কাজলদিঘী (৮৭ নং কিস্তি)

❝কাজলদীঘি❞

BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

৮৭ নং কিস্তি
—————————

তুই এতো ভালো উর্দু বলতে পারিস!

আমি শুনেছিলাম ও জানে, নিজে কানে কখনও শুনিনি। আজ শুনলাম। ইকবালভাই বললো।

ইসলামভাইয়ের দিকে তাকাল।

কার সঙ্গে কথা বললো, বুঝতে পারলে। ইকবালভাই বললো।

আফতাবভাই। দুবাইতে যাঁর তেলের ব্যবসা!

হ্যাঁ। আরব কান্ট্রিতে যাঁর পজিশন এখন দু-নম্বরে।

যাও শুয়ে পরগে যাও। অনেক কষ্টে বনিয়াদটা তৈরি করেছি। মিস ইউজ কোরো না।

ইসলামভাই তখনও আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে।

এবার সব জলের মত পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। কোথা থেকে কি হচ্ছে। তোকে কথা দিচ্ছি পেট থেকে আর একটা কথা বেরবে না।

তিনজনে বারান্দায় এলাম।

অর্ক বললো আনোয়ার নার্সিংহোমে। সাকিল….। ইকবালভাই বললো।

সেটাও শুনে ফেলেছো।

তোর ফোনটা ভয়েজ অন না থাকলেও বেশ পরিষ্কার শুনতে পেয়েছি।

তোমরা কি আমার পেছনে দাঁড়িয়েছিলে?

না দাঁড়ালেও শুনতে পেয়েছি।

কাল সকালে জানতে পারবে। এখন শুয়ে পরো। আমি লিখতে বসি।

ঘরে ঢুকলাম।

লিখতে লিখতে টেবিলে মাথা দিয়ে কখন ঘুমিয়ে পরেছি জানি না। ঘরের মধ্যে মৃদু কথাবার্তায় ঘুমটা ভেঙে গেলো।

তোরা তিন তিনটে প্রাণী এই ঘরে রয়েছিস, তোদের কি ঘুম বাবা। বড়োমা বলছে।

এরকম ভাবে বোলো না। কালকে সারাদিনটার কথা চিন্তা করো। মিত্রা বললো।

আমি ওর মাথায় হাত রাখলাম, কপালে হাত বোলালাম টের পেল না। আর এক হয়েছে তোর দাদা। ছেলেটাকে একেবারে পিষে মেরে দিলে। তোকে লিখে দিতে হবে। কেন রে বাবা। তোদের কাগজের অফিসে কি আর লোকজন নেই।

তুমি আর কথা বলো না। জেগে যাবে।

ছেলেটা ওইভাবে ঘুমিয়ে পরলো।

বড়োমার গলাটা ভারি হয়ে এলো।

ঠিক আছে অন্যায় হয়েছে। আমরা জামা-কাপর ছাড়ার জন্য দরজা বন্ধ করলাম ও ইসলামভাই-এর ঘরে গেল। কথা বলছিল। একবার বেরিয়ে দেখলাম। তারপর এসে শুয়ে পরলাম। বিশ্বাস করো, শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পরেছি। মিত্রা বললো।

এই দেখো কাঁদে। বলছি তো আর হবে না।

দেখগে যা পেন হাতে নিয়ে ঘুমচ্ছে।

ঠিক আছে। ও ঘুমোক আমরা রেডি হয়ে নিই। তারপর ওকে ডাকবো।

ওই ঘরে গিয়ে কর। দরজা ভেজিয়ে দে।

ঠিক আছে তাই হবে।

নীচু গলায় কথার আওয়াজ, বুঝতে পারলাম নিজের নিজের জামাকাপর নিয়ে সব বেরিয়ে যাচ্ছে। কম বেশি মনে হয় সবাই উঠে পরেছে। ওরা বেরিয়ে গেল।

চোখ মেলে তাকাতে দেখলাম, টেবিল ল্যাম্পটা নেভান। পেছন ফিরে দেখলাম দরজা ভেজান। নিচের ঘর বলে সেই ভাবে আলো নেই। গাছের ছাওয়ায় অনেকটা আধা অন্ধকার। তবু বাইরে যথেষ্ট আলো।

না আর ঘুম আসবে না। ঘুম যখন একবার ভেঙে গেছে।

সোজা হয়ে বসলাম। হাতদুটো ঝিঁঝি ধরে গেছে। নিজে নিজেই একটু নারাচারা করলাম। হাতের ঝনঝনানিটা একটু কমলো।

বড়োমা ও ঘরে গিয়েই চাঁচামিচি শুরু করে দিয়েছে। বুঝছি ও ঘরে দাদার সঙ্গে বড়োমার তুমুল চলছে। দাদা চুপ। সব একতরফা হয়ে যাচ্ছে। সামান্য আওয়াজ এ ঘরের বন্ধ দরজা ভেদ করে ঢুকে পড়ছে।

বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে একটু জল দিলাম। কাল ঠিক এই সময়, হয়তো একটু আগেই এসেছি। কালকের দিন আজকের দিনের মধ্যে কতো তফাৎ। লেখাটা আবার শুরু করলাম। বাইরে হই হট্টোগোল চলছে। লেখায় মন দিলাম।

লিখতে লিখতে হঠাৎ চোখ পড়ে গেল সামনে যেন কারা দাঁড়িয়ে। লেখা থেকে চোখ তুললাম।

সুরোর ছেলে আর মিলির মেয়ে। কি যেন নাম। যাঃ ভুলে গেছি। আমার দিকে তাকিয়ে। একবার টেবিলটা ধরে উঁকি মারার চেষ্টা করলো।

তুমি লেখাপড়া করছো? মিলির মেয়েটা বললো।

বেশ মিষ্টি করে কথা বলে। এরই মধ্যে রেডি হয়ে গেছে। ওর মা চুলগুলো পেছন দিকে টেনে দুটো বিনুনি বেঁধে দিয়েছে। ফর্সা গায়ের রং। অনেকটা ওর মায়ের মতো। ছোটো ছোটো ঠোঁট দুটো বেদানা রং-এর মতো। ওর মা আচ্ছা করে মনে হয় কোনও ক্রিম টিম মাখিয়েছে। বেশ চক চক করছে।

মাথা দোলালাম।

তুমি কোন ক্লাসে পড়ো।

প্রেপ ওয়ান।

হি হি হি।

তুমি তো আমার থেকে বড়ো।

তুমি প্রেপ ওয়ানে পড়ো।

না।

তাহলে।

আপার নার্সারি।

আরি বাবা সে তো অনেক বড়ো ক্লাস।

তুমি তো আমার থেকে উঁচু ক্লাসে পড়ো।

তোমার বন্ধু কোন ক্লাসে পড়ে?

তুই বল।

তুমি জান না।

মিলির মেয়েটা মাথা দোলায়, না জানে না।

সুরোর ছেলেটার দিকে তাকালাম। ওকেও ওর মা রেডি করে দিয়েছে। মিলির মেয়ের থেকে সুরোর ছেলেটা তুলনামূলক ভাবে ঠান্ডা। এতোটা টট্টরি নয়। সুরো একগাদা পাউডার ঘসে দিয়েছে। গায়ে মুখে। মুখের আদলটা অনেকটা সুরোর মতো।

তুমি সব সময় ওর সঙ্গে কথা বলো কেন? তোমার সঙ্গে কথা বলবো না।

ওরি বাবা, কি গোঁসারে বাবা। কাছে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরলাম।

ও তো তোমার বন্ধু।

মাথা দোলায়।

বন্ধুর সঙ্গে কথা বললে রাগ করতে নেই। তুমি কথা বললে আমিও কথা বলবো। তুমি তো ওর মতো কথা বলতেই পারো না।

প্রেপ টু। গম্ভীর হয়ে বললো।

ওরি বাবা তুমি তো আমার থেকে এক ক্লাস উঁচুতে পড়ো।

ওর থেকে দু-ক্লাস উঁচুতে।

ঠিক কথা।

এতো সাজুগুজু করেছো কেন?

বেড়াতে যাব।

তাই! কোথায়?

গাড়ি করে।

চলো দেখবে চলো। সব সময় মিত্রার দোষ দেখ তাই না।

বাইরের বারন্দায় চেঁচামিচির শব্দ।

থাম না ওরকম করিস কেন, কোথায় পরে মরবো।

পেছন ফিরে তাকালাম।

দেখলাম বড়োমাকে জাপ্টে ধরে মিত্রা ঘরে ঢুকছে। একেবারে রেডি হয়ে গেছে।

বড়োমা সেই চিরা চরিত শাড়ি। মিত্রা একটা জমপেশ শাড়ি পরেছে। শরীরটা আগের থেকে একটু ভাড়ি হয়েছে। তবে শরীরের তুলনায় বুকটা অনেক ভাড়ি হয়ে গেছে।

নিশ্চই এই দুটো তোকে ডেকে তুলেছে? বড়োমা বললো।

না। অনেক আগে ঘুম ভেঙে গেছে। একটু লিখছিলাম।

আবার লেখা! মিত্রা তেড়ে এলো।

আমি ওর হাতদুটো ধরে ফেললাম।

তোর জন্য সাত সকালে দাদা বড়োমার কাছে দাঁত খিঁচুনি খেলো।

কেন?

বাচ্চা দুটো হাসে।

কেন আবার জিজ্ঞাসা করছিস?

গেট দিয়ে সুরো ছুটে এলো। বৌদি ছেড়েদাও ছেড়েদাও বেচারা….।

থাম, তোর দাদা চলে এসেছে, বড়োমার মতিগতি বিগড়ে গেছে। পদেপদে মিত্রার দোষ ধরতে শুরু করেছে।

আজ নতুন নয়। তা বলে তুমি….।

বড়োমা ঠোঁট মুখ বেঁকিয়ে হাসে।

দাদা দেখবি আয়, মা, বাবার সঙ্গে যুদ্ধ করছে।

অনিসার চেঁচানিতে মিত্রা আমার হাত ছেরে দিল।

বচ্চাদুটো তখনও হি হি করে হেসে চলেছে।

তোরা হাসছিস কেনরে?

মিত্রার ধমকানিতে ওরা দে ছুট।

সুরো পেছন পেছন দৌড়ল।

বাবা, আজ দুটো ড্রপ সিন দেখলাম। দুটোই ইউনিক।

অনিসার কথায় ওর দিকে তাকালাম।

একটা দুদুন-দিদান, আর একটা তুমি-মা।

সাহেব উঠেছেন?

কথা বলতে বলতে তনু ঘরে ঢুকলো।

আমি তনুর দিকে তাকিয়ে হাসলাম।

একটা জিনসের প্যান্ট আর একটা ঢলঢলে টপ পরেছে। এলোচুলে একটা স্কার্ফ বাঁধা। সাজে নি। ঠোঁটে লিপস্টিক নেই, কপালে কোনও টিপ পরেনি, তবু কোথায় যেন ওর সৌন্দর্যটা ধরা পরে যাচ্ছে।

সত্যি তুমি ভিআইপি। এতদিন মিত্রাদির কাছে গল্প শুনেছি। এখন চাক্ষুষ দেখছি।

আমি হাসছি।

হেসো না। সকাল থেকে তোমার জন্য একপ্রস্থ ওঘরে হয়ে গেছে।

কইরে উঠেছিস, আমার লেখাটা দে।

বড়োমা একবার গেটের দিকে তাকাল।

সকাল থেকে তোর বড়োমা এর জন্য কতো গাল দিল।

দাদা পায়ে পায়ে ঘরে ঢুকলো।

ঘরের সবাই হেসে উঠলো।

দেখলি দেখলি তনু। কোনও সেন্স আছে। মিত্রা বললো।

বড়োমা হাসছে।

তনু হেসে মিত্রার গায়ে ঢলে পরেছে।

বড়োমা এতো বললো, কোনও রি-অ্যাকসন নেই। তনু বললো।

আমি যেদিন প্রথম এ বাড়িতে এসেছি, সেদিন থেকে দেখছি। প্রথম প্রথম একটু অবাক হতাম, তারপর দেখলাম এটা না হলে এ বাড়ির প্রাণটাই উবে যাবে।

দাদা কাছে এসে দাঁড়াল।

চশমার তলা দিয়ে আমাকে একবার দেখল।

তোর বড়োমা বললো, কাল নাকি তুই ঘুমোসনি। কই দেখে বুঝতে পারছি না।

বড়োমা দাদার দিকে কট কট করে তাকিয়ে।

তিরিশ পাতা লিখেছি। একবার চোখ বুলিয়ে নাও। আমাকে শেষের পাঁচ পাতা ফেরত দিও। না হলে বাকিটা লিখতে পারবো না।

বাবাঃ তুই তো অনেক লিখে ফেলেছিস, তোর বড়োমা যে ভাবে বললো, ভাবলাম সাত-আট পাতা লিখেছিস।

বড়োমা দাদার দিকে হাসি হাসি চোখে তাকিয়ে।

আমার হাত থেকে কাগজগুলো নিয়ে চশমাটা ঠিক করে একবার লেখাটা দেখে নিল, তারপর বড়োমার দিকে তাকিয়ে একবার হাসলো, ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখার মতো হাসি।

তোমার ঘটে যদি বুদ্ধি থাকত, তাহলে তুমি এডিটর হতে। আমি নয়।

গট গট করে বেরিয়ে গেল।

সারাটা ঘর হাসির চোটে ম ম করে উঠলো।

মা দুদুনের মুখটা দেখলে।

অনিসা হাসতে হাসতে মাকে জড়িয়ে ধরলো।

হাসির রেস কাটতে না কাটতেই ছোটোমা ঘরে ঢুকলো।

কিরে মিত্রা, কি হয়েছে রে?

তখনও মিত্রা, তনু, অনিসা হেসে চলেছে।

মিত্রা, ছোটোমার দিকে তাকিয়ে।

তোরা এতো হাসছিস কেন?

দিদান তুমি দুদুনের মুখটা দেখলে না।

ও ঘেরে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো, দেখ মল্লিক যবান কাকে বলে।

মিত্রা হাসছে।

আমি প্রথমে ভড়কে গেছি।

উনি সারারাত ধরে লিখেছেন তাই এতো মেজাজ। মিত্রা বললো।

ছোটোমা কাছে এগিয়ে এসে আমার মাথাটা বুকে চেপে ধরলো। দাড়িতে হাতটা বুলিয়ে দিল।

কালরাতে আর একটা গণ্ডগোল করেছিস, তাই না?

ছোটোমার মুখের দিকে তাকালাম। ছোটোমা আমার মুখের দিকে হাসিহাসি মুখ করে চেয়ে রয়েছে।

কেউ বলে নি, সেরকম একটা গন্ধ পাচ্ছি ও ঘরে। তাই বললাম।

মুহুর্তের মধ্যে পরিবেশটা সামান্য হলেও একটু বদলে গেল। তনু, মিত্রা আমার মুখের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে।

একটু চা খাওয়াও।

বুঁচকি চায়ের পট থেকে বাবার জন্য ঢেলে আন।

বিস্কুট আনবো?

এখন না। আমি বললাম।

অনিসা বেরিয়ে গেল।

দাঁত মেজেছিস। ছোটোমা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

না। মুখটা ধুয়ে নিয়েছি।

যা দাঁত মেজে আয়। না হলে চা পাবি না।

কি এবার কিছু বলো। তনু আমার দিকে তাকিয়ে বললো।

কেন তোমার ওখানে….। মিত্রা বললো।

আমি না করে দিলে, নিজে করে খেয়ে নিত।

তোকে ধরে আচ্ছা করে দিতে হয়।

ছোটোমা চড় তুললো। আমি মাথাটা সরিয়ে নিলাম

ছোটো ওরা সব এসেগেছে। বড়োমা বললো।

দেবারা আসেনি। ফোন করেছিল মিলিকে, আসছে।

মিত্রার দিকে তাকাল।

মিত্রা ওর কাপরটা নিয়ে আয়।

তাহলে এক কাজ করো। আমি বাথরুমের কাজটা সেরে নিই। পরে চা খাব।

সেই ভালো।

আমি উঠে দাঁড়ালাম। মিত্রার দিকে তাকালাম। একটা পেয়ারা গাছের ডাল ছিঁড়ে আন।

আঙুল বার কর মাজন লাগিয়ে দিচ্ছি।

তনু হাসছে।

জানো মিত্রাদি কলকাতায় এলেই নিম দাঁতন কিনে নিয়ে যেত। একটা কাঠিকে তিন টুকরো করতো। তাই দিয়ে দাঁত মাজতো। মাঝে মাঝে আমার কাছ থেকে মাজন চেয়ে নিত। কতগুলো ব্রাস কিনে এনে দিয়েছি একটাও ইউজ করেনি।

কাল সকালে বড়োমার কাছ থেকে নুন-তেল চেয়ে নিয়ে দাঁত মেজেছে। ওখানে চলো আর একটা জিনিস দেখতে পাবে।

ঘুঁটের ছাই?

হ্যাঁ! তুমি কি করে জানলে!

সে এক কেলোর কীর্তি মিত্রাদি। বলেই তনু নিজেই হাসতে আরম্ভ করলো।

এখন থাক। ধাবায় বসে হবে।

দুজনের কথা বলার ফাঁকে, আমি বাথরুমে গিয়ে ঢুকলাম।

দরজা বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে মিত্রা, ছোটোমাকে চেপে ধরেছে। কি হয়েছে বলো—

বিশ্বাস কর আমি কিছু জানি না। প্রবীরের আসার কথা ছিল, আসতে পারছে না। অনিমেষদাকে ফোন করলো। কথাবার্তা যে টুকু শুনলাম তাতে গেইজ করছি। বার বার অনি অনি করছে।

তুমি কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে ওর চোখটা দেখলে। মিত্রা বললো।

ইস কি মিস করলাম। তনু বললো।

ওরে ও যখন কলকাতায় এসেছে, তখন সব সাজিয়ে গুছিয়ে এসেছে। বড়োমা বললো।

ইসলামভাই কিছু জানে না—মিত্রা, ছোটোমার দিকে তাকাল।

জানলে আমাকে বলবে। অনাদির সময় দেখলি না। চুপ চাপ নিজে হজম করে গেল। চল। জানিস তো ওর কান।

বুঝলাম ঘর থেকে সবাই বেরিয়ে গেল।

আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালাম, সত্যি মাথার জটাগুলো বিভৎস রূপ ধারণ করেছে। দাড়িগুলো পেটের কাছে চলে এসেছে। সাওয়ারের জলে ভালো করে স্নান করলাম।

পরনের কাপরটা ভালো করে ধুয়ে সেটা দিয়ে গা মুছলাম।

ঘরে এলাম। কেউ নেই। দরজা হাট করে খোলা।

বিছানার ওপর মিত্রা নতুন কাপর ওর্ণা রেখে গেছে। ভিঁজে কাপরটা ছেড়ে ওগুলো পরলাম। মাথার জটাগুলোকে আবার ভালো করে মুছলাম।

ভজুরাম এসে ঘরে ঢুকলো। হাসছে।

কিরে ভজু—

তোমাকে দারুণ মানিয়েছে। এক্কেবারে সাধু সাধু।

তোর পছন্দ?

হ্যাঁ। তোমাকে একটা পেন্নাম করি।

আজকে নয়।

না আজকে।

ঠিক আছে কর।

ভজুরাম পেন্নাম করে উঠে দাঁড়াল। আমাকে জড়িয়ে ধরলো।

তুমি ছিলে না দিদিমনিকে পুলিশগুলো এসে খালি জেরা করত।

তুই শুনেছিস—

হ্যাঁ—

কি বলতো—

খালি তোমার কথা জিজ্ঞাসা করতো।

কোথায় থাকো, কি করো, দিদিমনির সঙ্গে তোমার আলাপ কি করে, কবে বিয়ে হয়েছে।

দিদিমনি কি বলতো?

তুমি মরে গেছো। আমার খুব কান্না পেত। তারপর জগাই সব বলেছে।

কে জগাই!

ছগনদাদার ছেলে।

তোর সঙ্গে খুব ভাব বুঝি।

আমরা দুজনে এক সঙ্গে বাগান ঝাঁট দিই।

আমি ভজুর দিকে তাকিয়ে আছি। না পুরোটা সারেনি। এখনও মাঝে মাঝে লালা গড়িয়ে পড়ছে।

জানো বড়দাদার বুকে যন্ত্র বসিয়েছে ডাক্তারবাবু। বড়োমা খুব কাঁদত। তখন তোমাকে কতো ডেকেছি।

বুকের ভেতরটা হঠাৎ কেমন মোচর দিয়ে উঠলো। কেমন যেন একটা দলা পাকান অবস্থা। ভজু আমার মুখটা দেখে ধরতে পেরেছে।

মন খারাপ কোরো না। এখন ঠিক হয়ে গেছে।

ভজুর দিকে তাকালাম। প্রসঙ্গটা ঘোরাবার চেষ্টা করলাম।

অনিসা তোকে বকে?

এক্কেবারে না। আমাকে চিপস দেয়।

তুই এখন কোথায় শুস?

তোমার ঘরের সামনে।

ঠিক আছে তুই যা আমি যাচ্ছি।

আচ্ছা।

ভজু বেরিয়ে গেল। আমি টেবিলের সামনে এসে আমার ঝোলা কাঁধে নিলাম। একবার চেনটা খুলে দেখে নিলাম কাগজগুলো ঠিক আছে কিনা। হ্যাঁ ঠিক আছে। সিপির দেওয়া ফাইল থেকে কাগজগুলো বার করে নিজের ঝোলাতে ঢোকালাম। পামটপটা বার করলাম। কলকাতার নম্বরটা সিলেক্ট করে ডায়াল করলাম।

অর্ক।

হ্যাঁ দাদা, এখুনি তোমায় ফোন করছিলাম।

ঘুরে গেটের দিকে তাকালাম। না কেউ নেই।

বল—

চেলুয়া কারেক্ট নিউজ দিয়েছে। পিটিয়ে মেরে দিয়েছে। ও ব্যাটা ছবি নিয়ে এসেছে।

সত্যি—

বাচ্চা ছেলে এন্থু আছে—

পোস্টমর্টেম হয়েছে—

আজকে করবে—

রিপোর্টটা কালেক্ট করিস—

হ্যাঁ—

আর খবর বল—

আনোয়ারকে নার্সিংহোম থেকে দেখিয়ে নিয়ে এসে ভেতরে রেখেছে।

কি হয়ছিল?

মনেহয় রেকটামে রুল ভরে দিয়েছিল। ব্লিড হচ্ছিল।

জানিস আমার একটা সন্দেহ হচ্ছে।

কেন সিপি এতো তাড়াহুড়ো করছে?

হ্যাঁ।

আই উইটনেসকে সরিয়ে দিচ্ছে।

ঠিক ধরেছিস।

কাল তোমার কথা শুনে আমারও একটা খটকা লাগল।

কি বলতো!

ঠিক আছে পরে বলছি। তুমি আমাকে আজকের দিনটা সময় দাও।

সে তুই সময় নে। গেম যেন হাতের বাইরে চলে না যায়।

খেপেছো। বারাসাত কাজ হয়ে গেছে।

ডাক্তারদাদা বললো।

সত্যি দাদা, তুমি ছিলে না কাজ করে মজাই পেতাম না। গত সাতদিন মনে হচ্ছে আবার আমি সেই জায়গায় ফিরে গেছি।

অনাদির ডিপার্টমেন্টের কাগজপত্র জেরক্স করা।

তুমি যদি আর দুটো ঘণ্টা সময় দাও তাহলে তোমাকে দিয়ে দিতে পারি। ফাইল চলে এসেছে। আমাকে শুধু পিকআপ করতে হবে।

আয় আমি আছি। লেখাটা নিয়ে যা।

দাদা ফোন করেছিল। তুমি নাকি হেবি নামিয়েছ।

দূর এইভাবে লেখা হয় নাকি। তুই আয় তাহলে।

আমি এখুনি বেরিয়ে পড়ছি।

দেখ যেটা ভালো হয়।

আমি টেবিলের ওপর রাখা নিউজ প্রিন্টের প্যাডটা ঝোলার মধ্যে ঢোকালাম। ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলাম। বাগানে অনেকগুলো গাড়ি। রবিন গাড়ি মুছছে। এগিয়ে এলো।

দাদা কেমন আছো।

ভালো। তুই কেমন আছিস?

ভালো।

দেশে আর যাস-টাস, না যাওয়া ছেড়ে দিয়েছিস?

সপ্তাহে একবার যাই। ছেলেটাকে বিয়ে দিয়েছি, একটা নাতি হয়েছে।

করেছিস কি! ছেলে ওখানেই থাকে?

হ্যাঁ। বাসুদা কো-অপারেটিভ থেকে লোন দিয়েছে। বাজারে একটা দোকান করে দিয়েছি।

ভালো করেছিস। নাতির বয়স কতো হয়েছে?

এই তো ন-মাস পূর্ণ করে দশে পরলো।

আর বিয়েটিয়ে করেছিস নাকি?

না দাদা, তুমি বারণ করেছিলে, আর করিনি।

ইসমাইল কেমন আছে?

ভালো আছে। কাল এসেছিল। ভিড়ে দেখতে পাওনি।

গোছগাছ করে নে, একটু পর বেরবো।

আচ্ছা।

পায়ে পায়ে এ ঘরে এলাম। খুব জোড় খাওয়া দাওয়া চলছে। একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। দাদারা এ ঘরে নেই। বড়োমাদের কাউকে দেখতে পেলাম না।

আমি পা রাখতেই নীরু চেঁচিয়ে উঠলো। অনি দশটা কচুরি ইকুয়ালটু তিনটে ঢেঁকুর।

কনিষ্ক তেরে গেল।

খুব হাসাহাসি চলছে।

কয়েকটা নতুন নতুন ছেলেমেয়ের মুখ দেখলাম। ঝপা ঝাপ এসে পায়ে হাত দিল।

বলতে পারবি কোনটা কার স্যামপেল। নীরু বললো।

মিলি, টিনা, শ্রীপর্ণা জোড়ে হেসে উঠলো।

সবার জন্য আছে, না তোরা একাই ঝেড়ে দিলি?

এক ঝুড়ি।

তুই এসেগেছিস? বড়োমার ঘর থেকে ছোটোমা বেরলো।

একটু মিষ্টি খেয়ে জল খা তারপর চা দিচ্ছি।

আর সব কোথায়?

ওপরের ঘরে।

আমি সোফায় বসলাম। একে একে নীরুর ছেলে, মিলির ছেলে, টিনার মেয়ের সঙ্গে আলাপ করলাম। দেখে মনে হচ্ছে সব কটা পিঠো পিঠি। এক দেড় বছরের ছোটোবড়ো। ওদের সঙ্গে কথা বলছি। বাইরে গলার আওয়াজ পেলাম।

ছাগলটা গেল কোথায় বলোতো। পুরুষ কন্ঠস্বর।

আবার দেখো কোন খেতে গিয়ে ঘাস খাচ্ছে। মহিলা কন্ঠস্বর।

দুজনের গলাই চেনা চেনা লাগছে। উঠে দাঁড়ালাম।

গেটের সামনে একটা সৌম্য শান্ত মূর্তি। অনেকটা টাক পরে গেছে। যেটুকু আছে তাও ধব ধবে সাদা। চোখে সোনালী ফ্রেমের চশমা। হাফ প্যান্ট, গেঞ্জি পরা। মনে হয় মর্নিং ওয়াক করতে করতে ঢুকে পরেছে।

চিনতে পারছিস না?

ছুটে গিয়ে সুজিতদাকে জড়িয়ে ধরলাম।

তুই চিনতে পারবি না এটা কখনও হয়। কাল মিত্রা ফোন করেছিল, আসতাম। কিন্তু তোর গুবলুবাবুর বৌটা কিছুতেই ছারলো না।

গুবলু বিয়ে করেছে!

যা বাবা এই তো গতমাসে নাতির অন্নপ্রাসন দিলাম।

তুমি দাদু হয়ে গেছ! করেছো কি?

তুই মেয়ের বিয়ে দিয়ে দে, দেখবি দাদু হয়ে যাবি।

অনিসা পাশে দাঁড়িয়ে জোরে হেসে উঠলো।

আঙ্কেল ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।

তোমার চেহারা….।

ওরে সেভেন্টি প্লাস আর কি চাস।

বৌদি?

এই তো পেছনে ছিল। সুজিতদা পেছন ফিরে তাকাল।

গেল কোথায়?

বাড়িতে ঢুকিয়েছো, না গেট দিয়ে বিদায় করে দিয়েছ। এটা অনির বাড়ি, এবার তুমি ভেগে পরো।

যাঃ তা হয়।

ঠিক আছে আসতে দাও।

আমি সুজিতদাকে নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখলাম ইসি, তনু, মিত্রা টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে।

কাল আসতে পারলাম না বুঝলি মিত্রা, বৌমা আসতে দিলে না। বললো কাল সকালে মর্নিং ওয়াকে যখন বেরবে, তখন দেখা করে আসবে।

শরীর কেমন আছে। মিত্রা বললো।

চিনি-টা চেক করেছি, চাপটা মাঝে মাঝে বেগড় বাই করছে।

ওরা হেসে ফেললো।

এই মেয়াটাকে চিনতে পারলাম না। তনুর দিকে আঙুল তুলে, সুজিতদা আমর মুখের দিকে তাকাল।

আমার দ্বিতীয় পক্ষ।

তোকে এমন দেব না। সুজিতদা থাপ্পর মারার জন্য হাত তুললো।

কেন আমার বোনটা কি খারাপ দেখতে।

ওরা হাসছে।

কেন? ও-ই বা দেখতে খারাপ কিসের। ভালো করে দেখ তুমি, আগে দেখেছ।

তনু এগিয়ে এসে সুজিতদাকে প্রণাম করলো।

সুজিতদা তনুর দু-কাঁধে হাত রেখে মুখটা দেখছে।

বুঝলি অনি হার্ডডিক্সে কয়েকটা ব্যাড সেক্টর হয়েছে, মাঝে মাঝে রি-বুট হয়ে যায়।

আমি বুটেবল সিডিটা লাগিয়ে দিই।

দে।

তোমার কাছে একবার আমার সঙ্গে ছবি বিক্রি করতে গেছিল।

চুমুকে চমক?

ঠিক ধরেছো।

মেয়েটার নাম ত দিয়ে।

আর একবার রি-স্টার্ট করো দেখবে ফাইল ওপেন হয়ে গেছে।

তনুশ্রী।

এই তো মনে পড়েছে।

সেই যে মিষ্টি মতো মেয়েটা, তোকে বললাম, নতুন পটালি।

মনে পড়বে না মানে, কলের জলের মতো গড় গড় করে এবার মনে পড়বে।

ওরা সবাই আমাদের কথায় হেসে গড়াগড়ি খায়।

এখন দেখতে বাজে হয়ে গেছে। সুজিতদা বললো।

বয়স হয়েছে।

ছোটোমা মিষ্টির প্লেট নিয়ে এসে সামনে দাঁড়াল।

দাদা একটা।

তুমি খেপেছো ছোটো, সবে মাত্র নিমপাতার রস খেয়ে বেরলাম।

আজকাল এসব খাচ্ছ নাকি?

আমি ছোটোমার হাতে ধরা প্লেট থেকে একটা তুলে নিয়ে মুখে দিলাম।

না হলে বাঁচব না।

পার্কস্ট্রিটের ফুটপাথের কচুরি, জিলিপি।

ইস অনি, এই সাত সকালে এ কি কথা তুই মনে করিয়ে দিলি। সুজিতদা একবার এদিক ওদিক তাকিয়ে নিল।

পর্শুদিনই অফিসে থেকে বেরিয়ে তোর সেই ছেঁড়া পরোটা, ঘুগনি আর জিলিপি মারলাম, অমৃতরে অমৃত। ব্যাশ, ছেলে যে পেছনে লোক পাঠিয়েছিল বুঝিনি। বাড়িতে এসে মাকে নালিশ। তোর বৌদি রণং দেহি। কান নাক মুলেছি। আর খাব না।

আমি ছোটোমার হাতে ধরা গ্লাস থেকে একটু জল খেলাম। মিত্রা ছোটোমার হাত থেকে প্লেটটা নিয়ে নিল। ছোটোমা মুচকি মুচকি হাসছে। মিত্রা চোখ পাকিয়ে গেটের দিকে তাকাল। দেখলাম বড়োমা, বৌদি ঘরে ঢুকছে।

আমার নামে কি বদনাম হচ্ছে শুনি। বৌদি ঘরে ঢুকলো।

সুজিতদা জিভ বার করলো, এখুনি ইজ্জতটা একেবারে ধুয়ে দিত, তুই আছিস বলে এ যাত্রায় ভাগ্যের জোড়ে বেঁচে গেলাম।

আমি বৌদির কাছে গেলাম। বড়োমা পাশে দাঁড়িয়ে।

দিদির কাছে সব শুনলাম।

বড়কে ভেতরে পাঠিয়ে নিজে বাইরে এনকোয়ারি করলে।

ফালতু কথা রাখ। কবে যাবি—

কালকেই যাওয়ার ইচ্ছে ছিল।

বকিসনা।

গেলে কি খাওয়াবে।

তোর রুটি, আলুভাজা হলেই যথেষ্ট। ম্যাক্সিমাম পরটা পর্যন্ত দৌড়।

তোমার ছেলের বউ তৈরি করতে পারবে না।

খুব পারবে। দিদির বোন-ঝি বলে কথা।

বড়োমার দিকে তাকালম।

বড়োমা হাসছে।

ছোটো এককাপ লিকার দিতে পার, চিনি ছাড়া। সুজিতদা বললো।

কি রাক্ষসরে বাবা। চোদ্দগুষ্টির খিদে নিয়ে যেন বেরিয়েছে।

দেখলি দেখলি অনি, শুনলি তোর বৌদির কথা।

আমি হাসছি।

স্বভাবটা আগে বেশ মধু মধু ছিল, এখন একেবারে নিমপাতা।

সবাই সুজিতদার কথা শুনে হাসছে।

আঙ্কেল তুমি তো এতো কথা কখনও বলতে না। অনিসা বললো।

তোর বাপ এসেছে, কতো সুখ-দুঃখের কথা বেরবে। বৌদি বললো।

তনু সুন্দরকে নিয়ে এলো, সুজিতদার সম্বন্ধে সুন্দরকে তনু ইংরাজীতেই সব বোঝাচ্ছে। ও সুজিতদাকে প্রণাম করলো।

সুজিতদা আমার দিকে তাকিয়ে।

আমার ছেলে।

ধ্যুস।

সব একদিনে হবে না। পরে বলবো, ও বাংলা বোঝে না।

সুন্দর আমার দিকে তাকাল।

ড্যাড, সুজিত আঙ্কেল, থ্রি ক্রোড়।

ইয়েস।

তারপর সুজিতদার হাতটা ধরে প্রচন্ড জোর ঝাঁকিয়ে বললো, তুমি আমার ড্যাডকে একটা টাফ টাইমে হেল্প করেছ, আমিও সুযোগ পেলে তোমাকে সাহায্য করবো। সুন্দর বেরিয়ে গেল।

সুজিতদা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

তোমাকে বাড়িতে গিয়ে বলবো। বৌদি বললো।

কিরে, সব জট পেকে যাচ্ছে!

মিত্রার দিকে তাকাল। মিত্রা হাসছে।

ছোটোমা আমার জন্য আর সুজিতদার জন্য চা নিয়ে এলো।

সুজিতদা, খাস্তা কচুরী, পুরনো তেঁতুলের টক আর কুচি কুচি আলুর কষা তরকারি।

নীরু পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠলো।

ইস-স-স-স, দিলি তো সারাটা দিন নষ্ট করে।

আমি সুজিতদার দিকে তাকিয়ে হাসছি।

চোখ বন্ধ করে মেরে দাও। আমি আছি।

বলছিস। অনিসা যা তো মা।

একদম যাবি না, উল্টে পরে থাকলে কে দেখবে। বৌদি চেঁচিয়ে উঠলো।

তাহলে আমি যাই। আমি উঠে দাঁড়ালাম।

অনি বাবা ওরকম করিস না।

দূর ছাড়ো তো একটা খেলে কিছু হবে না।

একটা। সুজিতদা বললো।

এটা চিনি নয় নুন।

ওরে তোর দাদা এখন গেসো রুগী, খাওয়ার পর হাউ হাউ করবে।

ওষুধ খাবে।

অনিসা ছুটে গিয়ে রান্না ঘর থেকে কচুরী আর একটু তরকারি প্লেটে করে নিয়ে এল।

সারা ঘর হাসিতে ভরে উঠেছে।

সুজিতদা অনিসার দিকে জুল জুল করে চেয়ে রয়েছে।

সত্যি অনি তুই আমার ভাই।

সন্দেহ আছে।

এইবার বৌদি হেসে ফেলল।

সুজিতদা একটু একটু করে কচুরী ছিঁড়ে মুখে দিচ্ছে।

তোমাকে একটা টোটকা বলবো, দেখবে তোমার গ্যাস-অম্বল একেবারে চলে যাবে।

বলতো এখুনি লিখে নিই। তারপর তোর বৌদিকে এক হাত নেব।

আগে কথা দাও আমাকে একটা চাকরি দেবে। আমি এখন সম্পূর্ণ বেকার।

সুজিতদা হাঁ করে রইলো।

সবাই হাসছে।

আমার সঙ্গে মস্করা হচ্ছে। সুজিতদা চিবিয়ে চিবিয়ে বললো।

আবার সকলে হেসে উঠলো।

তুই যদি বেকার হোস আমি তস্য বেকার।

ভালোই তো নোট কামাচ্ছ।

আমার ছেলে-বউ আমাকে অফিসেই ঢুকতে দেয় না।

সুজিতদার দিকে হেলে পরে আস্তে করে বললাম, সেই কচিগুলোর কথা মনে আছে।

মনে থাকবে না মানে। আলবাৎ মনে আছে।

মিত্রারা বুঝতে পেরেছে আমি সুজিতদাকে কিছু বলেছি মুচকি মুচকি হাসছে।

তোর শেষ কাজ, ওদের মডেলিং, বহুত কামিয়েছি।

আমার কমিশন।

হজম হয়ে গেছে।

ঠিক আছে মাথায় রাখবো।

জানিস ওরা মাঝে সিনেমায় নামল। বেশ নাম করলো, তারপর এখন সব বম্বেতে। হাত দিতে পারি না।

লাগবে।

দিবি।

আমি নামধাম সব ভুলে গেছি।

তনু ইসারায় মিত্রাকে জিজ্ঞাসা করছে। মিত্রা মনে হয় কিছু বলছে, হেসে গড়িয়ে পরে।

তোরা কখন বেরবি।

তুমি চলে গেলেই বেরিয়ে পরবো।

তুই বলতে পারলি?

যা বাবা, তুমি যেমন প্রশ্ন করলে তেমন উত্তর দিলাম।

কনিষ্ক। সুজিতদা পেছন ফিরে তাকাল।

বলুন।

নেক্সট চেকআপের ডেটটা কবে রে?

আগামী সপ্তাহে। যাওয়ার আগে একবার ফোন করতে বলেছি।

কনিষ্ককে নোট দাও, না ফোঁকটসে?

আমার এক একটা কথায় অনিসা হেসে গড়িয়ে পরে।

দেখছিস দেখছিস তোর বাপকে, একবারে গরম ইস্ত্রি চালিয়ে দিচ্ছে।

দেবারা সব হই হই করতে করতে ঢুকলো।

সুজিতদা একবার দেবার দিকে তাকাল।

কিরে তোরা কোথাথেকে….।

দেবা, সুজিতদাকে দেখে ফ্যাক করে হেসেফেলল।

জানিস অনি দেবাটা আজকাল বহুত দু-নম্বরি করছে।

কেন করবে না। তুমি মাল দেবে না, ভালো ভালো জায়গা চাইবে, হবে কি করে।

কে বলেছে আমি মাল দিই না। দেবা কাল সব বিল পাঠিয়ে দিবি, কালকেই চেক দিয়ে দেব, কাল থেকে তোদের কাগজের সঙ্গে সম্পর্ক শেষ।

আমি সুজিতদার বুকের দিকে হাত বারালাম। সুজিতদা একটু সরে গিয়ে বলে উঠলো।

আবার কি হলো!

কলজেয় দম আছে।

সুজিতদা হো হো করে হেসে উঠলো।

এরাও যাবে?

হ্যাঁ।

শুধু আমি বাদ।

তোমাকে যেতে বারন করেছি?

বলেছিস একবারও?

কাউকেই বলিনি, যে যার গাড়িতে তেল ভড়ছে, আর বেরিয়ে যাচ্ছে। খাওয়া থাকা ফ্রি।

তোর সব রেডিমেড উত্তর।

নির্মাল্যর পেছন পেছন একটা সুন্দর মিষ্টি মতো মেয়ে ঢুকলো। হাতে ধরা একটা বাচ্চা মেয়ে। বছর তিনেক হবে। হাঁটছে আর বাঁশির আওয়াজ হচ্ছে। মনে হয় মিলিরটার থেকেও ছোটো।

মিত্রা জড়িয়ে ধরে আমার দিকে চোখ মারলো। অদিতি দেখে ফেলেছে হেসে উঠলো।

কিরে নির্মাল্য, একেবারে কচি।

কথাটা বলেই জিভ বার করে ফেললাম। মেয়ে দেখে ফেলেছে।

বাবা তুমি না….।

দেখ দেখ তোর বাবাকে। নির্মাল্য অনিসার দিকে তাকাল।

তারপর নিজের বৌ-এর দিকে তাকিয়ে বললো।

নতুন করে অনিদার পরিচয় দিতে হবে।

মেয়েটা লজ্জা পেয়ে গেছে।

এবার তোমাকে অনিদার সম্বন্ধে এতদিনে যা গল্প বলেছি বিশ্বাস হচ্ছে।

দেবা আজকের পথ খরচের স্পন্সর নির্মাল্য।

সবাই আবার হই হই করে উঠলো।

কেন কেন, আমি একা মুরগী হবো কেন।

ওই যে বৌকে গল্প বলেছিস, ফোঁকটসে সব কিছু হয়।

মিলি তেড়ে গেল, এবার বল।

মিলিদি খারাপ হয়ে যাচ্ছে।

সমুদ্রের ঢেউ-এর মতো হাসির রোল ঘরের কোনায় কোনায় আছড়ে পরছে।

মিত্রা, নির্মাল্যর মেয়েটাকে কোলে নিয়েছে। মেয়েটা আমার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে। কিম্ভূত কিমাকার চেহারা লোকটা কে?

নির্মল্যর বৌ এসে আমাকে প্রণাম করার জন্য ঝুঁকে পরলো। আমি হাতটা ধরে ফেললাম।

আজ থাক, পরে কোরো।

নির্মাল্যর বৌ সুজিতদাকে প্রণাম করলো।

সুজিতদার দিকে তাকালম, আগে দেখেছ?

দেখেছি মানে, বড়ের ঘরের মাসি কোনের ঘরের পিসি হয়ে কব্জি ডুবিয়ে খেয়ে এসেছি।

তারপরেই চিনি আর চাপ এ্যাটাক করলো।

দেখলি দেখলি মিত্রা কোথা থেকে কোথায় চলে এল।

তুমি যে ভাবে বললে, অন্ততঃ একটু নিঃশ্বাস নাও। নির্মাল্য বললো।

সবাই হেসে গড়াগড়ি খায়। সুজিতদা মিত্রার দিকে তাকাল।

মিত্রা হাতের ইসারায় বুঝিয়ে দিল ওটা তোমাদেরে ভাই, দাদার ব্যাপার আমরা এর মধ্যে নেই।

বাবাঃ তুই বেশ জমিয়ে বসেছিস।

অনিমেষদা দাদার ঘর থেকে কথা বলতে বলতে বেরলো। সবাই পেছন পেছন।

সুজিতদা উঠে গেল, অনিমেষদার কাছে।

ভাইকে দেখলেন।

দেখলাম মানে, অনেকদিন পর এতটা হাসলাম।

এখনও সেরকম আছে।

একদম। ও যদি বদলে যেত মুখে হয়তো কিছু বলতাম না। ভেতর ভেতর ভীষণ কষ্ট পেতাম।

অনিমেষদা হাসতে হাসতে অনিসার মুখের দিকে তাকাল।

ওর মেয়ে বাপ বাপ করছিল। এখন বুঝতে পারছে বাপ কি জিনিষ।

দাদাই খারাপ হয়ে যাবে বলে দিচ্ছি। অনিসা চেঁচিয়ে উঠলো।

কেন আমার অফিসে গিয়ে জ্বালাস নি। সুজিতদা বললো।

তোমাকে তাই বলে সবার সামনে বলতে বলেছি।

সুরো বেরলো বড়োমার ঘর থেকে। সুন্দর একটা শালোয়াড় পরেছে।

দাদা কেমন লাগছে বলো। আমার সামনে এসে দাঁড়াল।

একিরে রাক্ষুসীর মতো ঠোঁটে রক্ত লাগিয়েছিস কেন?

তেরে এলো।

দেব না চুলের মুটি ধরে।

আমি ওর হাতদুটো ধরে ফেললাম।

কিছুটা ধস্তা ধস্তি। হাসা হাসি।

অংশুকে দেখতে পাচ্ছি না।

আশেপাশে আছে কোথাও।

বলোনা কেমন লাগছে।

তোদের ওই ফ্ল্যাটের বাউন্ডারি ওয়ালে এখনও ঘুঁটে দেওয় হয়?

সুরোর হাত কাজ করে উঠলো, আমি উঃ করে উঠলাম।

আর ঘুঁটেকুড়ুনি বলবে।

আমি যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠলাম। আমি কি তাই বলেছি।

সবাই শুনেছে।

চোরের মোন বোঁচকার দিকে।

বৌদি এসে সুরোর হাতটা ছারাল। সুরো তখনও তরপে চলেছে। আমার পেটে হাত বুলিয়ে দিল। লাল হয়ে গেছে জায়গাটা।

একবারে মাংস খুবলে নেব। ঘুঁটেকুড়ুনি। সুরো ঝগরুটে মেয়ের মতো চেঁচিয়ে উঠলো।

সবাই হাসছে।

দেখলি যাকে বললো, আর যে বললো, তারা দুজন ছাড়া তোরা কেউ প্রথমে বুঝতে পেরেছিস।

মিত্রা, মিলির দিকে তাকাল।

সত্যি! ঠিক বলেছো তুমি।

আবার হাসি।

ইসলামভাই গেটের সামনে এসে দাঁড়াল পাশে অর্ক।

আমি এগিয়ে গেলাম। অনিমেষদা হাতটা চেপে ধরলো। আস্তে করে বললো, লাস্ট আপডেটটা নিয়ে বেরবি, এই তো।

হেসে ফেললাম।

বিধানদা হাসছে। ডাক্তারদাদা হাসছে, গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ইসলামভাই হাসছে। তনু, মিত্রা মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে।

কাছে গেলাম। অর্ক ফাইলটা আমার হাতে দিল।

কিছু বাকি আছে। বিকেলে পাব।

যত্ন করে রাখিস। দুটো কচুরী খেয়ে যা।

অর্ক, মিত্রার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল।

ম্যাডাম আজকে আর একটা পেন্নাম করি।

অর্ক ঝুপ করে মিত্রার পায়ে ঝুঁকে পরলো।

সেদিনকার পেন্নামের পারিশ্রমিক পাইনি।

পেন্নামের আবার পারিশ্রমিক! তনু বড়ো বড়ো চোখ করে বললো।

সবাই মিত্রার দিকে তাকিয়ে।

আপনি চাইলে সেদিনেরটা আজকে দিতে পারি। কিন্তু আজকেরটা ডিউ স্লিপ থাকবে।

অর্ক মনে করে লেখাটা নিয়ে যাবি। দাদা বললো।

আপনি দিন। নিয়ে যাচ্ছি।

দাদা উঠে ঘরে চলে গেল।

আমি সোফায় এসে বসলাম। অনিমেষদা, বিধানদা আমার দুই পাশে। আমি ফাইল থেকে কাগজগুলো বার করে ঝোলাতে ঢোকালাম। অনিমেষদা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে আর হাসছে। অর্কর হাতে ফাইলটা ফেরত দিলাম। লেখাটা এর মধ্যে নিয়ে যা।

অনিমেষদা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।

ছোটোমা অর্ককে কচুরী এনে দিল।

দাদা আপনাদের দিই একটু খেয়ে নিন।

বেরতে দেরি আছে?

আর একটু, ওরা তৈরি হচ্ছে। বিতানরা দমদম ছারলো।

ঠিক আছে। তাহলে দাও।

বিধানদা?

কম করে দিও।

ছোটোমা চলে গেল।

তুই খাবি না। অনিমেষদা বললো।

দিচ্ছে না।

ছোটো। অনিমেষদা চেঁচালো।

যাই দাদা।

ছোটোমা রান্নাঘর থেকে কাছে এসে দাঁড়াল।

বলুন।

অনিকে দেবে না।

ওর জন্য আলাদা করা হয়েছে। পরে খাবে।

মিত্রারা অর্কর দিকে তাকিয়ে আছে।

তুই দাদার ঘরে চল।

অর্কও অস্বস্তি বোধ করছিল। মিত্রার কথায় হাঁফ ছেরে বাঁচল। জনস্রোত দাদার ঘরের দিকে।

ইসলামভাই, ইকবালভাই সামনের সোফায় বসলো। দাদা, মল্লিকদা, ডাক্তারদাদাও আছে।

ছোটোমা একে একে সবার হাতে কচুরীর প্লেট দিয়ে গেল।

খাওয়া চলছে। বুঝতে পারছি অনিমেষদা উস খুস করছে কিছু বলার জন্য। আমি চুপচাপ। শেষ পর্যন্ত অনিমেষদা আর চুপ থাকতে পারল না। চোখ নাচিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো।

অর্ক কি খবর নিয়ে এল?

তুমি সামনে ছিলে। সবই তো দেখলে।

যে কাগজগুলো ঝোলায় ঢোকালি।

এগুলো লেখার মেটেরিয়ালস।

সব দরকারি কাগজ ঝোলায় রাখিস না। কোথায় হারিয়ে টারিয়ে যাবে।

ডুপ্লিকেট আছে।

আমাদের জন্যও বানিয়েছিস?

হাসলাম।

তোর সিপিটা বেশ করিতকর্মা ছেলে।

আমার না, তোমাদের। আজ না হয় কাল সরকারে যাবে। তাই তোমাদের তেল দিচ্ছে। ডিজি-ফিজি যদি বানিয়ে দাও।

অনিমেষদা হাসছে।

তুই রাজনীতি করিস না। তবে বেশ পাকাপোক্ত রাজনীতিবিদের মতো কথা বলিস।

কে বললো রাজনীতি করি না। আমি আমার ফিল্ডে যথেষ্ট রাজনীতি করি।

খবর পেলাম অনাদির লোকজন রাস্তা ঘেরাও করছে।

তাতে আমার কি। আমার যাওয়া আটকাবে না। তাছাড়া তুমি সঙ্গে আছো।

বরং তোকে ছারলেও আমাকে, বিধানবাবুকে ছারবে না। ঘেরাও করে রাখবে।

পুলিশ গিয়ে তোমাকে রেস্কিউ করবে। টিভিতে বাইট পাবে। কাল কাগজে ছবি বেরবে।

বিধানবাবু, ছেলের কথা শুনছেন।

ডাক্তারদাদা মুচকি মুচকি হাসছে।

হ্যাঁরে, অর্ক কি সাকিলের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আনল?

আমি অনিমেষদার মুখের দিকে বোকা বোকা চাহুনি নিয়ে তাকিয়ে রইলাম।

কে সাকিল?

তুই নমটা প্রথম শুনলি?

সত্যি বলছি।

লাসকাটা ঘরের ডোমটাও তোর লোক? কতো পয়সা ছড়িয়েছিস বলতো?

তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না, বিশ্বাস করো। লাসকাটা ঘর, সাকিল, পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আমার কিছু বোধগম্য হচ্ছে না।

তোর সবচেয়ে বড়ো প্লাস পয়েন্ট মানুষ যেটা ভুলে যায় তুই ভুলিস না। ঠিক মনে রেখে দিস। আরও মারাত্মক তোর ডকুমেন্টেসান। খুঁজে খুঁজে কাগজগুলো বার করে জেরক্স করে রাখিস।

আমি চুপ করে থাকলাম।

দাদা, মল্লিকদা আমার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে।

অনুপ কালকে দাদাদের দিয়ে ভোকালত নামায় সাইন করিয়েছে।

আমি অনিমেষদার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি।

এমনকি তোর ছোটোমা, বড়োমা, সুতপাকে পর্যন্ত ছারেনি।

আমি, দামিনী, বিধানবাবু, প্রবীর, ডাক্তারবাবু সবাই সাইন করলাম। বললো তুই বলেছিস। ব্যাপারটা একটু খোলসা করে বলবি।

এনজিও মানে নন গর্ভমেন্ট অর্গানাইজেসন সেখানে রাজনীতি ঢুকতে পারে না। সাদা কথায় আমি এটুকু বুঝি। তাই প্রিকয়েশন নিচ্ছি।

এটা তুই মুখের কথা বলছিস, ভেতরের কথাটা বল।

একটু সবুর করো।

নার্সিংহোমগুলো ঠিক আগের জায়গায় নেই।

মাস খানেকের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে।

তুই এতো কনফিডেন্টলি বলছিস কি করে! আমরা হলে হাজার বার ভাবতাম।

তোমার পথ আমার পথ ভিন্ন। তুমি দশজনের কথা শুনে ডিসিসন নাও। আমার ডিসিসন আমি নিই। ব্যবসা করি।

সে তো বুঝলাম। আসল কথাটা শুনি।

তুমি যেটা এই মুহুর্তে আমার মুখ থেকে শুনতে চাইছ সেটা বলে ফেলি।

কি শুনতে চাইছি বল?

কামিং ইলেকসন হতে আর কতোদিন বাকি। পাক্কা দু-বছর সাত মাস।

চলবে —————————



from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/h4q3gFX
via BanglaChoti

Comments