❝কাজলদীঘি❞
BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়
৬১ নং কিস্তি
—————————
আমি এতক্ষণ মটকা মেরে পরেছিলাম। এবার একটু নরেচড়ে উঠলাম, পাশ ফিরলাম। ছোটোমা আমার কপালে হাত দিল।
ও অনি এবার ওঠ, অনেক বেলা হলো। তোর জন্য আমরা সবাই বসে আছি।
আমি চোখ মেলে তাকালাম। দেখলাম সবাই আমার দিকে জুল জুল করে চেয়ে আছে। আমি ফিক করে হেসে আড়মোড়া ভাঙলাম। একটু সরে এসে ছোটোমার কোলে মাথা রাখলাম।
ওঠ বাবা ওঠ।
কটা বাজে গো ছোটোমা।
দুটো বেজে গেছে।
আমাকে ডাক নি কেন!
ওঠ আর ঢং করতে হবে না। মিত্রা বললো।
ভালোই তো ঘুমলি।
তোর থেকে কম।
তোর থেকে তিনঘণ্টা পরে ঘুমিয়েছি।
তেমনি তোর আগে উঠেছি।
কখন উঠেছে? ছোটোমার দিকে তাকালাম।
অনেকক্ষণ।
এরা তিনজন এ ঘরে কি করছে?
তোকে পাহাড়া দিচ্ছি।
আজও ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আবার লেকচার ঝাড়লি।
রেকর্ডিং করেছিস।
ওমা কি শয়তান দেখেছো ছোটোমা। ইসি বললো।
মিত্রা ঘুসি পাকিয়ে তেড়ে এলো, আমি ছোটোমার কোল থেকে গড়িয়ে খাটের আর একপাশে চলে গেলাম। মিত্রা বিছানার ওপর ঘুসি মারলো।
দাঁড়া তোকে দেখাচ্ছি।
মিত্রা খাটের ওপর উঠে এলো।
আমি কিন্তু গণ্ডগোল করে দেব।
কর না কর। তুই তো সব সময় গণ্ডগোল করছিস।
একিরে তোরা কি দুজনে ঘুসো ঘুসি করছিস! দেখলাম দরজার মুখে বড়োমা, বৌদি।
দেখছিস দেখছিস সুতপা কাণ্ড দেখ। বড়োমা বললো।
বৌদি হাসছে।
ছোটো তুই ওখানে বসে কি করছিস? বড়োমা বললো।
এতক্ষণ তোমার ছেলের কর্তি কলাপ শুনলাম, এখন ঘুসো-ঘুসি দেখছি।
কেন, আবার কি করলো!
বড়োমা, বৌদি ঘরের ভেতর এলো।
ছেড়ে দিলাম।
মিত্রা বিছানা থেকে নেমে এলো।
তুই সং-এর মতো দাঁড়িয় আছিস কেন। তোকে ডাকতে পাঠালাম এসে জমে গেলি।
মিলির দিকে তাকিয়ে বড়োমা বললো।
এবার ওকে নিয়ে পরেছে। জিজ্ঞাসা করো। মিত্রা খ্যাড় খ্যাড় করে উঠলো।
তোকে বলেছে?
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বক বক করছিল।
ও ওরকম করে। তা বোলে কি….।
দেখলি দেখলি দিদিভাই, বড়োমার কথা শুনলি। বুবুন কোনও দোষ করে না। একবারে ধোয়া তুলসী পাতা।
তুই যে সকাল বেলা ফোন বন্ধ করে রেখেছিলি।
সেটাও তোমার ছেলের কথায়।
ওর কথা শুনিস কেন?
মিত্রা বড়োমাকে জড়িয়ে ধরলো। গালে গাল ঘোষে বললো, তুমিও বলবে।
তাহলে, দেখিস ও কোনও অন্যায় করে না। করলেই নয় তোকে নয় আমাকে এসে বলবে। দুজনকে যদি না পায় তাহলে ছোটোকে বলবে। বলে কিনা বল।
মিত্রা বড়োমার গলা জড়িয়ে ধরে আছে।
আমি ওদের দিকে তাকিয়ে আছি।
দেখছো দেখছো, চোখদুটো কেমন ছোটো ছোটো করে দেখছে। মিত্রা বললো।
কিরে বসে থাকলে হবে। সকাল থেকে গোটা চারেক লুচি খেলি, যা স্নান সেরে নে। বৌদি বললো।
একটু চা খাওয়াবে।
না হবে না ভাগ। ছোটোমা বললো।
আমি করে নিয়ে আসবো ছোটোমা। মিলি বললো।
ছোটোমা হাসলো।
যা নিয়ে আয়।
মিলি বেরিয়ে যাচ্ছিল।
আর শোন।
মিলি থমকে দাঁড়াল
মনার বউটাকে ডেকে দে।
মনার বউ এসেছে! আমি বললাম। উঠে বসলাম।
সকাল থেকে হত্যে দিয়ে পরে আছে। অনিদার সঙ্গে দেখা না করে যাবে না। বড়োমা বললো।
একা না আর কেউ আছে?
পাঁচ সাতজন আছে।
আমি খাট থেকে নেমে এলাম। টেবিলের কাছে গিয়ে মোবাইলটা নিলাম।
কনিষ্ককে ফোন করবি তো? মিত্রা বললো।
হ্যাঁ।
ওরা ভালো আছে। তুই উঠলে আমাকে ফোন করতে বলেছে। তাহলে আসবে।
সকালে বলছিল শ্যামেরা এসেছে।
সেটাও মাথায় আছে। ছোটোমা বললো।
হাসলাম।
তোর বায়োডাটা এখনও অসম্পূর্ণ, এবার পুরোটা দিস।
মাথা নীচু করে থাকলাম।
বাপের জন্মে এরকম ছেলে দেখিনি।
আমি মুখ তুলে ছোটোমার দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
আর হাসিস নি।
দেখো ইসি কেমন ভাবে আমাকে দেখছে। কি ভাবছে বলো তো।
ভাবাভাবির কিছু নেই। দু-দিনে ও আমাদের মতো সেগুনকাঠ হয়ে গেছে। সহজে আর ঘুন ধরবে না। তাও তোর দু-আনা দেখেছে। আর একজনকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পারাতে হচ্ছে।
মনার বৌ মালতী ঘরে ঢুকলো। কোলে মাস সাতেকের বাচ্চা। চোখ ছল ছলে। ওর পেছন পেছন আরও চার পাঁচ জন। ওদের আমি দেখেছি নাম জানি না।
আমি এগিয়ে গেলাম। মিলি চায়ের পট নিয়ে ঘরে ঢুকলো। ওরা যে যার আমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো।
থাক থাক।
মালতী কাঁদছে।
আমি বাচ্চাটার মাথায় হাত দিলাম। নরম তুলতুলে মাথাটা, আমার স্পর্শ পেয়ে নড়ে উঠলো। পিট পিট করে তাকাচ্ছে। আমার পাশে মিত্রা, ইসি, ছোটোমা, বড়োমা, বৌদি।
মনাকে দেখেছিস?
মালতী মাথা দোলালো।
ঠিক হয়ে যাবে। কাঁদিস না।
বাচ্চাটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
এটা ছেলে না মেয়ে?
ছেলে।
বাঃ।
তুমি ওকে একটু কোলে নাও।
দাঁড়া বাবু হয়ে বসি। না হলে নিতে পারবো না।
আমি মাটিতে বসলাম। মালতী আমার কোলে বাচ্চাটাকে দিল। বেশ গোলগাল। মনার মতো গায়ের রং কালো। চক চক করছে।
নীরুদা ইঞ্জেকসন দিয়েছে?
দুটো দিয়েছে। আবার আগামী মাসে যেতে বলেছে।
নিয়ম করে ইঞ্জেকসন দিবি।
আমার কি হবে অনিদা।
সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি মনার বৌ-এর মাথায় হাত রাখলাম।
বাচ্চাটা আমার কোলে ভীষণ নড়া চড়া করছে। আমি ঠিক মতো ম্যানেজ করতে পারছি না। ইসি-মিত্রা আমার রকম সকম দেখে হাসছে। তারপর দেখলাম কেমন ভিঁজে ভিঁজে লাগছে।
ও মালতী দেখ দেখ ব্যাটা মনে হয় পেচ্ছাপ করলো। কেমন কেমন লাগছে।
ইসি, মিত্রা, মিলি জোরে হেসে উঠলো।
বাচ্চাটা চোখ বড়ো বড়ো করে চারদিক ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে।
মালতী আমার কোল থেকে বাচ্চাটাকে তুললো। সত্যি ব্যাটা আমার কোলে মুতে দিয়েছে। পাঞ্জাবী কুর্তা ভিঁজে একসা হয়ে গেছে।
খেয়েছিস?
মালতী মাথা দোলালো।
বাড়ি যাবি কি করে?
ভক্তা এসেছে।
টনার বৌ আসে নি?
ও পোয়াতি। অনিকেতদা এখন বেরতে বারণ করেছে।
যা নিচে যা। আমি স্নান সেরে যাচ্ছি।
ওরা নিচে চলে গেল।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। মিত্রা, ইসি, মিলি আমাকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে দেখছে। ছোটোমা, বড়োমা, বৌদির চোখে বিষ্ময়।
দাও চা দাও। খেয়ে বাথরুমে যাব।
দিলো মুতে তোর গায়ে। মিত্রা বললো।
এরকম অনেক বাচ্চাই মোতে, আবার গায়েই শুকিয়ে যায়।
তারমানে!
তিনজনে একসঙ্গে বলে উঠলো।
আমি হাসলাম, চায়ের কাপে চুমুক দিলাম।
তোর কটা বাচ্চা আছে?
বুঝবে না।
দেখ ছোটো এই টুকুর জন্য ওরা সকাল থেকে বসে আছে। বৌদি বললো।
নাগো বৌদি ঠিক তা নয়। ওরা ঋণ শোধ করতে জানে। আর একটা সবচেয়ে বড়ো ব্যাপার ওরা বেইমান না। ওরা উপকারীর উপকারটা স্বীকার করে। ওরা যে অশিক্ষিত।
ইসি আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে।
তুই ওদের ওখানে কখন যাস।
ঠিক নেই, মন খারাপ হলে যাই। বলতে পার ওদের ওখানটা আমার এনটারটেনমেন্টের জায়গা। ওদের সঙ্গে কথা বললে মন ভালো হয়ে যায়।
বৌদি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বড়োমার চোখে হাজার প্রশ্ন।
মিত্রা।
বড়োমার ডাকে মিত্রা ফিরে তাকাল।
ওকে ইসির আনা পাজামা পাঞ্জাবীটা বার করে দে।
আবার নতুন!
ভালো লাগছেনা বল। মিত্রা ফুট কাটল।
ইসি হাসছে।
অনিকে ঠিক নতুন জামা কাপরে মানায় না, তাই না।
আমি মিত্রার দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
আয় তাড়াতাড়ি, ওরা আবার এসে পরবে। বড়োমা বললো।
আবার কারা আসবে?
তোর অনিমেষদা, তার সাঙ্গ পাঙ্গ। তুই তো ওদের ভাবিয়ে তুলেছিস। বৌদি বললো।
তুমি বিশ্বাস করো।
বিশ্বাস করতাম না। এখন সব শুনে বিশ্বাস করতে হচ্ছে।
সুরো কোথায়?
কলেজে গেছে। এসে খাবে।
ওকে একবার ফোন করে দাও।
তুই রেডি হ। চলে আসবে।
ওরা চলে গেল, আমি টাওয়েলটা নিয়ে বাথরুমে ঢুকলাম। শরীরটা এখন বেশ ঝড়ঝড়ে লাগছে। ভালো করে স্নান করলাম। বার বার টনা, মনার মুখটা ভেসে আসছে। মালতীর মুখটা ভেসে উঠছে। বাচ্চাটার মুখ, চোখের সামনে জ্বল জ্বল করছে। আমি যখন বাচ্চাটাকে কোলে নিলাম তখন মিত্রার মুখটা লক্ষ্য করছিলাম। কি পরিতৃপ্ত মুখ। মা হওয়ার জন্য কতটা উদগ্রীব। আমার দিকে এমন ভাবে তাকিয়েছিল আমিই লজ্জা পেয়ে গেছি। সবার চোখ এড়ালেও ছোটোমার চোখ এড়াতে পারিনি।
মালতী বাচ্চাটাকে যত্ন করে। তাছাড়া ওরা প্রকৃতির কোলে লালিত পালিত। ওদের ওখানে গিয়ে বেশ কয়েকবার দেখেছি, দুধের বাচ্চাগুলোকে চপচপে করে তেল মাখিয়ে রোদে ফেলে রাখে। ওদের কাছে অলিভ অয়েল স্বপ্ন। ঘানিতে ভাঙা কাদানি সরষের তেল ভাল করে মাখিয়ে ফেলে রেখে দিল। মালতীর বাচ্চাটা হাসপাতালে হয়েছে। নীরু, কনিষ্ক ছিল। হওয়ার পর আমাকে ফোন করেছিল।
কিরে আরও কতো সময় লাগবে। মিত্রার গলা।
দাঁড়া বেরচ্ছি।
আমি পাজামা, পাঞ্জীবীটা জলে চুবিয়ে ভালো করে ধুয়ে দিলাম।
টাওয়েল পরে বেরোলাম।
মিত্রা বাথরুমের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে। আমি বেরতেই একেবারে মুখো মুখি। ডাগর চোখে আমার দিকে তাকিয়ে। দরজা ভেজানো। ছিটকিনি দেওয়া নেই। বুঝলাম দুষ্টুমি করবে না।
একটু ধরি।
আবার কি হলো!
তোকে না ধরতে পারলে ভালো লাগে না।
দরজা খোলা আছে।
এমনি তোকে একটু জড়িয়ে ধরবো।
বাবা এতো ভদ্র হলি কবে থেকে!
আজ থেকে।
কেন।
তুই আমার মাথাটা অনেক উঁচু করে দিয়েছিস।
তোর মাথা নীচু ছিল নাকি?
মাটির সঙ্গে মিশে ছিল।
বাবা অতো বড়ো কাগজের মালকিন।
একবারে মালকিন মালকিন করবি না বলে দিচ্ছি।
হেসে ফেললাম।
দে পাজামা, পাঞ্জাবীটা দে পরে নিই।
মিত্রা আমাকে জাপ্টে ধরে আছে। খাটের কাছে এলাম।
এটা কি ইসি কিনে এনেছে?
আজ গিয়ে কিনে এনেছে।
হঠাৎ।
জানিনা, জিজ্ঞাসা করিস।
মালতীরা তোর জন্য গলদা চিংড়ি নিয়ে এসেছে।
কেন?
তুই বিয়ে করেছিস।
হাসলাম।
তোকে কি ভালোবাসে। তোর জন্য আমিও একটু পেলাম।
আমি না থাকলেও পেতিস।
আমাকে একবার নিয়ে যাবি?
কনিষ্করা প্রায় যায়, ওদের সঙ্গে চলে যাস।
তুই নিয়ে যাবি না?
আমার কোনও দিনক্ষণ নেই। তোর অফিসের ঝামেলা যখন মেটাচ্ছিলাম তখন ওখানে গিয়ে পড়ে থাকতাম। ওরাও আমার অনেক কাজ করে দেয়। মাস দুয়েক যাইনি।
মিত্রার সঙ্গে কথা বলতে বলতে পাজামা, পাঞ্জাবী পরলাম। পাঞ্জাবীর হাতাগুলো বেশ বড়ো, মিত্রা হাতাটা ভাঁজ করে দিল।
জানিস বুবুন যে দিদিভাই আজ ছয় বছর আমাকে একটা ফোন করেনি। আমার খোঁজ খবর নেয়নি, আজ আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, জানিস ছুটকি একটা বড়ো ভুল করে ফেলছিলাম।
আমি মিত্রার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম। সব তোর জন্য।
আমার জন্য কেন?
তুই আমাকে যদি মালিক না বানাতিস তাহলে আমি এই কাজ করার সুযোগ পেতাম না।
তুই আমাকে টুকলি।
একটুও না, তুই বিশ্বাস কর। তুই একটু ভেবে দেখ। তুই তোর মতো আছিস, আমি আমার মতো আছি। তাহলে কি এই ঘটনাগুলো ঘটতো।
না।
তাহলে—
তুই মালিক বানালি, পর পর ঘটনা ঘটে চলেছে। আমি শুধু তোর সেফটি দেখতে চাইছি। পাচ্ছি কই। সবার স্বার্থে আঘাত লাগছে। আমি পরিষ্কার করতে চাইছি।
ঠিক বলেছিস।
চল। এবার যাই। না হলে ছোটোমা এসে হাজির হবে।
তোর পারফর্মেন্সে ছোটোমা সবচেয়ে খুশী।
জ্যেঠিমনি?
কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।
সকাল থেকে আমাদের যারা আত্মীয় আছে সবাইকে ফোন করা হয়ে গেছে। যেই শুনেছে তুই ছুটকির বড়। সবাই সকাল থেকে একবার করে এসে চলে গেছে। তোর ঘুমন্ত শরীরটা ঘরে এসে দেখে, তোর ঘুমেরও প্রশংসা করে সকলে।
আমি মিত্রার মুখের দিকে তাকিয়ে।
সত্য বলছি বিশ্বাস কর।
জ্যেঠিমনিকে বলেছে ওই বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান করো।
জ্যেঠিমনি কি বললো?
ওর মতি গতির কথা শুনছো তো। আগে হ্যাঁ বলুক, তারপর। জ্যেঠিমনিকে কেউ ছেড়ে কথা বললো না। দু-একটা কথা শোনাল।
সেই জন্য তোর মাথাটা উঁচু হয়ে গেছে।
মিত্রা চোখ বুঁজিয়ে মাথা দোলাল।
দুজনে বেরিয়ে এলাম।
নীচে নামলাম। মালতী শিঁড়ির কাছে বসে আছে। বাচ্চাটাকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে। আমাকে দেখে বাচ্চাটার মুখে কাপর চাপা দিল। আমি কাছে গেলাম।
ভক্তা কইরে?
সে পাশে গেছে।
একবার ডাক।
একজন উঠে গিয়ে ভক্তাকে ডেকে নিয়ে এলো। আমাকে দেখেই পায়ে হাত দিল।
কিরে বাড়ি যাবি?
বড়োমা বললো খাবার দেবে।
কিসে যাবি?
ট্রলি নিয়ে এসেছি।
যেতে পারবি?
খুব পারবো।
আমি মানি পার্টস থেকে দুটো পাঁচশো টাকার নোট মালতীর হাতে দিতে গেলাম।
নাগো অনিদা আছে।
থাক, তবু রাখ, কাজে লাগবে।
সকালে অনিকেতদা দিয়ে এসেছে।
বাধ্য হয়ে পার্সে ঢুকিয়ে রাখলাম। মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
তুমি সকাল থেকে কিছু খাও নি, আগে খেয়ে নাও। তুমি খেয়ে উঠলে আমি যাব। মালতী বললো।
কেন, মনা বলে দিয়েছে।
মালতী চুপ করে রইলো।
বাইরের গেটে ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল। দেখলাম বটা, নীরু, কনিষ্ক, অনিকেত নামছে।
নীরু ট্যাক্সি ভাড়া দিল। আমি এগিয়ে গেলাম। আমার পাশে পাশে মিত্রাও এলো।
কিরে খাওয়া হয়েছে?
না।
শরীর ঠিক আছে?
হ্যাঁ। টনা, মনা কেমন আছে?
টনা ঠিক আছে, মনা একটু সমস্যা করেছিল। এখন ঠিক আছে। কাল ছেড়ে দেব।
চোখটা?
যা ভয় করেছিলাম তা নয়। স্যার দেখে বললেন, একটু বেশি ধাক্কা লেগে গেছে। ওষুধ চলবে। কনিষ্ক বললো।
সারতে কতদিন লাগবে?
দিন পনেরো লাগবে।
পেছনে দেখলাম মালতী দাঁড়িয়ে আছে।
কিরে তুই বাড়ি যাস নি! নীরু মালতীর দিকে তাকিয়ে বললো।
মালতী মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
সব ঠিক আছে, চিন্তা করতে হবে না।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে এলাম। বারান্দায় বড়োমা, ছোটোমা দাঁড়িয়ে।
খাবার রেডি করো, বহুত খিদে লেগেছে। কনিষ্ক চেঁচিয়ে উঠলো।
কনিষ্ক, অনিকেতের দিকে তাকাল।
অনিকেত ওষুধের প্যাকেটটা ভক্তার হাতে দে, ও টনার বউকে দিয়ে দেবে।
কিসের ওষুধ! আমি বললাম।
টনার বৌ-এর।
ওর আবার কি হলো!
তোর হোক বুঝবি।
নীরু এমন ভাবে বললো, মিত্রা পর্যন্ত ফিক করে হেসে ফেললো।
আমি নীরুর দিকে তাকালাম!
নীরু জমা হয়ে গেলি, ব্যাপারটা মাথায় রাখিস। বটা বললো।
অনি বললো কেন।
আমি কিছু জানি না। তুই সামলাবি।
আজ একটা ঝামেলা হয়ে গেল, বুঝলি অনি। কনিষ্ক বললো।
কাজের কথাটা বল। নীরু বললো।
আমি কনিষ্কর দিকে তাকালাম।
সুপারের সঙ্গে একচোট আজ হয়ে গেল।
কেন!
সকালে তিনটে একসিরা কাটার ছিল। যা ক্যাচাল বাধল। হাসপাতালে যেতে দেরি হয়ে গেল। একটা করতে পেরেছি। আর দুটো হয়নি।
পেসেন্ট কিছু বলছিল?
না।
তাহলে!
আমাদের এখনকার সার্জারীর হেড ডিপটা হারামী। বক বক করছিল।
তারপর।
দিলাম ঝাড়।
তারপর।
দেখি সুপারকে রিপোর্ট করেছে। মেজাজ গরম ছিল। শালা পার্টি দেখাচ্ছিল—
দাঁড়া কালকেই করকে দিচ্ছি। ওর সাতদিনের ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দেব।
তোকে করতে হবে না। কনিষ্ক হাই তুলে এসেছে। বটা বললো।
মানে!
ন্যানো, সব বোঝ এটা বোঝ না। নীরু বললো।
মিত্রা হাসছে।
তোর বউ বুঝেছে তুই বুঝিস নি? কনিষ্ক বললো।
আমি মিত্রার দিকে তাকালাম।
ওরা সবাই হাসে।
ওর মাথায় এখন ওটা নেই। ওই যে কনিষ্ককে সুপার দু-চার কথা শুনিয়েছে। সেদিকে কনসেন্ট করেছে। মিত্রা বললো।
তোকে কিছু করতে হবে না। এমনি তোর নাম শুনে প্যান্ট হলুদ হয়ে গেছে। নীরু বললো।
আমি তাকিয়ে আছি।
নীরু আমার চোখের সামনে দু-বার হাত নাড়াল।
ফিরে আয় বাবা মর্তে ফিরে আয়। কনিষ্কর কিছু হয়নি।
সবাই হাসছে।
আমরা বারান্দায় চলে এসেছি।
বুঝলে বড়োমা তোমার অনিকে বেশামাল করতে আমাদের বেশি সময় লাগবে না। এক ডোজ, ব্যাস অনি বেশামাল। পুরো ওপরে চলে গেছে। কিছুতেই মর্তে নামাতে পারছি না। নীরু বলে চলেছে।
তারপর কি হলো—আমি বললাম।
তোর পায়ে ধরছি, কিছু হয়নি। সব ঠিক হয়ে গেছে, সুপার সাহেব ঘেমে চান করে গেছে। নীরু বলে উঠলো।
কাজ মিটে গেছে।
হ্যাঁ বাবা, কাজ মিটে গেছে।
যাক বাবার এবার মর্তে আগমন হলো বুঝলি কনিষ্ক। নীরু চেঁচিয়ে উঠলো।
দেখলাম বসার ঘর থেকে ইসি বেরিয়ে এলো ওরা সবাই হাসাহাসি করছে। মিত্রা এগিয়ে গেছে। ও মনে হয় সবাইকে বললো। বড়োমা আমার দিকে কেমনভাবে যেন তাকিয়ে আছে। আমি গিয়ে সোফায় বসলাম। আমার একপাশে কনিষ্ক, আর একপাশে নীরু বসলো।
বড়োমা খিদে পেয়েছে। নীরু চেঁচিয়ে উঠলো।
আমি পকেট থেকে মোবাইলটা বার করে ডায়াল করলাম।
কিরে কাকে ফোন করছিস। আমি জানি তোর ঘোর এখনও কাটেনি। কনিষ্ক বললো।
কেন তুই বলতে গেলি। নীরু বললো।
যা পারিস কর, আর ভালো লাগছে না। কনিষ্ক বললো।
অর্ক।
হ্যাঁ দাদা।
তুই কয়েকদিন আগে একটা আর্টিকেল লিখে আমাকে দেখিয়েছিলি মনে আছে।
মেডিকেল কলেজের ওপর।
হ্যাঁ।
ছবি করেছিস?
না।
সায়ন্তনকে পাঠিয়ে দে। কি ভাবে ছবি করবে বলে দে।
ঠিক আছে।
আর শোন। ছবি গুলো প্রিন্ট করে লেখাটা রাতে দাদার হাতে পাঠাবি। যেন দেখতে না পায়।
আচ্ছা।
আজকে অশ্বিনীনগরের লেখাটা নামিয়েছিস।
হ্যাঁ।
দাদাকে দিয়েছিস?
দাদা বললো, তোমার সঙ্গে কথা বলে ফাইন্যাল করবে।
দাদাকে বল ওটা ছেড়ে দিতে। কালকে যেন কাগজে বেরোয়।
আচ্ছা।
ফোনটা পকেটে রাখলাম।
হয়েছে এবার, শান্তি। মাথা থেকে ক্যালাটা নামলো। নীরু খেঁকিয়ে উঠলো।
আমি হাসলাম।
তোকে কিছু করতে হবে না। কতবার বলছি সুপার তোর নাম শোনার পর থেকে পঞ্চাশবার কনিষ্ককে ফোন করেছে। ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে। কেনো হুলোটা দিবি।
অন্যায় করলে শাস্তি পেতে হবে।
মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা মেরে লাভ কি।
বলবে কেন।
বেশ করেছে বলবে, তোর কি।
বললেই হলো।
মিত্রা কাছে এসে দাঁড়াল
খিদে লেগেছে। তোর লাগেনি?
চল।
উঠে দাঁড়ালাম।
বড়োমা, দামিনীমাসি, ইসলামভাই কাউকে দেখতে পাচ্ছিনা।
সব কি তোর জন্য এখানে খুঁটি গেড়ে বসে থাকবে। তাদের কি কোনও কাজ-কম্ম নেই।
ও আচ্ছা।
আবার কি হলো।
না, কিছু হয়নি।
তোর কাজ করতে গেছে। অনুপ বাড়ি দেখাতে নিয়ে গেছে। বড়োমা চেঁচাল।
দাও, খেতে দাও।
মিত্রার দিকে তাকালাম।
টিনা, অদিতিরা কোথায়?
অফিসে গেছে।
বড়োমার দিকে তাকালাম।
কোথায় বসবো?
টেবিলে।
সবার এক সঙ্গে হবে না।
তোরা খেয়ে নে তারপর খাব। বড়োমা বললো।
নীচে বসলে হতো না।
ও কবিতা, মা টেবিল সরিয়ে নিচে জায়গা কর।
কবিতার দিকে তাকালাম। হাসছে।
ঘুমিয়ে শরীর ভালো হয়ে গেছে। মাথার পোকাগুলো আবার কিলবিল করতে শুরু করেছে। বড়োমা চেঁচাচ্ছে।
হাসলাম।
মিত্রার দিকে তাকালাম।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কোমড় দোলাচ্ছিস কেন, হাতে হাতে জায়গা কর না।
ওকে ধমকাচ্ছিস কেন। আবার কোথাও বেরবার মতলব করছিস নাকি। আজ বেরবার নাম করলেই ঠ্যাং ভাঙবো। ছোটোমা চেঁচিয়ে উঠলো।
আমার কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। আমি পকেট থেকে ফোনটা বার করলাম।
মিত্রা ওর কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে নে। বড়োমা চেঁচালো।
মিত্রা এগিয়ে এলো।
উঃ দাঁড়া না। বড়োমা বললো, অমনি নাচতে নাচতে চলে এলি।
কাকে ফোন করছিস?
কাজ আছে।
টিনা।
হ্যাঁ।
কোথায় তুমি?
অফিসে।
সে তো বুঝলাম।
তাহলে।
মিত্রার ঘরে না অন্য কোথাও।
সনাতনবাবুর কাছ থেকে ফিরছি।
হাওয়া কি রকম?
গিয়ে বলবো।
তুমি একটা কাজ করতে পারবে?
বলো।
একবার সুজিতদাকে ফলো আপ করবে।
সুজিতদা সকালে চেক পাঠিয়ে দিয়েছে। একটা চিঠি তোমাকে দিয়েছে। আমি এবার বেরচ্ছি।
আমরা খেতে বসছি, চলে এসো।
ঠিক আছে।
নির্মাল্য, দেবা কোথায়?
কিছুক্ষণ আগে ঢুকেছে। অদিতির ঘরে।
ওদেরকেও সঙ্গে করে নিয়ে চলে এসো।
আচ্ছা।
ফোনটা কেটে পকেটে রাখলাম।
মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
কিরে সুজিতদা চেক পাঠিয়েছে?
মাথা দোলালাম।
কি ম্যাডাম আবার আমদানি? নীরু বললো।
মিত্রা মাথা দোলাল।
সেই মডেল কন্যা।
মিত্রা হেসে ফেললো।
বটা তুই অনিকে সামলে দিস, আমি ঝিমিকে….।
নীরুর কথায় বটা কট কট করে তাকাচ্ছে। ইসি হাসছে।
এই নীরু এখন আর ফক্করি করতে হবে না। জায়গা হয়ে গেছে। ছোটোমা বললো।
আমি গিয়ে একটা ধারে বসলাম।
তুই ওখানে বসবি না। ছোটোমা বললো।
তাহলে।
মাঝখানে।
কেন।
বোস তারপর বুঝতে পারবি।
আচ্ছা।
ইসি হাসছে।
আমি উঠে পরলাম।
ইসি, জ্যেঠিমনি কোথায়?
ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি।
খেয়েছে।
হ্যাঁ।
পিকু।
পিকু তার দিদার কাছে শুয়ে ঘুমচ্ছে, বরুণদা তোর অফিসে গেছে। কাজ আছে।
আমি চুপ করে থাকলাম।
আর কোনও খবর নেওয়ার আছে।
না।
তুই কি এখনও মর্তে ফিরিস নি। নীরু চেঁচিয়ে উঠলো।
তখন থেকে খালি মর্তে মর্তে করে চেঁচাচ্ছিস, আমি কখন স্বর্গে গেলাম।
এখনও স্বর্গে বিচরণ করছিস।
চুপ করে থাকলাম।
ফোনটা বেজে উঠলো। পকেট থেকে বার করে দেখলাম, দাদার ফোন।
বলো।
খেয়েছিস?
না খেতে বসছি।
থাক, তাহলে পরে বলবো।
না বলো।
কে ফোন করেছে রে মিত্রা। বড়োমা রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে উঠলো।
শুনতে পাচ্ছি না।
কিরে তোর বড়োমা চেঁচাচ্ছে।
ও তো সব সময় চেঁচায়।
দাদা ফোন করেছে। মিত্রা চেঁচালো।
আমাকে একটু দিবি কথা বলবো। বড়োমা বললো।
শুনতে পাচ্ছ।
শুনছি।
বলো।
অর্ক এসেছিল।
ওই রিপোর্টটা করে দাও। দরকার আছে। শুধু রাজনাথের ভাইপো এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে, সেটা উল্লেখ করে দেবে। পারলে সিংজীর সঙ্গে কথা বলে নেবে।
সিং একটা ফাইল পাঠিয়ে দিয়েছে।
ডিটেলস আছে।
আছে।
তাহলে ছেড়ে দাও।
অনুপ বারন করছিল।
কিসের জন্য।
তুই একবার কথা বল।
তুমি কথা বলে নাও।
না তুই বল।
ঠিক আছে কথা বলে নিচ্ছি।
আমি ফোনটা মিত্রার হাতে দিলাম। মিত্রা রান্নাঘরের সামনে গেল।
বড়োমা কথা বলছে। আজ কোনও রাগা রাগি নয়। বেশ হেসে হেসে কথা বলছে। বুঝলাম খুব খুশ।
কিরে তুই এখনও ঠিক হোসনি—ইসি বললো।
কেন, আমি ঠিক আছি।
ওই যে ডাক্তার বলছে।
কে।
নীরু।
ওটা একটা ছাগল।
হ্যাঁরে আমি ছাগল, তুই কি। নীরু চেঁচালো।
আমি হাসছি।
মিত্রা আমার হাতে ফোনটা দিল।
তুই ওকে এখন জিজ্ঞাসা করে ঠিক উত্তর পাবি না। মিত্রা ইসির দিকে তাকাল।
ইসি হাসছে।
তোর সঙ্গে কথা বলছে ঠিক কিন্তু মাথাটা অন্য জায়গায়।
ফোনটা নিয়ে ডায়াল করলাম।
আবার কাকে ফোন করছিস। মিত্রা বললো।
আবার বিরক্ত করে।
আমি আসন ছেড়ে ঘর থেকে বারান্দায় বেরিয়ে এলাম।
তুমি কোথায়?
তোর বাড়ির সামনে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে পৌঁছে যাব। কেন?
একটু দরকার ছিল।
অপেক্ষা কর পৌঁছে যাচ্ছি।
আচ্ছা।
একটু থাম না, ভালো লাগছে না।
আমি মিত্রার দিকে তাকালাম।
সব সময় পেছন পেছন ঘুরলে চলবে। ডাক্তারদাদা কোথায় রে?
কাজে গেছে।
খাবে না?
এসে খাবে।
কখন আসবে?
খবর চলে গেছে, আসছে।
তুই এখন যা। পেছন পেছন ঘুর ঘুর করিস না।
যাব না কিছু করতে পারবি।
মহা মুস্কিল।
ম্যাডাম চলে আসুন, মর্তে আসতে সময় লাগবে। ঘুঁটি সাজাচ্ছে। নীরু ভেতর থেকে চেঁচাল।
দেখছিস নীরু কি বলছে।
বলুক। কাজ ও করবে না। আমাকে করতে হবে।
এখন খেয়ে নে।
দিক, যাচ্ছি।
তোকে একটা কথা বলবো?
বুঝেছি, তুই আমাকে বিরক্ত করবি। চল।
না, এখানে দাঁড়িয়ে।
বল।
মিলির কেশটা কি করলি?
আমি মিত্রার দিকে তাকালাম।
কিরে চোখের মনিদুটো স্থির হয়ে গেল। উত্তর দে।
তুই জানলি কি করে?
তুই ঘুমলে তোকে সব সময় পাহাড়া দিতে হবে, তাহলে অনেক কিছু জানা যাবে।
হাসলাম। তাই তখন বলছিলি মিলিকে নিয়ে এবার পরবো।
হ্যাঁ।
কাকে দায়িত্ব দিয়েছিস?
কেন!
গত তিন দিন মিলিকে তিরিশবার ফোন করেছে।
তাই! মিলিকে ডাক।
এখন না পরে।
ডাক না।
দূর, কেন যে তোকে বলতে গেলাম।
মিত্রা ভেতরে গেল।
কি ম্যাডাম কেশ খেয়েছেন। কনিষ্ক চেঁচালো।
মিত্রা হাসলো।
বুঝলাম মিলি বড়োমার ঘরে আছে। মিত্রা সেই দিকেই গেল।
আমি রতনকে একটা ফোন করলাম।
বলো অনিদা।
কোথায় আছিস?
কেন!
ব্যস্ত আছিস।
না।
তোকে একটা কাজ দিয়েছিলাম। মনে আছে।
কোনটা বলো—
ওই যে সল্টলেকের এ্যাড্রেস।
হ্যাঁ হ্যাঁ—
রেজাল্ট কি?
তুমি যে ভাবে বলেছো, সেই ভাবেই বলে এসেছি।
তাতে কি বললো।
ব্যাটা আইন দেখাচ্ছিল।
তারপর—
প্রথমে ভেবেছিল দিদি পাঠিয়েছে, আবিদ ব্যাটা ঘউড়া। তোমার নামটা ফট করে বলে দিয়েছে। ব্যাস যাবে কোথায়।
তারপর—
ত ত করছিল। আমি বললাম, দাদা পাঠিয়েছে ভাই তুই তাড়াতাড়ি কাজটা সাল্টে দে। না হলে হিতে বিপরীত হয়ে যাবে।
তুই কখন আসবি?
রাতে যাব, তোমার সঙ্গে একটু দরকার আছে।
ঠিক আছে আয়।
পেছন ফিরে দেখলাম, মিলি, ইসি, মিত্রা, ছোটোমা। আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে।
কাকে ফোন করলি! মিত্রা বললো।
তোর জেনে লাভ।
বড়োমা বলেছে এখন কোনও গণ্ডগোল করবি না।
গণ্ডগোল ছাড়া বাঁচতে পারবি।
বুঝতে পারলাম আমার গলার স্বরটা একটু কঠিন হয়ে গেছে। ওরা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
মিলি ওই ভদ্রলোকের ফোন নম্বরটা দাও।
এখন থাক না অনিদা।
যা বলছি করো।
দেখলাম কনিষ্ক, নীরু উঠে এলো।
মিলি ফোন নম্বরটা দিল।
কি যেন নাম?
অনীশ।
আমি ডায়াল করলাম।
ইচ্ছে করেই ভয়েজ অন করলাম। সবাই শুনুক।
রিং হচ্ছে।
হ্যালো।
কে বলছেন?
কাকে চান আপনি। ঝাঁজিয়ে উঠলো ভদ্রলোক।
আপনি কি অনীশবাবু?
হ্যাঁ।
আমি অনি ব্যানার্জী। আলাদা করে আমার পরিচয় দেওয়ার দরকার আছে।
না স্যার, না স্যার।
ভদ্রলোকের গলা মুহূর্তের মধ্যে আমূল পরিবর্তন হয়ে গেল। মিলি হেসে ফেললো।
আমার লোক আপনার কাছে গেছিল?
আমি স্যার বার বার ওকে ফোন করছি, ফোন ধরছে না।
ও এখন আমার সামনে দাঁড়িয়ে। আমার সঙ্গে ওর কি রিলেসন নতুন করে বলতে হবে।
না স্যার, আমি সব খোঁজ খবর নিয়ে নিয়েছি।
কি করতে চাইছেন?
ও যা বলবে আমি তাই করে দেব।
এতদিন করেন নি কেন?
আপনি যদি সময় দেন তাহলে আপনার কাছে গিয়ে বলতাম।
আপনি তো অনেক দিন আগেই বিয়ে করে ফেলেছেন?
না স্যার আপনাকে মিথ্যে কথা বলেছে।
প্রমাণ চান?
চুপচাপ।
কি হলো চুপ করে রইলেন কেন?
না স্যার, একটা ভুল হয়ে গেছে।
তাহলে দু-বছর ধরে ল্যাজে খেলাচ্ছিলেন কেন। ফ্ল্যাটটা লিখিয়ে নিতে চান?
না স্যার।
মিলি, ছোটোমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো।
আপনি কোথায় কাজ করেন, কি করেন না করেন, সমস্ত খবর আমার কাছে আছে।
ওই ছেলেটি আমাকে সব বলেছে।
কালকে বারোটার মধ্যে কাজটা শেষ করে ফেলবেন। ওর সঙ্গে আমার স্ত্রী যাবে।
আচ্ছা স্যার।
সব ব্যবস্থা ও করে রাখবে। আপনি শুধু এসে কষ্ট করে সইটা করে দেবেন। লোক পাঠাতে হবে।
না স্যার আমি চলে যেতে পারবো।
মিলি আপনাকে রাতে ডিটেলসে বলে দেবে। দ্বিতীয়বার ওকে বিরক্ত করবেন না।
আচ্ছা স্যার।
এটা আমার ফোন নম্বর সেভ করে রাখুন পরে ফোন করে আসবেন। আপনার কথা শুনবো।
আচ্ছা স্যার।
ফোনটা কেটে রেকর্ডিংটা সেভ করলাম।
দেখলাম বড়োমা গেটের সামনে স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে। নীরু ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেছে। কনিষ্ক স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বাইরের গেটে অনুপদার গাড়ি এসে থামল।
দেখলাম ইসলামভাই, ডাক্তারদা, দামিনীমাসি নামল। আমি ভেতরে এলাম। বড়োমা গেট ছেড়ে দাঁড়াল কোনও কথা বললাম না। থম থমে পরিবেশ। আমি সোফায় এসে বসলাম।
বড়োমা সামনে এসে দাঁড়াল।
এবার খেতে বসবি।
দাও। সবাই এসেছে?
বসে পর সবাই এসে পরবে।
বড়োমা রান্না ঘরে চলে গেল। দেখলাম বারান্দায় দাঁড়িয়ে অনুপদা, ছোটোমা, ইসলামভাই, দামিনীমাসি কথা বলছে। পাশে দাঁড়িয়ে ইসি, মিত্রা, মিলি। বুঝলাম এতক্ষণ যা হলো তার রিপোর্ট সার্ভ করা চলছে।
আমি উঠে গিয়ে টেবিলের ওপর রাখা জলের জাগটা থেকে ঢক ঢক করে কিছুটা জল খেলাম।
তোর কাজ করে দিলাম।
অনুপদা ঘরে ঢুকলো।
আমি অনুপদার দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
তিনজনকেই দেখিয়েছি। পছন্দ।
একে একে সবাই ভেতরে এলো।
চলো খেতে বসে কথা হবে।
কিগো বান্ধবী আমার খাওয়া জুটবে। ডাক্তারদাদা চেঁচিয়ে উঠলো।
বুড়ো ছেলের ঢং দেখ।
বড়োমার কথায় সবাই হাসছে, আমিও হেসে ফেললাম।
তোমার স্ট্রং ম্যানের মেজাজ ঠিক নেই। মিত্রা বললো।
তোরা খালি বিরক্ত করবি, তাহলে মেজাজ ঠিক থাকে কি করে।
আর সাউকিরি করতে হবে না। বড়োমা বলে উঠলো।
দামিনীমাসি রান্নাঘরের কাছে গেল। ইসলামভাই এসে আমার পাশে বসলো।
দামিনী সব নিয়ে গিয়ে মাঝখানে জড়ো করো, তারপর পাতে পাতে দিয়ে দাও।
নাও হাত ধুয়ে নাও খেতে বসে যাই। ইসলামভাই-এর দিকে তাকিয়ে বললাম।
অনুপদার দিকে তাকালাম।
দাদাকে সকাল বেলা কিছু বলেছো।
কি ব্যাপারে বলতো!
কালকের ব্যাপারে।
দাদাকে বলে দে ছাপতে। সকালের পজিশন আর এখনকার পজিশন সেপারেট।
দাদাকে তুমি বলে দাও।
এই জন্য তুই ফিউজ?
আমি ফিউজ কে বললো?
ওই তো ছোটদি বললো।
ওরা মনগড়া কথা বলে।
আমরা সব মনগড়া কথা বলি। যাবো দেখবি। ছোটোমা চেঁচিয়ে উঠলো।
ও ছোটো আবার কি হলো—বড়োমা রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে উঠলো।
বলবো দিদিকে।
বলো।
এবার খেতে বসে উদ্ধার করো।
আমি উঠে দাঁড়ালাম।
কনিষ্করা বাইরে দাঁড়িয়ে, ভেতরে ডাকলাম।
আমি গিয়ে মাঝখানে বসলাম। কনিষ্করা আমাদের উল্টদিকে বসলো।
ছোটদি আমি যদি অনির পাশে বসি অসুবিধে আছে। অনুপদা বললো।
অসুবিধে আছে। তুমি অনির বাঁদিক থেকে দুটো আর ডানিদেক থেকে দুটো ছেড়ে বসবে।
ওরে সব্বনাশ এগুলো বুক।
হ্যাঁ।
তাই হোক।
দামিনীমাসি হাসছে।
যে যার জায়গায় বসলো, খাওয়া শুরু হলো। ভাসিলা ভেড়ির গলদা চিংড়ির মালাইকারি এলো।
অনি কে আনল রে? কনিষ্ক বললো।
মালতী নিয়ে এসেছে।
নীরু চেঁচিয়ে উঠলো।
বড়োমা চাইলে পাওয়া যাবে?
না। গোনা গুনতি।
তাহলে আমাকে দিও না।
বড়োমা নীরুর দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো।
সবাই নীরুর দিকে তাকিয়ে। ও যে এই কথাটা বলতে পারে কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না।
তাকিয়ে লাভ নেই। তুমি একটা দেবে। সেটাও আমার ভাগ্যে জুটবে না। আমারটা রেখে দাও। যাওয়ার সময় খাব।
বড়োমা ওরটা আমার পাতে দাও। বটা বললো।
নীরু সটাং উঠে দাঁড়াল।
কি হলো! খেতে খেতে উঠে দাঁড়ালি কেনো? বড়োমা বললো।
ওর শরীর খারাপ লাগছে, আর খাবে না। কনিষ্ক বললো।
বড়োমা আমি যদি পাতাটা নিয়ে তোমার কাছে যাই অসুবিধে আছে।
বড়োমা হাসছে।
আয়।
নে আর একটা নিয়ে চব্বচোষ্য খা। নীরু, বটার দিকে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো।
আসন ছাড়াই নীরু বড়োমার পাতের কাছে এসে থেবড়ে বসে পরলো।
কমবেশি হাসাহাসি চলছে। চেঁচামিচি হচ্ছেই। হঠাৎ বড়োমার ঘরের গেট খুলে পিকু দাঁড়াল।
আংকেল তুমি নেমন্তন্ন খাচ্ছ।
ঘর শুদ্ধ সবাই হাসছে।
পিকুর কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই, সোজা চলে এসে আমার পাত ডিঙিয়ে, মিত্রাকে সরিয়ে মাঝখানে বসে পরলো।
নীরু, পিকুর দিকে তাকিয়ে আছে।
ভাত খাবি?
না।
তাহলে কি খাবি?
লব স্টার।
আবার হাসি।
নীরু পিকুর দিক তাকিয়ে। বাবা আমার যখের ধন, অনেক কষ্টে আগলে রেখেছি, তুই তোর মেসোরটা নে।
মেসো না অংকেল।
জয় হোক বাবা, তোর আংকেলেরটা নিয়ে তুই ঝামেলা কর।
আমাদের চেঁচামিচিতে জ্যেঠিমনির ঘুম ভেঙেগেছে। গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। পরিবেশ দেখে হেসে ফেললো। আমি একটু চিংড়িমাছ ভেঙে ওর মুখে দিলাম।
মুখে দিয়েই ফেলে দিল। চেঁচিয়ে উঠলো দিদাই।
দামিনীমাসি, বড়োমা, ছোটোমা তিনজনেই বলে উঠলো, বলো।
রসো নেই।
পিকু উঃ আঃ করছে। ঝাল লেগেছে।
জানিস পিকু, তোর আংকেলের থেকেও এটা বেশি ঝাল। নীরু, পিকুর দিকে তাকিয়ে।
দামিনীমাসি উঠতে যাচ্ছিল। কবিতা উঠে গিয়ে মিষ্টার হাঁড়িটা নিয়ে এলো।
বড়োমা একটা তুলে আমার পাতে দিল। এবার আর পিকুকে খাইয়ে দিতে হলো না। পিকু নিজে নিয়ে খেতে শুরু করলো। আমার কোলে উঠে বসেছে।
বুঝলে বড়োমা ওপার বাংলা থেকে এপার বাংলায় আসাতে খাওয়াটা ভালই হলো।
কনিষ্ক, বটা, অনিকেত একবার মুখ তুলে নীরুকে দেখে নিল, ব্যাপারটা এরকম খেয়ে নে, তারপর তোর বাংলার হিসাব দেব।
গেটের মুখে টিনা, নির্মাল্য, অদিতি, দেবা এসে দাঁড়াল। বড়োমা বললো, হাত ধুয়ে বসে পর। দেরি করিস না।
কবিতা উঠে দাঁড়াল।
তোমায় উঠতে হবে না আমরা নিয়ে নিচ্ছি। টিনা বললো।
যে যার মতো হাত মুখে ধুয়ে বসে পরলো।
টিনা তুমি চিংড়ি খাবে? নীরু বললো।
কেন বলো।
বটা বলছিল, আর একটা হলে ভালো হয়, তা বড়োমা বললো গোনাগুনতি।
তোরটা দে-না। দেবা বললো।
ওটা পিকুর জন্য।
আবার হাসি। টিনা মাটিতে থেবড়ে বসে পরেছে।
খাওয়া শেষ হলো।
তোমার সঙ্গে কথা বলা হলো না। একটু রেস্ট নাও আসছি। অনুপদাকে বললাম।
আমি মুখ ধুয়ে ওপরে চলে এলাম। নিজের ঘরে ঢুকলাম। চিকনাদের কাউকে দেখতে পাচ্ছি না, ওরা মনে হয় চলে গেছে। মিত্রার কাছ থেক শেষ খবরটা নিতে হবে। অনিমেষদা বলছিল বিকেল বেলা আসবে। সুরো এখনও এলো না। এই ঘরে আমার সবচেয়ে পছন্দের জায়গায় এসে দাঁড়ালাম। একটা সিগারেট ধরালাম। বাগানটা অনেক পরিষ্কার হয়ে গেছে।
ইসলামভাই-এর টিমটা বেশ ভালো। কালকে কাজ হয়েছে, আর আজ সকালের মধ্যে বাগান নব্বইভাগ পরিষ্কার।
সকালে নিশ্চই আমি ঘুমবার পর ওরা মিটিং করেছে। মিত্রাটা একটা ঢেঁড়স ওই সময় ভোঁস ভোঁস করে ঘুমচ্ছিল। দেখি ইসির পেটে একটা কিল মেরে কিছু পাওয়া যায় কিনা। ও অন্যদিক থেকে বুদ্ধিমতী কিন্তু এই দিক থেকে কতটা সরেস একবার ঘাঁটা ঘাঁটি করতে হবে।
অনিমেষদা, বিধানদা আসবে। তারমানে এবার অনেক আটঘাট বেঁধে নামবে। হয়তো আমার অনেক ঘুঁটিকে ওরা অফ করে দেবে। আবার নতুন করে তৈরি করতে হবে।
চিকনা গেল কোথায়? সকাল থেকে দেখতে পাচ্ছি না। ফোনটা পকেট থেকে বার করলাম। ডায়াল করলাম। চিকনার গলা।
কিরে কোথায়?
ক্ষমা কর। তোর সঙ্গে আসার সময় দেখা করে আসতে পারিনি।
এখন কোথায়?
আদাশিমলার বিলে।
একা না কেউ আছে?
পাঁচুকে ফোন করেছিলাম, পাঁচু নিতে এসেছে।
অনাদিরা কখন গেছে?
ওরা সকালে চলে এসেছে। কাকাকে কিছু জানাইনি। বলেছি তুই একটা কাজে গেছিস। নীপা জেনেছে। তুই কিছু ভাবিস না, আমরা সবাই তৈরি হয়ে গেছি।
তৈরি হলেই ভালো। দেখছিস তো আমার চাপ।
জানি গুরু, তোকে এদিকে মাথা গলাতে হবে না। তুই দেখিস আমরা আমাদের মতো ঠিক তৈরি করে নেব।
দেখি যদি পারি এই সপ্তাহে যাব।
তুই আগে ওই দিকটা সামলা। অনিমেষদা, বিধানদা সকালে প্রবীরদাকে হেবি ঝেড়েছে।
আমি চুপ করে শুনে যাচ্ছি।
হ্যাঁরে মিলি কেশটা কি?
কেন!
তুই ভুল ভাল বকছিলি। ভাবলাম আবার পীরবাবা ভড় করলো কিনা।
হাসলাম।
তোকে নিয়ে আমাদের টেনসন।
আমি ঠিক আছি। প্রবীরদাকে কি বললো?
আমাকে ফুটিয়ে দিল। দাদা, মল্লিকদা, ডাক্তারদাদা ছিল। তবে সব তোর ফরে।
ঠিক আছে। রাতে পারলে অনাদিকে একবার ফোন করতে বলিস। আর শোন, কাকাকে এই সপ্তাহে একবার ডাক্তার দেখাবার ব্যবস্থা করিস।
আচ্ছা।
চলবে —————————
from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/h8BWyXR
via BanglaChoti
Comments
Post a Comment