কাজলদিঘী (১৫৪ নং কিস্তি)

❝কাজলদীঘি❞

BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

১৫৪ নং কিস্তি
—————————–

পিকু চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে আমার পায়ের কাছে বসে পড়লো।

আমি আর কোনওদিন করবো না মশাই।

পিকু ভেউ ভেউ করে কাঁদছে।

বরুণদা মাথা নিচু করে রয়েছে।

মিত্রা মনেহয় চোখে রুমাল দিল।

তোমাকে অনি ব্যানার্জী উইল করে ফাইভ পার্সেন্ট শেয়ার দিয়েছিল। তার ছেলে মেয়েকেও সেই একই উইলে দশ পার্সেন্ট করে শেয়ারের কথা বলা হয়েছিল। বাকি অনি ব্যানার্জীর আদার প্রপার্টি তিনজনকে সমানভাগে ভাগ করে দেওয়ার কথা উল্লেখ আছে। এজপার মার্কেট ভ্যালু।

ভাল করে কোনও ল-ইয়ারকে দিয়ে পড়িয়ে নিও। ওখানে কয়েকটা হিডিন ক্লজ আছে। বেগরবাই করলে, তোমরা তিনজনেই রাস্তার ভিখিরি হয়ে যাবে। সম্পত্তির মালিকানা চলে যাবে অনি ব্যানার্জীর বিবাহিত স্ত্রীর কাছে।

একটু থামলাম।

বিতান।

বিতান তখনো টেবিলের দিকে মুখ নিচু করে বসে। মুখ আর তোলে না।

টিয়াকে আগামী সপ্তাহের এই দিনে অফিসে দেখতে চাই। কিভাবে সেটা তুমি ব্যবস্থা করবে।

আবার একটু চুপ থাকলাম।

আমার কথার নড়ন-চরন হলে টিয়ার বর্তমান যা হাল, তোমার হাল তার থেকেও খারাপ হবে।

আবার কিছুক্ষণ চুপ থাকলাম।

আমি সাপের পাঁচ-পা এখনও দেখিনি। ইচ্ছে থাকলো তোমার চোখ দিয়ে আমি সাপের পাঁচ-পা দেখবো।

আবার একটু চুপ করে থাকলাম।

দুজনেই এখন এ ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে পার। আমার অনেক কাজ আছে।

বেশ কিছুক্ষণ দু-জনে বসে থাকার পর। ধীর পায়ে দু-জনে বেরিয়ে গেল।

ঘরের দরজাটা বন্ধ হতেই, মিত্রা উঠে দাঁড়িয়েছে।

সর সর তনু।

কোথায় যাবে!

বাথরুমে।

তনু হাসছে।

বাথরুমে ঢোকার আগে মুখ বারিয়ে বললো।       

মিলি তুই আগে শিগগির ছিদামকে ফোন কর চা দিয়ে যাবার জন্য। মাথাটা ঝিম ঝিম করছে।

তুমি কিগো মিত্রাদি—, রেশটা একটু কাটুক।

ওরে এগুলো চাটনি। তোকে বহুদিন আগে বলেছিলাম। যা করছে করতে দে। একটা ধাক্কাদেবে দেখবি সবাই চিতপটাং। এরকম কত দেখলাম।

তনু হাসছে।

তুই নিশ্চই ভয়ে সিঁটিয়ে গেছিলি—মিত্রা তাকাল তনুর দিকে।

তোমার ভয় করছিল না—

দূর। যা ভয় আর টেনশন ওই মাস ছয়েক পেয়েছিলাম তারপর থেকে ভয় আর টেনশন কাকে বলে সব ভুলে গেছি। মনেই পড়ে না।

তাহলে বাথরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আমি বললাম।

মিত্রা আমার দিকে তাকাল। বাথরুমের দরজা বন্ধ করলো।

আমি এক মনে ফাইল দেখে চলেছি। কারুর সঙ্গে কোনও কথা বলছি না।

মিত্রা বাথরুম থেকে বেরলো।

বুবুন।

মিত্রার দিকে তাকালাম।

পিকুর কেশটা বুঝলাম, বিতানের কেশটা কি?

বড়োমা তোকে কিছু বলে নি! আমি স্বাভাবিক।

না!

তাহলে হয়তো রাতে বলবে।

কি হয়েছে একটু শুনি।

আবিদের রিসেপশনের দিন রাতে মাল খেয়ে বাওয়াল করেছে। শেষ পর্যন্ত টিয়ার গায়ে হাত তুলেছে। মেয়েটা আজ বড়োমাকে কাঁদতে কাঁদতে ফোন করে সব কথা বলেছে। এমনকি মামা-মামী পর্যন্ত ওর ওপর তিতি-বিরক্ত হয়ে গেছে।

এ্যাঁ।

ছিদাম চা নিয়ে ঢুকলো। পেছন পেছন নেপলা।

ছিদাম হরিদার ছেলেটাকে বলো যে প্যাকেটটা আছে ওটা নেপলাকে দিতে। মিত্রা বললো।

ছিদাম মিত্রার কথা মতো কাজ করলো।

নেপলা খেতে খেতে আমার দিকে তাকিয় হাসছে। আমি চায়ে চুমুক দিয়েছি।

হাসছিস কেন?

পিকু, বিতান গাড়ি নিয়ে দৌড়লো। চোখ মুখ ফোলা ফোলা। আমি গুড আফটার নুন বললাম, পাত্তাই দিল না।

পেনিসিলিন চার্জ করলাম।

হাই ডোজ না লো ডোজ—

হাই—

তাহলে কাজ হবে—

মিত্রা, তনু দু-জনেই ফুলে ফুলে হাসছে।

হাসবে না তনুদিদি আমাদের মতো ছেলে অনিদার দাওআইয়ে মানুষ হয়ে গেল, ওরা তো অনিদার কাছে শিশু। নাক টিপলে এখনও দুধ বেড়োয়।

ফাইলগুলো দেখে একটু বেরবো। নেপলার দিকে তাকালাম।

কোথায় যাবে?

কাজ আছে।

বরুণদার তখনও মনে হয় ঘোর কাটে নি। আমি তাকালাম।

কি হলো তুমি ওইভাবে বসে আছো কেন?

ভাবছি।

কি ভাবছো?

প্রথম থেকে তোমার কথাগুলো পর পর সাজিয়ে একটা ছবি আঁকার চেষ্টা করছি।

হাসলাম।

সত্যি অনি, বাবা হয়ে বিগত তিন বছর আমি যা পারিনি। তুমি আধাঘণ্টায় তা সলভ করে দিলে। এখন ধরতে পারছি তুমি কেন তখন আমার ফোন থেকে ইসিকে ফোন করলে।

ও সব প্রি-প্ল্যান্ড বরুণদা। ঘুঁটি সব সাজানো থাকে। নেপলা বললো।

তোমরা ওর সঙ্গে উঠতে বসতে আছো, তাই তোমরা যতোটা তাড়াতাড়ি ধরতে পার, আমি পারি না। আমার এখনও সব কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে।

আসার সময় মিউজিয়ামের ওখানে একটা কালীঠাকুরকে হেঁটে যেতে দেখলাম।

কালীঠাকুর! মিত্রা বলে উঠলো।

মিলিরা হাসছে।

হ্যাঁগো, কালীঠাকুর সেজে পয়সা নেয় না।

তাই বলো, বহুরূপী। টিনা বললো।

হঠাৎ বলে গাড়ি থামা নেপলা।

থামালাম।

যা ওকে ডেকে নিয়ে আয়।

ধরে নিয়ে এলাম।

পাঁচশো টাকা হাতে গুঁজে বলে গাড়িতে ওঠ। মেয়েটা প্রথমে ভরকে গেছিল। তারপর সব বলার পর চার নম্বর ব্রিজের তলায় ওদের ডেরায় গেলাম। বড়োজোড় ঘণ্টা খানেক ছিলাম। অনেক কিছু জানলাম, শিখলাম। পরে হয়তো কখনও কাজে লাগবে।

তুমি এইটাই এতক্ষণ বসে বসে লিখলে! তনু বললো।

হ্যাঁ। পাঁচশো খরচ করে যদি দশ হাজার আসে ক্ষতি কি?

মিত্রার ফোনটা বেজে উঠলো। আমার দিকে তাকালো। দিদিভাই। ভয়েজ অন করলো।

হ্যালো। হ্যালো।

বল। কি হয়েছে।

ও কোথায় রে?

কে, বরুণদা না বুবুন?

তোর বরুণদা।

এই তো আমার ঘরে বসে।

ওর ফোনটা শুধু বিজি বিজি বলছে। জিজ্ঞাসা করতো, ছেলের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে না কি?

তোর কথা শুনতে পাচ্ছে। কেন কি হয়েছে?

পিকু হঠাৎ এই অবেলায় বাড়িতে ফিরে মায়র ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলো। তারপর শুধু কান্নার আওয়াজ। কিছুতেই দরজা খুলছে না। আমি তো ভয়ে মরছি।

বুবুন হাইডোজের ওষুধ দিয়েছে।

তাহলে ঠিক আছে।

তুই কিছু ভাবিস না।

ভাববো কিরে আমি হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। তোর বরুণদাও ফেডআপ। কতো আর বলি তোদের। মা শুধু বলতো অনিকে একবার বল। আমি আর পারছি না। অনি ওই শেয়ার ট্রান্সফার করার পর ও যেন কেউকেটা বনে গেছে।

বুবুন আজ বেলুনে পিন মেরে দিয়ছে।

তাই বলি এতো কান্না এলো কোথা থেকে।

এখানে বুবুনের পা ধরে কিছুক্ষণ কাঁদছিল। ঘর থেকে বের করে দিয়েছে।

বিতানটাকে দেয় নি—

তুই জানিস!

মা বলছিল। বড়োমা মাকে বলেছে।

দু-টোকেই কাপর চোপড় খুলে দিয়েছে।

ও তখন ছিল—

বরুণদার সামনেই ঝাড় হয়েছে।

যাক বাবা, শান্তি।

তোর বরুণদাকে দে।

তোর কথা শুনছে তো।

কি-গো কি বুঝছো।

আমার এখনও ঘোর কাটেনি ইসি। আমার এতটা বয়স হলো, এরকম মধুর ঝাড় কারুর কাছে কোনওদিন খাই নি। ভাবছিলাম ও হয়তো ক্রশ করবে। দেখলাম তার আগেই ওর প্রশ্নগুলো বলে দিল, আভাসে ইঙ্গিতে তার উত্তর, এতো সুন্দর ভাবে উত্তরটা দিল, তোমাকে গিয়ে সব বলবো।

অনিকে একটা থ্যাঙ্কস দাও।

থ্যাঙ্কস দিয়ে ওকে ছোটো করবো না।

ঠিক আছে এখন রাখি।

আচ্ছা।

অদিতির শেষ ফাইলটা দেখে, মিত্রার মুখের দিকে তাকালাম।

কখন ফিরবি—

কোথাও নিয়ে যাবি?

তনু হাসলো।

টিনা তোমার ফাইলগুলো এখন আর দেখতে ভালো লাগছে না। পরে একসময় দেখে দেব।

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম।

সত্যি সত্যি তুই বেরবি!

হ্যাঁ।

বরুণদা আগামী ছ-মাস বেশ ব্যস্ত থাকবো। তোমাদের ঠিক মতো সময় দিতে পারবো না। নিজেদের একটু সামলে-শুমলে নেবে।

বরুণদা হাসছে।

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম, আসিরে।

সময়মতো বাড়ি চলে আসবি।

ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।

ইকবালভাইয়ের কাছে যখন পৌঁছলাম তখন সাড়ে সাতটা বেজে গেছে।

ট্যাক্সির টাকা মেটাতে না মেটাতেই নেপলা সামনে এসে দাঁড়ালো।

মুখটা গম্ভীর।

কিরে আমার ওপর খুব রেগে আছিস মনে হচ্ছে।

না।

একটা কাজে আটকে পড়েছিলাম একটু দেরি হয়ে গেল। ইকবালভাই আছে?

এখুনি বেরলো।

তুই বলিস নি আমি আসবো!

জরুরি দরকার ছিল তাই। তুমি আমার গাড়িতে ওঠো। এখন আর ভেতরে যেতে হবে না।

কেন!

ওঠো-না, পরে বলছি।

নেপলর দিকে তকালাম।

কিছু হয়েছে?

নেপলা কোনও কথা বললো না, গাড়িতে উঠে বসলাম। ও স্টার্ট দিয়ে চালাতে শুরু করলো।

দু-জনেরি চোখ রাস্তায়।

কিরে বললি না।

বলছি। তোমার ফোন বন্ধ?

পকেট থেকে বার করলাম। সত্যি বন্ধ হয়ে পড়ে আছে।

ব্যাটারি নেই। নেপলার দিকে তাকালাম।

কতক্ষণ—

ছটা দশ-পনেরো নাগাদ আমি লাস্ট কথা বলেছি।

তারপর তোমাকে বহুবার ফোন করেছি। স্যুইচ অফ।

সকালে চার্জ দিয়ে বেরলাম। এরই মধ্যে শেষ হয়ে গেল! বাড়িতে গিয়ে ব্যাটারিটা একটু দেখিস।

ঠিক মতো চার্জ হয় নি দেখো।

নেপলা গাড়িটা বেশ জোরে চালাচ্ছে। মনে হচ্ছে ভীষণ তাড়া আছে।

আস্তে চালা।

নেপলা আমার দিকে তাকাল।

বললি না—

ডাক্তারদাদার শরীরটা একটু খারাপ হয়েছে।

ডাক্তারদাদার!

হ্যাঁ।

ডাক্তারদা, দামিনীমাসির ওখানে গেছিল না?

ওখানেই শরীরটা খারাপ হয়েছে। কনিষ্কদারা বাড়িতে নিয়ে এসেছে।

কি হয়েছিল?

জানি না। বড়োমা সমানে আমাকে ফোন করে যাচ্ছে। তোমার ফোন বন্ধ।

নেপলার ফোনটা বেজে উঠলো। নেপলা আমার দিকে তাকাল…। বড়োমা।

ধর।

হ্যাঁ বড়োমা….হ্যাঁ হ্যাঁ অনিদাকে নিয়েই যাচ্ছি….আর পাঁচ মিনিট।

নেপলা মোবাইলটা পকেটে রাখলো। স্টিয়ারিংয়ে হাত, চোখ রাস্তায়।

ডাক্তারদার শরীর কি খুব খারাপ?

কি করে বলবো। আমাকে আধাঘণ্টা আগে ফোন করে তোমার কথা জানতে চাইল। আমি বললাম অনিদাকে পাঁচটা নাগাদ বাগবাজারে ছেড়েছি। কোথায় যাবে কিছু বলে নি। আমাকে বলেছে, সাতটা নাগাদ ইকবালভাইয়ের কাছে আসবে।

ফোনটা অনেকবার অন করার চেষ্টা করলাম। কিছুতেই হলো না।

বাড়িতে পৌঁছেই দেখলাম বাগানে গাড়ির ভিড়। সবাই প্রায় চলে এসেছে। গাড়ি থেকে নেমে তাড়াতাড়ি ভেতরে এলাম। দেখলাম আমার ঘরেই সকলে ভিড় করেছে।

ঘরে ঢুকেই দেখলাম কনিষ্ক, নীরু, বটা, সাত্যকি, অনিকেত রয়েছে।

ডাক্তারদা আমার খাটে শুয়ে। মাথার শিয়রে বড়োমা, ছোটোমা, জ্যেঠিমনি। পায়ের কাছে মিত্রা, তনু, বৌদি। খাটের চারপাশে সবাই ভিড়ে করে রয়েছে। সোফায় দাদা, অনিমেষদা, বিধানদা। সবারই মুখটা কেমন শুকনো শুকনো। এক কোনে ইসলামভাই, ইকবালভাই দাঁড়িয়ে।

সবার চোখে মুখে উৎকণ্ঠা।

ঘরে ঢুকতেই ওরা আমার দিকে সবাই তাকিয়ে আছে।

আমি কনিষ্কর দিকে তাকালাম।

কনিষ্করা এগিয়ে এলো। চাপা গলায় বললো।

এখন ঠিক আছে, প্রোসারটা হঠাৎ হাই হয়ে গেছিল।

তোদের ডাক্তারি শাস্ত্র অনুযায়ী যা যা করার করেছিস।

করেছি।

ঘরে নিয়ে এলি! নার্সিংহোমে নিয়ে গেলি না কেন?

স্যার বললো, যাবে না।

সিরিয়াস কিছু নয় তো?

ইসিজি করেছি। সেরকম কিছু পাইনি।

হঠাৎ এরকম হলো।

মনে হচ্ছে ভেতর ভেতর একটা চাপা টেনশন থেকে হয়েছে।

কথা বলতে বলতেই ডাক্তারদার পাশে এসে বসলাম। চোখ বন্ধ করে রয়েছে।

আমি আস্তে করে কপালে হাত দিলাম। আমার দিকে তাকাল।

হেসে ফেললাম।

ডাক্তারদা আমার হাতটা ধরলো।

আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।

এই হাসির মধ্যেই অনেক কথা লুকিয়ে আছে।

আমি মাথা দোলাচ্ছি আর মিটি মিটি হাসছি।

তোমার শরীর খারাপ হওয়ার কথা নয়। হলো কেন?

ডাক্তারদা সমানে হাসছে।

অনি অন্যায় করেছে, তাই শরীরটা খারাপ হলো?

ডাক্তারদা কোনও কথার উত্তর দেয় না। শুধু হাসে।

অনি একটু বেশি স্বপ্ন দেখে ফেলেছে।

ডাক্তারদা হেসে চলেছে।

অনি কি খুব অন্যায় করেছে?

আমার কথা শুনে সবাই অবাক। সবার চোখ যেন আমাকে গিলে খাচ্ছে।

এখন শরীর কেমন বোধ করছো?

ডাক্তারদা মাথা দোলাল, আস্তে করে বললো, ভালো।

নীরু এখন প্রেসার কেমন আছে?

নর্মালের থেকে একটু বেশি। যা ছিল তার থেকে অনেকটা ভালো।

কখন হয়েছে?

বলতে পারবো না। মাসি যখন ফোন করে তখন সাড়ে পাঁচটা। স্যার এনজিওতে ছিলেন।

তোরা কোথায় ছিলি?

কনিষ্ক স্যারের সঙ্গে ছিল। আমরা নার্সিংহোমে।

ডাক্তারদার দিকে তাকিয়ে আবার হাসলাম।

আমার হাতটা শক্ত করে ধরলো। হাসছে।

শরীর খারাপের পেছনের ইতিহাসটা বান্ধবীকে বলি?

ডাক্তারদাদা মাথা দুলিয়ে না বলছে।

বড়োমা যেন আমাকে পারলে গিলে খেয়ে নেয়।

এখন তো বয়সটা আঠাশ-উনতিরিশ নয়। এতো টেনশন কিসের?

ডাক্তারদাদা কথার কোনও উত্তর দেয় না শুধু হাসে।

তোমার ফোনটা কোথায়?

আমার কাছে। মিত্রা এগিয়ে এলো।

দেখি।

না দেখবি না। ডাক্তারদা বললো।

তাহলে আমি টাইমটা বলে দিতে পারবো তোমার শরীরটা ঠিক কখন খারাপ হলো।

ডাক্তারদাদা মাথা দোলায়। না।

দেখাটাও অন্যায়?

আমি তোর ফোন দেখি—

ঠিক আছে দেখবো না।

কি হয়েছেরে অনি—তুই আমাকে বলতো। বড়োমা তেড়েফুঁড়ে উঠলো।

ডাক্তারদাদা বড়োমার দিকে তাকাল। আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।

এতক্ষণ মরার মতো চোখ বন্ধ করে পড়েছিলে, মুখ দিয়ে সারা-শব্দ বেরচ্ছিল না। সকলে ভয়ে মরছিলাম। অনি আসতেই হাসি বেরচ্ছে। বেশ তো টুকটুক করে কথা বলছো।

তোমরা বুঝবে না।

বয়েস তো হয়েছে, বোঝার আর বাকি কি রাখছো শুনি?

আমি হাসছি।

ঘরের চারিদিকে একবার চাইলাম, সবার চোখে মুখের রংয়ে পরিবর্তন হয়েছে।

অনি বুঝি তোমার অক্সিজেন সিলিন্ডার—বড়োমা ক্যাট ক্যাট করছে।

মিত্রা, ডাক্তারদাদার ফোনটা আমার হাতে দিতে চাইলো।

ডাক্তারদা মিত্রার দিকে তাকিয়ে মাথা দুলিয়ে না না করছে।

তুমি ডাক্তার তোমার এতো টেনশন হওয়া উচিত নয়? আমি ডাক্তারদাদার দিকে তাকিয়ে।

তোর থাকতে পারে, আমার থাকতে পারে না?

তোমার ভূ-ভারতে নিজের বলতে কেউ নেই।

কেন, তুই আছিস। বান্ধবী বললো শুনলি না। তুই আমার অক্সিজেন।

এখন তাই তো মনে হচ্ছে। বড়োমা যেন ডাক্তারদাদার সঙ্গে ঝগড়া শুরু করেছে।

আমি হাসছি।

আমার জন্য তোমার টেনশন হওয়া উচিত নয়। আমি এমন কোনও কাজ করিনি তোমার টেনশন হতে পারে।

করেছিস বলেই শরীরটা গণ্ডগোল করলো।

দেখো, আজ অনি কি ভাবে এই জায়গায় এসে পৌঁচেছে তোমার থেকে ভালো কেউ জানে না।

ডাক্তারদাদা হাসছে।

মিত্রা না থাকলে আজ অনি কিছুতেই অনি হতে পারতো না। এখন অনির অগাধ ক্ষমতা, তাছাড়া অনির পাশে অনিমেষদা আছে, বিধানদা আছে, সবতো তুমি জানো, নতুন করে বলার কিছু নেই। ওইটুকু বাধাকে অনি বাধা বলে মনে করে না।

তুই থাম।

কেন থামবে? গুণের কথা প্রকাশ পাচ্ছে। বড়োমা খেঁকিয়ে উঠলো।

ছোটোমা, জ্যেঠিমনি, বৌদি মুখ ঘুরিয়ে হাসছে।

অনিমেষদা সোফা থেকে উঠে এসে আমার পিঠে হাত রেখেছে।

আমি অনিমেষদার দিকে তাকালাম।

চোখে প্রচ্ছন্ন সহানুভূতি, ব্যাপারটা কি বল। আমিও চোখের ইশারা করলাম পরে বলছি।

বড়ো, ডাক্তার কি বুড়ো বয়সে প্রেমে পড়লো। দাদা বলে উঠলো।

দাদার কথায় ঘর ময় সকলে হেসে কুটি কুটি খায়।

ডাক্তারদাদা দাদার দিকে তাকাল।

বুঝলে সামন্ত এ ভীষণ বিষম রোগ।

থামো। একবারে কথা বলবে না। বড়োমা খিঁচিয়ে উঠলো।

বড়ো, অনি সেরকমই আভাস ইঙ্গিত দিচ্ছে।

কি হয়েছেরে অনি—বড়োমা বলে উঠলো।

ডাক্তারদাদার দিকে তাকালাম। দু-হাতে শক্ত করে আমার হাত ধরেছে। মুখে করুণ আর্তি।

হাত চেপে ধরলে হবে। তোমার যেমন অধিকার আছে, আমারও আছে। বড়োমা সমানে তরপে যাচ্ছে।

আমি মাথা দোলাচ্ছি।

কাউকে বলবো না। আমার কথা মতো চলতে হবে।

চলছি তো।

দেখছিস ছোটো দেখছিস, কি সাংঘাতিক!

ছোটোমা মুখ টিপে হাসছে।

এতক্ষণ ডেকে ডেকে গলা দিয়ে স্বর বেরচ্ছিল না।

নেপলা আমার ফোনটা নিয়ে ঘরে ঢুকলো, রিং বাজছে।

কে ফোন করেছে?

নামটা চিনতে পারছি না।

আমি নেপলার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নামটা দেখলাম। হাসলাম।

কে ফোন করেছে? বড়োমা বললো।

ডাক্তারদার দিকে ফোনটা ধরলাম। ডাক্তারদা হাসছে।

বড়োমাকে দেখাই?

মাথা দোলাচ্ছে, না।

ফোনটা রিং হয়ে হয়ে কেটে গেল।

আমি উঠে দাঁড়ালাম।

ডাক্তারদা হাতটা টেনে ধরেছে।

একটু কথা বলে আসি।

তুই কিছু বলবি না।

অন্যায় কার?

আমার।

আমি হাসছি।

অনি আমাকে বলতো কি হয়েছে? তারপর আমি দেখছি। বড়োমা এবার উঠে দাঁড়িয়েছে।

তুই ও ঘরে গিয়ে কথা বল।

চল তোর সঙ্গে আমি যাব। বড়োমা আমার হাত ধরেছে।

ঘরের সকলে কেউ আর গম্ভীর নেই।

যাচ্ছি।

ডাক্তারদাদার দিকে তাকালাম।

একটু চা খাবে।

মাথা দোলাল। খাবে।

সুতপা শুনতে পাচ্ছ ডাক্তারের গলা। এতক্ষণ জল যেচে যেচে এক ঢোক খাওয়াতে পেরেছো।

বড়োমাকে থামানো যাচ্ছে না।

নীরুদের দিকে তাকালাম। ওরা মুচকি মুচকি হাসছে।

কিরে, তোদের স্যারকে চা দেওয়া যাবে। বৌদি বলে উঠলো।

কনিষ্ক হাসছে।

স্যার খেতে চাইলে দেওয়া যেতে পারে।

এবার প্রেসারটা দেখ আরও কমে গেছে। আমি বললাম।

তুই কি প্রেসারের ওষুধ। মিত্রা বলে উঠলো।

আমি ওর দিকে তাকিয়ে হাসলাম।

সবার চোখে মুখের অভিব্যক্তি, কিছু একটা ঘটনা ঘটেছে, ব্যাপারটা বুঝতে পারছি, ঠিক ধরতে পারছি না।

বড়োমা, ডাক্তারদার দিকে কট কট করে তাকিয়ে।

অনিমেষদা, ডাক্তারদার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।

আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।

বিধানদা, দাদা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

তনু, মিত্রা আমার পেছন পেছন বেরিয়ে এলো। ইসিও দেখলাম দৌড়চ্ছে।

তোরা পেছন পেছন কোথায় আসছিস!

আমরা শুনবো।

ভাগ এখান থেকে।

ধমকাচ্ছিস কেন। মিত্রা বলে উঠলো।

বিরক্ত করিস না।

ওরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে পড়লো।

ঘরের ভেতর খুব জোড় গুলতানি চলছে। বড়োমা চেঁচাচ্ছে। আমি বাগানে নামলাম।

অনি। অনিমেষদা ডাকলো।

আমি দাঁড়িয়ে পড়েছি।

অনিমেষদা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।

এদিকে আয়।

ফিরে এলাম।

বলো।

দেখলাম ডাক্তারদাদা বিছানায় উঠে বসেছে। নীরু প্রেসার মাপছে।

কিরে! আবার কি হলো?

আমি পাশে গিয়ে বসলাম। ডাক্তারদাদা আমার কাঁধে হাত রাখলো।

তুই প্রেসারটা মাপতে বললি।

বেড়ে গেছে নাকি!

ডাক্তারদাদা হাসছে।

নীরু হাতের ফেটটিটা খুলতে খুলতে বললো, না ঠিক আছে।

তুই আমাকে ও ঘরে নিয়ে চল। ডাক্তারদাদা বললো।

ডাক্তারদাদার মুখের দিকে তাকালাম।

কেন?

দরকার আছে।

বড়োমা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে!

যেতে পারবে?

পারবো।

চল আমি যাচ্ছি। বড়োমা বললো।

ডাক্তারদা, বড়োমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে।

তুই সব গণ্ডগোল করে দিলি।

আমি! কেন?

ডাক্তারদা হাসছে।  

গণ্ডগোল করলে অনেকদিন আগেই করতে পারতাম।

আমি ডাক্তারদাকে ধরে দাঁড় করালাম। ডাক্তারদা আমাকে জড়িয়ে ধরলো।

আমরা বরং আপনাকে চেয়ারে বসিয়ে ও ঘরে নিয়ে যাই। বটা এগিয়ে এল।

না। আমি যেতে পারবো।

বৌদি আমার দিকে তাকিয়ে ইসারা করছে ব্যাপারটা কিরে?

ঘর থেকে বেরবার মুখেই আবার ফোনটা বাজলো। পকেট থেকে বার করলাম। এবার আর ডাক্তারদাকে দেখালাম না। সোজা কানে তুলে নিলাম।

বলো।

কিরে ওর নাকি শরীর খারাপ হয়েছে!

তোমাকে কে খবর দিল?

তুই চলে যাবার পর আচ্ছা করে দিলাম।

কেন দিতে গেলে?

সব দোষ কি আমার।

ঠিক আছে, তারপর বলো।

মনটা খারাপ হয়ে গেল। বুড়ো বয়সে এ কি করলাম। কি মনে হলো, আবার ফোন করলাম। একজন ভদ্রমহিলা ধরে বললেন, ওর নাকি শরীর খারাপ লাগছে। তারপর তোকে ফোন করলাম তোর ফোন স্যুইচ অফ। একটু আগে করলাম, তুই ফোন তুললি না।

আমি এই মুহূর্তে বাড়িতে। শরীরটা খারাপ হয়েছিল, এখন ভালো আছে। আমার সঙ্গে এ ঘর থেকে ও ঘরে যাচ্ছে। তাও আবার হেঁটে। এবার বলো।

এতো চেঁচামিচি কিসের।

বড়োমা, ছোটোমা, জ্যেঠিমনি, বৌদি সবাই হাসাহাসি করছে।

তুই বলেছিস নাকি?

কেন বলবো।

আমাকে একটু দে।

একটু পরে দিচ্ছি।

আচ্ছা।

ফোনটা পকেটে রাখলাম।

তুই আমাকে দিতে পারলি না। বড়োমা চেঁচিয়ে উঠলো।

কেন দেবো। তুমি চেনো?

বড়োমা চুপ করে গেল।

আমরা এ ঘরে এসে ঢুকলাম। সবাই পেছন পেছন আসছে।

ডাক্তারদাকে সোফায় বসালাম।

মাসি রান্নাঘর থেকে উঁকি মারল।

চা করেছো?

মাথা দোলাল।

দাও।

দাদা, বিধানদা, অনিমেষদা লম্বা সোফায় হেলান দিল।

ও ঘরের সবাই এখন এ ঘরে ভিড় করেছে। বারান্দায় জটলা।

বুঝতে পারছি নেপলাকে খুব জোড় জেরা পর্ব শুরু হয়ে গেছে।

তোমরা চা খাও, আমি আসছি।

ডাক্তারদাদা আমার দিকে তাকালো। আমি বেরিয়ে এলাম।

দেখছো অনিদা দেখছো, তোমার জন্য ছোটোমা, বৌদি আমাকে কথা শোনাচ্ছে। নেপলা চেঁচাল।

তুই শুনছিস কেন—

আমি বাগানে নেমে এলাম।

গেটের কাছে এগিয়ে এসে ফোনটা বার করলাম।

দেখলাম ওরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমাকে লক্ষ্য করছে।

হ্যালো।

তোর বাড়ির ঠিকানাটা বল।

কেন কি করবে!

আমি এখুনি একবার যাব।

তোমাকে নিয়ে আর পারা যাবে না।

তোকে আর পারতে হবে না। আমার জিনিষ আমি বুঝে নেব।

এতদিন নাওনি কেন?

তুই ওই ভাবে মনে করিয়ে দিসনি।

আমার পাকা ঘুঁটি তুমি কেঁচিয়ে দিলে।

কিচ্ছু দিই নি। তুই আমাকে নিয়ে চল।

তোমাকে সব দিক ভাবতে হবে।

আমার ভাবা হয়ে গেছে।

তোমার কি হয়েছে বলো তো?

তুই এখুনি আয়।

তোমার আবার শরীর খারাপ লাগছে না তো!

না। আমি ঠিক আছি।

এত রাতে এসে কি করবে, আমি তো বলছি ঠিক আছে।

তুই আসবি, না আমি খুঁজে খুঁজে যাব।

এখানে এসে রাতে থাকতে হবে।

তোর ঘরে থাকবো।

তাহলে তুমি আসবেই।

হ্যাঁ।

ঠিক আছে তুমি রেডি হও, আমি যাচ্ছি।

আমি রেডি হয়ে বসে আছি।

ঠিক আছে।

ফোনটা পকেটে রেখে আমি এগিয়ে এলাম।

ছোটোমা এগিয়ে এসেছে।

কিরে কার সঙ্গে কথা বলছিলি?

ছোটোমার দিকে তাকালাম। কথা বললাম না। ডাক্তারদাদা, দাদাদের সঙ্গে কথা বলছে।

আমি ভেতরে ঢুকলাম।

ডাক্তারদাদা আমার মুখের দিকে তাকাল।

তোমার শরীর এখন ঠিক আছে?

এখন একবারে ফিট। দাদা বললো।

আমি ডাক্তারদাদার মুখের দিকে তাকিয়ে।

তুই বললি না ওর শরীর খারাপ হওয়ার মূল কারণ কি? দাদা বললো।

সময় হোক জানতে পারবে।

এতো অনিমেষের তদন্ত কমিশনের মতো।

অনিমেষদা হাসছে।

আমি একটু বেরচ্ছি। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে চলে আসবো।

আমার কাছে আয়। ডাক্তারদাদা বললো।

আমি গিয়ে পাশে হাঁটু মুড়ে বসলাম। গলা নামিয়ে কথা বলছি।

কোথায় যাবি?

ডাকছে যাই। ঝামেলা করলে তুমি। আমাকে ঠেলা সামলাতে হবে।

কি করেছি বল।

তোমার শরীর খারাপ হলো কেন? বেশ তো ছিল।

তুই ওকে ওই বুদ্ধিটা দিলি কেন। আমি জেনে শুনেও চুপচাপ ছিলাম।

অনিমেষদা আমার মাথায় হাত রেখেছে। মুচকি মুচকি হাসছে। দাদা, বিধানদা ক্ষুরধার দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে।

তুমি আমার পাকা ঘুঁটি কেঁচিয়ে দিলে।

ডাক্তার তখন থেকে তোমরা কি কথা বলছো বলোতো, বুঝেও বুঝছি না।

দাদার কথায় বড়োমা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো।

কি হয়েছে গো—

এবার অনিমেষদা জোড়ে হেসে উঠলো।

সুতপা এ তো বেশ জটিল কেশ।

ডাক্তারদাদা, অনিমেষদার দিকে তাকাল।

আমি মাথা নিচু করে আছি।

যা আসতে চাইছে যখন নিয়ে আয়। রেখে আসার দায়িত্ব তোর।

তুমি বলে দাও—

আমি বলবো কেন, ঘোঁট কি আমি পাকিয়েছি—

তুমি মানছো না কেন—

আজ বাদে কাল ঘাটে যাব। এই বয়সে মানা যায়। তুই বুঝিস না—

ওটা আমার ওপর ছেড়ে দাও।

তুই তো হুড়ুম-দুড়ুম করে সব করবি। এদের কাছে কি জবাবদিহি করবো।

আমি করবো।

যা নিয়ে আয়।

ডাক্তার তলে তলে এতোদূর!

বড়োমা এমনভাবে বললো, সবাই হেসে কুটি কুটি খায়। ডাক্তারদাদা গম্ভীর থাকার চেষ্টা করছে।

মিডিয়েটর কে শুনি?

তোমার ছেলে। বেশ ভুলে গেছিলাম। কোথা থেকে খুঁজে বার করেছে ওই জানে।

যা অনি নিয়ে আয়, আমি বুঝে নেব, তোকে আর বুঝতে হবে না।

মিত্রা, তনু, ইসি চোখ ছোটো ছোটো করে হাসে।

বড়োমার দাপট শুরু হয়ে গেল। দামিনীমাসি, বৌদি, জ্যেঠিমনি হেসে যাচ্ছে।

আমি উঠে দাঁড়িয়েছি।

ছোটোমা এসে মুখো মুখি দাঁড়াল।

তুই অ্যাততো পাকা ছেলে!

হাসছি। মিত্রা, তনু ছোটমার পেছন থেকে ঘুসি দেখাচ্ছে।

বারান্দায় আসতেই ইসলামভাই জড়িয়ে ধরলো।

তুই আচ্ছা জিনিস।

ঘুরে আসি অনেক রাত হল।

যা যা শুভস্র শীঘ্রম।

অনিকারা কোথায়?

সব দল বেঁধে সিনেমা দেখতে গেছে।

নেপলা দাঁত বের করে আছে।

যেতে হবে?

চল।

আমরা দু-জন ট্রাংগুলার পার্কের মুখে আসতে নেপলা বললো, কোথায় যাবে?

বি কে পাল এ্যাভিনিউ।

নেপলা একটা বিটকেল হাসি হাসলো।

হাসছিস কেন?

কবে খোঁজ পেলে।

মিত্রার ডাইরী দেখে একটু হিন্টস পেয়েছিলাম। ওরা চলে যাবার পর সেরকম কোনও কাজ ছিল না। খুঁজে বার করলাম।

যেতে যেতে দু-বার ফোন হয়েগেল।

কোথায় আছিস?

বললাম।

নটা দশ পনেরো নাগাদ সেই ফ্ল্যাট বাড়ির তলায় এলাম।

আমাকে দেখে গেটের সিকুরিটির ছেলেটা এগিয়ে এলো।

ম্যাডাম বলেছেন, আপনি এলে একবার জানাতে।

জানা।

নেপলা বুঝলো আমার এই ফ্ল্যাটে যাওয়া আসা আছে।

তুমি কি আজ বিকেলে এখানে এসেছিলে?

হ্যাঁ।

বাগবাজারে নেমে এখানে হেঁটে এসেছিলে!

আমি হাসছি।

স্যার আপনি ওপরে যান।

নেপলাকে বললাম, তুই যাবি।

তুমি যাও, আমি নিচে আছি।

আমি ওপরে গিয়ে বেল টিপলাম। আন্টি নিজে দরজা খুললো।

এসে গেছিস—

হাসছি। হাতটা ধরে পালস দেখার ভান করলাম।

আমি ওর থেকে স্ট্রং।

কাজের মেয়েটা চলে গেছে?

হ্যাঁ বিদায় করেছি। কয়েকদিন ছুটি দিয়ে দিয়েছি।

ছেলে মেয়েদের কিছু জানিয়েছো?

বলে দিয়েছি। আমি এবার আমার পথে চলবো। তোমাদের আর আমাকে নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে না। আমার দায়িত্ব এখন থেকে অনি নেবে।

কেন বলতে গেলে?

আন্টি চুপ করে থাকলো।

চল আর দেরি করবো না। ওই বাক্সটা নে—

ওতে কি আছে!

কয়েকটা জামা কাপর নিয়েছি।

সত্যি তুমি আর আসবে না!

আসবো না কেন? এটা আমার ফ্ল্যাট। আমার ছেলে মেয়ের পয়সায় কিনিনি। এখনও দিনে আমি পাঁচহাজার টাকা রোজগার করি।

আমি কি তোমায় সেই কথা বললাম।

শুধু বকবক। চল, দেরি করিস না। চাবিটা নিয়ে তালা দে। আন্টি ধমকালো।

আমি ফ্ল্যাটের মেন স্যুইচ অফ করে লক করলাম। লিফ্টে করে নিচে নেমে এলাম।

তোমার গাড়িতে যাবে, না আমার গাড়িতে যাবে।

ড্রাইভারকে বলেছি, কাল সকালে ফোন করতে, যেখানে বলবো সেখানে গাড়ি নিয়ে যাবে।

গাড়ির চাবি।

আমার ব্যাগে আছে।

হাঁটুর ব্যাথা ঠিক আছে।

ক্রেপ বাঁধলাম। কাজ হয় নাকি।

সোনা আন্টি আমার হাত ধরলো। হেলতে দুলতে হাঁটছে।

বাড়ির সকলে জেনে ফেলেছে, তাই না?

আমি সোনা আন্টির মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছি।

তোর বড়োমা কি বলছে?

তুই নিয়ে আয়, আমি বুঝে নেব।

যাক তবু একজনকে পাশে পেলাম।

নেপলা এগিয়ে এসে আমার হাত থেকে লাগেজটা নিল।

এটা আবার কে রে?

নেপলা।

তোর গল্পের সঙ্গে মিলছে না।

নেপলা, আন্টির পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো।

এটা কোটিপতি ব্যবসায়ী।

হাসছি।

সব দাদার জন্য আন্টি। নেপলা বললো।

বাহনটা ভাল পেয়েছিস।

তুমি চাইলে নিয়ে নিতে পার।

ভাগ্য করতে হয় বুঝলি অনি। কপালে না থাকলে কিছু হয় না। কখনও কি ভেবেছিলাম, অজুকে আমি আবার পাব। তুই এলি, সব কেমন যেন এলোমেলো করে দিলি। ছাইচাপা আগুনটা আবার কেমন যেন ধিকি ধিকি করে জ্বলতে জ্বলতে এখন দাউ দাউ করে জ্বলছে।

আন্টির চোখ কেমন ছল ছল করে উঠলো।

আমি কিন্তু ওপরে রেখে ফিরে যাব।

আন্টি আমার হাতটা শক্ত করে ধরেছে। চোখে মুখে অব্যক্ত বেদনা।

উঠতে পারবে, না ধরে তুলবো।

পারবো।

নেপলা গেট খুলে দাঁড়িয়েছে। আমি আন্টিকে ধরে গাড়িতে তুললাম। নেপলা পেছনের দরজা খুলে আন্টির ব্যাগটা রাখলো।

আমি সামনে বসি।

না। তুই আমার পাশে বোস।

নেপলার চোখে বিশ্বগ্রাসী ক্ষুধা। ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিল।

বড়ো রাস্তায় এসে বললো, চিত্তরঞ্জন না নকু।

আন্টি আমার মুখের দিকে চাইল।

ও তোর মনের কথা খুব বোঝে, তাই না।

আমি হাসছি।

নকুর দোকানে চল।

আমি, আন্টি কেউই গাড়ি থেকে নামলাম না। নেপলা সব গুছিয়ে কিনলো।

অনিদা, আন্টির কোনও পছন্দ অপছন্দ আছে?

আমি সোনা আন্টির মুখের দিকে তাকালাম।

হাসছে।

তুমি বলো না। আমি আমার মতো কিনেছি। তোমার কোনও জিনিষ পছন্দ থাকলে বলো কিনে নিই।

ও কি খেতে ভাল বাসে?

ডাক্তারদাদার পছন্দের জিনিষ নেপলা কিনেছে।

বেশি বেশি করে কিনেছিস। নেপলার দিকে তাকাল।

নেপলা হাসছে।

ব্যাগ থেকে পয়সা বার করতে গেল।

তোমাকে পয়সা চেয়েছি। বলেছি তোমার পছন্দের জিনিষ কিছু থাকলে বলো।

জিনিষ কিনতে পয়সা লাগে না।

তুমি দাদার আন্টি, আমারও। পয়সা দিয়ে সব পাওয়া যায় না।

আন্টি হাসছে, ওরে অনি এ শুধু বোঝে না, বেশ ভালো কথা বলে।

উঠে আয়।

ট্র্যাংগুলার পার্ককে ডানদিকে রেখে গাড়ি ঢুকতেই আন্টির মুখের দিকে তাকালাম।

কিগো ধুকপুক করছে নাকি?

তা একটু করছে।

কেন?

মানুষটাকে কতো যুগ আগে শেষ দেখেছি। এখন দেখবো। মাঝে যা কিছু গলার শব্দ শুনে অনুভব করার চেষ্টা করেছি।

তুমি ভীষণ এক্সাইটেড হয়ে পড়েছো।

তা একটু হয়েছি।

পৌঁছতে দাও সব ঠিক হয়ে যাবে।

তুই আছিস, কিছু হলে তোকে জাপ্টে ধরবো।

নেপলার কানে ফোন, বুঝলাম আসার কথা বললো।

গেটের কাছে গাড়ি এসে দাঁড়াতে দেখলাম ফুটপাথে অনিকা, অনিসা, অনন্য, সুন্দর দাঁড়িয়ে।

ঢোকার আগেই ওরা গাড়ি ঘিরে ধরেছে।

বাবা এতদিন তুমি এতো বড়ো খবরটা চেপে রেখেছিলে কি করে বলো। অনিসা বললো।

আন্টি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

মেয়ে।

অনিসা।

হাসলাম।

মেয়ে নিজেই গাড়ির দরজা খুলে দিয়েছে।

ভেতরে ঢুকতে দে।

আমরা দিদাইকে কোলে করে নিয়ে যাচ্ছি। অনন্য বললো।

ওরা সবাই আন্টির পায়ে হাত রেখেছে। আমি নেমে দাঁড়িয়েছি।

অনিরে হাঁটুদুটো গেল।

তোমার কিচ্ছু হবে না। চলো না কাঁধে করে নিয়ে চলে যাচ্ছি। সুন্দর এগিয়ে এসেছে।

দাঁড়া বাবা দাঁড়া। এখন কি আর বয়সটা তোদের মতো।

আমি আন্টির সামনে দাঁড়িয়ে। অনন্য, সুন্দর দুজনে দুদিকে ধরে আন্টিকে গাড়ি থেকে নামাল।

কোনটা অনন্য কোনটা সুন্দর ? আন্টি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

আমাকে কিছু বলতে হলো না, ওরা নিজেরাই, সবাই পরিচয় করে নিল।

এই অনি আর দুটো কোথায়?

কারা বলো—

ঘণ্টা, পক্কে?

ওরা মাঠে দাঁড়িয়ে আছে। অনিকা বললো।

ওদের ডাক।

অনিসা চেঁচাল, ঘণ্টাদা।

ওরা সবাই এগিয়ে এসেছে।

বড়োমারা সবাই দেখলাম বারান্দায় দাঁড়িয়ে। ঘণ্টা, পক্কের পেছন পেছন মিত্রা, তনু এগিয়ে এসেছে।

ঘণ্টা, পক্কেরা প্রণাম করলো।

কোনটা ঘণ্টা, কোনটা পক্কে?

অনিকারা হাসে। নিজেরাই পরিচয় করছে।

আন্টি আমার দিকে তাকাল। কই ভালোনামগুলো আগে বলিস নি তো! সব কটাতে নিজের টাইটেল বসিয়ে দিয়েছিস।

আমি হাসছি।

তোর বউ দুটো কোথায়?

আমার কোনও বউ নেই।

নচ্ছার, দেবো এক থাপ্পর।

অনিকারা খিল খিল করে হেসে উঠলো।

তুমিও বাবাকে মারো। অনিসা তর তর করে উঠলো।

তোর বাবা ছ্যেঁচড়ামি করলে মারবো না। ফুল চন্দন দিয়ে পূজো করবো।

তনু, মিত্রা দুজনে এসে প্রণাম করে জড়িয়ে ধরলো।

এগুলো কোথ থেকে এলো শুনি। আকাশ থেকে পড়লো।

ততক্ষণে দুজনে পরিচয় পর্ব সেরে নিয়েছে।

দেরি করো না। ডাক্তারদাদার আবার প্রেসার বেড়ে যাবে।

চলনা মিনসেটাকে দেখাচ্ছি। ওর প্রেসার থাকতে পারে, আমার নেই।

ওরা সবাই আন্টির কথা শুনে হেসে যায়।

ও অনি তুই হাতটা ধর।

কেন নতি নাতনিরা ধরলে হবে না?

ওরা এখনও ছোটো আছে।

আমরা সবাই এ্যাডাল্ট। অনন্যরা চেঁচিয়ে উঠলো।

থাম আর বকিস না।

আন্টি আমার হাত শক্ত করে ধরেছে।

ধীরে ধীরে হাঁটছে। ওরা সবাই আমার পাশে। মিত্রা টেরিয়ে টেরিয়ে আমার দিকে তকাচ্ছে। ইশারায় বলছে কি সুন্দর দেখতে। গায়ের কি রং। তনু মুচকি মুচকি হাসছে।

অনিদা তুমি কাকে নিয়ে এলে গো?

ভজু সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

আন্টি আমার দিকে তাকাল।

ভজু।

দাঁড়াও একটা পেন্নাম করি।

ভজু মাঠের মধ্যেই মাটিতে শুয়ে পড়লো।

আন্টি ওর মাথায় হাত রেখেছে।

বলো না অনিদা উনি কে?

তুই বল।

বড়োমা বললো, তুমি কাকে ধরে আনতে গেছো। জ্যেঠিমনির মতো।

আন্টি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে। নির্মল হাসি।

বলে দাও।

যাঃ।

মিত্রারা কল কল করে হেসে উঠলো।

বড়োমারা আর ধৈর্য ধরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। পায়ে পায়ে মাঠে নেমে এসেছে। মল্লিকদা ছাড়া আর কেউ ঘরের বাইরে আসেনি।

অনিসা, অনিকা দৌড়ে ভেতরে চলে গেল।

মিনসেটা ভালই জাঁকিয়ে বসেছে মনে হচ্ছে।

আমি আন্টির দিকে তাকিয়ে হাসছি।

শুধু মিনসের দোষ দিলে হবে। তোমার কি একটুও দোষ নেই। বড়োমা এগিয়ে এলো।

বড়োমা, জ্যেঠিমনি, ছোটোমা, দামিনীমাসি, বৌদি দাঁড়িয়ে হাসছে।

আন্টি আমার দিকে তাকিয়ে।

ডাক্তারদাদার বড়ো বান্ধবী।

বড়োমা!

আন্টি আমার হাত ছেড়ে বড়োমার হাত ধরলো। নিচু হতে গেল।

থাক থাক।

বড়োমা আন্টির হাত চেপে ধরেছে। দু-জন দু-জনকে জড়িয়ে ধরেছে।

বড়োমা একে একে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল।

এতদিন তোমাদের সবাইকে অনির চোখ দিয়ে দেখেছি। আজ সামনা সামনি দেখছি।

আন্টির গলাটা ভাড়ি ভাড়ি শোনাল।

চলে এলেই পারতে। এই বয়সে কে আর আটকাবে? বড়োমা বললো।

ভেবেছিলাম এজম্মে হয়তো তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে না। অনির গল্প গল্পই থেকে যাবে।

বড়োমা আন্টির গালে গাল রেখেছে।

হ্যাঁগো দিদি।

কি যে হলো, অনি গিয়ে আজকে আমার ভেতরটা তোলপাড় করে দিল। রাগ করে চলে এলো। একা একা কিছুক্ষণ বসে বসে কাঁদলাম। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। অনির যুক্তিগুলো একবারে ফেলনা নয়। আমার কি নেই, শুধু একজন সঙ্গীর অভাব। ফোন করে ওকে সব বললাম।

তখন কি আর মাথার ঠিক ছিল, খুব বলেছি।

তারপর ভাবলাম, এভাবে বলাটা ঠিক উচিত হলো না।

সত্যিতো ও আমার কে? ভাবলাম ক্ষমা চেয়ে নিই। ফোন করে শুনি শরীর খারাপ।

বোঝ দেখি কাণ্ড, এই বুড়ী বয়সে খুনের দায়ে জেল খাটবো নাকি—

সবাই হাসছে।

চলবে —————————–



from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/mk2unHO
via BanglaChoti

Comments