কাজলদিঘী (১৯৪ নং কিস্তি)

❝কাজলদীঘি❞

BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

১৯৪ নং কিস্তি
—————————–

মিত্রা, তনু দুজনেই আমার চোখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। চোখের পাতা জলে ভিজে কাদা হয়ে গেছে। বাবা মনে হয় মনাকাকাকে সন্দেহ করত। মা সেটা সহ্য করতে পারেনি।

বুবুন!

হ্যাঁরে।

তারও কিছু রিজিন আছে। অস্বীকার করতে পারি না। কিন্তু সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। বলতে পারিস এখনও সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি।

দু-জনেই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

বাবা-মার সম্পর্কটা মনে হয় প্রথমে মনাকাকা জানত না। পরে কোনও এক সূত্রে ঘটনাটা জেনেছিল। ব্যাশ এই পর্যন্ত। যখন সব উদ্ধার করলাম। তখন মনাকাকা স্বর্গে চলে গেছেন।

আমারও তখন টালমাটাল অবস্থা। কোন কূল রাখি কিছুতেই ঠাহর করতে পারি না।

ইতিহাস চাপা পরে গেছে।

তোকে ভূততলার গল্প বলেছিলাম।

হ্যাঁ!

বাবা-মার মৃত্যুর কয়েকদিন পর সেখানে অশ্বিনী খুড়োর ছোট বনকে মৃতা অবস্থায় পাওয়া যায়। গ্রামের মানুষ সহজ সরল বিশ্বাসে মেনে নিয়েছিল, পিসীকে নাকি ভূতে গলা টিপে মেরেছিল। পরে আমি খোঁজ খবর নিয়ে জেনেছি পিসী গর্ভবতী ছিল।

কুমারী মেয়ে গর্ভবতী। অঙ্কগুলো কেমন যেন কিছুতেই মিলতে চায় না।

বাবা-মা মারা যাওয়ার মাস ছয়েক পর কাকা বিয়ে করেন।

তখন মনাকাকার মা বেঁচে। আমার ঠিক তাকে মন পরে না। সব কেমন আবঝা আবঝা, ভাষা ভাষা। তবে কাকা কাকীকে বিয়ের সময় একটা সর্ত দিয়েছিলেন কাকী কোনওদিন মা হতে চাইবে না। যেহেতু আমি আছি। আমাকে পুত্র স্নেহে বড়ো করতে হবে।

তাহলে কি কাকা মাকে ভালোবেসে ফেলেছিল?

ভাবতে গেলে সব কিছু কেমন যেন গোলমাল হয়ে যায়।

মা তোর জন্মের কথা জানিয়ে মাসীমাকে চিঠি দিয়েছিলেন।

মিত্রা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

সেই চিঠি কোনওদিন খুঁজে পাওয়া যাবে না। পেলে তবু একটা হদিস করা যেত।

মসীমার চিঠিতে সেইরকম লেখা আছে।

মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে।

দ্বিতীয় চিঠিতে তোর অন্নপ্রাসনের কথার উল্লেখ আছে।

হয়তো মা জানিয়েছিলেন। ওইটুকু। এর বেশি কিছু লেখা নেই।

মিত্রা-তনু দুজনে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

আমি তনুর মুখের দিকে তাকালাম। চোখ ছল ছল করছে।

কেঁদে কি করবে তনু।

মিত্রার বুবুন, তনুর অনি দু-জন আলাদা ব্যক্তি। দু-জনের দুটো সত্ত্বা। কেঁদো না। আমি যা সহ্য করতে পারি তোমরা তা পার না। তাই তোমাদের বলিনি।

ওদের ছেড়ে দিয়ে খোলা জানলার কাছে এগিয়ে গেলাম। জানলার ধাপিতে হাতটা রেখে বাগানের আলো-ছায়া মাখা অন্ধকারে চোখ মলে তাকালাম। আদি অকৃত্রিম সেই আলো-ছায়া মাখা আমগাছের তলাটা। একবারে জল মেশানো নেই। সেই অন্ধকার। আলো-আঁধারি।

খাওয়ার শেষে তিনজনে বিছানায় এসে শুলাম।

ছোট লাইটের আলোটাও আজ যেন ঘরটাকে অনেক বেশি আলোকিত করে রেখেছে। দুজনে আমার বুকে উঠে এসেছে। আষ্টে পৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে। শরীরের নেশাটা আজ একটুও নেই। ওদের যেন অজানা কোনও জিনিষ জানার নেশা জেগেছে। কোনও মতেই নিজের সেই মনের চাহিদা অর্গল মানতে চাইছে না। দাও দাও খালি দিয়ে যাও।

তারপর থেকে শুরু কর। মিত্রা বললো।

দুজনের মুখের দিকে তাকালাম।

তোর কষ্টের থেকেও আমাদের বেশি কষ্ট। আবার ভীষণ আনন্দ হচ্ছে।

মিত্রা আমার মাথার চুলে আঙুল ছুঁইয়েছে। তনুর একটা হাত আমার বুকে।

বুকের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

এই চিঠি পাওয়ার পর কয়েকদিন দুবাইতে ছিলাম। মন ভাল লাগল না। বার বার মনে হচ্ছে আমি কি তাহলে আমার শেকড়ের সন্ধান পেলাম?

ছুটে গেলাম তনুর কাছে।

কাউকে না কাউকে আমারও কিছু কথা বলার থাকে, বলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কে শুনবে আমার কথা ধৈর্য ধরে। ভেবেছিলাম তনুকে গিয়ে সব কথা খুলে বলবো, মনে মনে অনেক প্রিপারেসন নিলাম। শেষ-মেষ বলতে পারলাম না। উল্টে তনুর সঙ্গে দুদিন শরীরে শরীর মেশালাম। তনু আমার মধ্যে প্রথমে কিছু এ্যাবনর্মালিটি দেখলো, ওর চোখেমুখে তার বর্হিপ্রকাশ ঘটলো। পরে সেই কথা অবশ্য আমাকে বলেছে।

সপ্তাহ দুয়েক পর চিকনা খবর পাঠাল মনাকাকা মারা গেছে। চারিদিক কেমন অন্ধকার দেখলাম। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করবো তার উপায় নেই। আমাকে তিলে তিলে তিলত্তমা করে গড়ে তোলা শেষ মানুষটা চলে গেল। যার নিবিড় ছায়ায় আমি লালিত পালিত। আমার জন্য যিনি সারা জীবন পিতা হওয়ার স্বপ্ন থেকে বঞ্ছিত হলেন।

তনু আমার বুকে মাথা রাখল।

তনু একবারে কাঁদবি না।

তুমি বলো দিদি, আমি কি অপরাধ করেছিলাম।

আমরা কেউই অপরাধ করিনি।

আবার কিছুক্ষণ চুপ চাপ থাকলাম তিনজনে।

তনুকে সঙ্গে নিয়ে অনেক খুঁজলাম, সাদা থান জোগাড় করতে পারলাম না। বাধ্য হয়ে গেড়ুয়া ধরলাম। তার আগের বার তনু সেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে কি সব ইঞ্জেকসন দেওয়াতে গোঁফ দাড়ি বের হতে শুরু করেছিল। সে আর কাটা হল না। কিছুদিন থেকে কাগজের অফিসের কাজ তনুকে বুঝিয়ে আবার দুবাই ফেরত এলাম। নেপলারা দেখে অবাক হলো। ওদের বললাম কাকা মারা গেছেন।

শুরু হলো আমার নতুন জীবন।

অভ্যস্ত হতে মাস কয়েক সময় লাগল।

মাসিকে একটা তিন লাইনেরে চিঠি লিখলাম। আমার জীবনে কিছু অঘটন ঘটে গেছে তোমাকে আমি সব জানিয়ে পরে চিঠি লিখব। একটু সময় দাও।

দিল্লী আসি আর কলকাতা বলতে কৃষ্ণনগর অনিকাদের কাছে। তাও একরাত্রি। মাসির সঙ্গে দু-তিন লাইনের চিঠিতে যোগাযোগ রেখে চলেছি। প্রায় তিনবছর ভারত মুখো হলাম না। সবার সঙ্গে ফোনা ফুনি আর চিঠি। অনিকাদের নিয়ম করে চিঠি লিখতাম। তখন ওরা একটু বড়ো হয়েছে। ওরাও তার উত্তর দিত। মাঝে মাঝে ফাদারের ফোনে ফোন করে ওদের সঙ্গে কথা বলতাম। ফাদার একদিন জানাল তুই একবার কলকাতায় আয় জরুরি দরকার।

সেই সময় তোরও ওখানে ভীষণ সমস্যা।

তারমানে তখন তোর দাড়ি জটা সব হয়ে গেছে।

হ্যাঁ।

পুরো সন্ন্যাসী।

হাসলাম।

সেবার তনুকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলাম। সুন্দরকে অনুপের কাছে রেখে দুজনে কলকাতায় এলাম। চিকনাকে ফোন করে বললাম। তনু যাচ্ছে, কাকার ওখানে, মা-বাবার ওখানে, আর পীরসাহেবের থানে ফুল দিস।

তখন তোর সঙ্গে আফতাবভাই-এর পরিচয় হয়েছে। মিত্রা বললো।

হ্যাঁ। তবে অতটা ঘনিষ্ঠতা হয়নি। তখন সবে মাত্র বসিরের বোনটা হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছে। বসিরের বয়স তখন বছর সাতেক।

হঠাৎ একদিন আফতাবভাই ফোন করলো। একবার আসবি।

গেলাম। শুনলাম বাচ্চাটার শরীর খারাপ আবার রক্তের প্রয়োজন। দিলাম।

তোদের হয়তো বলেছি, বাচ্চাটাকে বাঁচাতে পারিনি। বাচ্চাটা মারা গেল। ধীরে ধীরে আমি হয়ে পরলাম আফতাবভাই-এর পারিবারের একজন। এরপর থেকে পয়সার অতটা অভাব হয় নি।

এর মধ্যেই ঘটে গেল মুখার্জীর কেশ।

দিদির হাতে শুভকে গুঁজে দিলাম। দিদি ওই কটা দিন শুভকে নিজের বুকের দুধ খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখলো। সে এক অদ্ভূত পরিস্থিতি।

সেটা আর এক অধ্যায়। প্রথমে ফাদারের কাছে গেলাম। ফাদার দেখে অবাক। অনিকারাও কেউ ধারে কাছে এলো না। সব বড়ো বড়ো হয়ে গেছে। তখন মনে হয় এইট নাইনে পড়ছে। চিনতে পারেনি। পরে অবশ্য ওরা কাছে এসেছিল।

ফাদারের সঙ্গে কিছু আইনি কাজ সারলাম। মাসীমনির চিঠি ফাদারকে দেখালাম।

চিঠিটা পরার পর ফাদার হাসলো। বললো, যা গোপন আছে তাকে গোপনেই রাখ। এখনও অনেক সময় আছে। নিজের কাজ আগে শেষ কর। যার জন্য নিজের জীবনের অমূল্য সময় নষ্ট করলি, সেদিকে মাথা না ঘামিয়ে এদিকে মাথা ঘামালে, সব পণ্ডশ্রম হবে। এদিকটা শেষ করে এটা ভবতে শুরু করবি।

আমি কি তাহলে কনফেস করবো।

করতে পারিস। মহাভারতে যুধিষ্ঠিরের মতো অশ্বত্থমা হত ইতি গজ।

তনুকে বললাম তুমি ফিরে যাও। আমি পরে যাচ্ছি।

তনু, সুন্দরকে নিয়ে ফিরে গেল।

কলকাতা এলাম।

মাসির চিঠি অনুসরণ করে প্রথম গেলাম পোড়ামাতলা। সেখানে আমার পৈত্রিক বাড়ি দেখলাম। সে বাড়ি বহুদিন আগে বিক্রী হয়ে গেছে। নতুন অতিথিরা বাস করছে। বাবার নাম অনেকে জানে। তবে সবাই কেমন নাক সিঁটকাল। সাধুর বেশ দেখে সকলেই কেমন যেন উৎসুক। এ আবার কে?

কোনও প্রকারে নিজেকে সামলে নিলাম।

তারপর দিদার বাড়িতে এলাম। দেখলাম। সেটাও হস্তান্তরিত হয়ে গেছে। সেখানেও খোঁজ খবর নিয়ে দেখলাম একই রিপার্কেসন। কিছুদিন নবদ্বীপ আর কৃষ্ণনগরের আশে পাশে ঘুরে আবার ফাদারের কাছে এলাম। ফাদারকে বললাম আমি বাড়িগুলো কিনতে চাই দেখো ব্যবস্থা করা যায় কিনা।

ফাদার শুনে হাসল।

পিছুটান রাখিস না।

কেন বলছো বলো।

যে মাটিতে তুই জন্মেছিস, যেখানে বড়ো হয়ে উঠেছিস, সেটাই তোর জন্মভূমি। তাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেষ্টা কর।

ওখানে বেশ কয়েকদিন থাকলাম। মাসিকে চিঠি লিখে জানালাম। আমি কলকাতায় এসেছি। যদি তুমি অনুমতি দাও একবার তোমার কাছে যাব। এই নম্বরে ফোন করে জানিও।

চারদিনের মাথায় মাসির ফোন এলো।

ভাল-মন্দ খবর নিল। অনেক কথা বললো। তারপর বললো তুই কবে আসবি।

বললাম কাল যেতে পারি।

আয়।

সকাল সকাল বেরিয়ে এলাম।

তখন ওই বিএলআরও অফিস থেকে হেঁটে যেতে হত। না হলে ট্রলি। আমি হেঁটেই গেলাম। মনসা মন্দিরে এসে প্রণাম করে মাসির বাড়ির দোরগোড়ায় পৌঁছলাম।

বিনয়দা বেরিয়ে এল।

কাকে চান।

বললাম নিবেদিতা মুখার্জী।

শুনে চোখ মুখ কোঁচকাল।

কি প্রয়োজন বলুন, আমি ওনার ছেলে।

বুঝলাম বিনয়দা আমাকে চিনতে পারছে না।

বললাম একবার দেখা হতে পারে কি?

কি ভাবলো কে জানে। সাধুবাবা কেন মায়ের খোঁজ করছে।

তারপর যা হোক ভেতরে নিয়ে গেল। তখন তিতাসকে দেখলাম। বছর চারেক বয়স।

সামনের বাগানটায় খেলে বেরাচ্ছে।

মাসির ঘরে যেতে মাসিও কিছুক্ষণ আমাকে অবাক হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল।

ঘরে বৌদি, বিনয়দা দাঁড়িয়ে। আমাকে বসার জন্য চেয়ার এগিয়ে দেওয়া হল।

বলুন মহারাজ। আমি নিবেদিতা মুখার্জী। মাসি বললো।

হাসলাম।

তাহলে তোমার চোখেও ধুলো দিতে পেরেছি।

গলা শুনে মাসি চিনতে পারল। ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল।

বিনয়দা, বৌদি আমার শরীর ছুঁয়ে দেখছে লোকটা সত্যি অনি তো।

এ কি শরীরের অবস্থা করেছিস!

তারপর বিনয়দাকে বললো, তুইও অনিকে চিনতে পারিসনি।

তখন বিনয়দা, বৌদি হাসছে।

মাসিকে বললাম কেন এই বেশ ধরেছি।

সেদিনটা মাসির বাড়িতে ছিলাম। আমার জন্য সমস্ত আলাদা ভাবে ব্যবস্থা করা হল।

সারাটা দিন মাসির সঙ্গে গল্প করে কাটালাম।

খেপে খেপে আমার সমস্ত কথা মাসিকে বললাম।

শুধু মনাকাকার প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গেলাম। বললাম তিনি আমার পাড়া প্রতিবেশী। আমি ওনার স্কুলে পড়েছি। তিনি আমর শিক্ষা গুরু। এর বেশি কিছু নয়।

এখনও মনা মাস্টারের স্ত্রী বেঁচে আছেন। মনা মাস্টার নিঃসন্তান। নিজের শালীর মেয়েকে কন্যা সমতুল বড়ো করেছেন। সেই-ই এখন সংসার দেখা শুন করে। আর গ্রামের একটি ছেলে।

মা-বাবার কথা বললাম। বললাম তাদের আমি দেখিনি। লোকের মুখে যে গল্পটুকু শুনেছি তা তোমাকে বললাম। তবে সেই সব সম্পত্তি আমাদের গ্রামের পীরসাহেব আর বাসন্তী মাকে দান করা হয়েছে। মনা মাস্টার নিজেই এই সব ব্যবস্থা করেছেন।

ওরা আমার গল্প শুনে অবাক।

মাসিকে আলাদা করে বিধানদা, অনিমেষদা, বৌদি, দাদা, মল্লিকদা, ছোটোমার কথা বললাম।

কিভাবে আমি কলকাতায় এলাম। কলেজে পড়ার কথা, আমার সাংবাদিকতার জীবন, তোর কথা। ছেলে-মেয়েদের কথা। অনিকাদের পার্টটা বলিনি। দামিনীমাসির কথা। তনু-সুন্দরের কথা।

মাসি বললো তুই এতো ধরিবাজ!

আমি হাসছি।

তোর ওই সময়কার ঘটনা আমি সব জানি। কাগজে দেখেছি। তখন শুধু কলকাতা নয়। যেখানে যেখানে তোদের কাগজ গেছে সেখানেই হুলুস্থূলুস কাণ্ড। তোর মেসোমশাইও সকালে উঠেই বাংলা কাগজটা নিয়ে বসে যেত। তখন যদিও আজেকের কাগজ কালকে যেত।

কাগজ পড়তে পড়তেই বলতো, বুঝলে রুমু ছেলেটার হিম্মত আছে।

তবে একটা কথা আমাকে বলেছিল। ছেলেটার কানেকসন অনেক গভীর পর্যন্ত বিস্তৃত। তা না হলে এই রকম নিউজ তুলে আনতে পারত না।

তোর নামও তখন লোকের মুখে মুখে ফিরতো।

বলতো, দেখবে ছেলেটা বেশিদিন বাঁচবে না। পলিটিক্যাল পাওয়ার ওকে বাঁচতে দেবে না।

মাসি চেঁচিয়ে বিনয়দা-বৌদিকে ডেক সব বললো, তখন ওদের চোখ উল্টে গেছে।

আমি হাসছি। তখন অবশ্য মাসিকে টডির কথা বলিনি। বলতে পারিস সব কিছু বুড়ি ছোঁয়া গোছের। মাসিকে বললাম তোমাকে আমি আমার এই মিসনের সঙ্গী করতে চাই।

মাসি বললো, বিধানদা যেন জানতে না পারে।

আমি বললাম তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পার।

বিকেলে বিনয়দা, বৌদি গিয়ে আমার জন্য একসেট গেড়ুয়া কিনে আনল।

সাধু বাবা তোমাকে আমাদের কিছু দেওয়ার নেই এইটুকু রাখো।

মাসিকে বললাম তোমার যদি আপত্তি না থাকে আজ রাতটা তোমার ঘরে কাটাব।

আমার আপত্তি কিসের তোর অসুবিধে না হলেই হলো।

রাতে খাওয়া দাওয়ার পর দুজনে গল্প করতে বসলাম। বিনয়দারা নিজের ঘরে চলেগেল।

টুকরো টুকরো কথা হচ্ছে আমার কথা মাসির কথা। তারপর মাসি বললো।

জানিস অনি আমাদের পরিবারটা অভিশপ্ত। পরিবার না বলে অভিশপ্ত বংশ বলতে পারিস।

এখন আমাদের দুটো বংশেরই কোনও অস্তিত্ব নেই।

আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম।

অধীপ-অনিন্দিতার রিলেসন শুধু মাত্র আমাদের দুটো পরিবারকে পথে বসায়নি। আমাদের মান-সম্মান সব জলাঞ্জলি গেছে। বলতে পারিস আমাদের দুটো পরিবারকে সমাজচ্যুত করা হয়েছিল। দুটো পরিবারকেই বাড়ির যা দাম তার থেকে কম দামে বাড়ি বেচে অন্যত্র চলে যেতে হয়েছিল।

ওদের দু-জনের জন্য আমার জীবনটাও শেষ হয়ে গেল।

তোর বিধানদাকে আমি ভালোবেসেছিলাম। ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছিলাম। আমার সে স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল। তোর বিধানদাকে তারপর ছবিতে দেখি, টিভিতে দেখি, চাক্ষুষ কোনওদিন দেখিনি।

বিধানদা তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি?

চেষ্টা করেছিল। তখন আমি আর একজনের হয়ে গেছি।

মাসির চোখ দুটো ছল ছল করে উঠলো।

সব ওই ঝুমুটা আর অধীপটার জন্য। একটা গাধা কোথাকার।

আমি মাসির মুখের দিকে তাকিয়ে।

তিন ভাইবোনে বেশ ছিলাম, কি থেকে যে কি হয়ে গেল।

তুমি আগে তোমার পার্টটা বলো। তারপর তোমার বোনের পার্টটা শুনব।

তোকে তো লিখেছি।

কোথাও কোথাও তুমি নিজেকে খুব সন্তর্পনে আড়াল করে রেখেছ।

মাসি হাসলো।

একটুও না।

আমি মাসির মুখের দিকে তাকিয়ে।

একচ্যুয়েলি আমাদের প্রেমটা সেই অর্থে প্রেম না। তখন দুজনেরই মাথায় পার্টির ভূত। তারই ফাঁকে একটুক্ষণ দুজনে আলাদা হয়ে যেতাম। একটু নিবিড় ভাবে মন দেওয়া নেওয়া। এটাকে তুই সেই অর্থে প্রেম বলতে পারবি না। একটা সুন্দর অনুভূতি।

তোর বিধানদা সারা জীবনে একটা চিঠি আমাকে লিখেছিল।

সেই চিঠি থেকে বুঝেছিলাম ও আমার প্রতি দুর্বল। তখন আমার কিন্তু ওর প্রতি সেই অর্থে দুর্বলতা আসেনি। আমি ভাবতাম ও আমাদের সংগঠনের সিনিয়ার লিডার। তাকে যেটুকু সম্মান দেওয়া দরকার দিতাম। তবে মিটিং-এ আমার কথার খুব গুরুত্ব দিত।

তখন তুমি হস্টেলেই থাকতে?

হ্যাঁ। মাঝে মাঝে বাড়িতে যেতাম।

বাড়িতে জানত তুমি চুটিয়ে পার্টি করছো?

পাগল। কেউ বলে নাকি। তাহলে ধরে বিয়ে দিয়ে দেবে।

হাসলাম।

সেবার বাড়ি যেতে মা ডেকে বললো। তোর বাবা ঝুমুর ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে আমাকে খুব বকাবকি করেছে। আমি নাকি ঝুমুকে কিছু বলছি না। লায় দিচ্ছি।

তারমানে!

কি জানি আমি কিছু বুঝি না। তোর বাবা বললো ও নাকি অধীপকে ভালোবাসে।

মায়ের কথা শুনে আমি অবাক। কি বলছো!

মা মায়ের কথা বলে গেল।

আমি বললাম, ভাই-বোনে ভালোবাসা থাকবে না তো কি….।

মা আমাকে সরা সরি বললো। তোর বাবা ওদের চুমু খেতে দেখেছে।

মায়ের কথাটা শোনার পর আমি ভীষণ অবাক হয়েগেলাম।

বললাম ঠিক আছে তোমাদের এখন কিছু বলতে হবে না। আমি ঝুমুর সঙ্গে কথা বলবো।

তোমার বনের নাম ঝুমু।

আমি রুমা ও ঝুমা। কেটে-ছেঁটে রুমু-ঝুমু।

ভালনাম অনিন্দিতা-নিবেদিতা। আমি বললাম।

হ্যাঁ।

হাসলাম।

ঝুমুকে রাতে শোয়ার সময় জিজ্ঞাসা করলাম ব্যাপারটা কি।

ও অস্বীকার করলো।

একটু বকা বকি করলাম।

সেবার ওই পর্যন্ত।

দুই বনে এক ঘরে শুতে।

হ্যাঁ। আমি তো বাইরে থাকতাম গেলে ঝুমুর ঘরেই শুতাম। পরে কি কাজে একবার বাড়িতে গেছি। দেখলাম মাসি মেসো এসে হাজির। ভাবলাম এমনি এসেছে। ওরা প্রায়ই আসে। ব্যাপারটা তখন একটা চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেছে। অবশ্যি আমার চোখেও একদিন পরেছে।

ঘটনা ঘটতো কোথায়?

অধীপ প্রায়ই আমাদের বাড়ি আসতো। কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে পড়তো। ঝুমুও ওই স্কুলে পড়তো। ঠিক হলো অধীপকে আর নবদ্বীপে রাখা হবে না। একমাত্র ছেলে দুই বাড়ির অবলম্বন। অধীপের কৃষ্ণনগরেই পড়ার কথা ছিল। মাসিমনি জোড় করে ওকে কলকাতায় পাঠিয়ে দিল।

ঝুমু আমার কলেজে।

বেশ চলছে।

তারপর আমি আধীপ চলে এলাম কলকাতা। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলাম। ওর সাবজেক্ট ছিল বাংলা। আমার পলসাইন্স। ভেতর ভেতর যে ওরা এতটা এগিয়ে গেছিল জানতাম না। ফাইন্যাল ইয়ারের পরীক্ষা শেষে অধীপকে বললাম, বাড়ি যাবি না? বলল না, আমি কলকাতায় একটা চাকরির চেষ্টা করি।

আমি তখন পার্টির ভাল পজিসনে। অধীপ আমার বেলঘরিয়ার মেসেও যেত। কলকাতায় সমস্যা হওয়ার জন্য আমি কলকাতার পাত্তারি গুটিয়ে কৃষ্ণনগরের দায়িত্ব নিলাম।

পুরো নদীয়া ডিস্ট্রিক্ট?

হ্যাঁ।

তখন তুমি বিধানদাকে কিছু বলোনি?

তখন আমরা সকলে আণ্ডারগাউণ্ডে। গোপন ডেরায় রয়েছি।

কি কাজে আমি একবার বাড়ি গেছি। দেখলাম ঝুমু খুব জোড় পড়াশুন করছে। ওর তখন ফাইন্যাল ইয়ার।  কোথা থেকে খবর পেয়ে একদিন পুলিশ রেট করলো আমাদের বাড়িতে। আমাকে এ্যারেস্ট করা হল। জেল খানাতেই খবর পেলাম বিধানদাকেও এ্যারেস্ট করা হয়েছে। বাবা-মা, মাসি-মেশো খুব ভেঙে পরলেন খবর পেয়ে অধীপ এসেছিল। ও সেই সময় অনেক সাহায্য করলো। দৌড়ো দৌড়ি থেকে সব কিছু। আমাকে কৃষ্ণনগর থেকে কলকাতায় ট্রান্সফার করা হল। কোর্টে কেশ উঠলো। ইয়ং জজ। তিনি সব শুনে টুনে একটা ডেট দিলেন। আমাকে পলিটিক্যাল বন্দি হিসাবে সম্মান দেওয়া হল। তারপর জজের বদান্যে মুক্তি পেলাম। কিন্তু আমার মুক্তিটা যে নিগোসিয়েসন ছিল সেটা বুঝিনি।

বুঝলাম জেলখানা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর। মা, মাসি, মেসো, বাবা আমাকে বোঝালেন।  বললাম, একটু সময় দাও আমাকে। আমি আমার হবু স্বামীর সঙ্গে দেখা করলাম। তার সঙ্গে কথা বললাম।

কথা বলে বুঝলাম। মেয়েদের অনেক কিছু মেনে নিতে হয়, মানিয়ে নিতে হয়। বিয়ে করে মাস কয়েক কলকাতায় ছিলাম। তারপর দ্বীপান্তরিত হলাম। আমার স্বপ্ন শেষ।

ভাগলপুর?

হ্যাঁ।

আমার বিয়েতে অধীপ এল। তখন কিন্তু ওদের সেই নেশাটা লক্ষ্য করিনি। আস্তে আস্তে সব কিছু মেনে নিলাম। বিয়ের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তোর বিনয়দা কোলে এলো।

মাসি একটুক্ষণ থামল।

তোর বিধানদা আমাকে সত্যি খুব ভালোবাসত। তাই সারাজীবন কুমারই থেকে গেল। ওদের বংশটা কৃষ্ণনগরে খুব নামকরা বংশ বুঝেছিস।

মাসির চোখ দুটো ছল ছল করছে।

তখন আমি ভাগলপুরেই রয়েছি। একদিন মা চিঠি লিখে জানাল ঝুমু কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে চলে গেছে।

মাথায় বাজ ভেঙে পড়লো।

বিনয়ের তখন মাস খানেক বয়স। ছুটে এলাম কৃষ্ণনগর। সব শুনে আমি থ। চারদিকের ওই উত্তাল পরিস্থিতে আমি কি করবো। আইনি যা ব্যবস্থা নেওয়ার তোর মেসো নিল। কিন্তু কে কার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেবে। আমাদের মামাবাড়ি ছিল মালতীপুর, কাজিডাঙা। ওখানে চলে এলাম। তোর মেসো তখন বললো তোমাকে এখন আর ভাগলপুরে যেতে হবে না। আপাতত এখানে থাক। যদি ট্রান্সফারের ব্যবস্থা করতে পারি। বছর দেড়েক পর ঝুমুর একটা চিঠি পেলাম। ওরা ঘর বেঁধেছে ওদের একটা সন্তান হয়েছে। নাম রেখেছে অনি।

সেই চিঠিও এসেছিল আমাদের একটা লোকাল ব্রাঞ্চে। সেখান থেকে আমার মামার বাড়িতে। এখানকার কথা লিখে ওদের জানালাম। ওই মাস আষ্টেক গোটা দশ-বারো চিঠি চালাচালি হয়েছিল। তারপর সব চুপ-চাপ।

মা-বাবাকে জানালাম। ওঁরা ভীষণ ভেঙে পরলেন। দেখলাম কেউ ব্যাপারটার প্রতি কোনও গুরুত্ব দিল না। সকলে তখন আমাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়। গা ভাসিয়ে দিলাম বুঝেছিস। বছর খানেক আমার আর তোর মেসোর ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেল। তারপর চারজনেই স্ট্রোক আর সেরিব্রালে পটাপট দেহ রাখলেন। সেই সময়টা নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হয়েছিল।

বোন, বোনপোর কোনও খোঁজ খবর রাখনি?

তখন আর সে ফুরসৎ ছিল না। তখন আমি নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগর-ভাগলপুর করে বেরাচ্ছি। যদি ওরা সত্যিকারের সেই সময় কোনও চিঠি দিয়ে থাকে আমার হাতে এসে পৌঁছয়নি। যোগাযোগের সেতু বলতে আমি। বাড়ির কেউ ঘুরেও তাকায়নি।

তোর মেসোর পরিবারেও প্রপার্টি নিয়ে তখন সমস্যা তৈরি হয়েছে। তোর বিনয়দা একটু বড়ো হতে একবার ওই ঠিকানায় চিঠি লিখেছিলাম। উত্তর এলো বাচ্চা সমেত তিনজনেই আত্মহত্যা করেছে। চিঠিটা পড়ার পর স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।

ভালোবাসার তাগিদে যারা সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে চলে গেল। ঘর বাঁধল, তারা স্ব-পরিবারে আত্মহত্যা করল! ওই দিনটা আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় দিন।

সেই মুহূর্তে ঠিক কি করবো ভেবে উঠতে পারছিলাম না।

তোর মেসো কোর্ট থেকে ফিরলো। সব জানলো। সান্তনা দেওয়ার ভাষা তারও নেই। আমার নিজের বলতে পৃথিবীতে আর কেউ রইল না। তিন চারদিন মুখে কিছু তুলতে পারলাম না।

কে উত্তর দিয়েছিল?

তোর ওই মনা মাস্টার। মাসি ঝাঁঝিয়ে উঠলো।

তোমরা আর ইনিসিয়েটিভ নিয়ে খোঁজ খবর নাওনি।

তোর মেসোমশাই-এর এক বন্ধু তখন ওই জেলার কোনও এক কোর্টের বিচারপতি ছিল। তার মাধ্যমেই খবরটা নিয়েছিলাম। ঘটনাটা সত্যি।

ওনারা ওখানে কি করতে গেলেন?

ওখানকার একটা স্কুলে অধিপ মাস্টারি করত। মনামাস্টার অধীপের বন্ধু ছিল। এক সঙ্গে কলেজে পড়াশুন করতো। নিয়ে গিয়ে ওখানে চাকরি দিয়েছিল।

মাসি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল।

আমার বোনপোর সঙ্গে তোর নামের মিল আমাকে ভীষণ দুর্বল করে দিয়েছিল।

সেই জন্য তুমি আমাকে এতটা স্নেহ কর?

ঠিক তা নয়। আবার হতেও পারে। আফটার অল আমি মানুষ।

একটু থেমে।

যতই হোক রক্তের বন্ধটা অস্বীকার করতে পারি কি করে বল।

তাহলে মেনে নিলে না কেন?

সেই জন্যেই ওদের খোঁজ নিতে গেছিলাম।

বড্ড দেরি করে ফেলেছিলে।

এটা স্বীকার করি। কিন্তু আমি সব নই। তখন আমার গুরুজনেরা ছিলেন।

তুমি লুকিয়ে ওই রকম একটা টাফ প্রিয়েডে বামপন্থী রাজনীতি করতে পারলে আর তোমার মা-বাবা, মাসি-মেসোকে এটা বিশ্বাস করাতে পারলে না?

হয়তো পারতাম, কিন্তু সেই মুহূর্তে আমিও মন থেকে মনে নিতে পারিনি।

তাহলে আমাদের মনের গহীণ কোনে এখনও অন্ধকার আছে?

আমরা শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে এগুলো ভেঙে ফেলেছি। বাস্তবে কতটা ইমপ্লিমেন্ট করতে পেরেছি বলতে পারব না। তুই যদি সেই মনের গহীন কোনে অন্ধকারের কথা বলিস তাহলে মেনে নিচ্ছি।

সেই রাতে আর বিশেষ কথা হলো না। ঘুমিয়ে পরলাম।

পরের দিন ফিরে আসব। বিনয়দা, বৌদি ধরলো আজকের দিনটা অন্ততঃ থেকে যাও।

থেকে গেলাম।

সারাদিন মাসির সঙ্গে গল্প করি। ফাঁকে ফাঁকে ফোনা-ফুনিতে নিজের কাজ সারি। দুপুরে খেতে বসে মাসি বললো, জানিস আমার মনে হয় তোর ছোটোমা একসময় এখানে থাকতো।

আমি মাসির মুখের দিকে তাকালাম।

তাহলে আমার ধারণা ঠিক আমি একসময় এখানে এসেছিলাম। কিরকম বলো?

আমাদের এই তল্লাটে ওই মনসা মন্দিরটা দেখেছিস?

দেখেছি।

ওর যিনি পুরহিত ঈশ্বর চক্রবর্তী ওঁর বাড়িতে ভাড়া থাকতেন।

তাই!

হ্যাঁ।

আমি মাঝে মাঝে যখন ভাগলপুর থেকে আমার শ্বশুরের ভিটেতে আসতাম। তখন লোকের মুখে শুনতাম ওই বাড়িতে একজন সাংবাদিক থাকেন। তিনি তোদের কাগজে কাজ করতেন।

আমি মাসির মুখের দিকে তাকালাম।

সে বহুকাল আগের কথা।

চলো বিকেলের দিকে ঘুরতে ঘুরতে একবার ওনার সঙ্গে আলাপ করি। তবে আমার ব্যাপারটা গোপন রাখবে।

ঠিক আছে।

বিকেলের দিকে আমি মাসীমা ঘুরতে ঘুরতে গেলাম। ঈশ্বরবাবুর সঙ্গে দেখা হলো। ওনার ছেলের সঙ্গে দেখা হলো। ওনার ছেলে সীতারামদা। নিঃসন্তান দম্পতি। বিকাশের বয়স তখন গোটা চোদ্দ পনেরো।

আলাপ পরিচয় হওয়ার পর ছোটোমার প্রসঙ্গ এলো। বুড়ো বলে আমি কন্যদান করেছি। সীতারাম বিয়ে দিয়েছে। আমাকে মানিঅর্ডার করে এখনও মাসোহারা পাঠায়। মল্লিক মাঝে মাঝে আসে। ছোটোর এখন নাতি-পুতি নিয়ে ভরা সংসার। ওর পালিত ছেলেটা এ্যাক্সিডেন্টে মরে গেল। বেশ নামকরা সাংবাদিক ছিল। মাতৃমন্দিরে এসে কতো কান্নাকাটি করলো।

বুড়োর মুখে সব শুনলাম।

ফিরে এলাম।

সে রাতটুকু ছোটোমা, বড়োমার ইতিহাস শুনেই মাসীমা কাটিয়ে দিল।

পরদিন আমি মনাকে ডেকে পাঠালাম। মাসির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম। মনাকে বললাম মাসির সমস্ত দায়িত্ব তোকে দিয়ে গেলাম। কোনও অসুবিধে হলে তুই সামলাবি।

মাসি মনাকে দেখে অবাক। ওই এলাকায় মনার বেশ নাম ডাক। সবাই কম বেশি ভয় পায়। সেই মনা আমার সামনে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে। আমি তখন অতটা বুঝিনি। মনাকে আমার স্বভাব সিদ্ধ ভাষায় বলে যাচ্ছি।

মথায় রাখবি ছোটোমা, বড়োমা আমার যেমন মা। মাসিও আজ থেকে আমার মা। তার যেন এতটুকু অযত্ন না হয়। রেগুলার একবার করে এসে খোঁজ খবর নিয়ে যাবি।

তারপর সীতারামদা, ঈশ্বরজ্যেঠুর কথা বললাম।

বললাম মন্দির যেমন আছে তেমন থাকবে। মন্দিরের যাতে উন্নতি হয় তার টাকা জোগাড় করবি। না হলে আমার এ্যাকাউন্ট থেকে তুলে নিবি। আমি রাতের ফ্লাইটে দিল্লী হয়ে দুবাই ফিরব। ঠিক সময়ে চলে আসবি।

মনা মথা দুলিয়ে চলে গেল।

মনা চলে যেতেই মাসি চেপে ধরলো। তুই একে চিনলি কি করে বল।

কেন বলো!

ওরে এ তো এই এলাকার দাদা। এই ভেঁড়ি অঞ্চলটা ও দেখা শুন করে।

আমি হাসলাম।

তোমাদের কিছু আছে নাকি?

ওরাই সব জবর দখল করে রেখেছে। সেই নিয়ে কত কেশ-কামারি চলছে।

আজ থেকে ও তোমাদের পরিবারের সঙ্গে দাদাগিরি করবে না। সমস্যা যদি খুব জটিল হয় আমাকে জানাবে। না হলে নিজেই সমস্যার সমাধান করবে। তোমাকে এ নিয়ে আর ভাবতে হবে না।

বিকেলের দিকে ঠিক সময়ে মনা এলো। আমি বেরলাম। মাসি আমার হাতটা ধরে কেঁদে ফেললো। বৌদিরও চোখে জল। একটু খারাপ লাগলেও কিছু বলিনি।

ফিরে এলাম। নিজের কাজ।

মাসির সঙ্গে চিঠিতে আর ফোনে কথা বার্তা হয়। কতবার বলেছে একবার আয়। কলকাতায় এসেছি মাসির কাছে যাইনি।

মাসির শরীর খারপ হয়েছে। মনা সমস্ত ব্যবস্থা করেছে। ডাক্তারদাদাকে দেখিয়েছে।

ঝিমলিকে মাসির দায়িত্ব দিলাম।

তারপর বিনয়দাদের বললাম তোমরা দিল্লীতে চলে এসো। ওরা সকলে দিল্লী এলো। ওখানে মাসিকে দেখলাম। ভীষণ খারাপ লাগল। আমার যতটুকু করার করলাম।

ওরা ফিরে এলো। আমি আবার দুবাই। তখন দিল্লী-দুবাই-লণ্ডন এই করে বেরাচ্ছি।

অনিকারা সব বড়ো হয়েছে। তাদের মান অভিমান সামাল দিই। সে হরেক সমস্যা।

মাঝে মাসি জানাল ঈশ্বরবাবু গত হলো। সীতারাম বাড়ি বেচে দিতে চাইছে। আমি বললাম, মনার হাতে টাকা পাঠাচ্ছি আমার নামে কিনে দাও। শেষ বয়সে একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই করি।

আমার কথা শুনে মাসির সে কি হাসি।

যাই হোক কয়েক রাত্রিরের জন্য এসে রেজিস্ট্রি করে গেলাম।

মাসির সেই এক কথা এবার ফিরে আয়। বললাম খুব শীঘ্রি ফিরে আসছি।

তারপর ফিরে এলাম। দুর্ঘটনা ঘটল। পরে শুনেছিলাম বিনয়দা তিন চারদিন নার্সিংহোমে এসেছিল। তবে মনা রেগুলার আপডেট দিয়ে আসতো মাসিকে। তোরা দাদাকে নিয়ে লণ্ডনে গেলি, প্রায়ই যেতাম মাসির কাছে। রতনকে দাঁড় করিয়ে যেতাম বিএলএলআরও অফিসের সামনে।

তনু-মিত্রার মুখট চক চক করছে।

মাসি এখনও জানে না তোর আসল পরিচয়?

না।

কেন মাসির কাছে গেছিলি সেটাও উহ্য থেকে গেছে?

মাসির চিঠিটা পাওয়ার পর নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হয়েছিল।

শুনেছি বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট করলে এই রোগটা সেরে যায়।

সবারটা টেস্ট করেছি কারুর সঙ্গে মেলেনি।

তোরটা।

এখনো টেস্ট করিনি।

কেন?

আফতাবভাইরা আসছে। ওরা চলে গেল একবার দিল্লী যেতাম কাজটা সারতে।

লুকিয়ে করতিস, গোপন জিনিষ গোপনে রাখা ভালো।

মিত্রার দিকে তাকিয়ে হাসলাম।

জীবনটা আর কতো গোপন করবি?

আমি মিত্রার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম।

মিত্রা আমার কপালে ঠোঁট ছোঁয়াল।

তনু আমার বুকে মথা রেখেছে।

তারপর নিজেই আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।

এবার একটু ঘুমো। তোর চোখ মুখের অবস্থা ভাল লাগছে না।

দু-জনকে নিবিড় ভাবে জড়িয়ে ধরলাম।

আস্তে করে বললাম।

কাউকে বলিস না। মাসি ভীষণ লজ্জা পেয়ে যাবে।

মিত্রা, তনু কেমনভাবে যেন আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল।

সারাটা শরীরে ক্লান্তি। সত্যি চোখদুটো ভীষণ জ্বালা জ্বালা করছে। ওদের শরীরের নরম উষ্ণতা আমাকে ঘুম পারিয়ে দিল। আমি ঘুমিয়ে পরলাম।

একটা বিচ্ছিরি স্বপ্নে ঘুমটা ভেঙে গেল। ধরফর করে বিছানায় উঠে বসলাম।

আবার তাড়াহুড়ো করে।

কেউ যেন আমাকে ধমকালো।

তখনো আমার ঘোর কাটেনি। বুকের ভেতরটা কেমন ধড়ফড় ধড়ফড় করছে।

সম্বিত ফিরতে দেখলাম, ডাক্তারদাদা আমার মাথার শিয়রে বসে। পায়ের কাছে আন্টি। সোফায় নম্রতা আর নয়না।

তখনও ঘোর কাটেনি।

কি স্বপ্ন দেখছিলি? কেউ তোর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি।

ডাক্তারদার গলায় স্নেহের ধমক।

আমি ডাক্তারদার মুখের দিকে তাকালাম।

চোখে মুখে হাজার প্রশ্ন।

ভাবছিস সপরিবারে এখানে কি করতে তোকে জেগে বসে আছি?

মাথা নীচু করে হেসে ফেললাম।

আমি একা অন্যায় করি না তুইও করিস। এবার তোর শাস্তিটা আমি দেব।

ভ্যাবলার মতো ডাক্তারদার মুখের দিকে তাকালাম।

ওইভাবে তাকিয়ে থাকার কিছু নেই।

তাহলে কি মিত্রা তনু!

নম্রতা, যা দিদাদের ডাক। বল বাবু উঠেছেন।

ডাক্তারদাদা আমার মুখের দিকে তাকাল।

তারা তো সব তোর মতিগতিতে ভয়ে মরে।

নম্রতা মুচকি হেসে ঘরের বাইরে চলে গেল।

কেন, আমি কি অন্যায় করেছি?

যথেষ্ট অন্যায় করেছিস। ভেবেছিস কি নিজেকে।

ডাক্তারদার কণ্ঠ থেকে আবার স্নেহের ধমক চুঁইয়ে চুঁইয়ে পরছে।

মিত্রা, তনু কোথায়?

ও ঘরে।

তোমরা এত সকালে?

এখন সকাল নয়। বেলা সোয়া এগারটা।

দেখলাম আন্টি মুচকি মুচকি হাসছে। নয়না মাথা নীচু করে মুখে আঁচল চাপা দিয়েছে।

বড়োমারা সব ও বাড়ি থেক চলে এসেছে?

তোর আর কি কি জানার আছে একবারে প্রশ্ন করে নে। আমি প্রত্যেকটা প্রশ্নের উত্তর এক কথায় সারবো। শেষে যে প্রশ্নটা করবি সেটাও কি বলে দেব?

তুমি এই সাত সকালে এত রেগে যাচ্ছ কেন?

তোকে বলেছি না এখন সোয়া এগারটা বাজে।

ডাক্তারদার কথায় আমি মুখ নীচু করে হাসছি।

এসো। আন্টি খীন কণ্ঠে বলে উঠলো।

দরজার দিকে চোখ পরতেই অবাক হয়ে গেলাম। মাসীমনি হুইল চেয়ারে বসে। বিধানদা ঠেলতে ঠেলতে ভেতরে নিয়ে আসছে। পেছনে সবাই।

চলবে —————————–



from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/cDXmBxb
via BanglaChoti

Comments