❝কাজলদীঘি❞
BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়
১৭৭ নং কিস্তি
—————————–
তখন শের-শোয়াশেরদের দেখলাম। চিনলাম।
পুলিশকে সকলের ভয়। ওই ব্যাপারটায় আমি তখন পোক্ত। আন্ডারস্ট্যান্ডিং করিয়ে দিতাম। বলতে পারো মিডিলম্যান। সেখানেও একটু-আধটু নাম করলাম।
এরই মধ্যে মিঃ ঘোষ ওসি থেকে এসি হয়েগেল। তার দৌলতে আলাপ হলো মুখার্জীর সঙ্গে।
কথাবার্তার ফাঁকে ছোটোখাটো টিপ দিতাম। মুখার্জী দেখলো আমি যা বলি মিলে যাচ্ছে।
গভীর ঘনিষ্ঠতা হলো। বেডরুম পর্যন্ত পৌঁছেগেলাম। মেশোমশাইয়ের সঙ্গে আলাপ হলো।
দু-জনে দু-জনকে জানলাম। এদিকে আমার তখন একটু একটু নামডাক হয়েছে।
ইসলামভাই-এর কেশটার জন্য। অনুপদা বললো।
হ্যাঁ। ইসলামভাই-এর কেশটায় মেশোমশাই আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন। ওনার দৌলতে টপ ইনফর্মার যারা তাদের সঙ্গে আলাপ হলো।
পার্কসার্কাসের ফরেন্সিক ডিপার্টমেন্টে যাতায়াত শুরু করলাম। সেখানে পেলাম সিংকে।
এইভাবে এগিয়ে গেলাম।
তারপরের ঘটনা তোমরা জানো।
ইসলামভাই-এর দিকে তাকালাম।
কটা বাজে ইসলামভাই।
নটা।
এবার তোমরা যাও আমি একটু ঘুমোই।
একবারে খেয়ে ঘুমো। বিধানদা বললো।
খেতে ভালো লাগছে না।
মিত্রার দিকে তাকালাম।
রতনকে বলে দে কাল সকাল সকাল বেরবো।
অনিমেষদাদের দিকে তাকালাম। তোমরা কাল কখন যাবে?
তোর সঙ্গে বেরবো।
একবার নাতনিদের সঙ্গে কথা বলে আপডেট নাও। এখানকার ব্যাপার কিছু বোলো না।
তুই রাতে না খেলে কেমন হয়। কাকীমা মন খারাপ করবে। মিত্রা বললো।
ঠিক আছে তোরা যখন খেতে বসবি ডাকিস।
অনিমেষদাদের বেরতে দেরি আমি পাঞ্জাবীটা খুলে টান টান হয়ে শুয়ে পরলাম।
মাথাটা কেমন খালি খালি লাগছে। মনে হচ্ছে আমি যেন শূন্যে ভেসে বেরাচ্ছি।
ছোটো লাইটটা জেলে দিই। মিত্রা বললো।
দে। একবার বড়োমার সঙ্গে কথা বলিস। বলিস আমি পরে কথা বলবো।
অনিমেষদা কথা বলেছে।
ওদের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই আমার কথা জড়িয়ে গেল। ঘুমিয়ে পরলাম।
হঠাৎ কেমন দম বন্ধ অবস্থায় ঘুমটা ভেঙে গেল।
চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলাম ঘরটা ঘুট ঘুটে অন্ধকার।
সম্বিত ফিরতে বুঝলাম। তনু-মিত্রার হাত আমার বুকে। দু-জনেই মুখটা ঘাড়ের কাছে গুঁজে দিয়ে ভঁস ভঁস করে গরম নিঃশ্বাস ফেলছে। অঘোরে ঘুমচ্ছে।
ওদের হাতদুটো আস্তে করে বুক থেকে নামালাম। আমার দিকে পাশ ফিরে শুয়ে ছিল সোজা করে দিলাম।
দু-জনের খাট, তিনজনে হয়? তবু ঢুকে পরেছে দু-জনে।
আন্ধকারে চোখটা তখনও সয়ে যায়নি। জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালাম।
রূপোলী আলো চারদিকে থিক থিক করছে। জেনারেটরের আওয়াজ পাচ্ছি। তারমানে কারেন্ট অফ। টেবিল ফ্যানটা মিত্রা একবারে বিছানার সমনে নিয়ে চলে এসেছে। মাথা দুলিয়ে এপাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত মিষ্টি হাওয়ার পরশ দিয়ে চলেছে।
এবার ধীরে ধীরে চোখটা অন্ধকারে শয়ে গেল।
ওদের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললাম।
নাইটিটা এমন পড়েছে পরা না পরা দুই সমান।
তনুর নিম্নাঙ্গ পুরো উন্মুক্ত। মিত্রার নাইটি গুটিয়ে-গাটিয়ে বিপদ সীমার কাছে এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
বেশ কিছুক্ষণ বসে বসে ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম।
হাত পা ছড়িয়ে কি নিশ্চিন্তে ঘুমচ্ছে। দেখে ভীষণ ভাল লাগছে।
জানলা দিয়ে ঝির ঝির বাতাস আসছে। বাতাসের ঝাপটায় ফ্যানের ব্লেডের রিদিম মাঝে মাঝে কেটে যাচ্ছে।
আমি ওদের দু-জনকে টপকে কোনও প্রকারে নিচে নামলাম।
এখন ঘরটা এই অন্ধকারেও অনেক পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি।
মিট সেফের কাছে এলাম। দেখলাম একটা ছোটো ঝুড়ি চাপা দেওয়া আছে।
ছোটো লাইটটা জ্বাললাম।
ঝুড়িটা তুলে দেখলাম দুধ আর মিষ্টি।
বুঝলাম রাতে উঠে যদি ওদের খেতে চাই তাই নিয়ে এসে রেখেছে।
আবার ওদের দিকে তাকালাম।
দেখলাম দু-জনে অকাতরে ঘুমচ্ছে আমি জলের জাগটা নিয়ে বারান্দায় এলাম। ভালকরে চোখে মুখে জল দিলাম।
ঘরে এসে মুখটা মুছে দুটো মিষ্টি খেয়ে জল খেলাম।
আমার মোবাইল সিগারেটের প্যাকেট দেখলাম মিট সেফের ওপর পরে রয়েছে।
প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বার করে নিলাম। লাইটারটা মোবাইলটা নিয়ে বাইরের বারান্দায় এলাম। দেখে মনে হচ্ছে ভোর হয়ে এসেছে। খামারে দেখলাম দড়ির খাটিয়া পেতে কয়েকজন মুড়িশুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। চারিদিকে চাঁদের আলো থিক থিক করছে।
অনেক দূর পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। বারান্দার একবারে কোনায় এসে নতুন বাড়ির ফাঁক দিয়ে নদী বাঁধের দিকে তাকালাম। মৌসুমি মাসির ঘরের কাছে কারা যেন বসে আছে। বিড়ির আগুন এতদূর থেকেও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।
সিরিষ গাছটায় পাখিগুলো ডানা ঝাপ্টে উঠলো।
ওদের ঘুম ভাঙছে।
এই প্রাণী জগতের একটা তৃতীয় অনুভূতি আছে। ওরা রাতের প্রহরটা শিক্ষিত মানুষের থেকে অনেক বেশি বোঝে, কখন ভোর হচ্ছে। কখন প্রকৃতি বিরূপ হবে। সেই ভাবে আগে থেকে নিজের নিশ্চিন্ত আশ্রয় নিয়ে নেয়।
সব মানুষ এটা বোঝে না, কিছু কিছু মানুষ বোঝে। সাধারণ পরিভাষায় আমরা তদের অতিমানব বুঝি। কিন্তু একটু চর্চা করলে যে কেউ এটা বুঝতে পারবে। কোনও ম্যাজিক কিংবা মাদারির খেল নয়।
কঁ কঁকড় কঁ। দূরে কোথাও মুরগী ডেকে উঠলো।
সিগারেটটা ধরালাম। পায়ে পায়ে একবার জানলার কাছে এলাম। একটুক্ষণ দাঁড়াতেই অন্ধকারেও ওদের চোখ-মুখ পরিষ্কার দেখতে পেলাম। হ্যাঁ ওরা ঘুমচ্ছে।
কালকে ছুড়কিদের ম্যাসেজ করেছিলাম। আজ বাড়ি ফিরে যাবি। বৎসরান্তে এই একটা মাত্র দিনে তোদের উৎসব। এখানে কিছুতেই থাকবি না। এই দিনটা মা-বাবার সঙ্গে কাটিয়ে পর্শু ফিরে আসবি।
দারুর সঙ্গে আর কথা হয় নি। সেই যা ম্যাসেজ পাঠিয়েছিলাম।
এতো রাতে কাউকে ফোন করা ঠিক হবে না। প্রয়োজনীয় কথা লিখে একে একে সবাইকে ম্যাসেজ করলাম। এটাও লিখে দিলাম এখন কোনও ফোন করবি না। শুধু ম্যাসেজ করবি। ফোনের দরকার হলে আমি করবো।
সিগারেটটা শেষ করে আবার ভেতরে এলাম।
এই কম আলোয় ওদের পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। মিত্রা বাঁদিকে হেলে পড়েছে।
একটা হাত খাট থেক ঝুলে পড়েছে। উন্মুক্ত বুক। ভীষণ ছুঁতে ইচ্ছে করছে। তনু সেইভাবেই উদম হয়ে শুয়ে আছে। ঘুমের এমন গভীরতা কোনও হুঁশ নেই। কাছে গিয়ে হেঁসে ফেললাম।
মিত্রার হাতটা ধরে তুলে দিলাম, সামান্য ঠেলে ভেতরে ঢুকিয়ে দিলাম।
তনুর নাভীর নিচের বিশাল অববাহিকায় হাত ছোঁয়াতেই কেঁপে উঠলো। পাশ ফিরলো।
দু-জনের শরীরের ফাঁকে যেটুকু জায়গা তাতে আশ্রয় নেওয়া যাবে না।
তবু উঠে এলাম। আস্তে করে ঠেলে সরাতে গিয়ে তনু চোখ চাইল।
হেসে ফেলেই আগে নাইটি ঠিক করতে চাইলো। আমি ওর হাতটা ধরে ফেললাম।
না।
এতক্ষণ তো দেখছিলাম। কই তখন ঢাকা দিতে পারোনি।
চোর।
মিত্রার বুকে হাত রাখতেই চোখ চাইল।
ধরফর করে সোজা উঠে বসতে গিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
কখন উঠেছিস!
অনেকক্ষণ। তনুর অবস্থা দেখ।
যাঃ।
তনুর হাতটা ছাড়লাম।
তনু নিজেকে গুছিয়ে নিল।
দাঁড়াও আসছি।
তনু খাট থেকে নিচে নামলো।
নিচে যেও না ওপরেই সেরে নাও।
তনু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বেরিয়ে গেল।
মিত্রা আমার কোলে শুয়ে পরলো।
শুস না। ভেতরে কিছু পড়া নেই একটা বিপত্তি হলে আবার গণ্ডগোল।
এখন তোর বয়সটা আঠাশ নয়। আর যদি কিছু হয় সামলাবার মতো ক্ষমতা এখনও আছে।
তনু বাইরের কাজ সেরে ভেতরে এলো। আলনা থেকে টাওয়েলটা নিয়ে মুখ মুছে নিল।
কিগো আওয়াজ পেলাম না।
দেখছো মিত্রাদি কি অসভ্য।
কোনদিন সভ্য ছিল বল।
আমি হাসছি।
তুই তো বললি তোকে বার পাঁচেক ছুঁয়েছে। আমাকে তোর থেকে একটু বেশি ছুঁয়েছে।
তাও সেটা আমার ইচ্ছেয় ওর ইচ্ছেয় নয়। তনু বললো।
টাওয়েলটা আবার আলনায় রেখে মিত্রার দিকে তাকাল।
ওকে মিষ্টি দিই?
দুটো খেয়েছি।
দুধটা খেয়েছো?
না।
কাকীমা সকালে জানতে পারলে দুটোকে আর আস্ত রাখবে না।
ঠিক আছে সকালের আগে খেয়ে নেব।
কালরাতে নিজে এসে রেখে গেছে। বার বার বলেছে তোরা ঘুমোবার আগে ওকে ডেকে খাইয়ে দিয়ে তবে শুবি।
ডাকো নি কেন?
তুই যে ভাবে ঘুমচ্ছিলি। ডাকতে ভীষণ মায়া হচ্ছিল। মিত্রা বললো।
তনু এগিয়ে এসে পাশে বসে পরে জড়িয়ে ধরলো।
তনু হুল ফুটছে।
ফুটুক।
তুই কোথায় করলি। মিত্রা, তনুর দিকে তাকাল।
বারান্দার ওই কর্নারে।
কেউ দেখেনি।
দূর উঠলে তো দেখবে।
যাই টন টন করছে।
মিত্রা আমাকে জড়িয়ে ধরে কোল থেকে উঠলো।
বাইরের বালতিতে জল আছে। মগের জলে মুখ ধোবে। তনু বললো।
আচ্ছা।
মিত্রা উঠে দাঁড়িয়ে একটা আলিস্যি ঝারলো। আমি ওর পাছায় একটা থাপ্পর কষালাম।
মাথায় রাখিস। ঘুরে আসি শোধ তুলবো। আজা সারারাত আমাদের দেওয়ার কথা ছিল।
অনেক ঘুমিয়েছিস শরীর ঠিক হয়ে গেছে। এবার একটু এনার্জি খসাবি।
মিত্রা মিটসেফের ওপর থেকে জলের জাগটা নিয়ে বেরিয়ে গেল।
তনু আমার গালে ঠোঁট ছোঁয়ালো।
একবারে নো ঝামেলা।
সেই আন্টির প্রোগ্রামের দিন একটু ঝামেলা করেছিলাম তারপর আর করিনি।
মাসে এক বছরে বারো তার থেকে পারলে কম করো। খনার বচন মনে আছে।
এই বুড়ো বয়সে আবার খনার বচন। দিদি আসুক।
কেন দু-জনে মিলে যুদ্ধ করবে।
তোমাকে এখনও ঠিক আগের মতো পাই।
আবার হাত দেয়।
নিজের জিনিষে হাত দচ্ছি। অন্যেরটা নিয়ে টানা টানি করছি না।
খুব টরটরি হয়েছো দেখছি।
যে লজ্জা সঙ্কোচটা ছিল দিদি ভেঙে দিয়েছে।
আমি তনুর মুখের দিকে তাকালাম। পরিতৃপ্ত মুখ। কাঠ ঠোকরার মতো আমার ঠোঁটটাতে তিন-চারবার ঠুকরে দিল।
কাল রাতে বড়োমার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বললাম।
কি বললো।
ভীষণ খুশী। তোমার সেই পকেটমারের গল্পটা দিদি বললো।
ওমনি লাগান-ভাগান হয়ে গেছে।
বারে বলবো না।
মিত্রা ঘরে এসে নাইটি দিয়ে মুছছে।
ওটা কি করছিস! আমি ওর দিকে তাকালাম।
জল লেগে আছে।
টাওয়েল দিয়ে মোছ।
দূর এটা কাচতে দেব।
সকালে উঠে বেরবি কে কাচবে?
নীপাকে দিয়ে যাব কেচে রাখবে।
ওর রকম সকম দেখে আমি, তনু হাসছি।
মিত্রা মিটসেফের ওপর থেকে ওর হাতঘড়িটা তুলে নিল।
ওরে তনু হবে না। সাড়ে তিনটে। এখুনি এসে নীপা চেঁচাবে মিত্রাদি ওঠো।
যেটুকু হয়।
তনু ঠেলে আমাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পরলো।
আজ ছেড়ে দে। মিত্রা মুচকি মুচকি হাসছে।
হোক না হোক।
দেখছো ইচ্ছে আছে। আমি একটু গা গরম করে নিই।
আমি হাসছি।
এক যাত্রায় পৃথক ফল কেন। তুইও একটু গা গরম করে নে।
মিত্রা ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পরলো।
বেরতে গিয়ে বুঝলাম সবাই আমার পেছন ধরেছে। এমনকি মৌসুমী মাসিকে পর্যন্ত ট্রলিতে তুলেছে। আমি ওদের রকম-সকম দেখে হাসি। নিশ্চই কাল সব প্ল্যান প্রোগ্রাম করেছে।
চিকনা বললো। ওরা যাক তোকে চিন্তা করতে হবে না। আমি ঠিক আছি। সামলে নেব।
মীরচাচা হাসছে।
তুই নিশ্চিন্তে যা। কালকের কথা সব শুনেছি বাসুর মুখ থেকে, আজ থেকে খোঁজ খবর নিচ্ছি।
সাবধানে। একবারে হরবর করবি না।
এটা সেটা করে, তবু বেরতে বরতে সাড়ে পাঁচটা হয়ে গেল।
তনু মাঝখানে আমরা দু-জনে দু-পাশে। সামনে চাঁদ, আবিদ পেছনে চিনা।
মিত্রা কাকে ফিস ফিস করে ফোন করছে। এতো কাছ থেকেও কিছু শুনতে পাচ্ছি না।
পরিদার দোকানে এসে ধাক্কা খেলাম। একটু চা খাওয়া হলো। মিষ্টির হাঁড়ি উঠলো।
ভোলার সঙ্গে একটু কথা বলে নিলাম। যেটুকু বুঝলাম একদিনে হাওয়া পরিবর্তন হয়েছে।
সময় নষ্ট না করে আবার রওনা হলাম।
এখানের সকালটা বড়ো মনোরম।
নরম রোদের পরশ চারদিকে। একটা মিষ্টি ঠান্ডা হাওয়া। দ্বীপের মতো দূরের কিছু কিছু মাঠ সবুজ গালিচায় মোড়া। গ্রীষ্মকালীন চাষ। যেখানে যেখানে শ্যালো টিউব-ওয়েলের জল পাওয়া যায় সেখানেই চাষ হয়। বাকিটা শীর্ণ শরীরের মতো পড়ে রয়েছে।
আমাদের ও পাশটা কিন্তু এরকম নয়। অনেকে মাঠে মাঠে শ্যালো টিউব-ওয়েল পুঁতে নিয়েছে।
জল যদিও অনেকটা নেমে গেছে। একটা কালবৈশাখী এক পশলা বৃষ্টি হলেই জলের স্তর আবার ওপরে উঠে আসবে। এই সময়টা মাঠে যারা কাজ করে তাদের খুব কষ্ট।
এই ঠাটা-পোরা দুপুর রোদে মাঠে মাঠে ঘুরে দেখতে হয় জল কতদূর পর্যন্ত পৌঁছলো। গাছের গোড়ায় ঠিক মত জল দাঁড়িয়েছে কিনা। কত খুঁটি নাটি।
জামনার বাজারটা আজ দেখলাম বেশ স্বাভাবিক। দেখে বোঝাই যাচ্ছে না। চব্বিশ ঘণ্টা আগে এরকম কিছু একটা এখানে ঘটে গেছে। আমাদের গাড়িগুলো সাঁই সাঁই করে বাজারটা পার হয়ে চলে এলো।
স্টেশন রোডের কাছে আসতেই দেখলাম অনেক পুলিশ।
আমাদের গাড়িটা ড্রাইভ করছে রতন। ওকে জিজ্ঞাসা করলাম। ব্যাপার কিরে!
কি করে বলবো। তুমি যেখানে আমিও সেখানে। তবে বসেরা যাচ্ছে। হয়তো তাই জন্য।
একটু চোখ বুলিয়ে নিয়ে দেখলাম রতন কথাটা নেহাত খারাপ বলেনি। দু-একটা পুলিশ আমাদের গাড়ির দিকে তাকিয়ে স্যালুট মারছে।
অনিমেষদা বিধানদার গাড়ি সবার প্রথমে। আমাদের পেছনের গাড়িতে নীপারা। তার পেছনে ইসলামভাই।
হাইরোডে এসে সব গাড়ি এক সঙ্গে দাঁড়াল।
অনিমেষদা, বিধানদা গাড়িতে বসে। অনুপদা, রূপায়ণদা নিজেদের গাড়ি থেকে নামলো।
একজন পুলিশ অফিসার অনিমেষদার কাছে এগিয়ে গেছে।
আমি মিত্রাকে বললাম, দাঁড়া একবার ওদের দেখে আসি।
যা আমরা এখানে আধাঘণ্টা অপেক্ষা করবো।
কেন?
সবাই আসছে।
সবাই আসছে মানে!
এলেই দেখতে পাবি।
ম্যাডাম সামনের কেবিনটায় চায়ের কথা বলি। রতন বললো।
বলো। অন্য কিছু বলো না। ওরা ধাবা থেকে সব নিয়ে আসছে।
কিরে দলবল জুটিয়েছিস মনে হচ্ছে?
তনু হাসছে।
আমাকে নামতে দেখে অনুপদা এগিয়ে এসেছে। নীপারা সবাই গাড়ি থেকে নেমেছে। বাসু, ভানু এগিয়ে এলো।
ওদের সঙ্গে দেখা করবি তো?
হ্যাঁ।
চল।
দাঁড়া অনিমেষদার সঙ্গে একবার দেখা করে আসি।
আগে ভেতরের কাজটা সেরে নে। পরে দেখা করিস। অনুপদা বললো।
তাই চলো।
আমরা ভেতরে এলাম। রিসেপসনে সেই মেয়েটির সঙ্গে আজ একটা নতুন মেয়েকে দেখলাম।
আমাদের দেখেই বেরিয়ে এলো।
ওরা কেমন আছে ম্যাডাম।
ভালো আছে স্যার।
ঘুম থেকে উঠেছে।
হ্যাঁ।
একবার দেখা করা যাবে?
আসুন।
উনি নিজেই নিয়ে গেলেন আমাদের।
দেখলাম একটা বড়ো ঘরে তিনজনকে রেখেছে। চার বেডের ঘর। একটা বেড ফাঁকা।
আমাকে দেখে ফকিরের চোখ ছল ছল করে উঠলো। আর দু-টোকে চিনি না। গ্রামেরই ছেলে হয়তো, দেখেছি। খেয়াল করতে পারছি না।
সকলেরি বাঁদিকে চোট লেগেছে। ফকির আর একটা ছেলের গুলি তলপেটে লেগেছিল। আমি ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম।
আর দুটো দিন কষ্ট কর তারপর এরা ছেড়ে দেবে।
তুমি আর মোনকাকে বারন করবোনি। একটা ছেলে বলে উঠলো।
আমি ওর ডানহাতটা ধরলাম।
সব সময় মাথা গরম করলে চলে। কি করবি। কপালে ছিল, হয়েছে।
অন্যে অনেকদিন নু বাধাইবার ফন্দি আঁটছিল। চাচা মনকাকে খালি থাবারি দেয়।
আমি চুপ করে রইলাম।
তিনজনেই গজরাচ্ছে।
কালকের থেকে আজকে একটু সুস্থ লাগছে?
গা-হাতে বিষ ব্যাথা।
কমে যাবে।
ওদের সঙ্গে একটুক্ষণ সময় কাটিয়ে বেরিয়ে এলাম।
বাসুকে বললাম তুই কি থাকবি না চলে যাবি?
এখানে যে দু-জন ছিল বাড়ি যাবে ওখান থেকে দু-জন আসবে ওরা দশটা নাগাদ আসবে। বারোটা পর্যন্ত থাকবো তারপর আমি, ভানু ফিরে যাব।
সাবধানে যাস।
সে তোকে আর বলতে হবে না। ভানুর গাড়ি নিয়ে আসবে। মালপত্র সব থাকবে। এবার থেকে শুধু খেয়ে বাড়ি ফিরবো না। কিছুটা দিয়েও যাব।
অনুপদার পার্মিসন নিয়েছিস?
পার্মিসনের দরকার নেই। বাঁচার জন্য যেটুকু দরকার করতে হবে।
সুবীরকে দেখলাম এসেছে, ব্যাঙ্ক কে চালাবে।
লোক তৈরি হয়ে গেছে।
বাইরের গেটে আসতে দেখলাম চারখানা নতুন গাড়ি সংযোজন হয়েছে। সবকটা হাইরোডের ওপর সাইড করে দাঁড়িয়ে।
সুকান্তকে দেখতে পাচ্ছি। অনিমেষদার গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। আজ একবারে পোষাক লাগিয়ে এসেছে। সেন, শ্রীবাস্তব, মহান্তিও রয়েছে। সবাই সাফারি পরেছে।
দেখেই বোঝা যাচ্ছে। একবারে তৈরি হয়েই আছে।
আমি রাস্তা পার হয়ে এপারে এলাম। এবার গাড়ির দিকে লক্ষ্য করলাম। কে নেই সবাই হাজির হয়েছে। একমাত্র বাড়ির বুড়োরা সব রয়েগেছে।
অনিমেষদার দিকে তাকালাম। হাসছে।
যাক, কোনও দিন যায়নি। একবার ঘুরে আসুক।
মেয়ে-জামাই-বউ-নাতি সবাইকে পাঠিয়ে দিচ্ছ খাবে কি?
মল্লিক আর অনুপ রান্না করবে বলেছে। তাছাড়া দামিনী একজনকে রেখে এসেছে।
ভজু এসে সামনে দাঁড়াল। হাসছে।
চলো, দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমার হাতটা চেপে ধরলো।
তুই চলে এলি?
বা-রে, বড়োমা বললো।
দেখা করেছো। অনিমেষদার দিকে তাকালাম।
হ্যাঁ। যা বলার কাল রাতেই বলে দিয়েছি।
অনেক কাজ করে ফেলেছো বলো।
তুই সুযোগ দিলি ছাড়ি কেন।
সুকান্ত একটা ফাইল আমার হাতে এনে দিল।
অনিমেষদা, বিধানদা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে।
সব আছে?
দুটো বাকি আছে।
কবে দেবে?
তিন-চারদিন সময় লাগবে।
অনিমেষদা, বিধানদাকে বললাম একবার এসো।
দেখলাম কনিষ্ক, নীরু, বটা, অনিকেত এগিয়ে এসেছে।
আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
কিরকম স্ট্যান্ট দিলাম বল। নীরু বললো।
আমি ওদের দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
ছেলেগুলোকে একবার দেখে এসেছিস।
দরকার পরবে না। আজ কোনও ডাক্তারি করবো না। কনিষ্ক বললো।
একবার একটু চোখের দেখা দেখে আয়। ওদের ভালো লাগবে।
চল ও যখন বলছে দেখে আসি। নীরু বললো।
আমি, অনিমেষদা, বিধানদা আমার গাড়িতে এসে বসলাম। অনুপদা, রূপায়ণদাও এলো।
ফাইলটা অনিমেষদার হাতে দিয়ে এতে কি কি আছে সব বললাম।
ওরা আমার কথা শুনে একটু অবাক হলো।
তাহলে প্রবীরের সঙ্গে বসে আজই কথা বলে নিই। বিধানদা বললো।
পারলে বলে নাও।
সকালের কোনও খবর আছে? অনিমেষদার দিকে তাকালাম।
কলকাতায় তাড়াতাড়ি ঢুকতে ভয় করছে।
কেন!
অরিত্র যা লিখেছে। সাংবাদিক কুল চেপে ধরবে।
লেটেস্ট খবর কি?
তুই কিছু জানিস নি!
এখনও নিই নি।
কাল পর্যন্ত অনাদি এক কথা বলেছে। আজ সকাল থেকে নাকি অন্য কথা বলতে শুরু করেছে।
একবারে তিনশো ষাট ডিগ্রী ঘুরে গেছে?
ওই রকম।
এটাকে কাজে লাগিয়ে দাও। এই ফাইলটা নিজের কাছে রাখবে। গিয়ে তোমার কাছ থেকে নেব।
অনুজের ব্যাপারটা কি করবি?
আমি কোনও কমপ্রমাইজ করবো না।
কোনও প্রশ্নই নেই। বিধানদা বলে উঠলো।
বিধানদা আমার দিকে তাকাল।
তোকে ভাবতে হবে না। ওটা আমি অনিমেষের সঙ্গে বুঝে নেব।
অনিমেষদা হাসছে।
হেসো না অনিমেষ। ও কোনও অন্যায় কাজ করলে নিশ্চই আমরা বলতে পারি। ও টোটালটা আমাদের দিকে তাকিয়ে করছে। সেখানে সামান্য স্বার্থের জন্য এটা মেনে নেওয়া যায় না।
অনুপদা, রূপায়ণদা মুখ ঘুরিয়ে হাসছে।
তুই তো ভালো ভোট জোগাড় করেছিস। অনিমেষদা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
বারে, আমি কেন জোগাড় করতে যাব।
ওরে সংগঠনটা চালাতে হবে। ভুল-ত্রুটি নিশ্চই থাকবে সেটা সংশোধন করতে হবে। আমারটা তুই সংশোধন করে দিসনি। দেখবি ও নিজেকে সংশোধন করে নেবে। রিজিড থেকে লাভ কি?
ওটা তোমাদের ব্যাপার।
এখন আর আমাদের, তোমাদের বলে কিছু নেই। যদি তাই হতো এই ঘটনা শোনা মাত্র লাফিয়ে এখানে চলে আসতাম না। এইরকম ঘটনা আকছাড় অনেক ঘটছে। কটায় নিজেরা যাচ্ছি।
আমি চুপ করে রইলাম।
তুই কলকাতায় কবে ফিরছিস?
কাল রাতে।
অনুপ তোর সঙ্গে যাক, গিয়ে কথা বলে আসুক।
কেন তোমরা কথা বলোনি!
বলতে চায়নি। এক কথা অনিদার সামনে যা বলার অনুপদাকে বলবো।
তোমরা যে কিছু করোনি এটা তো অস্বীকার করতে পারবে না।
অস্বীকার করছি না বলেই তো একটা রফা সূত্র খুঁজে বার করার চেষ্টা করছি। তুই যে ভাবে বলছিস সেই গাইড লাইনটাকেই মনে চলার চেষ্টা করছি।
প্রবীরদার সঙ্গে তো শ্যামের কথা হয়েছে।
প্রবীর এখনও কিছু বলেনি। তুই যখন বলছিস আজ জেনে নেব।
অন্ততঃ দু-বেলা, দু-মুঠো পেট ভরে খাওয়ার সংস্থান তোমরা করো।
অনুপ যাক শ্যামের সঙ্গে বসুক। তারপর যে সমাধান সূত্র বেরবে সেই মতো ব্যবস্থা করবো।
সেন, মহান্তি, শ্রীবাস্তবকে সঙ্গে নিয়ে যাও। প্রবীরদার সঙ্গে কথা বলার পর একবার রাঘবনের সঙ্গে কথা বলবে। আমি কাল ওকে একটা ম্যাসেজ করে দিয়েছি।
তুই কি কিছু ঠিক করেছিস।
প্রবীরদা দু-জনকে চেয়েছে। ওরা তিনজনেই থাকতে চায়। ভাল ছেলে, সুকান্তর ব্যাচমেট।
সুকান্তর ব্যাপারটা রিক্স হয়ে যাচ্ছে না।
ফিটব্যাক দেওয়া আছে।
এরা কেউ নয় তো?
না। ডিএমটাকে একটু বোঝাও। ওর গায়ে গন্ধ আছে।
ভালো পাচ্ছি কোথায় বল। দেখি প্রবীরের সঙ্গে কথা বলে।
দ্যাখো। চলো, আর দেরি করা যাবে না।
হ্যাঁ তোরা এবার বেরিয়ে পর। ও হ্যাঁ শোন কাল বুঁচকির সঙ্গে কথা হয়েছে। যা বুঝলাম এখানে একটা কিছু হয়েছে সেটা ওরা জানে। এতোটা জানে না।
ওরা কবে রওনা হচ্ছে।
যেদিন ঠিক করা আছে সেদিনই রওনা হচ্ছে।
কথা বলতে বলতে বড়োমাদের গাড়ির দিকে এগিয়ে এলাম।
অনিমেষ তোমার কি এখনও কথা বলা শেষ হয়নি? বড়োমা বললো।
এ জীবনে মনে হয় শেষ হবে না।
দেখলাম মাঝের সিটে বড়োমা, আন্টি, জ্যেঠিমনি সামনে বসেছে ছোটোমা, বৌদি।
পেছনে দামিনীমাসি, ভজু।
আমাকে দেখে সবাই হাসছে।
তোমরা কি করতে এলে?
তুই একা যাবি তাই আমরা সব বডিগার্ড। বৌদি বললো।
কে ঠিক করলো?
নিজেরাই ঠিক করলাম।
বাড়িতে সব বয়স্ক মানুষ গুলোকে ফেলে রেখে আসতে পারলে।
আর ডেঁপোমি করিস না। এবার ওঠ। বড়োমা ফর্মায় ফিরলো।
তোমার গাড়িতে জায়গা আছে?
পেছনে আছে উঠে পর।
আমি একা একটা গাড়িতে যাব।
ছোটো ওই দুটো কোথায় রে।
কনিষ্করা সব ওই গাড়িতে গিয়ে উঠেছে। ওদের ভাগিয়ে দিয়েছে।
ওই দুটোকে ওর সঙ্গে গুঁজে দে।
চাঁদ, চিনা, রতন আছে।
সবকটা দরকচা মারা। থেকে কি করবে। কিছু জানে।
বৌদি হাসছে।
খাওয়া-দাওয়া কোথায় হবে? বড়োমার দিকে তাকালাম।
আগে পূজো দিই তারপর।
উরি ব্যাস! বেশ প্ল্যান প্রোগ্রাম সেট করে বেরিয়েছো দেখছি।
তুই করতে পারিস আমরা করলে দোষ।
তোমরা বরং ঘুরে এসো আমি কলকাতায় ফিরে যাই। অন্ততঃ দাদাদের দুটো ভালোমন্দ রান্না করে খাওয়াতে পারবো।
বড়োমা চোখ-মুখ পাকিয়ে এমনভাবে তাকাল বিধানদা, অনিমেষদা পর্যন্ত হেসে ফেললো।
ছোটো দেখেছো ও কি স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে। সত্যি কি ও এতটা স্বাভাবিক? আন্টি বললো।
দেখো না মিত্রা রেগে গেলে কেমন তরপায় ও তো গিরগিটি। এখুনি একটা রং পরক্ষণেই ওর আর একটা রং।
রবীন কাছে এসে দাঁড়াল।
তুই কি এই গাড়ির ড্রাইভার?
রবীন হাসছে।
নে উঠে পর।
তুমি যাবে না?
না। আমি আমার গাড়িতে।
বড়োমা যে বললো, তুমি এই গাড়িতে যাবে।
আমি এগিয়ে এলাম।
বড়োমা জানলা দিয়ে মুখ বার করে চেঁচাল। উঠবি না।
পরে উঠছি।
আমাদের গাড়িটা ততক্ষণে রতন বড় রাস্তায় নিয়ে চলে এসেছে।
নিরঞ্জনদা কি তোমাদের সঙ্গে কলকাতায় যাবে? অনিমেষদার মুখের দিকে তাকালাম।
হ্যাঁ। ওকে নিয়ে বসতে হবে।
কেন?
কতকগুলো ঘটনা বললো। ওগুলোকে খবর পাঠিয়েছি। শুনে নিই। এখন থেকে ব্যবস্থা না নিলে সামনে ঘোর বিপদ।
বড়োমার সঙ্গে দেখা করেছে?
করেছে।
গালাগাল দিয়েছে?
তা একটু আধটু দিয়েছে।
সুরো মুখ বারিয়ে বললো, এখন কিছু বলছি না। আগে নামি তারপর চুলের মুটি ধরবো।
আঙ্কেল তারস্বর চেঁচানিতে পেছন ফিরে তাকালাম। দেখলাম গাড়ির পেছনের কাঁচদিয়ে মাম্পি, মিকির মুখ দেখা যাচ্ছে। দরজাটা খুলতেই নেমে এলো।
তোমার গাড়িতে।
দু-জনে দুটো ঠ্যাং জাপ্টে ধরেছে।
ওরা হাসছে।
মিলি মুখ বেঁকিয়ে বলছে, যা যা আঙ্কেলের পেছন ধর, মাল বাগাতে পারবি।
তনু, মিত্রা দেখলাম সামনের সিটে বসে।
পেছনে ইসি, নম্রতা বসে।
ইসলামভাই-এর গাড়িতে দেখলাম সুবীর, নীপারা উঠেছে। অংশু, বরুণদাও আছে।
তারমানে নীপারা যে গাড়ি নিয়ে এসেছিল সেটা ফিরে যাচ্ছে।
তোরা এখন মার সঙ্গে বোস, আমরা যখন পাহাড়ে উঠবো তখন তোকে নেব।
না।
ওই গাড়িতে বাবা আছে।
তোমার সঙ্গে।
বাধ্য হয়ে দু-জনকে দু-হাতে ধরলাম।
ইসলামভাই ইসারায় কাছে ডাকলো। গেলাম।
আবিদকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
আমি তোমাকে বলবো ভেবেছিলাম। সাহস পাচ্ছিলাম না। যদি মনখারাপ করে।
আমি বুঝিয়ে বলেছি।
ভালো করেছো।
অনিমেষদারা চলে গেল। আমি নিজের গাড়িতে উঠলাম।
কনিষ্ক-নীরু মাম্পি, মিকিকে দেখে হেসে গড়িয়ে পরে।
আমি দু-টোকে নিয়ে সামনের সিটে বসলাম নীরু পেছনে চলেগেল।
বক বক করতে পারবি না।
দুজনে উঠেই সামনের দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে পরলো।
গাড়ি চলতে শুরু করতেই মিকির মুখ থেকে বুরুর বুরুর আওয়াজ বেরতে শুরু করলো।
রতন একবার মিকির দিকে তাকায় আর হাসে। নিজের মনে গাড়ি চালাচ্ছে।
মাম্পি জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে। মিকি মাঝে মাঝে গাড়ি চালাতে চালাতে টাল খেয়ে মাম্পির ঘাড়ে পড়ে যায়। মাম্পি থাপ্পর বাগিয়ে এগিয়ে যায়।
এক থাপ্পর, ধরতে পারছিস না।
দেখতে পাচ্ছিস না। গাড়ি চালাচ্ছি।
দু-জনে লেগে পরলো। কিছুক্ষণ চলার পর আমি ধমকে উঠলাম মার কাছে পাঠিয়ে দেব।
দু-জনেই চুপ করে গেল। আবার নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল।
কনি।
বল।
অনি বশ ভাল ম্যানেজ করে তাই না। নীরু বললো।
আগে দেখিনি। এখন দেখছি। ভালকরে দেখে নিই, নেমে তোকে উত্তরটা দেব।
আমরা সবার আগে। রতন যেন হাওয়ায় উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে গাড়ি।
কনিষ্ক একটা সিগারেট দে।
পূজো দিয়ে খাস।
কিসের পূজো!
রাস্তায় নাকি জাগ্রত মনসা মন্দির আছে।
এখনও ঘণ্টা দেড়েক লাগবে।
রবীন যে বললো আর কিছুটা দূরে।
ও ব্যাটা জানে না। একটা উজবুক।
কফি খাবি?
পেছন ফিরে দেবার মুখের দিকে তাকালাম।
তুই এখানে কফি পেলি কোথায়!
অবাক হচ্ছিস?
স্বাভাবিক।
নার্সিংহোমে রিসেপসনিস্ট ম্যাডামকে ধরে একটা ফ্লাক্স জোগাড় করলাম, সামনের দোকান থেকে ভড়ে নিলাম।
গ্লাস?
সব আছে।
দে।
দুটো বিস্কুট চিবিয়ে নে।
বটা দেখলাম একটা প্যাকেট থেকে দুটো বিস্কুট দিল।
আমি হাসছি।
সব আছে।
মাম্পি আমার হাতের বিস্কুট দেখতে পেয়ে গেছে। আমার দিকে তাকাল।
দাও।
একটা, দু-জনে হাফ হাফ।
তুই খা ওদের দিচ্ছি। কনিষ্ক বললো।
চাঁদ কফিটা ঢালো। বটা বললো।
আমার হাতে কফির গ্লাস আসতেই বিস্কুটের যে টুকু অবশিষ্ট ছিল, মিকি, মাম্পি ডোবাল।
কনিষ্করা হাসছে।
কফি খেয়ে কনিষ্কর দেওয়া সিগারেট ধরালাম।
মৌজ করে তিন-চারটে টান মরলাম।
দেবা তুই কাল এই তল্লাটে ছিলি না?
থাকলে তো চলেই আসতাম। পর্শুরাতে এখান থেকে সাড়ে-আটটা পৌনে নটায় বেরিয়েছি। সেইদিন দুপুর বেলা বাজারে বসে চিকনা, বাসু, মীরচাচার সাথে কতো কথা হলো। ওদের একটা নতুন প্রস্তাব দিলাম। ওরা রাজিও হলো। গতকাল টিভিতে দুপুরে নিউজটা দেখে চমকে উঠি।
সঙ্গে সঙ্গে তোকে ফোন করি স্যুইচ অফ, মিত্রার ফোন কনটিনিউ বিজি।
বাধ্য হয়ে মিলিকে ফোন করলাম। বললো কনিষ্ক এখানে এসেছে।
সোজা তোর বাড়িতে। গিয়ে সব শুনে আমি থ।
তারপর কনিষ্ক, নীরু ফিরতে ডিটেলসে সব জানলাম। মিত্রার সঙ্গে কথা হলো।
কনি এই প্রোগ্রামটা কখন সেটেল করলি?
কনিষ্ক, নীরু দু-জনেই কিছুক্ষণ ঝেড়ে হেসে নিল। চাঁদ, চিনা, রতনও হাসছে।
জানি তুই ভূমিকার পর তোর জায়গায় ঢুকে পরবি।
আমি ঘাড় ঘুরিয়ে কনিষ্কর দিকে তাকালাম।
সবাই মিলে ঠিক করলাম। কতদিন পর আমরা চারজন একসঙ্গে শ্যামের ওখানে যাচ্ছি বল।
তা ঠিক, প্রায় বছর বাইশ হবে। আমি বললাম।
হ্যাঁ। শেষ একসঙ্গে এসেছিলাম চাকরিতে জয়েন করার কয়েক মাস আগে। বটা বললো।
সেবার মনে হয় অনিকেত আসেনি। ওর কি প্রবলেম হয়েছিল।
দাদু মারা গেছিলেন। অনিকেত বললো।
হ্যাঁ। আমরা তোর দাদুর শ্রাদ্ধে কম্পিটিসন করে রসোগোল্লা খেয়েছিলাম। নীরু বললো।
শ্রাদ্ধে রসগোল্লার কম্পিটিসন! দেবা বলে উঠলো।
ও তুই বুঝবি না। বটা বললো।
দেবা বটার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে।
দাদু নাইনটি সেভেন প্লাস, কেঁদে কি করবো, দাদু রসোগোল্লা খেতে ভালোবাসতো, তাই দাদুর অনারে রসগোল্লার কম্পিটিসন। তাই নারে অনিকেত?
বটার কথায় চাঁদ, চিনার হাসি আর থামছে না।
অনিদা সামনে একটা মোড় দেখতে পাচ্ছি। রতন বললো।
কোনও দিকে তাকাবি না বেঁকে বুঁকে সোজা চলে যাবি। এই মোড়টা দিয়ে বাঁদিকে গেলে খড়গপুর। ডানদিকে গেলে মেদিনীপুর টাউন।
সকালের কাগজ দেখেছিস? কনিষ্ক বললো।
না। অনিমেষদা একটুখানি বললো।
কাল ব্যাটা অনাদি, সাগর খুব তরপাচ্ছিল। আজ পুরো পাল্টি।
অরিত্র কি লিখেছে?
পুরো উগড়ে দিয়েছে। তোর ছকটা হেবি কাজে লেগেছে।
প্রিয়দর্শিনী, দিবাকরের ব্যাপারে কিছু টাচ করেছে।
ওদের দু-জনের ম্যারেজ রেজিস্ট্রেসনের সার্টিফিকেট ছেপে দিয়েছে।
আবার অনাদিরটাও ছেপেছে। সেটা বল। নীরু বললো।
সাগরের ব্যাপারে?
পুরো শুইয়ে দিয়েছে। ও আর উঠতে পারবে না। যা শুনলাম কাগজ বেরবার পর সিপি অরিত্রকে ফোন করে ডকুমেন্টস চেয়েছে।
আর থাকতে পারলাম না। প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইলটা বার করলাম।
অন করতেই একের পর এক ম্যাসেজ রিসিভ হতে শুরু করলো।
প্রথমে আলতাফের ম্যাসেজ পড়লাম।
তোমার কথা মতো সব কাজ শেষ করে ভোররাতে কলকাতা ফিরলাম। সুকান্তদা সাহায্য করেছে। কোনও অসুবিধে হয়নি। বাকিটা তোমার সঙ্গে ফোনে কথা বলবো।
বাসন্তীর ম্যাসেজটা ওপেন করলাম।
জানিনা তোমার বিশ্বাস ভাজন হতে পারলাম কিনা। এইরকম কাজ জীবনে কখনও করিনি। মাসির মুখ থেকে তোমার কাজের নানা গল্প শুনেছিলাম। আজ নিজে করলাম। একটা আলাদা অনুভূতি। তোমার অনুমতি না নিয়ে একটা ভুল কাজ করেছি। মাসি জোর করলো। বড়োমা আমাকে দেখতে চেয়েছিল। তাই কাল অনেক রাতে মাসিকে নিয়ে বড়োমা, ছোটোমা, আন্টি, জ্যেঠিমনি, বৌদিকে প্রণাম করে এসেছি। ভজুদাকে আগে দেখেছি। সেইভাবে মনে দাগ কাটেনি। কালকে ভজুদাকে নতুনভাবে দেখলাম। বুকের ভেতরটা ভীষণ যন্ত্রণা করছিল। ডাক্তারদাকে আগে দেখেছি। দাদাকে দেখে বাবার কথা মন পড়ে গেল। আর এই পাঁকে থাকতে ইচ্ছে করছে না অনিদা। এবার আমাকে একটা সুস্থ জীবন দাও।
ছুড়কির ম্যাসেজটা ওপেন করলাম।
অনিআকা তুমার কথা মতো ঘর যাতিছি। তুমি কাল যাতিছ বাবা জানছে। আমাকে কইছে মনসা মন্দির নু তুমাকে লে যাতি। আমি সেউঠি থাইকবো।
অনেক ম্যাসেজ, আর পড়লাম না।
কিরে একবারে ডুবে গেলি যে?
কনিষ্কর মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
ফোনে ডায়াল করে কানে দিলাম। রিং বাজছে। রিসিভ করেই অরিত্র হেসেফেললো।
গুরু আজ কামাল কর দিয়া।
এটা কিরকম কথা হলো, না হিন্দী না বাংলা।
উচ্ছ্বাসের বর্হিপ্রকাশ।
এতো উচ্ছ্বাস কিসের?
রিল্যাকস করতে যাচ্ছ যাও। ফিরে এলে সুমন্ত বলেছে বাটাম দেবে।
কেন রে!
এতো বড়ো কেশ ও কিছুই টের পায়নি। কালকে কাগজ ছেপে বেরবার পর দেখে পুরো খেপচুয়াস। বললো এবার থেকে আর কোনও বখড়া অরিত্রদা, অর্কদার সঙ্গে ভাগ করবো না।
সন্দীপ খুশ।
এবার আর কলার ওল্টায়নি, পুরো জামা খুলে ফেলেছে।
এতো গরম নিউজ সহ্য করতে পারছিল না।
আমার কথা শুনে অরিত্র হেসে যায়।
অর্কবাবু।
একটু আগে ফোন করেছিল। সিপি ফোন করেছিল। বলেছে যদি একটু ডকুমেন্টস গুলো দেন।
অর্ক কছু বলেনি।
বলেনি আবার, কাগজে ছেপে দিয়েছি পারলে খোঁজ খবর করে দেখে নিন। নাহলে আপনার হোম মিনিস্টারকে বলুন চিঠি দিয়ে এডিটরের কাছে রিকয়েস্ট করতে, দিয়ে দেব।
প্রবীরদা হেভি গোঁতান দিয়েছে। একবারে গলা পর্যন্ত। শালা দু নৌকায় পা দিয়ে চলে।
মাল পত্র কিছু পেলি।
অর্ক দু-একটা পেয়েছে তেমন জুতসই নয়। বুরুর বুরুর কিসের আওয়াজ।
মাম্পি-মিকি আমার কোলে। গাড়ি চালাচ্ছে।
মিলিদিরাও গেছে!
ফুল ব্যাটেলিয়ান।
তারমানে তিনজনেই আজ অফিস কাট মেরেছে!
হ্যাঁ।
আসুক দাঁড়াও।
আমিও জানতাম না। হাইরোডে এসে জানলাম।
কাল ম্যাডামকে ফোন করেছিলাম, বললো তুমি না খেয়ে ঘুমিয় পড়েছো।
আর তিনটের কি খবর?
কাজ চলছে।
অর্ককে বলিস পরে ফোন করবো।
আচ্ছা।
ফোনটা কেটে দিয়েই আলতাফকে ধরলাম। বেশ কিছুক্ষণ ফোন বেজে যাওয়ার পর নো রেসপন্স হয়ে গেল। বুঝলাম ব্যাটা ঘুমিয়ে পড়েছে।
বাসন্তীকে ফোনে ধরলাম।
কয়েকবার রিং বাজার পর ধরলো।
হ্যালো বলার পরও কোনও কথার আওয়াজ পেলাম না।
কিরে বাসন্তী কথা বলবি না?
তখনও কোন শব্দ পেলাম না। মনে হলো বাসন্তী চাপা স্বরে কাঁদছে।
একটা ক্ষীণ আওয়াজ পাচ্ছি।
ঠিক আছে তোর সঙ্গে পরে কথা বলবো।
বলো। গলাটা ধরা ধরা।
এখন কোথায় আছিস?
শিবঠাকুরকে পূজো করে উঠলাম।
কাঁদছিস?
না। বাসন্তীর গলাটা বুঁজে এলো।
তুই আমাকে ঋণী করলি। আমি তোর ঋণ শোধ করবো।
বাসন্তী ফুঁপিয়ে উঠলো।
আমি নষ্ট মেয়ে।
নষ্ট মেয়েরাই পৃথিবীর মহৎ কাজগুলো করে।
বাসন্তী কথা বলছে না।
যা এখন ঘরে যা, ফিরে গিয়ে তোর সঙ্গে দেখা করবো।
আমি তোমাকে একটা ম্যাসেজ করেছি।
পড়েছি।
বকবে না।
নিশ্চই বকবো। সেটা সামনা সামনি, ফোনে নয়।
তোমার বকুনি আমার কাছে আর্শীবাদ।
কাউকে মন দিলি নাকি?
মনটা বেচতে চাই কে কিনবে বলো।
দাঁড়া খরিদ্দার দেখি।
বাসন্তী হাসলো।
মাসি বকাবকি করেনি।
না। ফিরে আসতে কেঁদেছিল। বললো, তুই আমাকে ছেড়ে যাস না। কাজ করতে ইচ্ছে না হলে, করিস না। আমার সঙ্গেই থাকিস।
এখন রাখি বুঝলি, ফিরে গিয়ে দেখা করবো।
আচ্ছা।
চলবে —————————–
from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/3gxVuZ8
via BanglaChoti
Comments
Post a Comment