কাজলদিঘী (৪৮ নং কিস্তি)

❝কাজলদীঘি❞

BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

৪৮ নং কিস্তি
—————————

দাদার ঘরে ঢুকলাম। দেখলাম সনাতনবাবু আর চম্পকদা বসে আছে। দাদা আমাকে দেখেই ফোনটা তুলে নিল। ইন্টার কমে ডায়াল করেই বললো, সবেমাত্র আমার ঘরে এসে ঢুকলো বুঝেছিস। রেখে দিল।

বুঝলাম মিত্রাকে সংবাদ দেওয়া হলো।

তোকে একটা সারপ্রাইজ দেব তার সুযোগই দিচ্ছিস না। চম্পকদা বললো।

কেন?

সনাতনবাবু, চম্পকদা হাসছেন।

দাদার দিকে তাকিয়ে, আমি আবার কি অন্যায় করলাম।

একনম্বর অন্যায় তুই সেদিন ওরকম একটা দুর্ধর্ষ লেখা লিখলি। আমরা কেউ জানতেই পারলাম না। সকালে কাগজ দেখেই দাদাকে ফোন করলাম। তখন তুই ভীষণ ভাবে গণ্ডগোল করছিলি। দু-নম্বর তুই একটা ভালো কাজ করলি প্রেসের এবং সার্কুলেসনের ছেলেদের জন্য। তাও এখানে এসে জানলাম।

ছোটোবাবু এইগুলো একটু সই করে দাও দেখিনি।

কি এগুলো? সনাতনবাবু কয়েকটা কাগজ এগিয়ে দিল।

দাদার দিকে তাকালাম।

একটু চা খাওয়াবে?

দেখছিস, ওর রকমসকম দেখছিস চম্পক। দাদা বললো।

চম্পকদা হাসছে।

মহা মুস্কিল, এসব নিয়ে আমি কি করবো। আমার লাগবে না।

যা বলছে সই করে দে, ঝামেলা করছিস কেন। দাদা বললো।

তুমি বুঝবে না। অভ্যাস খারাপ হয়ে যাবে।

তুই একটা কাগজের মালিক বলে কথা, ঘরের কথা বাদ দে বাইরের লোকের কাছে তোর একটা এটিকেট আছে। চম্পকদা বললো।

রাখো তোমার এটিকেট। এগুলো আপনাকে কে বানাতে বললো।

সনাতানবাবুর দিকে তাকালাম।

ম্যাডাম।

ম্যাডামকে দিয়ে সই করিয়ে নিন।

ম্যাডাম সই করে দিয়েছেন।

ওর তো অনেক কার্ড আছে আরও লাগবে।

এগুলো এ্যাড অন কার্ড। দুজনের যে কেউ ব্যবহার করতে পারবে।

একজনের কাছে থাকলেই যথেষ্ট। আমি বরং পাসপোর্টের ফর্মটায় সই করে দিচ্ছি।

আমি পাসপোর্ট ফর্মটায় সই করতে শুরু করলাম।

চম্পকদা।

বল।

ওদের একটু বাজিয়ে দেখলেন।

আমি বাজাব কিরে! ওরা আমার থেকে অনেক এ্যাডভান্স।

সবার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন?

সেটা বরং করিয়ে দিয়েছি।

সনাতনবাবু?

বলো ছোটোবাবু।

পছন্দ।

একটু রিলিফ পাব। যা ঝামেলা শুরু করেছে সবাই।

আবার ঝামেলা! মুখ তুললাম।

হরিদা ঘরে ঢুকলো। সবাইকে চায়ের কাপ দিল। আমাকে দিল না।

আমি হরিদার দিকে তাকালাম।

এ ঘরে চা খাওয়া হবে না। সকাল থেকে কিছু খাওনি। ও ঘরে যাও, পাবে।

তোমাকে এ খবর কে দিল?

আমি জানি না।

মহা মুস্কিল। আমি চা চাইলাম, আর আমিই পেলাম না।

সকলে হাসছে।

ফোনটা বেজে উঠলো। দেখলাম দামিনীমাসি। ধরলাম।

বলো।

কিরে এখনও বেরোস নি?

যাচ্ছি যাচ্ছি। আধঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাব।

ঠিক আছে।

ফোনটা পকেটে রাখলাম।

কোথায় যাবি? দাদা আমার দিকে তাকিয়ে।

কাজ আছে।

আচ্ছা দাদা, আপনি ওকে জিজ্ঞাসা করছেন কেন?

ঠিক বলেছিস চম্পক। কেন জিজ্ঞাসা করছি?

হাসলাম।

সব সই করা হয়ে গেল। সনাতনবাবুর দিকে কাগজগুলো এগিয়ে দিলাম।

খুশি সনাতনবাবু।

সনাতনবাবু হাসছেন।

এই প্রথম কোনও কাগজ না পড়ে সই করলে।

উঠে দাঁড়ালাম। চম্পকদা সোমবার একটু বসবো।

আবার কি হলো!

কামিং সিক্স মান্থের টার্গেট সেট করে নেব।

চম্পকদা হাসলো।

আমাকে তোর দরকার পরবে না। একটা হাউসের জন্য যা যা দরকার, তুই তা করে দিয়েছিস।

দাদার দিকে তাকালম। ফিরতে দেরি হবে। বড়োমাকে বলে দিও।

দাদা আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। কোথায় যাবি!

দেখি।

এখন গণ্ডগোল পাকাসনি।

পাকাব না।

সবাই হেসে উঠলো। আমি বেরিয়ে এলাম।

করিডরের শেষ ঘরটা মিত্রার। এ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টের একজনকে ঘর থকে বেরিয়ে যেতে দেখলাম। হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে এলাম। হরিদার ছেলেকে আশে পাশে দেখতে পেলাম না। মিত্রার ঘরের নেমপ্লেটটা বেশ ঝক ঝক করছে। বুঝলাম কাজ হচ্ছে।

আমি দরজাটা একটু ফাঁক করলাম, দেখলাম মিত্রা একটা কাগজ দেখছে মন দিয়ে, অপরজিটে নীপা, মিলি, টিনা বসেও একই কাজ করছে। সবাই আমার দিকে পেছন ফিরে।

আসতে করে বললাম। আসতে পারি ম্যাডাম।

আসুন।

ভেতরে এসে দাঁড়ালাম।

কেউ আমার দিকে ঘুরে তাকাল না। আমি ঘরের চারিদিক চেয়ে চেয়ে দেখছি। দু-দিন আগে এই ঘরে ঢুকেছিলাম। তখন এই ঘরের চেহারা, আর আজ এই ঘরের চেহারার মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। টেবিলের ওপর অনেকগুলো ফুলের বুকে। এতো ফুলের বুকে এখানে কেন! কারা এসেছিল? এক ডাঁই ফাইল টেবিলের ওপর। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম।

বসুন।

মিত্রা মুখ তুললো।

তুই! শয়তান।

ওরা তিনজন পেছন ফিরে তাকাল। হেসে ফেললো।

আমি খুব গম্ভীর ভাবে বললাম।

ম্যাডাম এটা অফিস। অফিসের কিছু এটিকেট আছে, মাথায় রাখবেন।

দাঁড়া তোকে এটিকেট দেখাচ্ছি।

ওরা হাসছে। আমি না হেসে গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে।

বুঝলি টিনা ঠিক ওই জায়গায়, এখন যেরকম ভাবে দাঁড়িয়ে আছে, ঠিক ওই ভাবে।

বুঝলেন সুনীতদা।

মিত্রা চেয়ারে দোল খাচ্ছে।

আমার যিনি রিসেন্ট বস ছিলেন, তিনি যখন আমাকে এ্যাপয়েন্টমেন্ট দেন, তাকে বলেই ঢুকেছিলাম আমার একটা পা এই হাউসের ভেতরে, আর একটা এই হাউসের বাইরে থাকবে। যে কোনও সময় যদি মনে করি ভেতরের পাটাও বাইরে নিয়ে চলে যাব।

মিত্রা ছেলেদের গলা নকল করে বলছে, ওরা সকলে হাসছে।

কি সাহস! মালকিন এই চেয়ারে বসে, ঘরে আরও সব সিনিয়ার অফিসিয়ালরা বসে আছেন, সুনীতবাবু আমার আত্মীয়, সেই সময় উনি এ্যাকটিং এডিটর। যার তার চাকরি চলে যাচ্ছে। বাবুর কি রোয়াব!

তারপর চম্পকদা কি একটা যেন বলেছেন, ওমনি চম্পকদাকে সপাটে দিয়ে দিল। আমি জানতাম আপনি এ্যাডম্যানেজার আপনার সাবজেক্ট বিজ্ঞাপন। সাংবাদিক কবে থেকে হলেন।

বুঝলি মিলি, তখন আমি হাসব না কাঁদব। এতো লোকের সামনে চম্পকদার মুখটা ছোট হয়ে গেছে। ওর কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই।

মিত্রা উঠে দাঁড়াল।

বুকের ওপর ঠিক এইভাবে হাত টাকে রেখে ঠিক এই ভাবে আমার দিকে তাকাল।

ভাবলাম হয়তো চোখ মারবে।

ওমা, বলে কিনা, ম্যাডাম তাহলে আমি আসি, পারলে শোকজ করুণ। আমি তার ঠিক ঠাক উত্তর না দিতে পারলে স্যাক করবেন।

সোজা দরজার দিকে হাঁটা। আমি ডাকলাম।

ঘরের সবার থোঁতা মুখ দেখি ভোঁতা হয়ে গেছে। তখনই বুঝলাম বুবুনের বুকের মধ্যে সেই আগুন এখনও আছে। যে আগুনে একদিন আমি পুরে মরেছিলাম। এই সুযোগ আর ছাড়া যাবে না। তখন আমি মাঝ সমুদ্রে একটা ডিঙি নিয়ে ভাসছি। ব্যাশ খপ করে ওর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলাম। বল অন্যায় করেছি।

একবারে না। টিনা বললো।

তারপর রাতে ডেকে পাঠালাম। সেদিন ওর পোষাক দেখলে তুই হেঁসে মরে যেতিস।

কেন!

মালকিনের বাড়িতে গেছে একটা পাজামা পাঞ্জাবী পরে। তাও রং ওঠা।

সত্যি!

তোকে বলছি কি। মিত্রা হাসছে।

সেদিন আমার বাড়িতে আরও ভালো করে ওকে বুঝলাম, আমার বুবুন আমাকে ভুলে যায়নি। আমাকে সেই ভাবে মনে রেখেছে। বাবার কথাটা মনে পড়ে গেল, অনি ফিরে এলে ওকে ফিরিয়ে দিস না। আমি ওকে ফিরিয়ে না দিয়ে অন্যায় করেছি বল?

শেষের কথাটা বলতে গিয়ে ওর গলা ধরে এলো। মিত্রার চোখের কোল জলে ভরে গেল।

কেঁদে ফেললো।

মিলি চেয়ার ছেড়ে উঠে ছুটে মিত্রার কাছে গেল।

ওরা সবাই অপ্রস্তুত। আমি ওর দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে।

প্লীজ মিত্রাদি এরকম করবে না। তুমি এরকম করলে আমাদের খারাপ লাগে। টিনা চেয়ার থেকে উঠে কাছে গেল। নীপা হাঁ করে আছে।

মিত্রা রুমাল দিয়ে চোখের জল মুছলো। আমার দিকে তাকাল।

একটু বসবি না। তুই তো চা খাসনি। চায়ের কথা বলি।

চল বেরবো। বাথরুমে গিয়ে মুখটা ধুয়ে আয়।

কোথায় যাবি!

গেলেই দেখতে পাবি। তোর গাড়ি কোথায়?

নিচে আছে।

কে চালাচ্ছে?

রবীন।

ওকে চাবিটা দিয়ে যেতে বল। মিলি তোমরা এখন কোথায় যাবে?

কোথাও না।

যাবে নাকি আমাদের সঙ্গে?

হ্যাঁ।

মিত্রা বাথরুমে গেল।

ওকে নিয়ে চলে এসো ইন্ডিয়ান এয়ার লাইন্সের সামনে, আমি ওখানে দাঁড়াচ্ছি।

আচ্ছা।

ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।

সোজা নিচে চলে এলাম। দেখলাম রবীন দাঁড়িয়ে আছে।

কাছে ডাকলাম।

চাবিটা দিদিমনিকে দিয়ে আয়।

কেন দাদা, আমি যাব না?

আজকের দিনটা থাক।

আমি কি অফিসে থাকব?

হ্যাঁ। দাদাদের বাড়িতে পৌঁছে দিবি।

ঠিক আছে।

সোজা বরো রাস্তায় চলে এলাম।

একটা সিগারেট কিনলাম। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের সামনে। বার বার মিত্রার কান্না ভেঁজা চোখ চোখের সামনে ভেসে আসছে। নিশ্চই আজ ওদের মন খুলে গল্প করেছে। এই কান্না তার শেষ পরিণতি। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখলাম ওরা চলে এলো।

মিত্রা নিজে ড্রাইভ করছে। সামনের সিটটা খালি। ওরা পেছনে বসেছে। কাছে এসে দাঁড়াতে আমি উঠে বসলাম। এখন মুখটা অনেক পরিষ্কার। আমাকে দেখে হেসে ফেললো।

কোথায় যাবি?

বৌবাজর, কলেজস্ট্রীট ধরে সোজা বিবেকানন্দ রোড চল তারপর বলছি।

কলেজে যাবি?

ওর দিকে তাকালাম।

বল না।

কেন আবার কলেজে ভর্তি হবি?

উঃ যদি ওই বয়সটা আবার পেতাম।

আগামী জন্মে।

মিলি পেছন দিক থেকে হেঁসে উঠলো।

অনিদা তোমরা কোথায় বসে প্রেম করতে। টিনা বললো।

প্রেম! তুই খেপেছিস। যা কিছু কলেজের লনে। খুব বেশি হলে আমাদের কলেজের গেট দিয়ে বেড়িয়ে হেঁদুয়ায় ঢুকেই বাঁদিকের বেঞ্চটা। কতো কষ্টে একবার মাত্র সিনেমা দেখাতে নিয়ে যেতে পেরেছিলাম।

কেন!

বাবুর তখন কতো কাজ। পার্টি করেন না কিন্তু পার্টির লিডাররা ওর পেছন পেছন ঘুর ঘুর করে। তারপর আমার সঙ্গে ঘুরতে গেলে, তোদের পেছনে লাগবে কখন।

মিলি হেসে ফেললো।

নীপা এটা কলেজস্ট্রীট বাঁদিকের দোকানগুলো দেখেছিস। আমি, বুবুন প্রায় আসতাম। আমি বোড় হোতাম সে বাবু পুরনো বই কিনেই চলেছেন।

পয়সা পেত কোথায়?

কেন আমার মতো কতকগুলো মুর্খোকে নোট বেচতো।

টিনা হাসছে।

নীপা এটা ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি। আমাদের দু-জনের জীবনে একটা মাইলস্টোন। আমরা এই মন্দিরে দাঁড়িয়ে দু-জন দু-জনকে মেনে নিয়েছিলাম।

মিলি এই সিনেমাহলে কোনওদিন এসেছিস?

বহুবার।

আমরা দুজনে জীবনে একবারই ঢুকেছিলাম। সেই প্রথম সেই শেষ। আমি একটু দুষ্টুমি করেছিলাম বুঝলি। বাবুর সেকি গোঁসা। আর সিনেমাই দেখতে গেলনা আমার সঙ্গে।

কিগো অনিদা তুমি কিছু বলছো না যে। টিনা বললো।

আমি চুপচাপ সামনের ভিউইংগ্লাস দিয়ে রাস্তা দেখছি।

কিরে বিবেকানন্দ রোড এসে গেলাম, এবার কোথায় যাবি?

সোজা গিয়ে বেথুনের গা দিয়ে বাঁদিকে ঢোক।

নীপা এই গলির মধ্যে বিবেকান্দর বাড়ি।

একটু এগোতেই।

ওই দেখ চাচার হোটেল, বিবেকান্দ এখানে বসে গরুর মাংস খেতো। এই গলিতে বহুবার বুবুনের সঙ্গে এসেছি। যতবার এসেছি বুঝলি মিলি, ততবার মনে হয়েছে প্রথম এলাম। বুবুন এতো সুন্দর গল্প বলতো। ফাঁক পেলেই দুজনে চলে আসতাম।

সিনেমা দেখার থেকে ভাল।

সেটা পরে বুঝেছিলাম বুঝলি। তখন ওর নেওটা হয়ে পড়েছি।

বাঁদিকে ঘোর।

এদিকে কোথায় যাবি?

চুপ থাকলাম।

বল না।

সামনে বাঁদিকে ওই গাড়ি বারান্দার তলায় দাঁড় করা।

এতো মিষ্টির দোকান। মিষ্টি খাওয়াবি!

খাবি?

হ্যাঁ।

গাড়ি থেকে নামবি না।

আচ্ছা।

গাড়ি থামলো।

আমি নামলাম। ছয় রকমের মিষ্টির অর্ডার দিলাম। ওদের জন্য নলেন গুড়ের সন্দেশ, জলভড়া তালশাঁসের অর্ডার দিলাম।

খাবেন, না নিয়ে যাবেন।

খাবো। আর বাকিটা প্যাকিং করে দিন ওটা নিয়ে যাব।

ওটা বুঝেছি।

আপনারা খেতে খেতে ওগুলো রেডি করে দিচ্ছি।

উনি একটা একটা শালপাতার প্লেটে সাজিয়ে দিলেন আমি ওদের এগিয়ে দিলাম।

মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে বললো, চাইলে পাব।

এখানে সব খেয়ে নিলে বাকি জায়গায় খেতে পারবি না।

তুই কি এখন খাওয়াতে নিয়ে বেরিয়েছিস।

হ্যাঁ।

মিলি তাড়াতাড়ি সাঁটা। বেশি জল খাস না।

দুর, তুমি না কি।

সাঁটা সাঁটা।

খাওয়া হলো, আমি একটা জলের বোতল কিনে গাড়িতে দিলাম। গাড়ির পেছনের দরজাটা খুলে মিষ্টির প্যাকেটগুলো ঢোকালাম।

কিরে এতো মিষ্টি কার জন্য?

যাচ্ছিস তো, দেখতেই পাবি।

এই মিষ্টির দোকানটার নাম জানিষ। মিত্রা, নীপার দিকে তাকাল।

তুই জানিষ?

জানব না। তোর সঙ্গে এখানে এসে কতো মিষ্টি খেয়েছি। তখন তুই খাওয়াতিস না। তুই কোনও কাজ করে দিলে, আমরা তোকে খাওয়াতাম।

মনে আছে।

অবশ্যই। চ্যালেঞ্জকর, কাজটা করে দিতে পারলে নকুর সন্দেশ। রাজি।

রাজি।

এই হচ্ছে বুবুন। বুঝলি টিনা।

আমি গাড়িতে উঠে বসলাম মিত্রা চালাতে শুরু করেছে।

তোমাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে তোমরা কলেজ লাইফটা দারুণ এনজয় করেছো।

তা বলতে পারিস।

কলেজে ক্লাস না থাকলে বুবুনকে নয় লাইব্রেরীতে পাবি নয় মাঠে। নয় ড. রায়ের বাড়ি, না হয় আমার সঙ্গে হলঘরে, নয়তো হেঁদুয়াতে।

নীপা হাসছে। অনিদা তোমাকে কখনও কিস করেছে।

ওই যে বললাম না, একবার দুষ্টুমি করেছিলাম, ব্যাশ সিনেমা দেখা বন্ধ। এরপর কিস। ছেড়ে পালিয়ে যেত।

সবাই হেসে উঠলো।

ও ভীষণ শ্রদ্ধা করতে জানতো সকলকে। ওর সামনে বলছি না, তুই দেবাকে জিজ্ঞাসা করিস। বন্ধুদের কেউ এইভাবে শ্রদ্ধা করতে পারে আমি প্রথম শিখেছিলাম ওর কাছ থেকে। ও প্রায়ই বলতো, তোকে যদি আমি শ্রদ্ধা করতে না পারি, তুই আমাকে করবি কি করে।

ডানদিকে ঘোর।

এতো সেন্ট্রাল এ্যাভিনিউ চলে এলাম। তুই কি আমার বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছিস এদের?

আবার কথা বলে। সামনে ট্রাম লাইন এলে গাড়িটা স্লো করবি।

আমি ফোনটা বার করে একবার রতনকে ফোন করলাম।

বলো দাদা, তোমরা কোথায়?

তুই চলে এসেছিস?

হ্যাঁ, মাসি বললো।

আমি পেছন পাশ দিয়ে ঢুকছি।

কেন তুমি সামনের দিক দিয়ে ঢোকো।

সামনের দিক দিয়ে এদের নিয়ে যাওয়া যাবে না।

ঠিক আছে, আমি গেটের সামনে দাঁড়াচ্ছি।

তাই দাঁড়া।

কিরে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস! মিত্রা আমার দিকে তাকাল।

চল না, বুবুনের একটা আঁতুড় ঘর দেখেছিস, আর একটা দেখবি।

দামিনীমাসির বাড়ি!

হ্যাঁ।

সবাই এবার নড়ে চড়ে বসলো।

সত্যি অনিদা, আমরা মাসির বাড়ি যাচ্ছি! টিনা বললো।

আর মিনিট চারেক।

ওরা চারিদিক দেখছে।

ট্রামলাইন দিয়ে বাঁদিকে ঢুকবি। ঢুকেই বাঁদিকের গোলিতে গাড়িটা ঘোরাবি।

আচ্ছা।

মিত্রা আমার পথ নির্দেশ মতো চলতে শুরু করলো।

এইটা হচ্ছে এই পাড়ার খিড়কি দরজা। তোদের সামনের দিক দিয়ে ঢোকালাম না। প্রথম তো, ভড়কে যেতে পারিস।

কেন ঢোকালে না। টিনা বললো।

ঠিক আছে ফেরার সময় আসবো।

নীপা এটা হচ্ছে কবিরাজ শিবকালী ভট্টাচার্জের বাড়ি। নাম শুনেছো কখনও।

চিরঞ্জীব বনৌষধি যাঁর লেখা। টিনা বললো।

হ্যাঁ।

এই পাড়ায় থাকতেন!

হ্যাঁ। তখন উনিই ছিলেন এদের ডাক্তার। বিনে পয়সায় চিকিৎসা করতেন।

পাশের বাড়িটা অরতি গুপ্তের।

প্রথম মহিলা হিসাবে যিনি ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়েছিলেন। টিনা বললো।

আর এই যে সরু গলিটা দেখছো। এখানে থাকতেন গায়ক বিমান মুখোপাধ্যায়, রামকুমার চট্টোপাধ্যায়। বিমানদার বাবা ছিলেন সুবল মুখোপাধ্যায় ওনার কাছে ইন্দুবালা, আঙুরবালা আসতেন। ওরা কিন্তু এই পাড়া থাকে উঠে এসেছেন। দু-জনের কারুর কিন্তু পিতৃপরিচয় নেই, মাতৃ পরিচয়েই তাঁরা গানের জগতে রাজ করেছেন। সুবলবাবুর সঙ্গে ঠাকুর পরিবারের একটা নিভৃত যোগাযোগ ছিল। ওনার কাছে নজরুল, কমল দাশগুপ্ত ওঁর ভাই সুবল দাশগুপ্ত সকলেই আসতেন। এই পাড়ার ভেতর দিয়েই তাঁরা যাতায়াত করতেন।

মিত্রা এবার ওই সামনের বাঁদিকে ঘুরে দুটো বাড়ি পরে গাড়িটা দাঁড় করা।

মিত্রা খুব ধীরে চালাচ্ছে।

দুপাশে সারি দিয়ে মেয়ারা দাঁড়িয়ে। কেউ হয়তো শায়া ব্লাউজ পরেও দাঁড়িয়ে আছে। এ পাড়ার যা রীতি। আমাদের গাড়িটা দেখে অনেকে অনেক কথা বলছে। দুএকটা কথা ওদের কানেও যে ভেসে আসছে না তা নয়। ওরা সব যেন চোখ দিয়ে গিলছে। কারুর গলায় কোনও শব্দ নেই।

বাঁদিকে ঘুরতেই দেখলাম রাস্তার ওপর রতন আর আবিদ দাঁড়িয়ে আছে।

মিত্রা গাড়ি দাঁড় করাল। রতন দরজা খুললো। আমি নামলাম। ওরা একে একে সব নামলো। সবাই চারিদিক হাঁ করে দেখছে। রূপের হাটে বিকি কিনি চলছে।

মিত্রা গাড়ি থেকে নেমে কাছে এগিয়ে এসে আমার হাতটা ধরলো।

একবার ঘাড় উঁচু করে বাড়িটার দিকে তাকাল।

রতন পেছনে মিষ্টি আছে। দুটো বাক্স নামিয়ে নিয়ে আয়।

তুমি আবার আনতে গেলে কেন?

আমি রতনের কথার কোনও উত্তর দিলাম না। বাড়ির ভেতরে ঢুকলাম। মিত্রা আমার হাতটা শক্ত করে ধরে আছে।

কিরে ভয় করছে?

ও আমার মুখের দিকে তাকাল। হাসলো।

একটু দেখে আসিস। অন্ধকার। হোঁচট খেতে পারিস।

ওরা তিনজন আমার ঠিক পেছনে।

কাঠের শিঁড়ি। শিঁড়ি ভাঙতে গিয়ে ঢক ঢক করে আওয়াজ হচ্ছে।

দোতলায় উঠতেই একদঙ্গল মেয়ে এসে ঘিরে ধরলো। এদের সাজ পোষাক অনেক রুচি সম্মত কিন্তু চোখে মুখে সেই উগ্রতা।

অনিদা বৌদি কোনটা।

বৌদি! তোদের কি মাথা খারাপ। এতগুলো বৌ থাকতে বিয়ে করতে যাব কেন?

একজন চেঁচিয়ে উঠলো, মাসি তুমি তোমার নাগরের কথা শুনতে পাচ্ছ। বলে কিনা এতগুলো বৌ থাকতে বিয়ে করতে যাব কেন?

শিঁড়ির ওপরে মাসির চেহারাটা দেখতে পেলাম। তিন তলা থেকে নিচে নামছে।

একবারে মা মা সেজেছে।

ওমা দেখ কাণ্ড, তোদেরও নিয়ে এসেছে। মাসি তাড়াহুড়ো করে নিচে নেমে এলো।

কিরে রতন মিষ্টি কে এনেছে?

আবার কে।

মাসিকে দেখে মিত্রাদের মুখে হাসি ফুটে উঠেছে।

বৌদি শ্বশুর বাড়িতে এলো মিষ্টি নিয়ে আসবে না। রতন বললো।

ভিড়ের মধ্যে থেকেই একটা মেয়ে চেঁচিয়ে উঠলো।

কইরে নিয়ে আয়।

দেখলাম ভেতর থেকে একজন বিরাট একটা গোলাপ ফুলের বুকে নিয়ে এলো। সবাই আমাদের ঘিরে রেখেছে।

মিত্রা আমার হাতটা শক্ত করে ধরে আছে।

বলো না অনিদা বৌদি কোনটা?

তোদের বুঝতে হবে না। নিজেদের নাগরকেই খালি চেন। মাসি বললো।

তোমার নাগরের মতো যদি একটা নাগর পেতাম মাসি।

চলতো মামনি, এখানে দাঁড়ালে তোর মাথা খারাপ হয়ে যাবে।

মাসি মিত্রার হাতটা ধরতেই সকলে হই হই করে উঠলো।

মুহুর্তের মধ্যে মিত্রা আমার হাতছাড়া হয়ে গেল।

মিত্রা আর আমার কাছে নেই।

কেউ মিত্রার গাল টেপে, কেউ মিত্রার হাত ধরে, কেউ মিত্রাকে জড়িয়ে ধরে।

আমি শিঁড়ি ভাঙতে শুরু করলাম।

ওরা তিনজন অবাক হয়ে দেখছে। মিত্রার হাতে ফুলের বুকে তুলে দিল। মাসি কোনওপ্রকারে ওদের হাত থেকে মিত্রাকে রক্ষা করে ওপরে নিয়ে এলো। পেছনে সবাই।

মাসি আমরা একটু ওপরে যাব। তুমি নিচে একটু খবর দিয়ে দাও এক ঘণ্টা কেউ যেন এখন না আসে।

আবিদ বাবা একটু নিচে বলে দে।

আমরা ওপরে এলাম। লক্ষ্মী এগিয়ে এলো। দেখলাম কবিতাও আছে। কবিতা এগিয়ে এসে মিলি, টিনা, নীপার সঙ্গে কথা বললো। লক্ষ্মী আমাকে এসে প্রণাম করলো।

মাসি আর কবিতাদির মুখ থেকে বৌদির গল্প শুনে শুনে বৌদিকে দেখা হয়ে গেছে। লক্ষী বললো।

মিত্রা এটা লক্ষ্মী। মাসির ডান হাত।

আর কবিতা বাম হাত। লক্ষ্মী ঘর সামলায়, কবিতা বাইরেটা।

ও মাসি এগুলো রাখব কোথায়? রতন বললো।

লক্ষ্মীর ঘরে রাখ, হ্যাঁরে লক্ষ্মী এখন কাউকে আসতে বলেছিস?

হ্যাঁ।

কাকে।

আমার বৃহন্নলাকে।

লক্ষ্মী আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলছে। মুচকি মুচকি হাসছে। মাসি প্রথমে ধরতে পারেনি, তারপর জোড়ে হেসে উঠলো।

তুই মাসিকে সব বলে দিয়েছিস?

নইলে মাসি দূর করে দেবে। খাবো কি। তুমি তো আর চাকরি দেবে না।

মিত্রা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। তারপর মাসির মুখের দিকে তাকাল।

সেদিন রাতের কীর্তি। আমরা কেঁদে মরি। ও ওর কাজ করে। তোকে পরে বলবো। মাসি বললো।

মিত্রারা সবাই লক্ষ্মীর ঘরে বসলো। লক্ষ্মী ওদের নিয়ে গেল।

আমি মাসির ঘরে ঢুকলাম। মাসিকে বললাম বেশিক্ষণ বসবো না আরও দু-জায়গায় যেতে হবে। তোমাকে নেমন্তন্ন করতে এলাম। শুক্রবার বিয়ে করছি, রবিবার বৌ-ভাত।

মাসি আমার কান ধরলো।

কাল যাচ্ছি, আমি বড়দিকে গিয়ে রিপোর্ট করবো।

সে তুমি করতে পারো।

মাসি আমার ভাঙা বাক্স।

খাটের নিচে। কেন?

বার করতে হবে।

এখুনি!

হ্যাঁ।

কবিতাকে ডাক।

রতন গিয়ে কবিতাকে ডেকে নিয়ে এলো।

ওই ঘর থেকে হাসির শব্দ ভেসে আসছে। কবিতা এসে খাটের তলা থেকে আমার ভাঙা বাক্স বার করলো। আমি মাটিতে থেবড়ে বসে পরলাম।

নিচে কেন, খাটে বোস।

না।

মাসি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

টিনের এই বাক্সটা কলকাতায় পড়তে আসার সময় কাকা কিনে দিয়েছিল। রঙ চটে গেছে। মাসি একটা কাপর দিয়ে বাক্সটা ঢেকে রেখেছে।

ওই ঘরে হই হই, হাসাহাসি চলছে। আমি মানি পার্টস থেকে মরচে পরা চাবিটা বার করলাম। বার কয়েক চাপ দিতেই দেখলাম তালাটা খুলে গেল। এই বাক্স নিয়ে কত স্মৃতি মগজের কোনায় কোনায় খোদাই হয়ে আছে। এখান থেকে চলে যাওয়ার সময় মাসির ছল ছল চোখ দুটো এখনও চোখে ভাসে। আমি আর এখানে থাকব না। আমাকে এবার যেতে হবে। এই কথাটা গুছিয়ে বলতে মাসিকে সাতদিন সময় নিয়েছিলাম।

মেরিনাদি তখন মাস খানেক হলো মারা গেছে। আমার লেখার শেষ ইনস্টলমেন্ট যেদিন ছেপে বেরলো। পর দিন একটু বেলা করে অফিসে গেছি। মল্লিকদা নিজের চেয়ারে বসে। আমাকে দেখে মুচকি হাসলো।

আসা মাত্রই বড়োসাহেব দেখা করতে বলেছে।

কেন!

আমি কি করে জানবো।

কিছুক্ষণ নিজের চেয়ারে বসলাম।

সন্দীপ কাছে এসে বসলো।

গত চোদ্দদিন যা লিখেছিস তার মধ্যে কালকেরটা সেরা ইনস্টলমেন্ট।

আমি সন্দীপের দিকে তাকালাম।

শেষ প্যারাটা পড়তে গিয়ে চোখ ফেটে জল আসছিল।

কেন?

আচ্ছা ভদ্রমহিলা কি সত্যি তোর কেউ হন?

ওর মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলাম।

নিজের খুব আপন না হলে এ ধরণের লেখা হাত থেকে বেরতে পারে না।

আমার পরিচিতা।

তারমানে তুই ওই পাড়ায় ঘনিষ্ঠভাবে যাতায়াত করিস?

ঘনিষ্ঠভাবে বলা ভুল। তবে যাতায়াত আছে।

দাদা তোর লেখার ভীষণ প্রশংসা করলেন। আজ দাদাকে খুব উচ্ছ্বসিত লাগছে।

আমি সন্দীপের দিকে তাকালাম।

দাদা কেন ডেকেছে?

হয়তো তোর সঙ্গে এই আনন্দটা শেয়ার করবেন।

আমার থেকেও অনেক সিনিয়ার জার্নালিস্ট এই অফিসে আছেন।

সকলকে আজ ধুয়ে দিয়েছে। সুনিতদাকে তুলে আছাড়ই মেরে দিল।

উঠে দাঁড়ালাম। ধীর পায়ে নিউজরুমের বাইরে চলে এলাম।

একবার চোরা চোখে তাকিয়ে দেখলাম মল্লিকদা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।

দাদার ঘরের সামনে এসে দাঁড়াতে হরিদা আমার দিকে গম্ভীর হয়ে তাকাল।

সকাল থেকে কোথায় থাকা হয় শুনি?

কেন?

বার পাঁচেক নিউজরুমে গেছি।

ঘুম থেকে উঠতে দেরি হলো।

ওই এক রোগ।

কেন, দাদা তোমায় কিছু বলেছে?

না, ভেতরে যাও।

তুমি দাদাকে গিয়ে বলো, আমি এসেছি।

বলতে হবে না। তুমি চলে যাও। এখন কেউ নেই।

আমি দরজার লকটা সামান্য মোচড় দিয়ে একটু ফাঁক করে মুখ বারালাম।

দাদা দরজার দিকে তাকিয়ে বললো, ভেতরে আয়।

তখন দাদাকে সত্যি কত ভয় পেতাম। এটুকু বুঝতাম দাদা আমাকে অন্ধ স্নেহ করেন। কেউ কেউ ইয়ার্কির ছলে বলতো সম্পাদক পুত্র।

টেবিলের কাছে এগিয়ে গেলাম।

বোস। সকাল থেকে কিছু খেয়েছিস?

মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম।

তোর কাকা শুভঙ্করকে একটা চিঠি দিয়েছে।

দাদার মুখের দিকে তাকালাম।

কলকাতায় তুই কোথায় থাকিস তারা জানে না।

আমি চুপ করে আছি।

অফিসের খাতায় দেখলাম লোকাল এ্যাড্রেসটা ড. রায়ের।

আমি কোনও কথা বলছি না। দাঁড়িয়ে আছি।

বোস।

আমি চেয়ারে বসলাম।

বুঝলাম দাদা বেল বাজিয়েছে। হরিদা মুখ ঢুকিয়ে বললো, চা না ডিম টোস্ট।

দুটোই নিয়ে আয়।

দাদা কি লিখছিলেন আবার লেখায় মনোযোগ দিলেন। আমি চুপ চাপ বসে আছি। হরিদা ডিমটোস্ট নিয়ে এলো। এবার দাদা টেবিলে কলমটা রেখে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো।

চটপট খেয়ে নে।

আমি খেয়ে এসেছি।

ঠিক আছে দুটো পাঁউরুটি খেলে অসুবিধে হবে না।

খেতে শুরু করলাম।

শুভঙ্করের কথা মতো তোর এ্যাকাউন্ট থেকে তোর কাকাকে পাঁচ হাজার টাকা মানি অর্ডার করে দিয়েছি।

একবার দাদার দিকে তাকিয়ে মাথা নীচু করে নিলাম।

কিছু বললি না।

ঠিক আছে।

হরিদা চা নিয়ে এলো। আমার সামনে একটা কাপ, দাদার সামনে একটা কাপ বসিয়ে চলে গেল।

পরের লেখাটা কি লিখবি কিছু ভেবেছিস?

মাথা দোলালাম, না।

তুই যা মাইনে পাস তার থেকে ওই টাকাটা প্রতিমাসে তোর কাকাকে পাঠাবার ব্যবস্থা করেছি। তোর আপত্তি আছে?

না।

কলকাতায় তোর কোনও স্থায়ী ঠিকান নেই। আমার বাড়িতে অনেক ঘর খালি পড়ে আছে। তোর আপত্তি না থাকলে একটা ঘরে থাকতে পারিস।

দাদার মুখের দিকে তাকালাম।

মনে মনে বললাম, আমি যে নরকে থাকি এতে আপত্তি করার কিছু নেই।

ঘণ্টা খানেক পর আমি বেরবো। আমার সঙ্গে গিয়ে একবার দেখে আসতে পারিস।

সেদিন প্রথম দাদার বাড়িতে পা রেখেছিলাম।

তারপর সাতদিন সময় নিয়েছিলাম দামিনীমাসিকে কথাটা বলতে। সেদিন দামিনীমাসি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিল। বলেছিল তুই এবার আমাদের ভুলে যাবি।

বাক্সটা নিয়ে আসার সময় দামিনীমাসি বলেছিল এটা আমার কাছে থাক। এই বাক্সের টানে তবু তুই মাঝে মাঝে আসবি।

আমি দাদার বাড়িতে চলে এসেছিলাম ঠিক কিন্তু মন টেঁকেনি। প্রায়ই রাত-বিরেতে ফিরতাম। কোনও কোনও দিন ফিরতামই না। বুঝতাম আমার জন্য সকলের সমস্যা। অফিসের ফ্ল্যাটটা সেই সময় অযাচিত ভাবে পেয়েছিলাম। সেখানে চলে গেলাম ঠিক কিন্তু ততদিনে বড়োমা, ছোটোমার স্নেহের বাঁধনে বাঁধা পরে গেছি।

থাকো যেখানে সেখানে কিন্তু দুবেলা খেতে হবে এখানে।

ওরা সকলে হই হই করে আমার ঘরে ঢুকলো। আমার ধ্যান ভঙ্গ হলো।

বুবুন বুবুন মাসি মিষ্টি খেয়ে দোকানের নাম বলে দিয়েছে।

মিত্রার দিকে তাকিয়ে হাসলাম।

সবাইকে দিয়েছিস?

হ্যাঁ। এই দেখ ওরা সবাই মিলে আমাকে দিল।

মিত্রার গলায় সোনার হার।

তুই নিলি?

জোর করে পরিয়ে দিল।

ওই ঘরে গিয়ে বোস, আমি যাচ্ছি।

তুই কি করছিস?

একটা কাজ করছি।

এটা কার বাক্স।

আমার।

বাক্সটা খুলে দেখলাম সব ঠিক আছে। কাগজগুলো একটু নারা চারা করলাম।

মাসি মিষ্টি নিয়ে এলো।

কিগো আজ বুঝি আমি নাগর নই?

বৌমাকে নিয়ে এসেছিস।

বৌমাকে খাওয়ায়।

খাইয়েছি। তোর জন্য নিয়ে এলাম।

এরকম সাজিয়ে গুছিয়ে। কিরে লক্ষী—

আমি জানি না, তুমি মাসিকে বলো।

আমি একটা তুলে নিচ্ছি। বাকি সবাই ভাগ করে নে।

আজ তুই দুটো খা। মাসি এমন ভাবে বললো আমি হেসে ফেললাম।

মাসি এই বাক্সটা নিয়ে যাব।

না।

মাসির দিকে তাকালাম, মাসির চোখ অন্য কথা বলছে।

ওটা আমার কাছে থাক, তোর একমাত্র স্মৃতি। আমি মরার পর নিয়ে যাস।

হাসলাম। ঠিক আছে তুলে রাখো। ইসলামভাই এলো না?

আসবে।

আমি দুটো মিষ্টির একটা খেলাম আর একটা মাসিকে খাইয়ে দিলাম।

প্লেটটা এগিয়ে দিয়ে লক্ষ্মীকে বললাম, এবার তোরা খেয়ে নে।

ওরা শুধু আমার বলার অপেক্ষায় ছিল। ছোঁ মেরে নিয়ে চলে গেল।

টিনাদের দিকে তাকালাম।

তোমরা ঘুরে দেখলে?

মিলি হাসতে হাসতে বললো। তুমি চলো।

মাসির দিকে তাকালাম। মাসি হাসছে। তুমি একটু চা করো, আমি আমার আঁতুড় ঘরটা দেখিয়ে আনি। কে আছে ওখানে এখন?

তুই চলে যাবার পর ভজু থাকত, এখন কবিতা এলে শোয়, না হলে তালা বন্ধ থাকে।

খোলা না বন্ধ।

খোলা আছে। কবিতা বললো।

আমি উঠে দাঁড়ালাম। আলো অন্ধকার শিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এলাম।

ওরা চারজন আমার পেছনে। ছাদে এলাম। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। এখন আর গোধূলি বলা চলে না। চারিদিকে হই হই রই রই শব্দ।

এতো আওয়াজ কিসের বুবুন? মিত্রা বললো।

সবার ঘরেই কম বেশি খরিদ্দার আসা শুরু হয়ে গেছে। হাসা-হাসি, খেস্তা-খিস্তি, শীতকার সব মিলিয়ে মিশিয়ে একটা শব্দ।

ওরা আমার মুখের দিকে বিষ্ময়ে তাকিয়ে।

আমি নিজের ঘরে এসে দাঁড়ালাম। ছয় বাই দশ একটা ঘর। এর থেকে এখন আমার ঘরের বাথরুমটা অনেক বড়ো। একটা মসারি টাঙানো। একদিকে বিছানাটা রোল করে গুটিয়ে রাখা। মলিনতার চিহ্ণ ঘরের চারদিকে। আমি যখন ছিলাম তখন একটু পরিষ্কার ছিল। নিজেই করতাম। পরে কবিতা করে দিত।

তুই এই ঘরে থাকতিস!

হ্যাঁ।

মিত্রা আমার সামনে এসে দাঁড়াল। আমার মুখটায় হাত বোলাল।

আঠার মাস। বলতে পারিস ওই আঠার মাস আমাকে আঠার বছরের ম্যাচুরিটি দিয়েছে। অরিজিন্যালের থেকে আমার বয়স এখন আঠার বছর বেশি।

মিত্রা আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার বুকে মাথা রাখল।

এই পাড়ায় এই ঘরটুকুর ভাড়া প্রতি রাতে একশো টাকা।

জানো মিলি কখনও কখনও খুব ভিড় হতো।

আমাকে এই ঘরটা সেই রাতের জন্য ছেড়ে দিতে হতো। কোনও একটা মেয়ে আমার বিছানাতেই তাদের নাগরকে নিয়ে লুটোপুটি খেত। তখন আমি বয় গিরি করতাম। কারুর মদ এনে দিতাম, মদের সঙ্গে খাওয়ার জন্য চাট এনে দিতাম। বয় হিসাবে কাজ করে বেশ ভালো টিপস পেতাম। খরিদ্দাররা হুকুম করতো আমি তামিল করতাম। বেশ ভালো লাগতো।

পরবর্তীকালে অনেকের সঙ্গেই আমার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই সম্পর্কের খাতিরে এখনও তাদের কাছে আমার যাওয়া আসা আছে। দায়ে অদায়ে তারা আমাকে সাহায্য করে। কেউ কেউ আমার পরিচয় জানে, কেউ এখনও আমার পরিচয় জানে না। আমি এখনও তাদের চোখে বেশ্যা পট্টির দালাল। দালাল মাস্টার।

কতবার ইসলামভাই-এর কাছ থেকেই টিপস নিয়েছি। এক একদিন সারারাত না ঘুমিয়ে কেটে যেত। শোয়া হতো না। সকালবেলা ছাদের ওই কোনে একটা কল আছে। ট্যাঙ্কের সঙ্গে লাগান। স্নান করে বেরিয়ে পড়তাম। নিচে চায়ের দোকান থেকে এক ভাঁড় চা খেতাম।

তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। প্রতিদিন দশটায় ক্লাস থাকত। নটায় বেড়িয়ে পড়তাম। হেঁটে সোজা চলে যেতাম ইউনিভার্সিটিতে। ফার্স্ট ক্লাসটা করে কলেজ স্কোয়ারের ভেতরে একটা বিহারীর ছাতুর দোকান আছে, সেখান থেকে ছাতু খেতাম। দুপুর পর্যন্ত ইউনিভার্সিটি, তারপর চলে যেতাম মিত্রার কাগজে।

মিত্রার দিকে তাকালাম।

ফ্রি-ল্যান্সার। কোনওদিন লেখার বরাত পেতাম, কোনওদিন পেতাম না। মাস গেলে তিন চারশো টাকা আসতো। তার থেকে বেশি আসতো এই বাড়িতে বয়ের কাজ করে। তবু লেখার নেশাটা ছাড়তে পারলাম না। ঘসে মেজে চলে যেত কোনও প্রকারে।

সেই সময় আমার বন্ধু ছিল না। সপ্তাহে একদিন কি দু-দিন কনিষ্কদের হস্টেলে আড্ডা মারতে যেতাম। একচুয়েলি বন্ধু পাতাইনি। বন্ধু হলেই কেউ না কেউ আসতে চাইবে। কাকে নিয়ে আসবো। এমনকি তখন আমার মেলিং এ্যাড্রেস ছিলো ড. রায়ের বাড়ি অথবা অনিমেষদার বাড়ি।

তুই তখন সুরোকে পড়াতিস?

হ্যাঁ।

অনিমেষদা জানতো না।

না কাউকে জানাতাম না। কেউ জোড়জবরদস্তি জিজ্ঞাসা করলে বলতাম, একজনের বাড়ির ছাদের চিলে কোঠায় থাকি। সব তো আর সকলকে বলা যায় না।

একসময় ইউনিভার্সিটি শেষ হলো। হাতে অঢেল সময়, টিউশনির বাজারটা আমার কপালে কোনওদিন স্যুট করেনি। কি করি। আমি ভজু রামবাগানের একটা হোটেলে কাজ নিলাম। বিকেল চারটে থেকে রাত এগারটা পর্যন্ত হোটেল, তারপর এখানে এসে বয়ের কাজ। বিন্দাস কেটে যেত সেই সময়টা।

আমি নীপার দিকে তাকালাম।

কি নীপা ম্যাডাম। অনিদার থেকেও জীবনে অনেক বেশি কষ্ট পেয়েছ?

নীপা মুখ নীচু করে মাথা দোলাল। না।

আমি এতো কষ্ট করে যদি এই জায়গায় আসতে পারি, অবশ্যই মিত্রার অবদান সেখানে অনস্বীকার্য, তাহলে তোমরা আমার থেকে আরও এগোবেনা কেন, অনিদা যদি তোমাদের কাছে ডিমান্ড করে, সেটা অন্যায় হবে।

আমার আর কি অবদান। নিজে বাঁচতে তোকে আঁকড়ে ধরলাম। তবে তোকে যে খুঁজিনি তা নয়। তোর হদিস কেউ দিতে পারত না।

নীপা ম্যাডাম, লজ্জার মাথা খেয়ে ওইদিকে একটু তাকাও, ব্লু ফিল্ম কাকে বলে দেখে নাও। এখানে যা দেখবে সব লাইভ। ছাদে আছো বলে দেখতে পাচ্ছ। এখানটা অন্ধকার। তোমাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না। তবে এখানে কেউ জানলা বন্ধ করে বা লাইট নিভিয়ে এসব করে না। তাহলে মজা পাওয়া যায় না।

মিলি একবার তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে।

লজ্জার কিছু নেই মিলি। এটাও একটা পেশা। আর পাঁচটা জীবিকার মতো একটা জীবিকা। একটা জীবন। পৃথিবীর সবচেয়ে আদিমতম পেশা। এখানে এলে তোমাদের এমবিএ, ম্যানেজমেন্টের থিওরি সব ওলটপালট হয়ে যাবে। এই পাড়ার নিজস্ব একটা থিওরি আছে। তুমি যতোটা তোমার পোষাক খুলবে, ততটা পয়সা। তোমরা জগৎটা দেখার জন্য উসখুশ করছিলে, তাই তোমাদের নিয়ে এলাম, দেখালাম। তাও তোমরা দশভাগ দেখলে। এখন এই পাড়ায় বিকেল, সন্ধ্যা হয়নি।

ওরা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে!

কিগো অনিদা নিচে চলো। চা যে জুড়িয়ে গেল।

দেখলাম কবিতা।

যা যাচ্ছি।

কবিতা নিচে চলে গেল।

এই কবিতা মেয়েটাকে দেখলে, একদিন আমি এই ঘরে শুয়েছিলাম। আমার দরজা কোনওদিন বন্ধ থাকত না। বলতে পার, আমি ইচ্ছে করেই এটা করতাম। যাতে মাসির মনে কোনও সন্দেহ না হয়। একদিন কবিতা আমার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করেছিল। বেদম মার মেরেছিলাম, তারপর থেকে কবিতার লাইফটাই বদলে গেল।

তুমি কবিতাকে মেরেছ! টিনা বললো।

আমার আড়ালে একবার ওকে জিজ্ঞাসা করবে। কি বলে শুনে নেবে।

কি মিলি ম্যাডাম এ পাড়ায় এসে কাজ করতে পারবে?

সত্যি বলতে কি অনিদা, অনেক কিছু ভাবা যায়, বাস্তবে সেটা ইমপ্লিমেন্ট করা ভীষণ টাফ। বই, সংবাদ সিনেমার মাধ্যমে এই পাড়ার একটা ছবি চোখের সামনে ছিল। এখানে এসে একেবারে ওলট-পালট হয়ে গেল। আমরা যারা ওদের কেতাবী ভাষায় সেক্স ওয়ার্কার বলি, ওদের আজ খুব কাছ থেকে দেখলাম। কথা বললাম। মনে হলো আমিও একজন সেক্স ওয়ার্কার। তুমি সেদিন তোমার দেশের বাড়ি যেতে যেতে একটা কথা বলেছিলে, এভরি ওয়াইফ (উয়ম্যান) ইজ আ প্রস। কথাটা খুব গায়ে লেগেছিল। এখানে এসে দেখলাম কথাটা কতোটা বাস্তব সত্য। ওরা মিত্রাদিকে ফুলের বুকে দিল, আমাদের একটা করে গোলাপ দিল, সবাই মিলে পয়সা দিয়ে মিত্রাদির জন্য একটা সোনার হার কিনে এনে দিল। আমাদের জড়িয়ে ধরে আনন্দ করলো। একেবারে পুরুষ বিবর্জিত হয়ে। কিন্তু শরীরটা ওদের পণ্য। আমরা জাস্ট নিজেদের স্বার্থে….।

বুঝলাম মিলি ওর ইমোশানটাকে ঠিক গুছিয়ে বলতে পারলো না। শেষ পর্যন্ত গলাটা ধরে এলো। রুমাল দিয়ে চোখ মুছলো। আমার সামনে এসে দাঁড়াল। জড়িয়ে ধরে বললো।

তুমি একবার সুযোগ দাও। কথা দিচ্ছি, শরীরের শেষ বিন্দুটুকু দিয়ে লড়ে যাব।

আমি মিলির মাথায় হাত দিলাম। এই মিলি। বোকা মেয়ে কোথাকার, একবারে কাঁদবে না। কান্না দুর্বলতার লক্ষণ। এই পৃথিবীটা লড়ার জায়গা। তোমাকে প্রতি মুহূর্তে লড়াই করতে হবে।

আমি লড়াই করবো অনিদা।

এই দেখ আবার কাঁদে। চলো চলো। নিচে চলো। কবিতা অনেকক্ষণ এসে ঘুরে গেছে। ওরা সকলে আমাকে দেখছে। চোখে মুখের অবস্থা দেখে কারুর মনই যে ঠিক নেই বুঝতে পারছি।

শিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতেই দেখলাম বাবুদের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। দামী সেন্ট আতরের গন্ধে চারিদিক ভরপুর। টিনা আমার দিকে তাকাল।

গন্ধটা পেয়ে তাকাচ্ছ?

মাথা দোলালো।

সবে ঘুম ভাঙছে। এখন সুন্দর গন্ধ পাচ্ছ। এরপর মদের গন্ধ পাবে। আতর, সেন্ট, মদের গন্ধে জায়গাটা ম ম করবে। চোখ বন্ধ করে একবার ভেবেনাও।

দেখলাম ইসলামভাই শিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে।

ওপরে যেতে পারতাম। গেলাম না।

যেতে পারতে।

কিরে মামনি, কিরকম দেখলি? সখ মিটলো?

নীপা এগিয়ে গিয়ে ইসলামভাইকে জড়িয়ে ধরলো।

মেয়েগুলো আবার কল কল করে এগিয়ে এলো। অনিদা তোমার পা-টা দেখি।

কেন!

মাসি বলেছে তুমি শিবঠাকুর আবার পীরসাহেব। আর্শীবাদ করো আজকের ব্যবসাটা যেন ভালো হয়, মাসির কাছে যেন গালাগালি না খাই।

মাসি তোদের গালাগালি দেয়?

ওটা মাসির বীজ মন্ত্র, না দিলে মাসির ভাত হজম হয় না, আমাদেরও দিনটা কেমন কেমন যেন লাগে।

মিলিদের মুখটা কেমন ফ্যাকাশে।

কি মিলি ম্যাডাম চোখটা লাল কেন। অনিদার কথায় চোখে জল বেরিয়ে এসেছে। ইসলামভাই বললো।

ওরা একে একে আমাকে এসে প্রণাম করে যাচ্ছে।

মিলি মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে।

ইসলামভাই মিলির মুখটা তুলে ধরলো। মিলি চোখ বন্ধ করে। চোখের কোল বেয়ে জল গড়িয়ে পরছে। ইসলামভাই নিজের ওর্ণাদিয়ে মিলির চোখ মুছিয়ে দিল।

কাঁদলে জয় করা যাবে না। কাজ করতে হবে। অনিদাকে দেখছো।

ইসলামভাই আমর দিকে তাকাল।

কোথায় বসবি অনি?

চলো তোমার পুরনো ঘরে বসি। কিরে লক্ষ্মী?

আমার বাবু রাতে আসে, অসুবিধা নেই।

মাসি এক কোনে দাঁড়িয়ে।

কিগো তুমি আবার ভাতের হাঁড়ির মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে আছ কেন।

ওই যে তুই বলেছিস বাক্স নিয়ে চলে যাবি।

বলেছিলাম। নিয়ে যাচ্ছি না।

কে বোঝাবে বল।

ওটা তুলে রাখবে, তোমার বৌমাকে কয়েকটা জিনিষ দেখাই, তারপর। তোমার বৌমার অনেক স্মৃতি ওখানে আছে। একসময় ওইগুলো আমাকে বাঁচার ইনস্পিরেসন দিয়েছে।

কি আছে ওতে? মিত্রা আমার দিকে তাকাল।

যা দেখে আয়। আমি ওই ঘরে বসছি।

আমরা দেখবো অনিদা। টিনা বললো।

যাও।

ওরা চারজন মাসির ঘরে গেল। আমি, ইসলামভাই লক্ষ্মীর ঘরে এলাম।

এই বাড়ির সবচেয়ে দামী মেয়ে লক্ষ্মী। তার ঘরটাও সমান দামী। লক্ষ্মীর ঘরে এসে সোফায় বসলাম। ইসলামভাই আমার পাশে বসলো।

ছোটোমার সঙ্গে কথা হয়েছে?

হ্যাঁ।

এখানে এসেছি সেই সংবাদটা দিয়েছ।

দিয়েছি।

ভালো করেছো।

শুক্রবার কোনও কাজ রাখবে না।

রাখিনি।

রবিবারও।

রাখিনি।

আজ আবহাওয়া কেমন বুঝলে?

একেবারে কুল।

এ পাড়া? মাসিকে কেউ ডিস্টার্ব করেনি?

এরপরও কারুর বুকের পাটা আছে ডিস্টার্ব করার।

এখানে জায়গা দেখেছো।

দেখেছি। দামিনীর পছন্দ নয়।

তাহলে অন্য জায়গা দেখ। যেটা মাসির পছন্দ। দামের জন্য চিন্তা করো না। মুখার্জীর কাছ থেকে টেনে নেব।

ইসলামভাই হাসছে।

আচ্ছা মুখার্জী তোকে এতো ভয় পায় কেন?

আমি ইসলামভাই-এর দিকে তাকালাম।

ঠিক আছে, ঠিক আছে, তোকে জিজ্ঞাসা করবো না।

লক্ষ্মী চা নিয়ে এলো। ওর হাত থেকে নিলাম।

তুমি কি-গো, শুধু বউমনিকে কাঁদাও।

আমি কোথায় কাঁদালাম?

তোমার বাক্স থেকে কিসব দেখছে, আর কাঁদছে।

ওগুলো তোর বৌদিমনির লেখা চিঠি বুঝলি লক্ষ্মী। আজ থেকে দশ বছর আগে আমাকে লিখেছিল।

নিজের লেখা চিঠি দেখে বউমনি কাঁদছে!

হ্যাঁ।

লক্ষ্মী বেরিয়ে গেল।

কালকে একবার একটু আসতে পারবে, আমি বাড়িতে থাকবো।

কখন বল।

এই বারটা নাগাদ।

আচ্ছা।

এবার উঠবো ইসলামভাই, অনিমেষদার বাড়ি যাব।

তুই এখন অনিমেষদার বাড়ি যাবি!

নেমন্তন্ন করতে।

এখানে তুই নেমন্তন্ন করতে এসেছিলি?

হ্যাঁ।

ইসলামভাই হাসছে।

হাসছো যে।

আমাকে করলি না?

ওটা ছোটোমা করবে। আমি রতন, আবিদকে বলতে পারি, তোমাকে নয়।

তাহলে এখানে এলি যে?

তোমার মামনির শ্বশুর বাড়ি দেখাতে নিয়ে এলাম। তোমার মামনির শ্বশুর বাড়ি একটা নয়। দেখুক, না হলে জীবনটা বুঝবে কি করে।

ইসলামভাই আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

তাকিয়ে লাভ নেই, যা সত্যি তাই বললাম। এবার চলো উঠবো। নাহলে বড়োমার মুখ হাঁড়ি হয়ে যাবে, তাড়াতাড়ি ফিরবো বলে এসেছি।

তুই এতো ব্যালেন্স করিস কি করে!

নিজে থেকেই হয়ে যায়, আমি করি না।

মাসির ওখান থেকে সবাই বেরিয়ে এলাম। মাসি নীচ পর্যন্ত এলো। সঙ্গে ইসলামভাই, লক্ষ্মী, কবিতা আর যাদের ঘরে এখনও বাবু আসেনি তারা। ওরা কিছুটা গণিকাপল্লীর লাইভ দেখলো। সবাইকে বিদায় জানিয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম।

মিনিট পঁয়তাল্লিশ পরে আমরা অনিমেষদার বাড়ি এলাম। রাস্তায় কেউ কথা বলেনি। বুঝতে পারছি সবার মনটা ভাড়ি ভাড়ি। আমি শুধু পথনির্দেশ করলাম।

কি মিলি ম্যাডাম মন খারাপ, না ভেতরটা ওলট পালট হচ্ছে।

মিলি চুপ করে থাকল কোনও উত্তর দিল না।

টিনা ম্যাডাম।

তোমার প্রশ্নের উত্তর দেবার কোনও ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। বার বার মনে হচ্ছে তোমার সঙ্গে কেন বছর তিনেক আগে দেখা হয়নি।

আমারও অনিদা। তাহলে আমার জীবনটা এমন ওলটপালট হতো না। মিলি বললো।

সব ঠিক হয়ে যাবে মিলি। সময় সব কথা বলে।

কি মিত্রাবাবু।

নীপা ফিক করে হেসে উঠলো।

নীপা হাসলে যে।

তুমি মিত্রাদিকে বাবু বললে।

তুই আমার চিঠিগুলো এখনও অতো সুন্দর করে গুছিয়ে রেখেছিস।

মিত্রা আমার দিকে তাকাল।

পড়লি?

পড়লাম। নিজেকে আরও বেশি করে জানলাম।

ওই আঠারো মাস তোর চিঠিগুলো আমাকে নষ্ট হতে দেয়নি। নাহলে আমি হয় তো বয়ে যেতাম। খাতাটা দেখেছিস?

আমি মাসির কাছ থেকে নিয়ে এসেছি। বলেছি আমি নিজে এসে আবার রেখে যাব।

কেন?

আমাদের দু-জনের শেষ প্রোগ্রামের খাতা।

তোর মনে আছে?

বেথুনে যে প্রোগ্রামটা করেছিলাম, ইন্টার কলেজ কম্পিটিশনে।

হ্যাঁ।

এখন পারবি?

পারবো।

অনিদা একবার করবে। টিনা বললো।

করবো।

ডানদিকের গেটের সামনে গাড়িটা রাখ।

মিত্রা গাড়িটা সাইড করলো। আমি গাড়ি থেকে নেমে বেল বাজালাম। দারোয়ান গেটটা খুলে দিল।

গাড়িটা ভেতরে নিয়ে গিয়ে রাখুন স্যার।

আমি মিত্রার দিকে তাকালাম।

ঢুকিয়ে দিচ্ছি। একটু সর।

মিত্রা গাড়িটা ধীরে ধীরে ভেতরে নিয়ে এলো। আমি পেছন থেকে দুটো সন্দেশের বাক্স বার করলাম। ওরা হাতে হাতে ভাগ করে নিল।

শিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে এলাম।

কিরে বুবুন অনিমেষদা এখানে থাকেন!

ভাড়া দিয়ে।

ওরা একে অপরের দিকে তাকাল।

আমি দোতলায় এসে বেল বাজালাম।

সুরো দরজা খুলেই আমাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে মিত্রাকে জড়িয়ে ধরলো। নীপার দিকে তাকিয়ে বললো, তুইও এসেছিস। সুরোর চেঁচামিচিতে বৌদি বেরিয়ে এলো।

আসুন চাঁদের কনা।

আমি এখনও গেটের বাইরে, জুতো খুলিনি, এখান থেকে চলে যাব।

যেতে পারিস, মিত্রাকে আর ওদের রেখে যা।

মিত্রাদের দিকে তাকালাম। সুরো তখনও মিত্রাকে জড়িয়ে ধরে আছে।

দেখেছিস, আসলের থেকে সুদের কি মূল্য।

ওরা হাসছে।

আমরা সকলে একে একে ভেতরে এলাম।

তুই এগুলো কি নিয়ে এসেছিস?

ছেলে বিয়ে করে এলো, শ্বশুর বাড়ি থেকে তত্ব পাঠাল।

বৌদি দিলো আমার কান মূলে।

তুমিও ওর কান ধরো। মিত্রা খিল খিল করে হাসে।

আগে প্রতিদিন কান মোলা খেত, সুরোকে ঠিকমতো পড়াত না। শুধু ফাঁকি মারত। এখন এ বাড়ি আসা ভুলেই গেছে।

বৌদি অনিমেষদা আসবে না? মিত্রা বললো।

সাড়ে সাতটায় একটা প্রেস কনফারেন্স আছে। ওটা সেরে আসবে বলেছে।

অনিদা তুমি আজকে এতো মাঞ্জা দিয়েছো কেন? সুরো বললো।

তোর পছন্দ?

দারুন লাগছে। হ্যান্ডসাম। সুরো চোখমুখ বেঁকিয়ে বললো।

তোর বৌদি সকাল থেকে কতবার ড্যাব ড্যাব করে তাকাল, কিছুই বললো না। তাই ভাবছি বিয়েটা করেই ডিভোর্স করবো।

তার আগেই কর না। শুধু শুধু বিয়ে করবি কেন। বৌদি বললো।

বুঝলে ওটা না করলে সম্পত্তিগুলো হাতান যাবে না।

আবার কানটা ধরবো গিয়ে।

ধরো না ধরো। মুখে বোলছো কেন। সুরো বলে উঠলো।

কিরে মিলি কি খাবি? তোর টিনার মুখটা কেমন শুকনো শুকনো লাগছে।

মিলি, টিনা মাথা নীচু করলো।

আমার দ্বিতীয় আঁতুড় ঘরে নিয়ে গেছিলাম। কি রকম দেখাতে। এখনও ঘোড় কাটেনি।

দামিনীর ওখানে গেছিলি!

হ্যাঁ।

অনিদার ভ্যারিয়েশন বুঝতে পারছিস। বৌদি তাকাল মিলি, টিনার দিকে।

মিলি, টিনা মাথা নীচু করেই মাথা দোলাল।

ও ভীষণ মানুষের মনকে জাদু করতে জানে বুঝলি। যেমন আমাদের তিনটেকে জাদু করেছে। ওর কিছু হলেই কেঁদে মরি। ওর সেদিকে কোনও ভ্রুক্ষেপ আছে।

গাড়ি কিন্তু ডি-রেলড হয়ে যাচ্ছে। আমার পরোটা, আলুভাজা কোথায়। কিরে মিত্রা হ্যাঁ করে দেখছিস কি। মিষ্টিটা বৌদিকে খাইয়ে দে।

মিত্রা সঙ্গে সঙ্গে রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। পেছন পেছন টিনা, মিলিও। সুরো, নীপাকে নিয়ে ওর ঘরে গেল।

চলবে —————————



from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/ZQi8sHz
via BanglaChoti

Comments