❝কাজলদীঘি❞
BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়
১৮৯ নং কিস্তি
—————————–
কিরে ব্যাটা এত রাতে! ছেলে বাবা বাবা বলে ঘুম থেকে উঠে পরবে না?
আবিদ হাসছে।
কেমন আছে বেবি?
ভালো।
আয়েশা?
ভালো আছে।
বাড়ি নিয়ে এসেছিস?
নীরুদা ফিরে এসেই দেখেছে। বলেছে কাল সকালে ছেড়ে দেবে।
তোর এখন অনেক দায়িত্ব।
চাঁদের মুখ থেকে সব শুনেছি। আমি থাকলে….ওর এখন রক্ত ঠান্ডা হয়ে গেছে।
বাপ হলি তুই চাঁদের রক্ত ঠান্ডা হয়ে গেল।
চাঁদ হাসছে।
আবিদ আমার কথার কোনও উত্তরই দিল না। মিত্রার দিকে তাকাল
ম্যাডাম তোমরা রতনদার গাড়িতে, আমার গাড়িতে অনিদা। চাঁদ, দাদা-মল্লিকদাকে নিয়ে যাবে।
মিত্রা আবিদের দিকে তাকিয়ে হাসলো।
রবীন কোথায়?
রতনদা বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে।
ইসমাইল।
ইসমাইলভাইকেও পাঠিয়ে দিয়েছে। দাদা কোথায়?
নামছে।
ফিরতে ফিরতে রাস্তায় সেই এক চিত্র দেখলাম, কাগজ নিয়ে মারা মারি।
ফেরার সময় বিশেষ কথা বলতে ইচ্ছে করলো না। যেটুকু কথা বললাম বাচ্চাটার কথাই আবিদকে জিজ্ঞাসা করলাম।
বাড়ির গেটে যখন পৌঁছলাম রাত্রি তখন একটা।
আবিদ গাড়ি বাগানের রাস্তায় দাঁড় করাতে দরজা খুলে নেমে এলাম। দোতলার ঘরের একটাতেও লাইট জ্বলছে না। একমাত্র বারান্দার একটা লাইট টিম টিম করে জ্বলছে। বুঝলাম সবাই শুয়ে পড়েছে।
স্বাভাবিক। এতটা রাস্তা আসার পরিশ্রম ঠিক ভাবে নিতে পারেনি কেউ।
নিচের ঘরগুলোতেও একই অবস্থা। একমাত্র বড়মার ঘরের লাইট জলছে।
তুই বাড়ি ফিরবি? আবিদের দিকে তাকালাম।
হ্যাঁ।
বাচ্চাটার জন্য কাউকে ঠিক করেছিস?
মাসি দুটো মেয়ে ঠিক করে দিয়েছে।
ভালো হয়েছে। নীরু কাল কখন ডিসচার্জ করবে?
ন-টার পর যেতে বলেছে।
ঠিক আছে আয়েষাকে বাড়ি নিয়ে আয় তারপর একবার যাওয়া যাবে।
আমি কাল প্রথমে এই বাড়িতে নিয়ে আসবো, তারপর ফ্ল্যাটে নিয়ে যাব।
তোর কোনও আত্মীয়কে খবর দিয়েছিস।
আছে কে? তুমি তো সব জানো। এক চাচা-চাচী আছে তাদের বলেছি। তারা কলকাতায় আসার জন্য গাড়ী ভাড়া চেয়েছে। আস্তে না বলে দিয়েছি। তার চেয়ে বড়োমা ইকবালভাই যেমন যেমন বলবে তাই করবো।
আয়েষাকে জিজ্ঞাসা করেছিস?
ও বলেছে অনিমামা যা বলবে তাই করবে। আমার কাউকে দরকার নেই। অনিমামা থাকলেই যথেষ্ট। আমিও অনিমামার কাছে মানুষ তুমিও। অনিমামা আমাদের সব।
আবিদের পিঠে হাত রাখলাম। এখানে খাওয়া দাওয়া করে ফিরে যা। যদি মনে করিস যাওয়ার দরকার নেই তাহলে কাল সকালে এখান থেকেই একবারে আয়েষাকে আনতে যাবি।
মিত্রা, তনু পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। মিলিরা ভেতরে গেল।
এখানে দাঁড়িয়ে সব কথা শেষ করে দিবি।
মিত্রার দিকে তাকালাম।
ও বাড়ি চলে যাবে বলছে। তাই কথা বলছিলাম।
এতরাতে বাড়ি যেতে হবে না। কাল একবারে আয়েষাকে এখানে নিয়ে আসবে। কালকের দিনটা এখানে থাকবে। পর্শুদিন নিয়ে যাবে। এর মধ্যে ওখানে সব গুছিয়ে নেবে।
মিত্রা আবিদের দিকে তাকিয়ে এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে বারান্দার দিকে হাঁটা দিল।
আবিদের দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
ম্যাডাম যা বললো তই কর।
আবিদ হাসছে।
তুমি ভেতরে যাও। সারাদিন অনেক ঝড় গেছে তোমার ওপর দিয়ে।
বুকর ভেতর তেকে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো।
রতন, চাঁদ এগিয়ে এসেছে।
এত রাতে ফিরে আর লাভ নেই। যা হাতমুখ ধুয়ে রেডি হয়ে নে। খেয়ে নিই।
তুমি যাও আমরা রেডি হচ্ছি।
আমি ভেতরে এলাম। দাদা, মল্লিকদা সোফায় বসেছে। অনিমেষদা, ডাক্তারদাদা, বিধানদাও আছে।
অনিমেষদা আমর দিকে তাকিয়ে হাসলো।
বৌদি, জ্যেঠিমনি, দামিনীমাসি, আন্টি কাউকে ধারে কাছে দেখতে পেলাম না। ছোটোমা-বড়োমা রান্নাঘরে খুট-খাট করছে।
আমি একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলাম। দাদার দিকে তাকালাম।
বড়োমাকে চায়ের কথা বলেছো।
বলেছিলাম, দেবে না বলেছে।
কেন?
রাত হয়ে গেছে।
আজ কি প্রথম?
তুই বল।
বিধানদা, অনিমেষদা হেসেই চলেছে।
আমি চেঁচালাম, বড়োমা।
চা হবে না। রান্নাঘরের ভেতর থেকে আওয়াজ হলো।
আমি উঠে দাঁড়িয়ে রান্নাঘরের কাছে গেলাম। দেখলাম গ্যাসে চা হচ্ছে।
ছোটোমা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলো।
ওখান থেকেই দাদার দিকে তাকালাম।
তুমিও আজকাল বেশ ভাল ড্রিবলিং শিখে গেছ।
তোর পাল্লায় পরে।
আবার ছোটোমার দিকে তাকালাম।
জ্যেঠিমনিরা কোথায় ছোটোমা?
শুয়ে পড়েছে।
তুমিও দাদার মতো বলতে শুরু করে দিলে।
না-রে, দিদিকে জিজ্ঞাসা কর।
বড়োমার ঘরে শুয়েছে?
না। ওপরের ঘরে।
ইসলামভাই?
সবাই শুয়ে পড়েছে।
চলো তাহলে দেরি করে লাভ নেই। চা খেয়ে আমরাও ঝপঝপ খেয়ে শুয়ে পড়ি।
কাজ মিটলো?
সব কি আর মেটে।
বড়োমা আমার মুখের দিকে তাকাল।
তাকিয়ে দেখছো কি। একটা অধ্যায় শেষ করলাম, আর একটা অধ্যায় লখা শুরু হয়েছে বহুদিন আগে থেকে, এবার সেটাকে শেষ করতে হবে। এইভাবেই চলে যাবে বুঝলে।
বড়োমা তবু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
ছোটোমা চা ঢালছে।
নয়না, নম্রতা কোথায়?
সামন্তদার বাড়িতে শুয়েছে। ছোটোমা বললো।
কিছু বলছিল?
কি বলবে। মোনখারাপ হওয়া স্বাভাবিক।
ঠিক।
ছোটোমা আমার হাতে চায়ের কাপ দিয়ে ট্রে-টা নিয়ে বেরিয়ে গেল।
কি রান্না করলে? বড়োমার দিকে তাকালাম।
তুই যে বললি খাবার কিনে আনতে।
ও ভুলে গেছিলাম।
একটু থেমে।
মেয়ে ফোন করেছিল?
ওরা পর্শুদিন ফিরে আসছে।
কেন!
কি জানি। বললো বাবা কোথায়?
কি বললে?
অফিসে গেছে।
আর কিছু জিজ্ঞাসা করে নি?
মনেহলো সব জানে।
তার মানে আরও অনেকক্ষণ কথা হয়েছে।
বড়োমা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
চায়ের কাপটা বেসিনে নামিয়ে রেখে বেরিয়ে এলাম। অনিমেষদাদের দিকে তাকিয়ে বললাম, আজ অনেক রাত হয়েছে। খেয়েদেয়ে শুয়ে পরো। কাল বসবো।
নিজের ঘরে চলে এলাম।
সকালে ঘুম ভাঙতে দেখলাম বড়োমা আমার মাথার শিয়রে, দামিনীমাসি আমার পায়ের কাছে। ছোটোমা সোফায় শরীর এলিয়ে দিয়েছে।
তিনজনে চাপা স্বরে কথা বলছে। আমি চোখ মেলে তাকাতে তিনজনেই চুপ করে গেল।
ঘুম ভাঙলো। ছোটোমা বলে উঠলো।
বড়োমার কোলে মাথাটা দিয়ে ছোটোমার মুখের দিকে তাকালাম।
কখন উঠলে?
যেমন উঠি।
তোমাদের দম আছে।
তোর থেকেও।
অবশ্যই। মাসি।
বল।
কাল বেশ আগে আগে শুয়ে পড়লে।
কি করবো ঘুম পেয়ে গেল।
ঘুমের ওষুধ খেয়েছিলে?
দেখছিস ছোট, কি সন্দেহ বাতিক ব্যাটাছেলে—
ছোটোমাকে সাক্ষী মেনে লাভ আছে—
আমার শরীর খারাপ করতে নেই?
তোমার শরীর খারাপ হয় না। হলেও দু-একজন ছাড়া কেউ বুঝতে পারে না।
কিছুক্ষণ বড়োমার কোলে চোখ বন্ধ করে চুপ করে রইলাম।
বড়োমা।
আমি কিছু জানি না যা।
ছোটোমা জোড়ে হেসে উঠলো। দামিনীমাসিও হাসছে। আমি বড়োমার মুখ দেখতে পাচ্ছি না।
চোখ খুললাম।
তোমরা তিনজন এই ঘরে, আন্টি কোথায়?
কেন তোর মুখের সামনে সকলে এসে বসে থাকবে, কখন অনি ওঠে। বড়োমা বলে উঠলো।
তোমরা তিনজন বসে আছো কেন?
কাজ নেই তাই।
রান্না হয়ে গেছে?
সুতপা করছে।
আমি তড়াক করে উঠে বসলাম।
মেনু কি?
লুচি, আলুভাজা, বেগুনভাজা।
বাঃ জমপেশ করে খাওয়া যাবে। সোজা খাট থেকে নিচে নেমে টেবিলের কাছে এলাম। ব্রাসে মাজন লাগিয়ে আলনা থেকে টাওয়েলটা কাঁধে ফেলে বাথরুমে ঢোকার আগে তিনজনের মুখের দিকে তাকালাম।
তোমরা গিয়ে খাবার রেডি করো, আমি মিনিট পনেরোর মধ্যে যাচ্ছি।
আজ কোথাও বেরনো হবে না। ছোটোমা আমার দিকে তাকাল।
খুব দরকার না পড়লে বেরবো না।
বাথরুমের দরজা বন্ধ করলাম।
তিনজন সকাল সকাল আমাকে জেগে বসে আছে কেন? তাহলে কি?
কাল কথায় কথায় মিলি বলে ফেলেছিল মাসি নাকি গেইজ করেছিল, আমি এই ধরণের কিছু একটা কাজ করতে পারি। আমি তো এদের কাউকে মনের কথা বলি নি?
তাহলে কি আমার কাজের মধ্যে এমন কোনও ফাঁক থেকে গেছিল যেখান থেকে মাসি ব্যাপারটা ধরতে পেরেছিল! চিন্তার সূত্রটা ঘুরে ফিরে সেই এক জায়গায় চলে আসছে।
ইসলামভাইকে দেখে যতটা শ্রুট মনে হয় ততটা শ্রুট ইসলামভাই নয়। কিন্তু মাসি বুদ্ধি দিয়ে কাজ করে। ইসলামভাই-এর থেকে বেশি মানুষ দেখেছে। ক্ষমতা ইসলামভাই-এর থেকে যথেষ্ট বেশি। মাসির যৌবনে অনেক বড়ো বড়ো দাদা, ক্ষমতাবান সরকারি প্রতিনিধি মাসির টলটলে শরীরটাতে আশ্রয় নিয়েছে। মাসিও সেই সুযোগের যথেষ্ট সদ্ব্যবহার করেছে। এটা আমি নিজের চোখে দেখেছি।
যৌবনে মাসি ছলা-কলায় যথেষ্ট পটিয়সী ছিল। রূপ-যৌবনও মাসির খারপ ছিল না। না হলে ওই এলাকায় মাসি এই জায়গায় পৌঁছতে পারতো না।
মাসিকে আমি ভরা যৌবনে দেখিনি। যখন দেখেছি তখন মাসি বিগত যৌবনা, পরন্ত বেলা। ওই পরন্ত বেলায়ও মাসির ঘরে যেসব মৌমাছি ভ্যান ভ্যান করে ভিড় করতো তারা নেহাত কম ক্ষমতাবান লোক ছিল না।
তখন আমি গ্রামের আকাট মাল, কোনওপ্রকারে মাথা গোঁজার ঠাঁই পেয়েছি মাসির দয়ায়। গায়ে গতরে একটু খাটা-খাটনি করে সেই আশ্রয়কে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছি। বেশ্যা পাড়ায় থেকেছি, বেশ্যা সঙ্গ করিনি। মাথা গোঁজার ঠাঁই টুকু চলে যাবার ভয়ে।
তাছাড়া তখন এতো কিছু বুঝতাম না। একটাই লক্ষ্য ছিল নিজের পায়ের তলার মাটি শক্ত করতে হবে। যে ভাবেই হোক নিজের এস্টাব্লিশমেন্ট চাই। একটু আধটু সময় পেলে, চড়ুই পাখির মতো ফুরুত ফুরুত করে উড়েছি।
তারপর জীবনের চলার পথে প্রতিটা মুহূর্তে ঘা খেতে খেতে শেখা।
কিন্তু সেই সময়কার প্রতিটা ছবি আমার মনের ফ্রেমে আলাদা আলাদা করে ধরে রেখেছিলাম। এখন সেগুলো নিয়ে নারাচারা করলে চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে আসে মাসির ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দুতে কারা আছে। সেই সোর্স মাসির নষ্ট হয়ে যায়নি। বরং দিনে দিনে আরও বেড়েছে। এখনও বেশ কিছু অবশিষ্ট রয়েছে। তাদের কাছে মাসি গিয়ে দাঁড়ালে, তারা এখনও মাসিকে যথেষ্ট সহায়তা দেয় ফিরিয়ে দেয় না।
এটাও মাসি বুঝেছে, মাসি নিজে এক মুখী ক্ষমতার উৎস। আমি বহুমুখী। ওপর থেকে নিচ সব জায়গায় আমার অবাধ বিচরণ। অনিকে ধরা অতো সহজ নয়। তাই তখন কাছে এসে হাত পেতেছে, এখন আর তার দরকার হয় না। মাসি যেমন চেষ্টা করলে আমার খোঁজ পাবে, আমিও মাসির খোঁজ পেয়ে যাব। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মাসি অবশ্য ফেল করে যায়।
কিন্তু মাসি গেইজ করলো কি করে?
কিরে তুই কি বাথরুমে বিছানা-বালিশ নিয়ে গেছিস।
ছোটোমার গলা তার সঙ্গে দরজা ধাক্কানি।
হুঁশে ফিরলাম।
দাঁড়াও বেরচ্ছি। আর পাঁচ মিনিট।
দশ মিনিট বলে আধঘণ্টা কাটালি আরও পাঁচমিনিট।
যাচ্ছি যাচ্ছি। একটু দাঁড়াও গা মুছছি।
তোকে আর দয়া করে মুছতে হবে না। বেরিয়ে এসে দেখা তোর স্নান হয়ে গেছে।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখলাম ছোটোমা ছাড়াও ঘরে বৌদি রয়েছে।
বৌদি খাটে বসে আছে। আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো।
ছোটোমা এগিয়ে এলো।
মাথাটাও ঠিক ভাবে মুছতে পারিস না।
কেন।
জল টপ টপ করে গড়িয়ে পড়ছে।
মুছছিলাম তুমি তারা লাগালে তাই বেরিয়ে এলাম।
ছোটোমা এগিয়ে এসে মাথাটা টেনে নিচে নামিয়ে নিজের আঁচল দিয়ে মোছাতে শুরু করে দিল।
উঃ হয়েছে। তোমাকে আর মোছাতে হবে না। এখুনি দেখবে সব শুকিয়ে যাবে।
কে কার কথা শোনে।
ছোটোমা তার নিজের কাজেই ব্যস্ত। কাজ শেষ করে বললো, কোনটা পরবি।
সরো আমি নিয়ে নিচ্ছি।
রংওঠা জামাকাপর পরবি না।
ছোটোমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
কেন!
কেনর কোনও উত্তর নেই।
ঠিক আছে যে কোনও একটা পাজামা পাঞ্জাবী দাও পরে নিই।
আলমাড়ির চাবি কোথায়?
জানি না।
তারমানে! তোর আলমাড়ির চাবির খোঁজ কে রাখবে?
মিত্রাকে ডাকো বলে দেবে।
বাড়ি নেই।
ঘুম থেকে উঠেই চড়তে বেরিয়েছে।
এখন সাড়ে এগারটা বাজে।
ও।
ছোটোমা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
বৌদি হাসছে।
তুই একটা ঢপ।
তা যা বলেছো। সংসার তো করলাম না মাহাত্ম বুঝি কি করে।
এতো বুঝিস ওই পদার্থটা বুঝিস না।
ওই জায়গায় আমার ব্রেণটা বহুত ডাল।
বল না, পরের ঘারের ওপর দিয়ে চালিয়ে গেলাম, শিখে আর কি হবে।
তুমি একবারে সত্যি কথাটা বলে ফেলেছো।
বৌদি কখনও মিথ্যে কথা বলে না। সব সময় সত্যি কথা বলে।
মিথ্যে কথা বলে না হয়তো, কিন্তু মাঝে মাঝে সত্যি কথাটা গোপন করতে পারে না।
কি গোপন কথা ফাঁস করেছি বল।
ভেবে দেখো।
তুই বল না।
সব কথা এখন সেইভাবে মনে রাখতে পারি না। তবে কিছু কিছু কথা মগজে খোদাই করে রাখি।
বৌদি আমার মুখের দিকে তাকাল।
আমি টেবিলের ওপর থেকে চিরুনিটা নিয়ে আলমাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে চুলে চিরুনি চালালাম।
আয়নার মধ্যে দিয়ে বৌদির মুখটা দেখতে পাচ্ছি। আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি নির্বিকার চিত্তে থেমে থেমে কথা বলে চলেছি।
সবাই সব কথা সহ্য করতে পারে না বলে আমি সবাইকে সব কথা বলি না।
বৌদি মাথা নিচু করে নিল।
আমাকেও বাঁচতে হবে। তাই কাউকে না কাউকে আমার কথা বলতে হবে।
বৌদি উঠে এসে আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।
আমি অন্যায় করলে নিশ্চই আমাকে শাসন করবে। সেই অধিকার তোমার আছে। অনেকবার শাসন করেছো। মাথা পেতে নিয়েছি।
বলতে পারবে এমন কোনও কাজ করেছি যা তোমার অগোচরে ঘটেছে। পৃথিবীতে আর কেউ জানুক ছাই না জানুক তুমি অন্ততঃ পক্ষে সব জানো।
কোনও কোনও ক্ষেত্রে বড়োমার থেকেও তুমি আমার মনে অনেক উঁচুতে উপবেশন করে আছো।
আমার ভুল হয়েগেছে অনি। আর কখনো হবে না।
তোমরা প্রত্যেকে আমাকে স্নেহ করো, জানি না আমি তার কতটা মর্যাদা দিতে পেরেছি। কিন্তু নিজের মন থেকে বলছি, আমি আপ্রাণ চেষ্টা করি তোমরা অন্ততঃ ভালো থাকো।
আমৃত্যু আর কোনওদিন এই ভুল করবো না তোকে কথা দিচ্ছি।
ও কিগো দিদি! তুমি ওই ভাবে ওকে জাপ্টে ধরে দাঁড়িয়ে আছ?
ছোটোমা ঘরে ঢুকলো।
চোখে বিষ্ময়।
কি হয়েছে!
কিছু না।
কিছু না বললে হবে। তোমার চোখ মুখটা কেমন কেমন দেখাচ্ছে।
একটা অন্যায় করেছিলাম। ও বকুনি দিল।
থাবড়ে গাল ভেঙে দেব। ছোটোমা হাত তুললো।
আমি ছোটোমার হাতটা ধরে নিলাম।
তোমাকেও বকুনি দেব।
দে-না দেখি কতোবড়ো সাহস, কান টেনে ছিঁড়ে দেব।
কালা হয়ে যাব, আর শুনতে পাবো না।
ছোটোমা হাসলো। হাতে একটা প্যাকেট।
এটা কি?
পাজামা-পাঞ্জাবী আছে।
নতুন!
কেন গা কামড়াচ্ছে।
নতুন মানে আবার কোমড় ধাপান।
অতই যদি কষ্ট, কোমড় ধাপাবি না।
ছোটোমাকে জড়িয়ে ধরলাম।
অনেকক্ষণ থেকে মেজাজ দেখাচ্ছ। কারণটা কি শুনি।
ছোটোমা আমার মুখের দিকে ভাষা ভাষা চোখে তাকাল। তারপর মুখটা নামিয়ে নিল।
আমি ছোটোমার মুখটা তুলে ধরলাম। চোখের পাতা থিরি থিরি করে কাঁপছে।
আমি কি তোমাকে আমার অজান্তে আঘাত করলাম।
ছোটোমার আয়তো চোখ দুটো বুঁজে এল। চোখের ভাষায় বোঝাতে চাইল, না।
আজ বাড়িতে নিশ্চই কোনও উৎসব আছে। তার একটা গন্ধ আমি পাচ্ছি। আমি যেমন তোমাদের কিছু বলি না। তোমরাও আমাকে বলো না।
ছোটোমা আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
অনি চিরটাকাল বৈষয়িক বিষয়ে একইরকম পাগল-ছাগল থেকে গেল। কেন তোমরা তার ওপর এতো অভিমান করো।
একটু থামলাম।
বহু চেষ্টা করি বুঝলে ছোটোমা, ভেতরের সব কিছু কেমন যেন ওলট-পালট হয়ে যায়।
মিত্রা মাঝে মাঝে গুম হয়ে থাকে। ওর অভিমানটা ধরা পড়ে যায়। তনুর অভিমানটা চোরাবালির তলায় নদীর শ্রোতের মতো বয়ে চলে। দেখা যায় না। অনুভূতি সেখান বোঝার মাপকাঠি। ভাষার কোনও আঁকি-বুঁকি সেখানে পৌঁছয় না।
আমি কি করি বলো, যত দিন যাচ্ছে পাকে পাকে জড়িয়ে পরছি।
একজন অসুস্থ হয়ে পরে রয়েছে, বার বার ফোন করছে যেতে পারছি না। কিন্তু সেখানে যাওয়াটা ভীষণ জরুরি। যাওয়ার ফুরসৎই পাচ্ছি না।
কে!
বুঝলাম স্লিপ অফ টাং হয়ে গেছে। একহাত জিভ বার করে ফেললাম।
বৌদি কাছে এগিয়ে এলো। ছোটোমা আমার দিকে ছোটোছোটো চোখে তাকিয়ে আছে।
কিরে বলবি তো কে অসুস্থ?
কেউ না। তুমি আমকে পাজামা-পাঞ্জাবীটা বার করে দাও। পরে নিই।
ছোটোমাকে ছেড়ে দিলাম।
ছোটোমা তবু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
ছোটোমার হাত থেকে প্যাকেটটা নিয়ে নিজে নিজেই পাজামা-পাঞ্জাবী বার করলাম।
ড্রয়ার-গেঞ্জি-পাজামা-পাঞ্জাবী সব নতুন।
ছোটোমা-বৌদি একটা কথাও বলছে না। আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি একে একে সব পরলাম।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একবার নিজেকে দেখে নিলাম। খারাপ লাগছে না।
ছোটোমা, বৌদিকে প্রণাম করলাম।
দেখো এবার ঠিক আছে?
ছোটোমা তবু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
কেমন লাগছে বলো।
ছোটোমা হাসলো, এ হসি স্বতঃস্ফূর্ত নয় সেটা বোঝার মত বয়স আমার হয়েছে।
ভালো লাগছে।
চলো খিদে লেগেছে। এবার পেটে কিছু দিতে হবে।
আমি টেবিলের কাছে গেলাম। মোবাইলটা তুলে অন করলাম।
তিনজনে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।
শুনসান বাড়ি, কেউ কোথাও নেই। কারুর গলার আওয়াজও পাচ্ছি না।
এ ঘরে এলাম। দেখলাম দামিনীমাসি, বড়োমা রান্নাঘরে।
ঘরে ঢুকেই চেঁচালাম বড়োমা।
বড়োমা একবার রান্নাঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। একগাল হেসে ছোটোমার দিকে তাকাল।
কিরে ছোটো বক বক করেনি।
করেনি আবার। মুখে বলেনি। শরিরী ভাষায় বুঝিয়েছে।
আমি ছোটোমার দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
দামিনীমাসি, বড়োমাকে প্রণাম করলাম।
এবার খেতে দাও। সব টেবিলে নিয়ে চলে এসো। একসঙ্গে বসে খাব।
ছোটো ওকে প্রসাদ দে।
আবার কিসের প্রসাদ!
তাহলে এতক্ষণ ও ঘরে কি করছিলি। ছোটো তোকে কিছু বলেনি।
আমি কি সব কথা বলি।
বড়োমা, ছোটোমার মুখের দিকে তাকাল।
ছোটোমা, বড়োমার ঘরের দিকে চলে গেল।
বড়োমা একবার বৌদির মুখের দিকে একবার ছোটোমার চলে যাবার দিকে তাকাল।
বুঝলাম বৌদি চোখে চোখে কথা বললো।
ছোটোমা প্রসাদের চুবড়ি নিয়ে বড়োমার ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
আমি এগিয়ে গেলাম। ছোটোমা আমার মাথায় ফুল ঠেকিয়ে একটা পেঁড়া আমার হাতে দিল।
কালীঘাট না দক্ষিণেশ্বর?
কালীঘাট।
তা বেশ। মল্লিকদা কোথায়?
ছোটোমা হেসে ফেললো।
সকাল বেলা তিনজনে বেশ গুছিয়ে ও ঘরে বসেছিলে।
বড়োমা বললো, জানি না।
বৌদি হেসে যাচ্ছে।
তুই ওর সঙ্গে পারবি না ছোটো।
তবে যাই বলো ছোটোমা তোমাকে আজ অন্যান্য দিনের থেকে একটু অন্যরকম লাগছে।
ছোটোমা আমার দিকে তাকাল।
আমি টেবিলের ওপর থেকে জলের বোতলটা নিয়ে গলায় ঢাললাম।
ঢক ঢক করে কিছুটা জল খেয়ে সোফায় বসলাম।
বড়োমা একটু চা দাও। মল্লিকদা আসুক, একটা পুরনো হিসেব আছে চুকিয়ে-বুকিয়ে নিই তারপর লুচি বেগুনভাজা আলুভাজা খাব।
ফোনটা পকেট থেকে বার করলাম। ডায়াল করলাম।
বোচন ধরেছে। ইচ্ছে করেই ভয়েজ অন করে কথা বলা শুরু করলাম।
হ্যালো।
বাবা।
কিরে সকাল থেকে উঠে কোথায় বেরিয়েছিস, ঘুম থেকে উঠে কাউকে দেখতে পাচ্ছি না।
কেন দিদানরা নেই?
না।
তাহলে হয়তো মন্দির থেকে ফেরেনি।
আবার মন্দির কোথা থেকে এলো?
তুমি জানো না!
কি?
আজ দাদাই আর দিদানের বিবাহ বার্ষিকী।
তাই! তাহলে খুব জোর খাওয়া দাওয়া বল।
হ্যাঁ।
রান্না-বান্না কখন করবি।
নো রান্না-বান্না। সব বাইরে থেকে।
সকাল, বিকেল, রাত্রি সব?
হ্যাঁ।
এখন কি আমি হরিমটর খাবো।
কেন কচুরী আছে, সকালে আমরা খেয়ে বেরিয়েছি। তুমি রান্নাঘরে খোঁজ করো পেয়ে যাবে।
তোর দাদাই-দুদুন কোথায়?
সব মার বাড়িতে।
তোরাও কি ওখানে?
না আমরা খাবার কিনতে এসেছি ভালোদাদাই-এর সঙ্গে।
তোর মা-ছোটোমা।
ও বাড়িতে। ঠিক আছে তুমি রাখো আমি দিদানকে ফোন করে দিচ্ছি।
না তোকে আর ফোন করতে হবে না।
শোনো না।
বল।
দিদানরা ফিরে এলে তাড়াতাড়ি এ বাড়িতে চলে এসো।
ছোটোমা আমাদের কথা শুনছে আর মুচকি মুচকি হাসছে।
আমি ফোনটা পকেটে রেখে রান্নাঘরের দিকে তাকলাম। বড়োমা, দামিনীমাসি দাঁড়িয়ে আছে।
আমার দিকে তাকিয়ে ওরা দুজনেও হাসছে।
তুই চেপে রাখতে পারলি। বৌদি, ছোটোমার দিকে তাকাল।
আমি চেপে রাখতে চাইনি। ঠিক সময় ওকে বলতাম।
বড়োমা রেডি হও, আমরা একটা জায়গায় যাব। মিত্রাকে ফোন করে বলে দাও, আমাদের যেতে যেতে তিনটে-সাড়ে তিনটে হবে।
কোথায় যাব! এই যে বললি খাব।
ওখানে গিয়ে খাব। চারজনে ঝপ ঝপ রেডি হয়ে নাও।
এখানকার খাবার কি হবে?
সঙ্গে নিয়ে নাও।
আমি সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালাম।
রতন কি ও বাড়িতে?
হ্যাঁ। ছোটোমা বললো।
আমাদের কে নিতে আসবে?
রতন আসবে। ফোন করতে হবে।
ফোন করে দাও। আধা ঘণ্টার মধ্যে যেন চলে আসে।
শ্যামবাজার থেকে আসতে সময় লাগে।
এর বেশি লাগবে না। ও তো ট্যাক্সিতে আসবে না। যে মিটার তুলতে হবে।
একটু চা খা।
দাও।
আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।
সোজা এঘরে চলে এলাম।
আজ এই মুহূর্তে এই বাড়িটাকে মনে হচ্ছে যেন নিস্তব্ধ পুরী। শুনসান কেউ কোথাও নেই।
ঘরে ঢুকে জানলার সামনে এসে দাঁড়ালাম। ভজুরাম বাগানটার শরীরে যৌবন ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে। আগে যেমন প্রায়ই উই লেগে যেত গাছগুলোর গোড়ায়, এখন তা আর লাগে না।
বাগানের পেছনদিকে গ্যারেজটার সামনে একটা সিমেন্টের চৌবাচ্চা ছিল বাগান ঝাঁট দেওয়ার পর শুকনোপাতা সেখান জড়ো করে মাঝে মাঝে আগুন জ্বালায় তারপর সেই ছাই গাছের গোড়ায় দেয়।
একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলাম এটা কি করছিস?
বললো এটা গাছের সার। তুমি বুঝবে না।
হেসেছিলাম।
আমাদের গাঁইয়া ভাষায় খতকুর।
গোয়ালঘর পরিষ্কার করে যা বেড়তো সব ওই খতকুরে ফেলা হতো।
এমনকি সারাবছরের উনুনের ছাইও ওই খতকুরে জড়ো করা হতো। তারপর চাষের সময় ওই খতকুর পরিষ্কার করে মাঠে ফেলা হতো।
কাকা বলতো জৈব সার। এই সব ক্যামিক্যাল সারের থেকে যথেষ্ট উপকারী।
এই পদ্ধতি চিকনা এখনও ধরে রেখেছে। শুনেছি, দেবাশীষও ফার্মে এই পদ্ধতি অনুসরণ করে।
মনে পরে গেল চিকনাকে কাল থেকে ফোন করা হয়নি। খবরা খবরও নেওয়া হয়নি।
পকেট থেকে মোবাইলটা বার করলাম। চিকনার নম্বরটা ডায়াল করলাম।
রিং বাজছে। একবার, দুবার, তিনবার। লাইনটা অটোমেটিক কেটে গেল।
হয়তো ফোনের কাছে নেই।
অর্ককে ফোন করলাম।
অর্ক ধরলো।
কিগো ঘুম ভাঙলো?
অনেকক্ষণ উঠেছি।
আমি সকালে ফোন করেছিলাম।
তাই!
তোমার স্যুইচ অফ ছিল।
খবর কি?
তুমি কিছু জান না।
না।
সকাল থেকে কতো কেলর কীর্তি হয়ে গেল।
কিরকম?
সত্যি তুমি কিছু জান না!
বিশ্বাস কর। কেউ তো এই বাড়িতে নেই।
সরি। আমি নিজেই ভুলে গেছিলাম। আজ সব ও বাড়িতে।
হ্যাঁ।
ছোটোমা ফোন করেছিল বলেছে দুপুরে ওখানে খেতে হবে। আজ আবার কি অনুষ্ঠান বলো তো?
কিরে আবার কার সঙ্গে বক বক করছিস। ছোটোমা চায়েরকাপ হাতে ঘরে ঢুকলো।
একটু ধর, ছোটোমা চা নিয়ে এসেছে।
অর্ক হাসছে।
ছোটোমার হাত থেকে চায়ের কাপটা নিলাম।
রেডি।
রেডি বললেই হবে, একটু সময় দিতে হবে।
বেশি সময় দেওয়া যাবে না। ফিরতে তাহলে বেলা হয়ে যাবে।
রতনকে আসতে দে।
তাড়া লাগাও।
ছোটোমা চলে গেল।
চায়ে চুমুক দিয়ে আবার কানে ফোন ধরলাম।
কুঁক কুঁক আওয়াজ হচ্ছে বুঝলাম কেউ ফোন করছে।
হ্যালো।
কোথায় যাবে? অর্ক বললো।
একটু ছোটোমাদের নিয়ে বেরবো।
বললে না কিসের অনুষ্ঠান।
ছোটোমা তোকে বলেনি!
না।
আজ ছোটোমা মল্লিকদার বিবাহ বার্ষিকী।
ফিফটি ইয়ার্স।
না না অতো হবে না। আবার হলেও হতে পারে। জানি না।
সত্যি তুমি না কি?
তোদের মতো রিজিওনেবেল হতে পারলাম না।
এই তোমার এক কথা।
আচ্ছা খবর কি বল?
সকালে তোমার বাড়িতে সব কটা চ্যানেল হুমরি খেয়ে পড়েছিল।
কেন!
ম্যাডামের ইন্টারভিউ নেবে।
সত্যি!
হ্যাঁগো। এমনকি প্রশাসনিক স্তর থেকেও প্রচুর ফোন গেছে ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলবে বলে।
তারপর?
অনিমেষদা সব অপারেট করেছে।
তুই জানলি কি করে?
আমি ম্যাডামকে ফোন করেছিলাম। ম্যাডাম বললো।
চ্যানেল ওয়ালারা খালি হাতে ফিরলো?
না। ম্যাডামের ইন্টারভিউ নিয়েছে।
টিভিতে দেখিয়েছে?
দেখাবে না আবার, সকাল থেকে কপচেই চলেছে। সত্যি, তুমি স্টোরিটা দারুণ লিখেছো। কালকে একবার রিডিং মেরেছিলাম। আজ চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ভালো করে মন দিয়ে পড়লাম। যেন সত্যি ম্যাডাম লিখছে, তুমি লেখোনি। গদ্যের স্টাইলটাও একটু অন্যরকমের।
আমি চুপ করে আছি।
রাত্রি পড়ার পর বলেই ফেললো, এ লেখা পড়লে কেউ বলবে না অনিদা লিখেছে।
কাল দাদার কথা মন দিয়ে শুনছিলাম। খারপ লাগছিল। চেষ্টা করি বুঝলে, হয় না।
চেষ্টা করে যেতে হবে।
তুমি আমি সমান নয়। তুমি যেভাবে মানুষ দেখেছো, আমি সেইভাবে মানুষ দেখিনি।
তোমার সান্নিধ্যে এসে কিছু মানুষ দেখলাম। যদি তোমার সান্নিধ্যে না আসতাম তাহলে এই জগৎটা আমাদের কাছে অধরাই থেকে যেত।
নতুন কোনও খবর জোগাড় করতে পারলি।
সিপি ফোন করেছিল সন্দীপদাকে। আইজি বাকি লেখাটা দিতে রিকোয়েস্ট করেছে।
কেন!
আগে থেকে একটু পড়ে নেবে।
কি বললি।
কাল পর্শু আরও দুটো ইনস্টলমেন্ট বেরবে দেখে নেবেন।
ওরা কি লেখাটার বিশ্বাসযোগ্যতা খুঁজে পাচ্ছে।
অফকোর্স। না হলে কাগজ বেরবার সঙ্গে সঙ্গে তোমার বাড়িতে গিয়ে হত্যে দিয়ে পরে থাকে।
অনিমেষদার আর একটা কাজ বারলো।
ওটা বিধানদা, রূপায়ণদা সামলাচ্ছে। তবে দিবাকরকে এ্যারেস্ট করে প্রবীরদার প্রশাসনিক ভাবমূর্তি অনেকটা বেড়ে গেছে। শুনলাম দিল্লী, মুম্বাই থেকে একটা করে টিম কলকাতায় আসছে।
কেন?
দিবাকরকে ইন্টরোগেট করবে।
সুকান্তর খবর?
সকাল থেকে টিভিতে কন্টিনিউ থোবড় দেখাচ্ছে। আমাকে ফোন করেছিল।
কখন।
কাল রাতেই করেছিল। তখন তোমার লেখার প্রুফ দেখছিলাম। তারপর সকাল থেকে দু-তিনবার কথা হয়েছে।
কি বলছে?
অনিদার কাছে সারাজীবন ঋণী থেকে গেলাম। এ জীবনে এই ঋণ শোধ করতে পারবো না। অনিদা আমার ক্যারিয়ারটা অন্যভাবে লিখে দিল।
আফতাবভাই আসছে। জরুরী ফাইলগুলো সব গুছিয়ে রাখ।
রেডি করা আছে। অরিত্ররগুলো একটু হচপচ হয়ে আছে। দেখি আজ অফিসে গিয়ে গুছিয়ে নেব।
অনাদি, সাগর?
নার্সিংহোমে ছিল, কাল ওই কেশটা ঘটে যাবার পর সরকারি হাসপাতালে পুলিশ প্রহরায়।
ওদের কোনও ইন্টারভিউ নেয়নি।
কালকে বহুত ফর ফর করছিল, আজ আর কোনও সারা-শব্দ পাচ্ছি না। তাছাড়া আমাদের কাগজে দিবাকরের সঙ্গে অনাদিদার ওই সময়কার ছবি বেরিয়েছে, ব্যাটা একবারে চুপ।
সাগরের অবস্থা?
এইবার ওর ডাউনস্ট্রিম শুরু হলো। ব্যাটা বহুত কপচেছিল। প্রেসের সামনে আইন দেখাচ্ছিল।
অর্ক অনেকক্ষণ থেকে ফোনটা কুঁ কুঁ করছে বুঝলি। কেউ মন হয় ফোন করছে। তোর সঙ্গে পরে কথা বলছি।
দুপুরে দেখা হবে।
ঠিক আছে।
ফোনটা কেটে দিতেই দেখলাম দশটা মিশকল তিনটে নাম তনু, মিত্রা, চিকনা।
চিকনাকে ফোনে ধরলাম।
হ্যালো।
কার সঙ্গে কথা বলছিলি?
অর্কর সঙ্গে।
আমি তখন স্নান করতে গেছিলাম।
একা একা।
তাহলে কি?
ঠিক হয়ে গেছে!
ব্যাথাটা অনেকটা কমেছে।
হাঁটতে চলতে অসুবিধে হচ্ছে না?
পা-টা একটু টেনে টেনে চলছি।
কেন হাঁটা হাঁটি করছিস। দু-একদিন হাঁটা হাঁটি না করলে চলছে না।
প্রথম দুদিন নীপা উঠতে দেয়নি। সুস্থ মানুষ কতক্ষণ শুয়ে থাকা যায় বল। গা-হাত-পা ব্যাথা হয়ে মরলো। তাই আজ একটু জোড় করে উঠেছিলাম।
সঙ্গে কে ছিল?
পচার ছেলেটা।
মীরচাচা?
গতকাল বাড়ি গেছে।
তোর বাড়ির লোকজন আসেনি?
মা-বাবা এসেছিল। ভাই ভায়ের বউ এসে একটু মরা কান্না কাঁদল, ভাগিয়ে দিলাম।
কেন!
আর নেকামো পোষায় না। মা-বাবার প্রতিও সেই টানটা আর অনুভব করি না।
তবু মা-বাবা।
ছেলে হিসাবে সেই দায়িত্বটা আমি পালন করি। এটা তোর কাছ থেকে শেখা।
সকালের কাগজ দেখেছিস?
কাগজ দেখিনি। টিভি দেখছি। ম্যাডামের কথা শুনছি আর হাসছি।
হাসছিস কেন?
মেলার গল্প কয়ঠে।
আবার গাঁইয়া ভাষা আওরাচ্ছিস।
তোর সঙ্গে কথা কইতিছি।
আজ ছোটোমার বিবাহ বার্ষিকী।
ইচ্ছে করছিল যাই, বাসু বারণ করলো। বললো, আফতাবভাইরা আসবে। দু-একদিনের মধ্যে ওরা এখানে আসতে পারে। বেগতিক কিছু হলে অনির মন খারাপ হয়ে যাবে। তুই রেস্ট নিয়ে শরীর সুস্থ কর।
কাঞ্চন কি বলছে?
আজ সকালে গিয়ে শিবমাড়োতে পূজা দিয়ে এসেছে।
কেন!
কি বলি বল। অনাদির নামটা পর্যন্ত সহ্য করতে পারছে না।
ছেলে মেয়ে?
দুটোকে ব্যাঙ্কের কাজে লাগিয়েছি। সুবীর বললো, বাইরে থেকে আবার নিতে গেলে কি বিপদ হয়, তার থেকে ঘরে যখন আছে দুটোকে নিয়ে নাও।
কি বুঝছিস?
বাপের নাম পর্যন্ত মুখে উচ্চারণ করে না।
কাকা-কাকী?
ঠিক আছে।
বাড়িটার কি হাল?
উদ্ধার করেছি। গরুগুলার জন্য দুটা লোক ঠিক করে দিয়েছি।
জমি-জমা।
সব উদ্ধার করতে পারবো না। কিছু বেহাত হয়েছে। কিছুটা উদ্ধার করার চেষ্টা করছি।
কাঞ্চন এখন আসে?
সকালে একবার আসে, বিকেলে একবার আসে।
কাকা-কাকী?
একবার করে এসে খামারে বসে সকলের সঙ্গে একটু গল্প করে চলে যায়।
যতই হোক অনাদি ওদের বাবা। ওদের মনে একটা চাপ পড়বে। ওদের পাশে থাকিস।
এটা তুই বলছিস। ওরা বরং তার উল্ট। বাপ যদি গুলি খেয়ে মরে যেত বরং ভাল হতো।
এটা ওদের মনের কথা নয় রাগের কথা।
তুই এসে বোঝাস।
গুরুমার সঙ্গে কথা বললি?
গুরুমাই সকালে ফোন করে বললো, চিকনা আমার ইন্টারভিউ দেখাবে টিভিতে, দেখো।
ওমনি টিভি খুলে বসে পরলি।
শুধু আমি, গ্রাম শুদ্ধু সকলে চলে এসেছে। টিভি এখন খামারে। সঞ্জুর বড়ো ছেলেকে ম্যানেজার বানিয়ে দিয়েছি।
বেশ মস্তিতে আছিস।
হ্যাঁ।
ওই মালটার আপডেট নিয়েছিস?
কোনটা বলতো।
বাসুর দোকানের ছেলেটা।
বড়ো খলিফা বুঝলি। ফোনে বলা যাবে না। এখন জুনিয়র ছেলেগুলো পর্যন্ত আমাকে বাসুকে চমকাচ্ছে। পাত্তা দিচ্ছে না।
কেন!
একটু দয়া দাক্ষিণ্য দেখাচ্ছি।
এখন থেকে কন্ট্রোল কর।
বেশি বললে বলে অনিকাকা আসুক তার সঙ্গে আলোচনা করবো।
তাই বলি কার সঙ্গে এতো ফুসুর ফুসুর গুজুর গুজুর, দেখছিস তনু, কেন বিজি বিজি বলছিলো।
পেছন ফিরে তাকালাম, দেখলাম তনু-মিত্রা আমার দিকে এগিয়ে আসছে।
কার সঙ্গে কথা বলছিস দেখি।
মিত্রা আমার হাত থেকে ছোঁ মেরে মোবাইলটা নিয়ে নিল, কানে দিয়েই বললো।
হ্যালো।
তারপর জোড়ে হেসে উঠলো।
তুমি।
সঙ্গে সঙ্গে ভয়েজ অন করে দিল।
হ্যাঁ।
গুরুকে সব আপডেট দিলে?
না।
কেন?
তুমি থাকতে আমি কি বলবো।
জিজ্ঞাসা করেছো কখন ঘুম থেকে উঠেছে।
ওর জায়গায় আমরা থাকলে টেঁসে যেতাম বুঝলে। ঘুমটা আছে বলে বেঁচে আছে।
ঢং।
হ্যাঁগো গুরুমা। তুমি ওকে আমার থেকে বেশি দেখ। তুমি তো ওকে ভাল জানবে।
থাক আর গুণ গাইতে হবে না। খাওয়া দাওয়া হয়েছে?
এবার বসবো। সকাল থেকে তোমাকে টিভিতে দেখা নিয়ে যা চলছে।
ঘর মোছা ন্যাতা বনে গেছি।
চিকনা জোড়ে হেসে উঠলো।
কাগজ পড়েছো?
না। খেয়েদেয়ে উঠে জমিয়ে পড়তে বসবো।
তোমাকে এবার পুলিশ ধরবে।
ধরলে ধরবে। আমার জন্য কাঁদার মতো তো একজন আছে, তার একটু মন খারাপ হবে।
শুধু মন খারাপ, আর কিছু নয়?
কি আর হবে কিছু লোক মরবে।
তাতে কি আর রাগ যাবে?
হ্যাঁ হ্যাঁ এখন বয়স হয়ে গেছে।
আমার জন্য কুড়ি বছর সময় নিয়েছে তোমার জন্য হয়তো কুড়িঘণ্টা সময় নেবে।
ওর জন্য বেঁচে আছি বুঝলে গুরুমা। না হল কবে স্যুইসাইড করতাম।
তোমার গুরু কিন্তু সব শুনছে।
তুমি ভয়েজ অন করে রেখেছো!
হ্যাঁ।
হলো, তুমি তো আমার কাজ সেরে দিলে।
কেন!
সুদে আসলে কবে রিটার্ণ পাব কে জানে।
কিরে আমরা রেডি, তুই তো এখনও গল্প করে চলেছিস।
ছোটোমা, বৌদি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে।
চিকনা আমরা এখন বেরচ্ছি। পরে কথা বলবো।
কোথায় যাবে?
দেখি তোমার গুরু কোথায় নিয়ে যায়।
বুঝেছি।
আমি দরজার দিকে হাঁটা মারলাম। মিত্রারাও আমার পেছন পেছন হাঁটা লাগাল।
কি বুঝেছো।
ও হচ্ছে পেঁয়াজ বুঝলে, শাঁসটা খুঁজে পাওয়া খুব মুস্কিল।
মিত্রা হাসছে।
রাখি।
রাখো। আমার নাম করে তুমি, তনুদি দুটো করে রসোগোল্লা বেশি খেও।
তাহলে তোমার খাওয়া হয়ে যাবে।
হ্যাঁ।
আচ্ছা। মিত্রা ফোনটা কেটে দিয়ে আমার হাতে দিল। ততক্ষণে আমরা বারান্দা দিয়ে বাগানে এসে পড়েছি। দেখলাম জ্যেঠিমনিও সঙ্গে এসেছে।
চলবে —————————–
from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/qd1WGQF
via BanglaChoti
Comments
Post a Comment