“কাজলদীঘি”
BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়
৩৮ নং কিস্তি
—————————
আমরা সবাই খিড়কি দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলাম। বেরবার মুখে সবাইকে বললাম, কেউ জোড়ে কথা বলবে না। আর কোনও প্রশ্ন করবে না।
এটা কি রকম কন্ডিশন অনিদা। টিনা বললো।
ঠিক আছে, ফিস ফিস করে বলবে।
কিরে বুবুন পেছন দিক দিয়ে কেন? সামনের দিক দিয়ে চল।
অনিদা আমরা শ্মশানে যাব। নীপা বললো।
আমি মুখে আঙুল দিয়ে বললাম, ফিস ফিস করে।
আচ্ছা আচ্ছা।
দেখলাম মিলির চোখ দুটে উত্তজনায় ফেটে পড়ছে। এতো ঘনো অন্ধকার। ঝিঁঝিঁর ডাক। নিস্তব্ধ রাত্রি ও আগে দেখেনি। চাঁদের আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে।
ওরে বাবা কি সর সর করে উঠলো। মিলি আমার কাছে চলে এলো। চোখে মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।
হাসলাম, কিছু না।
লাইন দিয়ে আমরা হাঁটছি। ডানদিকে খাল। খাল বাঁধে বাঁশঝাড়ের ঘনো বন। মাঝখানে একফালি শরু রাস্তা। আমি সবার আগে, আমার পেছনে মিত্রা, টিনা, মিলি। সবার পেছনে নির্মাল্য তার ঠিক আগে নীপা। ছেঁড়া ছেঁড়া কথা চলছে। কোথাও মাথা নীচু করে কোথাও ঝুঁকে পড়ে আমার খালের ধার বরাবর চলে এলাম খাঁড়্যেগড়্যার বিলে।
এইটা কিসের মাঠ রে অনি? দেবাশিস বললো।
এটা খাস জমি গরু চড়ে দিনের বেলা। এক কথায় বলতে পারিস ভাগার।
মিলি আমার হাতটা শক্ত করে ধরলো, মিত্রাও আমার হাত ধরে আছে। আর এক পাশের হাত ধরেছে টিনা। আমি ওদের দিকে তাকালাম। জ্যোৎস্নাভেঁজা রাত, ওদের চোখে বিস্ময়।
দেখ দেবা আমি কি ভাগ্যবান। আমার তিনটে বউ। তোর একটা।
যাও তোমার হাত ধরবো না। টিনা হাত ছেড়ে দিল।
টিনা এখানে কিন্তু ভূতের উপদ্রব আছে।
ওরে বাবা।
তিনজনেই আমাকে আবার জাপ্টে ধরলো। দেবা, অদিতিও ছুটে আমার কাছে চলে এলো। নীপা, নির্মাল্য আর জায়গা পাচ্ছে না।
সত্যি তোদের ভূতে এতো ভয়!
তুই শালা এই জায়গায় নিয়ে এলি কেন?
একবার আকাশটার দিকে তাকা।
সবাই আকাশের দিকে তাকল।
সত্যি তো অনিদা! এতো সুন্দর চাঁদের আলো? কতো তাড়া দেখ টিনা। মিলি বলে উঠলো।
পটাপট মিলি, টিনা, মিত্রা, অদিতি মোবাইলের ক্যামেরা ফিট করলো।
তোরা একটু ছবি টবি তোল, আমি একটু আসছি।
না তুই যাবি না। মিত্রা বললো।
আচ্ছা তুমি কি একটু অনিদাকে টয়লেটেও যেতে দেবে না। টিনা বললো।
ও টয়লেটে যাচ্ছে না, মাথায় কিছু দুর্বুদ্ধি আছে, তুই জানিস না।
মিলি, টিনা হি হি করে হাসছে।
আচ্ছা পাঁচ মিনিট। দুটো ধেড়ে ছেলে আছে তোর ভয় কি।
ওগুলো এখানে মেয়ে।
মিত্রাদি। অদিতি চেঁচিয়ে উঠলো।
চেঁচাসনা। একটু পরে ঠেলা বুঝবি।
তাহলে এলি কেন। নীপা তো আছে।
ও আর একজন, দেখলি না কেমন ছুটে চলে এলো।
মিত্রা ঠিক বলেছে। দেবা বললো।
ঠিক আছে। আমি যাব আসবো।
মিত্রার হাতটা ছাড়িয়ে আমি হাঁটতে হাঁটতে সামনের বোনের মধ্যে ঢুকে গেলাম। দূর থেকে পেঁপে গাছটাকে লক্ষ্য করেছিলাম। গুনে গুনে আটটা পেঁপে পাতা ভাঙলাম। ভালো করে পরিষ্কার করে নিলাম। ঝোপের ফাঁক দিয়ে দেখলাম সবাই গোল হয়ে খুব ক্লোজে দাঁড়িয়ে ঝোপের দিকে তাকিয়ে। আমি ওখান থেকে শেয়ালের ডাক ডাকলাম। দু-চারবার ডাকার পরই দেখলাম, ওরা আমার নাম ধরে তারস্বরে চেঁচাতে শুরু করে দিয়েছে। হিতে বিপরীত। আমি দৌড়তে দৌড়তে কাছে এলাম। মিত্রা শক্ত কাঠের মতো দাঁড়িয়ে আছে। দু-দিকে টিনা, মিলি।
আসতেই আমাকে জড়িয়ে ধরলো। ওই দেখ শেয়াল।
কোথায় শেয়াল!
মিত্রা বোনটার দিকে আঙুল তুলে দেখাল। চোখ ভয়ে পাংশু।
শেয়াল তুই দেখেছিস আগে।
তুই বাড়ি চল। আমার ঘোরার দরকার নেই। দেবাশিস বললো।
আমি এতদিন এখানে থাকলাম কানারাতে কোনওদিন বেরইনি। আমার কেমন ভয় ভয় করছে মিত্রাদি। নীপা বললো।
দেখলি কেমন সাহস।
অনিদা তোমার হাতে ওটা কিগো! মিলি বললো।
তুই আবার খেজুর রস চুরি করবি! মিত্রা বললো।
এবার সবাই জোড়ে হেসে উঠলো।
দেখি দেখি মালটা। দেবাশিস এগিয়ে এলো।
শালা এই জন্য তুই ওই ঝোপে গেছিলি। মিত্রা ঠিক কথা বলেছে।
অদিতিরা তখনও হেসে চলেছে।
কিরে খাবি। মিত্রার দিকে তাকিয়ে বললাম। না পেঁপে ডাঁটা গুলো ফেলে দেব।
জলের ব্যবস্থা রাখিস, যদি পটি পেয়ে যায়।
উঃ মিত্রাদি তুমি না….। মিলি বললো।
ওর সঙ্গে এই ভাবে কথা না বললে বিপদ আছে, দেখবি দাঁড়া।
চল খালটা পেরতে হবে।
আবার সেই পচা পাতা! কাদা জল।
মিত্রা নীপার দিকে তাকাল।
কিরে নীপা?
ওটা ওইদিকে। আমরা অন্য রাস্তায় এসেছি।
সেই জায়গা মিত্রাদি। মিলি বললো।
আমি হাসছি।
নীপা কোথা দিয়ে আমরা পেরোব গো। টিনা বললো।
সত্যি বলবো টিনাদি।
বল।
আমি এই রাস্তা দিয়ে কোনওদিন আসিনি। এই রাস্তা দিয়ে এ গাঁয়ের কেউ যাওয়া আসা করে না।
কেন!
এই রাস্তাটা ভালো নয়।
তারমানে!
বিশ্বাস করো আমি প্রথম এলাম।
সেরেছে।
ওই যে অনিদা বললো, ভাগাড়। এই রাস্তায় লোক মড়া গরু ফেলতে আসে।
ওরে বাবারে অনি এ তুই কি করলি বেঘোরে প্রাণ যাবে। দেবাশিস বললো।
গ্রাম দেখতে বেরিয়েছিস। গল্প, উপন্যাস পড়ে লোকের কাছে গল্প ঝারিস, এইবার ডাইরেক্ট দেখ।
তাই বলে তুই ভাগাড়ে নিয়ে যাবি?
যেতে হয় চল, নাহলে তোরা নীপার সঙ্গে ফিরে যা।
আমি তোমার সঙ্গে যাব অনিদা। নির্মাল্য এগিয়ে এলো।
কে-রে আমার বীরপুরুষ। মুতে নাম লিখতে জান কেলিয়ে গেছিল। তার আবার বরোবরো বুকনি। মিলি টোনট কাটলো।
মিলিদি খুব খারাপ হয়ে যাবে। আমি এবার শুরু করবো।
তুই কি বলবি, চুমুর কথা। মিত্রাদি সবাইকে বলে দিয়েছে।
আমি ওদের কথা শুনে হাসছি।
ওরে মিলি তুই থাম। মিত্রা বললো।
আমি হাঁটতে আরম্ভ করলাম। ওরা আমার পেছন পেছন। আমরা নদীর ধারে এলাম।
দেখ এইখান দিয়ে পেরিয়ে যাব।
জল আছে।
না।
তুই কি ভাল রে। মিত্রা আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
ধ্যাৎ! বাচ্চা বাচ্চা মেয়েগুলো আছে। আমি বললাম।
ওরা বাচ্চা নয়, সব চৌবাচ্চা।
দেবা হাসছে।
অনি সিগারেট খাবি?
এখন খাস না। মজা পাবি না।
বুবুন আমি তোকে ধরে নামবো।
অনিদা আমিও। মিলি বললো।
আমিই বা বাদ যাই কেন। টিনা বললো।
তোমাদের আগে আমি নেমে যাচ্ছি। ড্যাম স্মার্টের মতো নির্মাল্য বললো।
আমি বারন করলাম। দাঁড়া তাড়াহুড়ো করিস না।
কেন!
নির্মাল্যদা শুকনো মাটি, রাতভোর কুয়াশা পরে স্যঁতসেঁতে, ঠিক মতো নামতে না পারলে পা হড়কাবে। নীপা বললো।
হুঁ। নির্মাল্য এগিয়ে গেল।
সত্যি সত্যি একটু নামতেই ব্যালেন্স রাখতে পারলো না। কাঁকর মাটিতে পা হড়কাল গড়িয়ে একেবারে নিচে।
মিলি দাঁতে দাঁত চিপে চেঁচিয়ে উঠলো, কিরে পাঁঠা এবার শখ মিটেছে।
আমি দৌড়তে দৌড়তে নীচে নেমেগেলাম। দেখলাম নির্মাল্যের হাত ছোড়ে গেছে। পড়ে গিয়ে কাতরাচ্ছে।
কেন তুই তাড়াহুড়ো করলি। আমি বারন করলাম।
বুঝতে পারিনি অনিদা।
কোথায় লেগেছে?
পাছায়।
কোমড়ে লাগেনি তো?
না।
দাঁড়া।
ওপরে তাকিয়ে দেখলাম নীপা, অদিতি, দেবাশিসকে হাতে ধরে আস্তে আস্তে নামাচ্ছে।
ওরা তিনজন দাঁড়িয়ে আছে।
দাঁড়া আমি আসছি।
নদীর জল এখন শুকনো। এখানে ওখানে সামান্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। আমি রুমাল ভিঁজিয়ে এনে ওর কনুই মুছিয়ে দিলাম। নির্মাল্য পাজামা পাঞ্জাবী পরেছে। হাঁটুর কাছে কাদা লেগে গেছে। আমি নদীর এপারে এসে ককসীমা পাতা খুঁজে বার করলাম। আবার নামলাম। দাঁত দিয়ে চিবিয়ে তার রসটা লাগিয়ে দিলাম নির্মাল্যের কনুইতে।
কি জালা করছে গো অনিদা।
এটা ডেটলের বাবা। একটু পরেই দেখবি ব্যাথা কমে যাবে।
এটা কি পাতা অনিদা। নীপা বললো।
ককসীমা।
নামই শুনিনি।
তুমি শহরের মেয়ে।
টিজ করবে না বলেদিচ্ছি।
দেখছো অদিতি ওইটুকু ছোট্ট শরীরে কি রাগ।
অদিতি, দেবা হাসছে।
তুই ওপরে যা, তুই না গেলে ওরা নামবে না।
তোরা নদীটা পেরিয়ে যা। নীপা নিয়ে যাও ওদের, আমি ওগুলকে নামাই। বালি দেখে দেখে নিয়ে যেও।
আমি আবার তরতর করে ওপরে উঠে এলাম।
জুতো খোল।
খালি পায়ে নামবো! পায়ে যদি লাগে। মিত্রা বললো।
নির্মাল্যের মতো হড়কাবি।
এই রাস্তা ছাড়া তোর সর্টকাট রাস্তা নেই।
আছে। সেই রাস্তায় এলে লোকে জেগে যাবে তোদের কথায়। তারপর চোর চোর করে চেঁচিয়ে উঠে রাম পেঁদান পেঁদাবে।
পেঁদানি খেতাম।
টিনা, মিলি হাসছে।
অগত্যা তিনজনে জুতো খুললো।
টিনাকে বললাম তুমি ডান হাতটা ধরে আগে নামো মিত্রা আমার বাম হাত ধরলো মিলি, মিত্রার হাত ধরেছে। ধীরে ধীরে পা টিপে টিপে নামালাম। এর মাঝে মিলি একবার হড়কেছিলো। দু-জনে মিলে আমাকে জাপ্টে ধরলো।
সত্যি অনিদা মিত্রাদি ঠিক বলেছে তুমি আর জায়গা পেলে না।
কষ্ট করলে, কেষ্ট মেলে।
আমার কেষ্টর দরকার নেই, তোমাকে পেয়েছি এই যথেষ্ট।
মিত্রা ফিক করে হাসলো।
এবার অনিদা জিনিষটা কি বুঝতে পারছিস?
হারে হারে টের পাচ্ছি।
আমরা নদী পেরিয়ে আবার বাঁশ বাগানের মধ্যে দিয়ে হারু জানার কালায় এলাম।
এই পচা পুকুরের ধারে কি করতে এলি। দেবাশিস বললো।
এটা হারুজানার কালা।
তোর সেই বার।
হ্যাঁ।
নীপা এগিয়ে এলো।
সত্যি মিত্রাদি পাঁচ বছর হয়ে গেল এখানে আছি, নাম শুনেছি কোনওদিন আসিনি।
হ্যাঁরে এখন পাওয়া যায়?
বিকেলের দিকে এলে পাওয়া যায়।
জায়গাটা কি নিঃঝুম। আশেপাশে কোনও লোক নেই?
হাফ কিলোমিটারের মধ্যে কোনও বসতি নেই।
বলিস কি!
নির্মাল্য বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলো।
কি শুঁকছিস?
তোমার কথাটা মনে করে গন্ধ পাওয়ার চেষ্টা করছি।
শালা হারামী। দেবাশিস বললো।
তোরা দাঁড়া আমি আসছি।
আবার কোথায় যাবি!
ওই যে গাছটা দেখা যাচ্ছে, দেখতে পাচ্ছিস?
হ্যাঁ।
ওটা থেকে নামাবি? মিত্রা বলে উঠলো।
আমি মিত্রার দিকে তকিয়ে হাসলাম।
চল আমরা যাব।
গু-বোন।
সেটা আবার কি! মিলি বললো।
ওরে ওখানে পটি করে। মিত্রা চেঁচিয়ে উঠলো।
এমাগো। টিনা বললো।
তাহলে এখানে দাঁড়াও। জোরে কথা বলবে না।
আমি যাব তোর সঙ্গে। দেবাশিস বললো।
না তুমি যাবে না পায়ে নোংরা লেগে যাবে। অদিতি বললো।
হাসলাম।
আয়।
দেবাশিস হাসছে।
নির্মাল্য।
না অনিদা একবার শিক্ষা হয়েছে। আর না।
টিনা খিল খিল করছে। নীপা মুখে হাত চাপা দিল।
নীপা তুমি এরকম করো না।
বাবাঃ তুমি যা খেল দেখালে। সকালে মিত্রাদির ক্যারিকেচার দেখবে।
মিত্রাদি কি দেখাবে, আমি যা দেখাব না। মিলি বললো।
আমি আর দাঁড়ালাম না। এগিয়ে গেলাম। দেবাশিস আমার পেছন পেছন এলো।
পেঁপে পাতাগুলো কোথায় রেখেছিস। দেবাশিসের দিকে তাকালাম।
মিলির হাতে।
ঠিক মতো রেখেছে তো, না হলে সব পরিশ্রম বৃথা।
তুই তাড়াতাড়ি গাছে ওঠ। গায়ের চাদরটা খুলে দেবাশিসের হাতে দিলাম। দেবাশিস মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে।
আমি কিছুক্ষণের মধ্যে রসের কল্সি নামিয়ে নিয়ে এলাম।
দেবাশিস এসেই বললো অদিতি অনি বাঁদরের মতে তরতর করে গাছে উঠে গেল।
বাঁদর নয়, হনুমান বল। মিত্রা বললো।
ভাগ পাবি না।
উঁ।
পটি পেয়ে যাবে।
ওই তো জল আছে। তায় অন্ধকার কেউ দেখতে পাবে না।
মিত্রাদি। টিনা বলে উঠলো।
আমি পেঁপের ডালগুলো একসঙ্গে করে এদিক ওদিক তাকালাম।
কি খুঁজছিস। মিত্রা বললো।
টিনা তোমার ওর্ণাটা দাও।
কেন!
দাও না।
টিনা গা থেকে ওর্ণাটা খুলে দিল। আমি ভালো করে পেঁপের ডালের একদিকে বেঁধে কলসির মধ্যে ঢুকিয়ে দিলাম। যার যারটা নিয়ে টানতে আরম্ভ কর। বেশি দেরি করা যাবে না। লোক এসে পরলে, পেঁদানি, মাথায় রাখবে।
উরি বাবারে কি ঠাণ্ডা। দেবাশিস বললো।
প্রথমটা একটু লাগবে পড়ে দেখবি ঠিক হয়ে যাবে।
অনিদা দারুণ টেস্ট। টিনা বললো।
সবাই গোল হয়ে বসে টানতে আরম্ভ করলাম। কারুর মুখে কোনও কথা নেই। চোঁ চাঁ আওয়াজ।
দেবাশিস পেঁপে নল থেক মুখ উঠিয়ে বললো। বিউটি ফুল।
ছাগল, কথা বলিস না। কম পড়ে যাবে। দেখছিস টিনা, মিলি কেমন টানছে। যেন পেপসি খাচ্ছে। আমি বললাম।
সবাই হো হো করে হেসে উঠলো।
বুবুন আর পারছি না। মিত্রা বললো।
কিরে এরি মধ্যে কেলসে গেলি।
যদি পটি পেয়ে যায়।
টান টান। পটি পেলে জায়গা আছে।
তুই আবার নাচতে বলবি।
নীপা নল ছেড়ে হাসতে হাসতে পেছনে ধপাস করে উল্টে পড়েগেলো।
কি হলো নীপা?
আমি আর পারবো না অনিদা।
কিরে হলো? আমি বললাম।
আর একটু দাঁড়া। মিত্রা বললো।
সব খাওয়া যাবে না। একটু রাখতে হবে।
উঃ কি টেস্ট। টিনা বললো।
মিলি গঁ গঁ করে উঠলো।
কি হলো মিলি?
কথা বলো না কম পড়ে যাবে।
নির্মাল্য টেনে যাচ্ছে।
শয়তান ঢ্যামনা। এবার ছাড়। মিলি বললো।
তুমি খাওনা ডিস্টার্ব করছো কেন।
এবার ছাড়, কলসি তুলে রেখে আসি। আমি বললাম।
ওরা উঠে দাঁড়াল।
আমি আবার ছুট লাগালাম। কলসি তুলে এসেই বললাম এখানে আর দাঁড়ান যাবে না। সময় হয়ে গেছে লোক আসার, চল এখান থেকে কেটে পরি।
আমার ওর্ণা। টিনা বললো।
ঠিক বলেছো দাঁড়াও।
আমি টিনার ওর্ণাটা নিয়ে তরতর করে জলে নেমে গেলাম ভালো করে ধুয়ে নিংড়ে দিলাম। টিনার হাতে দিয়ে বললাম, একটু জড়িয়ে নাও শুকনো হয়ে যাবে।
টিনা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলো।
এবার কোথায় যাবি? মিত্রা বললো।
স্কুলে।
তোর সেই স্কুলে।
না।
আমাদের স্কুলে। নীপা বললো।
থাম। তোর স্কুল। মিত্রা বললো।
বা-রে আমিও ওই স্কুল থেকে এবার উচ্চ মাধ্যমিক দিলাম।
এটা ঠিক কথা মিত্রাদি। নির্মাল্য বললো।
ওরে! এটা আবার কবে থেকে সাউকিড়ি করতে শিখলো। মিলি বললো।
আমি সামনে হেঁটে চলেছি। ওরা পেছন পেছন আসছে। ফিস ফিস করে কথা বলছে সবাই।
আমার অনুসন্ধিৎসু চোখ চারিদিকে বন বন করে ঘুরছে। কেউ এদিকে আসছে কিনা। আমাদের কেউ দেখে ফেললো কিনা। কানে এলো….
আমি বলবো না, তুই বল। টিনা বললো
তুই বল, অনিদা তোকে ভালোবাসে। মিলি বললো।
দূর গালাগালি কে খাবে। টিনা বললো।
চেপে থাক। অদিতি বললো।
দুর চাপা যায়। আমি আর পারছি না। মিত্রা বললো।
তুই বল। দেবার গলা।
বুবুন। মিত্রা চেঁচাল।
কি হলো।
অতো তাড়াতাড়ি হাঁটছিস কেন একটু দাঁড়া না।
ধরতে পারলে পেঁদিয়ে লাস বানিয়ে দেবে।
খাওয়াতে গেলি কেন?
খেলি কেন।
মনে হচ্ছে কাজ করতে শুরু করেছে।
কি!
ফিরে দাঁড়ালাম। দেখলাম সবাই হন হন করে এগিয়ে আসছে। নিজের মনে নিজে হাসি। কিন্তু গম্ভীর মুখ। কাছে এসেই মিত্রা বললো।
তুই বিশ্বাস কর।
বলেছিনা….।
প্লিজ তুই আর বলিসনা। সকালে খালি পেটে….।
চোব্য চষ্য গিলবি….। আমি চেঁচিয়ে উঠলাম।
আমার একার নয়….।
অনিদা আমারও….মিলি আমার দিকে কাকুতি মিনতি করে তাকাল।
টিনারা দিকে তাকালাম। টিনা মাথা নীচু করে হাসছে।
ওরা বলতে পারছে না। আমি বলে ফেললাম। মিত্রা বললো।
দেবাশিসের দিকে তাকালাম।
আমরা এই পাশে যাই, ওরা ওই পাশে যাক। এখন তো অন্ধকার। অসুবিধে কোথায়। তোর পায়নি? দেবাশিস বললো।
এখানে জল নেই, ঘাসে মুছতে হবে। না হলে পাতায়।
তাই করবো।
তুই এরকম জায়গায় নিয়ে এলি কেন? মিত্রা বললো।
আর মিনিট পাঁচেক চল। একটা পুকুর আছে।
বেড়া ঘরের পুকুর পার। নীপা বললো।
ওটা পেড়িয়ে এসেছি।
অন্ধকারে কিছুই বুঝতে পারছি না।
তুই কিন্তু ব্যবস্থা কর, নাহলে কেলেঙ্কারী কাণ্ড হেয়ে যাবে। দেবাশিস বললো।
ঠিক আছে।
একটু এগিয়ে এসেই শবর পাড়ার গায়ে সেই পুকুর ধারে এলাম। চারিদিক শুনশান লোকজন নেই। আমি দাঁড়ালাম।
যে যার মতো উধাও হয়ে যা। আমার মুখ থেকে কথা বেরোবার আগেই ওরা পা বারাল।
দেবা আমাকে সিগারেটের প্যাকেটটা দে।
দেবা একটা সিগারেট বার করে ধরিয়ে প্যাকেটটা আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দে দৌড়।
নিমেষের মধ্যে সকলে হাওয়া হয়ে গেল।
আমি মাঠের মাঝখানে আইলের ওপর একা বসে পড়লাম।
এ পাসের মাঠে ধান কাটা হয়ে গেছে ধান তোলাও হয়ে গেছে। এবার সরষে বোনা হবে। কেউ কেউ এরই মধ্যে বুনেও দিয়েছে। চাঁদের আলোটা সামান্য ফিকে হয়ে এসেছে। পূব আকাশটা ফর্সা হয়ে এসেছে। দূরে দিগন্ত রেখাটা আস্তে আস্তে চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে আসছে। সিগারেট ধরালাম। মৌতাত করে সিগারেট খেতে আরম্ভ করলাম। সকাল বেলা সিগারেটটা খেতে বেশ ভালো লাগছে। হাল্কা হাল্কা হাওয়া বইছে। শীতটা এখনও সেই ভাবে বিদায় নেয়নি। সিগারেট খেতে খেতে নিজের কাজ কিছুটা সারলাম।
অনি। দেবাশিস চেঁচিয়ে ডাকলো।
চমকে পেছনে তাকালাম। চারিদিক থেকে অনি কথাটা রিনি ঝিনি করে ছড়িয়ে পরলো। দেখলাম দেবাশিস শেলো টিউবওয়েলের খড়ের ছাউনি ঘরটার পাশ দিয়ে হেঁটে আসছে।
আমি তাকাতেই হাত নারলো।
এখান থেকে বুঝতে পারছি মুখে হাসি হাসি ভাব। নির্মাল্যকে দেখতে পেলাম না।
এদিকে দূরে পুকুর পাড়ের ঝোপ থেকে একে একে সবাই লাইন দিয়ে বেরলো। ওরা সবাই কাছে এলো। নির্মাল্যকে দেখতে পেলাম না।
অদিতি তোমার এক্সপিরিয়েন্সটা কেমন আগে বলো, তারপর আমারটা শেয়ার করবো। দেবাশিস বললো।
আমি ওদের দিকে তাকিয়ে আছি। হাসছি।
টিনা, মিলি, নীপা মুখ টিপে হাসছে।
সত্যি অনিদা তোমার গ্রামে এসে মার্ভেলাস এক্সপিরিয়েনস। অদিতি বললো।
সাবান তো পেলে না, কি করলে।
কেন? কি সুন্দর মাটি।
তোমদের অবস্থা দেখে আমার গোপালভাঁড় আর কৃষ্ণচন্দ্রের গল্পটা মনে পড়ে যাচ্ছে।
প্লিজ আর বলতে হবে না। টিনা বললো।
সত্যি অনি গল্পটার সারার্থ আজ উপলব্ধি করলাম। দেবাশিস বললো।
শালা।
একটু একটু করে অন্ধকারের বুক চিড়ে ভোরের আলো ফুটে উঠছে।
ওই দূরে মোরাম রাস্তাটা দেখতে পাচ্ছিস?
হ্যাঁ।
কাল ওই রাস্তায় এসেছিলাম।
উরি শালা এতটা চলে এসেছি।
আমরা কিন্তু ওই বনের ভেতর দিয়ে এসেছি।
সত্যি অনি ভাবলেই অবাক লাগছে।
নির্মাল্যটা গেল কোথায়?
ও শালা এখনও বসে আছে।
তারমানে!
প্রথমবার বসে ছিল। তারপর চেঁচিয়ে উঠলো, দেবাদা মরে গেলাম।
আমি ঝট করে উঠে দাঁড়ালাম।
তুই বোস, কিছু হয়নি।
ওই দিকে তাকিয়ে দেখলাম নির্মাল্য হন হন করে হেঁটে আসছে। দেবা খিল খিল করে হাসছে।
ওখান থেকেই নির্মাল্য চেঁচাল।
তুমি শালা বহুত বেইমান। নিজেরটা যেই হয়ে গেল ফুটে এলে।
সবাই হো হো হো করে হেসে ফেললো। হাসি কারুর থেমে নেই।
কেন তোকে ছু-ছু করিয়ে দেবে। মিলি বললো।
নির্মাল্য, মিলির কথাটা গায়েই মাখল না।
কি বিশাল একটা সাপ।
মিত্রা আমার কাছে চলে এলো।
কোথায় দেখলি!
সবে মাত্র বসেছি। পেছন দিকে সর সর আওয়াজ। তাকিয়ে দেখি এই মোটা এই লম্বা।
কিরকম দেখতে?
হলুদের ওপর মেরুন কালারের ছোপ।
ঢ্যামনা সাপ। ইঁদুর খেতে বেরিয়েছিল।
রাখো তোমার ঢ্যামনা।
সত্যিরে লেজটা ধরে কতোবার আছাড় মেরে মেরেছি। তারপর গোড়ালি দিয়ে মুখটা থঁতলে দিয়ে মাটিতে পুঁতে দিয়েছি।
কামরালে কি করতে?
ওর বিষ নেই।
টিনা কখন আমার হাতটা শক্ত করে ধরেছে বুঝতে পারিনি।
তোর বুকটা এখনও ধক ধক করছে?
করবে না!
টিনা ফিক করে হাসলো।
একবারে চাটবে না টিনাদি।
মিত্রা আমার কাঁধে মাথা রেখেছে।
তোর আবার কি হলো?
সেদিন কাকা তোর এই কীর্তির কথা ডাক্তারদাদা, মল্লিকদা, দাদাকে বলছিল। নীপাকে জিজ্ঞেস কর?
নীপা ফিক ফিক করে হাসছে।
আমি মিত্রার দিকে তাকালাম।
সত্যি। মিত্রা বললো।
তাতে তুই কেলসে গেলি কেন?
তুই এখনও এইসব করবি!
মিলি এগিয়ে এসে আমার হাতটা ধরে দেখতে লাগলো।
হ্যাঁ-রে। মিত্রা, টিনা-মিলির দিকে তাকল।
শুনে বুকটা হিম হয়েগেছিল। সাগরেদ কে চিকনা, ভানু। মিত্রা বললো।
তুই এখন ঠিক আছিস তো। নির্মাল্যের দিকে তাকিয়ে বললাম।
হ্যাঁ।
দেবা ওকে একটা সিগারেট দে।
না খাবো না।
পেটে রস আছে, না সব বার করে দিলি।
আর থাকে। পুরো জায়গাটা কাদা করে দিয়ে এসেছি।
যাক তাহলে এতো দিন পরে নামটা লিখতে পারলি।
মিলিদি আবার শুরু করেছো।
ঠিক আছে আর বলবো না।
দেবা ওই টালির বাড়িটা দেখতে পাচ্ছিস। আমি বললাম।
হ্যাঁ।
ওটা আমার আর নীপার স্কুল।
তুই শালা এখান থেকে ওই জায়গায়! হ্যাটস অফ মাইরি।
দেবাদা এই ভাবে। টিনা আমার সামনে মার্চ পাস্টের ভঙ্গিতে এসে স্যালুট করলো।
টিনা খুলে পড়ে যাবে। মিলি বললো।
ধ্যাত।
যেতে যেত পথের বামদিকে পীরসাহেবের থান পরলো। আমরা সবাই দাঁড়ালাম। মিত্রা আমাকে ধরে আছে।
যা ওদের নিয়ে যা। আমি এখানে বসি।
তুই চল।
যাচ্ছি, তোরা যা।
মিত্রা ওদের নিয়ে গেল।
সবাই জুতো খুলে পুকুরে হাত-পা-মুখ ধুলো। তারপর সেই অশ্বত্থতলায় প্রণাম করলো। দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারছি মিত্রা ওদের সেই সব গল্প শোনাচ্ছে। ওরা গোল হয়ে সব দাঁড়িয়ে আছে। আমি পুকুরের এপারে বসে আছি। ওরা চারিদিকটা ঘুরে ঘুরে দেখলো।
তারপর ধীর পায়ে সবাই আমার কাছে এলো।
দেবাশিস আমাকে এসে জড়িয়ে ধরলো। মিলি, টিনা, অদিতি, নির্মাল্য ঢিপ ঢিপ করে প্রণাম করলো।
এইসব আবার কি হচ্ছে!
ওরা মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
অনিদা আর্শীবাদ করো যেন তোমার মতো হতে পারি। অদিতি আমার ডানহাতটা নিয়ে মাথায় ঠেকালো।
কেন আমি কি ভগবান?
এ জন্মে তাঁকে দেখার সৌভাগ্য হবে না। সেই কপালও আমাদের নয়। তার রিপ্রেজেন্টেটিভকে দেখে চোখ জুড়ই। টিনা বললো।
ভুল করছো। জায়গাটা আমার ভালো লাগে। আমিও তোমাদের মতো ওই গাছটার কাছে আসি।
সত্যি তুই দেখেছিস! দেবাশিস বললো।
না।
তাহলে?
বলতে পারবো না, ব্যাখ্যা করতে পারবো না, বলতে পারিস একটা মিথ।
একটু থেমে। আমার বিশ্বাসের বড়ো জায়গা।
ছবি তুলতে পারবো অনিদা। টিনা বললো।
কেন পারবে না!
মিলি, টিনা, অদিতি ওদের মোবাইলের সার্টার অন করলো।
মিত্রা আমার হাতটা ধরে বললো, আজ আর একটা জিনিষ চাইলাম।
হাসলাম।
ওদর সবার কাপালে মাটি লাগিয়ে দিয়েছি।
বেশ করেছিস।
নির্মাল্য খুব গম্ভীর হয়ে রয়েছে।
ওর দিকে তাকালাম। চোখে চোখ পড়তেই মাথাটা নীচু করে নিল।
কি নির্মাল্যবাবু?
নির্মাল্য কাছে এগিয়ে এলো। চোখে হাজার প্রশ্ন।
তুমি রাতের অন্ধকারে এখানে একলা আসো!
হ্যাঁ।
তাহলে তুমি সাপ মারতেই পার।
এতক্ষণে তুই বুঝলি? মিলি বললো।
নির্মাল্য মাথা নীচু করে নিল।
অনিদা।
কি।
না থাক তোমায় পড়ে বলবো।
এখন বল না।
মিলিদিরা ইয়ার্কি মারবে।
ঠিক আছে।
চলো কোথায় যাবে বললে।
অনিদা কুল খাব। টিনা বললো।
এখানে পাওয়া যাবে না।
যাবে, তুমি চেষ্টা করলেই হবে।
এ খবর তোমায় কে দিল?
হল কালেকশন।
টিনা দারুন দিয়েছে মাইরি। দেবাশিস হাসতে হাসতে বললো।
আমরা পায়ে পায়ে স্কুলের সামনে এলাম। সবে মাত্র ভোর হয়েছে। পূব আকাশটায় গাঢ় কমলা রং ছড়িয়ে পরেছে। ওরা ক্যামেরায় কেউ মুভি তুলছে, কেউ স্টিল ফটো তুলছে।
নীপা নবোদা এখনও আছে?
আছে।
এখনও এখানে থাকে?
হ্যাঁ।
অনি।
পেছন ফিরে তাকালাম।
এই মাঠে শুধু ধান চাষ হয়, না অন্য কিছু। দেবাশিস বললো।
শুধু ধান চাষ হয়। এগুলো সব তিন ফসলী জমি।
তুই এগুলো সব জানিস।
গ্রামের ছেলেরা এই সব আপনা থেকেই শিখে ফেলে।
শহরের ছেলেদের কতো মাইনাস পয়েন্ট বল।
এখানে যখন এসেছিস প্লাস করে নে।
একটা করলাম। যা জীবনে কখনও করিনি।
অদিতি দেবার দিকে তাকিয়ে বললো, যাঃ।
মিত্রা কোথায়রে?
ওই দেখ কি করছে।
তাকিয়ে দেখলাম স্কুলের সামনে মাঠের ধারে যে ঝোপটা আছে সেখানে দৌড়দৌড়ি করছে।
কি করছিস রে? চেঁচিয়ে বললাম।
দাঁড়া একটা জিনিষ ধরছি।
অদিতি দেবার হাতটা ছেড়ে মিত্রার দিকে তীরের মতো ছুটে চলে গেল। দেখা দেখি টিনা, মিলি দৌড়লো। নির্মাল্য একটু দূরত্ব রেখে একা একা এদিক ওদিক ঘুরছে। বড় আনমনা মনে হচ্ছে।
একটা সিগারেট দে।
দেবা পকেট থেকে বার করলো। আমাকে একটা দিল নিজে একটা ধরাল।
নির্মাল্যর দিকে তাকিয়ে বললাম একা একা কি করছিস নির্মাল্য?
নির্মাল্য পায়ে পায়ে কাছে এগিয়ে এলো। জানো অনিদা এখানে এসে অলস অথচ এনজয়বেল টাইম উপভোগ করছি।
ঠিক বুঝতে পারলাম না!
দূর তোমার মতো ভাষা আছে নাকি?
ঠিক আছে তুই তোর মতো করে বল।
কলকাতায় সকালে ঘুম থেকে উঠেই রুটিন মিলিয়ে কতো কাজ, নাকে মুখে দেখতে পাই না। মাঝেমাঝে কাজ করতে ইচ্ছে করে না।
ঠিক।
এখানে দেখো। কোনও কাজ নেই কিন্তু মনের মধ্যে কোনও অলসতা নেই।
তার মানে কলকাতায় অলস সময়গুলো তুই এনজয় করতে পারিস না এখানে সেটা পারছিস।
একেবারে ঠিক।
জানো অনিদা মায়ের মুখ থেকে শুনেছিলাম আমাদের নাকি একটা দেশ আছে।
কোথায়?
বর্ধমানের ওইদিকে। সেটাও গ্রাম।
যাস নি?
না। মায়ের মুখে শুধু গল্পই শুনেছি। আজ পুরোপুরি উপভোগ করছি।
তোর ভালো লাগছে?
দারুণ। সবচেয়ে ভাল লাগছে এই নির্জনতা। বাতাসের সাঁই সাঁই আওয়াজ। এতো নির্জন, এসি রুমে একা বসে থাকলেও পাই না।
দারুণ কথা বললি।
ফিরে গিয়ে একাটা আর্টিকেল লিখব একটু এডিট করে দেবে?
অবশ্যই, কেন দেবো না।
একটা বড় কাজ এসেছে। আমাদের কপিরাইটাররা কিছুতেই নামাতে পারছে না। তুমি এখানে নিয়ে এসে আমার মনের পলিগুলো ড্রজার দিয়ে কেটে পরিষ্কার করে দিচ্ছ।
বাবা তোর ভাব তো দুধের মতো উথলে উঠছে। দেবাশিস বললো।
দেখছো অনিদা দেখছো, দেবাদা কিরকম বলছে।
তুই যে একটা অতবড়ো পোস্ট হোল্ড করে রেখেছিস সেটা পাত্তাই দেয় না।
মিথ্যে কথা বলবো না। দেবাদা অনেক হেল্প করে। দায়ে অদায়ে দেবাদার কাছে ছুটে যাই। আফটার অল দেবাদা এই ফিল্ডে আমার সিনিয়ার।
বুউউউবুউউউন।
মিত্রার তারস্বর চিৎকারে ফিরে তাকালাম। দেখলাম মিত্রা মাটিতে বসে পা ছুঁড়ছে। অদিতি, মিলি, টিনা, নীপা মাগো বাবাগো মাগো বাবাগো করে তারস্বর চিৎকার করছে।
প্রথমটা একটু হকচকিয়ে গেছিলাম। তারপর এক ছুটে কাছে গেলাম। দেবাশিস, নির্মাল্য আমার পেছন পেছন। কাছে যেতেই মিত্রা হাউ হাউ করে কেঁদে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। পায়ের দিকে আঙুল দেখাল। তখনও সজোরে পা ছুঁড়ে চলেছে।
তাকিয়ে দেখলাম একটা জোঁক ওর পায়ে বসে আছে। টেনে জোঁকটাকে বার করলাম। একটা মাটির ঢেলা দিয়ে পিষে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিলাম। রক্ত বেরচ্ছে। জায়গাটা চেপে ধরলাম। মিত্রা আমার কাঁধে মাথা দিয়েছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
আরে বোকার মতো কাঁদে। দেখ কিছু হয়নি।
টিনা, মিলি, অদিতি মাটিতে থেবরে বসে হাঁপাচ্ছে। ভয়ে ওদের চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসবে এমন অবস্থা। নীপাকে বললাম যাও তো একটু ককসীমা পাতা নিয়ে এসো।
নীপা হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, চিনিনা।
মেনি বেড়ালের মতো উঁ উঁ করছিস কেন—কিচ্ছু হয়নি।
কতোটা রক্ত খেয়ে নিল। মিত্রা বললো।
এখানে কি করছিলি?
প্রজাপতি ধরছিলাম।
শখ দেখোনা। প্রজাপতি ধরছে বুড়ো বয়সে।
টিনা, মিলি, অদিতি ফিক ফিক করে হাসছে।
দেবাশিস নির্মাল্য থ।
আমি জায়গাটা থেকে আঙুল সরালাম দেখলাম রক্ত বন্ধ হয়ে গেছে।
বোস এখানে, আসছি।
কোথায় যাচ্ছিস?
মরতে।
মিত্রা হেসে ফেললো।
নির্মাল্য একটু আয়তো।
নির্মাল্য আমার কথা মতো পেছন পেছন এলো। আমি স্কুলের পুকুর থেকে একটা পদ্মপাতা তুলে তার মধ্যে জলদিয়ে নির্মাল্যকে বললাম যা গিয়ে পাটা ধুয়ে দে আমি যাচ্ছি।
পুকুরের ওপারে গেলাম। কোকসীমা গাছ ছিঁড়লাম। এসে দেখলাম ওরা গোল হয়ে বসে আছে। মিত্রা পা ছড়িয়ে। আমি একটা একটা ডাল ভেঙে যে রস বার হলো তা ওর পায়ে লাগালাম।
ওরা সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে আমার দিকে দেখছে।
বুবুন চুলকোচ্ছে।
চুলকুনি বন্ধ করার জন্য গোবর লাগাতে হবে। লাগাবি।
এ-মাগো। টিনা নাক সিঁটকিয়ে উঠলো।
তুই খেঁচাছিস কেন?
মিত্রার দিকে বিরক্তি চোখে তাকালাম।
দেহি পদ পল্লব মুদারম। আমি বললাম।
সবাই হাসে।
দেবাশিস আমার কাঁধটা ঝাঁকিয়ে বললো। হাইড দিয়েছিস গুরু।
তুমি পুরো বৈষ্ণব পদাবলী ঝেড়েদিলে! মিলি বললো।
তুমি গেঁওটাল মাটি চেনো। নীপার দিকে তাকিয়ে বললাম।
কাকে বলে?
তুমি গ্রামে আছ কি করতে।
মশাই একপাও বেরতে দেয় না।
আমাকেও দিত না।
তুমি আমি এক।
দাঁড়া। নিয়ে আসি।
আমি আবার পুকুর ঘাটে গিয়ে গেঁওটাল মাটি নিয়ে এলাম। ওর ওখানে লাগালাম। তারপর একটা লতা ছিঁড়ে পদ্মপাতা দিয়ে জায়গাটা বেঁধে দিলাম।
দারুণ ব্যান্ডেজ করলি। দেবা বললো।
কিছু শিখলে মিলিদি। নির্মাল্য গম্ভীর হয়ে বললো।
তুই চল, তারপর হচ্ছে।
কি করবে?
চলনা দেখবি। অদিতি সব সানিয়ে রাখবি। আজ তোকে কুরমুর করে খাব।
অনিদা আছে।
অনিদা তোকে পাহাড়া দেবে?
পেছন ছাড়ছি না।
আমি ফিক ফিক করে হাসছি।
এবার ওঠ।
দাঁড়ানা।
এত ঢেপুস হলে চলে।
তোর হলে কি করতিস।
কেউ জানতেই পারত না।
মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে।
নে উঠে দাঁড়া।
মিত্রা আমাকে ধরে উঠে দাঁড়াল।
জুতো কোথায়?
ওই যে খুলে চলে গেছে।
যা নাচানাচি করলি ছিঁড়ে যায়নি এই ভাগ্য ভালো।
নীপা গিয়ে জুতো নিয়ে এলো।
প্রজাপতি ধরেছিস?
সব উড়ে চলে গেল।
ওগুলো মেয়ে প্রজাপতি ছেলে হলে ধরা দিত।
যেমন তুই বল।
ছাগল।
লিঙ্গে ভুল করলি।
আমি মিত্রার দিকে তাকালাম। টিনা, মিলি, অদিতি মুখে হাত চাপা দিয়েছে।
চালা চালা বেশ লাগছে মাইরি। সেই কলেজ লাইফটা যেন ফিরে পাচ্ছি। দেবাশিস বললো।
ফ্যাটকাসনা।
মিত্রার দিকে তাকিয়ে বললাম, চল অনেক হয়েছে। ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরে চল।
না যাব।
কোথায় যাবি?
তোর স্কুলে।
ওই তো দেখা যাচ্ছে চলে যা।
চলনা ওরকম করিস কেন।
অগত্যা মাঠ পেড়িয়ে ওদের স্কুলে নিয়ে এলাম। মিত্রা আমার হাত ধরে একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে।
কি হলো।
ব্যাথা লাগছে।
বাড়িতে চল পলতে পুড়িয়ে ছেঁকা দিয়ে দেব, ঠিক হয়ে যাবে।
তুই আমাকে পুড়িয়ে মারবি।
টিনা, মিলি আমার দুপাশে। হাসছে।
তোর একটুও ব্যাথা লাগছে না। তুই মনে মনে ভাবছিস তোর ওখানে ব্যাথা।
তোকে বলেছে।
আমরা সবাই এসে স্কুলের বারান্দায় দাঁড়ালাম।
ওরা স্কুলের ভেতরে ঢুকে অবাক। নীপাকে বললাম একটু নবদাকে ডাকো।
অনি এটা তোদের হায়ার সেকান্ডারী স্কুল?
আমি দেবাশিসের দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
আমার সময় সেকান্ডারী পর্যন্ত ছিল।
তুই কলেজে ইলেভেন-টুয়েলভে ভর্তি হয়েছিলি?
হ্যাঁ।
কি নিস্তব্ধ জায়গাটা তাই না মিলিদি? নির্মাল্য বললো।
মিলি হুঁ বললো।
আয় আমার নাইন-টেনের বসার জায়গাটা দেখাই।
ওরা আমার পেছন পেছন এলো। আমি ওদের ঘুরে ঘুরে সব দেখালাম। ওদের প্রশ্নের আর শেষ নেই। এটা কি, সেটা কি, করেই চলেছে। আমি আমার সাধ্য মতো একের পর এক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে চলেছি।
দেখলাম এখন বেঞ্চির সংখ্যা বেরেছে। আমাদের সময়ে তিনটে মাত্র বেঞ্চ ছিল।
জানিস দেবা এটা তবু পদের, বুবুনের প্রাথমিক স্কুলটা দেখিসনি, ওখানে একটাও বেঞ্চ নেই, মাটিতে বসতে হয়। মিত্রা বললো।
অনি একবার নিয়ে যাবি। দেবাশিস বললো।
যাব।
কোথায়রে অনি? ছেলেটার নাম শুনি, চোখের দেখা একবার দেখি।
নীপার পেছন পেছন নবোদা এলো।
আমি এগিয়ে গিয়ে নবোদার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম।
নবোদা আমার থুতনি ধরে চুমু খেল। এই তো ঠিক আগের মতো আছে। একটু যা ঢ্যাঙা হয়েছে।
তুমি কেমন আছো নবোদা।
আর নবোদা। সাতকাল গিয়ে এককালে ঠেকলো। এদের চিনতে পারলাম না।
আমি সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম। শেষে মিত্রার সঙ্গে। নবোদা মিত্রার থুতনিটা ধরে নাড়িয়ে দিল। বেশ হয়েছে বউমাটি।
সবাই নবোদার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। আদল গায়ে একটা গামছা পরে চলে এসেছে।
নবোদা ল্যাবরেটরি খোলা আছে।
হ্যাঁ চলে যা।
এদের একটু গ্রামের স্কুলের ল্যাবরেটরি রুমটা দেখাই।
কি দেখবে বাপু একি আর শহরের স্কুলের মতো।
ওরা অনির সব কিছু দেখতে চায়।
দুটি মুড়ি খাবি।
না।
হ্যাঁগো নবোদা খাবো। মিত্রা চেঁচিয়ে উঠলো।
ও নীপা আয়তো মা একটু পেঁয়াজটা কেটে দিয়ে যা। সে কচিটা আসেনি আজকে।
মিলি আমার দিকে গোল গোল চোখে তাকাল।
টিনা বললো, এখন না, স্টক করো।
আমি হাসলাম।
মিত্রার দিকে তাকিয়ে বললাম
খাই খাই করছিস, মুখ ধুয়েছিস।
তুই নিমদাঁতন দিয়েছিস।
দাঁড়া।
আমি হন হন করে স্কুলের পেছন দিকে চলে গেলাম। নিমডাল ভেঙে নিমদাঁতন তৈরি করে সবার হাতে হাতে দিলাম। নে চিবোতে আরম্ভকর। পেঁয়াজ কাটতে কাটতে দাঁত মাজা হয়ে যাবে।
ল্যাবোরেটরিতে যাবি না।
চিবতে চিবতে চল।
আমি ওদের ল্যাবরেটরিতে নিয়ে এলাম। ল্যাবরেটরি দেখে ওদের চোখ চড়কগাছ।
এটা কি ল্যাবরেটরিরে!
এই ল্যাবরেটরি ব্যবহার করে কতো ছেলে সাইন্সে ফার্স্ট ডিভিসন পাচ্ছে জানিস।
দেবা আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে!
ওই বাক্সটায় কি আছেরে বুবুন?
মাইক্রস্কোপ।
সেইটা।
কিগো মিত্রাদি নিশ্চই গপ্পো। মিলি বললো।
মিত্রা মাথা দোলাল।
দাঁড়াও আগে দেখে নিই। তারপর গপ্পোটা শুনবো।
খোল খোল বাক্সটা। মিত্রা বললো।
আমি এগিয়ে গেলাম। বাক্সটা খুলে মাইক্রোস্কোপ বার করলাম।
কি ভাবে দেখতে হয়? টিনা এগিয়ে এলো।
ওদের দেখালাম কোথায় চোখ রেখে কোথায় এ্যাডজাস্ট করে ব্যাপারটা দেখতে হয়।
ওরা যে যার নিজের মতো করে দেখলো।
আমাকে দেখাবি না।
যা দেখে নে।
তুই চল।
আমি মিত্রাকে সঙ্গে করে মাইক্রস্কোপের কাছে গেলাম। নে এখানে চোখ রাখ। মিত্রা রাখলো।
দুর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।
তুই কি দু-চোখ খুলে দেখছিস?
হ্যাঁ।
দুর, একটা চোখ এইভাবে বন্ধ কর। যেভাবে চোখ মারে সেই ভাবে ওকে দেখালাম।
আর একবার দেখা।
দেখালাম।
মিত্রা মুচকি হেসে আবার ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রাখলো।
বুবুন।
কি।
কিছুই দেখতে পাচ্ছিনা।
তোর দ্বারা হবেনা। আমার মতো তোরও গবেট মাথা। এবার রাখ, চল মুখ ধুয়ে মুড়ি খেয়ে বিদায় হই।
আর একবার, আর একবার।
আবার ওকে রিপিড দেখালাম ভিউফাইন্ডারে চেখ রাখতেই এ্যাডজাস্ট করলাম।
কিরে দেখতে পাচ্ছিস?
হ্যাঁ এবার পাচ্ছি।
ছাড় অনেক হয়েছে।
দারুনরে জিনিসটা।
কাট। দেবাশিস চেঁচিয়ে উঠলো।
মিলি ছুটে এসে মিত্রাকে জড়িয়ে ধরলো। কি সুন্দর এ্যাকটিং করলে মিত্রাদি।
তারমানে! মিত্রার চোখে বিস্ময়।
নির্মাল্য সব মুভি করে রেখেছে।
দেবা কাছে এগিয়ে এলো।
জানিস অনি তোদের দুজনকে দেখে দত্তার বিজয়া আর নরেনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল।
কি ফালতু বকছিস!
তুলে রেখেছি। চল টিনার ল্যাপটপে ভরে তোকে দেখাব। কি নাইস লাগছিল তোকে। একেবারে ইনোসেন্ট। আমি অদিতি চেষ্টা করলেও পারবো না।
আমি মাইক্রোস্কোপ বাক্সে ভরলাম। দরজায় সেকল তুলে স্কুলের বাইরে বেরিয়ে এলাম।
তোদের এই মাইক্রোস্কোপ ছাড়া আর কিছু নেই।
ওই তো কয়েকটা স্পেসিমেন পড়ে রয়েছে।
ফিজিক্সের ল্যাবরেটরি।
ওই একটা ঘরে সব। দেখলি না দেয়ালের ধারে একটা বস্তা আছে।
হ্যাঁ!
ওর মধ্য ফিজিক্সের কিছু মাল পত্র আছে। কিছু টেস্ট টিউব রয়েছে একটা বার্ণার রয়েছে ব্যাশ আর কি চাস।
আমি যদি কিছু জিনিষ কিনে দিই।
থমকে দাঁড়ালাম। দেবার মুখের দিকে তাকালাম। সত্যি কি ও ভেতর থেকে বলছে?
দিলে খুব ভালো। ছেলেগুলো পড়াশুনো করে বাঁচবে।
আমি কিনে দেব তুই ব্যবস্থা কর।
আমরাও যদি কিছু কন্ট্রিবিউট করি দেবাদা, তোমার অসুবিধে আছে। টিনা, মিলি দুজনে একসঙ্গে বলে উঠলো।
একেবারে না।
তোরা কাকার সঙ্গে কথা বল। উনা মাস্টার এখনও মনে হয় পার্টটাইম এখানে পড়ায়। স্যার ব্যবস্থা করে দেবে।
আজই কাকার সঙ্গে কথা বলবো। অনেক পয়সা এদিক ওদিক নষ্ট করি। এখানে কিছু পয়সা নষ্ট করলে ক্ষতি হবে না।
একে একে সবাই পুকুর ঘাটে মুখ ধুলাম। নীপাকে নিয়ে মিত্রারা এরই মধ্যে কিছুক্ষণের জন্য হাওয়া হয়ে গেল। নবোদা মুড়ি এনে দিল। নিমেষের মধ্যে সব শেষ। চা খেলাম।
অনিদা ও অনিদা।
এই অসময়ে আবার কে ডাকেরে। বাইরে বেরিয়ে এসে দেখি বিজয়।
কিরে তুই! জানলি কি করে আমরা এখানে?
বিজয় হাসছে। বড়োমা পাঠাল।
তুই একা?
হ্যাঁ।
কিরে কে এসেছে? মিত্রা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
বিজয়ের দিকে তাকিয়ে মিত্রা হেসে ফেললো।
বড়োমা বললেন, তোমাদের নিয়ে যেতে।
কেন আমরা যেতে পারবো না! আমি বললাম।
তা বলতে পারবো না।
আমি মিত্রার দিকে তাকালাম। তোরা চলে যা, আমি নির্মাল্য দেবা পরে যাচ্ছি।
তুই আমাদের সঙ্গে চল।
মহা মুস্কিল।
ঠিক আছে, ঠিক আছে। সরি। ওদের ডাকি।
যা ডেকে আন।
নবোদার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা সবাই বেরিয়ে এলাম। আসার সময় নবোদা হাতটা ধরে বললো, আবার আসিস।
এদিকে এলে অবশ্যই আসবো।
মিত্রারা সবাই ট্রলিতে চাপলো।
বিজয় ট্রলি চালাতে শুরু করলো।
আমার মোবাইলটা বেজে উঠলো। ম্যাসেজ এলো। আমি মিত্রার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললাম।
দাঁড়াও দাঁড়াও বিজয়।
কি হলো দিদিমনি?
তুমি একটু থামাও না।
বিজয় থামালো।
মিত্রা ট্রলি থেকে নেমে ছুটে আমার কাছে চলে এলো।
দে একটু দেখি।
দেবা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে জিজ্ঞাসা।
আমি ওর হাতে মোবাইলটা দিলাম।
অর্ক লিখেছে।
দাদা সকাল থেকে কাজ শুরু করলাম। আমার সঙ্গে দুটো চেলুয়াকে নিয়েছি। মনে কিছু করবে না। ওরা তোমার কথা জানে না। ঘুটি সাজিয়ে নিয়েছি। কাজ খুব স্মুথলি শুরু করে দিয়েছি। একটু আগে, আটটা দশ নাগাদ মিঃ ব্যানার্জী, রাজনাথবাবুর কাছে এসেছেন। গাড়ির নম্বর ডিএলও জিরো টু সিক্স এইট নাইন ফোর। সঙ্গে একটা বড় ভিআইপি স্যুটকেশ নিয়ে এসেছে। ভেতরে কি আছে খবর নিয়ে একঘণ্টা পরে জানাচ্ছি।
পড়া শেষ হতে মিত্রা আমার দিকে তাকাল, খুশির ঝলক ওর চোখে মুখে। আমাকে জড়িয়ে ধরে চকাত করে ঠোঁটে একটা চুমু খেয়ে নিল।
দেবাশিসের চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। নির্মাল্য মাথ নীচু করে নিল। বুঝতে পারছি মিলি, টিনারাও মিত্রার এই অস্বাভাবিক আচরণে একটু অবাক।
তুই কি করে আগে থেকে জানলি বল? মিত্রা বললো।
প্র্যাকটিশ।
আমাকে শিখিয়ে দে।
দেব।
ছোট্ট মেয়ের মতো মিত্রা ছুটে চলেগেল ট্রলির কাছে।
একটু দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে বললো, তাড়াতাড়ি আয় প্লীজ।
যা যাচ্ছি।
দেবাশিস আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে।
চল।
আমরা তিনজন হাঁটতে আরম্ভ করলাম। মাঠ পেরিয়ে পীরবাবার থান। ওখানে মিনিট খানেক দাঁড়ালাম, আমার পাশাপাশি ওরাও দাঁড়াল। জুতো খুলে ওখান থেকেই প্রণাম করলাম। দেবারাও প্রণাম করলো। উঠে আবার হাঁটতে আরম্ভ করলাম।
দেবা একটা সিগারেট দে।
অনি।
দেবা আমাকে সিগারেট দিল।
এখানকার ঘটনাটা সত্যি।
বলতে পারবো না।
দেবা আমার দিকে তাকিয়ে।
বিশ্বাস কর, শোনা কথা। তবে আমার বাবা দেখেছিলেন। এটাও আমি কাকার মুখে শুনেছি। বাবা এই স্কুলেরই মাস্টার ছিলেন।
রিয়েলি!
আমার যখন চার বছর বয়স তখন বাবা-মা দুজনেই গত হন।
তারমানে তখন থেকে তুমি একা! নির্মাল্য বললো।
এই যে কাকা-কাকীমাকে দেখছিস এদের কাছে মানুষ।
এরা তোর নিজের কাকা-কাকীমা নন! মিত্রা বলছিল।
বাবার বন্ধু। একই স্কুলে দু-জনে মাস্টারি করতেন। পাশাপাশি বাড়ি, জমিজমা, সম্পত্তি সব একসঙ্গে। বলতে পারিস হরিহর আত্মা।
স্ট্রেঞ্জ!
সত্যি অনিদা তোমার সম্বন্ধে ভাষাভাষা জানতাম। যতো কাছে আসছি, অবাক হয়ে যাচ্ছি।
কেন? এটাও একটা জীবন।
মিত্রা হঠাৎ ওরকম করলো? দেবা আমার দিকে তাকাল।
আমি জানতাম তুই এই প্রশ্নটা করবি।
তুই কি আবার কিছু ঘটনা ঘটিয়েছিস?
হ্যাঁ।
বলবি না?
না। খালি শুধু মিত্রাকে কাল রাতে শুয়ে শুয়ে বলেছি। কাল রাতে কিরকম খেপে গেল দেখলি। একটা সিনক্রিয়েট করলো। তাই বাধ্য হয়ে বললাম। মিলিয়েও দিয়েছি। তাই মিত্রা ইমোশন্যালি ঘটনাটা ঘটাল। ও ঠিক বিশ্বাস করতে পারেনি।
আমাদের সঙ্গে একটু শেয়ার কর, এখন তো কেউ নেই।
জানতে পারবি। না জানলে মঙ্গলবার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আন্ডার প্রসেস।
অনিদা যখন বলতে চাইছে না তখন ডিস্টার্ব করো না। নিশ্চই গুরুত্বপূর্ণ কিছু। নির্মাল্য বললো।
আমরা মাঠের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে মোরাম রাস্তায় এসে পড়েছি বুঝতে পারিনি।
অনিদা এই রাস্তায় কাল আমরা এসেছি, তাই না?
হ্যাঁ।
ওই তো সেই ক্যালভার্টটা।
চিনতে পেরেছিস?
দেবাদা দেখো অনিদার স্কুলটাকে কেমন ছোটোছোটো লাগছে।
দেবা পেছন ফিরে তাকাল।
সত্যিতো! অনি কতটা রাস্তা হবে রে?
প্রায় তিন কিলোমিটার।
তারমানে সকাল থেকে প্রায় সাত কিলোমাটার হাঁটা হয়ে গেল!
হ্যাঁ।
গড়িয়া থেকে আমার অফিস! শালা কিছুই বুঝতে পারলাম না।
হাসলাম। শ্মশানে যাবি?
চল, এসেছি যখন ঘুরেই যাই।
মোরাম রাস্তা পেরিয়ে আবার খেতের আইল পথ। সরু রাস্তা। দু-পাশের খেতে কলাই শাক বোনা হয়েছে সবুজ হয়ে আছে খেতগুলো।
দাঁড়া একটা ছোট্ট কাজ করে নিই।
কি করবি?
দাঁড়ানা, দেখ।
আমি কলাই খেতে নেমে পড়লাম বেছে বেছে কলাই শাক তুলতে আরম্ভ করলাম। আমার দেখা দেখি দেবাশিস খেতের আইল থেকে মাঠে নেমে এলো।
কিভাবে তুলবো দেখিয়ে দে। আমরাও কিছুটা তুলে কোঁচড়ে ভরি।
হাসলাম। ওদের দেখিয়ে দিলাম। খালি ডগাটা তুলবি না হলে গাছ মরে যাবে।
অনি এতো চা পাতা তোলার মতো কেশ। শিলিগুড়িতে চা বাগানে বেড়াতে গিয়ে দেখেছিলাম।
কচি কচি পাতাগুলো তুলবি। যে ডালে ফুল আছে। ওই অংশগুলো বাদ দিস।
বেশ কিছুক্ষণ কলাই শাক তুললাম। তিনজনেরই পাঞ্জাবীর কোঁচর ভরে গেছে।
কি করবি। দেবাশিস বললো।
ভাজা খতে দারুণ লাগে।
চল সুরোমাসিকে গিয়ে বলতে হবে।
আমরা ক্ষেত থেকে উঠে এলাম। হাঁটতে হাঁটতে শ্মশানে এলাম।
বেশ লাগছে বুঝলি অনি। কলকাতায় এই ভাবে রাস্তা দিয়ে হাঁটবো কখনও স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারি না।
কলকাতায় তুমি এরকম রাস্তা পেয়েছো যে হাঁটবে।
দেবাশিস, নির্মাল্যের কথায় হো হো করে হেসে ফেলল।
কেন। দুর্গাপূজোর সময় থিম হিসাবে গ্রাম দেখিসনা। আমি বললাম।
দূর, কার সঙ্গে কার তুলনা করছো। ওটা কৃত্রিম এটা প্রকৃতির নিজের হাতে তৈরি।
তোর কি হয়েছে বলতো? দেবাশিস বললো।
কেন!
সকাল থেকে সাহিত্য ঘেঁষা কথা বলছিস।
মনটা শুধু বলছে কিছু লিখি।
চল মিলিকে খবরটা দিতে হবে।
এই তো তুমি হ্যাজাতে আরম্ভ করলে।
এই যে জঙ্গল মতো জায়গাটা দেখছিস এটাই শ্মশান। আমি বললাম।
মড়া পোড়ান হচ্ছে কোথায়?
দূর এখানে কি সব সময় পোড়ান হয় নাকি।
তাহলে!
তুই কি এটাকে নিমতলা শ্মশান পেয়েছিস?
তবে কি দেখবো!
তুই একটা মিথকে দেখতে এসেছিস। দেখেছিস ধারে কাছে কোনও বসতি আছে।
না।
কোনও চাষের জমি আছে।
না।
কেন বলতো?
কেন।
এখানে ভূত আছে। চাষ করলে মানুষকে মাঠে এসে কাজ করতে হবে। যদি ভূত ধরে।
তুই কিন্তু সব ডেঞ্জার ডেঞ্জার কথা বলছিস।
কেন ছোটো হয়ে গেছে এরই মধ্যে।
বাচ্চা ছেলেটার সামনে যা তা শুরু করে দিয়েছিস।
ভেতরে যাবি? না এখান থেকে পালিয়ে যাবি?
না মানে….।
তুমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকো দেবাদা, আমি অনিদা একটু ঘুরে আসি।
ঢ্যামনা।
আমি ফিক করে হাসছি।
চল তাহলে।
যা থাকে কপালে।
আমরা শ্মশানের ভেতরে ঢুকলাম।
চারিদিকে পোরাকাঠের ছড়াছড়ি। দেখে মনে হচ্ছে আমি শেষবার যখন এসেছিলাম তার পর কেউকে আর দাহ করা হয়নি। যেমনটি দেখে গেছিলাম তেমনটি আছে। গাছের পাতায় বাতাসের স্পর্শে সোঁ সোঁ আওয়াজ হচ্ছে।
আমি ধীর পায়ে পুকুর পাড়ের বট গাছটার তলায় এসে দাঁড়ালাম। চারিদিক নিস্তব্ধ। একবার ওপরের দিকে তাকালাম। সেই একইভাবে বটের ঝুড়িগুলো আঁকা-বাঁকা হয়ে নিচে নেমে এসেছে। মনে মনে বললাম, মা তোমার ছেলের শহুরে বন্ধুরা তোমায় দেখতে এসেছে। দেখতে পাচ্ছ। তোমার ছেলের বউ-এর মুখ দেখেছো মা? দেখনি। দেখি তাকে আনতে পারি কিনা। ও ভয় পায় মা। আসতে চায় না। রাগ করো না। আমি তো আসি তোমার কাছে।
বুঝতে পারলাম মনটা ভারি হয়ে এলো। বুঝতে পারছি চোখটা ছল ছল করে উঠলো। কোঁচর থেকে দুটো কলাই শাক বটগাছের তলায় রাখলাম। পুকুর থেকে এক মুষ্টি জল এনে কলাই শাকের ওপর ছড়িয়ে দিলাম।
আমি স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে। চোখের পলক পরছে না।
অনিদা।
নির্মাল্যের দিকে তাকালাম।
চোখ দুটো ছল ছল করছে।
চলবে —————————
from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/HBGiMPq
via BanglaChoti
Comments
Post a Comment