❝কাজলদীঘি❞
BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়
৭২ নং কিস্তি
—————————
অনিসা আড়মোড়া ভাঙলো এতক্ষণ ল্যাপটপের থেকে চোখ সরাতে পারছিল না। জলের বোতলটা হাত বাড়িয়ে টেনে নিল। ঢক ঢক করে বেশ কিছুটা জল খেল। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। একবার জানলার কাছে এলো।
নিশুতি রাত। নীচের ঝোপ থেকে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। সারা বাড়ি নিস্তব্ধ।
নীচের দিকে তাকাল। অন্ধকার ঘুটঘুট করছে। ভাবল একবার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াবে। তারপর ভাবল না। স্ক্যান ইমেজগুলো পড়ে ফেলি। যতো তাড়াতাড়ি পড়া শেষ করতে পারবো তত জানতে পারবো।
এতক্ষণে এটা ও বুঝে গেছে ওর বাবা মরেনি। বেঁচে আছে।
টোডি কে?
রাজনাথ কে?
কেনই বা বাবা রাজনাথকে মেরেছে?
মা দামানিদাদুর গল্প করেছে! কিন্তু রাজনাথের কথা কোনও দিন বলে নি?
বাবার সঙ্গে মায়ের আলাপ?
দামিনী দিদার গল্প?
দুদুন (দাদা) দিদানের (বড়োমা) গল্প?
দাদাই (মল্লিকদা) দিদাইয়ের (ছোটোমা) গল্প?
ডাক্তারদাদাইয়ের গল্প?
আবিদ আঙ্কেল, কনিষ্ক মামাকে গিয়ে বলেছে, রাজনাথ মায়ের ক্ষতি করেছে!
বাবা কেনই বা টোডির পেছনে ধাওয়া করতে গেল!
মা লিখেছে। বাবা বলেছে তার ভালোবাসাকে যে কলঙ্কিত করেছে তার শোধ তুলতে গেছে।
কিসের কলঙ্ক! কেনই বা বাবা শোধ তুলতে যাবে?
মা বলেছে, বাবা এই কাগজের মালিক।
মালিকরা এরকম মস্তান হয় নাকি?
নেপলা কে?
কেনই বা নেপলা বলেছে তাকে মেরে তবে অনিদার গায়ে হাত দিতে হবে।
নেপলা, রতন আঙ্কেলকে ম্যাসেজ করেছে। তারমানে নেপলা বিলক্ষণ রতন আঙ্কেলক চেনে। আবিদ আঙ্কেলও নেপলা আঙ্কলের নাম করেছে। আর দু-জন কে কে যেন? ও সাগির, অবতার! এদের ডিটেলসটা বার করতে হবে।
কিসের জন্য বাবাকে মার কাছ থেকে দূরে সরে থাকতে হবে?
মা কার সঙ্গে লুকিয়ে লুকিয়ে প্রতি সপ্তাহের একটা নির্দিষ্ট দিন অনর্গল কথা বলে।
ওকে বার করতেই হবে। এর একটা শেষ ও দেখতে চায়।
কার হেল্প নেবে?
ভজুমামা বলছিলো বাবার সঙ্গে থাকতো। তারমানে ভজুমামা অনেক কিছু জানে।
ঠিক আছে সব নোট ডাউন করি। একটা কোশ্চেনইয়ার তৈরি করতে হবে। এনকোয়ারিগুলো আগে লিখে রাখি, তারপর দেখা যাবে।
অনিসা আবার ডাইরীর পাতায় চোখ রাখলো।
আজ সকালে ঘরে ঢুকে আমার আলমাড়িটা একটু গোছাছিলাম। সকালেই তোর ছেলে-মেয়ের ডাক্তারদাদু, দুটো আলমাড়ি নিয়ে এসেছে কোথা থেকে।
দুজনের দুটো আলমাড়ি। দুরকম কালার।
শোন মামনি, দুজনের জিনিষপত্র সব আলাদা আলাদা রখবি। এক সঙ্গে রাখবি না।
তথাস্তু।
ওদের যা জামা কাপর হয়েছে একটা আলমাড়িতে হবে না। তিনটে করে আলামাড়ি হলে ঠিক হবে। আমার এখন স্থান হয়েছে বড়োমার ঘর।
দামিনীমাসি তোর ছেলেমেয়ে হওয়ার পর থেকে আর এ বাড়ি থেকে নরেনি। আমার দেখভাল, ছেলেমেয়ের দেখভাল করছে। আমার ডিউটি, টাইমে টাইমে গিয়ে দুধ খাওয়ান। এককথায় বলতে পারিস জার্সি গরু।
ডাক্তারদাদা বলেছে। বুকের দুধ ছাড়া এই মুহূর্তে কোনও সিনথেটিক দুধ খাওয়ান যাবে না। রতন কোথা থেকে প্রত্যেক দিন তিনলিটার করে গরুর দুধ এনে দিয়ে যাচ্ছে।
আমাকেও একেবারে গরু বানিয়ে দিয়েছে বুঝলি। খালি খাচ্ছি আর দুধ দিয়ে যাচ্ছি। তুই থাকলে কিছুটা সাহায্য পেতাম। এখন দিদিভাই, জ্যেঠিমনি পর্যন্ত বড়োমার দলে। আমার ডিউটি প্রত্যেকদিন সকালে জ্যেঠিমনির কাছে গাড়ি পাঠান। কোন দিন পিকু একা, কোন দিন পিকু, দিদিভাই, জ্যেঠিমনি আসে। সারাদিন এখানে থাকবে। রাতে ফিরে যাবে। যাওয়ার সময় বরুনদা নিয়ে চলে যায়। মিলি, অদিতি, টিনার কথা বাদ দে। ওরা আসতে যেতে সব সময় এ বাড়িতে রয়েছে।
চিকনা আজ পাঁচকিলো সরষের তেল নিয়ে এসেছে। নিজেদের খেতের সরষে দিয়ে কাঠের ঘানিতে মেরে নিয়ে এসেছে। সে কি কাদানি কাদানি দেখতে। বোঝাই যায় না সরষের তেল। নিজে নিজেই তাকে শুকনো পাতা জ্বালিয়ে মাটির হাঁড়িতে গরম করে শুদ্ধ করলো। ঠান্ডা করে, ভাই আর বোনের বোতল ভাগাভাগি করে দিল। বড়োমাকে বললো নিশ্চিন্তে মাখাও আমি মাসে মাসে এসে দিয়ে যাব।
চিকনা আজকাল কলকাতায় এলেই তিন চারদিন এই বাড়িতে থাকছে। কোথাও নরছে না। সময় পেলেই সারাক্ষণ দুটোর মুখের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে। আজ দেখি আমার ঘরের সামনে ঘুরঘুর করছে। দরজা হাট করে খোলা। বুঝলাম কিছু বলতে চায়। সুযোগ পাচ্ছে না।
ইশারায় ভেতরে ডাকলাম।
ঘরে এলো।
কিছু বলবে?
পায়ে পায়ে ভেতরে এলো। মুখটা থমথমে।
এ মাসে তিনলাখ টাকা প্রফিট হয়েছে।
আমি কি করবো, তোমার গুরুকে ফোন করো।
তুই বিশ্বাস করবি না বুবুন, আমি যে ওই ভাবে ওকে বলতে পারি ও বিশ্বাসই করতে পারে নি। মাথা নীচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো।
আমি খাটে গিয়ে বসলাম।
আজকাল একা একা শ্মশানে যাচ্ছ। সময় পেলেই পীরসাহেবের থানে যাচ্ছ। মাঝ রাতে কামরপাতায় গিয়ে কার সঙ্গে ফুসফুস করে কথা বলছো।
তুই বিশ্বাস কর বুবুন, একটা কথা মুখ থেকে বেরলো না।
তোর ছেলের মতো ঠোঁট ফুলিয়ে নিস্তব্ধে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করলো। শুধু ফুঁপিয়ে যাচ্ছে। কোনও আওয়াজ হচ্ছে না। আমার খুব খারাপ লাগছিল। কিন্তু আমাকে তখন জানতেই হবে। কেমন যেন একটা জেদ চেপে বসলো। চিকনা তখন শক্ত কাঠের মতো দাঁড়িয়ে আছে। টপ টপ করে চোখ দিয়ে জল পরছে।
আমার কথার জবাব দাও। না হলে যা ভালো বোঝ নিজে করবে। আমাকে জিজ্ঞাসা করবে না। ওটা তোমার আর তোমার গুরুর ব্যাপার।
ওমা দেখি আমার পা ধরে আমার কোলে মাথা রেখে সে কি ফুলে ফুলে কান্না।
ফোপান বেড়ে গেল।
বলে কিনা, তুমি আমার মা। তোমাকে আমি মিছে কথা বলতে পারবো না। তুমি আমাকে জিজ্ঞাসা করো না।
ওর কান্নার আওয়াজে দেখি বড়োমা গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আমাকে চিকনাকে ওই অবস্থায় দেখে একটু অবাক হয়েছে। চোখে মুখে তার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে।
বড়োমাকে ইশারা করলাম। চুপ। আড়ালে যাও।
বড়োমা কি বুঝলো চলে গেল।
কেঁদে কোনও লাভ নেই চিকনা। তুমি যখন আমাকে মা বলেছো, মায়ের কাছে সন্তান কিছু গোপন করে না।
আমি বলতে পারবো না। ওর ক্ষতি হবে।
আমার কোল থেকে কিছুতেই মুখ তোলে না।
বুবুন কোথায় আছে?
জানিনা।
কার সঙ্গে তুমি কথা বলো।
তনুদিদির সঙ্গে।
ওর কথা শুনে আমার সারাটা শরীর কেঁপে উঠলো। খুব জোড় সামলে নিলাম।
তনুকে তুমি পেলে কোথায়?
অনি চিনিয়ে দিয়েছে।
কি করে চেনাল?
ও যাওয়ার আগে তনুদিদি কলকাতায় এসেছিল।
তুমি সব জানতে!
জানতাম।
তারপর!
আমি যেতে চেয়েছিলাম। আমাকে নেয়নি। বলেছে তোর এখানে অনেক কাজ।
তনু এখন কোথায়?
লণ্ডনে।
তোমার সঙ্গে শেষ কবে দেখা হয়েছে?
ভাই-বোন যেদিন হয়েছে সেদিন।
সেদিন সকালে!
না।
তাহলে?
আগের দিন কলকাতায় এসেছিল। তারপর রাতে আমাদের ওখানে গেছিল।
তনু ওখানে গেছিল!
হ্যাঁ।
কি করে গেল?
লাস্ট ট্রেনে গেছিল। আমি মটোর বাইকে করে নিয়ে যাই।
কেউ জানে না?
না।
কেন গেছিল?
অনি কাকা, কাকীর (মা-বাব) জন্য ফুল পাঠিয়েছিল। প্রথমে শ্মশানে যাই, তারপর পীরসাহেবের থানে। ওখান থেকে কলকাতায় আসি।
কি করে এলে!
ফার্স্ট ট্রেনে।
তারপর!
তনুদিদ হাওড়া থেকে একটা মেমসাহেবের গাড়িতে উঠে চলে গেল।
কোথায় গেল?
জানি না।
তনুদিদি আমার কাছ থেক সব খবর নিয়ে দুপুরের প্লেন ধরে লণ্ডন চলে যায়।
সঙ্গে আর কে ছিল?
মেমসাহেব ছাড়া আর কেউ ছিল না।
বুবুন কোথায়?
তুমি বিশ্বাস করো, আমি জানি না। আমার সঙ্গে তনুদিদির কথা হয়। ও নাকি শুনতে পায়।
অনিসার সব কেমন যেন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। মাথাটা কেমন যেন দপ দপ করছে। একটা মানুষ কেন এতটা জটিল হতে যাবে, কিছুতেই বুঝতে পারছে না। মনে হচ্ছে এর ভেতরে আরও অনেক কিছু আছে। যা ওর কাছে অজানা।
অনিসা ল্যাপটপ থেকে মুখ তুলে খোলা জানলার দিকে তাকাল। চোখ কান নাক ভোঁ ভোঁ করছে। মাথায় কিছু ঢুকছে, কিছু ঢুকছে না। কেমন যেন সব মাথার ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে।
ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। কোথা থেকে যে সারা রাত কেটে গেলো বুঝতেই পারলো না। স্ক্যান ইমেজগুলো পড়তে পড়তে অনিসা কখনও হেসেছে কখনও কেঁদে ফেলেছে। কখনও ওর পিঠের শিড়দাঁড়া দিয়ে গরম শ্রোতের মতো দ্রুত কিছু ছুটে গেছে।
মা ভীষন ভালো লিখেছে। যেন মনে হচ্ছে চোখর সামনে সব কিছু দেখতে পাচ্ছে।
ল্যাপটপটা বন্ধ করে টেবিল থেকে উঠে এলো। বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিয়ে একবার এপাশ ওপাশ করলো। কালই আবিদ আঙ্কেলকে ধরতে হবে। ইসলামদাদাইকে এখন ঘাঁটান চলবে না। মনে হচ্ছে মিলি মনি, টিনা মনিও এর মধ্যে ইনভলভ।
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে অনিসা ঘুমিয়ে পরলো।
মিত্রা রান্নাঘর থেকে চায়ের ট্রেটা নিয়ে এসে সেন্টার টেবিলে রাখলো। একবার দাদার দিকে তাকাল। চোখমুখটা কেমন শুকনো শুকনো।
দাদা, শরীরটা খারাপ লাগছে? মিত্রা বললো।
না।
তাহলে চোখমুখটা কেমন কেমন যেন লাগছে।
কাল সারারাত ঘুমোয়নি। বড়োমা বললো।
মিত্রা বড়োমার দিকে তাকাল।
কেনো!
জিজ্ঞাসা কর।
কোনও সমস্যা?
শুধু অনন্য কোথায় গেছে? কেনো তোমরা ওকে একা একা যেতে দিলে।
ও তো ডাক্তারদাদার সঙ্গে গেছে—
বিশ্বাস করলে তো।
ছোটোমা চায়ের পট থেকে সকলকে চা ঢেলে দিল।
অনিসা উঠেছে। দাদা জিজ্ঞাসা করলো।
না।
মিত্রা একবার দাদার দিকে তাকাল।
মেয়েটাকে ডাক।
থাক না, এই তো সবে পরীক্ষা শেষ হলো।
দাদা একবার বড়োমার মুখের দিকে তাকাল।
জানো মিনু, এখন এই দুটো আমার বেঁচে থাকার অক্সিজেন। বুকে যন্ত্র বসিয়ে কতদিন বেঁচে থাকা যায় বলো।
মিত্রা মাথা নীচু করে নিল। ধীর পায়ে রান্নাঘরের দিকে গেল। কাজের মাসিকে বুঝিয়ে দিয়ে বেরিয়ে আসতে গেল….।
মিত্রা।
দাদার ডাকে মিত্রা ফিরে তাকাল।
অনন্য কখন আসবে?
ডাক্তারদাদা বলেছে সকালের দিকেই ওখান থেকে রওনা দেবে।
কোথায় গেছে?
বুবুনের বাড়িতে।
পরীক্ষা দিয়েই চলে গেছে!
হ্যাঁ।
তিনদিন হয়ে গেল। ফোন করেছিস?
একটু আগেই কথা হয়েছে। ডাক্তারদাদা বললো কিছুক্ষণ পর বেরবে।
ডাক্তারের কাণ্ডজ্ঞান দেখ, ওকে ছাড়া যাওয়া যায় না—
ডাক্তারকে দোষ দিচ্ছ কেন। ও অনেকদিন থেকে বলে রেখেছে। দাদাই পরীক্ষা শেষ হলেই বাবার বাড়িতে যাব।
মিত্রা দাঁড়িয়ে থেকে মুচকি হাসলো। ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
বারান্দায় আসতেই ভজু এগিয়ে এলো।
দিদিমনি, ছোটোবাবু কবে আসবে?
ভজুর দিকে তাকিয়ে মিত্রা হাসলো।
আজ আসবে।
মুখটা হাসিতে ভরে উঠলো।
ছোটো দিদিমনি ঘুমচ্ছে?
ডাকতে যাচ্ছি।
তাড়াতাড়ি ডাকো।
কেন!
ও বাড়িতে যাবে বলেছে।
মিত্রা পায়ে পায়ে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে এলো।
দরজা ঠেলতেই হাট হয়ে খুলে গেল। অনিসা আষ্টেপৃষ্ঠে পাশবালিশ জাপ্টে ধরে শুয়ে আছে। এলো চুল বিছানায় লুটপুটি খাচ্ছে।
সত্যি এই মেয়েটাকে নিয়ে আর পারা যাবে না। কতবার বলেছি মা শোয়ার সময় চুল বেঁধে শুবি। কে কার কথা শোনে।
মিত্রা চেয়ে চেয়ে অনিসাকে দেখছে। ভরা যৌবনের স্পর্শ সারাটা শরীরে। মুখটা একেবারে বুবুনের মতো। সেই চোখ সেই ঠোঁট। একেবারে বাবার মুখ বসানো। মাঝে মাঝেই কথা বলতে বলতে চুপ করে যায়। স্থির চোখে দেখে।
মাস দেড়েক হলো এই পরিবর্তনটা আরও বেশি করে মিত্রার চোখে পড়ছে।
মিত্রা ধীরে ধীরে খাটে উঠে এলো। অনিসার কপালে হাত রাখলো।
এবার ওঠ মা।
অনিসা চোখ মেলে তাকাল, মিত্রার গলাটা জড়িয়ে ধরে কপালে গালে চকাত চকাত করে চুমু খেল।
ইস তোর মুখে গন্ধ।
অনিসা মার গলা জড়িয়ে ধরে গালে গাল ঘোষলো।
যদি অনি ব্যানার্জী চুমু খেতো, এ কথা বলতে পারতে—
মিত্রার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো। অনিসা কি কথা বললো!
কপট গাম্ভীর্যে মেয়ের মুখের দিকে তাকালো।
ওমনি মুখটা শুকিয়ে গেল।
অনিসা মাকে জড়িয়ে ধরলো।
জানো মা আজ একটা দারুণ স্বপ্ন দেখলাম।
মিত্রা মেয়ের মুখের দিকে তাকাল।
কি দেখলি?
মি. অনি ব্যানার্জী এসেছেন।
আমাকে, দাদাভাইকে চিনতেই পারছে না। তোমার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললো, মিত্রা এরা কারা। যেন আমরা কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেছি।
আমিও তেমনি গম্ভীর ভাবে বললাম, আমার মাকে নাম ধরে ডাকার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে।
দেখি মি. অনি ব্যানার্জীর মুখ শুকিয়ে একবারে আমসি হয়ে গেছে।
আপনি চিনতে পারছেন না। আমি অনিসা ব্যানার্জী ও হচ্ছে আমার দাদা অনন্য ব্যানার্জী। আচ্ছা মা, বাবার সঙ্গে তোমার কোনও যোগাযোগ আছে?
মিত্রা মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। পাহাড়ি ঝোড়ার মতো অনিসা কল কল করছে। বুকের ভেতরটা আবার দুরু দুরু করে কেঁপে উঠলো। কি বলতে চায় ও?
বলো না। তোমার সঙ্গে বাবার কোনও যোগাযোগ নেই?
না।
সামথিংস রং।
মিত্রা মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে।
অনিসা একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেল।
পিকুদা কখন আসবে?
ও ফার্স্ট আওয়ারে অফিসে যাবে।
ভজু, মিত্রার ফোনটা নিয়ে ঘরে ঢুকলো।
দিদিমনি, মিলিদিদি ফোন করেছে।
আমার হাতে ফোনটা দিল।
হ্যালো।
তুমি কি আজ অফিসে আসছো?
বলতে পারছি না। কেন বলতো?
দুটো থেকে মিটিং আছে। কামিং ইয়ারের বাজেট।
তাহলে যাব। আমি না গেলে তোরা সামলাতে পারবি না?
পারব। তবে তোমার থাকা জরুরি।
দাদার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না।
দশ মিনিটের জন্য। আবার সেই আইডি থেকে মেল এসেছে।
তাই! কখন?
তুমি মেল চেক করোনি!
না।
দেখো তোমাকেও ফরোয়ার্ড করা হয়েছে। নাম ধরে ধরে ইনস্ট্রাকশন দেওয়া আছে। পুরো গাইড লাইন দিয়ে দেওয়া রয়েছে।
একই মেল সবাইকে পাঠিয়েছে।
হ্যাঁ। ব্যাপারটা এরকম সবাই সবারটা দেখবে।
এখন আর কিছুতেই বিশ্বাস হয় না মিলি। মনে হচ্ছে সমস্ত ব্যাপারটা অবাস্তব।
অবাস্তব বলি কি করে, প্রথম বছরটা বাদ দিলে, আজ সতেরো বছর ধরে আমাদের সমস্ত ভুলগুলো ধরিয়ে দিচ্ছে তো।
আমার আর ভাবতে ভালো লাগছে না।
তোমায় ভাবতে হবে না। তুমি একবার এসো।
দেখি।
দেখি না, আসবে।
মিলি ফোনটা কেটে দিল। অনিসা মায়ের মুখের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে। চোখের পাতা পরছে না।
কিরে?
মিলিমনি ফোন করেছিল?
হ্যাঁ।
নিজের ফোনটা বালিশের তলা থেকে টেনে বার করলো। পটা পট বোতাম টিপে ডায়াল করলো।
আবিদ আঙ্কেল….এক ঘণ্টার মধ্যে বাড়িতে আসবে….কি বললে….ওসব কাজফাজ অন্য কাউকে দিয়ে দাও। যা বলছি তাই করবে।….ঠিক আছে দেড়ঘণ্টা, তার বেশি হলে আমি আমারটা বুঝে নেবো….মনে থাকে যেনো। ভাইদাদাই কোথায়?….দাও….শোনো, আবিদ আঙ্কেলের সঙ্গে তুমিও আসবে।….মনে থাকে যেনো….হ্যাঁ আমি অনি ব্যানার্জী আর কিছু জানতে চাও।
মিত্রা মেয়ের মুখের দিকে তাকাল। ওর কথা বলার ভঙ্গি দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছে। কয়েকদিন আগে পর্যন্ত গলার স্বরে এরকম তীক্ষ্ণতা ছিল না। মাস খানেক হলো ওর চলন-বলন একেবারে বদলে গেছে। পুরো বাপকা বেটি!
কি দেখছো?
কার সঙ্গে কথা বললি!
ভাইদাদাই-এর সঙ্গে।
তুই ইসলামভাই-এর সঙ্গে ওই ভাবে কথা বলছিলি!
কি হয়েছে—
কি হয়েছে মানে!
আমার প্রয়োজন আছে তাই। এই তো নয় আজই বলছি। আজ থেকে সাতদিন আগে বলে রেখেছি। আজ যদি বলে সময় দিতে পারবে না। তাহলে হয় কি করে?
তাই বলে তুই!….
তুমি নিচে যাও। আমি রেডি হয়ে নামছি। ভজুমামাকে বলো গাড়িটা ধুয়ে দিতে।
ভজুমামা তোর চাকর।
ঠিক আছে তোমাকে বলতে হবে না, আমি বলে দিচ্ছি।
হন হন করে বারান্দায় বেরিয়ে গেল। চেঁচিয়ে উঠলো, ভজুমামা—ভজুমামা বলে।
নিচ থেকে ভজু চেঁচিয়ে উঠলো। ও নিজের কথা বলে ভেতরে চলে এলো। হন হন করে বাথরুমে ঢুকে গেল। মিত্রা কিছুক্ষণ স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে রইলো, তারপর ধীরে ধীরে নিচে নেমে এলো।
একেবারে বাবার মতো স্বভাব। সেই তেজ। ইদানিং মাঝে মাঝে দাদাকে পর্যন্ত এমন ভাবে ক্রশ করে, দাদা পর্যন্ত চুপ করে যায়।
দাদা প্রায়ই বড়োমাকে বলে, দেখেছো, নিজে কেটে পরেছে, একটা দিয়ে গেছে। বোঝ এবার তোরা।
এটা তবু একটা পদের ওটা আরও মিটমিটে। নিজের কাজ নিজে করে যাচ্ছে। বললেই বলবে কিছু হয়নি।
কিরে মুখটা শুকনো কেন! বড়োমা কাছে এগিয়ে এলো।
নিশ্চই বুঁচকি কিছু বলেছে?
না।
তাহলে!
ও দিন দিন একেবারে বুবুনের মতো হয়ে যাচ্ছে।
মিত্রা, বড়োমাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠলো।
কি করবি বল। সব কপাল। তুই ওর পেট হোসনি। ও তোর পেটে হয়েছে।
আমি আর পারছি না বড়োমা।
এতদিনেও ভুলতে পারছিস না।
ভুলি কি করে বলো।
ছোটোমা এগিয়ে এলো।
বুঁচকি কোথায়?
আসছে।
মিত্রা সোফায় এসে বসলো। যতক্ষণ কাজের মধ্যে থাকে, ততক্ষণ কিছু মনে হয় না। যখনই একলা হয়ে যায়। তখনই বার বার অতীতের কথা মনে পড়ে যায়। আষ্টেপৃষ্ঠে সমস্ত দিক দিয়ে যেন মিত্রাকে বেঁধে রেখেছে। পালাবার কোনও পথ নেই।
মিত্রার মোবাইলটা বেজে উঠলো। হাতে নিয়ে দেখলো অনন্য। ফোনটা ধরলো।
মা আমরা বাড়ির রাস্তায় ঢুকছি। তুমি টেনশন কোরো না। দুদুন ফোন করেছিল। তোমার নাকি মন খারাপ।
না।
বোন উঠেছে?
উঠেছে।
ঠিক আছে এখুনি পৌঁছে যাব।
আয়।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বাইরের গেটে হর্ন বেজে উঠলো। মিত্রা সোফা থেকে আর ওঠে নি।
অনন্যরা সবাই ঘরে এলো। দাদা নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ডাক্তারদাদাকে বললো। তোমার কাণ্ডজ্ঞান বলিহারি।
কেন!
একবার তো জানাবে—
মানে!
ফোন তো করতে পারো।
বড়ো বান্ধবীকে জানিয়েছি। ছোটোকে জানিয়েছি। তোমার সঙ্গে কাল রাতে সমস্যাগুলো নিয়ে একঘণ্টা ফোনে কথা বললাম। সত্যি এডিটর তোমার বয়েস হয়েছে।
হ্যাঁ ডাক্তার সত্যি আমার বয়েস হয়েছে।
আমি তো কোচি খোকা। আমর আর বয়েস হয়নি।
দাদা সোফায় বসতে বসতে হো হো করে হেসে উঠলো।
মিত্রা মুচকি মুচকি হাসছে।
তুই একবার বিচার করে দেখ মামনি। বেমালুম ভুলে গেল।
অনিসা ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকেই, অনন্যকে জিজ্ঞাসা করলো।
কিরে তুই কখন এলি?
এই তো মিনিট পাঁচেক।
গিয়ে একটা ফোন মারতে পারতিস—
সময় পাই নি।
খুব ঘুরেছিস?
শুধু ঘোরা। যা খেলাম না।
আমার জন্য নিয়ে এসেছিস?
দাদু আনতে দেয়নি।
অনিসা সোফায় গিয়ে মায়ের পাশে বসলো।
মনে রাখিস এক মাঘে শীত যায় না।
তুই চলে যা।
অবশ্যই যাব। তোকে বলতে হবে নাকি। সময় হোক দেখতে পাবি।
তাল পাটালি খেলাম বুঝলি। ছোটঠাকুমা যা বানিয়েছিল না।
লোভ দেখাস না। তোকেই হয়তো কামরে খেয়ে নেব।
দুই ভাই বোনের তরজা চলছে। সবাই নির্বাক দর্শক। মিত্রা হাসছে।
তুই সক্কাল সক্কাল এতো ড্রেস লাগিয়ে কোথায় বেরচ্ছিস?
ডাক্তারদাদা অনিসার মুখের দিকে তাকাল।
দিদান।
বড়োমা রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে উঠলো।
বল, কি হয়েছে।
খিদে লেগেছে। রুটি না লুচি।
কোনটা তোমার মুখে রুচবে বলো।
আমার কোনও ফ্যাসিনেশন নেই, তোমার নাতির আছে।
মিত্রা মেয়ের দিকে তাকাল।
তাকিয়ে কোনও লাভ নেই। যা বলছি সত্যি বলছি।
তুই আমার কথার উত্তর দিলি না। ডাক্তারদাদা বললো।
এখনও সময় হয়নি। খাওয়ার টেবিলে প্রশ্ন করবে উত্তর পাবে।
তুমিই আদর দিয়ে ওদের মাথায় তুলেছো। দাদা, ডাক্তারদাদার দিকে তাকিয়ে বললো।
অনিসা কট কট করে দাদার দিকে তাকাল।
রাতে ডেকো দিদিভাই বলে, সেলো টেপ আটকে দেব।
দাদা অনিসার কথা শুনে হেসে উঠলো।
হ্যাঁরে বুঁচকি সকালে মাকে কি বলেছিস?
অনিসা ছোটোমার দিকে তাকাল।
কই—কিছু বলিনি।
অনিসা মায়ের গলা জড়িয়ে ধরলো।
তুমি রাগ করেছো। ঠিক আছে আর কোনওদিন বলবো না কথা দিচ্ছি।
মিত্রা মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
দাদা তুই আজ কোথায় যাবি?
এখন খাবোদাবো তারপর ঠেসে একটা ঘুম। ঘুম থেকে উঠে দুপুরে স্নান করে খাওয়া, তারপর দাদাইয়ের সাথে দামিনীদিদার ওখানে।
কিগো দিদান তোমার হলো? অনিসা আবার চেঁচাল।
কেনো ঘোঁড়ায় জিন দেওয়া আছে?
হ্যাঁ আছে।
বড়োমা রান্নাঘর থেকে খাবার নিয়ে এসে টেবিলে রাখলো।
দাদা তুই আজ দিদাই-এর পাশে আমি দিদানের পাশে। নো ঝামেলা।
দিদানের ভাগ আমার।
ঠিক আছে মায়েরটা আমার।
কেন তুই দুটো নিবি।
আর বক বক করতে হবে না। এবার এসে বসে পরো। বড়োমা খ্যাঁক করে উঠলো।
সবাই টেবিলে এসে বসে পরলো।
দাদা ওদিকের দুটো চেয়ার খালি রাখিস।
কেন।
ইসলামদাদাই, আবিদ আঙ্কেল আসবে।
কেনরে?
সব কেনর উত্তর হয় না।
বাবাঃ তুই আজ বেশ স্মার্টলি কথা বলছিস। মল্লিকদা বললো।
বয়েস হোক বুঝতে পারবে।
ডাক্তারদাদা জোরে হেসে উঠলো।
হেসো না হেসো না বুড়ো, তোমরও সময় আসবে, মনে রেখো।
বান্ধবী ওকে একটু পাটালি দিও।
সত্যি নিয়ে এসেছো!
অনিসা চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে ডাক্তারদাদার গলা জড়িয়ে ধরলো।
সরি।
তাহলে এবার বল। এতো সব ড্রেস-ট্রেস লাগিয়ে কোথায় যাচ্ছিস?
প্রথমে একটু আবিদ আঙ্কেলকে নিয়ে বেরোব। তারপর অফিস।
অফিসে কি করতে যাবি?
তোমাকে এখন বলবো না। সময় হোক তারপর বলবো।
এখনও সময় হয়নি?
শুরুই করলাম না।
কি শুরু করবি?
একটা কাজ স্টর্ট করছি বুঝলে দাদাই। বলতে পারো রিসার্চ ওয়ার্ক।
সাবজেক্ট?
অনিসা ডাক্তারদাদার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেললো।
একজনের ওপর।
পরিচিত না অপরিচিত?
নাম বলা যাবে না।
কেন!
বড়োমা, মিত্রা মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে।
আমি তোকে সাহায্য করতে পারি?
অবশ্যই তোমার সাহায্য নেবো। তবে ইনিসিয়ালি লাগবে না।
অনিসা প্রথমেই মায়ের পাত থেকে একটা আলুর দমের আলু তুলে নিল। অনন্য একবার কট কট করে তাকাল।
এদিকে তাকাবি না তুই দিদান। আমি দিদাই, মা ওখান থেকে অনেক খেয়ে এসেছিস।
মিত্রার মনে পড়ে যাচ্ছে বুবুনের কথা। ও ঠিক খেতে বসে এরকম করতো। তখন মিত্রা ছোটোমার ভাগেরটা আর বুবুন বড়োমার। মিত্রা মাথা নীচু করে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলো।
কিরে মিত্রা খাচ্ছিস না কেন? মিত্রা বড়োমার দিকে একবার তাকাল।
বড়োমা বুঝতে পারলো। মুখে কিছু বললো না।
অনিসা কিছুই লক্ষ্য করলো না।
আচ্ছা দুদুন তোমাকে বাবা ভয় পেত।
কথাটা কানে যেতেই, দাদা অনিসার দিকে তাকাল।
কেন বলতো?
এমনি জিজ্ঞাসা করছি।
ভয় পেতো না। তবে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতো।
ওই হলো, শ্রদ্ধার আর এক নাম ভয়।
তুই কি করে বুঝলি। ডাক্তারদাদা অনিসার দিকে তাকাল।
জানো দাদাই কয়েকদিন বেশ ঠেসে পড়াশুন করলাম। হাতের সামনে যা পেলাম তাই পড়লাম।
কি কি পরলি?
গোটা দশেক উপন্যাস পড়ে ফেললাম। সব এ্যাডভেঞ্চার। তার মধ্যে দুটো জেমস বন্ড।
কোথায় পেলি?
কেন, নেটে।
তা হঠাৎ জেমস বন্ড?
তোমাদের মুখ থেকে বাবার কিছু ঘটনা শুনেছিলাম। তাতে মনে হলো বাবা জেমস বন্ডের মতো।
একটু থেমে।
বাবার মাথাটা ভীষণ কাজ করতো।
তোরও কাজ করতে শুরু করেছে।
অনিসা ডাক্তারদাদার দিকে চোরা চাহুনি মেলে তাকাল। ফিক করে হাসলো।
তুমি কি করে বুঝলে?
ওই যে বললি বয়স হোক।
তুমি বহুত চাল্লু পুরিয়া আছ।
ডাক্তারদাদা জোড়ে জোড়ে হাসছে।
হেসো না। হেসো না।
তোর বাবা এই সময় হলে কি করতো বলতো।
কি করতো?
চুপ করে যেতো। আস্তে করে প্রসঙ্গটাই পাল্টে দিত। যেন মনে হতো ব্যাপারটা নিয়ে এতক্ষণ আলোচনাই হয়নি। দ্বিতীয় বার ভুল করেও আর ওই প্রসঙ্গটার মধ্যে ঢুকতো না। তারপর সুযোগ বুঝে আবার ওই প্রসঙ্গে ফিরে আসতো।
গুড এন্টিসিপেশন।
একটা জিনিষ শিখলি বল।
সিওর।
মিত্রা মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।
আজ তুই অফিসে গিয়ে তোর বাবার পাস্ট লাইফ নিয়ে ঘাঁটা ঘাঁটি করতে চাস?
মোটেই না। ওখানে ঢুকলে তল খুঁজে পাব না। তার থেকে বেশ আছি। ও সব মা বুঝবে।
তোর শেখাটা বেশ ভালো ইমপ্লিমেন্ট করলি।
অনিসা একবার ঠাণ্ডা চোখে ডাক্তারদাদার দিকে তাকাল।
ডাক্তারদাদা বললো, এ্যাম আই রাইট অর রং?
রং।
দিস ইজ ট্রু।
অফকোর্স।
সার্টেনলি নট।
প্রমাণ পেয়ে যাবে।
সবাই শ্রোতা। একমাত্র ডাক্তারদাদার সঙ্গে অনিসার ডুয়েট চলছে।
মিত্রা সব বুঝতে না পারলেও কিছু কিছু বুঝতে পারছে। ডাক্তারদাদা অনিসার মনের কথাটা ধরে ফেলেছে। মনে মনে বললো ওরে ডাক্তারদাদাই তোর বাবার চাল মাঝে মাঝে ধরে ফেলত, আর তুই কোন ছাড়। তোর নাক টিপলে এখনও দুধ বেরবে।
ইসলামভাই, আবিদ এসে ঘরে ঢুকলো।
বড়োমা বললো, চেয়ার খালি আছে বসে পরো।
ইসলামভাই মিত্রার দিকে তাকালো।
চুবরি ঢাকা দেওয়া আছে তুলে বসে পরো।
সব একেবারে রেডি।
তোমার গুণমন্ত্র নাতনিকে জিজ্ঞাসা করো।
কেন ও সব রেডি করে রাখতে বলেছে।
হ্যাঁ ঘোড়ায় জিন দেওয়া আছে।
যাই বলো বড়দি, অনিসা আজ পাঞ্জাবীটা দারুণ লাগিয়েছে।
তোমার পছন্দ। অনিসা ইসলামভাই-এর দিকে তাকাল।
পাঞ্জাবীটা চেনা চেনা মনে হচ্ছে।
বাবার। মাকে বললাম, বাবার পাঞ্জাবীগুলো পরে পরে নষ্ট হচ্ছে, দাও তো একটা পরি।
তাই বল।
মিত্রা মেয়ের কথায় হাসছে।
তুই হাসছিস কেন মামনি। ইসলামভাই বললো।
ওকে জিজ্ঞাসা করো।
মা প্রথমে দিতে চায়নি। আমি জোর করে নিয়েছি তাই।
আমার জন্য একটা বার করে দেবে। অনন্য পাশ থেকে বলে উঠলো।
কেন তোর সখ হয়েছে। অনিসা টিপ্পনি কাটলো।
তোর সখ হতে পারে, আমার হয় না।
ঠিক আছে, মা আমি যেগুলো বেছে রেখেছি সেগুলো বাদ দিয়ে অন্যগুলো দেবে।
কেন?
যা না ঘুরতে যা।
অনন্য গুম করে একটা ঘুসি দিল বোনের পিঠে।
ছোটোমা অনন্যর কান ধরলো।
বোন এখন বড়ো হয়ে গেছে।
অনন্য উঃ আঃ করে চেঁচিয়ে উঠলো।
যা আমি এখানে বসে খাবোই না। আমি দাদাই-এর পাশে গিয়ে বসবো।
অনিসা উঠে চলে গেল।
বোস না ওখানে। তিনজনেরটা আমার।
তুই তিন আমি পাঁচ।
মিত্রা দুজনের দিকে চেয়ে আছে। মনে মনে হাসছে।
আবিদ আঙ্কেল তাড়াতাড়ি সাঁটাও, বেরতে হবে।
আমার কিন্তু আজ অনেক কাজ। আবিদ বললো।
আমাকে দুটো পর্যন্ত সময় দেবে। তারপর তোমার ছুটি।
আমার কাজটা কি বল। ইসলামভাই বললো।
ভেবেছিলাম তোমার ফ্ল্যাটে গিয়ে বসবো। আজ ওটা ক্যানসেল করলাম।
তাহলে আমার ছুটি।
হ্যাঁ। তবে ফোন করতে পারি। প্রোগ্রাম চেঞ্জ হতে পারে।
তুই যাবি কোথায় বল?
দাদা জিজ্ঞাসা করলো।
একটু ঘুরতে বেরবো।
কোথায়?
তোমাকে বলতে যাবো কেন।
ইসলাম ও একজনের সম্বন্ধে রিসার্চ শুরু করছে। তোমাকে তার সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করবে।
অনিসা, ডাক্তারদাদার দিকে তাকাল।
দাদাই খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
অনিসা পাটালিটা হাতে নিয়ে মায়ের কাছে এলো। মায়ের মুখের কাছে এগিয়ে দিয়ে বললো।
কামড়াও।
মিত্রা একটু কামড় দিল।
কেমন টেস্ট বলো।
মিত্রা হাসছে।
মাকে ঘুস দিলি।
বড়োমা বলে উঠলো।
ঘুস ঠিক না। শেয়ার করলাম।
পাটালিটা কেমন খেলি বল। ডাক্তারদাদা বললো।
দারুণ।
তোর একটা থ্যাঙ্কস দেওয়া উচিত ছিলো।
ডিউ স্লিপ দিলাম।
অনিসার কথার ভঙ্গিতে সবাই হেসে উঠলো।
অনিসা বেসিনের দিকে চলে গেল। হাত ধুয়ে ঘরের বাইরে চলে এলো। সোজা নিজের ঘরে। ল্যাপটপের ব্যাগটা নিয়ে তর তর করে নিচে নেমে এলো। মায়ের ঘরে ঢুকলো।
পায়ে পায়ে ববার ফটোটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
এক দৃষ্টে বাবার চোখের দিকে তাকাল।
কাল তোমার কিছু জিনিষ পড়লাম। আজ চেষ্টা করবো শেষ করতে। তোমার সঙ্গে আমার অনেক বোঝা পড়া আছে।
দাঁতে দাঁত চিপে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো।
আই মাস্ট উইন দ্যাট গেম। আই মাস্ট ডু ইট।
টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করলো।
ঘুরে দাঁড়াতেই মায়ের মুখো মুখি হলো। মা এক দৃষ্টে ওর দিকে তাকিয়ে।
কি বললি বাবাকে।
অনিসা মাথা নীচু করলো।
নীচু হয়ে মায়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো।
কি হয়েছে বল?
কিছু না।
প্রণাম করলি যে?
একটা শুভ কাজে যাচ্ছি, তাই।
বলা যাবে না?
এটা সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত।
মাকেও বলা যাবে না?
সময় হোক বলবো। তুমি আমাকে বাধা দিও না।
আমার যে হারাবার ভয়।
আমি বাবার মতো ভীরু নয়।
মিত্রা মেয়ের মুখটা চেপে ধরলো।
অনিসা মায়ের মুখের দিকে তাকাল। মায়ের চোখদুটো ছল ছল করছে।
সারাজীবন কেঁদেছ। কিছু করতে পেরেছ?
মিত্রা মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। বুঝলো ওর হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে মেয়ে। চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কোনও উপায় নেই। দোষ ওর। ওর বাবার সম্বন্ধে অনেক কিছু গোপন করেছে ও।
তুমি কাঁদো, আমি আসি। তবে তোমায় একটা কথা দিলাম। কাজটা আমি করবোই। সময় নেবো ওনলি থ্রি মান্থস।
চলবে —————————
from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/avAeoZN
via BanglaChoti
Comments
Post a Comment