কাজলদিঘী (ষোড়শ কিস্তি)

কাজলদিঘী

BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

ষোড়শ কিস্তি
—————————

আর দাঁড়ালাম না। তর তর করে নিচে নেমে এলাম।
রবিন বসে আছে। আমাকে দেখে উঠে দাঁড়ালো। আমাকে একটা ট্যাক্সি ডেকে দিতে পারবি।
-এত রাতে কোথায় যাবে দাদা।
-দেখি।
-চলো আমি তোমায় ছেড়ে দিয়ে আসি।
-অনেক রাত হলো, তোকে শুতে হবে তো।
-এরকম রাত অনেক হয় দাদা।
-চল তাহলে। বুড়ীমাসিকে বলে আয়।
-দরকার লাগবে না।
আমি গাড়িতে এসে বসলাম। দারোয়ানের মনে হয় নাইট ডিউটি থাকে, ও দরজা খুলে দিলো। রাস্তা ঘাট শুনশান, কেউ কোথাও নেই।
-কোথায় যাবো দাদা।
-অফিসে চল।
-এখন।
-হ্যাঁ।
রবিন কোনো কথা বললো না। মিনিট পনেরোর মধ্যে অফিসে চলে এলাম, আমি ওকে গলির ভেতরে ঢুকতে বারণ করলাম, বললাম আমায় রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে চলে যা। ও আমার কথা মতো তাই করলো। হাঁটতে হাঁটতে গেটে এলাম, আমাকে গেটটা খুলতে দেখে সিকিউরিটি গার্ডের ছেলেটা এগিয়ে এলো।
-কোথায় যাবেন?
নতুন ছেলে আমাকে চিনতে পারেনি।  খুব ক্লান্তি লাগছে, মনটা ভীষণ ভারি ভারি লাগছে। ওর সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগছিলো না। বাধ্য হয়ে প্রেস কার্ডটা বার করলাম।
ও দরজা খুলে দিলো। আমি সোজা প্রেস রুমে চলে এলাম। ছেলেটি আমায় বাধা দিচ্ছিলো, আমি বললাম তুমি সঙ্গে এসো। কি বুঝলো জানি না, ও আমার পেছন পেছন এলো। লাস্ট নাইট এডিসন বেরোচ্ছে। সকালে মিটিংয়ে দেখা সার্কুলেসনের সেই ছেলেটি দেখেই ছুটে এলো। স্যার।
সবাই আমার দিকে তাকাচ্ছে, সিকিউরিটি গার্ডের ছেলেটি মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আজ কতো সার্কুলেশন হয়েছে।
ওরা বললো।
এখন কি লেট নাইট এডিসন চলছে।
হ্যাঁ। স্যার।
একটা কাগজ টেনে নিয়ে দেখলাম, অমিতাভদা আমার একটা পুরনো ফিচার ছেপেছে।
-ট্রেনের কাগজ চলে গেছে
-হ্যাঁ, কলকাতারও কিছু বিটের কাগজ গেছে।
অতীশবাবু এগিয়ে এলেন, বললাম সব ঠিক চলছে তো।
অতীশবাবু একেবারে গদো গদো, হ্যাঁ ছোটবাবু,
আজ থেকে মনে হয় আমি অনি থেকে ছোটবাবু হয়ে গেছি।
এদের রকম সকম দেখে তাই মনে হচ্ছে।
সব ঠিক আছে দেখবেন আর কোনো সমস্যা হবে না। অতীশবাবু বললেন।
আমি প্রেস রুম থেকে ওপরে উঠে নিউজরুমে চলে এলাম। নিউজরুমে তিন-চারজন ইতি উতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে গল্প করছে, টেলেক্স মেশিনটা গঢ় গঢ় করে চলছে। আমাকে দেখে ছেলেগুলো কেমন নড়ে চড়ে বসলো,
আমি আমার টেবিলে গেলাম, এই ছেলেগুলোকে আমি ঠিক চিনি না। তবে এরা আমায় চেনে, আমার সারকিটটা এই হাউসে খুব কম। একজনকে ডেকে বললাম, লাইটটা একটু জ্বেলে দেবে ভাই।
হ্যাঁ অনিদা বলে ছুটে চলে গিয়ে লাইটটা জেলে দিলো,
আমি ড্রয়ার থেকে নিউজপ্রিন্টের প্যাডটা নিয়ে বললাম
-হ্যাঁরে ক্যান্টিন খোলা আছে।
-আছে।
-আশেপাশে তো কাউকে দেখছি না।
-বলো না কি আনতে হবে এনে দিচ্ছি।
-ডিম টোস্ট পাওয়া যাবে এত রাতে। আর একটু চা।
একটি ছেলে, জলের বোতল এগিয়ে দিলো, আমি ছিপিটা খুলে ঘট ঘট করে জল খেলাম। ওরা চা নিয়ে এলো ডিম টোস্ট বানিয়ে নিয়ে এলো। একজনকে বললাম
-দেখতো আর্ট ডিপার্টমেন্টে কেউ আছে কিনা। আমার কথা শেষ হোলো না, একজন ছুটে বেরিয়ে গেলো। ফিরে এসে বললো, দ্বীপায়নদা আছে। আমি ডিম টোস্ট খেতে খেতে বললাম
-এই যা, দেখ আমি একলা খাচ্ছি, তোদের জন্য নিয়ে আয়।
-না না তুমি খাও আমরা তো খেয়েছি।
-তা হয় না, তখন একজন দৌড়ে গিয়ে ক্যান্টিনে বলে এলো, কিছুক্ষণ পর ক্যান্টিন থেকে একটা ছেলে এসে খাবার দিয়ে গেলো। আমি পয়সা মিটিয়ে দিলাম, দ্বীপায়ন এসে হাজির। আমায় দেখ একগাল হেসে বললো
-কনগ্রাচুলেশন, অনিদা।
-কেনো দ্বীপায়ন।
-তুমি আমাদের বস হলে।
-আমায় দেখে কি তাই মনে হচ্ছে।
-তোমায় দেখে কারুরি কোনো দিন সেরকম মনে হবে না।
-তাহলে।
-তবু।
-জীবনে অব্যয়গুলো বাদ দাও। যদি, তবে, কিন্তু, বটে এসব কথা বলবে না। বোল্ড হও, সবার শেষ কথা কাজ। তোমাকে কেউ মনে রাখবে না, তোমার কাজটাকে সবাই মনে রাখবে। কাজের মধ্যে দিয়ে তুমি।
দ্বীপায়ন মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
-শোনো, আমার মোবাইলে কতকগুলো ছবি আছে। একটু প্রিন্ট করে দিতে পারবে।
-অবশ্যই।
-চলো তোমার ঘরে যাচ্ছি।
-ঠিক আছে তুমি এসো।
দ্বীপায়ন চলে গেলো।
আমি উঠে বাথরুমে গেলাম। ফিরে এসে ট্যাক্সিডার্মির আর্টিকেলটা লিখলাম, ছেলেগুলোকে বললাম, তোরা পরতো কোথাও কোনো সমস্যা আছে কিনা, দ্বীপায়নের ঘরে গেলাম। ছবিগুলো প্রিন্ট করালাম, দ্বীপায়ন অবাক, ছবিগুলো দেখে
-দাদা তুমি তো প্রফেশনাল ফটোগ্রাফারকে হার মানাবে।
-না রে আমার গুণ নয়, এই মোবাইলটার গুণ।
-তুমি যাও আমি ছবিগুলো কারেকসন করে প্রিন্ট নিয়ে যাচ্ছি।
-আচ্ছা।
আমি আবার নিউজ রুমে চলে এলাম। ছেলেগুলো আমায় দেখেই বললো, অনিদা সুপার্ব হয়েছে। তুমি এরকম ভাবে লেখ কি করে বলোতো, একটা নিরস সাবজেক্ট তুমি কি সুন্দর গল্প লিখেছো।
হাসলাম। ওদের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করলাম।

আমার গল্প করার বিষয় কাগজ কাগজের লেখা, জীবনের কিছু কিছু অভিজ্ঞতা ওদের সঙ্গে শেয়ার করে নিলাম, ওরা আমার গল্প যত শোনে তত অবাক হয়ে যায়, আমাকে বললো, তুমি কিছু সাবজেক্ট দাও না অনিদা লিখি, আমি ইনস্ট্যান্ট কয়েকটা সাবজেক্ট ওদের দিলাম, কিভাবে লিখতে হবে, কোন এ্যাঙ্গেলে লেখাটাকে টুইস্ট করে দাঁড় করাতে হবে, তা বললাম, ওদের চোখমুখে বিস্ময়, দেখে বুঝলাম আমাদের অফিসের সিনিয়ররা ওদের সঙ্গে এইভাবে কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা করে না। একটি ছেলে বলে উঠলো
-অনিদা আমরা লিখলে তুমি কারেকশন করে দেবে।
-কেনো দেবনা, তোরা লিখিস আমি সময়মতো কারেকশন করে দেবো।
-কালকে থেকেই শুরু করছি, বিশ্বাস করো প্রত্যেকদিন এই নিউজ লিখতে লিখতে একেবারে হেজে গেছি। ভীষণ একঘেয়েমি লাগে।
হাসলাম।
-নিউজটাকে নিরস সাবজেক্ট ভাবছিস কেনো, নিউজ তথ্য, তথ্য কেউ পড়ে, তোকে এই নিউজটাকেই একটা ফিচারের আকারে প্রেজেন্ট করতে হবে, দেখবি, নিউজটা অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য হবে।
-তোমাকে মাঝে মাঝে বিরক্ত করবো।
-দূর অনিদাকে পেলে তো বিরক্ত করবি, আমিই তো অনিদাকে ছয় মাস আগে দেখেছিলাম। তারপর আবার অনিদার ঘাড়ে আরো দায়িত্ব পরলো। আর একজন বললো।
আমি হেসে বললাম, নারে এবার থেকে অফিসে আসবো। সময় দেবো।
দ্বীপায়ন এলো ছবিগুলো নিয়ে। আমার হাতে পৌঁছবার আগেই ওরা কাড়াকাড়ি করে দেখে নিলো। আমি দ্বীপায়নকে বললাম, ছবিগুলো ঠিক ঠাক দাঁড়িয়েছে তো। দ্বীপায়নের দিকে তাকালাম।
-কি বলছো অনিদা এর থেকে ভালো ছবি হয় না।
আমি বললাম গ্যাস খাওয়াচ্ছ।
-তোমায়?
একটি ছেলে আমার হাতে ছবিগুলো দিল, দেখলাম, আমি যা তুলেছিলাম, তার থেকেও অনেক বেশি পরিষ্কার এবং সুন্দর দেখাচ্ছে।
-কিরে ওই লেখার সঙ্গে এই ছবিগুলো যাবে।
-যাবে মানে, দৌড়বে।
হাসলাম। একটা খাম নিয়ে আয়।
ওরা দৌড়ে গিয়ে মল্লিকদার টেবিল থেকে একটা খাম নিয়ে এলো। আমি খামের মধ্যে ছবি এবং লেখাটা ঢুকিয়ে খামটা স্ট্যাপল করলাম, ওপরে লিখে দিলাম, টু দ্য এডিটর ইন চিফ।
-খামটা অমিতাভদার টেবিলে রেখে আসবি।
-দাদার ঘর বন্ধ।
-তুমি আমায় দাও, সকালে যারা আসবে তাদের বলে দেবো। দাদার টেবিলে রেখে দেবে। আর একজন বললো।
-রাখ তাহলে খামটা।
-লেখাটা কবে বেরোবে।
-সে তো এডিটর মহাশয় জানবে।
ওরা সবাই হো হো করে হেসে ফেললো।
-তোমার লেখা……
-ভুল কথা, এখানে আমি সাংবাদিক, উনি সম্পাদক, উনি যদি মনে করেন কাগজের স্বার্থে এটা যাওয়া উচিত তাহলে যাবে, না হলে যাবে না।
-তুমি এই ভাবে ভাবো।
-না ভাবলে এগোনো যাবে না।
ওরা চুপ চাপ।
সার্কুলেশন থেকে নিউজ রুমে কাগজ এলো, হুরো হুরি পড়ে গেলো, নিজেদের লেখাটা বেরিয়েছে কিনা দেখার জন্য, প্রথম প্রথম আমারও এরকম হতো। আমাকে ওরা একটা কাগজ এনে দিলো, ভালো করে উলটে পাল্টে দেখলাম, কাগজটা আবার স্বমহিমায় ফিরে আসছে। কাগজটাকে আরো ভালো করা যায়, একটু গেটআপ আর আধুনিকিকরণ। মনে মনে হাসলাম, মিত্রার ঘাড়ে যা লোনের বোঝা এখন বছর খানেক এইসব চিন্তা ভাবনা করা যাবে না। তারপর ঋণ শোধ হলে ভেবে দেখা যাবে।
-কটা বাজে রে।
-পৌনে পাঁচটা।
-না এবার যেতে হবে।
আমি উঠে দাঁড়ালাম, চলি রে।
-আবার কবে দেখা হবে অনিদা। একটা ছেলে এগিয়ে এল।
-পাগলা আমি তো রেগুলার আসি, তোর ইচ্ছে থাকলেই দেখা হয়ে যাবে।
নিউজরুম থেকে বেরিয়ে এলাম।
সেই ছেলেটি নিচে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেই স্যালুট করলো। হেসে ফেললাম।
-স্যার, ভুল হয়ে গেছে।
-কেনো?
-আপনাকে তখন…
-তুমি তো ঠিক কাজ করেছো, আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে, তুমি কি করতে?
ছেলেটি মাথা নীচু করে আছে।
-তোমার ডিউটি তুমি করেছো। আমার ডিউটি আমি করেছি। এই ভাবে কাজ করবে।
ছেলেটি মাথা নীচু করে ঘাড় দোলালো। তারপর মাথা তুলে বললো, স্যার আপনার গাড়ি রেডি আছে।
-আমার! কেনো?
-সার্কুলেসন বাবু বলে গেছেন।
-না না আমি চলে যেতে পারবো, তোমরা গাড়িকে অন্য কাজে লাগাও।
বেরিয়ে এলাম।

একটা ট্যাক্সি ধরলাম। পকেট থেকে সিগারেট বার করে ধরালাম। মোবাইলটা বার করে, দেবাশিষদের গ্রুপটাকে একটা ম্যাসেজ করলাম, “সুপ্রভাত তোমাদের দিনটা ভাল কাটুক”। কলকাতার সকাল আস্তে আস্তে জেগে উঠছে, চায়ের দোকানগুলোয় ভিড়, সকালের মর্নিং ওয়াকারদের সৌজন্যে। রাস্তাঘাট বেশ ফাঁকা, মোড়ে মোড়ে কাগজের হকারদের ভিড়। কাড়াকাড়ি মারামারি।
আবার মিত্রা, মিঃ ব্যানার্জীর কথা মনে পরে গেলো বুড়ীমাসি, রবিনের কথা মনে পরে গেলো, কিছুতেই আমি মেলাতে পারছি না। মেমসাহেব বউ, তার ছেলে, মিত্রাকে বিয়ে করার প্রস্তাব, সব কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। কেনই বা মিত্রা কাল গেলো মিঃ ব্যানার্জীর কাছে, কেনই বা মিত্রা মিঃ ব্যানার্জীকে আড়াল করতে চাইছে, সব কেমন যেন ঘন কুয়াশার মতো লাগছে আমার কাছে। এবার মনে হচ্ছে এই জটটা খুলতে হবে আমাকে, আরো অনেক কিছু আমার জানার বাকি, বুড়ীমাসি কিছু জানে। ওই সব বলতে পারবে।

অমিতাভদার বাড়ির গেটে যখন পৌঁছলাম, পৌনে-ছটা বাজে। ট্যাক্সি থেকে নামতেই, গেট খুলে অমিতাভদা বেরিয়ে এলেন। দাদা নিয়ম করে বাড়ির বাগানে এই সময়টা হাঁটেন, কেউ ওঠে না। বাগানে হাঁটার ফাঁকেই যতটা সম্ভব পরিষ্কার করেন।
আমাকে দেখেই বললেন কিরে কোথা থেকে। এত সকালে।
-গেছিলাম একটু।
-সে তো দেখতেই পাচ্ছি। তুই কোথাও গেছিলি।
-উঃ তুমি হাঁটো, হাঁটার সময় কথা বলতে নেই। সবাই উঠেছে।
-না।
-ঠিক আছে। আমি গট গট করে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেলাম। আমার ঘর খুলে প্রথমে জামা প্যান্ট খুলে বিছানার ওপরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গামছা নিয়ে দৌড়ে বাথরুমে ঢুকলাম। দাঁত মেজে ভালো করে স্নান করে ফ্রেস হলাম। শরীরটা অনেক হাল্কা লাগছে। বাথরুম থেকে বেড়োতেই দেখলাম, বড়মা ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন।
-মর্নিং ম্যাডাম। কথা রেখেছি।
-সে তো দেখতে পাচ্ছি।
-তাহলে, অনি যা বলে তা করে। আলনা থেকে পাজামা পাঞ্জাবীটা টেনে বার করলাম।
-সারারাত কোথায় থাকা হয়েছিল শুনি।
-বাবা, এতো মাস্টারনীর মতো কথা।
-হ্যাঁ, তোর কোনো মাস্টারও নেই মাস্টারনীও নেই। আজ থেকে আমিই মাস্টারনী হবো।
-তা ভালো, তা ভালো।
চুপচাপ। আমি পাজামা পাঞ্জাবী গলালাম।
-তা বড়সাহেব বুঝি ঠেলে তুলে দিলেন, যাও তোমার ছেলে পৌঁছে গেছে।
বড়মা উঠে এলেন, আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন
-আমার মাথা খা, বল তুই কোথায় ছিলি সারারাত।
-এই তো, এই সব দিব্যি টিব্বি দিলে অনি ফুরুত হয়ে যাবে।
-ঠিক আছে দিব্যি দেবো না। বল তুই কোথায় ছিলি।
-আরে বাবা অনির কিছু কাজ আছে সেগুলো করছিলো।
-সে তো বুঝলাম, আবার কিছু গন্ডগোল।
-একেবারে না।
ছোটমা চা নিয়ে ঘরে ঢুকলেন।
-আসুন আসুন…..
-খুব খুশি খুশি মনে হচ্ছে।
-স্বাভাবিক। ছোটমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললাম, কাল রাতে শুয়ে শুয়ে সমস্ত নিউজ পরে ফেলেছো।
-তোর নিউজ। বয়েই গেছে।
-তাহলে।
-ধর, আমার এখন অনেক কাজ। তোর সঙ্গে গল্প করার সময় নেই।

ছোটমার চোখে চোখ রাখলাম, শেয়ানে শেয়ানা চেনে, ছোটমা আমার চোখে চোখ রাখতে পারল না। ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। বড়মা বড় সাধা সিধে, কিছু বোঝালে বোঝে, ছোটমা বুদ্ধি রেখে কাজ করে।
-যাই, তুই যখন বলবি না, ছোটকে জিজ্ঞাসা করি।
-যাও।

চায়ের কাপটা হাতে করে, জানলার সামনে এসে দাঁড়ালাম। সেই আমগাছ, মাথায় ঝাঁকরা চুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, পাশেই পেয়ারা গাছ, দুটো টিয়া পাখি পাকা পেয়ারা খাচ্ছে, ঠোঁট দুটো অসম্ভব লাল। মাঝে মাঝে টেঁ টেঁ আওয়াজ করছে, সারারাত জাগলাম, একেবারে ঘুম পাচ্ছে না। শরীরটা বেশ সতেজ লাগছে। কোথাথেকে একটা কাক উড়ে এসে টিয়াটার সঙ্গে ঝগড়া করতে শুরু করলো, দুজনের সে কি ঝগড়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম, ভীষণ মজা লাগছে শেষে কাকটা উড়ে চলে গেলো, বোধ হয় দলবল ডাকতে গেলো, টিয়াটাও খাওয়া শেষ হতে উড়ে চলে গেলো। মাঝা মাঝে যখন সময় পাই আমি এই জানালাটার সামনে এসে দাঁড়াই, এই পক্ষীকুলের কাছে অনেক কিছু শেখার আছে। আমি দেখে দেখে শেখার চেষ্টা করি। লোকে এসব কথা শুনলে পাগল বলবে।

ঘুরে ফিরে সেই এক কথা বার বার মনে পরে যাচ্ছে। মিত্রা, মিঃ ব্যানার্জী, অদ্ভুত সাইকোলজি, ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে, তবু মিত্রা মাথায় ডগডগে সিঁদুর মেখে ঘুরে বেরায়, বুড়ীমাসি দারুণ কথা বলেছে গায়ে হলুদ মাখলে কুমীরে ধরার ভয় নেই, কথাটা রামকৃষ্ণ পরমহংসের, কথামৃতে পরেছিলাম। বিনোদিনী দাসীকে বলেছিলেন রামকৃষ্ণ, কিন্তু সে তো বিনোদিনী, গণিকার কন্যা ছিলেন, তাহলে কি মিত্রা। দূর, কি সব চিন্তা করছি, কথার পৃষ্ঠে কথা সাজিয়ে নিজেই নিজের জালে ফেঁসে যাচ্ছি।
-বুবুন।
-চমকে তাকালাম। মিত্রা।
ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। চোখটা যেন গনগনে কাঠকয়লার টুকরো।

এত সকালে মিত্রা! এই বাড়িতে! ধীর পায়ে এগিয়ে এলো আমার কাছে।

আমি চায়ের কাপটা জানলার ধাপিতে রাখলাম।

-ওই নাম ধরে ডাকার অধিকার তোর নেই।

-কেনো গেছিলি?
নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না, একটা কিছু বলার দরকার আছে, কাল থেকে অনেক কিছু শুনেছি, এই সুবর্ণ সুযোগ ওকে আঘাত করার, আসল সত্য আমাকে জানতেই হবে, মুখ থেকে বেরিয়ে এলো
-নিজের কেপ্টের কাছে গেছিলাম, দেখলাম শরীর খারাপ ফিরে এলাম।
সপাটে আমার গালে একটা থাপ্পর মারলো মিত্রা। ঘরের গেটের মুখে তখন বড়মা ছোটমা, মিত্রা আমাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো, আমার পাঞ্জাবীটা মুঠো করে ধরেছে মিত্রা। বুকে মাথা ঘষছে, ওরা অবাক, এরকম ঘটনা কখনো ঘটতে পারে ওরা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারে নি। আমি নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। বড় হওয়ার পর জীবনে প্রথম কেউ আমার গালে থাপ্পর মারলো, তাও আবার যে সে কেউ নয় মিত্রা। যার জন্য আমি রাতকে দিন দিনকে রাত করেছি। গেটের মুখে ওরা চারজন স্থানুর মত দাঁড়িয়ে আছে ওরা ঠিক মেলাতে পারছে না ব্যাপারটা। সকলে স্তম্ভিত।
তাকিয়ে দেখলাম মিত্রার চোখ বন্ধ। মাথাটা কেমন ভাবে যেন আমার বুকে ঢলে পরেছে।
-মিত্রা।…..মিত্রা…..মিত্রা।
মিত্রা আমাকে জড়িয়ে ধরে আস্তে আস্তে মাটিতে লুটিয়ে পরছে, আমি ওকে জাপ্টে ধরলাম, মিত্রার চোখ বন্ধ, চোখের কোলে জল, আমি ওকে জাপ্টে ধরে ওর গালে আস্তে আস্তে থাপ্পর মারলাম, না কোন সেন্স নেই। মাথাটা বুক থেকে হেলে পরল, মল্লিকদা বুঝতে পারলো ব্যাপারটা, ছুটে এসে ধরে ফেললো, মিত্রা আমার পাঞ্জাবীটা মুঠো করে ধরে আছে। কিছুতেই মুঠো খুলতে পারলাম না, চড় চড় করে পাঞ্জাবীটা ছিঁড়ে গেলো, আমি ওকে আঁকুড় করে ধরে এনে আমার বিছানায় শুইয়ে দিলাম, ছোটমাকে বললাম, তাড়াতাড়ি ফ্রিজ খুলে ঠান্ডা জল কিংবা বরফ নিয়ে এসো, মল্লিকদাকে বললাম, দেখোতো আমার টেবিলে কোনো চামচ আছে কিনা, ছোটমা ছুটে বেরিয়ে গেলেন, অমিতাভদার দিকে তাকিয়ে বললাম, দেখোতো একজন ডাক্তারকে পাও কিনা।

কয়েক মিনিটের মধ্যে ঘরের মধ্যে যেনো হুরোহুরি পরে গেছে, বড়মা স্থানুর মতো একধারে দাঁড়িয়ে আছেন, কাপড়ের খুঁট দিয়ে চোখ মুছছেন, মল্লিকদা বাথরুম থেকে মগে করে জল আনলেন, আমি ওর চোখে মুখে ছিটিয়ে দিলাম, না কোন সেন্স নেই। মল্লিকদা চামচেটা এগিয়ে দিলেন, আমি মিত্রার গালটা টিপে ধরে, চামচটা ঢোকাবার চেষ্টা করলাম, দাঁতে দাঁত লেগে আছে, ওকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে কাপড়টা কোমর থেকে ঢিলে করে ওর শায়ার দড়িটা খুলে দিলাম, বুকের কাপড়টা ঢেকে টপ টপ করে ব্লাউজের বোতাম গুলো খুলে দিলাম, আঁকুড় করে বুকের সঙ্গে ধরে, ওর ব্রার হুকটা আলগা করে দিলাম, মল্লিকদাকে বললাম, টাওয়েলটা একটু ভিজিয়ে এনে দাও তো, মল্লিকদা ছুটে টাওয়েলটা ভিজিয়ে এনে দিলো, আমি খুব সন্তর্পনে মিত্রার শারা শরীর ভালো করে মুছিয়ে দিলাম, ছোটমা ঠান্ডা জলের বোতল আর বরফ নিয়ে এসেছে, আমি আলনা থেকে আমার একটা গেঞ্জি টেনে নিয়ে ওর মধ্যে বরফের টুকরো দিয়ে ওর ঘাড়ের তলায় দিয়ে দিলাম, বাড়িতে কোনো এন্টাসিড আছে, থাকলে দাও তো, মল্লিকদা বললেন, তোর ছোটমা খায়, আমার কথা মুখ থেকে বেরলো না, ছোটমা ছুটে চলে গেলেন, কার্মোজাইনের বোতলটা নিয়ে এলেন,
ছোটোমার দিকে তাকালাম।

চামচেতে ঢেলে দাও।

ছোটোমা কেমন ভাবে যেন আমার দিকে তাকিয়ে। ছিপি খুলে চামচেতে ঢেলে দিল।

আমি মিত্রাকে বুকের সঙ্গে জাপ্টে ধরে, জোর করে চামচে ঢুকিয়ে ওর দাঁতের পাটি খুললাম, জিভটা টেনে বের করে, চামচে দিয়ে কার্মোজাইম খাওয়ালাম, ওরা আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে সবাই দেখছে, আমি ওদের দিকে তাকিয়ে বললাম, এক মিনিটের জন্য একটু বেরোও তো তোমরা, ওরা বেরিয়ে গেলো, আমি মিত্রার কাপড়ের ভেতর হাত ঢুকিয়ে প্যান্টিটা টেনে খুলে আমার আলনায় একটা জামার তলায় রাখলাম, ওদের বললাম এবার এসো। ওরা ঘরে এলো, মিত্রা চোখ বন্ধ করে মরার মতো পরে আছে, অমিতাভদা ডাক্তার নিয়ে এলেন, ভদ্রলোককে আগে দেখেছি, দাদারই বন্ধু, দাদারই বন্ধু। পাশের বাড়িতে থাকেন। উনি ভালো করে দেখলেন। প্রেসার মাপলেন, প্রেসার হাই
-বাঃ ট্রিটমেন্টতো ভালই করেছো দেখছি, বরফটা খুব কাজ দিয়েছে বুঝলে অমিতাভ, নাহলে একটা অঘটন ঘটতো। ওরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে চোখ চাওয়া চাওয়ি করছে।
-একটা কাগজ পেন দাও তো, দুটো ইঞ্জেকশন লিখে দিচ্ছি নিয়ে এসো এখুনি, দিয়ে যাই, খুব স্ট্রেইন পরেছে বুঝলে, নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনি, তাই ফেন্ট হয়ে গেছে, বিশ্রাম দরকার, ডোন্ট মুভ। সাতদিন। তারপর কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাওয়া, হাওয়া বদল চাই।
আমি টেবিলের ওপর থেকে একটা নিউজ প্রিন্টের প্যাড আর পেন দিলাম।
উনি ইঞ্জেকশন লিখে দিলেন, আমি বেরিয়ে গেলাম কাগজটা নিয়ে, নিচে রবিন ছিলো ওকেই নিয়ে গেলাম, ইঞ্জেকশন নিয়ে এলাম, রবীন ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না ব্যাপারটা কি হলো, ম্যাডাম ওপরে গেলেন, একটা হৈ হৈ তারপর ডাক্তার এলো, বেচারা জিজ্ঞাসাও করতে পারছে না। ডাক্তারবাবু ইঞ্জেকশন দিলেন মিত্রার দুহাতে দুটো।
-এখন ঘুমুবে, ওর ঘুমের দরকার বুঝলে অমিতাভ, আর একজন সর্বক্ষণের পাহারাদার দরকার। আমি বৈকালে একবার আসবো।
বড়মা এগিয়ে এলেন, ও সামন্ত ঠিক বলছো, ভয়ের কিছু নেই।
-না সেরকম তো কিছু বুঝলাম না, স্ট্রেইনটা কেউ নিয়ে হজম করতে পারে কেউ পারে না, তখন উল্টো এ্যাকশন, সেন্সলেস। মেয়েটি কে?
অমিতাভদা বললেন, আর বলো কেনো আমার অফিসের মালকিন।
-বলো কি। ইন্টারেস্টিং। তোমার বাড়িতে এসে সাত সকালে অজ্ঞান।
এর মধ্যেও ছোটোমা ফিক করে হেসে ফেললো।

-হ্যাঁ। সে অনেক কথা, তোমায় পরে একদিন গল্প করবো।
-আগে তাও সময় পেতে এখন তো দেখি তুমি আমার থেকেও বিজি।
অমিতাভদা আমায় দেখিয়ে বললেন, যত নষ্টের গোড়া হচ্ছে এই অনি।
-না । এ বললে তো শুনবো না। গুড প্রিকোয়েশন নিয়েছে, না হলে এ সব কেস যখন তখন অঘটন ঘটাতে পারে।

আমি বাইরে বেরিয়ে এলাম। একেবারে এপাশে মল্লিকদার ঘরের সামনে। ওরা আমার ঘর দখল করে রাখলেন বেশ কিছুক্ষণ, বুঝতে পারছি আমি বেড়িয়ে আসার পর বেশ জমিয়ে গল্প হচ্ছে, হাসাহাসি হচ্ছে, ছোটমা একবার বেরোলেন, চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে ঘরে ঢুকলেন, আমাকে এককাপ চা দিয়ে গেলেন, আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে চলে গেলেন, যাওয়ার সময় বলে গেলেন, তোলা থাকলো।
বাগানে এখন রোদের ঝলকানি, রবীন গাড়ির একটা পাল্লা খুলে তেড়ে ঘুমোচ্ছে। কিই বা করবে কালকে শুতে শুতে রাত হয়েছে। আবার সাত সকালে মালকিনের তাড়ায় বেড়িয়ে এসেছে।

ওই কথাটা বলতে মিত্রা আমাকে তেড়ে একটা চড় মারলো, কথাটা ও সহ্য করতে পারে নি, তাহলে ম্যাসেজটা লিখতে গেলো কেনো। আমি মোবাইলটা খুলে কালকের ম্যাসেজটা দেখলাম, একবার, দুবার, তিনবার পরলাম, নিচের টাইমটা দেখলাম, এটা তো খেয়াল ছিলো না, যে টাইমে ম্যাসেজ করেছে মিত্রা সেই টাইমটা বলছে ও তখন মিঃ ব্যানার্জীর চেম্বার থেকে সবে বেরিয়েছে। ইস খুব ভুল করেছি, এই বোকামী করলাম কেনো। আমার আরো বেশি সতর্ক হওয়া উচিত ছিল, কালকে এমন কিছু ওখানে ঘটেছে যা মিত্রা মেনে নিতে পারে নি, আমাকেও বলতে পারছে না, তার জন্য কালকে ক্লাবে গিয়ে আকন্ঠ মদ গিলেছে।

মনটা ভারি হয়ে উঠলো একটা ছোট্ট ভুলে কি থেকে কি হয়ে গেলো। কেনো বলতে গেলাম ওই কথা, না বললে এ ঘটনা ঘটতই না। নিজেকে নিজে দোষী সাব্যস্ত করলাম, অনি আজ এই ঘটনার জন্য তুমি দায়ী। এর দায় তুমি অস্বীকার করতে পারো না। এর শাস্তি তোমাকে পেতে হবে।
-এই ছোকরা, শোনো এদিকে।
ফিরে তাকালাম।
ডাক্তারবাবু আমাকে ডাকছেন। আমি এগিয়ে এলাম।
-তোমার কথা সব শুনলাম অমিতাভের মুখে। গুড। তোমার বান্ধবীর এখন রেস্টের দরকার, আর ওকে সঙ্গ দিতে হবে। এটাতো এই বুড়ো-বুড়িরা পারবে না। এর দায়িত্ব তোমার।
ছোটমা মুচকি মুচকি হাসছে।
-ভালো হয়েছে। ও বলেছিলো আমার কাছে কয়েকদিন থাকবে। ওর দাদাটা ওকে খাটিয়ে মারলে। বড়মা বললেন।
-দেখলে, দেখলে ডাক্তার কি বলি বলোতো, সরষের মধ্যেই যদি ভূত থাকে।
-ওঃ তুমি এসব বুঝবে না। শোনো আমি বৈকালে একবার আসবো। আজ বিছানা ছেড়ে একেবারে উঠবে না। বুঝলে। আর একটা কথা, যখন সেন্স আসবে তখন একটা জার্ক হতে পারে, আমি পাশেই থাকি একবার খবর দেবে, আর যদি সে রকম না হয় তাহলে যেমন চলছে তেমন চলবে, আমি ডিউ টাইমে আসবো।
আমি মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম।
-তুমি লেগে পরো, তোমার কাজে।
-জমাটা খোল। ছোটোমা হাসতে হাসতে বললেন।
আমি একবার ছোটমার মুখের দিকে তাকিয়ে আস্তে করে মাথা দোলালাম। খুলছি।

ওরা নিচে চলে গেলো, আমি আমার ঘরে গেলাম। মিত্রার নিথর দেহটা বিছানার সঙ্গে মিশে আছে। হাত দুটো দুপাশে ছড়িয়ে রয়েছে। আমি হাত দুটো আস্তে করে জড়ো করে ওর পেটের ওপর রাখলাম। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। কাপড়ের তলা দিয়ে বুকটায় একটু হাত বুলিয়ে দিলাম, এই খাঁচাটায় কতো কষ্ট আত্মগোপন করে আছে। মিত্রা চোখ খুলছে না। মাথার চুলগুলো মাথার শিয়রে ছড়িয়ে রয়েছে, বরফের টুকরোগুলো আর ঘাড়ের তলায় নেই, ছোটমা মনে হয় সব ঠিক করে দিয়েছে। আমি মিত্রার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। বুকের ভেতরটা ষন্ত্রণা করছে। একটা নিষ্পাপ মেয়ের জীবন কিভাবে নষ্ট হয়ে যেতে বসেছিলো। ভাবতেই শিউরে উঠছি। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ঠায় বসে রইলাম।
ছোটমা এলেন খাবার নিয়ে, বললাম খেতে ভালো লাগছে না।
-খা, না খেলে যুদ্ধ করবি কি করে, তোর তো সব সময় যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা।
-তুমিও বলবে।
-কেনো, আমি ছাড়া কি আর কেউ বলেছে।
চুপ করে গেলাম।
-একটু খা, এত কষ্ট করে বানালাম।
-না। তুমি রেখে দাও। পারলে একটু চা বানিয়ে দাও।
ছোটমা খাবারটা টেবিলে রেখে, আমার কাছে এগিয়ে এলেন। মাথাটা বুকে চেপে ধরে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন, মন খারাপ করিস না, ঠিক হয়ে যাবে। আমি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। ছোটমার বুকে মুখ গুঁজে ঝড় ঝড় করে কেঁদে ফেললাম।
-আমি কোনো অন্যায় করি নি।
-কে বলেছে তুই অন্যায় করেছিস। পাগল।
-তোমরা সকলে আমাকে দোষ দাও।
-কে তোকে দোষ দেয়, বল তুই।
কিছুক্ষণ আমাকে জড়িয়ে ধরে চুপচাপ থাকলো।
তুই তোর মতো নিজের খেয়ালে কাজ করিস, কত বিপদের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে কাজ করিস, কাউকে না জানিয়ে নিজের মাথায় সব ঢুকিয়ে নিস, কাউকে কিছু বলিস না। আমরাও তোকে ভালোবাসি, আমাদেরও ভয় করে। রাতের বেলা ঘুমতে পারি না। আমাদেরও হারাবার ভয় আছে অনি। তোকে সেটা বুঝতে হবে। কাঁদিস না।
আমি ছোটমার আঁচলে মুখ মুছে, মাথা নীচু করে বসে রইলাম।
-নে খেয়ে নে।
-না ছোটমা ভালো লাগছে না। তুমি একটু চা দাও।
-ঠিক আছে আমি ঢেকে রেখে যাচ্ছি, তোর ইচ্ছে হলে খাস।
ছোটমা অনিচ্ছা সত্বেও ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন, আমি মিত্রার মুখের দিকে তাকালাম, চোখের পাতা একটুও নড়ছে না। স্থির। আমি ওর নাকের কাছে আঙুল নিয়ে গিয়ে রাখলাম, না নিঃশ্বাস পরছে, বুকে কান দিয়ে শুনলাম, ধক ধক করছে। পায়ের তলায় হাত দিলাম, না এখনো গরম আছে। কত চিন্তা মাথার মধ্যে বাসা বাঁধছে। সবই কু-চিন্তা কোনটাই ভালো নয়। দাদা এলেন, অফিসে বেরোবেন।
-তুই তাহলে থাক। কি করবি। তোর কাগজপত্র সব দেখলাম, রাতে ফিরি কথা বলবো। আমারও অনেক জানা বাকি তোর কাছ থেকে, তুই তো কালকে সব ম্যাজিক দেখালি, কিছু বুঝলাম, কিছু বুঝলাম না, আমি, মল্লিক বেরোচ্ছি, রাতে তাড়াতাড়ি ফিরবো। সেরকম হলে ফোন করবি।
মাথাটা নীচে নামিয়ে রাখলাম, দাদার দিকে তাকাতে পারছি না।
-কিছু ভাবিস না, যা বুঝলাম এইকদিন একটু টেনশন গেছে তোদের দু’জনেরই, তুই নিতে পেরেছিস ও নিতে পারে নি, বড় কাজ করতে গেলে, এরকম একটু আধটু হয়।
আমি কোনও কথা বললাম না।
ঠিক আছে আসি। আর শোন রবিনকে নিয়ে যাচ্ছি, গিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দেবো।
-অফিসে কাউকে আবার বলতে যেও না।
-না না বলবো না।
-সনাতনবাবুকে জিজ্ঞাসা করো ওরা চেকগুলো জমা দিয়েছে কিনা, আমাকে একবার ফোন করতে বোলো।
-তাহলে আমি আর জিজ্ঞাসা করবো কেনো, কিছু বললে তোকে ফোন করতে বলবো।
-আচ্ছা।
মল্লিকদা হাত নাড়লেন দাদার পেছনে দাঁড়িয়ে।
আমি হাত নাড়লাম।
ওরা চলে গেলো।
আমি আবার মিত্রার মুখের দিকে তাকালাম।
মনে হলো মিত্রার ঠোঁট দুটো যেন সামান্য নড়ে উঠলো। মুখটা ওর ঠোঁটের কাছে নিয়ে গেলাম, না আমি ভুল দেখেছি। আমার চোখের ভুল। আবার ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম, ঠায় ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বসে আছি। কতক্ষণ বসে ছিলাম জানি না। ছোটমা ঘরে ঢুকে বললেন, এবার তুই একটু বাইরে যা আমি বসছি।

আমি টেবিলের ওপর থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা নিয়ে বারান্দার এক কোণে চলে এলাম, কটা বাজে, সূযর্টা ঠিক মাথার ওপর, একটা সিগারেট ধরালাম, কিছুতেই ভালো চিন্তা মাথায় আসছে না, যতো ভুলে থাকার চেষ্টা করি, ততই যেনো আমার মাথায় কু-চিন্তা চেপে বসছে,

পায়ে পায়ে ছোটমার ঘরে ঢুকলাম, এ ঘরে আমি খুব একটা আসি না। মনে করতে পারছি না শেষ কবে এসেছি। ছোটমার ঘরটা বেশ সাজানো গোছানো। খাটটায় টান টান করে চাদর পাতা, খুব শুতে ইচ্ছে করছিলো, নিজের মনকে বললাম, না। খাটের পাশে ছোট্ট একটা টেবিল, ওখানে চোখ আটকে গেলো। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম, আমার মায়ের ছবি। মিত্রা নিয়ে এসেছিলো। ছোটমা একদিন কথায় কথায় বলেছিলো “আমাকে তোর মায়ের একটা ছবি দিস তো”। তার মানে মিত্রা সেই ছবিকে কপি করে ছোটমাকে প্রিন্ট করে দিয়েছে। মনটা ভারি হয়ে উঠলো। আমি টেবিলটার সামনে গিয়ে মাটিতে বাবু হয়ে বসলাম, কিছুতেই চোখ বন্ধ করে মায়ের মুখটা মনে করতে পারছি না।যতোসব আজেবাজে মুখের ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠছে।

ভেতর ভেতর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, মনে মনে বলে ফেললাম, মা আমি কি অপরাধ করেছি বলতে পারো, যার জন্য আমাকে এত কষ্ট পেতে হয়। কোনো সাড়া মিললো না। ছবি ছবিই থেকে গেলো। কতক্ষণ ওইখানে ওইভাবে বসেছিলাম মায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে জানি না। নরম হাতের স্পর্শে ফিরে তাকালাম, ছোটমা দাঁড়িয়ে আছেন, চোখের পাতা ভারি ভারি।
– চল মিত্রা উঠেছে, আমি এর আগে দুবার এসেছিলাম, তোকে বিরক্ত করি নি।
আমি উঠে দাঁড়ালাম।
-এই ছোট্ট বুকটায় এতো কষ্ট হাসি মুখে ধরে রাখিস কি করে।
আমি ছোটমার বুকে মুখ লুকালাম।
-পাগল। কালরাতে তুই এতো কান্ড করেছিস, সেটা বললেই তো সব মিটে যেতো। তুইও কষ্ট পেলি মেয়েটাকেও কষ্ট দিলি। সাথে সাথে বড়মাকে কষ্ট দিলি, ছোটমাকে কষ্ট দিলি। নিচে গিয়ে বড়মাকে একবার দেখ, সে কি করছে। সে মুখে কিছু বলতে পারে না। তোর মায়ের মুখটা দেখেছিস, ঠিক তার মতো তোর বড়মার মনটা, বুঝিস না। কাল তুই আসিস নি, তোর বড়মা খায়ও নি। নিজেও খেলি না কাউকে খেতেও দিলি না। তোদের দুটো পাগল-পাগলীকে নিয়ে বড়ো সমস্যা।
আমি ছোটমাকে জাপ্টে ধরে দাঁড়িয়ে আছি।
-যা নিজেরা নিজেদের সমস্যা মেটা। আমি নিচে গিয়ে বড়কে সামলাই, সে তো অতিষ্ঠ করে মারছে। আমার যত জ্বালা। সকাল থেকে এক কাপ চাও তাকে খাওয়াতে পারি নি। যা ও ঘরে যা। কথা শেষ হলে বলবি একসঙ্গে খাবো।
আমি ছোটমার ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। ছোটমা নিচে নেমে গেলো। আমি আমার ঘরের গেটের সামনে এসে দাঁড়ালাম, মিত্রা দুহাঁটু জড়ো করে, মাথা নীচু করে বসে আছে। অগোছালো কাপড়, খোলা ব্রেসিয়ারের ফিতে, পেছন থেকে দেখা যাচ্ছে, আমি ওর পাশে গিয়ে বসলাম, ওর মাথায় হাত রাখলাম। ও আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পরলো। কোনো কথা নেই খালি কাঁদছে, ঝর ঝর করে কাঁদছে।
আমি ওর মাথায় হাত বোলাচ্ছি, মনে মনে বললাম তুই যত পারিস কাঁদ তাহলে যদি কিছুটা হাল্কা হোস। আমার বুক ভিঁজে গেছে।
-মিত্রা মুখ তোল। আর কাঁদিস না।
মিত্রা কিছুতেই মুখ তুলছে না। আমি জোর করে ওর মুখ তুললাম, ও চোখ বন্ধ করে রয়েছে।
-চোখ খুলবি না।
আমি ওর ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে নিজেও কেঁদে ফেললাম। কতোক্ষণ দুজনে জাপ্টা জাপ্টি করে বসেছিলাম জানি না। ছোটমা কখন ঘরে এসেছে, তাও জানি না।
-এবার ওঠো অনেক হয়েছে।
আমরা দুজনে দুজনকে ছেড়ে দিলাম।
দুজনেই দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। ছোটোমা মুচকি মুচকি হাসছে।
-খিদে পেয়েছে। তাড়াতাড়ি রেডি হও। মিত্রা তুই স্নান করেছিস।
মিত্রা ঘাড় দুলিয়ে বললো না।
-যা উঠে পর, স্নান সেরে নে। কোথায় করবি নিচে না এঘরে।
-এখানেই করে নিচ্ছি।
-ঠিক আছে।
-তোর যে ব্যাগ এখানে রাখা আছে, সাখান থেকে কাপড় বার করে দেবো, না আমার একটা পরে নিবি।
-তোমার একটা দাও।
ছোটমা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। আমি মিত্রার মুখের দিকে তাকাতে পারছি না, মিত্রাও আমার মুখের দিকে তাকাতে পারছে না, মাথা নীচু করে রয়েছে।
-যা ওঠ। আমি এগিয়ে গিয়ে ওকে ধরলাম, ও আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো। অগোছালো কাপড়টা ঠিক করার চেষ্টা করলো।
-থাক আর কাপড় গোছাতে হবে না, যা খেল দেখাচ্ছিস।
মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে একবার হাসার চেষ্টা করলো।
ছোটমা, ঘরে ঢুকলো, আমি ওকে ছেড়ে দিলাম।
ছোটমা বলে উঠলেন ধর ধর ওকে ছেড়ে দিলি কেনো, ছোটমার কাছে লজ্জার আর কি রাখলি।
দুজনেই মুচকি হাসলাম। ছোটমা কাপড়-শায়া-ব্লাউজ, রেখে বেরিয়ে গেলো।
আমি ফিস ফিস করে বললাম, কি রে আমায় স্নান করিয়ে দিতে হবে নাকি।
মিত্রা আমার মুখের দিকে তাকালো। নাও বলছে না হ্যাঁও বলছে না। বুঝলাম আমায় যেতে হবে।
ওকে টেবিলটা ধরে দাঁড়াতে বললাম, আমি বাইরের দরজাটা বন্ধ করলাম। ফিরে এসে, ওকে আবার ধরলাম।
-বাথরুম করবি।
-হ্যাঁ, আমার তলপেটটা ভীষণ টন টন করছে সোজা হতে পারছি না।
আমি ওকে ধরে বাথরুমের ভেতর নিয়ে গেলাম, বললাম কমোডে বোস। আমি বাইরে দাঁড়াচ্ছি।
ও বললো আচ্ছা।
কিছুক্ষণ পর ও ডাকলো, ভেতরে আয়।
-কেনো।
-আমার ভীষণ শীত করছে।
-গিজারটা চালিয়ে নে।
-না, আমি স্নান করবো না, তুই গাটা মুছিয়ে দিবি আয়।
-দাঁড়া যাচ্ছি।
টাওয়েলটা জড়িয়ে নিয়ে বাথরুমের ভেতরে গেলাম। মিত্রা শায়া পরে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
-শায়া পরে দাঁড়িয়ে কি করছিস।
-পটি করলাম।
-ধুয়েছিস ভালো করে।
-হ্যাঁ। তোর মতোন নাকি।
-সে তো দেখতেই পাচ্ছি।
-গা মুছবো টাওয়েল কোথায়। তুই তো পরে আছিস।
-তাহলে খুলে দাঁড়াই।
-দাঁড়া।
মিত্রা আমার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে।

-ওরকম ভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?

-আমার প্যান্টি কোথায়।
জিভ বার করে ফেললাম।
-কিরে কোথায়?
-আমার আলনায়।
-তুই কি সবার সামনে আমার প্যান্টিটাও খুলেছিলি।
-না ওদের ঘর থেকে বার করে দিয়েছিলাম।
-তুই সত্যি আমার আর কিছু বাকি রাখলি না।
-তুইই বা বাকি কি রাখলি। ছোটোমা সব জেনে ফেলেছে।
-জানুক। আজ না হয় কাল জানতো।
-দাদাকে কি জবাবদিহি করবো।
-সে বড়মাকে দিয়ে ম্যানেজ করবো।
-তুই করবি, আমি পারবো না, এটা মনে রাখিস।
-দাঁড়া আর একটা টাওয়েল নিয়ে আসি।
-না এটা খোল।
-পাগলামো করিস না।
-খোল না।
-ঠিক আছে দাঁড়া টানাটানি করিস না। শায়া খোল।
আমি গিজার অন করলাম, কিছুক্ষণের মধ্যেই জল গরম হয়ে গেলো। আমি টাওয়েল খুলে, ভালো করে ওর গা মোছাতে লাগলাম।
-উঃ কি গরম রে বাবা, গা পুরে যাবে একটু ঠান্ডা জল দে না।
-বক বক করিস না। অনেক সুখ উপভোগ করছিস, কাল থেকে আমাকে খাটিয়ে মারছিস এর শোধ আমি তুলবো। মনে রাখিস।
-যখন সময় আসবে তুলিস।
-বগল তোল।
মিত্রা বাধ্য মেয়ের মতো বগল তুললো। দু একবার আমার নুনুতেও হাত দিলো, আমি গম্ভীর হয়ে গেলাম
-আচ্ছা আচ্ছা হাত দেবো না। তুই এখন নার্স আমি এখন পেসেন্ট।
গা মুছিয়ে টাওয়েলটা জড়িয়ে বললাম, বেরিয়ে আয় এসে কাপড় পর। ছোটোমা এরি মধ্যে বার তিনেক রাউন্ড দিয়ে গেছে।
-তুই কি করে জানলি।
-ও যে কি সাংঘাতিক, জানিস না।
-তুই টাওয়েল পরলি আমি লেংটো হয়ে বেরোবো।
-বেরো না কে দেখবে। বাইরের দরজা বন্ধ আছে।
-তোরটা খুলে দে।
-নে, ওকে টাওয়েলটা খুলে দিয়ে বাইরে এসে পাজামা পরলাম।
-ও টাওয়েলটা জড়িয়ে বাইরে বের হলো।
-আমার প্যান্টিটা দে।
-দাঁড়া বলে পাজামার গিঁটটা বেঁধে, আমার আলনার তলা থেকে প্যান্টিটা বার করে দিলাম।
-ও দিকে ফিরে তাকা।
-উঃ লজ্জাবতী লতা।
আমি ফিরে দাঁড়ালাম।
-কিরে আমার ব্রেসিয়ার।
-পরতে হবে না। খালি গায় ছোটমার ব্লাউজ পর।
-যাঃ।
-আর জ্বালাস না। তোকে কেউ এসময় দেখতে আসবে না। সাতদিন তুই এখানে গ্যারেজ।
-কি আনন্দ।
ওর দিকে কট কট করে তাকালাম।
-আচ্ছা বাবা পরে নিচ্ছি।
ও কাপড় পরে নিলো, দরজা ঘট ঘট করে উঠলো। আমি গিয়ে দরজা খুললাম।
-কি রে, তুই কি ওর কাপড়ও পরিয়ে দিলি। ছোটমা চোখ বড় বড় করে বললেন।
দুজনেই মাথা নীচু করে দাঁরিয়ে আছি।
-খিদেয় পেট জ্বালা করছে। তাড়াতাড়ি আয়। ছোটমা চলে গেলো।
-তোর জন্য আজ কেসের পর কেস খাচ্ছি।
-হ্যাঁরে পাউডার নেই।
-আমার কি বউ আছে। না আমি মাখি। দাঁড়া।
আমি আমার দেওয়াল আলমারি থেকে একটা পাউডার কৌটো বার করে দিয়ে বললাম এই নে। ও কৌটটা খুলে দুবার ঝাঁকালো, পরলো না। তারপর মুখটায় হাত দিয়ে আমার দিকে ঘুরে বললো।
-এটা কোনো দিন ব্যাবহার করেছিস।
-কি জানি মনে পরে না।
-কবে কিনেছিস।
-তা মনে করতে পারি না।
-এটা এখনো খোলা হয় নি।
-দে ফুটো করে দিচ্ছি। তাড়াতাড়ি কর।
-তুই ফুটো করে দে।
আমি টেবিলের ওপর থেকে একটা আল পিন দিয়ে ফুটো করার চেষ্টা করলাম, ফুটো হলো বটে, কিন্তু পিনটা হাতে ফুটে রক্তপাত ঘটালো। মিত্রা ছুটে এসে, আমার আঙুলটা মুখে দিয়ে চুষতে শুরু করলো।
-এটা কি করছিস। ও আঙুলটা মুখে নিয়ে গঁ গঁ করে কিছু বললো।
-ওঃ ছাড় না। এটুকুতে আমার কিছু হয় না। ও আঙুলটা ভাল করে দেখে, ছেড়ে দিয়ে গায়ে পাউডার দিলো।
-যেতে পারবি, না কোলে করে নিয়ে যেতে হবে।
-যেতে পরবো।
-চল।

নিচে এলাম, বড়মার মুখটা গম্ভীর, বুঝলাম ভীষণ অভিমান বুকে পোষণ করে রেখেছে। মনে মনে চিন্তা করলাম, আজ আমাকে নিজেকে কনফেস করতে হবে। এছাড়া কোনো উপায় নেই। আমি বড়মার পাশে বসলাম, ছোটমার পাশে মিত্রা। খাওয়া শুরু করলাম, খেতে খেতেই বললাম সেদিন তুমি পীর সাহেবের গল্পটা শুনতে চেয়েছিলে না।
বড়মা আমার দিকে তাকালেন, হ্যাঁ। তোর মনে আছে এখনো।
-নিশ্চই।
-মিত্রা সেদিন বলতে পারলো না।
আমি বলতে শুরু করলাম, সবার খাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো, হাত গুটিয়ে বসে থাকলো, শেষে বললাম, এর এক বছরের মাথায় আমার জন্ম, বার্থ ডেটটা বললাম।
-মানে সেই ফিস্টের দিন তোর জন্মদিন ছিলো। তার মানে তুই আমার থেকে ছ’মাসের বড়। মিত্রা বললো।
-আজ থেকে দাদা বলে ডাকবি। নাম ধরে ডাকবি না।
-হুঁ বয়েই গেছে।
ছোটমা মুচকি হাসলো।
-না না থাক ওর মুখে তোর নামটা শুনতে ভালো লাগে। বড়মা বললেন।
-কি এবার বল।  মিত্রা চোখ নাচাচ্ছে।
আমি চুপচাপ।
-তার ঠিক চার বছরের মাথায় মা-বাবা দুজনেই কলেরায় মারা যায়, দুজনকে গ্রামের লোকেরা পাশাপাশি চিতায় পুড়িয়েছিল। তারপর থেক মনা কাকার আশ্রয়ে। টিল টু ডে।
বড়মা আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।
-তাকিয়ে আছো কেনো।
-তুই এই সময় বললি।
-কেনো।
-একটু প্রণাম করতাম।
-কোথায়।
-বাগানে গিয়ে ওই অশ্বথগাছটাকে মনে করে।
-ঠিক আছে তোমায় নিয়ে যাব। অশ্বত্থগাছটা এখনো আছে।
-আমরা যাব না!
-আমাদের দুজনের সঙ্গে কথা হচ্ছে, তোমরা ইন্টারফেয়ার করবে না।
-হুঁ।মিত্রা বললো।
-গত সাত দিনের ঘটনা তুমি জানতে চেয়েছিলে।
-সে বললি কোথায়। বড়মা অভিমান ভরা সুরে আমায় বললেন।
-খাওয়া শুরু করো। থামলে চলেবে না। আমায় একটু ভাত দাও। গত সাতদিনে ভাত জোটে নি।
-ও ছোটো দে দে। দেখ ছেলের কান্ড। আমায় ফোন করে বললে কিনা এই বিরিয়ানি খেয়েছি, এই পোলাও খেয়েছি।
-তোমায় তো তবু বলেছে। আমার সাথে কথা বলেছে কিনা জিজ্ঞাসা করতো। আমায় মানুষ বলেই মনে করে না। মিত্রা বললো।
-একবারে চুপ থাকবি।
-সে কি রে। তোর মালকিন বলে কথা। ছোটোমা বললেন।
-থামো তুমি।
ছোটমা আমার পাতে ভাত দিলো। তোর মল্লিকদা পাবদা মাছ এনেছে খাবি।
-দাও। একটা নয় দুটো।
-বাবাঃ সাতদিনের খাওয়া তুই একবারে খাবি নাকি।
-গ্রামের ছেলে, আমাদের পাতে বিড়াল ডিঙোতে পারে না।
মিত্রা মুচকি হাসলো,
বড়মা বলে উঠলো থাম।
আমি খেতে খেতে আবার শুরু করলাম।
সমস্ত ঘটনা একে একে খুলে বললাম, এমনকি কাল রাতে কোথায় ছিলাম কি করেছি সব, কোনো কথা গোপন করলাম না। বড়মা, ছোটমা, মিত্রার চোখ কপালে উঠে গেছে। ওদের চোখে যেন হাজার পাওয়ারের সব বাল্ব জ্বলছে। বড়মা আমার মাথায় হাত রাখলেন। এঁটো হাতে আমায় জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেলেন। অনি আমি বলছি তোকে কেউ কোনো দিন হারাতে পারবে না।
মিত্রার মুখ থালার সঙ্গে মিশে গেছে। ছোটমা মুখ নীচু করে আছে।

-বাকিটা মিত্রার কাছ থেকে তোমরা জানো, আমার আর কিছু বলার নেই। এরপর তোমরা যদি বলো আমি অন্যায় করেছি, তাহলে আমাকে শাস্তি দাও, আমি মাথা পেতে নেবো।
মিত্রার ফোনটা বেজে উঠলো। মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে বললো, দাদার ফোন।
-ধর। মিত্রা ফোনটা ধরলো।
বুঝলাম দাদা ওর শরীরের খোঁজ খবর নিলো। ও হাঁ হুঁ করে ফোনটা বড়মার দিকে এগিয়ে দিলো। বড়মা ফোন ধরেই বললো, -এই সময় ফোন না করলে হোতো না।
-কেনো।
-আমরা এখন অনির গল্প শুনছি।
-ও কি করে গেছে জানো।
-কেনো তোমায় বাঁশ দিয়েছে।
-না। কাল আর্টিকেলটা বেরোলে, সরকারে একটা হৈ হৈ পরে যাবে।
-জানি।
-তুমি জানো।
-ও আমার ছেলে আমাকে সব বলেছে, কোনো কথা গোপন করে নি।
বুঝলাম অমিতাভদা হতাশ হলেন।
-নে ধর। মরণ, ফোনের আর সময় পেল না।
আমার দিকে ঘুরে বললো, হ্যাঁরে ওই তিনটেকে শাস্তি দিবি না।
-না। দাদা, মিত্রা, মল্লিকদার কথায় ওদের রেখেছি। পরে দেখা যাবে। তোমাদের সেদিন বলেছিলাম, পাওয়ার গেম খেলবো, খেলেছি।
-ওগুলোকে তাড়া।
-ওটা মিত্রার ডিসিশন।
-ও কি বলবে। মেয়ে মানুষ। তোর মতো কি ও চালাতে পারবে।
-চালাতে হবে। মালিক হবে, আমি কিছু করবো না তা বললে হয়, শুধু পড়ের ঘাড়ে বন্ধুক রেখে ট্রিগার টিপব। লোকের ওপর বিশ্বাস করলে, কোটি কোটি টাকার লোন হবে। যা হয়ে আছে।
মিত্রা আমার দিকে ফ্যাকাশে দৃষ্টি নিয়ে তাকালো।
-তোর ইসলাম ভাইকে একটু দেখাবি।
-ওরা লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকে। সামনে আসে না।
-তাহলে তোর সঙ্গে ওর দেখা হয় কি করে।
-ফোন আছে ফোন করি, সময় এবং জায়গা বলে দেয় চলে যাই। তাছাড়া ওর সঙ্গে দীর্ঘদিনের পরিচয়, এখন আমি জানি, ও কখন কোথায় থাকে। ওর সার্কিটের অনেকেই আমাকে নামে চেনে।
-তুই এ সব করছিস তোর যদি কোনো বিপদ হয়।
-হলে হবে, তার মোকাবেলা করতে হবে। তবে কি জানো এদের সঙ্গ ছাড়া জগত সংসার চলবে না।
-যাঃ যতসব মনগড়া কথা।
-তুমি যতোসব মন্ত্রী আমলা দেখছো, ম্যায় পুলিস পযর্ন্ত এদের তেল দেয়। ইসলাম ভাই আমাকে সত্যিকারের ভালবাসে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ। চারিদিক নিস্তব্ধ। যে যার মতো খেয়ে চলেছে।
-মিত্রা।
-উঁ।
-তুই তোর জায়গাটা কাকে রেজিস্ট্রি করেছিলি জানিস।
-না।
-তোর জমি কাকে দিচ্ছিস তা জানবি না।
-ও তো বললো সই করে দাও, তাহলে শেয়ারটা অনির নামে ট্রান্সফার হয়ে যাবে, সই করে দিলাম।
-বেশ গদ গদ হয়ে সই করে দিলি।
-থাম তুই, বক বক করিস না, মেয়ারা একা চলতে পারে কখনো। বড়মা বলে উঠলেন।
-তোমাকে বোঝা মুস্কিল তুমি একবার এদিকে ঝোল টানছো, আর একবার ওদিকে ঝোল টানছো।
-দেবো কান মুলে, আবার কথা। বড়মা বাঁহাত তুললো।
মিত্রা মুচকি হেসে কিল তুলে বলছে দাও না দাও, মুখে বোলো না।
-ছোট তুমি কি বলো।
-সত্যি তো তুই এই কদিন হলো ওর কাছে এসেছিস, ওর বুদ্ধিতে যতটুকু কুলিয়েছে, ততটুকু করেছে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ।
-ওর কোনো দোষ নেই?
– মিত্রার ওই দোষটা দোষ না, তোর মতো ওরও কোনো আশ্রয় নেই। আমরা সবাই এই পৃথিবীতে আশ্রয় খুঁজি জানিস, কেউ পাই কেউ পাই না। তখনই হতাশা আমাদের গ্রাস করে, আমরা দিশেহারা হয়ে দৃষ্টি কটু কাজ করি।
আমি উঠে দাঁড়ালাম, ছোটর কাছে গিয়ে নীচু হয়ে একটা পেন্নাম ঠুকলাম।
-এটা কি করলি।
-তোমার কাছ থেকে একটা নতুন জিনিস শিখলাম। তাই।
-পাগল।
আজকের খাওয়াটা ম্যারাথন দৌড়ের মতো, ঘড়ির দিকে তাকালাম, দেখছো, চা খাওয়ার সময় হয়ে গেছে।
-সত্যি তো, ও ছোটো দেখেছিস, কথা বলতে বলতে কত বেলা হয়ে গেলো বলতো।
-শান্তি।
-কথা বলিস না আর, সাতদিনেরটা এক দিনে হজম করা যায়। এবার থেকে প্রত্যেক দিন বলবি। বড়মা বললেন।
-আচ্ছা।
উঠে পরে বেসিনের কাছে চলে গেলাম, ছোটমা টেবিল পরিষ্কার করছে, আমি মুখ ধুলাম, মিত্রা আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। ও আমার দিকে কেমন ভাবে যেন তাকিয়ে আছে। আমি ছোটমার আঁচলে মুখটা মুছে, ওপরের দিকে হাঁটা লাগালাম, ছোটমা রে রে করে উঠলো।
রান্না ঘর থেকে বড়মা চেঁচিয়ে উঠলো, কি হলো রে ছোটো।
-দেখনা অনি আমার কাপড়ে মুখ মুছে চলে গেলো।
-মুখপোড়া।
যেতে যেতে দরজা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলাম, মিত্রা মুখ ধুতে ধুতে মুচকি মুচকি হাসছে। নিজের ঘরে গেলাম, সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে না। বড়মাকে সব কথা বমি করার পর বেশ হাল্কা হাল্কা বোধ হচ্ছে। মিত্রা ঘরে এলো
-একটা কাজ করবি।
-বল।
-বড়মার কাছ থেকে গোটা পাঁচেক লবঙ্গ নিয়ে আয় না।
-সিগারেট খা।
-ভালো লাগছে না।
-দাঁড়া। মিত্রা বেরিয়ে গেলো।
আমি জানলাটার সামনে এসে দাঁড়ালাম, পশ্চিম আকাশ গাড় কমলা রংয়ের, ভদ্রলোককে আর দেখা যাচ্ছে না।
-এই নে।
মিত্রা কাছে এগিয়ে এলো। আমি ওর হাত থেকে একটা লবঙ্গ তুলে নিয়ে মুখে দিলাম। ওর মুখেও একটা গুঁজে দিলাম। ও আমার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।
-কি দেখছিস।
মিত্রা আমার গালে হাত দিলো। হেসে ফেললাম।আমাকে জাপ্টে ধরে আমার বুকে মুখ গুঁজলো।
-আবার কি হলো।
-তুই আমাকে মার।
-পাগলামো করিস না। তোকে নিয়ে আমার বড় জ্বালা।
-কি করবো বল, তোর কাছে যখন আশ্রয় চাই তুই দিচ্ছিস না কেনো।
-আমি তো ভগবান নই যে চাইলেই পাবি।
-আমি তোকে আমার ভগবান বলে মানি।
-ঠিক আছে চল একটু বাগানে ঘুরে আসি। বাড়িতে একটা ফোন করে বলে দে তুই যাবি না। না হলে ওরা আবার চিন্তা করবে।
-বুড়ীমাসির সঙ্গে কালকে ঝগড়া করেছি।
-তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে।
-কালকে হয়েছিলো।
-ঠিক আছে চল নিচে যাই।

দুজনে মিলে নিচে এলাম। দেখলাম, রবীন গাড়ির ভেতর বসে বসে চা খাচ্ছে। আমায় দেখে বললো, দাদা তোমার জন্য আজকে ফুল রেস্ট পেলাম।
-ভাল করেছিস। চা খেয়ে নিয়ে একটা কাজ কর।
-বলো।
-বুড়োমাসীকে গিয়ে বলবি। মিত্রা সাতদিন এখানে থাকবে। ওর শরীরটা খারাপ। সকালে ডাক্তার এসেছিলো।
রবিন আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে।
-আমি সারা দিন এখানে থাকলাম কিছু জানতে পারলাম না।
-কেনো তোকে নিয়েই তো সকালে ইঞ্জেকসন কিনতে গেছিলাম।
-সেটা ম্যাডামের জন্য!
-তাহলে কার জন্য। গাধা।
রবিন মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
-আর শোন বুড়ীমাসি যদি আসতে চায়, কাল সকালে নিয়ে আসিস। গাড়ির দরকার হলে আমি ফোন করে দেবো। ঠিক ঠাক ভাবে থাকিস। বেচাল হলে আমি কিন্তু খবর পেয়ে যাবো।
-না দাদা আর হবে না।
রবিন চা খেয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলো। এসে দেখলাম মিত্রা পেয়ারা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে একটা ভাঙা বেঁকারি দিয়ে পেয়ারা পারার চেষ্টা করছে।
-কি করছিস তুই! আবার একটা বিপদ ডাকবি নাকি, এরা তাহলে আমাকে ফাঁসি কাঠে ঝোলাবে।
-আমাকে একটা পেয়ারা পেড়ে দে।
বাধ্য হয়ে গাছে উঠে গোটা সাতেক পেয়ারা পেড়ে দিলাম। কয়েকটা কাপরে জড়িয়ে রাখলো, একটা নিজে খেতে শুরু করলো।
-তুই একটা খা।
ওর হাত থেকে পেয়ারা নিয়ে কামড় দিলাম। অনেকক্ষণ বাগানের এপাশ থেকে ওপাশে ঘুরলাম, অনেক কথা বললাম, সন্ধ্যে হয়ে এলো। ফোনটা বেজে উঠলো। টিনার ফোন।
-বলো টিনা।
-তুমি কোথায়।
-বাড়িতে।
-বাড়িতে এখন।
-তোমাদের মিত্রাদির শরীর খারাপ পাহারা দিচ্ছি।
-কি হয়েছে।
সংক্ষেপে বললাম। টিনা দাদার বাড়ির এ্যাড্রেস চাইলো। আমি দিলাম। লোকেশন বলতে বললো, বললাম। ও ফোনটা রেখে দিলো।

চলবে —————————



from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/0nXaAWE
via BanglaChoti

Comments