❝কাজলদীঘি❞
BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়
৯০ নং কিস্তি
—————————
ধাক্কা খেতে খেতে চলেছি। রাস্তাটা আগে মোরাম ফেলা ছিল। তার রং ছিলো গেড়ুয়া। এখন পিচে ঢালা রাস্তা। সামান্য এবরো খেবরো তবু মোরামের থেকে ঢের ভালো। অনেকদিন যে মেইনটেনান্স হয় নি তা বুঝলাম।
আমরা খুব ধীরে ধীরে চলেছি।
আমার দুই পাশে অনিসা আর সুন্দর, সামনে অনন্য আর শুভ।
জানিস মা একটা সময় এই রাস্তাটা মাটির ছিল। বর্ষাকালে এই রাস্তার ওপর এক মানুষ জল দাঁড়িয়ে যেত। এখনও মনে হয় বন্যার সময় একই অবস্থা থাকে। জল সরে গেলে এক হাঁটু কাদা। সেই কাদা ভেঙে আমি এই চকে আসতাম।
ড্যাড প্লিজ ইংলিশ।
সুন্দরের দিকে তাকালাম। আবার রিপিড করলাম।
গ্রীষ্মকালে অবশ্য আমরা সব বন্ধুরা মিলে সাইকেলে চেপে আসতাম পরিদার দোকানে আড্ডা মারতে। অনেকক্ষণ থাকতাম তারপর ফিরে যেতাম।
বাড়ি থেকে পরিদাদাই-এর দোকান!
এই তো একটু খানি পথ।
অনাদি আঙ্কেল আসতো?
হ্যাঁ।
গাছ-গাছালির ফাঁক দিয়ে ঝিলের পাশ দিয়ে আমরা চলেছি। একটু থামছি কথা বলছি আবার চলছি। অনাদির নামে কেউ একটাও ভালো কথা বলে না। এমনকি লোকে অনাদিকে চোর, ডাকাত বলতেও কসুর করছে না। আমি বোবার মতো শুনে যাচ্ছি।
সেই বড়ো বিলের কাছে এসে একটু দাঁড়ালাম। টিউবওয়েল থেকে চোখে মুখে জল দিলাম। অনিসার মুখটা রোদে লাল হয়ে গেছে। মায়ের মতো গায়ের রং পেয়েছে। পাকা গমের মতো।
কষ্ট হচ্ছে।
না। তুমি ঘেমে গেছো।
প্রায় বছর কুড়ি পরে সাইকেল চালাচ্ছি।
আমি থামছি সকলে পেছনে এসে থেমে যাচ্ছে। গ্রীষ্মের চাষ চলছে। মাঠ সবুজ হয়ে আছে। ডিপ টিউবওয়েল থেকে জল তুলে মাঠে ফেলা হচ্ছে। সুন্দর মোবাইলে ছবি তুলছে। ডিটেলসে সমস্ত কিছু আমাকে জিজ্ঞাসা করছে।
মাঠের মাঝখানে ওই ঘরগুলো কিসের জন্য? কেন রাতে পাহাড়া দেওয়া হয়? এরা তোমাকে সবাই কি বলছে? পঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে।
আমি ওর প্রশ্নের উত্তর দিয়ে চলেছি। অনিসার চোখে বিশ্বগ্রাসী ক্ষুধা। চারিদিক চেয়ে চেয়ে দেখছে। এভাবে আগে মনে হয় কেউ ওদের বলেনি।
অনন্য, শুভ সবকিছু দেখছে শুনছে কিন্তু নির্বাক শ্রোতা।
উনা মাস্টারের বাড়ির কাছে এস দাঁড়ালাম। আঠারো বছর পর দেখছি। বেশ কিছুটা বদল চোখে পড়ছে। কিন্তু সেই অ্যাজবেস্টারের চালটা ঠিক মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আমার জীবনের একটা মাইলস্টোন। শিবরাত্রির সলতের মতো ধিকিধিকি করে জ্বলছে। সাইকেল থেকে নামলাম। ওরাও নামলো। সাইকেলটা রেখে আমার সঙ্গে এসো।
কার বাড়ি বাবা? অনিসা বললো।
আমার মাস্টার মশাই।
উনা মাস্টার?
মেয়ের মুখের দিকে তাকালাম।
দেখেছো?
দাদানের শ্রাদ্ধের সময়।
মুখটা তোমার মনে আছে?
তখন আমি ছোটো।
এ বাড়িতে কখনও এসেছো?
না।
আমি এই বাড়িতে স্যারের কাছে পড়তে আসতাম।
হেঁটে!
হ্যাঁ। আমি আর ভানু।
চকে যে তোমায় জড়িয়ে ধরে কাঁদলো?
মাথা দোলালাম।
চারজনের মুখটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
মনাকাকা আর উনা মাস্টার, এই দুজন তখন এই তল্লাটের শিক্ষক।
মাত্র দুজন!
হ্যাঁ।
মনাকাকা আর্টস গ্রুপ পড়াতো আর উনা মাস্টার সাইন্স গ্রুপ।
ওরা সবাই আমার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে। ব্যাপারটা ঠিক ওদের বোধগম্য হচ্ছে না। ওরা এই ভাবে পড়াশুন করেনি। ওদের সব সাবজেক্টের জন্য আলাদা আলাদা শিক্ষক।
আমি পিচের রাস্তা থেকে মেঠো রাস্তায় নামলাম। আইল পথ ধরে হাঁটছি। এবরো খেবরো রাস্তা। ওরা আমার পেছন পেছন।
সাবধানে আসবে। পা হড়কে যেতে পারে।
মেয়ে এগিয়ে এসে আমার হাতটা চেপে ধরলো।
মেঠো পথ পেড়িয়ে খামারে এসে দাঁড়ালাম। সুন্দর চারদিক চেয়ে দেখছে। বাঁশের ঝাড়, আম গাছ, পুকুর, পাখির ডাক কেমন যেন স্বপ্নিল পরিবেশ। জায়গাটা ভীষন নিস্তব্ধ। বারান্দায় কাউকে দেখতে পেলাম না। স্যার বেশির ভাগ সময় বারান্দায় বসে থাকতেন।
আমি তিন চারবার স্যার স্যার বলে ডাকলাম।
ভেতর থেকে মহিলা কণ্ঠে একটা মিহি আওয়াজ এলো, কে?
স্যার আমি অনি।
নামটা শোনা মাত্রই ম্যাজিকের মতো কাজ হলো। ভেতর থেকে একটা হুড়মুড় শব্দ ভেসে এলো। কেউ যেন ভেতর থেকে ছুটে আসছে। কাছে এসে থমকে দাঁড়াল। বছর ছত্রিশের একটা মেয়ে। পরণে আটপৌরে শাড়ি। ঘোমটা টানা। সিঁথির সিঁদুর ফ্যাকাশে। ম্যাড়মেড়ে চেহারা। চোখের পাতা পড়ছে না, ঠোঁট দুটো থিরি থিরি কাঁপছে। ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো।
তোমার এ কি চেহারা হয়েছে অনিদা!
চিনতে পেরেছিস?
কেন পারবো না।
তারপর নীচু হয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে চাইলো। ওর হাত দুটো ধরে ফেললাম।
আজ থাক।
আচ্ছা।
ওর কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালাম। মিনতি অনিসাদের দিকে তাকিয়ে।
চিনতে পারছিস না।
চোখের ভাষায় বুঝিয়ে দিলো, না।
এইটা তোর মিত্রাদির মেয়ে, আর এইটা ছেলে।
মিত্রাদির ছেলে মেয়ে হলে তুমি তাহলে কে?
বাবা।
আর এ হচ্ছে তোর তনুদির ছেলে।
আবার মিনতির চোখে বিষ্ময়।
চিনতে পারছিস না। তাই তো? কালকে যাবি চিনিয়ে দেব। সুন্দর আমারও সন্তান। দত্তক নিয়েছি। এর নাম শুভ। তোর মিঃ মুখার্জীকে মনে আছে।
হ্যাঁ।
শুভর বাবা মিঃ মুখার্জী।
আঙ্কেল, আন্টি সবাইকে চেনে? শুভ বলে উঠলো।
তখন ওরা আমার সঙ্গে ছিল। মিনতির দিকে তাকালাম।
স্যার কোথায়?
চলো ভেতরে চলো। আমার হাতটা চেপে ধরলো।
তোর ল্যান্ডাগ্যান্ডা কোথায়?
সব তোমার বাড়িতে।
ওর বাবার সঙ্গে কাজ করছে?
হ্যাঁ।
কটা?
দুটো।
ছেলে?
হ্যাঁ।
বেশ করেছিস।
বয়স কতো।
একটা পোনেরো পেরিয়ে ষোলয় পরেছে, আর একটা চোদ্দ পেরিয়ে পনেরোয়।
তুই তো একেবারে হিসাব করে….।
ধ্যাত তুমি না….।
কি!
মিনতি বাঁকা চোখে তাকাল।
দূর পাগলী ওরা এখন বড়ো হয়ে গেছে। আমার সব ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
ঋজু কোথায়?
দাদা দোকানে।
বিয়ে করে নি?
করেছে।
ওর বৌকে দেখছি না।
বাজারের ওখানে একটা ঘর করেছে ওখানেই থাকে।
বুঝেছি।
তুমি বুঝবে নাতো আর কে বুঝবে।
ভেতর বারান্দায় এলাম।
স্যার খাটে শুয়ে আছেন।
দেখে ভালো লাগলো। অন্ততঃ পরিদার মতো দেখতে হয়ে যায়নি।
ঘুমলে ডাকিস না।
ঘুম থেকে উঠলে আমার রক্ষা থাকবে?
মিনতি আস্তে করে বাবা বলে ডাকলো।
কে—
আমি মিনতি—
কি হয়েছে—
ওঠো—
কেন—
অনিদা এসেছে—
কে—
অনিদা—
অনি—
কথাটা বলতে গিয়ে গলার স্বরটা কেমন যেন কেঁপে কেঁপে উঠলো।
কোথায়—
স্যার চোখ খুললেন। অদ্ভূত এক আড়ষ্টতা চোখের মনিদুটোয়। পাশ ফিরলেন। আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন। মুখটা যন্ত্রণাকাতর। আমি হাঁটু মুড়ে খাটের কাছে বসলাম। শীর্ণহাত মাথায় রাখলেন। কাঁপছে। চোখের কোলে জল চিকচিক করে উঠলো।
তুই এলি না। মনাটা অভিমান করে চলে গেল।
ফোঁটা ফোঁটা জল চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। এক অব্যক্ত যন্ত্রণা ফুটে উঠেছে চোখেমুখে। বুকের ভেতর কে যেনো সজোরে হাতুড়ীর বাড়ি মারলো। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠলাম। চোখ দুটো কেমন ঝাপসা হয়ে এলো।
অনি।
হ্যাঁ স্যার।
আমাকে একটু ধরে বসা বাবা।
আমি স্যারকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে উঠে বসালাম।
মিনতি, মা চশমাটা একটু দে না—অনির মুখটা একটু ভালো করে দেখি।
মিনতি জানলার কোলঙ্গা থেকে চশমার বাক্সটা এনে দিল।
স্যার চশমা চোখে দিলেন।
এ কি বেশ ধরেছিস!
স্যারের কোলে মুখ ঢাকলাম।
কাকা মারা যাবার খবর পাওয়ার পর আর কাটিনি।
মরার সময় তোর মুখটা দেখার খুব ইচ্ছে ছিল। কপালে নেই। হবে কি করে।
আমি খুব অন্যায় করেছি স্যার।
তুই কিচ্ছু অন্যায় করিসনি। তার থেকেও অনেক বড়ো কাজ করেছিস। চিকনা সব বলেছে। স্থূল অন্যায়কে বড়ো করে দেখতে নেই। প্রবাহমানকাল তোর বিচার করবে।
আমি স্যারের কোলে মাথা গুঁজে পড়ে আছি।
স্যার আমার মুখটা তুলে ধরলেন।
কাঁদছিস কেন। তুই তো কান্নাকাটি করার ছেলে নোস।
কাকার শ্রাদ্ধ করতে পারিনি। পনেরো বছর পর কাল চুল দাড়িটা কাটব।
মরার আগে এটাও তোর কাছ থেকে শিখলাম। মানুষকে কি ভাবে শ্রদ্ধা করতে হয়।
স্যারের হাত আমার মাথায়। অনিসাদের মুখের দিকে আর তাকাইনি। ওরা আমার পেছেনে দাঁড়িয়ে। কার মুখের কি অভিব্যক্তি জানি না। তবে ওরা অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করতে পারছে।
তুই লিখিস না, তোর কাগজ এখন আর পড়ি না।
চুপ করে থাকলাম।
এদের চিনতে পারলাম না।
আমার ছেলে মেয়ে।
সঙ্গে সঙ্গে ঝুপ ঝুপ করে সকলে স্যারের পায়ে হাত ঠেকাল।
ওরে বাবা এরা সব এতো বড়ো হয়ে গেছে। সেই মনার শ্রাদ্ধের সময় দেখেছিলাম।
কোথায় গেল সব, চারিদিক নিস্তব্ধ। সারা শব্দ নেই কেন। মিত্রার গলা।
বাইরের দিকে তাকালাম। হুড়মুড় করে সবাই ঢুকলো।
সোজা ভেতরে চলে এসে স্যারের কাছে দাঁড়াল।
তুমি নিশ্চই বুবুনকে বকেছো। স্যারকে ধমকে উঠলো।
স্যার মিত্রার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো।
মিত্রারা স্যারের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো।
থাক থাক। দীর্ঘজীবী হও।
তারপর মিত্রার গালে হাত দিল।
তোকে কতোদিন পর দেখলাম।
আমার কথার উত্তর দিলে না—
কি বলতো—
তুমি বুবুনকে বকেছো কিনা—
তা একটু বকেছি—
কেন—
অন্যায় করেছে—
আমাকে কথা দিয়েছিলে, মনে আছে—
ঠিক আছে আর বকবো না। এরা কারা।
মিলিকে চিনতে পারছো না?
কে বলতো!
বাঃ তোমার স্কুলে সাইন্সের ইনস্ট্রুমেন্ট দিয়েছিল।
হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে।
কইগো উনা মাস্টার কোথায় গেলে। বড়োমার গলা।
কে এলো।
বড়োমা। মিত্রা বললো।
দিদি এসেছে!
আমাকে একটু ধরে দাঁড় করা। আগের মতো পায়ে আর জোড় পাই না।
মিত্রা, মিলি দুজনে স্যারকে ধরলো।
ও মিনতি মাকে একবার ডাক। কতক্ষণ স্নান করতে লাগে। কখন গেছে পুকুর ঘাটে।
মা এসেছে। কাপর ছাড়ছে। মিনতি রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে উঠলো। তারপর রান্নাঘর থেকে ট্রেতে করে গ্লাস সাজিয়ে সরবৎ নিয়ে বেরিয়ে এলো।
মিত্রা স্যারের সঙ্গে সকলের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। কনিষ্ক, নীরু, বড়োমা, জ্যেঠিমনিকে ধরে ধরে নিয়ে এলো।
যাঃ তুই মিছে কথা বলছিস।
কথাটা কানে আসতেই ওদিকে তাকালাম।
মিত্রা, স্যারের কানে কানে কি বলছে। স্যার তনুর দিকে তাকিয়ে ফিক ফিক করে হাসছে।
কেমন আছোগো উনা মাস্টার।
বড়োমা স্যারের সামনে এসে দাঁড়ালো। স্যার চোখ তুলে তাকাল।
তুমি বুড়ী হয়ে গেছো, আমি বুড়ো হয়ে গেছি।
ছাত্রটিকে দেখে চিনতে পারলে।
প্রথমে পারিনি, পরে চিনলাম। আবার ওর কাছ থেকে শিক্ষে নিলাম।
আবার কি শিক্ষে নিলে?
কি ভাবে মানুষকে শ্রদ্ধা করতে হয়।
এ ব্যাপারে তোমার ছাত্র আর তুমি ভালো বুঝবে।
তুমি তো ওর মা, তুমি বুঝবে না।
বড়োমা স্যারের হাতটা চেপে ধরলো। মাথা নীচু করলো।
কালকে তোমাকে একবার যেতে হবে।
তুমি যখন বলছো যাব। এখন বড়ো একটা বাইরে বেরোই না।
মিনতি সকলকে সরবতের গ্লাস এগিয়ে দিচ্ছে।
তুই একা কেন আমরাও একটু হাত লাগাই। মিত্রা এগিয়ে গেলো।
না তোমরা এখন গেস্ট।
মুখপুরী।
মিত্রা কল কল করছে। সবাইকে সরবতের গ্লাস এগিয়ে দিতে দিতে তনুকে চিঁড়েভাজা চায়ের গল্প করছে। সুন্দর চারিদিক ঘুরে ঘুরে দেখছে। আর মোবাইলে পটাপট ছবি তুলে যাচ্ছে। ওর কাছে সব নতুন। একটা গোটা বিস্ময় ওর চোখের সামনে এসে হাজির। শুভ ওর পেছন পেছন।
কিছুক্ষণ সময় স্যারের বাড়িতে থেকে বেরিয়ে এলাম।
ছেলেমেয়ে আমার পাশে।
দুটো গাড়ি দেখছি দাঁড়িয়ে আছে। আর সব মনে হয় এগিয়ে গেছে।
চিকনা দাঁড়িয়ে। পিচ রাস্তায় উঠতেই চিকনা বলে উঠলো।
এবার গাড়িতে যা।
কেন!
সবাইকে বাজারে পাঠিয়ে দিয়েছি।
কেন ওরা আমার জন্য কষ্ট করবে?
এতদিন করেছে আর একটা দিন করলে অসুবিধে কোথায়।
সুন্দর এগিয়ে এলো।
আমরা সাইকেলে যাব না।
চিকনা ইংরাজীতে উত্তর দিল।
অনিসা তাকিয়ে আছে চিকনার দিকে।
ভাবলি কি, তুই একা বলতে পারিস। আমিও পারি।
সুন্দর, চিকনার হাতটা ধরে ঝাঁকিয়ে দিল।
ইংলিশ ইংলিশ।
চিকনা হাসছে।
কনিষ্ক, নীরুরা এলো। সবাই একসঙ্গে গাদাগাদি করে গাড়িতে উঠলাম।
এবার ছোটোমা পেছনে চলে গেল। মেয়ে আমারে পাশে বসলো।
গাড়ি চলতে শুরু করলো। চিকনা সামনে বাইক নিয়ে।
দু-পাশে সবুজ ধানখেত। সবুজের বুক চিড়ে মাঝখান দিয়ে পিচের রাস্তা। দেখতে ভীষণ ভালো লাগছে। অনেক দিন পর আমার গ্রামে এলাম। রাস্তার ধারে দেখলাম ভুঁই ফোড়ের মতো দু-একটা বাড়ি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু নতুন কিছু পুরনো।
বড়ো বিল শেষ হতেই গ্রামের নতুন স্কুল। চিকনা বলছিল নীপা এই স্কুলের দিদিমনি। গায়ে বড়ো বড়ো করে লেখা কাজলদীঘি হাই স্কুল। বেশ বড়ো বাড়ি। অনেকটা জায়গা নিয়ে স্কুল। চিকনা দাঁড়িয়ে পরেছে। আমি গাড়ি থেকে নামলাম। ওরাও নেমে এসেছে। দু-চোখ ভরে দেখছি। ছোটোবেলায় খুব সখ ছিল এরকম একটা স্কুলে পড়ার।
সেই সখ মেটেনি। বড়ো হয়ে কলেজে পড়েছি। বেশ বড়ো কলেজে। আমাদের গাড়ি দেখে স্কুলের ছেলে মেয়রা হই হই করতে করতে গেটের সামনে চলে এসেছে। দেখলাম এই জায়গাটা এখনও অমলিন। অনেক বড়ো বয়স পর্যন্ত আমি চকে গেলে বাস দেখার জন্য বসে থাকতাম।
মনে মনে ভাবতাম এই বাস কতোদূর চলে যাচ্ছে। আমিও একদিন এই বাসে করে কলকাতা যাব। অনেক অনেক বড়ো হবো। তখন চকটাই ছিল আমাদের বন্ধুদের কাছে কলকাতা। চক থেকে ফেরার সময় মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যেত।
স্কুল থেকে ক্যালভার্টের দূরত্ব বেশি নয়। সামনে অনেক দোকান-পাট তৈরি হয়েছে। একটা বড়ো গোডাউনের মতো দেখলাম।
ওটা কি চিকনা?
সিনেমাহল।
আমাদের এই অজ গাঁয়ে সিনেমাহল!
হ্যাঁ। অধঃপাতে যাওয়ার শেষ রাস্তা।
পার্মিশন কে দিয়েছে?
পার্মিশন দেবার মালিকের অভাব। পয়সা লোটার স্বর্গরাজ্য। তাছাড়া তুই এখনও আঠারো বছর পিছিয়ে আছিস। আমরা গ্রামের মানুষ এখন অনেক এগিয়ে গেছি। এখন এখানে সপ্তাহে তিনদিন বাজার বসে। তাছাড়া বিকেল হলেই সব দোকান পাট খুলে যায়। এখন আমাদের আর কষ্ট করে চকে যেতে হয় না। সব টেক্কা দেওয়ার রাজনীতি।
এখানে তো মাইতি ঘরের একটা মাত্র দোকান ছিল।
এখন এখানে সব পাবি। এটা এখন হারুজানার কালা।
কি বলছিস!
সব কি আর তোকে ফোনে বলা যায়। নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করবি কি করে।
আমি চিকনার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে। চোখে মুখে অবিশ্বাসের ছোঁয়া।
এই তল্লাট থেকে আজকে চোদ্দলাখ টাকা জমা পরেছে। ওই সিনেমাহল মালিক একাই চারলাখ দিয়েছে। এখনও সাতলাখ বাকি। এটা আসল। ইন্টারেস্টে এখনও হাত দিইনি। এতদিন একটা পয়সাও কেউ ঠেকায়নি।
নাম কি!
চিনবি না।
তবু শুনি?
বীরকটার মণ্ডলদের বাড়ির জামাই। উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। কোথায় মিলিটারিতে কাজ করতো। ভলেনটিয়ার রিটায়ারমেন্ট নিয়ে কিছু টাকা পেয়েছিল, সেই নিয়ে এখানে এসে বেশ জমিয়ে বসেছে। এখন অনাদির ডানহাত। এই তল্লাটটা দেখাশোনা করে।
পঞ্চায়েত?
ধ্যুস বেওসায়ী।
অনিসারা চিকনার কথায় হাসলো।
চারপাশে আস্তে আস্তে ভিড় জমছে। দু-একজন করে প্রায় গোটা কুড়ি লোক দাঁড়িয়ে।
স্কুলটাকে পর্যন্ত নখরামির জায়গা বানিয়ে দিয়েছে।
আমি চারদিক চেয়ে চেয়ে দেখছি, কাউকে চিনতে পারছি না।
সবাই আমার দিকে জুল জুল করে চেয়ে রয়েছে।
রবীন গাড়িটা এগিয়ে নিয়ে গিয়ে রাখ। আমি হেঁটে যাচ্ছি।
চিকনা বাইকটা ঠেলতে গেল, একজন এগিয়ে এলো।
তুমি যাও আমি নিয়ে যাচ্ছি।
ছেলেটিকে চিনতে পারলাম না তবে এই গ্রামের ছেলে এটা বিলক্ষণ। ছেলেটি বাইক ঠেলতে ঠেলতে এগিয়ে চলেছে আমি চিকনার পাশে পাশে।
মিত্রা, তনু পেছনে হেঁটে হেঁটে আসছে।
ক্যালভার্টের কাছে এলাম। অনিসারা আমার পাশে দাঁড়িয়েছে।
শ্মশানের দিকে তাকালাম।
আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা, মা-বাবার শেষ শয়ন ভূমি। কিন্তু সেই ঘন জঙ্গল আর নেই। কেমন যেন অনেকটা ছোটো হয়ে গেছে ফাঁকা ফাঁকা। একসময় ওখানে কেউ জমি চাষ করতে যেত না। এখন দেখছি সবুজ হয়ে আছে। সেই সুন্দর জায়গাটা কেমন মরা মরা লাগছে।
বড়োমারা গাড়ি থেকে নেমে এসেছে। গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে।
চিকনা শ্মশানটা ছোটো হয়ে গেছে না?
অনাদি সকলকে পাট্টা দিয়েছে। নিজের নামে বেনামে কিছু জমি পাট্টা নিয়েছে।
মা বাবার জায়গাটা?
অনেক কষ্টে অক্ষত রেখেছি। বলেছিল গ্রামে শ্মশান রেখে লাভ নেই, যার যার নিজের জায়গায় দাহ করবে। সেই নিয়ে কতো ঝামেলা, তিনদিন জেলও খেটেছি।
চিকনার গলা ভাড়ি হয়ে এলো। চোখ দুটো ছল ছল করছে।
চিকনার দুই কাঁধে হাত রাখলাম। চোয়ালদুটো শক্ত হয়ে গেল। একদিন মাঝ রাতে তুই পীরসাহেবের থানে বসে আমায় ফোন করেছিলি। মনে আছে।
চিকনা মাথা নীচু করে মাথা দোলাল।
তোকে মেয়ের দিব্যি কেটে বলেছিলাম। একটা মাংসের টুকরো কেউ খুঁজে পাবে না।
চিকনার মুখচোখ কেমন বেঁকেচুরে দুমড়ে গেলো। চোখ জলে ভরে গেল।
পেয়েছে কেউ?
চিকনা হাতের তালু দিয়ে চোখ মুছলো।
কাঁদবি না। অনি কোনওদিন কাঁদে না।
সামনের সবুজ মাঠের দিকে তাকালাম।
সাতদিন সময় তোর কাছ থেকে চাইছি। ওকে পাগলা কুত্তা বানিয়ে দেব। আর অরিজিন্যাল কুত্তা ওর শরীরে মাংস খুবলে নেবে। ও আমার বাল্য বন্ধু ছোটো থেকে এক স্কুলে এক সঙ্গে পড়াশুনো করেছি। খেলাধুলা করেছি। ওকে মারবো না। এই গ্রামের মানুষ ওকে পেটাবে। কেউ বাঁচাতে পারবে না।
ওর ছেলে মেয়ে আমার কাছে কাজ করে।
তোর কাছে কাজ করে!
হ্যাঁ কাঞ্চনকে দিয়ে একটা কাগজে সই করিয়ে নিয়েছিল। তখন কি অতোসতো বুঝতাম। তারপর হিমাংশুদাকে নিয়ে গিয়ে দেখালাম, বললো মিউচ্যুয়াল ডিভোর্স পেপার।
কাকা, কাকী?
কি বলবে, গ্রামের মানুষরা কেমন হয় তোকে নতুন করে কি বলবো।
আমার চোখ মুখের রং যে বদলে গেছে, আশেপাশের সকলে বুঝত পেরেছে।
মিত্রা আমাকে জড়িয়ে ধরে পিঠে মাথা রেখেছে।
তুই বিশ্বাস করবি না। গত সাত বছরে ও যেন ধরাকে সরাজ্ঞান করেছে।
ও যে কুত্তা বনতে শুরু করেছে আজ কো-অপারেটিভে ভিড় দেখে নিশ্চই বুঝেছিস।
চিকনা মাথা নীচু করলো।
এতদিন ভেঙে পরিসনি। আজ ভেঙে পরবি না।
হারুজানার কালায় আমাদের জমিগুলো পর্যন্ত নিয়ে নিয়েছে। বাবা কতোবার বললো, অনাদি এটা তুই কি করছিস? আমার ঠাকুর্দার আমলের জমি। তুই গিয়ে তোর বাপকে জিজ্ঞাসা কর। বললো, এটা সরকারি পলিসি কাকা, আমি অমান্য করতে পারবো না।
সব পেয়ে যাবি। তোকে বলেছি না। পাগলা কুত্তা বানিয়ে দেব। ও বিষধর সাপের লেজে পা দিয়েছে, মুখেদিলে বেঁচে যেত। আমার ছোবলে কি যে বিষ ও এবার টের পাবে।
চিকনা মুখ তুললো। তখনও চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে।
স্কুলের দিকে তাকালাম। হ্যাঁ দুটো বটগাছ, একটা অশ্বত্থ গাছ, এখনও অক্ষত আছে। স্কুলের টালির চালটা দেখা যাচ্ছে।
আমার পীরসাহেবের থান।
ওটা অক্ষত আছে। নিতে গেছিল, মুসলমান পাড়া ওকে তাড়া করেছিল। তখন এখানে রায়েট বেধে যায় আর কি।
কি বলছিস তুই!
এই করেই তো ও ক্ষমতা পেয়েছে।
আমার স্বপ্নের গ্রাম, আমার মাতৃভূমি। একটা দিক দেখতে গিয়ে আর একটা দিক অবহেলায় দগদগে ঘা হয়ে গেছে। কতো স্বপ্ন আঁকা হয়ে আছে আমার এই ছোট্ট গ্রামটাকে নিয়ে। জানিনা রক্ষা করতে পারবো কিনা। শেষ চেষ্টা একবার করে দেখবো।
চারদিক একবার ঘুরে ঘুরে দেখলাম। যেমনকার ঠিক তেমন আছে। মাঝে মাঝে কোথায় যেন অহেতুক কমা, দাঁড়ি, জিজ্ঞাসার চিহ্ন, বিষ্ময় বোধক চিহ্ন পড়ে গেছে।
বড়োমা আমার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে। ছোটোমার চোখ ছল ছলে। জ্যেঠিমনি, বৌদির চোখে গভীর দুশ্চিন্তার ছায়া। ছোটোমাকে জড়িয়ে ধরলাম।
মন খারাপ করো না।
না। কেন করবো। গলাটা ধরা ধরা।
অনি আবার জাগছে ছোটোমা। এবার অন্যভাবে। আমার স্বপ্ন কোনওদিন আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে না। আমি কখনও নিজের জন্য কিছু চাইনি।
ছোটোমা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
চলো গাড়িতে ওঠো।
সবাই একে একে গাড়িতে উঠে বসলো। মেয়ে আমার পাশ ছাড়ে নি।
আবার পথচলা শুরু। দু-পাশ দেখতে দেখতে চলেছি। ধাক্কা খেলাম। করাত কল পেরিয়ে মুসলমান পাড়ায় ঢোকার মুখে।
চিকনা সামনে ছিল। ওকে প্রথমে আটকাল।
এখন ছাড়ো না চাচা।
কেন ছাড়বো।
তারপর আমার গাড়ির সামনে এসে সকলে ঘিরে ধরলো।
অনি কোথায়?
একজন বয়স্ক ভদ্রলোক এগিয়ে এলো। আমি তাকিয়ে আছি। ঠাহর করতে পারছি না।
চিকনা বাইক রেখে এগিয়ে এলো।
চিনতে পারছিস না।
মাথা দোলালাম।
মীরচাচা। হাতিম মীরের ধানকুটা কল। মাথায় ধানের বস্তা নিয়ে তুই আমি মীরচাচার কলে ধান কুটতে যেতাম।
গাড়ি থেকে নেমে এলাম।
মীরচাচার পরনে সাদা ধবধবে লুঙ্গি আর পাঞ্জাবী। দাড়িটাও সাদা ধবধবে।
জড়িয়ে ধরলাম।
চোখের সামনে ছবিগুলো ভেসে আসছে। ছ-পয়সায় এক মোন ধান কোটা হয়ে যেত। তখন এই তল্লাটে একমাত্র মীরচাচার ধান কোটার কল ছিল। নিজেরাই হ্যান্ডেল মেরে মেসিন স্টার্ট দিতাম। ফিতে লাগাতাম, হলারে বসে যেতাম। প্রথম প্রথম মীরচাচা বারণ করতো, কোথায় লেগেটেগে যাবে একটা অনর্থ হবে। পরে আমাদের আবদার মেনে নিয়েছিল। মহরমের সময় মীরচাচার কলঘরের সামনের বড়ো ধান খেতটায় মেলা বসতো। কতো রকমের খেলা হতো। লাঠি খেলা, ছুড়ি খেলা আমরা দলবেঁধে দেখতে যেতাম। মীরচচা জিলিপি খাওয়াত।
তোকে চিনতেই পারিনি।
মীরচাচার মুখের দিকে চেয়ে হাসলাম।
তুই আমার মতো নুর রেখেছিস কেন।
হাসলাম।
কাকা মারা যাওয়ার পর আর কাটিনি। কাল কেটে ফেলবো।
হ্যাঁরে, ভালো মানুষটা আমাদের ছেড়ে চলেগেছেন।
একটু থেমে।
তোর সঙ্গে অনেক কথা আছে।
হেসেফেললাম।
আমাদের ভালোর জন্য তুই তোর সর্বস্ব দিয়ে কষ্ট করে সাজিয়েগুছিয়ে গেছিলি। আর দশজনে মেরে খাবে, এটা হতে পারে না।
আমি তোমার কথা শুনবো চাচা।
তোর সঙ্গে ইমামসাহেব এসেছেন।
ইকবালভাই! তুমি চেনো?
বহুবার ওনার কাছে গেছি। আমাদের মসজিদের ইমাম ওনার কাছে পড়াশুন করতে যান। ওনার কাছ থেকে আমরা অনেক জাকাতও পাই।
তাহলে তুমি ইকবালভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে নাও।
না ওনার সঙ্গে এই বিষয় নিয়ে কথা বলবো না।
কেন! ইকবালভাই সব জানে চাচা।
জানুক, তুই আমার গ্রামের ছেলে। তোর ওপর যে জোড় আমাদের আছে। ওনার কাছে সেই জোড় থাকবে না।
আমি হাসছি।
তোকে এর একটা বিহিত করে যেতে হবে। আমাদের হকের জিনিষ আমরা ছাড়বো কেন।
অনিমেষদারা এসেছেন ওঁদের সঙ্গে কথা বলো।
বলেছি না আমরা কারুর সঙ্গে কথা বলবো না। এতদিন যখন মুখ বুঁজে সব সহ্য করতে পেরেছি আর কয়েকদিন করবো।
চাচা তুমি যা হুকুম করবে তাই মেনে নেব।
তোকে হুকুম করার ক্ষমতা আমাদের নেই, তুই আমাদের গ্রামের ছেলে তোর প্রতি আমাদের একটা অধিকার আছে। সেই অধিকারের জায়গা থেকে তোকে চাইছি।
রাতের দিকে একবার এসো। বসবো।
বড়োমারা গাড়িতে বসেই সব শুনছে। মিত্রা, তনু, ইসি নেমে এসেছে। অনিসা আমার পাশে দাঁড়িয়ে চারিদিক চেয়ে চেয়ে লোক দেখছে।
এবার যাবো চাচা।
তোর অবস্থার কথা আমরা জানি। ওরা কিছু ডাব আর পাকা কলা নিয়ে এসেছে, তুই নিয়ে যা।
হাসলাম। তারপর পেটে দিয়ে সবাই মিলে আমাকে পিঠে দেবে তাই তো?
তোর গায়ে একটা আঁচড় পরলে গ্রামকে গ্রাম রক্ত গঙ্গা বইয়ে দেব। মাথায় রাখবি তোর মীরচাচা এখনও মরেনি।
আমি মীরচাচাকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম।
এ কথা বলো না চাচা, খুব কষ্ট পাব।
তুই বললি, তাই তোর প্রশ্নের উত্তর দিলাম।
আমার জিলিপি।
মহরমের সময় আসবি, খাওয়াব।
অনিসারা হেসে উঠলো।
তোর মেয়ে?
হ্যাঁ।
বৌমাকে আগে দেখেছি। ওকে প্রথম দেখছি।
চারিদিকে সবাই ঘিরে ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
শাজাহান। মীরচাচা হাঁক দিল।
একটা ছেলে এগিয়ে এলো।
আমিনার ঘরে কলার কাঁদি আর ডাবের কাঁদি গুলো আছে নিয়ে আয়।
তীর বেগে তিন-চারটে ছেলে দৌড় মারলো।
আমি নিয়ে যাব কি করে?
গাড়িতে নিয়ে যা।
জায়গা নেই। আগের গাড়িতে তুলে দিলে না কেন?
মানুষটাকে না দেখে তার সঙ্গে কথা না বলে দিই কি করে। সে আদৌ আমাদের ছোঁয়া জিনিষ নেবে কিনা আগে দেখতে হবে তো।
আমি হাসছি।
ঠিক আছে তুই যা, আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।
এর সঠিক জবাব তুমি পাবে।
আমি পেয়েগেছি।
গাড়িতে উঠে বসলাম।
এবার আর ঠোক্কর খেতে হলো না। সোজা এগিয়ে এলাম। এখন আর কাঠের পুল নেই নদীর ওপর পাকা পুল হয়েছে। গাড়ি নদী পার হতে দেখলাম বাজারে প্রচুর লোক। আজ কি হাটবার? না। তাহলে?
গাড়ি এগিয়ে এসে বাসুর দোকানের সামনে দাঁড়াল।
চিকনা বাইক থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে।
পিল পিল করে লোক এদিকে ছুটে আসছে। চিকনাকে প্রায় ঠেলে মাটিতে ফেলে দেয়।
আরে তোরা কেমন করিস। মিয়াপুরু, আধাভুদ্রার দল, পিটটা ছাল খিঁচি দিব খন। এউখানে সব ভিরকিটি মারাইতে আসছু। দিলো গালাগালি।
চিকনার কথায় কেউ পাত্তাই দেয় না।
অনিসা আমার হাতটা চেপে ধরেছে।
বাবা!
ভয় পাচ্ছিস?
মেয়ে আমার কাঁধে মাথা রাখলো।
ওরা যদি কিছু করে।
কিচ্ছু করবে না। ওদের অনেক কথা জমে আছে। এতদিন কেউ শোনেনি। আমাকে বলতে আসছে। কে আগে বলবে তার লড়াই হচ্ছে।
চিকনা গাড়িটা কোনও প্রকারে বাসুর দোকানের সামনে রেখে গাড়ির কাছে এলো।
তোরা সরবি।
আগে শুনতি হবে।
তাকে নামতে দে আগে।
না। আগে শুনতি হবে।
দিবো এক ঝাঁপর।
মার দেখি। তুই কিছু করতে পারছু।
চিকনা হেসে ফেললো।
নেমে আয়, এতদিন পর এসেছিস যন্ত্রণা ভোগ কর।
আমি নেমে এলাম। হুটো পুটি করে সব আমার পায়ে পরে।
আরে লেগে যাবে কোথায়, তখন একটা বিপত্তি হবে।
তুমাকে মোদের কথা শুনতি হবে।
আমি কাউকে চিনতে পারছি না। তবে এটা ঠিক এরা এই গ্রামেরই মানুষ।
আমি আস্তে আস্তে বাসুর দোকানের সামনে এলাম।
ভিড়টা গাড়ির কাছ থেকে সরে এসেছে।
দূরে ব্যাঙ্কের বাড়িটার দিকে তাকালাম। দোতলা বাড়ি। গ্রামের নামেই কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কের নাম রাখা হয়েছে। দোতলার বারান্দায় ইসলামভাই, ইকবালভাই দাঁড়িয়ে হাসছে। বড়োমাদের দিকে তাকাবার জো নেই।
তুই কি ব্যাঙ্কে গিয়ে বসবি, না বাসুর দোকানে বসবি।
আমি চিকনার দিকে তাকিয়ে।
বড়োমাদের বাড়িতে পাঠাবার ব্যবস্থা কর।
সব ব্যবস্থা করা আছে। ওদের নিয়ে চিন্তা নেই, যতো চিন্তা তোকে নিয়ে। তুই এতো সহজে ছাড়া পাবি না।
চারিদিকে ক্যাঁচর-ম্যাচর হইহল্লা। প্রচুর গরম লাগছে। আমি পায়ে পায়ে ব্যাঙ্কের দিকে এগিয়ে গেলাম। ভিড়টা আমার সঙ্গে সঙ্গে চলেছে। সব বয়সী লোক আছে। এদের দেখে মনে হচ্ছে হাঁড়িপারা, ডোমপারা, শবরপারার লোক বেশি। ভাটপারা, তাঁতীপারারও কিছু আছে বলে মনে হয়। এক একজনের চেহারা চরিত্র এক এক রকমের, দেখে গেইজ করলাম।
ইসলামভাইরা নিচে নেমে এসেছে। কাছে যেতেই হেসে ফেললো।
খ্যাতির বিড়ম্বনা।
সব তোমার জন্য।
একটা বেশ সৌম্যশুভ্র দেখতে ছেলে এসে আমাকে নীচু হয়ে প্রণাম করতে চাইলো। আমি হাতটা চেপে ধরে বললাম, আজ থাক।
ইসলামভাই-এর মুখের দিকে তাকালাম।
সুবীর, নীপার বড়।
আমি জড়িয়ে ধরলাম।
এতদিন আপনার নাম শুনেছি। আপনার গল্প শুনেছি। আপনার কীর্তিকলাপ শুনেছি। আপনাকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি।
হাসলাম।
কেমন দেখছো আমাক সুবীর।
কল্পনায় যা দেখেছিলাম, বাস্তবে তার সঙ্গে কোনও মিল নেই।
আরও গোটা সাতেক সমবয়সী ছেলে এসে পায়ে মাথা ঠেকাবার চেষ্টা করলো। সকলকেই বললাম আজ এই পোষাকে নয়, সব কলকের জন্য তুলে রাখ। এই পোষাকে কাউকে প্রণাম করতে নেই। করুর প্রণাম নিতে নেই।
তুই চা খাবি?
ফিরে তাকালাম। বাসু।
হাসলাম।
চিন্তা করতে হবে না সবাইকে ঠিক ঠাক বুঝিয়ে শুনিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি।
কে গেলো?
পাঁচু, পচা, ভানু।
ভানু এখানে!
তোকে নালিশ করে সোজা এখানে চলে এসেছে। আরও সবাইকে ডেকে এনেছে। রাস্তায় খবর দিতে দিতে এসেছে। কতো কাজ। বুজুম ফ্রেণ্ড এসেছে।
সঞ্জু।
সব তোর পেছন পেছন ঘুরলে কাজগুলো করবে কে।
আবার হাসলাম।
দাদা ভেতরে চলুন। সুবীর বললো।
দাঁড়াও ওদের সঙ্গে একটু কথা বলে আসি।
আপনি পারবেন না।
তা হয় না সুবীর। ওরা আমার জন্য এতক্ষণ অপেক্ষা করেছে।
আমি এগিয়ে গেলাম। সবার মাঝখানে দাঁড়িয়ে কথা শুনলাম। এক কথা অনাদি গ্রামের ছেলে হয়েও সব মেরে খেয়ে নিয়েছে। সবার কথা শুনলাম। মনটা ভাড়ি হয়ে গেল।
ধীর পায়ে কো-আপারেটিভের বারান্দায় পা রাখলাম। এই বাড়ি আমি প্রথম দেখছি। বেশ সুন্দর ডেকরেসন। আধুনিক ব্যাঙ্কের মতো। প্রত্যেক ঘরেই কমপিউটার আছে। তার সঙ্গে আনুসাঙ্গিক সবকিছু। মাটি দিয়ে জায়গাটা যখন ভরাট করা হচ্ছিল তখন দেখেছিলাম।
ইকবালভাই।
বল।
তোমার পরিচিত লোকজনও আমার গ্রামে আছে দেখলাম।
সত্যিরে আমিও এতদিন জানতাম না। আগে আগে পালিয়ে এলাম। সারাটা রাস্তা ধাক্কা খেতে খেতে এসেছি। গাড়ি দাঁড় করিয়ে অনি আছে কিনা দেখবে। তারপর ছাড়া পাচ্ছি। সেই করতে গিয়ে দেখা পেয়ে গেলাম।
আবিদরা কোথায়?
তোর বাড়িতে।
তুমি গেছিলে?
একবার গিয়ে খেয়ে চলে এসেছি।
খাওয়া দাওয়া সেরে ফেলেছো! কটা বাজে বলোতো?
এই জন্য তুই খুব ভালো আছিস। ভাবছিস দেড়টা দুটো বাজে।
হ্যাঁ।
এখন পৌনে চারটে।
ইস, কাকীমা, সুরোমাসি আমার জন্য বসে আছে। না গেলে খাবে না।
তা তো বসে আছেই। ইসলামভাই বললো।
চিকনা মনে হয় বলে কয়ে নিচের ভিড়টা ফাঁকা করলো।
আমরা ওপরের একটা বেশ সুন্দর ঘরে এসে বসলাম।
এটা কিসের ঘর ইসলামভাই।
এই ঘরে বোর্ড মিটিং হয়। শেষ মিটিং হয়েছিল আট বছর আগে। তারপর আর কোনও মিটিং হয়নি। গড়িয়ে গড়িয়ে চলছে। যা করে চিকনা, বাসু, সুবীর। আমি সপ্তাহন্তে একবার আসতাম সই সাবুদ যা করার করে যেতাম।
অডিট।
সেটা হিমাংশু রেগুলার করেছে।
সুবীরবাবু।
দাদা আমাকে বাবু বলবেন না প্লীজ।
রাখো তো সুবীর ওর কথা। ও কখনও তোমায় বাবু বলবে, কখনও তোমায় স্যার বলবে, কখনও হয়তো আবার তোমায় দাদা বলবে। ওর ডাকের কোনও ছিড়ি ছাঁদ আছে নাকি। ইসলামভাই বললো।
ওঃ ভাইদাদা গো। এখন একটু শান্তি। চিকনা ঢুকলো। আমার দিকে তাকাল।
সব তোর জন্য।
বাসু ঘরে ঢুকলো।
বাসু, বাবু ঢুকেই প্রণামী পেয়ে গেছেন। চিকনা বললো।
কে দিলো! বাসু বললো।
মীরচাচা। তিন কাঁদি ডাব, তিন কাঁদি পাকা কলা, সঙ্গে পেয়ারা, সপেদা, আতা, পাকা পেঁপে কতো বলি বল তো।
হ্যাঁরে চিকনা কালকের ব্যাপার। আমি বললাম।
তোর এতক্ষণে মনে পড়েছে!
খেয়াল ছিল না।
বড়ো মাথা ছোটো জিনিষ খেয়াল থাকবে কি করে।
ইসলামভাই, ইকবালভাই, সুবীর হাসছে।
তবু ভালো, খেয়াল পড়েছে। গিয়ে দেখবি আগামী কালের রান্না শুরু হয়ে গেছে।
বাজে কথা রাখ।
না বললেও কাল হাজার দেড়েক লোক আসবে। মীরচাচাকে দেখলি তো। শুধু ওখান থেকে এলেই তিনশো। তুই নিশ্চই না বলবি না। এবার বেড়ভেতর আর আশপাশ ধর। তুই এই গ্রামটা কতদিন ছেড়েছিস?
চিকনার কথাগুলো অকাট্য সত্য। আমি তার কোনও উত্তর দিতে পারবো না।
চিকনার মুখের দিকে তাকালাম।
এই জায়গায় তোর মাথা কাজ করবে না। এইখানে ভানু, পচা, পাঁচু, চিকনার দরকার। ম্যানেজমেন্ট, ভাঁড়ার বাসু।
চিকনাদা আমি।
সুবীর বলে উঠলো।
তুই সিকি।
ইসলামভাই হাসছে।
একটি ছেলে চা নিয়ে এসে ঢুকলো।
নে তাড়াতাড়ি চা-টা মার। বস্তাটা বাড়িতে ঠিকঠাক ফেলতে পারলে, একটু শস্তির নিঃশ্বাস নেবো। সকাল থেকে যা যাচ্ছে।
চিকনা আমার দিকে তাকাল।
সুবীর আজকের সংবাদ, যিনি এই প্রতিষ্ঠানের ক্রিয়েটার তাকে বলো। ইসলামভাই বললো।
সুবীর হাসছে।
বলে দাও একবার।
এই ব্যাঙ্কের আঠারো বছর সাতমাস বয়স হলো আজ রেকর্ড। পঁচানব্বই লাখ সাতাশি হাজার চারশো ছাপান্ন খুচরো কিছু আছে।
এখনও কতো বাকি আছে? আমি বললাম।
আমি একটা স্টেটমেন্ট বার করে নিয়েছি। বাড়িতে গিয়ে আপনাকে দেব।
এটা বলো, এই টাকাগুলো আমরা পাওয়ার আশা করতাম? চিকনা বললো।
দাদা সব জানে, নীপা বলেছে।
ও এরই মধ্যে ফিসফাস হয়ে গেছে?
চিকনার কথায় আমি হেসে উঠলাম।
সুবীর লজ্জা পেয়ে গেছে।
আগামীকালও বেশ কিছু জমা পড়বে।
কি করে বুঝলি? চিকনা বললো।
খবর পেলাম।
দেখি অনির দৌলতে কতটা রিকভার হয়।
সব ব্যাঙ্কে পাঠিয়ে দিয়েছো? আমি বললাম।
হ্যাঁ দাদা। এক/দেড়লাখের বেশি ক্যাশ কাছে রাখি না। থানার গাড়িতে করে ব্যাঙ্কে পাঠিয়ে দিয়েছি। ব্যাঙ্কের লোকও এসেছিল। শেষের দিকে ওরাও হেল্প করলো।
সুবীর একটা কাজ করবে।
বলুন দাদা।
আজকে যারা জমা দিল তারা কি সবাই এতদিন ডিফলটার ছিল?
নাইনটি পার্সেন্ট।
তাদের একটা লিস্ট আমাকে দেবে।
কালকেরটা দেখে নিই।
ঠিক আছে।
কাউকে মার্সি করবে না।
এতদিন করিনি যখন আর করার কোনও প্রশ্নই নেই।
এদের কিছু মর্টগেজ আছে?
সবার নেই, কিছু লোকের আছে। তাছাড়া এগুলো সব বড়ো বড়ো লোন।
তাদের মর্টগেজ?
কিছু আছে।
ইসলামভাই এখন যাবে নাকি?
এখানে বসে কি করবো। সব তোর বাড়িতে।
ব্যাঙ্ক বন্ধ!
তিনটের সময় বন্ধ হয়ে গেছে। তোর জন্য বসেছিলাম। বার বার মামনিকে ফোন করছি, তুই শুধু ধাক্কা খেয়েই যাচ্ছিস।
হেঁটে যাব, তোমাদের আপত্তি আছে। উঠে দাঁড়ালাম।
তোর পায়ে ধরি। এখন যাস না। তাহলে বাড়ি যেতে সন্ধ্যে হয়ে যাবে। চিকনা বলে উঠলো।
অগত্যা সব বন্ধ করে নিচে নেমে এলাম। আমি চিকনার বাইকের পেছনে উঠলাম।
বাসুরাও দেখলাম এক একটা বাইকে দুজন দুজন করে উঠেছে।
বাঁধের ওপর দিয়ে আসার সময় দুপাশ দেখতে দেখতে এলাম। বেশ কিছু পরিবর্তন হয়েছে। এমনকী বাঁধের ওপরও বেশ কিছু নতুন বাড়ি ঘর হয়েছে।
অনেকেই আমাদের দেখছে। বাঁধের ওপর দিয়ে যারা হেঁটে বাড়ি ফিরছে। আমাদের মোটর বাইকের আওয়াজে তারা পথের ধারে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। আমরা এগিয়ে চলেছি। কাছাকাছি আসতে বাঁধের ওপর দিয়েই দেখলাম বাঁশ গাছের আড়ালে একটা নতুন দোতলা বাড়ি। বেশ সুন্দর দেখতে।
ওই বাড়িটা কার রে চিকনা?
তোর। আবার কার।
তার মানে!
ওপর তলাটা গেস্টহাউস। আর নিচেরতলাটা আমার গোডাউন। এটা ছাড়া সব যা ছিল তাই রেখেছি।
তাহলে তুইও কিছু পরিবর্তন করেছিস?
স্যার বেঁচে থাকতে পার্মিশন নিয়ে করেছি। তিনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে করিয়েছেন।
কই আমাকে বলিসনি।
বললে তুই করতে দিতিস না।
কাকা আমার কথা জেনে গেছে?
একমাত্র তাঁকেই সব জানাতাম। একজন কাউকে তো জানাতে হবেই। মিথ্যে কথা বলতে পারতাম না। আর গুরুমা কিছু কিছু।
গাড়ি নিয়ে খামারে ওঠা গেল না। পেল্লাই একটা সামিয়ানা টাঙানো হয়েছে টান টান করে। কালকে মনে হয়ে এখানেই খাওয়া দাওয়া হবে। খামারে ঢোকার মুখে ঢিবিটার ওপর চিকনা গাড়ি দাঁড় করাল। আমি নেমে দাঁড়ালাম। গোয়াল ঘরের সামনে কাকীমা, সুরোমাসি মাথায় হাত দিয়ে বসে। দু-জনেরি পরনে সাদা থান। তারমানে নীপার বাবাও মারা গেছেন! ইস, আমি কতো কিছু জানিনা। পায়ে পায়ে এগিয়ে এলাম। কাকীমা, সুরোমাসি জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। আবার সেই শোকার্ত পরিবেশ।
চলবে —————————
from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/PESYiZ7
via BanglaChoti
Comments
Post a Comment