কাজলদিঘী (৬৯ নং কিস্তি)

❝কাজলদীঘি❞

BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

৬৯ নং কিস্তি
—————————

বড়োমা, ছোটোমাকে নিয়ে এক জায়গায় যাব। সেখানে আগে থেকে বলা আছে।

ফিরবি কখন।

ফিরতে রাত হয়ে যাবে।

রাজনাথকে ছেড়ে দে।

অনিমেষদার দিকে স্থির দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকলাম।

ও কি রাজনাথকে….! ডাক্তারদাদা বললেন।

হ্যাঁ সামন্তদা।

অনিমেষদা আমার থেকে চোখ সরায়নি। দাদা, বড়োমা, ছোটোমা, মিত্রার চোখেও ভাঁজ পড়েছে।

দায়িত্ব তোমার, এরপর আমার কানে যদি কোনও খবর আসে ও বেঁচে থাকবে না।

অনিমেষদা আমার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলো।

তাকিয়ে লাভ নেই। আমি যা বলছি খোঁজ নিয়ে দেখ। ওর লোক জন এগুলো করেছে কিনা।

আমি খোঁজ নিয়েছি। ওরা তোর ভয়ে সেল্টার নিতে গেছিল প্রবীরের কাছে।

উইথ ওয়েপনস।

বলতে পারবো না।

প্রবীরদা—

আমার সঙ্গে কাল রাতে শেষ কথা হয়েছে। ঘটনাটা ঘটার পর থেকে আর কথা হয়নি।

অবতার, সাগির কোথায়? ইসলামভাই বললো।

তোমার জেনে লাভ।

ইসলামভাই হেসে উঠলো।

ওরা বাচ্চা ছেলে কোথায় কি করে বসবে।

তোমার থেকে বেশি বুদ্ধি রাখে।

সে তো এখন টের পাচ্ছি।

দামিনীমাসি মুখে কাপর চাপা দিয়ে হাসছে।

হেসো না মাসি। তোমাদের জগতটাই এটা, তোমরা কোনওদিন রাজনাথকে ছুঁতে পারতে।

কখনও কোনওদিন ভাবনা চিন্তাতেই আনিনি। ইসলামভাই বললো।

ও কিন্তু তুলে নিয়ে গিয়ে নিজের হেফাজতে রেখেছে। পুলিশ এখনও ট্রেস আউট করতে পারেনি।

আমি উঠে দাঁড়ালাম। মোবাইলটা পকেট থেকে বার করলাম স্যুইচ অন করে পাসওয়ার্ড দিলাম। তারপর ডায়াল করলাম।

ওরা আমাকে স্থির চোখে সবাই লক্ষ্য করছে।

বলো।

কোথায় রেখেছিস?

ঠিক জায়গায় আছে। রিপোর্ট পেয়েছ।

এখনও আসেনি। শোন এখন পাঠাতে হবে না। পরে নিয়ে নেব। রাজনাথকে পার্টি অফিসের সামনে নামিয়ে দে।

ঘণ্টা দুয়েক দেরি হবে।

কটার সময় বল।

একটা বাজবে।

আচ্ছা। প্রবীরদার বাড়ি থেকে চোখ সরাবি না।

ওখানে লোক আছে।

আরগুলোকে পেয়েছিস।

নেপলা ধরে বিট দিয়ে দিয়েছে। বললো ওদের চেনে।

এখানকার?

হ্যাঁ।

পকেটে পয়সা আছে।

না।

তাহলে আবিদের কাছ থেকে নিয়ে নে। ওর কাছে রাখা আছে। রাজনাথকে ছেড়ে দিয়ে মাসির ওখানে গিয়ে কাজগুলো দেখাশুনো কর।

আচ্ছা।

ফোনটা কেটে দিলাম।

আমি চেয়ারে এসে বসলাম।

অনিমেষদা মাথা দোলাচ্ছে আর হাসছে।

অনিমেষদা মিত্রার দিকে তাকাল।

কিরে কথা হলো?

হ্যাঁ।

কখন যাবি বললি?

বললাম বুবুন একটা মিটিং করছে মিটিং শেষ হলেই যাব।

কোথায় যাবি?

বলাযাবে না।

সেকিরে!

অনিমেষদা জোড়ে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতেই বললো।

দামিনী একটু চা করো। দিদি আপনারা রেডি হয়ে নিন।

কম বেশি সকলেই মিত্রার কথায় হাসছে।

আমার দিকে তাকিয়ে।

তুই বিশ্বাস কর ও প্রবীরের কাছে সেল্টার নিতে চেয়েছিল।

আমাকে বিশ্বাস করাতে পারবে না। তুমি অনেকক্ষণ থেকে এক তরফা কথা বলে চলেছ। আমাকে বলতে পারবে এই কেসে ও যামিন পায় কি করে?

আইন বলছে ও যামিন পেতে পারে তাই পেয়েছে।

আমি বলছি তোমাদের লবির বিচারকটা সুবিধার নয়।

তোর সব মনগড়া কথা। অনিমেষদা মুচকি মুচকি হাসছে।

একটা প্রশ্ন করলে, জল না মিশিয়ে তার সঠিক উত্তর দিতে পারবে?

বল।

ওর প্রতি তোমাদের এতো দুর্বলতা কেন?

তোকে অবশ্যই বলবো। পার্টির ভেতরের সব কথা তোকে বলা যায় না। বলতে পারিস রাজনীতি করছি। আমি তোকে কথা দিচ্ছি একটু সময় দে।

অনিমেষদা এমনভাবে কথা বললো আমি কোনও কথা বলতে পারলাম না।

আমি অনিমেষদার মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছি।

তুই বিশ্বাস কর অনুপ, প্রবীর মনিটরিং করছে। মাঝে মাঝে ওদের চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে। কথা দিচ্ছি এবার হবে না।

এই প্রসঙ্গে আর একটা কথা বলে রাখি ও আরও দু-চার জায়গায় চোখ দিয়েছে। সেটা আমি বুঝতে পেড়েছি। এটা ওকে জানিয়ে দেবে। ও যদি ভেবে থাকে অনির দুর্বল জায়গাগুলো ও জেনে ফেলেছে তাহলে ও ভুল করছে।

তুই সব মনগড়া কথা বলছিস।

আমি পাটিগণিতে কোনওদিন ভালো ছাত্র ছিলাম না। নম্বরও পাইনি। নম্বর পেতাম বীজগনিতে। ওখানে অঙ্ক মেলাতে গেলে সব সময় একটা এক্স ধরতে হয়।

অনিমেষদা আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। আমি যে এ ভাবে সপাটে জবাব দিতে পারি অনিমেষদা বিশ্বাস করতে পারেনি।

অনুপদা, প্রবীরদা হেসে ফেললো।

বয়স হয়েছে রাজনীতি করতে করতে চুল পেকে গেল। তোর কথা বোঝার ক্ষমতা আছে।

আমি অনিমেষদার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

তুই যা ভাবছিস তা কখনও ঘটবে না। তাহলে তোর অনিমেষদা চুপচাপ বসে থাকতো না।

এর আগেও তোমাকে সাবধান করেছি তা সত্ত্বেও তুমি ভুল করেছো।

পার্টির কাজ করতে গেলে দশজনের ওপর নির্ভর করতে হয়। তারা যদি ভুল ইনফর্মেশন দেয় কি করবো।

তাড়িয়ে দেবে।

সংগঠন চালাতে গেলে পার্টি থেকে তাড়িয়ে দিয়ে সমস্যার সমাধান করা যায় না। তাকে পার্টির মধ্যে রেখে রাজনীতি দিয়ে সেই সমস্যার সমাধন করতে হয়। তোর অঙ্কটা অবশ্য আলাদা।

সবাই আমাদের কথা অবাক হয়ে শুনছে। ভাবছে অনি কার সঙ্গে এই ভাবে কথা বলছে। যার মুখের ওপর কথা বলতে গেলে লোকে দশবার ভাবে। তাকে অনি এই ভাবে ক্রশ করছে।

এক সময় পার্টিটা আমি মন দিয়ে করেছি।

তুই পার্টি করিসনি। তুই পার্টিকে একান্তভাবে ভালোবসেছিস। আজও ভালোবাসিস। তাই আমার কথা ভাবিস, প্রবীরের কথা ভাবিস। পার্টির স্বার্থ দেখিস। কিছু নোংরাম দেখলে আমার কাছে ছুটে যাস। নিজের চেষ্টায় পার্টির সংগঠন তৈরি করিস। বলতে পারিস তাদেরকে আমাদের পার্টির প্রতি একনিষ্ঠ হতে অনুপ্রেরণা দিস। আমরা তোকে আগবারিয়ে বলতে যাইনি। তুই আমাদের হয়ে এই কাজটা কর। ক-জন নিজে থেকে দায়িত্ব নিয়ে এই কাজ করে। তুই যদি ভাবিস আমি বুঝি না, তাহলে ভুল। আমি বুঝি, সময়ের অপেক্ষা করি।

তোমার সময়ের অপেক্ষা করতে করতে অনেক কিছু ক্ষতি হয়ে গেছে।

তোর কথা মেনে নিচ্ছি। তবে কিছুটা রিভাইভ করেছি। তুই এতো খবর রাখিস ওই খবর রাখিস না, এটা আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।

আমি চুপ করে রইলাম।

তুই এই কদিনের মধ্যে ভালোপাহাড়েও গেছিলি। নিশ্চই শুনেছিস আমি অনুপকে শ্যামের কাছে পাঠিয়েছিলাম। অনুপ কিছুটা কাজ করে এসেছে। আবার যাবে।

সবাই একবার আমার দিকে অবাক হয়ে তাকাল।

ও কবে ভালোপাহাড়ে গেল? বড়োমা অনিমেষদার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো।

আপনারা ওকে ঠিক এখনও চিনে উঠতে পারেননি দিদি। অনুপদা বললো।

ছোটোমা চা নিয়ে এলো।

কিগো দিদি ভালোপাহাড়ের কথা শুনলাম।

ছোটোমা সবাইকে চায়ের প্লেট এগিয়ে দিল।

তুই একবার ভেবে দেখ ছোটো, অনি এর মধ্যে নাকি ভালোপাহাড়ে গেছিল। বড়োমা হতাশ গলায় বললো।

অনিমেষদা চায়ে চুমুক দিল। ডাক্তারদাদার দিকে তাকাল।

আচ্ছা সামন্তদা অনুপ আমার একেবারে কাছের মানুষ এটা আপনি মানেন।

না হলে তুমি অনুপকে সঙ্গে নেবে কেন।

অনুপ যদি অনির ইনফর্মার হয় এবং আমার সব গোপন খবর অনির কাছে পৌঁছে দেয় আপনার ক্ষমতা আছে ইনটরোগেট করার।

কি বলছো তুমি!

আপনাকে একটা ছোট্ট উদাহরণ দিলাম।

আর একটা কথা বলি। একটু মন দিয়ে শুনুন। ওর অফিসের বটাদা ওর সবচেয়ে বড়ো ইনফর্মার। এটা কম বেশি সবাই জানে। তবে কি বটাদার সামনে কেউ আলচনা করবে।

না!

তাহলে বটাদা সব জেনে ওকে ইনফর্ম করে কি করে?

ডাক্তারদাদা ঘন ঘন চায়ে চুমুক দিল।

এই বার বলুন ওর কথা কিছু বুঝলেন।

তারমানে ও তো আমার পেছনেও লোক লাগিয়ে রেখেছে!

সকলে হেসে ফেললো। আমি মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছি।

এরকম অসংখ্য উদাহরণ আপনাকে দিতে পারি। আমি সংগ্রহ করেছি, এখনও করছি বলতে পারেন। এখন আমি নিয়ম করে ওর পেছনে এক ঘণ্টা করে সময় দিই।

অনিমেষদা চায়ে চুমুক দিল।

আপনি হঠাৎ করে ওর কথা বুঝতে পারবেন না। ওর কথাগুলো আপনাকে মনে রাখতে হবে। তারপর একা একা একটু ভাবলে উত্তর পেয়ে যাবেন।

তুমি তো আমার পথ ধরেছ। আমিও ওকে একই ভাবে স্টাডি করি। ডাক্তারদাদা বললো।

তাহলে বুঝুন।

দিদি, ছোট, অমিতাভদা, মল্লিক ওকে কি করে বুঝবে। মিত্রাকে আমি খরচের খাতায় ধরি।

আমি উঠে দাঁড়ালাম। জামাকাপরটা চেঞ্জ করে আসি?

ঘরে একটা হাসির রোল উঠলো।

যা।

অনিমেষদা এমন ভাবে বললো, আবার সকলে হেসে উঠলো।

আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।

রেডি হয়ে নিচে নেমে দেখলাম দাদা, মল্লিকদা টেবিলে বসে খাচ্ছে। আর সবাই চলে গেছে। বাইরের বাগানে দুটো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। রবীন, ইসমাইল দুজনেই আছে। বুঝলাম ইসমাইল দাদাদের নিতে এসেছে। ঘড়ির দিকে তাকালাম। দেখলাম সাড়ে এগারটা বাজে।

বড়োমা, ছোটোমা, মিত্রা কাউকেই দেখতে পেলাম না। বুঝলাম সব কাপর পরতে ব্যাস্ত। আমি সোফায় এসে বসলাম।

আজ তাহলে ওপাশে যাচ্ছিস না?

মনে হয় হবে না।

তুই কিন্তু অনেক দিন কিছু দিসনি।

দেবো একটু অপেক্ষা করো।

ব্যানার্জীর ব্যাপারটা কি করবি?

একটা বক্স করে একটা নিউজ করে দেবে আমরা দুঃখিত।

ওর বডিটা সুনীত হ্যান্ড ওভার করেছে। ওর সম্বন্ধে কিছু ভাবলি।

ও নিয়ে তুমি ভেব না। আগে লিগ্যালি কি এ্যাকশন নেয় দেখো তারপর। সুনীতদার ফাইল রেডি করে হিমাংশুর কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি। এবার আমি আমারটা ডিমাণ্ড করে চিঠি দিতে বলেছি।

কালকে কিংশুক গণ্ডগোল করেছে। টিনা শো কজ করে দিয়েছে।

তার জবাব দিতে না পরলে টিনাই ব্যবস্থা করবে।

তুই কি করে জানলি?

জানলাম।

মেয়েটা যে এতো স্ট্রং মেন্টালিটির আগে বুঝতে পারিনি।

ওকে একটু হেল্প করবে। এখনও ঠিক ঠিক সরোগরো হয়ে উঠতে পারেনি।

তোর সেই আগের গাড়ির ড্রাইভার তাপস এসেছিল।

কি বলেছে?

ওকে নিয়ে গণ্ডগোল করে রেখেছে।

ওটাও টিনা সামলে নেবে। টিনাকে বলে দিয়েছি।

ঠাকুরের ব্যবস্থা কি করবি?

আমার সঙ্গে বসতে বলবে। আমি না যাওয়া পর্যন্ত যেমন চলছে তেমন চলবে।

ঠাকুর বলেছে তার পক্ষে সম্ভব নয়।

ছেড়েদেবে প্রচুর লোক আছে।

একটা গণ্ডগোল পাকাবার বন্দোবস্ত করছে।

জানি।

তুই সব জানিস!

জানি বলেই উত্তর দিতে পারছি। তুমি এক কাজ করবে ঠাকুরের হিসাবটা করে রাখতে বলবে টিনাকে।

দাদা খাওয়া থামিয়ে আমার দিকে তাকাল।

কিরে তুই এই জামা প্যান্ট পরে যাবি।

ছোটোমা কথা বলতে বলতে আমার সামনে এসে দাঁড়াল

আর কিছু বলবে?

ওকে তারাবার মতলব করছিস। দাদা বললো।

অনেকদিন আগে থেকে ঠিক করেছি। তাই একটু আধটু ঝামেলা করছে।

সামলাবে কে?

তিনজন লাইন দিয়ে আছে। তোমাকে ভাবতে হবে না।

ছোটোমা এসে থমকে দাঁড়িয়ে পরেছে। মল্লিকদার সঙ্গে চোখের ইশারায় কথা হলো।

বুঝলাম ছোটোমাকে এখন কথা বলতে মানা করছে।

তোকে একটা কথা বলবো?

বলো।

তাপস ছেলেটাকে যদি দায়িত্ব দিস কেমন হয়।

আমি একবার দাদার দিকে তাকালাম।

দাদা নিজে থেকে বলছে, না কারুর কাছ থেকে শুনে বলছে।

তাপস কি তোমায় কিছু বলেছে?

ছেলেটার সঙ্গে কথা বলে ভালো লাগলো। মনে হলো স্বভাবটা ভালো।

পয়সার মুখ দেখলে সকলের স্বভাব বদলে যায়। আমাকে দেখছো না। তোমাকে আগের মতো আর লেখাফেখা দিচ্ছি না।

দাদা আমার দিকে একবার বিরক্তিভরা চোখে তাকালো।

দেখলি দেখলি মল্লিক কি কথা থেকে ও কি কথায় চলে এলো।

মল্লিকদা হেসে ফেললো। ছোটোমাও হাসছে।

তোমাকে এ নিয়ে ভেবতে হবে না।

আমি ভাবতে চাই না। তোর বড়োমাই খোঁচায়, তুমি একটু ওর চাপ নিতে পারো না।

ওটা তোমার সঙ্গে বড়োমার ব্যাপার, এর মধ্যে আমি ঢুকবো না।

বলে দিস তোর বড়োমাকে, আমাকে যেন খ্যাচ খ্যাচ না করে।

কি বলছেরে অনি—বড়োমা ঘর থেকে বাজখাঁই গলায় চেঁচিয়ে উঠলো।

আমার সঙ্গে কথা হচ্ছে, তুমি এর মধ্যে ঢুকছো কেন।

এবার দাদাও হেসে ফেললো।

মিত্রা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। সাজগোজ হয়ে গেছে। ওর দিকে তাকালাম।

এরপর বেরলে আর যাওয়া যাবে না।

তোকে একটা কথা বলবো?

আবার কি হলো!

জ্যেঠিমনি, দিদভাই যেতে চাইছে। ওরা কোনওদিন দেখেনি।

সবাইকে মোটামুটি গাওনা গেয়ে দিয়েছিস।

আমি কি করবো বড়োমা যদি জিজ্ঞাসা করে।

সত্যবাদী যুধিষ্ঠির—

খেঁচাচ্ছিস কেন—

রেডি হতে বল, যাওয়ার সময় তুলে নিয়ে যাব।

আমি বলে দিয়েছি।

কৃতার্থ করেছ।

বড়োমা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। পরিপাটি করে সেজেছে। দামী একটা তাঁতের শাড়ি পরেছে।

খুব মাঞ্জা দিয়েছ দেখছি।

দাদা, মল্লিকদা হাসলো।

মন্দিরে যাব, তাই একটু সেজেছি।

এটা মন্দিরে যাওয়ার সাজ হয়েছে? বিয়ে বাড়ির সাজটা একবার দেখাবে তো।

তোর বিয়ের সময়েই সেজেছিলাম। তুই এটা পরে যাবি!

তোমরা যখন আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে তখন তোমাদের মতো পোষাক পরবো, নাহলে আমি আমার মতো।

তাহলে যাব না।

যেও না। আমি একা চলে যাব।

আচ্ছা দিদি যখন বলছে চেঞ্জ করে নে। মল্লিকদা বললো।

বাধ্য হয়ে চেঞ্জ করলাম। সবাই এক সঙ্গে বেরিয়ে এলাম। শ্যামবাজারে এসে জ্যেঠিমনিদের তুললাম। ওরা সবাই রেডি হয়েছিল। মিত্রা, ইসিকে সামনের সিটে বসতে বললাম। মাঝে ছোটোমা, বড়োমা, জ্যেঠিমনি। পেছনে আমি, পিকু, ভজুরাম।

রবীনকে বললাম একটা মিষ্টর দোকান দেখে থামাস।

চিত্তরঞ্জন থেকে নিয়ে নাও।

আবার এতটা ঘুরতে হবে।

রাস্তায় যদি আবার পছন্দ মতো না পাই।

ঠিক আছে তাই কর।

অগত্যা আবার গাড়ি ঘুরিয়ে চিত্তরঞ্জনে এলাম। মিষ্টি কেনা হলো।

আমার মিষ্টি কেনার ধরন দখে বড়োমার চোখ ছানাবড়া।

কিরে এতো মিষ্টি কিনছিস কেন?

তোমার যেনে লাভ।

আমরা খাবো না। মিত্রা বলে উঠলো।

জ্যেঠিমনি হাসছে।

ছারো না মিনু ও যা করছে করতে দাও।

রাস্তায় টুকরো টুকরো কথা খুনসুটি করতে করতে আমরা পৌঁছে গেলাম। বেশিক্ষণ সময় গেল পিকুর পেছনে। ওর প্রশ্নের আর শেষ নেই। আমি যতটা সম্ভব ওর প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করলাম।

মন্দিরে ঢোকবার আগে গৌতমদাকে একবার ফোন করলাম। সঙ্গে সঙ্গে গৌতমদা ফোন ধরলো।

কোথায় আছো?

তোমাদের মন্দিরের রাস্তায় ঢুকছি।

একবারে ভেতরে চলে এসো, কেউ জিজ্ঞাসা করলে আমার নাম বলবে।

কেন?

গাড়ি ভেতরে নিয়ে আসার পার্মিশন নেই।

তাহলে আমার গাড়ি ঢোকাবে কেন?

পাকামো করো না। আমি গেটের মুখ দাঁড়িচ্ছি।

আচ্ছা।

আজ উৎসবের দিন। চারদিকে বেশ ভিড়। লোক থিক থিক করছে। একটু ভেতরে ঢুকে আসতেই, গৌতমদা যথা সময়ে গাড়ির কাছে এসে হাজির হলেন। গাড়ি রাখার একটা সুবন্দবস্ত করে দিলেন।

আমি সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম। গৌতমদা একেবারে গদো গদো। এবার সবাই পায়ে পায়ে মন্দিরের দিকে এগোলাম।

বড়োমাকে বললাম, জানো বড়োমা এই একজন মানুষ যার কোনও শিষ্য নেই সবাই ভক্ত। তুমি যদি মনে করো তাহলে তুমি ভেবে নিতে পারো ইনি তোমার গুরুদেব। নচেৎ নয়। ব্যাপারটা ভাড়ি মজার তাই না।

ওরা আমার কথা শুনে দাঁড়িয়ে পরেছে। ভজুরাম, পিকু একটু এগিয়ে গেছে।

দেখো এতো লোক সমাগম হয়েছে আজকের উৎসবে কেউ কিন্তু এনার শিষ্য নন।

অনি ভেতরে চলো, এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করলে হবে না। ভেতরে গিয়ে বড়োমাকে সব দেখাও গল্প করো। গৌতমদা বললো।

আমি কেন? তুমি আছো। আমি এই মন্দিরের ভক্ত নই।

তাহলে এসেছো কেন?

দু-চোখ ভরে মানুষ দেখতে এসেছি। কিসের টানে মানুষ এখানে আসে।

দেখছেন বড়োমা, ওর কথা শুনছেন। এই মন্দিরটা যখন তৈরি হচ্ছে, তখন ওইই প্রথম কাগজে হাইলাইট করে। কেন করেছিল ওকে একবার জিজ্ঞাসা করুণ।

এই তুমি পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটতে শুরু করলে। চলো খিদে লেগেছে।

আগে বিগ্রহ দর্শন করো, তারপর খাওয়া দাওয়া।

আমরা সবাই গৌতমদার সঙ্গে মন্দিরের সামনে এলাম।

নাটমন্দিরে লোক গিজ গিজ করছে। তিল ধারণের জায়গা নেই। আমরা যেহেতু গেস্ট গৌতমদা সকলকে ভেতরের দরজা দিয়ে নিয়ে গেল। আমি বাইরে দঁড়িয়ে রইলাম।

শ্বেত পদ্মের ওপর গোমুখাসনে একটা কাঠের তক্তায় হেলান দিয়ে তিনি বসে আছেন। শ্বেতশুভ্র পোষাক। জটাজুট ধারী। কিন্তু চোখ দুটোর মধ্যে অসম্ভব দীপ্তি। আমি বেশ মনোযোগ সহকারে বিগ্রহ মূর্তিটা দেখছিলাম। একেবারে একা।

জীবনে একটা মানুষ কতটা কৃচ্ছসাধনা করলে এই জায়গায় পৌঁছতে পারেন, তার কথাই ভাবছিলাম।

স্বপ্নে দেখা পীরসাহেবের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। পক্ককেশ শুভ্রবসন। ফর্সা টকটকে রং। শরীর থেকে একটা জ্যোতি বেরিয়ে আসছে। তার চোখ দুটোর মধ্যেও অসম্ভব রকমের দীপ্তি চোখে পড়েছিল। অশ্বিনীকাকার মুখ থেকে গল্প শুনেছিলাম। তারপর নিজের মতো করে ভেবে নিয়েছিলাম। তাই হয়তো ওরকম দেখেছিলাম।

তাঁর কোনও ছবি আমি দেখিনি। এনাকে সামনা সামনি দেখছি। কোথাও কোনও অমিল খুঁজে পাচ্ছিনা। স্থান কাল পাত্র ভেদে এনারা আলাদা আলাদা বিরাজ করছেন। দুজনেরই মত পথ এক। হিংসা নয় ভালোবাসো। মানুষকে ভালোবাসা দিয়ে জয় করো, হিংসা দিয়ে নয়।

ধর্ম সংস্থাপনার্থায় সম্ভাবামি যুগে যুগে।

অনি তুই তাহলে কি করছিস?

আমি সত্যের পূজা করছি। সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছি। গীতায় এর ব্যাখ্যা দেওয়া আছে। আমি নিজে কোনও অন্যায় করছি না। দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন করছি।

তোর মনের মধ্যে এতো কন্ট্রাডিক্টরি কেন! মনে হচ্ছে বলিষ্ঠতার অভাব?

দিলে এতো সুন্দর মনটাকে মাটি করে।

নিজে নিজে হাসলাম।

বাবা লোকনাথ। কথাটার অর্থ কি? যিনি লোকের হিত করেন। যিনি সাধারণ মানুষের সবসময় ভালো চান। তিনিই লোকনাথ। তর্ক বিতর্ক থাকতে পারে। সাদা চোখে এটাই বোঝায়। যখন এই মন্দিরটা নিয়ে লিখেছিলাম, তখন বেশ কিছুদিন ওনার সম্বন্ধে পড়াশুনো করেছিলাম। লেখাটা ছাপা হবার পর প্রচুর চিঠি এসেছিল অফিসে।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে দেখছি, কাতারে কাতারে মানুষ ভক্তি সহকারে মাথা নোয়াচ্ছেন। প্রত্যেকেরই চোখে মুখে না পাওয়ার যন্ত্রণা স্পষ্ট। সবাই তার মনের আকুতি বিগ্রহের পদযুগলে সমর্পণ করছে। বেশ লাগছিলো।

কিরে তুই ভেতরে গেলি না?

ফিরে তাকালাম। মিত্রা পাশে দাঁড়িয়ে হাঁ করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

প্রণাম করবি না?

করেছি।

কোথায় করলি!

মনে মনে।

ওরা সবাই একে একে মন্দির থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো।

আঙ্কেল আমি দুবার চন্নামিত্ত খেয়েছি।

কেনরে!

কি মিষ্টি।

মিত্রার দিকে তাকালাম।

এই প্রশ্নের কোনও উত্তর দিতে পারবি?

ইসি আমার দিকে গভীর ভাবে তাকিয়ে।

তোরা ঠাকুর ঠাকুর করিস। ওর সঙ্গে ঠাকুরের মানসিক বন্ধনটা একবার চিন্তা কর। তাহলেই সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবি।

তোমার গভীরতা দিয়ে তুমি সকলকে দেখো কেন? গৌতমদা বললো।

ঠিক বলেছো, বুঝলে গৌতমদা মাঝে মাঝে আমার নিজের অবস্থানটা আমি নিজেই গুলিয়ে ফেলি।

আগে খেয়ে নাও। তারপর ঘুরে ঘুরে বড়োমাদের দেখাও।

তুমি কি আমাদের জন্য স্পেশাল ব্যবস্থা করেছো।

করবো না। ম্যাডাম আজকে আমাদের গেস্ট।

তাহলে ম্যাডামকে নিয়ে যাও।

এই তো, কথাটা আগে শেষ করতে দাও। গৌতমদা হাসছে।

জানো বড়োমা, গৌতমদা এই মন্দিরের ট্রস্টিবোর্ডের একজন কত্তা।

বড়োমা হাসছে।

এই মন্দিরটা হিন্দুদের এটা তুমি নিশ্চই অবিশ্বাস করবে না।

বড়োমা মাথা দোলাচ্ছে, ওরা আমার দিকে সবাই তাকিয়ে।

মজার ঘটনা কি জান—এই মন্দিরের ট্রাস্টি বোর্ডের যিনি প্রধান তিনি একজন মুসলমান।

চলতে চলতে বড়োমা থেমে গেল, ওরাও সবাই দাঁড়াল

নিশ্চই আমার কথাটা শুনে শক্‌ড হলে।

বড়োমা আমার দিকে তাকিয়ে।

তুমি ভাবছো অনি কি বলতে চায়।

বড়োমার গভীর চোখ আমার প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে।

না আমি তেমন কিছু বার্তা তোমার কাছে পৌঁছে দিচ্ছি না। শুধু এই টুকু বলবো, তোমার মনের মধ্যে যদি কোনও বিভেদ না থাকে তাহলে তুমি পরিপূর্ণ মানুষ।

যাঁদের আমরা এখনও দেবতা বলে পূজো করি তারা কিন্তু একদিন সাধারণ মানুষ ছিলেন। বলতে পারো তোমার আমার মতো গৃহস্থ। তাদের জীবনধারা, চাল-চলনে কোনও বাঁধন ছিল না। তারা সবখানেতেই বিরাজমান। জাতপাতের বালাইটা এখন যেমন আছে তখনও ছিল। বরং অনেক বেশি। কোনও অংশেই সেটা কম ছিল না। খুব ভালো করে ভেবে দেখবে। যাঁদের আমরা সাধক বলছি। তাদের কিন্তু এই সবের কোনও বালাই ছিল না। কেউ তখন তাঁকে প্রশ্ন করেনি। আপনি কেন ওখানে গেছেন। আবার কোনও পণ্ডিত, বিজ্ঞজন এসে বলেন নি, আপনি যখন ওখানে গেছেন তখন আপনি সমাজচ্যুত। আপনার জাত গেছে।

আর যদি কেউ প্রশ্নও করে থাকে, তিনি ঠিক কি উত্তর দিয়েছিলেন তার সাঙ্গ-পাঙ্গরা কেউ সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ করে যাননি। কেন করেননি বলতে পারবো না। তবে আমি ব্যক্তিগত ভাবে অনুভব করি তাদের মধ্যে কোনও বিভেদ ছিল না।

রামকৃষ্ণের কথা ভাবো। একটা গ্রামের ছেলে। মাঠে ঘাটে ঘুরে বেড়াত তার নিজের খেয়াল খুশি মতো। পৈতের সময় ভিক্ষে মা করলেন একজন নীচু জাতের মেয়েকে। সে নাকি তার ভিক্ষে মা হবে। বাচ্চা ছেলের বায়না। তখনকার সমাজের মাথারা ওই বাচ্চাটার জেদ বলো বায়না বলো মেনে নিল। তারপর তিনি চলে এলেন পুরুত গিরি করতে কলকাতার দক্ষিণেশ্বরে। মানুষ দেখলেন। তাদের আচার আচরণ দেখলেন। মাতৃমূর্তি বিগ্রহকে তিনি তাঁর মায়ের আসনে বসালেন। সাধনা করলেন। কিসের সাধনা?

কথিত আছে তিনি মুসলমান ধর্ম নিয়ে মসজিদে গিয়ে নমাজ পড়েছেন। আবার চার্চেও গেছেন। আবার তন্ত্র-মন্ত্রের সাধনাও করেছেন। তখনকার দিনের শিক্ষিত ডেঁপো ছেলেরা তাঁকে গিয়ে বিরক্ত করতো। তার মধ্যে বিবেকানন্দও ছিলেন। ছেলেটাকে তিনি ভালোবেসে ফেললেন।

বিবেকানন্দ যখন চাচার হোটেলে বসে রুটি দিয়ে গো-মাংসো খেতেন, তখন রামকৃষ্ণের কাছে অনেকে গিয়ে নালিশ করতো, তোমার নরেন চাচার হোটেলে বসে গো-মাংস খাচ্ছে। তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ওর সহ্য হয় তাই খায়, তোর সহ্য হলে তুই খা।

এইসব সাধারণ ব্যাপারগুলো একটু ভাবো, দেখবে তিনি অত্যন্ত সাধারণ কথা সাধারণ ভাবে বলেছেন। এর মধ্যেই তাঁর জীবনদর্শনটা উঁকি-ঝুঁকি মারছে। এটা নিয়ে কেউ কোনওদিন একফোঁটাও ভাবে নি।

বড়োমা আমাকে আবেগে বুকে জড়িয়ে ধরলো।

জানো, এই দিকপাল মানুষগুলো কখনও বলে যান নি, তোমরা আমাকে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করে পূজো করো। আমরা বোকা, তাই আমরা মন্দির বানিয়ে এদের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে দেবতা বানিয়ে দিয়েছি। এঁরা কিন্তু সব সময় তাঁদের কাজের পরিমণ্ডলের মধ্যে দিয়ে বলে গেছেন, আমি যে পথের দিশা তোমাদের দেখালাম, তোমরা সেই পথে হেঁটে মানুষের উপকার করো। মানুষের পাশে দাঁড়াও।

আমার একটাই দুঃখ বড়োমা, গীতাটা আমরা কেউ ভালো করে মন দিয়ে পড়ি না। কেউ মারা গেলে কিংবা শ্রাদ্ধের সময় শ্রদ্ধা সহকারে দান করি। আর ঠাকুরের সিংহাসনে রেখে দু-বেলা ফুল চন্দন সহকারে পূজো করি। কিন্তু গীতাটা যদি আমরা বার বার পড়ি, তার মর্মোদ্ধার করি, তাহলে আমরা সার্থক জীবন রচনা করতে পারি। সেইটা সবচেয়ে বড় পূজো। যিনি ওটা লিপিবদ্ধ করেগেছেন তাঁরও পরিশ্রম সার্থক।

জ্যেঠিমনি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের পলক পড়ছে না।

কিগো কি ভাবছো। অনিটা কি পাগল, তাই না।

আমার কথায় জ্যেঠিমনি সম্বিত ফিরে পেল।

তোর কথাগুলো ভাবছিলাম।

আমার কথা! কেন?

সত্যিতো কথামৃত আমি পড়েছি। লোকনাথ বাবার জীবনী পড়েছি। কিন্তু তোর মতো করে ভাবিনি। ভেবেছি বয়স হলে একটু ধম্মেকম্মে মতি হয়, আমারও হয়েছে হয়তো।

আমি বলছিনা তুমি আমার মতো করে ভাবো। তবে দেখবে তুমি তাদের দেবতা না মনে করে যদি তোমার ঘরের একজন সদস্য করে নাও, তাহলে তুমিও তাদের কাজকর্ম চিন্তা-ভাবনার সামিল হয়ে যাবে। দেবতা ভেবে ফেললেই তার স্থান হয়ে যাবে ঠাকুর ঘরের সিংহাসন। তোমার সঙ্গে তার দূরত্ব তৈরি হয়ে যাবে।

তোর সব সময় যুদ্ধং দেহি মনোভাব, এতো ভাবিস কখন? ইসির কথায় চোখ ফেরালাম।

এই জন্য তোর ছুটকি মনে মনে ভীষণ গালাগাল দেয়।

দেখলে বড়োমা দেখলে, শেষমেষ সেই আমাকে খোঁচা দিল। মিত্রা বললো।

বড়োমা হাসলো। ছোটোমা আমার দিকে তখনও তাকিয়ে আছে। আমি মাথাটা ধরে একটু ঝাঁকিয়ে দিলাম।

কিগো অনির কথার ঘোর এখনও কাটেনি। অনি সব সময় শুধু বকবক আর বকবক।

ছোটোমা চুপ করে আছে। আমি ছোটোমাকে জড়িয়ে ধরে হাঁটতে আরম্ভ করলাম।

চলো বকেবকে বেশ জোরদার খিদে পেয়েছে।

ছোটোমা আমাকে জড়িয়ে ধরেছে।

সবাই মিলে ধীর পায়ে খাওয়ার জায়গায় এলাম। গৌতমদা আমাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করেছে। কাছে আসতেই গৌতমদা আর যারা সদস্য ছিলেন তাদের সবার সঙ্গে আমাদের আলাপ করিয়ে দিলেন। আলাপ করার পর সকলেই বেশ গদোগদো। এঁদের মধ্যে এই মন্দিরের অনেক ডোনারও রয়েছেন। এই রকম একটাদল মন্দিরের বাৎসরিক উৎসবের দিনে উপস্থিত হতে পারে অনেকেই ভাবতে পারেনি।

সবাই কেমন আমাদের যাতে কোনও অসুবিধে না হয় তার দেখভালে ব্যস্ত হয়েগেলেন। আমাদের সকলকে আলাদাভাবে একটা ঘরে বসাবার ব্যবস্থা হলো।

মিত্রা, ইসি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।

খাবার এলো। এই মন্দিরের অন্নপ্রসাদ। তৃপ্তি সহকারে সকলেই কম বেশি চেয়ে খেলো। নিরামিষ খাবার। বড়োমা, জ্যেঠিমনি আমার গুণাগুন নিয়ে চুলচেরা বিচার বিবেচনা শুরু করে দিয়েছে। আমি শারীরিক ভাবে নাস্তিক কিন্তু মনে মনে প্রবলভাবে আস্তিক।

খাওয়া দাওয়ার শেষে আমি ওদের নিয়ে ঠাকুরের আতুঁড়ঘর, বাসস্থান তার পুজো করা বিগ্রহ ঘুরে ঘুরে দেখাতে লাগলাম টুকরো টুকরো গল্প বলি ওরা অবাক হয়ে শোনে। পায়ে পায়ে আমবাগানে এসে দাঁড়ালাম। ইসি, মিত্রা, ভজুরাম পুকুরের ধারে গেল যারা বাঁকে করে জল আনছে তাদের জল ঢালা দেখতে।

আমি বড়োমার মুখোমুখি দাঁড়ালাম। দু-পাশে জ্যেঠিমনি, ছোটোমা। বড়োমার কাঁধে হাত রাখলাম। চোখে চোখ রাখলাম। কোনও ভনিতা নয় একেবারে সরাসরি কথা বললাম।

আচ্ছা বড়োমা এখান থেকে তোমার বাড়িটা কতোদূর?

বড়োমা আমার চোখে চোখ রাখলো।

এ চোখের ভাষা বড়োমা পড়ে ফেলেছে। কেন অনি এ কথা বলছে।

জ্যেঠিমনি, ছোটোমা আমার দিকে তাকিয়ে। চোখে অবাক বিষ্ময়।

বড়োমার চোখ জলে টল টল করে উঠলো।

এই মন্দিরে আগে কখনও এসেছো?

বড়োমা মাথা দোলাল। না।

এই জায়গায় আগে কখনও এসেছো?

বাবার হাত ধরে একবার এসেছিলাম।

দাদুর শরীর খারাপ। আমি এখান থেকে দাদুর কাছে যাব। উনি তোমার জন্য সকাল থেকে অপেক্ষা করছেন।

জ্যেঠিমনির চোখ যেন ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ছোটোমার চোখে কে যেন হাজার পাওয়ারের বাল্ব জ্বেলে দিয়েছে।

বড়োমা আমার বুকে মাথা রেখে ডুকরে কেঁদে উঠলো।

কাঁদলে হবে না বড়োমা।

বড়োমা আমাকে আরও জোরে জাপ্টে ধরে কেঁদে উঠলো।

এই জায়গায় দেবতাদের মতো অনির চোখ দুটোও পাথরের, একফোঁটাও জল পড়বে না। আমি দাদুকে কথা দিয়েছি, তোমাকে নিয়ে যাব।

বাবা আমাকে কোনওদিন ক্ষমা করতে পারবে না।

উনত্রিশ বছর ধরে যে মানুষটা আত্মীয় স্বজনদের কাছে তার সন্তানের খোঁজ খবর নিয়েছে তার কতটুকু খবর তুমি রেখেছ?

আমি বাবার সম্মান রাখতে পারিনি। বাবার কাছে আমি মৃত।

তবু তুমি তাঁর সন্তান। দাদু-দিদা দুজনেই অসুস্থ।

আমি জানি।

জ্যেঠিমনি, ছোটোমা দুজনেই বড়োমার পিঠে হাত রেখেছে। ইসিরা কাছে এসে দাঁড়াল বড়োমার অঝোড়ে কান্নাদেখে প্রথমে একটু অবাক। মিত্রা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পেরেগেছে ঘটনা কি ঘটেছে। আমি নিথরের মতো দাঁড়িয়ে আছি।

আঙ্কেল তুমি দিদাকে বকেছো।

পিকুর দিকে তাকালাম। হাসলাম।

দুষ্টুমি করেছে, তাই বকেছি।

বেশ করেছ। মাও আমাকে বকে।

বড়োমা আমার বুক থেকে মুখ তুলে পিকুর দিকে তাকাল। চোখ ছলছলে। তবু হেসে ফেললো।

আমি ওদের কাছ থেকে একটু দূরে সরে এলাম। গৌতমদাকে একটা ফোন করলাম। অনুরোধ করলাম, আমার জন্য যদি একটু প্রসাদ দাও খুব ভালো হয়। আমরা বেরিয়ে যাব। গৌতমদা কথা রেখেছিল। কিছুক্ষণের মধ্যে নিজে গাড়ির সামনে এসে একটা বিশাল মাটির হাঁড়ি দিয়ে গেল।

এটা কি?

ভেতরে সব আলাদা আলাদা ভাবে দেওয়া আছে।

তুমি পারও বটে।

গৌতমদা হাসলো।

গাড়িতে ওঠার সময় বড়োমা বললো, তুই আমার পাশে এসে বোস।

আমি বড়োমার দিকে একবার তাকালাম। বড়োমা, জ্যেঠিমনির মাঝে চাপাচাপি করে বসলাম। বড়োমা আমার হাতটা চেপে ধরে আছে। কারুর মুখে কোনও কথা নেই। রবীনকে বললাম সামনে একটা চৌমাথা পরবে ওখানে গিয়ে গাড়িটাকে ডানদিকে টার্ণ করবি।

বড়োমা আমার কাঁধে মাথা রেখেছে। আর একদিকে জ্যেঠিমনিও আমার কাঁধে মাথা রেখেছে। বুঝতে পারছি এদের ভেতরকার টেনসন। দুজনেরই ভেতরটা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। উনত্রিশ বছর আগের একটা দিন।

দাদা এই রাস্তায়।

হ্যাঁ। মিত্রা।

বল।

চিনিয়ে নিয়ে যেতে পারবি।

মিত্রা পেছন ফিরে চোখের ইশারায় আমাকে বললো, পারবে।

বড়োমা, ছোটোমা দুজনেই আমার হাতটা আরও জোড়ে চেপে ধরেছে। ছোটোমার মুখটা থম থমে। ইসি সব বুঝেও যেন কিছু বুঝে উঠতে পারছে না।

ফোনটা পকেট থেকে বারকরলাম।

তুমি কোথায়?

আমরা কাছাকাছি চলে এসেছি, মিনিট তিনেক লাগবে পৌঁছতে।

ঠিক আছে।

ফোনটা পকেটে রাখলাম।

তোমরা দুজনে বৃথা টেনসন করছো।

জ্যেঠিমনির বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

বড়োমা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের কোল দুটো চিকচিক করছে।

ইসি পেছন ফিরে তাকাল। মুখটা থমথমে। পিকু, ভজুরাম তাদের মতো করে মত্ত।

গাড়িটা আমবাগানের ভেতর দিয়ে গেটের সামনে এসে দাঁড়ালো। বড়োমা, জ্যেঠিমনি মাথা নীচু করে আছে। সামনের ভিউংগ্লাস দিয়ে পরিষ্কার দেখতে পেলাম বরুণদা, মামীমা দাঁড়িয়ে। ইসি পেছন ফিরে আমার দিকে একবার তাকাল। মুখে হাসি।

গাড়ি থেকে ওরা নামতেই বরুণদা হাতজোড় করে ইসি, মিত্রাকে সম্বোধন করলো।

তুমি এখানে! বললে অফিসে যাচ্ছি।

মাফ করবেন ম্যাডাম আজ আমার এখানে ডিউটি।

মিত্রা খিল খিল করে হেসে উঠলো। ইসি অবাক চোখে বরুণদার দিকে তাকাল। পিকু বাবা বাবা করতে করতে পেছন থেকে দুরদার করে ছুটে নামলো। বড়োমা, ছোটোমা, জ্যেঠিমনি আমার দিকে তাকিয়ে।

আমি ভাবলেশহীন মুখে জ্যেঠিমনির দিকে তাকিয়ে বললাম, এবার নামতে হবে।

বরুণদা গেট খুললো।

জ্যেঠিমনি বরুণদার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে।

আসুন।

জ্যেঠিমনির মুখে কোনও কথা নেই।

আসতে আসতে সবাই নেমে এলাম জ্যেঠিমনি, বড়োমা শক্তকরে দুজনে আমার দু-হাত চেপে ধরেছে। চারিদিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। হয়তো উনত্রিশ বছর আগেকার কোনও একটা ছবি খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছে।

মামীমার সঙ্গে সকলের পরিচয় করিয়ে দিলাম। বড়োমার একমাত্র ভাইয়ের স্ত্রী।

মামা কোথায় মামীমা?

তোর মামা আর সানা চৌমহিনীতে গেল। বললো দেখি ওরা আসছে কিনা।

বিতান—

সবাইকে ডাকতে গেছে তোর সঙ্গে আলাপ করাবে।

আমরা গেট পেরিয়ে ভেতরে এলাম।

তিন মহল্লা বাড়ি। রাজা আছেন কিন্তু সেই রাজবাড়ি আর নেই। নেই তার আভিজাত্য। চারিদিকে দীর্ণতার চিহ্ন স্পষ্ট। শরীরের পলেস্তরা খসে পড়েছে। তবু পুজোর মন্দিরটা ঠিক আছে। বছর বছর পুজো হয়। তাই পরিষ্কার হয় রং হয়। গেটের মাথায় একসময় সিংহমূর্তি ছিল, এখন সেটা নোনা ধরে কয়েকটা ইঁটে পরিণত হয়েছে।

ইসি, মিত্রা সর্বগ্রাসী ক্ষুধা নিয়ে চারদিক চেয়েচেয়ে দেখছে। আর একবার করে আমার মুখের দিকে তাকাচ্ছে।

প্রথমবার এসে আলাপ পর্ব শেষ হওয়ার পর দাদুকে কয়েকটা প্রশ্ন করেছিলাম। দাদু সংক্ষেপে বলেছিলেন, বছরে একবার এই পরিবারের সব আত্মীয় স্বজন একত্রে মিলিত হন। হই হুল্লোড় চলে। পাঁচটা দিন বেশ ভালো কাটে। তখন বোঝা যায় এই বাড়ির আভিজাত্য এক সময় ছিল। দাদু কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে ফেলেছিলেন।

তুই এতো সব জানলি কি করে?

বই পড়ে। আর আমার এক কলেজের বন্ধু ছিলো হাটখোলা দত্ত ফ্যামিলির, তাদের দুর্গা পূজোয় একবছর উপস্থিত ছিলাম।

তুই এইসব নিয়ে খুব ঘাঁটা ঘাঁটি করিস তাই না?

ঠিক তা নয়, আমার পুরনো জিনিষ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে বেশ ভালো লাগে।

আমাদের এই পূজোটার বয়স প্রায় আড়াইশো বছর পার হয়ে গেছে। তখন এই তল্লাটে একটাই পূজো ছিল। আমার দাদুর মুখ থেকে শুনেছিলাম তখন খুব জাঁকযমক করে পুজো হতো। বলিটলি হতো। এখন সে সব বন্ধ হয়ে গেছে।

বড়োমা, জ্যেঠিমনি আমার দু-হাত দুজনে এখনও শক্ত করে ধরে।

দাদু তোমায় বকবে না, এবার হাতটা ছাড়ো।

বড়োমা হাসলো। এই হাসির মধ্যে প্রাণ নেই। মুখটা ভয়ে পাংশু।

এখনও এতো ভয় পাও মানুষটাকে? তখন তাহলে এতটা সাহস দেখালে কি করে!

বড়োমা মাথা নীচু করে রইলো।

আমি মামীমার দিকে তাকালাম।

তোমার বৌমাকে চিনতে পেরেছ।

মামীমা মিত্রাকে জড়িয়ে ধরলো।

ইসির দিকে ইসারা করে বললাম এটা নয় কেন।

মামীমা ফিক করে হাসলো, তোকে পরে বলবো।

বড়োমার দিকে তাকালাম, যাও তোমাদের দুর্গামন্দিরটা এদের সবাইকে নিয়ে একবার ঘুরে এসো। তোমার অনেক স্মৃতি ওখানে গচ্ছিত আছে।

চলুন দিদিভাই। মামীমা বড়োমার হাতটা চেপে ধরলো।

তুই চল।

বড়োমা আমার হাতটা ছারলো না।

তুমি জ্যেঠিমনিকে চিনতে পেরেছ।

মামীমা মাথা দুলিয়ে মুখ নীচু করলো।

দিদি বলছে যখন চল। মামীমা বললো।

বড়োমার বাড়ি, নিজে সবাইকে ঘুরে ঘুরে দেখাক।

বড়োমারা সকলে ধীরপায়ে মন্দিরের দিকে এগিয়ে গেল। আমি নীচে খোলা জায়গাটায় দাঁড়িয়ে রইলাম।

বিতানরা সবাই হই হই করতে করতে ঢুকে পরলো। আমায় ঘিরে ধরলো। বড়োমারা তখন দুর্গামন্দিরের শিঁড়ি দিয়ে উঠছে।

পিসিমনি কই অনিদা?

খুঁজে নে।

এটা তুমি সট্টিয়ালি করছো। তোমার সঙ্গে এই চুক্তি ছিল না।

ইসি, মিত্রা ওইখান থেকেই শব্দ করে হেসে উঠলো।

ঠিক আছে মার কাছ থেকে জেনে নিচ্ছি। বৌদি কোনটা বলো।

দুটোই।

বরুণদা তুমি বলো এটা ঠিক হচ্ছে। বিতান তাকাল বরুণদার দিকে।

একবারেই না।

বিতান একবার আমার দিকে একবার বরুণদার দিকে তাকাচ্ছে।

সামনের ফাঁকা জায়গাটায় আমরা দাঁড়িয়ে, বড়োমারা সবাই দুর্গামন্দিরের বারান্দায় উঠে পড়েছে। বিতান হুড়মুড় করে ওদের কাছে চলে গেল। ওর পেছন পেছন ওর বন্ধুরা।

বরুণদার দিকে তাকালাম।

সব ঠিক আছে?

হ্যাঁ।

ওপরে কে আছে?

জ্যেঠু, জ্যেঠি, আরও দু-চারজন আত্মীয়। সকলকে তো চিনি না। সবেমাত্র চিনতে শুরু করেছি। মা সকলকে কম বেশি চেনে, মাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছি।

তাই! ভালো করেছো।

সত্যি তুমি গ্রেট।

কেন এ কথা বলছো?

আমাদের পারিবারিক দ্বন্দের পরিসমাপ্তি ঘটালে। আবার সবাইকে এক ছাতার তলায় নিয়ে এলে।

একচ্যুয়েলি কি জানো বরুণদা আমি ঘটকের রোলটা প্লে করছি। আর এটাই বোঝাতে চাইছি। পৃথিবীটা খুব ছোটো। তুমি তাকে হাতের মুঠোয় পেতেই পারো।

নাট মন্দিরে হই হই চলছে। মজা লুটে নিচ্ছে পিকু, ভজুরাম।

একটা বাইক এসে পাশে দাঁড়ালো সানা নেমেই আমাকে চোটপাট করতে শুরু করলো।

এটা কি হলো অনিদা—

আমি কি করলাম!

তুমি ফোন করবে বলেছিলে।

পরিবেশ পরিস্থিতি পারমিট করেনি।

মামা আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো। আমি নীচু হয়ে মামাকে প্রণাম করলাম।

এই এলি—

মিনিট দশেক।

যাই দিদির সঙ্গে দেখা করি।

যাও।

সানা মন্দিরের দিকে দৌড় লাগালো। মামা পেছন পেছন গেল।

মন্দিরের চাতালে দাঁড়িয়েই আবার একচোট ভাইবোনে জড়া-জড়ি করে কান্নাকাটি হলো। আমি এখান থেকেই লক্ষ্য করছি।

বরুণদা তুমি ওদের নিয়ে ওপরে যাও, আমি একটু আসছি।

কোথায় যাবে!

অনেকক্ষণ সিগারেট খাওয়া হয়নি। এই ফাঁকে একটা খেয়ে নিই।

বরুণদা হাসলো।

তাড়াতাড়ি, জ্যেঠু কিন্তু তোমাকে খুঁজছে।

ধ্যুস তুমি কি পাগল হয়েছো। মেয়েকে এনে হাজির করে দিয়েছি। এখন অনি আমের আঁটি।

আমি বাইরে বেরিয়ে এলাম।

রবীন এগিয়ে এলো।

দাদা এগুলো নামাবে না।

অপেক্ষা কর।

সিগারেট বার করে ধরালাম। সবে মাত্র সুখ টান দিয়েছি। মিত্রা, ইসি এসে হাজির। পেছন পেছন বিতান, ওর বন্ধুরা, সানা।

তুমি আচ্ছা লোক। বিতান বললো।

কেনরে!

সবাইকে ভিড়িয়ে দিয়ে ফুটে এলে।

সকাল থেকে সিগারেট খাওয়া হয়নি। খাবি।

যাঃ বৌদিরা আছে।

ও কিছু হবে না।

তুই চল। মিত্রা বললো।

বিতানরা সবাই আমাদের দুজনের দিকে চমকে তাকাল।

তুমি মাইরি সত্যি। অনেক হেদিয়েছো। এবার তুইটা ছাড়ো।

সানা, ইসি খিল খিল করে উঠলো।

বিতান ওর বন্ধুদের সঙ্গে একে একে পরিচয় করিয়ে দিল। সবাই কম বেশি পড়াশুনো করছে। কেউ এমবিএ পড়ছে, কেউ চ্যাটার্ড পড়ছে, কেউ ইঞ্জিনীয়ারিং পড়ছে। কেউ হেদি-পেদি নয়।

একটু পরে আমার বন্ধুরা আসবে। সানা বললো।

দু-একটা পাবো?

খারাপ হয়ে যাবে অনিদা, বৌদি আছে।

তা থাক সাইড লাইনে বসিয়ে রাখবো।

ঠিক আছ তোমাকে তিনপিস দেখাবো একটা পছন্দ করে নিও।

ঝাক্কাস।

একেবারে ঝাক্কাস।

মিত্রা হাসছে।

বরুণদা গেটের মুখে এসে দাঁড়াল।

অনি জ্যেঠু তোমায় ডাকছে।

সত্যি বুড়ো বহুত ঘাঘু মাল।

ওরা আমার কথায় হাসাহাসি করছে।

বিতান।

বলো।

গাড়ির পেছন দিকে কিছু মাল পত্র আছে ধরাধরি করে একটু ওপরে নিয়ে যা।

ফেলনা সিগারেটটা। মিত্রা চেঁচিয়ে উঠলো।

শেষটান। মনে আছে সেই ডায়লগটা।

হ্যাঁ মনে আছে, কচি মেয়েকে চুমু খাওয়া।

আঃ ছুটকি। ইসি বললো।

বিতানের বন্ধুরা হাসছে।

পায়ে পায়ে ভেতরে এলাম।

কি ইসি ম্যাডাম, শ্বশুর বাড়ির আত্মীয়দের সঙ্গে পরিচয় হলো।

সামান্য। ইসি লজ্জা পেয়েগেল।

কোথা থেকে কি হয়ে গেল তাই না?

ইসি মাথা দোলাচ্ছে।

তুই এতো সব জানলি কি করে?

আমি হাসছি।

ইসি, মিত্রার দিকে তাকাল।

তোর বরুণদা এখনও পর্যন্ত আমাকে কিছু বলেনি। তুই জানতিস ছুটকি?

না।

জানো না বৌদি, অনিদা একটা বিষ মাল। প্রথম যেদিন এসেছিল। সেই ঘটনা তোমায় যদি বলি হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাবে। বিতান বেশ রসিয়ে রসিয়ে বললো।

মিত্রা আমার দিকে তাকাল। ভাবটা এরকম তোকে আমার থেকে বেশি কে চেনে বল।

তারপর আসতে আসতে খাপ খুললো।

প্রথমে তো পরিচয় জানতাম না। আমি, সানা চেটে পরিষ্কার করে দিলাম।

সেদিন সানার কয়েকজন বন্ধুও ছিল।

দাঁড়াওনা একটু পরে আসবে। তারপর তোমার হবে।

সানা চোখ পাকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো।

তারপর একটু একটু করে খাপ খুলতে শুরু করলো। শেষে দাদুর মতো স্ট্রং মেন্টালিটির মানুষকে পর্যন্ত পটকে দিল। সেই থেকে দাদু দিনে অন্ততঃ দশবার অনিদার খোঁজ নেবে। একবার কথা বলিয়ে দিতে হবে। ব্যাশ শান্তি। না হলে ঘ্যানর ঘ্যানর।

বাতেলা কম মার।

সবাই হেসে ফেললো।

ওপরের ঘরে এলাম। দাদু বিছানায় শুয়ে। শরীরটা বিছানার সঙ্গে একেবারে মিশে গেছে। গায়ের রং চোখ মুখ দেখলে মনে হয় একসময় যথেষ্ট রাশভারি লোক ছিলেন। এই তল্লাটের জমিদার বলে কথা। এখনও অনেকে দাদুর সঙ্গে দেখা করতে আসেন।

থম থমে পরিবেশ। দাদুর মাথার শিয়রের একপাশে বড়োমা। আর একপাশে দিদা। পায়ের কাছে জ্যেঠিমনি, ছোটোমা চেয়ারে একজন বসে আছেন চিনতে পারলাম না।

আমি কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম।

ফোকলা দাঁতে দাদু হাসলো। উঠে বসার চেষ্টা করলো।

একবারে না।

আমি পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম।

দাদু কাঁপা কাঁপা হাতে আমার মাথায় হাত রাখলো।

কিগো নিজের জিনিষ বুঝিয়া পেলে?

দাদু হাসলো।

এবার আমার বকশিস।

নাতবৌকে যে দিলাম।

বড়োমা হেসে ফেললো।

নাতবৌকে দেখেছ?

দাদু মাথা দোলাল।

তুই আমাকে উঠে বসা।

তোমার জন্য অনিদা পেঁড়া এনেছে। বিতান চেঁচিয়ে উঠলো।

দাদু হাত বাড়াল।

কিগো তুমি থম মেরে বসে আছো কেন? দিদার দিকে তাকালাম।

দিদা হাসলো।

তুই তো আমাকে নতুন খবরটা দিসনি।

খবর তৈরি হোক তবে না দেব।

বড়বৌ ও ভীষণ চালাক, নিজের গোছান না হলে কিছু দেয় না।

আমি দাদুকে আসতে করে বুকে জড়িয়ে উঠে বসালাম। বড়োমা বালিশগুলো পেছনদিকে খাঁড়া করে দিল।

তোমাকে যে বলেছিলাম বিকেল বেলা প্রতিদিন একটু একটু করে হাঁটবে।

সানা ধরে না।

দাঁড়াও বুড়ো কাল থেকে তোমাকে ধরবো না। অনিদার কাছে নালিশ হচ্ছে। সানা ফড়ফড় করে উঠলো।

দাদু হাসছে।

দিনু এসেছিল, তোর খোঁজ করছিল তুই তখন কলকাতায় ছিলি না।

কোথায় গেছিল জিজ্ঞাসা করো। বড়োমা দাদুর দিকে তাকাল।

কেন তোকে বলেনি।

বড়োমা মাথা দোলাল।

এর মধ্যে একদিন ও নিজে এসেছিল। আর দু-দিন বরুণকে নিয়ে এসেছিল।

এখানে এসে সেটা জানলাম।

দিদা এসেছে শুনলাম, কোথায়?

কথা ঘোরাচ্ছিস কেন। বড়োমা বাঁকা চোখে আমার দিকে তাকাল।

আমি হাসলাম।

বৌমার সঙ্গে রান্নাঘরে গেল। ওকে দেখেছিস আগে? দাদু বললো।

না।

ও মিনুর পিসততো বোন। টাকিতে থাকে।

আমি গিয়ে প্রণাম করলাম। নিয়ম মোতাবেক সবাইকে পায়ে হাত দিতে হলো।

মামীমা চায়ের প্লেট হাতে ঘরে ঢুকলো। বরুণদার মাও এলেন।

তুই আজ সকালে কি গণ্ডগোল করেছিস?

বরুণদার মার দিকে তাকালাম।

কে বোললো?

বরুণ।

ইসি এগিয়ে গিয়ে শ্বাশুরীর হাত থেকে চায়ের ট্রেটা নিল।

বরুণদা কিছু জানে না।

বড়োমা ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে হাসলো।

কেন তুই গণ্ডগোল করিস। দাদু বললো।

চায়ের কাপ হাতে তুলে নিলাম।

আজ এখানে থাকতে হবে। মামীমা বললো।

খেপেছো। কতো কাজ আছে জানো।

তোর ওই একটা অছিলা।

আমায় বাদ দিয়ে এরা যদি থাকে আমার আপত্তি নেই।

বড়োমা হাসছে।

বরুণদা তুমি কি তাপসকে নিয়ে এসেছো?

হ্যাঁ।

ওকে দেখছি না।

বললো বসিরহাটে ওর কে আত্মীয় আছে দেখা করতে গেছে।

বড়োমা দাদুকে চা বিস্কুট খাইয়ে দিল। ছোটোমা, জ্যেঠিমনি চুপচাপ বসে বসে দেখছে।

আনিদা চলো তোমার সঙ্গে পার্শোনাল টকটা এবার সেরে নিই। বিতান বললো।

এখুনি!

নাহলে তুমি হুট করে বলে বসবে, আজ যাই কাল সকালে আসছি।

দেখেছিস তোর ব্যাপারটা সকলে জেনে ফেলেছে। মিত্রা বললো।

তুই খুশী—

ভীষণ খুশী।

আমাকে সবাই তোর মতো করে বুঝতে পেরেছে, তাই না—

দেখছো বড়োমা ও কিরকম অন্য দিকে চলে যাচ্ছে।

ছাড়ো বৌদি, তুমি এতো দিনেও অনিদাকে চিনতে পারলে না। বাড়ি থেকে যখন বেরবে বলবে পশ্চিমদিকে যাচ্ছি। দেখবে দক্ষিণে গিয়ে হাজির হয়েছে।

মিত্রা চায়ে চুমুক দিতে দিতে হাসছে।

কি খাবি?

মামীমা আমার দিকে তাকাল।

এই তো চা খাচ্ছি ব্যাশ।

তাহলে ওগুলো নিয়ে এসেছিস কেন?

বড়োমার হুকুম।

দিদি কি জানতো তুই এখানে আসবি?

মিত্রা চায়ের কাপটা খাটে রেখে হাততালি দিয়ে উঠলো।

জবাবটা দে।

আমি মিত্রার দিকে তাকালাম। হাসলাম, বিতানদের সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে এলাম।

অনেকক্ষণ বিতানদের সঙ্গে কথা বললাম। ওদের অনেকগুলো আর্জি আমার কাছে। তার মধ্যে ওর দুই বন্ধুর লেখার সখ আছে, তাদের একটু ব্যবস্থা করে দিতে হবে।

ভাঙা বারান্দা দিয়ে নিচের দিকে তাকালাম। দেখলাম বেশ কয়েকটা মেয়ে গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকলো। একবার ওপরের দিকে তাকাল।

বিতানদা সানা কই?

ওপরে চলে এসো পেয়ে যাবে।

এগুলো সানার বন্ধু ?

সব তোমার ফ্যান।

কেন!

তোমার লেখা পড়তে ভালোবাসে। জানো অনিদা, এখন আমার রেলাটা আগের থেকে অনেক বেড়ে গেছে।

কেন?

আগে সকলকে তোমার কথা টুকটাক বলতাম। অনি ব্যানার্জী আমাদের আত্মীয়। তখন ওরা প্যাঁক দিত, কথায় কথায় চ্যালেঞ্জ করতো, একবার নিয়ে চল। পারতাম না। তখন তোমাকে পাইনি।

হাসলাম।

এখন?

সবাইকে মুখে ঝামা ঘসে দিয়েছি।

বেশ করেছিস।

ওর বন্ধুরাও আমার সঙ্গে কথা বলছে। সবারই এক কথা আপনি এইরকম লেখেন কি করে? আমাদের এখানে আপনাদের কাগজের আরও দু-তিনজন করেসপন্ডেন্স আছে  তাদের আপনার কথা বলেছি। বলার পরই ওরা কেমন টেরিয়ে টেরিয়ে তাকায়।

ওরা কথা বলছে, আমার বেশ মজা লাগছে। আমার ফ্লেভারটা ওরা বেশ উপভোগ করছে।

সানা ওর বন্ধুদের নিয়ে এলো।

একপ্রস্থ তাদের সঙ্গেও হলো। এক একজনকে একটু আধটু কথার চিমটি দিলাম। দু-একজনের সঙ্গে দেখলাম বিতানের বন্ধুদের সঙ্গেও বেশ ভালো আলাপ। আমাদের হই হট্টগোলে জ্যেঠিমনি একবার উঁকি মেরে গেল।

ওদের কতো প্রশ্ন।

আপনি যে এইভাবে লেখেন, স্পটে যান? আপনার ভয় করে না? আপনার সঙ্গে এতো লোকের আলাপ হলো কি করে?

আমি ওদের সঙ্গে হাল্কা খেজুরে আলাপের ভঙ্গিতে গল্প করলাম বেশ কিছুক্ষণ। আমার কথাবলার ধরণ ধারনে ওদের ডাগর চোখে বিষ্ময়।

মামীমা হাত ধরে হিরহির করে টেনে নিয়ে ভেতরে এলো। দেখলাম লুচি, আলুভাজা বানানো হয়েছে। সঙ্গে আমার আনা মিষ্টি। বড়োমা দাদুকে একটা রসোগোল্লা ভেঙে ভেঙে খাওয়াচ্ছে। দাদু আমার দিকে তকিয়ে হাসলো।

সন্ধ্যে হয়ে আসছে। আমাকে এইবার কাটতে হবে। এদের হাবভাব বলছে আজকে এখান থেকে এরা নড়বে না। খেতে খেতে দু-চারটে আওয়াজ দিলাম, তাতেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল। বড়োমারা আজ থাকছে। তাপসকে একটা ফোন লাগালাম

কোথায় আছিস?

তুমি কোথায়?

তুই যেখানে বরুণদাকে নিয়ে এসেছিস আমি সেখানে।

তাই!

হ্যাঁ। তাড়াতাড়ি আয়, আমি কলকাতায় ফিরবো।

কাছাকাছি চলে এসেছি।

ঠিক আছে।

বড়োমা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। ফোনটা পকেটে রাখলাম।

সত্যি তুই চলে যাবি!

আবার কাল না হয় আসা যাবে।

আর বলতে হবে না। সানা আধো আধো গলায় বললো।

বিশ্বাস কর। তোর বৌদি কিন্তু মাঝে মাঝে ঠকে যায়।

মিত্রা হাসছে।

দাদুর দিকে তাকালাম।

দাদার সঙ্গে কথা বলেছো।

দাদু মাথা দোলাল।

এখানে আসার কথা বলেছো।

দাদু হাসলো।

কি বললো দাদা।

আসবে বলেছে।

তাহলে আমার কাজ শেষ। আমে দুধে মিশে গেছে এবার আঁটি গড়াগড়ি।

বড়োমা হাতটা বাড়াল, আমার কানের নাগাল পেল না।

দেখছো তোমার মেয়ের কীর্তি।

দাদু হাসছে।

আমি ধরবো। মিত্রা বলে উঠলো।

ধ্যাৎ। ছোটোমা বললো।

প্রক্সি। বড়োমার মায়ার শরীর।

বড়োমা চোখ পাকিয়ে মিত্রার দিকে তাকাল।

আমার খাওয়া শেষ। প্লেটটা নিচে নামিয়ে রেখে হাতটা প্যান্টেই মুছলাম।

মিত্রা কট কট করে আমার দিকে তাকাল।

বড়োমা তোমরা তাহলে থাক। আমি কাল সকালে আবার আসছি।

চা করেছি। খেয়ে যা।

মামীমা বললো।

তাড়াতাড়ি।

কি রাজকার্যে যাবি?

সে তুমি বুঝবে না।

কাল সত্যি আসবি?

আসবো।

বরুণদা এসে বললো, তাপস চলে এসেছে। ওর জন্য আবার খাবার পাঠানো হলো। আমি চা খেয়ে নিচে নেমে এলাম। মিত্রা, ইসি, বিতান, সানা ওদের বন্ধুরা নিচে নেমে এলো।

কাল কখন আসবি? মিত্রা বললো।

বলতে পারছি না। তবে চলে আসবো। রবীন কাছে এগিয়ে এলো। ওকে বললাম, আজ রাতটা এখানে থেকে যা।

রবীন চুপ করে রইলো।

সবার সঙ্গেই একটু ইয়ার্কি ফাজলাম মারলাম। বারান্দার দিকে একবার তাকালাম। দেখলাম সবাই দাঁড়িয়ে আছে। দাদু, দিদাকে দেখতে পেলাম না। হাত নারলাম।

গাড়িতে উঠে তাপসকে বললাম, চল।

তাপস গাড়ি স্টার্ট করে বেরিয়ে এলো।

আমি পেছনের সিটে বসেছি। বড় রাস্তায় উঠে তাপসকে বললাম, কলকাতা যেতে কতক্ষণ লাগবে।

ঘণ্টা দুয়েক।

তার মানে রাত নটার মধ্যে পৌঁছে যাব কি বলিস।

হ্যাঁ।

আমি পকেট থেকে মোবাইলটা বার করে বেশ কয়েকটা ফোন করলাম।

ঘুটঘুটে অন্ধকার রাস্তা।

হেডলাইটের আলো সামনের যতটুকু রাস্তা আলোকিত করে রেখেছে ততটুকু দেখতে পাচ্ছি। দু-পাশের মাঠ ঘাট সব নিশ্চিদ্র অন্ধকারে ডুবে আছে। আকাশ ভড়া তারা। সব গ্রামেরই রাতের রং এক।

তাপস ডিপার করে গাড়ি চালিয়ে এগিয়ে চলেছে। হাল্কা করে রবীন্দ্রসংগীত চালিয়েছে দেবব্রত বিশ্বাসের কন্ঠে। সত্যি ছেলেটার রুচি আছে।

পেছনের সিটে শরীরটা এলিয়ে দিয়েছি। গাড়ির দুলুনিতে কেমন যেন ঝিমুনি ভাব।

দূর থেকে দেখতে পেলাম অন্ধকারের বুক চিরে একটা গাড়ি এগিয়ে আসছে। যতো কাছে আসছে বুঝতে পারলাম এটা ছোটো গাড়ি নয়। বড়ো গাড়ি। তাপস ডিপার করা শুরু করলো। কিন্তু গাড়িটা কিছুতেই সেই সিগন্যালের গুরুত্ব দিলো না।

আমি পেছনের সিটে সোজা হয়ে বসলাম।

কি হারামী দেখছো। হেডলাইটটা কিছুতেই নেবাচ্ছে না। তাপস চেঁচিয়ে উঠলো।

মনে হচ্ছে গাড়িটা যেন ইচ্ছে করে আমাদের ঘাড়ে এসে পড়ছে।

শ্লো করে বাঁ সাইড চাপ।

তাপস গাড়িটা শ্লো করে দিল। গালাগালি দিয়ে উঠলো।

অন্ধকারের বুক চিরে হঠাৎ যেন মনে হলো, গাড়িটা আমাদের ঘাড়ে এসে পড়লো।

পর মুহূর্তেই একটা দড়াম করে আওয়াজ হলো। একটা প্রবল ঝাঁকুনি অনুভব করলাম।। আমার মাথাটা জানলায় সজোরে ধাক্কাখেল। চোখে অন্ধকার দেখলাম। অসহ্য যন্ত্রণা সারাটা শরীরে ছড়িয়ে পরলো। শরীরটা কেমন যেন অবশ হয়ে আসছে। চেষ্টা করেও হাত-পা নারাতে পারছি না।

আমি যেন অন্ধকারের অতল গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছি। ধীরে ধীরে আরও গভীরে।

————————— প্রথম খন্ড সমাপ্ত —————————



from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/eoL0tpy
via BanglaChoti

Comments