কাজলদিঘী (১৪৩ নং কিস্তি)

❝কাজলদীঘি❞

BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

১৪৩ নং কিস্তি
—————————

ওরা নড়ে চড়ে বসার আগেই টেবিলের ওপর আধা ঠাণ্ডা চা এক চুমুকে খেয়ে উঠে দাঁড়ালাম।

ছোটোমা বলে উঠলো, এটা কি করছিস? আমি এক কাপ বানিয়ে দিতে পারতাম না।

অনিমেষদা বললো, কোথায় যাচ্ছিস?

আসছি, একটু কাজ আছে।

দাঁড়ালাম না। সোজা বেরিয়ে এলাম।

মেয়ে বাগানে দাঁড়িয়ে হেসে হেসে কথা বলছে। আমি ঘরে এসে ঢুকলাম।

সুন্দর, অনন্য, শুভ বসে বসে কথা বলছে।

আমাকে দেখেই তিনজনে উঠে দাঁড়াল।

বোস বোস।

শুভবাবু অনেকদিন পর তোমার মুখ দেখলাম।

শুভ মাথা নিচু করে আছে।

দাদু ভালো আছে?

মাথা দোলালো, ভালো আছে।

আমি টেবিলের ড্রয়ারটা টেনে পুরনো মানিপার্টস থেকে আমার আলমাড়ির চাবিটা বার করে আলমাড়িটা খুললাম। টেবিলের ওপর থেকে হলুদ ফাইলটা আলমাড়িতে রাখলাম।

অনন্য দেখতো নেপলা আঙ্কেল আছে নাকি, মাকে একবার ডাক।

আমি একটা জিনসের প্যান্ট জিনসের জামা বার করলাম।

দেখলাম তিনজনেই উঠে গেল।

আলমাড়ি বন্ধ করে চাবিটা যথাস্থানে রাখলাম।

বাথরুমে চলে গেলাম।

বেরিয়ে দেখলাম তনু, মিত্রা দুজনেই আমার খাটে বসে, সোফায় ইসি। তিনজনেই আমার মুখের দিকে তাকাল।

কিরে হঠাৎ তোর মুডটা অফ হয়ে গেল।

আমার মুড অফ! কে বললো?

ওই রকমভাবে উঠে চলে এলি।

বাথরুম পেলেও ধরে বসে থাকবো।

তনু, ইসি ফিক করে হেসে ফেললো।

তুই আমাকে বাথরুম শেখাচ্ছিস।

দেখ, এসেই কিন্তু শুরু করে দিয়েছিস।

কে শুরু করলো, তুই না আমি। জামা প্যান্ট কে বার করেছে?

আমি।

কোথায় যাবি?

মহা মুস্কিল।

কেন, বলতে অসুবিধে আছে?

বোস, আমি জামা-প্যান্টটা পরে নিই।

আমি নিচু হয়ে জামাপ্যান্টটা নিতে যেতেই মিত্রা আমার হাত থেকে জামাপ্যান্টটা ছিনিয়ে নিল।

কোথায় যাবি আগে বল?

আমার সঙ্গে চল দেখতে পাবি।

ছোটোমা কষ্ট পেয়েছে তুই ঠাণ্ডা চা খেলি।

ছোটোমা কি ঠাণ্ডা চা দিয়েছিল?

গিয়ে বোঝাতে পারছিস না। মিত্রা চেঁচিয়ে উঠলো।

জামাপ্যান্টটা পড়ে নিই তারপর গিয়ে বোঝাচ্ছি।

আমি ওর হাত থেকে জামাপ্যান্টটা নিয়ে বাথরুমে যেতে গেলাম।

এখানে পর, আমরা বেরিয়ে যাচ্ছি।

বেরতে হবে না। আমি তোদের সামনেই পরে নিতে পারি।

অনেক করেছো। আর করতে হবে না। তনু বলে উঠলো।

আমি হাসছি।

ওরা তিনজনেই উঠে দাঁড়িয়ে গেটের কাছে গেল।

মিত্রা শোন।

আবার কি হলো।

তোকে যে কথাটা জিজ্ঞাসা করবো বলে ডাকলাম, সেটাই বলা হয় নি।

তনু হাসছে। মিত্রা কাছে এগিয়ে এলো। ওরা দাঁড়িয়ে।

আমার ফ্ল্যাটের চাবি কার কাছে?

মিত্রার চোখ দুটো ছোটো ছোটো হয়ে গেল।

কি হলো, তাকিয়ে দেখছিস কি, কানে কথা যায় নি?

তুই হঠাৎ ফ্ল্যাটের চাবির খোঁজ করছিস!

একটু দরকার আছে।

দরকারটা কি আগে বল।

চল আমার সঙ্গে দেখতে পাবি।

ঠিক আছে তুই রেডি হয়ে আয়।

নেপলা গেটের সামনে এসে দাঁড়াল।

ডেকেছো।

হ্যাঁ। ঘণ্টা দুয়েকের জন্য একটু বেরবো। খাওয়া দাওয়া করেছিস?

দেখলাম মিত্রারা দরজার গোড়ায় থমকে দাঁড়িয়ে পরেছে।

অনেকক্ষণ, আবার খাওয়ার সময় হয়ে গেলো।

ঠিক আছে।

মিত্রা, ছোটোমাকে বল, চার-পাঁচ কাপ চা করে একটা হটফ্লাক্সে দিয়ে দিতে। আর একটু স্ন্যাক্স।

কেন যেখানে যাচ্ছি সেখানে পাওয়া যাবে না? নেপলা বললো।

দূর অতো কে ঝামেলা করবে। তার থেকে সঙ্গে নিয়ে চল।

মিত্রা, তনু হাসছে।

তুই আয় রেডি হচ্ছি।

তিন সখী না দুই সখী?

দুই সখী। ইসি বললো।

নেপলা এসে সোফায় বসলো।

আমি আলনা থেকে ড্রয়ার গেঞ্জিটা বার করে নিলাম। টাওয়েলটা কোমড়ে জড়িয়ে নিয়ে প্যান্ট আর জামাটা গায়ে চড়ালাম।

নেপলা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।

তুমি যাবে কোথায় বলো?

একটু ফ্ল্যাটে যাব।

হঠাৎ!

যা বাবা, নিজের ফ্ল্যাটে নিজে যাব তাতেও….।

সে ঠিক আছে। এতদিন পর তোমার হঠাৎ মনে পড়লো?

ব্যাটা বহুত শেয়ানা হয়েছো।

নেপলা হেসে যাচ্ছে।

রেডি হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। নেপলা পেছন পেছন বেরিয়ে এলো।

এই ঘরে এসে দেখলাম, অনুপ, অনিমেষদাদের সঙ্গে কথা বলছে। শিউলি, ঋককে দেখতে পেলাম না। হয়তো ওপরে আছে। অনুপদা, রূপায়ণদাকেও দেখতে পেলাম না।

রান্নাঘরে যেন যুদ্ধ চলছে।

গোলটেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালাম।

অনিমেষদা আমার দিকে তাকিয়ে।

তোমরা নাকি আমার ওপর খুব রেগে গেছো।

বিধানদা, মল্লিকদা হেসে উঠলো।

কেন বলতো? অনিমেষদা বললো।

মিত্রা ও ঘরে গিয়ে ঝাড়লো।

বিধানদা হাসছে।

তোর আবার এসব আছে নাকি? জানতাম না তো! অনিমেষদা বললো।

চুপ করে গেলাম।

তুই বেরোচ্ছিস নাকি? অনুপ বললো।

ঘণ্টা খানেকের মধ্যে ফিরে আসবো।

তোর সঙ্গে একটু দরকার ছিল।

ফিরে আসি। তুই তো খেয়েদেয়ে যাবি। বড়োমা নিশ্চই শুকনো মুখে ছেড়ে দেবে না।

বিকেলে তোর সঙ্গে বসবো। প্রবীরকে বলেছি সময় বার করে নিতে। অনিমেষদা বললো।

আজই বসতে হবে?

প্রাথমিক একটা আলোচনা সেরে নিতে চাই। আমার একটা মান সম্মান আছে।

তোমার কোথায় সম্মানহানি হয়েছে আমাকে বলো?

তোকে বলতে পারবো না।

মিটিংটা বিকেলে নয় রাতের দিকে করো।

কটার সময় বল।

সন্ধ্যের পর। সাতটা সাড়ে সাতটা।

আমি তাহলে অনুপকে বলে দিচ্ছি।

বলে দাও।

রান্নাঘরের সামনে এলাম।

বড়োমাকে দেখতে পেলাম না। ছোটোমা, বৌদি, দামিনীমসি গুঁতোগুঁতি করছে।

সোজা ঢুকে পরলাম, দেখলাম ছোটোমা মাছের ডিমের বড়া ভাজছে।

তুই কোথায় ঢুকছিস রে—বৌদি তেড়ে উঠলো।

আমি ছোটোমার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম।

একবারে হাত দিবি না। গরম খুন্তির ছেঁকা দিয়ে দেব। বৌদি বললো।

ছোটোমা স্নেহভরা চোখে আমার দিকে তাকালো।

তুমি বললে শুনবে, রেওভাট কোথাকার। ছোটোমা বললো।

ছোটোমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলাম।

চা বানিয়েছ?

কেন?

তোমাকে মিত্রা কিছু বলে নি!

ছোটোমা একটা বড়া তুলে নিয়ে আমার মুখে দিল।

বললো, ঘণ্টা খানেকের জন্য বেরবি। চায়ের কথা কিছু বলে নি!

ওকে যে বললাম ছোটোমাকে বল গোটা পাঁচকাপ চা বানিয়ে দিতে।

তাহলে দিদি বানাচ্ছে।

বৌদি—সুরো, পুঁচকে দুটোকে ধারে কাছে দেখছি না।

সব ওপরে। যা শুরু করেছিল।

মাসি কতটা খালি করলে?

একটুও করি নি। তুই ছোটোকে, দিদিকে জিজ্ঞাসা কর।

শুধু ফিচলেমি না।

ছোটোমা কান ধরতে গেল। আমি একটু জোড়ে জড়িয়ে ধরলাম।

উঃ পেট ফেটে যাবে।

তাহলে কান ধরতে গেলে কেন?

মিত্রা তনু এসে রান্নাঘরের সামনে দাঁড়ালো।

দেখ তনু ছোটোমাকে কি পরিমাণ তেল মারছে।

দুজনেই বেশ সুন্দর শালোয়াড় পড়েছে। আমি মুচকি মুচকি হাসছি।

ছোটোমা ওদের দিকে তাকাল, তারপর আমার দিকে। আমি ইসারা করলাম। ঝাক্কাস।

কি বলছেগো ছোটোমা। মিত্রা চেঁচিয়ে উঠলো।

এতেও তোর অসুবিধে! ছোটোমা আমার দিকে তাকাল।

আমার কেন অসুবিধে হবে।

তাহলে ওরকম বিটকেল মার্কা হাসি কেন।

ছোটোমাকে চায়ের কথা বলেছিলি। মিত্রার দিকে তাকালাম।

এই যা ভুলে গেছি।

তোরাও আছিস। বৌদি বললো।

হুঁ হুঁ, বুঝেছি। সাজুগুজুর পেছনে সময় দিলি। কে দেখবে বলতো?

কেনো, তুই আছিস কি করতে। বৌদি ঝাঁঝিয়ে উঠলো।

তনু হাসছে।

মাসি। আমি বললাম।       

আমাকে আবার এর মধ্যে টানছিস কেন।

টানছি না। তোমার হাতে ভালো ছেলে আছে।

কি হবে?

তাহলে তোমার মামনির একটা বিয়ের ব্যাবস্থা করতাম।

হ্যাঁরে, তোর সখ থাকলে তুই করগে যা। মিত্রা খেঁকিয়ে উঠলো।

ওরে চুপ চুপ, ওরা সব বসে আছে। বৌদি বললো।

ওকে কিছু বলতে পারছো না।

আমি হাসছি। তনু ফিক ফিক করছে। ছোটোমা হাসছে।

মামনি, দিদির ঘর থেকে ফ্লাক্সটা একটু আনতো। মাসি বললো।

তুমি চা বানিয়ে ফেললে! মাসির দিকে তাকালাম।

কথা বলিস না।

মিত্রা বড়োমার ঘরের দিকে গেল।

আমি তখনও ছোটোমাকে জড়িয়ে ধরে আছি।

ছোটোমা।

বল।

সকাল থেকে বুঁচকি ম্যাডামকে খুব ব্যস্ত দেখতে পাচ্ছি।

বনিদের সঙ্গে আছে। ওদের নিয়ে বেরবে। বৌদি বললো।

কোথায়?

কলকাতা দেখাতে। ওরা আজ-কাল-পর্শু থাকবে। পর্শু রাতের ফ্লাইটে ফিরে যাবে।

ছোটোমা।

কিরে!

তনুর কথায় ছোটোমা তাকাল, আমিও তাকালাম।

একটা টিফিন কৌটে কয়েকটা তুলে দাও না। ওখানে গিয়ে খেতাম। ও তো এক ঘণ্টা বলছে কতক্ষণ থাকতে হবে কে জানে।

ছোটোমা হেসে ফেললো।

বৌদি তাকিয়ে আছে তনুর দিকে।

তনু মুচকি মুচকি হাসছে।

আমার কাছে কিছু হবে না ভাগ।

বেশি না চারটে দাও। তুমি যে ভাবে ভাজছো। জিভ থেকে জল পড়ে যাচ্ছে।

পরুক।

দুপুরে একটা করে কম দেবে।

আচ্ছা তোরা কি সবাই অনি হয়েগেছিস।

ও তো শিখিয়েছে।

বৌদি আমার দিকে তাকাল।

দিয়ে দাও, নাহলে আবার শরীর খারাপ করবে।

বৌদি হাসছে।

দামিনীমাসি সব গুছিয়ে দিলো। বড়োমার সঙ্গে একবার দেখা করে বেরিয়ে এলাম।

গাড়িতে ওঠার সময় মিত্রাকে বললাম, চাবি নিয়েছিস?

ফ্ল্যাটের চাবি নিয়েছি। তোর আলমাড়ির চাবি নিই নি।

ওটা আলাদা করে বলিনি বলে।

নেপলা হাসছে।

মেয়ের কাছে আছে।

নেপলা অনিসাকে ডাক?

নেপলা ওখানে দাঁড়িয়ে মেয়ের নাম ধরে চেঁচিয়ে উঠলো। তিন চারবার ডাকার পর মেয়ে বারান্দায় এসে মুখ বারালো।

কোথায় যাচ্ছ?

মিত্রা হাত নেড়ে নিচে ডাকলো।

অনিসা নিচে নেমে এলো।

বাবা, তুমি মাদের নিয়ে কোথায় যাচ্ছ?

একটু ফ্ল্যাটে যাব। আলমাড়ির চাবিটা দে।

আমি যাব।

মিত্রা আমার মুখের দিকে তাকাল।

তুই তো বনিদের নিয়ে বেরবি।

সে তো বিকেলে। দাঁড়াও আসছি।

মেয়ে দৌড়ে ভেতরে গেল।

কিছুক্ষণ পর দেখলাম বনি, নাগেশও ওর সঙ্গে চলে এসেছে।

বেশ একা একা কেটে পরছো না। বনির চোখে-মুখে দুষ্টুমি।

তোরা কলকাতা দেখতে বেরবি।

দুপুরে খাওয়ার পর। এতক্ষণ কি করবো?

পিপটু কোথায়?

ও এখন মাম্পি, মিকিদের সঙ্গে খেলা করছে। আসবে না।

মেয়ের দিকে তাকালাম।

যা দিদানকে বলে আয়। নাহলে খোঁজা খুঁজি করবে।

মেয়ে আবার দৌড়ে ভেতরে গেল।

আমি সামনের সিটে উঠে বসলাম। ওরা মাঝের সিটে উঠে বসলো। মেয়ে এসে আমার পাশে সামনে বসলো।

গাড়ি ছাড়তে পেছনে ফিরে দেখলাম, বড়োমা, জ্যেঠিমনি, বৌদি, ছোটোমা, দামিনীমাসি বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাসছে।

ছোটোমা চেঁচিয়ে উঠলো, কিরে তনু কম পরে যাবে না?

তনু হাত নাড়লো। না।

গেট থেকে বেরবার মুখে নেপলা ব্রেক কষলো।

ইসলামভাই গাড়ি নিয়ে ঢুকছে। পাশে ইকবালভাই বসে। গাড়িটা সাইড করে নেমে এলো।

কোথায় যাচ্ছিস?

মেয়ে জানলা দিয়ে মুখ বারিয়ে বললো, বাবার বাড়ি।

ইসলামভাই সারাটা শরীর কাঁপিয়ে হেসে উঠলো।

তোর আবার বাবার বাড়ি আছে নাকি?

ফ্ল্যাটে।

আমার দিকে তাকালো।

তোকে এরা বেশ প্যাঁচে ফেলে দিয়েছে মনে হচ্ছে।

কি করা যাবে। বসো ঘণ্টা খানেক বাদে আসছি।

নেপলা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে এলো। গড়িয়াহাট হয়ে পৌঁছতে মিনিট সাতেক সময় নিলো।

নেপলা হর্ন বাজালো। সিকুরিটি গার্ডের ছেলেটা গেটের দরজা খুললো। যে দরজা খুললো তাকে চিনি না। নেপলা গাড়ি ভেতরে নিয়ে এলো। নেমে দাঁড়ালাম।

অনেকদিন পর আসছি। কিছুই চেনা চেনা ঠেকছে না। সব কেমন অপরিচিত। সিকুরিটি গার্ডের সেই ছেলেটাও নেই। এখন দেখছি নতুন মুখ। মিত্রাকে দেখে সেই ছেলেটা সেলাম মাইজি বললো। অনিসাকে দেখে ওর হাত থেকে ব্যাগটা নিলো।

বুঝলাম এই দুজনকে এই ছেলেটা বিলক্ষণ চেনে।

কাজের লোক আসছে। মিত্রা ছেলেটাকে জিজ্ঞাসা করলো।

হ্যাঁ মাইজি, প্রত্যেকদিন এসে পরিষ্কার করে দিয়ে যায়।

এ মাসের পয়সা দিয়ে দিয়েছো।

হ্যাঁ মাইজি।

সব কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। ঘর পরিষ্কার করার লোক? সেটা আবার কোথা থেকে এলো!

প্রায় কুড়ি বছর পর আসছি। আমার মতো তনুও চারদিক চেয়ে চেয়ে দেখছে। আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।

আসা যাওয়ার পথে অনেক নতুন মুখ মিত্রাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ছে, কথা বলছে। এরা সব ফ্ল্যাটের বাসিন্দা। মিত্রা একে একে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। আমি এগিয়ে গেলাম।

এক সময় আমিই এখানে আসতাম। কখন আসতাম কখন যেতাম কেউ জানত না। শুধু গেটের সকাল সন্ধ্যের সিকুরিটির ছেলেদুটো আমাকে চিনতো।

ওরাই জানতো আমি কে। বুঝলাম মা, ময়ে এখানে বেশ পরিচিত। আমি অপাংক্তেয়ের মতো একপাশে দাঁড়িয়ে।

সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম।

মেয়ে পাশে। বনি এগিয়ে এলো।

তুমি আগে এখানে থাকতে? এখানকার গল্পই আমাকে বলতে?

মাথা দোলালাম।

নেপলাকে বললাম কিছু স্ন্যাক্স কিনে নিয়ে ওপরে আয়।

যা নিয়ে এসেছো তাতে হবে না।

নেপলা গাড়িটা একটা সাইডে পার্ক করে রাখলো। বেরোতে যেতে মিত্রা ডাকলো।

কোথায় যাচ্ছো?

একটু কিছু কিনে নিয়ে আসি।

তোমাকে যেতে হবে না।

তারপর সেই গেটের ছেলেটিকে বললো, তুমি একটু ওপরে এসো।

আমি সিঁড়ির দিকে হাঁটা লাগালাম।

লিফ্টে উঠবে না? মেয়ে হাত ধরলো।

কেন? মেয়ের দিকে তাকালাম।

চারতলায় হেঁটে উঠবে?

কষ্ট হবে।

আমি কোনওদিন উঠি নি।

মেয়ে হাসলো।

তুই বরং মাকে নিয়ে লিফ্টে আয়, আমি হেঁটে উঠি।

বনি আমার কথা শুনে হাসছে।

মা-রা বরং লিফ্টে আসুক আমি তোমার সঙ্গে হেঁটে উঠি।

দু-জনে ওপরে উঠে এলাম।

ঘরের বাইরে একটা কোলাপসিবল গেট। দরজায় দেখলাম নেমপ্লেটে মেয়ের নাম।

মেয়ের মুখের দিকে তাকালাম। হাসছে।

এটা এখন আমার ফ্ল্যাট, তোমার নয়।

বনি হাঁপিয়ে গেছে।

তুই লিফটে উঠতে পারতিস।

এক্সপিরিয়েন্স করলাম।

শুধু শুধু শরীরকে কষ্ট দিলি।

বনি হাসছে।

মিত্রারা চলে এলো।

তনু আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।

হাসছিস কেন? মিত্রা বললো।

তোমায় কিছু বলে নি?

নিজ থেকে কোনওদিন কিছু বলেছে।

মেয়ে মায়ের কাছ থেকে চাবি নিয়ে গেট খুললো।

ভেতরে এলাম।

আমার সেই বেতের চেয়ারের সোফা এখনও আছে। পালিশ করা ঝকঝকে। নতুন সংস্করণ তাতে গদি লাগানো হয়েছে। ঘরের রং বদলেছে। একটা ছোট্ট মিটসেফ আছে দেখলাম।

কাছে গিয়ে দেখলাম বই-এ ঠাসা। চারিদিক বেশ ঝকঝকে তকতকে।

দেয়ালের একপাশে আমার একটা কম বয়সের ছবি। সব কিছু যেন নতুন করে চিনছি।

কে থাকে এখানে? মিত্রার দিকে তাকালাম।

গেটে নাম দেখিস নি?

মেয়ে বললো।

তোর মেয়ে কমবেশি রেগুলার একবার এখানে আসে।

নেপলা গিয়ে ঘরের জানলা খুলে দিয়েছে।

জানেন ম্যাডাম এই ঘরে আমি মাত্র একবার এসেছিলাম।

কবে?

যেদিন রাজনাথের এ্যাকসান হলো। দাদাভাইকে নিয়ে এই ঘরে এসে কিছুক্ষণ ছিলাম। তার আগে অনিদাকে মাত্র কয়েকদিন দেখেছি। দলে নতুন এসেছি। সকলে সেইভাবে চিনতও না। অনিদার নাম শুনেছি, চোখে দেখি নি।

নেপলা ভাইয়া হিন্দীমে বলিয়ে। বনি বলে উঠলো।

নেপলা যে বলেছিল তা আবার হিন্দিতে তর্জমা করলো।

যেদিন ডাক্তারের সঙ্গে অনিদার বোঝাপড়া হলো, সেদিন রাতে দাদাকে প্রথম দেখলাম।

বিশ্বাস হচ্ছিল না। দাদার মতো লোক আমাদের সঙ্গে মিশতে পারে!

সাট্টার স্লিপ লিখছিলাম শেয়ালদা স্টেশনে বসে। রতনদা ফোন করে বললো, এখুনি চলে আয়। জায়গা বলে দিল।

তখন আমি সার্কিটে রতনদা, আবিদদা আর ওমরকে ছাড়া কাউকে চিনি না। সাগির, অবতারের নাম শুনেছি স্টেশন চত্বরে, চোখের দেখা কখনও দেখি নি।

শুনেছি রতনদার এগেনস্টে নতুন দল করেছে। চমকা চমকি তো ছিলই। আমাকে হাপিস করে দেবে। সেয়ানা লাইনে যা হয় আর কি। নুঙ্গিতে ওদের ভাল টিম ছিল। সেদিন রাতে প্রথম সাগির, অবতারকেও দেখলাম।

সেই রাতে দাদার রূপ দেখলাম। যে দাদাভাইয়ের মুখের ওপর আমরা কোনওদিন কথা বলতাম না। ধমক দিলে প্যান্ট নষ্ট হয়ে যেত, সেই দাদভাইকে দাদা ধমক লাগাচ্ছে।

দাদার চোখে আগুন, মুখটা বরফের মতো ঠাণ্ডা।

কবিতাদি এলো। মাসি এলো। আমি সবাইকে সেদিন প্রথম দেখলাম।

দাদা, মল্লিকদা, হিমাংশুদা, নিরঞ্জনবাবুকেও সেদিন প্রথম দেখলাম। সব এখনও আমার চোখের সামনে ছবির মতো ভাসছে।

সেদিন একটা কথা খুব ভাল করে বুঝেছিলাম। দাদা শুধু দাদাভাইয়ের কাছের মানুষ নয়। দাদার সঙ্গে দাদাভাইয়ের একটা অন্যরকম রিলেশন আছে। কেন জানিনা দাদার চলাফেরা কথাবার্তা ভীষণ ভালো লেগে গেল।

সেই রাতে আমার ডিউটি ছিল গাড়িতে বসে বাড়ি পাহাড়া দেওয়া। দিচ্ছিলাম। দাদা বাড়িতে একা। হঠাৎ দাদা ছগনদাদাকে ডেকে পাঠালো। তারপর নিচে নেমে এলো। গাড়ির কাছে আসতে কাঁচটা খুললাম। বললো, তোরা ঘরে গিয়ে শুয়ে পর। আমার কিছু হবে না। তোদের এতো টেনশন নেওয়ার দরকার নেই।

আমাদের মতো পথের ছেলেকে কজন এরকম করে বলে বলো।

তার আগে কবিতাদিকে দাদার পা ধরে কাঁদতে দেখেছি। দাদা নাকি কবিতাদির ছেলের মুখে ভাতে খেতে গেছিল। দাদা নাকি কবিতাদির বিয়ে দিয়েছে। ব্যাটা ভিকি। আমার কাছে সব কেমন যেন গল্প গল্প বলে মনে হলো।

কবিতাদি সাগিরকে লাথি মেরে দাঁত ভেঙে দিল। আবিদদার সে কি বেধড়ক মার।

আর সেই দিনের কথা তো জীবনে ভুলবো না।

ছট্টুর মুখে ঠাসিয়ে একটা থাপ্পর মেরে যখন বললো নেপলা এখুনি দড়ি আর লিউকোপ্লাস নিয়ে আয়। তখন আমার নিজেরই হাত-পা কাঁপছে।

মেয়ে দেখলাম নিজের অসতর্কে আমার হাতটা চেপে ধরেছে।

ওদের চোখে মুখে বিষ্ময়।

ছট্টু প্রাণপনে দাদার পা ধরে বলে চলেছে তুমি আমাকে মেরে দিও না। আমি আর কোনওদিন বেইমানি করবো না। আমি জানি তুমি ঘোষদাকে নিয়ে আসবে।

কে ঘোষ? দাদা কেন ছট্টুকে মেরে দেবে? দাদা আদৌ কাউকে মারতে পারে! বিশ্বাসই হচ্ছে না!

তারপর রতনদার দিকে তাকিয়ে গর্জে উঠলো, আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত একটাও কেউ এখান থেকে নরবি না। তাহলে কুত্তার মতো মেরে দেব।

রতনদা, আবিদদা ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপছে। দাদার সে কি চোখের চাউনি।

আমাকে বললো আমার সঙ্গে চল। তখন আমার ভয়ে আত্মারাম খাঁচা।

আমাকেও হয়তো মেরে দেবে। তবু দাদাকে বাইকের পেছনে বসালাম।

ট্রাম ডিপোর কাছে এসে মানিপার্টস থেকে চাবি বার করে বললো, এখুনি ইসলামভাইকে দিয়ে আয়। আজ রাতে আমার ঘরে থাকবে। কথার নড়চড় যেন না হয়। একটা ট্যাক্সি ধরে ভেগে গেল, বেকবাগানের দিকে।

আমি দাদাভাইকে ফোন করে সব বললাম।

দাদভাই বললো, তুই ওইখানে দাঁড়িয়ে থাক। আমি এখুনি আসছি।

রতনদাকে বললাম। রতনদা বলে আমার মাথা কাজ করছে না। অনিদা আজ একটা অঘটন ঘটাবে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাঁচটা সিগারেট খেয়ে ফেললাম।

দাদাভাই এলো সঙ্গে দাদাভাইয়ের বডিগার্ড নুরুলদা। আমি সব বললাম।

দাদভাইয়ের মুখটা কেমন থম থমে হয়ে গেল।

বুঝলাম দাদাভাইও কিছু একটা আঁচ করেছে। অনিদাকে ফোন করলো।

সে কি ঝাড়গো, বোঝাই যাচ্ছে না অনিদার গলা। দাদাভাই কতো করে বললো, তুই আমার ভাই, আমি তোর পায়ে ধরছি।

কে কার কথা শোনে। শুধু বললো, আমার কাজ আমাকে করতে দাও, কেউ যেন আমাকে ডিস্টার্ব না করে।

দাদাভাই কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলো।

বুঝলাম দাদাভাইয়েরও মাথা কাজ করছে না।

নুরুলভাই কাকে কাকে যেন ফোন করলো। তারপর বললো, ইসলামভাই আজ অনিদার দিন, তুমি অনিদাকে আটকাতে পারবে না। তাহলে একটা অঘটন ঘটবে।

দাদাভাইয়ের মুখটা শুকিয়ে গেল।

এর ঠিক আধাঘণ্টার মধ্যে দেখলাম ছ-খানা জিপসি গাড়ি গলিদিয়ে ঢুকলো। ঝুপড়ির কাছে এসে একটা জিপসি দাঁড়ালো। চারজন নামলো। হাতে কারবাইন। এক একটার কি চেহারা। সবার গায়ে অ্যাসকালারের সাফারি, আমরা সবাই তখন নিঃশ্বাস বন্ধ করে পাশের ঝুপড়ি দিয়ে উঁকি মেরে দেখছি।

ঝুপরিতে ঢুকে একজন ছট্টুকে কলার ধরে তুললো, যেন মনে হলো একটা বাচ্চা ছেলেকে টেনে তুললো।

মুখের ফেট্টিগুলো এক হ্যাঁচকায় টান মেরে খুলে দিল। হাতের বাঁধন খুলতেই ছট্টু চেঁচিয়ে উঠলো। তারপর পাঁজরায় একটা ঘুঁসি। শুধু একটা অঁক করে আওয়াজ হলো ছট্টু কেমন ঝিমিয়ে পড়লো। তখন আমার হাত-পা সব ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।

অর্কদা, সায়ন্তনদাকে সেদিন প্রথম দেখলাম। সায়ন্তনদা শুধু ছবি তুলেই চলেছে।

ওরা বেরিয়ে গেল।

অনিদাকো নেহি দেখা! বনি বললো।

না।

দাদাভাই আমাকে বললো, তুই আমাকে অনির ফ্ল্যাটে নামিয়ে দে। রতনদা, আবিদদাকে বললো এখন যেখানে পারিস চলে যা। সন্ধ্যের দিকে দাদার বাড়ি আয়।

তারপরের ঘটনা তুমি জানো।

তোমার পায়ে ধরে তিনজনে মিলে কতো কেঁদেছি। দাদাভাই কঁদেছে। মাসি কেঁদেছে। তুমি অনিদাকে ফিরিয়ে আনো। তুমি কিন্তু সেদিন পাশ করো নি, ফেল করেছিলে।

সবাই কেমন যেন একটা ঘোড়ের মধ্যে ছিল এতক্ষণ।

মিত্রা, তনু, বনি আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে। নাগেশ খাটে বসে পড়েছে। মেয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে।

তোর গল্পবলা শেষ?

নেপলা আমার দিকে তাকাল।

বেশ বাড়িয়ে বাড়িয়ে গুছিয়ে বলতে শিখেছিস।

তুমি নিজে বলো একটা লাইনও বাড়িয়ে বলেছি।

নে, ফ্লাক্স থেকে চা ঢাল।

আমি দিচ্ছি। বনি এগিয়ে গেল।

বনি দাঁড়াও রান্নাঘরে কাপ-ডিস আছে। তনু বললো।

আমার আলমাড়ির চাবি দে। মিত্রার দিকে তাকালাম।

মেয়ের প্যান্টের পকেটে।

কিরে মা, ভাবছিস বাবা একটা রঘুডাকাত ছিল?

মেয়ে মুচকি হেসে মাথা দোলাল।

নে আলমাড়িটা খোল।

তুমি আমাকে আবার এনকাউন্টার করাবে না?

মিত্রা, তনু দুজনেই হো হো করে হেসে উঠলো।

দেখ মেয়ে তোকে চিনে ফেলেছে।

কেন তুই কিছু অন্যায় করেছিস। মেয়ের দিকে তাকালাম।

মেয়ে মাথা দোলাচ্ছে। করেছে।

কি করেছিস?

তোমার কাগজপত্রগুলো অগোছালো ভাবে ছিল গুছিয়ে রেখেছি।

আর কিছু?

তোমার কয়েকটা ডাইরী পড়েছিলাম এখানে এসে।

আমি মেয়ের দিকে তাকিয়ে। চোখের পলক পড়ছে না।

আমাকে জড়িয়ে ধরে ত্রস্ত হরিণীর মতো কেঁপে উঠলো।

আমাকে ছোটোমা সব বলেছে, তুমি সব জেনে ফেলেছো।

আমি তনুর দিকে বিস্ময় চোখে তাকালাম। তনু জানলো কি করে? ওর তো জানার কথা নয়।

তনু আমার চোখে চোখ রাখতে পারলো না।

মেয়ে বুক থেকে কিছুতেই মুখ তুলছে না।

ঠিক আছে তুই আলমাড়িটা খোল তোকে আরও কিছু নতুন জিনিস দেখাব।

তুমি বকবে না। মেয়ের গলাটা ধরা ধরা।

কই আমার দিকে তাকা।

মেয়ে কাঁপা কাঁপা চোখে আমার দিকে তাকাল।

হাল্কা জলে টল টল করছে চোখের মনি দুটো।

এ মা, তুই কি বোকা মেয়ে। কেন বকবো! তুই তো তোর বাবাকে অনেকটা জেনে ফেলেছিস। তোর দুই মা এতদিনে তা ও জানতে পারে নি।

মিত্রা, বনি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে এই দৃশ্য দেখে একটু অবাক। চোখের ভাষা, কি হয়েছে?

নে আলমাড়িটা খোল, তুই যেগুলো পড়ে ফেলেছিস, সেগুলো আলাদা কর, যেগুলো পড়িস নি। সেগুলো আলাদা কর।

আমি সব পড়ে ফেলেছি।

সব্বনাশ। করেছিস কি! এই বললি কয়েকটা ডাইরী পড়েছি।

মেয়ে হাসছে।

তোর মার সঙ্গে আমার ইন্টু-মিন্টু! ছোটোমার সঙ্গে আমার ইন্টু-মিন্টু!

মেয়ে এবার জড়িয়ে ধরলো।

ছোটোমাকে তুমি ভীষণ ভালোবাস, ছোটোমাও তোমাকে ভীষণ ভালোবাসে।

আমি তাই লিখেছি বুঝি।

তনু, মিত্রার চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেছে।

মা, ছোটোমাকে কিছু বলিসনি?

একটু একটু।

আর কাকে বলেছিস?

কাউকে বলিনি।

একটু ভেবে বল?

মেয়ে আমার দিকে তাকালো।

ভাইদাদাইকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করেছিলাম। ওমনি ভাইদাদাই আমাকে জেড়া করা শুরু করেদিল। আমি ভাইদাদাইয়ের সঙ্গে আর কথাই বলিনি।

এই ডাইরীগুলো পড়ার পর ভজুমামার মাথা চিবিয়েছিস?

মেয়ে হাসতে হাসতে জড়িয়ে ধরলো।

এগুলো আলমাড়ির বাইরের তাকে ছিল। ভেতরের চোরা কুঠরিগুলো।

অনেক খুঁজেছি চাবি পাইনি।

মিত্রা, তনু দুজনেই আমার দিকে টেরিয়ে টেরিয়ে দেখছে।

সব খাটে গোল করে বসে পরেছে। মাছভাজা মাছেরডিমের বড়া খাচ্ছে। চায়ে চুমুক দিচ্ছে।

ব্যাপারটা এরকম মেয়ে সব গ্যামাকসিন করেদিলরে। এবার পালিয়ে কোথায় বাঁচা যায় তার পথ বাতলে দে।

যা মার কাছ থেকে দুটো বড়া নিয়ে আয় তোর আর আমার জন্য।

আমি আলমাড়ির সামনে দাঁড়ালাম। অগোছালো আলমাড়ি একবারে টিপ টপ।

মেয়ে এসে পাসে দাঁড়ালো। একটা মাছের ডিমের বড়া দাঁতে কেটে আমার মুখে দিলো।

সব কাগজ রেখেছিস না ফেলে দিয়েছিস?

একটাও ফেলিনি। সব গুছিয়ে রেখেছি।

এগুলো লুকিয়ে লুকিয়ে এখানে এসে পড়তিস আর ভজুমামা, রতন আঙ্কেল, আবিদ আঙ্কেল, ইকবালদাদাই, ভাইদাদাইকে জ্বালাতন করতিস?

মেয়ে মাথা দোলাচ্ছে।

আচ্ছা তোর মাথার মধ্যে এলো কি করে বাবার সম্পত্তি ফ্ল্যাটে আছে?

মার লেখা অনেকগুলো ডাইরী আছে। সেগুলো আগে চুরি করে পড়েছি। সেখান থেকে এখানকার হদিশ পাই।

মিত্রা খিক খিক করে হেসে উঠলো।

কিরে সব চা তোরা খেয়ে ফেললি?

না। তোর আর তোর মেয়ের জন্য রেখেছি।

মেয়ে খাটের কাছে গেলো।

আলমাড়ির দ্বিতীয় তাকে যে লকার আছে তাতেই আমার সব আছে। চাবি চোরা কুঠরিতে ছিল। সেটা কি ঠিক আছে? না মরচে পরে গেছে। কতদিন আগের কথা।

পেছনদিকের লকটাও ঠিক আছে কি না সন্দেহ।

একের পর এক বই-খাতা-ডাইরী সব টেনে নামালাম।

খালি করার পর মাথাটা ঢুকিয়ে হাতটা ভেতরে ঢোকালাম। নিচু হয়ে দেখলাম হ্যাঁ লকটা ঠিক আছে। অনেকটা ছিটকিনির মতো। হাত ঢুকিয়ে বারকয়েকের চেষ্টায় লকটা সরলো। খট করে একটা আওয়াজ হলো। দেখলাম হ্যাঁ ড্রয়ারটা উঠেছে। মাথা বার করলাম।

দেখলাম তনু, মিত্রা, বনি, মেয়ে আমার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে।

কিরে তোর আলমাড়ির লক ওখানে! এইরকম মাথা ঢুকিয়ে খুলতে হয়?

জীবনে একটাই আলমাড়ি বানিয়ে ছিলাম নিজের মতো করে।

মিত্রা খাট থেকে নেমে এলো।

দেখছিস তনু! কেউ এতদিন জানতই না।

খাটে গিয়ে বস।

তোর এই তাকে কি আছে?

সব বলা যায়। তোরা আবার রাষ্ট্র করে দিবি।

আমি এবার আলমাড়ির পাল্লাদুটো হাট করে খুলে ড্রয়ারটা সামনের দিকে টানলাম।

হ্যাঁ, সব ঠিক আছে। এই জায়গায় কারুর হাত পরেনি। চারটে ফাইল যেমন থাকার তেমনি আছে। প্লাস্টিকে যত্ন করে মোড়া।

মিত্রা ঝাঁপিয়ে পরলো।

প্লিজ না। এরকম করিস না। অনেক কাজ, আমাকে আগে শেষ করতে দে। তারপর সব বলবো।

মিত্রা আমার কথায় কেমন থমকে গেল। আমার মুখের দিকে কেমনভাবে তাকাল।

বুঝতে পারলাম আমার এই অনুনয় করে বলার ব্যাপারটা ও ঠিক মেনে নিতে পারলো না।

আমি ফাইলগুলো আস্তে আস্তে বার করে নিলাম।

একটা চাবির পার্সে চাবি ছিল পার্সটা বার করলাম, দেখলাম চাবিগুলো মরচে পড়ে গেছে।

নেপলার দিকে তাকালাম।

কিছু বলবে?

এগুলো একটু ঘষা ঘষি করে আন। লকারটা খুলতে হবে।

তেল হলে ভালো হতো।

দেখ না নিচে গিয়ে ওই ছেলেটার কাছে একটু পাস কিনা।

দাঁড়াও নেপলা, তোমাকে যেতে হবে না। আমি বলে দিচ্ছি।

মিত্রা বললো। তারপর আমার দিকে তাকাল।

তুই চা খেয়ে নে, তাহলে ওকে দিয়ে আর একটু আনাতাম।

দে।

মিত্রা একটা কাপে চা ঢেলে দিলো।

মেয়ে আমার কাঁধে হাত রেখে পাশে থেবড়ে বসে পরেছে।

বাবা—

মেয়ের দিকে তাকালাম।

তন্ত্রের বইগুলো সব তুমি পড়েছো?

হেসে ফেললাম।

ফ্রয়েড?

কেন!

আমি পড়েছি। মাথায় ঢোকে নি।

নিয়ে নে বুঝিয়ে দেব।

আমার মাথাটা টেনে নিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে ফিস ফিস করে বললো, মেরিনা আন্টি তোমায় খুব ভালোবাসতো। তাই না?

মেয়ের মুখের দিকে তাকালাম। ও আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। কি উত্তর দিই।

আমাকে জড়িয়ে ধরলো।

আমিও তোমাকে খুব ভালোবাসি। তোমার অনেক কষ্ট।

বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

তোমার কাছে মেরিনা আন্টির কোনও ছবি নেই।

না বলতে গিয়েও মাথা দুলিয়ে দিলাম, আছে।

চকাত করে আমার গালে একটা চুমু খেয়ে নিল।

কিরে বাপ-বেটি ওখানে বসে বসে কি শুরু করে দিয়েছিস!

মিত্রার দিকে তাকিয়ে হেসেফেললাম।

বেল বেজে উঠলো।

তনু উঠে গেল।

মাইজি।

মিত্রা বেরিয়ে গেল। আমি আমার কাজে মন দিলাম।

আস্তে আস্তে সব গুছিয়ে তুলতে আরম্ভ করলাম।

তনু ঢুকেই বললো, ডাইরীগুলো তুলো না। ওগুলো আমি নিয়ে যাব।

কেনো?

পড়বো।

কি হবে পড়ে? ফিরে পাবে কি?

জানো ছোটোমা তুমি যেদিন বিবিসিতে জয়েন করার কথাটা বাবাকে জানাতে এসেছিলে।….

তুমি সেই ঘটনা লিখে রেখেছো!

তনুর দিকে তাকাতে পারলাম না।

তোমার জায়গায় আমি থাকলে কিছুতেই জয়েন করতাম না।

মেয়ের কথায় তনুর মুখটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

তুমি রাগ করলে ছোটোমা?

তনু মাথা দোলাচ্ছে। না।

তুমি বাবাকে রিয়েলাইজ করেছো ঠিক কিন্তু সেটা অনেক পরে। আর একটু আগে করলে, বাবা এতটা কষ্ট পেত না।

তনু এগিয়ে এসে বসে পরে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলো।

বলোনা ছোটোমা আমি কি ঠিক বলেছি?

তুই একবারে ঠিক বলেছিস।

মিত্রা ঘরে ঢুকে থমকে দাঁড়ালো। আমি বই গোছাচ্ছি।

বাবার ডাইরীগুলো না পড়লে আমিও বুঝতাম না।

তনু মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে।

তুমি, মা দুজনেই বাবাকে জড়িয়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছো। কিন্তু বাবাও যে তোমাদের কাউকে জড়িয়ে ধরে বাঁচতে চায় তার খোঁজ তোমরা কোনওদিন রাখোনি।

মিত্রার চোখের ভাষা পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে।

মা বাবাকে ভীষণ ভালোবাসতো তাই তোমার কোনওদিন ক্ষতি করে নি। চাইলে করতে পারতো, তুমি বাধা দিতে না।

তনু মেয়ের মুখ চেপে ধরলো।

আমি উঠে দাঁড়ালাম। ফাইলগুলো নিয়ে বাইরের ঘরে এসে বেতের সোফায় বসলাম।

নেপলা পেছন পেছন এলো।

সিগারেট আছে?

আছে।

দে একটা।

চলো বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই।

তাই চল।

দুজনে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম।

প্রায় ঘণ্টা দুয়েক ফ্ল্যাটে কাটিয়ে ফিরে এলাম। আমার জিনিষপত্র সব গুছিয়ে নিলাম। মেয়ে সব কিছু দেখলো। আমি কি কি বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি।

আসার সময় বনি আমাকে নিয়ে খুব হাসাহাসি করলো।

অনিদা তুমি কৃষ্ণা তোমার শত গোপিনী।

পেছন ফিরে বনির দিকে তাকালাম।

চোখ টিপে হাসছে।

মাকে গিয়ে গুছিয়ে গল্প করবি। অনিদার লেটেস্ট ক্লু।

মাথা দোলাচ্ছে।

মাথায় রাখবি। তুইও করেছিস। তোর ব্যাপারটাও লিখে রেখেছি, ওদের পড়াবো।

নাগেশ জোড়ে হেসে উঠলো।

বাবা আমি পড়বো। মেয়ে চেঁচিয়ে উঠলো।

বুঁচকি একবারে না।

কেনো, এই বেলা না কেনো। আমি বললাম।

নাগেশ সাপোর্ট করলো। অনিদা আমি পড়তে চাই।

সবাই হেসে উঠলো।

চলবে —————————



from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/auRqtyG
via BanglaChoti

Comments