কাজলদিঘী (৭১ নং কিস্তি)

❝কাজলদীঘি❞

BY-জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

৭১ নং কিস্তি
—————————

রাতে অনিমেষদার সঙ্গে কথা বললাম। বাড়িতে যাওয়ার অনুমতি চাইলাম। আমাকে সময় দিল। পরদিন অনিমেষদার বাড়িতে গেলাম। বৌদি প্রথমে একটু অবাক হয়েছিল। অনির কথা বলে কিছুটা চোখের জল ফেললেন। তারপর অনিমেষদা এলেন। বৌদি কিছুতেই আমাদের কাছ থেকে উঠে গেলেন না। আমার চলন বলনে ধরতে পেরেছিলেন আমি কিছু শলা-পরামর্শ করতে এসেছি। সুরো পাশের ঘরে পড়ছিল, আমরা কথা বলছিলাম। পঙ্খানুপুঙ্খ রূপে আবিদের সমস্ত কথা অনিমেষদার কাছে বমি করলাম।

আমার কথা শোনার পর অনিমেষদা হাসলেন। খবরের সত্যতা স্বীকার করে নিলেন। সেদিন আমি অনিমেষদাকে আমার সংগ্রহে থাকা দুটো ক্লু দিলাম। সেদিনের সমস্ত ঘটনা বিস্তারিত ভাবে বললাম। অনিমেষদার চোখ ছানাবড়া।

কি বলছিস তুই!

আমি ঠিক বলছি দাদা।

বৌদি শুনে লাফাতে আরম্ভ করলো।

অনিমেষদা আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, অনি মরেনি।

তোর কথা শুনে এখন বিশ্বাস হচ্ছে। আর একটা প্রশ্ন মনে জাগছে বুঝলি কনিষ্ক।

কি বলুন দাদা!

কয়েকদিন আগে শুনলাম মি. মুখার্জী ট্রান্সফার নিয়ে দুবাইতে গেছে।

একবারে দেশ ছেড়ে বিদেশে!

অনিমেষদা হাসলো।

আমার মাথায় ঢুকছে না দাদা।

ঠিক আছে তুই যা, ভেবে দেখি। মিত্রা কিছু জানতে পেরেছে?

বলতে পারবো না। তবে আমার মন বলছে অনির সঙ্গে আবিদের যোগাযোগ আছে।

না।

কেন বলছেন দাদা?

আবিদ, রতনকে আমি ওয়াচে রেখেছি।

শ্যাম, শিবুর ব্যাপারটা।

ওটা প্রবীরকে দায়িত্ব দিতে হবে।

কনিষ্ক কিছুক্ষণ চুপচাপ মাথা নীচু করে বসে থাকলো। তারপর ছল ছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো। অনি নেই, অনির অবর্তমানে তুমি আমাদের কাছে অনি। দায়ে অদায়ে তোমার কাছে মাঝে মাঝে ছুটে আসবো। তুমি আমাদের ফিরিয়ে দিও না।

এ কি কথা বলছো তুমি! তোমরা বুবুনের সবচেয়ে কাছের মানুষ। বুবুনের অবর্তমানে তোমরাই এখন আমার বল ভরসা।

কনিষ্করা চলে গেল বুঝলি বুবুন। মনটা আশ্বস্ত হলো। তুই বেঁচে আছিস। আজ থেকে আবার নতুন করে বাঁচার তাগিদটা অনুভব করতে শুরু করলাম।

আজ আমি নার্সিংহোমে ভর্তি হলাম। নিজের নার্সিংহোম, নিজের পরিচিত পরিবেশ। ডাক্তারদাদা দু-দিন আগে দেখে শুনে বড়োমার অনুমতি নিয়ে সব ঠিক করেছিল।

অতএব অসুবিধে হওয়ার কিছু নেই। পরিচিত পরিবেশেও আমার জন্য সমস্ত আলাদা ব্যবস্থা। বড়োমা, ছোটোমা, বৌদি, জ্যেঠিমনি, দামিনীমাসি সঙ্গে এলো। সকাল থেকে নীরু বাড়িতে চলে গেছিল। নার্সিংহোমের এ্যামবুলেন্সেই আমাকে নিয়ে আসা হলো। কনিষ্ক সব ব্যবস্থা করে রেখেছিল। বুঝতে পারছি সবাই আড়ালে চোখের জল মুছছে। আমি একটুও মন খারাপ করলাম না। আমি জানি, ওরা জানে না। বৌদি যেহেতু জানে তাই ওদেরকে সান্তনা দিচ্ছে। কথায় কথায় বলছে মন খারাপ করো না। মন খারাপ করলে কি ও ফিরে আসবে। সবাই ফোনে খবরা-খবর নিচ্ছে। আমার সব কিছু থরো চেক আপ হলো।

বিকেলের দিকে সবাই বসে গল্প করছি। নীরু এসে ঢুকলো। ও আমার দেখভালের দায়িত্ব পেয়েছে। ডাক্তরদাদা ওকে আমার দায়িত্ব দিয়েছে। তবে টাইট, লুজের ব্যাপারটা ওকে দেখাইনি। যা কিছু সব ওপর ওপর। আমাকে প্রশ্ন করে আমি তার উত্তর দিই। মাঝে মাঝে ইয়ার্কি ফাজলামো মারে।

ম্যাডাম মনে রাখবে আমি কিন্তু অনির সাবস্টিটিউট।

আমি ফিস ফিস করে বললাম, তাহলে বুবুনকে ব্যাপারটা জানাতে হয়।

ও হাসলো, তোমার মনের যা অবস্থা, আমাদের মনেরও সেই অবস্থা।

তারপর একটা জোড়া কলা বার করে বলে খাও তো।

বড়োমা হেঁই হেঁই করে উঠলো।

বদমাশ, এই সময় জোড়া কলা খাওয়াতে হয়?

খাবে না মানে, আলবাৎ খাবে।

জানিস জোড়া কলা খেলে কি হয়?

দেখো বিদ্যেটা অনি শিখিয়েছে। ভুলি কি করে বলো।

তখন সবাই চুপ করে গেল।

কেন খাওয়াতে চাইছিস বল।

এতদিন বলিনি। আজ বলছি। ম্যাডাম দুজনকে ক্যারি করছে। টুইন বেবি।

জানিস বড়োমা উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে সে কি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না। কিছুতেই থামাতে পারি না। তারপর বললো, অনি আর কোনওদিন দেখতে পাবে না।

আমি চুপ করে গেলাম। মনটা স্বাভাবিক একটু খারাপ হয়ে গেল।

কিছুক্ষণ পর কনিষ্ক গজ গজ করতে করতে ঢুকলো।

আমার দিকে তাকিয়ে বললো। তুমি কাউকে নিচে থাকার পার্মিসন দিয়েছো?

না!

সকাল থেকে একটা বানজারা ফ্যামিলি নার্সিংহোমের তলায় রয়েছে। কি নোংরা করে রেখেছে, তোমায় কি বলবো।

তোর কি। নীরু চেঁচিয়ে উঠলো।

দেখগে যা নিচে। দাঁড়ান যাচ্ছে না।

ওরা ফুটপাথে আছে। তোর জায়গা?

ওটা নার্সিংহোমের ফুটপাথ।

বেশ করেছে আছে, থাকবেও।

তারমানে!

তোকে ওরকম ডেকরেশন করতে কে বলেছে। এটা কোলকাতা। ওরা সাজিয়ে গুছিয়ে সংসার পেতেছে। থাকার জায়গা দিতে হবে তো।

আচ্ছা আচ্ছা। এবার থামো। বুঝেছি। আমি বললাম।

কি বুঝেছো! কনিষ্ক বললো।

আমাকে সিকুরিটির ছেলেটা এসে ব্যাপারটা বলেছিল। ম্যাডাম ওরা এসে কয়েকজন রয়েছে। দুটো ছোটো ছোটো বাচ্চা রয়েছে। ওরা বেশিদিন থাকবে না। আমি ওদের সঙ্গে কথা বলেছি। ম্যানেজার সাহেব চলে যেতে বলছেন, ওরা বলেছে কয়েকদিন পর চলে যাবে। আপনি যদি একটু বলে দেন।

তাই আমি ম্যানেজার সাহেবকে বলেছি।

কনিষ্ক শান্ত হলো।

পরের দিন আমার সিজার করার দিন ধার্য হলো। বড়োমা জ্যোতিষদাদার কাছ থেকে দিনক্ষণ, সময় সব লিখিয়ে নিয়ে এসেছে। ডাক্তারদার হাতে সেই ফর্দ ধরিয়ে দিল। সেই নিয়ে ডাক্তারদার সঙ্গে বড়োমার কিছুক্ষণ তরজা চললো। আমরা সব নীরব দর্শক। কিন্তু মাঝ রাতের দিকে আমার হঠাৎ শরীরটা খারাপ হলো। কনিষ্করা আমার কাছে কেউ না কেউ থাকতোই, ডাক্তারদাদা নীচে আরএমওর রুমে থকতো। খবর দিতে ডাক্তারদাদাও সঙ্গে সঙ্গে চলে এলো। যাকে দিয়ে আমার সিজার করানর ঠিক ঠাক ছিল, তাকে ওই মুহূর্তে পাওয়া গেল না। তখন ডাক্তারদাদার এক বান্ধবী অঞ্জলি সাহাকে ধরে নিয়ে এসে সিজার করান হলো। বাড়ির কেউ জানতেও পারলো না।

অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়ার সময় ডাক্তারদাদা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, তুই ঠিক আছিস তো? আমি হাসলাম।

আমাকে সেনস্লেস করে দিয়েছিল। মনে হয় অবস্থাও কিছুটা বেগতিক ছিল। তোর বন্ধুরা সব সামলে দিয়েছে। মাঝে একবার একটু জ্ঞান ফিরে এসেছিল। আমার মাথার শিয়রে একটা লাইট জ্বলছে।

ডাক্তারদাদা আমার গালে আস্তে আস্তে থাপ্পর মেরে বলছে, মামনি দ্যাখ দ্যাখ দাদুভাই, দিদিভাইকে দ্যাখ। দুজনেই কেমন জুল জুল করে তোর দিকে তাকিয়ে। একবার মনে হয় চোখ মেলে তাকিয়ে ছিলাম। তখন আমি একটা ঘোরে আছি।

ভোরের দিকে আমার পুরো সেন্স ফিরে এলো।

দেখি ডাক্তারদাদা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাঁ করে বসে আছে।

হেসে ফেললো।

আমিও হাসলাম।

হাসিস না। তিনজনে মিলে যা চরকি নাচন নাচালি না।

ওরা কেমন আছে?

এদিকে তো টনটনে জ্ঞান আছে। এখন কেমন বোধ করছিস?

ঠিক আছি।

কোনও অসুবিধা বোধ করছিস না।

মাথা দুলিয়ে না বললাম।

মনে হয় আমার চোখমুখ দেখে ডাক্তারদাদা আশ্বস্ত হলো।

ডাক্তারদাদা আমাকে নিজে হাতে হাতমুখ ধুইয়ে হরলিক্স আর দুটো বিস্কুট দিল।

তুমি আগে ওদের নিয়ে এসো।

নিয়ে আসছি। ওদের একটু সাজুগুজু করতে দে। সবে পৃথিবীর আলো দেখলো।

নীরু ফিক ফিক করে হাসছে।

বুঝলি একেবারে গা জ্বালান হাসি।

ওরাও আমার সঙ্গে সবাই চা খেল। দুজন সিস্টার দুটো বেবি কটে ছেলে মেয়েকে নিয়ে এলো। ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে তোর মুখটা মনে পড়ে গেল।

ভীষণ খারাপ লাগছিল। আমাদের দুজনের ভালোবাসার প্রথম ফল।

দুজনের গায়ে হাত রাখলাম। এক একটা গোটা টাওয়েলে দুজনকে আলাদা আলাদা করে পৌঁটলা বানিয়ে দিয়েছে। হাত দুটো আর পা দুটো সামান্য দেখা যাচ্ছে।

নীরু তুই সব চেক করে নিয়েছিস? ডাক্তারদাদা বললো।

হ্যাঁ।

এবার দুধ খাওয়াবে?

ম্যাডাম যদি পারে খাওয়াক।

ওরা বেরিয়ে গেল।

ডাক্তারদাদা সিস্টারদের বললো, ওদের একটু দুধ খাওয়াও। বেচারারা পৃথিবীর আলো দেখার পর কিছু খায়নি।

ডাক্তারদাদা নিজেও ঘর থেকে চলে গেল।

সিস্টার দুটো আমার মুখের দিকে তাকায়। দুধ খাওয়ানর জন্য আমাকে তৈরি করলো। আমি তো আনপড়। তার ওপর তুই থাকলে তবু একটু আধটু সাহায্য করতিস। যাই হোক সিস্টার দুটো আমার ম্যাক্সি টেনে বুক থেকে নামিয়ে দিল। নিজের দিকে তাকিয়ে নিজেই কেমন যেন অবাক হয়ে গেলাম। নিজের বুক নিজেই চিনতে পারছি না। তুই বিশ্বাস কর বুবুন, প্রথম মাতৃত্ব কাকে বলে অনুভব করলাম। বার বার তোর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। একটা শূন্যতা। তুই পাশে থাকলে কি ভালো লাগতো।

তুই বলেছিলি একজন্মে সব কিছু পরিপূর্ণ হয় না। পরের জন্মের জন্য কিছু রাখ। এইটুকু পরের জন্মের জন্য রাখলাম।

একজন সিস্টার বললো, কাকে প্রথম খাওয়াবেন?

হেসে ফেললাম।

সিস্টার দুজনও হাসছে। ওদেরই একজন ছেলেকে এগিয়ে দিল।

প্রথমে ছেলেকে বুকে আঁকড়ে ধরলাম। মনে মনে বিশ্বাস করলাম। তোর নেক্সট জেনারেশন। তারপর মেয়েকে। ওরে তোকে কি বলবো, যেই কোলে নিয়েছি, টিঁ টিঁ করে সে কি কান্না।

কিছুতেই থামাতে পারি না। সিস্টাররা হেল্প করলো।

দুজনে ঘুমচ্ছিল ঘুম ভেঙে গেছে। তারপর কান্না থামিয়ে পিট পিট করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। কোন দিকে তাকাচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না।

সিস্টারদের সাহায্যে দুজনকে দুধ খাওয়ালাম। আমার শরীর নিসৃত অমৃত। সারাটা শরীরে একটা বিদ্যুতের শিহরণ। এক অভূতপূর্ব অনুভূতি। আমার স্বপ্ন স্বার্থক। তোর দেওয়া জীবন আমি তোকে ফিরিয়ে দিতে পেড়েছি।

কচি কচি ঠোঁটে নিপিল দুটো নিয়ে কি খামচা খামচি। যেন সাত রাজার ধন এক মানিক খুঁজে পেয়েছে। কি শুরশুরি লাগছিল। হঁ হঁ করছে।

কচি কচি হাত দুটো চোখ বন্ধ করে কিছু ছুঁতে চাইছে। কিছুতেই সামলাতে পারি না। সিস্টার দুটো সাহায্য করলো। ওদের মুখের দিকে ঠায় চেয়ে আছি। কুত কুত চোখে মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আবার চোখ বন্ধ করে নেয়। মিনিট তিনেক নিপিল দুটো চোষাচুষির পর ঘুমিয়ে পরলো। মনটা খারাপ হয়ে গেল।

সিস্টারকে বললাম, ওরা আর খাবে না?

পেট ভরে গেছে, আবার এক ঘণ্টা পর।

ওদের নিয়ে চলে গেল।

বার বার মনে হচ্ছে তুই গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছিস।

আমাকে গুছিয়ে-গাছিয়ে বেডে নিয়ে এলো।

ঘরে এসে অবাক হয়ে গেলাম। ঘর ভর্তি লোক। ওই সাত সকালে বড়োমা, ছোটোমা, জ্যেঠিমনি, দামিনীমাসি সবাই হাজির। কার কথা বাদ দেব। কারুর আর গুছিয়ে কাপর পড়ার সময় হয়নি। দেখে মনে হলো, খবর পাওয়ার পর যে যা পরেছিল সেই ভাবেই চলে এসেছে। মুখটা পর্যন্ত মনে হয় ধোয়নি।

তুই এলি দাদু, দিদা কোথায়? বড়োমা কট কট করে উঠলো।

আমি হাসি।

এখন ওর কাছে দেওয়া যাবে না। ডাক্তারদাদা বললো।

ওমনি বড়োমার সে কি মুখ রে, ডাক্তারদাদার চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে দেয় আর কি। ডাক্তারদাদা বাধ্য হয়ে বললো। নীরু ওদের একবার নিয়ে আসতে বল। বড়োমার দিকে তাকিয়ে বললো, মনে রাখবে, মাত্র পাঁচ মিনিট। গায়ে হাত দেওয়া যাবে না। তারপর ওদের নিয়ে চলে যাবে।

তাহলে তোমরা আছো কি করতে?

ডাক্তারদাদার হাসিটা তুই যদি সেই সময় দেখতিস।

আমাকে আমার খাটে তোলা হলো। গুছিয়ে বসলাম।

সবাই অধীর আগ্রহে তাকিয়ে রয়েছে করিডোরের দিকে।

বেবিকট ঠেলতে ঠেলতে দুজন সিস্টার ওদের নিয়ে এলো। গুঁটি শুঁটি মেরে দুজনে চোখ বন্ধ করে ঘুমচ্ছে। মাথা ভর্তি চুল। মুখ দুটো লাল টকটকে। পাশ ফিরে আছে।

সবাই হুমরি খেয়ে পড়লো।

তোকে কি বলবো বুবুন, আমার দিকে তখন আর কারুর নজর নেই, আমি তখন ফাউ। এই পৃথিবীতে আমার কোনও মূল্য নেই।

তোর কথা মনে পড়ে গেল। আসলের থেকে সুদের দাম বেশি।

যে যা খুশি নামে ডাকছে। আমি চেয়ে চেয়ে দেখছি। আমি তখন যথেষ্ট ফিট।

ও হ্যাঁ, ছোটোমা প্রথম তোর ছেলেমেয়ের নামকরণ করলো বোচন, বুঁচকি।

বড়োমা নাতি নাতনির মুখ দেখে আমাকে এসে জড়িয়ে ধরলো। ব্যাগ থেকে একটা ফুল বার করে আমার কপালে গায়ে বুলিয়ে দিলো।

এতো সকালে কোথায় পূজো দিলে?

তুই ভর্তি হয়েছিস শুনে, চিকনা কাল এসেছে। পীরসাহেবের থানে নিজে পূজো করেছে।

বোঝ একবার। তোর শিষ্য।

চিকনা কোথায়?

নিচে আছে।

এলো না?

বললো, বাড়িতে গেলে দেখবে।

কাকারা আসে নি?

খবর পাঠিয়েছি। আর কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবে।

বড়োমারা কেউ ঘর থেকে একপাও নড়লো না। সবাই একে একে আসছে। আমার সঙ্গে দেখা করছে। চলে যাচ্ছে। পিকুর নাচ তো তুই দেখলি না। আমি দেখলাম।

দিদিভাই ওকে বলেছে মনিকে ভগবান দুটো পুতুল দিয়েছে। পুতুল দুটো ওর।

নীরু আমাকে চেকআপ করতে এসে ফিস ফিস করে বললো, জানো ম্যাডাম সেই বানজারাগুলো তল্পি-তল্পা গুটিয়ে কেটে পরেছে।

আমি নীরুর দিকে তাকালাম!

কনিষ্কটা কতো বড়ো গাঢ়ল, এবার বুঝতে পারলে।

আমি নীরুর দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছি।

তুমি জানলে কি করে?

সিকুরিটির ছেলেটা এখন এসে বললো। সকালে ওরা তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে গেছে।

ছেলেটা ওদের সঙ্গে কথা বলেছিল?

কি জানি।

লোকের আসা যাওয়ার কোনও বিরাম নেই। আমার থেকেও ভিআইপি এখন তোর ছেলে মেয়ে। তাদের দিকেই সবার নজর বেশি।

কাকা, কাকী, সুরোমাসি এলো একটু বেলার দিকে। দেখলাম উনামাস্টার এসেছে।

সবার চোখ ছল ছল করছে।

নাতি, নাতনির মুখ দেখলো। উনামাস্টার কাছে এসে আমার মাথায় হাত রেখে বিড়বিড় করলো। বুঝলাম কিছু একটা মন্ত্র আওড়ালো। তারপর চোখটা মুছে বললো।

জানিস মা সুযোগ থাকলে এই দু-টোকেও অনি বানাতাম।

আমি একটু ফাজলাম করে বলেছিলাম, না তুমি বুবুনের মতো ওদেরকেও মারবে।

উনামাস্টার হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো।

আমি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম।

কাকা এগিয়ে এসে উনামাস্টারকে সামলাল।

এই তুমি আবার বাচ্চাদের মতো কাঁদতে শুরু করলে।

না মনা, অনি নেই বুকের ভেতরটা কেমন শূন্য শূন্য লাগছে।

দেখলাম কাকার মুখটাও কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেল। কাকা উনামাস্টারকে নিয়ে ঘরের বাইরে চলে গেল।

নীপা কাছে এগিয়ে এলো। মুখটা নীচু করে রয়েছে।

আমি ওকে কাছে টেনে নিলাম।

কথা বলবি না?

আমি বিশ্বাস করিনা অনিদা মরে গেছে। তুমি চিকনাদাকে ধরো। ও সব জানে।

আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম!

তুমি বিশ্বাস করো মিত্রাদি।

কেন বলছিস বল!

যে শ্মশানকে ও সবচেয়ে বেশি ভয় পেত, সেই শ্মশানে ও মাঝরাতে একা একা যায়। পীরসাহেবের থানে গিয়ে বসে থাকে। ওর কে বন্ধু আছে, মাঝরাতে কামরপাতায় বসে ওকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করতে হবে।

তুই দেখেছিস!

আমি খোঁজ নিয়েছি। সব সত্যি।

অনাদিকে বলেছিস।

বলেছি। অনাদিদাকে বলেছে বেশি বাড়াবাড়ি করবি, গাইপ করে দেব। ওকে এখন ওখানকার সকলে যমের মতো ভয় পায়। কেন পায় জানিনা।

ঠিক আছে আমি ওর সঙ্গে কথা বলবো।

দুপুরে ইসলামভাই এলো। তখন সবে খেয়ে উঠেছি।

প্রায় সাত মাস পর ইসলামভাইকে এতো কাছ থেকে দেখছি। ঘরে তখন কেউ নেই। একমাত্র দামিনীমাসি বসে ছিল। বুড়ি সারাদিন একটু বাথরুম পর্যন্ত করতে যায়নি। বড়োমা কতো বার বললো চলো একটু মুখে জল দিয়ে আসি, বললো তোমরা যাও দিদি, আমি মামনিকে পাহাড়া দিই।

ইসলামভাই-এর মুখটা কে যেন এক পোঁচ কালিঝুলি লেপে দিয়েছে। মিশ কালো মুখখানা। কিছুক্ষণ গেটের মুখে দাঁড়িয়ে রইলো। আমাকে দেখলো। তারপর আমার কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। এই প্রথম ইসলামভাই আমার শরীর স্পর্শ করলো। প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি।  দামিনীমাসি উঠে এলো।

এই ইসলাম কি করছো!

সে কি কান্না।

ইসলামভাই-এর চোখের জল আমার কপালে টপ টপ করে পরছে। ইসলামভাই-এর চোখ বন্ধ। আবিদ, রতন পেছনে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে।

কান্না ভেঁজা গলায় বললো, বুঝলি মামনি, আমি হেরে গেলাম।

পাঠানের সব অহংকার আজ মাটিতে চুরমার হয়ে ভেঙে পড়েছে। জং এর ময়দানে অনি জিতে গেছে, তোর ইসলামভাই আজ মৃত সৈনিক। তার কোনও ক্ষমতা নেই।

আমি অবাক হয়ে ইসলামভাই-এর দিকে তাকালাম।

ইসলামভাই-এর স্নেহের স্পর্শ তখন আমার কপালে ফোঁটা ফোঁটা হয়ে পড়ছে।

কেন তুমি মন খারপ করছো। আমি করছি না।

আর মন খারাপ করবো না। আজ আল্লাহর কাছে প্রতিজ্ঞা করেছি, সব ছেড়ে দেব।

আমি ইসলামভাই-এর হাতটা শক্ত করে ধরলাম। চোখ দুটো জবাফুলের মতো লাল।

তোকে একটা জিনিষ দেখাব কাউকে বলবি না।

মাথা দোলালাম। না।

এতদিন বিশ্বাস করতে পারিনি, আজ বিশ্বাস করছি।

কি!

মনটা মরেগেছিল, আজ হঠাৎ বেঁচে উঠলাম। আমাকে তুই কয়েকদিনের জন্য ছুটি দে।

না।

তোকে দিতে হবে। আমাকে আমার শেষ কাজটুকু করতে দে।

যাদের কাজ তারা করুক, তুমি আমার কাছে থাকবে। কি দেখাবে বললে?

ইসলামভাই রতনের ফোনটা চাইলো। একঘণ্টা আগে রতনের মোবাইলে ম্যাসেজটা এসেছে।

কে পাঠিয়েছে?

তুই দেখ।

বুকের ভেতরটা দুর দুর করে উঠলো।

রতন ম্যাসেজটা ওপেন করে মোবাইলটা আমার হাতে দিল।

রতনদা, বসকে বলবে নেপলা বেঁচে থাকতে অনিদার গায়ে কেউ কোনওদিন হাত তুলতে পারবে না। অনিদার শরীর হাত লাগাবার আগে নেপলাকে প্রথম দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে হবে।

ম্যাসেজটা পরার পর আমার শরীরটা কেমন ভারি হয়ে গেল। শরীরটা কেমন যেন আনচান করতে লাগল। আমার চোখে মুখে সেটা ফুটে উঠেছিল।

আবিদ মনেহয় বুঝতে পেরেছিল ব্যাপারটা, ছুটে বাইরে চলে গেল। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই নীরু, কনিষ্ক, বটা ছুটে ঘরে ঢুকলো।

তখন আমি নিজেকে কিছুটা সামলিয়ে নিয়েছি।

এনি প্রবলেম ম্যাডাম? আমাকে দেখে কনিষ্কর মুখ শুকিয়ে গেছে।

না।

তাহলে!

ওদের হাত দেখিয়ে ইশারায় একটু থামতে বললাম।

আমি তখনও ইসলামভাইকে শক্ত করে ধরে আছি।

ইসলামভাই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। চোখের পাতা ভিঁজে কাদা হয়ে গেছে।

ওদের তিনজনের মুখ শুকিয়ে গেছে।

দামিনীমাসি উঠে এসে আমার মাথার শিয়রে দাঁড়িয়েছে।

কি হলো ইসলামভাই?

আমি কনিষ্কর দিকে হাত তুলে একটু দাঁড়াতে বললাম।

কনিষ্ক চুপ করে গেল।

নিজেকে সামলে নিলাম। কনিষ্কর হাতে মোবাইলটা দিলাম। ইসলামভাই-এর দিকে তাকিয়ে বললাম, তোমাকে কিছু পাঠায়নি।

রতনকেই আরও দুটো ম্যাসেজ করেছে।

কনিষ্করা ততক্ষণে পড়ে ফেলেছে। মুখটা হাসিতে ভরে উঠলো।

এটা আমি জানতাম ইসলামভাই, আজ এক্কেবারে সিয়োর হয়ে গেলাম। কনিষ্ক বললো।

ইসলামভাই ওগুলো জানে না? কনিষ্ক আমার দিকে তাকালো।

না।

ইসলামভাই আমার মুখের দিকে তাকাল।

তুই আগে জানতিস!

ঠিক জানতাম না। কনিষ্কর মতো বিশ্বাস করতাম ও আছে। আজ কনফার্ম হলাম।

ইসলামভাইকে ছেড়ে দামিনীমাসিকে জড়িয়ে ধরলাম। গালে গাল ঘোষলো।

পরের দুটো কি আছে?

রতন আবার মোবাইলটা আমার হাতে দিল।

মঞ্জিল আভি তক বহুত দূর রতনদা। কবে ফিরবো জানি না। আজ বহুত খুশ রতনদা, আজ ভাইপো, ভাইঝির বার্থডে। অনিদা ছুটি দিয়ে দিয়েছে।

পরের ম্যাসেজটা।

অনিদা জানে না আমি তোকে ম্যাসেজ করছি। কেউ যেন জানতে না পারে। বস খুব মনে মনে কষ্ট পাচ্ছে তাই না। পাক। এই কাজ বস সারাজীবনেও করতে পারত না।

ম্যাসেজগুলো পরার পর আমার চোখে জল ভরে এলো। দামিনীমাসি আমার মাথাটা ধরে চোখের জল মুছিয়ে দিল।

কোথা থেকে ম্যাসেজগুলো এসেছে কিছু খোঁজ খবর নিলে?

আবিদ জেনে এসেছে।

কোথা থেকে?

দুবাই থেকে।

আমার পিঠে সপাং করে কে যেন চাবুক মারলো বুঝলি বুবুন। তার মানে তুই টোডির পেছনে ধাওয়া করেছিস!

ইসলামভাই স্থানুর মতো আমার হাত দুটো ধরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো।

আমি ইসলামভাইয়ের মুখের দিকে তাকালাম। চোখ দিয়ে অনোবরতো জল গড়িয়ে পরছে। কি বলি বল।

নাতি-নাতনিকে দেখেছো?

মাথা দোলাল। দেখেছে।

ছোটোমার সঙ্গে কথা বলেছো?

মাথা দোলাল। বলেছে।

ম্যাসেজের কথা কাউকে বলেছো নাকি?

না।

বোলো না।

দিদিরা বড্ড কষ্ট পাচ্ছে।

দেখবে নাতি, নাতনিকে পেলে কিছুটা ভুলে যাবে।

ইসলামভাই চুপ করে রইলো।

বাড়িতে গিয়ে গায়ে, মাথায় জল দিয়ে তিনজনে মিলে খেয়ে নাও।

ইসলামভাই চলেগেল।

বিকেলে আবার সকলে এলো। সকলের সঙ্গে বেশ কিছুটা হই হই হলো।

বিকেলে যখন ছেলেমেয়েকে মুনু খাওয়ালাম ছোটোমা, দামিনীমাসি সাহায্য করলো।

বড়োমা, জ্যোঠিমনির মুখটা তখন যদি তুই দেখতিস, একবারে ফিদা হয়ে যেতিস। সে কতো কথা দুজনের। দুজনে ছেলেমেয়েকে কোলে নিয়ে একচক্কর করে ঘরের মধ্যে ঘুরে নিল। এই দেখে বড়োমার সঙ্গে ডাক্তারদাদার এক চোট ফাটাফাটি হলো। সময়টা বেশ ভালো কাটলো।

রাতে আমার কাছে জ্যেঠিমনি থাকবে বলেছিল। দামিনীমাসিকে কিছুতেই নরানো গেল না। আমি যতো দিন এখানে থাকবো দামিনীমাসি থাকবে আমার ঘরে। আমার সমস্ত দায়দায়িত্ব তার। ডাক্তারদাদার কাছ থেকে সেই পার্মিসন করিয়ে নিল। বড়োমা আবার বাড়িতে গিয়ে তার কাপর-চোপর পাঠাল।

বিকেল থেকে ঘর ভর্তি লোক। সারাদিন সময় পাইনি মোবাইলটা খুলে দেখার। রাতে দামিনীমাসিকে বললাম। ব্যাগ থেকে আমার মোবাইলটা এনে দাও।

দামিনীমাসি এনে দিল।

আমি মোবাইলটার স্যুইচ অন করতেই বহু ম্যাসেজ। একটা ম্যাসেজের নম্বর বুঝতে পারলাম না। প্লাস সাইন, মাত্র তিনটে ডিজিট। খুললাম।

পীরবাবার থানে দাঁড়িয়ে তুই আমার জীবনটা চেয়েছিলি। আমি সেই পূর্ণিমার রাতে তোকে আমার জীবনটা দিয়েছিলাম। আজ তুই আমাকে আমার জীবনটা ফিরিয়ে দিলি। আমি পিতৃত্ব লাভ করলাম। আমার সবচেয়ে আনন্দর দিন। তোর পাশে নিজে থাকতে পারলাম না। তবে আমার লোকজোন তোর চারপাশে সর্বক্ষণ আছে। তোকে কথা দিয়েছিলাম, আমার ভালোবাসাকে যারা কলঙ্কিত করেছে, তারা আমার হাত থেকে কোনও দিন মুক্তি পাবে না। আমার শরীরের শেষ বিন্দু দিয়ে তাদের সঙ্গে আমি যুঝে যাবো। এই যুদ্ধ যতদিন শেষ না হচ্ছে ততদিন তুই আমার মুখ দেখতে পাবি না। আমি ভালো আছি। ছেলে মেয়ের দায়িত্ব তোকে দিলাম। ওদের যেন কোনও অসুবিধা না হয়। বুবুন।

ম্যাসেজটা পড়ার পর কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকলাম। নিমেষের মধ্যে আমার হাত-পা কেমন ঠাণ্ডা হয়ে গেল। শরীরটা এত ভারি হয়ে গেল নড়াচড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেললাম। তোকে কি বলবো। যেন আমি দশমনি বস্তা। মাথার ভেতরটা মুহূর্তের মধ্যে কেমন হাল্কা হয়ে গেল। কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।

দামিনীমাসি মনে হয় বুঝতে পেরেছিল। কাছে এসে দাঁড়াল।

কার ম্যাসেজ পড়লি, অনির।

মাথা দোলালাম।

শয়তান ছেলে। একবার ফিরুক। দেখাচ্ছি মজা।

মাসির কথা শুনে হেসে ফেললাম।

সিস্টার আবার তোর ছেলে মেয়েকে নিয়ে এসে হাজির করলো। ওদের দুধ খাওয়ালাম। মাসি ওদের দুটোকে একসঙ্গে কোলে নিয়ে আদর করলো।

বাড়িতে চল, তেল মাখিয়ে তোদের শক্ত করে দেব।

মাসির কথায় আমি হাসছি।

মিটি মিটি চোখে মাসির দিকে তাকায়। আবার হাই তুললো। তোকে কি বলবো বুবুন জিভটা লাল টুকটুকে। আবার ঠোঁট চাটলো। আমি যেই চোখের কাছে আঙুলটা নিয়ে গেছি ওমনি আমার আঙুলটা চেপে ধরলো।

দিলো মাসির কোলে মুতে।

ওরা নিয়ে চলে গেল।

নীরু এলো চেকআপ করার জন্য।

এখনও চেকআপ করার কিছু আছে?

আছে ম্যাডাম আছে। পান থেকে চুন খসলে। ঘ্যাচাং।

কেন?

সকালের খবরটা আপডেট নিলাম।

কি পেলে?

ব্যাটারা নির্ঘাৎ অনির লোক। তুমি যেদিন ভর্তি হয়েছো। সেদিন মাঝরাতে নিচে বাসা বেঁধেছিল। যেই শুনেছে তোমার খাল্লাস, সেই ভেগে পরেছে।

আমি নীরুর দিকে তাকালাম। ভাবলাম তোর ম্যাসেজটা একবার ওকে দেখাই। তারপর নিজেই চেপে গেলাম।

তুমি কি আজ থাকবে?

কাল সকালে আবার চলে আসছি। কনিষ্ক, বটা থাকবে। তুমি বাড়ি ফিরে চলো তোমাকে একটা কথা বলবো।

এখন বলো।

না।

কবে ছাড়বে?

যে রকম আছো সেরকম থাকলে কাল ছেড়ে দেব।

ওরা দু-জন ঠিক আছে?

তোমার থেকে ভালো আছে।

কেন?

তুমি তো বেগড়বাই করছো। ঠিক আছে, গুড নাইট।

গুড নাইট।

নীরু চলে গেল।

ঘড়ির দিকে তাকালাম। রাত এগারটা।

মনটা ভীষণ আনচান করছে। অনিমেষদাকে ফোন করলাম। বুঝলি, অনিমেষদা আমার ফোন ধরে ভীষণ ভয় পেয়ে গেল।

কিরে মামনি? এত রাতে! তোর কাছে কেউ নেই?

দামিনীমাসি আছে।

কি হয়েছে বল?

আপনার খাওয়া হয়ে গেছে?

হ্যাঁ, এই খেয়ে উঠলাম। টিভিতে নিউজ দেখছি। তোর শরীর কেমন আছে বল?

ভালো।

বাচ্চা দুটো?

ভালো।

বল কি হয়েছে?

আপনি একবার আসবেন?

কে ফোন করেছো গো? বৌদির গলা পেলাম।

মিত্রা।

এত রাতে!

আমি পরিষ্কার বৌদির গলা শুনতে পেলাম।

কি হয়েছে!

মিত্রা। বৌদির গলা পেলাম।

হ্যাঁ বৌদি।

কি হয়েছে রে?

একবার দাদাকে নিয়ে একটু আসবে।

কি হয়েছে আগে বল?

আমি আর পারছি না বৌদি।

আবার কান্নাকাটি শুরু করেছিস।

তুমি দাদাকে নিয়ে একটু এসো না। একবার।

আচ্ছা, যাচ্ছি।

কিছুতেই ঘুম আসছে না। কনিষ্ক এলো। আমার থম থমে মুখের দিকে তাকিয়ে। একটু অবাক হয়ে গেল।

এরকম করলে হবে না ম্যাডাম। ঘুমতে হবে।

ঘুম আসছে না কনিষ্ক।

তাহলে ইঞ্জেকসন দেব।

এখন না একটু পরে দিও।

মাসি তুমি ম্যাডামের হাতে মোবাইল দিয়েছ কেন?

শয়তানটা ম্যাসেজ করেছে।

কে!

কে আবার, গুণধর।

অনি!

আমি কনিষ্কর দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলাম।

কই দেখি দেখি।

বুঝলি, কনিষ্ক ছোঁ মেরে আমার হাত থেকে মোবাইলাটা নিয়ে নিল। এক নিঃশ্বাসে ম্যাসেজটা পরে, দুহাত ওপরে তুলে একবার ঝাঁকিয়ে নিল।

শালা। বাবা হয়েছো।

অনিমেষদা আসছে।

এত রাতে!

আমি ডেকে পাঠালাম।

কাল সকালে বললে হতো না। সকাল থেকে শরীরের ওপর দিয়ে এতটা জার্ক গেল। কেন তুমি অবুঝপনা করছো।

আমি পারছিনা কনিষ্ক।

কেন এক কথা বার বার বলো। আমাদেরও কি ভালোলাগছে। তবু লড়ে যেতে হবে। স্যার শুনলে আমাকে একেবারে চিঁড়ে ভাজা করে দেবে।

অনিমেষদা, বৌদি এলো।

আমি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। বৌদিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললাম। অনিমেষদা প্রথমে একটু ভড়কে গিয়েছিল। তারপর কনিষ্ক সব গুছিয়ে বললো।

অনিমেষদা হো হো করে হেসে উঠলো।

কাঁদিস না মামনি। এতদিন অন্ধকারে হাতড়াচ্ছিলাম। তুই বিশ্বাস কর। তোর দাদা চুপচাপ বসে নেই। সে তার মতো কাজ করে চলেছে।

অনিমেষদা আমার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।

নিজে থেকেই ইসলামভাইকে ফোন করলো।

তুমি কোথায় আছো….একবার নার্সিংহোমে এসো….না ভয়ের কিছু নেই….হ্যাঁ। রতনকে সঙ্গে এনো।

ইসলাম কোথায় আছে দাদা। দামিনীমাসি বললো।

রতনের ফ্ল্যাটে।

যাক রক্ষে, না হলে এখুনি বড়দি খেয়ে ফেলতো।

ওখানে থাকলে আমি আসতে বলতাম না।

তুই একটু ঘুমো মা। বাচ্চাগুলোকে দেখতে হবে। বৌদি বললো।

আমার ঘুম আসছে না।

তোকে এই বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে না। আমি দেখছি। অনিমেষদা বললো।

কনিষ্ক আমাকে ইঞ্জেকসন দিল।

আজ সারাটা দিন আমার শরীরের ওপর দিয়ে একটা ঝড় বয়ে গেল।

শরীর আর বইছে না। লিখতে ইচ্ছে করছে না। তবু লিখছি। তুই ছাড়া আমার কে আছে বল। তাই লেখার মধ্যে দিয়ে তোর সঙ্গে একটু কথা বলি।

লেখার আগে কতো কথা মনে আসে, কতো তার ভাষা, এটা লিখব সেটা লিখব। যেই লিখতে বসি কিছুতেই মনে পড়ে না। অর্ধেক মনে পড়ে তো অর্ধেক মনে পড়ে না। সব তালগোল পাকিয়ে খিচুড়ি হয়ে যায়। লিখতে লিখতে প্রায়ই খেই হারিয়ে ফেলি।

আজ তোর ছেলে মেয়ের ষষ্ঠীপূজো হলো। মানে তাদের বয়স আজ ছয়দিন।

নার্সিংহোম থেকে ফেরার পর মানুষের আসার আর বিরাম নেই। কেউ আর খালি হাতে আসে না। বড়োমার ঘরে আর জায়গা নেই। সারাদিন লোক আর লোক।

গতকাল থেকে সবাই এসে হাজির। সেই বিয়ের দিনের মতো। সবাই তোর ছেলে আর মেয়েকে নিয়ে হই-হুল্লোড়ে মত্ত। মিনিটে মিনিটে তারা সব নতুন জামাকাপর পরছে।

সকালে প্রথমে আসে বটাদা, হরিদা।

দুজনে সাত সকালে এসেছে লক্ষ্মী, নারায়ণকে দেখতে। দুজনের জন্য দুটো সোনার চেন নিয়ে এসেছে। লকেটটা জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার। সেই দেখে দাদা বকাবকি করলো। এতো দাম দিয়ে এসব নিয়ে আসার কি দরকার।

দুজনের মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। তারপর দাদাকে বললো। অনেক নুন খেয়েছি। এইটুকু দিলাম। দিদিমনির দাদুর সময় থেকে আছি। দিদিমনির কোলে লক্ষ্মী-নারায়ণ এসেছে। তুমি রাগ করো কেন। আমাদেরও তো একটু সাধ আহ্লাদ আছে।

ওদের দুটোকে নিয়ে দুই বুড়ো কিছুক্ষণ বসে থাকল। দুজনের খুনসুঁটি দেখে সকলে হাসে।

তারপর খেয়ে দেয়ে অফিসে চলে গেল।

তুই বিশ্বাস করবি না। দু-জনের কেউ ঘুণাক্ষরেও তোর নামটা পর্যন্ত উচ্চারণ করলো না। আমি একটু অবাক হয়ে গেলাম।

একে একে অনিমেষদারা সবাই এলো। প্রবীরদা একটু মন খারাপ করলো। আলাদা করে আমায় ডেকে বললো, জানিষ মিত্রা এবারও ফেল করে গেলাম। সব উদ্ধার করলাম, কিন্তু ওকে পেলাম না। তবে এটুকু বুঝলাম ও আছে।

নম্বরটা পেয়েছো?

পেয়েছি।

দাও একবার ট্রাই করি।

তুই কি ভেবেছিস আমি বসে ছিলাম।

যদি আমি করতে ধরে।

নম্বরটা এমন কারুর যে ওখানে বসবাস করে। সে ওকে চেনে না।

সব কিছু গুছিয়ে বলার পর সে বললো আপনি ভুলভাল বলছেন, ঠিক করে নামটা বলুন তাহলে আপনাকে হেল্প করতে পারবো।

নেপলারটা?

স্যুইচ অফ।

আমার পরিচিত একজনকে বলেছি। সে ওখানেই থাকে। এক সপ্তাহ টাইম নিয়েছে।

বিধানদা শুধু দুজনকে চেয়ে চেয়ে দেখলো। আর হাসলো।

যাই বল মিত্রা, এ দুটো মনে হয় ওর বাপের মতো হবে না।

হাসলাম।

কাকে বাদ দিয়ে কার কথা বলি বল তো—

সুরঞ্জনা তোর মেয়েকে নিয়ে ঘুরছিল। হঠাৎ দেখি দৌড়ে বৌদির কাছে চলে গেল।

ধরো ধরো।

কেনরে শখ মিটে গেল।

উঃ ধরো না তুমি।

বৌদি ধরলো সুরঞ্জনা দৌড়ে বড়োমার ঘরের বাথরুমে ঢুকে গেল।

তারপর দেখি তোর মেয়ে টিঁ টিঁ করে উঠেছে।

দামিনীমাসি গিয়ে ধরলো।

হেসে ফেললো।

সত্যি তোর মেয়েটে একেবারে অসভ্য। সুরঞ্জনার কোলে পটি করে দিয়েছে।

বাথরুম থেকে সুরঞ্জনা বেরতে সকলে হাসাহাসি করলো।

সুরঞ্জানা বলে প্রথমে দেখি ও চুপ করে গেল। তারপর দেখি ওর নাকটা কেমন ফুলে ফুলে উঠছে। আমার দিকে কেমন পিট পিট করে তাকিয়ে। ভাবলাম নতুন মানুষ দেখেছে হয়তো।  ওমা, তারপর দেখি আমার হাতটা গরম গরম ঠেকছে। একটা পড় পড় আওয়াজ, ব্যাশ মায়ের কোলে দিয়ে সিধে বাথরুম।

সুরঞ্জনা বলে, সবাই হেসে গড়িয়ে পরে যায়।

জানিষ বুবুন, এখন আমার সহ্য শক্তি অনেক বেড়ে গেছে। এখন আর সেইভাবে মন খারাপ হয় না। কেউ কিছু বললে, ভাবি, চিন্তা করি, কেন এই কথা বললো। নিশ্চই এর পেছনে কোনও কারণ আছে তাই।

কাকা, উনামাস্টারকে ধরে এনেছে। উনামাস্টার নাকি তোর ষষ্ঠীপূজো করেছিল। তাই তোর ছেলে মেয়ের ষষ্ঠীপূজো সেইই করবে।

তার পূজার উপকরণ সাজানগোছান দেখে সকলের ভীমরি খাওয়ার অবস্থা।

জ্যোতিষদাদা এসেছিল। তোর ছেলেমেয়ের জন্মের আগে দিনক্ষণ ঠিক করে দিয়েছিল। সেই সময়ে তো হয়নি। তার আগেই হয়েছে।

সব দেখেটেখে বললো মিত্রা তুই ছেলেকে আটকে রাখতে পারলেও মেয়েকে আটকে রাখতে পারবি না। এ ওর বাপের মতো স্বভাব পাবে। আর দেখবি এইই ওর বাপকে ধরে আনবে।

তারমানে! কবে মেয়ে বড় হবে তবে ওর বাবা ফিরবে!

তোকে আমি আগেই বলেছিলাম। অনি থাকবার ছেলে নয়। ও তোর জীবনে বেশি দিন থাকবে না। ওকে তুই বেশি দিন ধরে রাখতে পারবি না। একরোখা। মাথায় যেটা ঢুকবে সেটা যতক্ষণ পর্যন্ত শেষ না দেখছে ততক্ষণ পর্যন্ত ও তার পেছনে পরে থাকবে।

তোকে এ ও বলেছিলাম তোর দুই সন্তান হবে। তুই তখন বিশ্বাস করিসনি।

দেখ মিত্রা, কে কি বলে জানিনা। তবে পড়াশুনটা ঠিক মতো করলে কিছু বলা যায়। না হলে নস্ত্রাদামু কি করে এতো ভবিষ্যৎবাণী করে গেল। তার কিছু তো মিলে যাচ্ছে।

তোর ছেলে শান্তশিষ্ট অতো ঘোর প্যাঁচোয়া হবে না। কিন্তু মেয়ের থেকে সাবধান। বাবার লাইফলাইন ওর ওপর ভীষণভাবে প্রভাব বিস্তার করবে।

তুমি কিছু দাও।

দিয়ে লাভ নেই। ওর বাবাকে দিয়ে কিছু হয়েছে।

জ্যোতিষদা খাওয়া দাওয়া করে চলেগেল। যাওয়ার আগে বড়োমার কানে ফুস মন্ত্র দিল।

তুই যখন চলে গেলি। তোকে যখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তারপর সবাই যখন শুনলো তোর ডেডবডি পাওয়া গেছে কল্যানী হাইওয়ের একটা ঝোপে।

আর সেই দিনটার কথা মনে করতে ভালো লাগছে না। সেদিন কিন্তু একজনই বলেছিল তুই মরিসনি। সে হচ্ছে জ্যোতিষদাদা। তুই বেঁচে আছিস। কোথায় আছিস বলতে পারবে না। জোড় দিয়ে বলেছিল তুই বেঁচে আছিস। বড়োমা শুনে আশ্বস্ত হয়েছিল। কিন্তু মন কি মানে। সব সময় কু গাইত।

বড়োমার সে কি তাড়া।

তুমি আগে বলো, অনির কি করলে?

ফিরে আসবে। ওর কাজ সারতে দাও।

কতদিন লাগবে?

কোনও ঠিক নেই। তোমাদের আগেও বলেছি। ওকে সহজে কেউ মারতে পারবে না। ওর গ্রহ-নক্ষত্র প্রচন্ড স্ট্রং।

ছেলের কথা বলো।

ছেলে ভালো। মেয়ে ঠিক নয়।

কেন! ওর বাপের মতো জ্বালাবে?

জ্বালাতে পারে।

ব্যাশ আগুনে ঘৃতাহুতি পরলো।

এখুনি তুমি ওর একটা ব্যবস্থা করো। ডোমরা টোমরা কি লাগবে বলো।

এখন লাগবে না। যখন লাগবে বলবো।

জানিস আজ বসিরহাট থেকে সবাই এসেছিল। দাদু, দিদা পর্যন্ত।

তুই চলে যাবার পর, তোর কথা শুনে দাদুর দীর্ঘদিন কথা বন্ধ হয়ে যায়। ডাক্তারদাদা অনেক রকমের ওষুধ খাইয়ে তবে স্বাভাবিক করতে পেরেছিল। বুড়ো বলে কি আমি অনির ছেলেকে না দেখে মরবো না।

বুড়ো তোর ছেলেকে মেয়েকে কোলে নিয়েছে। পারে নাকি। আমি ধরলাম। তোর মেয়ে সত্যি অভদ্র। বুড়োর কোলে মুতে দিয়েছে।

মামা, মামীমা, বিতান, সানা, সানা-বিতানর বেশ কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব কার কথা বাদ দিই বলতো। সকলেই আজ বেশ ফুর ফুরে। তোর ছেলেমেয়ে মাঝে মাঝে জেগে ওঠে আবার ঘুমিয়ে পরে। যেই জাগে সকলে হুমড়ি খেয়ে পড়ে দেখার জন্য। এক একজনে এক একরকম নামে ডাকে। নামের আর শেষ নেই। খাওয়া দাওয়া হই-হুল্লোড়।

সকাল বেলা উনামাস্টার ঘণ্টাদুয়েক পূজো করেছে। আমি, ছোটোমা ঠায় ওদের দুটোকে নিয়ে বসেছিলাম। কোমড় পিঠ ব্যাথা হয়েগেছিল। ওই সময়টুকু উনামাস্টার ওদের মুনু পর্যন্ত খাওয়াতে দেয়নি। শাস্ত্র মেনে সব নিয়মকানুন পালন করতে হয়েছে।

শেষে সবাই লাঠি দিয়ে কুলো ভাঙলো। তোর গাওয়া সেই গানটা গাইল।

আট কড়াই, বাট কড়াই, ছেলে আছে ভালো। ছেলের বাবার কাঁচা ধরে টানা টানি করো।

শুধু তুই নেই।

চলবে —————————



from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/VFIwu8M
via BanglaChoti

Comments