কাজলদিঘী (৮৯ নং কিস্তি)

❝কাজলদীঘি❞

BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

৮৯ নং কিস্তি
—————————

রিসেপসনিস্ট মেয়েটা আমার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে।

আবার ভেতরে এসে বসলাম।

আমি জানি আমি ফিরে আসতে না আসতেই রিসেপসনিস্ট মেয়েটি ভেতরে খবর পৌঁছে দেবে। দিক। খেলাটা বেশ ভালো করে জমাতে হবে। মনে মনে বললাম, অনাদি মাথায় রাখবি মাথাটা তোর থেক আমার ভালো কাজ করে। দেখবো তোর মৌচাক আমি ভাঙতে পারি কিনা।

দরজা খুলে ভেতরে এলাম। এসপি কার সঙ্গে কথা বলছে। কৌস্তভবাবু ঘরে নেই।

আমার পক্ষে সম্ভব নয়….উনি আইনতো এটা করতে পারেন….আপনি আর দেড় বছর আছেন তারপর আপনি মন্ত্রী নাও থাকতে পারেন আমার চাকরি এখনও দশ বছর আছে।….আপনি প্রেসার করলে আমি ছুটিতে চলে যেতে বাধ্য হবো।

বুঝলাম অনাদি ফোন করেছে। আমি আমার চেয়ারে বসলাম।

ডাক্তারদাদা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে, মিত্রা মাথা নীচু করে বসে আছে। এসপি সাহেব কথা বলা শেষ করে থম মেরে বসে গেল।

ঘরটা নিস্তব্ধ একটা পিন পরলে শব্দ হবে।

কৌস্তভবাবু ঢুকলেন।

আমি মুখের দিকে তাকালাম।

হবে না স্যার।

আচ্ছা কৌস্তভ তোমার দিতে অসুবিধে কোথায়? আর একজন ওনার এখানে বসে আছে।  চেয়ারম্যান হিসাবে আমি আছি, আমরা কোনও বাধা দিচ্ছি না।

না স্যার….।

আপনার শেষ কথাটা আমি শুনতে চাই। গলাটা চড়িয়ে এবার বাজখাঁই শব্দে গড় গড় করে উঠলাম।

এই মুহূর্তে পারছি না।

আবার ব্যাগের চেনটা খুললাম। খুব ধীরে সুস্থে আর একটা গাডার মোড়া কাগজ বার করলাম। তিনটে চিঠি আছে। সোজা করলাম। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে। চশমাটা চোখে লাগিয়ে এসপির দিকে তাকালাম।

স্যার।

এসপির হাতে একটা চিঠি দিলাম।

এটা কি!

এতক্ষণ এখানে বসে যা আলোচনা করলাম এটা তার প্রতি লিপি। আপনি একটু ভালোকরে পড়ে রিসিভ করে দিন। যাওয়ার পথে থানায় আর একটা কপি দিয়ে যাব।

এসপি হেসে উঠলো।

আপনি এগুলো সব জানতেন তাই না মিঃ ব্যানার্জী। কোনটার পর কি হবে?

এসপির দিকে ফ্যাকেশ চোখে তাকালাম।

এসপি সাহেব চোখ বুলিয়ে নিয়ে কৌস্তভবাবুর দিকে তাকালেন।

কৌস্তভবাবু।

বলুন স্যার।

আপনার কাছে দুটো অপসান খোলা আছে। আপনি যেটা হোক একটা বাছতে পারেন।

আপনি বলুন আমি কি করতে পারি। আপনি সব জানেন।

আমার জানাজানির এখানে কোনও ব্যাপার নেই।

বলুন আমি করতে পারি।

এই চিঠিটা যদি আমি রিসিভ করি। চিঠির বয়ান অনুযায়ী আজ না হোক কাল আপনাকে আমি এ্যারেস্ট করতে বাধ্য হবো। এটা সুপ্রীম কোর্টের অর্ডার। হয়তো বা….নিজেই হেসে ফেললেন। আর আপনি যদি ওনার চাহিদা মতো কাগজ পত্র দিয়ে দেন তাহলে আমি চিঠিটা ওনাকে ফেরতে দিয়ে দেব।

এ-কি বলছেন স্যার!

ডাক্তারদাদা নড়ে চড়ে বসলো।

এখানে দুটো কপি আছে একটা আমাকে লেখা আর একটা লোকাল পিএসকে লেখা। দু-টোই দু-জনকে সিসি করা আছে। এবার আপনার ডিসিসান।

আপনি বলুন স্যার।

আমি কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারী। আজ ইচ্ছে প্রকাশ করলে কাল চলে যাব। স্টেট গর্ভমেন্ট আমাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য। কিন্তু আপনি বাঁচবেন না। আর আজ থেকে নার্সিংহোমের যেন কোনও ক্ষয়-ক্ষতি না হয় তার প্রোটেকসন আমাকে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। বলতে পারেন হিসাব পত্র দেখার অধিকারও আমার আছে। কোর্টের অর্ডার, না মানলে আমরা চাকরি যেতে পারে। এবার আপনি বলুন।

কৌস্তভবাবু চেয়ার থেকে উঠে এসে কাঁদো কাঁদো মুখ করে আমার হাতদুটো চেপে ধরলেন। মুখে অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এলো। স্যার।

সরি কৌস্তভবাবু, এখানে বসে নষ্ট করার মতো সময় আমার নেই, আমি পারছি না, আমাকে ক্ষমা করবেন।

আমি উঠে দাঁড়ালাম। এসপির দিকে তাকালাম।

আপনি চিঠিটা রিসিভ করে দিন।

প্লিজ স্যার আমাকে আর পাঁচমিনিট সময় দিন।

কৌস্তভবাবু হাত জোড় করে দাঁড়ালেন।

সরি।

এসপি চিঠিটা রিসিভ করে স্ট্যাম্প মারতেই আমি ছোঁ মেরে চিঠিটা হাতে নিলাম।

এসপি হাসছেন।

কফি কফির জায়গায় পরে রইলো।

আমি বেরিয়ে এলাম। এসপি আমার পেছন পেছন বেরিয়ে এলো। পাশাপাশি হাঁটছে।

আপনি বিরাট একটা চাল দিলেন।

মানছেন।

মানছি। চারিদিকে আপনার প্রচুর লোকজন।

আপনার এসবি রিপোর্ট দিয়েছে।

এটুকু না বুঝলে পুলিশে চাকরি করা বৃথা। এটাও কি আপনার একটা চাল?

এসপির দিকে তাকিয়ে হাসলাম।

দেখলাম সুন্দররা অপজিটের দোকানে দাঁড়িয়ে স্ন্যক্স খাচ্ছে। আমাকে দেখতে পেয়ে গাড়ির দিকে চলে গেল।

আপনি চিঠিটা দিন, আমি রিসিভ করিয়ে আনিয়ে দিচ্ছি।

থানাটা যাওয়ার পথে পরবে না?

এখন এই রাস্তার ধারে চলে এসেছে। এসপি সাহেব হাইরোডের দিকে আঙুল তুললো।

আমি চিঠিটা এসপির হাতে দিলাম।

একজনকে ইসারায় ডাকলেন।

একজন এসআই গোছের লোক এগিয়ে এলেন। পরি কি মরি করে ভদ্রলোক এগিয়ে এসে সাবধান পজিশনে দাঁড়ালেন। স্যার।

চিঠিটা একটু থানা থেকে রিসিভ করিয়ে আনুন।

আমার দিকে তাকালেন।

কাজ হলো এবার একটু কফি খান।

অনেকে আছে।

সবার কাছে পৌঁছে গেছে। একমাত্র আপনি খাননি।

অনিমেষদারা গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে। আমার দিকে তাকিয়ে।

পায়ে পায়ে অপজিটের দোকানটায় এলাম।

হুড়মুড় করে আঠার বছর আগে কাকার অপারেশনের দিনটা মনে পড়ে যাচ্ছে। সেদিন এখানে নিরঞ্জনদা ছিল। নিরঞ্জনদাই মেন রোলটা প্লে করেছিল। সেই সময় এখানে বসে আমি মিত্রা একসঙ্গে কফি খেয়েছি। তখন অনাদি কতো সার্ভিস দিয়েছে। আর আজ অনাদি?

ভেতরে বসবেন?

না।

আপনাকে একটু আপসেট লাগছে।

আপনি যেমন দাসত্ব করছেন, আমিও তেমনি কারু না কারুর দাসত্ব করছি।

আমি আপনার পাশে আছি।

শুনে ভালোলাগলো। কাল আমি আমার পালক পিতাকে শ্রদ্ধা জানাবো।

জানি স্যার।

পারলে আসুন।

অবশ্যই যাব।

সবাই আমাদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। এমনকি এই এলাকার ছেলেরাও এই কিম্ভূত কিমাকার সাধুবাবার সঙ্গে এসপির হেসে হেসে কথা বলাকে বেশ তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছে। এসপির সাগরেদরাও অবাক।

কফি এলো। দুজনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এলোমেল কিছু কথা বললাম। সেই এসআই ভদ্রলোক চিঠিটা রিসিভ করিয়ে এনে আমাদের সামনে স্যালুট করে দাঁড়ালেন। এসপি চিঠিটা দেখে নিয়ে আমাকে দিলেন। আমি ঝোলা ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখলাম।

কথা বলে যেটুকু বুঝলাম এসপি ভদ্রলোক এরইমধ্যে আমার বায়োডাটা আদ্যপ্রান্ত জোগাড় করে ফেলেছেন।

আপনি জানেন না মিঃ ব্যানার্জী, আপনি এই এলাকার অনেক ইয়ং ছেলের আইকন। আপনার ত্যাগ স্বীকার শুধু আমাকে ইমপ্রেসড করেনি। আমার মতো ব্যাপারটা যারা জানে তারা সকলে আপনাকে হেল্প করার জন্য মুখিয়ে আছে।

তাদের প্রতি আমার অসীম শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা রইলো। আর আপনার মুখ থেকে কথাটা শুনে ভালো লাগলো।

এসপির কাছ থেকে বিদায় নিলাম।

আমাদের গাড়ি আপনার সঙ্গে যাচ্ছে।

তার দরকার আছে কি?

এটা অর্ডার, মানতে হবে।

হাসলাম। নিজেই হাতটা বারিয়ে দিলাম। উনি আমার হাতটা ধরে কয়েকবার ঝাঁকুনি দিলেন।

কাল দেখা হবে।

রাস্তা পার হয়ে আমার গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম। মিত্রার গাড়ি ক্রশ করার সময় মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। অনিমেষদা আমার দিকে হাসি হাসি চোখে তাকিয়ে।

আমি সামনের সিটে ছোটোমার পাশে বসলাম।

সবাই আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।

গাড়ি চলতে শুরু করলো।

আমি কিছুক্ষণ জানলার দিকে তাকিয়ে গুম হয়ে বসে থাকলাম। ছোটোমা এরই মধ্যে তিন চারবার খোঁচা মেরে দিয়েছে। ছোটোমার দিকে তাকালাম।

জল খাবি?

দাও।

বোতলটা এগিয়ে দিল। জল খেলাম।

বউকে চিঠি ধরিয়েছিস, তুই কেমন স্বামী?

ও আমার বউ নয়।

তুই বলতে পারলি!

ছোটো ওর কানটা আচ্ছা করে মুলে দে। বড়োমা পেছন থেকে বললো।

ছোটোমা হাত বারিয়েছে আমি কান সরিয়ে নিলাম।

দিদি বলেছে তোকে ধরতে দিতে হবে।

রবীন গাড়ি চালাতে চালাতে হাসছে।

থাক ছেড়ে দে।

তুই নাকি বুঁচকি, বোচন আর পিকুকে সব লিখে দিয়েছিস। ছোটোমা বললো।

ছোটোমার মুখের দিকে তাকালাম। ব্যাপারটা এরকম, সন্দেহের কোনও কারণ আছে।

তাহলে?

শুধু কাগজের পার্টটা দিয়েছি। যেগুলো প্রবলেম আছে, সেগুলো নিজের হেপাজতে রেখেছি। না হলে ডাক্তারদাদা আর মিত্রাকে সব টিপে মেরে দেবে।

ওরে বাবা! তাহলে?

তাহলে আবার কি, ব-কলমে আমি ছড়ি ঘোরাবো।

অনুপ যে কালকে আমাদের দিয়ে সই করাল।

ওটা অনুপ লড়বে।

তোর কি লড়াই শেষ হবে না।

দেখতে পাচ্ছ। এই টুকু একটা নার্সিং হোম সেখানে ওই ডাক্তারটা পর্যন্ত অনাদির সঙ্গে সাঁটগাট করে গত সাত বছরে প্রায় কয়েকশো কোটি টাকা ঝেড়ে দিয়েছে।

কয়েকশো কোটি! বলিস কি? বড়োমা পেছন থেকে বললো।

মিত্রা, ডাক্তারদাদাকে এতদিন পাত্তাই দেয়নি। আর আজ বাপ বাপ করছে। মিত্রা, ডাক্তারদাদার চিঠিটা আই ওয়াশ। এসপিকেও চিঠি ধরিয়েছি। দেখ না, কাল সকালে অনাদি এসে হাজির হলো বলে।

কি করবি?

ছোটোমা বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে।

ঘুঁটে দেব। তারপরে শুকিয়ে উনুনে ধরিয়ে দেব।

দামিনীদি।

বল।

আগে মিষ্টির প্যাকেটটা বার করো। সাবই মিলে একটু মিষ্টি মুখ করি।

বৌদি, জ্যেঠিমনি জোরে হেসে উঠলো।

দিদি দাও।

পেছন ফিরলাম, দামিনীমাসি মিষ্টির প্যাকেটটা বড়োমার হাতে দিল। আমি একটা তুলে নিলাম। দেখলাম মিত্রাদের গাড়িটা পাশ দিয়ে ওভারটেক করছে। আবিদ চালাচ্ছে।

মিত্রারা আমাদের গাড়ির দিকে তাকিয়ে হই হই করে উঠল। আমি একটা মিষ্টি তুলে ওদের দেখিয়ে মুখে পুরলাম। মিত্রার চোখ বড়ো বড়ো।

দেখলাম বেশ কিছুটা গিয়ে গাড়িটা সাইড করে দাঁড়িয়ে গেল।

বড়োমা।

তুই দেখালি কেন।

তুমি দিলে কেন।

দেব না কান মূলে সব সময় মাথায় কূট বুদ্ধি না। বড়োমা দাঁত খেঁচাল।

বৌদি, দামিনীমাসি হাসে।

রবীন, মিত্রাদের গাড়ির পেছনে এসে গাড়িটা দাঁড় করাল।

পেছনে শুধুমাত্র অনিমেষদাদের গাড়ি। তারাও থামলো। আর সব গাড়ি আগে বেরিয়ে গেছে।

গাড়ি থামতেই মিত্রা নেমে এসে গাড়ির কাঁচে ধাক্কা মারতে শুরু করলো। একে একে সবাই নেমেছে। অনিমেষদাও নেমে এলো। আমি গেটের লক খুলে দিলাম।

শয়তান একা একা মিষ্টি গেলা। আমরা কি বানের জলে ভেসে এসেছি।

দেখছো দিদি দেখছো, তোমার ছুটকির কথার ছিড়ি দেখছো। বড়োমা তাকাল জ্যেঠিমনির দিকে। জ্যেঠিমনি ফিক ফিক করে হাসছে।

ওকে একা খাওয়ালে কেন। তনু বললো।

ও কি তোদের মতো সকাল থেকে গিলছে।

কথা পরে আগে মিষ্টি দাও। মিত্রা বললো।

অনিসা মায়ের রকমসকম দেখে হেসেই চলেছে।

ওলো তুই কি কচি খুকী। দুটো যেন সাপে নেউলে।

বড়োমা, অনিসার দিকে তাকাল।

তুই কি করতে দাঁত বার করছিস রে। ধিঙ্গি মেয়েটাও হয়েছে তেমনি। মায়ের তালে তাল মেরে চলেছে।

বড়োমার কথায় জ্যেঠিমনি,  দামিনীমাসি, বৌদি হাসছে।

দামিনী দুটো প্যাকেট দাও তো।

কি হলো—অনিমেষদা বললো।

সব গপ গপ করে মিষ্টি খাচ্ছে দেখ না। মিত্রা বললো।

বড়োমা, মিত্রার হাতে প্যাকেট দিল। মিত্রাই প্যাকেট থেকে সকলকে মিষ্টি ভাগ করে দিল।

তুই নাম। মিত্রা আমার দিকে তাকাল।

কেন!

নাম।

না।

মিত্রা, তনু দুজনেই ডাক্তারদাদের গাড়ির দিকে চলে গেল।

অনিমেষদা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে।

আর একটা কাজ সারলি।

আমি হাসলাম।

ডাক্তারবাবু তোর খুব প্রশংসা করছে।

প্রশংসা শুনে লাভ নেই, নোটগুলো গুছিয়ে রাখতে বলো, নাহলে দুটোকে জেল খাটাব।

কার নোট কে নয়। অনিমেষদা বললো।

বড়োমা, বৌদি, জ্যেঠিমনি, ছোটোমা হাসছে।

বলে কি, মিত্রা ওর বউ নয়। ছোটোমা বললো।

আইনত নয়। আবার দেখ কেয়েকদিন পর বলবে মিত্রা চল তোকে বিয়ে করি। আবার আমরা নেমন্তন্ন খাব।

সবাই অনিমেষদার কথায় হেসে উঠলো।

বেশ মজা হবে তাই না দাদাই, বাবার বিয়ে খাবো। অনিসা বললো।

ধ্যুস বাঁদরী কোথাকার। ছোটোমা বলে উঠল।

মিত্রা, তনু ধারে কাছে নেই। থাকলে হয়তো তেড়ে আসত। ওরা ও গাড়িতে মিষ্টি দিচ্ছে।

কিরে আমি তোর মনের কথাটা বললাম।

অনিমেষদা আমার দিকে তাকিয়ে।

আমি মুচকি মুচকি হাসছি।

ভেবে দেখলাম এছাড়া তোর কোনও গতি নেই।

তুমি এখন যাবে।

তারমানে সত্যি! বৌদি পেছন থেকে বলে উঠলো।

সুতপা এটাই ধ্রুব সত্য। নিজের ফাঁদে নিজে পা পিছলে পড়ে গেছে। না হলে এতো সম্পত্তি রক্ষা করবে কি করে। তাও কিছুটা বেঁটে দিয়েছে।

অনিমেষদা মুচকি মুচকি হাসছে।

এগুলো লিটিগেশন আছে। নিজের হেফাজতে রেখেছে। বছর খানেকের মধ্যে এগুলো ঠিক করে ফেলবে। তারপর এটাও বেঁটে দেবে। দেখ সেটাও হয়তো বাবু উইল করে রেখেছে।

রবীন গাড়ি স্টার্ট দে।

পালিয়ে যাবি কোথায়, ধরা পড়ে গেছিস।

বড়োমা আমার মাথার জটায় হাত বুলচ্ছে।

এই দেখ আবার শুরু করে দিলে। আমি বললাম।

এবার আমি, বিধানবাবু তোকে ধরার জন্য জাল ফেলছি।

মাসি।

বল।

ডায়লগগুলো মুখস্থ করো। কাজে লাগবে।

তুই যত পাশ কাটাবার চেষ্টা কর, পারবি না। তোর আশে পাশে যারা আছে তাদের কি জবাব দিহি করবি।

তুমি ওর বুদ্ধিটার প্রশংসা করো। বৌদি বললো।

সুতপা ওর বুদ্ধি প্রশংসা করা যায় না, সমীহ করতে হয়। সম্মান করতে হয়। তুমি একবার ভাব ও কতোটা ধূর্ত, এটা হলে ওটা হবে আগে থেকে সব অঙ্ক করে রেখেছে। সেই মতো নিজে প্রিপেয়ার্ড হয়ে এসেছে। ও কিন্তু জানে কি কি হতে পারে।

ডাক্তারবাবুর মুখ থেকে গল্পটা শুনে আমি বিধানবাবু পুরো স্তম্ভিত হয়ে গেছি। অ্যাতোটুকু জমি ছেড়ে আসেনি। ওদের সামনে ডাক্তারবাবু, মিত্রাকে দিয়ে চিঠি সাইন করিয়েছে। তুমি আমি হলে পারতাম। একটা চক্ষু লজ্জা আছে। নিজের বউ বলে কথা।

পরে বলা যাবে না।

টাটকা জিনিষ খেতে মজা। বাশি হয়ে গেলে সেই মজা পাওয়া যায় না।

এইনে তোর চিঠি। ধুয়ে জল খা।

মিত্রা আমার কোলে চিঠিটা ছুঁড়ে দিল।

সবাই হাসছে।

তখন কি মনে হচ্ছিল জানিস, তোকে আচ্ছা করে দিই। যেন চেনেই না। আপনি আজ্ঞে করে কথা বলছে। এসপিটাও দোসর হয়েছিল। বলে কি এই চিঠির এগেনস্টে আমি বাধ্য হবো এ্যারেস্ট করতে।

বড়োমার দিকে তাকিয়ে।

সত্যি বড়োমা, তখন আমার বুকের ভেতরটা হিম হয়ে গেছে। বার বার বাথরুম পেয়ে যাচ্ছে। ডাক্তারদাদার মুখটা পর্যন্ত শুকিয়ে গেছে।

তারপর বাবু গটগট করে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো এসপির সঙ্গে।

তুই চিঠিটা পরিসনি? অনিমেষদা বললো।

দূর তখন এতোসব মাথায় ঢোকে। পরের পর ও প্রশ্ন করে যাচ্ছে।

অনিমেষদা তাকিয়ে আছে মিত্রার দিকে।

আমি, ডাক্তারদাদা বোবা হয়ে বসে আছি।

যাকে প্রশ্ন করছে সে বুঝছে আর ও বুঝছে। কৌস্তভবাবু তিনবার বাইরে বেরিয়ে গেল। ঘরের মধ্যে আমাদের সঙ্গে একটা কথাও বলেনি। এমনকি কফিটা পর্যন্ত ফেলে রেখে এসেছে।

বৌদিরা মিত্রার কথা শুনে পেছনে হাসাহাসি করছে।

ওই সময় তোর কে লোক এসেছিল রে? মিত্রা আমার দিকে কট কট করে তাকাল।

ওকে ডাকতে ওই সময় লোক এসেছিল! অনিমেষদা বললো।

জিজ্ঞাসা করো না।

কিরে অনি, এটা ডাক্তারবাবু বলেনি! অনিমেষদা চোখ পাকাল।

রবীন গাড়ি ছাড়।

রবীন গাড়ি ছাড়বে না। কেশটা এখানেই হেস্তনেস্ত করে যেতে হবে। না হলে তুই বেমালুম সব অস্বীকার করে যাবি।

অনিমেষদা ওই গাড়ির দিকে তাকাল।

ডাক্তারবাবু এদিকে একবার আসুন।

তুই বহুত গবেট গোবিন্দ আছিস। আমি মিত্রার দিকে তাকালাম।

মেয়ে, তনু, ইসি হাসছে।

এ্যারেস্ট করাবি তো, করা। তুই কি আমায় আবিদ, রতন পেয়েছিস হজম করে দিবি।

প্রচণ্ড রাগ হওয়া সত্ত্বেও হেসে ফেললাম।

ছোটোমা আমার গলা জড়িয়ে ধরেছে।

বল না, মেয়েটা যখন জানতে চাইছে, অমন করিস কেন।

ডাক্তারদাদা, মল্লিকদা, বিধানদা সবাই নেমে এসে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছে।

ইকবালভাই, ইসলামভাই, অনুপদারা হাসছে।

শেয়ালের গলায় হাড় আটকে গেছে। ইসলামভাই বললো।

সবাই হাসছে। বৌদি আমার মাথায় হাত বোলাচ্ছে।

অনিমেষদা ডাক্তারাদার দিকে তাকাল।

আপনারা যখন ভেতরে ছিলেন তখন ওকে একজন ডাকতে এসেছিল?

যাঃ—এই কথাটা তোমাদের বলতে ভুলে গেছি। ডাক্তারদাদা বললো।

আঠারো বছর পর দেশে ফিরলো। ও যে আজ ওই নার্সিংহোমে আসবে ছেলেটা জানলাই বা কি করে? আর ওকে চিনলই বা কি করে?

আমার মাথায় ব্যাপারটা ওই মুহূর্তে আসেনি অনিমেষ।

আপনি একবার সিচুয়েশনটা ভেবেছেন?

এখন অনেকটা পরিষ্কার হচ্ছে। এডিটর তখন ফুট কাটলো। চারপাশ দেখে মনে হচ্ছে ওর লোকজন আছে বুঝলে ডাক্তার।

ধমকে উঠলুম ঠিক, এখন মনে হচ্ছে কথাটা এডিটর খারাপ বলেনি।

বুঝলাম এরপর বাড়তে দিলে পুরো ব্যাপারটা কেঁচিয়ে যাবে। বাধ্য হয়ে ব্যাগের চেন খুলে খামটা বার করে একটা কপি ওদের হাতে দিয়ে দিলাম।

দেখছো দেখছো বড়োমা কি শয়তান, তুমি একবার দেখো। মিত্রা বললো।

অনিমেষদা কাগজে চোখ বুলিয়ে হেসে ফেললো। ডাক্তারদাদা, বিধানদাও হাসছে।

তুই কতো বড়ো ধরিবাজ দেখ। অনিমেষদা আমার দিকে তাকিয়ে।

কিগো অনিমেষ! কাগজে কি লেখা আছে ? বড়োমা বললো।

যে কাগজটার জন্য ও কৌস্তভবাবুকে চিঠি ধরিয়েছে। এমন কি এসপিকে প্রেসার ক্রিয়েট করে এ্যারেস্ট পর্যন্ত করাতে পারে। করাতে পারে বললে ভুল হবে, ও এ্যারেস্ট করাবেই। সেই কাগজ এইটা।

অনিমেষদা, ডাক্তারদাদার দিকে তাকাল।

এবার বুঝলেন ডাক্তারবাবু।

তারমানে ওর লোক এসে আগে থেকেই আজকের ডেট পর্যন্ত সমস্ত আপডেট বার করে রেখেছিল!

দেখুন ডেট টাইম দেওয়া আছে।

অনিমেষদা আবার আমার দিকে তাকাল।

ওরে তোর কাছে মাথা নতো করতে ইচ্ছে করছে।

ছিঃ অনিমেষ ছিঃ ও কথা বলতে নেই। জ্যেঠিমনি বললো।

এরপর ওকে আর কি বলার থাকতে পারে বলুন দিদি। আমরা তো এইরকম একটা ঘটনা ভাবতেই পারি না। এই কাগজটা দিয়েই ও সকলকে বধ করে দেবে।

অনুপদা, রূপায়ণদা, ইসলামভাইরা হাসছে।

দাও কাগজটা দাও।

এটার দাম কতো অনি। অনুপদা হাসতে হাসতে বললো।

দশহাজার টাকা।

তুই কয়েকশো কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নিয়েছিস।

এবার খান্ত দাও।

অনিমেষদা হাসছে।

মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে। ভাসা ভাসা চোখে বুবুনের প্রতি প্রগাঢ় বিশ্বাস। তনু, মিত্রার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে। চোখে প্রচ্ছন্ন হাসি।

তুই চল তারপর তোর বুদ্ধির গোড়ায় কেমন ঝামা ঘসতে হয় আমি দেখছি। মিত্রা কল কল করে উঠলো।

আ মোলো যা গাড়িতে গিয়ে বস। বেলা হয়ে যাচ্ছে। বড়োমা বললো।

তুমি কিছু বলতে পারছো না। নিজের ছেলে বলে। মিত্রা চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠলো।

অনিসা মার কথা শুনে হাসছে। আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

আমি কি বলবো, তোর ভালোর জন্যই তো করেছে।

ও ওই গাড়িতে চলুক।

কেন। আমি বলে উঠলাম।

ঠিক আছে তুই চকে নাম। তারপর দেখছি।

আমি একটা বিটকেল হাসি হাসলাম।

মিত্রা গট গট করে চলে গেল। ওর পেছন পেছন সবাই।

আবার গাড়ি চলতে শুরু করলো।

মিনিট কুড়ির মধ্যেই আমরা চকে পৌঁছলাম। দূর থেকে দেখলাম চকে প্রচুর লোক। আমাদের গাড়িগুলো সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। রবীন গাড়িটা সাইড করে থামাল।

দেবা, নির্মাল্য এগিয়ে এলো।

তোদের এতো দেরি!

আমি চুপচাপ।

মিত্রা ঝামেলা পাকিয়েছিল?

মিলি হাসছে।

একে একে সবাই নামলো। ভজুরাম এগিয়ে এসে বড়োমাকে ধরেছে। জ্যেঠিমনিকে অনন্য ধরেছে। বৌদি একা একাই নামলো। চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। না এই ভিড়ের মধ্যে কোনও পরিচিত মুখ চোখে পরছে না।

গতো আঠারো বছরে একবারও এখানে আসা হয়নি। তনু এসেছে। পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে চারপাশে। আগে পরিদার আশেপাশে দু-একটা দোকান ছিল। এখন দেখছি বাজারে পরিণত হয়েছে। সামনের স্কুল মাঠের খালি জায়গাটায় পাঁচিল উঠেছে। তবে বিশাল ভীমঠাকুরটা জায়গা বদল করেনি। সে এখনও তার জায়গায় অধিষ্ঠিত।

মিলি, অদিতি, মিত্রাকে ফিস ফিস করে কি বলছে।

সামান্য একটা হই হই শব্দ।

হঠাৎ একজন তীরবেগে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে হেঁচকি তুলে কেঁদে উঠলো। প্রথমটায় ভীষণ নিজেকে অপ্রস্তুত লাগছিল কোনপ্রকারে সামলে নিলাম।

তুই বল অনি, আমি কি দোষ করছি।

কথাটা কানে যেতেই সারাটা শরীরে বিদ্যুতের শিহরণ বয়ে গেল। আমি চমকে উঠলাম। বুকের লাবডুব শব্দটা মুহূর্তের মধ্যে দ্বিগুন হয়ে গেল। লতান গাছের মতো আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আছে। অঝোড়ে কেঁদে চলেছে। বুকের থেকে মুখটা তুললাম।

ভানু!

চোখ জলে ভিজে গেছে।

মুখটা কেমন তোবড়ানো।

চোখ দুটো কোটরে ঢুকে গেছে। আমার স্বপ্নের ভানু, আমার ডানপিটে বন্ধু ভানু, আমার ছেলেবেলার একমাত্র বন্ধু ভানু, আমাদের কৈশোর জীবনের নেতা ভানু।

এ কি চেহারা করেছিস!

ভানু কোনও কথা বললো না। মুখটা ভেঙেচুড়ে দুমড়ে একাকার।

শরীরে একফোঁটা মাংস নেই, কঙ্কাল সর্বস্ব। সামনের দিকে গোটা কয়েক দাঁত নেই। দাড়িগুলো দীর্ঘ দিন না কামানর ফলে খোঁচা খোঁচা। আদল গায়ে কোনও প্রকারে একটা ধুতি গলিয়ে চলে এসেছে। আমার বয়সি একটা ছেলে, খুব বেশি হলে বছর তিনেকের বড়ো। অকাল বার্ধক্য ওর সারাটা শরীরে। ওকে দেখে আমার ভীষণ কান্না পেয়ে গেল।

তোর এই অবস্থা কি করে হলো!

খাইতে পাইনি।

মানে!

সংসার লিয়ে পথে বুসছি। চিকনা দুটা চাল দেয়, সেউ দিয়া সংসার চলে।

কেন, তোর গাড়ি!

অনাদি লিয়ে লিছে। বলছে এ গাড়ি তোর নয়। কাগজপত্র সব তার নামে।

কি পাগলের মতো বকছিস!

আমার বাস্তু ভিটে পর্যন্ত লিয়ে লিছে। কইছে আমি নাকি জোর করে সেঠি বুইসছি।

আমি ওর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছি। বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

তুই কাঁদিস না। আর কে এসেছে?

কথা বলতে গিয়ে গলাটা ধরে গেলো।

সুন্দর আমার পাশে দাঁড়িয়ে। অবাক হয়ে আমাকে দেখছে।

হঠাৎ কোথা থেকে চিকনার উদয় হলো, ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলো।

তোকে আমি পই পই করে বলেছি এখানে অনিকে কিছু বলবি না।

কেন বলবো নি। অনাদি কি মোর বাপ। সব বেনামে করে লিছে। পার্টি দেখাইতিছে।

তোকে বলেছি অনি বাড়ি গেলে তুই বলবি।

কেনো কইবো নি, বেশ করবো কইবো।

ভানু আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো।

সকাল নু এঠি মুখ দেখাইতে বুইসে আছি। আমি একা আসছি? ওন্যে আসেনি?

চিকনা ভানুর মুখের দিকে তাকিয়ে। চোখ দুটো রাগে-হতাশায় পরিশ্রান্ত।

তান্যে সক্কলে তানকার দুঃখের কথা কইতে আসছে।

ভানু ভিড়ের দিকে আঙুল তুললো।

একটা হই হই শব্দ। কারুর কথা শুনতে পাচ্ছি না।

চিকনা তরপে যাচ্ছে।

উঃ চিকনা থাম না।

আর কারা এসেছে। ভানুর মুখের দিকে তাকালাম।

এউখানে সক্কলে তোকে কইতে আসছে। তুই হাঁইটা চ দেখবি পথে কততো লোক তোকে কইবে বলে বুইসে আছে। ভানু আবার কেঁদে ফেললো।

মিত্রা, তনু, ইসি আমার মুখের দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে। হয়তো আমার চোখ ছল ছল করছে। বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

তুই মোনকাকে যা দিছিলি সব লিয়ে চলিইছে, সেউখানে গিয়ে ফুর্তি মারায়ঠে।

ভানু এবার কিন্তু আমি পিটবো। চিকনা বলে উঠলো।

কেনো পিটবি, কোপারেটিভ কি ওর বাপের। সমবায় কি ওর বাপের। অনি তৈরি করছে।

আমাদের গ্রামে ওর ভিটেমাটি জমিজিরেত পর্যন্ত বাসন্তীমা, পীরবাবাকে দিছে। সে বেবাক সব লিয়ে পালিইছে। তোন্যে উদ্ধার করতে পারছু। আমি কইলে দোষ। গ্রামের রাস ওর বাপের। শালা ছুচ্চা, নেতা হয়া মরছে।

চিকনা অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে।

পাঁচু, পচা এগিয়ে এলো।

আমাকে জড়িয়ে ধরলো। ওরাও কাঁদে।

ভানু, চিকনার দিকে তাকিয়ে। চোখে আগুন ঝড়ছে।

পাঁচুর কেন যক্ষ্মা হবে। জবাব দে। তুই কি ভগবান। একা কতো সামলাইবি।

চারিদিকে শুধু কালো কালো মাথা ভিড় করে আছে।

এই মুহূর্তে নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছে। মিত্রার দিকে তাকালাম। ওরাও কেমন ভাবে যেন আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

চিকনা, পরিদা কোথায়?

তুই বিশ্বাস কর অনি, পরিদাকে পর্যন্ত জাগা দিবে কয়্যা টাকা লিয়া জাগা দেয়নি। মানুষটা শোকে পঙ্গু হইছে?

চিকনা ভানুর দিকে কট কট করে তাকিয়ে।

তোর জন্য ও এতো বাড় বাড়ছে। ভানু চেঁচিয়ে উঠলো।

চিকনা মনেহয় আর ধৈর্য রাখতে পারলো না। পায়ের জুতোটা খুলে তেড়ে এলো।

শালা জুতায় ছাল খিঁচি দিব।

মার না মার কততো মারবি। আমি সব অনিকে কয়া দিব।

আমি চিকনাকে ধরে ফেললাম।

আবার একটা হই হই। দু-একজন এসে চিকনাকে ধরে নিয়ে গিয়ে ভিড়ে মিশে গেল।

ধারে পাশে কাউকে দেখতে পেলাম না। মিত্রারা গেল কোথায়?

সামনেই পরিদার দোকান। দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু এতো মানুষ ঠেলে যাব কি করে? যে দিকে তাকাই সকলেরই শুকনো পাংশু মুখ।

ধীর পায়ে পরিদার দোকানের কাছে এলাম। পাঁচু, ভানু, পচা আমাকে ছাড়েনি।

দেখলাম বড়োমারা ভেতরে বসে আছে। বাসু, চিকনা কাউকেই দেখতে পাচ্ছি না।

পরিদার ছেলে চা দিচ্ছে। কেমন যেন দেখতে হয়ে গেছে।

সামনে একটা জটলার মধ্যে অনিমেষদাদের দেখতে পেলাম।

গ্রামের মানুষ ঘিরে ধরে কথা বলছে। ইসলামভাই, ইকবালভাই কোথায়?

দেখলাম ভিড়ের মধ্যে থেকে চিকনা, বাসু এগিয়ে এলো। পচা, পাঁচু, ভানু পরিদার দোকানের সামনে মাটিতে থেবড়ে বসে পরেছে।

চিকনা।

বল।

মিত্রারা কোথায়?

সব ঠিক আছে, ওদের সামনের বাড়িতে বসিয়ে এসেছি।

আমি একটু পরিদার কাছে যাব।

এখন যাবি!

হ্যাঁ।

দাদা তুমি একটু চা খেয়ে যাও। পরিদার ছেলেটা বললো।

তুমি বড়োমাদের দাও। আমি আসছি।

দোকানের বাইরে বেরিয়ে এলাম।

মিনিট পাঁচেকের পথ প্রায় তিন-চারশো লোক আমার পেছনে।

এখনও সেই খড়ের চাল, মাটির দেওয়াল, মাথা নীচু করে ভেতরে এলাম।

আমাকে চিনতে কারুর আর অসুবিধে হচ্ছে না। সবাই জেনে ফেলেছে।

এইরকম দেখতে মানুষটা অনিদা।

পরিদাকে দেখেও মনটা খারাপ হয়ে গেল। বিছানার সঙ্গে একেবারে মিশে গেছে। বহুদিনের না কামান খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চোখ দুটো কোটরগতো।

আমাদের আসার আওয়াজ পেয়ে ফ্যাঁসফেসে গলায় পরিদা বললো।

কে এলো গো বড়োবৌ।

অনি এসেছে।

একবার চোখ দুটো ওপরে তুলে আমার দিকে তাকাতে চেষ্টা করলো। নিথর হাত দুটো সামান্য কেঁপে উঠলো, কিন্তু উঠলো না। আমি মাথায় হাত রাখলাম।

পরিদা।

সারাটা মুখ ভেঙে দুমড়ে একাকার হয়ে যাচ্ছে। চোখের কোলে জল টল টল করছে।

ঘ্যাড় ঘ্যেড়ে গলায় বললো।

তোর নার্সিংহোমে গেছলাম। চিকিৎসে করেনি।

আমি কোনও কথা বলতে পারলাম না।

শুয়ে শুয়ে পিঠে ঘা হয়া মরছে। ছেলেরা আর টানতে পারেনি।

একটু কথা বললেই হাঁপিয়ে যাচ্ছে।

বোকনাটাকে পর্যন্ত ওর পার্টির ছেলেরা মেরে দিছে। পুলিশ কিছু করেনি।

বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো, বোকনাকে মেরে দিয়েছে!

শেষবার যখন এসেছিলাম তখন ওকে দেখেছিলাম। এখনও চোখের সামনে ওর কচি মুখটা ভেসে আছে। সেই ফুট ফুটে বাচ্চা মেয়েটা। মিলি, টিনারা ওর সঙ্গে খুব মজা করেছিল। সেবার ফেরার পথে ওকে জামা কিনে দিয়েছিল। কিছুতেই নেবে না। ওরা জোড় করে ওকে পরিয়ে দিয়েছিল। হাসতে হাসতে বলেছিল, দাদু মোকে আদর করে বোকনা কয়।

বোকনা মরে গেছে!

চিকনার দিকে তাকালাম। মাথা নীচু করে নিল।

আমি আসি পরিদা, ফেরার পথে তোমার সঙ্গে দেখা করবো।

ফ্যাকাশে চোখ নিয়ে পরিদা আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।

আমি বেরিয়ে এলাম। বাড়ির সামনে অসংখ্য মানুষ। সবাই যেন আমাকে গিলে খাচ্ছে। ভিড়ের মধ্যেই কনিষ্ক, নীরু, বটাকে দেখতে পেলাম। ওদের পাশে শুভ, অনন্য, সুন্দর, অনিসা দাঁড়িয়ে।

চিকনা।

বল।

আমার জন্য একটা সাইকেল জোগাড় কর।

অনেকগুলো বাইক আছে।

আমি সাইকেল চালিয়ে একলা যাব।

আজ থাক না।

চিকনাদা আমার সাইকেলটা দাদার জন্য এনে দিই। আমি বন্ধুর সাইকেলে চলে যাব।

ভিড়ের মধ্যে কেউ বলে উঠলো।

তন্যে থাম না।

কনিষ্ক এগিয়ে এলো। পরিদার কি হয়েছে বল?

পারলে একবার দেখে আয়।

কনিষ্ক, নীরু, বটা তিনজনেই ভেতরে গেল।

আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। অনন্যরা পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো।

আমরা তোমার সঙ্গে যাব।

ইয়েস ড্যাড। সুন্দর বললো।

আমি ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। ওরা কখনও এই পরিস্থিতি আগে দেখেনি। চোখে মুখে উত্তেজনা ফেটে পরছে।

কনিষ্করা বেরিয়ে এলো। আমি ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে।

দেখেছি। যা হয়ে গেছে তা রিকভার করা যাবে না। যেটুকু অবশিষ্ট আছে লড়াই করা যাবে।

কনিষ্ক, চিকনার দিকে তাকাল।

এখানে ওষুধের দোকান আছে।

আছে। তবে তোমাদের চাহিদা মতো ওষুধ মিলবে কিনা জানি না।

চলো একবার দেখি।

হাঁটতে হাঁটতে আবার চকে এলাম।

আমার পেছনের ভিড় চক পর্যন্ত ধেয়ে এলো। যেদিকেই চোখ যায় সেদিকেই আমার গ্রামের মানুষের শুকনো মুখ। চকে পরিদার দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালাম।

ভিড়টা এখন অনেক পাতলা। অনিমেষদাদের হাতে চায়ের গ্লাস। অচেনা অনেক ছেলে সাহায্য করছে। বড়োমারা পরিদার দোকানেই বসে আছে। মিত্রাদের তখনও দেখতে পেলাম না।

আমাকে দেখে অনিমেষদা এগিয়ে এলো।

তোমরা যাও, আমি পরে যাচ্ছি।

কি হয়েছে বল?

কিছু হয়নি।

ও অনি এদিকে আয়। বড়োমা ডাকলো।

আমি পরিদার দোকানে গেলাম। বড়োমা বাঁশের বেঞ্চিতে বসে। একটু সরে বসলো। আমি বসলাম।

তোমরা এগিয়ে যাও। আমি পরে যাচ্ছি।

তুই এরকম অবুঝ হলে চলে কি করে।

বোঝাও তো ওকে। চিকনা বললো।

চিকনাদা সাইকেল জোগাড় হয়ে গেছে। একটা ছেলে এসে বললো।

থাম তোরা, আর ঝামেলা বারাস না।

ড্যাড আমি কিন্তু তোমার সঙ্গে যাব।

সুন্দর গড় গড় করে বলে গেল। ওর ভাষা এখানে কম লোকেই বোঝে। বুঝলও না।

বড়োমা আমার মুখের দিকে তাকাল।

ওরাও তোর সঙ্গে যাবে!

আমি বড়োমার মুখের দিকে তাকিয়ে। পরিদার ছেলে চা দিল।

দাদা ছানার জিলিপি আছে। একটা খেয়ে একটু জল খাও।

বড়োমাদের দিয়েছিস?

সবাইকে দিয়েছি। কাল খবর পেয়েছি। তাই একটু বেশি করে বানিয়েছিলাম।

দুধের বানিয়েছিস না ভেজাল দিয়েছিস?

কানে হাত ঠেকাল।

তোমার মুখ, ভেজাল দিলে তুমি ঠিক ধরে ফেলবে।

বড়োমা হাসলো।

প্লেটে করে দুটা ছানার জিলিপি দিল। একটা খেয়ে অনিসার দিকে এগিয়ে দিলাম।

আমি খেয়েছি, তুমি খাও।

আমি তাকিয়ে রইলাম। প্লেটটা আমার হাত থেকে নিলো।

চা খেলাম। কারুর সঙ্গে কোনও কথা বললাম না। চুপ চাপ। বার বার উনুনের কাছটায় চোখ চলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে পরিদার সঙ্গে বোকনা দাঁড়িয়ে আছে। ছবিগুলো একের পর এক চোখের সামনে ভেসে উঠছে। বোকনাকে নিয়ে বড়োমার কথা, ছোটোমার কথা। বুঝতে পারছি যতো বোকনার কথা মনে পড়ছে ততো চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে উঠছে। চিকনা বাইরে দাঁড়িয়ে।

চা খেয়ে উঠে দাঁড়ালাম।

বাইরে বেরিয়ে এলাম।

তুই সত্যি যাবি! চিকনা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

তুই বড়োমাদের নিয়ে আয়।

এতগুলো সাইকেল তোর জন্য নিয়ে এসেছে। কোনটা নিবি বল।

যে কোনও একটা হলেই হলো।

বাবা। অনিসা হাতটা ধরলো।

তুই চালাতে পারিস?

মাথা দোলাল। পারে।

মাকে একবার জিজ্ঞাসা করে আয়।

তুমি তো আছো।

ঠিক আছে চল।

আমি আর কারুর দিকে তাকালাম না। এগিয়ে গেলাম।

কে কি ভাবছে কারুর দিকে নজর দেওয়ার মতো মন এই মুহূর্তে নেই, দিলামও না। একটা সাইকেলে উঠে বসলাম। প্রথমটায় একটু অসুবিধে হলো। অনভ্যাসের ফল। তারপর ঠিক হয়ে গেল। ভানু, পাঁচু, পচা আগে আগে চলেছে। দু-একটা বাইকও আছে। পেছনে আরও গোটা পঁচিশ সাইকেল।

চলবে —————————



from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/9ObU0Tw
via BanglaChoti

Comments