কাজলদিঘী (১৮৬ নং কিস্তি)

❝কাজলদীঘি❞

BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

১৮৬ নং কিস্তি
—————————–

জানিস নম্রতা তোর বাবা এতো নোংরা ভাবতে পারছি না।

নম্রতা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে নিল।

ছুড়কি ও দুটোকে নিয়ে আয়।

সারাটা ঘর নিস্তব্ধ। সবাই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

সকলেরই মুখ থম থমে। কিছু যেন একটা ঘটতে চলেছে।

আমাদের ছেড়ে দাও, আমরা আর কোনও দিন করবো না। বিশ্বাস করো।

ছুড়কি-বিষাণ দুটো ছেলেকে কলার ধরে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে ঘরের মধ্যে নিয়ে এলো।

দেখা মাত্র চিনা বেঞ্চ থেকে সটাং উঠে দাঁড়িয়ে একটা ছেলের গলা চিপে ধরে সজোরে পাঁজর লক্ষ্য করে গোটা চারেক ঘুসি মেরে দিল। ছেলেটা মুখ দিয়ে কয়েকটা ওঁক ওঁক শব্দ করে মাটিতে শুয়ে পরে ছটফট করছে।

রতন চাঁদ ছুটে গিয়ে কোনওপ্রকারে চিনাকে ধরে ফেলেছে।

চিনা সজোরে পা ছুঁড়ে দিল ছেলেটার তলপেট লক্ষ্য করে।

মুহূর্তের মধ্যে একটা হই হই পড়ে গেল। চিনার মুখ থেকে অকথ্য ভাষায় খিস্তী বেরচ্ছে। রতন, চাঁদ কোনওপ্রকারে ওর মুখ চেপে ধরে বাইরে টেনে নিয়ে গেল।

ছেলেটা তখনও কুঁকড়ে-মুকড়ে মাটিতে শুয়ে ছটফট করছে।

মিত্রা-তনু আমার দু-দিকের দুই হাত চেপে ধরেছে। নম্রতা খাটের ভেতরে উঠে এসে আমার পেছনে বসেছে। নয়না সোজা হয়ে চেয়ারে বসে আছে। চোখে মুখে উৎকণ্ঠা।

হঠাৎ এইভাবে কিছু একটা ঘটতে পারে আমিও ভাবিনি।

বাইরে চেঁচা মিচি চলছে। আলতাফ বেরিয়ে গেল।

তুই ছাড়না রতনদা, মাত্র দশমিনিট সময় নেবো, ওর পেট থেকে সব কথা বার করে নেব। চিনা চেঁচিয়ে উঠলো।

কাঁচা কাঁচা খিস্তী মুখ থেকে ফুল ঝুড়ির মতো বেরচ্ছে।

অভিমন্যু, ঝিনুক আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। দু-জনেরি চোখমুখ মুহূর্তের মধ্যে বদলে গেছে। চোখ দুটো ভাল ঠেকলো না।

নয়না চেয়ার থেকে উঠে খাটে এসে বসলো।

বাইরে তখন তুমুল চলছে।

আলতাফ ঘরে ঢুকল। দুটোকেই টেনে হিঁচড়ে বাইরে বার করে নিয় চলে গেল।

মিত্রা আমার হাতটা ধরে জোড়ে নাড়া দিল।

আমি ওর মুখের দিকে তাকালাম।

তুই কিছু বল।

নম্রতা আমার পিঠে মাথা রেখেছে। ওদেরও চোখে মুখে যথেষ্ট ভয়ার্তের ছাপ।

আমি বললে ওরা সত্যি কথা বলবে না। আমাকে সত্যি কথাটা জানতে হবে।

বাইরে থেকে আর্তস্বরে চিৎকার ভেসে আসছে। সেই গগনভেদী চিৎকার শুনলে সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ পর্যন্ত অসুস্থ হয়ে পরবে।

বুঝলাম দু-জনকেই বেধড়ক মারছে। আমি পাথরের মতো বসে আছি।

অভিমন্যু উঠে এসে আমার কাছে দাঁড়াল। চোখ দুটো গন গন করে জ্বলছে।

আমি ওর মুখের দিকে তাকালাম। আমার চোখে মুখে কোনও ভাষা ফুটে উঠলো না।

একটু অপেক্ষা কর, ওরা সত্যি কথাটা বলে দেবে। তারপর ভাববো।

ঝিনুক, অভিমন্যু দু-জনেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

আমরা ছয়টা প্রাণ ঘরের মধ্যে চুপচাপ বসে।

চেঁচামিচির শব্দটা আস্তে আস্তে থিতিয়ে আসছে।

তনু ব্যাগের থেকে জলের বোতলটা বার করে ঢক ঢক করে কিছুটা জল খেল।

মিত্রাও বোতলটা চেয়ে নিয়ে কিছুটা খেয়ে নম্রতাকে দিল। নম্রতা তার মাকে।

আপ্পে উদাস চোখে বসে আছে। ভাবগতিক এরকম কিছুই হয়নি।

আলতাফ ঘরে ঢুকলো। আমি ওর মুখের দিকে তাকালাম।

সব বড়ো খলিফা।

হাসলাম, কেন?

একটা ফোন করবো।

না।

একটু বেঁধে নিই।

আমি সব বেঁধে নিয়েছি।

আলতাফ কিছু বললো না। আপ্পে মুচকি মুচকি হাসছে।

কিছু বার করতে পারলি?

ওদের কথা বুঝতে পারছি না। রতন মনে হয় বার করতে পেরেছে।

ঝিনুক, অভিমন্যুকে ভেতরে ডাক। ওদের কোমড় থেকে পিস্তল বার করে টেবিলের ওপর রাখ।

আলতাফ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

মুখের দিকে তাকিয়ে থাকিস না। যা বললাম তাই কর।

আমি বলতে পারব না। ডেকে দিচ্ছি, তুমি বলো।

আলতাফ বেরিয়ে গেল, মিনিট খানেকের মধ্যে তিনজনে ঘরে এলো।

দু-জনেই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

আলতাফ কিছু বলেছে?

বলেছে।

ওগুলো টেবিলে রাখ।

তুমি তো নুলো বানিয়ে দেবে।

এখন এখানে এগুলোর কোনও প্রয়োজন নেই। যখন লাগবে আমি নিজে হাতে তুলে দেব।

কেন শুনি। তোমার যদি কিছু হয়।

তোর বিশ্বাস হয়।

রাগের চোটে কোমড় থেকে পিস্তল বার করে টেবিলের ওপর রেখে দিল।

যা আপ্পের পাশে গিয়ে দু-জনে বোস। আমি না বলা পর্যন্ত উঠবি না।

তারমানে আর একটা বড়ো ঘুঁটি সাজিয়ে রেখেছো। ঝিনুক মুখ ঝামটা দিল।

আপ্পে, আলতাফ মুখ ঘুরিয়ে হাসছে।

আমি তনুদের বাংলা তর্জমা করলাম কি কথা বললাম ওদের সঙ্গে।

রতন হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকলো।

পর্শু থেকে দু-জনে খেপে আছে, আজ সুদে আসলে তুলে নিল।

হিন্দীতে বল ওরা শুনুক।

রতন আবার রিপিড করলো।

আলতাফ বললো, কেন?

ইকবাল, হাফিজ যখন পিটছিল চাঁদ অনিদাকে শুধু বললো, কেশটা আমাকে দিতে পারতে।

আলতাফরা হাসছে।

কি পেলি বল। আমি বললাম।

আবার আর্তস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো কেউ।

মরুকগে যাক, আমি আর পারবো না। রতন বলে উঠলো।

ঘটনাটা কি?

সাগর পাঠিয়েছে।

কেন?

ভাবি, নম্রতাকে সরাতে হবে।

নম্রতা আমাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠলো। আমি মাথা দোলাচ্ছি।

আর একটা?

ওটা তোমাকে গিলতে এসেছে।

দুটোকে ভেতরে নিয়ে আয়। চিনাকে ডাক।

রতন গেটের কাছে গিয়ে চেঁচাল, চিনা।

চিনা ভেতরে এলো পেছনে চাঁদ, ছুড়কি। চোখ মুখ তখনও লাল।

কিরে মাথা ঠাণ্ডা হলো।

শালাদের কি দম চিন্তা করো তোমাকে, ভাবিকে, নম্রতাকে হজম করতে এসেছে।

তোরা যে এখানে আছিস জানত না।

সব জানে। পর্শুদিনের সমস্ত ঘটনা জানে।

ওদের কবে ফিট করেছে।

সেটা শালা কিছুতেই বলছে না।

তুই চিনলি কি করে।

ওটা নোনাগো।

সেটা আবার কে?

একসময় নচের সঙ্গে কাজ করতো। নচেকে ওড়াবার পর ওকে আর খুঁজে পাইনি। একবারে ওড়াং হয়ে গেল। মাঝে একবার এসেছিল। আমার চেলুয়াগুলো তারা করলো আর আসেনি।

এখন শুনি ও নাকি খড়গপুরের ডন। চন্দ্রশেখরের সঙ্গে কাজ করতো।

তোকে কে বললো?

প্রথমে ছুড়কি বললো, তারপর নিজে স্বীকার করলো।

কিরে ছুড়কি। ছুড়কির দিকে তাকালাম।

তুমাকে তো কইলি।

ওকে আগে দেখেছিলি।

সেউদিন দ্যাখছিলি।

কোথায়?

বাজারে ঘুরতি ছ্যালো।

এখানে ঢুকলো কি করে?

মেলার ভিড়ে চোখ ফস্কি চইলে আসছে। একটাকে সেউঠি ধরছিল, তার কাছে অস্ত্র ছ্যালো। তাকে পিটতে কইছিল আরও চাইরজন আসছে। অখন কইতিছে তিনজন পলাইছে।

ওটা বেঁচে আছে?

না, মারি দিছি।

যা দুটোকে ভেতরে নিয়ে আয়।

ছুড়কি বেরিয়ে গেল।

মিত্রা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

তুমি শুধু শুধু ম্যাডমকে তনুদিকে নিয়ে এলে। রতন বললো।

ওদের মনে অনেক প্রশ্ন, বুঝলি রতন। একবার নিজের চোখে দেখে নিক।

ছুড়কি-বিষাণ দুটোকে টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে এলো।

এতো মারের পরও মুখে তার বর্হিপ্রকাশ নেই। আমি একবার ওদের চোখে চোখ রেখে বোঝার চেষ্টা করলাম। একবারে মার্কা মারা চোখ মুখ।

কাল রাতে শ্যাম কোনটাকে ধরে এনেছে?

ইকে। ছুড়কি আঙুল দিয়ে দেখাল।

থাকিস কোথায়?

ইন্দা।

যাকে খুঁজতে এসেছিলি তাকে চিনিস?

বিশ্বাস করুণ আমি এসব কিছু করতে আসিনি।

সপাটে একটা চড় আছড়ে পরলো ছেলেটার গালে।

আমি চিনার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছি।

যা জিজ্ঞাসা করছে সোজা সাপ্টা জবাব দিবি। চিনা গড় গড় করে উঠলো।

কাল রাতে ওই মেয়েটাকে কি জিজ্ঞাসা করছিলি?

কোন মেয়ে?

বিষাণ। বাজখাঁই গলায় চেঁচিয়ে উঠলাম।

বইলো।

হাত-পা বেঁধে দুটোকে তিনতলা থেকে নিচে ছুঁড়ে ফেলে দে।

নিস্তব্ধ ঘরে পিন পরলে শব্দ হবে।

এই তল্লাটের হায়না, শেয়াল, ভাল্লুকগুলো অনেকদিন মানুষের মাংস খায়নি।

তনু চমকে আমার মুখের দিকে তাকিয়েছে। মিত্রা-নয়না মাথা নিচু করে বসে।

নম্রতা আমার কাঁধে থুতনিটা দিয়ে জাপ্টে ধরে আছে।

বলছি, বলছি।

আমি স্থির চোখে ছেলেটার দিকে তাকালাম।

আপনাকে চিনতাম না, তাই ওকে জিজ্ঞাসা করছিলাম।

কেন?

আপনার জন্য আমাদের বস উড়ে গেছে, তাই খোঁজ নিতে এসেছিলাম।

তারপর।

ছেলেটি চুপ করে গেল।

এই যে ওরা বললো, তুমি আমাকে মারতে এসেছিলি?

আমি না, যারা এসেছিল তারা ভেগে গেছে।

তুমি এখনও সত্যি কথা বলছো না।

বিশ্বস করুণ।

তোমাকে একটা লাস্ট চান্স দেব, তারপর এদের যা বলেছি তা করবে। সত্যি কথা বললে, তোমাকে ছেড়ে দেব।

একটু জল খাব।

ছুড়কির দিকে তাকালাম।

বাইরের মাটির কলসি থেকে পেতলের ঘটিতে জল নিয়ে এসে দিল।

ছেলেটা ঘট ঘট শব্দ করে জল খেল, যেন কতদিন জল খায়নি।

নিস্তব্ধ ঘরে সকলে আমার আর ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। নোনা মাথা নিচু করে বসে।

তোমার কাছে কাল মেয়েটি দশটাকা চেয়েছিল, কেন?

সবাই এবার একটু নড়ে চড়ে বসলো।

ছেলেটি মাথা নিচু করলো।

তুমি তো আমাদের সকলকে মেলায় দেখেছো।

তবু ছেলেটি মাথা তোলে না।

তুমি জানতে ও এখানকার মেয়ে?

ছেলেটি মাথা দোলাল। জানতো।

ও তোমাকে আমার সম্বন্ধে অনেক কথা বলেছে।

ছেলেটি চুপ। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

তুমি আগে এখানে অনেকবার এসেছো।

ছেলেটি কোনও কথা বলে না। মাথা নিচু করে নিল।

মনীশকুমার এখন কোথায়?

ছেলেটি চমকে আমার মুখের দিকে তাকাল।

এই নোনা তুই চিনিস? আমি ঝাঁজিয়ে উঠলাম।

বিশ্বাস করুণ ও আমাকে পয়সা দিয়েছে, আমি কাজ করতে এসেছি।

কবে এসেছিস?

কাল রাতে।

ছুড়কি।

বলো। ছুড়কি দরজার গোড়ায় মুখ বারাল।

ওদের দোতলায় নিয়ে যা। স্নানটান করিয়ে পেট পুরে খাইয়ে দে। তারপর বড় রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে আসবি। ওই তিনটেকে নিয়ে আয়।

ছেলে দুটো আমার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।

আলতাফরা সকলে আমার মুখের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে।

বিষাণ।

বইলো।

তুই তোর কাজে চলে যা, তোকে আর দরকার লাগবে না।

আইচ্ছা।

বিষাণ বেরিয়ে গেল।

শোন।

বিষাণ আবার ফিরে এলো।

শিবুর সঙ্গে ওদেরকে একটু নিয়ে আয়। একটু চায়ের কথা বল না।

বিষাণ একটু থমকে দাঁড়িয়ে বেরিয়ে গেল।

আলতাফ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

হাসলাম।

এই তোমার শাস্তি!

এগুলো চুনোপুঁটি। এগুলোকে মেরে কিছু হবে না।

রতন ফিক করে হাসলো।

দে একটা সিগারেট দে।

আলতাফের তখনও সম্বিত ফিরে আসেনি। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।

রতন তুই বুঝে হাসলি, না, না বুঝে হাসলি। আমি বললাম।

আবিদ থাকলে বলে দিত। ওই দিনে আমরা দু-জনে সাক্ষী ছিলাম।

কিরে আবার ছোট্টু কেশ! আলতাফ রতনের দিকে তাকাল।

এখনও সিওর নই। তবে মন বলছে। দাদা কখন কোথায় কোন ঘুঁটি সাজিয়ে রাখে বোঝা মুস্কিল। দাদার হাতে অনেক অপশন। কাজ শেষ না হলে বলতে পারব না।

আলতাফ একবার আমার দিকে একবার রতনের দিকে তাকায়।

তুমি কথা না বলে অপেক্ষা করো। অপেক্ষা করা ছাড়া তোমার কোনও গতি নেই।

মিত্রা একবার রতনের মুখের দিকে তাকায়, একবার আলতাফের মুখের দিকে তাকায়।

আলতাফ সিগারেটের প্যাকেটটা আমার হাতে দিল। একটা বার করে নিয়ে ওকে ফেরত দিলাম।

আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে।

মিত্রা-তনু একটা কথাও বলছে না।

সিগারেট ধরিয়ে দুটো টান মারতেই মুখটা কেমন তেঁত তেঁত লাগল। চিনাকে দিয়ে বললাম ফেলে দে, ভাল লাগছে না।

চিনা সিগারেটটা নিয়ে বাইরে চলে গেল।

দিবাকার, প্রিয়দর্শিনী, ন্যান্সি তিনজনে ভেতরে এলো। পেছনে ছুড়কি, বিষাণ, শিবু।

অভিমন্যু বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে তারস্বরে চেঁচিয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলে উঠলো, শুয়ারকা বাচ্চা।

দরজার মুখে চিনার মুখটা ভেসে উঠলো।

দিবাকর থমকে দাঁড়াল একবার অভিমন্যুর মুখের দিকে তাকাল।

স্থির চোখে একবার ঘরের চারদিক চোখ বুলিয়ে নিল।

ন্যান্সি, প্রিয়দর্শিনীর চোখ মিত্রাদের দিকে।

অভিমন্যুর সারাটা শরীর থর থর করে কাঁপছে। চোখ দুটো ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে।

ভিকু একবার দিবাকরকে দেখেই মাথা নিচু করে নিল। চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে।

আপ্পে, অভিমন্যুর হাতটা ধরে বেঞ্চে বসাবার চেষ্টা করছে। ঝিনুক স্থির চোখে আমাকে একবার দেখে, একবার অভিমন্যুকে।

আলতাফের মুখটা কেমন থমথমে।

দিবাকার, প্রিয়দর্শিনী, ন্যান্সি থম থমে মুখে আমার দিকে তাকাল।

আপ্পে ওদেরকে নিয়ে এদিকে আয়।

কারুর-ই চোখে মুখের অবস্থা ভাল নয়।

অভিমন্যু ছুটে এসে আমার কোলে মুখে গুঁজে ঝড় ঝড় করে কেঁদে ফেললো।

আমি ওর মাথায় হাত রেখেছি।

তুমি একবার হ্যাঁ বলো।

অভিমন্যু কান্নাভেঁজা চোখে আমার দিকে তাকাল।

আলতাফ, রতনের চোখমুখ লাল হয়ে গেছে।

ঘটনাটা কি ঘটলো ওরা ঠিক বুঝতে পারছে না। অভিমন্যুর মতো ছেলে কাঁদছে।

ঝিনুক, আপ্পে আমার পায়ের কাছে হাঁটু ভাঁজ করে বসে পড়েছে। ভিকু এক কোনে দাঁড়িয়ে

চোখ মুখ লাল ডগ ডগ করছে।

প্লিজ অনিদা। অভিমন্যুর কন্ঠে কাতর স্বর।

তোর থেকেও ও সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে অর্জুনের। অর্জুনকে ও মাতৃহারা করেছে। আর তোর ভালোবাসার জনকে ও তোর কাছ থেকে কেরে নিয়েছে।

আমি পনেরো বছর ধরে খুঁজছি।

আমি জানি।

আলতাফ টেবিলের ওপর থেকে পিস্তলটা তুলে নিয়েছে।

আমি ষাঁড়ের মতো চেঁচিয়ে উঠলাম, আলতাফ।

আমার গগনভেদী চিৎকারে চারদিকটা গম গম করে উঠলো।

দেখলাম গেটের সামনে অনেক চেনা মুখের ভিড়। কেউ নিরস্ত্র নয়।

আমি আলতাফের দিকে তাকিয়ে কঠিন স্বরেই বললাম।

ওঠা রেখে দে। এখানে আমার কথাই শেষ কথা।

আলতাফ পিস্তলটা আবার টেবিলের ওপর রেখে দিল।

আমি অভিমন্যুর দিকে তাকালাম। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম।

আলতাফের দিকে তাকালাম।

অভিমন্যুর একার কষ্ট, অনিদার কোনও কষ্ট নেই। গলাটা সামান্য ভেঙে গেল।

অভিমন্যু আমার কোলে মুখ গুঁজলো।

পাশে বসেই বুঝতে পারছি তনু-মিত্রার চোখ ছল ছল করছে। ওরা মাথা নিচু করে রয়েছে।

দিবাকর, ন্যান্সি, প্রিয়দর্শিনী বেঞ্চে বসে। থম থমে মুখ।

আমি দিবাকরের দিকে তাকালাম।

তোর ম্যাডামকে চিনতে পারছিস?

দিবাকার থম মেরে বসে আছে।

তোকে কাগজের ব্যুরো চিফ বানালো না বলে আজ আমার এই দশা।

মিত্রা-তনু চকিতে একবার দিবাকরের মুখের দিকে তাকাল। তারপর আমার মুখের দিকে।

দিবাকর! মিত্রার মুখ থেকে অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এল।

হ্যাঁ দিবাকর।

আজ থেকে ঠিক তেইশ বছর আগে আমাদের রথশহরের মেলায় তোর পাশে বসে, তোর সমস্ত কথাবার্তা সুনীতদাকে শুনিয়েছিল। তখন স্টেজে ফাংসন চলছে। নীপারা চন্ডালিকা করছে। আমি একা একা স্কুল ঘরের সামনে ছোট টেস্ট-রিলিফের বাঁধটায় বসে আছি। সেদিন আমার জীবনে প্রথম কালির দাগ লেগেছিল। এরা রটিয়েছিল তোকে নিয়ে আমি দীঘাতে ফুর্তি করতে গেছিলাম। আরও কতো কিছু। সেদিন রাতে তুই আমার ওপর অভিমান করলি। শুনতে চাইলি সব কথা। তোকে বললাম, তুই আগুনের মতো দপ করে জ্বলে উঠলি।

মিত্রা ছল ছল চোখে আমার দিকে তাকাল।

তারপর গর্ভবতী শেলিকে মার্ডার করে দিবাকার ধীরে ধীরে আন্ডারওয়ার্ল্ডে পা রাখলো।  সেদিন ওকে শেল্টার দিয়েছিল মল, সুনীত, অতীশবাবু। মাঝে মনে হয় তিন-চার বছর জেলে ছিল, তারপর আমি মরে গেলাম, ওই সুযেগে অনাদি দাদা হলো, অনাদির সাহচর্যে দিবাকর জেলের বাইরে। তারপর আস্তে আস্তে দাদা বনে গেল। তার আগে যদিও একটা নিগোসিয়েসন করে নিয়েছিল। দিবাকর নিজের বিয়ে করা বউ প্রিয়দর্শিনীকে আনাদিকে ভেট দিল। সে আর এক খেলা।

তবে বড়ো খেলাটা দিবাকর খুব নিপুন হাতে খেলতে চেয়েছিল ঠিক মতো হয়নি। হলে হয়তো আজ আমি ও মুখো মুখি বসতাম না। আমাকে মারার পেছনেও ওর একটা সদিচ্ছা ছিল। রাজনাথও এটা চেয়েছিল। ও ভাবেনি আমি বেঁচে গেছি। তাই আরও শক্তি অর্জন করে ও কাজ করতে শুরু করলো। একটা একটা ধাপ পেরিয়ে একদিন ও বনে গেল বচ্চে সিং। বম্বের দ্বিতীয় সারির ডন।

অনিদা। আলতাফ আবার ষাঁড়ের মতো চেঁচিয়ে উঠলো।

অভিমন্যুর মতো একই অবস্থা ওর।

আমি ঠাণ্ডা চোখে তাকালাম আলতাফের দিকে।

ভিকু এগিয়ে গিয়ে আলতাফের হাতটা চেপে ধরলো।

তু বাহার চল। ইধার খাঁড়া হোনা ঠিক নেহি লগতা। তেরা তবিয়েত গড়বড় হো গায়ে।

আলতাফ কাঁচা কাঁচা খিস্তী দিয়ে উঠলো।

ইধার ভাবিজি বৈঠা হ্যায় তু সোচ সমঝকে বাত কর।

ভাবিজি ইধার কিঁউ আয়া। আলতাফ ভেঙে পড়লো।

ইসিলিয়ে, মেয়নে অনিদাকো দাদা বোলা। অর্জুনভি দাদাকো পিতাজীকা মাফিক শ্রদ্ধা কিয়া। আফতাবভাই ভি দাদাকো কোই বাত অমান্য নেহি কিয়া। কিস লিয়ে? চল বাহার চল।

ভিকু, আলতাফকে নিয়ে বাইরে চলে গেল।

আমি শিবুর দিকে তাকালাম।

শিবু এদের স্নান খাওয়া দাওয়া হয়ে গেছে।

শিবু মাথা দোলাল, হয়ে গেছে।

দিবাকরের দিকে তাকালাম।

অনাদিকে ফোন করেছিলি?

দিবাকর চুপ করে রইলো।

তোকে আনার জন্য লোক পাঠিয়েছে?

দিবাকর তবু চুপ করে রইলো।

আমার কথাটা তোর বিশ্বাস হলো না।

দিবাকর মুখ তুললো।

ফোনটা হাতে পেয়েই এখানে লোক ঢুকিয়ে দিলি।

আমি করিনি।

আমার একটা হ্যাঁ বলাতে তোদের তিনটে শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে এটা কখনও ভেবেছিস।

তুই বিশ্বাস কর।

বিশ্বাসের তেইশ। চেঁচিয়ে উঠলাম।

অভিমন্যু আমার কোল থেকে সটাং উঠে দাঁড়াল। কপালের দুই পাশের শিরা ফুলে ফুলে উঠছে। আগুন ঝড়া চোখে তাকিয়ে দিবাকরের দিকে।

চাঁদ-চিনা ওদের পাশে গিয়ে দাঁড়াল।

আমি আমার কথা রেখেছি। বিষয়টা আমার জানা দরকার।

ন্যান্সি ফোন করেছিল।

কাকে?

সাগরকে।

কেন?

ও চায় না সাগরের স্ত্রী-মেয়ে বেঁচে থাকুক।

আমি কি তার সঙ্গে ফাউ?

তোকে ওরা চেনে না।

ওদেরকে ডাকবো?

তুই অনাদিকে ফোন করতে পারিস।

আমি কেন ফোন করতে যাব।

তুই সাগরের স্ত্রী মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরছিস।

হেসে ফেললাম।

শুধু সাগরের স্ত্রী-মেয়ে নয় শ্বাশুড়ীকেও নিয়ে এসেছি।

কালকে সাগর ম্যাসেজে ছবি পাঠিয়েছে।

গুড। ওদের দু-টোকেও ফরোয়ার্ড করেছে?

দিবাকর চুপ।

এখানে যারা আছে তুই এদের সবকটাকে নামে চিনিস। একমাত্র অভিমন্যু তোকে দেখেছে।

কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। সারাটা ঘর থম থম করছে।

তুই এদের অনেক ক্ষতি করেছিস। দলের ক্ষতি করেছিস। কারুর মাকে তুলে নিয়ে গিয়ে দৈহিক নির্যাতন করে তাকে খুন করেছিস। কারুর ভালোবাসার মানুষকে তুলে নিয়ে গিয়ে মুখ থেকে কথা বার করার জন্য তার চোখের সামনে ধর্ষণ করে খুন করেছিস। অস্বীকার করতে পারবি।

দিবাকার চুপ করে রইলো।

নয়না তুমি ন্যান্সিকে আগে দেখেছো?

একবার।

কখন, কি ভাবে?

একবার বাড়িতে নিয়ে এসে তুলেছিল। ওকে নিয়ে একঘরে থেকেছিল।

প্রতিবাদ করো নি?

করেছি।

ফল খারাপ হয়েছে?

নয়না চুপ করে রইলো।

সাগর ওর সঙ্গে রেজিস্ট্রি করেছে। এখন থেকে তুমি সাগরের স্ত্রী নও। ডকুমেন্টস দেখতে চাইলে নম্রতার কাছে আছে, দেখে নেবে।

দেখেছি।

সাগর তার সিক ইন্ডাস্ট্রিগুলো তোমার আর নম্রতার নামে ট্রান্সফার করেছে, যাতে তোমাকে আর নম্রতাকে পুলিশ, ইনকামট্যাক্স, সেলসট্যাক্স টানা হ্যাঁচড়া করে। যেগুলো ফ্রেস সব ন্যান্সি আর সাগরের জয়েন্ট নামে আছে।

না। ন্যান্সি প্রতিবাদ করে উঠলো।

এ রেনডি। অভিমন্যু ষাঁড়ের মতো চেঁচিয়ে উঠলো।

আলতাফ, ভিকু ঘরে ঢুকলো।

তুই চেঁচালি কেন অভিমন্যু।

শালি ফর ফর কর রহ্যা।

আলতাফ একবার ন্যান্সির দিকে একবার প্রিয়দর্শিনীর দিকে তাকাল।

চোখের চাহুনিতে আগুন ঝড়ে পরছে।

তোমার ব্যবসা কেমন চলছে?

ছেড়ে দিয়েছি।

দিবাকরের দিকে তাকালাম।

আমার সম্বন্ধে কিছু বলেছিস?

দিবাকর চুপ করে রইলো।

নম্রতা?

বলো।

ফোন তোর কাছে?

না টেবিলে রেখেছি।

নিয়ে এসে বাবাকে ফোন করে জানা তুই এখন কোথায় বসে আছিস। কাদের সামনে বসে আছিস। আমাকে শোনাবি।

চাঁদ এগিয়ে এসে ফোনটা তুলে নম্রতার হাতে দিল।

কি বলবো বলো?

এই সিচুয়েসনে তুই তোর বাবাকে কি বলতে পারিস। যেটা তোর মন চায় তুই বল।

নম্রতা ডায়াল করলো।

একবার দুবার তিনবার নো-রেসপন্স।

দিবাকরের দিকে তাকালাম।

তোর ফোন থেকে ফোন কর।

ও এখন ধরবে না।

হুঁ। অনাদিকে ফোন লাগা।

কেন! আমি কাজ করে দিয়েছি।

দিবাকরের দিকে তাকালাম।

বিশ্বাস করতে পারি।

দিবাকর আমার চোখে চোখ রেখেছে।

কোনদিক দিয়ে যাবি?

আমাকে পাহাড়টা পার করে দে।

নদীর ভেতর দিয়ে ডুলুং হয়ে যেতে পারতিস।

না।

কেন?

দিবাকর হাসল।

হাই রোড পর্যন্ত আমার লোক রয়েছে। তোর লোকদের বারন করে দে। বিরক্ত যেন না করে।

আমি তোকে কথা দিচ্ছি।

আমি উঠে দাঁড়ালাম। দিবাকর উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে এল।

হাতে হাত চোখে চোখ।

তোর সঙ্গে এটাই আমার শেষ দেখা। ভাল থাকিস।

দিবাকর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

তোদের তিনজনের টিকিট কাটা আছে। রাঁচী থেকে সাতটা পনেরোর ফ্লাইট।

দেখেছি।

এবার যা, দেরি হয়ে যাবে। আমাকে আবার কলকাতা ফিরতে হবে।

তোকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো?

বল।

তুই আমাকে এভাবে ছেড়ে দিচ্ছিস কেন?

আমার কাজ হয়ে গেছে।

শুধু কি তাই?

মারতে চাইলে তোকে অনেক দিন আগে মেরে দিতাম, এটা তুই ভাল করে জানিস।

দিবাকর চোখ দিয়ে আমার কথা শুনছে।

আমার কাজগুলোর গ্রীণ সিগন্যাল পেয়েছিস?

পেয়েছি।

দিবাকার আমার চোখ থেকে চোখ সরাচ্ছে না। কিছু খুঁজতে চাইছে। পড়তে চাইছে। এই চোখের ভাষা, এই শব্দ-বর্ণগুলো ওর কাছে অস্পষ্ট লাগছে।

যাই।

যা। ওই দুটো তোর সঙ্গে যাচ্ছে। রাস্তায় নামিয়ে দিস।

দিবাকর হাসলো।

তোর লোক, আমি রেখে কি করবো।

আমার না, অনাদি আর সাগরের লোক।

ছুড়কি।

আমার গলা পেয়ে ছুড়কি ভেতরে এলো।

এদের সবাইকে বড় রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে আয়। সমস্ত এ্যারেঞ্জ করে নিয়ে যাবি। রাস্তায় যদি কিছু গন্ধ পাস পাঁচটাকেই ওখানে শেষ করে দিবি। টোটাল জোনে সিগন্যাল পাঠিয়ে দে।

আইচ্ছা।

দিবাকরের দিকে তাকালাম।

তোর যদি কাউকে কিছু বলার থাকে বলে দিতে পারিস।

বলে দিয়েছি।

ভালো করে খোঁজ খবর নিয়েছিস?

ক্লিয়ার আছে।

দিবাকর একটু থমকে দাঁড়াল।

একটা জিনিষ চাইবো দিবি।

বল।

তোর ফোনটা আমাকে দে।

হাসলাম। তুই সার্চ করে দেখতে পারিস। আমি সঙ্গে নিয়ে আসিনি। আর কেউ যাতে ফোন করতে না পারে, তার জন্য সবার ফোন টেবিলের ওপর রেখেছি। আমার পার্মিসন ছাড়া একটা ফোনও কেউ হাতে তুলে নেবে না।

হানিফকে ডাক।

যা বাইরে আছে।

ওরা তিনজনে বেরিয়ে গেল। আমি ওদের পেছন পেছন বাইরে এলাম।

মিত্রারা আমার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে। ঘটনা কি ঘটলো ওরা ঠিক বুঝলো না। ওদের চোখের ভাষা মুখের রেখায় তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

আমি পায়ে পায়ে ঘরের বাইরে এলাম। খোলা আকাশের তলায় দাঁড়িয়েছি।

দিবাকর, হানিফের সঙ্গে কথা বললো। তারপর ছুড়কির সঙ্গে, দড়ির মতো আঁকা বাঁকা বনপথ ধরে ধীরে ধীরে নিচের দিকে নেমে গেলো।

হানিফ একটু এগিয়ে গিয়ে দেখে এলো কতটা নামলো। ফিরে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।

তুমি এতো বড়ো একটা গেম এতো ঠাণ্ডা মাথায় খেললে কি করে!

এছাড়া আমার কোনও উপায় ছিল না হানিফ।

এই জন্য বসও তোমাকে মাঝে মাঝে ভয় পায়।

হাসলাম।

যে ছেলেগুলো আশেপাশে রয়েছে, তারা আমার দিকে চেয়ে চেয়ে দেখছে।

দাঁড়াও রেকর্ডিংটা বন্ধ করে আসি।

যা।

হানিফ ছুটে ওপরের দিকে চলে গেল। আমি কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

হাওয়ার ধাক্কায় গাছের পাতা দুলছে। সর সর একটা আওয়াজ। মাঝে মাঝে আওয়াজটা বেরে যাচ্ছে। আবার কমে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে গাছের নরম ওপরের অংশটাও দুলছে। একটা ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজ কানে ভেসে আসছে। একমনে শুনলে বড়ো আনমোনা করে দেয় মনটাকে।

আকা চি দিব?

ছেলেটার মুখের দিকে তাকলাম। বছর ষোল বয়স হবে। ইনোসেন্ট মুখটা।

হাসলাম। করেছিস?

হ করছি।

নিয়ে আয়।

ও আর একটা ঘরের দিকে চলে গেল।

আমি পায়ে পায়ে নিজের ঘরে এলাম।

টেবিলের ওপরটা ফাঁকা। প্রত্যেকের কানে মোবাইল উঠে গেছে। কারুর ঠোঁট বন্ধ নেই।

দেখলাম একমাত্র নয়না কাউকে ফোন করছে না।

নিজেই হেসে ফেললাম।

চেয়ারটা খালি। আমি চেয়ারে বসলাম।

মিত্রা কান থেকে ফোনটা নামিয়ে বললো, বড়োমা তোর সঙ্গে কথা বলতে চাইছে।

বল একটু পরে ফিরে যাচ্ছি।

নয়না আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

সেই ছেলেটা শালপাতায় ধরে একটা বড়ো ভাঁড়ে করে চা নিয়ে এলো।

কিরে অনিআকা একলা চা খায় আমরা খাই না। মিত্রা কান থেকে ফোনটা নামিয়ে বলে উঠলো।

তুমান্যে খাব?

কেনি আকা একলা খিব। মিত্রা ধমকে উঠলো।

আমি মুচকি হাসলাম।

আনিঠি।

ছেলেটা বেরিয়ে গেল। হানিফ ঘরে ঢুকে একটা ছোট ক্যাসেট আমার হাতে দিল।

তার-ফার সব খুলে ফেলি?

আগে তুই একটা কাজ কর।

বলো।

খাটের তলায় আমার মোবাইলটা তখন পড়ে গেছে একটু বার করে দে।

অন করা আছে।

না স্যুইচ অফ।

হানিফ হাসতে হাসতে খাটের দিকে এগিয়ে গেল। মিত্রারা উঠে দাঁড়াল।

আলতাফরা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।

কথা বলা শেষ হলো।

কি কথা বলবো। সবাই বললো কিছু জানি না।

তুই যে তোর ছেলেগুলোকে ধুলাগড়ির দিকে বর্ডারে পাঠিয়েছিস তাদের ফিরে যেতে বল। না হলে কেউ বাঁচবে না।

আলতাফ আমার মুখের দিকে বিষ্ময়ভরা চোখে তাকাল।

যা বলছি কর। দেরি করিস না।

আপ্পে ফোনটা তুলে ডায়াল করতে শুরু করেছে।

তুমি কি সত্যি….!

হাতে বেশি সময় নেই। ওদের ওখান থেকে বেঙ্গল বর্ডার পেরিয়ে চলে যেতে বল। যখন সিগন্যাল দেব তখন আবার ঢুকবে।

আপ্পে কথা বলতে শুরু করেছে। আমার কথা মতো ইনস্ট্রাকসন দিয়ে দিল।

চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিলাম।

হানিফ ফোনটা এনে আমার হাতে দিল।

তোর বাক্স প্যাঁটরা গুছিয়ে নে। আজ কলকাতায় চল কাল ফিরে যাবি।

এখানে কিছু কাজ ছিল।

মেটেরিয়ালস নেওয়ার আছে।

হ্যাঁ।

তাহলে নিয়ে পাঠিয় দে। এখানকার দায়িত্বটা তোর থাকবে। তুই সেইভাবে এদের সাহায্য করে যাবি। এখানে এলে, ওপরে থাকবি না নিচে থাকবি?

ওপরে থাকব।

নিজের ঘরে না আমার ঘরে।

যেখানে হোক থাকলে হলো।

তোর পরে বিষাণ এখানকার দায়িত্ব নেবে, ছুড়কি ওইদিক সামলাবে।

আচ্ছা।

আমরা একটু ওপরটা ঘুরে আসবো।

কথাটা শুনে মিত্রার দিকে তাকালাম।

পারবি না। অনেকটা উঁচু খাঁড়াই।

যত কষ্ট হোক, আর তো এখানে আসব না। একটু ঘুরে আসি।

আমি তাড়াতাড়ি ফিরবো।

ঠিক আছে। আধঘণ্টা।

ওরা সকলে উঠে দাঁড়াল। আলতাফরা যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছে।

তোরাও যাবি নাকি?

একটু ঘুরে আসি।

হানিফ ওদেরকে সঙ্গে নিয়ে যা।

ওরা সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমি একা।

সকলকে একে একে ম্যাসেজ করলাম লেটেস্ট নিউজ নিয়ে ফোনটা বন্ধ করে চুপ চাপ বসে রইলাম।

মাথাটা ভীষণ ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।

যা করছি ঠিক করছি তো? এই মুহূর্তে আমি একটা শরু সুতোর ওপর দিয়ে চলেছি। একটু বেসামাল হলেই পট করে ছিঁড়ে নিচে পড়ে যাব।

অনেক ভেবে-চিন্তে এই রিক্সটা নিলাম। বলতে পারি নিতে হল। এ ছাড়া কোনও উপায় ছিল না।

আর দেরি করলে হয়তো টোটাল গেমটাই হাতের বাইরে চলে যেত।

আমার একটাই দোষ শত্রুকে আমি অনেকটা এ্যাডভান্টেজ দিয়ে ফেলি। বুঝতে পারি একবারে শেষ মুহূর্তে, তখন এ ছাড়া কোনও উপায় থাকে না।

একটু ধরো, অতো রাগ করলে চলে, আর এক মিনিট, নেমে পড়েছি। মিত্রার গলা পেলাম।

সম্বিত ফিরে দরজার দিকে তাকাতে দেখলম মিত্রা কানে ফোন দিয়ে ঘরে ঢুকছে।

চিকনা। এই নিয়ে তিনবার ফোন করলো। তোকে ভীষণ জরুরী দরকার।

বড়োমা তনুর মোবাইলে কনটিনিউ ফোন করে যাচ্ছে। অনিমেষদা তোকে চাইছে। তোর ফোন স্যুইচ অফ। তুই ফোন স্যুইচ অফ করে বসে আছিস কেন?

আমি ওর দিকে তাকিয়ে আছি।

মিত্রা আমার হাতে ফোনটা দিল।

একে একে সবাই ঘরে ঢুকছে।

হ্যালো।

ওখানে বসে বসে মজমা মারাউঠু। চিকনা ঝাঁজিয়ে উঠলো।

ফোনটা ভয়েজ অন করা বুঝতে পারিনি। কানের থেকে দূরে সরিয়ে নিলাম।

মিত্রা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে।

কেন কি হয়েছে?

অভিমন্যু-ঝিনুক, অনাদি-সাগরকে গুলি করছে।

সবাই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে নম্রতা, নয়নার মুখ হঠাৎ কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

আমি কি করবো?

তুই কি করবি মানে! ফোন বন্ধ করে রেখেছিস কেন?

তাতে তোর কথা বলতে কোনও অসুবিধে হচ্ছে।

অনিমেষদা তোকে ফোন করে পাচ্ছে না।

তুই যে ভাবে পেলি সেইভাবে পেতে পারত।

এক ঘণ্টা আগে ফোন করেছিল পাওয়া যায়নি।

তুই পেলি কি করে?

অনিমেষদাকে এখুনি ফোন কর।

যার দরকার সে ফোন করবে।

এই ঘটনা ঘটালি কেন?

কি ঘটনা।

তোর কথা ছাড়া অভিমন্যু-ঝিনুক সাগর অনাদিকে গুলি করতে পারে না।

অভিমন্যু-ঝিনুক আমার সঙ্গে রয়েছে।

এ্যাঁ!

হ্যাঁ। কথা বলবি?

আলতাফ?

আলতাফ, আপ্পে, ভিকু, রতন, চাঁদ, চিনা সবাই আমার সঙ্গে রয়েছে। ম্যায় নম্রতা, নয়না পর্যন্ত আমার সঙ্গে রয়েছে।

অভিমন্যুর দিকে তাকালাম।

অভিমন্যু চিকনাদার সঙ্গে কথা বলে নে, কথা বলা হলে আমাকে দে।

ফোনটা অভিমন্যুর দিকে এগিয়ে দিলাম।

তনুর ফোনটা বেজে উঠলো। তনু নম্বরটা দেখে আমার মুখের দিকে তাকাল।

অনুপদা।

কথা বলে নাও।

দে আমি কথা বলছি।

মিত্রা ফোনটা নিয়ে বাইরে চলে গেল। তনুও বেরিয়ে গেল, পেছন পেছন নয়না, নম্রতা।

অভিমন্যু কথা বলে ফোনটা আমার দিকে এগিয়ে দিল।

হ্যালো।

তুই কি করছিস আমার মাথায় ঢুকছে না। চিকনা বললো।

ঢোকাতে হবে না। তোকে কে খবর দিল?

অনিমেষদা।

কতক্ষণ আগে ফোন করেছিল।

ঘণ্টা খানেক আগে।

কি বললো।

আনাদি সাগর গুলি খেয়েছে। পুলিশ সাসপেক্ট করছে অভিমন্যু-ঝিনুক করেছে। সাবধানে থাকো।

দুটো বেঁচে আছে না মরে গেছে।

বেঁচে আছে।

মরবে, না বেঁচে যাবে?

বলছে তো বেঁচে যাবে।

গুড।

গুড মানে!

সব কথা বুঝতে হবে এমন কোনও ব্যাপার আছে।

কেন বুঝবো না।

বুঝলে গুলি খেতিস না।

গুলি খাওয়ার সঙ্গে এর কি সম্পর্ক?

তোকে বুঝতে হবে না।

গুষ্টির ঠ্যাং, তুই কি আমাকে মউগা পাইছু।

গাঁইয়া ভাষা ঝাড়ছিস।

বেশ করছি।

কটার সময় ঘটনাটা ঘটেছে?

ঘণ্টা খানেক আগে।

ঠিক আছে। তোর শরীর কেমন আছে?

আজ একা একা হেঁটেছি।

ব্যাথা আছে?

একটু আছে।

ওদিকটা সামলে নে, কেউ ঝামেলা করতে চাইলে একবারে গুঁড়িয়ে দিবি।

আমিও সেই কথা বলে খবর পাঠিয়েছি। তুই কি আজ ফিরবি?

আরও ঘণ্টা তিনেক পর বেরব।

আচ্ছা।

মিত্রা ফ্যাকাশে চোখে ঘরে ঢুকল। আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে।

কিরে কি কথা বললো অনুপদা?

ওদিকে নাকি খুব গোলা-গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। কালি পটকা ফাটার মতো।

গোলা, আবার গুলি!

কেন তুই ঝামেলা করিস বল।

তাতে ওদের কি। ওদের কেউ গুলি করতে এসেছে।

তনু আমার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে।

আমাদের তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে বললো।

চল। আমি উঠে দাঁড়ালাম।

তুই এত স্বাভাবিক আছিস কি করে? মিত্রা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

কাজগুলো ঠিক ঠাক হচ্ছে তাই। রতন বললো।

আলতাফ হেসে ফেললো।

তুমি হাসছো আলতাফ। মিত্রা বললো।

কি করবো বলুন। নিজের কানে সব শুনছেন। দেখছেন। আমাদের সব হ্যান্ডিক্র্যাফ্ট করে বসিয়ে রেখে দিয়েছে। যাতে এক ফোঁটা আঁচড় না লাগে। আমরা….।

আলতাফ।

আলতাফ আমার মুখের দিকে তাকাল।

বলো।

আমার সঙ্গে নিচে চল।

কেন!

খেয়েদেয়ে এখানে চলে আসবি। আমি না বলা পর্যন্ত এখান থেকে তোরা কেউ এই মুহূর্তে নরবি না।

আপ্পে হাসছে।

আপ্পে ওদেরকে বলে দিয়েছিস।

হ্যাঁ।

বেরিয়ে গেছে।

মাথা দোলাল।

ফোনে সবার সঙ্গে যোগাযগ রাখ।

আচ্ছা।

হানিফ এখানে থাকবে। তোদের কোনও অসুবিধে হবে না।

ঘরের বাইরে এলাম।

দুটো ছেলে এগিয়ে এল। মুখ চিনি নাম জানি না।

আকা বিষাণ ফোণ করতি বইলছে।

ছুড়কির কোনও খবর পেয়েছিস?

লিচে আছে।

ফিরে এসেছে?

হ।

চল আমরা নিচে যাব।

চইলো।

এখানে কে থাকবে?

তান্যে আইছে।

তোরা খেয়েছিস?

খাবার হতিছে।

কাল মেলা গেছিলি?

গেছলি।

ছেলেদুটো আমার আগে, আমার ঠিক পেছনে তনু, মিত্রা, নম্রতা, নয়না। তার পেছনে ওরা সবাই।

বুবুন।

বল।

এই জায়গাটা ওই অঞ্চল থেকেও ডেঞ্জার।

হুঁ।

এখানে কোনও রাস্তাই নেই। ওখানে তবু একটা রাস্তা আছে।

হুঁ।

এখানকার গাছগুলো ওখানকার থেকে বেশ মোটা আর লম্বা।

হুঁ।

কি তখন থেকে খালি হুঁ হুঁ করে যাচ্ছিস।

তুই কথা বলছিস আমি সায় দিচ্ছি।

মিত্রার সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছি আর ফোনটা টেপা টিপি করে যাচ্ছি।

কি টেপা টিপি করিস?

ততক্ষণে ডায়াল করে কানে তুলেছি।

কিরে আমাদের শোনবি না।

না।

হ্যালো।

আকা।

বলছি।

এঠিতো যুদ্ধ লাইগছে।

তুই সকলকে নিয়ে পালিয়ে আয়।

আইকটে পরছি।

কেন!

লিচে বেদম গুলি চলেঠে।

ওরা কোথায়?

মন কইতিছে তান্যে বাঁচি লাই।

তুই যেভাবে পারিস পালিয়ে আয়।

টুকু পরে যাতিছি।

সাবধানে।

আইচ্ছা। লাইনটা কেটে দিলাম।

চলবে —————————–



from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/cdMQzbU
via BanglaChoti

Comments