কাজলদিঘী
BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়
চতুর্থ কিস্তি
—————————
আমি আমার ঘরে এসে ল্যাপটপটা নিয়ে বসলাম। প্রথমে ভালো করে ম্যানুয়ালটা পড়লাম। তারপর সমস্ত তার-তুর ঠিকমতো লাগিয়ে ল্যাপটপটা ওপেন করলাম।
আমার জীবনের একটা নতুন দিকের উন্মোচন হলো।
মানুষের জীবনে কত কিছু জানার আছে। এক জন্মে শেষ করা যায় না। আমারও তাই অবস্থা। হঠাৎ অমিতাভদার গলার শব্দে চমকে পেছন ফিরে তাকালাম।
তোর সঙ্গে কিছু কথা ছিল।
ওখানে দাঁড়িয়ে রইলে কেন ভেতরে এসো।
দাদা ধীর পায়ে ভেতরে এলেন। আমার এই ঘরে একটা কাপরের ইজি চেয়ার আছে। মল্লিকদা এই বাড়িতে আশ্রয় নেওয়ার আগে যেখানে থাকতো সেখানে ছিল। এখানে আসার পর এটা আমার দখলে এসেছে। অমিতাভদা তাতে এসে বসলো।
মনা তোকে যে চিঠিটা দিয়েছে তুই তো পড়লি না।
তুমি পড়েছ?
পড়েছি।
তাহলে?
ও তোকে একবার যেতে বলেছে।
কেন?
তোর সম্পত্তি বুঝে নেবার জন্য।
সম্পত্তি নিয়ে আমি কি করবো?
তা ঠিক। তবে তোর মনার প্রতি কিছু কর্তব্য আছে। ছোটো থেকে সেইই তোকে মানুষ করেছে।
বলতে যাচ্ছিলাম, সে তো তুমি মাসে মাসে টাকা পাঠাচ্ছ। চুপ করে থাকলাম।
এতদিন এই ব্যাপারটা নিয়ে একবারে মাথা ঘামাইনি। খুব একটা ভেবেছি বলেও মনে হয় না। হঠাত ভাবনাটা কেমন মাথা চারা দিয়ে উঠলো। সত্যিতো। দাদা ঠিক কথা বলেছে।
তার এখন বয়েস হয়েছে। আজ বাদে কাল….। মনা তোকে তোর সব কিছু বুঝিয়ে দিতে চায়।
আমি মাথা নিচু করে বসে আছি।
একবার ওখানে যা। তাকে ঋণ মুক্ত কর।
ঠিক আছে যাব।
কবে যাবি?
তুমি বলো।
কালই চলে যা। এই ক-দিন অফিসে ডামা ডোল চলবে।
কেন?
আমি সব খোঁজ খবর রাখছি। ওটার দ্বারা কিছু হবে না। কাগজটা দেখিস?
না।
কি করিস তাহলে সারা দিন?
চুপচাপ থাকলাম।
মিত্রা কেন আসছে?
জানিনা। তবে ওকে বলেছিলাম, আমরা যা আলোচনা করলাম, ওর বেটার হাফকে একবার জানানো উচিত, আফটারঅল উনি তোর গার্জেন।
মিত্রা কি মিঃ ব্যানার্জীকে….।
না সেভাবে পাত্তা দেয় না।
মল্লিকদা এলো। খাটের ওপর বসলো। বুঝলো বেশ গুরু গম্ভীর আলোচনা চলছে।
তুই কি বলিস?
আমার কিছু বলার নেই, মিত্রা যা ডিসিসন নেবে ওটাই হবে। খুব বেশি হলে আমি ওকে সাহায্য করতে পারি। আফটার অল পঁচাত্তরভাগ শেয়ার ও নিজে হোল্ড করছে।
না।
কি না!
মিত্রা পঁচাত্তরভাগ শেয়ার হোল্ড করছে না।
তোমার কাছে খবরটা ভুল আছে।
অমিতাভদা আমার দিকে তাকাল। মল্লিকদা অবাক হয়ে আমার কথা শুনছে। ছোটোমা চায়ের পট কাপ নিয়ে এসে হাজির, ঘরের আবহাওয়ায় বুঝলো পরিবেশ অনুকূল নয়।
চা দিয়ে চলে গেল।
চায়ে চুমুক দিয়ে অমিতাভদা বললো, তুই যে ডিসিশনগুলো ওকে দিয়েছিস তা কি ঠিক?
বেঠিক কোথায়?
ও কি সামলাতে পারবে?
ওর রক্তে বিজনেস। ওদের সাতপুরুষের ব্যবসা, ব্লাড কোনওদিন বিট্রে করে না।
আমার কথাটা শুনে অমিতাভদা কেমন থমকে গেল। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
মল্লিকদা অবাক বিষ্ময়ে আমার চোখে চোখ রেখেছে। কোনওমতেই এতদিনের দেখা অনির সঙ্গে এই মুহূর্তের অনিকে মেলাতে পারছে না।
ওই যে নতুন ছেলেগুলোকে জয়েন করিয়েছে?
ওই ব্যাপার নিয়ে ভাববে না। তুমি এতদিন সবার সব ব্যাপার নিয়ে ভেবেছো। বেশি নাক গলাতে গিয়ে অনেকের শত্রু হয়েছো। এবার নিজের জায়গাটা নিয়ে ভাবো। কে কি করছে তাতে তোমার কি আসে যায়।
কথাটা তুই ঠিক বলেছিস। মল্লিকদা বললো।
অমিতাভদা, মল্লিকদার দিকে তাকাল। তুই তো কোনওদিন এ ভাবে আমাকে বলিসনি।
বলার সময় পেয়ছি কোথায়—আর বললেও শুনতে—তুমি যা বলেছো, তা অন্ধের মতো পালন করার চেষ্টা করেছি।
সেটা ঠিক আছে।
যুগ বদলেছে, সময় বদলেছে, তোমাকে এগুলো মেনে নিতে হবে। আমি বললাম।
তুই কি ভাবছিস অন্যরা এগুলো মেনে নেবে?
যারা মানবে না তাদের সরে যেতে হবে।
কি বলছিস!
ঠিক বলছি।
দামানি, মল, আলুওয়ালিয়ারা ছেরে দেবে।
প্রথমজন বহুদিন আগে শেয়ার বেচে দিয়েছে মিত্রার কাছ। তুমি যে লবির হয়ে এতদিন কাজ করছিলে।
না।
আবার না না করে, ভালোকরে খোঁজ খবর নাও।
দাদা আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে।
বাকি দুজন শেয়ার বেচে চলে যাবে।
কে কিনবে?
মিত্রা কিনে নেবে।
কি বলছিস তুই! আলুওয়ালিয়া মিত্রাকে শেয়ার বেচবে না।
বাধ্য করবো।
আমার কথাটা একটু অন্যভাবে বলা হয়ে গেলো। আমিতাভদা বিষ্ময়ভরা চোখে আমার দিকে তাকাল, ধীরে ধীরে মাথা দোলাচ্ছে।
কিছুতেই সম্ভব নয়।
আমি ঠিক বলছি। ও যদি মনে করে একাই সমস্ত শেয়ার কিনে নিতে পারে। আমি ভেতর ভেতর সেই ব্যবস্থা করছি।
অমিতাভদা আমার দিকে তাকাল। মল্লিকদা অবাক। বড়োমা ঢুকলো।
আচ্ছা তোমরা কি ছেলেটাকে একটু শান্তিতে থাকতে দেবে না?
দাঁড়াও তো। খালি বক-বক-বক। অমিতাভদা খেঁকিয়ে উঠলো।
আমি চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে বড়োমাকে ব্যাপারটা বোঝালাম।
বড়োমা শিশুর মতো বলে উঠলো, অনি আমি একটু শুনবো।
আমি বড়োমাকে চেয়ারটা এগিয়ে দিলাম, তুমি বসো, কোনও কথা বলতে পারবে না।
ঠিক আছে।
অমিতাভদা কট কট করে আমার দিকে তাকাল। মুখে কিছু বললো না।
ওরা খুব একটা সহজে ছেড়ে দেবে না।
কেউ কি দেয়। তুমি দিয়েছ? দিতে বাধ্য হবে।
এখন কতটা শেয়ার বাইরে পড়ে আছে।
আলুওয়ালিয়া কুড়ি, মল পাঁচ।
নিস্তব্ধ ঘর। আমার সঙ্গে দাদার কথোপকথন চলছে।
তুই জানলি কি করে?
কথার উত্তর দিলাম না।
তুমি এতদিন দামানির লবির হয়ে কাজ করছিলে, মিত্রার বাবার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক খুব একটা ভালো ছিল না।
অমিতাভদা মাথা দোলাচ্ছে।
কেন? ভদ্রলোক খারাপ ছিলেন না। অমি যতটুকু জানি।
অমিতাভদা মাথা নিচু করে বসে আছে।
আমার ভুল হলে আমাকে বলতে পার।
তুই এ খবর জোগাড় করলি কোথা থেকে!
আমার সোর্সের ব্যাপারে আমি কিছু বলবো না। যা বলছি ঠিক কিনা?
হ্যাঁ।
কাজের জায়গায় ব্যক্তিগত আক্রোশ আসবে কেন?
আমিতাভদা আমার দিকে তাকাল, চোখে বিষ্ময়।
দামানিরা আজ থেকে মাস আষ্টেক আগে শেয়ার বেচে দিয়েছে মিত্রার কাছে। তুমি তা জানতে?
অমিতাভদা আমার দিকে তাকাল। চোখের ভাষা বলছে জানত না।
আমি জানতাম, তোমাকে বলিনি।
কেন!
আজ পরিস্থিতির ফেরে আমার কথা শুনছো, ছ-মাস আগে বললে তুমি আমার কথা শুনতে?
বড়োমা মাথা দোলাচ্ছে। মনে মনে বেশ আনন্দ পাচ্ছে। যাক একজন তাহলে তৈরি হয়েছে, যে ওর মুখের ওপর সপাটে উত্তর দিতে পারে।
অমিতাভদা চুপ।
আমি যদি তোমার পরিচিত না হতাম এবং মিত্রা যদি আমার পূর্ব পরিচিতা না হতো তাহলে তোমাকে আমাকে সবাইকে এই হাউস থেকে সরে যেতে হতো।
অমিতাভদা মাথা নিচু করে বসে আছে।
তুমি হয়তো জানো না তোমার লবির ৪০ ভাগ লোককে তারিয়ে দেওয়া হয়েছে। ৬০ ভাগ লোক তোমাকে ছেড়ে সুনিতদার ন্যাওটা হয়েছে। বাকি খবর এখনও আমার কাছে এসে পৌঁছয়নি।
অমিতাভদার চোখ দুটো ছল ছলে।
বড়োমার চোখে আগুনের হলকা।
কখন যে ছোটোমা এসে দাঁড়িয়েছে জানি না।
তোমার ঘরে আপাতত সুনিতদাকে বসাচ্ছি। ওকে আমি বলির পাঁঠা বানাবো। তুমি এই মুহূর্তে আমার কোনও কাজে বাধা দেবে না।
কি বলছিস অনি! মল্লিকদা বিষ্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে।
অমিতাভদা আমার দিকে তাকাল, চোখ দুটো স্থির।
এই কদিনের মধ্যে যে করেই হোক কুড়ি পার্সেন্ট শেয়ার আমার চাই। মিত্রাকে বলেছি টাকা জোগাড় করতে।
অমিতাভদা হতাশ দৃষ্টিতে বললো, ওরা দেবে!
কেউ কি দেয়। ছেড়ে দেবে। ওটা হিমাংশু ব্যবস্থা করছে।
হিমাংশু কে?
আমর বন্ধু, চাটার্ড এ্যাকাউন্টেন্ট। এর বেশি কিছু জানতে চাইবে না।
অমিতাভদার গালে কেউ যেন সপাটে একটা থাপ্পর কষাল।
স্থবিরের মতো ইজি চেয়ার থেকে উঠে ধীর পায়ে আমার দিকে এগিয়ে এলো। আমার হাত দুটো ধরে আমাকে বুক জরিয়ে ধরে ছোট্ট শিশুর মতো ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।
বড়োমা কাপড়ের খুঁট দিয়ে চোখ মুছছে। ছোটোমা মাথা নিচু করে পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মাটি ঘষছে। কাপরের খুঁটটা ধরে আঙুলে জড়াচ্ছে। মল্লিকদা খাটের এক কোনে স্থানুর মতো বসে আছে। কাঁদতে কাঁদতে অমিতাভদা বললো—
মিনু তুমি আমার কাছে সন্তান চেয়েছিলে, তোমাকে দিতে পারিনি, এই নাও তোমার ছেলেকে, বড়োমা এগিয়ে এলো, আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো, মা-বাবা কি জিনিস জানতাম না, আজ জানলাম, ছোটোমা কাছে এসে আমার কপালে চুমু খেয়ে বললো, বুবুন মাকে পেয়ে ছোটোমাকে ভুলে যাবি না?
মিত্রারা এলো প্রায় দেড়টা নাগাদ। আমি তখন আমার ঘরে ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছি। অফিসে কম্পিউটর ঘাঁটা ঘাঁটি করি তাই খুব একটা অসুবিধা হলো না। বেশ তারাতারি সরোগরো হয়েগেলাম। ছোটোমা এসে বললো, চলুন আপনার গেস্টরা চলে এসেছেন।
আমি ছোটোমার মুখের দিকে তাকালাম, ছোটোমা হাসছে। এ হাসি পরিতৃপ্তির হাসি। এ হাসি মন ভালো হয়ে যাবার হাসি। এ হাসির মধ্যে লুকিয়ে আছে হারিয়ে গিয়ে আবার ফিরে পাওয়া।
কি হলো, ওই ভাবে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয় কি দেখছিস?
তোমাকে।
তবেরে দুষ্টু, বলে আমার কান ধরলো।
উঃ ছোটোমা লাগছে। ছাড় ছাড়।
ছোটোমার চোখ চোখ রেখে বললাম, কেমন দেখলে?
দারুন।
কি দারুন?
মিত্রাকে দেখতে।
পছন্দ?
ছোটোমা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল, পছন্দ হয়ে হবে কি?
ঠিক। কপালে নেইকো ঘি, ঠক ঠকালে পাবে কি।
আর বুড়োমি করতে হবে না। এবার চলো।
বড়োমা কি বলছে?
খুব শুনতে ইচ্ছে করছে না।
মাথা নারলাম।
বিয়ে না হলে, বউ করতো।
ওতো আমার বউ।
যাঃ।
হ্যাঁ গো।
চল চল ওরা বসে আছে।
চলো।
ছোটোমার পেছন পেছন নিচে এলাম, এরই মধ্যে মিঃ ব্যানার্জী, মিত্রা, অমিতাভদা, মল্লিকদা বেশ জমিয়ে গল্প শুরু করে দিয়েছে। আমাকে দেখেই মিত্রার চোখ দুটো চক চক করে উঠলো। সবার চোখ এড়ালেও ছোটোমার চোখ এড়ালো না। মিঃ ব্যানার্জী বললেন, এসো অনি তোমার জন্য….।
মল্লিকদা মিঃ ব্যানার্জীকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, না স্যার, অনি নয়, অনিবাবু। সবাই হাসলো।
আমি মিত্রার পাশে সোফার খালি জায়গায় বসে পড়লাম। মিত্রার দিকে তাকিয়ে বললাম, সবার সঙ্গে দাদার আলাপ করিয়ে দিয়েছিস?
ও বোকা বোকা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, আমার আগে মল্লিকদা সবার সঙ্গে আলাপ করেছেন, আলাপ করিয়ে দিয়েছেন।
বড়োমার সঙ্গে আলাপ হয়েছে?
মাথা দোলাল, হ্যাঁ।
তুই বড়লোক মানুষ, বড়োমা বিশ্বাসই করতে পারেনি, তুই এখানে আসতে পারিস—
গালে একটি থাপ্পর।
হ্যাঁরে, সত্যি।
মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে।
দাদার সঙ্গে কথা বলার পর তোর সঙ্গে যখন কথা বলছিলাম, সবাই আমাকে পাগল ভাবছিল।
এতটা ঠিক নয়। মিঃ ব্যানার্জী বললেন।
ছোটোমা চোখ পাকিয়ে গোল গোল চোখ করলো, মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো।
বড়োমা রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললো।
ও কোনওদিন পরিষ্কার করে কোনও কথা বলে না। সব সময় একটা হেঁয়ালি।
ঠিক বলেছেন, এটা ওর চিরকালের অভ্যাস। মিত্রা বললো।
তোমরা আমার থেকে বেশি জানবে মা। আমি আর ওর কতটুকু দেখলাম।
কলেজেও ও এরকম ছিল। সব সময় দেখছি-দেখবো, খাচ্ছি-খাবো ভাব। খালি ড. রায় যখন কোনও কথা বলতেন তখন বুবুনকে পায় কে। ও তখন সিরিয়াস।
ড. রায় কে?
আমাদের হেডডিপ ছিলেন।
সমকালীন পত্রিকায় একসময় খুব ভালো ভালো প্রবন্ধ লিখতেন। আমাদের কাগজেও লিখেছেন, খুব কম, এখন উনি সাহিত্য সমালোচক হিসাবে বেশ খ্যাতি লাভ করেছেন। অমিতাভদা বললো।
ও আরও ভালো বলতে পারবে। ও স্যারের পোষ্যপুত্র ছিল। মিত্রা বললো।
আমি মিত্রার দিকে তাকালাম।
ঠিক বলেছো। এখানেও তাই। খালি বড়সাহেব কিছু বললে ও শুনবে, আর কাউকে পাত্তাই দেয়না। অমিতাভদার দিকে তাকিয়ে বড়োমা বললো।
খিদে পেয়েছে—তোর পায় নি? মিত্রার দিকে তাকালাম।
কি রাক্ষসরে তুই। এই তো কয়েকঘণ্টা আগে অতগুলো লুচি গিললি এরই মধ্যে…. ছোটোমা বললো।
মিত্রা খিল খিল করে হেসে উঠলো।
সকলে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
তাহলে চল আমার ঘরে গিয়ে বসি।
আমার কথাটা মিঃ ব্যানার্জী লুফে নিলেন। হ্যাঁ-হ্যাঁ সেই ভালো, কাজের কথা আগে, তারপর খাওয়া দাওয়া।
আমরা সবাই আমার ঘরে এলাম। ছোটোমা বাধা দিয়ে বলেছিল, বড়দির ঘরে বোস না।
কেন?
ছাটোমা চোখ পকালো।
বুঝলাম আমার ঘরটা আবর্জনায় ভরপুর। ব্যাচেলারস কোয়ার্টার।
আমি মাথা নিচু করে হাসতে হাসতে বললাম, তুমি মিত্রাদের আদি বাড়িতে যাওনি। গেলে এ কথা বলতে না।
মিত্রা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে, মিঃ ব্যানার্জী আমার দিকে একবার তাকালেন।
আয়, আসুন আমি ওদের দোতলায় আমার ঘরে এনে বসালাম।
এই বাড়িতে এই ঘরটা সবচেয়ে সুন্দর। অন্তত আমার কাছে। পিওর ব্যাচেলার্স কোয়ার্টার বলতে যা বোঝায় ঠিক তাই। তবু আমার ফ্ল্যাটের থেকে এটা কিছুটা মন্দের ভালো। সৌজন্যে ছোটোমা, বড়োমা।
আমার জানলার ধারেই বিশাল একটা আমগাছ। তার পাশেই বড় একটা নিমগাছ। এছাড়া আরও কত গাছ আছে। অমিতাভদা ওঁর যৌবন বয়সে এই বাগান বাড়িটা কিনেছিলেন। সামনের দিকে কিছুটা অংশ বাগান। বাকিটা পেছনে। প্রায় ২৫ কাঠা জমির ওপর মাত্র তিন-চার কাঠায় বাড়িটা। কেনার সময় কিছু গাছ ছিল, বাকি অমিতাভদা পুঁতেছেন। এখন পরিচর্যার অভাবে জঙ্গল। একে একে সবাই বসলেন। আমি আমার ভাঙ্গা চেয়ারে বসলাম।
কাল কখন ফিরলেন?
বিকেলের ফ্লাইটে।
আপনাকে কাছে পাওয়া খুব মুস্কিল?
কি করবো বলো। ডাক্তারদের কোনও জীবন নেই।
একথা বলছেন কেন?
তোমার বান্ধবীকে জিজ্ঞাসা করো।
আপনি শুধু ডাক্তার হলে আলাদা কথা ছিল। আপনি এশিয়াতে একটা ফিগার।
লোকে বলে।
মিত্রা মুচকি মুচকি হাসছে।
দেখছো অনি, তোমার বান্ধবীর অবস্থা। আমাকে ডাক্তার বলে মনেই করে না। বলে কিনা আমি ভেটারনারি সার্জেন।
সবাই হেসে উঠলাম।
একচ্যুয়েলি ও আপনার পাশে আছে। সব সময় দেখছে, সেইজন্য গুরুত্ব দেয় না।
ওকে বোঝাও। ওর পাগলামির চোটে আমিও পাগল হয়ে যাব।
এই দেখো, ভালো হচ্ছে না কিন্তু। মিত্রা ডঃ ব্যানার্জীর দিকে তাকিয়ে বললো।
থাক। বাড়িতে গিয়ে কুস্তি করিস। আমরা কেউ দেখতে যাব না।
আবার হাসি।
দাদাকে সব বলেছিস? মিত্রার দিকে তাকিয়ে বললাম।
হ্যাঁ।
দাদা শুনে কি বললো?
তুই জিজ্ঞাসা কর।
আমি তো দাদাকে প্রশ্ন করিনি, তোকে করেছি।
আমি কিছু জানিনা যা।
বাঃ তুই মালকিন, সম্পাদক বলে কথা।
না আমি মালকিন নই।
তাহলে কে?
জানিনা।
মিঃ ব্যানার্জী হাসলেন। তুমি কি দাদাদের সব বলেছো।
যতটা আমি মিত্রার মুখ থেকে শুনেছি, বুঝেছি।
দাদা আপনাদের মতামত বলুন।
আমরা কি মতামত দেবো বলুন। সংবাদ বুঝি, কাগজটা বুঝি, কিন্তু তার পারিপার্শিক অরও অনেক কিছু আছে যা আমার বোধগম্য নয়। তাছাড়া আমরা আজ আছি কাল নেই। পরবর্তী সময়ে কাগজটা চালাবে ওরা।
ফোনটা বেজে উঠলো। সন্দীপের ফোন। সরি বলে, ঘর থেকে বারান্দয় বেরিয়ে এলাম।
কি হয়েছে বল।
অফিসে এলিনা কেন?
আমি এখন কয়েকদিন যাব না। তোকে যে দায়িত্ব দিয়ছিলাম করেছিস?
হ্যাঁ।
ওরা কিছু বলছিল?
না। ওরা তোকে বেশ ধ্বসে।
তুই কি করে বুঝলি?
কি খাতির যত্ন।
থাক। আমার ফোন নম্বরটা দিয়েছিস?
সে আর বলতে।
অফিসের হালচাল?
সুনিতদা ছড়ি ঘোরাচ্ছে। ম্যাডাম অসুস্থ। তাই কয়েকদিন আসতে পারছেন না।
ম্যাডাম অসুস্থ তোকে কে বললো?
আরে আমাদের ওই এ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার আছে না, কি সাম ঘরুই—
হ্যাঁ।
উনিই বললেন। এলে আরও কিছু ছাঁটাই হবে।
তাই!
এখন তো উনিই মালিক।
তাই নাকি?
হ্যাঁরে।
আজ আমার মর্নিং ছিল। এই ফিরছি। আর শোন অফিসে রিমডুলেশন চলছে।
বাঃ বাঃ।
হ্যাঁরে, সত্যি!
কাগজ ঠিক ঠিক বেরচ্ছে?
বেরচ্ছে, তবে ওই রকম। তুই আমার চাকরিটা একটু দেখিস।
যে দায়িত্ব তোকে দিয়েছি করে যা।
ঠিক আছে।
ঘরে এলাম।
মিঃ ব্যানার্জী, অমিতাভদা কথা বলছেন। অফিস কি ভাবে সাজান হবে। পরবর্তী কি কি কাজ করলে ভালো হয়। সেই নিয়ে। আমি আমার জায়গায় বসলাম। ছোটোমা চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে হাজির। পেছনে বড়োমা। দেখলাম মেনুটা খারাপ নয়, চিংড়িমাছের চপ আর চা। আমি জুল জুল করে চেয়ে রইলাম। ছোটোমা হেসে বললো, তোর জন্য নয়, ওনাদের জন্য।
চা খেতে খেতে আবার আলোচনা শুরু হলো।
মিত্রা বললো, হিমাংশুর সাথে কথা হয়েছে। ও এই সপ্তাহের মধ্যে রেডি করে দেবে।
ভালো তো….।
একটা সমস্যা হয়েছে।
কি রকম।
ওরা আমার নামে ট্রান্সফার করবে না।
তোর নামে করবে না, দাদার নামে করুক।
আমাদের দুজনের নামে হবে না।
মিঃ ব্যানার্জী আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, একটা কথা বলবো অনি।
বলুন।
শেয়ারটা তোমার নামে ট্রান্সফার করিয়ে নাও।
বড়োমা, ছোটোমা, অমিতাভদা, মল্লিকদার চোখের রং বদলে গেল। চারজনের গালেই সামান্য রং লেগেছে। চোখ দুটো চকচক করে উঠলো। ঠোঁটের কোনায় হাসির রেখা।
আমার নামে! খেপেছেন নাকি!
তোর নামে করলে আপত্তি কোথায়? মিত্রা বললো।
আমি মিত্রার দিকে তাকালাম। আমার চাহুনি মিত্রা চেনে।
ঠিক আছে, ঠিক আছে। তুই ওর সাথে কথা বল। মিঃ ব্যানার্জীকে দেখিয়ে দিল।
আমি ফোনটা তুলে ডায়াল করলাম। ইচ্ছে করে স্পিকার অন করে রাখলাম।
হ্যাঁ বল। তোর কাজ করে দিয়েছি। হিমাংশু বললো।
মাঝে কি ঝামেলা হয়েছে শুনলাম?
হ্যাঁ হয়েছে। সে তো আমি ম্যাডামকে বলেছি।
ঝামেলাটা কে সামলাবে, তুই না মিত্রা।
এটুকু সাহায্য তুই যদি না করিস তাহলে কি করে হয়।
ঠিক আছে দুটো ডিড কর, একটা আমার নামে ট্রান্সফার হচ্ছে, আর একটা কর আমি মিত্রার নামে ট্রান্সফার করছি।
আমি বলেছিলাম সেই কথা, ম্যাডাম রাজি হয়নি।
সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মিত্রা আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে। মুখ লাল হয়ে গেছে। ও ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে।
ঠিক আছে আমি তোকে আধঘণ্টা বাদে ফোন করছি।
ফোন নামিয়ে রাখলাম। মিত্রার দিকে তাকালাম। সম্পত্তি নিয়ে পাগলাম করিস না। আজ আমি ভালো আছি। কাল তোর শত্রু হয়ে যাব না কে বলতে পারে। হিমাংশু আমার ইনসট্রাকশন ছাড়া একটুও হিলবে না। ওকে যে ভাবে কাজ করতে বলেছি সে ভাবে করতে দে। তোর ভালোর জন্য বলছি। আমাকে তোর যদি কিছু দিতে হয়….সে তো অনেক সময় রয়েছে। এতো তাড়াহুড়ো করার কি আছে।
মিত্রা মাথা নিচু করে বসে আছে। চোখ দুটো ছল ছলে।
আমি জ্ঞানত কোনও অন্যায় কাজ করবো না।
মিত্রা মাথা নিচু করে রয়েছে।
চোখ মোছ। মুখ তোল।
মিত্রা তবু মুখ তুললো না।
আমি তোকে অপমান করতে চাইনি। তোকে বোঝাতে চাইলাম। সেদিনও তোকে বুঝিয়েছি। এই টাইমটা খুব ভাইট্যাল। তোকে আটঘাট বেঁধে পা ফেলতে হবে। এখানে ইমোশনের কোনও দাম নেই। এ্যাডমিনিস্ট্রেশন আর ইমোশন এক নয়। এটা তোকে আগে বুঝতে হবে।
মাথায় রাখবি আমি কিন্তু ভীষ্মের সঙ্গে যুদ্ধ করছি। যে ইচ্ছামৃত্যুর বর নিয়ে বসে আছে। তুই আমার শিখণ্ডি। তোর সাহায্য ছাড়া কাউকে কিছু করতে পারবো না। তবে আমিও ভগবান নই আমারও ভুল হতে পারে। তখন তুই কৃষ্ণের মতো আমাকে তোর বিশ্বরূপ দেখাস।
সবাই মুচকি মুচকি হাসছে।
মিত্রা আপাত গম্ভীর কণ্ঠে বললো, তুই থামবি। বহুত লেকচার মেরেছিস।
আমি হাসলাম। আসর ভেঙে গেল।
খাবার টেবিলে খুব মজা করে সবাই খেলাম। মিঃ ব্যানার্জী সবচেয়ে আনন্দ পেলেন আজকের মেনুতে। স্বীকারও করে নিলেন।
এরকম ঘরোয়া খাবার কতদিন পরে খেলাম তা মনে করে বলতে পারব না। খুব ছোটো সময়ে মায়ের হাতে এই ধরনের রান্না খেতাম। বাবার ট্রান্সফারেবল জব। বাংলার বাইরেই বেশিরভাগ সময় থেকেছি। তারপর তো বাইরে চলে গেলাম।
মল্লিকদা টিপ্পনি কেটে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, রাইট চয়েস বেবি।
মিত্রা, মল্লিকদার দিকে তাকাল।
আজকের মেনুটা অনির মস্তিষ্ক প্রসূত।
মিত্রা একবার টেরিয়ে আমার দিকে তাকাল।
খাবার শেষ হতে মিঃ ব্যানার্জী বললেন, অনি তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল। চলো তোমার ঘরে যাই। আমর বুকটা ধরাস ধরাস করে উঠলো। তাহলে কি সেদিন রাতের ব্যাপারে….। কিন্তু মিত্রার হাবে ভাবে সেরকম কিছু বুঝলাম না। তাহলে?
আমি বললাম চলুন, মিত্রা আমার দিকে একবার তাকাল। ওর চোরা চোখের চাহুনি কিছু বলতে চায়। আমি চোখ সরিয়ে নিলাম। পায়ে পায়ে ওপরের ঘরে উঠে এলাম। মিঃ ব্যানার্জী আমার পেছন পেছন এলেন।
অনি তোমার এখানে এ্যাসট্রে আছে?
না। একটা ভাঙা ভাঁড় আছে।
সেটাই দাও।
আমি টেবিলের ওপর থেকে ভাঙা ভাঁড়টা নিয়ে এসে ওনাকে দিলাম।
তুমি সিগারেট খাও না?
খাই। ইচ্ছে হলে।
খুব ভালো হেবিট।
আজ কি আমার সঙ্গে একটা শেয়ার করবে?
দিন।
মিঃ ব্যানার্জী ইজি চেয়ারে বসলেন। আমি আমার চেয়ারে। উনি দামী ব্র্যান্ডের একটা প্যাকেট পকেট থেকে বার করলেন। একাট সিগারেট আমাকে দিলেন। আর একটা নিজে ধরালেন। দু-চারবার সুখ টান দেবার পর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, অনি আমাকে একটু সাহায্য করতে হবে।
আপনাকে! আমি?
হ্যাঁ।
আমার সাধ্যের মধ্যে হলে অবশ্যই করবো।
আমি তোমাকে অসাধ্য সাধন করতে বলবো না। তবে আমি বিশ্বাস করি তুমি পারবে।
বলুন।
মিত্রা তোমার খুব ভালো বন্ধু।
হ্যাঁ।
মিত্রাকে তুমি একটু সঙ্গ দাও। ও বড়ো একা।
দিচ্ছি তো। ওর যখনই অসুবিধা হবে আমি ওর পাশে থাকবো, কথা দিয়েছি।
না অফিসিয়ালি নয়। আন অফিসিয়ালি।
আমি মিঃ ব্যানার্জীর চোখে চোখ রাখলাম।
মনে মনে বললাম ডাক্তার তুমি বহুত শেয়ানা। আমার থেকে বড় খেলোয়াড় হতে পার। আমি ছোটো খেলোয়াড় এটা ভাবছ কেন। আমি এঁদো গলি থেকে রাজপথ দেখেছি। তুমি সেরকম এঁদো গলি দেখইনি।
আমি আপনার কথাটা ঠিক ধরতে পারছি না।
তুমি সেদিন আমাদের বাড়িতে গেছিলে।
হ্যাঁ। মিত্রা যেতে বললো।
মিত্রা আমায় সব বলেছে।
আমি মিঃ ব্যানার্জীর চোখ থেকে চোখ সরালাম না।
তাছাড়া সেদিন থেকে মিত্রা একটা জিনিস ছেড়ে দিয়েছে। যা আমি বিগত দেড় বছরে চেষ্টা করেও ছাড়াতে পারিনি।
কি?
মিত্রা সেদিন থেকে আর ড্রিংক করে না।
এটা খুব ভালো খবর দিলেন।
শুধু ভালোখবর নয়, আমি সেদিন থেকে একটা জিনিস লক্ষ্য করছি ও তোমার সান্নিধ্যে এসে অনেক বদলে গেছে। ওর চাল-চলন কথাবার্তা।
এটা আপনি বাড়িয়ে বলছেন। মিত্রা বরাবরই খুব ভালো মেয়ে। সেই কলেজ লাইফ থেকে।
আমি অস্বীকার করতে পারি না। তবে কি জানো অনি, তুমি আমার থেকে অনেক ছোটো। আজ তোমার কাছে আমি অকপটে স্বীকার করছি। আমি ওকে আমার স্ত্রীর মর্যাদা দিতে পারিনি। সে অনেক কথা। সময় সুযোগ হলে তোমায় বলবো। আজ মনে হচ্ছে তোমাদের এখানে এসে আমি একটা দিশা খুঁজে পাচ্ছি।
আমি মিঃ ব্যানার্জীর দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। একটা সিগারেট শেষে দ্বিতীয়টা ধরিয়েছেন।
অর্থ বাদ দিলে, স্ত্রীর প্রতি স্বামীর কিছু কর্তব্য থাকে। আমি তার কোনওটাই পালন করতে পারিনি। তুমি হয়তো প্রশ্ন করবে কেন? ওই যে বললাম, সে অনেক কথা। তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে তোমার কথা ওর মুখ থেকে বহুবার শুনেছি। তুমি ওর কলেজের বন্ধু। ওদের বাড়িতে বহুবার গেছ। ওই কলেজে ওই বর্ষের তুমি ফার্স্টক্লাস পাওয়া ছেলে। আরও অনেক কিছু।
দেখো কাকতালীয় ভাবে তুমি যে আমাদের হাউসেই কাজ করো তা জানতাম না।
ক্লাবে তোমার সঙ্গে প্রথম পরিচয়। তারপর আমাদের বাড়িতে গেলে। সেদিনই তোমায় আমি মার্ক করেছি। তবে তুমি এর মধ্যে কোনও যোগাযোগ রাখনি তোমার বান্ধবীর সঙ্গে। কলেজ লাইফটা শেষ হয়ে গেলে যা হয়।
তুমি ভাইজ্যাক গেছ, সেও আমি জানতাম। তুমি এ বাড়িতে থাক না। তাও আমি জানি। যেখানে থাক সেখানেও প্রায় দিন থাকো না। তুমি একটা বাউণ্ডুলে। তবে মিত্রা কিছু আমাকে বলেনি। আমি নিজের ইন্টারেস্টে তোমার খোঁজ খবর নিয়েছি।
আমি মিঃ ব্যানার্জীর দিকে তাকিয়ে আছি। উনি ভাবলেশহীন ভাবে ওনার কথা বলে চলেছেন। কিন্তু প্রত্যেকটা কথার পেছনে একটা সূত্র রেখে চলেছেন।
তুমি আমার বয়েসটা দেখছো, মিত্রার পাশে আমায় মানায় না।
আমার কানের লতি গরম হয়ে যাচ্ছে।
কোনও একটা কারণে মিত্রাকে আমি বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছি। সেটাও তোমাকে আমি একদিন বলবো।
আমি মিঃ ব্যানার্জীর কথায় অবাক হলাম। উনি কি নিজের কথা বলছেন! না বানিয়ে বানিয়ে আমার সঙ্গে গল্প করছেন!
আমি তোমাকে একটা রিকোয়েস্ট করবো।
মিঃ ব্যানার্জী ইজি চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে আমার হাত দুটো ধরলেন।
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। ওর সঙ্গে কলেজ লাইফে তুমি যে ভাবে মিশতে ঠিক তেমনি ভাবে মেশো। আমার কোনও আপত্তি নেই।
আমি মিঃ ব্যানার্জীর চোখে চোখ রাখলাম। চোখ দুটো কেমন ভাবলেশ হীন। কিন্তু ভেতরে অন্য কথা বলছে বলে মনে হয়। এতো বড় একজন ডাক্তার আমার সামনে কেমন যেন নমনীয় হয়ে পরেছেন।
সত্যি বলছি অনি, তুমি যদি ওর বেড পার্টনারও হও, তাতেও আমার কোনও আপত্তি থাকবে না। আমি বিদেশে মানুষ। ওখানে এই ব্যাপারটা জলভাত।
আমি ওকে ভীষণ হাসি-খুশি দেখতে চাই। ওর মধ্যে যে প্রাণটা হারিয়ে গেছিল, তুমি কয়েক দিনের মধ্যে তা ফিরিয়ে দিয়েছ। সবচেয়ে অবাক কথা কি জানো অনি। আমার কথায় অভিমানে ওর চোখে কোনও দিন জল দেখিনি। আজ প্রথম ওর চোখে জল দেখলাম। আমি জানি ও তোমাকে বন্ধু হিসাবে ভীষণ ভালোবাসে। আমি সেই মুহূর্তে ডিসিশন নিয়েছিলাম। তোমাকে আমি সব বলব। আশা রাখি তুমি আমার এই অনুরোধটুকু রাখবে।
আমার সব কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। মনে মনে ভাবছি ব্যাপারটা কি? এতটা আত্মসমর্পন কেউ করে নাকি?
এ আপনি কি বলছেন!
আমি ঠিক বলছি। আমি স্বজ্ঞানে তোমাকে বলছি। এটা আমার কোনও অভিনয় নয়। এটা আমার পরাজয়। তবু এই পরাজয়ের মধ্যে আনন্দ আছে। সে তুমি বুঝবে না। তোমাকে আমি বলবো, সব বলবো।
বলো তুমি এই উপকারটুকু করবে?
আমি কথা দিতে পারবো না। তবে চেষ্টা করবো।
কি হলো, এবার যেতে হবে। ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়েছ? কটা বাজে?
দেখলাম ছোটোমা, বড়োমা, মিত্রা আমার ঘরের গেটের মুখে দাঁড়িয়ে। মিত্রা আমার দিকে বিষ্ময় চোখে তাকাল। মিঃ ব্যানার্জী চশমাটা চোখ থেকে খুলে রুমাল দিয়ে মুখ মুছলেন।
পাঁচ বছর পর আমার নিজের বাসভূমিতে পা রাখলাম। এতদিন নিজভূমে পরবাসে ছিলাম। দেখতে দেখতে পাঁচ পাঁচটা বছর কোথা দিয়ে কেটে গেছে জানি না।
বাস থেকে চকে নামলাম। চকের নাম বড়চাড়া। গ্রাম্য ভাষায় বাসস্ট্যান্ডকে চক বলে।
লাল ধূলো উড়িয়ে মোরাম রাস্তা দিয়ে বাসটা গর্জন করতে করতে সামনের দিকে চলে গেল। গায়ে মাথায় লালাধূলোর পরশ।
বাস থেকে নামতে সবাই কেমন উত্সুক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। অজ গাঁয়ের বাসস্ট্যাণ্ড, খুব একটা বেশি লোক নামে না। সারাদিনে তিনটে বাস। জনা তিনেক নামলে অনেক বেশি। সবাই উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে থাকে কোয়ার্টার শহরের খোঁজ খবর নিতে।
আমার সঙ্গে আরও দু-জন নামলো। নেমেই তারা হন হন করে সামনের মোরাম রাস্তা ধরে হাঁটতে আরম্ভ করলো মাঠের দিকে। এখান থেকে আমায় দশ কিলোমিটার হেঁটে যেতে হবে। এই রাস্তাটুকু হাঁটতে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা সময় লাগবে। একটা সময় সাইকেল নিয়ে এসব রাস্তায় কত ঘোরা ঘুরি করেছি। আজ কেমন যেন মনে হচ্ছে। সব কেমন যেন অচেনা অজানা। সময়টা কিন্তু বেশি নয় মাত্র পাঁচটা বছর।
সূর্য এখন মধ্য গগনে। পাঁচবছর আগে এই চকে যে কয়টা দোকান দেখেছিলাম এখন তার থেকে কয়েকটা বেরেছে। পরিচিত যারা ছিলেন তাদের কাউকেই চোখে পড়ছে না। হয়তো চিনতে পারছি না। আমরা যে চায়ের দোকানে এসে প্রায় আড্ডা মারতাম সেই দোকানে ঢুকলাম।
একটা বছর কুড়ি বয়সের ছেলে বসে আছে। আরও দু-চারজন বসে আছেন। আমি চায়ের কথা বলতে ছেলেটি একটু ভ্রু-কুঁচকে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল।
এটা পরিতোষদার চায়ের দোকান। আমরা সবাই পরিদা বলে ডাকতাম। ক্লাস টেনে যখন পড়তাম তখন সবে নতুন পাখনা গজিয়েছে। বন্ধুরা সাইকেল নিয়ে এই দশ কিলোমিটার পথ ঠেঙিয়ে আড্ডা মারতে আসতাম।
এটা পরিতোষদার চায়ের দোকান, তাই না?
পরিতোষদার কথা বলতেই ছেলেটি কেমন ভাবে যেন আমার দিকে তাকাল। বুঝলো আমি একেবারে অপরিচিত নই। তারপর আস্তে করে বললো।
বাবা বাড়িতে আছেন। চা দিতে একটু দেরি হবে।
আমি ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বললাম, ঠিক আছে, তুমি করে দাও। আমি একটু বসছি।
আমি জানি এই দুপুর রোদে এখানে কেউ চা খায় না। তাই চায়ের সরঞ্জাম সব ধোয়া হয়ে গেছে। আমার জন্য আবার নতুন করে বানাতে হবে। তাই দেরি হবে।
সামনের একটা আলমাড়িতে কয়েকটা মিষ্টি সাজান আছে দেখলাম। দুটো ছানার দানাদার চেয়ে নিলাম। আমাদের কলকাতার চিনির ডেলা থেকে যথেষ্ট ভালো।
ভালো লাগল। বললাম রসোগোল্লা আছে? ছেলেটি হ্যাঁ বললো। আমি বললাম দুটো দাও।
পরিতৃপ্ত সহকারে বহুদিন পর আমার গ্রামের মিষ্টি খাচ্ছি। মিষ্টির স্বাদ সেরকমই আছে। পরিদা নিজে হাতে তৈরি করে। নিজের ঘরের গরুর দুধ। বাকিটা গ্রামের ঘরের এর তার ঘর থেকে জোগাড় করা। জলের স্বাদও একইরকম। যাক এত পরিবর্তনের মধ্যেও এই দুটোর স্বাদ এখনও ঠিক আছে। চা খেলাম। কথা বলতে বলতে জানলাম। এখন আর হেঁটে যাবার দরকার নেই। চাইলে ট্রলি পাওয়া যায়।
লোক যদি বেশি হয় তাহলে পয়সা কম লাগে। না হলে পয়সা একটু বেশি লাগে। চা খেতে খেতে আমাদের হাউসের কাগজটায় একটু চোখ বোলালাম। আমার একটা লেখা বেরিয়েছে। এ লেখাটা অনেক দিন আগের লেখা। অমিতাভদা সরিয়ে রেখেছিলেন। সুনিতদা ছেপে দিয়েছে। মনে মনে হাসলাম।
বাবু আপনি ট্রলিয়ে যাবিন নাকি?
কাগজ থেকে চেখ তুলে তাকালাম। একটা কালো কুচকুচে ছেলে আমার দিকে জুল জুল করে তাকিয়ে আছে। সারা শরীর রুক্ষ। পরনে ঘেমো দাগ ওয়ালা স্যাণ্ডো গেঞ্জি, গ্রামের ভাষায় বলে ‘মাইছাতি পরিইছে’। একটা আধময়লা লুঙ্গি। কাঁধে একটা গামছা।
হ্যাঁ যাব।
কুথা যাবেন?
কাজলদীঘি।
গ্রামের নাম বলতেই আশেপাশের লোক আমার দিকে তাকালেন।
কার ঘরে গো?
দোকানে বসা একজন বয়স্ক লোক আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন।
মনামাস্টার।
এবার সকলে মুখ চাওয়াচাওয়ি করছেন।
আপনি তাঁর কে হন?
আমি ওনার ছাত্র।
তা বাবু আপনি কুথা থেকে আইসছন।
কলকাতা থেকে।
শুনছি উনার এক আত্মীয় কইলকাতায় থায়। খপররে কাগজে কাজ করিন। রেপোর্টার।
হাসলাম।
তুমি থাকো কোথায়? ছেলেটির দিকে তাকালাম।
মনামাস্টারের পাশের গেরামে।
ও। চলো তাহলে।
চা খেয়ে ওর ট্রলিতে চেপে বসলাম।
ছেলেটি মাটির বাঁধে ট্রলি নিয়ে উঠলো। ক্যাঁচর ক্যাঁচর শব্দে হেলে দুলে ট্রলি চলেছে। দু-পাশে সবুজ ধানের খেত। আর কিছুদিন পরেই ধান কাটার মরশুম চলে আসবে।
কতক্ষণ যেতে লাগবে?
ঘণ্টা খানিক।
তুমি কি বীরকটায় থাকো, না লাড়োতে?
লাড়ো। আপনি চিনেন নাকি?
না।
তাইলে বলতিছেন কি করে?
অনেকদিন আগে এসেছিলাম। তখন তোমাদের এই রাস্তাটা তৈরি হয়নি।
হ্যাঁ বাবু। এ তো বৎসর খানিক হলো। তায় আবার বর্ষার সময় ডুবি যায়।
রাস্তাটা হয়েছে বলে তোমাদেরও কিছু রোজগার হচ্ছে বলো?
হ্যাঁ বাবু।
সামনের দিকে তাকালাম। আদাশিমলার সেই বিশাল মাঠ। প্রায় পাঁচ কিলোমাটার। ধানের খেত ছাড়া জনমানব শূন্য। এই দুপুরে চারিদিক খাঁ খাঁ করছে। মাঝে মাঝে কয়েকজন মাঠে বাছার কাজ করছে। মাঠের মাঝে মাঝে ছোটোছোটো খরের চালার টং-গুলোয় শ্যালো টিউবওয়েল পোঁতা রয়েছে। দু-একটা চলছে মনেহয়। ভট-ভট মৃদু আওয়াজ দূর থেকে কানে ভেসে আসছে।
এখানে আমার কতো স্মৃতি লুকিয়ে আছে।
ওই দূরে দেখা যায় উনামাস্টারের বাড়ি। সামনের দিকটা আগে খরের ছিল এখন দেখছি এ্যাজবেস্টর লাগানো হয়েছে। ওই বাঁধের ওপাশ দিয়ে গেলেই সৌমি, পূর্ণিমাদের বাড়ি। দূরে দেখা যাচ্ছে শ্মশানটা। না যেমন দেখে গেছিলাম, ঠিক তেমনি আছে। আমার চোখে কোনও বদল ধরা পড়ছে না। রাস্তার দু-পাশের মাঠে এখন চাষ চলছে। চারদিক সবুজ গালিচার মতো। যেদিকে তাকাও শুধু সবুজ সবুজ।
স্কুল জীবনের কথা মনে পড়ে যচ্ছে। এখানে আমার শৈশব-কৈশোর কেটেছে। আমার বন্ধু-বান্ধব সব এখানে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। একটু আনমনা হয়ে পড়েছিলাম।
কে যায়, অনি না?
ট্রলিটা বেশ কিছুটা এগিয়ে গেছে।
আমি ট্রলিওয়ালাকে থামাতে বললাম। ও ট্রলি থামাল। ট্রলি থেকে নেমে ছুটে কাছে এসে দাঁড়ালাম।
উনামাস্টার।
পা থেকে চটি খুলে নিচু হয়ে পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করলাম।
থাক থাক। আমার থুতনি ধরে চুমু খেলেন।
তুই অনেক বড়ো হয়েগেছিস।
না স্যার। আপনার কাছে এখনও আমি অনিই আছি।
তোর লেখা পড়ি। আজকের লেখাটাও পড়েছি। তোর লেখার হাতটা বড়ো ভালো।
আমার মাথা নিচু। মাথা আর তুলি না।
তোর লেখা এখনকার ছেলেগুলোকে পড়াই বুঝলি। ওদের বলি। আনিও তোদের মতো আমার কাছে পড়েছে। কিন্তু তোদের মতো এতো বখাটে ছিল না। ও আমাদের গ্রামের গর্ব। দেখ কলকাতায় গিয়ে কতো নাম করেছে।
স্যারের মুখ থেকে এত প্রশংসা আমি আগে কখনও শুনিনি। বরং বেতের বাড়ি পিঠে পরেছে অসংখ্যবার। লজ্জায় আমার মাথা আর উঠছে না। মাঝে মাঝে মুখ দিয়ে স্যার স্যার বেরিয়ে আসছে। সত্যি গ্রামের মানুষগুলো এতো সাদাসিধে হয় যে তাদের কোনও তুলনা হয় না।
কলকাতা থেকে আসা হচ্ছে?
হ্যাঁ স্যার।
কয়দিন থাকবি তো?
হ্যাঁ স্যার।
মনার আবার শরীরটা খারাপ হয়েছে। বয়স হচ্ছে।
উনামাস্টারের মুখের দিকে তাকালাম।
যা। পারলে একবার দুয়ারে আসিস।
আচ্ছা স্যার।
মনটা খারাপ হয়ে গেল। মনাকাকার শরীর খারাপ—কি হয়েছে! ধীরে পায়ে ট্রলিতে উঠে বসলাম। আর একটুখানি। তারপর নদী পেরিয়ে আমার স্বপ্নের বাড়ি।
বাবু আপনি চকে দাঁড়িয়ে মিছে কথা বলছেন।
চমকে উঠলাম। ট্রলি চালাতে চালাতে ছেলেটি বললো।
আমি! কই না—
ওই যে আপনার পরিচয় দেন নি। আমি কিন্তু আপনাকে চিনতি পারছি।
তুমি আমাকে চেনো!
হ্যাঁ বাবু। আমি বিজয়।
কুইল্যা ঘরের বিজয়?
হ্যাঁ।
হাঁড়িপাড়ায় থাকো?
হ্যাঁ বাবু। আমি তো আপনার ক্ষেতটা ভাগে চাষ করতিছি। মনামাস্টার দিছেন।
আমি অবাক হয়ে বিজয়ের দিকে তাকালাম।
ক্লাস টেনে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অচেনার আনন্দ পড়েছিলাম। সেখানে অপু বিশ্বগ্রাসী ক্ষুধার মতো চারিদিক গিলতে গিলতে চলতো। এখন আমার অবস্থা খানিকটা তাই। আমি যেন আমার নিজের গ্রামে অপু হয়েছি। চারদিক গিলতে গিলতে চলেছি।
নদী ঘাটের কাছে এসে বিজয় ট্রলি থামাল। আমি নামলাম। নড়বরে বাঁশের সাঁকোটা এখনও সেই জায়গাতেই আছে। কোনও পরিবর্তন নেই।
বিজয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, কতো দেব?
না বাবু আপনের কাছ থিকা পয়সা নিতি পারবনি।
কেন! তুমি এতটা পথ এলে—
সে বৈকালে যখন আপনের ঘরকে যাব তখন দিবেন।
না না তুমি এখন নাও।
না।
বিজয় ট্রলি ঘুরিয়ে চলে গেল।
বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে নদী বাঁধে এসে উঠলাম। চারদিক শুনশান। এই কাটফাটা রোদে কে আর বেরবে। বাঁধের ওপর উঠলে আমার বাড়ির টং দেখা যায়। আমিও দেখতে পেলাম। মাত্র কয়েক মিনিটের পথ। মৌসুমি মাসির ছিটে বেড়ার ঘরটা বাঁদিকে রেখে, বাঁশবাগানের মধ্যে দিয়ে বাড়ির পেছন পাশের পুকুর ধারে এলাম। এই দুপুর রোদে চারদিক জনমানবশূন্য। মাঝে মাঝে কুব পাখি কুব কুব করে ডাকছে। নিস্তব্ধ দুপুর। গ্রামের ঘরে দিনে-দুপুরে খুব একটা চুরি-চামারি হয় না। তাই সব কিছুই খোলামেলা। পানাভর্তি পুকুর। বুঝলাম বহুদিন সংস্কার হয়নি। বাঁশঝাড়ের তলা শুকনো পাতায় ভর্তি। শুকনো পাতার ওপর দিয়ে হাঁটতেই একটা চড়চড় আওয়াজ হলো। আমি আমার বাড়ির সামনে এলাম।
চলবে—————————
from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/Hj4t1rL
via BanglaChoti
Comments
Post a Comment