কাজলদিঘী (৮৬ নং কিস্তি)

❝কাজলদীঘি❞

BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

৮৬ নং কিস্তি
—————————

বৌদি, সুরোর দিকে তাকিয়ে হাসছে।

তোদের দেখে মনে হচ্ছে তোরা দুর্ভিক্ষ দেশের লোক।

সে তুমি যাই বলো। বিয়ের দিনটা আমার এখনও মনে আছে। সারা জীবন ধরে তার প্রতিশোধ তুলবো।

এইভাবে!

দামিনীদিদি বরফি আর নেই? ইকবালভাই ও পাশ থেকে চেঁচিয়ে উঠলো।

কয়েকটা পড়ে রয়েছে। ওদের সবাইকে দিয়েছি।

ওদের এনে দাও, আমি কাল সকালে আবার আনিয়ে নিচ্ছি।

দামিনীমাসি উঠতে গেল।

তোমায় উঠতে হবে না, আমরা নিয়ে নিচ্ছি। মিলি উঠে রান্নাঘরে গেল।

ছোটোমা,  দামিনীমাসি, বৌদি হাসছে।

তুমি এইভাবে এদের কিছু করতে পারবে না ইকবালভাই।

বৌদি ইকবালভাই-এর দিকে তাকিয়ে।

এটাই বা ক-জনের ভাগ্যে জোটে দিদিভাই। আমি ইসলামের মুখ থেকে মাঝে মাঝে গল্প শুনতাম। আজ চাক্ষুষ দেখছি।

তাকাসনি আসার সঙ্গে সঙ্গে ভালো মন্দ খাওয়া শুরু করে দিয়েছিস। মিত্রা বললো।

তনু ঠেলা মারলো মিত্রাকে।

তুমি তো দেখোনি। এবার দেখবে। আদর উপচে উপচে পড়বে। দিদিভাই।

ইসি তাকাল মিত্রার দিকে, বল।

কয়েকটা সরিয়ে রেখেছিলি না।

আছে।

নিয়ে আয়।

ইসি উঠে দাঁড়াল।

ইসি তুইও কি? জ্যেঠিমনি বললো।

একবারে কথা বলবে না। এতদিন যা যা করেছো সব ওকে বলে দেব।

তোরা সব গুবলেট করে দিলি। আর ও এটাই চাইছিল।

অনিমেষদা মিত্রার দিকে তাকাল।

তোমরা কথা বলো না।

গোল হয়ে এমনভাবে বসেগেছিস, বলি কি করে।

তুমি কি ভেবেছ, তুমি জিজ্ঞাসা করবে আর ও গড়গড় গড়গড় করে তোমাকে সব পেট উজাড় করে বলে দেবে। আহাহাহা কি ভালো ছেলেরে আমার।

মিত্রার কথা শুনে অনিমেষদা হেসে ফেললো। বড়োমা, ছোটোমা, বৌদি সবাই।

আমি আঠারো বছর ওর কাছে ছিলাম না, তনু ছিল, বিন্দু বিসর্গ জানে কিনা জিজ্ঞাসা করো। শুধু কতকগুলো নাম জানিয়ে রেখেছে, আর তাদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে রেখেছে। বেশি কথা বললে বলেছে, যা বলছি করো, তাতে তোমার উপকার হবে।

অনিমেষদা হাসি হাসি মুখে মিত্রার দিকে তাকিয়ে।

তোমাকে ঝোপ বুঝে কোপ মারতে হবে, তাহলে তুমি যদি কিছু বার করতে পার।

মিলি আর কয়েকটা লুচি নিয়ে আয়। মিত্রা মিলির দিকে তাকাল।

ইসি দি—

দাঁড়া চাঁছা চাঁছি করি—

যাব নাকি—

নিয়ে যা—

মিলি উঠে রান্নাঘরের দিকে গেল।

বড়োমা, ছোটোমা, বৌদি মিত্রার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। মিত্রা, বৌদির দিকে তাকিয়ে বললো।

হেসো না খিদে লেগে গেছে।

তনু, টিনা, সুরো হেসে উঠলো। আমিও মুচকি মুচকি হাসছি।

আবার অনিমেষদার দিকে তাকাল।

তুমি, বিধানদা পার্টি মিটিংয়ের ঢঙে ইনিয়ে বিনিয়ে আলোচনা করলে, ও আরও বেশি ভাববার সময় পাবে, তারপর তোমায় এমন গল্প বলবে না, ভাববে ওটাই ঠিক।

মিত্রার রকমসকম দেখে ছোটোমা হেসে আমার গায়ে ঢলে পরলো।

দাড়ি না কাটলে, তুমি ওর চোখমুখের ভাষা বুঝতে পারবে না। ওটা মারাত্মক। আমি মল কেশের সময় দেখেছি। বড়োমা, ছোটোমাও দেখেছে, তিনজনের চোখের জল চোখেই শুকিয়ে গেছে, ও ওর মতো দিব্যি থেকেছে।

আঙুলটা আর একবার চুষে নিল।

ওরে তোর আঙুলে আর কিছু নেই। বৌদি বললো।

দামিনীমাসি ধোঁকার ডালনাটা হেববি বানিয়েছে বুঝলে বৌদি। বুবুন এসে গেছে, খাবার চাট দেখেছ। মাসি, এতদিন এই রান্নাগুলো ছিল কোথায়? শিকেয় তুলে রেখেছিলে?

দামনীমাসি হাসছে।

ইসি, মিলি খাবার নিয়ে এসে বসে পড়লো।

মিত্রা অনিমেষদার দিকে তাকাল।

কথা বলতে বলতে ওর চোখের মনি কখনও স্থির হয়ে গেছে দেখেছো?

না! অনিমেষদা মিত্রার দিকে তাকিয়ে।

তাহলে?

আবার আঙুলটা চুষে নিয়ে।

তোমরা ওকে ভাবাতেই পারনি। তোমাদের সব প্রশ্নের উত্তর ওর মুখস্থ, গড়গড় করে এখুনি সব বলে দেবে। যতই তোমরা ভাব আসল জায়গায় পৌঁছে গেছি, ঘেঁচু।

মিলি বরফি ভেঙে মুখে তুলেছে।

মিত্রা, মিলির দিকে তাকিয়ে।

কিরে একলা খাচ্ছিস, আমাকে দে।

তুমি তো কথা বলছো।

মা তোমার থেকে একটু দিও। অনিসা বললো।

মনির কাছ থেকে ভেঙে নিয়ে দাও।

আমি মিত্রার দিকে তাকিয়ে। এক অসীম পরিতৃপ্তি ওর চোখে মুখে ছড়িয়ে পরেছে। সকালে ঢোকার সময় ওর চোখে মুখে যে কালির ছাপ দেখেছিলাম, তা এখন একটু হলেও পরিষ্কার। সেই প্রাণোচ্ছল মিত্রা। কলকল করে পাহাড়ী ঝোড়ার মতো কথা বলে চলেছে।

আবার অনিমেষদার দিকে তাকাল।

শুধু তোমাকে এটুকু বলতে পারি, অনাদির হাড়ে দুব্বোঘাস গজিয়ে যাবে। আর ওর সাঙ্গ-পাঙ্গরা ভিখারী হয়ে যাবে। কি করে হবে, কি ভাবে হবে, কতদিনে হবে, তা বলতে পারব না। তবে সামান্য ওষুধে যে অনাদির কাজ হয়েছে, নিরঞ্জনদার কাছে ছুটে যাওয়াটাই তার প্রথম প্রমাণ।

তুই তো সার কথাটা বেশ ভালো বুঝেছিস। অনিমেষদার চোখ চক চক করে উঠলো।

তোমার থেকে অনিকে ও বেশি দেখেছে। বিধানদা বললো।

গর্ব করছি না। ওকে কলেজ লাইফ থেকে দেখছি। সব বুঝি, সব জানি এ কথা বলবো না। তবে বেশি ঘ্যানর ঘ্যানর করবে কিছুই পাবে না। আবার না চাইতে তুমি অনেক বেশি পেয়ে যেতে পার। আমি তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ।

শেষের কথাটা বলতে গিয়ে মিত্রার গলাটা ধরে এলো। মাথা নীচু করলো।

এতক্ষণ যারা মিত্রার কথায় হাসা হাসি করছিল, তারা হঠাৎ কেমন থম মেরে গেল।

নিস্তব্ধ ঘর। গুরুগম্ভীর পরিবেশ।

এই মিত্রাদি। তনু মিত্রার পিঠে হাত রাখলো।

না-রে তনু, আমি কাঁদছি না। জীবনে ওকে যা দিয়েছি, তার থেকে অনেক অনেক বেশি পেয়েছি। তুই যে আমার থেকে কোনও অংশে কম পেয়েছিস মনে হয় না। শুধু আমি বললে ভুল হবে, আরও অনেকে, বড়োমা, জ্যেঠিমনি, ছোটোমা তার কিছু কিছু জানে।

মেয়ে মায়ের পেছনে বসে গলা জড়িয়ে ধরেছে। ছেলে মাথা নীচু করে রয়েছে।

তুই মন খারাপ করিস না। বিধানদা বললো।

আমি একটুও মন খারাপ করিনি বিধানদা।

একটু থেমে।

তোমরা এতো তাত্বিক আলোচনা করছিলে আমার ঠিক ভালো লাগছিল না, তাই অংশগ্রহণ করলাম। তোমরা একটা জিনিস লক্ষ্য করেছো।

কি বল?

ওকে এতদিন পর দেখে তোমাদের নিশ্চই একটু আধটু মন খারাপ হয়েছে?

তা একটু হয়েছে। বিধানদা বললো।

ওর চোখে মুখে তার কোনও ছাপ দেখতে পেয়েছ।

ঠিক ওইভাবে লক্ষ্য করিনি, তবে ও সকাল থেকে খুব স্বাভাবিক আছে।

তুমি কি ভাবো, গতো সাত দিন এই পরিবারের ওপর যা হয়েছে তার কোনও খবর ওর কাছে নেই?

সেটা আছে, একটু একটু বুঝতে পারছি।

সকাল থেকে ও এসেছে, কনস্ট্যান্ট সকলের সঙ্গে কথা বলছে, হাসি ঠাট্টা করছে।

হ্যাঁ।

ওর কাঁধের ঝোলাটা ও কাছ ছাড়া করেছে। এখন খেতে বসেছে। দেখো ওর পাশে আছে।

কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে সবাই আমার দিকে লক্ষ্য করলো।

ঘরের সব চোখ এবার আমার ওপর।

ছোটোমা পাশে তাকাল।

আমি হাসছি।

তোমরাও কেউ ওকে কিন্তু বলোনি, খেতে বসার সময় ঝোলাটা রেখে আসবি। কোনও লাগেজ নিয়ে ও কলকাতায় এসেছে?

অনিমেষদা এবার চশমাটা খুলে মিত্রার দিকে তাকাল।

স্রেফ একটা কাপর পরে আছে, আর একটা গায়ে কোনও প্রকারে জড়িয়ে রেখেছে।

একটু থেমে।

এখন যে কাপরটা পরে আছে সেটা দামিনীমাসি কিনে নিয়ে এসেছে। মাসি কি করে জানল, ও আজ আসবে? কাপরটা নিশ্চই সকালে ওকে দেখার পর কিনে আনে নি।

অনিমেষদা, বিধানদার চোখ বড়ো বড়ো।

আমি হলপ করে বলতে পারি কাপড় কেনার ইতিহাসটাও দামিনীমাসি জেনেছে অনেক পড়ে।

বড়োমা মিত্রার দিকে তাকিয়ে। সবার দৃষ্টি এখন ওর মুখের দিকে।

তোকে আমি বলবো। বিশ্বাস কর। দামিনীমাসি বললো।

তোমাকে তারজন্য কিছু বলছিনা মাসি। আমি শুধু অনিমেষদাকে ব্যাপারটা বোঝাতে চাইছি।

অনিমেষদার দিকে তাকিয়ে—তোমরা ওর অত্যন্ত সাধারণ ব্যাপারগুলোর দিকে একেবারে লক্ষ্য করো না। ওই দিকে একটু নজর দাও।

বিধানদা, অনিমেষদা, প্রবীরদাদের চোখের রং বদলে যাচ্ছে।

ওর বড়ো বড়ো ব্যাপারের দিকে লক্ষ্য করলে কিছুই ধরতে পারবে না।

তুই তো খুব সুন্দর কথা বললি। অনিমেষদা বললো।

তোমার পাশে সবসময় আছে, তোমার খুব ঘনিষ্ঠ, কিন্তু সে তোমার কাজের লোক নয়, তুমি তাকে একবারেই গুরুত্ব দাও না, তার সামনে তুমি সমস্ত রকম আলোচনা করো, এক কথায় তুমি ভাব লোকটা গো-মুখ্খু, সেইই ওর পিন অপারেটর।

অনিমেষদা হাঁ করে মিত্রার মুখের দিকে তাকিয়ে।

কি ভাবে? প্রশ্ন করবে না। তাকে ও নিজের মতো তৈরি করে নেবে।

দাঁড়া দাঁড়া তুই তো সব গুবলেট করে দিবি।

না। আমার অনুধাবন শক্তিদিয়ে যতটুকু বুঝেছি তাই তোমাকে বলছি। বেশি ভাববার মতো শক্তি আমার নেই। তাই এখনও ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করছি। ওই ঘটনার পর সবাই বলেছে ও মরে গেছে, তোমরা কি করেছিলে আমি বলতে পারবো না। তবে আমি বিশ্বাস করিনি, আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল ও ওইভাবে কখনও মরতে পারে না। ও যদি মরতো তাহলে তাপসও মরতো। ওর মরার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর ওর ঘনিষ্ঠ মিঃ মুখার্জি, মিঃ সিং, আর মিঃ ঘোষ এদের কোনও খবরা খবর নিতে দেখেছো কখনও কোনও দিন। আমার তো মনে পড়ে না। তোমরা নিয়েছো কিনা জানিনা। ওরা তিনজনেই কিন্তু তখন ওর মেন অপারেটর। তিনজনকেই তোমরা বার কয়েক দেখেছো। কেউ একদিনের জন্যও এ বাড়ির মুখ দর্শন করেছে। মিঃ মুখার্জির ইতিহাস পড়ে জেনেছি। মাঃ সিং, মিঃ ঘোষ কোথায় গেল? কর্পূরের মতো উবে গেল। সে এক ইতিহাস।

একটু থেমে।

কনিষ্ক, চিকনা তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। ওরা হয়তো তোমাকে পরবর্তী সময়ে কিছুটা বলেছে। আবিদ, রতনের কথা বাদ দাও। ওরা প্রেমানন্দকে চিনতো। এই প্রেমানন্দ কে? অনুপ না অনিন্দ ব্যানার্জী না অনি ব্যানার্জী।ল আজ থেকে আঠারো বছর আগে তোমরা সাগির, অবতার, নেপলাকে দেখেছ।

অনিমেষদা, বিধানদা অবাক হয়ে মিত্রার দিকে তাকিয়ে।

আজ প্রত্যেকে সুন্দরের সঙ্গে বাংলায় কথা বলছে না। ইংলিশে কথা বলছে। সুন্দরের ইংলিশ বলার ধরণটা আমাদের মতো নয়। এটা নিশ্চই নতুন করে বলতে হবে না।

আমি খবর নিয়ে জেনেছি, দুবাইয়ে আবতার, সাগির, নেপলার সম্পত্তির পরিমাণ এক এক জনের কয়েক হাজার কোটি টাকার ওপর। আমাদের ফার্মের শতকরা আশিভাগ জিনিষ নেপলাদের কোম্পানি কিনে নেয়। এর মাঝে অবশ্য দু-একজনকে ব-কলমা দেওয়া আছে। কর্মচারীদের মধ্যে সত্তরভাগ ওই দেশের, বাকি তিরিশভাগ ইন্ডিয়া, বাংলাদেশ। এর মধ্যে কলকাতার আছে কুড়ি শতাংশ। তার মধ্যে বুবুনের পকেটের লোক আছে পনেরো শতাংশ। রেশিওটা আজ তনু দিয়েছে।

আমি তনুর দিকে তাকালাম।

শুধুমাত্র মিত্রাদিকে বলেছি আর কাউকে বলিনি। তনু মাথা নীচু করলো।

ওই পনেরো শতাংশের মধ্যে কারা বুবুনের লোক নেপলা, সাগির, অবতারও চেনে না।

আচ্ছা তনু তো ওর কাছে ছিল। ওকে জিজ্ঞাসা করো প্রেমানন্দের ব্যাপারে, বলবে কিছু জানি না। আমি যে তনুকে জিজ্ঞাসা করিনি তা নয়, করেছি। কোনও সদুত্তর পাইনি।

দেখো এই আঠারো বছরে কতো ঝড় আমার ওপর দিয়ে গেছে, আমার মুখ থেকে একটুও শব্দ শুনতে পেয়েছ। খুব কষ্ট হলে বড়োমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছি। বুঝতে দিইনি কেন জড়িয়ে ধরে কেঁদেছি। তোমাদেরও কমবেশি সব কথা বলেছি।

আবার একটু থামল।

দুবার যখন গভীর সঙ্কটে পড়েছি, ওর ফোন এসেছে। তোমরাও শুনেছ।

এবার ভাবছো প্রবীরদা? প্রবীরদা জানতো ও আছে। তবে ভায়া-মিডিয়া। আমার বিশ্বাস সরাসরি প্রবীরদার সঙ্গে ওর কোনওদিন কথা হয়নি। প্রবীরদা চেষ্টা করেনি বললে ভুল, প্রবীরদা পেড়ে ওঠে নি। তবে প্রবীরদাকে নির্দিষ্ট কিছু দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, প্রবীরদা তা পালন করেছে। প্রবীরদাও ওই ভায়া-মিডিয়াতে ওর কাছে খবর পৌঁছে দিত।

মিত্রা, অনিমেষদার দিকে তাকাল।

বার বার এটুকু ও বুঝিয়েছে আমি তোর পাশে আছি। এটুকুতেই শান্তি।

সুরোর বিয়ের দিন, ছেলে হওয়ার দিন….। বড়োমা আমাকে কতো কথা বলেছে, তবু বড়োমাকে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারিনি।

খাওয়া হয়ে গেছে, মিলি প্লেটগুলো তুলে নিয়ে গেল।

মিলি রাখ না, আমি তুলছি। দামিনীমাসি বললো।

সকাল থেকে অনেক করছো, এইটুকু করলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না।

একটু জল আনবি মিলি। মিত্রা বললো।

খাবে, না হাত ধোবে।

খাব।

আবার অনিমেষদার দিকে তাকাল।

চিকনার পেট থেকে তুমি এই আঠারো বছরে কিছু বার করতে পেরেছ?

না।

তোমাদের এটুকু অন্ততঃ ভাবা উচিত ছিল, যে বড়োমাকে ও অন্ধের মতো ভালোবাসে, তাকে ও এই আঠারো বছরে রেসপন্স করেনি। কেন?

মিলি জল এনে মিত্রার হাতে দিল।

আমার ইন্টিউসন বলছে সকাল থেকে তোমরা যা দেখছো সব বেড-টীর মতো। এরপর ব্রেকফাস্ট আছে, লাঞ্চ আছে, টিফিন আছে তারপর ডিনার। ডিনারটা ও জবরদস্ত করবে।

মিত্রা জলের গ্লাসে চুমুক দিল।

তনু হাসছে।

ব্যাপারটা বেশ জমছে মনে হচ্ছে।

ইসলামভাইরা ওপাশ থেকে একে একে সামনে চলে এসে মাটিতে বসে পড়েছে।

আমি গোবর গণেশের মতো বসে আছি। মাঝে মাঝে মিত্রার দিকে চেয়ে হাসছি।

তোমাদের এতদিন বলিনি। কথাটা যখন উঠলো তখন বলেই ফেলি।

বল মামনি, যদি কিছু আন্দাজ করতে পারি। ইসলামভাই বললো।

পারবে না।

কেন!

তোমাকে কিরকম খুব সুন্দর করে ঘরে বসিয়ে দিয়েছে, এটা কখনও বুঝতে পেরেছ।

ইসলামভাই মিত্রার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে।

একটু ভেবে দেখ দাদাভাই। যেদিন থেকে ও জানতে পারলো তুমি ছোটোমার ভাই, সেদিন থেকে ও তোমার সহায্য নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। আস্তে আস্তে ট্র্যাক চেঞ্জ করিয়ে তোমাকে অন্য মানুষ বানিয়ে দিয়েছে। তথাকথিত তোমার ডানহাত বাঁ হাত এখন সেই জায়গায় নেই।

ইসলামভাই ফ্যাল ফ্যাল করে মিত্রার মুখের দিকে তাকিয়ে।

তুই সত্যি বলেছিস! এইভাবে কখনও ব্যাপারটা ভাবিনি?

তোমার কিছু হলে ছোটোমা আঘাতে পাবে। ওটা ও সহ্য করতে পারবে না। তার থেকে তোমাকে দলছুট করে দেব। কেননা ও তখন ডিটারমাইন্ড এই কাজগুলো ও করবে। তোমার খাস লোককেও ও বাধ্য করিয়েছে তুমি যেন কিছু জানতে না পার।

ইসলামভাই-এর চোখদুটো ছল ছল করে উঠলো।

কেঁদে লাভ নেই দাদাভাই, আমি কিছু করতে পেরেছি।

কি ইকবালভাই আমি ঠিক বলছি?

মিত্রা ইকবালভাই-এর দিকে তাকাল।

হ্যাঁ মা তুই ঠিক বলছিস। এটা আমি হালে রতনের কয়েকটা কথা শুন বুঝতে পেরেছি।

তারমানে তখন জালটানা শেষ।

আমি এবার উঠি অনেক রাত হলো।

ছোটোমা আমার হাতটা চেপে ধরলো।

বোস, গুণকীর্তন হচ্ছে বলে।

দাদা এরপর কিন্তু আর হাত থেকে লেখা বেরবে না।

তা হোক, তোর এই কথাগুলো শুনি, আগে জানতাম না।

অনিমেষদা, বিধানদার দিকে তাকিয়ে হাসছে।

কিগো এডিটর তুমি কি ঘোরে আছ, অনির লেখা বলছো চাই না। ডাক্তারদাদা বললো।

পালিয়ে যাবে কোথায়? এবার আমিও বাঁধবো।

দূর যতোসব গাঁজাখুরি গল্প।

মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। ব্যাপারটা এরকম আঠারো বছর ধরে তোকে চুল চেরা স্টাডি করেছি। তার সারার্থ এদের সঙ্গে শেয়ার করছি। তোর পেছনে না সামনে।

মিত্রা, অনিমেষদার দিকে তাকাল।

আমাদের অফিসের রোজকার খবর ওর কাছে পাই টু পাই যেত। কি করে? কে ওর সোর্স?

বিধানদা থালার মধ্যেই গ্লাস থেকে সামান্য জল নিয়ে হাতটা ধুয়ে ফেললো।

দাদা আপনি….? বৌদি বলে উঠলো।

ও থাক।

ছোটোমা, বৌদি, দামিনীমাসি, জ্যেঠিমনি মুচকি হাসলো।

পেয়েছিস? অনিমেষদা বললো।

অনেক চেষ্টা করেছি। এমনকি পার্সোনালি লোক লাগিয়ে খোঁজার চেষ্টা করেছি। পাইনি।

তোমরা নিশ্চই বটাদাকে চেন।

কে বলতো? বিধানদা বললো।

ওই যে, আমাদের অফিসে চা করে দিতো। দাদা বললো।

হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে।  উনি তো মারা গেছেন। অনিমেষদা বললো।

হ্যাঁ।

আমার দাদুর আমলের লোক। দাদার সমবয়সী।

মিত্রা আবার শুরু করলো। বেশ সুন্দর গুছিয়ে গল্প বলছে।

বটাদার সেরিব্রাল এ্যাটাক হলো, জানতে পারার পর মনটা খুব খারাপ লাগলো। বুবুনকে বটাদা খুব ভালোবাসতো, উড়িয়া ভাষাটা শিখিয়েছিল, নিজের চায়ের দোকানের হিসেব পত্তর করাতো। ও তখন কাগজের মালিক। বুবুনের কাছ থেকে টাকা ধার নিতো। সেই টাকা বুবুন হারিয়ে যাওয়ার পর, আমাকে শোধ করতে এসেছিল। আমি বলেছিলাম যার টাকা তাকে দিও। আমার কথাটা শুনে মুখটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল, থম মেরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো তারপর ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

অনিমেষদারা অবাক হয়ে মিত্রার দিকে তাকিয়ে।

মিথ্যে বলছি না। সব সত্যি ঘটনা। পরে তোমাকে এই গল্পটা বলবো।

সে যাক, কিছু টাকা নিয়ে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেলাম বটাদাকে দেখতে। একটা সাইড পড়ে গেছে, জড়িয়ে জড়িয়ে কথা বলছে। কনিষ্কর ছাত্ররা ভীষণ কেয়ার নিত। এতটুকু গাফিলতি করতো না। আমাকে দেখতে পেয়ে হাত বাড়িয়ে দিল।

কাছে গিয়ে বসলাম।

আমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলো। মুখ থেকে অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এলো, অনি।

চমকে উঠলাম।

যে লোকটা মরতে বসেছে, সে বুবুনকে খুঁজছে! বুবুনতো ওর কাছে মৃত।

আর ও তখন দশ বছরের বেশি উধাও। বেশ কিছুক্ষণ বসে বসে বটাদার মাথায় হাত বোলালাম, চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। মনে হলো যেন কিছু বলতে চায়।

ওই ফোনের ঘটনার আগে না পরে? অনিমেষদা বললো।

আগে।

তারপর বল। অনিমেষদা বললো।

বটাদার মুখের কাছে কানটা নিয়ে গেলাম।

জড়িয়ে জড়িয়ে বললো, আমার কাছে একটা লোক আসতো, আমি তাকে সব খবর দিতাম। তারমানে বুঝতে পারলে! বটাদা তার মাধ্যমে অফিসের সমস্ত ডিপার্টমেন্টের খবর বুবুনের কাছে পাঠাত।

সবার ভাব ভঙ্গি এমন যেন মিত্রাকে গিলে খাবে।

সেদিন ফিরে এলাম। মনটা ভীষণ খারাপ। সারারাত ঘুমতে পারলাম না। পরেরদিন বটাদা মারা গেল। মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল। হয়তো বটাদা এই কথাটা আমাকে বলার জন্যই বেঁচে ছিল।

ব্যাপারটা এরকম, তুমি ভেবেছ অনি মরে গেছে, না অনি মরে নি।

পরে একটু ভেবে দেখলাম, কথাটা ঠিক।

আমাদের অফিসে একমাত্র বটাদা আর হরিদার অবাধ গতি। এমনকি কোনও কনফিডেন্সিয়াল মিটিং চলছে সেখানেও বটাদা আর হরিদার ঢোকার পার্মিসন ছিল। এটা দাদার তৈরি অলিখিত নিয়ম। বটাদা আমাদের চা দিতো, কথা বলতো, আমাদের মিটিং শুনতো। সমস্যাগুলো বটাদা সেই ছেলেটির মাধ্যমে বুবুনের কাছে পৌঁছে দিত।

বটাদা মারা যাওয়ার পর, ভাবলাম হরিদা ওর ঘুঁটি হবে। দেখলাম না। হরিদা ওর ঘুঁটি নয়। এমনকি আমি হরিদাকে বাজালাম, হরিদা ব্যাপারটা শুনে আকাশ থেকে পড়লো।

খোঁজ খোঁজ। হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করলাম, আমাদের গেটের সিক্যুরিটির ছেলেটা কি যেন নাম, হ্যাঁ ছিদাম, ক্যান্টিনের দায়িত্ব নিয়েছে। চা-টা করছে। এ ঘরে ও ঘরে গিয়ে দিয়ে আসছে। খবর নিয়ে জানলাম চম্পকদাকে ধরাধরি করে ও কাজটা বাগিয়েছে।

সিক্যুরিটির ছেলে চা বানাচ্ছে? খটকা লাগল। ওয়াচে রাখলাম। তারপর একদিন ডেকে পাঠালাম। একথা সেকথা বলার পর দুই ধমক মারলাম।

বলে কালকে থেকে আর অফিসে আসবে না। মহা মুস্কিল।

তারপর বাবা বাছা করতে সব স্বীকার করলো। ও বটাদার কাছ থেকে খবর সংগ্রহ করে পাঠাত। এখন ও নিজেই দায়িত্ব নিয়েছে। নিজে কিছু লোকও ঠিক করেছে। অনেক কসরৎ করার পরও লোকগুলোর নাম আমি জানতে পিরিনি। তারা কোন ডিপার্টমেন্টে কাজ করে, কি কাজ করে, তাও জানাল না। বোঝ কান্ড।

বুঝলাম ধমক দিয়ে কাজ আদায় করা যাবে না।

আবার বাবা-বাছা করতে একটা ফোন নম্বর পেলাম। যা কোনওদিন চিকনা দেয়নি।

একদিন ফোন করলাম একটা মেয়ের গলা। আমাকে বললো মিত্রাদি।

একটু অবাক হলাম।

তনু হাসছে।

তনুর নম্বর। অনিমেষদা বললো।

হ্যাঁ। এই কাজটুকু করতে আমার সময় লেগেছিল চার বছর।

তারপর থেকে ছিদাম আর এই দায়িত্ব নেয়নি। খবর ওইই সংগ্রহ করতো, আমার কাছে এসে টুক টুক করে বলে যেতো, আমি তনুকে বলতাম। তাও সপ্তাহে দু-দিন। তনু বড়বাবুর কাছে পৌঁছে দিত। ওর কাছ থেকেই বুবুনের খবরা খবর পেতাম। সুন্দরের কথা তনু গোপন রেখেছিল।

তুই সব জেনেও চুপচাপ ছিলি! বৌদি বললো।

অনিমেষদার চোখেও বিষ্ময়।

আমার পেছনেও যে লোক লাগান ছিলো বৌদি।

তোর পেছনে!

হ্যাঁ। আজ পর্যন্ত তাদের দেখা পাইনি।

তনুর সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে, কোনও কোনও দিন তনু বলে ফলতো আজ কেন তুমি ওখানে গেছিলে মিত্রাদি? আর কখনও যাবে না। তখন ধরতে পারতাম।

এটুকু জানতাম মেয়ে আর ছেলের দেখভালের দায়িত্ব ছিল রতন আর আবিদের ওপর। দুজনকে দুটো দায়িত্ব দেওয়া ছিল। এবার ওদের পেছনে কারা ছিল তা জানি না।

আমি সটাং উঠে দাঁড়ালাম।

ছোটোমা আমার কাপর চেপে ধরেছে।

যাচ্ছিস কোথায়?

মুখটা ধুই।

ইসলামভাই, ইকবালভাই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে।

তাহলে অনিমেষ কিছু বোঝা গেল। এতক্ষণ পর ডাক্তারদাদার গলা পেলাম।

আমি বেসিনে গিয়ে মুখটা ধুলাম। কাপরেই হাত মুছলাম।

তোমরা গল্প করো আমি একটু শুই।

মিত্রা আমার মুখের দিকে তাকিয়, চোখে হাসির ছটা।

ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলাম। রতন, আবিদ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। নেপলাদের দেখতে পেলাম না। বুঝলাম ওরা যে যার শুয়ে পরেছে। সারাদিনের ক্লান্তি তারওপর এতটা জার্নি। বাগানটা অন্ধকার অন্ধকার সব লাইট জ্বালা হয়নি।

সোজা মিত্রার ঘরে চলে এলাম। টেবিলের কাছে গিয়ে কাঁধের ব্যাগটা রাখলাম। নিজের ফটোটার দিকে তাকালাম। বিয়ের দিনে নীরু তুলেছিল। হেসেফেললাম।

বিছানায় ধব ধবে চাদর টান টান করে পাতা। সেন্টার টেবিলে জলের বোতল। ঘরের একপাশে তনুদের লাগেজ ডাঁই করে রাখা।

এ বাড়িতে থাকার সময় এই ঘরে আমি খুব একটা ঢুকি নি। প্রয়োজন পড়তো না। বেশিরভাগ সময় দরজা বন্ধই থাকত। এখন ছেলে মেয়ে ওপরের দুটো ঘর দখল করেছে। আরও দুটো ঘর খালি। একটায় মল্লিকদা ছোটোমা। নিচেও ঠিক তাই।

পায়ে পায়ে বিছানায় এসে দরজার দিকে মুখ করে একটু টান টান হয়ে শুলাম। তখনও ও ঘরে হাসাহাসি চলছে। তার সামান্য আওয়াজ এই ঘরে ভেসে আসছে।

মাথার ওপর পাখাটা বন বন করে ঘুরছে। আজকে গরমটা একটু বেশি মনে হচ্ছে।

একটা সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে, পাই কোথায়?

কনিষ্করা নীচে শুয়েছে না ওপরে? চিকনাটাও হাতের কাছে নেই। সবাই মনে হয় ওপরের দুটো ঘরে গিয়ে ঢুকেছে।

দূর থাক সিগারেট খাবো না।

অনাদি নিরঞ্জনদার কাছে গেল। কেনো? ওর এতো তাড়া কিসের। শুধু একটা উকিলের চিঠিতে ও এতো ছটফট করতে শুরু করে দিয়েছে। তারমানে চিকনা যা হিন্টস দিয়েছে তার থেকেও বেশি কিছু নিয়েছে। না অন্য কিছু আছে।

ব-কলমে ওর ব্যবসাটা যিনি চালাচ্ছেন সেই ভদ্রমহিলা ওর কেপ্ট। মেয়েটাকে দেখা হয়নি। একবার দেখতে হবে। শুনলাম কলকাতার মেয়ে। বেশ ব্রাইট। এই রকম একটা মেয়েকে অনাদি জোগাড় করলো কোথা থেকে?

না এখন এসব চিন্তা করে লাভ নেই। আগে সিপির দেওয়া ফাইলটা দেখে নিই। তারপর লিখতে বসে যাই। পড়ে আর সময় পাব না।

উঠে বসলাম। শরীর না টানলেও কাজগুলো শেষ করতে হবে।

টেবিলের কাছে এলাম।

টেবিল ল্যাম্প দেখতে পাচ্ছি। লেখার কাগজ কোথায়?

দাদা তখন একটা প্যাড নিয়ে আসতে বলেছিল। টেবিলের ওপর অনেকক্ষণ ধরে খুঁজলাম। পেলাম না।

অগত্যা সোফায় এসে বসলাম। সিপির ফাইলটা খুলে বসলাম।

প্রথম কাগজটা দেখেই মাথা খারাপ হয়ে গেল। অনাদির এগেনস্টে কনফিডেনশিয়াল রিপোর্ট। এসবি, সিআইডি জয়েন্টলি তৈরি করেছে। ওপর ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। কান, মাথা গরম হয়ে গেল। কেমন যেন ভোঁ ভোঁ করছে।

এ কি করেছে অনাদি?

এই কয় বছরে ও তো আর এক ডন তৈরি হয়েছে! মলের বাবা! করলো কি করে?

রিপোর্ট দেখে মনে হচ্ছে ও একা নয়। সিপি বললো, আগে ছিলাম এখন ছেড়ে দিয়েছি।

শালা অনাদির থেকেও চালাক। এ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ পার্টের লোক। আগেভাগে গন্ধ পেয়ে গেছে। তাই সরে গেছে।

চিকনা যতটুকু বলেছিল। ও নাকি কো-অপারেটিভের টাকায় প্রচুর গাড়ির লোন বার করে দিয়েছিল। কিন্তু একটাও শোধ হয়নি।

দু-তিন কিস্তি দেওয়ার পর কেউ দেয়নি।

অনাদি তখন একটা অ্যাসোসিয়েশন বানিয়ে খেলতে শুরু করেছে।

ফার্মের একচেটিয়া মাল ও কিনে রতনদের সাপ্লাই করেছে। সমবায় আন্দোলনকে নিজের কুক্ষিগত করে রাজনৈতিক ফয়দা তুলেছে। গ্রামের ছেলেগুলো মরেছে।

চিকনা প্রতিরোধ করতে গেলে ওকে পুলিশ দিয়ে তুলিয়েছে। অনেক মেন্টাল টর্চার করেছে।

মনে হচ্ছে ওর পেছনেও অনেক ভালো ভালো মাথা আছে।

এতদিন টোডি ছাড়া মাথায় কিছু রাখিনি। প্রয়োজনে বকলমায় ওদের হ্যান্ডেল করেছি। আজ আবার এগুলোর পেছনে মনঃসংযোগ করতে হবে।

আজ ও নিরঞ্জনদার কাছে ছুটে গেছে। নিরঞ্জনদা ওকে বাঁচাবে?

ওখানকার নার্সিংহোমটা পার্টির আখরা করেছে।

সিপি হঠাৎ এই ফাইলটা দিয়ে গেল কেন? ওর নিজের স্বার্থ না অনাদিকে আমার সাহায্যে কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইছে। সচিবটা যতদূর জানি সাসপেণ্ড হয়েছিল। সে এখন অনাদির কাছের মানুষ!

দেখেছিস দিদিভাই তোকে কি বললাম, আর তুই কি বলছিলি।

গেটের সামনে তিনজন। তনু, ইসি, মিত্রা।

আজ তোর ঘরে শোবো। ইসি বললো।

ফাইলটা বন্ধ করলাম। ওদের দিকে তাকিয়ে হাসলাম।

ওরা ভেতরে এলো।

তনু একটা কাজ করবে—

বলো।

দাদার কাছ থেকে একটা নিউজপ্রিন্টের প্যাড নিয়ে এসো না।

টেবিলের ওপর আছে।

দেখতে পেলাম না।

তুই এখন লিখতে বসবি! মিত্রা বললো।

কাল পর্শুর ইনস্টলমেন্টটা লিখে দিই।

তোর দম আছে।

অনিসারা শুয়ে পড়েছে?

না। তার বাপের কীর্তি শুনছিল এতক্ষণ।

সব একদিনে দিস না। বদহজম হয়ে যাবে।

তোর থেকে ওদের নেওয়ার ক্ষমতা বেশি।

তোর মেয়ে বলে কথা।

মিত্রা তেড়ে এলো।

এই দেখো, আমি মিথ্যে কথা বললাম ইসি?

ইসি হাসছে।

আজ আমার কি সৌভাগ্য বলতো।

ইসির দিকে তাকিয়ে খালি ইসারা করলাম। মিত্রা দেখে ফেলেছে।

বুবুন তিনজনে মিলে এমন দেব না, দম আটকে যাবে।

ঠিক আছে হয়ে যাক।

তবেরে মিত্রা আবার তেড়ে এলো।

এটা কি হচ্ছে মুখ থাকতে হাতে কেন। বড়ো জোড় শরীরটা কাজে লাগান যেতে পারে।

খুব রস না।

তনু টেবিলের কাছ থেকে হেসে উঠলো।

এই যে তোমার প্যাড।

তোমার পেনটা একটু দিও।

তনু খুব জোড়ে হেসে উঠলো।

মিত্রা বাঁকা চোখে আমার দিকে তাকাল।

বাবা গুড নাইট।

দেখলাম মেয়ে গেটের মুখে। গুড নাইট।

মেয়ে আর দাঁড়াল না।

তোরা রেডি হ। আমি একটু বাইরে দাঁড়াই।

তুই থাকলেও অসুবিধে নেই, বাথরুম আছে। ইসি বললো।

আমি ঝোলাটা কাঁধে নিয়ে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। বাগানের সব আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে। গেটের মুখে ছগনভাই-এর ঘড়ের সামনে একটা আলো জ্বলছে। পাশের ঘর থেকে ইসলামভাইয়ের গলা পেলাম।

এগিয়ে গেলাম। ওরা দরজা বন্ধ করলো।

এই ঘরে ইসলামভাই, ইকবালভাই। গেটটা সামান্য ভেজান। ঘরে আলো জ্বলছে। একটু ঠেলতেই খুলে গেল। আমাকে দেখে ইসলামভাই বললো।

আয়।

ভেতরে ঢুকলাম।

ওরা চেঞ্জ করছে।

হ্যাঁ। অনিমেষদারা চলে গেছে?

না, ডাক্তারদার বাড়িতে গেল।

সবাই।

অনুপ, প্রবীর, রূপায়ণ গেল। দাদা, বিধানদা এই বাড়িতে থাকলেন কালকে মনে হয় আমাদের সঙ্গে যাবেন।

অবতার, লক্ষ্মী….।

ওরা সবাই রতনের ফ্ল্যাটে গেল। কাল সকলে চলে আসবে।

আমাকে গোটা দুয়েক সিগারেট দাও।

ইকবালভাই হাসছে।

ও মাঝে মাঝে খায়। ইসলামভাই বললো।

আমার দিকে তাকিয়ে।

প্যাকেটটা নিয়ে যা।

না। দুটো কি তিনটে দাও। একটা দেশলাই দিও।

ইসলামভাই মাথার সিয়রে রাখা বালিশের পাশ থেকে প্যাকেটটা এনে তিনটে সিগারেট আর দেশলাই দিল।

কো-অপারেটিভের দায়িত্বে এখন কে আছে?

যারা ছিল তারাই। শুধু অনাদির জায়গায় নীপার বর সুবীরকে রাখা হয়েছে।

কেমন ছেলে?

ভালো ছেলে। অনাদি থাকাকালীন ম্যানেজার হিসাবে জয়েন করে। তারপর নীপার সঙ্গে এ্যাফেয়ার্সে জড়িয়ে পরে। মিত্রা বিয়ের ব্যবস্থা করলো।

বাড়ি কোথায়?

আমাদের ফার্ম হাউসটা যেখানে তার থেকে একটু দূরে। কি যেন গ্রামটার নাম। ভুলে গেছি।

নীপা শ্বশুর বাড়ি যায় না?

যায়, কম। ছেলেটার বাবা নেই। মাও কয়েকবছর আগে মারা যান। এক বোন আছে, আমাদের নার্সিংহোমের সামনে বিয়ে হয়েছে।

অনাদির এগেন্সটে কো-অপারেটিভ কোনও লিগ্যাল স্টেপ নেয়নি?

নিয়েছে কিন্তু প্রমাণ করতে পারিনি। এমনকি কাগজপত্র পর্যন্ত সরিয়ে দিয়েছে।

ব্যাপারটা হলো কি করে?

সেই সময় প্রচুর টাকা হাতে এসেছিল। আমরা বাসে ফিনান্স করেছিলাম, প্রায় তিরিশটা মতো বাস। প্রথম মাস তিনেক ভালো ইনস্টলমেন্ট পেমেন্ট হয়েছিল। যেহেতু অনাদি ব্যাপারটা ড্রিল করতো সব কাগজপত্র ওর হাতেই ছিল।

ব্যাঙ্কের কাগজপত্র ওর কাছে থাকবে কেন?

বড্ড বেশি বিশ্বাস করে ফেলেছিলাম। এ্যাকচুয়েলি ছেলেটা ওরকম ছিল না। এমএলএ হওয়ার পর থেকেই ওর মাথাটা কেমন ঘুরে গেল। পর পর কতকগুলো নোংরা কাজ করে ফেললো। অনিমেষদা বোঝাল তুমি অনির বন্ধু তাই পার্টি থেকে তারালাম না। তারপর অনিমেষদা আর সহ্য করতে পারলো না।

যে মেয়েটার সঙ্গে এখন থাকে তার সঙ্গে কোনওদিন মিট করেছো।

ইসলামভাই ঝট করে উঠে দাঁড়াল।

তুই এখন যা। সারাদিন অনেক ঝড় সামলেছিস। একটু শুয়ে পর।

ইকবালভাই, আনোয়ারের খবর কি?

এতদিন কোনও পাত্তা দেয়নি। আজ সকালে ফোন করেছিল। একটা রফা করতে চাইছে।

তুমি কি বলেছো?

সাগিরের সঙ্গে কথা বলতে বলেছি।

এর বেশি আর কিছু বলতে যাবে না। ইসলামভাই জানে?

আমি জানিয়েছি।

আনোয়ার আর কোনও আওয়াজ দিয়েছে।

গতো সপ্তাহের ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর এখানকার সকলের মনে একটা ভয় ধরে গেছে। অতো সিক্যুরিটির মধ্যে কি করে ঘটলো। তখন তোর ক্ষমতা ওরা টের পেয়েছে। ওদের সঙ্গেও টোডির রিলেশন ছিল।

জানি।

ওখানকার আদিবাসী পার্টি স্বীকার করে নিয়েছে ঘটনাটা ওরা ঘটিয়েছে। তাছাড়া সকলে জানে তুই মরে গেছিস। এরা অনাথ হয়ে গেছে। তাই এতটা বার বেরে গেছে।

আনোয়ার এখানে না বম্বেতে।

ইকবালভাই আমার দিকে তাকাল। হেসে ফেললো।

বোম্বেতে যাওয়ার প্ল্যান করেছিল। সিপি মনে হয় রাতের দিকে এ্যারেস্ট করে লালাবাজারে রেখেছে।

টিপ কে দিয়েছে?

রতন।

এখান থেকে যাওয়ার পর?

হ্যাঁ।

তাহলে অন্য গল্প বলছিলে। সকালের ঘটনা সত্যি?

হ্যাঁ।

অনিমেষদা জানে?

আমি বলেছি।

পেটে রাখতে পার না।

তোকে কাল সকালে বলতাম।

আর যেগুলো একটু ছটফট করছে নামগুলো বলবে?

অনিমেষদা, সিপিকে বলে দিয়েছে।

কেন!

তুই তো বললি সিপিকে, অনিমেষদার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে। সিপি যদি ফোন করে জিজ্ঞাসা করে কি বলবে। সিপি এতোদিন তোমাদের কথা শুনেছে?

তোকে বোঝা মুস্কিল!

কেন?

এই বলছিস যোগাযোগ রাখতে, এই বলছিস….।

এতদিন একটা টিম চালাচ্ছ, রাজনীতি বোঝ না?

ইকবালভাই চুপ করে থাকল।

এখন শুনছে কেন বলো। ঠেলার নাম বাবাজীবন। এরপর তোমাকে দিয়ে একদিন বালাবে, দাদাকে বলবেন আমাকে একটু দেখতে, দেখেনিও।

সে স্কোপ দেব না।

যে তার দফতরের মন্ত্রীকে, সচিবকে পাত্তা না দিয়ে কনফিডেন্সিয়াল ফাইলের জেরক্স আমার হাতে তুলে দিয়ে যায়, তার দম খুব একটা কম নয়।

ইকবালভাই আমার দিকে তাকিয়ে!

তোমরা আমার কলমটা বন্ধ করে দেবে। ধরলাম ইসলামভাই জানতো না, তুমি তো জানতে। আমাকে একবার বলতে পারতে।

আঠারো বছর চুপ থেকেছি এখন কাজ করিয়ে নিতে হবে। না হলে সামনের ইলেকসনে দাঁড়ান যাবে না।

এতদূর এগিয়ে গেছে!

হ্যাঁ।

ইসলামভাই ওখানকার পরিস্থিতি?

সকাল থেকে কতো যে ফোন এসেছে বিশ্বাস করতে পারবি না।

এটা তোমার আবেগের কথা।

তুই বিশ্বাস কর। তোকে যে এতো মানুষ এখনও ভালোবাসে ভাবতেই পারছি না।

নার্সিংহোমের হাল।

ওটা অনাদি খবরদারি করছে।

টাকা পয়সা।

সব লন্ড ভন্ড।

ডাক্তারদাদা কোনও চিঠিপত্র দেয়নি।

দিয়েছে, কাজ হয়নি।

চলছে কি করে?

একচ্যুয়েলি সব তোর নামে ছিল। ওই জায়গাটা ধরেই সব খবরদারি করেছে। তাছাড়া অনাদি সব জানতো তোর ব্যাপারটা, তাই কাজে লাগিয়েছে।

বুঝেছি। শুয়ে পরো। এবার যা করবে একটু ভেবে করবে।

বেরিয়ে এলাম।

বাগানে এলাম। দেখলাম ইসলামভাই ঘরের লাইট নিভিয়ে দিল। আমার ঘরের লাইটও জ্বলছে না। ছোটো লাইটটা জ্বলছে। জানলা দিয়ে একবার উঁকি মারলাম। তিনজনেই খাটে আড়াআড়ি ভাবে শুয়ে আছে।

দেখে মনে হলো ঘুমিয়ে পরেছে।

ধীর পায়ে আমাগাছের তলায় এসে বসলাম। একটা সিগারেট ধরালাম।

ব্যাগ থেকে পামটপটা বার করলাম। চিপটা সেট করলাম।

অর্ককে একটা ম্যাসেজ করলাম। জেগে আছিস। লাস্ট আপডেট বল।

সঙ্গে সঙ্গে রিং ব্যাক হলো। ধরলাম।

হ্যালো।

তুমি জেগে আছো?

বাগানে বসে সিগারেট খাচ্ছি।

আর কে আছে?

আমি একা।

আমি এই অফিস থেকে এলাম। দাদা লেখাটা হেবি নামিয়েছে।

ওদিকের খবর?

সিপিটা হেবি সার্ভিস দিল।

কি করলো আবার!

আনোয়ারকে তুলে নিয়ে গেছে। সাকিলকে গিড়িয়ে দিয়েছে।

তোকে কে বললো?

তোমার চেইন। আসার পথে নেমে হেডকোয়ার্টারে সিওর হলাম। ওরা বললো নিউজ মেরো না।

একবারে চেপে যা। দময়ন্তী?

ওইই তো প্রথম খবরটা দিল। মেয়েটা তোমার জন্য সত্যি লড়ছে।

আমার দেখা উচিত।

তুমি তো দেখছো। বলে তো অনিদা না থাকলে পেটের জন্য দামিনীমাসির ওখানে যেতে হতো।

সাকিলকে গিড়িয়ে দিল কেন?

ওখানে গিয়ে বেশি বাড়া বাড়ি করছিল। মারটা একটু বেশি হয়ে গেছে। ওদেরও রাগ ছিল। শুনলাম মেডিক্যেলে নিয়ে গেছে।

ওখানে গেছিলি?

না চেলুয়া পাঠিয়ে দিয়েছি। সারারাত থেকে খবর তুলবে। আর আনোয়ারকে পুরো গরম তাবায় সেঁকে দিয়েছে। কামিং সিক্স মান্থ গ্যারেজ।

ওকেও কি হাসপাতালে….।

না, মনে হয় কোনও এক নার্সিংহোমে নিয়ে গেছে।

পাত্তা লাগিয়েছিস?

তুমি কি ভাবো অর্ক হাত গুটিয়ে বসে থাকবে।

কালকে আপডেট নিয়ে জানাস।

আচ্ছা। লেখা হয়ে গেছে?

এখনও শুরু করিনি।

শোবে কখন?

দেখি।

গুড নাইট।

শুভ রাত্রি।

অর্ককে ছেড়ে দিলাম।

দুবাইতে একটা কল করলাম।

আফতাব ভাই।

আরে, এতো রাতে। কোথায় তুই?

বাড়িতে।

তুমি কি ডিনারে বসেছো?

হ্যাঁ।

দিদি আছে, না একা।

অনেকদিন পর তোর দিদির সঙ্গে বসেছি।

তাহলে পড়ে কথা বলবো।

আরে বল বল। কাজ শুরু করে দিয়েছিস?

হ্যাঁ।

আমি খবর পাঠিয়ে দিয়েছি।

শুনেছি। তুমি কি এখানে প্রজেক্টটা করবে।

আবার জিজ্ঞাসা করে। তোকে একবার বলে দিয়েছি প্রসিড করতে।

আমাকে কিছু টাকা ধার দাও।

হো হো করে হাসির শব্দ হলো।

তোর দিদি তোর কথা শুনছে।

শুনুক। আমার কি আছে বলো।

তুই আমার থেকে ধনী লোক।

রাখো।

কবে শোধ দিবি।

যবে পারবো।

কাল তোর এ্যাকাউন্টে ট্রান্সফারের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আর খবর বল।

মেয়ের নামে ছেলের নামে আর পিকুর নামে সব ট্রান্সফার করে দিলম।

বেশ করেছিস। এটা ভালো কাজ করলি। এবার তোর কাজ শুরু কর।

কাকার কাজটা শেষ করি।

হ্যাঁ, ওটা আগে, তারপর সব। তোকে দেখে অনেক কিছু শিখলাম। কবে আসছিস?

দেখি মাস ছয়েকের মধ্যে যেতে পারবো না। প্রয়োজন পরলে তুমি আসবে তো।

অবশ্যই যাব। তনুবেটি ঠিক আছে?

হ্যাঁ।

সুন্দর।

হ্যাঁ ঠিক আছে।

ওরা কবে আসবে?

এ মাসের শেষের দিকে।

আচ্ছা।

ফোনটা অফ করে উঠে দাঁড়ালাম।

ফেরার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই দেখলাম অন্ধকারে দুটো ছায়া মূর্তি দাঁড়িয়ে। প্রথমটায় একটু ঘাবড়ে গেছিলাম। তারপর চোখটা একটু সয়ে যেতে দেখলাম, ইসলামভাই, ইকবালভাই।

এগিয়ে এলাম। ইসলামভাই জড়িয়ে ধরলো।

চলবে —————————



from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/i3Qfy12
via BanglaChoti

Comments