কি গো অনিদা, এটা আবার কখন এলো?
এই তো দিয়ে গেল।
ঝিমলি বাথরুম থেকে পোষাক পরেই বেরিয়েছে। তুঁতে কালারের একটা শালোয়াড় কামিজ। এখন ঝিমলিকে একবারে অন্যরকম দেখতে লাগছে।
ঝিমলি আমি এখুনি বেরিয়ে যাব। তুমি একটু রেস্ট নাও। তারপর বেরিয়ো। আমি অফিস গিয়ে কথা বলে নিয়ে গাড়ি পাঠিয়ে দেব।
ঠিক আছে।
তোমার কোনও অসুবিধে হবে না তো?
না না।
দুজনে একসঙ্গে খেলাম। আলুপরটা, মাখন পনির, স্যালড। বেশ ভালো লাগল।
অফিসের গাড়ি চলে এলো ঠিক সময়ে। আমি বেরিয়ে এলাম। রাতে আর ফিরতে পারলাম না। ঝিমলিকে জানিয়ে দিলাম। তবে বালচন্দ্রন ওকে ভীষণ কো-অপারেট করেছে।
পরেরদিন ওকে নিয়ে ওর কলেজে পৌঁছে দিয়ে আমার কাজ সারলাম। বিকেলের ট্রেনে ঝিমলি ফিরেগেল।
ঝিমলি চলে গেল। এরপর কাজ আর কাজ। কাগজের অফিসে কাজ করা তো নয়—ঘন ঘন ফোন। নানা রকমের ফাই ফরমাস। আরও কতো কি। যাক এই ক-দিন চুটিয়ে কাজ করলাম। যাওয়ার সময় ঝিমলি ট্রেনে বসে একটা কথা বলেছিল।
অনিদা আমি জীবনে এমন পুরুষ প্রথম পেলাম। যে হাতের কাছে সাজিয়ে-গুছিয়ে দেওয়া খাবার পেয়েও একবারও চেখে দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করল না। তোমার প্রতি শ্রদ্ধায় আমার মাথা নত হয়ে আসছে। এই দু-দিনে তোমার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখলাম। একটা প্রণাম করব তোমায়।
আমি ওর হাতটা ধরে ফেললাম।
না ঝিমলি, জীবনে বড় হতে গেলে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। আমি সেই ত্যাগ স্বীকারের ব্রত পালন করছি। তোমার মতো আমার একজন পরিচিতা আছেন। তবে আমি তাকে জীবনে পাব না। ওই আর কি। গলাটা কেমন ধরে এল।
ঝিমলি আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল।
আমি ওর মাথায় হাত দিলাম, কেঁদো না। পারলে যোগাযোগ রেখো। তোমার মা-বাবার সঙ্গে আলাপ করার ইচ্ছে রইল। ঝিমলি আমাকে ওর মোবাইল নম্বরটা দিল।
চলবে—————————
from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/L1lHZQI
via BanglaChoti
Comments
Post a Comment