কাজলদিঘী (৩৩ নং কিস্তি)

“কাজলদীঘি”

BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

৩৩ নং কিস্তি
—————————

পকেট থেকে বার করে দেখলাম মিত্রা ফোন করেছে। বাইরের বারান্দায় বেরিয়ে এলাম।

হ্যালো।

কাজ শেষ?

শুরুই করলাম না।

ইসলামভাই বড়োমাকে বললো, রতন নিয়ে চলে গেছে।

এখনও এসে পৌঁছয়নি। তুই কোথায়? পাখির ডাক শুনতে পাচ্ছি।

হো হো হো। মিত্র খুব জোড় হেঁসে উঠলো।

হাসছিস কেন?

পুকুর পাড়ে বাঁশবাগানের ভেতর।

বাঁশবাগানে! ওখানে কি করছিস?

তোকে ফোন করবো, তাই চলে এলাম।

আমাকে ফোন করার জন্য বাঁশবাগানে!

হ্যাঁ মশাই। ওরে আমাকে সবাই এখন ফলো করছে। তুই কাউকে কিছু বলছিস না। এমনকি ছোটোমা মল্লিকদাকে ফোন করেও কিছু বার করতে পারলো না। দাদা বলে দিল অনিকে জিজ্ঞাসা করো।

আমি হো হো করে হাসলাম।

সবাই ভাবছে কি জানিস?

কি!

আমাকে তুই সব বলেছিস। আমি চেপে যাচ্ছি।

কালকের কেশটা মিলিয়ে দিলাম।

তোকে বলতেই ভুলেই গেছি!

আমি হাসছি।

সত্যি চিকনা কি জিনিষরে!

কেন?

আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। ও নিচ থেকে শুনেছে। কিন্তু পরিষ্কার শুনতে পায়নি বলে পেছনের চাল দিয়ে উঠে বারান্দার চালে এসে আমার মাথার ওপরের চালে বসে সব শুনেছে।

তাহলে বুঝলি।

বুঝলাম মানে। এবার তোর সঙ্গে কথা বলতে গেলে মাঝে মাঝে তোর মতো হতে হবে।

কিরকম?

এই যে বাঁশবাগানে চলে এসেছি।

হাসছি।

হাসিসনা।

বাঁশবাগান পার হয়ে তোর সেই খালের ধার পর্যন্ত চলে এসেছি। যেখান থেকে খাল পার হয়েছিলাম।

ফিরে যেতে পারবি তো?

খুব পারবো। বড়োমা কি বলে জানিস?

কি!

আমাকে সকালে জিজ্ঞাসা করলো অনি তোকে কি বললো। আমি ডিনাই করে গেলাম। দেখলাম হুঁ বলে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকাল। বুঝে ফেললাম খবর হয়ে গেছে। তারপর একফাঁকে চিকনাকে ধরলাম। কিছুতেই স্বীকার করেনা। বললাম ঠিক আছে দাঁড়াও তোমার গুরু আসুক।

আমি হাসছি।

তখন আমার পায়ে হাত দিয়ে বলে, ম্যাডাম অন্যায় নেবেন না বড়োমার হুকুম।

ব্যাশ তারপর থেকে এ্যাকটিং শুরু করেদিলাম।

এই তো তুই পাকছিস।

তোর মতো হতে পারবো?

চেষ্টাকর, ঠিক হবে।

ঠিক।

আবশ্যই। তারপর কাজ শেষ, সকলকে বলে দাও।

তা বলে তোকে না বলে কোনও কাজ করবো না।

সেটা আলাদা ব্যাপার।

রতন এলো বুঝলি। গেটে গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। আমি এখন রাখি। তোর ঢ্যামনা বরটাও এলো।

তুই এত নরম নরম গালাগাল দিস না, আরো কঠিন কঠিন দে।

ঠিক আছে। ঘণ্টাখানেক বাদে করিস।

আচ্ছা।

আমি আমার ঘরে এলাম। দেখলাম সিঁড়ি দিয়ে রতন আবিদ ওর সাগরেদরা ডাক্তারকে নিয়ে ওপরে উঠে আসছে। ডাক্তারকে দেখে বেশ ঝকঝকে মনে হচ্ছে। দাদাকে বললাম তোমার সব পড়া হয়ে গেছে?

হ্যাঁ। খুব সুন্দর হয়েছে।

ওরা এসে গেছে।

নে নে কাজ শুরু করে দে।

হিমাংশু ম্যাডামকে আনার ব্যবস্থা কর।

প্রত্যুষ ডাইরেক্ট চলে গেছে। এখুনি এসে পড়বে।

রতন ঢুকলো। পেছন পেছন সবাই। কবিতাকে দেখতে পেলাম না। ডাক্তারকে দেখেই আমার মুখের জিওগ্রাফি বদলে গেল। ডাক্তার ঘরে ঢুকেই দাদার পায়ে হাত দিয়ে ঝড় ঝড় করে কেঁদে ফেললো। দাদাও ডাক্তারের ব্যবহারে কিংকর্তব্য বিমূঢ় অবস্থা। কি করবে ঠিক ভেবে পাচ্ছে না।

আমায় ক্ষমা করুন দাদা, আমি অনেক পাপ করেছি।

মল্লিকদা গরম খেয়ে গেল।

আপনি পাপী নন, নরকের কীট।

আবিদ তেড়ে এসেছিল। রতন কোনওপ্রকারে ধরে ফেললো।

দাদা মুখে কিছু বলতে পারছে না। ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে আছে।

আপনি আমাকে এদের হাত থেকে বাঁচান দাদা।

আমি পারবো না, অনি পারবে।

অনি আমাকে মেরে দেবে।

আমি কি করবো। অন্যায় করেছেন। আপনারও শুনেছি প্রচুর ক্ষমতা।

যাদের ওপর নির্ভর করে আমি ক্ষমতা দেখাতাম, তারা অনির খাস লোক।

আমি আর থাকতে পারলাম না। উঠুন অনেক নখরামি করেছেন, এবার ভালোয় ভালোয় সই করে দিন।

তুমি যা বলবে সব সই করে দেব। আমায় আজ ছেড়ে দাও।

দেব।

আবিদ টেনে হিঁচড়ে দাদার পা থেকে ডাক্তারকে তুললো।

যা বলবে অনিদা মুখ বুঁজে তাই করে যা। কালকে থেকে অনেক কিছু সহ্য করছি।

হিমাংশু। আমি চেঁচিয়ে উঠলাম।

বল।

ডাক্তারের সই সাবুদ আগে সেরে নে।

ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বললাম ওপাশে চলে যান। হিমাংশু যা যা বলছে সেখানে সই করুন।

আমার গলার স্বরে এমন কিছু ছিল দাদা, নিরঞ্জনদা, মল্লিকদা আমার দিকে চমকে তাকাল। ডাক্তার শুর শুর করে হিমাংশুর দিকে চলেগেল।

একবার ভালো করে পড়িয়ে নিবি। লিখিয়ে নিবি আদ্যপ্রান্ত ভালো করে পড়ে বুঝে সবেতে সই করছি।

রতনের দিকে তাকিয়ে বললাম, রতন এদিকে একবার আয়।

আমি বাইরের বারান্দায় এলাম। রতন আমার পেছনে।

ইসলামভাইয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে?

হ্যাঁ। তোমাকে কিছু বলেনি!

সাগির, অবতারের ব্যাপারে বললো।

আমরা যাওয়ার আগেই আধমরা করে দিয়েছে।

বাঁচবে।

বলতে পারবো না।

কেনরে!

কালকেই শেষ করে দিত।

তুই কি করছিলি।

তুমি আমার কথা বলছো। দামিনীমাসি আমাকে পাত্তা দেবে।

তাহলে তুই এতদিন কি করলি?

রতন হাসলো। তুমি আর আমি। দামিনীমাসি তোমার কথা তবু শুনবে আমার কথা….।

কাজ শেষ হোক একবার যাব। কথা বলে তুই কি বুঝলি?

একটাই ভুল কাজ করেছে। আমাদের গ্যাংয়ের কিছু ছেলেকে ডাক্তারের সেই লোকের কাছে পাঠিয়েছে।

কারা কারা খুঁজে পেয়েছিস?

আবিদ কাল রাতেই খুঁজে বার করেছে।

ডাক্তার?

অনেক ফোন কাল থেকে এসেছে। তোমায় শোনাব। সব রেকর্ড করে রেখেছে আবিদ। তুমি শুনলে বুঝতে পারবে।

অনিদা, হিমাংশুদা ডাকছে। আবিদ এসে বললো।

আমি ভেতরে গেলাম।

কিরে হিমাংশু?

ডাক্তার কি বলে শোন।

কি হয়েছে!

তুমি সব লিখিয়ে নেবে।

বেশি কথা বলার সময় নেই। যা বলছি করুন।

তোমায় একটা কথা বলি শোনো।

দ্বীপায়ন ছবিগুলো নিয়ে আয়তো।

ইস তুমি ওগুলোও পেয়ে গেছো।

কেউ এখনও দেখেনি দ্বীপায়ন ছাড়া।

ঠিক আছে। ঠিক আছে। করে দিচ্ছি। সই করে দিলে সব আমায় ফেরত দেবে।

সেটা পড়ে ভাবা যাবে।

দাদা আপনারা ঘরের বাইরে যান। কাজের বহুত অসুবিধে হচ্ছে। অবিদ বাজখাঁই গলায় চেঁচিয়ে উঠলো।

দাদা উঠে দাঁড়াল। ডাক্তার দৌড়ে এসে দাদার পায়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে ফললো, দাদা আপনি যাবেন না।

আর কি বাকি রেখেছেন।

আবিদ হিমাংশুর হাত থেকে দলিলগুলো নিয়ে ডাক্তারের কাছে এগিয়ে দিল। সই কর।

ডাক্তার আবিদের দিকে একবার তাকাল।

কাল রাতের কথা মনে আছে।

মনে আছে ভাই।

আবিদ টেনে হিঁচড়ে দাদার পা থেকে ডাক্তারকে তুলে খাটে বসিয়ে দিল। দাদা, নিরঞ্জনদা, মল্লিকদা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়াল।

ডাক্তার সই করতে শুরু করলো। হিমাংশু পাশে দাঁড়িয়ে।

আমি হিমাংশুকে বললাম, আগের সই-এর সঙ্গে এই সইগুলো মিলিয়ে নে। আমি কিছুই বিশ্বাস করি না।

হিমাংশু সব দেখে নিল।

পাওয়ার অফ এ্যাটর্নিটা সই করা।

ওটা আগে করিয়ে নিয়েছি।

তখন কিছু বলেনি?

মিত্রার নাম লেখা ছিল।

আস্তে করে বললাম, হারামী।

চেকের এ্যামাউন্টগুলো বলে দিয়ে সই করা।

আমার কাছে কোনও টাকা নেই অনি।

সব আছে, এখুনি বেরিয়ে যাবে, দেখবেন বিট পরুক।

বিশ্বাস করো।

দাদা তোমরা বেরও তো। হিমাংশু ওই ঘরে গিয়ে দাদাদের সই করা।

আমার গলার স্বরে এমন কিছু ছিলো দাদা আমার দিকে একবার ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাল। ধীর পায়ে ঘরের বাইরে চলে গেল।

আবিদ দরজা জানলা বন্ধ কর।

আবিদ তুরন্ত কাজ শুরু করে দিল। কালকের সেই ছেলেগুলো আমাকে অবাক হয়ে দেখছে। রতন আমার পাশে দাঁড়িয়ে।

বল এবার তোর কথা।

এই প্রথম আমি ডাক্তারকে আপনি আজ্ঞা ছেড়ে একবারে তুইতে নেমে গেলাম। আবিদ, রতন দুজনেই আমার দিকে একবার তাকাল। বুঝলো আজ অনিদা আরও বেশি ডেঞ্জার।

তুমি বিশ্বাস করো অনি।

বিয়ে করা বউকে টোডির বিছানায় তুলেছিলি কেন?

আমি তুলিনি।

ঠাস করে ডাক্তারের গালে একটা থাপ্পর মারলাম।

শুয়োরের বাচ্চা।

এই প্রথম রতনদের সামনে আমি মুখ খিস্তি করলাম। ওরা ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

খানকির ছেলে। সিডিটা কোথায়?

জানি না।
আবার একটা থাপ্পর।
-বল কোথায়।
-বলছি।

সজোরে একটা ঘুসি ডাক্তারের মুখে আছড়ে পড়লো। ডাক্তার ছিটকে মাটিতে পড়ে গেল। নাক দিয়ে ঝড় ঝড় করে রক্ত বেরতে শুরু করলো। তলপেট লক্ষ করে সপাটে পাটা ছুঁড়ে দিলাম। তখন আমার মাথায় খুন চেপে গেছে। কতগুলো লাথি মেরেছি নিজেই জানিনা। তখন কি ভাষা বলছি তাও জানিনা। আমার রুদ্রমূর্তি দেখে আবিদ আমাকে জাপ্টে ধরে ফেললো।

খানকির ছেলে তুমি ঘুঘু দেখেছো, এখনও ফাঁদ দেখনি।

অনিদা তুমি থামো আমরা আছি। রতন আমাকে জাপ্টে ধরে আছে।

শুয়োরের বাচ্চা কাল থেকে তোর অনেক নখরামি সহ্য করছি। পঁয়তাল্লিশ দিন ধরে তোর ওপর আমি হোম ওয়ার্ক করেছি। আমি এই টুকুতে হাঁপিয়ে গেছিলাম।

ডাক্তার মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছে।

কলার ধরে টেনে তুলে আবার সজোরে একটা থাপ্পর কষালাম।

বল কোথায়?

সব বলছি।

আমাকে খুন করারা প্ল্যান করেছিলি, যা বলবো তাইতে সই করে দে, নাহলে এখুনি তোকেই লোপাট করে দেব।

আবিদ ও ঘর থেকে চেক বইগুলো নিয়ে আয়।

আবিদ বলার সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুললো।

দেখলাম গেটের মুখে সবাই ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। রতন আমাকে জাপ্টে ধরে আছে।

দাদা দৌড়ে ভেতরে এলো।

চোখ দুটো ছল ছল করছে। তোর কিছু হয়নি তো? দাদার গলাটা ধরে এলো।

আমার মুখে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো।

তুমি এখান থেকে চলে যাও। কথা বলতে গিয়ে গলাটা ধরে এলো।

ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বললো।

আপনি ছেলেটার লাইফটা একেবারে শেষ করে দিলেন।

ডাক্তার ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। নাকের ডগা দিয়ে রক্ত চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। মুখটা ফুলে বেঢপ হয়ে গেছে।

হিমাংশু চেঁচামিচির শব্দ পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলো।

ম্যাডাম ওইগুলো সব রেস্ট্রি করে দিয়েছে। ওনার থাম্ব ইম্প্রেসন দরকার।

নিয়ে নে।

আমার গলাটা গম গম করে উঠলো। মল্লিকদা, নিরঞ্জনদা স্থানুর মতো আমার পাশে দাঁড়িয়ে। চোখ ছল ছল করছে।

প্রত্যুষ ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

রতন আমাকে তখনও ছাড়েনি।

দাদা তুমি শান্ত হও।

গাড়ি রেডি রাখ এখুনি ওর বাড়িতে যাব। আজই এই খেলা শেষ করবো। আরও অনেক মাল আছে। আমায় গিয়ে ঘাঁটতে হবে।

তুমি বিশ্বাস করো।

দিকবিদিক জ্ঞনশূন্য হয়ে পাটা সজোরে ছুঁড়েদিলাম ডাক্তারের মুখে। রতন ধরে ফেললো। তার আগেই ডাক্তার ছিটকে মাটিতে পড়ে গেল।

প্রত্যুষ ঘরে ঢুকলো কাগজগুলো নিয়ে। আবিদ ওই অবস্থাতেই ডাক্তারের আঙুলে কালি লাগিয়ে থাম্ব ইমপ্রেশন নিয়ে নিল।

হিমাংশুর দিকে তাকিয়ে বললাম সব ভালো করে দেখে নে। কিছু যেন বাকি না থাকে। এ মলের থেকেও বিষধর সাপ। ছোবল খাওয়ার আগে আমি ওর বিষদাঁত সব কটা ভেঙে দেব।

হিমাংশু মাথা নীচু করে আছে।

চেক বইগুলো নিয়ে আয়।

প্রত্যুষ বেরিয়ে গেল।

হিমাংশু আমার কাছে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো।

তুই একটু শান্ত হ।

শান্ত কিরে, তোদের এখনও সত্তরভাগ কথা বলিনি। বললে এখুনি রতন ওকে মেরে দেবে।

রতন মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে। চোখ দুটো জবা ফুলের মতো লাল ডগডগে। দাঁতের পাটি দুটো একবার ফুলে উঠছে আবার স্বাভাবিক হচ্ছে।

প্রত্যুষ চেক বই নিয়ে ঢুকলো।

আমি হাতে নিয়ে বললাম মিত্রার নামে প্রতিটা চেক বই থেকে দশ কোটি টাকা করে লেখ।

বিশ্বাস করো, সব কটাতে নেই।

আবার কথা। আমি আবার তেড়েগেলাম। রতন জাপ্টে ধরে ফেললো।

আমার আশি কোটি চাই। কিভাবে দিবি আমি জানি না।

আমি তিনটে চেকে দিয়ে দিচ্ছি।

তাই দে। হিমাংশু।

বল। হিমাংশুর গলাটা ধরে এলো।

একটা স্ট্যাম্প পেপারের ওপর লিখিয়ে নে স্টেটের বাইরের নার্সিংহোমগুলোর শেয়ার কোনওদিন মিত্রা ডিমান্ড করবে না। তার বিনিময়ে এই টাকাটা ও দিচ্ছে।

লিখছি।

একটু জল খাব।

জল, মদ, মেয়েছেলে সব তোকে দেব। আগে অনিদা যা বলছে তাই করে দে। তারপর। রতন ধীর স্থির ভাবে বললো। চোখে আগুন জ্বলছে।

দাদারা সবাই মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে।

সন্দীপ কোথায়?

বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। দাদা বললো।

আমি ওদের হাত ছাড়িয়ে বাথরুমে এলাম। বাথরুমের দরজা বন্ধ করার পর নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। ঝড় ঝড় করে কেঁদে ফেললাম। বুকের ভেতরটা ভীষণ যন্ত্রণা করছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে যেন। মুখে চোখে ভালোকরে জল দিলাম। আয়নায় নিজের মুখের ছবিটা ভেসে উঠল। চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। মাথাটা নীচু করে নিলাম।

ক্লাস টেনে পড়ার সময় একবার চিকনাকে ধরে খুব মেরেছিলাম। ওটাই আমার জীবনে কাউকে শেষ মারা। চিকনা একটা অন্যায় কাজ করেছিল। তারপর পীরসাহেবের থানে এসে খুব কেঁদেছিলাম। আমার হাতদুটোকে তুমি পঙ্গু করে দাও, যেন আমি কাউকে কোনওদিন মারতে না পারি। অনাদি, বাসু সেটা দেখতে পেয়ে আমাকে বুঝিয়েছিল। তুই অন্যায় করিসনি। চিকনা দোষ স্বীকার করে নিয়েছে। তুই বিশ্বাস কর।

আজ আমার পাশে অনাদি, বাসু কেউ নেই। আজ আমাকে বোঝাবার কেউ নেই। হাতের কাছে নেই পীরসাহেবের থান। চোখ বন্ধ করে অশ্বত্থ গাছটা দেখতে পেলাম। ঝড়ঝড় করে কেঁদে চেলেছি। কতোক্ষণ বাথরুমে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেঁদেছিলাম জানিনা। দরজা ধাক্কাবার শব্দে আমার হুঁশ হলো।

কিরে অনি দরজা খোল। দাদার গলা।

অনি এই অনি কথা বলছিসনা কেন।

ধরা গলায় বললাম, খুলছি দাঁড়াও।

আমি ভালো করে চোখ মুখ ধুয়ে দরজা খুললাম।

আমার ঘরে তখন সবাই দাঁড়িয়ে আছে। ডাক্তার সামন্ত এসেছেন। ডাক্তারদাদা আমাকে দেখেই এগিয়ে এলেন। রেজিস্ট্রার ম্যাডাম এগিয়ে এলেন। আমি মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছি। মুখ তুলতে পারছি না।

তুমি কষ্টপেওনা অনি, কাল থেকে দেখছি এই বাড়িতে একটা হুলুস্থূলুস কান্ড চলছে। কথা বলতে গিয়ে ডাক্তারদাদার গলাটা কেমন ধরা ধরা মনে হলো।

আমার মাথা নীচু।

রাতে কিছু বুঝতে পারিনি। আজ নিজে থেকে চলে এসেছি। ভাবলাম তোমার বান্ধবীর আবার কিছু হলো কিনা। এসে দেখলাম এই অবস্থা। অমিতাভ আমাকে সব বলেছে। ডাক্তারকে আমি খুব ভালো করে চিনি। ও আমাদের এ্যাসোসিয়েশনের সদস্য।

মনে হচ্ছে আমার কান দিয়ে যেন কিছু ঢুকছে না।

আমি তোমাকে ওর ব্যাপারে আরও হেল্প করবো। কথা দিচ্ছি আজই ওর রেজিস্ট্রেশন আমি ক্যানসেল করার ব্যবস্থা করছি। ও যে এতটা নীচ জানতাম না। তুমি স্ট্রং ম্যান। ভেঙে পরলে চলবে না। অমিতাভ ওকে নিচে নিয়ে যাও।

আবিদ, রতনের দিকে তাকালাম। ওরা মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আমার এই অবস্থাটা ওরা ঠিক সহ্য করতে পারছে না। ওদের চোখে মুখের ভাষায় তা ফুটে উঠেছে। কিছু করার নেই, এই পরিবেশ ওদের মতো নয়।

আমি নিচে চলে এলাম।

আমার পেছন পেছন নিরঞ্জনদা, মল্লিকদা, রেজিষ্ট্রার ম্যাডাম। বুঝলাম হিমাংশু রেজিষ্ট্রার ম্যাডামকে এরই মধ্যে সমস্ত ঘটনা বলেছে। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামলাম। বাগানের রাস্তায় চারটে গাড়ি দাঁড়িয়ে। গেটের বাইরে আরও দুটো গাড়ি। গাড়ির মধ্যে কয়েকটা ছেলে তাকিয়ে তাকিয়ে ওপরের দিকে দেখছে। চোখে মুখে চাপা টেনসন। শুধু নির্দেশ পাওয়ার অপেক্ষা।

আমি নিচের ঘরের সোফায় এসে মাথা নীচু করে বসলাম। ম্যাডাম আমার পাশে এসে বসলেন। নিরঞ্জনদা এক গ্লাস জল এনে দিল। আমি টেবিলে রাখতে বললাম।

খেয়ে নে। মল্লিকদা বললো।

আমি জলটা খেলাম।

বুঝতে পারছি আমার চোখ-মুখ জবাফুলের মতো লাল। নিজের চেহারাটা নিজে এই মুহূর্তে দেখতে পাচ্ছি না। তবে সবার চোখ দিয়ে নিজের চেহারাটা দেখতে পাচ্ছি। নিরঞ্জনদা রান্নাঘরে গেল। বুঝলাম চা করেছে। মল্লিকদাও রান্নাঘরের দিকে গেল।

তুমি চিন্তা করো না অনি। আইনত যা যা করার দরকার আমি করে দিয়েছি। হিমাংশু আমাকে সমস্ত ঘটনা বলেছে। ম্যাডাম আমার পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন।

আমি খুব খারাপ কাজ করে ফেললাম ম্যাডাম।

একটুও খারাপ কাজ করোনি। যা করেছো ঠিক করেছো। বরং কম করেছো।

না ম্যাডাম।

মুখে হাত চাপা দিলাম।

এই দেখো পাগলাম করে। মল্লিকদা বললো।

আমি মুখে হাতচাপা দিয়ে নিচু হয়ে বসে আছি।

তোরা ষন্ডামার্কাগুলো কি করতে আছিস। তোদের তাহলে কি করতে পাঠিয়েছি। কি জন্য তোদের পুষবো। পুঁচকে একটা ছেলে যদি সব চাপ নেবে তোরা ঘোড়ার ঘাস কাট ময়দানে গিয়ে।

কথার এতটাই জোর। সাড়াটা বাড়িতে তার অনুরণণ ছড়িয়ে পরলো।

গলাটা শুনে মাথা তুললাম। এই বাজ খাঁই গলা দামিনীমাসি ছাড়া আর কারুর নয়।

উঠে দাঁড়ালাম। মাসি এখানে কেন!

এটা ডাক্তার।

হ্যাঁ। রতনের গলা।

তোকে কুত্তার মতো মেরে দেব। তোর কতোবরো ক্ষমতা, আমি দেখব। অনি কোথায়?

নিচে।

ছেলেটাকে তোরা শান্তিতে একটু বাঁচতে দিবিনা। সারাটা জীবন তোদের জন্য করে যাবে। গলাটা সামান্য ধরে এলো।

আমি তাড়াহুড়ো করে ঘরের দরজা দিয়ে সিঁড়ির কাছে এলাম।

দামিনীমাসি সিঁড়ি দিয়ে নামছে।

এই দামিনীমাসিকে আমি আগে কখনও দেখিনি। চিনিনা। পাটভাঙা সাদাখোলের লালপার তাঁতের শাড়ি পরেছে। বাড়িতে মায়েরা যেরকম আটপৌরে ঢঙের কাপর পরে সেই রকম। একেবারে বড়োমার মতো লাগছে। মাথায় ডগডগে সিঁদুর। কপালে লাল টিপ। পেছনে কবিতা, দাদা, সামন্ত ডাক্তার, হিমাংশু, সন্দীপ। সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে। রতন আর আবিদকে দেখতে পেলাম না।

আমি দামিনীমাসিকে জড়িয়ে ধরলাম। দামিনী মাসির স্নেহভরা হাত আমার পিঠে।

কেঁদে কেঁদে মুখটা কেমন করেছিস দেখেছিস।

মাসির গলাটা ভাড়ি হয়ে এলো।

তুই তো কাঁদার ছেলে নোস। বল আমাকে সব কথা।

আমি দামিনীমাসির কাঁধে মুখ রেখে চোখ বন্ধ করলাম।

তোর দামিনীমাসি এখনও মরেনি। মাসি মায়ের সমান। আমার কাছে জীবনের আঠারো মাস কাটিয়েছিস। বল আমাকে সব কথা।

আমি দামিনীমাসির কাঁধ থেকে মুখ তুলছি না। বুঝতে পারছি চোখ দিয়ে ঝড় ঝড় করে জল গড়িয়ে পরছে।

রতন।

দামিনীমাসির গলার শব্দে আবার সারাটা বাড়ি কেঁপে উঠলো।

ওপর থেকে রতন যাই বলে ছুটে চলে এলো।

ওপরের ঘরটা খালি কর। আমি অনির সঙ্গে একা কথা বলবো।

ডাক্তারকে আমার গাড়িতে তোল।

আচ্ছা।

কবিতা।

হ্যাঁ মাসি।

যাঁরা এসেছেন দাদাদের সঙ্গে হাতে হাতে কাজ করে চা জলের ব্যবস্থা কর।

যাই মাসি।

আবিদ।

ওপরে আছে। রতন বললো।

কাউকে দিয়ে মিষ্টি আনা। আজকের শুভ দিনে সবাইকে মিষ্টি মুখ করা।

আচ্ছা মাসি।

আমার পিঠে হাত দিয়ে বললেন। চল আমার সঙ্গে তোর ঘরে।

মাসির সঙ্গে সিঁড়ি ভেঙে ওঠার সময় সবার দিকে তাকালাম। ওরা কেমন যেন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। দাদার চোখ দুটো ছলছল করছে। সামন্ত ডাক্তার চোখ থেকে চশমা খুলে আঙুল দিয়ে চোখ মুছলেন।

ওপর তলার সিঁড়ির মুখে আসতেই দেখলাম রতন আবিদ ডাক্তারকে কুত্তার মতো কলার ধরে টেনে হিঁচড়ে নিচে নামাচ্ছে। আমরা ওপরে এলাম।

তোর ঘরটা খুব সুন্দর। ভজু কোথায় শোয়রে।

আঙুল তুলে জায়গাটা দেখালাম। আমি না থাকলে আমার ঘরে। গলাটা ধরে এলো।

ঠিক জায়গায় শোয়।

এখন শীত পরেছে বলে বড়োমা ওকে নিচের ঘরে থাকতে বলেছে।

ও।

আমি দামিনী মাসিকে নিয়ে খাটে বসলাম।

তোর ফোনটা থেকে একবার ইসলামকে ফোন কর।

ভয়েজ অন করে দিই।

দে।

আমি ডায়াল করলাম। রিং বাজতেই ইসলামভাই কথা বলে উঠলো।

হ্যাঁ বল অনি। ইসলামভাইয়ের গলাটা ধরা ধরা মনে হলো।

আমি দামিনী।

বলো মাসি।

তুই সব জানিস।

জানি। এখনকার ঘটনা সব শুনলাম। এখুনি যেতে ইচ্ছে করছে। শুধু অনির কথামতো এখানে পরে রয়েছি।

ও যা বলছে শুনে যা।

শুনছি তো।

হ্যাঁ শুনবি। শুনে রাখ আজ থেকে তোকে অনির বিষয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। ওর দায়িত্ব আমি নিলাম। ও আমার ছেলে এটা মাথায় রাখিস। আমার ছেলের ক্ষতি করে কেউ আমার হাত থেকে রেহাই পাবে না।

আমার জন্য কিছুটা রেখো।

ভেবে দেখবো। এখন রাখছি।

অনি কোথায়?

আমার সামনে বসে আছে।

একটু কথা বলবো।

এখন না। আমি ওর ঘরে বসে আছি। কথা বলছি। ওখানে যারা আছেন তাদের বলে দিবি অনির জন্য চিন্তা করতে হবে না। দামিনী মরে যায়নি।

তোমার কথা সবাই শুনছে।

ঠিক আছে। এখন রাখ। আধঘণ্টা বাদে অনির ফোনে ফোন করবি।

আচ্ছা।

কবিতা মিষ্টি জলের গ্লাস নিয়ে ঢুকলো।

সবাইকে দিয়েছিস।

হ্যাঁ।

দিয়ে কাজ সেরেছিস, না খাইয়েছিস।

সবাই খেয়েছে। তুমি গিয়ে দেখ।

নিচে যা।

কবিতা ট্রেটা রেখে চলে গেল।

নে মিষ্টি মুখে দিয়ে সব বল।

তুমি খাও।

খাচ্ছি।

আমি একটা মিষ্টি মুখে দিলাম। জল খেলাম। একে একে দামিনীমাসিকে সব খুলে বললাম। দামিনীমাসির চোখ মুখের চেহারা বদলে গেল।

কাগজগুলো তোর কাছে সব আছে।

আছে।

মিত্রার ছবিগুলো।

আমার কাছে।

তুই একা দেখেছিস না সবাই দেখেছে।

আমি একা দেখেছি। ভিডিও সিডি ওর বাড়িতে আছে।

স্বীকার করেছে।

হ্যাঁ।

ওটা উদ্ধারের দায়িত্ব আমার। তুই এখন কি করতে চাস?

কালকে ওখানে ওই ব্যাপারগুলো রেস্ট্রি আছে। দাদারা যাবে।

কখন যাবেন?

কাজ শেষ হলে।

তুইও যা।

আমাকে লেখাগুলো লিখে ফলতে হবে।

এখন ছাপিস না।

আমি দামিনীমাসির দিকে তাকালাম।

আরও গল্প আছে মনে হচ্ছে। আমাকে একটু খোঁজ খবর নিতে দে।

তুমি বলো।

তুই দাদাদের সঙ্গে চলে যা।

সবাই চলে গেলে কাগজ চলবে না। বুঝতে পারছো না।

ঠিক আছে আমি দাদার সঙ্গে কথা বলবো।

বলো।

মন খারাপ করিস না। কি করবি। মেয়াটার ভাগ্য আমি তুই লিখি নি। ওর ভাগ্যে যেটুকু ছিল সে টুকু ঘটেছে। তোকে কথাদিলাম আর ঘটবে না।

আমি মাথা নীচু করে দাঁড়ালাম।

ও আদৌ সিডিটা বাজারে ছেড়েছে কিনা কি করে জানব।

সব জেনে নেব।

কবিতা চা নিয়ে এলো।

খাটের ওপর রাখলো।

কবিতা দাদাদের একটু ডাক।

কবিতা নিচে চলে গেল।

একটু পরে দাদা, মল্লিকদা, নিরঞ্জনদা, সামন্ত ডাক্তার এলো।

দাদা ঘরে ঢোকা মাত্র দামিনীমাসি দাদার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো। সামন্ত ডাক্তারকে প্রণাম করলো। নিরঞ্জনদা, মল্লিকদার দিকে তাকিয়ে হাতজোড় করে নমস্কার করলো।

আপনারা আমার থেকে ছোটো, তাই প্রণাম করলাম না।

ঠিক আছে, ঠিক আছে।

ডাক্তারবাবু আপনি আমাকে চিনতে পারলেন না।

আপনার গল্প নিচে শুনলাম। আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি।

আপনি আমার ছেলেকে সুস্থ করে তুলছেন।

কে? ভজুর কথা বলছেন।

হ্যাঁ।

বড়ো ভলোছেলে।

হ্যাঁ। তাছাড়া আমি বহুবার আপনার শ্যামবাজারের চেম্বারে গেছি।

আমি দামিনীমাসির দিকে তাকালাম।

এ দামিনীমাসি আমার পরিচিত নয়। একেবারে অপরিচিত।

অনি তুই বাইরে যা।

আমি বাইরে বেরিয়ে এলাম। সন্দীপ দাঁড়িয়েছিল।

হিমাংশু কোথায়?

ম্যাডামকে এগিয়ে দিতে গেছে।

সিগারেট আছে?

আছে।

একটা দিবি?

চল ওই দিকটায় যাই।

বউকে ফোন করেছিলি?

করেছিলাম।

সব কথা বলার দরকার নেই।

কিছু কিছু বলেছি তাতেই রেগে টং। পারলে এখুনি এসে গলা টিপে দেয়।

ছেলে দুটোকে কোথায় পাঠিয়েছিস?

তোর কথা মতো কাজে পাঠিয়ে দিয়েছি।

অফিস সামলাচ্ছে কারা।

লোক আছে। তোকে চিন্তা করতে হবে না।

সিগারেট ধরালাম।

ওই ঘর থেকে হাসাহাসির শব্দ ভেসে আসছে।

বুঝলাম দামিনীমাসি এরই মধ্যে বেশ জমিয়ে নিয়েছে। কবিতা সিঁড়ি দিয়ে উঠে ওই ঘরে চলে গেল। আবার কিছুক্ষণ পরে বেরিয়ে এলো। রতন গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ডাক্তারকে কোন গাড়িতে রেখেছে বুঝতে পারলাম না। সব গাড়িরই কাঁচ তোলা। এসি চলছে। রতন কাকে যেন ফোন করছে।

তুই কয়েকদিন কাগজটা টেনে দিতে পারবি।

তুই নিশ্চিন্তে থাক। এখন কাগজের যা পরিস্থিতি যাকে যা বলবো তাই করবে।

কেন!

তোর সঙ্গে আমার রিলেশন।

ব্যাপারটা ভারি মজার, তাই না?

মজার মানে। সুনিতের মালগুলোও তোকে ধ্বসে।

আমি, দাদা, মল্লিকদা নিশ্চিন্তে যেতে পারি।

যা।

আমার একটু ব্রেক দরকার।

জানি। তুই বলে তবু টানছিস। অন্য কেউ হলে পটকে যেত।

টেনে যেতে হচ্ছে।

আমি বললে ভুল হবে। আমার সঙ্গে আরও অনেকে আছে। দামিনীমাসী তার মধ্যে প্রথম। জানিস এই দামিনীমাসিকে নিয়ে একটা গোটা উপন্যাস লিখে ফেলা যায়।

তোর মুখ থেকে ভদ্রমহিলার গল্প শুনেছি। আজ চাক্ষুষ দেখলাম।

কি বুঝলি?

তোর গল্পশুনে ওনার সম্বন্ধে একটা ছবি চোখের সামনে ধরা ছিল, আজ সেটা একেবারে মিললো না।

হাসলাম।

দাদা নিচে বলছিলেন ওনার সম্বন্ধে। শুনলাম।

ডাক্তার সামন্ত খুব ইমপ্রেসড হয়ে গেলেন, ওঁর কথা শুনতে শুনতে।

কি জানিস অনি আমরা বাইরে থেকে একটা মানুষকে খুব তাড়াতাড়ি বিচার করে ফেলি। কিন্তু যখন ভেতরে ঢুকি তখন সাগর মহাসাগর। এপার ওপার দেখা যায় না।

সন্দীপ সিগারেটে সুখ টান দিল।

ডাক্তারদাদাকে দেখেছিস?

দেখলাম। অতোবড়ো একজন ডাক্তার কি সিম্পিল।

এরা কোনওদিন আমাদের সমাজে দাম পেল না। আর গান্ডুটাকে দেখ।

সন্দীপ সিগারেটটা আঙুলের ডগা দিয়ে বাগানে ছুঁড়ে ফেলেদিল।

যতো ভাববি তত জালে জড়াবি। তার থেকে কাজ করে যাই, কপালে যা লেখা আছে তা হবে।

কপালের নাম গোপাল।

সন্দীপ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল।

অনিদা চা।

পেছন ফিরে দেখলাম কবিতা।

চায়ের কাপটা ওর হাত থেকে নিলাম।

মুচকি মুচকি হাসছে।

হাসছিস কেন?

তোমার হবে দাঁড়াও।

কেন!

ওখানে সবাই তোমাকে নিয়ে আলোচনা করছে।

হাসলাম।

আজ থেকে তোমার সমস্ত ব্যাপার মাসি দেখবে।

সাগির, অবতারের খবর কিরে?

তুমি বললেও ওরা বাঁচবে না। দামিনীমাসিকে আমার থেকে তুমি ভালো করে চেন।

খুব খারাপ লাগছে।

তুমি ভালো মানুষ তাই।
হাসলাম।

কবিতা চলে গেল।

সন্দীপ আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

কি পরিষ্কার ভাবে বলেদিল মাইরি।

ওরা পথের কাঁটাকে কখনও পথে ফেলে রাখে না। বিশ্বাসঘাতককে প্রশ্রয় দেয় না।

ওর কথার সারমর্ম তাই বলে।

আমার ঘর থেকে সবাই হাসতে হাসতে বেরলো। আমি দাদাদের দিকে তাকালাম।

এদিকে আয়। দামিনীমাসি ডাকল।

আমি এগিয়ে গেলাম। দাদারা কথা বলতে বলতে পাশ দিয়ে চলে গেল। মল্লিকদা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।

সকাল থেকে কিছু খাসনি। দামিনীমাসি বললো।

কেউই খাইনি।

স্নানকরে খেয়ে নে। দাদারা এখন চলে যাক। তুই কাল সকালে যাবি। আমি সন্ধ্যের সময় একবার আসবো। বাড়িতে থাকবি।

মাথা নীচু করে রইলাম।

দাদারা তোর সম্বন্ধে সব বেলেছে। অনেক অজানা কথা শুনলাম। আমাকে আগে বললে তোকে এতো কষ্ট পেতে হতো না।

রতন সিঁড়ি দিয়ে বারান্দায় উঠে এলো।

ইসলামের ব্যাগটা এই ঘরে রেখে যা। দাদারা যাবার সময় নিয়ে যাবেন। গলার টিউনটা সঙ্গে সঙ্গে চেঞ্জ হয়ে গেল।

রতন ছুটে নিচে নেমে গেল।

ইসলামভাইকে ফোন করেছো?

হ্যাঁ। তোর বউয়ের সঙ্গে কথা হলো। তুই তো দেখালি না।

মাথা নীচু করে রইলাম।

অনেক কাজ, এখন যাই। রাতে এসে গল্প করবো।

আমি দামিনীমাসির সঙ্গেই নিচে নেমে এলাম। গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম। একে একে ওরা সবাই চলে গেল। ডাক্তারকে কোনও গাড়িতেই দেখতে পেলাম না।

ফিরে এলাম।

দাদা নিচের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। সন্দীপ সব গুছিয়ে নিয়ে নেমে এলো। স্ক্যানার প্রিন্টার তোর মেসিনের সঙ্গে লাগান রয়েছে। কাগজ পত্র সব ছোটোমার ঘরে। পারলে রাতে আসছি।

আয়। দ্বীপায়ন অফিসে গেছে না বাড়িতে গেছে।

বাড়ি হয়ে অফিসে যাবে। ও আগে গিয়ে সামলাবে তারপর আমি যাব।

সন্দীপ চলে গেল। বুঝলাম দাদার সঙ্গে কথা হয়েগেছে। আশে পাশে সামন্ত ডাক্তারকে দেখতে পেলাম না।

যা তাড়াতাড়ি স্নান সেরে নে একসঙ্গে খাব। অনেকটা পথ যেতে হবে।

আমি সিঁড়ি দিয়ে ওপরে চলে এলাম।

এতক্ষণ একটা ঝড় বয়ে গেল।

নিজের ঘরটা একটু গোছালাম। চাদরটা দুমড়ে মুচড়ে একাকার। শরীর আর বইছে না। কেমন যেন লাগছে। ঠিক ক্লান্তি নয় একটা ল্যাথার্জি।

ইস, আজকে বেমক্কা কতকগুলো গালাগাল দিয়ে ফেললাম। কিছুতেই চেক করতে পারলাম না। কেন যে দিলাম। না দিলেই পারতাম। কেনই বা গায়ে হাত তুলতে গেলাম। যতোই হোক উনি আমার থেকে সিনিয়ার। রেজিস্ট্রার ম্যাডামই বা কি ভাবলেন। আমি মস্তান। দাদাগিরি করে জোড় করে ছিনিয়ে নিই। মুখে যদিও উনি অন্য কথা বলেছেন।

দাদার ডাকে নিচে নেমে এলাম।

সবাই একসঙ্গে খেতে বসলাম ডাক্তারদাও আজ আমাদের সঙ্গে একই টেবিলে বসলেন। দাদা বেশ হাসি মস্করা করলো আমার সঙ্গে। আমি আজ প্রাণখুলে ওদের এই আড্ডায় যোগ দিতে পারলাম না। মাঝে মাঝে দামিনীমাসির কথা উঠে আসছে।

তুই তো ঢোকার সময় দেখিসনি। যেন রাজরাণী। দাদা বললো।

গট গট করে ওপরে উঠে এলো। রতনকে দিলো এক ধমক। রতন ওনাকে দেখেই নেতিয়ে পরেছিল। ধমক খাওয়ার পর সে কি অবস্থা। যেন অজ্ঞান হয়ে যায়।

অনিকে খুব ভালোবাসে। নিরঞ্জনদা বললো।

ভালোবাসে মানে। গাঢ়ল। শুনলিনা কি বললো, আমার ছেলের গায়ে হাত পরলে বেঁচে থাকা মুস্কিল।

ইসলাম মনে হয় ওনাকে খুব ভয়পায়। মল্লিকদা বললো।

ফোন করলো যখন ইসলাম কিরকম ত ত করছিল। কি দাপট বলতো।

আমি চুপচাপ। একটা কথারও উত্তর দিচ্ছি না। চুপচাপ খেয়ে উঠে চলে এলাম। সোজা আমার সেই প্রিয় জায়গা জানলাটার সামনে এসে দাঁড়ালাম।

বুকের মধ্যে কে যেন পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে। মনটা ভীষণ খারাপ লাগছে। নিজের থেকেও বেশি খারাপ লাগছে মিত্রার জন্য। নিশ্চই রতন ওদের সব শুনিয়েছে। কি ভাবলো। ওর অনেক অজানা কথা সবাই আজ জানতে পেরে গেল।

ভাবছে হয়তো বুবুন কেন এসব কথা বলতে গেল। নিজের মাথার তখন ঠিক ছিল না। না বললেই পারতাম। সেই সময় মনে হচ্ছিল যেন ওকে ছিঁড়ে খেয়ে নিই।

কিরে ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি করছিস?

পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম দাদা গেটের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। কাপড় জামা পরে রেডি।

এমনি দাঁড়িয়ে আছি।

আমাদের সঙ্গে যাবি?

না। তোমরা যাও।

কেন, চল না। সন্দীপ ঠিক গুছিয়ে নেবে বলেছে।

আমি কাল সকালে যাব। তোমরা এখন বেরচ্ছ।

হ্যাঁ।

আমি এগিয়ে এলাম।

মন খারাপ করছিস কেন।

আমি দাদার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম।

গাড়ি এসে গেছে।

হ্যাঁ। নিরঞ্জনের গাড়িতে যাচ্ছি।

ইসলামভাইয়ের ব্যাগটা নিয়ে পায়ে পায়ে দাদার সঙ্গে নিচে নেমে এলাম। দেখলাম সামন্ত ডাক্তার গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে।

আমাকে দেখে একগাল হেসে বললো, তোমার গ্রামটা একটু ঘুরে আসি। এডিটার অনুরোধ করলো, না বলতে পারলাম না।

মুখ নীচু করে হাসলাম।

মল্লিকদা পিঠ চাপরে বললো, তোকে শুকনো শুকনো দেখলে মনটা ভালো লাগে না।

না ঠিক হয়ে গেছি।

কাল কখন যাবি?

সকালে বেরবো।

অফিসে যাবি নাকি?

না। সন্দীপকে বলেছি সামলে নে। প্রয়োজন হলে ফোন করিস।

আচ্ছা।

আমি সকলকে প্রণাম করলাম।

নিরঞ্জনদা বললো, একবারে রেস্ট্রি অফিসে যাবি, না বাড়ি হয়ে রেস্ট্রি অফিসে যাবি?

বেরবার সময় ফোন করবো।

আচ্ছা।

ইসলামভাইয়ের ব্যাগটা গাড়িতে তুলে দিলাম।

ব্যাঙ্কের কাজটা একবারে সেরে নেবে।

ঠিক আছে।

ওরা বেরিয়ে গেল।

এ বাড়িতে আমি এখন একা। ছগনলাল গেট বন্ধ করে নিজের ঘরে চলে গেল। আমি নিচের ঘর বন্ধ করে ওপরে উঠে এলাম। ছোটোমার ঘরে ঢুকলাম। সব কাগজ-পত্র আস্তে আস্তে গুছিয়ে নিজের ঘরে নিয়ে এলাম।

ছবির খাম থেকে মিত্রার অর্ধউলঙ্গ ছবিগুলো আলাদা করে সরিয়ে রেখেছিলাম।

সেই খামটা বার করলাম। অন্যান্য ডকুমেন্টস আলমাড়ি খুলে ঢুকিয়ে রাখলাম। ল্যাপটপটা খাটের ওপর নিয়ে বসলাম।

খাম থেকে মিত্রার ছবিগুলো বারকরলাম। মনটা খারাপ হয়ে গেল। কলেজ লাইফে এই মেয়েটা কতো ইনোসেন্ট ছিল। আর কি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এই মেয়েটা এই কাজ করতে বাধ্য হয়েছিল। ছবিগুলো দেখতে দেখতে মাথাটা গরম হয়ে গেল। মিত্রার চোখ মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে অনিচ্ছা সত্ত্বেও এসব করতে বাধ্য হয়েছিল। মানুষ কতটা নীচে নামলে নিজের বউকে এই কাজ করাতে বাধ্য করতে পারে।

আমার মিত্রার মার কথাটা বার বার মনে পড়ছে।

ভদ্রমহিলা কি একবারেই বুঝতে পারেন নি? ভদ্রলোক এইরকম নোংরা চরিত্রের। না নিজের পরিচিত বলে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করেছিলেন? না মেয়ের প্রতি জেলাস?

অনেক মাকে দেখেছি মেয়ের প্রতি ঈর্ষান্বিত হতে। মেয়ের ভাল মন্দ তিনি সহ্য করতে পারেন না। মিত্রা স্বভাবে একটু নরম প্রকৃতির ছিল। কলেজ লাইফে ওর সঙ্গে মিশে যতটুকু বুঝেছিলাম।

আচ্ছা ওর বাবাই বা কিরকম? তিনি কি মেয়ের ভালো মন্দ বুঝতে পারেননি? মিত্রা বলেছিল ওর বাবা ওকে ভীষন ভালোবাসতেন। তাহলে উনিই বা কেন মেনে নিলেন?

তাহলে কি মিত্রার মা সেইরকম ভদ্রমহিলা ছিলেন! যে কারণে মিত্রার বাবা তাকে ভয় পেতেন? না মিত্রার বাবার কোনও দুর্বলতা ছিল? বাবার প্রতি ওর মা রিভেঞ্জনিতে না পেরে তার মেয়ের প্রতি নিলেন?

ছবি গুলো দেখতে দেখতে চোখ জলে ভরে গেল।

মিত্রা, বড়োমা-ছোটোমার সামনে আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, তুই বড়োমা, ছোটোমাকে বেরিয়ে যেতে বল। আমি বড়োমা, ছোটোমাকে সব বলিনি।

তাহলে এই কথাই কি মিত্রা বড়োমা, ছোটোমার কাছে গোপন করেছিল? করতেই পারে। আমি হলেও করতাম। মিত্রা কোনও অন্যায় করেনি।

আচ্ছা আমি এইসব নিয়ে এতো ভাবছি কেন?

আমার মনের মধ্যে কি মিত্রার প্রতি কোনও সন্দেহ জাগছে?

মিত্রা আমাকে বার বার বলেছে, তোর কাছে আমি কনফেস করবো। তারপর আবার বলেছে তুই নিজেই সব জানতে পেড়ে যাবি। আমাকে বলতে হবেনা। নিজের মুখেই টোডির কথা বলেছে। তাহলে এই ব্যক্তিই কি টোডি!

আমাকে খোঁজ খবর নিতে হবে। দামিনীমাসি কি করে আগে দেখি। তারপর আমাকে খুঁজে বার করতে হবে। ইসলামভাইকে জানান যাবে না।

নিজেই নিজেকে মটিভেট করলাম। আগামী একমাসের মধ্যে এই কাজটা আমাকে শেষ করতে হবে। আমি কিছুটা কাজ এগিয়েছি। এখনও অনেক বাকি। মিত্রার কাছ থেকে আগে জানতে হবে এই ব্যক্তিই সেই টোডি কিনা। যদি হয় তাহলে এর কপালে অনেক দুঃখ আছে। মল এবং ডাক্তারের থেকেও সেটা হবে ভয়ংকর।

ছোটোবাবু।

নিচ থেকে ছগনলালের গলা পেলাম। ছবিগুলো খামের মধ্যে ঝটপট ঢুকিয়ে আমার আলমাড়ির একবারে নিচের খোপে ঢুকিয়ে দিলাম। বাইরের বারান্দায় এসে মুখ বারালাম। দেখলাম গেটে কবিতা দাঁড়িয়ে আছে। আমি ছগনলালাকে বললাম খুলে দাও। ছগনলাল গিয়ে গেট খুলে দিল। কবিতা গাড়ি নিয়ে ভতরে এলো।

একলাই নামলো। হাতে একটা খাম। এখান থেকে বুঝতে পারলাম না ভেতরে কেউ আছে কিনা। ছগনলাল গেট বন্ধ করলো। কবিতা আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো।

ওপরে আয়।

কবিতা ওপরে উঠে এলো।

আমি নিজের ঘরে এসে খাটে বসলাম।

ল্যাপটপটা খুললাম।

কবিতা ঘরে ঢুকলো।

মাসি এই খামটা তোমায় দিল।

হাতে নিয়ে বুঝলাম এতে একটা সিডি আছে। ওর দিকে তাকালাম, ভাবলেশহীন মুখ।

কোথায় গেছিলি?

ডাক্তারের বাড়ি। কি হারামী গো লোকটা।

কেন!

শালার বিএফের ব্যবসা। ওতেই শালা কোটি কোটি টাকা বানিয়েছে।

কি করে জানলি?

মাসি ওর বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রতনকে দিয়ে উদম কেলালো। সব গড় গড় করে বলে দিল। তারপর মাসি ওকে নিয়ে একটা ঘরে গেল। অনেকক্ষণ ছিল।

ডাক্তার এখন কোথায়?

ওর বাড়িতে নজর বন্দি।

মাসি।

মাসির জায়গায়। ফেরার পথে আমাকে এটা দিয়ে বললো। অনিকে দিয়ে আয়। সব বলা আছে। আমাকে একবার ফোন করতে বলবি।

তুই চলে যাবি?

হ্যাঁ। আমাকে অনেক কাজ দিয়েছে। করতে হবে।

বলা যাবে না।

শুনতে হবে না। তোমার কাজ তুমি করো। এসব নোংরা কাজ তোমার জন্য নয়।

আমার জন্য তোদের কতো ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে।

একবারে ওসব কথা বলবে না। মাসির কানে গেলে বুঝতে পারছো কি বলবে।

ঠিক আছে তুই যা।

কবিতা চলে গেল। ছগনলাল গেট বন্ধ করলো। আমি আবার নিজের জায়গায় এসে বসলাম।

খাম খুলে সিডিটা বার করলাম। ল্যাপটপে চালালাম। সত্যিই মিত্রাকে নিয়ে তোলা ছবি। ভালো করে পঙ্খানুপুঙ্খ রূপে দেখলাম। ঠিক ব্লু-ফ্লিম নয়। এককথায় বলা যায় রেপ সিন। মিত্রাকে সম্পূর্ণ নগ্ন করতে পারেনি। নব্বইভাগ নগ্ন করেছে। ধস্তা ধস্তি হয়েছে। তারপর মিত্রা লোকটার বুকে একটা লাথি মেরেছে।

একটা মেয়ে এই মুহূর্তে বাঁচার জন্য যা যা করার দরকার তাই করেছে। খুব চেঁচামিচির শব্দ। খেস্তা খিস্তি। বোঝা যাচ্ছে। ঘরের মধ্যে ফিট করা গোপন ক্যামেরায় ছবি তোলা হয়েছে। বোঝা যাচ্ছে এটা ডাক্তারের চাল। এ ছবি বাজারে বিক্রি হবে না। এটা তোলা হয়েছে মিত্রাকে নিঃশেষ করে দেবার জন্য।

এই কারণেই কি মিত্রা ডিভোর্সের পরও মাথায় সিঁদুর রাখতো। ডাক্তারের সঙ্গে নিত্য যোগাযোগ রাখতো। যখন বুঝেছে এখন ওর আশ্রয় হারানোর ভয় নেই তখন থেকে সিঁদুর মুছে দিয়েছে। নানা চিন্তা মাথার মধ্যে খেলা করছে। সবচেয়ে কষ্ট হচ্ছে মিত্রার জন্য। কুড়ি মিনিট ঊনিশ সেকেন্ডের সিডি।

আমি কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে বসে রইলাম।

নানা আজেবাজে চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।

মোবাইলের ঘরিটার দিকে তাকালাম। সাড়ে চারটে বাজে। তারমানে দাদারা এখন ওই ধাবার কাছাকাছি।

ঘরের দরজা বন্ধ করে নিচে নামতে গেলাম। দেখলাম ছগনলাল চায়ের কাপ নিয়ে সিঁড়িদিয়ে উঠে আসছে।

তুমি চা করতে গেলে কেন?

আরি বাবা। বড়াবাবুর হুকুম।

আমি ছগনলালের হাত থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে নিলাম। ছগনলাল নিচে নেমে গেল। আমি আবার ঘরে এলাম। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে দামিনীমাসিকে ফোন করলাম।

হ্যালো। একটা মহিলা কন্ঠস্বর। গলা শুনে মনে হচ্চে না মাসি।

মাসি।

কে বলছেন?

অনি।

অনিদা তুমি! আমি লক্ষী।

মাসি কোথায়রে?

একটু বেরিয়েছে।

ঠিক আছে আমি পরে ফোন করছি।

তুমি কেমন আছো অনিদা?

ভালো আছি।

কতদিন আসোনি?

যাব।

কবে আসবে?

একটু কাজ গুলো সেরে নিয়ে যাব।

আচ্ছা।

উঠে গিয়ে টেবিলের ওপর থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা নিয়ে এলাম। একটা সিগারেট ধরালাম। মিত্রার নম্বরে একটা ম্যাসেজ করলাম।

একটু দূরে কোথাও পালিয়ে যা কথা বলবো।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এলো।

আমি, নীপা বাসুর দোকানে যাচ্ছি। অপেক্ষা কর, সুযোগ বুঝে ফোন করবো।

ভাবলাম দেবাশিসকে একবার ফোন করি। তারপর কি ভেবে মনে হলো না দেবাশিসকে নয় টিনাকে একটা ফোন করি। করলাম।

কিগো ভুল করে ফোন করে ফেললে?

আমি চুপ থাকলাম।

কথা বলবে না?

না টিনা, খুব বাজে অবস্থার মধ্যে আছি।

তোমার গলাটা এরকম ধরা ধরা লাগছে কেন! টিনার গলায় উৎকন্ঠা।

ফোনের ভয়েজটা সমস্যা করছে হয়তো।

তুমি কোথায়!

বাড়িতে।

বাড়িতে! এই সময়!

একটু কাজ করছি।

ওখান থেকে কবে এলে?

গতকাল।

অফিসে যাওনি?

না।

বাড়িতে আর কে আছে?

কেউ নেই। আমি একা।

সামথিংস হ্যাপেন?

না। এমনি।

তুমি কি এখন বাড়িতেই থাকবে?

হ্যাঁ।

ঠিক আছে তুমি রাখো। পরে তোমায় ফোন করছি।

আচ্ছা।

সিগারেটের প্যাকেট থেকে আবার একটা সিগারেট বার করে নিয়ে ধরালাম। নেটটা খুললাম।

আমার মেল বক্স খুললাম। তনু মেল পাঠিয়েছে। এ্যাটাচমেন্টে প্রচুর ডকুমেন্টস। আমি খুললাম।

দেখে যেটুকু উদ্ধার করতে পারলাম। তাতে বুঝলাম। ডাক্তার ওখানে খুব ঘৃণ্য কাজ করতে গিয়ে তার ডিগ্রীটা খুইয়েছে। তারই ডকুমেন্টস তনু পাঠিয়েছে। আমি আলাদা ফোল্ডার করে ধীরে ধীরে সব ডাউনলোড করতে আরম্ভ করলাম। ফোনটা বেজে উঠলো। দেখলাম দামিনীমাসির ফোন।

হ্যালো বলতেই দামিনীমাসি বললো, দেখেছিস?

হ্যাঁ।

কি দেখলি?

ওরই।

ঠিক বলছিস?

হ্যাঁ। বিশ্বাস হচ্ছে না?

কতো বরো খানকির ছেলে হতে পারে সেটা ভাবছি।

সাধে কি অনি কেঁদে ফেলেছিল।

তুই বিশ্বাস কর….। দামিনীমাসির গলা বুঁজে এলো।

কিগো কথা বলছোনা কেন?

ও আমার ছেলের বউকে….।

কেঁদোনা মাসি। ওর ভাগ্যে যা লেখা ছিল তাই হয়েছে। কেন তোমাকে সব কথা বলতে পারিনি এবার বুঝতে পারছো।

ওই লোকটাকে দেখাতে পারবি?

ছবিতে দেখাতে পারবো। সিডিতেও রয়েছে। তুমি দেখতে চাইলে আমার আপত্তি নেই।

দামিনীমাসি কোনও কথা বলছে না।

মনে হয় ইসলামভাই চেনে। ইসলামভাই এই সব ঘটনার সাক্ষী। যেহেতু তখন ও জানতো না আমার সঙ্গে মিত্রার একটা সম্পর্ক আছে, তাই ও সেই ভাবে বাধা দেয়নি। তবে ইসলামভাই আমার কাছে সব স্বীকার করেছে। ওরা আরও কিছু হয়তো করতে পারতো ইসলামভাইয়ের জন্য করতে পারেনি।

এই মিত্রাই কি সেই মিত্রা যার কথা তুই আমায় বলেছিলি।

হ্যাঁ। ডাক্তার এখন কোথায়?

ওর বাড়িতেই রেখেছি। আবিদকে রেখে দিয়েছি।

ইসলামভাই খুব কষ্ট পাচ্ছে।

জানি। ওকে বার বার বারন করেছি, এই সব কাজ হাতে নিবি না।

ইসলামভাইয়ের কোনও অপরাধ নেই। যদি বলো তুলনায় আমি বেশি অপরাধ করেছি।

কেন!

মিত্রা আমাকে অনেক দিন আগে ওর বাড়িতে যেতে বলেছিল। আমি অভিমান করে ওর বাড়িতে যাই নি।

মাসি চুপ করে রইলো।

একটা মেয়ের কতটুকু ক্ষমতা তুমি জানো।

কি চিন্তা করলি?

ওকে মারবো না। ও নিজে আত্মহত্যা করবে।

পারবি?

অনি মুখে যা বলে তাই করে দেখায়। এর প্রমাণ তুমি আগে পেয়েছো।

ওই লোকটা?

ওটা আমাকে জোগাড় করতে হবে। তবে আমার মন বলছে ইসলামভাই এতক্ষণে কাজ শুরু করে দিয়েছে।

তুই ঠিক বলছিস?

ওই যে তখন বললো, আমার জন্য একটু রেখো। ওর প্রশ্নের মধ্যেই উত্তর লুকিয়ে আছে।

তুই এতো ভাবিস!

ভাবি বলেই কষ্ট পাই মাসি। আমার কথা শোনার যে কেউ নেই।

বুঝতে পারলাম মাসি কাঁদছে।

আবার কাঁদে। তোমার কাছে আঠারো মাস থাকার অভিজ্ঞতা এখন কাজে লাগাচ্ছি।

চুপচাপ।

কথা বলছোনা কেন?

অনিদা মাসি আমার হাতে ফোনটা দিয়ে চলে গেল।

কেরে, লক্ষী?

হ্যাঁ।

ঠিক আছে এখন রাখ।

ফনটা কেটে দিলাম।

মনটা খারাপ হয়ে গেল।

কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম। বাইরের আলো কমে এসেছে। ঘরটা সামান্য অন্ধকার।

দাদারা আমায় এখনও ফোন করেনি। আমিও ফোন করিনি। ল্যাপটপটা খোলা রয়েছে। ভীষণ চা খেতে ইচ্ছে করছে। নিচে গিয়ে করতে ভালো লাগছে না। সিগারেটের প্যাকেট থেক একটা সিগারেট বার করে ধরালাম।

টান টান হয়ে শুলাম। জানলার ফাঁক দিয়ে কমলা রংয়ের সূর্য আমার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। এখন এই সূর্যের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায়। অসুবিধে হয় না। মাথার ভেতরটা কেমন শূন্য শূন্য মনে হচ্ছে। হিমাংশুকে সকাল থেকে ফোন করা হয়নি। ছেলেটা কি ভাবছে।

মোবাইলটা টেনে নিয়ে হিমাংশুকে ফোন করলাম।

কোথায়রে, বাড়িতে না অফিসে?

বাড়িতে।

কি করছিস?

শুয়ে আছি।

একটু ঘুমবার চেষ্টা কর।

ঘুম আসছে না।

শোন মিত্রার চেকগুলো আজই ব্যাঙ্কে ফেলে দিয়েছি।

ভালো করেছিস। আগামী সপ্তাহে বোঝা যাবে ওর ব্যাঙ্কের পজিশন।

মালটা এখন কোথায়?

দামিনীমাসির হেপাজতে চলে গেছে। ওর বাড়িতে আছে। তবে গৃহবন্দি।

সত্যি এই কদিনে কতো রকমের মানুষ দেখলাম। এরকম হার হারামী দেখিনি।

তুই কি দেখেছিস। দামিনীমাসি তার সারাজীবনে অন্ততঃ লাখ খানেক মানুষকে তার শরীরে আশ্রয় দিয়েছে, মাসি পর্যন্ত কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেললো।

খুব খারাপ লাগছে।

খারাপ সবার লাগছে। করার কি আছে। মেনে নিয়ে মানিয়ে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।

শোন, আমি সনাতনবাবুর সঙ্গে আজ কথা বলে এসেছি। আগামী সপ্তাহ থেকে দুটো ছেলে তোর অফিসে গিয়ে বসবে।

বেশ করেছিস। তুই প্রেসার কনটিনিউ কর। আমি সামলে নেব।

আচ্ছা। এখন একটু ঘুমবার চেষ্টা কর।

দেখি।

হিমাংশু ফোনটা কেটে দিল।

উঠে বসলাম, ল্যাপটপটা নিয়ে তনুকে একটা মেল করলাম। ওকে ভাসা ভাসা সব জানালাম। এও বললাম, আমি কয়েকদিন কলকাতায় থাকবো না। তোমার মেল চেক করতে পারবো না। তোমার কিছু মেল করার থাকলে করবে। আমি সময় মতো খুলে দেখে নেব।

ফোনটা বেজে উঠলো। দেখলাম মিত্রার ফোন।

উঠে বসে ধরলাম। বাইরে অন্ধকার হয়ে এসেছে। ঘরের লাইট জ্বাললাম। বারান্দায় এসে ছগনলালকে দেখতে পেলাম ওর দেশোয়ালী ভাইদের সঙ্গে বসে গল্প করছে। আমায় দেখে ফিরে তাকাল ইশারায় বললাম একটু চা খাওয়াবে। ও হেসে ফেললো।

কোথায় তুই?

বাসুর বাড়িতে।

কে নিয়ে এলো?

বাসু এগিয়ে দিয়ে গেল।

খবর কি?

কোনখান দিয়ে শুরু করি বল তো।

কথা শুনে মনে হচ্ছে মিত্রা বেশ খুশিতে আছে। ওর কোনও টেনসন নেই।

তোর থেকে শুরু কর।

তুই কোথায়?

বাড়িতে।

একা।

হ্যাঁ।

আমার জন্য খুব কষ্ট পেলি আজকে।

তা একটু পেয়েছি।

তার সঙ্গে আমাকে যে পেলি।

তোকে তো আগেই পাওয়া হয়ে গেছে।

সেটা সম্পূর্ণ ছিল না। আজকে সম্পূর্ণ হলো। আজকে আমার থেকে সুখী এ পৃথিবীতে কেউ নেই।

একথা বলছিস কেন?

তুই আজকে ওই বাস্টার্ডটাকে মেরে রক্ত বার করে দিয়েছিস। তুই যদি মেরে ফেলতিস আমি আরও আনন্দ পেতাম।

ভাবলাম কতটা জ্বালা এতদিন ও বুকে নিয়ে ঘুরেছে। কেউ ওর পাশে ছিল না যে ওর কথা শুনে ওকে একটু সাহায্য করবে। যা কিছু করেছে নিজের বুদ্ধিতে।

হাতাশা গ্রস্ত হয়ে রাতের বেলা আকণ্ঠ মদ গিলেছে। তারপর নিজের প্রতি ঘেন্নায় গা ভাসিয়ে দিয়েছে। যা হয় হোক। শেষ পরিণতি কি আছে মৃত্যু। এর বেশি কিছু নয়।

কিরে চুপ করে গেলি?

এমনি।

আজ এখানে কি হয়েছে জানিস।

কি!

চিকনা বললো।

কি বললো।

তুই নাকি ক্লাসটেনে পড়ার সময় ওকে একবার বেধড়ক মেরেছিলি। তারপর কাউকে এইরকম মারলি। তুই যে রেগে যেতে পারিস। তুই যে কাঁচা কাঁচা গালাগাল দিতে পারিস এটা ওরা প্রথম জানলো।

তুই?

কলেজে তোর মুখ থেকে দু-একটা শুনতাম। তারপর তো আমি হারিয়ে গেলাম।

তোরা সব শুনেছিস?

তোর ঘরে মাল ফিট করা ছিল। তুই ধরতে পারিসনি?

তখন আমার মনের অবস্থা সেরকম ছিল না।

সেই সময় ইসলামভাইকে দেখলে তোর মাথা খারাপ হয়ে যেত।

কেন!

হাতগুলো কেমন করছিল কেমন এ্যাবনরমাল ভাব। চোখগুলো কেমন ঘোলাটে। তারপর তুই যখন মারলি হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললো। আমি, ছোটমা কতো বোঝালোম। কান্না থামান যায় না। পরে রতনকে যা বললো না। আমার শুনে আত্মারাম খাঁচা।

বড়োমারা কেউ ছিল না?

না।

ইসলামভাই আজ আমাকে নিয়ে আড়ালে আড়ালে ঘুরেছে। আমাকে প্রশ্ন করেছে আমি উত্তর দিয়েছি। আর ফোন করে করে শুধু মিলিয়ে নিয়েছে।

কোথায় ফোন করছিল?

বম্বেতে। ইসলামভাই কি দারুন উর্দু বলেরে। আমি কিছু বুঝতে পারিনি।

তোর কি মনে হয় কোথায় ফোন করছিল?

আমার কাছে টোডির ব্যাপারে জানতে চেয়েছে। আমি যতটা জানতাম বলে দিয়েছি। তারপর দামিনীমাসি ফোন করেছিল।

তোর সঙ্গে কথা বলেছে।

হ্যাঁ। ইসলামভাই বললো, আমার সঙ্গে আছে। কথা বলবে। কথা বললাম। তুই তো নিয়েগেলি না। দামিনীমাসি বলেছে, আমাকে নিয়ে যাবে।

তাই!

ওরে দামিনীমাসি, ইসলামভাই দু-জনেই বড় খেলোয়াড়।

আজ বুঝলি।

বুঝলাম।

বড়োমা, ছোটোমা।

নো টেনসন ডু ফুর্তি। ওরা এসব ঘটনা জানেই না। তুই একা একা, মনটা খারাপ লাগছে।

তোরা সবাই ঠিক আছিস।

তোকে একবারে ভাবতে হবে না। নীপা আসছে এখন রাখি। রাতে কথা বলবো। জেগে থাকবি।

আচ্ছা।

মিত্রার সঙ্গে কথা বলার পর মনটা একটু হাল্কা হলো বলে মনে হচ্ছে। ভাবছিলাম ওকে একবার জিজ্ঞাসা করি ভিডিওটার সম্বন্ধে। তারপরে ভাবলাম না থাক। ওর কাছে যখন যাব তখন ওকে জিজ্ঞাসা করবো। ওর মুখ থেকে ব্যাপারটা শোনার দরকার আছে।

চলবে —————————



from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/wfyWqPm
via BanglaChoti

Comments