কাজলদিঘী (১৮০ নং কিস্তি)

❝কাজলদীঘি❞

BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

১৮০ নং কিস্তি
—————————–

নম্রতা পর্যন্ত সামন্তদাকে ফোন করে বললো দাদাই কালকে যে গুমোট ভাবটা ছিল, আজ একবারে উধাও। অনেক পাহাড় পর্বতে গেছি জানো। এইরকম আনন্দ করিনি। মসাই মানুষকে কতটা ভালোবাসে এখানে না এলে বুঝতে পারতাম না। তোর চিঁড়ে-মধু-দুধ খাওয়ার গল্প বললো। কতো সাধারণ জিনিষ কিন্তু কি তার টেস্ট।

সামন্তদা আবার আনার জন্য অর্ডার করেছে। বলেছে ওইরকম কাঁচা শালপাতায় নিয়ে আসবি তাহলে খাব, না হলে খাব না।

গল্প করলে সময় চলে যাবে, এমনি বেলা হয়ে গেছে, পৌঁছতে বিকেল হয়ে যাবে।

রাখ।

ফোনটা কেটে ছোটোমাদের কাছে এলাম। ওরা তখন প্লাস্টিকের ছোটো ছোটো কাপে কফি ঢালছে।

মিত্রা একটা কাপ আমার হাতে এনে দিল।

হনিমুনে তো নিয়ে গেলি না। এখানে নিয়ে এলি তাও দূরে দূরে থাকলি।

আমি ওর কপট অভিমানভরা মুখের দিকে তাকলাম। এ চোখ অনেক কথা বলছে।

যাই বল অনি, আমার পরিবারের সঙ্গেও এখানে ওখানে ঘুরতে গেছি। অনেক বন জঙ্গলেও গেছি। কিন্তু এমন নির্মল আনন্দ কখনও উপভোগ করিনি। অনুপদা বললো।

আমি হাসছি।

দারুর ছেলে-পুলে গুলো কি অবিডিয়েন্ট। আমদের বার বার গাইড করলো আকা ওদিকে যেও না। ইদিকে থাকো। পা হড়কি গেলে পাথরে মাথা বাজবে।

এবার জোড়ে হেসে ফেললাম। অনুপদা সাঁওতালী কথা বলতে গিয়ে হড়কে গেছে।

হাসিস না দেখ না কয়েকদিনের মধ্যে ঠিক ম্যানেজ করে নেব।

মাটির কাছা কাছি আসতে আরও কিছুটা সময় দিতে হবে।

এবার থেকে দেব। তোকে আর দরকার লাগবে না। আমি, বৌদি এবার নিজেরাই প্রোগ্রাম করে চলে আসবো।

বড়োমার কাছে এলাম। মুচকি মুচকি হাসছে।

সব তোলা থাকছে। দাদাকে গিয়ে পাই টু পাই রিপোর্ট দেব, মনে থাকে যেন।

দিস।

শুভরা দেখলাম সব পাজামা পাঞ্জাবী লাগিয়ে নিয়েছে।

আঙ্কেল দারুন এনজয় করছি। শুভ এগিয়ে এলো।

এবার বন থেকে ভালুক বেরলে এনজয় বেরিয়ে যাবে, তাড়াতাড়ি গাড়িতে ওঠ।

ভালুকেরও ভয় আছে। আমাদের দেখলে পালিয়ে যাবে।

তুই এবার আমাদের গাড়িতে ওঠ। মিত্রা বললো।

ঠিক আছে।

মিলিরা পাশে দাঁড়িয়ে ছিল তারস্বরে চিৎকার করে উঠলো।

সুরো ছুটে এসে বললো, বৌদি দাদা আমাদের গাড়িতে?

মিত্রা হাসছে।

গোছ গাছ করে আবার যাত্রা শুরু। আমাদের গাড়ির মাথায় ছুড়কি।

এবার দেখলাম রবীন বসেছে ড্রাইভারের সিটে আমার কোলে মাম্পি, মিকিকে গুঁজে দিয়েছে ওরা। বসা মাত্রই কানের পোকা বার করতে শুরু করে দিল।

গাড়ি স্টার্ট করার আগে দারুকে বলেছিলাম, শ্যাম মোড়লের বাড়িতে আছে। ওখানে থামাস। তারপর ওখান থেকে হেঁটে ওইটুকু পথ ঠিক চলে যেতে পারবো।

আমরা নদীকে ডান দিকে রেখে এগিয়ে চলেছি।

আঙ্কেল জানো মিকি না জলে ডুবে গেছিল। মাম্পির দিকে তাকালাম।

এই শুরু হলো। সুরো ফুট কাটলো।

তুই বাঁচালি?

মাম্পি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।

তুই যে জলে হিসি করলি।

মিকির কথায় মিত্রারা জোরে হেসে উঠলো।

বুঝেছি তুই মিথ্যে কথা বলছিলি।

ডুরু আঙ্কেলটা মিকি দুষ্টু করছিল বলে উঠিয়ে দিল।

তুই যে ওকে বালি মাখাচ্ছিলি।

আমি না ও।

মা পাছুতে ঘা-দুচ্চার দিয়েছে। থাপ্পর দেখালাম।

মাম্পি মাথা দোলাচ্ছে। না।

রবীন গাড়িটা থামাল। সামনের দিকে তাকালাম।

দেখলাম সবকটা গাড়িই দাঁড়িয়ে পড়েছে।

জানলা দিয়ে মুখ বারিয়ে ছুড়কিকে জিজ্ঞাসা করলাম, কি হলো রে।

তান্যে জল খাতি নামেঠে। দারুআকা গড়ি থামাইছে।

বুঝলাম ভাল্লুক নামছে বনের ভেতর থেকে। নিজের মনে নিজে হাসলাম।

তারা করবে না?

না গোটা কয় আইছে। জল খায়ে উঠি যাবে।

মিত্রা আমার কাঁধে হাত রেখেছে।

কি রে!

ওর মুখের দিকে তাকালাম।

চুপ করে রইলি কেন।

ডানদিকে তাকা দেখতে পাবি।

আবার হাতি?

না।

ওরা সকলে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে।

উঃ অনিদা যা ভেল্কি দেখাচ্ছে না। নীপা পেছন থেকে বললো।

আমি কোথায় ভেল্কি দেখাচ্ছি।

মিত্রাদি ওই দেখ ভাল্লুক! মিলি চেঁচিয়ে উঠলো।

বিয়ার! মাম্পি লাফিয়ে রবীনের কোলে চলে গেল। মিকি ওর জামা টেনে ধরেছে।

আবার কিছুটা কোস্তা কুস্তি হলো।

রবীন বাধ্য হয়ে দুটোকে জানলার কাছে বসাল।

হেলতে দুলতে পাঁচটা ভাল্লুক এগিয়ে চলেছে জলের দিকে। আমরা যে এখানে দাঁড়িয়ে আছি সেদিকে ভ্রুক্ষেপই নেই। মিত্রাদের চোখ স্থির। কারুর মুখে কোনও কথা সরছে না। দেখে মনে হচ্ছে একটা পরিবার। একটা বিশল বড়োসড়ো একটা মাঝারি তিনটে বাচ্চা।

আমরা প্রায় আধঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম।

দূর থেকে ওদের স্নান করা জল খাওয়া দেখলাম।

তনু গাড়ি থেকে নেমে পটা পট ছবি তুলে যাচ্ছে। ও মনে হয় ক্যামেরা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। ওর দেখা দেখি টিনা, মিলিও নেমে পরেছে।

বুবুন।

বল।

বড়োটা ছেলে ভল্লুক।

তুই কাছে গিয়ে দেখে আয়।

ধ্যাৎ।

কেন বলতে গেলে। মিলি বললো।

কি খোদার খাসির মতো চেহারা। কি খায় বলতো।

তোর মতো আধবুড়ো মেয়েদের ওরা পছন্দ করে।

তনু ঠেলা মারলো।

আবার ওরা ভাল্লুকের দিকে মনোনিবেশ করলো।

বেশ লাগছিলি। মিত্রারা যেমন স্নান করছিল খেলছিল ওরাও ঠিক তেমনি। বাচ্চাগুলোকে কেমন সুন্দর আগলিয়ে রেখে মা ভাল্লুকটা ওদের গায়ে গা ঘঁষে স্নান করলো। তারপর ডাঙায় এসে গা ঝাড়া দিয়ে জল ঝারলো।

বাচ্চাগুলোও মায়ের দেখা দেখি শরীরটা দোলাল, প্রথমে মাথাটা প্রবল জোড়ে নাড়াল, তারপর সারাটা শরীর দোলালো। সব কিছু মিটে যাওয়ার পর ধীর পায়ে নিজেদের গন্তব্য স্থলে এগিয়ে গেল।

একটা দম বন্ধ করা পরিবেশের অবসান ঘটল। গাড়ি আবার চলতে শুরু করলো।

বুবুন তুই আগে কখনও দেখেছিস?

এই রকম অবস্থায় দেখিনি। তবে কখনও কখনও যাওয়া আসার পথে দেখেছি। কখনও তাড়া করেছে কিন্তু বাইকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়তে পারেনি। ভাড়ি শরীরে আর কতো দৌড়বে। তাছাড়া এদের কাছে আর্মস থাকে, ভয়ের কিছু নেই।

কই একবারও তুই এই সব গল্প বলিসনি।

কি বলবো, জানিস মিত্রা একবার বেশ ঘটা করে ভালোপাহাড়ে গেছিলাম এই-আ বড়ো বড়ো ভাল্লুক দেখলাম, সে কি বিশাল রে, এই তার….।

মিত্রারা হেসে উঠলো।

তুমি কি মাম্পিকে গল্প বলছো। টিনা বললো।

মাম্পিকে নয়। মাম্পির মতো কয়েকটা মেয়কে।

পেছন ফিরে মিত্রার দিকে তাকালাম। চোখ হাসছে।

কথা বলতে বলতে নদী গর্ভ ছেড়ে আবার ওপরে উঠতে শুরু করলাম। আর মিনিট পাঁচেক গেলেই শ্যামেদের গ্রাম। ফুলডুংরি।

কিরে রবীন অসুবিধে হবে না।

রবীন আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো।

হাল্কা হাল্কা সাঁওতালী গানের সুর ভসে আসছে। বেশ লাগছে।

আবার শাল-মহুয়ার জঙ্গলে ঢুকে পড়লাম। এদিকের জঙ্গলটা ততটা গভীর নয় তবে জঙ্গল জঙ্গল, তার কোনও মাপকাঠি নেই। ওদিককার থেকে এদিককার রাস্তাটা বেশ পরিষ্কার। অতোটা খানা খন্দর নেই। শ্যামেরা নিজেরাই লাল মাটি বিছিয়ে নিয়েছে। পোষাকি ভাষায় যাকে মোরাম বলে। বৃষ্টি হলে ধুয়ে যায়। আবার ওরা ফেলে।

বেশ কিছুটা যাওয়ার পর গাড়ি থেমে গেল। আর যাবে না।

এবার বেশ কিছুটা চড়াই উঠতে হবে।

গাড়ি থেকে একে একে সবাই নামলাম।

অনিদা কুথায়রে শিবু। শ্যামের গলা পেলাম।

পিছনে চলি যা বৌমনির গাড়ি-এ আছে।

মিত্রারা নেমে দাঁড়িয়েছে।

গাড়ি কি এখানে থাকবে অনিদা। রবীন বললো।

আমরা তো খিড়কি দরজা দিয়ে এলাম। ফেরার সময় আর এ পাশ দিয়ে যাব না।

ছুড়কি ওপর থেকে নেমে এসেছে। আমি তখনও মাম্পিদের কোলে নিয়ে বসে।

লামো।

দাঁড়া না, তাড়াহুড়ো করছিস কেন।

ছুড়কি নিজেই গেট খুলে দিল। মাম্পি-মিকিকে কোলে করে নিচে নামাল। এবার আর ওরা কিছু বললো না। সামনের ভিড়টা আস্তে আস্তে পিছনের দিকে এগিয়ে আসছে।

গাড়ি থেকে নামলাম। শ্যামের সঙ্গে চোখা চুখি হয়ে গেল। বড়োমার সামনে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে।

বড়োমা মনে হয় কিছু বলছে। শ্যাম মুচকি মুচকি হাসছে।

মিত্রারা নিজেদের কাপর চোপর টেনে টুনে ঠিক করে নিচ্ছে।

ছুড়কি গাড়ি কোথায় থাকবে রে।

তুমাকে চিন্তা করতি হবেক লাই।

হেসে ফেললাম।

রবীন আকা চাবিগুলান মনকাকে দাও।

ছুড়কির কথায় রবীন হাসছে।

শ্যাম হাসতে হাসতে আমার কাছে এসে পায়ের কাছে ঝুঁকে পড়লো। আমি ওর হাতটা ধরে ফেললাম।

এখানে এসব করিস না। অনেক লোক, কোমড় ব্যাথা হয়ে যাবে।

কবে নু বড়োমা অইসবে আইসবে করতিছে তুই আনিস লাই।

থাক আর বক বক করিস না। তুই তো আনতে পারতিস।

বড়োমা তুকে ছাড়া আসবেক লাই কইছে। তুই বড়োমার বল ভরসি।

আমি শ্যামকে বুকে টেনে নিলাম।

তুই খুশি।

শ্যাম হাসছে। তন্যে চাইরজন কতদিনবাদ আইসলু। আমি স্বপ্ন দেখতি।

কনিষ্ক আসার সময় বলছিল।

মিত্রার দিকে তাকাল।

বউমনি শ্যাম কুন জঙলে থাইকে দেইখছো।

মিত্রা হাসছে।

চল আর দেরি করবো না।

বড়োমা হাঁটি যাবে কইছে।

এত খাঁড়াই উঠতে পারবে না। কোথায় লেগে-টেগে যাবে।

তুই কইগে যা।

বড়োমাকে তোর দেশে নিয়ে এলাম, আমি কেন বলবো।

মোকে ধমকিবে।

হাসলাম। ঠিক আছে পারলে যেতে দে। তুই পাশে পাশে থাক।

অখন রাস্তা আইগে নু ভাল করছি। অসুবিধা লাই।

তুই তো সব কিছু সোনা দিয়া বাঁধাইছু। বিজলী লিয়া আসছু।

শ্যাম আমার কথা শুনে হসে ফেললো, মিত্রারাও গম্ভীর থাকতে পারলো না।

দেখছু বউমনি, অনিদা মোর ভাষায় কইথা বইলে।

শ্যাম হাসতে হাসতেই আমার দিকে তাকাল।

কনিষ্কদার মাইয়া, সুরোদির ছেইলেটা কুথা।

ছুড়কির কাছে ছিল, দেখ আবার কার সঙ্গে আছে।

ওগুলানকে দেখি লাই, শুনলি নম্বরি হইছে।

হ্যাঁ। খুব কথা বলে।

আস্তে আস্তে সামনের দিকে এগোতে শুরু করলাম।

পিসী কোথায়রে শ্যাম?

তাকে বিষান কাঁখে কইরে লিয়ে ইছে।

সুখলালকাকা কেমন আছে।

আকার শরীলটা ভাল লাই। ভাবতিছি এউবার কইলকাতা লিয়ে যাব।

তাই কর, বয়স হয়েছে।

আমি আগু যাই, তান্যে ঠিক মতো বড়োমাকে বুঝাইতে পারবেক লাই।

দোলাটা পাশে পাশে নিয়ে যাস যেখানে অসুবিধে হবে তুলে নিস সকলকে।

আইচ্ছা।

শ্যাম এগিয়ে গেল পেছন পেছন ওরাও এগিয়ে গেল। আমার পাশে তনু-মিত্রা।

যে যার নিজের মতো করে হাত পা ছড়িয়ে হেঁটে চলেছে।

কথা বলতে বলতে আঁকা বাঁকা শরু পথ ধরে আমরাও এগিয়ে চলেছি ওপরের দিকে।

অনেকটা খাঁড়াই উঠে তারপর আবার একটু সমতল। এই রাস্তা টুকু আগে পাথরে বেছানো ছিল। শ্যামেরা রাস্তাটা মোরাম ফেলে ঠিক করেছে। অন্ততঃ পক্ষে বাইকগুলো যাতে ঠিক ঠাক যাতায়াত করতে পারে।

একটু পরে পরেই সামনের মানুষগুলো গাছ-গাছালির ফাঁকে হারিয়ে যাচ্ছে। শুধু তাদের গলার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। পাহাড়ী রোদ গাছের ফাঁক দিয়ে শরীরে লুটোপুটি খাচ্ছে।

বুবুন।

মিত্রার মুখের দিকে তাকালাম।

একটা সময় তুই প্রায় এখানে আসতিস?

একা পেয়েছে কিছু কথা বলতে চায়। চোখে-মুখে অনেক প্রশ্ন।

প্রায় বললে ভুল হবে, সপ্তাহে একবার আসতাম।

তখন তুই মাসির ওখানেই থাকতিস?

মাথা দোলালাম।

অনিকা তখন হয়নি?

না।

অনিকা হওয়ার পর এখানে আসতিস?

হওয়ার পর আসতাম। তবে মেরিনাদি মারা যাবার পর আর বেশি আসতে পারতাম না। তার পরেই সব কিছু কেমন যেন দ্রুত পাল্টে গেল।

মিত্রা থমকে দাঁড়িয়ে পরলো। আমিও দাঁড়িয়ে পরলাম।

দাদার বাড়ি আশ্রয় পেলাম। তনু চলে গেল। তুই আবার ফিরে এলি। একের পর এক ঝড় আছড়ে পরলো। নিজে ঠিক সামলে উঠতে পারতাম না।

তবু ফাঁক পেলে চলে আসতাম। গ্যাপটা বেড়ে গেল। শ্যামেরা একটা সংগঠনের ফাঁদে পা দিল। অনিমেষদাকে বললাম একটু নার্সিং করো। অনিমেষদা অনুপদাকে পাঠাতো তবে এতো ভেতরে কখনও আসেনি। স্টেশনের কাছে বসেই কথা বলে চলে যেত। ফলে ধীরে ধীরে সেটা বৃক্ষে পরিণত হলো।

তুই অনুপদাকে বলেছিস তুই এদের ব্যাপারটা সাপোর্ট করিস?

কেন করি, কি কারনে করি সেটাও বলেছি।

বৌদি মুখে কিছু না বললেও তোকে মনে মনে সাপোর্ট করে। সুরো অনিমেষদাকে ফোন করে পরিষ্কার বলে দিয়েছে। এখানে অনিদাকে ওরা দেবতার মতো পূজো করে। তুমি অনুপ আঙ্কেলকে পরিষ্কার বলে দাও, যেন একটা আণ্ডার স্ট্যান্ডিং করে ব্যাপারটা মিটিয়ে নেয়। তোমাদের রাজনীতি এরা বোঝে না। এরা অত্যন্ত সহজ সরল।

যেটুকু চাহিদা, মিটিয়ে দিলেই এরা তোমাদের হয়ে যাবে। আজই বিধানজ্যেঠুর সঙ্গে আলোচনা করবে। প্রয়োজন পরলে আমি-মা শ্যামদা-শিবুদা-দারুদার সঙ্গে বসবো।

অনিদাকে এই আলোচনার মধ্যে একবারে টানবে না। অনিদা এদের বিশ্বাসের জায়গা। তুমি যেমন অনিদাকে আঁকড়ে ধরে আছ, এরাও। সেখানে যেন অনিদাকে কলুষিত করা না হয়।

মিত্রা দম না নিয়ে এক নিঃশ্বাসে কথা বলেগেল।

আমি ওদের দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে। চক চক করছে মুখ খানা।

তুই তখন বড়োমাদের সঙ্গে ঝোড়ার কাছে বসে কথা বলছিলি। হঠাৎ দারু আমাকে আর তনুকে হাত ধেরে টানতে টানতে একটা জায়গায় নিয়ে গেল। প্রথমে সঙ্কোচ লেগেছিল। তারপর ওর সহজ সরলতার কাছে আত্মসমর্পণ করলাম।

মন্যে একসময় কি খায়ে বাঁচতি দেখবি চ।

তারপর টিলাটার পাশ দিয়ে একটা শরু রাস্তা দিয়ে একটু নিচের দিকে নিয়ে গেল। দেখলাম বিরাট একটা পিঁপড়ের ঢিবি।  আঙুল তুলে বললো, উইটা মোদের একসময় খাবার ছিল। আগে বেবাক দিন খাইতি অখন অনিদা চাল দিছে, ডাল দিছে, অখনো খাই, কম।

আমি দারুর মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম।

ওটা তো পিঁপড়ের ঢিবি!

উর মধ্যে পিঁপড়ের ডিম আছে। মন্যে বাছি বাছি লিয়ে যাইতি। একবাটি দুবাটি হইতো। চালের খুঁদ দিয়ে সিদ্ধ কইরা একবেলা খাইতি। অনিদা একবার দুফুরে একা একা আইসছিল মনকাকে খপর দেয় লাই। এইসে দেখে মন্যে লাই। মন্যে তখন পিঁপড়ের ডিম লিতে আসছি। এঠিনু যায়ে দেখি অনিদা এয়ছে। আমাদের হাতে ওই সব দেখে কেমন গুম হয়্যা গেল। তারপর কইলো, সাইকেলটা নিয়ে আমার সঙ্গে চল। অনিদার মুখের ওপর মন্যে কুনোদিন কেউ কথা বলি লাই।

ঘাটশিলার হাটে গিয়ে এক বস্তা চাইল আনাজপাতি কিইনে দিয়ে ট্রেনে করে কইলকাতা ফিরে গেল। যাওয়ার সময় কয়া গেল, সকলে ভাগ কইরে খাস। আমি আগামী সপ্তাহে আইসবো। মোনকার গেরামে প্রেথ্থম চাউলের বস্তা আইল।

জানিস বুবুন কথা বলতে বলতে দারু কেঁদে ফেলেছিল।

আমি লজ্জা সঙ্কোচ সব জলাঞ্জলি দিয়ে ওর হাতটা চেপে ধরলাম। তনু ওর মাথায় গায়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিল। সে কি ফুলে ফুলে কান্না।

তুই বইল বউমনি, কেনে মন্যে অনিদাকে দেবতা মানবনি। যে মোদের মুখে অন্ন দেয় সে তো মোদের বাপ। মোদের দেবতা। তার অপমান হলে মন্যে ছাড়ি দিব। কখখনো ছাড়বো লাই।

আমি তোকে ঠিক বলে বোঝাতে পারছি না বুবুন। কিন্তু ওই মুহূর্তটা ওর বলা কথাগুলো ভীষণ অনুভব করেছিলাম। তনুর চোখ ছল ছল করছিল। ওকে আবার চোখ দেখালাম। দারুর কান্না থামে না। বেশ কিছুক্ষণ পর দারুর কান্না থামলো। ওদের কতো যন্ত্রণার তুই সাক্ষী। ওরা তোকে কতো ভালোবাসে। ফিরে এসে ছোটমাকে বলছিলাম, সুরো বৌদি এসে পাশে দাঁড়াল, সুরো কেঁদে ফললো। বৌদির চোখ ছলছল করে উঠলো।

কনিষ্ক তখন কফি খেতে খেতে বিষাণকে ডাকল। আবার তোর একটা গল্প শুনলাম।

বার বার বিয়ের দিনের কথাটা মনে পরছিল। সেদিন কনিষ্ক বলেছিল। ম্যাডাম অনির গল্প যদি তোমাদের বলে যাই টানা মাস পাঁচেক সময় লাগবে।

তারপর বিষাণের বেঁচে থাকার ইতিহাস শুনলাম।

ছোটোমা হাসতে হাসতে বিষাণের কান মূলে দিল।

বিষাণ কি খুশি, দিদাই কান মূলেছে।

আমি হাসলাম। সামনের বাঁকেই মোড়লের বাড়ি। এই তল্লাটের মাথা গুরুজন।

আমরা আবার হাঁটতে শুরু করলাম।

হাল্কা একটা হই হই শব্দ ভেসে আসছে।

সুখলাল মুর্মু।

পিসির আপন ভাই। পিসিরা দুই ভাই, এক বোন। পিসি নিঃসন্তান। সুখলালকাকার দুই ছেলে একজন এখানেই থাকে। আর একজন আমাদের গ্রামে। পিসির আর এক ভাই-এর ছেলে শ্যাম।

শ্যামের বাবা বেঁচে নেই শ্যামের খুব ছোটোবেলাতেই সে রোগেভুগে মারা গেছে। কাকার মুখ শুনেছিলাম। তিনিও আমাদের বাড়িতে ধান কাটার মরসুমে কাজ করতে গেছেন।

সুখলালকাকাও গেছেন। তবে কম। শ্যাম শিবুদের মায়েরাও আমাদের বাড়িতে এসেছে।

পায়ে পায়ে সবাই সুখলালকাকার ভিটেতে পা রাখলাম।

একতলা মাটির ছোটো ঘর। খড়ের চাল হুমড়ি খেয়ে মাটির পানে তাকিয়ে।

মোড়লের বাড়ি, তাই ঝকঝকে তকতকে। সামনের বিরাট খামারে উৎসবের আয়োজন।

বড়োমারা মনে হয় শেষটুকু হাঁটতে পারেনি। দোলাগুলো সামনের ফাঁকা জায়গায় রাখা।

কয়েকটা ছেলে ঘেমে ঘুমে একসা। গামছা দিয়ে গা-মুছছে।

ছোটো থেকে বয়স্ক সকলেই এসে প্রণাম করছে। আমার ভলমন্দের খবর জিজ্ঞাসা করছে। সবার মুখেই এক কথা কতদিন পর তোকে দেখছি। হাসি ছাড়া আমার কিছু বলার নেই। সবাই মুখ চেনা। এই মুহূর্তে শত চেষ্টা করেও নাম বলতে পারবো না।

ভিড়টা আমার কাছ থেকে মিত্রা, মিত্রা থেকে তনুর পাশে চলে যাচ্ছে।

আমার সঙ্গে যারা এসেছে, তাদের চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু চেষ্টা করেও এই মুহূর্তে ধরতে পারছি না। তারা যে কেউ অনিদার বোন, অনিদার ছেলে, অনিদার বৌদি, অনিদার মা, অনিদার মাসি, অনিদার জ্যেঠিমনি, অনিদার শালি।

ব্যস্ততা দারু-শ্যাম-শিবুর মধ্যেও। কম বেশি ওরাই সকলকে দেখেছে। এরপর ছুড়কি।

আজ বিষাণ প্রথম সকলকে দেখেছে। সেও ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

আমি, কনিষ্ক, নীরু, বটা, অনিকেত, সাত্যকি ছাড়া এখানে সকলেই নতুন। প্রথম এলো। আতিথ্যের আতিশয্যে তাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। কিন্তু কেউ মুখে একটি কথাও বলছে না। অবাক হয়ে শুধু দেখে যাচ্ছে।

একসময় এখানে ঘন ঘন আসতাম। সকলকে মনে রাখতে পারতাম, নাম জানতাম। আজ প্রায় কুড়ি বছর পর এদের মাঝে এসেছি। এর মধ্যে যে দু-দশবার এখানে এসেছি। তাও সেটা ঘণ্টা খানেকের জন্য। তবে এতদূর আসিনি। ঝোড়ার ওখানে বসে কথা বলেছি নয় স্টেশন চত্বরে। নয় আমার নিজের গোপন আস্তানা। সেখানে অনেকেরই প্রেবেশ নিষেধ। নিজের কাজ সেরে চলে গেছি।

শ্যাম, শিবু, দারু ছাড়া কারুর সঙ্গে সেইভাবে কথাই বলিনি। ওদের কাছ থেকেই সবার খোঁজ খবর নিতাম। মাঝে মাঝে ময়না আর চূড়ার সঙ্গে কথা বলতাম।

ফলে সব কিছুই কেমন যেন চোখের সামনে থেকে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।

আজ উৎসব। চারিদিকে সাজো সাজো রব। শ্যামেদের সঙ্গে সঙ্গে ভালোপাহাড়ের শরীরে, চোখেমুখেও নতুন রঙ লেগেছে। সেও সেজেগুজে নিজেকে সুন্দরী করে মেতে উঠেছে এই উৎসবের অংশীদার হতে।

গোবর মাটি দিয়ে নিকনো খামার ঝক ঝক করছে।

একপাশে সেই বেদি যেখান থেকে বিকেলে উৎসবের সূচনা হবে। চলবে সারাটা রাত।

আতাপচাল বাটার সাদা রঙ রাঙিয়ে তুলেছে বেদী মূলকে। প্রকৃতি পূজোই যে তার মূল উপজীব্য বিষয়। রেখায় রেখায় তা ধরা পড়েছে। এই চিত্র কোনও বিখ্যাত শিল্পীর তুলির টানে ফুটে ওঠেনি।

মা-মাসিদের দেখাদেখি যারা সবে মাত্র যৌবনে পা রেখেছে সেই সব আদিবাসী যুবতীরা তাদের নরম আঙুলের ছোঁয়ায় ফুটিয়ে তুলেছে নিজের মনের মাধুরীকে। ট্র্যাডিসন, ঐতিহ্য শিল্পের ছোঁয়ায় প্রকৃতির বুনো গন্ধ। আজ থেকে যে তাদের নতুন পথ চলা শুরু। নতুন জীবনের গন্ধে-স্পর্শে নিজেকে মিলিয়ে মিশিয়ে রাঙিয়ে নেবে।

সাদা রঙের সঙ্গে সিঁদুরের মিশেল। মাঝে মাঝে হলুদের বুটি বুটি দাগ। কোনও সিনথেটিক কালার নয়। একেবারে প্রকৃতি থেকে আহরণ করা। মাটির দেওয়ালে আলপনার প্রলেপ। চারিদিকে একটা অদ্ভূত বুনো গন্ধ ছড়িয়ে রয়েছে।

শোলার তৈরি হাতে গড়া ঝুমকো, নানা রঙের কাগজের শেকলে চারদিকটা রঙিন।

মিত্রা তনুর সঙ্গে চোখাচুখি হয়ে গেল। ওরা অবাক বিষ্ময়ে তাকিয়ে রয়েছে। প্রতিটা জিনিষ পঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে দেখছে। বুঝলাম এখন শুধু গোগ্রাসে গিলে যাচ্ছে পরে জাবর কাটবে।

সুরেলা মহিলা কণ্ঠে কেউ যেন ধমকে উঠলো, খালি অনি অনি করি মরতিছে, অনি কি তুর বাপ।

পিসীর ফোকলা দাঁতে হাসির শব্দ পেলাম। দিলখোলা হাসির শব্দই বলে দিচ্ছে এ কথা নিকট আত্মীয় ছাড়া কেউ বলছে না। চারদিকে থিক থিক করছে মানুষ।

আমি এগিয়ে গেলাম।

বড়োমারা সবাই উঁচু ঢিবিটার সামনে দাঁড়িয়ে দেখে চলেছে। পিসী, সুখলালকাকা দড়ির খাটে বসে। দু-জনের পায়ের কাছে একটা বছর আঠারোর মেয়ে বসে আছে।

আমাকে দেখে পিসী বলে উঠলো।

কাছকে আয়। সুখলাল তোকে চিনতে পারছেনি।

আমি খাটের কাছে গেলাম। সুখলাল কাকা উঠে দাঁড়িয়ে আমার হাতদুটো চেপে ধরলো।

কেমন আছো।

ভালো লাই। শরীলটা আর মোর বশে লাই।

বয়স হয়েছে।

তা হুছে। মোর থেকে দিদি ভালো আছে।

তুমিও চলো দিদির সঙ্গে একসঙ্গে থাকবে।

সুখলাল কাকা হাসছে। মেয়েটি আমার মুখের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে।

কালো কোষ্ঠী পাথরে কেউ যেন কুঁদেকুঁদে এই নারীমূর্তি তৈরি করেছে। রূপ যেন সারাটা শরীর থেকে ঠিকরে পরছে। চোখে-মুখে অদ্ভূত শীতলাতা। নিরাভরণ শরীরে টক টকে হলুদ রং-এর একটা শাড়ি পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে জড়িয়ে রেখেছে। মাথার খোঁপায় বনফুল। কপালে সিঁদুরের টিপ।

আমার পায়ে হাত ছোঁয়াল। আমি ওর হাতটা ধরে ফেললাম।

হাসির শব্দে পেছন ফিরে তাকালাম।

শিবু-দারু আমার কাছে এগিয়ে এলো।

চিনতি পারিস লাই।

আমি অবাক চোখে ওদের দিকে তাকালাম।

মেয়েটি মুখ নিচু করে মুচকি মুচকি হাসছে।

তুমি বলবেক লাই আকা, অনিআকা মোকে লিজে লিজে চিলুক।

বুঝলাম এখনও ভাষায় ঠিক ঠিক পোক্ত হয়ে ওঠেনি।

শ্যামের মায়াঝি চম্পা। উকে তুই জম্মাতে দেখিস লাই। তাইলে বুঝছু কতদিন আসিস লাই।

আমি চম্পাকে কাছে টেনে নিলাম। তিতির পাখীর মতো নরম শরীরটা থিরি থিরি কাঁপছে। মুখটা লাজে রাঙা হয়ে উঠেছে। চম্পা আমার বুকে আশ্রয় নিল।

ভাইঝি জ্যেষ্ঠ মাসে হুইছে উ পর বৎসর আষাড় মাসে হুইছে।

তোদের?

মোর একটা দারুর দুটা।

ছেলে না মেয়ে?

ছেইলে।

তারা কথায়?

ম্যারাক বাঁধতিছে।

মিত্রা কাছে এসে দাঁড়াল।

তোকে বড়োমা ডাকছে।

একে দেখেছিস? শ্যামের মেয়ে।

চম্পা মুখ নিচু করে হাসছে।

কিরে হাসছিস কেন?

তোর আগে আমার সঙ্গে আলাপ হয়েছে।

চম্পার গালটা টিপে দিলাম ওকে ছেড়ে দিয়ে ধীরে ধীরে সেই উঁচু ঢিবির কাছে এসে দাঁড়ালাম।

শ্যাম দাঁড়িয়ে বড়োমাকে কিছু বলছিল। বড়োমার মনে হয় মন পসন্দ হয়নি। তাই আমার ডাক পড়েছে। কাছে এলাম।

শ্যামেদের অনুষ্ঠান শ্যামই ঠিক মতো বলতে পারে না। বলে মানজিহিতান। বললাম এটা কি বল, বলে অনিদাকে ডাইক সেউ কইতি পারবে।

আমি হেসে ফেললাম।

বলে মোড়লের ঘরে এউটা থাকে।

বড়োমার কথার টানে হেসে ফেললাম।

ঠিক আছে তোমাকে পরে বলবো।

না এখন বল। পরে তুই ভুলে যাবি।

মিত্রা খোঁচা মারলো। বল না। আরও অনেক কিছু দেখেছি। ছেলেরা বিরক্ত করে মারছে।

মিত্রার দিকে তাকিয়ে হাসলাম।

এই জন্য তোকে বলেছি এখানে ঘন ঘন নিয়ে আসবি, তাহলে তোকে আর বিরক্ত করবো না।

মিলিরাও সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কনিষ্করা হাসছে।

বড়োমার মুখের দিকে তাকালাম।

এটা তুলসী মঞ্চ।

তুলসী গাছ কোথায়?

তোমাকে ভেবে নিতে হবে, আছে।

সরো সরো তোমার ওই ইনিয়ে বিনিয়ে জিজ্ঞাসা করাতে কিছু হবে না। ছোটোমা এগিয়ে এলো।

ওদের রকম সকম দেখে আমার হাসি থেমে নেই।

জ্যেঠিমনি, বৌদি, দামিনীমাসি, সোনাআন্টি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

আন্টি, নম্রতা, সুন্দররা শিবুকে নিয়ে পরেছে।

ছোটোমার গলা জড়িয়ে ধরলাম।

দেখো সাঁওতালদের নিজস্ব একটা ধর্ম আছে। সেই ধর্মে এরা পৌত্তলিকতা বিশ্বাস করে না। এরা দেবতা বলতে বোঝে সূর্য আর চন্দ্রকে। এখনো এই বিশ্বাসে এরা বিশ্বাসী।

গোঁজামিল দিবি না। ডিটেলসে বল।

ছোটোমার দিকে তাকালাম।

এরা যে ধর্ম পালন করে তার প্রমাণ ইতিহাসে সঠিক ভাবে পাওয়া যায় না।

আমার দৃঢ় বিশ্বাস এরা যে ধর্ম পালন করে তাতে কিছুটা হিন্দু কিছুটা বৌদ্ধ ধর্মের সংমিশ্রণ।

সুখলালকাকার আগে যিনি মোড়ল ছিলেন তার সঙ্গে একবার এই ব্যাপারে কথা বলেছিলাম। বুড়ো বেশ কিছুটা পড়াশুন জানতো, তাছাড়া পূর্ব পুরুষদের কাছ থেকে শোনা গল্পগুলো আমাকে বেশ সুন্দর করে বলেছিল। আমি তার নির্যাসটা তোমাদের বলছি।

বুড়ো বলেছিলি, আমাদের আদি বাসস্থান ছিল হিহিরি পিপিরি। পরে অনেকের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি। জায়গাটা সম্ভবতঃ ব্যাবিলন।

এদের ধর্ম বিশ্বাস মতে পৃথিবীর আদি মানব দম্পতি পিচলু হরম ও পিচলু বুড়ির সাত জোড়া সন্তান পৃথিবীতে সাতটি সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করে যা হাসডক বা হাসদা, মুর্ম্মু, কিসকু, হেমব্রম, মার্ডি বা মারানডি, মারন্ডি এবং সোরেন বা সরেন সম্প্রদায় হিসাবে পরিচিত। পরে এই সাত সম্প্রদায় আরও পাঁচটি সম্প্রদায় সৃষ্টি করে। এরা হলো বাসকে, বেসরা, পাউরিয়া, চোরে এবং বেদিয়া।

আমাদের যেমন গোত্র আছে সান্ডিল্য, কাশ্যপ, বাৎস্য, আলম্যান, শিব ইত্যাদি। এদেরও কিন্তু এগুলো এক একটা গোত্র হিসাবে বিবেচিত হয়।

এদের মধ্যেও উচ্চ বর্ণ নিম্ন বর্ণ আছে। আমাদের মধ্যে যেমন কুলীন ব্রাহ্মণ, কুলীন কায়স্থ আছে। এদের মধ্যেও সেই ব্যাপারটা আছে। মুর্ম্মু পরিবারের ছেলের সঙ্গে মুর্ম্মু পরিবারের মেয়ের বিয়ে হবে না। কারণ গোত্র এক।

এদের প্রধান আরাধ্য দেবতা হলো সিংবাঙ্গো বা সূর্য। এদের ধর্মীয় উৎসব গুলোর মধ্যে মারাংবুরুর পুজো, বোঙ্গাপুজো, পুষণা, ফাগুয়া… বলতে পারো আমাদের মতো বারো মাসে তের পার্বন।

বাবাঃ এতো!

বড়োমার কথায় সবাই হেসে উঠলো।

আবার শুরু করলাম।

দেখবে একটু গ্রামাঞ্চলে প্রচণ্ড ঝড় ঝঞ্ঝার সময় যখন বিদ্যুৎ চমকায় কড় কড় করে বাজ পরে। গ্রামের ঘরের মেয়েরা তখন শঙ্খ বাজায়। কেন?

তারা ভেবে নেয় পবন দেব রাগ করেছে। তাই পৃথিবীর বুকে এতো ঝড়-ঝঞ্ঝা তখন শঙ্খ বাজিয়ে উলুধ্বনি দিয়ে তাঁকে সন্তুষ্ট করতে চায়। বৃষ্টি হোক কিন্তু যেন এরকম বাজ না পড়ে।

একটু ভাল করে লক্ষ্য করবে, আমাদের যাবতীয় দেবদেবীর সৃষ্টি আমাদের সৃষ্ট ভয় থেকে মুক্তি পাওয়ার লক্ষ্যে। অর্থাৎ শুষ্ঠ স্বাভাবিক ভাবে বেঁচে থাকার জন্য।

বড়োমার দিকে তাকালাম।

তুমি তো বাংলা নিয়ে পড়েছো। মঙ্গলকব্যগুলোর সৃষ্টি এই ভাবে।

আর ধর্মের ব্যাপারটা তৈরি হয়েছে সেই দেশের, সেই অঞ্চলের পরিবেশ পরিস্থিতির ওপর।

বড়োমারা সব বিষ্ময়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

ধরো সুন্দরবন।

ওখানে দেখবে বনবিবির পূজো হয়। মাতৃ-রূপী শক্তি অধিষ্ঠান করছেন বাঘের পিঠের ওপর। কারণ ওখানে বাঘের ভয় বেশী। বাঘের পেটে নিত্য বছর প্রচুর মানুষ মারা যায়। তুমি কোনওদিন তোমার বাড়িতে বনবিবির পূজো করেছো?

বড়োমা আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে।

কখনোই করোনি, আর করবেও না। কারণ তোমার বাঘের ভয় নেই। তুমি শহরের।

ছোটোমার সঙ্গে মিত্রারাও হাসছে।

কেন ওরা বনবিবির পূজো বৎসরান্তে ঘটা করে করে?

ওখানকার মানুষের জীবন জীবিকা সব কিছু নির্ভর করে গভীর জঙ্গলকে ঘিরে।

ডাঙায় বাঘ, জলে কুমীর।

মধু, মাছের মিন ওদের প্রধান জীবিকা। তারপর কাঠ।

অরণ্যের গহণ গহীণে রাখা আছে ওদেরে জীবন জীবিকা।

জঙ্গলে কে আছে বাঘ। অতএব তার হাত থেকে বাঁচার জন্য বনবিবি। তাকে স্মরণ করে যদি বনে যাওয়া যায়, তাহলে বিপদে আপদে বাঘের হাত থেকে বনবিবি রক্ষা করবে।

ঠিক তেমনি সাপের হাত থেকে বাঁচার জন্য মা মনসা।

বণিক চাঁদ সওদাগারের কাহিণী তুমি জান।

চাঁদ সওদাগর শিবের ভক্ত সে কিছুতই মনসার পূজো করবে না। মনসার এক চোখ কানা বলে তাকে কানি বলে গালাগাল দিত। বলতো চ্যাং মুরি কানি।

যাক সে গল্প তোমাদের পরে বলবো।

না তা হবে না। পরে মানেই তুই ভুলে যাবি। তারপর বলবি ও বলেছিলাম বুঝি, হবে হয়তো।

মিত্রার কথায় হেসে ফেললাম।

ঠিক আছে তোকে পরে বলবো।

না তা হবে না।

কেন তুই এমএ-তে মনসার ভাসান পড়িসনি।

তোর মতো ভাল করে পড়িনি। কোশ্চেন-এ্যানসার লেখার জন্য পড়েছিলাম।

অতো হ্যাজাচ্ছ কেন। মুড নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সুরো সামনে এসে দাঁড়াল।

পরে বলেছি দাঁড়া না।

আজ হাতির পালটা দেখেছিলে।

বড়োমা মুখের দিকে তাকাল।

একটু ভাল করে আমার কথাটা ভেবে দেখবে। আমি যা বলছি সেটাই যে বেদবাক্য তা নয়। তবে আমাদের যা কিছু শিক্ষা-দীক্ষা তা কিন্তু এই বনের পশুদের কাছ থেকে। এমনকি সেক্সটাও তার বাইরে নয়। আমি বিশ্বাস করতে বলছি না শুধু ভাবতে বলছি।

তোমরা যদি হাতির পালটা ভাল ভাবে দেখে থাকো দেখবে সব চেয়ে সন্ডাগন্ডা হাতিটা সবার সামনে। সে সবাইকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তার পেছন পেছন সবাই। কথ্য ভাষায় তুমি তাকে পালের গোদা বলতে পার। কিংবা মোড়ল।

কেন?

তাকে বাকি সব হাতির পাল দলপতি বলে স্বীকার করে নিয়েছে।

দলের সে সবচেয়ে বয়স্ক এবং অভিজ্ঞ।

বলতে পারো ওই পঞ্চাশ-ষাট জনের সংসারে সে গৃহকর্তা। তার ওপরে সংসারের অনেক কিছু নির্ভর করে। যেমন দাদাকে তুমি, আমি, ছোটোমা, আমরা সকলে মানি।

বড়োমা মুচকি হাসলো।

তারমানে তুমি ভেবে নিও না আমি দাদাকে পালের গোদা বলছি। নিজেই হেসে ফেললাম।

তখন তোমাদের কথায় কথায় বলেছিলাম এই হাতির পালটা দলমা থেকে নেমে এসেছে।

কেন?

সেখানে এখন খাবারের ভীষণ আকাল। খরা চলছে। বৃষ্টি নেই। খাবার ছাড়া বাঁচবে কি করে। তাই যেখানে খাবার পর্যাপ্ত সেখান তারা যাচ্ছে। সেই পথটা চেনে এই অভিজ্ঞ হাতিটা তাই তার পেছন ধরেছে বাকি হাতির দল। রাস্তায় বিপদ-আপদ হলেও সামলাবে সে।

ওদের মধ্যেও নিয়ম শৃঙ্খলা আছে। আছে আইন-কানুন। সেটা আমাদের থেকে বেশি।

সুখলাল কাকা এখানকার মোড়ল। কারণ এই সম্প্রদায়ের সে সবচেয়ে অভিজ্ঞ মানুষ।

আর এই মোড়লরাই এই সম্প্রদায়ের শেষ কথা। এরা কোর্ট-কাচারির ধার ধারে না। মোড়ল যা বিচার করে দেবে সেটাই সকলকে মানতে হবে।

না মানতে পারলে তোমাকে সমাজ থেকে সরে যেতে হবে।

এদের যা কিছু পালা-পাব্বন তার সূচনা হবে মোড়লের বাড়ি থেকে। তার সমাপ্তিও হবে এখানে এসে। তাই মোড়লের বাড়িতে তৈরি করা হয় এই পবিত্র নিশানা।

মানজিহিতান সেই পবিত্র ঢিপি বা নিশানা।

মানজিহিতান কথার অর্থ কি দাদা। সুরো বলে উঠলো।

আক্ষরিক অর্থ কি কিংবা কোথা থেকে এর উৎপত্তি বলতে পারবো না। যারা গবেষক তারা এই নিয়ে হয়তো পাতার পর পাতা ব্যাখ্যা দিয়েছে। আমি যা উপলব্ধি করেছি তা বলতে পারি।

সুরো আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

মান্যগণ্য মানুষের বাসস্থান। সমাজপতি।

সুরোর চোখে মুখে খুশির ঝলক।

আর একটা প্রশ্ন করবো।

বল।

আমাদের আচার অনুষ্ঠানে দেখেছি আম, বট, অশ্বত্থ গাছের পাতা পবিত্রতার নিশানা। এখানে এসে যেদিকে তাকাই সেদিকেই দেখছি শাল পাতা।

এই আচার অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়েই আমরা সেই অঞ্চলের ভৌগলিক পরিবেশ, সেখানকার মানুষের আচার-ব্যবহার তাদের সমাজিক অবস্থান বুঝতে পারি।

এখানে তুই শাল, সেগুন, মেহগিনি, মহুয়া ছাড়া বিশেষ আরও কোন গাছ দেখতে পাবি না। এদের মধ্যে শালগাছের আধিক্য এখানে সবচেয়ে বেশি। তাই এদের মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে শাল পাতার প্রাধান্য বেশি করে পাবি।

তুই কখনও কোজাগরী লক্ষ্মী পূজোয় লক্ষ্মী ঠাকুরকে মাছ ভাত খেতে দেখেছিস?

না!

কিন্তু বাংলাদেশে বেশ কিছু অঞ্চল আছে তারা লক্ষ্মী ঠাকুরকে মাছ ভাত খেতে দেয়। কেন?

সেখানেও আঞ্চলিকতা, পরিবেশ।

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। ফল মূলের জায়গায় মাছের উৎপাদন বেশি। লক্ষ্মী এখানে দেবতা নয়। তিনি আমাদের ঘরের মেয়ে। অতএব আমরা নিত্যদিন যা খাওয়া-দাওয়া করি লক্ষ্মীও তাই খাবে। মাছের ব্যঞ্জনা তাই লক্ষ্মীর ভোগ বলতে পারিস প্রসাদও বলতে পারিস।

চলবে —————————–



from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/uoTiDUG
via BanglaChoti

Comments