❝কাজলদীঘি❞
BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়
১৫২ নং কিস্তি
—————————–
বারান্দায় আসতেই দেখলাম ছগনলাল বাইরের ঘর থেকে বেরচ্ছে। আমাকে দেখে হেসে ফেললো।
ছোটাবাবু কুছু দিয়ে গেলাম।
চাটনিটা ভালো করে বানিয়েছ?
হাঁ হাঁ।
সকালে কেমন খেলে?
বাহুত ভালো খেয়েছে ছোটাবাবু।
ঘরে ঢুকতেই দেখলাম মিত্রাদের মুখ নড়ছে।
কিরে এরই মধ্যে….।
শুধু আমাদের দেখলি, সবার মুখের দিকে একবার তাকা।
আমি হাসলাম, ও ঘরে দিয়ে আয়।
টিনা রেডি করছে।
আমি সোফায় এসে বসলাম।
নিচে দেখলাম ঘণ্টা, পক্কে, ভজু খুব জোর লড়ে যাচ্ছে। মিলি, অদিতি, নিপাও ওদের সঙ্গে বসে গেছে। অনিকা, অনিসা পেঁয়াজ কাটছে। চোখ দিয়ে জল বেরচ্ছে।
এক কাজ কর মা।
মেয়ে, অনিকা আমার দিকে তাকালো।
বলো।
পেঁয়াজগুলো দু-ফালা করে একটু জলে ফেলে দে, দেখবি চোখ দিয়ে জল বেরবে না।
আঙ্কেল। মাম্পি তারস্বরে চিৎকার করলো।
মাম্পি, মিকির দিকে তাকালাম। সুরো দুটোকে টেবিলের ওপর বসিয়ে দুধ খাওয়াচ্ছে।
এসো।
কাছে এগিয়ে গেলাম।
বজু আটা দেয়নি।
মিকির দিকে তাকালাম।
আটা দিয়ে কি করবি?
ঠাকুর বানাবো।
উঃ, বলতে না পেরে যেন পেট ফুলে যাচ্ছিল। সুরো ধমকে উঠলো।
আমি সুরোর দিকে তাকালাম।
কখন থেকে বলে যাচ্ছে, আঙ্কেল আসুক বলবো। কতোবার ও ঘরের কাছ থেকে টেনে এনেছি।
কেন?
তুমি কথা বলছিলে।
তোদের সবেতেই বাড়াবাড়ি।
ভজু তুই মিকিকে আটা দিস নি?
দিয়েছি, মাঠে গিয়ে কাককে খাইয়েছে।
মিকির গালটা একটু টিপে দিলাম। হাসছে।
টিনারা খাবার প্লেট, চা নিয়ে ও ঘরের দিকে গেল। তনু আমার জন্য প্লেটে করে একটা লেট্টি একটু চাটনি আর চা নিয়ে এলো।
কি দারুণ খেতে। তনু বললো।
আগে খাও নি?
একবার। তোমার সঙ্গে কলেজ স্কোয়ারে একটা নিউজ কভার করতে গিয়ে।
এখন আর তাকে দেখতে পাই না।
সোফায় বসলাম।
তোমরা খেলে না?
ছগনদা তৈরি করছে, দিয়ে যাবে বলেছে।
বনি, নাগেশ কোথায়?
নেপলার সঙ্গে বেরিয়েছে।
কোথায়!
জনিনা।
পিপটু?
পিপটুকেও সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েছে।
ওরা কি কাল সকালের ফ্লাইটে চলে যাবে?
হ্যাঁ।
মিত্রা ওদের দুজনের জন্য চা নিয়ে এলো।
দু-জনে আমার দু-পাশে বসলো। ইসি অপরজিটের সোফায়।
এরা সব গেল কোথায় বল তো? মিত্রার দিকে তাকালাম।
কারা? চায়ে চুমুক দিল।
চিকনা, ইসলামভাই, নেপলা….।
একটু বেরিয়েছে সময় হলেই চলে আসবে।
মিত্রার দিকে এমনভাবে তাকালাম, তনু হেসেফেললো।
তাকাবি না। দেখলি তো কি বললাম অনুপদাকে।
রাতে ঘরে ঢুকবি না। অন্য জায়গায় শোবার ব্যবস্থা করবি।
ইস কতো খায়।
মিলি ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো, তোমায় ওঘরে ডাকছে।
যা, তুই এখন কোকা আর খোকা ছাড়া কথা বলছিস না।
মিত্রার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম।
দিদিভাই, তনুকে গল্পটা বলেছি। ভাবিস না সেই রাতের কথা ভুলেগেছি।
মিত্রার কোমড়টা চিমটে ধরলাম।
লাগছে ছাড়। চর্বি অনেকটা ঝরিয়েছি আরও আছে।
মিলি হাসছে।
ও ঘরের পজিসন কি?
মাথায় ঢুকলো না। তবে বহু টাকার হিসেব-নিকেষ চলছে।
চা খেয়ে উঠে দাঁড়ালাম। মিত্রা মুচকি মুচকি হাসছে। বেরিয়ে এলাম।
এ ঘরে এসে অনিমেষদাদের সঙ্গে বসলাম। কথা বললাম।
আজ সারাটা দিন ছেলেমেয়েদের বায়না শুনলাম। দিনটা ওদের জন্য বেশ ভালো কাটলো। হই-হুল্লোড়, ঠাট্টা-ইয়ার্কি, ফাজলামো। রাতে শুতে এলাম। তনু, মিত্রা আমার আগে এসে ঘরে ঢুকেছে।
আমি ঢুকতে তনু বলে উঠলো দরজা বন্ধ করে এসো।
দু-জনে চুল বাঁধছে আলমাড়ির আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে।
আমি বাধ্য ছেলের মতো দরজা বন্ধ করলাম।
মুখটা ওরকম ব্যাজারের মতো করে আছো কেন? তনু বললো।
দাঁড়া ভাবছে, খাটে না সোফায়। মিনিটে মিনিটে মত বদলায়। মিত্রা বললো।
আমি ওদের পাশ দিয়ে টেবিলের কাছে গেলাম। ওষুধের প্যাকেট থেকে ট্যাবলেট বার করে বোতলটা তুলে ঢক ঢক করে কিছুটা জল গিলে ওষুধগুলো খেয়ে নিলাম।
তুই এত ভালোছেলে হলি কবে থেকে—মিত্রা আবার খোঁচা মারলো।
আমি খাটে এসে শুয়ে পরলাম। দু-জনেই আমাকে দেখছে।
বড়োলাইটটা নিবিয়ে দে, ডোন্ট ডিস্টার্ব।
দাঁড়া তোকে এ্যাকটিং করাচ্ছি। বউদের সময় দিতে গেলেই তোর সময় থাকে না তাই না।
মিত্রা দাঁতে দাঁত চিপেছে।
আমি হাতটা চোখের ওপর রাখলাম।
সারাদিন সকলকে সময় দিতে বিরক্তি লাগে না। রাতে ঘরে ঢুকে যতো বিরক্তি। দাঁড়া যাচ্ছি।
আমি চুপ করে আছি।
সরে শুবি। আমি এই ধারে তনু ওই ধারে তুই মাঝখানে।
আমি হাতের ফাঁক দিয়ে একবার দেখলাম। তনু মুচকি মুচকি হাসছে। মিত্রা কট কট করে আমার দিকে তাকিয়ে।
তুই কি ভাবছিস আমি কিছু বুঝছি না। তুই কি আমাকে তনু পেয়েছিস। দাপাবি। হাতের ফাঁক দিয়ে দেখা বার করবো।
তনু, মিত্রার মুখের দিকে তাকালো—
আমি হাতটা সরিয়ে একটু হাসলাম।
আয় ঠান্ডা করে দিচ্ছি।
তনু এবার শব্দ করে হাসলো।
বালিশের ওয়াড় পরবি না?
তার আর দরকার লাগবে না।
তাহলে হবে কি করে?
সব হবে। আগে রেডি হই মজাটা দেখতে পাবি।
বাঘ অনেকদিন রক্ত না খেলে কি হয় জানিস?
দুটো বাঘিনী আছে। এটা ভুলে যাস না।
ক কিলো মাংস খেয়েছিস?
মিত্রা কোনও উত্তর দিলো না। তনুর দিকে তাকাল।
তুই আগে যাবি না আমি যাব। বাথরুমের দিকে ইসারা করলো।
আমি যাই।
যা।
হাউস কোর্ট বার করবো।
করো।
তনু বাথরুমে গেল। মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।
মেয়েটার কাছ থেকে সারাজীবন নিয়ে গেলি, কিছু দিয়েছিস?
তোর সামনে আজ সর্বস্ব দেব। তুই সাক্ষী থাকবি। না হলে বলতিস লুকিয়ে লুকিয়ে….।
কোনওদিন বলতাম না। মিত্রা গলাটা নামিয়ে নিল।
তনু বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো।
দিদি ট্যাঙ্কে মনে হয় জল কমে এসেছে।
সব্বনাশ, বলিস কি!
খুব শরু হয়ে জল পড়ছে।
মিত্রা দৌড় লাগাল।
তনু আলমাড়ির পাল্লা খুলে হাউস কোট বার করলো।
আমি তাকিয়ে থাকবো, না চোখ বন্ধ করবো।
যেটা ইচ্ছে। দিদির কাছ থেকে গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে গেছি। যেটুকু অবশিষ্ট আছে লুটেপুটে নিই।
সত্যিরে তনু। রাতে বাথরুম পেলে কি করবো। মিত্রা বাথরুম থেকে বেরিয়ে বললো।
বালতিতে জল ভরে রেখে আয়। যতটা কাজ সামলানো যায়।
এক বালতি ভরে রেখে এসেছি।
কোনটা পড়বে। তনু মিত্রার দিকে তাকাল।
যে কোনও একটা দে-না, শোবো তো দু-জনে ওর পাশে। ভেতরে কিছু পরবি নাকি?
আমার কেমন সির সির করে।
তুই পর, আমি পরবো না।
তনু হাসছে। আমি ওদের কথা শুনছি। জীবনে প্রথম তিনজনে এক ঘরে এইভাবে কথা বলছি। একদিন কল্পনাই করতে পারিনি, জীবনে আমার এইরকম একটা দিন আসতে পারে।
ভাব সাগরে ডুববি না।
ওদের দিকে তাকালাম। তনু পেছন ফিরে হাউসকোর্ট চড়াচ্ছে, কোনও সঙ্কোচ নেই। মিত্রা সব কিছু খুলে ফেলেছে। আমার চোখ দুটো ছোটো ছোটো হয়ে গেল।
চোখতো না যেন মাইক্রোস্কোপ।
তনু ঘুরে দাঁড়ালো, বুকের কাছটা উন্মুক্ত। মিত্রা কিছুই পরলো না।
সোরে শো আমি ধারে।
তোরা দু-জনে আমাকে টিপে মারার ধান্দা করেছিস নাকি?
কেন!
যেভাবে সাজো সাজো রব করে আসছিস।
মিত্রা আমাকে ঠেলে ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে পাশে শুয়ে পড়লো। তনু বড়োলাইটটা অফ করে খাটে উঠে এলো। আমি চিত হয়ে শুয়ে। দু-জনে পাশ ফিরে আমার দিকে। মুখের কাছে মুখ।
এবার অনিকার কেশটা ডিটেলসে বল। যা শুনেছি ভাসা ভাসা।
নতুন কিছু নেই, যা বলার বলে দিয়েছি।
ওর গয়নাগুলো কি সব মেরিনাদি করেছিল?
নব্বইভাগ। বাকি কিছুটা আমি দিয়েছি।
প্রায় একশো ভরি!
হবে হয়তো, আমি বাক্সটা সেইভাবে দেখিনি। সেদিনই প্রথম দেখলাম। তবে অনেকটা টাকাই ইসলামভাইয়ের।
মেয়েটা সত্যি খুব ভালো। তনু বললো।
এর জন্য ফাদারের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ। তখন তোরা কেউ আমার জীবনে ছিলি না। তোকে পেয়েও হারিয়েছি। ভেতরে ভেতরে ভীষণ ছটফট করতাম।
তখন ওরা তিনজনেই আমার সব ছিল। ওদের আঁকড়ে ধরেই আমার সময় অনেকটা কেটে যেত। আমার সব স্বপ্নছিল ওদেরকে ঘিরে।
তখন তনুকে চিনতিস না।
চিন্তাম না তা নয়। বেশি কথা বলতাম না। তনু আমাকে ন্যাস্টি সাংবাদিক বলতো। আমি ওর সঙ্গে গেলে ওর প্রেস্টিজ নষ্ট হয়ে যেত।
তনু ঘুসি তুললো।
আমি মিথ্যে বলছি, তুমি বলো? তুমি মল্লিকদার কাছে রিপোর্ট করতে না?
একবার করেছিলাম। তার জন্য তোমার কাছে ক্ষমাও চেয়ে নিয়েছি।
আমি দু-জনের শরীরে তলা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে দিলাম।
ওরা আমার হাত রাখার জায়গা করে দিল। শরীরে একটা অংশ আমার ওপর তুলে দিল। এখন অনেকটা নিবিড়ভাবে ওদের জড়িয়ে রয়েছি। ওদের উষ্ণ নিঃশ্বাস আমার ঘারের কাছে।
জানিস মিত্রা একটা সময় তোদের দু-জনকে নিয়ে আকাশ কুসুম চিন্তা করতাম। বার বার মনে হতো আমি ভুল করছি। একবার ভাবতাম, মিত্রাকে আর পাব না। তনুই আমার জীবনে আসুক। আবার তনু যখন কাছে এসে দাঁড়াত, তখন ভাবতাম—আমি তো মিত্রাকে প্রমিস করেছি। তার কি হবে?
একদিন যুদ্ধ করতে করতে দেখলাম তুই জিতে গেছিস, তনু হেরে গেল।
একবুক অভিমান বুকে নিয়ে তনু চলেগেল লন্ডন। আমি যদি একবার বলতাম তুমি যেও না। তাহলে ও যেত না। বিশ্বাস কর।
যেদিন রাতে তোর বাড়িতে মিটিং সেরে এলাম, তার ঠিক পরের দিন তনু ফ্ল্যাটে এলো। ওই রাতে তুই জেদ ধরলি। আমার শরীরটাকে দলামচা করে একবারে নিঃশেষ করে দিলি।
তোর কাছ থেকে বড়োমার কাছে না গিয়ে ফ্ল্যাটে এলাম।
সারাটা রাস্তা তোর কথা ভাবছিলাম। অতো বড়ো বাড়িতে তুই একা। কিছুতেই মেলাতে পারছি না। তোর শরীরের গন্ধ তখন আমার সারাটা শরীরে ম ম করছে। একটা নেশাগ্রস্ত ভাব।
সেদিন অঝোড়ে বৃষ্টি পরছিল।
তনু এল বিকেলের দিকে। সর্বাঙ্গ ভিঁজে চপচপে। আমার একটা পাজামা পাঞ্জাবী ওকে পড়তে দিলাম। তারপর তনুর আনা ফিস কাটলেট খেলাম। তনু ওর কথা বললো। আমি ওকে বোঝালাম। তারপর ঠিক এইভাবে আমার বুকের ওপর মুখ রেখে তনু হাপুশ নয়নে কাঁদলো। নিজের খুব খারাপ লেগেছিল। কিন্তু সেদিন তনুর শরীরে গন্ধ তোর শরীরে গন্ধের কাছে হার মেনেছিল। তনু আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিল। কিন্তু আমি জানতাম ও আমার খোঁজ খবর রাখে। দেবাদের সঙ্গে তাজে বসে যেদিন প্রথম কথা বলছিলাম সেদিন একটি ছেলে এসে আমার কাছে তনুর সংবাদ দিল। এমনকি তনুর ফোন নম্বর পর্যন্ত।
টাইমস অফ ইন্ডিয়ার ফটোগ্রাফার….। তনু বললো।
এখন ঠিক মনে নেই নামটা।
তারপর তো নানা ঝামেলায় নিজে জড়িয়ে পড়লাম।
একদিন ওকে মেল করে সব জানালাম। বলতে পারিস সেদিন ওর কাছ কনফেস করেছি। প্রায় দশ-বারো পাতার মেল। ব্যানার্জীর আসল চেহারা ধরা পরেগেছে। ওর কাছে সাহায্য চাইলাম।
সেদিন কিন্তু তনু আমাকে ফিরিয়ে দিতে পারতো, ফিরিয়ে দিল না। বরং আমাকে দু-হাত দিয়ে বুকে টেনে নিল। তারপরের ঘটনা সব তুই জানিস।
বিশ্বাস কর আমি এতদিন অপেক্ষা করেছি আজ রাতটার জন্য। তোরা একদিন একসঙ্গে দু-জনে আমার বুকে উঠে আসবি। শরীরটা পৃথিবীর সব নয়। ওটা একদিন নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু মনটা।
আমি একবার মিত্রার দিকে তাকালাম একবার তনুর মুখের দিকে তাকালাম। দু-জনে স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে।
কিরে তোদের কি মনে হচ্ছে আমি এ্যাক্টো করছি।
একজন আমাকে জড়িয়ে ধরলো, একজন আমার বুকে মাথা রাখলো।
জানিস আমি আমার শরীরে এক সঙ্গে দুটো নদীকে ধারণ করেছি। তারা আমার শরীরে স্নাত হয়ে একইভাবে বয়ে চলেছে আজ বিশ বছর ধরে।
আমি কিছুতেই সঙ্গমের হদিস পাচ্ছিলাম না। আজ মনে হয় পেলাম।
দু-জনে আরও নিবিড় করে জড়িয়ে ধরলো।
মাঝে মাঝে আমি ভাবি, আমি কি গডফাদার, না রবিনহুড, না নিজেকে ভগবানের পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাইছি? নিজের প্রশ্নের উত্তর নিজে পাই না। তবে একটা জিনিস খুব ভালোভাবে অনুভব করি। আমার মনের মধ্যে বাঁধন আছে, তবু আমি বহেমিয়ান।
তোরা দু-জন আমার এই বহেমিয়ান, যাযাবর পনাকে আরও উসকে দিয়েছিস। তোদের সমস্যাগুলো ছাড়া আমার ওপর তোরা জোর করে কিছু চাপিয়ে দিসনি। সেই যে তোকে নিয়ে পড়েছি, আজও তার রেশ চলেছে। তনু তার জেদগুলো আমার ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। মেনে নিয়েছি।
খুব ভয় ছিল অনিসা, অনন্যদের নিয়ে, ওরা সুন্দরকে সেইভাবে মেনে নেবে কিনা। কিংবা পক্কে, ঘণ্টা, অনিকাকে। আশা রাখি ওরা আমার সমস্যাটা অনুভব করেছে, বুঝতে পেরেছে। ওদের বাবা কিংবা মামারূপে আমি কোনও অন্যায় করিনি।
তবে বড়োমা, ছোটোমা, দাদা, মল্লিকদার ঋণ আমরা কেউ কোনওদিন শোধ করতে পারব না। অনিকাদের ঠিক রাখার জন্য ফাদারকে পেয়েছিলাম। সুন্দরের জন্য তনুকে পেয়েছি। অনিসা, অনন্যর জন্য পেয়েছি বড়োমা, ছোটোমা, তোকে।
দামিনীমাসিও অনেক করেছে। মিত্রা বললো।
তুই কাকে ছেড়ে কাকে ধরবি। দাদা, বড়োমা, ছোটোমা যদি দামিনীমাসিকে মেনে না নিতো।
এর জন্য তোর অবদান অনেক। তুই খুব সুন্দর ভাবে সবার মধ্যে একটা সেতুবন্ধন করেছিস।
মিত্রা আমার মাথায় হাত বোলাচ্ছে।
আমি তনুকে বলেছি। তোমার নামটা যখন প্রথম শুনেছিলাম, তোমাকে মেনে নিতে পারিনি। আমার কাছ থেকে তুমি বুবুনকে ছিনিয়ে নেবে, আমি মেনে নিতে পারবো না। কিন্তু তুমি বুবুনকে ছিনিয়ে না নিয়ে পাশে থাকতে চাইলে, তুমি বুবুনকে সেই সময় ভীষণভাবে সাহায্য করলে।
তুমি শুধু ওকে ভালোবাসনি আমাকেও ভালোবেসেছিলে, তাই তুমি ওকে প্রাণদিয়ে সাহায্য করতে পেরেছো। তুমি বুবুনকে সেই সময় না-ও সাহায্য করতে পারতে। কারণ তোমার ওকে পাওয়া হয়নি। যে পেয়েছে সে বুঝুক।
তনু হাসছে।
বিশ্বাস করো মিত্রাদি অনি আমার জীবনে প্রথম পুরুষ। ওর ওপরে অনেক অভিমান করেছি, কিন্তু কিছুতেই ভুলে থাকতে পারিনি।
ওকে ভুলে থাকার জন্য চব্বিশঘণ্টা কাজ করার চেষ্টা করতাম। যখন ক্লান্ত হয়ে পরতাম, তখন ঘুমিয়ে পরতাম। প্রত্যেকদিন বন্ধুদের কাছ থেকে ওর খোঁজ খবর নিতাম। বিশেষ করে সন্দীপদার কাছ থেকে রেগুলার।
ওখানে পৌঁছে একটু নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে যখন প্রথম ফোন করলাম সন্দীপদাকে তখন আমার মাথায় বাজ ভেঙে পড়লো। আমি প্রথমে বিশ্বাসই করিনি তোমার সঙ্গে ওর কোনওদিন কোনও রিলেশন ছিল। সব শুনে আমি স্ট্যান্ট।
তারপর শোনো না মিত্রাদি সন্দীপদা বললো তুমি ওকে মালিক বানিয়ে দিয়েছ। আমাদের যারা খতি করেছিল তাদের একটা একটা করে ধরে ও কচুকাটা করছে। তখন ভীষণ আনন্দ হচ্ছিল।
প্রায় দু-মাসের মাথায় ওকে একটা ম্যাসেজ করলাম। কোনও উত্তর পেলাম না। বুঝলাম ও আমাকে ভুলে থাকতে চাইছে। বিরক্ত করলাম না। হঠাৎ একদিন মেল বক্স খুলে দেখলাম ও মেল করেছে। ওর মেলটা পড়তে পড়তে কেঁদে ফেলেছিলাম। আবার যেন ওকে ফিরে পেলাম।
বুবুনকে জিজ্ঞাসা কর ও জানতো কিনা আমি ওই হাউসের মালিক। মিত্রা বললো।
জানবে কি করে! ওর সঙ্গে ওই হাউসের সম্পর্ক ছিল মাত্র দু-জনের। এক দাদা, দ্বিতীয় মল্লিকদা। আমি থাকাকালীন হাউসের অনেকে ওকে নামে চিনতো, কোনওদিন দেখেনি। একমাত্র দাদার ঘরে যারা যেত, তারা ওকে চিনতো।
তুই আমাকে চিনতিস। মিত্রা তনুর দিকে তাকাল।
যাওয়া আসার পথে তোমাকে কয়েকবার দেখেছি। ওই এক ঝলক। তোমার ঘরে কোনওদিন যাওয়ার প্রয়োজন হয়নি।
মিত্রা হাসছে।
আমার দৌড় মল্লিকদা। ম্যাক্সিমাম দাদা। বেশিরভাগ সময়েই মল্লিকদার কাছেও যেতে হতো না। সন্দীপদাই সব বুঝিয়ে দিত।
শোনোনা ওর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়ের ঘটনা বলছি। আমি সারাজীবন মনে রাখবো।
আমি দু-জনের কথা শুনে যাচ্ছি। মনে মনে হাসছি।
সেদিন এসইউজুয়াল যেমন অফিসে ঢুকি তেমন ঢুকেছি।
অফিসে ঢোকার পর সন্দীপদা বললো, তনু তুমি মল্লিকদার সঙ্গে একবার দেখা করো।
গেলাম, মল্লিকদা বললো, তুই অনিকে চিনিস?
ওকে তো কখনও দেখিনি। নাম শুনেছি। বললাম, নামে চিনি। বহুত দেমাক।
মল্লিকদা আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো।
বললো ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে চলে যা। আজ উৎপল দত্তের একটা শো আছে। ভালো করে কভারেজ করবি। দাঁড়া অনিকে একবার ধরার চেষ্টা করি আছে কিনা।
যতদূর মনে পরছে মল্লিকদা ছোটোমার সঙ্গে ফোনে কথা বললো। আমার দিকে তাকিয়ে বললো। ফার্স্ট রোর একবারে ডানদিকের শেষ সিটে ও বসে থাকবে। তথাস্তু। কাজ বুঝে নিলাম।
একটু বিকেল হতেই হলে চলে গেলাম। ছটায় শো আরম্ভ।
জোর ফন্দি আঁটলাম ছেলেটার সঙ্গে আজ জমিয়ে আলাপ করতে হবে।
ছেলেদের এতো দেমাক থাকা ভালো নয়।
দেখি ওই জায়গায় আমাদের কাগজের জন্য দুটো সিট রয়েছে। আমি বসে পরলাম। নাটক শুরু হয়ে গেল বাবুর পাত্তা নেই। আমি আমার কাজ করে চলেছি। নাটক শেষ হয়ে গেল, বাবুর পাত্তা নেই। মেজাজ কিরকম লাগে বলো। আমার সমস্ত প্ল্যান প্রোগ্রাম চটকে চাটনি হয়ে গেছে।
নাটক শেষ হতে আমি গ্রিণরুমে গিয়ে বেশ কয়েকজন আর্টিস্টের পোর্টেট তুললাম। পরে যদি কাজে লাগে।
মল্লিকদাকে ফোন করে বললাম, আমি আজ আর অফিসে যাচ্ছি না। কাল ফার্স্ট আওয়ারে যাব।
ওর কথা কিছু বললি না, ও যে যায়নি। মিত্রা বললো।
না। শোনো না।
পরদিন সকালে অফিসে গেছি।
মল্লিকদা হেসে বললো, কিরে সব ছবি তুলেছিস—
মাথা দুলিয়ে বললাম তুলেছি। মনে মনে ভীষণ রাগ হচ্ছে। বললাম, আপনার ঢ্যাঁটা সাংবাদিক যায় নি। আনকালচার্ড একটা ছেলেকে আমার সঙ্গে পাঠান কেন?
মল্লিকদা হাসতে হাসতে বললো, হতেই পারে না।
তারপর আমাকে ইশারায় বললো, ওই দেখ বসে বসে লিখছে।
বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে লিখছে। তখন আমি রাগে গড়গড় করছি।
তখন ওর মুখ দেখিস নি।
দেখবো কি করে! পেছন ফিরে ওর চেয়ারে বসে লিখছে। ওর পেছনটা দেখতে পাচ্ছি।
কিছুক্ষণ পর চেয়ার থেকে উঠে এসে মল্লিকদার টেবিলের সামনে দাঁড়ালো। বললো, আজ এই একটা কপি দিলাম। আমার ছুটি। মাল জোগাড় হলে বিকেলে দেখা পাবে, না হলে কাল।
মল্লিকদা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে।
আমি তখন যেন ভূত দেখছি।
কিরে কাল ও না গেলে এতবড়ো কপিটা লিখলো কি করে?
মল্লিকদা আমার দিকে তাকিয়ে, আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে।
এটা সানডের ফার্স্ট পেজ। মল্লিকদা বললো।
আপনি কালকে আমাকে গ্রীণ রুমে ভাঁড়ে করে চা আর মিষ্টির প্যাকেট দিলেন না?
হ্যাঁ, তাতে অসুবিধে কোথায়?
অ্যাঁ!
আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে।
মল্লিকদা বললো, দাঁড়া দাঁড়া কি বললি?
উনিতো কালকে আমাকে…. আবার রিপিড করলাম।
তোমরা গল্প করো, আমি চলি।
একমুহূর্ত দাঁড়াল না। নিউজরুম থেকে বেরিয়ে গেলো। কি ঔদ্ধত্য তুমি চিন্তা করো।
আমি কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইলাম। তারপর মল্লিকদাকে বললাম কপিটা আমাকে দিন তো একটু পড়ি।
তুমি বিশ্বাস করো মিত্রাদি, কপি পড়ছি আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। নাটকের সমালোচনা মাত্র দু-প্যারা, বাকিটা পুরো গল্প। নাটক তৈরির ইতিহাস।
তখন আমি একটা ঘোরে আছি, সম্মোহনের মতো মল্লিকদার কাছে এসে কপিটা ফেরত দিলাম।
কিরে এডিট করার দরকার আছে?
বললাম, কলম ছোঁয়াবার জায়গা রাখেনি।
তাহলে এবার বল। তোর এত কাছে থাকল, তুই চিনতে পারলি না।
আমি মল্লিকদার মুখের দিকে তাকিয়ে।
ভাবছিস, এতোবড়ো কাগজের সাংবাদিক সে কিনা ওখানে চা দিচ্ছিল।
আমি ঠিক মেলাতে পারছিনা মল্লিকদা।
পারবি না। আরও একজন ফ্রিল্যান্সারকে পাঠিয়েছিলাম বেশ ভালো লেখে। অপেক্ষা কর সেও লেখা জমা দিয়ে যাবে। তুই আজ ঠিক করবি কার লেখাটা রবিবারের ফ্রন্ট পেজে যাবে। আজ তোর এটাই কাজ।
সেদিন সারাদিন অফিসে ছিলাম। মনটা খচখচ করছে। মল্লিকদা আমাকে সেই লেখাটাও পড়িয়েছিল। পাতি লেখা বলতে যা বোঝায় তাই।
ধরে ধরে নাটকের দৃশ্য নিয়ে আলোচনা, কোনটা ভালো কোনটা মন্দ কে ভালো অভিনয় করেছে তাই লিখেছে।
পড়ার পর মল্লিকদাকে কপিটা ফেরত দিলাম।
মল্লিকদা হাসছে। তোর মুখ দেখে বুঝে গেছি তোর ডিসিশান।
এবার বল কেন অনির পাগলামো হাউস সহ্য করবে না। যে গরু দুধ দেয় তার লাথি খেতে হয়। ও আমাদের হাউসের এ্যাসেট। তাই ওর সব ওজর-আপত্তি আমরা দু-জনে সহ্য করি।
থাকে কোথায়?
খুব কঠিন প্রশ্ন করলি।
কেনো!
একমাত্র ওর বড়োমা, ছোটোমা একটু আধটু ওর ঠিকানা জানে। সেই ঠিকানায় কখনও লোক পাঠালে সে ফিরে এসে বলেছে, তালা বন্ধ আছে।
বড়োমা, ছোটোমা কে?
মল্লিকদা হেসে বললো। অনির ছোটোমা আমার স্ত্রী। বড়োমা অমিতাভদার স্ত্রী।
সেদিন বড়োমা, ছোটোমার পরিচয় পেলাম।
তারপর ওর সঙ্গে গায়ে পরে আলাপ করতে চেয়েছি, পাত্তাই দেয়নি।
তখন ওই হাউসে দশজন এক্সিকিউটিভ আমার পেছনে ঘুরছে। কত নাম তোমায় বলবো। একবার ইশারা করলেই চলে আসে। আর আমি ওকে নিয়ে পড়েছি।
এর মধ্যে তিন চারদিন ওর সঙ্গে নিউজ করতে গেছি। একটু একটু কথা বলে। একদিন কলেজ স্কোয়ারে লেট্টিও খাওয়ালো।
মিত্রা হাসলো।
অনেকভাবে বোঝাবার চেষ্টা করেছি। আমি শুধু তোমারি, আমি শুধু তোমারি।
দূর আমার চোখের ভাষাকে পাত্তাই দেয় না।
তারপর ঝাড়গ্রামে একটা কভার করতে দু-জনে গেলাম। তিনদিন, তিনরাত থাকলাম।
তোমাকে মিথ্যে বলবো না মিত্রাদি। তখন আমি এ্যাডামেন্ট। যে ভাবেই হোক অনিকে আমায় তুলতে হবে। গাড়িতে বসেই শুরু করে দিলাম।
আমি তখন মেনকা। বিশ্বামিত্রের ধ্যান আমাকে ভাঙাতেই হবে। তাতে যদি শকুন্তলার জন্মহয় হোক। আমাদের আলাদা ঘর দিয়েছিল। ওদের বুঝিয়ে শুনিয়ে এক ঘরে রাত কাটালাম।
ব্যাশ বিশ্বামিত্রের ধ্যান ভঙ্গ হলো।
ফেরার সময় আমার সঙ্গে প্রয়োজন ছাড়া একটা বাড়তি কথাও বলেনি। এই বাড়ির গেটের সামনে নেমে শুধু বললো।
আমাকে ক্ষমা করো তনু। আমি জেনেশুনে জীবনে প্রথম একটা ভুল কাজ করলাম।
আমি ওর মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে।
আর কোনওদিন দ্বিতীয়বার এ ভুল করবো না।
তুমি একবার ভাবো, এই সব ঘটনা ঘটার পর একটা মেয়ের ইমোসান কোথায় থাকতে পারে। আর ও কিনা এক ঝটকায় তাকে মাটিতে আছাড় মেরে ফেললো?
বিশ্বাস করো আজও পর্যন্ত আমার অনুমতি নিয়ে দু-বার বাদ দিলে, দ্বিতীয়বার আমার সঙ্গে সেই ভুল কাজ করেনি। অনেক সুযোগ দিয়েছি। আমাকে খুব সন্তর্পনে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। তাহলে বলো ওকে ছেড়ে কি করে থাকি।
যখন জানতে পারলাম ও একান্তই তোমার, তখন ওর প্রতি শ্রদ্ধায় আমার মাথা নুয়ে পড়েছে। আরও বেশি করে যেন ওকে জড়িয়ে ধরলাম।
তারপর যখন লন্ডন গিয়ে আমাকে সব বললো। তখন আমি মনে মনে ঠিকই করে ফেললাম আমার জীবনে অনি ছাড়া দ্বিতীয় কোনও পুরুষের স্থান নেই। এটলিস্ট একটা সন্তান ওকে চাইবো। অনেক ঘ্যানর ঘ্যানর করারা পর সুন্দরকে দিলো। তখন অনুপদাকে দিয়ে ম্যারেজ রেজিস্ট্রি করলো।
আইনত সিদ্ধ করে সুন্দরকে এখান থেকে নিয়ে গেল।
তখন তো অনি মরে গেছে। মিত্রা বললো।
হ্যাঁ। খাতায় কলমে।
জানিনা কোথা থেকে কাগজপত্র জোগাড় করেছিল, দেখলাম নাম অনিন্দ ব্যানার্জী। আমার সঙ্গে অনিন্দ ব্যানার্জীর বিয়ে হলো। ঠিকানা সুমন্তদের গ্রাম।
অনেক কপচেছো এবার লাট খাও দেখিনি।
মিত্রা দাঁত মুখ খিঁচিয়ে আমার গালটিপে নারিয়ে দিলো।
টিপে ঠোঁট দিয়ে রক্ত বার করে দেবো।
তোরা কিন্তু দুজনে মিলে আমাকে শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন করছিস।
বেশ করছি। কিছু করতে পারবি।
তনু তোমার হাত কিন্তু গণ্ডগোল করছে।
আমার নয় মিত্রাদির।
আচ্ছা আমাকে একটু ঠিকমতো নিঃশ্বাস নিতে দে।
যেরকম ভাবে শুয়ে আছিস সেইভাবে থাকবি। ছোটোমার কথা শুনবি না?
ঠিক বলেছিস। ওটা আমার জানার দরকার।
তোর অনেক কিছু জানার বাকি আছে, সময় দে। সব বলবো।
এই তো দিচ্ছি।
সে তো জোড় করে।
ঠিক আছে প্রতিদিন রাতে ঘুমবার আগে দু-ঘণ্টা।
কালকেই বলবি। মিত্রা শরীরটা গণ্ডগোল করছে, আমি সোফায় শুলাম, তোরা খাটে শো।
কিরে কথা বলছিস আর হাতও কথা বলছে।
এটা তনু আমি নয়।
তনুর দিকে তাকালাম। চোখ ছোটো করে হাসছে। একটু খানি, তুমি দাও না। বারন করবো না।
ছোটোমার কথাটা বল।
তুই তো চলেগেলি, ছোটোমা খাটে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। ছোটোমাকে ওইভাবে কাঁদতে কোনওদিন দেখিনি। কি খারাপ লাগছিল। তোর সঙ্গে যা কথা হলো মাথায় কিছুই ঢুকছে না। আমি তনু ভ্যাবলার মতো বসে।
তাহলে আয়েষা কে? তারওপর অর্জুনের গল্প। মাথাটা বন বন করে ঘুরছে।
ছোটোমাকে বললাম, কি হয়েছে একটু বলো।
ও একটা পাথর। সব সময় নিজে বয়ে বেড়াবে।
সত্যি মাথাটা খারাপ হয়ে যেতে বসেছে তখন।
তারপরই দেখি বড়োমা গেটের কাছে হাজির।
অনি কোথায় গেলরে ছোটো? গম্ভীর গলা।
ছোটোমা বড়োমার দিকে তাকাতেই সব গুবলেট।
তুই কাঁদছিস কেন! অনি তোকে কি বলেছে?
কিছু না।
আমাদের জেড়া করা শুরু হলো।
বড়োমার পেটেন্ট ডায়লগ মুখ থেকে তখন ফুলঝুরির মতো বেরচ্ছে।
ওরা কিছু জানে না। ছোটোমা বললো।
তাহলে দুটোতে মিলে ওর সঙ্গে শুস কেনো। যদি কথাই বের করতে না পারবি।
বড়োমার কি কথার ছিড়ি একবার ভেবে দেখ।
ছোটোমা ধমকে উঠলো, চুপ করবে।
ছোটোমার ওই তারস্বর চিৎকারে বড়োমা ঘাবড়ে গেল।
চুপ করে এখানে বসো।
বড়োমা দেখলাম শুর শুর করে ছোটোমার পাশে বসে পরলো।
চুপচাপ চারজনে বসে আছি। কারুর মুখে কোনও কথা নেই। বড়োমা একবার আমার মুখ দেখে একবার তনুর মুখ দেখে, আবার ছোটোমার মুখ দেখে। ঠাহর করতে পারছে না ব্যাপারটা কি হয়েছে। ছোটোমার ধমকানিতে কথাও বলতে পারছে না।
ডাক্তারদাদা এলো। ওইরকম ভাবে আমাদের বসে থাকতে দেখে প্রথমে ঘাবড়ে গেল।
কি হয়েছে!
ছোটোমাই বললো, বসুন দাদা বলছি।
তারপরে ছোটোমা সব বলতে আরম্ভ করলো। আমার তনুর তখন মাথা ঘুরছে।
কাকে কি বলবো, যেন আকাশ থেকে পরছি। ডাক্তারদাদার মুখ গম্ভীর।
ছোটো তুমি কোনদিন থেকে ওকে ফলো করছো।
গত সাতদিন।
আমরা যেদিন এলাম।
হ্যাঁ। দিদি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললো না, তোর চোখমুখটা কেমন শুকনো শুকনো লাগছে।
হ্যাঁ।
ভাবলাম, নার্সিংহোমে ছিল তারওপর উনমাস্টারের শ্রাদ্ধ থেকে ফিরেছে, মনটা হয়তো ভালো নয়। দামিনীদিকে জিজ্ঞাসা করলাম, বললো ছোটো তোকে বলবো আর একটু দেখি। তারপর বললো, আয়েষা মনুর মেয়ে। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে ওর চোখ মুখের চেহারা তত শুকনো হচ্ছে।
আমাকে একবার বলবে তো।
বলবো কি দাদা। ঠিক মতো ধরতেই পারছিলাম না। কাল রাতে দিদি যখন ওকে চেপে ধরলো, তখন খুব রাগ করেই বললো, বললে তোমার আমার সমস্যার সমাধান করতে পারবে? তখন আমার মনটা কেমন যেন কু গেয়ে উঠলো। চা খেয়ে ও আর বসলো না সোজা বাগানের দিকে চলে এলো।
আমি দোতলায় আমার ঘরে চলে গেলাম। বাগানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এক ঘণ্টা কাদের সঙ্গে কথা বলে গেল। উসমানের নাম শুনলাম। চিনার নাম শুনলাম। বললো কাল সকালে ও যাবে।
কোথায় যাবে কার কাছে যাবে কিছু বুঝলাম না।
শেষে অর্জুনের সঙ্গে কথা বললো।
অর্জুনকে বেশ রাগ করে বললো, যে ভাবেই হোক আমার কাজ হাসিল করতে হবে।
তখনই আমি ধরতে পারলাম, আয়েষা নয় আবিদ দু-জনের কাউকে ও সরাবে। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তখন আমি স্থির বিশ্বাস করে ফেলেছি আয়েষা আমার ভাইঝি নয়। কিন্তু আবিদ, আয়েষার কি হবে দাদা। আপনি মনুকে একবার ডেকে পাঠান।
যাওয়ার সময় ওকে কেমন দেখলে?
ওর চোখ মুখ ভালো লাগেনি।
আজ সকালে আমরা দু-জনেও ওকে দেখে ভীষণ ভয় পেয়েগেছিলাম। কি চোখ মুখ। হিংস্রতা যেন ফুটে বেরুচ্ছে। তনু বললো।
ইসলাম কোথায়?
ও এখন আবিদের ওখানে আছে। ছোটোমা বললো।
বড়োমা থতমার মতো বসে আছে। তখন কাঁদতে শুরু করেছে।
ডাক্তারদাদা নিজে ফোন করলো ইসলামভাইকে।
তখন বাড়ির সকলে উঠে পরেছে। তোর মেয়ে উঠেই বাবার খোঁজ। বাবা ভোক্কাট্টা।
দারুণ খেল জমিয়ে দিয়েছে। বার বার তনুকে আমার বিয়ের দিনের কথা বলি।
বড়োমা ডাক্তারদার হাতে ধরে হাউ হউ করে কেঁদে ফেললো। তুমি একটা কিছু করো ডাক্তার, কাজের বাড়ি, ও আমার পাগল ছেলে কোথায় কি করে বসে।
পর পর সব হাজির হতে শুরু করেছে।
ইসলামভাই পরি কি মরি করে ছুটে এলো।
সব শুনে ইসলামভাই তখন ঘন ঘন বাথরুমে যাচ্ছে।
বার বার বলছে অনি এ কাজ করতে পারে না। ছোটোমাকে বলছে, দিদি তুই ঠিক করে বল।
ছোটোমা বার বার বলছে। ওর সঙ্গে যখন শেষ কথা হলো, শুধু বললো, তোমাকে মিথ্যে কথা বলতে পারবো না। আমাকে একটু সময় দাও।
ইসলামভাই তখন মেয়ের শোক ভুলে গেছে।
বলেই বসলো আমার মেয়ের দরকার নেই। যেটা আছে এখন সেটাকে বাঁচাই। একমাত্র এই বাড়িতে নিয়ে এসে রাখলে অর্জুন কিছু করার সাহস পাবে না।
নেপলা কোথায়?
অনির সঙ্গে আছে।
সঙ্গে সঙ্গে ইসলামভাই ফোন লাগালো।
নেপলা ধরেই বললো, বলো কি হয়েছে—
তুই কোথায়?
গাড়ি চালাচ্ছি—
কোথায় যাচ্ছিস?
কৃষ্ণনগর—
অনি কোথায়?
ঘুমচ্ছে—
ডাক—
বলে কি, মরার হাত থেকে তুমি বাঁচাবে?
ইসলামভাই হাসবে না কাঁদবে।
তোকে অনি কি বলেছে?
যা বলেছে শুনে তোমার লাভ।
নেপলা কিছুক্ষণ ফর ফর করে গেল। ইসলামভাই ফোন রেখে দিল।
ছোটোমা তোর ফোনে ফোন করলো।
আবার নেপলা ধরেছে।
বলছিনা বিরক্ত করবে না।
আমি ছোটোমা বলছি।
সরি ছোটোমা, দাঁড়াও গাড়িটা একটু সাইড করি।
মোবাইলে শুনতে পাচ্ছি ও গাড়ি সাইড করলো।
বলো ছোটোমা।
কোথায় যাচ্ছিস?
কৃষ্ণনগর—
কৃষ্ণনগরের কোথায়?
জানি না। শুধু অনিদা বলেছে। কৃষ্ণনগর মোড়ে এসে ডাকতে। তারপর অনিদা পথ চিনিয়ে নিয়ে যাবে।
এখন কোথায় আছিস?
রানাঘাট পেরিয়ে এলাম।
কৃষ্ণনগর পৌঁছতে কতোক্ষণ লাগবে?
ধরো আরও পঁয়তাল্লিশ মিনিট।
তোকে অনিদা কি বলেছে?
সেরকম কিছু বলেনি। তবে একটা জট পেকে আছে। অনিদা নিজেই ভীষণ কনফিউজড।
অর্জুনের ব্যাপারে কিছু বলেছে?
সকালে তুমি যা বললো ওই টুকু শুনেছি। দাদাকে জিজ্ঞাসা করার সাহস আমার আছে। যে টুকু বলে, গিলে জাবর কেটে বোঝার চেষ্টা করি।
দাদা কি সত্যি ঘুমচ্ছে?
তুমি বিশ্বাস করো ছোটোমা, তোমার সঙ্গে গাড়ির কাঁচ তুলে বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলছি। দাদা মরার মতো ঘুমচ্ছে। যেন কতোদিন ঘুমোয়নি।
সাবধানে যাবি। আমাকে একটা খবর দিবি।
ঠিক আছে।
সবাই নেপলার কথা শুনে কিছুটা যেন আশ্বস্ত। কিন্তু মন থেকে সন্দেহ যাচ্ছে না।
এই ঘরে তখন ঘন ঘন মিটিং হচ্ছে। অনিমেষদাকে ডেকে পাঠান হলো।
অনিমেষদা এলো।
আবিদদেরও তাড়াহুড়ো করে নিয়ে আসা হলো।
আবিদ, আয়েষাকে জেরা করা শুরু করলো অনিমেষদা। আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম, আয়েষা আড়াল থেকে কিছু করেছে। আবিদ তখন রেগে কাঁই।
তুমি এ কি করেছো! তুমি জানো দাদার হাত কতটা লম্বা। সেরকম বুঝলে তোমাকে আমাকে দু-জনকে সরিয়ে দেবে।
আয়েষা চুপ করে আছে।
তুমি দাদার এতোটা ক্লোজ রিলেশনে আছো আমাকে একবারও বলো নি!
আবিদ থাম। অনিমেষদা বললো।
থামবো কি দাদা, দময়ন্তী ওর সঙ্গে আমাকে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল।
দময়ন্তীর রেফারেন্সে আমি ওকে এতটা কাছে টেনে নিয়েছি। তারপর ও অনিদার সম্বন্ধে এত কথা বলত আমার ভীষণ ভাল লাগতো। অনিদা আমাদের দাদা। আজ যে জায়গায় ছিলাম এখন যে জায়গায় আছি সব অনিদার জন্য। আমরা সবাই এমন কোনও কাজ করিনা যাতে অনিদা আঘাত পায়। আর ও অনিদাকে আঘাত করলো!
আয়েষা বলে কি, আমি মামাকে বোঝাব।
ইসলামভাই ওদের দুটোকে নিয়ে ও ঘরে চলেগেল।
নটা পাঁচ-দশ নাগাদ নেপলার ফোন এলো। ছোটোমা আমরা এখন এসে পৌঁছলাম। দাদা উসমানভাই-এর সঙ্গে কথা বলছে। তোমাকে পরে ফোন করছি।
অনিমেষদা সব শুনে বললো তোমরা যে ভয় পাচ্ছ ও সে কাজ কখনও করবে না। এটুকু তোমাদের আমি জোড় গলায় বলতে পারি। আবিদকে ও ভীষণ ভালোবাসে।
আবিদের মুখ চোখ শুকিয়ে আমসি, রতনের অবস্থাও তাই।
দিদিভাই এসে সব শুনে কেঁদেই ফেললো।
কিছুক্ষণ পর আয়েষার ফোনে একটা কল এলো। প্রথমে আয়েষা কথা বললো। তারপর আবিদ কথা বললো।
স্যার আমাদের কারা তুলে নিয়ে এসেছে।
জানা গেল ঘণ্টা, পক্কে। রতন তো রেগে কাঁই। ও নাকি ঘণ্টা, পক্কেকে নামে চিনতো না, তবে আবিদের অফিসে দেখেছে।
ওরা আবিদকে ডিটেলসে সব বলেছে। কোথায় আছে কি বৃত্তান্ত।
অনিমেষদা আবার শুনেটুনে বললো, এটা গটআপ। যে কিডন্যাপ করবে সে কখনও ওদের কাছে ফোন রাখবে, কেড়ে নেবে। তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে ওরা রাজার হালে আছে।
আবার দশমিনিট আলোচনা।
রতন বললো দাদা আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে আমি ওমরকে পাঠাই।
তাই কর।
রতন আবার ওমরকে সব বললো। বললো সাবধান। পারলে চাঁদকে নিয়ে নে।
চলবে ———————
from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/BsDM5et
via BanglaChoti
Comments
Post a Comment