কাজলদিঘী (২১০ নং কিস্তি)

❝কাজলদীঘি❞

BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

২১০ নং কিস্তি
—————————–

আমি আবার সোফায় এসে বসলাম।

এটা তোর ভেঁদোদা! সুজিতদা বলে উঠলো।

কেন আগে দেখনি?

গল্প শুনেছি, দেখিনি।

বুঝলে সুজিত এই ছেলেটি ওই পাড়ায় আমাদের পা রাখার জায়গা করে দিয়েছে। হৃত সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারে ওর অবদান যথেষ্ট। বিধানদা বলে উঠলো।

দেখে সত্যি বোঝা যায় না।

কাল রাতে রাঘবনের মুখে ওর কথা শুনেছিলে।

না। তখন আমি চলে গেছি।

কাল অনেকটা সময় আমাদের ওকে নিয়ে ব্যায় হয়েছে। কাল বেশ কয়েকজন বাঘা বাঘা লোক ওর কাছে গেছিল। দু-ঘণ্টার কথাবার্তায় একটাই কথা ও উচ্চারণ করেছে। অনি। ঝুনেকে দেখলে, ওর নিজের আপন মায়ের পেটের ভাই। মধ্যমগ্রামে বাড়ি করেছে….।

সেটা শুনেছি।

এরা হচ্ছে অনির সিপাই। তাহলে আমার শরীরটা খারাপ করা কি অপরাধ?

বিধানদার কথায় সুজিতদা জোরে হসে উঠলো। সকলেই হাসছে।

আপনি কনক্লুসানটা বেশ ভাল করলেন।

আর কনক্লুসন। ছোটো এবার একটু চা দাও। তোমরা আর দেরি করো না।

দাদা আমাদের সঙ্গে যাবে? ছোটোমা বললো।

না। অমিতাভবাবু, ডাক্তারবাবু আমাদের সঙ্গে যাবে। মল্লিক যদি যেতে চায় যেতে পারে। না হলে আমাদের সঙ্গে যাবে।

আমি সোফা থেকে উঠে নিজের ঘরে এলাম।

দেখলাম সোফায় পদু ঝুনে দুজনে বসে।

আমি এসে খাটে বসলাম। ঝুনে পদু দুজনেই হাসছে।

তুই এই সাত সকালে কোথা থেকে এলি। ঝুনের দিকে তাকালাম।

ও কাল রাতে এসেছে। পদু বললো।

ব্যাপারটা মাথায় ঢুকছে না।

হবে না। আচ্ছা তুই আর লোক পেলি না।

কি হয়েছে বলবি তো?

অনিকা, অনিসা দুজনে দুটো কচুরীর প্লেট নিয়ে ঢুকলো।

পদু হাসছে। কম করে নিয়ে এসেছিস।

দিদান কখনও কম করে দেয়। চটপট খেয়ে নাও। চা আনছি।

ওরা বেরিয়ে গেল। আমি বললাম। খেতে শুরু কর।

ঝুনে হাসছে। পদু একটা কচুরী মুখে দিয়েছে।

কালতো তোর এখানে বিশাল পার্টি ছিল। আমার ঘরে তো টিভি নেই তাই বাড়িওলার ঘরে বসে বসে সবাই টিভি দেখছি। বুঁচকি বললো, অনিকা বললো। আন্টি ফোন করে ডেকে পাঠাল। আমি দুপুরের দিকে একবার এসেছিলাম। তুই ঘুমচ্ছিলি। ফ্ল্যাটের চাবিটা দিয়ে বললো, নম্রতা তোর সঙ্গে যাচ্ছে, ওর কয়েকটা জিনিসের দরকার নিয়ে আসবে। তা নম্রতা নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করলো। গেলাম। ফেরার পথে বললো পদু আঙ্কেল একবার ভেঁদো মামাকে দেখব। তা বললাম চল। তা আমি ভেঁদোদার কাছে নিয়ে গিয়ে ওকে বসিয়ে বললাম তুই ভেঁদোদার সাথে কথা বল, আমি বিকেলের দুধটা একটু ধরে নিই। তা কতোক্ষণ হবে ধর আধাঘণ্টা। ফিরে এসে দেখলাম দুজনে গল্প করছে। ভেঁদোদাও ওর কথার উত্তর দিচ্ছে। তারপরতো ও চলে এলো।

তখন দুধ বেচছি। কটা হবে পাঁচটা সাড়ে পাঁচটা। সর্বেশ্বরজ্যেঠু ডেকে পাঠাল, তুই একবার সিগ্গির আয়। তা অজন্তাকে বসিয়ে এলাম। দেখলাম ভেঁদোদার ঘরে দুজনে বসে আছেন। দেখেই বুঝলাম এরা আইবির লোক। আমাকে জ্যেঠু পরিচয় করিয়ে দিল। ওরা আমার ইন্টারভিউ নিল। তখনই দেখলাম ভেঁদোদার চোখটা ঠিক লাগছিল না। সর্বেশ্বরজ্যেঠু বার বার ভেঁদোদাকে বললো, যদি তোর কাছে কিছু থেকে থাকে দিয়ে দে, আমি অনির সঙ্গে কথা বলে নেব। সে কি রাগ, বললো নেই। অনি আসবে।

ফেডআপ হয়ে ভদ্রলোক দুজন চলে গেল।

জ্যেঠু ওপরে চলে গেল আমি চলে এলাম। দোকান গুছিয়ে যখন আবার গেলাম, দেখলাম ভেঁদোদা ঘরে নেই। জ্যেঠুর দোকান বন্ধ। তাহলে গেল কোথায়!

ছুটে গেলাম জ্যেঠুর কাছে। জ্যেঠুকে সব বললাম। ওরা সবাই নিচে চলে এলো। পাড়ায় সবাই খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিল। খুঁজে আর পাই না। ভাবলাম হয়তো ও মধ্যমগ্রাম গেছে। ঝুনেকে ফোন করলাম। ঝুনে শুনে এসে হাজির। তোকেও ফোন করতে পারছি না। এখানে তখন পার্টি চলছে। নম্রতাকে একবার ফোন করলাম। বললো, জানি না।

মহা মুস্কিল।

তারপর মুড়িওলা টেঁপাদা বললো, ভেঁদোদাকে হেঁদোতে দেখেছে ছটা-সাড়েছটা নাগাদ।

যেতে আমার আর ঝুনের ওপর কি হম্বিতম্বি। কিছুতেই আসতে চায় না। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিয়ে এলাম। কথা দিতে হলো, তোর কাছে নিয়ে আসতে হবে। কালকেই আসতে চেয়েছিল মিথ্যে কথা বললাম। বুঝলাম আমার কথা ও বিশ্বাস করছে না। তারপর যা হোক এলো।

ঘরে ঢুকে বললো, তোরা বেড়িয়ে যা। চোখমুখটা ঠিক ঠেকছিল না। ঝুনেকে বললাম কি করবি? ও বললো মাথা কাজ করছে না। চুপচাপ বেড়িয়ে এসে বাইরের জানলার ফুটো দিয়ে ও কি করে দেখছি। দেখি পেটের ভেতর থেকে ভোজালি বার করলো।

তখন আমি বুঝলাম কিছু একটা অঘটন ঘটবেই আজ রাতে। ঝুনেকে বললাম তুই আমার বাড়ি গিয়ে শুয়ে পর। আমি এখানে জেগে বসে থাকি। কাল অনির গুষ্টির ষষ্ঠি পূজো করবো।

আমি হাসছি।

তুই হাসছিস!

কি করবো?

কি করবো মানে! কিছু হলে কে সামলাত?

কিচ্ছু হতো না।

তুই যেনে বসে আছিস।

আমার জায়গায় থাকলে তুইও যেনে যেতিস।

তোকে বলেছে।

আমি হাসছি। তারপর—

তারপর আর কি, আমি জানলার তলায় বসে সারারাত মশা মারলাম, ও দিব্যি ঘুমলো। মাঝে মাঝে উঠে বসে দেখি। বিড়ির শ্রাদ্ধ সারলাম। এক রাতে এক বান্ডিল বিড়ি।

ঝুনে জোরে হেসে উঠলো।

সকাল বেলা উঠে কি মেজাজরে আমার ওপর, বলে কি তুই ওখানে কুত্তার মতো বসে আছিস কেন।

রাগে গা জ্বলছে, কিছু বলতে পারছি না। বলে কিনা ১০টা টাকা দে, চা আনি। ঝুনে কোথায়?

বললাম, ঝুনে আমার বাড়িতে শুয়ে আছে।

ওকে ডাক। চা এনে দিচ্ছি খা। অনির বাড়ি নিয়ে চল।

সত্যি তুই বিশ্বাস কর ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুই বলতে পারছি না। হাঁ করে তাকিয়ে আছি।

পকেট থেকে পয়সা বার করে দিলাম। তখন কটা হবে পাঁচটা, সাড়ে পাঁচটা। ঝুনেকে খবর পাঠালাম। ও এলো। আজ সকালে বউ মেয়ে দোকান সামলেছে। তারা এখনো জানেনা, জানলে আমাকে ঝাঁটা পেটা করবে।

ওদের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ কথা বললাম, মেয়ে, নম্রতা দু-বার এলো। তারপর ওরা চলে গেল।

হই হই করে আমরা সবাই বেরিয়ে পড়লাম। আমাকে বড়োমা জোর করে নিজের গাড়িতে তুললো।

অনিমেষদা পেছন থেকে টিপ্পনি কাটলো।

বৌদি মিত্রাদের গাড়িতে গিয়ে উঠলো।

সামনের সিটে ছোটোমা, আন্টি। মাঝে মাসিমনি, জ্যেঠিমনি, বড়োমার পেছনে আমি দামিনী মাসি।

আর যে যার তাদের মতো।

বেরবার সময় কনিষ্ক, নীরুদের দেখতে পেলাম না। মাম্পি, মিকি বেরবার সময় ঝামেলা করলো। বাধ্য হয়ে সুরো আমার কাছে গুঁজে দিয়ে গেল। সঙ্গে সুমন্তরটাকেও।

গাড়ি চলছে। সঙ্গে তিনজনের চিল চিৎকার। কান ঝালা-পালা হওয়ার জোগাড়।

মাঝে মাঝে বড়োমা ভ্যাট ভ্যাট করে। কে কার কথা শোনে।

বিস্কুটের প্যাকেট বার করে তিনজনের হাতে দিল। কিছুক্ষণ চুপ।

হাইরোডে গাড়ি ছুটছে তীর বেগে।

আমি ঠিক বড়োমার পেছনে বসেছি।

অনি।

বলো।

সামনের সিটে ছোটোমা, সোনাআন্টি ফিক করে হেসে উঠলো।

বড়োমা, ছোটোমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো।

তোর জন্য এই তিনটে এতো বার বেড়েছে। বড়োমা দপ করে জ্বলে উঠলো।

যা বাবা, আমি কি করলাম! ছোটোমা হাসছে।

প্রথম থেকে তোকে বলেছি এতটা লায় দিস না।

আচ্ছা অনি, মিত্রা কি তখন ছোটো ছিল।

ছোটো না হোক বড়োতো ছিল না।

তোমার চোখে।

কত বয়স রে তখন ছাব্বিশ, সাতাশ হবে।

না দুধ খেত।

খেতো তো।

এবার দেখলাম মাসীমনি, জ্যেঠিমনিও মুখ ঘুরিয়ে হাসছে।

ঠিক আছে। তুমি যা জিজ্ঞেস করার ওকে করো আমরা সব মুখে কুলুপ এঁটে বসে রইলাম। তখন আবার ছোটো ছোটো করবে না।

অনি।

আমার কান আছে। যা বলার বলে ফেলো।

ভিউং গ্লাস দিয়ে ছোটোমার মুখ দেখছি। হাসছে না গম্ভীরও নেই।

মাম্পিরা তাদের মতো কিচির-মিচির করছে।

তোর জন্য বিধানবাবু আজ আমাকে কথা শোনাল।

বয়স হলে ওরকম একটু-আধটু সবাই বলে থাকে।

আমি স্বাভাবিক।

দেখলি ছোটো। বিধানবাবুর বয়স হয়েছে। আমরা যেন কচি খুকিটি।

তোমার সঙ্গে অনির কথা হচ্ছে, আমরা এখন শ্রোতা।

তবু তোকে একটু-আধটু বলে। আমাকে কিছুই বলে না।

ছোটোমা সামনের দিকে তাকিয়ে আছে।

জলের বোতলটা দাও দেখি, বুকটা জ্বালা জ্বালা করছে।

কেন! বড়োমার চোখেমুখে বিষ্ময়।

আমার দিকে ফিরে তাকাল।

সকালে অতোগুলো তেল খাওয়ালে।

আমি কোথায় খাওয়ালাম! দামিনী দিল।

দামিনীমাসির দিকে তাকাল।

তুমি একটু দেখে শুনে দিতে পারনি।

দামিনীমাসি কি বলবে একবার আমার দিকে তাকায়, একবার বড়োমার মুখের দিকে তাকায়।

বড়োমা আমার মুখের দিকে তাকাল।

খুব জ্বালা করছে।

না। দু-চারটে টক ঢেঁকুর মারলো।

তখনই তোকে বললাম একটা মিষ্টি খা, খেলি না। তেলটা তাহলে নেমে যেত। এখন একটা মিষ্টি দিয়ে জল খা।

তাই দাও।

দামিনী মিষ্টির বাক্স তোমার কাছে।

না ছোটোর কাছে।

ছোটো একটা সন্দেশ বার করে দে।

কোনটা দেব বলো। ছোটোমা মুচকি মুচকি হেসেই চলেছে।

কাঁচা সন্দেশ না কড়া পাক।

কড়া পাকটা দিস না। গলায় লেগে যাবে। তার থেকে বরং কাঁচা সন্দেশটা দে, দেখবি বুক থেকে তেলটা নেমে যাবে।

জ্যেঠিমনি একবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে জানলার দিকে মুখ ফিরিয়ে হাসছে।

ছোটোমা একটা সন্দেশ বার করে আমার হাতে দিল। চোখে চোখ রাখলো।

চোখের ভাষায় বুঝিয়ে দিল, তুই কত রঙ্গ করতে পারিস।

আমি মিষ্টিটা খেয়ে ঢক ঢক করে কিছুটা জল খেলাম। বোতলটা হাতে ধরা।

বড়োমা মিষ্টিটা নকুর।

হ্যাঁ, বেশ ভাল না?

ভাল কিনা জানিনা তবে টাটকা।

ডাক্তার সকালে নেপলাকে দিয়ে আনিয়েছে।

ডাক্তারদাদা আনল তুমি ক্রেডিট নিলে।

কেন, তুই কি ডাক্তারের আনা সন্দেশ আগে কখনও খাসনি?

এইভাবে খাইনি। যাক, রাঘবনের কাছে কাল অনেক গল্প শুনলে।

বড়োমাকে বোতলটা ফিরিয়ে দিতে দিতে বললাম।

দামিনীমাসি হাসছে। কোনও শব্দ হচ্ছে না।

কেন তুই এরকম করিস। আগের মতো কি সে বয়স আছে। আমি ছোটো ভয়ে মরি।

আর কেউ ভয় পায়নি।

সবাই কি আর স্বীকার করে। তোর দাদা কাল যেমন বললো, অনিকে নিয়ে আর পারা যাবে না। ও চিরটাকাল একরকম থেকে গেল।

ডাক্তারদাদা।

ও তো মিচকে পোড়া শয়তান। বড়োমা দাঁতে দাঁত চিপলো। হাড় বজ্জাত।

ভিউংগ্লাসে দেখলাম সোনা আন্টি হাসছে।

মুখটা শুকনো শুকনো করে বলবে ওকে ওর মতো থাকতে দাও না।

মাসীমনি কিছু বলেনি তোমায়?

মাসীমনি পেছন ফিরে আমার মুখের দিকে একবার তাকাল।

ও তো বোবা, শুধু দেখে, কিছু বলে না। জিজ্ঞাসা করলে বলে তারাহুড়ো করছো কেন।

তোমাকে কেউ কিছু বলে না। তাই না।

না।

ওখানে গিয়ে আমি তোমাকে সব বলবো।

আমি ছোটোকে বলেছি, দেখিস একটু ফাঁকা হলেই ও আমাকে বলবে।

আমি তোমাকে সব বলি কিনা বলো।

বলিস তো।

কালকে রাঘবন কি বললো গো।

মাসীমনি জোড়ে হেসে উঠলো। সঙ্গে ছোটোমা, দামিনীমাসি।

আমি পেছন থেকে বড়োমার গলা জড়িয়ে ধরে গালে গাল ঘসে দিলাম।

দেখছিস সকলে মিলে কিরকম হাসছে।

ছাড়ো তো। তোমার সঙ্গে আমার যে একটা….।

বড়োমা হেসে ফেললো।

আঙ্কেল তুমি দিদুনকে হামি খাচ্ছ।

এই বোস ওখানে, দামিনীমাসি ধমকাল।

মাম্পি ভপ করে উঠলো।

সত্যি ছোটো, মিলির মেয়েটা যা হয়েছে না।

ওই জন্য গুঁজে দিয়ে গেছে।

সকলে হাসাহাসি করছে।

ওরা যদি তোর কোনও ক্ষতি করে। বড়োমা আমার দিকে তাকিয়ে।

কারা!

ওই যে যাদের কাছে টাকা চেয়েছিস।

তোমাকে কথা প্রসঙ্গে একদিন একটা গল্প বলেছিলাম। মনে আছে?

বড়োমা বিষ্ময়ভরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে।

আমি বড়োমার গালে আবার গাল ঘষে দিলাম।

বুঝলে বড়োমা এই পৃথিবীতে প্রত্যেকটা মানুষ বাঁচতে চায়।

আমিও বাঁচতে চাই। তুমিও বাঁচতে চাও। আবার যার কাছে টাকা চেয়েছি সেও বাঁচতে চায়। জানো বড়োমা প্রতিটা মুহূর্ত তোমাকে এই বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করতে হচ্ছে।

বড়োমা পেছন ফিরে স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে।

সকলের হাসাহাসি বন্ধ। গাড়িটা সমানে গোঁ গোঁ করছে।

তুমি তোমার মতো ফাইট করছো। আমি আমার মতো ফাইট করছি। যার কাছে টাকা চেয়েছি সে তার মতো ফাইট করছে। বাঁচতে গেলে যুদ্ধ তোমাকে করতে হবেই। এই যুদ্ধের পেছনে একটা বড়ো ইতিহাস আছে। আছে একটা রাজনীতি। সেটা ভীষণ সূক্ষ্ম। বড়ো মজার।

যে যত ভালভাবে এই সূক্ষ্ম ব্যাপারটা ধরতে পারবে, সে জিতে যাবে। অনেক পরিশ্রম করে এটা আমি অর্জন করেছি। অতএব আমি জিতবো। আমাকে সহজে কেউ হারাতে পারবে না। এটা তোমাকে আগাম বলে রাখলাম।

আবার কেউ কেউ আছে। তাদের নিজেদের স্বার্থে আমাকে হারতে দেবে না। আমাকে জেতাবে। আমি যখন হারবো না। তোমারও ভয় নেই। আমাকে তোমায় হারাতে হবে না।

বড়োমা আমার হাতটা ছল ছল চোখে চেপে ধরলো।

এই দেখ চোখে জল আনলে হবে কি করে। তোমাকে জিততে হবে। চোখে জল, দুর্বলতার প্রতীক। এটা ঠিক নয়। তোমাকে বেঁচে থাকার সারার্থটা ধরতে হবে। তোমাকে মনে রাখতে হবে, আমরা একে অপরের পরিপূরক। বাকি যা কিছু, সব আই ওয়াশ। ওটা একটা মজার খেলা। তবে হ্যাঁ এই সূক্ষ্ম ব্যাপারটা সবার জন্য নয়।

যেমন ধরো রাঘবন। ভারত সরকারের এতবড়ো একটা পোস্ট হোল্ড করে আছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের প্রতিটা মুহূর্তের রিপোর্ট তার কাছে আসে। সে কি কিছু জানে না। এটা আমাকে মেনে নিতে হবে?

আলবাৎ জানে।

আমার বলাটা একটু জোর হয়ে গেল। নিজেকে সামলে নিলাম।

জানিনা কালকে তোমাদের রাঘবন কি বলেছে।

তবে এটুকু জানি ও আমার দিকে ঝোল টেনেই সমস্ত কথা বলেছে। শুধু বলেছে বললে ভুল হবে। যেখানে যতো প্রশাসনিক মিটিং হবে। সেই সব মিটিংয়ে আমার কথা উঠলেই ও আমার পক্ষ নিয়ে কথা বলবে। এ ছাড়া ওর আর কোনও উপায় নেই। তোমার যেমন আমাকে নিয়ে ভয়। ওরও তেমনি আমাকে নিয়ে ভয়। আমি যেন কোনও ভাবেই পা পিছলে না পরি। যদি পরি তাহলে ওর ক্ষতি। ঠিক তেমনি বিধানদা, অনিমেষদারও ক্ষতি।

কে তার নিজের ক্ষতি চায় বলো? তুমি চাও, কখনই না।

আমাকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিলে ওদের সকলের লাভ। তাই আমার চলাফেরার জায়গা না থকলেও ওরা আমায় তার জায়গা তৈরি করে দেবে। আমার সুবিধা-অসুবিধার খবর আমার থেকেও ওরা বেশি রাখবে।

বড়োমা যেমন আমার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে, মাসীমনি, দামিনীমাসি, জ্যেঠিমনিও আমার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে।

দেখবে আগে কার দিনের জামিদাররা তাদের জমিদারি রক্ষা করার জন্য লেঠেল রাখতো। তোমরা তো একসময় জমিদার ছিলে। হয়তো তুমি ছোট বেলায় এসব লেঠেল দেখে থাকবে। তোমাদের বাড়িতেই হয়তো অনেকগুলো লেঠেল ছিল। সব ষণ্ডা মার্কা। পেটান চেহারা। ইয়া তাদের গোঁফ। দেখলেই ভয় করতো। আমি খুব ছোটো সময় কাকার হাত ধরে একবার দত্তদের বাড়ি গেছিলাম। সেখানে লেঠেলদের দেখেছি। ওরা তখন মল্লযুদ্ধ প্র্যাকটিস করছিল।

বড়োমা বাকরহিত।

আমরা এখন আধুনিক হয়েছি। পুরনো কনসেপ্ট ঝেড়ে ফেলে সব নতুন চিন্তাভাবনার আমদানি করেছি। সব কিছু নতুন চেহারায় আমাদের সামনে হাজির। এখন জমিদারও নেই তাদের জমিদারিত্বও নেই।

চালাক-চতুর জমিদার হয়ে গেছে বড়ো বড়ো ব্যবসায়ী কিংবা ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট আর লেঠেলরা সব হয়েগেছে প্রাইভেট আর্মি। তাদের কারুর হাতে আর লাঠি নেই। আছে এ.কে-ফর্টি সেভেন, দামী রিভালভার যেমন ধরো গ্লক।

বড়োমা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লো।

দেখো জমিদারও বাঁচার তাগিদে লেঠেল পুষতো। আফতাবভাইও বাঁচার তাগিদে বিনদ, অর্জুনকে রেখেছে। অন্যায় কোথায় আমাকে বলো?

জমিদাররা তাদের জমিদারি চালাবার জন্য গোমস্তা, নয়েব রাখতেন। তাদের সেরেস্তা ছিল, সরকারবাবু ছিল, আরও কতো কি। এখানে অনিমেষদা, বিধানদা, প্রবীরদা সেইরকম রোল প্লে করছে।

জমিদারের জমিদারিত্ব এদের ছাড়া চলবে না। আবার এরা জমিদার ছাড়া বাঁচবে না।

এদেরও পরিবার পরিজন আছে। ভালোভাবে কে না বাঁচতে চায় বলো।

তাহলে ভুলটা কোথায়? কে কাকে মারবে?

জমিদারের জমিদারিত্বে কোনও বড়ো ব্যবসায়ী থাকতে পারে না, এমন হতে পারে না। অবশ্যই থাকতে পারে। সে সামান্য ক্ষমতাবানও হতে পারে। কিন্তু আমার জমিদারিত্বে তুমি আমাকে টপকে বেশি পয়সার মালিক হবে কি করে? কি ভাবে তুমি নিজেকে একজন ক্ষমতবান পুরুষ বলে নিজেকে সকলের সামনে মেলে ধরবে?

এরও পথ আছে। পথটা কি?

তোমাকে জমিদারের যে এ্যারাইভাল তার সঙ্গে তলে তলে ভাব রাখতে হবে। এর খবর তাকে, তার খবর একে দিয়ে দুজনের কান ভাঙচি দিতে হবে। একদিন দেখবে দুজনের মধ্যে যুদ্ধ লেগে গেছে। তোমার কার্যদ্ধার হলো। বলতে পারো নারদ নারদ খেলা।

এই ভাব রাখার ব্যাপারটা বেশ শক্ত। হিসেব নিকেষ করে করতে হয়। বেশির ভাগ মানুষ মাঝপথে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলে। এই খেলায় তুমি যদি একবার ঠিক মতো টিঁকে গেলে, তুমি সকলের চোখের মনি। না হলে দাঁড়ি পাল্লা হাতে চোখ বাঁধা মেয়েটার মতো তোমার দশা হবে।

সেটা আবার কি!

ওই যে বিচারকের পেছনে যে মেয়ের মডেলটা থাকে।

ওটা আবার এখানে কোথ থেকে এলো!

নাঃ তোমার মাথায় ঢুকবে না। এর থেকে আমি তোমাকে সহজ করে বলতে পারব না।

ছোটোমার চোখ স্থির, ঠোঁটে হাসি।

ছোটো ও কি সব বলেগেল তুই কিছু বুঝলি?

বুঝিনি, বোঝার চেষ্টা করছি।

দিদি তুমি কিছু বুঝলে? বড়োমা, মাসীমনির মুখের দিকে তাকাল।

তোমাকে আমি বুঝিয়ে দেব।

সেই ভালো। দামিনী তো বোবা হয়ে গেছে। পরে বলবে আমি জানতাম ও তলে তলে এরকম কিছু একটা করার মতলব করছে।

রতন গাড়ি চালাতে চালাতে ভিউইং গ্লাস দিয়ে একবার করে আমার মুখ দেখে আবার সামনের রাস্তায় চোখ দেয়। ওর ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা।

তারপর কি বল? বড়োমা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

তারপর আর কি, সব তো বলে দিলাম।

এইটুকুতে সব বলা হয়ে গেল।

হ্যাঁ।

আগা নেই মাথা নেই একটা গল্প বললি, সব বলা হয়ে গেল।

আমি হাসছি।

রাঘবন যে বললে হুন্ডির টাকা নিয়ে গণ্ডগোল। হুণ্ডিটা কি রে?

যাঃ। রতন স্বগতক্তির সুরে বলে উঠলো।

কিরে রতন! ছোটোমা রতনের দিকে তাকাল।

রতন গাড়ি চালাচ্ছে আর হেসে যাচ্ছে।

হাসছিস কেনরে মুখপোড়া। হাসির রোগ ধরেছে। বড়োমা খ্যার খ্যার করে উঠলো।

ছোটো দে তো ওর দাঁত কপাটি ভেঙে। বড়োমা দাঁতে দাঁত চিপল।

রতন হেসেই চলেছে।

অনিদার যা জানার জানা হয়ে গেছে।

ছোটোমা রতনের দিকে তাকিয়ে।

হ্যাঁগো ছোটোমা। আগে বড়োমাকে ছোট্ট করে বাজাল। দেখল যা জানতে চাইছে মুখ দিয়ে বেরল না। তারপর ফাঁদ পাতল। বড়োমা ধরা পরে গেল।

বড়োমার জায়গায় তোমরা হলেও ধরা পরতে। আমরাই কতবার পা পিছলে গেছি।

বড়োমা রতনের দিকে তাকিয়ে।

কি করে বুঝলি? ছোটোমা বললো।

হুণ্ডির ব্যাপারটা বড়োমার জানার কথা নয়। রাঘবন স্যার সবার সামনে কাল ওই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করেনি। তাহলে আড়ালে কি বিষয়ে আলোচনা করেছে সেটা দাদার জানার খুব দরকার ছিল। সেইভাবে পরবর্তী গেম প্ল্যান তৈরি হবে। এর সঙ্গে আনুসাঙ্গিক ব্যাপার দাদাকে খোলসা করে না বললেও চলবে।

বড়োমা আমার মুখের দিকে তাকাল। দামিনীমাসি ফিকফিক করে হাসছে।

কিরে তোর পেটে পেটে এত বুদ্ধি!

নাগো, রতনটা বেশি বুঝে গেছে। বোকারা কতোবার হাসে বলো তো?

কতোবার।

একবার বুঝে হাসে, একবার না বুঝে হাসে। রতনটা গাড়ল না বুঝেই হাসছে।

মসীমনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

দাও জলের বোতলটা দাও।

বড়োমা স্থবিরের মতো বসে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

আমি স্বাভাবিক। নিজে নিজেই বড়োমার কোলের ভেতর থেকে জলের বোতলটা তুলে নিলাম।

গাড়িটা এসে দাঁড়াল।

বুঝলে বড়োমা বুকের জ্বালাটা এখন অনেকটা কম। মিষ্টিটা বেশ টাটকা।

রতন তার মতো হেসেই চলেছে। আর সবাই আমার দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে।

ভিউংগ্লাস দিয়ে দেখলাম আমরা ধাবাতে চলে এসেছি। আমাদের আগে যে সব গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। সবাই নেমে পড়েছে। কনিষ্ক, নীরু, বটাকে এখান থেকে দেখতে পাচ্ছি। মিত্রা, তনুদের সঙ্গে কথা বলছে।

আমাদের গাড়িটা থামতেই ওরা পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো।

রতন দরজা খুলে নেমে পাগলের মতো হেসেই চলেছে।

মাম্পিরা নামার জন্য চেঁচা-মিচি শুরু করে দিয়েছে।

কিরে রতন তুই এতো হাসছিস কেন? কনিষ্ক বললো।

নীরু ততক্ষণে বড়োমার দিকের দরজা খুলে ফেলেছে।

দাদার এ্যাসিড হয়েছে। টক জলের ঢেঁকুর উঠছে।

অনির এ্যাসিড! টক জল!

বটা ততক্ষণে পেছনের দরজা খুলে ফেলেছে। মাম্পি, বটার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

এ্যাসিড! নাম আগে, তারপর পাইপ ঢুকিয়ে ওয়াশ করে দিচ্ছি। বটা বললো।

কিগো বড়োমা এ্যাসিড কেশের অবতারণা মানেই কেশ জণ্ডিস। কনিষ্ক বললো।

তোরা সবকটা এক নম্বরের তেঁয়েটে।

কনিষ্ক মুচকি মুচকি হাসছে। আর বলতে হবে না। বুঝে গেছি। এবার নেমে একটু পা-টা ছাড়িয়ে নাও। বড্ড ধরে গেছে।

কানে কানে কথাটা ছড়িয়ে পরেছে। সবাই হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে।

তনু-মিত্রা ছোটোমাকে নিয়ে পরেছে।

ইসি, জ্যেঠিমনি মাসীমনিকে ধরে ধরে নামাল।

আমি নেমে এলাম।

মেয়ে এগিয়ে এসে বললো।

বাবা তোমার বুকের কোনদিকটা জ্বালা করছে গো?

আমি হাসছি।

ছোটোমা মনেহয় এরিমধ্যে সংক্ষিপ্ত আকারে তনু-মিত্রার কানে তুলে দিয়েছে। ওরা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হেসেই চলেছে।

কি শয়তান বলো। ঠিক জায়গায় ঢিল ছুঁড়েছে।

বড়োমার আপাত গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে মিত্রা বললো।

কিগো, ছেলে ফুটুস করে দিয়েছে।

আর ভ্যাড় ভ্যাড় করিস না। দুটোই সমান।

মিত্রা এগিয়ে এসে বড়োমাকে জড়িয়ে ধরেছে।

রাগ করছো কেন। মিত্রা তো সব সময় খারাপ।

শয়তানের হাড্ডি সবকটা।

তনু এগিয়ে এসে বড়োমার দুই গালে হাত দিয়ে মুখটা তুলে ধরেছে। মিটি মিটি হাসছে।

সরে যা। সবকটা এক গোয়ালের গরু।

দু-জনে দু-পাশ দিয়ে বড়োমাকে জড়িয়ে ধরেছে।

চলো এবার আলুর পরটা, মটর পণির খেতে হবে।

বড়োমা ওদের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো।

ওকে ডাক।

ওর অম্বল হয়েছে, কিছু খাবে না।

ছোটোমারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে হেসেই চলেছে।

তুমি ওর ভাগের থেকে কিছুটা আমাদের দাও না। তনু বললো।

দিয়েছি তো।

আচ্ছা বড়োমা এতো বড়ো ডাঁহা মিথ্যেটা তুমি বিশ্বাস করলে কি করে বলো তো!

নীরু বড়োমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।

তোরা যেভাবে বিশ্বাস করতিস।

ওর কর্পোরেসনের জল খাওয়া পেট। আবার যে সে কর্পোরেসন নয়, কলকাতা কর্পোরেসন। জল খেলে জীবন বদলে যায়।

আমরা এতদিন ওর সঙ্গে রয়েছি জীবনে কখনও শুনিনি ওর গ্যাস অম্বল হয়েছে। আর তোমাকে বললো চারটে কচুরি খেয়ে ওর বুক জ্বালা করছে তুমি বিশ্বাস করে ফেললে।

কাঁচা সন্দেশ আমাদের কয়েকটা ছাড়ো তো।

ওরে নীরু শুধু কাঁচা নয় পাকাও খাওয়াচ্ছিল। সোনা আন্টি হাসতে হাসতে বললো।

দেখো আন্টি আমরা কিন্তু বড়োমার কাছে চেয়ে পাই না। আর অনি না চাইতেই।

হ্যাঁরে দুর্মুখো। সকালে অতোগুলো করে কচুরি আর মিষ্টি গিলে বেরিয়েছিলি।

বড়োমা বলে উঠলো।

সকলে হাসা হাসি করেই চলেছে।

আমরা আমাদের সেই পরিচিত জায়গায় এলাম। বুঝলাম কনিষ্করা এগিয়ে এসে সব ব্যবস্থা আগে থেকেই করে রেখেছে। অতএব বেশি সময় ওখানে অপেক্ষা করতে হলো না।

নেপলা দূর থেকে চোরা চোখে আমার দিকে তাকায় আর শরীরে ঢেউ তুলে হাসে।

ওর সঙ্গে তালে তাল মেলাচ্ছে সাগির, অবতার।

হই-হল্লার কোনও বিরাম নেই।

এবার কনিষ্করা ওদের গাড়িতে জোড় করে তুললো। এই নিয়ে অনিকাদের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ জোড় তরজা চললো। আমি নীরব দর্শক।

মাসীমনিকে দেখলাম মিত্রারা ওদের গাড়িতে তুললো। বৌদি ইন্টার চেঞ্জ করে বড়োমাদের গাড়িতে এসে ঢুকলো। বুঝলাম একটা ছোট্ট মিটিং হয়ে যাবে।

অপেক্ষা না করে রওনা দিলাম।

ছেলেমেয়েদের গাড়ি সবার আগে। ড্রাইভিং সিটে দেখলাম সুন্দরকে। মানে ইন্টার চেঞ্জ করে ওরা চালাচ্ছে। বহুবার এই রাস্তায় ওরা এসেছে। তাই অসুবিধা হওয়ার কোনও কারণই নেই। আমাদের গাড়ির ড্রাইভার আবিদ। পেছনে চাঁদ, চিনা। আমি নীরু সামনে। মাঝে কনিষ্ক, বটা, অনিকেত।

ভেঁদোদা ভজু কোন গাড়িতে রে। আবিদের দিকে তাকালাম।

নেপলার গাড়িতে।

ওই গাড়িতে কারা কারা ঢুকেছে।

তোর পুরনো সখীরা। বটা বললো।

হারামী। নীরু বলে উঠলো।

তোর আবার কি হলো!

দেখলি না। কনিষ্ক হারামী চাঁটা মারলো।

পেছন ফিরে তাকালাম। একটা সিগারেট দে। সকাল থেকে পেটটা ফুলে গেছে।

কখন উঠলি?

ঘরি দেখিনি।

কনিষ্ক সিগারেট দিল। ধরালাম।

তোরা আগে আগে চলে এলি?

বড়োমা খেদিয়ে দিল। তোরা গিয়ে সমস্ত ব্যবস্থা কর। এতো লোক যাবে ওখানেই তিন ঘণ্টা কেটে যাবে। তার থেকে এক ঘণ্টা যদি বাঁচে।

তোরাও আছিস।

আবিদ নিস্তব্ধে গাড়ি ছুটিয়ে চলেছে।

চাঁদ।

কোনও সারা শব্দ পেলাম না। বাধ্য হয়ে পেছন ফিরে তাকালাম।

কিরে ডাকছি শুনতে পাচ্ছিস না।

চাঁদ আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

চাঁদ কথা বলবে না। আবিদ বললো।

কেন! আমি আবিদের দিকে তাকালাম।

কাল থেকে পড়াশুন করছে।

কি পরীক্ষা দেবে।

কনিষ্ক খুব জোর হেসে উঠলো।

তোরা এতো হাসছিস কেন বলতো।

নেকু তুমি জানো না। নীরু আমার থুতনিটা ধরে নেড়ে দিল।

কাল তুই যা ফর্মা দেখালি, চাঁদের ফিলামেন্ট উড়ে গেছে। বটা বললো।

তোরা যা শুরু করেছিস।

যা চোলে, আমরা কোথায় শুরু করলাম! কালকে কারুর খাওয়ার হজম হয়নি। সবার বদহজম। নীরু বললো।

আমি কনিষ্কর দিকে তাকিয়ে হাসছি।

চাঁদ হাসতে হাসতে মুখ ঘুরিয়ে নিল।

রতনরা বলেছে তোর সঙ্গে এবার থেকে কম কথা বলবে। কনিষ্ক হাসছে।

নেপলার ডায়লগটা দে। নীরু বললো

ও হ্যাঁ নেপলা বলেছে, বুঝলি রতনদা রাঘবন স্যারের মতো লোক যদি এক ধাক্কায় এতটা ধ্বসে যায়। আমরা অনিদার ফুঁয়ে স্পেসে চলে যাব। কোনও ফুয়েলের দরকার লাগবে না।

কনিষ্ক বলার সঙ্গে সঙ্গে তারস্বরে সকলে হেসে উঠলো।

বল না তুই সত্যি চেয়েছিস। নীরু আমাকে খোঁচা মারলো।

কি?

ওই যে হাজার কোটি?

তোর বিশ্বাস হয়?

বিশ্বাস হয় না বলি কি করে, অতোবড়ো একজন মান্যিগন্যি মানুষ, সবার সামনে ওই রকম ভাবে রসিয়ে রসিয়ে গল্প করতে পারে?

আমি ভিউইং গ্লাসে চোখ রাখলাম।

কালো রাস্তাটা অলসভাবে চিৎপাত হয়ে শুয়ে আছে। সামনের দিকে পর পর লাইন দিয়ে গাড়ি চলছে। বেশ লাগছে। আজকে গরমটা বেশ পড়েছে। কেমন যেন ভেপসানি ভাব। মনে হয় ময়েশ্চারটা বেড়ে গেছে। এখন কালবৈশাখীর সময়। বিকেলের দিকে হয়তো ঢালবে।

কিরে চুপ করে গেলি।

কি বলবো।

তারমানে ঘটনাটা সত্যি।

সত্যি নীরুদা, তুমি না কি…। আবিদ স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখেই বললো।

কালকের সিনপসিসটা শুনেও তোমার বিশ্বাস হয় না। আর এই লাইনে যারা আছে তারা কম বেশি ভিখারামের নাম শুনেছে। আমাদের দম নেই ওনার কাছে পৌঁছবার।

কেন?

কোটি টাকাকে উনি লাখ টাকা হিসাবে গোনেন।

বটা খিক খিক করে উঠলো।

হ্যাঁ-গো বটাদা। দাদাভাই এতদিন লাইনে আছে অনেক চেষ্টা করেছে, চেইন করে উঠতে পারেনি। তাহলে আমরাও কিছু ব্যবসা করতে পারতাম।

পারেনি কেন?

শুনেছি ইয়ার্লি তিন-চারশো টার্নওভার না হলে উনি এনটারটেন করেন না।

কিরে কনিষ্ক কিছু শুনছিস!

কনিষ্ক নীরুর দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমি রাস্তা দেখছি।

অনিদার সঙ্গে ওনার যে পরিচয় আছে সেটা কালকে প্রথম শুনলাম।

পরিচয় আছে মানে! নীরু চেঁচিয়ে উঠলো।

ও টাকা চেয়েছে উনি এইট্টিথ্রি পার্সেন্ট পর্যন্ত ডান করেছেন। বাকিটা নিগোশিয়েশনের পর্যায়ে। এতো টাকা জীবনে কোনওদিন চোখে দেখি নি। ইহ জীবনে আদৌ দেখবো কিনা জানি না। গল্প শুনেছি। আর অনি….।

নীরু সাবধান এবার থেকে অনির সঙ্গে টেঁ-ফুঁ করলেই লাখ আর কোটি গিলিয়ে দেবে। বটা বললো।

সবাই জোড়ে হেসে উঠলো। আমিও হাসছি।

শালা গল্পের গরু গাছে উঠতে শুরু করেছে। আমি বললাম।

ঠিক আছে তুই বলে দে রাঘবন কাল যা বলেছে তা সব গল্প আমরা চুপ করে যাচ্ছি।

ও তোরা বুঝবি না।

শালা ঢেমনা। হারামী….। নীরু চিবিয়ে চিবিয়ে আরও কতো কথা বলে উঠলো।

সামনের গাড়িগুলো সব লেফ্ট টার্ন নিচ্ছে তারমানে আমরা নার্সিংহোমে পৌঁছে গেছি।

কিরে সব গাঁড়ি বাঁদিকে টার্ন করছে, আমরা পৌঁছেগেলাম নাকি। কনিষ্ক বললো।

হ্যাঁ। মাইরি অনি সাধে তোকে লোকে গুরু বলে। তুই চুপ-চাপ থাকিস, মাঝে মাঝে ঘুপ-ঘাপ এমন চালাস তল খুঁজে পাই না, সব কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যায়।

নীরু আমার কাঁধটা ধরে জোরে ঝাঁকুনি দিল।

বুঝলি অনি, নীরু সত্যি সত্যি এখনও পুরো ব্যাপারটা ঠিক হজম করতে পারে নি। বটা বললো।

আবিদ এখানে দাঁড়াবার কোনও ব্যাপার আছে নাকি? কনিষ্ক বললো।

ম্যাডাম মনে হয় মাসীমনিকে নিয়ে একবার ভেতরে যাবে।

আমরা সবার শেষে। টার্ন নিয়েই দেখলাম রাস্তার বাঁদিকে সবাই লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে।

অগত্যা আমরাও দাঁড়িয়ে পড়লাম।

মিত্রা গাড়ি থেকে নেমে আমাদের গাড়ির দিকে আসছে।

নীরু কনুই দিয়ে গোঁতা মারল। আমি ওর দিকে তাকালাম।

নাম।

দাঁড়া না কি বলে আগে শোন।

কি আবার বলবে, শুনলি তো।

মিত্রা এসে দরজার কাছে দাঁড়িয়েছে।

আমি জানলার কাঁচটা নামালাম। একঝলক গরম হাওয়া আমাকে গ্রাস করলো।

ভেতরে এসি চলছিল। গরমটা ঠিক মালুম পাইনি।

নাম।

আমি মিত্রার দিকে তাকিয়ে।

কেন?

মাসীমনিকে একবার দেখাবি না।

কেন ঝামেলা বাড়াচ্ছিস।

মাসীমনি তোকে নামতে বলছে।

ফেরার দিন দেখাস। এমনি বেলা হয়ে গেছে। পৌছতে দেরি হয়ে যাবে। তারপর ঝড় বাদলের সময়। মাঝ রাস্তায় হঠাৎ শুরু হয়ে গেলে গণ্ডগোল।

তুই নাম।

বাধ্য হয়ে দরজা খুলে নেমে এলাম।

নীরু খিক খিক করে হেসে উঠলো।

কিছু পেলে। মিত্রা, নীরুর দিকে তাকিয়েছে।

এতো সহজ। সাধিতে সাধিতে কৃষ্ণ যদি কৃপা করে।

আমি নীরুর দিকে তাকিয়ে হাসছি।

ম্যাডাম গরম জলের ব্যবস্থা হলো।

সুন্দররা গেল। নেমে দেখো ওরা কি বলে।

আমি মিত্রার পাশে পাশে হাঁটতে শুরু করলাম।

বড়োমার গাড়ির পাশে এসে দাঁড়াতেই বৌদি জানলা দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো।

এই ছাগল, দাঁড়া তোর হচ্ছে।

ছোটোমা, সোনাআন্টি বৌদির কথা শুনে হাসছে।

চা খাবে?

খাওয়াবি।

বলো না, এখুনি আবার তোমার কাছে  পঞ্চাশ টাকা ধার চেয়ে বসবে। মিত্রা বললো।

মিত্রার কথা শুনে সকলে জোরে হেসে উঠলো।

বলো ছোটোমা, আমি ঠিক বললাম কিনা। মিত্রা মুচকি মুচকি হাসছে।

রুমাদিকে নিয়ে ভেতরে যাবি। বৌদি বললো।

মাসীমনিকে বললাম, বললো অনিকে ডাক।

এখন থাক, ফেরার সময় তো এখানে দাঁড়াতেই হবে। তখন নয় একটু বসে যাব।

মিত্রা আমার দিকে তাকাল।

কিরে মন খারাপ হয়ে গেল। বৌদি বললো।

না।

ঠিক আছে যা ঘুরিয়ে আন। বেশিক্ষণ সময় নিস না।

চলবে —————————–



from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/8eV5YIN
via BanglaChoti

Comments