❝কাজলদীঘি❞
BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়
১৮৪ নং কিস্তি
—————————–
মিত্রারা আমার বুকের মধ্যে মুখ লোকাল।
হাসির শব্দটা যেদিক থেকে পেলাম ওদিকটা তাকালাম।
আমি দু-জনকেই জাপটে ধরে দাঁড়িয়ে আছি। আলো আধারিতে কিছু দেখা যাচ্ছে না।
হাল্কা কথা-বার্তা ভেসে আসছে। অস্পষ্ট।
আমি কান পাতলাম।
মিত্রা-তনু দু-জনেই আমার মুখের দিকে তাকিয়েছে।
ঠোঁটের ওপর আঙুল তুলে ওদের দিকে তাকালাম।
ওরা আমার দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে।
ফিস ফিস করে বললাম পা টিপে টিপে চল।
ওদের চোখে মুখে বিস্ময়।
আওয়াজ করবি না। একবারে কোনও কথা বলবি না।
ওরা কারা?
কি করে জানবো।
ভূত।
ধ্যুস।
এত রাতে কি করছে?
কোনও কথা বললাম না।
নদীর দিকে যে সরু রাস্তা নমে গেছে সেই দিক থেকেই কথা বার্তা ভেসে আসছে।
কর লা, রাত হয়্যা যাতিছে ঘরকে বাচ্চাগুলান আইছে।
মিত্রা মনে হয় এবার বুঝতে পেরেছে ফিক করে হাসলো। তনু, মিত্রার মুখটা চেপে ধরলো।
তাতে কি হয়েছে তুই তো মেলাতে পচাই বেচতে এসেছিস। সারারাত পচাই বেচবি।
শুদ্ধ বাংলা কথা। তারমানে ছেলেটা এই এলাকার নয়।
মিত্রার দিক তাকালাম।
তোরা আস্ত আস্তে মারাংবুরুর থানে চলে যা, আমি যাচ্ছি।
ওরা আমার হাতটা চেপে ধরলো।
কি হলো!
তুই চল।
এইখানে দাঁড়া। আমি আসছি।
না। চল।
দেখে নিই ছেলেটা কে, ভাল ঠেকছে না।
আমি ওদের থেকে একটু দূরে সরে গিয়ে ঝোপের আড়াল থেকে ওদের লক্ষ্য করলাম।
লাগতিছে, আইসতে।
মেয়েটার হল্কা গোঙানি কানে ভেসে আসছে।
বললি না।
কি কইবি তো। মেয়েটা ঝাঁঝিয়ে উঠলো।
নাম কি?
করতিছু কর।
আবার চুপ চাপ।
তোর ভাল লাগে?
ট্যাকার জন্যি তুর সঙ্গে শুইছি।
ওরা কারা?
দশ ট্যাকা লাইগবে।
দেব।
কইলকাতা থেকে আসছে। মোনকার জন্যি এখানে জল দিছে, ভাত দিছে, কাপর দিছে, ওষধ দিছে। আঃ এখন থামিস লাই।
নাম কি?
মেয়েটির মুখ থেকে গোঙানির শব্দ বেরচ্ছে, অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে এলো, অনিদা।
মিত্রারা কতটা শুনতে পেয়েছে জানিনা। কিন্তু আমার গালে কেউ যেন একটা থাপ্পর কষিয়ে দিল।
বুবুন।
মিত্রার দিকে তাকালাম। ওদের চোখ অন্য কথা বলছে। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ওদের হাসিটা কেমন যেন মিইয়ে গেল।
মিত্রা বুঝে গেছে আমার চোখে মুখের চেহারা বদলে গেছে।
কিরে, তোকে কেমন যেন লাগছে!
কোনও কথার উত্তর দিলাম না।
মোবাইলটা পকেট থেকে বার করে শ্যামকে ম্যাসেজ করলাম।
ইমিডিয়েট আয়। ঘটনা এই। ব্যাপারটা আমার ভাল ঠেকছে না। স্পটটা লিখলাম।
ম্যাসেজ পেলে আমাকে রেসপন্স কর।
ওদের নিয়ে পা টিপে টিপে ওই জায়গাটা থেকে এগিয়ে গেলাম।
একটু দূরে আসতেই মিত্রা ফিস ফিস করে বলে উঠলো, বুবুন বাথরুম পেয়েছে।
রাগ হলেও কিছু বললাম না।
ওখানে বসে পর।
তনু একটু আয়।
এখনও হাসাহাসির শব্দ সামান্য ভেসে আসছে। কথা পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি না।
শ্যাম ম্যাসেজ করলো।
তুই সেউঠি দাঁইড়া, পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসতিছি।
আমি কাঁধের থেকে মেশিনটা হাতে নিলাম। আনলক করে শক্ত করে ধরলাম।
মিত্রারা কোথায় গেল কি করলো তখন দেখার মতো মন নই। একটাই রক্ষে ওরা ঠিক মতো ওই ছেলেটার কথা বুঝতে পারেনি।
ছেলেটা কে? আমার নামটা শোনার পর ছেলেটা সেরকম আর কথা বলেনি।
এখনও হাল্কা কথাবার্তা ভেসে আসছে। হাসা-হাসি খুনসুঁটি।
আমি আর একটু এগিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম গাছের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে। দেখতে পাচ্ছি না। চাঁদের আলোয় দুজনের পা-দুটো দেখা যাচ্ছে।
ভালো করে শোনার চেষ্টা করছি ঠিক মতো শুনতেও পাচ্ছি না।
কিরে যাবি না?
ফিরে তাকালাম। দু-জনেই আমার পাশে দাঁড়িয়ে।
কিরে তোর হাতে ওটা কি? মিত্রার চোখ বড়ো বড়ো।
ঠোঁটে আঙুল তুললাম।
সরি।
ওদিকে কি দেখছিস?
বিরক্ত চোখে ওদের দিকে তাকালাম।
ওরা যা করছে করতে দে-না। কেন ঝামেলা করছিস।
বুঝলাম এখানে দাঁড়িয় থাকলে একটা গণ্ডগোল হলেও হতে পারে। মিত্রারা যখন ধরতে পারেনি, তখন এখানে দাঁড়িয়ে ওদের বুঝতে দিয়ে লাভ নেই।
ওদেরকে নিয়ে সোজা মারাংবুরুর থানে চলে এলাম। এখান থেকে জায়গাটা পরিষ্কার দেখা যাবে না। তবে কেউ যদি ওই পথে উঠে আসে পরিষ্কার দেখতে পাবো।
ছেলেটার কাছে কি আর্মস আছে? বুঝতে পারছি না। যদি এই তল্লাটের না হয়, তাহলে খালি হাতে এখানে আসেনি।
মোবাইলটা ভাইব্রেট করে উঠতেই পকেট থেকে বার করলাম। শ্যাম ম্যাসেজ করেছে।
আমরা চইলা আসছি কুথা আছু।
ম্যাসেজ করে জানালাম মারাংবুরুর থানে।
আবার ম্যাসেজ এলো।
তুই বউমনিদের লিয়ে চইলে যা। মন্যে দেইখে লিছি। উটাকে তুইলে লিয়ে যাইঠি, তুই ফিরলি হিসেব হবে।
আচ্ছা।
একটু অপেক্ষা করলাম। বোঝার চেষ্টা করলাম ও আর কোনও ম্যাসেজ করে কিনা।
হ্যাঁ ঠিক তাই। শ্যাম ম্যাসেজ করলো।
মন্যে এউঠি অপেক্ষা করিঠি তুকে ফিরার সময় লিয়ে যাব।
ঠিক আছে।
মেশিনটাকে আবার লক করে কাঁধে ঝোলালাম।
মিত্রাদের কাছে আস্তে দু-জনেই দুটো হাত শক্ত করে ধরলো।
কিরে এমন কাঠ কাঠ হয়ে গেলি?
খুব ভয় করছিলো।
কেন!
লোকটা কি ভাল নয়?
কি করে জানবো।
তুই কি শ্যামের সঙ্গে কথা বললি?
হ্যাঁ। শ্যামকে একটু লক্ষ্য রাখতে বললাম।
আবার গণ্ডগোল!
হাসলাম। মিত্রার গালটা ধরে একটু টিপে দিলাম।
যতদিন বাঁচবো এটা থাকবে। ওরা বাধা দেবার চেষ্টা করবে। আর আমি এগিয়ে যাব।
ফিরে চল, যাবো না।
ভয় পেয়েগেলি?
যদি কিছু হয়?
কান পেতে শোন, মাদলের আওয়াজ শুনতে পাবি।
মিত্রা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
আবার দু-জনের কোমড় জড়িয়ে ধরলাম। বুকের কাছে টেন নিলাম।
ভয় নেই, আমার কিছু হবে না। চল।
মারাংবুরুর থানের পাশ দিয়ে নদীর দিকে রাস্তাটা নেমে গেছে। একটু এগোলেই সেই খাঁড়িটা।
থমকে দাঁড়ালাম।
চারিদিকে একটা স্বপ্নিল পরিবেশ। চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে পাহাড়ের মাথায়। দূরের পাহাড়গুলোকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। দ্রিম দ্রিম মাদল আর ধামসার আওয়াজ ভেসে আসছে। তার সঙ্গে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক মিলে মিশে একাকার।
ওপরের দিকে মুখ তুলে তাকালাম। চাঁদের আলো এতো উজ্জ্বল যে শরীরের কালো দাগগুলোও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ওদের দিকে তাকিয়ে বললাম, চাঁদটাকে একবার দেখ।
দুজনেই ওপরের দিকে চোখ মেলে তাকাল।
বুবুন চাঁদ যে এতো উজ্জ্বল হয় আগে কখনও দেখিনি।
দেখবি কি করে, কলকাতায় চাঁদকে দেখিস ধোঁয়া-ধূলোর মধ্যে। এখানে পলিউসন-ফ্রি জোন, তোর চোখে মুখে না লাগবে ধুলো না লাগবে ধোঁয়া।
চাঁদের বুকের দাগগুলোও কেমন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। মিত্রা বললো।
আমাদের কথা বলার ফাঁকেই তনু ক্যামেরা বার করে সাটার টিপতে আরম্ভ করেছে।
জানিষ চাঁদের গায়ে এই দাগগুলো নিয়ে একসময় কতো প্রশ্ন মনে আসতো। কাকাকে জিজ্ঞাসা করতাম, কাকীমাকে জিজ্ঞাসা করতাম। কেউ আমার প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারতো না।
তখন ক্লাস থ্রি কিংবা ফোর হবে। যা দেখি তাতেই আমার অতি উৎসাহ। একদিন মৌসুমি মাসিকে বললাম, মাসি চাঁদের বুকে ওই কালো কালো দাগগুলো কি গো।
কেন তুই জানিস না?
মাসির দিকে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম।
চাঁদের বুড়ী বসে বসে চড়কা কাটছে।
চাঁদের বুড়ী!
কেনো তোর বইতে লেখা নেই?
না।
চাঁদে একটা বুড়ী আছে। এই তার বিশাল চেহারা, মাথার চুলগুলো সাদা ধপধপে। কি তার গায়ের রং। লাল টকটকে। এই তার বিশাল মুখ। এই তার বড়ো বড়ো দাঁত। পুর চাঁদটাই তার ঘর বাড়ি। বুড়ী যখন দুপুর বেলা খেয়ে দেয়ে পান চিবোতে চিবোতে চড়কাতে সুতো কাটে তখন চাঁদের গায়ে তার ছায়া পড়ে। অবাক হয়ে মৌসুমি মাসির গল্প শুনতাম।
তুমি দেখেছো!
কতোবার তার সঙ্গে কথা বলেছি।
আমাকে দাখাও।
সেই বয়সে মৌসুমি মাসিকে কতো জালাতন করতাম। এখন মনে পরলে হাসি পায়।
একবার খামারে ঘুটি খেলছি।
ঘুটি! সেটা আবার কি?
এইরে গাঁইয়া কথা বলে ফেলেছি। পাথরের গুলি। গাঁইয়া ভাষায় বলে ঘুটি।
তনু মুখ টিপে হাসলো।
হ্যাঁগো। তখন মনে হয় ক্লাস থ্রি। মনে করতে পারছি না চিকনা ছিল কিনা।
প্রচণ্ড ঝড় উঠলো। ছুটে বারান্দায় চলে এলাম। কাকা চেঁচামিচি করছে। আমাদের বাড়ির পেছন দিকের রান্না ঘরের খড়ের চাল অর্ধকটা উড়ে চলে গেল।
ছোট্ট মানুষ আমি, মাসির কোলে ঢুকে পড়েছি। মাসি নিজের শরীরের কাপরটা দিয়ে আমার ছোট্ট শরীরটাকে ঢেকে দিয়েছে।
কিছুক্ষণ প্রবল ঝড়, ধূলো উড়িয়ে চারদিক কালো করে দিল, তারপর বৃষ্টি নামলো। মুষল ধারে বৃষ্টি। সঙ্গে বিদ্যুতের মুর্হু মুর্হু ঝলকানি। মেঘের গর্জন। উসখুস করছি বৃষ্টিতে ভিঁজবো। মাসি আমাকে শক্ত কর চেপে ধরে রেখেছে।
দেখছিস তো ভগবান কিরকম রেগে গিয়ে যুদ্ধ করছে।
আবার মাসির কোলে ঢুকে পরলাম।
কোথায় ভগবান যুদ্ধ করছে?
কেনো, এতো জোড় হাওয়া দিচ্ছে, আকাশ থেকে আলো ঠিকরে পড়ছে, বুঝতে পারছিস না।
ভগবান কোথায়?
ওই কালো মেঘটার আড়ালে লুকিয়ে আছে। সব দেখছে। ওখান থেকে বজ্র মারছে। সেই জন্য বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আর মেঘ ডাকছে। তুই বৃষ্টিতে ভিঁজলেই তোকে বজ্র মেরে দেবে।
আমি অ্যাল। জিভ বার করলাম।
হ্যাঁ, অ্যাল।
তখন কি সহজ সরল ভাবে মাসির কথা বিশ্বাস করে ফেলতাম।
মিত্রা তনু আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে।
তোদের এরকম কোনও মাসি ছিল না?
দু-জনেই আমাকে জড়িয়ে ধরে আলতো করে বুকে ঠোঁট ছোঁয়ালো।
কিরে আমি অন্যায় কথা বললাম।
না। তোর এই কথার জাদুতেই আমরা দু-জন মরেছি।
কথার জাদু না-রে, মাঝে মাঝে সেই সময়ের এই ঘটনাগুলো ভীষণ নাড়া দেয়।
বেশ কিছুক্ষণ ওই খোলা আকাশের তলায় ওদের জাপ্টে ধরে চাঁদ দেখলাম।
যাবি না।
মিত্রার মুখের দিকে তাকালাম।
হ্যাঁ। চল।
আবার চলতে শুরু করলাম।
যত এগোই তত ধামসা মাদলের আওয়াজ পরিষ্কার হয়।
একবারে নদীর খাঁড়ির ধারে এসে তিনজনে দাঁড়ালাম।
জায়গাটা অনেকটা ইউ আকৃতির।
চারিদিকে পাহাড়ে ঢাকা।
আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে জায়গাটার দূরত্ব খুব কম করেও তিনশো ফিট।
পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ধামসা মাদলের তালে কারুর শরীর দুলছে। কেউ নদীর চিক চিকে বালির ওপরেই শুয়ে পড়েছে। কারুর শরীরে ছিটে ফোঁটা কাপর আছে কারুর শরীরে সেটুকুও নেই। সকলেই শরিরী মজায় মত্ত।
এইটা তোর ঘোটুল!
হ্যাঁ।
আমরা তিনজনেই পাহাড়ের কোল ঘেঁসে বসলাম।
একবার চারদিকটা তাকিয়ে দেখে নিলাম। না যে জায়গায় বসছি সেটা অনেকটা সেফটি।
ওরা অনেকক্ষণ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো।
এখানে কাউকে তো বয়স্ক দেখছি না।
পাবি না। এখানে শুধু মাত্র আঠারো থেকে পঁচিশ বছরের ছেলে মেয়েদের দেখতে পাবি।
ওরা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। আমার আরও কাছে সরে এলো। দু-জনে দুটো হাত ধরেছে।
তারপর।
ঘোটুলটা সাঁওতাল প্রজাতির একটা পুরনো প্রথা। আবহমানকাল ধরে চলে আসছে। এখানে ওরা ওদের জীবন সঙ্গী বেছে নেবে।
ওরা আমার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে।
জানিস চম্পাও এখানে আজ এসেছে।
এ্যাঁ।
হ্যাঁরে। ও একজনকে ভালোবাসে। কিন্তু বাইরে তার সঙ্গে কথা বলতে পারবে না। কিংবা তার সঙ্গে মিশতে পারবে না। আজকের এই উৎসবে ওরা প্রথম মিলিত হবে। তারপর মোড়লের কাছে প্রস্তাব যাবে, তারপর বিবাহ।
ওরা আমার মুখের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে।
ঘোটুলটা এদের খুব পবিত্র জায়গা।
কিরকম?
ধর তুই একটা মেয়ে আমি তোকে পছন্দ করলাম।
হুঁ।
আমার পছন্দটাই সব নয়। আমার যেমন পছন্দ হলো তোরও আমাকে পছন্দ হতে হবে। পছন্দটা থাকবে দু-তরফের। তবে আমরা দু-জনে আজ রাতে মিলিত হতে পারবো। যদি আমাদের দু-জনের মধ্যে কারুর একজনের পছন্দ না হয় তাহলে আমরা মিলিত হতে পারবো না।
তারমানে জোর করে কিছু করা যাবে না। দু-জনে যদি দু-জনের প্রতি আসক্ত হও তবে মিলন।
এবার যদি তুমি জোড় করো। ঘোটুলে উপস্থিত অন্য ছেলে-মেয়ারা সবাই বাধা দেবে। তারপর সেটা যদি মুখিয়া কিংবা মোড়লের কানে পৌঁছে যায়, তাহলে তার শাস্তি মৃত্যু।
সত্যি!
বড়ো কঠিন এই জঙ্গলের আইন-কানুন।
দারু-শ্যাম, ময়না-চূড়াকে পছন্দ করলেও, কথা বলতে পারতো না। এখানে এসে এই পবিত্র দিনে ওরা প্রথম মিলিত হয়েছে। তারপর বিবাহ।
তার মানে!
ময়না-চূড়ার কুমারীত্ব ঘুঁচেছে এই রকম একটা পবিত্র দিনে খোলা আকাশের তলায়।
অনি আমার মাথায় ঠিক ব্যাপারটা ঢুকছে না। তনু বললো।
হাসলাম।
এখন এই ব্যাপারটাকে নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলে।
বিজ্ঞরা বলেন এটা নাকি আদিবাসীদর যৌন লীলার পীঠস্থান।
মজা করে দু-চার লাইন কেউ যে লেখে না তা নয়।
তবে কি জানিষ, আমি এদের এই প্রথাটাকে নিয়ে অনেক ভেবেছি।
হ্যাঁ ঘোটুল আদিবাসীদের যৌন মিলনের পীঠস্থান। কিন্তু কেন?
এই প্রথাটার জন্ম এমনি এমনি হয়নি। নিশ্চই কেউ না কেউ এর রচয়িতা। তারপর সমাজ এই প্রথাকে মেনে নিয়েছে। পরে তা আইনে পরিণত হয়েছে। ট্র্যাডিসন্যালি যা চলে আসছে।
আমি সুখলাল কাকাকে একদিন এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম।
কাকা তো আমাদের মতো লেখা-পড়া শেখেনি। যা কিছু এই অরন্য আর জীবন থেকে নেওয়া। ঠিক গুছিয়ে বলতে পারেনি। তবে যে টুকু নির্যাস পেয়েছিলাম তাই দিয়ে নিজে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পেরেছিলাম।
কি? মিত্রা বললো।
আমাদের সমাজ এখন স্বাধীন যৌন মিলন মেনে নিয়েছে। কিন্তু এই স্বাধীন যৌন মিলনের কনসেপ্ট এলো কোথা থেকে?
বিষয়টাকে আমরা একটা সুন্দর নামের মোড়কে মুড়ে ফেলেছি, আধুনিক পরিভাষায় যাকে বলছি লিভ টু গেদার।
মানে এক ছাদের তলায় থেকে খুশী মতো শরীরটা উপভোগ করো। তারপর যদি তোমার পছন্দ হয় বিবাহ করো। না হলে আর একজন সঙ্গী বেছে নাও।
তুই যেটা বললি ঠিক কিন্তু মনের মিল না থাকলে শারীরিক মিলন সম্ভব নয়। মিত্রা বললো।
কোনটা আগে, মন আগে না শরীর আগে।
তুমি তো সেই ডিম আগে না মুরগী আগে সেই কথা বলতে চাইছো। তনু বললো।
কেন? যুক্তি দিয়ে বোঝাও। আমরা তিনজনে যথেষ্ট শিক্ষিত বলে আমি মনে করি।
মনের মিল না হলে শরীর মিলন হয় কি করে?
মনের মিল যদি হয়েই থাকে তাহলে লিভ টু গেদার হবে না। সেখানে আসবে চিরকালীন বন্ধন। সেখানে শরীরী সুখ-দুঃখ প্রাধান্য পাবে না। যেটা তোমার সঙ্গে আমার।
যদি লুভ টু গেদারেই বিশ্বাস করতাম, তাহলে তুমি আমার পাশে আজ বসে থাকতে না। আমার শরীরটা পাওয়া হয়ে গেলেই তুমি আর একটা শরীরের জন্য ছুঁক ছুঁক করতে।
তনু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
বুঝলে তনু মনটা হচ্ছে বন্ধন। শরীরটা বন্ধন নয়।
তুমি অন্য ব্যাখ্যা করে আমাকে বোঝাও।
আজ বিদেশে মুড়ি মুড়কির মতো ডিভোর্স হচ্ছে।
আর আমাদের এখানে। কেউ কেউ তাদের বিয়ের সিলভার জুবলি, গোল্ডেন জুবলি পালন করছে। আচ্ছা তোমার হাতের কছেই তো জল জ্যান্ত প্রমাণ আছে। দাদা-বড়োমা। তারা কি শরীরের ঊর্দ্ধে। দু-জনের মেনে নেওয়া, মানিয়ে নেওয়ার ব্যাপারটা একবার ভাব।
মল্লিকদা-ছোটোমা। তোমাকে কতো উদাহরণ দেব।
আমরা এখন এত ব্যস্ত, সব কিছুকেই ফার্স্ট ফুড হিসাবে দেখি। সেক্সটাও।
তবে বিদেশে কিন্তু এই ব্যাপারটা নিয়ে একটা আইন তৈরি হয়েছে।
মিত্রার দিকে তাকালাম।
এই লিভ টু গেদারের ফলে যদি কোনও সন্তান হয় তাহলে তাকে নষ্ট করা যাবে না।
সেই সন্তান কার পরিচয়ে বড়ো হবে?
কেন যার সঙ্গে আমি লিভ টু গেদার করছি তার পরিচয়ে। মিত্রা বললো।
মনে হয় না। সেই সন্তান তার মাতৃ পরিচয়ে বড়ো হবে। একটু ভেবে দেখিস। আজ আমাদের দেশেও এই আইনটা স্বীকৃতি পেয়েছে। উচ্চ আদালত তার স্বীকৃতি দিয়েছে। যার জন্য সিঙ্গেল মাদারের কথা শুনে থাকবি।
তবে হ্যাঁ সেই সন্তান তখনই তার পিতৃ পরিচয় পাবে, যখন সেই বয় ফ্রেন্ড তার ভালবাসার মানুষকে বিবাহ করে স্বীকৃতি দেবে।
বিদেশে এমন আকছাড় ঘটছে। যখন সেই পুরুষ তার বান্ধবীকে স্ত্রী হিসাবে স্বীকৃতি দিচ্ছে, তখন তাদের দু-তিনটে ছেলে মেয়ে সঙ্গে থাকছে।
অনেক নামীদামী মানুষের জীবনে এই সব ঘটেছে।
আমাদের এই সনাতনধর্ম ভারতবর্ষে এই চিন্তাভাবনা আমরা কখনও পোষণ করতে পারবো? পারবো না। এখন তবু কিছুটা ভাঙছে।
নতুন যে প্রজন্ম আসছে সেক্স ব্যাপারটা নিয়ে তাদের মধ্যে পারভারসন চলে আসছে।
আমি খুব ভাল করে ভেবে দেখেছি, এই জঙ্গলের মানুষদের জীবনে জঙ্গলের পশু-পাখী এবং প্রকৃতি ভীষণ ভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে। এবং এদের যৌন শিক্ষাটাও অনেকটা সেখান থেকে এসেছে। এটা কিন্তু একবারে আমার নিজস্ব ব্যাখ্যা। তোদের মনের সঙ্গে নাও মিলতে পারে। পৃথিবীতে যা কিছু বড়ো বড়ো যুদ্ধ দেখবি তার কেন্দ্র বিন্দুতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রয়েছে মেয়ে। তাকে জয় করতে হবে। তার মনকে জয় করতে হবে।
দুটো পুরুষ নিশ্চই একটা মেয়েকে নিয়ে থাকবে না। যে কোনও একজন পুরুষ থাকবে। আর একজনকে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যেতে হবে।
এক সময় এই সাঁওতাল সমাজেও পিতৃ প্রথা চালু ছিল না। মাতৃপ্রথা চালু ছিল।
বীরভোগ্যা বসুন্ধরা। বসুন্ধরা এখানে নারী মূর্তি। একটা মেয়ে কখনই একটা দুর্বল পুরুষকে তার শরীরে আশ্রয় দেয় না। সুস্থ-সবল-সতেজ পুরুষকেই মনে মনে চায়।
প্রাণী জগতের মধ্যে এটা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।
অর্থ কি?
ধরণী বীর পুরুষদের জন্য। বীর পুরুষকেই ধরণী তার শরীরে ধারণ করবে। এই ধারণ শব্দটা থেকেই ধর্মের উৎপত্তি।
আমরা কথায় কথায় বলি প্রকৃতি-পুরুষের মিলনে আমাদের উৎপত্তি।
প্রকৃতি কে? পুরুষ কে?
প্রকৃতি এই ইহ জগত। পুরুষ আলো-বাতাস।
প্রকৃতি এই গাছ-পালা, মাটি। পুরুষ সূর্য-চন্দ্র।
ধ্যুস কি বলতে গিয়ে কি বলে ফেলছি।
বল না। মিত্রা বললো।
পরে বলবো।
আবার ঘোটুলের কথায় ফিরে এলাম।
সুখলাল কাকার ভার্সান অনুযায়ী। যে কোনও মেয়েই চায় সে যে পুরুষের সন্তান গর্ভে ধারণ করবে সে যেন সৌর্য-বীর্যের প্রতীক হয়। তাহলে চলবে কি করে। সব মেয়েই যদি সেই পুরুষের কাছে যায়, তাহলে আর সব পুরুষেরা কি করবে। তাদেরও কাম, ক্রোধ, লোভ মাৎসর্য ক্ষুধা আছে।
একটা সময় এলো, অন্য পুরুষেরা দলবদ্ধ হয়ে তাকে মেরে ফেলতে চাইলো। কিছু কিছু ক্ষেত্রে যে এ ঘটনা ঘটেনি তা নয়। ফল স্বরূপ ক্ষমতাবান পুরুষের অভাব দেখা দিল। সেই গোষ্ঠীর ক্ষতি সাধন হলো।
এই জায়গা থেকে এরা শিক্ষা নিল।
তোরা কখনও হাতীদের মৈথুন দেখেছিস।
না।
এ্যানিমেল প্ল্যানেটেও দেখিস নি?
দু-জনেই আমার মুখের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে।
আমি এই অরণ্যেই দেখেছি। ওরা ভীষণ অর্গানইজড জানিস।
এই হাতিরা দলবদ্ধ হয়ে ঘোরে। যেটা সবচেয়ে অভিজ্ঞ হাতি সেটা দলপতি। সকলে তাকে মেনে চলে। দলের মধ্যে যে মেয়ে হাতিটা প্রথম ঋতুমতী হলো তাকে প্রথম দলপতির কাছে নিয়ে আসা হবে। বলতে পারিস সেই প্রথম তার কুমারীত্ব হরণ করবে। তখন দলের অন্যান্য মেয়ে হাতি তাদের দু-জনকে ঘিরে দাঁড়াবে। কেউ যাতে দখতে না পায়। ব্রিদিং টাইম শেষ হলে। সেই মেয়ে হাতিটা সেই দিন থেকে দলের আর সব পুরুষ হাতির কাছে গ্রহণ যোগ্য হবে।
এবার সেখানেও যদি দুটো দাঁতালোর জন্ম হয়…।
দুটো দাঁতালো মানে!
মানে আর একটা যদি দলপতির সমান ক্ষমতাবান হয়ে যায় তখন সে দলপতির বশ্যতা স্বীকার করে না। দলপতির সঙ্গে তার যুদ্ধ হয় যে কোনও একজনকে মৃত্যু বরণ করতে হয়।
মিত্রা আমার দিকে কুত কুতে চোখে তাকিয়ে। আমি হাসলাম।
মানুষ বুদ্ধিমান প্রাণ। ঈশ্বরের সর্বোত্তম সৃষ্টি। প্রথমে তারা এই কনসেপ্ট-টা ডাইরেক্ট গ্রহণ করে। পরে পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী সেটাই পরিশীলিত হতে থাকে।
ধীরে ধীরে ঘোটুলের জন্ম হয়। নিজেরাই অরণ্যের আইন কানুন রচনা করে।
মেয়েরা ঋতুমতী হলেই সন্তান ধারণের ক্ষমতা লাভ করে। প্রথা অনুযায়ী ঋতুমতী মেয়েরা এবং সমবয়স্ক পুরুষেরা ঘোটুলে যাবে। সেখানে তারা তাদের জীবন সঙ্গিনী বেছে নেবে। এবং প্রথম শরীরের স্বাদ গ্রহণ করবে একে অপরের।
এই ব্যাপারটাকে স্বতঃ সিদ্ধ করার জন্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান, অনুশাসন এলো।
এবার কালের পরিপ্রেক্ষিতে এখন সেটা মেয়েদের ক্ষেত্রে আঠারো বছর ছেলদের ক্ষেত্রে একুশ বছর হয়েছে। কিন্তু পঁচিশের ঊর্দ্ধে কখনই হবে না।
তারমানে শরিরী ব্যাপারাটা এদের কাছে খুব পবিত্র বল। মিত্রা বললো।
ছিল। এখন কতটা আছে বলতে পারবো না। তবে ট্র্যাডিসন্যালি এরা মেনে আসছে।
আসার সময় দেখলি তো। নিজের কানে শুনলি।
সেই জন্যই তোকে জিজ্ঞাসা করলাম।
তোর সঙ্গে মনে হয় রবীন্দ্র ধর্মরাজের চক্র সিনেমাটা দেখতে গিয়েছিলাম।
আমাকে নিয়ে যাসনি। নিজে একলা গিয়েছিলি। এসে গল্প বলেছিলি।
তোর মনে আছে?
খুব ভালো মনে আছে। নাসিরুদ্দিনের বিখ্যাত ডায়লগ, ইস দুনিয়ামে সব সে বড়া চিজ পেট ওউর পেট কা নীচ। তখন খুব আউরাতিস।
কতো বড়ো সত্যি কথা বল।
তনু ফিক করে হেসে উঠলো।
হাসিস না তনু, তখন যা রাগ হচ্ছিল ওর ওপর। অতো ভালো সিনেমাটা একা একা দেখে চলে এসেছে।
তোমাকে নিয়ে যায় নি কেন?
ওই যে তার আগে বীনা সিনেমায় বসে হাতটা ধরে একটু বুকে রেখেছিলাম।
তনু হেসে আমার কাঁধে মাথা রাখল।
শয়তান দেব একবারে ঘাড় মটকে। মিত্রা দু-হাতে আমার ঘাড়টা খামচে ধরলো।
আমি তনুর শরীরে ওপর ভড় দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম।
কিরে কোথায় যাবি!
ফিরতে হবে না।
আর একটু বসি।
অনেক রাত হয়ে গেছে। শ্যামেরা আমাদের জন্য জেগে আছে।
দু-জনেই আমার হাতটা ধরে উঠে দাঁড়াল।
আর একবার ভাল করে তাকিয়ে দেখল।
বুবুন অনেকটা ফাঁকা হয়ে গেছে না?
আস্তে আস্তে ফাঁকা হয়ে যাবে।
আচ্ছা এখানে এসে এরকমও তো হয় কোনও মেয়ের ছেলে পছন্দ হলো না। আবার কোনও ছেলের মেয়ে পছন্দ হলো না।
আগে হতো, এখন এর সংখ্যা খুব কম। যুগ বদলে গেছে। শ্যামেদের কমুনিটি তবু ব্যাপারটা ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে এখনও ধরে রেখেছে। অন্যান্য জায়গায় প্রতিদিন ঘোটুল বসে। বলতে পারিস দামিনীমাসির পাড়া তৈরি হয়ে যায়। কিছু করার নেই। ওই পেট আউর পেট কা নীচ।
বিশ্বাস করো সেক্স ব্যাপারটা যে এতো পবিত্র আগে জানতাম না।
মহাভারতটাকে ধর্মীয় বাতাবরণের বাইরে গিয়ে শুধু উপন্যাস হিসাবে কিংবা কাহিনী হিসেবে পরো, দেখবে সব বলা হয়ে গেছে। নতুন করে কিছু বলার নেই।
দ্রৌপদীর পঞ্চ-স্বামী কিন্তু সবার সঙ্গে এক সঙ্গে কখনও শোয়নি। কেন?
তোকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি।
বল।
আচ্ছা এই ঘোটুল ব্যাপারটা এদের উৎসবের বাইরের উৎসব।
উৎসবের বাইরে নয় এটাও উৎসবের অঙ্গ। কিন্তু এর একটা নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করা হয়, এবং তার স্থানও ঠিক করে দেওয়া হয়। তোমার খেয়াল খুশি মতো নয়।
আচ্ছা এতোগুলো ছেলে মেয়ে এক সঙ্গে….।
ইয়েস তুই খুব ভাল প্রশ্ন করেছিস।
আমরা সেক্স এডুকেসন নয়ে খুব চেঁচা মিচি করি না।
মিত্রা আমার মুখের দিকে তাকাল।
তুই তোর ছেলেমেয়েকে সেক্স এডুকেসন দিতে পেরেছিস কখনও।
দেওয়া যায়। তুই বল।
ঠিক কথা। আচ্ছা তুই কখনও মনে মনে ভেবেছিস তোর মেয়ে একটা পুরুষের সঙ্গে এবং তোর ছেলে একটি মেয়ের সঙ্গে একই ঘরে শুয়ে সেক্স করছে।
এটা কখনও ভাবা যায়।
আচ্ছা তোর শরীরের চাহিদা আর তনুর শরীরের চাহিদা এক?
কখনই না।
তুই যে ভাবে আমাকে চাস তনু কি সেইভাবে আমাকে চাইতে পারে?
হয়তো আমার থেকে বেশি, নয়তো কম।
এই ব্যাপারটা তুই যদি ভিজুয়াল করিস তাহলে কি তুই কিছু শিখবি?
অফকোর্স, কেন নয়।
এটাই সেক্স এডুকেসন। বাৎসায়ন কাম সূত্র লিখেছিল। সেটা কি কল্পনা করে।
বলতে পারবো না।
বাৎসায়নের শিষ্য ছিল কোক। দু-জনে মিলে একটা ঘর তৈরি করেছিল, এবং সেখানে ছেলে-মেয়েদের ঢুকিয়ে দিয়ে তারা কীভাবে মিলিত হচ্ছে তা দেখতো। কোক দেখতো আর বলতো বাৎসায়ন তা নোট ডাউন করতো। সৃষ্টি হলো কামশাস্ত্র।
কিন্তু কোক যেহেতু ব্যাপারটা ভিজুয়াল করেছিল তার দেখার দৃষ্টিভঙ্গিটা একবারে অন্য হলো। তাই কামশাস্ত্রের পরিশীলিত রূপ কোকশাস্ত্র। বলতে পারিস অনেক বেশি অথেন্টিক।
এই ঘোটুলে আজ চম্পা-বিষান দু-জনে এসেছে। দু-জনেই কিন্তু তাদের মনের মানুষকে খুঁজে নিয়েছে। একজন যেভাবে সেক্স প্র্যাক্টিশ করছে আর একজন সেইভাবে করছে না। এই যে ভিজুয়াল করছে একে অপরকে, এখান থেকে শেখার উপকরণটা তৈরি হয়ে যাচ্ছে। সেটা কিন্তু এরা বাস্তবে ইমপ্লিমেন্ট করে। খুব ভালো করে লক্ষ্য করে দেখবি, সেক্স ঘটিত রোগে এরা কিন্তু ভোগে না। তোর থেকেও এরা বেশ শক্ত সামর্থ। ময়না চূড়াকে দেখলেই তুই তা বুঝতে পারবি।
সত্যি দেখলে বোঝাই যায় না অতো বড়ো বড়ো ছেলে মেয়ে। তনু বললো।
আমরা তিনজনেই আবার চড়াই ঠেলে ওপরের দিকে উঠতে শুরু করলাম।
চাঁদটা অনেকটা হেলে পড়েছে। আমরা ধীর পায়ে ওপরে উঠছি। মাঝে মাঝে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ উড়ে এসে চাঁদের মুখ ঢেকে দিচ্ছে। মৃয়মান আলোয় ঢাকা পরছে চারদিক, আবার মেঘ সরে গেলে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে আলো।
বুবুন।
মিত্রার দিকে তাকালাম।
আচ্ছা এই ঘোটুলে ওরা দু-জন দু-জনকে পছন্দ করলো, তারপর মিলিত হলো এরপর যদি দু-জনে বিবাহ না করে, অপর কাউকে ভালোবেসে ফেলে।
সেটা হয় না। এটা মনের সংস্কার। আগে থেকে সব কিছু ঠিক ঠাক থাকলেই তবে ঘোটুলে প্রবেশাধিকার ঘটে। দু-জনেই শরীরটাকে মন্দির বলে মনে করে। দু-জনই কিন্তু ভার্জিন।
সেটা সম্ভব।
তোর এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব না। আমি যা চোখে দেখেছি। তাই বলছি। এখানে কিন্তু ছুড়কি আসেনি। সে পরিষ্কার বলে দিয়েছে আমি যেদিন অনুমতি দেব সেদিন সে তার পছন্দের কথা তার বাবা-মাকে জানাবে।
তুই ওই আদিবাসী ছেলেটার কাছে এই ধরণের কথা আশা করতে পারিস।
মিত্রা মাথা নীচু করে নিল।
তোকে একদিন বলেছিলাম না, এরা হচ্ছে মাস্টার ডগ, প্রভুকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। কখনও যদি মনে করে প্রভু তার ভালোবাসার অমর্যাদা করছে প্রভুকে মেরে দিতেও এরা কুণ্ঠা বোধ করে না। পাহাড় ওদের এই শিক্ষাটা দিয়েছে।
তিনজনেই হাঁটতে হাঁটতে মারাংবুরুর থানে এসে দাঁড়ালাম। হাঁপিয়ে গেছি। মিত্রা ব্যাগ থেকে জলের বোতলটা বার করলো। তিনজনেই খেলাম।
মোবাইলটা বার করে শ্যামকে একবার ফোন করলাম।
কোথায় আছিস, আমরা এখন মারাংবুরুর থানে দাঁড়িয়ে আছি।
তুকে দেখিঠি।
তাই।
হ। সেই নু তুকে দেখিঠি।
সেই নু মানে।
তুই যেউঠি বুইসেছিলি আমি তার পিছু বুইসেছিলি।
ব্যাটা আমি তোর বৌমনির সঙ্গে ফস্টি-নস্টি করি কিনা তাই দেখছিলি।
শ্যাম হাসলো।
তুই সেরকম লয়, তাই বুইসে ছিলি। তুর কথা শুনতিছিলি, তুই কততো জানু।
বকিস না। কোথায় আছিস?
চইলে আয় দেখি লিবি।
ফোনটা পকেটে রাখলাম। মিত্রা, তনু দু-জনে তাকিয়ে।
শ্যাম ছিল!
হ্যাঁ। আমাদের পাহাড়া দিচ্ছিল।
কোথায় ছিল!
হয়তো আশেপাশের কোনও ঝোপে ঘাপটি মেরে বসে ছিল।
সে কিরে আমরা কিছুই টের পেলাম না!
ওরা আমাকে কখনও একা ছাড়বে না। কাউকে না কাউকে লক্ষ্য রাখার জন্য পাঠাত।
তুই জানতিস!
তুই যদি শ্যামের জায়গায় থাকতিস কি করতিস?
মিত্রা হাসলো।
আমরা আবার খোলা আকাশের তলা থেকে বনপথে ঢুকলাম। সেই এক পরিচিত পরিবেশ।
অনি।
তনুর ডাকে পেছন ফিরে তাকালাম।
দেখলাম ওরা একটু পিছিয়ে গেছে। কাছে এলো।
তোমাকে একটা প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে।
বলো।
আচ্ছা এরা এইভাবে বিদ্রোহ করলো কেন?
তোমার শরীরের পরিধেয় বস্ত্রটা যদি জোড় করে কেউ খুলে নিতে চায় তুমি বাধা দেবে না?
অবশ্যই দেব।
এই বাধাটাকে তুমি বিদ্রোহ বলবে।
না। আত্মরক্ষা।
ওরাও তাই করছে। আমরা বুদ্ধিমান মানুষ তাদের এই আত্মরক্ষাকে রাজনীতির রং চড়িয়ে বলছি বিদ্রোহী।
একটু ভেতরের ব্যাপারটা বলো।
তুমি তো সকাল থেকে এখানে এসেছো। নিজে চোখে ওদেরকে দেখছো। এদের প্রতি তোমার অনুভূতি কি? আমি বললে হয়তো বাড়িয়ে বলা হবে।
না না তুমি বলো আমি একটু শুনতে চাই তোমার মুখ থেকে।
রাস্তা দিয়ে আসার সময় তুমি নিশ্চই লক্ষ করলে উর্বরা জমি থেকে আমরা কিভাবে লালমাটির দেশে পৌঁছে গেলাম।
দেখেছি।
এখানকার মাটি উর্বর নয়। বছরে একটা ফসলই ঠিক মতো হয় না। যেটুকু হয় তা দিয়ে এদের তিনমাসের সংসার চলে না। বাকিটা দিন মজুর খেটে আর অরণ্যের ওপর নির্ভর করতে হয়। সেই অরণ্যেও তোমরা হাত দেবে। উপরন্তু দু-বেলা দু-মুঠো পেট ভরে খেতে দেবে না। হয় কি করে?
তারপর সামাজিক অবক্ষয়। নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হবে তো। সেটুকু করতে গিয়ে তোমার পেছনে যদি কেউ তকমা লাগিয়ে দেয় তুমি নিষিদ্ধ সংগঠনের মানুষ, তুমি মেনে নেবে।
তনু আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
কি আমি অন্যায় বললাম।
তনু মাথা দোলালো। না।
তারপর বঞ্চনা। এই আদিবাসী সমজাটা চিরটাকাল বঞ্চিত হয়ে এসেছে। সারাদিন হারভাঙা খাটুনি খেটেও পেটের ভাতটুকু এরা জোগাড় করতে পারে না।
দেখো আমি মদ খাই না। তোমাদের নিয়ে ভালো রেস্তোরায় বসে লাঞ্চ বা ডিনার করি না। আমার সেইভাবে কোনও নেসা নেই। যদি আমার এগুলো থাকতো তাহলে আমার একটা খরচ হতো। ধরে নিতে পারো, আমি সেই টাকাটা এদের পেছনে খরচ করেছি।
দু-জনেই আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
খুব খারাপ কাজ করেছি, তোমরা বলো?
বিশ্বাস করো তোমাকে হার্ট করতে চাইনি।
না না তনু ভুল বুঝো না। আমি একটুও হার্ট হইনি। একচ্যুয়েলি তোমাদের সঙ্গে বসে দু-দণ্ড কথা বলবো সেই ফুরসত টুকু মেলে না। তোমরা আমার অনেক কাছে, তবু যেন মনে হয় তোমরা আমার কাছে নও, অনেক দূরে।
আবার হাঁটা শুরু করলাম।
ঠিক সেই জায়গাটার কাছে আসতেই, একটা সর সর করে আওয়াজ হতেই থমকে দাঁড়ালাম। নিজের অজান্তেই হাতটা পেছনে চলে গেছে। মেসিনটা হাতে নিয়ে নিলাম। কানটা সজাগ রাখলাম।
না। আশেপাশে কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। কান খাড়া করেও কোনও শব্দও পাচ্ছি না।
তনু মিত্রা আমার শরীরে শরীর মিশিয়ে দাঁড়িয়ে।
মেসিনটা আনলক করলাম। খুট খাট একটা শব্দ হলো। এই নিশুতি রাতে স্পষ্ট শুনতে পেলাম।
এই আধা অন্ধকারেও স্পষ্ট দেখতে পেলাম হাত পনেরো দূরের ঝোপটায় নুয়ে পড়া গাছগুলো সামান্য দুলছে।
মেসিনটা তাক করে চেঁচিয়ে উঠলাম, কে ওখানে। উত্তর না দিলে গুলি চালাতে বাধ্য হবো।
হঠাৎ একটা মোবাইল বেজে উঠলো।
যাঃ তুই সব গুইলে দিলু। ত্যাখন নু কইঠি মবিলটাকে ভ্যাব্রেটে দে। শুনলুনি।
চমকে উঠলাম। শ্যামের গলা না!
সেই ঝোপের আড়াল থেকে শ্যম-শিবু দুজনেই হাসতে হাসতে বেরিয়ে এলো।
মিত্রাদের দিকে ঘুরে তাকাতেই দেখলাম ফোনটা অফ করছে।
খুব ভয় লাগছিল, তাই শ্যামকে, শিবুকে ফোন করছিলাম। মিত্রা বললো।
তনু মাথা নীচু করে মুখটিপে হাসছে।
উত্তেজনায় শরীরটা তখনও সামান্য কাঁপছে। হঠাৎ এরকম একটা ঘটনা ঘটতে পারে ভাবি নি।
তুকে আর বন্ধুক চালাইতে হবিনি। শিবু আমার হাত থেকে মেসিনটা নিয়ে নিল।
বৌমনি ফোন না বাজাইলে তুই কি করতু।
একটুক্ষণ অপেক্ষা করে ফল্স ফায়ার করতাম।
শ্যাম হাসছে।
মন্যে দেখতি চাইছিলি তুই সত্যি চালাইতে জানু কিনা।
ভাগ্যিস বউমনি ফোন করছিল নাইলে গুলি খায়া মরিইতি। শিবু হাসতে হাসতে বললো।
তবুতো অনিদার হাতে মরতু। শ্যাম হাসছে।
আমার হাতটা চেপে ধরলো।
সত্যি শিবুকে কইতিছিল, অনিদা কথা কইতিছে ঠিক তবু ওর চোখ কান সজাগ। টুকু আওয়াজ হলি থামি যাবে, কান পাতি শুনবে।
শিবু কইল আওয়াজ দে।
গাছ লাড়তি তুই থাইমালু।
শিবুকে কইলি দেখছু। অনিদার অবস্থা দেখ। তারপরেই বউমনির ফোন। মোরটা ভ্যাব্রেটে ছিল শিবুরটা ছিলোনি।
চলবে —————————–
from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/H1CcM32
via BanglaChoti
Comments
Post a Comment