❝কাজলদীঘি❞
BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়
৬০ নং কিস্তি
—————————
আমি ওর মাথাটা কোলে তুলে নিলাম। আসতে আসতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম।
পাগল, আগে আমার নামটা বলবি তো।
কি করে জানবো এটা তোমার বাড়ি। সেই তুমি একমাস আগে গেছিলে ভাগ্নার অন্নপ্রাসনে, আর গেলে না।
কেন, কনিষ্করা যায়নি?
একমাত্র অনিকেতদা গেছিল দু-বার। বললো তোমার সঙ্গে দেখা হয়নি। তুমি ব্যস্ত।
কথা বলিস না। কষ্ট হবে।
শালা ওর জন্য মার খেলাম।
নীরুদা ওষুধ দিয়েছে?
হ্যাঁ।
একটু ঘুমো। কাল সকালে বাড়ি পৌঁছে দেব।
আজ রাতেই ফিরব। কাল মিটিং আছে।
ঠিক আছে কনিষ্কদা পৌঁছে দিয়ে আসবে সকালে।
টনা আমার হাত ধরে আছে।
কিছু খেয়ে বেরিয়েছিলি?
সেই দুপুরে বেরিয়েছি।
আমি কনিষ্কর দিকে তাকালাম।
কনিষ্ক দেখ না কিছু খাবার আছে কিনা।
অনেক আছে। চিকনা বললো।
যা মনাকে নিয়ে আয়। দুজনকে বসিয়ে দুটো খেতে দে।
চিকনা দৌড়ে বেরিয়ে গেল। ওরা আমাকে ঘিরে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি টনার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছি। চোখটা ছল ছল করে উঠলো।
তুমি কাঁদছো কেন?
টনা আমার হাতটা ধরে ফেললো।
আমি অন্যায় করেছি, শাস্তি দিয়েছে।
কেন অন্যায় করতে গেলি?
না জেনে করে ফেলেছি দাদা।
এখানে ভিড় করে কি করছিস সবাই। অনিমেষদার গলা।
ভিড়টা একটু সরে গেল। দেখলাম গেটের সামনে ওরা সবাই। আমাকে এই অবস্থায় দেখে ওরা এগিয়ে এলো, মিত্রা এসে পাশে বসলো।
টনা আধচোখ বন্ধ ফোলা মুখে তাকিয়ে তাকিয়ে মিত্রাকে দেখছে।
তোর বৌদি।
টনা উঠে বসতে গেল। মিত্রার পা ছুঁতে চাইল। একটু হাসার চেষ্টা করলো, পারল না। দু-ফোঁটা জল চোখ দিয়ে গড়িয়ে পরলো। অনিমেষদা, বিধানদা স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে।
তুই শুয়ে থাক। কিছু খেয়ে নে।
আমি ওর চোখটা মুছিয়ে দিলাম। আসতে করে ওর মাথাটা বালিসে রাখলাম।
উঠে দাঁড়ালাম। অনিমেষদার দিকে তাকালাম।
নিজের চোখে একবার দেখো, সত্যিকারের যারা পার্টিটাকে প্রাণদিয়ে ভালোবাসে তারা এইভাবে মার খায়। আর বাবুরা এসি গাড়ি চড়ে।
গমগম করে উঠলো আমার গলাটা। কোথাও দাঁড়ালাম না। কারুর দিকে তাকালাম না। ফোনটা বার করে ডায়াল করলাম।
সিংজী কি খবর।
কাম শেষ করলাম।
এমন দিন মুখের জিওগ্রাফি যেন বদলে যায়। বাকিটা আমি বুঝে নেব।
কি বলছেন অনিবাবু, এ আপনার রাগের কথা।
আপনি না পারলে, আমি অন্য ব্যবস্থা করবো।
ঠিক আছে ঠিক আছে। আপনি রাগ কিয়েন না।
ক্যাশ কতো পেলেন।
আরে রাম রাম। কি বলবে আপনাকে। জালি নোট ভি আছে। নেতা লোককা ঘরমে গন্ধী সিডি ভি আছে। আপনা পত্রকার যে এসেছে সে ভি বলে দু-একজনকে চেনে।
কি বলতে চায় কি?
ফরফরা রাহা হ্যায় বোলে কি হামি দিল্লিমে বাত করবে। উধার কই ক্যাবিনেট মিনিস্টার লোগোকে সাথ।
ওকে তুলে নিয়ে চলে আসুন। এখন ফ্ল্যাশ করবেন না। কালকের দিনটা যাক তারপর দেখছি।
আপনার অনিমেষবাবু ভি ওহি বোলা। হামারা সাথ বাত হুয়া।
ঠিক আছে।
হামার ওহি লোক।
একমিনিট দাঁড়ান।
আবিদ।
দাদা দু-মিনিট পর ফোন করলে হতো না।
সিংজি মিনিট পাঁচেক বাদে আপনাকে ফোন করছি।
আচ্ছা।
অনিমেষদা কাছে এগিয়ে এলো। আমার হাতটা চেপে ধরলো। অনুপদা আমার সামনে। কেউ কোনও কথা বলছে না। চারজনেই ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে।
আবিদ ছুটে এলো, দাদা ওম সাইন্স সিটির সামনে দাঁড়াচ্ছে। এই গাড়ির নম্বর।
আমি আবার সিংজীকে ফোন করলাম।
হ্যাঁ বলেন অনিবাবু।
গাড়ির নম্বর লিখুন।
হ্যাঁ বলেন।
গাড়ির নম্বর বললাম।
ওরা সাইন্স সিটির সামনে দাঁড়াবে আপনার গাড়িতে তুলে দেবে।
ঠিক আছে অনিবাবু। কাজ শেষ হবার পর আমাকে একবার জানাবেন।
ফোনটা কেটে সেভ করলাম।
অরিত্র।
হ্যাঁ দাদা।
ওখানে কে আছে?
সায়ন্তন আর ওর টিম আছে।
অর্ক।
তোমার ম্যাসেজ পেয়েই অর্ক সায়ন্তনকে পাঠিয়ে দিয়েছিল, তারপর নিজে চলে গেছে।
কাজ হয়ে গেলে চলে আসতে বল। নিউজটা বেরবে না। সব ডকুমেন্টস রেডি রাখ। সময় হলে বলবো। আর কেউ খবরটা পায় নি?
না।
অনুপদার দিকে তাকালাম।
অসুবিধে না হলে ডাক্তারদাদার বাড়িতে গিয়ে একটু শুয়ে পরো। কাল সকালে কথা বলবো।
কারুর দিকে তাকালাম না। সোজা নিজের ঘরে চলে এলাম। ঘর অন্ধকার। রাস্তার নিওন আলোর কিছুটা ঘরে এসে পরেছে। টেবিলের ওপর রাখা সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বার করলাম। সোজা জানলার ধারে চলে এলাম। আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা।
টনা, মনা। শালা, সম্বন্ধি। দু-জনে ওই এলাকার নেতা। ডাকসাইটে এলাকার দাদা। এদের ভয়ে কেউ ওই তল্লাটে রা করতে পারে না। তাদের কি অবস্থা করে ছেড়েছে এরা।
কিন্তু দুজনে কতো ভালো ছেলে। মনে পড়ে যাচ্ছে প্রথম দিনকার কথা। আমি গেছিলাম চিংড়ি মাছ নিয়ে লিখতে। ওদের ভেঁড়ি থেকে চিংড়িমাছ বিদেশে রপ্তানী হয়। কিভাবে চাষ হয়, কতদিন লাগে, কতটুকু অংশ বিদেশে যায় এই সব।
নতুন কেউ এলাকায় পা রাখলেই টনার কাছে প্রথমে খবর চলে যায়। তারপর মনার কাছে। অনেক নোংরামি ওই ভেঁড়ি এলাকায়। ফলে মানুষগুলো কিছুদিনের মধ্যে নোংরা হয়ে যায়। ওদের মন বলে আর কিছু থাকে না।
সারাদিন ভেঁড়িতে, রাতে মদ, জুয়া, মেয়ে নিয়ে নোংরামি। কি নেই।
আসতে আসতে ওদের মধ্যে ঢুকলাম। মাথার পোকাটা নরে উঠলো, মানুষের ভালো করতে হবে। একদিন টনাকে বললাম, এখানে একটা স্কুল কর না, বাচ্চাগুলো একটু লেখা পড়া শিখুক।
রাখো তুমি অনিদা। তার থেকে ভেঁড়িতে জাল টানলে দুটো পয়সা আসবে।
অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে একটা স্কুল করলাম। তাও আবার ভেঁড়ির ধারেই পাহাড়া দেবার একটা টংয়ে। চারদিক খোলা। শীতকালে খোলা আকাশের তলায় খোলা মাঠে। ওদের সঙ্গে যতক্ষণ থাকতাম আমি উনামাস্টার ওরা অনি হয়ে যেতো। নিজের দুষ্টুমিগুলো ওদের মধ্যে দিয়ে দেখার চেষ্টা করতাম।
বেশ ভালো লাগতো। প্রথম প্রথম কনিষ্করা যায়নি। ওদের ভাড়ি ধরণের শরীর খারাপ হলে, চিঠি লিখে কনিষ্কদের কাছে পাঠাতাম। পরে একদিন কনিষ্ক বললো, আমাদের নিয়ে চল।
ওদের নিয়ে এলাম। টনা, মনার সে কি আনন্দ। কনিষ্করা প্রস্তাব দিল, একটা ঘর করে দে। আমরা সপ্তাহের প্রতিদিন কেউ না কেউ আসবো। তোদের চিকিৎসা করবো। ওষুধ হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসতো। কিছু শ্যাম্পেল কপি ওদের দিত।
সারাদিন টেনশন কাজের চাপের মধ্যে যখন নাভিশ্বাস উঠতো ওদের ওখানে চলে যেতাম। কয়েকঘণ্টা বেশ ভালো কাটতো। খাওয়া জুটতো কলাই করা থালায় মুড়ি, মাছভাজা।
একেবারে ঘরের তৈরি।
খোলা আকাশের তলায় জলের ধারে বসে আমরা আড্ডা মারতাম। কখনও কখনও ওরা চিংড়িমাছ ধরে ভেজে খাওয়াত। আমার মতো কনিষ্ক, বটা, নীরু, অনিকেত সবার মধ্যে একটা নেশা ধরে গেল।
ভালোপাহাড়ের মতো এটাও আমাদের একটা এনটারটেনমেন্টের জায়গা।
এদিকে জরিয়ে পড়ার পর আমি মাঝে মাঝে যেতাম, কনিষ্করা রেগুলার যাওয়া আসা করতো। আমাদের কিছু চাওয়ার ছিল না। তাই ভালোবাসা কাকে বলে ওরা উজার করে দিত। ওরা বাম রাজনীতিতে বিশ্বাস করতো। আমরাও সবাই করতাম, ফলে মনের মিল হলো। ওদের বুদ্ধি দিতাম। তার ফল ওরা হাতে হাতে পেত। সমস্যা হলে আমাদের সঙ্গে বসে আলোচনা করতো। আমরা পথ বলে দিতাম। একসময় আমরা হয়ে পড়লাম ওদের বিশ্বাসের আশ্রয় স্থল। কিছু হলেই অনিদা। না হলে কনিষ্ক। বেশ কাটছিল। গতমাসেই তো মনার ছেলেটার অন্নপ্রাসনে গেছিলাম।
মনের মধ্যে প্রচন্ড টেনসন।
মল কেশ রানিং। তার মধ্যে রাজনাথ, ডাক্তর ঢুকে পরেছে।
কি করবো, হঠাৎ হাজির, গিয়ে দেখি মনার ছেলের অন্নপ্রাসন। ওর বউ কিছুতেই ছারবে না। আমারও কাজ আছে। চলে আসবো। বাধ্য হয়ে পান্তা খেয়ে চলে এলাম। ওর বউটা কাঁদছিল। অনিদা তোমাকে গরমভাত খাওয়াতে পারলাম না।
বলেছিলাম পরে একদিন এসে খেয়ে যাব। সেই শেষ যাওয়া। আর আজ।
বুকের ভেতর কে যেন পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। জানলার ধাপিতে হাতটা রেখে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। অন্ধকারের মধ্যেও আমগাছের পাতাগুলোকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি।
ঘরের লাইটটা জ্বলে উঠলো। ফিরে তাকালাম। গেটের মুখে বড়োমা, ছোটোমা, বৌদি, মিত্রা, ইসি।
জোড় করে হেসেফেললাম। জানলা থেকে পায়ে পায়ে এগিয়ে এলাম। কাছে এসে দাঁড়ালাম।
অনিমেষদারা ডাক্তারদাদার বাড়িতে গেছে?
বৌদি মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ বললো। দাদা, মল্লিকও গেছে।
কনিষ্করা ফিরে গেছে?
ওরা নিচের ঘরে শুয়েছে।
তোমরা একটু শুয়ে পরো। নাহলে সকালে উঠতে পারবে না।
বড়োমা, ছোটোমা আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে। ইসি, মিত্রা আমাকে অবাক হয়ে দেখছে।
হেসে ফেললাম। কি দেখছো অমন করে।
ছোটোমা জড়িয়ে ধরলো। আরও কতো ব্যাথা এই বুকে লুকিয়ে রেখেছিস।
এই দেখো বোকার মতো কাঁদে। অনি ঠিক আছে, একটুও বিগড়ে যায়নি। যাও অনেক রাত হয়েছে।
দেখলাম ইসির চোখ দিয়ে নিঃশব্দে জল গড়িয়ে পড়ছে।
তোমরা এরকম করলে চলে কি করে। আমার যা কিছু, সব তোমরা। তোমরা এরকম করলে অনি দুর্বল হয়ে পরবে। তোমরা কি এটা চাও। যাও আর দেরি কোরো না।
ছোটোমা আমাকে ছারলো।
তোমরা কোথায় শোবে নিচে না ছোটোর ঘরে?
দেখি। বৌদি বললো।
তুমি অনিমেষদাকে কিছু বলো না। দাদা বড়ো একা হয়ে পরেছে।
বৌদি মাথা নীচু করে কাপরের খুঁট দিয়ে চোখ মুছলো।
আমি ওদের ধরে নিয়ে বারান্দা দিয়ে আসতে আসতে ছোটোমার ঘরের কাছে এলাম।
একবার করে সকলকে জড়িয়ে ধরলাম।
সবাই আবেগে আপ্লুত। ইসিকে বললাম, অনিকে আট বছর পর দেখছিস, অনি হয়তো অনেক নোংরা হয়ে গেছে। পারলে ক্ষমা করিস।
ইসি আমাকে জাপ্টে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।
ওদেরকে ছোটোমার ঘরে ঢুকিয়ে আমি মিত্রা ফিরে এলাম। দুজনে ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখলাম ওরা ছোটোমার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। হাত নারলাম। ওরা ঘরে ঢুকে গেল।
আমরা দরজা বন্ধ করলাম।
পায়ে পায়ে টেবিলের সামনে এলাম। মোবাইলটা টেবিল থেকে তুলে নিলাম। স্যুইচ অফ করা ছিল অন করলাম। দেখলাম কয়েকটা মিস কল। তার মধ্যে সিংজীর মিশ কলও আছে। অর্ক একটা ম্যাসেজ করেছে।
তোমার মতিগতি বোঝা মুস্কিল, কতো কষ্ট করে মালটা তুললাম, অরিত্র বললো যাবে না।
বুবুন।
মিত্রা আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
আমি ওর দিকে তাকালাম। চোখ ছল ছল করছে।
আমার সঙ্গে একজায়গায় যাবি? আমি বললাম।
এখন? এত রাতে? কোথায়!
তুই বুবুনকে ভালোবাসিস। তাহলে প্রশ্ন করছিস কেন?
মিত্রা আমার বুকে মুখ রাখলো।
একটু দাঁড়া।
আমি সিংজীকে ফোন করলাম।
বলুন অনিবাবু।
আপনি কি অফিসে?
হ্যাঁ।
একটা গাড়ি পাঠাতে পারবেন?
আভি!
হ্যাঁ।
কোথায় বলেন?
আমার বাড়ির সামনে।
ওই ট্র্যাংগুলার পার্কে?
হ্যাঁ।
গাড়িটাকে বাড়ির থেকে একটু দূরে দাঁড়াতে বলবেন।
ঠিক আছে, আমি আভি পাঠিয়ে দিচ্ছে।
আর একটা কথা।
বলেন।
কোনও কেশ লিখবেন না। আমি না যাওয়া পর্যন্ত।
এ কি বলছেন অনিবাবু!
আমি গিয়ে সব বলছি।
ঠিক আছে আপনি আসেন।
মিত্রা আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। ওকে ঠোঁটের ওপর আঙুল দিয়ে চুপ থাকার ইশারা করলাম। আলমাড়িটা আসতে করে খুলে ডিরেক্টরের স্টাম্প এবং প্যাড বার করলাম।
মিত্রার হাতে দিলাম।
একটু ধর। আমি নিচে গিয়ে ইশারা করলে পা টিপে টিপে চলে আসবি।
ওর চোখ দুটো চক চক করে উঠলো। মুখে এক চিলতে হাসি।
আমি ঘরের লাইটটা নিভিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। নিঃশ্বাসে বুঝতে চেষ্টা করলাম কেউ জেগে আছে কিনা। দেখলাম সারা বাড়ি নিস্তব্ধ। পা টিপে টিপে নীচে নেমে এলাম। গেটে তালা ঝুলছে। দেখলাম ছগনলালের ঘরের দরজাটা সামান্য ভেজান আছে।
একটু ঠেলতেই খুলে গেল। আমি জানি দরজার পাশেই একটা হুকে চাবিটা ঝোলান থাকে। হুক থেকে চাবিটা নিয়ে বারান্দায় তাকালাম। দেখলাম মিত্রা বারান্দায় দাঁড়িয়ে। ওকে ইশারায় ডাকলাম। ও নিচে চলে এলো। আসতে করে গেটের তালাটা খুলে একটু ফাঁক করে মিত্রাকে প্রথমে বাইরে বার করলাম, তারপর নিজে বেরিয়ে এলাম।
তালাটা লাগিয়ে চাবিটা ছুঁড়ে বাগানের রাস্তায় ফেলেদিলাম। যাতে সকালে কারুর কোনও অসুবিধা না হয়। দুজনে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। চারিদিক শুনশান। জনমানব শূন্য। দু-একটা রাস্তার কুকুর গুটিশুঁটি মেরে শুয়ে আছে।
আমাদের দুজনকে একবার মুখ তুলে দেখে ভউ ভউ করে ডেকে উঠলো। মিত্রা আমার হাতটা শক্ত করে ধরেছে। দু-জনে হন হন করে হাঁটছি। ট্র্যাংগুলার পার্কের কাছে আসতে দেখলাম গাড়িটা এসে কাছে দাঁড়াল
স্যার আপনি অনিবাবু।
হ্যাঁ।
দুজনে গাড়িতে উঠে বসলাম। ড্রইভার সাহেব মোবাইলে আমাদের ওঠার সংবাদ পৌঁছে দিলেন।
দু-জনে গাড়ির পেছনের সিটে স্থানুর মতো বসে আছি। কাল রাতের পোষাক এখনও ছাড়া হয়ে ওঠে নি। কারুর মুখে কোনও কথা নেই।
মিত্রাকে ইশারায় বললাম মোবাইলের স্যুইচ অফ করে দে। মিত্রা মোবাইলের স্যুইচ অফ করে দিল। দুজনে দুজনের দিকে তাকাই আর মিটি মিটি হাসি। গাড়িটা সল্টলেকে ওদের দফতরে যখন এসে পৌঁছলো দেখলাম ভোরের আলো ফুটছে।
গাড়ি থেকে নামতেই দেখি সিংজী গেটের কাছে দাঁড়িয়ে। এগিয়ে এলেন। হাসছেন।
একি অনিবাবু, একেবারে ভাবিকে সঙ্গে করে লিয়ে এসেছেন।
মিত্রার সঙ্গে সিংজীর পরিচয় করিয়ে দিলাম।
সিংজী।
বলুন।
আমরা যে এখানে এটা কাউকে জানাবেন না।
ঠিক আছে।
প্রবীরদা কোথায়?
ভেতরে।
কেশ লিখে ফেলেছেন?
না বেলের অর্ডারটা লিখেছি। আপনি জামিন নিবেন। আপনার মতো লোক জামিন করাতে এসেছে। আমি না ছেড়ে পারি কি করে।
মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
পায়ে পায়ে ভেতরে চলে এলাম। বাইরে বেশ কিছু লোককে দেখলাম। আমাদের দেখে চাপা স্বরে কিছু কথা বলছে। ভেতরে আসতেই দেখলাম প্রবীরদা সিংজীর ঘরে মাথা নীচু করে বসে আছে।
আমাদের দুজনকে এইভাবে এই পোষাকে দেখবে কল্পনাও করতে পারে নি। ঝট করে উঠে দাঁড়ালো। ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললো।
মিত্রা প্রবীরদার পিঠে হাত বুলতে বুলতে বললো, একি করছেন প্রবীরদা।
তুই আমাকে প্রবীরদা বলিস না। তোর মুখে ওই নামটা শোভা পায় না।
ওকে ছাড়ুন, বুবুনের এখন অনেক কাজ।
প্রবীরদা আমাকে ছেড়ে দিয়ে চোখ মুছছে।
তোমার মোবাইলটা কোথায়?
বাইরে।
কার কাছে আছে?
তোর বৌদির কাছে।
যাও গিয়ে বলে এসো, মোবাইলের স্যুইচ অফ করতে। আমরা যে এখানে আছি কেউ যেন জানতে না পারে। তোমার সঙ্গে যারা এখানে এসেছে, তাদের যেন মুখ বন্ধ থাকে। লোকাল, ব্রাঞ্চেও খবর পাঠিয়ে দাও।
মিত্রার দিকে ঘুরে তাকালাম।
তুই প্রবীরদার সঙ্গে থাক। আমি ভেতরে যাই।
আমি সিংজীর সঙ্গে ভেতরে চলে এলাম। সব গুছিয়ে কাজ সারতে প্রায় দেড় ঘণ্টা লাগলো। আমাদের অফিসের প্যাডে চার রকমের চিঠি লেখা হলো। সব আইন বাঁচিয়ে, আমি মিত্রা দু-জনে সই করলাম। প্রায় গোটা পঁচিশেক। সব জায়গাতেই অফিসের স্টাম্প লাগাতে হলো। কাজ শেষে সিংজীকে বললাম, চলুন আমার বাড়িতে।
এখন না, খুব টায়ার্ড।
আমার থেকেও।
সিংজী হেসে ফেললেন।
বাইরে বেরিয়ে এলাম।
সিংজীর কাজ সেরে বেরিয়ে আসতে আরও পনেরো মিনিট সময় নিলো।
বাইরে বেরতেই প্রবীরদা একচোট জড়িয়ে ধরে আবার হাপুশ নয়নে কেঁদে উঠলো।
এখন ছাড়ো। চলো দেরি হয়ে যাচ্ছে।
মিত্রা প্রবীরদার স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল। পিকুর মতো প্রবীরদারও একটা ছেলে আছে। ওর গালটা ধরে একটু নেড়ে দিলাম।
তোমার গাড়ি আছে?
হ্যাঁ।
তুমি মিত্রাকে নিয়ে তোমার গাড়িতে বসো। আমি সিংজীর গাড়িতে বসছি।
প্রবীরদা বাধ্য ছেলের মতো আমার কথা শুনলো।
সবাই গাড়িতে উঠে যাত্রা শুরু করলাম। বাড়ির গেটের মুখে এসে যখন দাঁড়ালাম, তখন সূর্য অনেকটা ওপরে। আমি প্রথম গাড়ি থেকে নামলাম। গেটের মধ্য দিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম। অনিমেষদা, বিধানদা, দাদা, মল্লিকদা, ডাক্তারদাদা বসে আছে অনুপদা, রূপায়ণদাকে দেখতে পেলাম না। আমি গেটের দরজা খুললাম। ওরা সবাই নেমে এসেছে।
প্রবীরদা গাড়ি থেকে নেমে এসে আমার হাতটা চেপে ধরলো। দূর থেকে দেখলাম ওরা সবাই উঠে দাঁড়িয়েছে। বিধানদার মুখে একচিলতে হাসি। হাসিটা কেমন দোমড়ান, মোচড়ান। এই হাসি এবার সবার মুখে ছড়িয়ে পরলো। পায়ে পায়ে ওরা এগিয়ে আসছে। অনিমেষদা ফোনের বোতাম টিপছে।
ডাক্তারদাদা চেঁচিয়ে উঠলো, বান্ধবী দেখবে এসো তোমার ছেলের কীর্তি।
আমরা বাগানে ঢুকে পড়েছি। নিচের বারান্দায় চেনা মুখের ভিড়। বিধানদা এসে আমার কাঁধটা ধরে জোড়ে ঝাঁকিয়ে দিয়ে বুকে টেনে নিল।
বিধানবাবু সব মাংস আপনি খেলে আমি কি ঝোল খাব। অনিমেষদা বলে উঠলো।
বিধানদা আমাকে ছেড়ে মিত্রাকে বুকে টেনে নিল।
তোদের দু-টোকে কেউ হারাতে পারবে না। তোরা সকলকে বুকে করে আগলে রাখিস।
প্রবীরদা মাথা নীচু করে কেঁদে চলেছে। সবাই মাঠের মধ্যে নেমে এসে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে।
সবার চোখেই বিষ্ময়।
অনিমেষদা ফোনটা পকেটে রেখে আমার দিকে তাকাল।
আয় আমার বুকে আয়। তোর মতো আমার বুক অতোটা চওড়া নয় বুঝলি।
সবাই আমার দিকে কেমন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে।
কি প্রবীর জীবনে প্রথম কাঁদছো। এটা হেরে যাওয়ার কান্না, না দুঃখের।
বিধানদা, প্রবীরদার সামনে দাঁড়িয়ে।
অনিকে আমি নিজের হাতে তৈরি করিনি। ওকে প্রকৃতি তৈরি করেছে। তোমাদের নিজে হাতে গড়েছি। এখন দেখছি মানুষ গড়তে গিয়ে বাঁদর তৈরি করে ফেলেছি।
প্রবীরদা মাথা নীচু করে।
কি বনানী। অনির সম্বন্ধে অনেক কথা পার্টি অফিসে গিয়ে আমাকে বলেছো। মুখ বুঁজে তোমার সব কথা শুনেছি। কোনও উত্তর দিইনি। আজ তোমার সব প্রশ্নের উত্তর পাচ্ছ।
ওঃ বিধানবাবু।
থামো অনিমেষ। ওইটুকু দুধের শিশু কেমন তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে দেখ। ও কি শিখবে? আমাদের এই কীর্তি কলাপ।
ঠিক আছে, ঠিক আছে। এখন ওরা এসেছে। চলুন ভেতরে যাই।
আমি মিত্রা তখন বড়োমা, ছোটোমা, বৌদির সামনে দাঁড়িয়ে। ওরা অবাক চোখে দেখছে।
এমা তুমি ভয় পাচ্ছ কেন আমরা ঠিক আছি। মিত্রার গলা কানে এলো।
থাম তুই, তুইও দেখি অনির মতো ফর ফর করিস।
বড়োমার কথায় ডাক্তারদা হেসে ফেললো। হাসি একটা রোগ। সবাই হাসছে।
বড়োমা বাঁকা চোখে একবার ডাক্তারদাদার দিকে তাকাল।
আমি বৌদির বুকে আশ্রয় নিলাম। আমার পিঠে হাত বুলচ্ছে বৌদি।
তুই যে মায়াবী আগে অনুভব করতাম, আজ চাক্ষুষ দেখলাম।
আমি বৌদির গালে গাল ঘোষলাম।
দেখলাম পিকু বাবু ছুটতে ছুটতে বাইরে এলো। ঠোঁটে দুধের দাগ। তারমানে দুধ খাচ্ছিল।
আংকেল আজ নেমন্তন্ন খাব না।
আমি বৌদিকে ছেড়ে ওকে কোলে তুলে নিলাম। ছোটোমার দিকে তাকালাম।
তুই তো দুধ খেলি, আমাকে চা খেতে দে, তারপর নেমন্তন্ন খাব।
ছোটোমার কাছে গেলাম, পিকু আমার কোল থেকে মিত্রার কোলে চলে গেল। ছোটোমার কাঁধটা ঝাঁকিয়ে বললাম, একটু চা দাও। আর পারছি না।
ছোটোমা আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
দুজনে জড়ামরি করে বারান্দায় উঠে এলাম।
বুঝলে ছোটো এবার জামা কাপরটা ছাড়ি। কাল থেকে পরে আছি।
ছোটোমা আমার দিকে ডাগর চোখে তাকাল।
বসার ঘরে এলাম। দেখলাম জ্যেঠিমনি থম মেরে বসে আছে। কালকের শেষটুকু জানেনি। আজ মনে হয় জেনেছে। আমাকে দেখে হাসলো।
একটু জল খাওয়াবে।
ছোটোমা আমার মুখে হাত বুলিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেল। দেখলাম দামিনীমাসি উঁকি দিয়ে একবার দেখে ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল। ঠোঁটে এক চিলতে হাসি।
আমি সোফাতে গা ছেড়ে দিয়েছি।
ছোটোমা এক গ্লাস জল এনে দিল। ঠোঁটে স্পর্শ করলাম।
কই অনি, অনি কোথায় চেঁচাতে চেঁচাতে অনুপদা, রূপায়ণদা, নিরঞ্জনদা, ইসলামভাই, রতন, আবিদ, নেপলা, চিকনা, অনাদি ঢুকলো।
অনুপদা ছুটে এসে আমার পায়ের কাছে বসলো। কোলে মাথা রেখে কেঁদে ফেললো।
আমি গ্লাসটা ছোটোমার হাতে দিলাম।
নিজেকে ভীষণ অপ্রস্তুত লাগছে। ওরা সবাই আমার দিকে তাকিয়ে।
এই অনুপ এটা কি হচ্ছে। ছোটোমা অনুপদার কাঁধে হাত রেখেছে।
না বৌদি না। ও আমাদের চাপগে চাপগে শিক্ষা দিচ্ছে, কি ভাবে মানুষকে ভালোবাসতে হয় দেখো। ক্ষমতাটা শুধু দাঁপের নয়, ভালোবাসার জোড় তার থেকে অনেক বেশি।
ঠিক আছে, ওঠো।
আ-মোলো ওটা আবার ওখানে বসে বসে চোখের জল ফেলে কেন। আমরা মেয়ে কাঁদতে পারি, তোরা সব ব্যাটাছেলে, কাঁদিস কেন।
অনুপদা আমার কোল থেকে মাথা তুললো মুখে কান্নাভেঁজা হাঁসি। সবাই ঘরে ঢুকেছে। দেখলাম সিংজীও এসেছেন। সবাই এলো। আমি উঠে দাঁড়ালাম।
মিলি, টিনা এসে জড়িয়ে ধরলো। মুখটা শুকনো শুকনো।
কোথায় গেছিলে, দেখতে পেলাম না।
ওদের নীরুদার নার্সিংহোমে রেখে এলাম।
কেন!
শরীরটা খারাপ হয়েছিল।
কনিষ্ক কোথায়?
এখুনি এসে পরবে।
ওরা ভালো আছে?
কনিষ্কদা বললো। অনেকটা রক্ত বেরিয়েছে। রক্ত দিতে হবে।
জোগাড় করতে পেরেছে?
হ্যাঁ।
আমি মোবাইলটা পকেট থেকে বার করলাম।
ওটা বার করছিস কেন। চলে?
বড়োমা খ্যার খ্যার করে উঠলো।
বড়োমার দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
ওরকম গা জ্বালান হাসি হাসিস না।
উঃ দিদি। ছোটোমা বলে উঠলো।
থাম তুই।
ছোটোমা মাথা নীচু করলো।
আজকে ওর পাল্লায় পরে মেয়েটাও মোবাইল বন্ধ করে রেখেছে। দু-টোতে মিলে যুক্তিকরে আমাদের মারার ফন্দি করেছে।
জ্যেঠিমনি হাসছে।
আমি কি করবো, বুবুন বললো মোবাইল বন্ধ করে দে। আমি বন্ধ করে দিলাম।
সোহাগী আমার দেখ কেমন। খেতে বসিস পাশে, কান ধরে উঠিয়ে দেব। বড়োমা চিবিয়ে চিবিয়ে বললো।
মিত্রা গিয়ে বড়োমাকে জড়িয়ে ধরলো।
তুমি এরকম করলে চলে কি করে বলো।
রাখ তোদের চলন বলন। তিরিশ বছর ধরে ঘর করছি, বাপের জম্মে এমন দেখি নি।
কি বান্ধবী তোমার প্রেসারটা একবার মাপবো। ডাক্তারদাদা বললো।
রাখো তোমার ডাক্তারী।
আমি ঘরের বাইরে আসতে চাইলাম।
ওই দেখ ছোটো ও বাইরে যাচ্ছে। আজ একপাও বেরবি না বলে দিচ্ছি, তাহলে অনাসৃষ্টি হবে। বড়োমা চেঁচিয়ে উঠলো।
আচ্ছা আচ্ছা ও বেরবে না। আমি কথা দিচ্ছি। অনিমেষদা বললো।
রাখো তোমার কথা। তোমাদের কারুর কথা ও শুনেছে। ও ওর নিজের মতো চলছে, কালকে ধরে যাকে ঠেঙাল, আজ সকালে তাকে নিয়ে হাজির। তোমরা কেউ আগে থেকে জানতে পেরেছিলে।
বড়োমা এক তরফা বলে যাচ্ছে। সবাই মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে।
বড়োমার কথাটা যেন আমার কানেই ঢোকে নি। এমনভাবে আমি বারান্দায় বেরিয়ে এলাম। মোবাইল থেকে কনিষ্ককে একটা ডায়াল করলাম।
মিত্রা এসে পাশে দাঁড়াল সঙ্গে ইশি, মিলি, টিনা।
কখন ফিরলি।
আধঘণ্টা হলো।
খবর পেয়েছি। শোন মনার চোখটা একটু প্রবলেম হয়েছে। কয়েকদিন থাকতে হবে। অনিকেত কে পাঠিয়ে দিয়েছি ওর বাড়িতে খবর দিতে। বলেছি সামলে দিস।
পারবে?
পারবে।
আমাকে যেতে হবে।
না। বটা সেন স্যারকে ধরে আনতে গেছে।
কে, শ্যামল সেন।
হ্যাঁ।
অপারেশন করতে হবে।
না মনে হয়। চোখের ভেতরে ব্লাডটা ক্লড করে গেছে।
দেখ চেষ্টা করে, গায়ে গতরে খেটে খায়। চোখ চলে গেলে খাবে কি?
কনিষ্ক চুপ করে আছে।
কখন আসবি?
ঘণ্টা খানেক বাদে।
সোজা ওপরে চলে এলাম। নিজের ঘরে।
ফোনটা টেবিলে রাখলাম। মনটা খারাপ হয়ে গেল। পাঞ্জাবীটা খুলতে গিয়ে দেখলাম। ঘরের দরজার সামনে পাঁচ মূর্তি হাজির। দাদা, মল্লিকদা, ইসলামভাই, ডাক্তারদাদাও আছে।
খোল খোল কাল থেকে পরে আছিস। অনিমেষদা ভেতরে ঢুকল।
থাক পরে খুলবো।
তুই ওদের জন্য ভাবিস না, ওদের সব চিকিৎসার খরচ পার্টি দেবে।
দাঁড়িয়ে রইলে কেন, বসো।
অনিমেষদারা সকলে ভেতরে এলো। আমি আর জামা খুললাম না।
তোমরা একটু বসো, আমি চোখে মুখে একটু জল দিয়ে আসি।
যা।
আমি বাথরুমে ঢুকলাম। দাঁত মাজলাম। ভালোকরে মুখ হাত ধুলাম। কাল রাত থেকে যা গেল। সত্যি ভাবলেই কেমন যেন লাগছে। অনুপদা ঠিক কথা বলেছে, বিয়ে তো করলি না যেন যুদ্ধ করলি।
বাথরুমের ভেতর থেকে বুঝতে পারছি ওরা সবাই এতক্ষণ ঘটে যাওয়া বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে যে আমি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বৌদির গলা পাচ্ছি। ডাক্তারদাদার গলাও পাচ্ছি। ঠিক বুঝতে পারছি না কি আলোচনা হচ্ছে।
আমি টাওয়েল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বাথরুম থেকে বেরলাম। বৌদি কাছে এগিয়ে এলো। মুখে হাত বোলাল। বুকে জড়িয়ে ধরলো। সবাই তাকিয়ে আছে।
এগুলো এবারে ছাড়।
ছাড়ছি। মিত্রা কোথায় গো?
কেন!
ওকে বলো কাগজগুলো দিতে।
স্নান করছে। বেরলে বলছি। ছোটো লুচি ভাজছে, খাবি।
আমি একা।
বৌদি হাসলো। অনিমেষদার দিকে তাকাল। তোমরা ওকে এবার একটু ছাড়ো।
হ্যাঁ সুতপা ছেড়ে দেব। ও কোথায় শেষ করলো একটু শুনি। অনিমেষদা বললো।
আমাদের তারপর থেকে এগতে হবে। বিধানদা বললো।
বৌদি ঘর থেকে বেরতে গেল। গেটের মুখে ছোটোমা। চায়ের পট হাতে।
জিজ্ঞাসা করেছো?
কিরে!
বাবু এখন ভিআইপি। খাবার সময় আছে কিনা।
ঘরের সকলে হাসছে।
বৌদি ছোটোমা হাতে হাতে সকলকে চা দিল। আমার কাছে এগিয়ে এলো। হাতে কাপটা দিয়ে বললো, কনিষ্ক এসেছে। তোর কীর্তি কলাপ শুনছি।
অনিমেষদার দিকে তাকিয়ে, দাদা ভালো করে ওর খোঁজ খবর নিন, ওর আরও কটা টনা, মনা আছে, কটা কনিষ্ক আছে।
সবাই হাসছে।
ও ছোটো, এখন থাক বেচারা কাল সকাল থেকে….। বৌদি বললো।
ওর সব ক্রিয়েটেড, খালি কাজ খোঁজে। তুমি দেখবে একটা না একটা ও করেই চলেছে। এই আট মাসে আমার আর দিদির হাড়মাস এক করে দিল।
আমি ছোটোমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছি।
দেখছো দেখছো ওর হাসিটা দেখছো।
চল ও লুচি খাবে বলেছে।
আজ বাড়ি থেকে বেড়োবার নাম করিস।
সবাই ছোটোমার কথা শুনে যাচ্ছে এমনকি দাদা, মল্লিকদা, ডাক্তারদাদা পর্যন্ত প্রতিবাদ করছে না। ছোটোমা, বৌদি চলে গেল।
বিধানদা ইজি চেয়ারে। অনিমেষদা আমার খাটে। বাকি সবাই চেয়ারে।
অমিতাভবাবু।
বলুন।
একটা সিগারেট দিন।
দাদা প্যাকেটটা এগিয়ে দিলেন।
আয় এখানে এসে বোস।
আমি অনিমেষদার পাশে গিয়ে বসলাম।
দাদা, মল্লিকদা আমার দিকে তাকিয়ে।
বিধানবাবু আপনি বলুন।
তুমি শুরু করো।
অনুপ।
বলুন।
আচ্ছা অশ্বিনীনগরের খবরটা কবে আসে আমাদের কাছে।
অনির বিয়ের দিন।
মিত্রার কথা মতো অনি কবে জেনেছে।
তার আগের দিন।
আচ্ছা প্রবীর ওই ব্যাপারটার সঙ্গে তোমার কোনও ভাবে লিঙ্ক আছে।
প্রবীরদা চুপ করে আছে।
না প্রবীর তোমায় বলতে হবে। কাল তুমি অনির সঙ্গে ফোনে কি বলেছ তা আমরা শুনেছি। সবাই শুনেছে। অনি আমাদের পার্মিশন নিয়েই কথা বলেছে তোমার সঙ্গে।
ভদ্রলোক ওই ব্যবসা করেন। আমি সেল্টার দিয়েছিলাম।
তুমি আমাদের ব্যাপারটা জানিয়েছিলে?
দাদা। রূপায়ণদা বলে উঠলো।
বলো।
পুরনো ইতিহাসে গিয়ে লাভ নেই। প্রবীর অস্বীকার করতে পারবে না, এই ঘটনার সঙ্গে ও জড়িত নয়। আমি সকালে অনিকে খুঁজতে গিয়ে আরও খোঁজ খবর নিয়েছি। পরে বলবো আপনাকে। তারাও দেখলাম অনিকে চেনে।
আমি মাথা নীচু করে বসে আছি।
ডাক্তারদাদা হাসছে।
বিধানবাবু আপনি বলুন। অনিমেষদা বললো।
অনি।
আমি মুখ তুললাম।
প্রবীরকে কি বলে নিয়ে এলি?
প্রবীরদা কোনও অন্যায় করে নি।
বিধানদা হেলান দিয়ে শুয়ে ছিল। তড়াক করে উঠে বসলো।
কি বললি!
প্রবীরদা নির্দোষ।
ছোটোমা, বড়োমা, বৌদি, জ্যেঠিমনি ঘরে ঢুকলো।
বড়োমা পরিষ্কার বললো, ও অনিমেষ আমরা তোমাদের কথা শুনবো, যেতে বলবে না। না হলে টিঁকে ওঠা দায় হয়ে উঠছে।
বিধানদা হাসতে গিয়ে কেশে ফেললো।
ঠিক আছে বসুন।
ছোটোমা, বৌদি সকলকে খাবার প্লেট এগিয়ে দিল।
বিধানদা লুচির প্লেট হাতে নিয়েই বললো।
ছোটো, খাওয়া হলে একটু চা খাওয়াবে।
হ্যাঁ দাদা সব নিয়ে চলে এসেছি।
লুচি কয়েকটা বেশি নিয়ে এসেছো। ডক্তারদাদা বললো।
আ মরণ খাও না। দেবে খোন।
অনুপদা হেসে ফেললো।
বড়োমা, ছোটোমা আমার দুপাশে বসলো। বড়োমার পাশে জ্যেঠিমনি, ছোটোমার পাশে বৌদি।
হ্যাঁগো বিধানবাবু অনি ঠিক ঠিক জবাব দিচ্ছে। বড়োমা বললো।
বিধানদা খেতে খেতেই বললো। সবে কথাবলা শুরু করেছি। প্রথমেই ও চ্যাপ্টার ক্লোজ করে দিল।
আমি বড়োমার দিকে তাকালাম।
দেখছো তোমরা, কেমন ভাবে তাকায়। এখুনি বলবে তোমরা থাকো আমি চললুম।
তুমি থামো। খালি বক বক। দাদা বললো।
ধমকাও কেন, এতদিনে তুমি কিছু করতে পারো নি।
আমি কি ওর পেছন পেছন ঘুরি।
ঘুরতে কে মানা করেছে।
বিধানদার খাওয়া শেষ।
কোথায় রাখি বলো ছোটো।
দাদা আর দুটো নিন।
আবার তোমাদের নিচে যেতে হবে।
না না নিয়ে এসেছি।
দাও তাহলে। বাটি চচ্চড়িটা ভারি সুন্দর করেছো।
এটা অনির প্রিয় খাবার, ওর জ্যেঠিমনি করেছে।
বাঃ বাঃ। তাহলে অনিবাবু…।
আমি বিধানদার দিকে তাকালাম।
তাহলে প্রবীর কোনও দোষ করে নি।
বৌদি উঠে গিয়ে টেবিল থেকে একটা গাডার মোড়া কাগজ নিয়ে এলো।
ধর, মিত্রা দিল।
আমি বৌদির দিকে তাকিয়ে ইশারায় বললাম বিধানদাকে দাও।
বৌদি বিধানদাকে কাগজের রোলটা দিল।
এটা কি সুতপা?
অনি কি কাগজ চাইল, মিত্রা দিল।
কিরে, এটায় কি লেখা আছে?
প্রবীরদাকে কিভাবে নিয়ে এলাম তার ডিটেলস।
বিধানদা চা খেতে খেতে চারটে চিঠি ভাল করে দেখলো। তারপর অনিমেষদার হাতে চিঠিগুলো তুলে দিল।
তুই তো দেখছি আইনটাও ভালো জেনে ফেলেছিস।
আমি মাথা নীচু করে বসে রইলাম।
ওরা সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ডাক্তারদাদার মুখটা হাসি হাসি।
কি সামন্তবাবু, দিদির মুখ থেকে শুনছিলাম আপনি ওকে কিছুটা ধরতে পেরেছেন। কি বুঝছেন।
বিধানদার কথায় ডাক্তারদাদা চায়ের কাপ থেকে মুখ তুললো।
আপনারা এমন কিছু ঘটনা কাল ওর সামনে করেছেন যার জন্য ও নিজে চলে গেল। মনেহয় নিজের বণ্ডেই ও ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছে।
আপনি ঠিক ধরেছেন। কাগজের মালিক এবং মালকিন জয়েন্ট বণ্ডে ছাড়িয়েছে। আর একটাতে অনি নিজে সাংবাদিক হিসাবে ওখানে উপস্থিত রয়েছে। প্রবীরের বাড়ি থেকে সে করম কিছু পাওয়া যায়নি।
বিধানদার কথা শেষ হবার আগেই অনুপদা খাট থেকে নেমে এসে আমার সামনে দাঁড়াল আমাকে হাত ধরে দাঁড় করাল। বুকে জড়িয়ে ধরলো। সবাই অবাক হয়ে দেখছে। আমি চুপচাপ।
তুই কাল আমার মনের কথা ধরে ফেলেছিলি।
সবাই কিংকর্তব্য বিমূঢ়।
কি বলছো কি অনুপ! আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। বিধানদা বললেন।
তুই বোস তোর কাছে মাঝে মাঝে আসবো। তোর কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। বিশেষ করে কি ভাবে মানুষ চিনতে হয়।
আমি বসলাম।
অনুপদা ঠক ঠক করে বড়োমা, ছোটোমা, বৌদি, জ্যেঠিমনিকে প্রণাম করলো। ছোটোমা হাঁই হাঁই করে উঠলো।
এ কি করছো অনুপ।
নাগো ছোটোবৌদি অনির মতো তোমাকে যদি ছোটোমা বলে ডাকতে পারতাম খুব ভালো লাগতো।
আচ্ছা অনুপ আমরা বাম রাজনীতি করি। আমাদের রাজনীতিতে ইমোসনের কোনও জায়গা নেই। তুমি এসব কি শুরু করলে। বিধানদা বললো।
দাদা, আপনার আর অনিমেষদার হাতে আমি, রূপায়ণ, প্রবীর তৈরি হয়েছি। অনিমেষদাকে সব কথা কম বেশি বললেও আপনাকে ভয়ে বলতে পারি না। বলতে পারেন সেই ভয়টা অত্যাধিক শ্রদ্ধা। আমি চেষ্টা করলেও আপনার পার্মিশন নিয়ে কালকে ওই ভাবে প্রবীরের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে পারতাম না।
তখন ওকে আমি প্রবল ভাবে বোঝার চেষ্টা করছি। তার আগেই রূপায়ণ বলেছিল, ওরে ও অনেক পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ। তুই পারবি না। তখন ওর চোখ আমি দেখেছিলাম। আপনারা কেউ ওকে ফলো করেছিলেন কিনা জানিনা। ও কারুর কোনও কথা শোনেনি। ও ওর কাজ করে বেড়িয়ে এসেছে। অনিমেষদা যখন অরিত্রকে ডেকে বললো, ওদের গ্রীণ সিগন্যাল দিয়ে দাও।
মুখে কিছু বলতে পারি নি। মনে মনে খুব আপসেট হয়ে পরেছিলাম।
আমাদের তিনজনের একজন সরে যাবে। তারপর একঘণ্টা অনিকে দেখেছি।
আপনাদের কথা শুনেছি। অনি যখন ওপরে চলে আসছে, ওর হাতটা চেপে ধরেছিলাম। ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম। মুখে কিছু বলিনি, মনে মনে বলেছিলাম। তুই প্রবীরকে ক্ষমা করে দে। আমাদের পাঁচজনের থেকে একজনকে সরিয়ে দিস না।
আপনাদের সঙ্গে ও বাড়িতে গেছি। ঘুম হয়নি। সকালে শুনলাম অনি, মিত্রা দুজনেই বাড়ি নেই। মনটা প্রথমে কু গাইল। প্রবীরকে ফোন করলাম। ওর ফোন স্যুইচ অফ, ওর পরিচিত সবার ফোন স্যুইচ অফ। নিজের সমস্ত সোর্স ফেল, কাউকে বলতে পারছি না ঘটনাটা। শেষে আমি সল্টলেকে ওই আফিসে আমার একজন পরিচিতকে ফোন করি। তখন আমার বর্ণনা শুনে ও বললো, মিঃ সিংকে নিয়ে ওরা বেরিয়ে এসেছে। আপনাকে ভয়ে ফোন করিনি। যদি আপনি কিছু বলেন। অনিমেষদাকে ফোন করতে গেলাম। তখন অনিমেষদা ফোন করে জানাল অনি গেটের মুখে গাড়ি থেকে নামছে। জিজ্ঞাসা করুণ অনিমেষদাকে আমি প্রথমেই জিজ্ঞাসা করেছি, প্রবীর আছে কিনা। অনিমেষদা বললেন, উইথ ফ্যামিলি।
অনুপদা হাঁপাচ্ছে।
জানি বিধানদা, আমাদের বাম রাজনীতিতে ইমোসনের কোনও জায়গা নেই। সেখানে আমরা বাস্তববাদী। কিন্তু আজ এই মুহূর্তে আমার এই অবস্থার জন্য একমাত্র অনি দায়ী।
সারা ঘড় নিস্তব্ধ। পিন পরলে শব্দ হবে। অনিমেষদা ভাবলেশহীন মুখে বসে।
ছোটো তোমার ফ্লাক্সে একটু চা হবে। বিধানদা বললো।
আমার জন্য যদি হয় একটু দেখ। ডাক্তারদাদা বললো।
দাঁড়ান আমি বলে আসছি। ছোটোমা উঠে দাঁড়াল
দাঁড়া তোর সঙ্গে আমি যাচ্ছি। বৌদি বললো।
তুমি বসো আমি পারবো।
ছোটো। বিধনদা বললো
বলুন।
একবার পারলে দামিনীকে একটু ডাকো।
আচ্ছা।
ছোটোমা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। অনুপদা বাইরের বারান্দায় বেরিয়ে গেল। চোখ ছল-ছল।
প্রবীর অনির সম্বন্ধে তোমার ধারনা বলো।
প্রবীরদা মাথা নীচু করে বসে। বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
দেখো প্রবীর তুমি এবং বনানী এই কয়দিনে আমাকে অনেক কথা বলেছো, এমনকি এও বলেছো, অনি পার্টির অনেক ক্ষতি করছে। আমি শুনে গেছি। তোমাদের কথার কোনও উত্তর দিই নি। আমাদের পার্টির মধ্যে অনেক দ্বন্দ্ব আছে, আমরা পার্টির মধ্যে বসেই তার সমাধান করি। এই ঘটনাটা এখনও পর্যন্ত কেউ জানে না। হয়তো কেউ জানবেও না। যদি সত্যি সত্যি ঘটনাটা কাগজে বেরতো, পার্টি কিভাবে তার মোকাবিলা করতো। আমরা তার স্ট্র্যাটিজি তৈরি করি, আজ এই মুহূর্তে তোমাকে দায়িত্ব দিলাম। তুমি বলো।
ছোটোমা, বৌদি ঘরে ঢুকলো। পেছনে দামিনীমাসি।
বসো মাসি। বিধানদা বললো।
আমাকে নাম ধরে ডাকুন দাদা।
নাগো মাসি। তোমরা সবাই মিলে অনির মতো একটা ছেলে উপহার দিলে। তোমাদের নাম ধরে ডাকতে পারি। সুতপাকেও আজ থেকে আর নাম ধরে ডাকব না।
মাসি চুপ করে গেল।
তোকে একবার কনিষ্ক ডাকছে। ও চলে যাবে। দামিনামাসি বললো।
কোথায় কনিষ্ক? অনিমেষদা বললো।
বাইরের বারান্দায়।
ওকে ভেতরে ডাকো।
মাসি গেটের কাছে চলে গেল। ইশারায় কনিষ্ককে ডাকলো।
কনিষ্ক গেটের কাছে এসে দাঁড়াল।
আয় বাবা আয়। ওদের খবর কিরে। অনিমেষদা বললেন।
এখন ভালো আছে।
কোথায় রেখেছিস?
নীরুর নার্সিংহোমে।
ওই তল্লাটে লোক পাঠিয়েছিস?
হ্যাঁ।
সব ঠিক আছে।
না।
আবার কি সমস্যা!
অনিকেতের সঙ্গে মনার বৌ এসেছে। আরও দশ পনেরো জন। ওরা অনির সঙ্গে কথা বলতে চায়।
অনিকেত কি সব সত্যি কথা বলেছে।
না বলে উপায় ছিল না। ওরা এমনি খুব সহজ সরল। বিশ্বাস হারালে ডেঞ্জার।
অনিমেষদা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছারলো। বৌদি সবাইকে চা দিল।
তুই একটু বোস।
আমাকে হাসপাতালে যেতে হবে। কয়েকটা অপারেশন আছে। তাছাড়া ভালোপাহাড় থেকে লোক এসেছে। ওদের কি সমস্যা আছে। ওরা কোথা থেকে জানতে পেরেছে রাজনাথবাবুর ঘটনাটা। ওরাও অনির সঙ্গে দেখা করতে চায়। বুঝিয়ে সুঝিয়ে রেখে এসেছি।
বিধানদা হেসে ফেললো। হ্যাঁগো অনিমেষ ভালোপাহাড়টা আবার কোথায়?
অনিমেষদা চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন। ঝাড়খন্ডে। কেন আপনাকে বলিনি। ওখানে আমাদের একটা সংগঠন তৈরি হয়েছে। ওরা এসে বার বার যোগাযোগ করছে। রূপায়ণকে দায়িত্ব দিয়েছি।
কে এসেছে কনিষ্ক। বিধানদা বললেন।
শ্যাম।
তোমরা ওদের চিনলে কি করে। অনিমেষদা বললো।
তোমরা পার্টির সংগঠন কর কি করে বলতে পারো। বড়োমা খ্যার খ্যার করে উঠলো।
কি করে জানবো বড়দি।
ওখানে অনি যায়। আজ নয় বিগত সাত বছর ধরে। কনিষ্করাও যায় ডাক্তারী করতে। সুতপা জানে তো।
আমি পর্শু জানলাম। অনির বিয়ের দিন। কনিষ্ক গল্প করছিল। অনিমেষদা বললো।
কি অমিতাভবাবু আপনি অনিকে অনেকদিন দেখছেন। ও আপনার হাতে তৈরি। আপনি কিছু জানতেন। বিধানদা বললো।
রাখো ওর কথা, আমি যা জানি ও তাও জানে না। বড়োমা বলে উঠলো।
বিধানদা হাসছে।
বিধানবাবু এক কাজ করুণ। রূপায়ণ, অনুপ পার্টি অফিসে যাক। ওদিকটা ওরা সামলাক। আমি আপনি এখানে থাকি। কনিষ্ক ওদের এখানে আনা যাবে? অনিমেষদা বললো।
ওরা আসতে চাইছে, আমি না বলেছি।
তুই ওদের নিয়ে আয়। এ বাড়ি না হোক ডাক্তারবাবুর বাড়িতে বসে ওদের সঙ্গে কথা বলবো।
অনিমেষদা প্রবীরদার দিকে তাকাল।
প্রবীর তুমি এখানে থাকবে, না বাড়ি যাবে।
আমি একটু বাড়ি যাই, বিকেলে আসছি।
তুই একটু শুয়ে পর। তোর চোখ-মুখ লালা হয়ে গেছে। বিধানদা বললেন।
আর একজন নীচে বড়দির ঘরে ভঁস ভঁস করে ঘুমচ্ছে। ছোটোমা বললো।
বেচারা কি করে বলো, অনি যে এরকম তেঁয়েটে বদমাস ছেলে সে কি জানতো, তাহলে হয়তো বিয়ে করতো না। অনিমেষদা বললো।
বিধানদা, ডাক্তারদা, মল্লিকদা হাসছে দাদা মুচকি মুচকি হাসছে।
এই কথাটা বলুন না একবার গিয়ে, চোখে জল ভরে যাবে। আপনার সঙ্গে কথা বলাই বন্ধ করে দেবে। ছোটোমা বললো।
আমার আর হাসতে ইচ্ছে করছে না কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। বেদম ঘুম পাচ্ছে। মনে মনে বলছি তোমরা ঘর থেকে বেরলেই আমি ঘুমবো।
সত্যি সত্যি ওরা বেরিয়ে গেল। কারুর সঙ্গে আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
কনিষ্ককে বললাম, ওদের নিয়ে বিকেলে আয় কথা বলবো।
ওরা ঘর থেকে বেরবার অপেক্ষা, আমার আর জামা কাপর খুলতে ইচ্ছে করলো না। চিঠিগুলো মনে হয় অনিমেষদা নিয়ে গেল। আমি সোজা বিছানায় শুয়ে পরলাম। শোয়া মাত্রই ঘুমে চোখ জুড়িয়ে এলো। কে কোথায় কি ভাবে আছে কিছু চিন্তা করতে ভালো লাগছে না। ঘুমিয়ে পরলাম।
ঘুম ভাঙলো। চোখ মেলে জানলার দিকে তাকালাম। চোখটা কেমন জ্বালা জ্বালা করছে। কিছুতেই চোখ খুলতে ইচ্ছে করছে না। চোখে যতো রাজ্যের ঘুম জড়িয়ে আছে। বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না।
তুই ওকে তুলতে পারবি না দিদিভাই। ও হচ্ছে স্টেট বাসের মতো, চললে থামে না। আবার থামলে চলে না।
ইসি হো হো করে হাসছে।
অতো জোরে হাসিস না এখুনি জেগে যাবে।
তুই না সত্যি কি হয়েগেছিস।
যা বলছি শোন। না ঘুমলে আটচল্লিশ ঘণ্টা জেগে কাটিয়ে দেবে। আবার ঘুমলে কুম্ভকর্ণ।
ছোটোমা বললো তুলতে।
ছোটোমাকে আসতে বল। শুনলি নিজের কানে, মিলির কার গুষ্টি উদ্ধার করছিল।
মিলির কি লাইফ বল।
কি করবে। একটা ভুল করে ফেলেছে।
ও কোথা থেকে জানলো।
সকাল থেকে কি শুনছিস। দশবছর আগের বুবুন আর এখনকার বুবুন।
আমি ওকে যত দেখছি তত অবাক হয়ে যাচ্ছি।
ওর কোনও ভ্রুক্ষেপ আছে।
সত্যি ওর কোনও বিকার নেই।
অনিমেষদা, বিধানদা পার্টির অতো বড়ো বড়ো মাথা। ওরা পর্যন্ত তল খুঁজে পাচ্ছে না।
ওর প্রতি সুরোর কি জোড়।
জোড় মানে। বলতে পারিস কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে। সেই দিনের অবস্থা তুই দেখিস নি। অনিমেষদার রূপ দেখলে তুই ভয় পেয়ে যেতিস। সেদিন বুঝলাম ওরা তিনজন ওকে কতো ভালোবাসে। ইসলামভাই, দামিনীমাসি পর্যন্ত কেঁদে ভাসিয় দিচ্ছে। ও নির্বিকার।
পর্শুদিনের কথা ভাব।
সত্যি বলছি দিদিভাই আমি ভাবতেই পারিনি ও তোদের এনে হাজির করবে।
মিত্রার গলাটা ভারি হয়ে গেল।
আবার কাঁদে। যা হয়ে গেছে, গেছে, এবার আমরা সবাই এক সাথে।
বুবুন না থাকলে এ জন্মে জ্যেঠিমনিকে পেতাম না।
ঠিক আছে একেবারে চোখের জল ফেলবি না। নে কাপরটা পরে নে। ওকে ডাক।
মিত্রাদি ও মিত্রাদি।
দরজাটা খোল, মিলি এসেছে।
ব্লাউজটা পর।
পরছি, তুই খোল না, এখন কেউ আসবে না।
ইসি দরজা খুললো।
কিগো অনিদা ওঠে নি?
তুই ডাক, এতক্ষণ তোর ষষ্ঠী পূজো করলো।
আমার কি হবে দিদি।
কি আর হবে।
তুমি জানো না। গত তিনদিনে প্রায় তিরিশ বার ফোন করেছে।
কই তুই বলিস নি!
কখন বলবো তুমি বলো। সেই পরিস্থিতি ছিল।
আমাকে বলতে পারতিস।
ওই জন্য সেদিন তোমার বাড়ি থেকে আমি টিনা সোজা বাড়ি গেছিলাম। আমার ফ্ল্যাটে না। টিনার ফ্ল্যাটে। কথা বলেছি। বলে কিনা এখুনি চলে এসো। তোমার সঙ্গে ভীষণ দরকার। বার বার অনিদার নাম করছে।
তুই কি বললি?
আমি কিছু বলিনি। বলেছি আমার ল-ইয়ারের সঙ্গে কথা বলো। টিনার সঙ্গে কথা বলিয়ে দিয়েছি।
টিনা তোর ল-ইয়ার?
ওই মুহূর্তের জন্য।
টিনা কি বললো?
ডাইরেক্ট ঝাড়, কবে সই করছেন।
তুই কেশ করেছিস?
না আমার পরিচিত একজন ল-ইয়ারকে দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছি।
রিসিভ করেছে?
হ্যাঁ।
কোনও উত্তর দিয়েছে?
না।
কতোদিন হয়েছে?
দু-মাস হয়ে গেছে।
বুবুন জানলো কি করে?
আমি ঠিক ধরতে পারছি না দিদি। হয়তো কথা প্রসঙ্গে কখনও বলে ফেলেছি। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছি না। আমি সবাইকে জিজ্ঞাসা করেছি, সবাই বলছে আমরা বলিনি।
তাহলে বুঝতে পারছিস তোর অনিদা কি চিজ?
সে বলতে।
তোদের গল্প বলি, তোরা বিশ্বাস করিস না।
আচ্ছা তোরা কি বলতো, বেলা হয়েছে না হয়নি। আর কখন ছেলেটা খাবে বলতে পারিস। মিলিকে পাঠালাম সেও এসে জমেগেল। ছোটোমার গলা।
ভেতরে এসো।
ওকে এখনও তুলতে পারিসনি!
ডেকো না ডেকো না। তোমার ছেলের কীর্তিটা একবার শুনে যাও। মিত্রা বললো।
আবার কি হলো!
তোমায় মিলির ব্যাপারটা বলেছিলাম হাল্কা করে।
হ্যাঁ। কোনও গণ্ডগোল!
গণ্ডগোল তোমার ছেলে করেছে।
আবার! উঃ, ও একটু শন্তিতে থাকতে দেবে না।
আসতে কথা বলো না। জেগে গেলে আবার শুরু করে দেবে। মিত্রা বললো।
কি হয়েছে বল। গলা নামিয়ে।
তখন চিকনা ডাকতে গেল, মনে আছে।
হ্যাঁ। চিকনা তোকে ধরে নিয়ে এলো।
বাবু তখন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে মিলির তাকে ধমকাচ্ছিলেন। বাহাত্তর ঘণ্টা সময় দিয়েছেন।
একে নিয়ে কি করি বলতো। জিজ্ঞাসা করলে সব অস্বীকার করবে।
এখন মিলির মুখ থেকে শুনছি, আমার বিয়ের দিন থেকে উনি নাকি মিলিকে কনটিনিউ ফোন করে চলেছেন।
কি বলছে?
মিলির সঙ্গে দেখা করতে চায়।
এখানে আসতে বল।
তাহলে তো ল্যাটা চুকে যেত। তুমি একটা কাজ করতে পারবে।
বল।
মিলি কোথায় থাকে রে। মিত্রা, মিলিকে জিজ্ঞাসা করলো।
মিলি সল্টলেকের এ্যাড্রেস দিল।
কি করে?
সফ্টওয়ার ইঞ্জিনিয়ার।
তোর সঙ্গে কি করে আলাপ?
এমবিএ করতে গিয়ে।
সেপারেসন চাইছিস কেন?
চরিত্রের ঠিক নেই। আর কিছু বলতে পারবো না।
বলতে হবে না।
শুনলে মিলির সব কথা।
শুনলাম। ছোটোমা বললো।
তুমি একটা ঢিল ছোঁড়ো। ইসি বললো।
কাকে! অনিকে ?
হ্যাঁ।
দূর ওকে ছুঁড়লে কিছুই পাবি না। মিত্রা বললো।
বল তাহলে।
ওই যে নেপলা বলে ছেলেটা আছে না।
হ্যাঁ।
ওকে একবার ধমকাও, এই তুই মিলি যে ঠিকানাটা বললো ওই ঠিকানা বলে তুই ওখানে কি করতে গেছিলি।
তুই ভবলি ও আমাকে গড় গড় করে সব বলে দেবে। সেদিন অনিমেষদা একটা কথাও ওদের পেট থেকে বের করতে পারলো।
তাহলে ইসলামভাইকে বলো।
দাঁড়া ভাবতে দে। ওকে বললে ও বলবে দিদিভাই অনি আমার সমস্ত উইং বন্ধ করে দিয়েছে। আচ্ছা ও অরিত্র, অর্ককে দিয়ে অপারেট করাচ্ছে না?
এই তো ছোটোমা তুমি ঠিক বলেছো।
ওরে ছাড় ছাড় ওকে ডাক এখুনি দিদি এসে হাজির হবে। মনার বৌ এখনও বাচ্চা নিয়ে বসে আছে। অনিদার পায়ে ছুঁইয়ে তবে সে বাড়ি যাবে। বাচ্চাটাকে একবাটি দুধ দিয়ে এসেছি খাওয়াবার জন্য।
ছোটোমা আমার কি হবে। মিলি বললো।
থাম তুই। কতো রথী মহারথী গেল তল, মশা বলে কতো জল।
মিত্রা, ইসি হাসছে।
চলবে —————————
from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/RXDKOPV
via BanglaChoti
Comments
Post a Comment