কাজলদিঘী (২০৯ নং কিস্তি)

❝কাজলদীঘি❞

BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

২০৯ নং কিস্তি
—————————–

কথার পৃষ্ঠে রাঘবন কথা বললো। গলা থেকে স্নেহ যেন চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে।

জিনিসটা অনির ভেঁদোদার কাছে আছে।

এখান থেকেই বেশ বুঝতে পারলাম, নামটা শুনে সকলের চোখে মুখে বিষ্ময় ছড়িয়ে পরেছে।

হ্যাঁ অনিমেষবাবু আমি একটুও অবাস্তব কথা বলছি না।

তারমানে রুমাদি যেটা গেইজ করেছেন….!

মাসীমনি মনা-নম্রতার কথা শুনে ফেলেছিল। ওরা সেটা অতোটা গা করেনি। নতুন তো।

আমার অফিসাররা ভেঁদোবাবুর কাছে গেছিলেন। কোনও খারাপ ব্যবহার করেনি। আমার অফিসাররা ওর জন্য অনেক খাবার-দাবার জিনিষপত্র নিয়েগেছিলেন। একটা জিনিষও ছুঁয়ে দেখেনি। দু-ঘণ্টা ইন্ট্রোগেসন করার পর ওনার মুখ থেকে একটা কথা বার করতে পেরেছেন, অনি।

এখান থেকে বেশ বুঝতে পারছি রাঘবন স্বগোতক্তির সুরে কথা বলে চলেছে।

খাতা কলমে ভেঁদোবাবু মেন্টালি ডিসঅর্ডার পার্সেন। আপনি তাকে এ্যারেস্ট করলে কাগজে খবর বেরবে। মানবাধিকার কমিশন এগিয়ে আসবে। চারদিকে একটা হুলুস্থূলুস কাণ্ড বেঁধে যাবে। সেন্ট্রাল-স্টেট দুজনেই হ্যারাসমেন্টে পড়ে যাবে। টোটালটা চলে যাবে সিমপ্যাথেটিক গ্রাউন্ডে। হয়তো আপনাদের সরকারের ওপরেও উতরোত্তর চাপ বেড়ে যাবে।

ওই বাড়িতে সর্বেশ্বরবাবু থাকেন। উনি এসেছিলেন। ভেঁদোবাবু সর্বেশ্বরবাবুর কাছ থেকে পয়সা নিয়ে গিয়ে সকলকে চা খাইয়েছেন কিন্তু কেউ একটা কথাও মুখ থেকে বার করতে পারে নি।

সর্বেশ্বরবাবু কি কথা বলতে শুধু বলেছে, অনি আসবে।

ফেড আপ হয়ে তারা আমাকে জানিয়েছে, স্যার ইট ইজ টু ইমপসিবিল।

যে চিপটা ওর কাছে পৌঁছে দিয়েছিল সে একটা কথাই বলেছিল, অনিদা পাঠিয়েছে, অনিদা ছাড়া কাউকে এটা দেবে না। আমি হলপ করে বলতে পারি যে ওকে চিপটা পৌঁছে দিয়েছিল, সে যদি সেকেন্ড টাইম ওর কাছে গিয়ে চিপটা চায় তাকেও ভেঁদোবাবু দেবেন না।

সর্বেশ্বরবাবু নিজেহাতে ওর জিনিষপত্র ঘাঁটা ঘঁটি করেছেন কিছু পাওয়া যায়নি।

সামান্য একটা এইট জিবি মোবাইলের মেমারি কার্ড। তার কত দাম বুঝতে পারছেন।

কারুর মুখে কোনও কথা নেই। নিস্তব্ধ পরিবেশ।

স্যার এবার বুঝতে পারছেন কেন ভিখারাম নিগোসিয়েসন করতে চাইছে। কেন আমি আপনাকে রিকয়েস্ট করছি।

আমি বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলাম। বুঝতে পারলাম ম্যারাথন মিটিং চলছে। এখনো ঘণ্টা খানেক চলবে। আর ভালো লাগছে না। পাজামা পাঞ্জাবী পরে চুপচাপ শুয়ে পরলাম।

ঘুম ভাঙতে বালিশ থেকে মুখটা তুললাম। আমার পিঠে মাম্পি, মিকি। তাদের কোনও হেল-দোল নেই। জানলার দিকে মুখ ফিরিয়ে দেখলাম সকাল হয়েছে।

আয় তুই গাড়ি চালাবি আয়।

এবার ঘরের চারদিকটা দেখলাম। শূন্য ঘর। ওমা দেখি সুমন্তর ছেলেটাও সঙ্গে রয়েছে। খাটের এক কোনে গুঁটি-সুঁটি মেরে বসে আছে।

চোখের ইশারায় কাছে আসতে বললাম।

হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে এলো।

তোর নাম কি?

বাবান।

এতো সুন্দর আদো আদো করে বললো। হেসে ফেললাম।

গাড়ি চালিয়েছিস?

মাথা দোলাল, চালায়নি।

ওরা তোকে চালাতে দেয়নি?

চালাতে পারি না।

আঙ্কেল আমরা বেরাতে যাব।

মাম্পি গলা জড়িয়ে ধরেছে।

স্কুলে যাবি না?

না।

কেন?

দেখো সাজু-গুজু করেছি।

কি করে দেখবো, তুই পিঠ থেকে নাম।

দুজনে পিঠ থেকে নামলো। আমি উঠে বসলাম।

তিনজনেই বেশ চকচকে। মাম্পি আবার ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়েছে।

ওর দিকে তাকিয়ে নিজে নিজেই হেসে ফেললাম।

ঠোঁটে কি লাগিয়েছিস!

লিপিসটিক।

সেটা আবার কি?

তুমি জানো না। মাম্পি মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বললো।

না!

মা লাগায়।

তোকে কে লাগিয়ে দিল?

মা। আঙ্কেল জোনো মিকি না মেয়ে।

এ্যাঁ!

হ্যাঁ গো। ওকে মোজা খুলতে বলো। মাম্পি চোখ-মুখ পাকাল।

তুই তো লাগিয়েছিস। মিকি চেঁচিয়ে উঠলো।

তুই কি মেয়ে?

দুজনে শুরু করে দিল। আমি কিছুক্ষণ নীরব দর্শক। চড়ুই পাখির মতো দুজনেই কিচির মিচির করে চলেছে। বাবান একদৃষ্টে ওদের দিকে তাকিয়ে।

মোজা খোল, আঙ্কেলকে দেখা।

দেখাব না।

প্রায় হাতা-হাতি হওয়ার উপক্রম। আমি দুটোকে জড়িয়ে ধরে থামা-থামি করলাম।

তোকে মোজা খুলতে হবে না। পায়ে কি লাগিয়েছিস?

দিদাই আলতা লাগিয়ে দিয়েছে।

বেশ করেছে। মাম্পির ভাগে কম পড়ে গেছে, তাই ঝগড়া করছে।

আমার আছে।

সুমন্তর ছেলের দিকে তাকালাম।

বাবান পায়ে আলতা লাগিয়েছিস?

ও ছেলে।

মাম্পির দিকে তাকিয়ে হাসলাম।

কি করে বুঝলি?

আমি জানি।

আমি মাম্পির দিকে তাকিয়ে হেসেই চলেছি। বললাম।

সাত সকালে সাজুগুজু করেছিস, কোথায় যাবি?

বেরাতে।

কোথায়?

ওই যে বুড়ীদিদাই এসেছিল, লাঠি হাতে।

মাম্পি কুঁজো হয়ে দেখাল।

জানে না খালি কথা বলে। মিকি বললো।

তুই জানিস।

আমাকে দাদাই বলেছে।

মাম্পি বুড়ো আঙুল তুললো। ঘেঁচু।

নাগো আঙ্কেল। তোমার বাড়ি। মিকি বললো।

তুমি যাবে না? মাম্পি বললো।

আমাকে নিয়ে যাবে না।

ছোটোবোম এসেছিল তোমাকে ডাকতে।

সেটা আবার কে!

তুমি জানো না। মাম্পি আবার চোখ-মুখ পাকাল।

মাথা দোলালাম, না।

তোমার বউ।

খুব জোড় হাসির শব্দ হলো।

ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকালাম।

দরজার চৌকাঠে মিলি, মিত্রা, ইসি হেসে গড়িয়ে পরছে।

দরজার দিকে পেছন ফিরে এতক্ষণ চারজনে বসেছিলাম তাই কেউই দেখতে পাইনি।

তুমি বলো মিত্রাদি, এরকম পাকা পাকা কথা কে শেখাল। ছোটোমা শুনলে কি বলবে।

সব সময় পেছন পেছন ঘুরছে। জিজ্ঞাসা করলে বলেদিবি, তুমি শিখিয়েছ।

সুমন্তরটাকে দেখেছিস। কেমন ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে। যেন ভাজামাছটা উল্টে খেতে জানে না।

ধরে এমন দেব না। মিলি কপট রাগে হাসি মুখে তেরে এলো।

মিলির তারায় মম্পি আমার কোলের মধ্যে ঢুকে পড়েছে।

এখন আর কাউকে কথা শেখাতে হয় না বুঝলি মিলি, এরা সব পেট থেকে কথা শিখেই জম্মায়। মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।

তিনজনকে দেখেই মনে হচ্ছে যাওয়ার জন্য সব রেডি হয়ে পড়েছে। বেশ মিষ্টি করে সেজেছে।

সুমন্তর ছেলেটা তখনও আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

কিরে তুই যাবি না? আমি বললাম।

দিদি লজেন দেয়নি। খেয়ে নিয়েছে।

ছুটকি ওর মুখটা দেখ। ইসি বলে উঠলো।

এখুনি কি বললাম শুনলি তো।

মিলি আবার হেসে উঠলো। এতক্ষণে সত্যি কথাটা বলে ফেলেছে।

কিরে মাম্পি। আমি মাম্পির দিকে তাকালাম।

মিকি খেয়ে নিয়েছে। ওকে বকো।

ঠিক আছে তোরা পাবি না। বাবান চারটে পাবে।

আমার আছে। মিকি বললো।

আমারও আছে। দু-টো। মাম্পি বললো।

ওরা হেসেই চলেছে।

মা কই। মিকির দিকে তাকালাম।

কাপর পড়ছে।

ছোটবোমকে বল চা নিয়ে আসতে।

ব্রাস উইথ টিথ। মাম্পি বললো।

আমার দাঁত নেই।

মাম্পি এগিয়ে এসে আমার মুখে খোঁচা মারলো। এই তো দাঁত। তিনটেকে জড়িয়ে ধরলাম।

মিলিরা আমার দিকে হাসিহাসি মুখে তাকিয়ে।

উঁ মুখে গঅঅনননধধধধ।

ওদের ছাড়তেই দৌড় লাগাল।

খাট থেকে নেমে দাঁড়ালাম।

ভালই ঘুমলি।

মিত্রার মুখের দিকে তাকালাম।

তোরা সারারাত জেগেছিলি।

ঘুমলাম কোথায়। তোর গল্প শুনতেই রাত কাবার।

কিছু নতুন জিনিষ জানলি। কোশ্চেন পেপার তৈরি কর। পরীক্ষায় বসবো।

পেপার সেটারের কাছে পাঠিয়েছি।

বুঝলাম ট্র্যাক চেঞ্জ হচ্ছে, চুপ করে গেলাম।

আলনা থেকে টাওয়েলটা টেনে নিয়ে কাঁধে ফেললাম।

মিত্রা আমার দিকে একভাবে তাকিয়ে। টেবিলের ওপর থেকে ব্রাস-মাজনটা নিয়ে বাথরুমে ঢুকলাম।

মিত্রা পেছন থেকে চেঁচাল।

দেরি করিস না। সবাই রেডি হয়ে বসে আছে।

বাথরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে একবার ওদের দিকে তাকিয়ে হাসলাম।

যথাসময়ে আমার কাজ সেরে বেরলাম। ফাঁকা ঘর দরজাটা সামান্য ভেজান। বুঝলাম সবাই ওই ঘরে ব্যস্ত। টান টান করে বিছানার চাদর পাতা। একপাশে একটা ফুল হাতা গেঞ্জি আর জিনসের প্যান্ট গুছিয়ে রাখা। আনুসাঙ্গিক সবকিছু। বুঝেগেলাম আমার জন্য রেডি করে রাখা হয়েছে।

দেরি করলাম না। চুলটায় কোনওপ্রকারে চিরুনি দিয়েই জামা-প্যান্টটা পরতে শুরু করলাম।

প্যান্টটা গলিয়ে গেঞ্জিটা গলাতে যাব। দরজাটা সামান্য ফাঁক হলো।

রতনদা দাদা রেডি।

মুখ তুলে দেখলাম নেপলা গেট খুলে ভেতরে আসছে। পেছন পেছন চাঁদ, চিনা, ওমর, সাগির, অবতার, আবিদ।

গেঞ্জিটা গলিয়ে নাও।

কেন।

আগে গলাও না। তারপর….।

গেঞ্জিটা গলিয়ে নিলাম।

চাঁদ, চিনা দেখলাম পায়ের কাছে বসে পড়লো। ওমর ওদের ঘারে।

সাগির, অবতার দু-জনে দু-দিক থেকে জড়িয়ে ধরেছে।

কি হয়েছে কি বলতো!

রতন খাটের এক কোনে বসে হেসেই চলেছে। আবিদ শোফায়।

ব্যাপার কিরে আবিদ, সক্কাল সক্কাল বধ করবার ধান্দা।

নেপলা সামনে থেকে জাপ্টে ধরলো।

নেপলা আমার দম বন্ধ হয়ে যাবে। টেঁসে গেলে বিপদ।

টেঁসে যাব বললেই হলো। টাঁসতে দিচ্ছে কে শুনি ?

চাঁদ শুরশুরি লাগছে।

আবিদ হাঁসতে হাঁসতেই দরজার কাছে উঠে গিয়ে চেঁচাল, বুঁচকি দেখবি আয়।

মুহূর্তের মধ্যে গেটের মুখে সব হাজির। ওরাও আমার অবস্থা দেখে হাসছে।

একবারে হাসবি না। তোদের মাল বাগানো হয়ে গেছে। এবার আমাদের হিসেবটা করতে হবে। নেপলা চেঁচিয়ে উঠল।

ওদের চাপাচাপিতে আমার তখন নাভিশ্বাস উঠছে।

নেপলা আঙ্কেল এতো সহজে মাল বাগাতে পারবে না। ভাগীদার অনেক। অনিকা বললো।

ওরা সবাই ভেতরে এসেছে।

নেপলারা একে একে আমাকে মুক্তি দিল।

সত্যি বলছি এতটা বিশ্বাস করিনি। কাল বিনোদভাইকে ফোন করেছিলাম। আওয়াজ দিয়েছিল। সেটা যে এইরকম ধরতেই পারিনি। নেপলা বললো।

আমি হাসছি।

বিনদভাইকে কতদিন দেখিনি। অবতার বললো।

ওই দিন শেষ দেখেছিলাম তাই না অবতার। সাগির বললো।

কেন তারপর একবার বম্বেতে দেখা হয়েছিল। অনিদা একটা কাজে পাঠিয়েছিল তোর মনে নেই। নেপলা বললো।

তুই গেছিলি। আমরা কোথায় গেলাম। ফিরে এসে বলেছিলি। বিনদভাই মনখারাপ করেছে। বলেছে কতদিন অনিদা এই ভাবে বন্দি করে রাখবে জানি না। সাগির বললো।

অনিকা, অনিসা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। সুন্দররা সোফায় বসেছে। ওদের মুখ চোখ দেখে বুঝছি। কালকে রাঘবন এমন কিছু কথা ওদের বলেছে ওদের চোখে মুখে সেই বিষ্ময়ের ছোঁয়া এখনও রয়ে গেছে।

আমি এই মুহূর্তে সত্যি সত্যি ওদের কাছে বিষ্ময়ের বস্তু।

নিজেকে ঠিক-ঠাক ভাবে গুছিয়ে নিলাম।

রতনের দিকে তাকাতে তখনও মুচকি মুচকি হেসে চলেছে।

হাসছিস কেন?

হজম করতে কষ্ট হয়েছে।

ওরকম গো-গ্রাসে গিললে হজম হয়। যে কোনও জিনিষ রয়ে-সয়ে ধীরে সুস্থে খাবি। দেখবি শরীর খারাপ হবে না। তার ওপর বয়স হয়েছে। হজম করতে একটু সময় লাগবে।

ওরা হেসেই চলেছে।

আবিদ আমার কাগজপত্র?

রতনদাকে বুঝিয়ে দিয়েছি। আবিদ হাসতে হাসতেই বললো।

রতনের দিকে তাকালাম।

তোমর সঙ্গে একটু বসতে হবে। ওখানে চলো ঘণ্টা খানেক সময় দিও।

ওমর, তোর চাচার খবর?

বলে দিয়েছি। অনিদার সঙ্গে দেখা হবে না। তাতে পারলে তুমি করবে, না হলে আমিই ব্যবস্থা করে নেব।

চাচা করবে না!

করবে বলেছে।

অনিকার কাছে বুঝে নিয়ে কাজ শুরু করে দে।

ওমর আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।

অবতার।

বলো।

চাঁদ তোর টাকা দিয়েছে?

চাঁদ, চিনা দুজনেই হেসে চলেছে।

হাসছিস কেন? অবতারের দিকে তাকালাম।

ইন্টারেস্ট দেয়নি।

অতো কপচাচ্ছিস কেন। আমি তোকে দিয়ে দেব বলেছি। চাঁদ চেঁচিয়ে উঠলো।

অনিকা, অনিসা মুচকি মুচকি হাসছে।

রতন, চাঁদ-চিনার পার্ট বুঝিয়ে দিয়েছিস।

ওদের টাকা নেই।

আমি চাঁদ, চিনার দিকে তাকালাম।

নাগো। বলেছি এই মুহূর্তে একটু টানাটানি আছে। কয়েকদিন পর শুরু করবো।

কেন সুবীর নোট দেয়নি?

তুই চুপ করে আছিস কেন, বলতে পারছিস না। সব ঝাড়টা আমরা খাব তাই না।

রতনের দিকে তাকিয়ে চিনা চেঁচিয়ে উঠল।

দাদা জানে।

জানে তো টোঙা দিচ্ছে কেন।

বাজিয়ে দেখছে।

সাগির আমার নোটের ব্যবস্থা করেছিস?

তোমার আরও নোট লাগবে! অনিকা বলে উঠলো।

ঘরের সকলে জোড়ে হেসে উঠলো।

অনিসা বসেছিল হাসতে হাসতে উঠে এসে সামনে দাঁড়াল। ঠানদিদির মতো আঙুল উঁচিয়ে বললো। কতো লাগবে?

গোটা পঞ্চাশেক দে। তোর মা নতুন প্যান্ট-জামা দিল। খালি পকেটে ঘর থেকে বেরই কি করে।

সুন্দর জোরে হেসে উঠলো।

বোন ধরা খেয়েগেছিস। এতো সহজ। চিকনামামা সকালে কি আওয়াজ দিল শুনেছিস।

মেয়ে আমার মুখে দিকে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে।

তোমার মানি পার্টসে নেই?

দেখ ফাঁকা পড়ে রয়েছে।

কোথায়?

টেবিলের ওপর আছে নিয়ে আয়।

মেয়ে আমার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে, কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। কিছু না বলতে পেরে, শেষে বলে ফেললো, তুমি না….মা যে কেন তোমায়….।

নেপলার জোড়ে হেসে উঠলো।

কাল পর্শু দিয়ে দেব। এখন ধার দে।

পঞ্চাশ টাকায় তোমার সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। অনিকা এগিয়ে এলো।

আমার আর খরচ কি বল। মাঝে মাঝে সিগারেট বিড়ি কিনি।

অনিকা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। কিছু আর বলতে পারে না।

ছোটোমা এসে ঘরের সামনে দাঁড়াল।

আরও কতো সময় লাগবে শুনি?

দুই মেয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে। দেখে ভেতরে এলো।

কিরে তোরা ওরকম ভাবে সং-এর মতো দাঁড়িয়ে।

দিদান বাবা তোমার কাছে যে পঞ্চাশ-একশো টাকা নেয় শোধ করে? অনিসা বললো।

কেন বলতো!

অনিদা, বুচকির কাছে পঞ্চাশ টাকা ধার চেয়েছে। নেপলা বলে উঠলো।

হাসি থেমে নেই সে তার আপন খেয়ালে বেজেই চলেছে।

ছোটোমা আর থাকতে পারলো না। হেসে ফেললো। আমার দিকে তাকিয়ে।

কত রঙ্গ দেখাবি বলতো।

বিশ্বাস করো।

ঠিক আছে চল দিদি দিয়ে দেবে। আমাদের কাছে এত সামান্য টাকা ধার পাওয়া যায় না।

ছোটোমা আমার হাত ধরলো। চল চল।

ঘর থেকে বেড়িয়ে এলাম।

বারান্দায় পা রাখতেই দেখলাম অনেকগুলো গাড়ি। বাইরেও বেশ কয়েকটা দাঁড়িয়ে। অপরিচিত মুখ দু-একজন বাদে সবাই কমবেশি পরিচিত।

এ ঘরে এসে ঢুকতেই আর এক চোট হাসাহাসি হলো।

সবাই রেডি।

অনিমেষদা, আফতাবভাইদের কাউকে দেখতে পেলাম না।

সোফাতে আন্টি, মাসীমনি বসে। আমি দুজনের মাঝখানে নিজেকে গুঁজে দিলাম।

মিত্রাদের কাউকে দেখতে পেলাম না।

চা খাবি, না কচুরি? রান্নাঘরের দরজায় দামিনীমাসির মুখটা ভেসে উঠলো।

দুটোই।

মাসীমনির মুখের দিকে তাকালাম।

দীঘির স্থির জল টল টল করছে। প্রশান্ত মুখখানায় না বলা অনেক কথা।

শরীর কেমন আছে?

ভালো না রেখে উপায় কি বল।

বিনয়দাদের দেখতে পাচ্ছি না।

ওপরের ঘরে আছে।

দেখছো, আন্টি কিরকম আমর দিকে তাকিয়ে আছে।

তুই তাকিয়ে থাকার বস্তু তাই তাকিয়ে আছে।

এতো ঘনো ঘনো দাঁড়ি মরে দিলে চলে।

মাসিমনিকে জড়িয়ে ধরলাম।

আন্টি মুচকি মুচকি হাসছে।

নেক্সট ভেঞ্চার কি?

মাসীমনি আমার মুখের দিকে তাকাল।

কিছু না। কাজগুলো সেরে ফেলবো, তারপর রিটায়ার্ড লাইফ এনজয় করবো।

তোর জীবনে রিটায়ার্ড লাইফ আছে?

করে নিতে হবে।

অনেক দৌড়েছিস এবার থেমে যা।

থামতে দিচ্ছে কই বলো।

দামিনীমাসি কচুরীর প্লেট নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল।

মাসীমনিকে ছেড়ে দিলাম। দামিনীমাসি মুচকি মুচকি হাসছে।

আমি একা, তোমরা খাবে না?

দিদি আসুক।

বড়োমা কোথায়?

ওপরে।

ঠাকুর ঘর থেকে বেরইনি!

বেরিয়েছে, আসছে।

তাহলে চা খাই পরে কচুরী খাব।

তুই খা নিয়ে আসছি।

দাদারা?

সবার খাওয়া হয়ে গেছে।

বেরবে কখন?

তোর হয়েগেলেই বেরবো।

জ্যেঠিমনি, ছোটোমা বড়োমার ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।

দামিনীদি একসঙ্গে নিয়ে চলে এসো। ছোটোমা বললো।

আমি বড়দিকে ডেকে আনছি তুমি রেডি করো। ছোটোমা বেরিয়ে গেল। জ্যেঠিমনি এসে সোফায় বসলো।

আমি চায়ে চুমুক দিলাম।

ছোটদি মস্তানটা উঠেছে।

হ্যাঁ। বাবু খেঁটনে বসেছে।

আমাদের?

যাও দামিনীদি আছে।

চেনা গলার আওয়াজে দরজার দিকে তাকালাম। সুজিতদা গেটের মুখে দাঁড়িয়ে।

আমাকে দেখে হেসে উঠলো।

আজ নিজের গাড়ি, নিজের তেল, নিজে ড্রাইভ করবো। তোকে দাঁত ফোটাতে দেব না।

আমি হাসছি।

এগিয়ে এসে খালি সোফায়া দখল করে বসলো।

আমার দিকে তাকিয়ে হেসেই চলেছে।

দামিনীদি বেশি দেবে না। চিনি, চাপ দুটোই কন্ট্রোলে।

আমি চায়ের কাপটা টেবিলে রাখলাম।

তুমি যাবে নাকি?

আলবাৎ যাব। এরকম সুযোগ কেউ হাতছাড়া করে।

মাল ভালই কামাই হয়েছে মনে হচ্ছে।

জ্যেঠিমনি, আন্টি হেসে উঠলো।

দেখলেন মাসীমনি কি কথার কি উত্তর।

সুজিতদা মাসীমনির দিকে তাকাল।

গুবলু, গুবলুর বৌ, বৌদি ঘরে ঢুকলো।

মাসীমনি হাসছে।

একবারে পুরো পরিবার সমেত।

কেন তোর আপত্তি আছে?

অবশ্যই। আমার ঠেকায় যাবে, আমার পার্মিশন নিয়েছ।

বড়দি ইনভাইট করেছে।

ওটা কি বড়দির বাড়ি?

গুবলু, গুবলুর বৌ দুজনেই মুচকি মুচকি হাসছে।

গুবলু কন্ট্রাক্টে কে সাইন করেছে? আমি বললাম।

বাবা।

তাহলে কাজ করে মজা পাব।

কেন!

সুজিতদার দিকে তাকালাম।

গুবলু হলে তবু কিছু এ্যাডভান্স পেত। কাজে ভুল হলে মার্সি করা যেত। তুমি অভিজ্ঞ পুরুষ।

ওরা সবাই হাসছে।

ছোটোমারা সবাই ঘরে ঢুকলো।

দরজার সামনে থেকেই ছোটোমা চেঁচাল। আবার শুরু করে দিয়েছে।

আর বলিস না….। আন্টি হাসতে হাসতে বললো।

আমি কি অন্যায় কথা বলেছি আপনি বলুন। সুজিতদা বললো।

দামিনীমাসি ট্রেতে সাজিয়ে খবার নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরলো। গুবলুর বৌ এগিয়ে গেছে।

আমি চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে টেবিলে কাপটা রাখলাম। কচুরীর ট্রেটা সুজিতদার সামনে রাখতেই একটা তুলে মুখে তুললো।

জানো সুজিতদা রাস্তায় সের-ই-পাঞ্জাবী বলে একটা রেস্তোরাঁ আছে। সেখানে আলুর পরটা, কচি মুরগীর মাংস….।

কচুরীটা মুখে তোলার আগে বলতে পারোনি। সুজিতদা চেঁচিয়ে উঠলো।

এই জন্য বলি যা কিছু করবে ছোটভাই-এর একবার অনুমতি নেবে। আমি খুব গম্ভীর গলায় বললাম।

গুবলুর বৌ হাসতে হাসতে ছোটোমাকে জড়িয়ে ধরেছে।

মেয়েরা, মিত্রারা সব ঘরে ঢুকলো।

দামিনীদি কচুরী আর খাব না। চা দাও। সুজিতদা চেঁচিয়ে উঠলো।

মিত্রারা ঢুকেই হাসিতে যোগ দিয়েছে।

তুইও আছিস সুজিত। বড়োমা বললো।

তুমি বলো, সবে মাত্র একটা কচুরী মুখে তুলেছি….কথাটা আগে বলা যেত না।

গুবলু বাবার নতুন কোম্পানী রেজিস্ট্রেশন হয়ে গেছে।

গুবলুর দিকে তাকালাম।

গুবলু মুখ ঘুরিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। এবার বৌদি খুব জোর হেসে উঠলো।

কিরে হাসছিস যে? আমি গুবলুর দিকে তাকিয়েছি।

গুবলু, হিমাংশুর কাছ থেকে কালই সমস্ত ফাইল উইথড্র করে নিবি। কাল আমি নতুন ল-ইয়ার দেখবো। সুজিতদা গড় গড় করে উঠলো।

ড্রাফটা তো বেশ ঝাড়ি করে নিজেরটা গুছিয়ে বানিয়ে নিলে।

আমি মুচকি মুচকি হসছি।

সুজিতদা খুব জোর হেসে উঠলো।

তুই বিশ্বাস কর। লোভ সামলাতে পারলাম না।

পার্টনার কে কে?

সবাই আছি। ওটাতে চারজন, এটাতে চারজন। ওটাতে ছেলে একান্ন। এটাতে আমি একান্ন।

মাল বেশি তাই।

কেন তোমার কষ্ট হচ্ছে। খেটেখুটে একটু মাল কামাব, তাতেও টোঁকাটুঁকি শুরু করে দিয়েছ।

বড়োমারা হেসেই চলেছে।

আমার মুখ বন্ধ করার একটাই রাস্তা আছে সেটা তুমি জানো।

তোর কমিশন পেয়ে যাবি। আগে প্রমোশনের প্ল্যানিংটা করে দে।

ওই-টার মতো।

সুজিতদা হাসতে হাসতে মাথা দোলাচ্ছে।

এবার মিত্রারা তারস্বরে হেসে উঠলো।

দিদি আস্তে আস্তে বেরুচ্ছে। তনু বললো।

শুনে যা। সবে কলির সন্ধ্যে। আরও কতো বেরবে। মিত্রা বললো।

আমি ইসারায় দেখালাম, আবার সেই কচি কচি।

যাঃ ছেলের বউ আছ। ওটা তোর সঙ্গে পার্সোনালি বসবো।

দিদি ওর কানটা ধরোতো। ছোটোমা, মাসীমনির দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো।

আমি সুজিতদার দিকে হাসি মুখে তাকিয়ে।

মেয়েরা হেসেই চলেছে।

যতই কচুরী চেবাও, আলুর পরটা কচি মুরগী বন্ধ।

বৌমা রেগুলার কচি মুরগীর স্টু দেয়।

খেতে খেতে মনে মনে কতবার গালাগাল দাও।

কেন দেব।

তুমি ওটা ছাড়া আর একটা জিনিষ জানো…।

কি?

ধান্দা বাজি।

ওরে শালা! তাই বলি তুই এতক্ষণ কপচাচ্ছিস কেন। ধরতে পারিনি।

আমি হেসেই চলেছি।

কচি মুরগী? আলুর পরটা?

সুজিতদা চেঁচিয়ে উঠলো।

ছোটদি দেবা কোথায়? সুজিতদা ছোটোমার দিকে তাকাল।

এখনও ঢোকেনি। এবার ঢুকবে।

শালা আসুক আজকে। সুজিতদা আমার দিকে তাকাল।

ঠিক মাল বার করে নিয়েছিস!

এবার মিত্রাদের চোখে বিষ্ময়। সবাই সবার মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে।

তুই বিশ্বাস কর। বুলা সব জানে।

বৌদির দিকে তাকালাম। বৌদি হাসছে।

সুজিতদা প্লেট থেকে আর একটা কচুরী তুলে মুখে দিয়েছে।

আগের থেকে খরচ অনেক বেড়ে গেছে। আগে একজনকে দিয়ে অনেক কাজ করাতে পারতাম। এখন একজনকে দিয়ে একটার বেশি দুটো কাজ হয় না। মুখের ওপর বলে দেয় জানি না।

সুজিতদা কথা বলছে।

দেবাকে বলেছি কুড়িয়ে বারিয়ে যা পাওয়া যায় দিস, সংসারটা কোনও প্রকারে টেনে দিতে পারবো।

তোমার সংসারে কতো খরচ?

না তোকে আর আমার সংসার চালাতে হবে না।

আমি সুজিতদার দিকে তাকিয়ে।

ঠিক আছে। আমায় একমাস সময় দে। গুটিয়ে নেব। দাদা হিসাবে একটা ভুল না হয় করেই ফেলেছি। এবারটা ক্ষমা করে দে।

সুজিতদা কেমন গম্ভীর হয়েগেল।

হাসা-হাসির পরিবেশটা হঠাৎ কেমন থম থমে হয়ে গেল।

সুজিতদা মাথা নীচু করে কচুরী খাচ্ছে। কারুর মুখে কোনও কথা নেই।

হিমাংশুকে কয়েকটা গাইড লাইন দিয়েছি। সাদা চোখে যেটা মনে এল তাই বলেছি।

হিমাংশু বলেছে।

তুমি তো এবার ঝাড় খেলে।

কি করবো, লোভে পাপ পাপে মৃত্যু।

সবার সামনে তোমার সঙ্গে এইভাবে কথাবলছি বলে মনে কিছু করছো না তো?

দূর পাগল। তুই আমার ভাই। আমি বড়দিকে সব বলেছি। অনি না থাকলে সুজিতকে তুমি পেতে না। আজ সুজিতের যা দেখছো। ব্র্যাকেটে সব অনি বসিয়ে নিও।

বড়োমার বোনঝিকে বাগিয়েছো বলে খুব জোড় পাম্প করলে।

এই তুই আবার শুরু করলি। ঠিক আছে ফেরত দিয়ে দিচ্ছি।

তুমি ফেরত দেবার কে?

সুজিতদা আবার হেসে উঠলো।

তুই সত্যি বহুত ঘাঘু মাল।

এবার বলো, আমার কি আছে বল। আজ বাদে কাল চোখ বুঁজলে সবই তো ছেলে-বৌ পাবে।

কথা দিচ্ছি, তার আগে সব জঞ্জাল পরিষ্কার করে দেব।

জঞ্জাল তৈরি করতে কে বলেছে?

হয়ে যায়।

এই গল্প গুলো পুরনো হয়ে গেছে। কিছু নতুন বলার চেষ্টা করো।

তোর মতো অতো ভেবে কাজ করি না।

করতে কেউ বারন করেছে?

কথা দিচ্ছি আর কোনও উল্টপাল্টা হবে না।

এটাই তোমার মুখ থেকে এতক্ষণ শুনতে চাইছিলাম।

তোকে এই ব্যাপার নিয়ে ভাবতে হবে না।

কেন বলছি এটা তুমি নিশ্চই বুঝতে পেরেছ।

সে আর বলতে। তোকে কথা দিচ্ছি কেউ সহজে ট্যাপ করতে পারবে না।

চাঁদকে ব্যাপারটার দায়িত্ব দিয়েছি। এ ব্যাপারে তুমি মাথা ঘামাবে না। যদি কিছু কাগজপত্র চায় নির্দিধায় দিয়ে দেবে। বাকিটা ও বুঝে নেবে।

চাঁদ কালকে আমাকে একবার বলেছে। দুটো দিন তোকে কাছে কাছে পাব। ভেবেছিলাম ফাঁক মতো তোর সঙ্গে আলোচনা করবো।

গুবলুর বৌ, বৌদিকে এর মধ্যে টেনো না। ওদের দুজনকে পরিষ্কার রাখো।

তুই যখন বলছিস তাই হবে।

আমি বলছি না। তোমাকে ভাবতে বলছি।

তুই যখন বলেছিস, না ভেবে বলিসনি।

অনিকা তোমাকে চিঠি দিয়েছে।

ও তোর থেকে এক কাঁটা ওপরে।

কেন?

বলেছে ব্যাঙ্কে মিনিমাম ফাপাইভ ক্রোর ব্যালেন্স দেখাতে হবে।

দেখিয়ে দাও।

তারপর হাতে চুরি পরিয়ে নিয়ে যাক।

রাঘবন সাহি বাত বোলা অনিমেষবাবু। সাইনিং অথরিটি অনি কা পাসই রহেগা।

আফতাবভাইরা সকলে কথা বলতে বলতে ঘরে ঢুকলো। আমার দিকে চোখ পরে গেছে। আমি সোফায় হেলান দিয়ে দুজনের মাঝখানে বসে। দিদি আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো।

কখন উঠলি।

ঘুমোলাম কোথায়?

অনিমেষদা, বিধানদা হাসছে। সকলে খাবার টেবিলের চারধারে চেয়ারে বসলো।

আফতাবভাই বড়োমার দিকে তাকাল।

বড়োমা রেডি।

তোমাদের মিটিং শেষ।

ও তো চলতেই রহেগা। আবু অনিকে দিয়ে সাইন করিয়ে নাও।

আবুভাই আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।

আমি আফতাবভাই-এর দিকে তাকালাম।

কিসের সাইন!

ব্যাঙ্কের ফর্মে।

কেন?

অনিমেষদা হাসছে।

হাসছ কেন?

তোর এই কেনটার বহু অর্থ আছে। কোন অর্থে বলছিস বল?

তোমরা বহুত গণ্ডগোলে লোক।

তা তো বলবি।

ছোটো একটু চা খাওয়াও। বিধানদা বললো।

কচুরী খাবেন না?

কম করে দাও। শরীরটা ঠিক ভাল ঠেকছে না।

কেন তোমার আবার কি হলো? বড়োমা বললো।

তোমার ছেলে বাঁদরের মতো গাছের এক ডাল থেকে আর এক ডালে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে। কোন ডালে কখন বসে নাচানাচি করে বোঝা মুস্কিল। তারপর এই গাছ ছেরে লাফিয়ে আর একটা গাছে গিয়ে ওঠে। গতিবিধির ওপর নজর রাখতে গিয়ে শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে।

বিধানদা একবার আমার দিকে একবার বড়োমার দিকে তাকিয়ে কথা বলতে বলতে হাসছে।

মাসীমনি, বিধানদার দিকে তাকিয়ে। বড়োমা, ছোটোমা, বৌদিরা মুচকি মুচকি হাসছে।

কালকে থেকে সব কথা নিজের কানে শুনছো। একটু থেমে।

ও যদি সরকারটা চালাত বুঝতো কতো অবলিগেশন। কিছু করবো বললেই করে ফেলা যায় না। তারও অনেক প্রসেস মেইনটেন করতে হয়।

নিস্তব্ধ ঘরে বিধানদার গলা গম গম করছে। অনেকটা স্বগতোক্তির ঢঙে।

মাসীমনি, বিধানদার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।

তোমরা খাওয়া-দাওয়া করে বেরিয়ে যাও। আমরা একটু বেলার দিকে যাচ্ছি।

কেন?

কি বললাম এখুনি। ও ইমপ্লিমেন্ট করেছে। আমরা তাকে সরকারি মোহর লাগাব। তার জন্য পারিষদদের সঙ্গে বসতে হবে। ফর্মালিটি মেইনটেন করতে হবে।

খাবে কি?

তুমি এটা ছাড়া দ্বিতীয় আর কিছু ভাবতে শিখলে না। তাহলে তুমি আমাদের থেকেও অনিকে অনেক বেশি চিনতে। মনে মনে এতো কষ্ট পেতে না। আর ও এই সুযোগটার পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করেছে।

ও কোনও খারাপ কাজ করবে না।

কেন তুমি কথা বারাচ্ছ বিধানবাবু। ওকে তুমি বোঝাতে পারবে না। দাদা বলে উঠলো।

তোমরা কখনও বুঝিয়ে বলেছো যে বুঝবো। শুধু ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা। নিজের স্বার্থটা ছাড়া কখনও কিছু বুঝেছ। বলদের মতো খাটিয়ে নিয়েছো। বড়োমা শুরু করে দিল।

মেয়েরা, ছেলেরা হাসছে। মিত্রারা যে যার পেছনের সারিতে মুখ লুকিয়েছে।

সামনে তো বসে আছে বলতে পারছো না। দাদা ঝাঁঝিয়ে উঠলো।

কেন জিজ্ঞেস করতে যাব। চোখে দেখছি না। ও না থাকলে এতদিন মাঠে ঘাস কাটতে।

দেখলে দেখলে বিধানবাবু কোথা থেকে কোথায় চলে গেল। কে কথা বলবে ওর সঙ্গে।

বিধানদা হেসে ফেললো।

অনির বিষয়ে কোনও ট্যারা-বাঁকা কথা ওর সামনে তুমি বলতে পারবে না। তাহলেই আগুন জেলে দেবে।

কেন তোমার কি পাকা ধানে মই দিয়েছে শুনি। দু-নম্বরী করে টাকা কামাবে ও চাইলেই দোষ।

ছোটোমা, মাসীমনি মুখ টিপে হেসে ফেললো।

দাদা চুপ করে গেছে। বড়োমা একতরফা চালিয়ে যাচ্ছে।

কিছু খেতে দাও খিদে লেগেছে। আমি বললাম।

ছোটো ওকে দিস নি! মুহূর্তের মধ্যে বড়োমার গলার পরিবর্তন হয়ে গেল।

দামিনীদি দিয়েছিল বলেছে তুমি ওপর থেকে নিচে নামলে খাবে।

শেখো, সকাল থেকে নিজের চোব্বচোষ্য গেলা হয়ে গেছে। বড়োমা দাদার দিকে তাকিয়ে ঝাঁজিয়ে উঠলো।

বিধানদা, অনিমেষদা মাথা নীচু করে নিস্তব্ধে হেসে চলেছে।

শুভো। বড়োমা আবার চেঁচিয়ে উঠলো।

পেছন থেকে শুভো চিল্লিয়ে উঠলো, বলো।

আর একটা ধিঙ্গি কোথায়রে?

কার কথা বলছো বলো।

ন্যাকা জানিস না।

তুমি কখন কি বলো বোঝা মুস্কিল।

নম্রতা।

আকাশে আছে। সময় হয়ে গেছে এখুনি ল্যাণ্ড করবে।

শুভর কথায় বড়োমা হেসে ফেললো।

পর্বটা শেষ হলো।

আমি রাঘবনের দিকে তাকালাম।

বনি কই।

রেডি হচ্ছে।

ভাবি।

তোর সঙ্গে যাবে। আমি পরে যাচ্ছি।

তুমি কি ছুটি নিয়ে এসেছো?

কেন!

এমনি বললাম, মনে হলো।

স্টেটের কাজ সারতে এসেছি। এটা কি কাজ নয়।

তনুরা কচুরীর ট্রে নিয়ে এসে সকলের সামনে এগিয়ে দিচ্ছে।

মাসীমনির দিকে তাকাল।

তুমি কি খাবে?

এই তো খেলাম।

ও তো কর্নফ্লেক্স, তোমার খাবার। এটা একটা খাও।

দে। বিনয় এসেছে?

এসেছে।

আম্মি মেরা লাগেজকা চাবি কাঁহা হ্যায়। বসিরের গলা পেলাম।

নাসরিন কো পুছ।

বসির অনিকার দিকে তাকিয়েছে।

তুই এতো তাড়াহুড়ো করলে হবে। ও কি তোর মতো। ওর কাজ নেই। সকাল বেলা নাচতে নাচতে চলে এলি। বাইরের বারান্দায় ঝাঁজাল গলার স্বর পেলাম।

প্রতি উত্তরে একটা গোঁ গোঁ আওয়াজ হলো।

গলার স্বরটা চেনা চেনা মনে হলো।

কেন তুমি ওরকম করছো। আমি দাদাকে ডাকছি। নেপলার গলা পেলাম।

অনিসা ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেল। গেটের মুখ থেকেই বলে উঠলো।

তুমি! এসো এসো, বাবা এখানে।

অনিসা মিনিট খানেকের জন্য ঘরের দরজা থেকে উধাও হয়েগেল। সবার চোখে মুখে বিষ্ময়।

ঘরের দরজার সামনে যার মুখ প্রথমে ভেসে উঠলো সত্যি এই মুহূর্তে তাকে দেখে আমিও বিষ্মিত।

ভেঁদোদা! আমি সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম।

কিগো তুমি!

আর বলিস না…। পদু বললো।

পেছনে দেখলাম ঝুনে।

ভেঁদোদা কারুর দিকে তাকাল না। তীর বেগে আমাকে এসে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।

কি হয়েছে বলবে তো?

কাল থেকে আমার ঝুনের পিণ্ডি চটকে দিচ্ছে। পদু বলে উঠলো।

কেন?

তোকে ধরে নিয়ে যাবে, আবার মারবে।

ঘরের সবাই অবাক বিষ্ময়ে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে।

না না আমাকে কেউ ধরে নিয়ে যাবে না।

আমি ভেঁদোদার দিকে তাকালাম। ভেঁদোদা আমার দিকে জলে ভেঁজা চোখে তাকাল।

তোমাকে কে বললো আমাকে ধরে নিয়ে যাবে?

ওরা কাল রাতে গেছিল।

কারা!

চিনি না। তোর কথা জিজ্ঞাসা করলো। দিদিমনি যাবে বললো গেল না।

বুঝেছি।

বোঁচকা বুঁচকি নিয়ে চলে এসেছে। সে আর ওখানে থাকবে না। পদু চেঁচাচ্ছে।

থাম তুই। আমি বললাম।

আগে ওর কাঁধের বোঁচকায় কি আছে সেটা বার করতে বল। কোথ থেকে জোগাড় করেছে কে জানে, হিতে বিপরীত হবে। আবার এক ঝামেলা।

ভেঁদোদা পদুর দিকে কট কট করে তাকাল।

পদু হেসেফেললো।

উঁ প্রেসটিজ দেখাচ্ছে। অনিকে কিছু বলতে পারছিস না। সকাল থেকে আমাকে জ্যেঠুকে উদ্ধার করে দিয়েছিস।

অনিকা, অনিসা মুচকি মুচকি হাসছে।

আমি ভেঁদোদার দিকে তাকালাম।

চা খেয়েছো?

মাথা দোলাল। না।

সর্বেশ্বরজ্যেঠু দেয়নি?

খাইনি।

কি আছে ওতে?

থাক।

কেন?

তোকে ধরতে এলে খুন করে দেব।

আবার ভেঁদোদার চোখে মুখে ফুটে উঠলো অস্বাভাবিকতা।

অনিমেষদারা কেউ শব্দ করে হাসছে না। রাঘবনও দেখলাম এক দৃষ্টে ভেঁদোদার দিকে তাকিয়ে।

তোমার ঝোলায় যেটা আছে লুকিয়ে পদুকে দিয়ে দাও। বড়োমার কাছে চলে যাও, ভজু, তুমি এক সঙ্গে চা-কচুরী খাও। আমরা একটু পর বেরবো।

আমি যাব না।

আমি দেশের বাড়ি যাচ্ছি। কয়েকদিন পর ফিরবো।

আমি তোর সঙ্গে যাব।

ভেঁদোদার চোখমুখ ছল ছল করে উঠলো।

ঠিক আছে তোমার আর ভজুর জনিষ একসঙ্গে গুছিয়ে নাও।

এবার ভেঁদোদা আমাকে ছাড়লো। পকেট থেকে একটা পুরিয়া বার করে আমার হাতে দিল।

নিষ্পাপ মুখে অনেক কথা এর মধ্যে বলা হয়ে গেছে।

হেসে ফেললাম।

অনিসার দিকে তাকালাম।

মা একগ্লাস জল আনতো।

এতক্ষণ দুজনে আফতাবভাই আর দিদির ট্রানস্লেটরের কাজ করছিল।

অনিসা, অনিকা দুজনেই জোরে হেসে উঠলো।

ইসারায় ভেঁদোদার দিকে হাত বারিয়েছে।

ভেঁদোদা মুচকি মুচকি হাসলো।

কিগো ভেঁদোমামা আমাদের।

ভেঁদোদা লজ্জা পেয়েগেছে। মুখ নীচু করে নিল।

আমি ভেঁদোদার দিকে তাকালাম।

এটা ওদের দিয়ে দিই।

এটা তোর, ওদের আছে।

ওটা দাও।

বড়োমার ঘরে চল।

সবার সামনে দেওয়া যাবে না?

বার করতে হবে।

বুঝেছি। বড়োমার ঘরে গিয়ে বার করো। আমি যাচ্ছি।

সবাই নিস্তব্ধে হাসা হাসি করছে।

ভেঁদোদা ধীর পায়ে বড়োমার ঘরের দিকে চলে গেল।

পদুকে ইসারায় বললাম ওর কাছ থেকে জিনিষটা নিয়ে ওই ঘরে গিয়ে তোরা দুজন বোস, যাচ্ছি।

পদু হাসছে।

চলবে —————————–



from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/3mMhzil
via BanglaChoti

Comments