কাজলদীঘি
BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়
ত্রয়বিংশ কিস্তি
—————————
নীপা ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকলো কিগো চলো, আমি সব রেডি করে এসেছি। তারপর ঘরের চারিদিক দেখে নিয়ে বড়োমার দিকে তাকিয়ে বললো, বড়োমা তুমি এরকম ভাবে বসে আছো কেন, অনিদার শরীর খারাপ লাগছে।
নীপা ঘরের চারদিক চেয়ে চেয়ে দেখছে। দাঁড়াও অনাদিদাকে ডাকি।
এই মেয়েটাকে নিয়ে বরো সমস্যা। দাঁড়া না মা। বড়োমা বললো।
যাও তোমরা স্নান করে নাও। আবার বিকেল বেলা যাবে বললে। আমি বললাম।
বড়োমা আমাকে বুকে টেনে নিল।
বড়োমার ওপর রাগ করিস কেন, বড়োমা না জেনে তোকে জিজ্ঞাসা করে ফেলেছিল।
ঠিক আছে তারাতারি করো। মুন্নাভাই তুমি পুকুরে না বাথরুমে।
পুকুরে।
তাহলে চলে যাও স্নান সেরে ফেলো।
আমি তুই এক সঙ্গে যাব।
নীপা, অনাদিদের একটু ডেকে দাও। মুন্নাভাইয়ের থাকার জায়গা কোথায় করেছো?
ও বাড়িতে।
ভজু।
সব ও বাড়িতে। এ বাড়িতে শুধু তুমি।
আচ্ছা।
তাহলে মুন্নাভাইয়ের কাপর-জামার জায়গাটা নিয়ে গিয়ে গুছিয়ে দাও।
ঠিক আছে।
ওরা সবাই চলে গেল।
ইসলামভাই আমার দিকে তাকাল।
একটা কথা বলবো?
বল।
ভীষণ সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে।
তুই তো খাস না!
খাইনা এখন খেতে ইচ্ছে করছে।
ইসলামভাই ব্যাগ থেকে একটা ৫৫৫-এর কার্টুন বার করে হাতে দিয়ে বললো, একটা প্যাকেট তোর কাছে রাখ আর একটা প্যাকেট আমায় দে।
কোমড়ে হাত দিয়ে আমার দিকে তাকাল।
এই ফাঁকে মেশিনটা আলমাড়িতে ঢুকিয়ে রাখ।
ইসলামভাই কোমর থেকে পিস্তল বার করে আমার হাতে দিল। আলমাড়িতে ঢুকিয়ে রাখলাম, এই প্যাকেটটা রাখ, দানা আছে।
আমি আলমাড়িতে ঢুকিয়ে রেখে চাবি দিলাম।
এখানে এসব কাজে লাগবে না।
জায়গাটা দেখার পর তাই মনে হচ্ছে।
অনাদিরা সবাই এলো। ওরা মুন্নাভাইকে দেখেছে আলাপ হয়নি।
ওদের দিকে তাকিয়ে বললাম, কিরে খাওয়া দাওয়া করেছিস?
কালকে থেকে যা গেল। একবারে সব সেরে এলাম। বলে এসেছি এখন তোর বাড়িতেই গ্যারেজ। যদি প্রয়োজন হয় ডেকে নিতে।
চিকনাবাবু, খবর কি?
তুমি গুরু যা দিয়েছো একবারে পেট পযর্ন্ত। তারপরেই জিভ বার করলো।
মুন্নাভাইয়ের সঙ্গে তোদের পরিচয় হয়নি?
করালি কোথায়?
আমি ওদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম। ওরা সবাই মুন্নাভাইয়ের সঙ্গে হাত মেলালো।
একখান সিগারেট দে। চিকনা বললো।
আমি প্যাকেটটা এগিয়ে দিলাম।
গুরু বিদেশী ব্র্যান্ড। চিকনা নিজে একটা নিল। ওদের সবাইকে একটা দিল। আর একটা নিয়ে কানে গুঁজলো।
ওটা আবার কি করলি?
একখান আমার। একখান সঞ্জুর জন্য। তখন আবার চাইলে পাব কিনা। তাই।
সত্যি তো, সঞ্জু কইরে?
এসে পরবে। কালকে সারারাত দেবার বাড়িতে পাহাড়া দিয়েছে দলবল নিয়ে।
কেন!
যদি ফিরে আসে।
হাসলাম।
হাসিসনা। কাল যা টেনসন গেল না। অপনেন্ট পুরো ঢুকে পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত মালপত্রে টান পরে গেল। এদিকে অমূল্য বিট্রে করলো। কি যে অবস্থা। কি ভাবে সামাল দিয়েছি আমি জানি আর পাঁচু, পচা জানে। একলা লড়ে গেছে। একটা কথা বলবো, তোকে তো ফাঁকা পাওয়া যায় না।
বল।
মুন্নাভাইয়ে সামনে বলছি মুন্নাভাই কিছু মনে করবে না।
বলনা কিছু মনে করবে না।
পাঁচু, পচা আর হাঁড়ি পাড়ার হিরন এদিকটা দেখে। আমাদের অস্ত্রশস্ত্র ওদের কাছেই থাকে।
তোদের অস্ত্রশস্ত্র, মানে!
পার্টি করতে গেলে লাগে।
ইসলামভাই মুচকি মুচকি হাসছে।
ওরা মাঝে মাঝে খর বোঝাই করে হলোদিয়া হয়ে বাবুঘাট যায়। ওখান থেকে জোগাড় করে আনে।
এটা আগে বলিসনি?
এসব কথা তোকে বলা যায়।
তাহলে এখন বলছিস?
খোঁজ খবর নিয়ে জানলাম তুই আমাদের থেকে ক্ষমতাবান তাই বলছি।
তারপর। কি হয়েছে বল?
বাবুঘাটে আবিদ বলে একটা ছেলে আছে। ওই-ই এসব সাপ্লাই করে ওদের। এবার টাকা নিয়ে আর মাল দিচ্ছে না। খালি ঘোরাচ্ছে। মাস দেড়েক হয়ে গেল। পাঁচু খবর নিয়েছে ও নাকি ইসলামভাই-এর খাস লোক। তোর ইসলামভাইকে একটু বলনা।
খুব কঠিন কাজ।
আমি ইসলামভাই-এর মুখের দিকে তাকাচ্ছি। ইসলামভাই না পারছে হাঁসতে না পারছে কিছু বলতে। খুব গম্ভীর হয়ে রয়েছে। কিন্তু চোখে মুখে হাসির ছটা।
দেখ আমি এই ব্যাপারে ইসলামভাই-এর সাথে কোনও কথা বলতে পারবো না। আমি ইসলামভাই-এর কাছে নিউজ সংগ্রহের জন্য যাই। ও কি ভাববে বলতো।
তাও ঠিক। তুই একটা অবলিগেশনের মধ্যে পড়ে যাবি।
ঠিক আছে থাক, আমরা একটু ঘোরা ঘুরি করি। টাকাটা মনে হয় গিও।
তোরা কি আনতে দিয়েছিলি?
ওয়ান সার্টার চারটে।
ব্যাশ?
এই এখানে অনেক। জানতে পারলে কেউ ধারে কাছে ঘেঁসবে না।
বাবাঃ তোদের এবার ভয় করে চলতে হবে।
অনাদি এবারে অনি তোকে চাটতে শুরু করবে। চিকনা বললো।
চাটুক। ওকে বলবো নাতো কাকে বলবো।
ছেড়েদে। বাসু বললো।
ট্রলি ঠিক করে রেখেছিস?
কেনো দেখিস নি!
আমি খিড়কি দিয়ে ঢুকে ওপরে চলে এলাম।
দুটো রাখা রয়েছে। বড়োমা খামার থেকে ট্রলিতে উঠবে আর খামারে এসে নামবে। একটুও পায়ে হাঁটতে হবে না।
ইসলামভাই হেসে ফললো।
নীপা ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকলো।
কি হলো তোমরা এখনও বসে আছো, উঠবে না। অনাদিদা খাবে তো?
খেয়ে এসেছি।
বড়োমার কাছে গিয়ে রিপোর্ট করবে। খেয়ে এসেছো। আমি কিছু জানি না।
বাবা। তুই এ্যাসিসটেন্ট আছিস কি করতে। চিকনা বললো।
শোনো অনিদা, চিকনাদা তোমার ধানের ব্যবসা লাটে তুলে দেবে।
কেন!
সব ধান ইঁদুরে খেয়ে যাচ্ছে।
হিসাব তোর কাছে। টাকাও তোর কাছে। আমি শুধু জোগাড় করছি। অনিকে তুই হিসাব দিবি।
দেবো একখানা। নীপা থাপ্পর তুললো।
টাকা তুইও পাবি। তোকে এ্যাকাউন্টেট রেখেছি।
আমি পারব না যাও। আজই অনিদাকে হিসাব দিয়ে রিজাইন দিয়ে দেব।
পালাবি কোথায়?
সবাই হাসাহাসি করছে।
বুঝলে মুন্নাভই এরা ভাই-বোন, এদের কাছে নীপাকে রেখে আমার কোনও টেনসন নেই। নাহলে যা সব শেয়াল কুকুর আছে এই গ্রামে।
তোর প্ল্যানগুলো দারুন।
আচ্ছা আচ্ছা পরে গল্প হবে। মুন্নাদা ওঠো এখন অনেক বেলা হলো।
নীপা ইসলামভাই-এর হাত ধরে শোফা থেকে টেনে তুললো।
আমরা সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। স্নান করতে গেলাম।
ইসলামভাই পুকুরের জল তোলপাড় করে স্নান করলো। প্রায় আধঘণ্টা ধরে। মাঝে মিত্রা, ছোটোমা, বড়োমা এসে একবার তাড়া লাগিয়ে গেছে।
ইসলামভাই জল থেকে উঠে বললো। জানিস অনি প্রায় দশবছর পর পুকুরে স্নান করলাম।
লাস্ট একবার বনগাঁ গেছিলাম সেখানে স্নান করেছিলাম। আমাদের গ্রামে পুকুর ছিল না। তবে একটা বড় দীঘি ছিল। ঘাট ভাগ করা ছিল। সেখানে স্নান করতাম।
দীঘির এপার ওপার করা খুব মুস্কিল ছিল। এককথায় বলতে পারিস ওটা আমাদের গ্রামের রিজার্ভার। মাছও ছিল প্রচুর। খাওয়া দাওয়া স্নান সব ওই জলে। জানিনা এখনও আছে কিনা দীঘিটা।
ইসলামভাই-এর চোখদুটো ভারি হয়ে আসছে।
আজকে নিজের গ্রামের কথাটা খুব বেশিকরে মনে পড়ছে। দিদিরও হয়তো মনে পড়ছে। ও খুব চাপা, প্রকাশ করে না। হাসিখুশি মেয়েটা কেমন যেন বোবা হয়ে গেছে।
পায়ে পায়ে এবাড়িতে এলাম। ভিঁজে কাপর-জামা ছেড়ে আবার ও বাড়িতে গেলাম।
আমরা সবাই একসঙ্গে খেতে বসলাম। আমি, আমার একপাশে বড়োমা, একপাশে মিত্রা, তারপাশে নীপা। বড়োমার পাশে ছোটোমা। আর একদিকে ইসলামভাই, ভজু, অনাদি, বাসু, চিকনা।
কাকিমা, সুরমাসি সবাইকে পরিবেশন করছে।
সবাইকে গরম ভাত দিয়েছে সুরমাসি। ধোঁয়া উঠছে। মিত্রা আমার দিকে তাকাল।
তুমি জানোনা মিত্রাদি, মাকে ফোন করে আগে থেকে মেনুটা বলে দিয়েছে। নীপা বললো।
ও কি খাবেরে?
দেখনা কি খায়।
সুরমাসি কাঁচা সরষের তেল দিয়ে গেল, তার সঙ্গে পেঁয়াজ কুচি, লঙ্কা।
কিরে তুই সরষের তেল দিয়ে ভাত খাবি নাকি।
তোর কি, তোর ইচ্ছে হলে তুইও খা।
না না তুই খা। আমাদের মেনুটা তোর থেকে স্মার্ট।
আমি তো গাঁইয়া।
তাহলে কি সাঁইয়া?
বড়োমা আমার দিকে তাকাল, মুচকি হাসছে।
সুরমাসি ওদের জন্য ভাজা, ডাল, সবজি, দু-রকম তরকারি, মাছ সব একে একে দিয়ে গেল।
কিরে তুই এগুলো খাবি না। মিত্রা আমার দিকে তাকাল।
না।
একবারে আমার পাতের দিকে তাকাবি না। জিভ দিয়ে জলও বার করবি না।
মাথা দোলালাম।
আমি গরমভাতে সরষের তেল মেখে পেঁয়াজ কুচি মাখলাম। সুরমাসি আমার জন্য ঘুনো চিংড়ি কড়া করে ভেজে পেঁয়াজ দিয়ে মেখে নিয়ে এসেছে। দারুন গন্ধ বেরচ্ছে। ঘ্রানেন অর্ধভোজনায়। খাওয়া শুরু করলাম। মিত্রা টেরিয়ে টেরিয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে। মাঝে মাঝে নাক টানছে।
আমি খেয়ে চলেছি।
মিত্রা অনেকক্ষণ দেখার পর আর থাকতে পারল না। তুই কিরকম মেখেছিস দেখি। বেশ তাড়িয়ে তাড়িয়ে খাচ্ছিস।
বড়োমাকে টপকে আমার পাতে খাবলা মারলো। বড়োমা, ছোটোমা, নীপা দেখছে। ও আমার পাত থেকে ভাত মুখে তুলে একটু ঘুনো চিংড়ির চাট মুখে তুলে বললো—
বড়োমা তুমি একবার খেয়ে দেখো। শয়তান নিজের চাটের খাওয়াটা অর্ডার করে আমাদের মাছ ভাত খাওয়াচ্ছে। আমার কোমড়ে রামচিমটি দিল। আমি উঃ করে উঠলাম। সবাই হাসছে।
মুখে ভাত। আমি না পারছি হাসতে না পারছি কিছু করতে। বড়োমা আমার পিঠে হাত বোলাচ্ছে।
তোকে আর খেতে হবে না। তুই আমার থালাটা নে আমি তোর থালাটা নিচ্ছি।
বড়োমা হাসতে হাসতে বললো। ও মিত্রা করছিস কি?
তুমি একবার খেয়ে দেখ। তখন থেকে আমি নাক টানছি এতো সুন্দর ঝাঁঝালো গন্ধ আসছে কোথা থেকে। কতবার আমার ভাত শুঁকলাম। শয়তান পাশে বসে গপগপ করে গিলে যাচ্ছে। লজ্জাও করে না।
মিত্রা আসন ছেড়ে উঠে আমার পাত থেকে একগ্রাস তুলে বড়োমার মুখে ঢুকিয়ে দিল।
ছোটোমাকেও দিল।
দুজনেই হাসছে।
এবার বলো আমি মিথ্যে বলেছি?
না তুই মিথ্যে বলবি কেন।
অনাদিরা, ইসলামভাই হাসতে হাসতে পাতে গড়িয়ে পরছে।
সুরমাসি বললো, ঠিক আছে মিত্রা আমি তোমায় দিচ্ছি।
না তুমি ওকে আবার নতুন করে দাও, আমি ওর মাখা ভতটা তুলে নিচ্ছি। এই চিংড়িমাছও ওকে আলাদা করে মেখে দাও।
মিত্রা নিজের থালাটা আমার দিকে ঠেলে দিয়ে আমারটা টেনে নিল।
আমি মিত্রার পাতের মাখা ভাত খেতে আরম্ভ করলাম। সুরমাসিকে বললাম, আর লাগবে না। কাল আবার খাব।
সুরমাসি আমার কথাটা যেন ভুলে যেও না।
না না ভুলবো না।
মিত্রা তুই একলা খাবি। ছোটোমা বললো।
একগাল হেসে। তুমি নেবে!
গরম ভাতটা সরষের তেল দিয়ে অনি দারুন মেখেছে।
এবার বলো।
মিত্রা উঠে গিয়ে ছোটোমার পাতে কিছুটা দিল।
বড়োমা তাকিয়ে আছে। মিত্রা বড়োমার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো।
খালি মিত্রার দোষ দেখো, না। তোমার ছেলেটার দোষ দেখো না তো?
দাঁড়াও দিচ্ছি।
মিত্রা বড়োমার পাতে কিছুটা দিল।
ইসলামভাই ওই দিক থেকে চেঁচিয়ে উঠলো।
ম্যাডাম সবাই যখন পেল আমি ফাঁকে পরি কেন, একটু টেস্ট করি।
ওমা! বড়োমা দেখছো, বেড়ালের গলায় ঘণ্টা খালি আমি একা বেঁধেছি।
আমার দিকে ঘুরে বললো। এই আবার মাখ। খরিদ্দার অনেক।
তুই মাখ আমি পারবো না।
পারবিনা মানে। এতক্ষণ বসে বসে গিললি। আমরা খেয়েছি?
তাহলে কি করলি এতক্ষণ। গন্ধ শুঁকলি।
মিত্রাদি আমি। নীপা বললো।
ওমা দেখো কান্ড!
দিদিমনি। ভজু চেঁচিয়ে উঠলো।
দেখ দেখ আমি হাঘরে নই, সবাই।
সুরমাসি আবার গরমভাত সরষের তেল পেঁয়াজ কুচি দিয়ে গেল।
বাধ্য হয়ে আমি ভাত মাখলাম। সবাই খেলো।
বড়োমা আমার দিকে তাকিয়ে বললো। এই খাওয়াটা কোথা থেকে শিখলি।
আমি মিটি মিটি হাসছি।
কিরে বল। মিত্রা কট কট করে উঠলো।
শুনে লাভ, তোর খাওয়া নিয়ে কথা।
শোনাটাও দরকার।
আমি ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছি। সবাই-ই কমবেশি হাসাহাসি করছে।
জলেরগ্লাসে মুখ দিয়ে একটু জল খেলাম।
আমাদের এখান থেকে একটু দূরে হাঁড়িপারা।
ওদের আনাজ কেনার পয়সা থাকে না। মাঠে কাজ করলে চাল, তেল, নুন কয়েকটা আলু সিধা হিসাবে পায়। ওদের এই ভাবে খেতে দেখেছি। এখানে হয়তো আরও কয়েক বাড়িতে এই ধরনের খাওয়ার চল রয়েছে। আমি কলকাতায় একদিন এক্সপেরিমেন্ট করলাম। দেখলাম চলেবেল। শুরু করলাম। ভজু কয়েকদিন ভাগ মেরেছিল। এ্যাকচুয়েলি এই সব খাওয়ায় রান্নার ঝামেলা থাকে না।
তুই আর কি কি খাস, একটা লিস্টি দিস। মিত্রা বললো।
প্রথমে রাখ ইঁদুর পোরা।
ওয়াক।
কি হলো?
দেখছো বড়োমা।
তুই ওকে জিজ্ঞাসা করলি কেন?
তাই বলে। শয়তান।
দিলো আবার চিমটি।
আচ্ছা চল তোকে দেখাচ্ছি। খেলে বলবি বুবুন আর একবার খাওয়াবি।
আমি কিন্তু উঠে চলে যাব।
পেট ঠেসে নিয়েছিস। উঠে গেলে খুব একটা ক্ষতি হবেনা। কাল থেকে যা শুরু করেছিস।
নীপারে কালকে বুবুন যা চিকেন বাটার ফ্রাই করেছিল। জিভে টকাস করে আওয়াজ।
বড়োমা হেসে ছোটোমার ঘারে পড়ে গেল।
আমার জন্য আনতে পারলে না একটা?
আনব কিরে, যা কিপ্টা, সবার ভাগে একটা করে গোনাগুন্তি। ওর হেল্পার কে ভজুরাম। সেও তেমনি। বাবু যদি বলে ছটা নিয়ে আসবি ও চারটে নিয়ে আসে।
বড়োমা দেখছো দিদিমনি কিরকম মিছে কথা বলছে। আমি ষোলো পিস নিয়ে এসেছিলাম, দিদিমনি ছয় পিস খেয়েছে। ভজু ওদিক থেকে চেঁচিয়ে উঠলো।
আমি হাসতে হাসতে বলে উঠলাম একটা গোটা মুরগি।
মিত্রা আবার চিমটি কাটলো আমার কোমড়ে।
আমি উঃ উঃ করছি।
ও মিত্রা ছাড়।
আর বলবি বল, শয়তান, গোটা মুরগি, তুই খাসনি।
সবাই হেসে। অনাদিরা খাওয়া থামিয়ে দিয়ে হাসছে। ইসলামভাই, ছোটোমার দিকে তাকিয়ে বললো—দিদি আর খাওয়া যাবে না, ম্যাডাম হাসিয়ে পেট ভরিয়ে দিয়েছে।
বড়োমা মিত্রার দিকে হাসতে হাসতে তাকিয়ে বললো, সত্যি করে বলতো মিত্রা, কালকে তুই কটা খেয়েছিস?
বেশি না চারটে পুরো। তোমার পাত থেকে হাফ। তাও তুমি দেখো আমার ভাগের একটা বুবুনের ভাগের দুটো আর ছোটোমার ভাগের একটা।
আর রান্না ঘরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনি যে ভাজতে ভাজতে তোকে একটা দিল, তারপরে আমিও একটা দিলাম।
তারমানে তো একটা গোটা মুরগি হয়েই গেল। রাতে যদি ওর পেটে মুরগির ডাক শুনতে। সারারাত ঘুমতেই পারলাম না। আমি বললাম।
মিত্রা আমার পিঠে গুম করে একটা ঘুসি বসিয়ে দিলো।
বড়োমার সাপোর্ট পেয়ে বড়োবড়ো কথা। মুরগি ডাকা।
বড়োমার দিকে তাকিয়ে, চেঁচিয়ে বললো, তুমি কিছু বলতে পারো না।
সবাই হাসছে।
কাকা বাইরের বারান্দা থেকে এসে বললো। বাবা এতো দেখছি ভোজসভা বসেছে।
বড়োমা হাসতে হাসতে বললো বসুন না আপনি। আপনার ভাইপোর তরজা গান শুনতে পাবেন।
ও মহা ফোক্কর। তোমরা ওকে জানোনা, আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। আর ওর সব কাজে ওর কাকিমা ওকে সাপোর্ট করতো। কত মার খেয়েছে এর জন্য।
কোথায় কোথায় মারতে বলো। মিত্রা বললো।
সেকি আর মনে আছে মা।
তবে একবার ওকে খুব মেরেছিলাম। মনটাও খুব খারাপ হয়ে গেলো। দুদিন ওর সঙ্গে ঠিক মতো কথা বলতে পারিনি। তারপর আর ওর গায়ে হাত তুলিনি। দু-একটা চড় থাপ্পর মেরেছি।
তোমার তো মারার ব্যামো ছিল। কাকিমা বললো।
সে তুমি বলবেই। বাঁদরামো করলে মারবো না।
কাকা হাসছে।
ওই যে সামনের পুকুরটা দেখছো। ওটার একবার জলটা একটু খারাপ হলো। আমরা গ্রামের লোকেরা মেশিন বসিয়ে জল ছেঁচতে শুরু করলাম। পুকুরে প্রচুর মাছও ছিল।
সিঙ্গি, লেটা, কই, মাগুর, পাঁকের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে ঢুকিয়ে সব মাছ ধরছে।
তখন ও কিসে পড়ে ক্লাস নাইনে।
ও নেমে পরেছে ওই পাঁকের মধ্যে। মাছও ধরছে। তারপর একটা মাছ ধরে বলে উঠলো দেখ আমি একটা কত বড় মাছ ধরেছি। ভাবলাম হয়তো কুচে মাছটাছ হবে। দেখি পাঁক থেকে একটা গোখরা সাপ টেনে বার করলো। মুখটা হাত দিয়ে চেপে ধরে আছে।
প্রথম ও নিজেও বোঝেনি। যখন বুঝলো ছুঁড়ে ফেলে দিল।
সবাই চেঁচিয়ে উঠলো। কামড়ে দিলে কি সব্বনাশ বলো। আমার তো ওই দেখে গা হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেছে। ভাবলাম কামড়ে দিয়েছে হয়তো। ওর মরা বাপ-মা আমার গলা টিপে ধরলো বলে। সবাই ছুটে গেল। সাপটাকে মারলে।
আমি রাগে দিকবিদিক জ্ঞনশূন্য হয়ে একটা বেরাকলমি গাছ ভেঙে সপাং সপাং করে দিলাম। উনা ছিল, আরও সবাই ছিল, ওরা এসে সব ধরে ফেললো।
কতো বলবো মা ওর গুনের কথা। এই তল্লাটে একটা নারকেল গাছে ডাব হওয়ার যো নেই গাছে উঠে ওখানেই বসে ডাব খেয়ে গাছের ডালের ফাঁকে রেখে চলে আসবে। তোমরাই বলো মা যদি একবার পা হড়কে ওখান থেকে পরে, রক্ষা পাবে।
আমি মাথা নিচু করে বসে খেয়ে যাচ্ছি, ওরা কখনও অবাক হয়ে যাচ্ছে কখনও বিস্ময়ে কাকার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, নীপা মাঝে মাঝে মাথা নিচু করে আমার মুখ দেখার চেষ্টা করছে।
আচ্ছা কাকা, তেল পেঁয়াজ মেখে ভাত খাওয়াটা কার কাছ থেকে শিখলো বলো? মিত্রা বললো।
সবাই হেসে উঠলো।
বড়োমা বললো তুই থামবি।
আঃ তুমি দাঁড়াও না। ওর সব কিছুর মধ্যে একটা ইতিহাস থেকে। কি বেরলো তো?
বড়োমা বললো, মুখপুরী।
আমি মিত্রার দিকে তাকিয়ে হাসলাম
হাসছিস। এবার তোর কলেজের গুনকীর্তনটা বলি সবার সামনে।
ছোটোমা বললো। মিত্রা ওগুলো বলিস না।
সবাই এ ওর মুখের দিকে তাকায়।
বড়োমা বললো, তোরা কি আরম্ভ করেছিস বলতো, ছেলেটাকে খেতে দিবিনা, না কি।
দেখলে ছোটোমা, অমনি ছেলেটাকে খেতে দিবি না। এতক্ষণ কি জল আর হাওয়া খেল? মিত্রা মুখ ভ্যাঙচালো।
মিত্রা গম্ভীর হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো। মনে রাখিস তোলা থাকলো। কালকে মাছ ধরাটা শিখিয়ে দিবি।
সবাই হেসে গড়িয়ে পরে।
আমি মিত্রার দিকে তাকালাম। কাল রাতের কথা মনে রাখিস। বড়োমাকে সব বলিনি। খালি ছুঁয়েছি। এবার ঝেড়ে কাশবো।
প্লীজ প্লীজ আর হবে না, তুই বিশ্বস কর। আমি উইথড্র করছি। ব্যাশ শোধ-বোধ।
আবার হাসির রোল।
ইসলামভাই খেতে খেতে পা ছড়িয়ে দিয়েছে।
অনাদিরা হেলে হুলে বসে আছে। ভজু আমার পাতের সামনে। আমি যা রেখে যাব ভজু খাবে।
কিরে তুই এখানে উঠে এলি। মিত্রা বললো।
অনিদার পাতে পরে থাকলে খাব।
হায় রাম, বড়োমা দেখছো কান্ড।
ভজু ততক্ষণে আমার পাত চাটতে শুরু করেছে।
বড়োমাকে বললাম এবার ওঠো। একটু গড়িয়ে নাও দুজনে। তারপর রোদটা পরলে বেরবো। নীপার দিকে তাকিয়ে বললাম। নীপা, মুন্নাভাই-এর বিছানাটা একটু গুছিয়ে দাও। একটু গড়িয়ে নিক।
বড়োমা আমাকে বললো, অনি একটু টেনে তোল।
আমি মিত্রার দিকে তাকালাম।
বড়োমা আমাকে বলেনি, তোকে বলেছে। দেখছিস না আঙুল চাটছি।
তুই পারিসও বটে।
আমি বড়োমাকে ধরে তুললাম।
হাতমুখ ধুয়ে নিজের ঘরে এলাম।
অনাদিরা বললো, আমরা একটু বাজার থেকে ঘুরে আসি।
তারাতারি আসিস, বিকেলে যেতে হবে। বড়োমার হুকুম।
বাসু হাসতে হাসতে বললো, মনে থাকবে না মানে, হেডমিস্ট্রেস বলে কথা।
হেসে ফেললাম
হ্যাঁরে অনি। অনাদি বললো।
কি?
মুন্নাভাই বলছিল আমাদের সঙ্গে যাবে, নিয়ে যাব।
যা।
তুই রাগ করবি না?
না।
তাহলে মুন্নাভাইকে ডাকি?
যা।
আমি ওপরে চলে এলাম। একটা সিগারেট ধরালাম। জানলার কাছে হেলে বসলাম। সিঁড়ি দিয়ে ধুপ ধাপ আওয়াজ পেলাম। বুঝলাম কেউ আসছে। ভজুরাম এসে ঘরে ঢুকলো। অনিদা।
কি হলোরে?
তোমাকে দাদা একবার নিচে ডাকছে।
কোথায়?
নিচে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।
আমি নিচে নেমে এলাম। দেখলাম ইসলামভাই দাঁড়িয়ে আছে।
আমায় দেখে বললো, ওদের সঙ্গে যাই, তোদের গ্রামটা একটু ঘুরে আসি।
যাও।
যদি কোনও সমস্যা থাকে। তোকে এই জন্য জিজ্ঞাসা করলাম।
ওদের সঙ্গে গেলে তোমার কোনও সমস্যা নেই, থাকলে না বলে দিতাম।
ওটা সঙ্গে নিতে হবে নাকি?
না দরকার পরবে না। আর একটা কাজ করবে আমার হয়ে।
বল।
দাঁড়াও। বাসুকে ইশারায় ডাকলাম। ওরা খামারে দাঁড়িয়ে আছে।
ওরা পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো।
জায়গাটার ব্যাপারে বলেছিলাম, কথা বলেছিস?
হ্যাঁ সব ঠিক আছে। টাকা দিলেই রেজিষ্ট্রি হয়ে যাবে।
বাঃ। কতো চাইছে?
যা বলেছিলাম তোকে তাইই চাইছে, দেওয়ার সময় না হয় একটু কম করে দেওয়া যাবে।
মুন্নাভাইকে জায়গাটা একটু দেখিয়ে দিস। আমি ঝামেলার মধ্যে থাকবো।
ঠিক আছে।
ইসলামভাই-এর দিকে তাকালাম।
ইসলামভাই আমার চোখের ইশারা বুঝে গেল।
ভজুকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি।
যাও, কিন্তু বাইক চালাবে না, পথঘাট এবড়ো খেবড়ো।
ইসলামভাই আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো।
ওরা চলে গেল। আমি ওপরে এসে প্রথমে দাদাকে ফোন করলাম।
হ্যালো।
দারুন খবর বুঝলি অনি।
কি।
নিরঞ্জন ফোন করাতে কাজ হয়েছে।
কি হয়েছে!
মেয়েটা বিষ খায়নি। খুন হয়েছে।
কি করে বলে, হাসপাতাল বলছে বিষ খেয়েছে।
দুর। সব বাজে কথা।
তারমানে!
হাসপাতালে নিয়ে গেছিল, ওরা বলে দিয়েছে মরে গেছে। তখন পোস্টমর্টম করতে নিয়ে যায়। মেয়েটার মুখে বিষ পেয়েছে, কিন্তু গলার নলি থেকে সে বিষ আর পেটে যায়নি।
বলো কি, মারার পর মুখে বিষ ঢেলেছে।
হবে হয়তো। তবে রিপোর্ট এখনও আসেনি। রাতের দিকে ফ্যাক্স করবে বলেছে।
ওই দিকের খবর কিছু ফলো আপ করেছো।
আমি করতে পারিনি। মল্লিক আর সন্দীপ সামলাচ্ছে। তোর বড়োমা কেমন আছেরে।
খুব মজা করছে।
করুক। কতো বছর পর বাড়ির বাইরে বেরোল জানিষ।
জানবো কি করে, তুমি বলেছো কোনও দিন।
সে সুযোগ আর হলো কোথায়, এবার হয়তো একটা সুযোগ তৈরি হবে।
কেন, এতদিন পরপর ভাবতে?
আমি ভাবিনি তুই ভাবতিস। নিজের চারধারে একটা অদৃশ্য দেয়াল তুলে রাখতিস। একটু ভেবে দেখ।
অস্বীকার করছি না।
তাহলে?
বড়োমা ওবাড়িতে নাহলে তোমার সঙ্গে কথা বলিয়ে দিতাম।
আমি পরে ফোন করবো।
ঠিক আছে। আমি মল্লিকদার সঙ্গে কথা বলে নিচ্ছি। খেয়েছো।
হ্যাঁ। হরি ক্যান্টিন থেকে মাছ ভাত এনে দিয়েছিল আমার আর মল্লিকের জন্য।
আচ্ছা।
ফোনটা কেটে দিয়েই মল্লিকদাকে ফোনে ধরলাম।
কি বস কেমন আছো।
বস কে তুমি না আমি?
তুই।
বয়সে আমার থেকে বড়ো কে?
আমি।
তাহলে ওই যোগ্যতা কার হওয়া উচিত?
তোর সঙ্গে পারা যাবে না।
মাছ-ভাত ভালোই সাঁটালে।
তুই যে সরষের তেল মেখে ভাত, পেঁয়াজ কুচি, চিংড়ি ভাজা দিয়ে সাঁটিয়েছিস, সেটা বললি না।
খবর হয়ে গেছে।
আর কি নিয়ে থাকবো বল। জীবনে এইটুকু সম্বল।
একথা বলছো কেন?
তোর সঙ্গে অনেক কথা আছে।
কথার বাইরের কথা?
ঠিক। তোর কাছে আমাকে কনফেস করতে হবে।
কেন!
তোকে আমার অনেক কথা গোপন করেছি, বলা হয়নি।
যে কথা অগোচরে আছে থাকনা, তাকে গোচরে ডেকে আনছো কেন, সে বড় বেদনাদায়ক।
বেদনার মধ্যেই আনন্দ খুঁজে পেতে হবে অনি।
ছোটোমাকে কেমন বুঝলে?
দারুন খুশি। তোর নদী পেরনোর গল্প বললো। সত্যি তুই পারিস।
বাবাঃ তোমাকে পুরো ব্রিফ করে দিয়েছে?
তা বলতে পারিস।
এতো প্রেম ভালো নয়, মনে রাখবে উনি আমার ছোটোমা।
আমি অস্বীকার করছি না।
এবার থেকে প্রেমটেম একটু কম করবে।
তোর ছোটোমাকে কথাটা বলি।
সত্যি তুমি উজবুক আছো।
তাহলে বললি কেনো।
ঠিক আছে উইথড্র।
মল্লিকদা হেসে ফললো।
খবর কি বলো?
তোর কথা মতো কাজ হচ্ছে, সকাল থেকে ব্যানার্জী বার পাঁচেক ফোন করেছিল। দাদাকে প্রথম করেছিল। দাদা বলে দিয়েছে ও ব্যাপারটা মল্লিক কন্ট্রোল করছে। তারপর থেকে আমাকে ফোন। একবার একটু সময় দিন। আমি বলে দিয়েছি আজ তো নয়ই কাল করুণ দেখা যাবে। কালকে নিউজ ছাপা হচ্ছে কিনা। আমি বলে দিয়েছি, সেটা অফিসের কনফিডেনসিয়াল ব্যাপার, আপনাকে জানাতে যাব কেন।
তুমি কি ভাবছো ও জানতে পারছে না।
জানি জানতে পারছে।
আরও দু-চারটে ফোরে আছে। আমি পর্শুদিন যাই তারপর দেখাব মজা।
আমার শালাটা কোথায়?
ঘুরতে গেছে।
ছেলেটাকে জীবনে কোনওদিন দেখিনি। আজ প্রথম দেখলাম। তোর ইসলামভাই যে আমার শালা কি করে জানব?
দুরছাই আমিও কি জানতাম। সকাল বেলা সব কেমন যেন গোলমাল পাকিয়ে গেল।
তোর ছোটোমা বলতো বটে। আমি গা করতাম না।
ছোটোমাকে তুমি পেলে কোথায়?
সে এক উপন্যাসরে অনি। এখন ও ছাড়া আমার জীবনে আর আপন বলতে কেউ নেই। তারপর তুই, দাদা, বড়দি এখন মিত্রা।
মল্লিকদা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
তারপর বলো।
অফিসে আজ বাইরের লোক আসা একদম বন্ধ। দাদার ঘরে আমি সন্দীপ আর তোর চেলা দুটো ছাড়া সনাতনবাবুর প্রবেশের অধিকার আছে। তুই যদি হরিদাকে আজ দেখতিস।
কেন!
কমান্ডোরে কমান্ডো।
অফিসের কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না। ম্যায় চম্পক সকালে একবার দেখা করতে গেছিল বলেছে, দাদা ব্যস্ত আছে। আজকে বিরক্ত করা যাবে না।
বলো কি!
তাহলে তোকে বলছি কি।
হাসলাম।
তোর লেখাটা সবে প্রুফ দেখে দাদার টেবিলে পাঠালাম। দারুন নামিয়েছিস। এখন কিছুটা হাল্কা। সন্দীপ হেবি লোড নিয়েছে। তোর চেলা দুটোও।
কেমন মনে হচ্ছে।
খুব সার্প। তারাতারি ধরতে পারে।
তুমি তোমার অভিজ্ঞতা দিয়ে আর দুটো অনিকে তৈরি করে নাও।
অনি একটাই হয়, দুটো তিনটে হয় না।
সকাল থেকে অনেক টেনসন গেল। একটু রেস্ট নাও। আর ওই ছেলে দুটোকে বলো ফলোআপ করতে।
ওরা কন্টিনিউ করে যাচ্ছে।
আচ্ছা।
ফোনটা সুইচঅফ করলাম। চোখটা ঘুমে জড়িয়ে আসছে। দু-তিনটে বড় বড় হাই উঠলো। আমি বালিশটা টেনে নিয়ে মুখের ওপর রেখে চোখ বন্ধ করলাম।
আমি জানলার সামনে দাঁড়িয়ে আছি, আমার প্রিয় আম গাছটার দিকে তাকিয়ে, না আজ কোনও টিয়া পাখি এসে পেয়ারা গাছটায় বসেনি, অনেক হলুদ হলুদ পেয়ারা দেখতে পাচ্ছি, একটু আগে ছোটোমার সঙ্গে একটা ফালতু বিষয় নিয়ে, কথাকাটাকাটি হয়ে গেল। মনটা ভীষন খারাপ লাগছে। মাঝে মাঝে আমার কি যে হয়, আমি বুঝি না।
মল্লিকদা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে সব শুনলো। আমার সম্বন্ধে একটা খারাপ ধারনা তৈরি হলো। সত্যি আমার মনে হয় আমার মনের ভেতর একটা ভূত লুকিয়ে আছে। কখন যে সেই ভূতটা তার দাঁত মুখ খিঁচিয়ে আমার সামনে উপস্থিত হয় জানি না।
ছোটোমা কেনো ওই কথা বলতে গেলো, আমি বিধর্মী, না বললেই এই ঘটনা ঘটতো না। আমি ছোটোমাকে জিজ্ঞাসা করতে যাইনি, তুমি হিন্দু না মুসলিম। আমি মানি না, মানুষের আবার ধর্ম আছে নাকি, যার যার স্বার্থে সে তার ধর্ম পালন করে।
একটা শিশু যখন পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয় বলতে পারবে কেউ তার ধর্ম কি, যদি মা বাবার পরিচয় না পাওয়া যায়। পাখিদের দিকে তাকিয়ে দেখো তো তাদের কোনও ধর্ম আছে।
না।
তারা কোনও মন্দির, মসজিদ, গির্জাতে গিয়ে মাথা নোয়ায় না। তুমি মানুষ হও, পৃথিবীতে তুমি এসেছো কয়েকটা দিনের জন্য তারপর চলে যাবে। যে ভূমি তোমাকে এত কিছু দিল তার জন্য কি রেখে যাচ্ছ তুমি, এটা কখনও ভেবে দেখেছো।
রবীন্দ্রনাথের সোনার তরীর সেই কবিতাটা মনে পড়ে তোমার ছোটোমা, ‘যত চাও তত লও তরণী ভরে/আর আছে আর নাই দিয়েছি ভরে/এতকাল নদীকূলে যাহা লয়ে ছিনু ভূলে/সকলি দিলাম তুলে থরে বিথরে/এখন আমারে লহ করুণা করে’, তখন সেই কালের যাত্রী কি বলেছিল শুনবে। ‘ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোটে সে তরী/আমার সোনার ধানে গিয়েছি ভরি’।
এই কাল তোমার কর্মটুকু নেবে তোমাকে নেবে না। আর সেখানে লেখা থাকবে না তুমি কোন ধর্মের। তুমি ইতিহাসকে কি উত্তর দেবে। তুমি হিন্দু, তুমি মুসলমান, তুমি খ্রীস্টান না তুমি মানুষ। হিন্দু ধর্মে দেখেছো তুমি সন্ন্যাস নিতে গেলে তোমায় তোমার শ্রাদ্ধটা আগে করে নিতে হবে। মানে তোমার কোনও পিছু টান নেই। তুমি পৃথিবীতে একা।
সব ধর্মের মধ্যেই এই ব্যাপারটা আছে। তুমি এই যে এক সঙ্গে সবাইকে দেখছো না এটা মায়া।
আমার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু আছে, তার বয়স কত শুনবে? ৮১ বছর। একদিন কথায় কথায় তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, বন্ধু জীবনে চরম সত্য কি? তিনি কি বললেন শুনবে, মৃত্যু। বললাম তাহলে চরম মিথ্যে? বললেন কেন বেঁচে থাকা। তাহলে আমরা কি নিয়ে বেঁচে আছি? হাসতে হাসতে সেই বুড়ো কি বললো জানো, আশা।
যাকে তোমরা কেতাবী ঢঙে বলো হোপ।
তুমি ধর্মী কি বিধর্মী আমার জানার দরকার নেই, তুমি আমার ছোটোমা, আমার কাছে এটাই শেষ কথা।
না অনি তোকে শুনতে হবে।
কি বলতে চাও বলো।
একটা সময় আমার জীবন কেটেছে গণিকা পল্লীতে।
ছোটোমা!
হ্যাঁ অনি আমি তোকে মিথ্যে কথা বলছি না। বিশ্বাস কর। আমি গণিকা।
তুমি মুখ সামলে কথা বলো।
৭১ সালের যুদ্ধে ওপার বাংলা থেকে যখন এপার বাংলায় চলে এলাম, একদিন বর্ডারের এক লংগর খানা থেকে আমি হারিয়ে গেলাম, পেটের জালায়….। তুই বলেছিলি না সেদিন, অভাবের, দারিদ্রের কোনও রং নেই অভাবের কোন জাত নেই, তোর আজকের ইসলামভাই তখন আমার নিজের ভাই মুন্না, সেদিন সে তার দিদিকে বাঁচাতে পারেনি, সেদিন যে ও ইসলামভাই হয়নি।
শরীরটা ওরা ছিবরে করে দিল কয়েকদিনে।
তারপর বহু হাত ঘুরে তোর ছোটোমার স্থান হলো গণিকা পল্লীর রাজপ্রাসাদে।
নামতার নীলকমল। সেখানেই একদিন তোর মল্লিকদা আমাদের নিয়ে একটা আর্টিকেল লেখার জন্য গেল। প্রথম আলাপ। কেন জানি না তোর মল্লিকদাকে ভালো লেগে গেল।
তারপর প্রেম, তখন তোর দামিনীমাসির জন্ম হয়নি। হয়তো হয়েছিল, আমি জানতাম না, কতো পুরুষকে এই শরীরে আশ্রয় দিয়েছি। তারপর একদিন তোর মল্লিকদার হাত ধরে গণিকা পল্লীথেকে হিন্দু ঘরের সতী সাধ্বী স্ত্রী।
কপালে সংসার জুটল না। তোর মল্লিকদাকে বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে হলো। অনেক ঝড় বয়েগেছে এই শরীরের ওপর দিয়ে। তবে তোর বড়োদাদা ভগবান, বড়োমা সত্যি মা আমার দিদি। আমারও এই পৃথিবীতে তোর মতো কেউ নেই, তাই বড় পেলাম, ঘর পেলাম, দাদা পেলাম, দিদি পেলাম। তিনি আশ্রয় না দিলে হয়তো আবার ভাসতাম। তুই বলেছিলি আমার খোঁজ নিবি, আমি এই কারণে তোকে বারণ করেছিলাম।
শুনলে তুই হয়তো আঘাত পাবি, কেন জানিস? আমি এখনও একজনের কাছে সপ্তাহে একদিন যাই। তোর মল্লিকদা জানে। তার সঙ্গে চুক্তি ছিল, সে আমাকে ওখান থেকে বার করে দেবে, তবে তার কাছে আমাকে প্রতিদিন যেতে হবে।
তা সেটা নিগোসিয়েশনে সপ্তাহে একদিন হয়েছে। আমাকে মাসোহারাও দেয়। সবাই জানে। তোর ছোটোমা এখনও কোনওদিন মা হয়নি। গনিকারা কোনওদিন মা হতে পারে না। তাহলেই তাদের কাছে খরিদ্দার আর আসবে না, তুই মা বলে ডেকেছিলি, দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম।
শরত্চন্দ্র পরিসনি? শ্রীকান্তের পিয়ারী কি কোনওদিন মা হতে পেরেছিল, তাই তো সে জননী রাজলক্ষীর বেশ ধরতে বাধ্য হয়েছিল।
তুমি একবার তার নাম ঠিকানা বলো।
কেন, তাকে মারবি?
অনি কোনও দিন কাউকে মারবে না।
তাহলে!
তাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করবো।
না।
তোমায় কথা দিলাম, এখবর জোগাড় করতে আমার বাহাত্তর ঘণ্টা সময় লাগবে না। আর তোমায় এও বলে দিলাম, আমার হাতেই তার মৃত্যু লেখা আছে। মায়ের সম্মান রক্ষার্থে ছেলে তাকে হত্যা করতেই পারে। ছারো তুমি আমায়, ছারো।
তোমার মুন্নাকে বলো, যদি তার ক্ষমতা থাকে অনিকে আটকাতে।
অনি, অনি।
বুবুন এই বুবুন।
অনি ও অনি, বাবা চোখ খোল।
আমি চোখ মেলে তাকালাম।
আমার মাথার দুই দিকে ছোটোমা, বড়োমা। ছোটোমা আমার মুখের কাছে মুখ নামিয়ে নিয়ে এসেছে। মিত্রা আমার বুকে হাত বোলাচ্ছে। আমার পায়ের কাছে ইসলামভাই। ঘরে নীপা, অনাদি, বাসু, চিকনা দাঁড়িয়ে। পেছনে সুরমাসি, কাকিমা। ঘোর কাটতে মিনিট খানেক সময় লাগল। তারপর জিভ বার করে সটাং উঠে বসার চেষ্টা করলাম।
তোকে উঠতে হবে না। ছোটোমা বললো।
বাবাঃ কি খেল দেখাচ্ছিস তুই, আর তোকে কালীঠাকুর হতে হবে না।
মিত্রার দিকে তাকালাম।
আমি ভাবছিলাম তোর বুকের ওপর দাঁড়িয়ে জিভ বার করে আমি কালীঠাকুর হয়ে যাই, তাহলে যদি শিবের ধ্যান ভাঙে।
ওরে মিত্রা তুই থাম। বড়োমা বললো।
কেনো থামবো বলো। ওতো সবাইকেই মেরে ফেললো। শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বলছে মিত্রা তোকে খুন করে দেব।
আমাকে মারিস কোনও ক্ষতি নেই, মারার আগে আর একবার চিকেন বাটার ফ্রাই করে খাওয়াস। উঃ মুখে লেগে রয়েছে।
সবাই হাসছে।
আমি উঠে বসলাম।
ছোটোমাকে খুন করবি কেন বলতো! তোর কি পাকা ধানে মই দিয়েছে?
মিত্রা তুই থাম না। ছোটোমা বললো।
আমি ছোটোমাকে জড়িয়ে ধরলাম।
কি স্বপ্ন দেখছিলি বল। বড়োমা বললো।
কিছু না।
এই তো সব হেঁপি মেরে উড়িয়ে দিস। মল্লিক তোকে কিছু বলেছে?
না।
তাহলে!
মল্লিকদার সাথে আমার কথা হয়নি।
একবারে মিথ্যে কথা বলবি না। আমি তোর ফোনে কললিস্ট দেখেছি। ঘুমোবার আগে। তুই দাদা, মল্লিকদার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলেছিস।
মিত্রা ফোনটা দেতো। দুটোকে দেখাচ্ছি মজা। এখানে এসেও একটু শান্তি দেবে না। বড়োমা বললো।
উঃ ব্যস্ত হচ্ছ কেনো। সত্যি বলছি কিছু হয়নি। হাই তুললাম।
প্লিজ বুবুন তোর হাঁ দেখাস না, বিশ্বব্রহ্মান্ড ঢুকে যাবে।
হাসলাম।
দেখলে দেখলে তোমার ছেলের কান্ড। কিরকম চরকি নাচ নাচাল।
আচ্ছা অনির ভুল হয়েছে, কিন্তু আমাদের ডেকে আনলি তুই।
ভয়ে।
ঘরে এসে দেখি। বালিসের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। একবার কাছে গিয়ে দেখলাম ভালো করে, ভাবলাম আমাকে দেখে ঘাপটি মেরে পরে থেকে হয়তো অভিনয় করছে। ওমা বলে কিনা ছোটোমাকে খুন করবো। শ্মশানে-টসানে যায় ভাবলাম ভূতে ধরেছে হয়তো। তাই তোমাদের ডাকলাম।
আমার দিকে তাকাল।
সবাই হাসছে মিত্রার রঙ্গ দেখে।
আচ্ছা করে তোকে দিতে হয় বুঝলি। মিত্র দাঁতে দাঁত চিপে থাপ্পর তুললো।
কটা বাজে বলতো?
ছোটোমা আমার দিকে গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে রয়েছে।
সাড়ে চারটে বাজে, ট্রলি রেডি? মিত্রা বললো।
আমি ছোটোমাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, একটা বাজে স্বপ্ন দেখছিলাম। তোমরা আমাকে জাগাও নি কেন?
জাগাব মানে! তোর গায়ে গরম জল ঢালতে খালি বাকি রেখেছি।
ঢাললি না কেন?
ওই যে বড়োমা।
আমি আবার তোকে কখন ব্যাগড়া দিলাম।
তুমি বললে না। থাক মিত্রা ছেলেটার প্রচুর চাপ বুঝলি। তাই ওরকম ভুল বকছে। একটু ঘুমলে দেখবি ঠিক হয়ে যাবে।
দেখলি ছোটো দেখলি।
আমার থেকে ভালো গল্প বলে। তাই না বড়োমা?
বড়োমা আমার কানটা ধরলো।
তবেরে।
দাও দাও আর একটু জোড়ে। মিত্রা দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে উঠলো।
এইবার ছোটোমা না হেসে পারলো না।
আমি ছোটোমার গলা জড়িয়ে ধরে বললাম।
বিশ্বাস করো কিছু হয়নি। রেডি হয়ে নাও, অনেকটা পথ যেতে হবে।
মিটসেফের ওপর তোর আর মুন্নাভাই-এর জামাকাপড় রাখা রয়েছে পরেনে। মিত্রা কট কট করে উঠলো।
এটা বড়োমার হুকুম না তোর।
আমার….না না না বড়োমার।
বড়োমা হাসছে।
ঘরের চারদিকে সবার মুখের ওপর একবার চোখ বোলালাম। কারুর মুখ তেমন সুবিধার নয়। কেমন যেন থমথমে।
আমি খাট থেকে নেমে নীপার কাঁধ দুটো ঝাঁকিয়ে বললাম ভয় পেলে চলে। অনিদাকে দেখে লড়াই করার মানসিক প্রস্তুতি নাও। মাঝে মাঝে ব্রেক ডাউন হবে। তাতে কি হয়েছে। যাও রেডি হয়ে নাও।
অনাদিদের দিকে তাকিয় বললাম, তোরা বাজার থেকে কখন এলি?
এই তো মিনিট পনেরো হলো, এসে দেখি তোর এই কীর্তি। আমিতো গুনীন কাকাকে ডাকতে যাচ্ছিলাম।
হেসে ফেললাম।
নিজের কানে শোন, মিত্রা মিথ্যে কথা বলে না। মিত্রা কটকট করেই চলেছে।
সবাই চলে গেল। ঘর খালি। শুধু আমি ইসলামভাই রইলাম।
আমি ইসলামভাই-এর দিকে তাকিয়ে বললাম, জায়গাটা কেমন দেখলে?
দারুন। তোর কথা না শুনে একটু বাইক চালালাম।
অসুবিধে হয়নি?
না।
অনাদিকে বললাম, একটা বাইক জোগাড় করে দাও কয়েকদিনের জন্য।
কি বললো ও।
বললো চিকনার বাইকটা এখানে রেখে দেবে।
তাহলে তুমি বেশ জমিয়ে নিয়েছ বলো।
হ্যাঁ। তোর বন্ধুগুলো ভীষণ ভালো। কলকাতা গেলে একেবারে শেষ।
সেই জন্য এখানেই ওদের জন্য কিছু একটা ব্যবস্থা করবো।
জায়গাটা দেখলাম। ভালো স্পট।
দেখি আজ রাতে একটু বসবো সবাই।
কি জন্য?
রাতে বলবো।
নাও তুমি রেডি হয়ে নাও। আমি একটু হাত-মুখটা ধুয়ে আসি।
বাসুর দোকানে গেছিলাম। আমায় একটা শেরওয়ানী দিল। পয়সা দিতে চাইলাম নিল না। আমি কয়েকটা কাপর নিয়ে এসেছি তোর কাকিমা, সুরমাসি, বড়দিদি, দিদির জন্য নীপা, মিত্রার জন্য একটা করে শালোয়ার নিয়ে এসেছি।
কেন কিনতে গেলে?
মেরিনা ছাড়া জীবনে কাউকে কিছু নিজে হাতে কিনে দিইনি।
ওদের দিয়ে এসেছো।
দেব কি করে, এসে দেখলাম এই অবস্থা।
যাও নিজে হাতে দিয়ে এসো।
তোর কাকার জন্য কিছু নেওয়া হয়নি।
ঠিক আছে, এখন আছো তো।
আমি বেরিয়ে এলাম।
পুকুরঘাটে গিয়ে মুখ-হাত-পা ধুলাম, পাখিরা সব নিজের বাসায় ফিরছে, শালগাছ, জামগাছ, আমগাছের মাথায় কিচির মিচির শব্দ। ঘরে ফিরে যে যার একে অপরকে কাজের হিসেব দিচ্ছে যেন। আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের কথা বোঝার চেষ্টা করলাম। পারলাম না।
সং-এর মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি করছো?
দেখলাম নীপা আমার পেছনে।
এরইমধ্যে পোষাক বদল হয়ে গেছে।
এটা নতুন দেখছি?
হ্যাঁ।
নীপা একটা থ্রিকোয়ার্টার জিনসের প্যান্ট আর একটা টপ পরেছে। ওকে দেখে মনেই হচ্ছে না অজ গ্রামের মেয়ে। আজ নীপাকে বেশ মিষ্টি লাগছে। ঠোঁটে হাল্কা প্রলেপ।
-ড্যাব ড্যাব করে কি দেখছো।
-চুমু খেতে ইচ্ছে করছে।
-ওসব ছাড়ো এখন থেকে খালি মিত্রাদির ধ্যান করো। যা হয়ে গেছে, গেছে।
-কেনো।
-নেকু, আগে জানলে ওইটুকুও পেতে না।
-আজ জেনে ফেলেছো।
-সব।
-বাবাঃ তোমরা সবাই তো সাংবাদিক।
-ছোঁয়া পাচ্ছি না। যাও যাও ওঠো, আমি বাসন কটা ধুয়ে নিয়ে যাই। না হলে মাসিকে আবার আসতে হবে।
আমি ওঠার সময় নীপার বুকটা একটু টিপে দিলাম।
-ওঃ দুষ্টু কোথাকার, দাঁড়াও মিত্রাদিকে বলছি গিয়ে।
ওর দিকে ফিরে একটু হাসলাম।
পুকুর ঘাটে হাত-মুখ ধুয়ে নিজের ঘরে চলে এলাম, কেউ নেই।
ইসলামভাই মনেহয় ও বাড়িতে গেছে।
আমি মিটসেফের ওপর থেকে পাজামা পাঞ্জাবীটা নিলাম। একেবারে নতুন, তার সঙ্গে গেঞ্জি ড্রয়ার সব নতুন। ব্যাপারটা মাথায় ঢুকছে না। আবার নতুন পোষাক কেন? দেখেছি অকাজের কথা বেশি ভাবতে গেলে সব কেমন উল্টপাল্টা হয়ে যায়।
ছোটোমার ব্যাপারটা যেমন হলো, কি যে একটা বিচ্ছিরি স্বপ্ন দেখলাম। মনটা সমানে খচ খচ করছে।
দরজাটা ভেজিয়ে দিলাম। ভিঁজে গামছা দিয়ে ভালো করে গা মুছলাম।
খট খট করে দরজায় আওয়াজ হলো।
কে?
খোল।
আর কে আছে তোর সঙ্গে?
কেউ নেই।
আমি দরজা খুললাম। মিত্রা ভেতরে এলো। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে।
একটা সুন্দর গন্ধ মিত্রার শরীর থেকে ভেসে আসছে। ঘরটা গন্ধে ভরে গেল।
কিরে সব নতুন নতুন।
কোথায় নতুন দেখছিস!
দেখছি পাট ভাঙা কাপর পরেছিস। আবার বলছিস কোথায় নতুন?
পূজো দিতে যাব।
কোথায় পূজো দিবি!
যা বাবা, সাত কান্ড রামায়ন পড়ে, সীতা কার বাপ।
পীরবাবার ওখানে পূজো দিবি!
হ্যাঁ।
ওটা একটা অশ্বত্থগাছ। আর কিছু নেই। চারিদিক শুনশান।
তোকে অতো ভাবতে হবে না। বড়োমার হুকুম, চোখবুঁজে তামিল করে যা।
মনে হচ্ছে একটা কিছুর গন্ধ পাচ্ছি।
একথা বলছিস কেন!
নীপা একখানা জমপেশ মাল লাগিয়েছে। তুই। তারপর দেখবো বড়োমা, ছোটোমা।
সবাই পরেছি। তোর আপত্তি আছে?
একটুও না।
নীপারটা কেমন হয়েছে রে, দারুন লাগছে না ওকে, এখন মনে হচ্ছে অনির পরিবারের মেয়ে? তাই না?
আমি মিত্রার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। খুশির সোনালী রং ওর চোখে মুখে।
গ্রামের ছেলেগুলোকে জানিস না। জিভ দিয়ে চাটতে না পারলেও, চোখ দিয়ে চেটে খাবে।
মিত্রা আজ শুধু মুখে কথা বলছে না। চোখ দিয়েও কথা বলছে।
তুইও নিশ্চই ওরকম ছিলি। নে পর।
তুই বেরো।
আমি বেরোবার জন্য আসিনি।
তাহলে কি করতে এসেছিস?
তোকে দেখতে, দেখাতে।
বুঝেছি দরজাটা বন্ধ কর।
ওটা আগেই করে দিয়েছি।
ওদিকে ফিরে তাকা।
দাঁড়া তোর বক বক বার করছি।
একবারে গায়া হাত দিবি না
মিত্রা এগিয়ে এলো। আমার পাজামায় হাত দিয়ে খামচে ধরলো।
দিলে কি করবি বল।
কামরে দেবো ঠোঁটে। সাজ-পোষাক নষ্ট করে দেবো।
একেবারে গায়ে হাত দিবি না।
মিত্রা আমার চোখে চোখ রাখলো। ওর চোখ বলছে আজ ওর সবচেয়ে খুশির দিন, পরিতৃপ্ত চোখের মনি দুটো। আই লাইনার দেওয়া চোখ দুটো বেশ বড় বড় দেখাচ্ছে।
এতো সেজেছিস কেন? কে দেখবে এই অজ গাঁয়ে। তাও আবার ভর সন্ধ্যে বেলা।
তুই।
আমি তোকে দিনরাত দেখি।
নতুন করে দেখবি।
আজ মনে হচ্ছে তোরা কিছু একটা ঘোটালা পাকাচ্ছিস।
কি!
মাথা খাটাতে ইচ্ছে করছে না।
বেশি মাথা খাটাস না, বুড়ো হয়ে যাবি তারাতারি।
আমি গেঞ্জি-ড্রয়ার পরে পাজামা পাঞ্জাবী পরলাম।
তোকে আজ দারুন লাগছে, আমার পছন্দের কালার।
এই গেরুয়া রংটা তোর পছন্দের!
হ্যাঁ।
আমি মিত্রার দিকে তাকালাম, চোখ চক চক করছে।
একটু সেন্ট লাগিয়ে দিই।
অন্য সময় হলে না বলতাম, কেন জানি না ওকে না বলতে পারলাম না, সবারই কিছু না কিছু কষ্ট আছে, মিত্রারও আছে।
দে। বেশি দিস না।
মিত্রা ফস ফস করে, আমার বগলে গায়ে সেন্ট স্প্রে করে দিলো।
আমি রেডি। চল এবার।
আমি বেরোতে গেলাম, মিত্রা আমার হাত টেনে ধরলো।
চলবে —————————
from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/v4Chxbi
via BanglaChoti
Comments
Post a Comment