“কাজলদীঘি”
BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়
৩৬ নং কিস্তি
—————————
আমরা ওদের ডুয়েটে শ্রুতিনাটক শুনতে যেতাম। কলেজ থেকে আমাদের ইয়ারের ছাত্র-ছাত্রীরা ছাড়াও অন্য ইয়ারের ছাত্র-ছাত্রীরা যেত। আমরা হাততালি দেওয়া শুরু করলেই হল ফেটে পড়তো হাততালিতে। সেই সব দিন আর ফিরে আসবেনা।
আসবেরে দেবাশিস। আসবে। চেষ্টা করলে অতোটা হয়তো আসবে না। তবে কিছুটা অবশ্যই আসবে।
এবার শোনাতে হবে। টিনা বললো।
সময়ের দরকার বুঝলে টিনা। আর মুড। এটা না থাকলে চেষ্টা করলেও হবে না।
ওসব জানিনা, শোনাতে হবে।
দেখি। নির্মাল্য সামনের যে মোড়টা আসছে।
হ্যাঁ।
ওখান থেকে বাঁদিকে ঘুরবি।
আচ্ছা।
গাড়ি চলছে। আমরা চুপচাপ।
এই মোড়টা অনিদা? নির্মাল্য বললো।
হ্যাঁ।
দেবা।
বল।
এই বাঁদিকে যে নার্সিংহোমটা দেখছিস….।
হ্যাঁ।
ওটা কালকে ট্রান্সফার করলাম।
আরি বাবা এ তো বিশাল ক্যামপাস রে!
হ্যাঁ। সব মিত্রার পয়সায়।
বলিস কী!
ঈশ্বর ওকে সব দিক থেকে মেরেছে। শুধু কিছু পয়সা ছিল বলে এ যাত্রায় বেঁচে গেল।
সত্যি, যা বলেছিস।
ওরা জানলা দিয়ে সবাই মুখ বার করে দেখলো।
নির্মাল্য।
দাদা।
এখানের রাস্তাটা ভালো নয় একটু আস্তে চালাস।
আচ্ছা।
আর একটা কথা বলি মোন দিয়ে শোন।
বলো।
এখানে মানুষকে ধাক্কা দিলে তোর ফাইন হবে না। কিন্তু ছাগল বা মুরগিকে মারলে তোর জেল পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে।
সবাই হো হো করে হেসে ফেললো।
ছার তো, শুধু গুল। দেবাশিস বললো।
এক বর্ণও মিথ্যে কথা বলছি না। যেতে যেতে দেখবি। ছাগল গুলো রাস্তার মাঝখানে চলে আসে। হর্ণ মারলে সরে না। তোকে গাড়ি দাঁড় করিয়ে হ্যাট হ্যাট করলে তারপর সরবে। সাবধান।
টিনা আমাকে পেছন থেকে ঠেলা মারলো। দাঁড়াও মিত্রাদিকে গিয়ে বলবো।
মিত্রাদি ফেঁসেছিল, তাই নির্মাল্যকে সাবধান করলাম।
অনি?
বল।
যেতে যেতে তোর সেই পীরসাহেবের থান, শ্মশানটা দেখা যাবে।
দেখা যাবে।
রাতে যাওয়া যাবে।
তুই গেলে নিয়ে যাব।
না তোমাকে যেতে হবে না। অদিতি বললো।
দেখ তোর বউ তোকে আগলাতে শুরু করে দিয়েছে।
অনিদা খারাপ হয়ে যাবে বলে দিচ্ছি।
টিনা কিছু বলবে?
না অনিদা, ওর জিনিষ, আমি বলতে গিয়ে খারাপ হবো কেন।
দাঁড়া মুখপুরি তোর হচ্ছে।
দেখলে অনিদা তুমি বেমক্কা আমাকে গালাগাল খাওয়ালে।
মিলি চুপচাপ কেন বলতো। আমি বললাম।
মাপছে। মাপা শেষ হলে ডায়লগ ঝারবে। টিনা বললো।
আবার আমাকে চাটতে শুরু করলি। বেশ তো অদিতি চলছিল।
নির্মাল্য হর্ণ মার। আমি বললাম।
সামনের রাস্তায় একটা ছাগলের বাচ্চা দাঁড়িয়ে, সত্যি সত্যি সে সরলো না। কোনদিকে যাবে কোথায় যাবে দিশে হারা। এক জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। নির্মাল্য গাড়ি থামাতে বাধ্য হলো। আমি নেমে গিয়ে তাকে কোলে তুললাম। চ্যাঁ চ্যাঁ করছে।
অনিদা প্লিজ। অদিতি জানলা দিয়ে মুখ বারিয়েছে।
আমি অদিতির কাছে বাচ্চাটেকে নিয়ে গেলাম।
হাত দেবো।
দাও।
অদিতি বাচ্চাটার মাথায় হাত দিতেই বাচ্চাটা ছটফট করে উঠলো।
দাঁড়াও দাঁড়াও, টিনা মোবাইলটা বার করে একটা ছবি নিলো।
কিরে শেষপর্যন্ত ছাগলের সঙ্গে অনিদা। মিলি বললো।
আমি হাসছি।
গাড়ি চলতে শুরু করলো।
মিলি।
উঁ।
কালকে ফ্রন্ট পেজে যদি আমার এই ছবিটা ছাপা হয় আর….।
সরি সরি আর বলবো না।
কেন তুই খাপ খুলতে গেলি। অদিতি বললো।
দূরছাই অতো কি মনে থাকে।
আবার হাসির রোল।
কথা বলতে বলতে, আমরা চকে এসে দাঁড়ালাম।
গাড়িটা নির্মাল্যকে সাইড করতে বললাম।
কিরে দেবা চা খাবি?
এটা তোর পরিদার দোকান!
হ্যাঁ। আমাদের বসন্ত কেবিন।
চারিদিক নিস্তব্ধ। ঝিঁঝিঁ পোকার মৃদু ডাক। পাখির কুহুতান। দুপুর বেলা লোকজন বিশেষ একটা থাকেনা। দু-একজন দাঁড়িয়ে আছে বাসের জন্য। আমাকে নামতে দেখে রবিন পরিদার দোকান থেকে বেরিয়ে এলো। ওরা সবাই গাড়ি থেকে নামলো। দেবাশিস চারিদিক দেখে বললো।
অদিতি কি নির্জন বলো তো। তুমি কোনও আওয়াজ পাচ্ছ?
সত্যি ফ্রেস এয়ার। পলিউশন ফ্রি। নির্মাল্য বললো।
রবিন বত্রিশপাটি বার করে সামনে এসে দাঁড়াল।
কি বাবা রবিন, পরিদা আছে?
তোমার জন্য বাড়ি থেকে এসেছে। তুমি আসবে শুনেছে।
তাই নাকি?
আমি সবাইকে নিয়ে পরিদার দোকানে ঢুকলাম। রবিনের দিকে তাকালাম।
তুই একা?
পাঁচুদা ছেড়ে দিয়ে পালালো। ওখানে অনেক কাজ।
পরিদা।
আয় বাবা আয়। তোর জন্য দুপুরে ঘুমলাম না।
ছেলে কোথায়?
সেইই তো ছিল। বললো গিয়ে তুই আসবি, চলে এলাম।
বুঝলে পরিদা অনাদিরা যেমন আমার এখানকার বন্ধু। এরা আমার সব ওখানকার কলেজের বন্ধু।
আমি একে একে দেবাদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলাম।
ওরা পরিদাকে হাঁ করে দেখছে।
পরিদার সাজ পোশাক দেখে ওরা ঘাবড়ে গেছে। পরনে একটা আট হাতি ধুতি, স্যান্ডো গেঞ্জি, কাঁধে গামছা। গোবেচারা গোবেচারা চেহারা। সেই বাচ্চা মেয়েটাকে দেখলাম। পরিদা ডেকে উঠলো ও বোকনা।
টিনা আমার দিকে তাকাচ্ছে। মিলি মুখে রুমাল চাপা দিয়েছে। অদিতি অবাক। আমি ইশারায় বললাম এর ইতিহাস পড়ে বলবো।
টিনা চোখ দিয়ে বোঝাতে চাইল, আবার গল্প।
আমি মুখ টিপে হাসছি।
পরিদা কিছু খাওয়াও।
কি খাবি বল?
কি আছে?
রসোগোল্লা আর ছানার জিলিপি।
দাও।
পরিদা সবাইকে দিল। সেই বাচ্চা মেয়াটা প্লেটে করে এগিয়ে দিল।
মিলি দেখ কি মিষ্টি মেয়েটা। টিনা বললো।
মিলি মেয়েটাকে ডাকল। এই শোন।
মেয়েটা কিছুতেই আসবে না।
যা না যা। দিদিমনি ডাকতিছন। পরিদা বললো।
মিলি আমার দিকে আবার তাকাল। মুচকি মুচকি হাসছে।
স্টক করো পরে উত্তর দেবো।
মেয়েটি কাছে এলো। মিলি ওকে একটা মিষ্টি নিতে বললো।
না নিবনি। দাদু বোকবন।
মিলি আমার দিকে তাকায়। আমি বোকনার কথার মানে বললাম।
তোমার নাম।
মোকে সকলে কচি কয়। দাদু মোকে খালি বোকনা কয়।
মিলির চোখ বড় বড় হয়ে যাচ্ছে। টিনা আমাকে টপকে মেয়েটির পাশে গিয়ে উবু হয়ে বসলো। দুজনে লেগে পড়েছে বাচ্চাটার পেছনে। আমি ওদের দিকে তাকিয়ে দেখছি।
বুঝলি অনি। সকালে মাসির আনা মিষ্টি খেলাম। আর এই ছানার জিলিপি। আকাশ পাতাল তফাৎ।
কোনটা বেটার।
জৌলুসের দিক থেকে মাসির মিষ্টি সেরা। কিন্তু টেস্ট পরিদা।
পরিদার নিজের হাতে তৈরি।
সত্যি!
হ্যাঁ। বাড়ির গরুর দুধ থেকে ছানা তৈরি করে করা। তুই চাইলে আর পাবিনা সব শেষ।
না বাবু আজ গরুটা দুধ কম দিছে, বনাইতে পারিনিগো।
দেবা আমার দিকে তাকাল।
বস আমরা লাকি চ্যাপ।
আরও বাকি আছে। এরই মধ্যে কমেন্ট পাস করিস না।
পরিদা চা দিল। চায়ে চুমুক দিয়ে টিনা আমার দিকে তাকাল। দেবাশিস হাতের ইশারায় বুঝিয়ে দিল এক্সিলেন্ট। সবেতেই একটা গ্রাম গ্রাম গন্ধ।
ফোনটা বেজে উঠলো।
দেখো মিত্রাদি। মিলি বললো।
ফোনটা পকেট থেকে বারকরলাম। সত্যি তাই।
বল।
পরিদার দোকান থেকে রসোগোল্লা নিয়ে আসবি।
সব শেষ।
কি হাগুড়ে তোরা।
আমি না, দেবাশিস আর নির্মাল্য।
তুই শুধু আমাকে পেটুক বলিস। মিত্রার গলায় অভিমানের সুর।
এবার থেকে বলবো না।
মনে থাকে যেন।
তোর কথা সবাই শুনছে।
শুনুক। আমি এখন হাটে ঢুকছি।
কারা কারা আছে।
সবাই। বিজয়ের ট্রলি নিয়ে এসেছি।
একটু অপেক্ষা কর পৌঁছে যাব।
তাড়াতাড়ি আয়না।
আরি বাবা এসে গেছি তো।
আয়।
দেবাশিস আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
তুই কি করে ট্যাকেল করিস বল তো?
করতে হচ্ছে, কি করবো বল।
হ্যাটস অফ তোকে। তোর ধৈর্যকে।
টিনা, মিলি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
জানিস দেবা যতো জারিজুরি আমার কাছে। আমাকে কিছুতেই কাছ ছাড়া করতে চায় না। ইন-সিকিওর ফিল করে।
ওর কথাবার্তায় বুঝতে পারছি।
খুব সেন্টিমেন্টাল। বুঝে শুনে কথা বলতে হয়। এমনি খুব নর্ম্যাল তুই বুঝতে পারবিনা। হঠাৎ হঠাৎ কেমন যেন হয়ে যায়।
সাইকিয়াটিক কোনও ব্যাপার।
পুরোটাই নার্ভাস সিসটেম। ডাক্তারদাদার কথায়। আমি যেন ওকে তোলা কাপর হিসাবে ব্যবহার করি।
স্ট্রেইঞ্জ।
একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো।
চল এবার ওঠা যাক।
চল।
নির্মাল্য।
বলো অনিদা।
এটুকু রাস্তা রবিন চালাক।
ঠিক আছে।
তুই রাস্তাটা একবার দেখেনে।
নির্মাল্য ঘাড় দোলাল।
ফেরার পথে চালাতে হবে। আমার পাশে বোস।
চলো।
আমরা সবাই গাড়িতে উঠে বসলাম। পরিদার পয়সা মেটালো টিনা।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, ব্যাগ ভর্তি পয়সা থাকলেও খরচ করার জায়গা নেই, এটা মনে রাখবে।
টিনা হাসছে।
রবিনকে বললাম ক্যালভার্টের সামনে গিয়ে একটু দাঁড় করাস।
আচ্ছা দাদা।
ওরা রাস্তা দেখতে দেখতে চলেছে। মাঠে এখন ধান কাটার সময়। কোনও কোনও খেতে সোনালি ধান এখনও মাথা উঁচু করে রয়েছে। টিনা, মিলি, অদিতির হাজারো প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে চলেছি।
রবিন গাড়ি চালাতে চালাতে হাসছে। আমরা এসে সেই ক্যালভার্টের সামনে দাঁড়ালাম। সবাই নামলো। বিকেলের সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। মিষ্টি সূর্যের আলোর ওম নিতে নিতে দেবাশিসরা চারিদিক চেয়ে চেয়ে দেখছে। যতদূর চোখ যায়।
হাউ বিউটিফুল। মিলি বলে উঠলো।
অনি আমি ভীষণ একসাইটেড হয়ে পরছি। তুই মনে কিছু করিসনা। দেবাশিস বললো।
তোদের নিয়ে আসা আমার সার্থক।
আমার এই ছোট্ট কথায় ওরা আমার দিকে অবাক হয়ে তাকাল।
একে একে ওদের পীরবাবার থান, শ্মশান, ছাতারকলের বুড়োশিবের মন্দির, আমার স্কুল, সব দেখালাম।
দূর থেকে যতটুকু দেখা যায়। ছেঁড়া ছেঁড়া গল্প বললাম।
জানো অনিদা তোমার এই গ্রামটা দেখে অপুর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। টিনা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। ওর চোখ অনেক কথা বলছে।
দারুন কথা বললে তো টিনা। দেবা বললো।
যতোদূর দৃষ্টি যায় চোখ ভরে শুধু দেখো। অজানাকে জানা অচেনাকে চেনা। ক্লাস টেনে অচেনার আনন্দ পিসটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। তাই না টিনা।
হ্যাঁগো দেবাদা। এতো সবুজ আগে কখনও দেখিনি।
চল। আজ সব দেখে ফেললে চারদিন বোর লাগবে।
মিলি চুপচাপ। ওর চোখে বিশ্বগ্রাসী ক্ষুধা। দু-চোখ ভরে গিলছে। মুখে কোনও শব্দ নেই।
আমরা সবাই আবার গাড়িতে বসলাম। মিনিট দশেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম।
ভরা হাট। গাড়ি বাসুর দোকানের সামনে আসতেই গ্রামের বাচ্চাগুলো হই হই করে ঘিরে ধরলো। ওরা সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। চিকনা বাসুর দোকানের বারান্দায় বসেছিল গাড়িটা থামতেই পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো।
চিকনার পেছন পেছন বাসুও ওর দোকান থেকে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলো। আমি গাড়ি থেকে নামতেই চিকনা আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমার মুখে গায়ে হাত বোলাচ্ছে।
আমি চিকনার দিকে তাকিয়ে আছি।
তোর কিছু হয়নি তো। ওর চোখমুখের চেহারা বদলে যাচ্ছে।
বাসু চিকনার হাতটা চেপে ধরার চেষ্টা করলো।
আবার এই সময় বকচায়, তোকে কতবার বুঝিয়েছি। বাসু খেঁকিয়ে উঠলো।
শুয়োরের বাচ্চাটাকে যদি হাতের কাছে পেতাম মুরগী কাটার মতো কেটে ফেলতাম। চোখে মুখে হিংস্রতার ছবি স্পষ্ট। চিকনা তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো।
ওঃ তোকে বলেছি না—বাসু চিকনাকে জাপটে ধরে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করলো।
থাম তুই। আমার গুরুর গায়ে হাত পরলে এসপার-ওসপার হয়ে যাবে। তুই অনাদি আমাকে আটকাতে পারবি না।
দেবাশিসরা থতমতো খেয়ে গেছে। ওরা সব ভাসাভাসা জানে। চিকনার ওরকম চোখ মুখের চেহারা দেখে সবাই ভড়কে গেছে।
অনাদি ওই ভরা হাটে ভিড়ের মধ্যে থেকে ছুটতে ছুটতে আমার কাছে এলো।
আবার পাগলামো শুরু করেছে চিকনা।
দেবাশিসদের দিকে তাকিয়ে বললো, সরি, আপনারা কিছু মনে করবেন না।
আমি চিকনাকে জড়িয়ে ধরলাম। বাচ্চাদের মতো ভেউ ভেউ করে আমার বুকে মুখ লুকিয়ে কেঁদে উঠলো। দেবাশিস আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। পাংশু হয়ে গেছে মুখটা।
এই তো আমি, তুই কাঁদছিস কেন, আমি ঠিক আছি, দেখ। গলাটা ধরে এলো।
কাঁদতে কাঁদতে বললো, শালা কুত্তার বাচ্চাটাকে আমাকে একবার দেখিয়ে দে।
ঠিক আছে তুই শান্ত হ। দেখ আমি তোর সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আমার কিছু হয়নি।
আমি ওর মাথায় পিঠে হাত বোলালাম কিছুক্ষণ। চিকনা আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে।
দূর থেক দেখলাম মিত্রা ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসছে। কাছে এসেই বললো চিকনা এবার আমি একটু ধরি। চিকনা চোখ মুছতে মুছতে ফিক করে হেসে ফেললো। মিত্রা আমাকে জড়িয়ে ধরলো। চিকনা আমাকে ছারলো।
তুই ঠিক আছিস?
বেঠিক থাকবো কেন!
বাবাঃ যা গেল।
অনাদি চিকনাকে বাসুর দোকানে ধরে নিয়ে গিয়ে বসাল।
একবারে এখান থেকে কোথাও যাবি না। অনাদি ধমক দিল।
মিত্রাকে দেখে ওরা আশ্বস্ত হলো। টিনা, মিত্রাকে জড়িয়ে ধরলো। মিলি, মিত্রার গালে গাল ঘসে দিল। দেখলাম নীপা ছুটতে ছুটতে আসছে।
অনিদা তুমি ঠিক আছো। নীচু হয়ে পায়ে হাত দিল।
আমি হাসছি।
দেবাশিস বুঝতে পেরেছে কিছু একটা বড়ো ঘটনা ওখানে ঘটেছে।
হঠাৎ মিত্রার গলা পেলাম। ওকে বলিসনি তো! ভালো করেছিস—তোদের সব কটাকে বাঁশঝাড়ে লাইন করে বসিয়ে দিত।
আমি ওদের দিকে তাকালাম। টিনা ফিক করে হেসে ফেললো।
তুমি থামো, অনিদা….।
তুই জানিস না ও কিরকম। তুই কষ্ট পাবি ও….।
মিলি, মিত্রার মুখটা চেপে ধরলো।
আয় আমার সঙ্গে আয়। দেবা চল হাতমুখটা একটু ধুয়ে নে। নির্মাল্য আয়।
ওরা মিত্রার পেছন পেছেন চলেগেল।
আমি দেখলাম মিত্রা গট গট করে ওদের নিয়ে হাটের ভিড়ে মিশে গেল।
অনাদি আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে দেখছে। আমি অনাদির দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললাম।
কি দেখছিস?
তোর খোমাখানা।
কেন!
কতটা পরিবর্তন হলো।
হাসছি। জিনিসগুলো বার করে বাসুর দোকানে রাখ।
তোকে বলতে হবে না। আমাদের একটা দায়িত্ব আছে। সব নিজের ঘাড়ে নিয়ে মুখটার কি অবস্থা হয়েছে একবার দেখেছিস?
আমি মাথা নীচু করলাম।
ইসলামভাই কোথায়?
উঁ হুঁ ইসলামভাই নয়, মুন্না ভাই।
হাসলাম।
বাসু দাঁড়িয় দাঁড়িয়ে হাসছে।
হাসছিস কেন?
তোকে দেখে। চল।
এই ভড়া হাটে তোর দোকানে ভিড় করা যাবে না।
বক্তব্য ঝাড়িস না।
গাড়ির চারপাশে তখনও বাচ্চাদের ভিড় থিক থিক করছে। রবিন গাড়ির কাঁচ তুলে দিল। আমি অনাদির সঙ্গে বাসুর দোকানে এলাম।
বড়োমা এসেছে?
পুরো ব্যাটেলিয়ান।
ওরা কোথায়?
যে যার ইচ্ছে মতো হাটে ঘুরছে। স্যারও এসেছেন।
তাই নাকি! কাকা এসেছে!
হ্যাঁ। দাদা ধরে নিয়ে এলেন।
ঘরে কে আছে?
সুরোমাসি। কাকীমা।
চিকনা গেল কোথায়?
আছে এদিকে কোথাও।
আমরা ঢুকতেই বাসু ওর কাজের ছেলেটাকে বললো দরজাটা হাফ ভেজিয়ে দে। সকাল থেকে অনেক বেচাকেনা করেছিস।
ছেলেটি হাসতে হাসতে উঠে গেল। আমি টুলে বসলাম।
এরা মনে হয় তোর বাড়িতে গেল। বাসুর দিকে তাকালাম।
হবে হয়তো। ম্যাডামকে এখন সবাই চিনে গেছে অসুবিধে নেই। চা খাবি?
খাওয়া। অনাদি গেল কোথায়?
তুই ব্যস্ত হচ্ছিস কেন।
বাসু ওর ছেলেটিকে বললো যা একটু চা বলে আয়।
এদিকের খবর বল।
এদিকের খবর আর কি, সব তোর খবর।
হাসলাম।
হাসিস না। তোকে মাঝে মাঝে মনে হয় মেরে পাট করে দিই।
দে।
সে আর পারছি কোথায়।
বাইরে চোখ পড়লো দেখলাম বড়োমা, ছোটোমা, ইসলামভাই ঢুকছে পেছনে অনাদি।
আমি উঠে দাঁড়ালাম।
বাসু আমার আগেই বাইরে বেরিয়ে গেল। ওরা ঘরে ঢুকলো। আমি এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করলাম। বড়োমা আমার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। চোখের কোলে জল টল টল করছে। আমার মুখে হাত বোলাচ্ছে। আমি জড়িয়ে ধরলাম।
কি হয়েছে, বলবে তো।
বড়োমা কোনও কথা বলতে পারছে না। যন্ত্রণায় মুখটা পাংশু।
ছোটোমার দিকে তাকালাম। মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দিয়ে ঠস ঠস করে জল পরছে।
ইসলামভাইয়ের চোখও ছলছলে।
বাসু চেয়ার এগিয়ে দিল।
বড়োমা আমার বুকে মুখ লুকিয়েছে। আমি দুজনকে জড়িয়ে ধরলাম।
কিছুক্ষণ এইভাবে থাকার পর, বড়োমার মুখটা তুলে বললাম, আমার কিছু হয়নি।
তোর মুখটা দেখেছিস। গলাটা ধরে এলো।
ঠিক আছে, বসো।
হই হই করে দেবারা এসে বাসুর দোকানে ঢুকলো। ঘর ভড়ে গেল। পেছন পেছন চিকনা। হাতে পাটালি আর ছোলা সেদ্ধ।
ওমা! বড়োমা তুমি এখানে? টিনা চোখ পাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো।
ঝপাঝপ সবাই বড়োমার পায়ে লুটিয়ে পড়লো।
কিগো চোখ ছলছল কেন! অনিদার কিছু হয়নি। চোখ মোছো।
টিনা বড়োমার কাপরের আঁচল দিয়ে চোখ মোছাল।
ছোটোমা, এরকম করলে চলবে না। তুমি বড়োমা নও। মিলি জড়িয়ে ধরেছে।
ইসলামভাইকে ওরা দেখেনি। একটু ইতস্ততঃ করছিল।
মিত্রা পরিচয় করিয়ে দিল। দেবা জড়িয়ে ধরলো ইসলামভাইকে।
জানো দাদা, তোমার কতো গল্প শুনেছি অনির মুখে। আমার বন্ধুটা ভীষণ স্বার্থপর। একটু একটু করে ছারে। কিছুতেই পুরটা দেবে না।
তবু তোমাদের কিছু দেয়, আমাকে কিছুই দেয় না।
আমি মাথা নীচু করে হাসছি।
কিরে মাসিকে ফোন করেছিস? মিত্রা বললো।
সময় পেলাম কোথায়?
আমি জানিয়ে দিয়েছি। ইসলামভাই বললো।
অনিদা তোমার সঙ্গে ঝগড়া করবো। অদিতি বললো।
কেন!
নীপা এই সব জানলো কি করে?
নীপা ঘরের এককোনে দাঁড়িয়ে মিটি মিটি হাসছে।
ওকে জিজ্ঞাসা করো?
বড়োমার গালটা নেড়ে মিলি বললো। বড়োমা তুমি বলো এটা ঠিক।
ছোটোমা মুখে কাপর চাপা দিয়েছে।
কি বলবি তো।
ওই সব কথা।
ও তো মিত্রা গল্প করেছে সবার কাছে।
কিগো বড়োমা! ছেলেকে বাঁচাতে….।
মিত্রা এমন ভাবে চোখ বড়ো বড়ো করে বললো। সবাই হাসছে।
মার ধরে ওকে। শয়তানি। আসা মাত্রই হাত করে নিয়েছে।
সবাই হাসছে। দূরে দাঁড়িয়ে দেবাশিস তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে ব্যাপারটা।
চিকনা।
ম্যাডাম।
তুমি তোমার গুরুর জন্য শুধু পাটালি নিয়ে এসেছো?
নীপা পয়সা দেয়নি।
সবাই নীপার দিকে তাকায়।
বাসুর মুখ থেকে বেরিয়ে এলো। ছাগল।
তুই ছাগল বললি। কতোবার চাইলাম। বলে কিনা বাজে খরচ হবে না।
চিকনাদা। নীপা ধমকে উঠলো।
দেখেছিস। তুই যেমন কিপ্টা। তোর ক্যাশিয়ারও কিপ্টা। হাত থেকে জল গলবেনা। মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে কলকল করে উঠলো।
উঃ মিত্রাদি। মিলি বলে উঠলো।
থাম তুই।
এই ঘরের কেউ আর গম্ভীর নেই।
আমি বাসুকে আস্তে করে বললাম দরজাটা বন্ধ করে দে। তোর খরিদ্দাররা শুনলে কি বলবে।
তোমায় ফিস ফিস করে কি বলছে গো বাসু। মিত্রা ধমকে উঠলো।
কিছু না। বাসু বললো।
জানো বড়োমা, ওদের গাড়ি থেকে নামতে দেয়নি। সেই আমাদের কেশ।
মিত্রাদি চুপ চুপ। টিনা বললো।
তোর সব গুণের কথা এদের বলবো, তুই এতদিন ওদেরটা বলেছিস।
তাই নাকি। মিলি কাছে এগিয়ে এলো। কাঁধ নাচিয়ে ভুরু কাঁপিয়ে বললো, কিগো অনিদা, বলেছিলাম না, দলটা আগে একটু ভাড়ি করি, সব উসুল করে নেব।
আমার মুরগীর ঠ্যাং কোথায় বল। মিত্রা কোমরে কাপর জড়িয়ে তেরে এলো।
দেবা আমাকে এদের হাত থেকে বাঁচা।
দেবা এলে দেবাকে উড়িয়ে দেব ও ছাগলটা কি করবে।
মিত্রাদি। অদিতি চেঁচিয়ে উঠলো।
চুপ কর। তুই এখন আমাদের দলে।
দেবা হাসতে হাসতে বললো। মিত্রা গাড়ির পেছনে আছে।
নিয়ে আয়।
চিকনা। যা একটু। আমি বললাম।
চিকনা বেরিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর তিনজনে একসঙ্গে ঢুকলো দেখলাম পাঁচু, পচা এসেছে।
ইসলামভাই নিজের জিনিস চিনতে পেরেছে।
এটা আমার?
হ্যাঁ তোমার। তোমার সঙ্গে অনেক হিসেব আছে।
সে তুই করিস। তবে লাভ নেই। গেম তোর হাতের বাইরে।
ওঃ কি ভাড়িগো ইসলামভাই। চিকনা বললো।
আমি হাসছি।
ওদিকে মারা মারি লেগে গেছে। অনাদি ঢুকে ওই ভিড়ে হারিয়ে গেছে।
ও অনি আমাকে বাঁচা, এরা আমাকে শুদ্ধু খেয়ে ফেলবে।
কি এনেছিস? বড়োমা বললো।
মিষ্টির পেটি, আর আলুর পরটা।
ভিড়ের মধ্যে থকে মিত্রা ছুটে এলো বড়োমার কাছে। হাঁ করো। হাঁ করো।
কি বলবি তো? বড়োমা বললো।
উঃ হাঁ করো না।
বড়োমা হাঁ করলো। মিত্রা নলেন গুড়ের কাঁচা সন্দেশ বড়োমার মুখে গুঁজে দিল। তারপর ছোটোমা তারপর ইসলামভাই, শেষে নিজের মুখে কিছুটা ঢুকিয়ে চোখ নাচিয়ে বললো, কেমন বলো।
বড়োমা আমার দিকে তাকিয়ে বললো, কোথা থেকে আনলি।
ও আনবে কি-গো। সকালবেলা মাসিকে ফোন করেছিলাম। মাসি পাঠিয়েছে।
দামিনী সকালে এসেছিল!
আমি মাথা দোলালাম।
ওকে দিলি না।
সকাল থেকে অনেক খেয়েছে। এবার আমরা খাব।
দেখলাম কাকা, নিরঞ্জনদা, মল্লিকদা, ডাক্তারদাদা, দাদা একসঙ্গে বাসুর দোকানে ঢুকলো।
আরি বাবা, ডাক্তার দেখ এখানে হাট বসে গেছে। দাদা বলতে বলতে ঢুকলো।
আমি উঠে গিয়ে সকলকে প্রণাম করলাম। আমার দেখা দেখি ওরা সবাই করলো।
কিরে কাগজের খবর কি?
দাদার কথা শেষ হয়নি, বড়োমা দাঁত মুখ খিঁচিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো।
মরন। ছেলেটা এখনও বাড়ির চৌকাঠে পা দেয়নি ওর কাগজের খবর জানতে হবে।
ইসলামভাই শেরওয়ানীর ওর্নাটা মুখে চাপা দিয়েছে।
তুমি কাগজ পড়োনি?
পড়েছি। বেশ করেছে সন্দীপ। কখন এলি?
এইতো আধঘণ্টা।
ঘরে আর বসার জায়গা নেই। বাসু পাশের দোকান থেকে কয়েকটা চেয়ার নিয়ে এলো। ওরা সবাই বসলো।
বুঝলে বড়ো, ডাক্তার হাট শুদ্ধু কিনে নিলে।
বেশ করেছে। খেতে পায়না ওখানে, কি করবে।
এটা ঠিক কথা নয় বান্ধবী।
আমি হাসছি।
মল্লিকদার দিকে তাকালাম। গম্ভীর থাকার চেষ্টা করছে।
মিত্রা মিষ্টি এনে সকলের হাতে দিল।
এটা কিরে মামনি। ডাক্তারদাদা বললো।
বুঝলাম মিত্রার সঙ্গে ডাক্তারের এখন আর পেসেন্টের সম্পর্ক নেই।
খাওনা। মাসি পাঠিয়েছে।
ডাক্তারদাদা মুখে তুলেই বললো এ নিশ্চই উত্তর কলকাতার। না হলে এরকম স্বাদ আসবেই না।
যত্তো সব। বড়োমা গজ গজ করছে।
যাই বলো বান্ধবী কাঁচা সন্দেশটা নলেনগুড়ে বেশ ভালো পাক দিয়েছে।
খাওতো ডাক্তার, আর বক বক করো না। কাল থেকে খালি খাই খাই।
তুমি খাওনি।
বড়োমা ডাক্তারদার দিকে তাকিয়ে।
আমি যা যা বলে কয়ে সুরদিকে দিয়ে রাঁধিয়েছি তুমিও খেয়েছো। তখন না বলোনি।
এইবার প্যাঁচে পড়েছে। দাদা বললো।
শুঁরির সাক্ষী মাতাল। বড়োমা চিবিয়ে চিবিয়ে বললো।
আমি আর থাকতে না পেরে হো হো করে হেসে ফেললাম।
আমার হাসির আওয়াজে মিত্রারা ফিরে তাকাল।
কি হলোরে!
তরজা গান শুনছি।
দেখো বান্ধবী, ওরাও খাচ্ছে। এর জন্যই বেঁচে থাকা। নার্ভগুলোকে খাবার দিতে হবে।
এই ডাক্তারী শুরু করলে।
মল্লিকদা, ছোটোমা মাথা নীচু করে মিটি মিটি হাসছে।
মামনি।
মিত্রা ফিরে তাকাল।
আর কিছু দিবিনা?
আলুপরটা মুরগীর ঠ্যাং, খাবে?
নিয়ে আয় নিয়ে আয়। বিকেলের টিফিটনটা সেরে নিই। ভালই হবে।
দাদা আপনি?
হলে খারাপ হয় না।
সব এক গোয়ালের গরু।
কিগো এডিটর, বান্ধবী শেষপর্যন্ত গরু বানিয়ে দিলে!
কাকা এককোনে চুপচাপ বসে সব দেখছে। মিটি মিটি হাসছে।
ওরা এরই মধ্যে সব জোগাড় করে নিয়েছে। প্লেটে প্লেটে সবাইকে দিলো। টিনা, মিলি, অদিতি এগিয়ে এগিয়ে দিচ্ছে।
ওমা এরাও এসেছে দেখছি। ডাক্তারদাদা হাসতে হাসতে বললো।
টিনারাও মিটি মিটি হাসছে। বড়োমাকে এনে দিল। বড়োমা নিল। ছোটোমাও খাচ্ছে।
ডাক্তার আবার বড়োমার দিকে তাকিয়ে হাসলো।
এডিটর।
বলো।
আমরা তাহলে সকলেই গরু।
তুমি তো অনির মতো কথা বলছো।
কেন!
ভীষণ চালাক। সুযোগের অপেক্ষা করে।
বড়োমা বাঁকা চোখে ডাক্তারের দিকে তাকাল।
কিরে তুই খাবি। মিত্রা চেঁচিয়ে উঠলো।
আমি না বললাম।
বাঁচা গেল। তোর ভাগেরটা আমি খাব। সকলের মুখ চলছে।
তুই কি অর্ডার দিয়ে বানিয়ে এনেছিস?
ইসলামভাই বললো।
না।
সেদিনের থেকে প্রিপারেশনটা বেশ ভালো করেছে।
চিকনা আমার পাটালি। আমি বললাম।
ম্যাডাম খেয়ে নিয়েছে।
দেখলাম চিকনা মাটিতে থেবড়ে বসে মুরগীর ঠ্যাং চিবচ্ছে। বাসুও খাচ্ছে।
মিত্রা একটা প্লেটে করে হাফ আলুর পরটা আর তড়কা নিয়ে এলো।
একটু খা।
ভালো লাগছে না।
একটু।
ওর বলার ঢঙে হেসে ফেললাম।
অনিবাবু আমার বউ আমাকে এরকম করে কোনওদিন সাধেনি।
ডাক্তারদাদা খেতে খেতে খুব গম্ভীর ভাবে বললো।
আ মরন বিয়ে করলে কবে, যে বউ হবে?
ইস সব কেঁচিয়ে দিলেগো এডিটর।
যত্তোসব মস্করা।
আমি আর থাকতে পারলাম না। হো হো করে হেসেই চলেছি। ইসলামভাই জোড়ে হেসে উঠলো। ঘরটা গম গম করে উঠলো। দেবারা এবার ওপাশ থেকে সবাই এপাশে এসে আমাদের ঘিরে ধরলো।
টিনা ইশারায় জিজ্ঞাসা করছে। কি হয়েছেগো অনিদা।
আমি ইশারাতেই, বললাম দাঁড়াও দেখতে পাবে।
আচ্ছা এডিটর বান্ধবী কি তোমায় এখনও ভালোবাসে।
তোমার জেনে দরকার। বড়োমা খ্যাঁক করে উঠলো।
দাদা হাসছে। উত্তর পেলে।
আমি নিরঞ্জনদার দিকে তাকালাম।
কি অনিবাবু তুমি সভাধিপতির দিকে তাকাচ্ছ কেন?
এমনি।
ওর সরকার যেমন, তেমনি তার সাগরেদ হয়েছে।
সরি সামন্তদা আর কোনওদিন হবে না।
আরে রাখো তোমার হবে না। মেরে পোস্টমর্টেম করে পুড়িয়ে দিলে। আর হবে না। এই যে অনিরা আনলো। তুমি খাওয়াতে পারতে না।
আপনি খেতে চাইলেন না।
কোথায় হে! বুড়ো হয়েছি, দু-দিন পরে মরে যাব। তুমি কি না খাইয়ে মারতে চাও।
মল্লিক এটা কি হচ্ছে। নিরঞ্জনদা চেঁচিয়ে উঠলো।
আমাকে দলে ভেরাচ্ছ কেন। তোমায় জিজ্ঞাসা করেছে তুমি উত্তরদাও।
মামনি মিষ্টি আর নেই?
আছে। রসোগোল্লা। খাবে?
নিয়ে আয় নিয়ে আয়, কেউ খাক আর না খাক, তুই আমি খাই।
কিছুক্ষণ আগে একপেট ভাত খেয়ে এলে। ভাত কি কম খেয়েছিলে। বড়োমা আবার একই ভাবে কথা বললো।
টিনারা আর থাকতে পারলো না, হো হো করে হেসে এ ওর গায়ে ঢলে পড়ে।
পাঁচু পাটালি আর ছোলা সেদ্ধ নিয়ে এসে আমার হাতে দিল।
এটা কিরে অনি?
পাটালি।
হাটে ঢুকেই মামনি খাওয়াল। বেশ খেতে, তোর থেকে একটু দে। ডাক্তারদাদা বললো।
আ মোলো কিরকম আদেখলা পানা করে! বড়োমা বললো।
অনি আমাকেও একটু দিস। দাদা বললো।
ও পাঁচু, হাটে যতো পাটালি আছে নিয়ে আয় বাবা। আজ রাতে পাটালি খাইয়ে রাখবো।
আমি বড়োমাকে জাপ্টে ধরে বললাম তুমি এরকম করছো কেনো।
তুই জানিস না। আজ সকাল থেকে পেসেন্ট দেখছে আর বলছে এই শাকটা নিয়ে আয়, ওই শাকটা নিয়ে আয়। ডাক্তার আর তোর দাদা দশরকম শাক ভাজা খেয়েছে।
পেছন থেকে কাকা খুব জোড় হেসে উঠলো।
তোর কাকাটাও জুটেছে। জন্মভোর এখানে রইলো। শাকভাজা যেন জম্মে খায়নি।
জানো বান্ধবী কলকাতায় পয়সা দিলেও তুমি খুঁজে পাবে না। ডাক্তারদাদা বললো।
তা বলে এরকম হ্যাংলামো।
ইস ছি ছি ছি, এডিটর বান্ধবী আর প্রেসটিজটা রাখবে না।
কেউ চেষ্টা করেও গম্ভীর থাকতে পারছে না।
হ্যাঁগো বান্ধবী, পাটালি আনতে বললে, অনির নাকি জিলিপি খুব ফেভারিট, কয়েকটা আনতে দাও না।
আর হবে না।
নীপা মা।
নীপা হাসতে হাসতে এগিয়ে এলো।
কি বলো।
এই পকেটে হাত ঢোকা।
কেন বলো না।
হাত ঢোকা না।
তুমি বলো।
হাটে ঢুকতেই ডানদিকে যে ছেলেটা বসে আছে। ও জিলিপিগুলো বেশ কড়া করে ভাজছে। তুই আমার, অনি, এডিটর আর তোর জন্য নিয়ে আয়। গোনাগুন্তি দুটো করে।
আমরা কি বানের জলে ভেসে এসেছি। বড়োমা চেঁচিয়ে উঠলো।
ও এডিটর শুনলে কথা।
তুমি শোনো, আমি তিরিশ বছর ধরে শুনছি।
টিনা হাসতে হাসতে ডাক্তারদার পায়ের কাছে বসলো।
তুই আবার এখানে কেন!
দাঁড়াও তোমার আর বড়োমার কথাগুলো মুখস্থ করি।
পারবি না।
চেষ্টা করি।
পাঁচু জিলিপির ঠোঙা নিয়ে ঢুকলো।
দে দে বাবা আগে অনিকে দিয়ে বউনি কর। ডাক্তারদাদা বললো।
আমি একটা তুলে নিলাম। টিনা উঠে দাঁড়িয়ে সকলকে ভাগ করে দিল।
মিত্রার দিকে তাকালাম। ও এখনো একটা ঠ্যাং চিবচ্ছে।
কিরে তোর এখনও শেষ হয়নি?
তুই তাকাচ্ছিস কেন এদিকে।
জানো মিত্রাদি অনিদা ধাবায় পয়সা দেয়নি। মিলি বললো।
তারমানে! ফোঁকটসে….।
ইসলামভাই হাসছে।
তুই একটু ধুলো দিস তোর কাছ থেকে শিখতে হবে। ইসলামভাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আরে আমি না নিরঞ্জনদা….।
সবাই নিরঞ্জনদার দিকে তাকাল।
বুঝলে এডিটর, পার্টিটা এই করেই রসাতলে গেল।
না এবার আমি উঠি। নিরঞ্জনদা বললো।
আরে ভায়া উঠে যাবে কোথায়?
নাও এবার উঠে পরো। অনেক বাজার করেছো। গিয়ে রান্না করতে হবে। পথও কম নয়। বড়োমা বললো।
ফলুই মাছটা বেশ কষা কষা করে রেঁধো। অনেকদিন পর এইরকম সাইজের মাছ পেলাম।
আর কি কি তরিজুত করে খাওয়াতে হবে শুনি।
বাকিটা তুমি পারবে না। ওটা ছোটোকে বলবো।
ছোটোমা পেছন থেকে হেসেই চলেছে।
বুঝলি অনি মনাবাবু ছিলেন বলে গলদাগুলো অতো কম দামে দিলে না হলে দিত না।
এটা কিন্তু আমাদের এই নদীতে ধরা।
মনাবাবু বললেন। দেখতেও বেশ হৃষ্টপুষ্ট। বেশি পেলাম না। গোটা সাতেক পেলাম।
ওতেই হয়ে যাবে।
একটা বেশ পাকা শোল কিনেছি।
আমি হাসছি।
হ্যাঁরে ওই সাইজের শোল আমাদের গড়িয়াহাটের বাজারে বড়ো একটা দেখা যায় না। তোদের এখানে কোথায় পুকুর মারা হয়েছে সেখান থেকে ধরেছে।
আর কি কিনেছো?
বান্ধবী কিনতে দেয়নি। চিকনা বলেছে কালকে তোদের পুকুর থেকে মাছ ধরবে।
আমি ডাক্তারদাদার দিকে তাকিয়ে আছি। পরিতৃপ্ত মুখ।
বাসু বাবা একটু জল হবে। বড়ো নোংরা করে খাই। হাতটা একটু ধোব।
অনাদি জলের মগটা এগিয়ে দিল।
ডাক্তারদাদা বাইরে গিয়ে হাত ধুলো।
বড়োমা আমার দিকে তাকাল। তুই চল।
যাচ্ছি তোমরা যাও।
কেন একসঙ্গে চল।
তোমরা যাওনা। পড়ে যাচ্ছি। ইসলামভাই তুমি একটু থেকো।
আবার শলা পরামর্শ! দাঁড়া আমি দামিনীকে ফোন করছি। তুই যেমন বুনো ওল ও তেমনি বাঘা তেঁতুল।
আমি বড়োমার দিকে তাকিয়ে হাসছি।
ওরা এগিয়ে গেল।
বাইরে উঁকি দিয়ে দেখলাম অন্ধকার হয়ে এসেছে। বাসু ঘরের লাইট জ্বাললো। ধুপ দিলো।
চিকনা এবার একটু চা বল। অনাদি পাশে এসে বসলো।
ডাক্তারদাদা কাকা, কাকীদের দেখেছে?
দেখেছে মানে অর্ধেক রোগ সেরে গেছে।
যাঃ।
হ্যাঁরে অনি, বিশ্বাস কর। সুবলকাকার মুখ দেখে বললো, মাঠেঘাটে অনেক কাজ করেছেন। হাতটার এখানে বেদনা হয়।
কাকা হ্যাঁ বললো।
ঘরে গরু আছে।
গ্রামের ঘরে কার না গরু থাকে বল। কাকা হ্যাঁ বললো।
দিনে একলিটার করে দুধ খাবেন। আর পাঁচ রকমের শাকের নাম বললো। ব্যাশ ওষুধ দেওয়া হয়ে গেল।
আমি বাসুর দিকে তাকিয়ে আছি।
একটা ওষুধ দিল। এখানে পেলাম না, সুধীন ফার্মাসিস্টকে দিয়েছি, বলেছে এনে দেবে।
আমাকে একটা ফোন করতে পারতিস।
দুর, তুই ছাড়তো।
সত্যি অনি দেখলে বোঝা যায় না। হরেকৃষ্ণদা ডাক্তারদাদার সঙ্গে হাটে দেখা হতে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলো। বললো সাত মাস পরে এ্যাপয়েন্টমেন্ট পেয়েছিল। একহাজার টাকা ভিজিট। হাতটা শরু হয়ে গেছিল। এখন ঠিক হয়ে গেছে। আমাদের হাতুরে কানা সামন্তও সাষ্টাঙ্গে প্রণাম সারলো। কাল যাবে বলেছে। অনাদি এক নিঃশ্বাসে বলে গেল।
ইসলামভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, একটা সিগারেট খাওয়াবে।
চিকনা পকেট থেকে সঙ্গে সঙ্গে সিগারেট বার করলো।
কিরে সেই প্যাকেট!
না। বস আর এক প্যাকেট দিয়েছে। বাইরের কেউ এলে সিগারেট। না হলে বিড়ি।
আমি হাসলাম।
সিগারেট ধরিয়ে ইসলামভাইকে বললাম এদিকের খবর।
সব ঠিক আছে, কাজ সারতে সারতে একটা বাজলো। তারপর খেয়ে দেয়ে এখানে চলে এলাম।
আমি জায়গাটা এখনও দেখিনি।
তুই দেখিসনি!
বিশ্বাস করো।
দেখো কান্ড, যার জন্য এতোসব, সেইই এখনও দেখেনি। চল চল দেখবি চল।
দাঁড়াও সিগারেটটা খেয়ে নিই।
অনি।
আমি অনাদির দিকে তাকালাম।
একটু কাজ সেরে নিয়ে ডাইরেক্ট তোর বাড়ি চলে যাচ্ছি।
আচ্ছা আয়।
চিকনা চল।
চিকনা উঠে দাঁড়াল। বাসুকে জিজ্ঞাসা করলাম তুই কখন যাবি।
তোর ওখানে নেমন্তন্ন, সপরিবারে।
সবার!
সেই জন্য অনাদি দৌড়লো। না গেলে বৌ খেদাবে না।
আমি হাসলাম।
আমি ইসলামভাই যাব কি করে।
ইসলামভাইয়ের বাহন আছে।
চিকনারটা?
না। ইসলামভাই কিনে নিয়েছে।
আমি ইসলামভাইয়ের দিকে তাকালাম।
কি করবো বল। তুই এখানে যেভাবে তাস সাজাচ্ছিস, ঘনো ঘনো এখানে আসতে হবে। কাঁহাতক হাঁটি বল। নীপার নামে কিনেছি। আমি না থাকলে নীপা চালাবে।
নীপা চালাতে পারে।
একটু একটু শিখেছে।
তুমি পারো বটে।
তোর জন্য নাক যখন কেটেছি, একটু ভাল করেই কাটি।
বাসু উঠিরে, এখানে আর আসবো না। লতাকে নিয়ে চলে আয়।
যা যাচ্ছি।
আমি আর ইসলামভাই বেরিয়ে এলাম।
গাড়ি কোথায় রেখেছো?
সঞ্জুর দোকানের সামনে।
সত্যি তো সঞ্জুকে দেখতে পেলাম না।
দেখবি কি করে, তোর ওখানে ব্যস্ত।
কি করছে?
এদের জন্য দুটো ঘর রেডি হলো। লাইট লাগাচ্ছে। সত্যি তোর বন্ধুগুলো দারুন।
তোমার জন্য একটা সুখবর আছে।
কিরে!
চলো বলছি। ব্যাঙ্কের টাকা তুমি দিলে।
হ্যাঁ।
এ্যাকাউন্ট হয়েছে।
সাতজনের করিয়েছি। একটা করে সেভিংস। আর ডিডে যে নামটা তুই রেজিস্ট্রেসন করিয়েছিস সেই নামে একটা কারেন্ট এ্যাকাউন্ট।
কত টাকা জমা দিলে?
দাদা, মল্লিকদা, বড়দি, দিদি চেক দিয়েছে দু-লাখ করে নিরঞ্জনদা, মামনি আর আমার এ্যাকাউন্টে আমি ক্যাশ দিয়েছি। আর কো-অপারেটিভের এ্যাকাউন্টে তিরিশ জমা দিয়ে দিয়েছি।
সব শেষ করে দিয়েছো?
আজ তো রতন আবার পাঠালো।
সে তো দেখলাম।
পায়ে পায়ে দুজনে জমিটায় এসে দাঁড়ালাম। একেবারে বাজারের মুখে। বেশ ভালো স্পট। এখানটা একটু অন্ধকার অন্ধকার। বুঝতে পারছি এইবার বাজারটা এই পর্যন্ত এগিয়ে আসবে।
অনাদিকে বলেছি কাল থেকে কাজ শুরু করে দিতে।
অনেক টাকা লাগবে।
আমার ওপর ছেড়ে দে।
তোমায় যে আরও বড়ো কাজ করতে হবে।
তুই এখনও বললি না।
অনিমেষদার কাছে গেছিলাম।
শুনলাম।
তোমার সঙ্গে অনিমেষদা বসতে চেয়েছে।
সত্যি!
নিমেষের মধ্যে ইসলামভাই আমাকে কোলে তুলে নিল।
আরে ছাড়ো ছাড়ো। করছো কি!
আমি শূন্যে উঠে গেলাম।
পড়ে যাব।
ইসলামভাই কয়েকপাক ঘুরে আমাকে নিচে নামিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলো।
আমি ইসলামভাইয়ের বুকের মধ্যে পায়রার মতো হাঁপাচ্ছি।
বিশ্বাস কর অনি। ভদ্রলোকের সঙ্গে একবার বসার জন্য কতো চেষ্টা করেছি। কেউ পাত্তা দেয়নি। তুই আমার সাধটা পূরণ করলি।
সাধ পূরণ নয় তোমাকে একটা দায়িত্ব দেবে।
বল তুই। যে করেই হোক আমি কাজটা করবো। আমাকে ওই ভদ্রলোকের মন জিততেই হবে।
এই ডিস্ট্রিক্টে মাস দুয়েকের মধ্যে পাঁচটা সিটে বাই-ইলেকসন। সিটগুলো বার করতে হবে। আমাকে আড়ালে ডেকে বলেছে। নিরঞ্জনদা যেন জানতে না পারে।
সেটা শুনলাম নিরঞ্জনদার মুখে। তোর সঙ্গে আলাদা কথা বলেছে। নিরঞ্জনদা এখন তোকে ভীষণ ভয় পাচ্ছে।
কেন!
তোর সঙ্গে অনিমেষদার রিলেশন দেখে।
ভয় পাওয়ার কি আছে?
ওতো অনেক গজব করে রেখেছে।
সেটা অনিমেষদা জানে। নিজেকে শোধরাবে, না হলে মরবে।
বড়দি বলেছে, এরপর আর অনিকে তোর জন্য বলতে পারবো না। নিরঞ্জনদা স্বীকার করে নিয়েছে।
এ যাত্রায় নিরঞ্জনদা বেঁচে যাবে।
এটাই যথেষ্ট। কজন করে।
ডাক্তার ব্যানার্জী এখন কেমন আছে?
ইসলামভাই আমার চোখে চোখ রাখলো। কেউ যেন ইসলামভাইয়ের গালে কোষে একটা থাপ্পর মারলো।
ফিক করে হেসে ফললো। গিভ এন্ড টেক পলিসি।
না।
তুই আমার পেট থেকে কথা বার করতে পারবি না।
তাহলে আমার সোর্স কাজে লাগাতে হবে।
লাগাতে পারিস। কাজ হবে না।
ওকে আমার দরকার।
যখনি বলবি তোর কাছে হাজির করে দেব।
টোডি?
মামনিকে প্রমিস করেছি ও আর থাকবে না।
ভুল করছো।
কেন!
ওকে দিয়ে অনেক কাজ করানো বাকি আছে।
আর দরকার নেই। এখন যে কাজে হাত দিয়েছিস মন দিয়ে কর।
আমি ইসলামভাইয়ের দিকে তাকালাম। বোঝার চেষ্টা করলাম।
তুমি সব জানো?
দামিনী কাল ফোনে সব বলেছে।
কাল সারারাত মাসি ঘুমোয়নি কেন?
মামনির সঙ্গে কথা বলেছে।
কখন!
তোর সঙ্গে কথা বলার পর।
মিত্রার শরীরের ব্যাপারটা মাসি জানে?
জানতো না। আমি বলেছি। দামিনী শুধু কাঁদছে। আমাকে ফিরে যেতে দে।
ছোটোমার ব্যাপার?
বলেছি।
কি বললো?
তুই খুব ভাগ্যবান। আমার কপালে ঘর সংসার কিছুই জুটলো না, তোর তবু কিছুটা জুটলো।
মাসিকে এখানে নিয়ে আসা যাবে?
আর একটু সময় নে।
মাসি কষ্ট পাচ্ছিলো।
জানি। তবু তুই নিজেকে অনেক ভেঙেছিস। আমি সব বুঝি।
তাই তোমার সঙ্গে কথা বলছি।
ইসলামভাই চুপ করে রইলো।
দাঁড়াও অনিমেষদাকে একটা ফোন করি।
এখন!
হ্যাঁ।
পকেট থেকে মোবাইলটা বার করে ডায়াল করলাম।
হ্যালো।
দাদা আমি অনি।
ভালো করেছিস ফোন করে। তোর নম্বরটা আমার কাছে নেই। এখুনি সুরোকে ফোন করে তোর নম্বর চাইলাম।
কেন দাদা!
তুই আমাকে বাঁচতে দিবি না।
আবার কি অন্যায় করলাম!
ডাক্তারটাকে গুম করে রেখেছিস কেন?
আমি করলাম কোথায়!
ওই হলো। তুই আমার থেকে ক্ষমতাবান।
অন্যায় হয়েছে।
ওই ভদ্রমহিলার সঙ্গেও একটু বোসবো।
কেন!
তোকে জানতে হবে না। তুই ডাক্তারকে ছেড়ে দে। আমাকে আমার সংসারটা চালাতে হবে।
যদি গণ্ডগোল করে?
আমার দায়িত্ব।
চুপ করে থাকলাম।
তুই ওর নামে যা খুশি লেখ। তাতে যদি ওর ক্ষতি হয় হোক, আমি বলতে যাব না। আমার এই মুহূর্তে বলারও কিছু নেই।
ঠিক আছে ছেড়ে দিয়ে খবর দেব।
তাই দিস।
আর একটা কথা আছে?
বল।
হাতের সামনে ডাইরীটা আছে।
আছে। কেন?
আগামী রবিবারের পরের রবিবার সন্ধ্যে সাতটার পর থেকে আমার বাড়িতে সময় দিতে হবে।
কেন!
নেমন্তন্ন।
কিসের!
সুরঞ্জনা সেদিন জমপেশ করে সাজবে বললো।
হো হো করে অনিমেষদা হেসে ফেললো।
তাহলে তুই বিয়ে করেছিস বল।
করিনি করবো। আমি সোমবার বিকেলে যাব।
আমি থাকতে পারব না।
বৌদি আর সুরো থাকলেই হবে।
তুই তোর বৌদিকে ফোন করে বলে দে।
আচ্ছা।
আমার কাজ কতদূর এগোল।
জায়গাগুলোর নাম একটু বলো।
অনিমেষদা পর পর নাম বলে গেল। নিরঞ্জনকে আবার বলতে যাস না।
আচ্ছা।
শোন তোর সঙ্গে পরে কথা বলবো। হাতের কাজগুলো একটু সারি।
আচ্ছা।
রেকর্ডিংটা সেভ করলাম।
ইসলামভাইয়ের দিকে তাকালাম। ইসলামভাই হাসতে হাসতে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
তুই কি সুন্দর না বলেও, আমার কথাটা প্রেজেন্ট করলি।
এবার কি করবে?
দামিনীকে একটা ফোন কর।
আমি করবো না তুমি করো।
কেন!
আমার বলাটা ঠিক হবে। মাসি অন্য কিছু মনে করতে পারে।
কিচ্ছু মনে করবে না।
তুমি ফোন করো না তারপর আমি কথা বলে নেব।
ইসলামভাই ফোন করলো।
মাসি ফোন ধরেই হ্যালো বলার আগে জিজ্ঞাসা করলো।
অনি কেমন আছেরে?
ভালো, এখনও বাড়ি ঢোকেনি। আমরা দু-জন সেই জায়গাটায় বসে আছি।
সকাল থেকে ছেলাটা স্নান-খাওয়া কিছু করেনি।
বাড়িতে গিয়ে করবে।
দে ওকে।
তোমার কথা শুনতে পাচ্ছে।
কিরে।
বলো।
ফোন করলি না?
সবার ঝামেলা সামলাতেই সময় কেটে গেল।
ইসলাম বলছিল।
মাসি।
কি হয়েছেরে! তোর গলাটা কেমন কেমন শোনাচ্ছে!
মাসির গলার স্বর পরিবর্তন হলো।
কিছু হয়নি। তোমাকে একটা কথা বলবো।
ওখানে কিছু হয়েছে!
না।
তাহলে!
অনিমেষদাকে ফোন করেছিলাম একটু আগে।
ডাক্তারকে ছেড়ে দিতে বলছে।
তুমি জানলে কি করে?
তোকে জানতে হবে না। ওরা দায়িত্ব নেবে।
অনিমেষদা নিজে দায়িত্ব নেবে বলেছে।
ইসলামকে দে। আমার কথা শোনা বন্ধ কর।
আমি ইসলামভাইয়ের হাতে মোবাইলটা দিলাম।
ইসলামভাই আমার পাশ থেকে একটু দূরে চলে গেল। আমি ওখানেই একটু বসে পড়লাম।
অনেকক্ষণ দামিনীমাসির সঙ্গে কথা হলো। তারপর ধীরলয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমার কাছে এগিয়ে এলো। শুধু কানে টুকরো টুকরো কথা ভেসে এলো। তোমাকে ও মাসি বলে ডাকে। তুমি কষ্ট পেলে ও কষ্ট পাবে। তুমি চাও ও কষ্ট পাক। তাহলে?
আমি উঠে দাঁড়ালাম।
ইসলামভাই কেছে এগিয়ে এলো।
ধর কাঁদছে, কিছুতেই বুঝবেনা।
কি হলো মাসি, কাঁদছো কেন!
কই কাঁদছি, ইসলাম মিছে কথা বলছে।
তোকে সব সময় কাছে কাছে থাকতে হবে। তোর কোথাও যাওয়া চলবে না। ইসলামভই বললো।
ঠিক আছে, আমি কাল চলে যাব।
তোকে আসতে হবে না।
তুমি এরকম করলে….।
মন মানে না।
তুমি সকালবেলা আমাকে এতো বোঝালে।
তোকে বুঝিয়েছি নিজের মনকে বোঝাতে পারি না।
তোমরা সবাই যদি এরকম অবুঝপনা করো সামলাব কি করে।
আর করবো না।
তোমার মিষ্টি এখানে সকলে খেয়েছে। সবাই খুব আনন্দ করেছে।
আমি সব শুনেছি।
ইসলামভাই শুনিয়েছে?
হ্যাঁ।
ডাক্তারের ভাষণ কেমন লাগলো?
বড্ড অমায়িক।
তোমার মিষ্টি মুখে দিয়েই বলেছে উত্তর কলকাতার।
উনি অনেকদিন উত্তর কলকাতায় চেম্বার করেছেন।
তুমি আমার থেকে বেশি জানবে। আমি মিত্রার শরীর খারাপ হতে জানলাম। তারপর জানলাম দাদার বুজুম ফ্রেন্ড।
তুই রোববার কখন আসবি?
খেয়ে দেয়ে বেরবো। বিকেল বিকেল পৌঁছে যাব।
আচ্ছা। এখন ফিরে যা রাত হলো।
তুমি কিন্তু কাঁদবে না।
মাসি চুপ করে আছে।
রাখছি।
আচ্ছা।
কি করি বলো তো ইসলামভাই?
কি করবি, তোর কলকাতা ছেড়ে কোথাও যাওয়া হবে না। মাত্র দু-দিন এখানে ছিলি না। বড়দির মুখ ভার, দিদির মুখ ভার। তুই ওদিকে ওইসব করছিস। শুনে চিকনারা এই কলকাতায় চলে যায়। সব সামলাতে সামলাতে আমি হিমসিম খেয়ে গেছি। বাধ্য হয়ে আমাকে সব শোনাতে হয়েছে। তাও গতকাল আমি মামনি পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছি।
চলবে —————————
from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/D4FRi50
via BanglaChoti
Comments
Post a Comment