❝কাজলদীঘি❞
BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়
১৯৬ নং কিস্তি
—————————–
তুমি দেখ, পাতে এখনও একটা করে পরে আছে।
সুরো মাম্পি, মিকির দিকে তাকাল। ওরা আমার কোলে ঢুকে পড়েছে। মিটি মিটি হাসছে।
মিকি আমি ফার্স্ট গাড়ি চালাব। মাম্পি বললো।
আমি মাম্পির দিকে তাকিয়ে হাসলাম। ইসারা করলাম, পিঠে গুম গুম।
মাম্পি মাথা দোলাচ্ছে। না।
সুরো হাসছে।
তোমরা চা পেয়েছ।
ডাক্তারদাদার দিকে তাকালাম। আমি চায়ে চুমুক দিলাম।
না পাওয়ার মতো।
প্রবীরদা, রূপায়ণদা, অনুপদা এসে চেয়ার দখল করে বসলো।
প্রবীর তুমি যাবে না? ছোটোমা রান্নাঘরের সামনে থেকে বললো।
একটু চা খেয়ে যাই।
তোমার টেনসন মিটল।
এতো সহজে মেটে।
অনুপদা, রূপায়ণদা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
মাম্পি, মিকি অনবরতো খুনসুটি করে চলেছে।
এই বেরো ওখান থেকে। সুস্থির ভাবে একটা মানুষকে বসতে দেয় না। সুরো বললো।
তোদের সবাইকে দেয় শুধু ওকে দেয় না। অনুপদা বললো।
এই ভেঞ্চারটা কতদিনের। দাদা বলে উঠলো।
এই তুমি সব গুবলেট করে দিলে এডিটর। তোমাকে বলে বলে মুখ ব্যাথা হয়ে যাবে। ডাক্তারদাদা রাগতোস্বরে বলে উঠলো।
দাদা হাসছে। অনুপদারাও জোরে হেসে উঠলো।
তোমার আর বুদ্ধি কবে হবে বলো তো?
হাসতে হাসতে রূপায়ণদা, ডাক্তারদার দিকে হাত তুলেছে। থামুন থামুন।
এই জন্য বান্ধবী এত খ্যাঁক খ্যাঁক করে।
ডাক্তারদার চোখে মুখে বিরক্তির অভিব্যক্তি।
কতবার বলেছি, তাস বাঁটা হয়ে গেছে। ফার্স্ট কল ওর। ও যদি কল করে তারপর আমরা কল করবো, না হলে তাস হাতে নিয়ে চুপ চাপ বসে থাকবে। দিলে সব গুবলেট করে।
সোনা আন্টি হেসে উঠলো।
বৌদি, ছোটোমা, দামিনীমাসি রান্নাঘরের সামনে থেকে এগিয়ে এল।
শুনিনা ওর কলটা কি? জানার জন্য তোমার পেট ফুলে যাচ্ছে। প্রবীরদের ইচ্ছে করে না। যত্তো সব।
ডাক্তারদাদা দাদার মুখের দিকে তাকাল। দাদা হাসছে। নির্মল হাসি।
তুমি হাসছো। ও তো ওর পেটেন্ট ডায়লাগ আওরাবে। বাহান্ন কার্ডের মধ্যে ছেচ্চলিশ কার্ড তোমাদের। ছটা কার্ড আমার। গেম আমি উইন করব। সেই ছটা কার্ড তুমি জানতে পারবে?
মল্লিকদা শরীর দুলিয়ে হাসছে।
তোমার জানার ইচ্ছে আছে, আমার নেই। সোনা একটা কথাও বলেছে। ছোটো, দামিনী, সুতপা, ম্যায় অনিমেষ, বিধানবাবু ব্যাপারটা নিয়ে এতক্ষণ কোনও কথা বলেছে।
সামন্তদা এবার থামুন।
না অনুপ, বুঝিয়ে সুঝিয়ে এডিটরকে আর কিছু হবে না। সত্যি, বান্ধবী মাঝে মাঝে বলে না। তুমি কি করে কাগজের এডিটর হলে ধন্ধে পরে যাই। মাঝে মাঝে বান্ধবী মরন বলে চেঁচিয়ে ওঠে না—, একবারে ঠিক কথা বলে বান্ধবী।
কিগো ডাক্তার এতো তরপাচ্ছ কেন, নিশ্চই ও ফুস করেছে।
পেছন ঘুরে দেখলাম বড়োমা, জ্যেঠিমনি ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
স্নান, পূজো সেরে একবারে রেডি।
আমি মুচকি হাসলাম। প্রবীরদারাও হাসছে।
সবাই চা খাচ্ছে।
দাদার মুখে অমলিন হাসি। এত কথা ডাক্তারদা বললো, গায়েই মাখছে না।
যততো সব। বড়োমা গজ গজ করতে করতে রান্না ঘরের দিকে চলে গেল।
ছোটোমা, বৌদি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।
তনু হুইল চেয়ারে মাসিমনিকে বসিয়ে এ ঘরে এলো। পেছনে তিন্নী, ইসি।
প্রবীরদারা উঠে দাঁড়িয়েছে।
মাসীমনি হাত দেখিয়ে বললো। বসো।
হুইল চেয়ারটা ঠিক আমার পাশে নিয়ে এসে রাখল।
তোমরা সবাই খুব হাসাহাসি করছিলে। মাসিমনি বললো।
আর বলবেন না। ডাক্তারদা বলে উঠলো। এডিটরকে নিয়ে পরা যাবে না।
আমি মাসিমনির দিকে তাকিয়ে হাসলাম। একটা বড়া মাসিমনির মুখের সামনে তুলে ধরলাম।
শরীরে সইবে না।
সইবে সইবে। তখন সুরোর কথা শুনলে না। আমি তোমার অক্সিজেন। মাস খানেক সময় দাও সবাই মিলে তোমকে দাঁড় করিয়ে দেবে। দেখছো, পাশে চিফ মিনিস্টার বসে রয়েছে।
মাসিমনি আমার হাত থেকে বড়াটা নিল।
মাম্পি, মিকি মাসিমনির দিকে তাকিয়ে।
এদের দেখেছো?
সকালে স্কুল যাচ্ছিল।
তোমাকে শেষবার গিয়ে এদের কথা বলেছিলাম।
মাসিমনি হাসছে।
ওদের গালটা টিপল।
উঁ। মাম্পি হাত সরিয়ে দিল।
মাম্পি আমার মুখের দিকে তাকিয়েছে।
এটা একটা নতুন দিদা।
ক্যাণ্ডি দাও।
তুই পাবি না।
বৌদিরা হাসছে।
সুরো দুটোর মুখে ভাতের দলা গুঁজে দিল। মাসিমনির দিকে তাকালাম।
এদের সব বলেছো।
মাসিমনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
একসময় চুটিয়ে রাজনীতি করেছ। একটা গোটা জেলা তোমার দায়িত্বে ছিল….।
একটু থামলাম।
দাদা তোমার পূর্ব পরিচিত। একবার নয় বহুবার তোমার সঙ্গে সাক্ষাত হয়েছে।
নাম ছাড়া সেই সময়কার দাদার সঙ্গে আর কিছু মিল খুঁজে পাবে না।
দাদাও হয়তো তোমাকে নামে মনে রেখেছে। হয়তো ভুলে গেছে। সবটাই গল্প, বুঝলে।
জীবন ছাড়া গল্পের কোনও অস্তিত্ব নেই। মাসীমনি বললো।
আবার একটু থামলাম। চায়ের কাপে চুমুক দিলাম।
চা খাবে।
খেয়েছি।
আর একটু খাও। এ বাড়িতে চা-টা জলের মতো খাওয়া হয়। কম বেশি সবাই কাগজের লোক। তাই অভ্যাসটা তৈরি হয়ে গেছে।
মাসীমনি হাসছে।
দিদি একটু আনি। ছোটোমা বললো।
আনো। ও যখন বলছে।
মাসিমনিকে দুটো বরফিদাও ছোট। ইকবালভাই বললো।
মাসিমনি পেছন ফিরে ইকবালভাই-এর দিকে তাকাল।
কখন এলে?
এই তো মিনিট পনের হবে।
বসো।
অনির কথা শুনছি।
ও ওর প্রপিতামহের মতো খুব ভাল গল্প বলতে পারে। আমরাও খুব ছোট সময় যখন ওদের বাড়িতে দল বেঁধে যেতাম ওনার গল্প শুনে মহিত হয়ে যেতাম।
নাম কি? দাদা বললো।
রায়গুণধর বনমালী ব্যানার্জী।
মাসিমনি দাদার দিকে তাকিয়েছে।
উনি তো বৈষ্ণব পদাবলীর বিখ্যাত মানুষ! মঙ্গলকাব্যগুলো সংশোধন করে লিখেছিলেন!
হ্যাঁ। কৃষ্ণনগরের রাজা তাই ওনার কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ রায়গুণধর উপাধি দিয়েছিলেন।
দাদা মাসিমনির মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
সবাই কেমন নড়ে চড়ে বসলো। ছোটোমা চা, বরফি, দুটো পনিরের বড়া এনে দিল। সকলে ঘিরে ধরেছে। প্রবীরদাদেরও দিল। বড়োমা, জ্যেঠিমনি এসে আমার পেছনটাতে দাঁড়িয়েছে। রূপায়ণদারা একদৃষ্টে মাসিমনির মুখের দিকে তাকিয়ে।
আমরা তখন ক্লাস থ্রি-ফোরে পরি।
সন্ধ্যে হলে অন্ধকার। খুব ভূতের ভয় ছিল আমাদের।
রেড়ির তেল, সরষের তেলের বাতি জলতো। সাড়ে সাতটা আটটা বাজলেই খেয়ে-দেয়ে শুয়ে পড়তে হবে। রাতে ভাই-বোনেরা সকলে দাদুর পাশে শুয়ে গল্প শুনতাম।
এত খাব না ছোট।
মাসিমনি খুব আস্তে আস্তে কথা বলছে।
ঠিক পারবেন। না পরলে খাওয়ার মতো প্রচুর লোক আছে।
মাসীমনি হাসছে। মিত্রার দিকে তাকাল।
তোরা একটু সাহায্য কর।
তুমি একটু নাও তারপর আমরা খাচ্ছি।
মাসিমনি বরফির একটু খানি ভেঙে মুখে দিল।
উনি খুব সাত্ত্বিক মানুষ ছিলেন। বৈষ্ণব ধর্মে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু বাড়িতে সব ধর্মের লোকের আনাগোনা ছিল। কতো সুফী-সন্ত মানুষকে সেই সময় দেখেছি। কিছু মনে পরে, কিছু ভুলে গেছি। কৃষ্ণনগরের রাজ পরিবারের সঙ্গে ওনার খুব ভালো যোগাযোগ ছিল।
মাসি চায়ে চুমুক দিল।
অনিকে দেখে মাঝে মাঝে ওনার কথা মনে পড়ে যায়। ওঁর মুখশ্রীর সঙ্গে ওর যথেষ্ট মিল।
আমি মাসিমনির মুখের দিকে তাকালাম।
জল মেশাবে না।
সবাই হেসে ফেললো।
তুই জল মেশাস, আমি মেশাই না।
আমার তবু ফিল্টার করা। শরীরের পক্ষে ক্ষতিকারক নয়। তোমরটায় শরীর খারপ করতে পারে।
প্রবীরদারা হেসেই যাচ্ছে।
কিছু বুঝছ এডিটর। তোমার তের কার্ড বাজেয়াপ্ত হয়ে গেছে। এক পিঠও পাবে না।
মাসীমনি ডাক্তারদার দিকে তাকিয়েছে। মল্লিকদা হাসছে।
আপনি জানেননা দিদি ও কতটা গভীর জলের মাছ। ডাক্তারদাদা বললো।
সামন্তদা আমরা ভুক্তভোগী। অনুপদা বললো।
প্রথম দিন ওকে দেখে অনুমান করেছিলাম। আমার মত একটা বিস্মৃতপ্রায় মানুষকে নিয়ে যে পার্টির ইতিহাস লিখতে চায়। সে যে সাধারণ নয় সেদিনই বুঝেছিলাম।
তবু কেন যেন মনে হল একটু বাজাই।
ওটাই আমার বড়ো ভুল হয়েছিল। আর ওকে ধরতে পারলাম না। নিজেরটা গুছিয়ে কেটে পরলো। তারপর লোকের মুখে খোঁজ খবর নিই। সবাই বলে এই নামে একজন ছিল এ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। মনে মনে ভাবলাম যদি কোনওদিন ওর সঙ্গে আবার সাক্ষাৎ হয় জিজ্ঞাসা করবো। ইচ্ছে করেই ওর দেওয়া ঠিকানয় চিঠিপত্রে যোগাযোগ রাখলাম।
দ্বিতীয়বার সাধুর বেশে এসে হাজির।
মাসীমনি আমার দিকে তাকাল। আমি মুচকি মুচকি হাসছি। সব স্বীকার করলো। তবে ফিল্টার করে।
মাসিমনি থেমে থেমে খুব আসতে কথা বলছে। মুচকি মুচকি হাসছে।
এর মধ্যে যে কয়দিন আমার কাছে গেছে। বেশ ঝকঝকে লাগত। কালকে কেন জানিনা ওর চোখমুখটা ভালো লাগেনি। ভাবলাম ঘটনাটা ঘটিয়েছে। তাই হয়ত মনটা ঠিক নেই। আগামী সপ্তাহে আসবে বলেছে। তখন একবার জিজ্ঞাসা করব। সকালে মিত্রাকে দেখে বুকটা কেঁপে উঠেছিল।
কেন এতদিন ও তোমার কাছে যায় তা বোঝনি? বড়োমা বললো।
ও আমাকে বিশ্বাস করিয়েছিল, ও বিধানদাকে আমাকে খুশী দেখতে চায়।
বড়োমা হাসল। প্রবীরদারাও হাসছে।
দেখো ও কিন্তু মনাবাবু, অধীপ, অনিন্দিতার কথা আমাকে বলেছে। আমি বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছি ও ওই গ্রামের ছেলে। ও প্রথমবার চলে যাবার পর দুটো চিঠি লিখেছিলাম মনাবাবুর নামে। প্রথমটা উত্তর না পেয়ে দ্বিতীয়টা লিখেছিলাম। তারপর আর লিখিনি।
আজ সকালে ওই চিঠি দুটো মিত্রা দেখাল।
ও জানতো ও এমন কিছু কথা আমার মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে। আমি জানার উৎসাহে ওখানে চিঠি লিখতে পারি। লিখেওছি। ও তো দেশে ছিল না। কে পৌঁছে দিল ওই চিঠি ওর কাছে বলো।
একটু অপেক্ষা করো, সেই মর্কটটাকে দেখতে পাবে। বড়োমা চেঁচিয়ে উঠলো।
মাসি হাসছে।
ওর অনেক কীত্তি, গুণে নুন দেওয়ার জায়গা নেই।
আমি বড়োমার দিকে তাকালাম। গম্ভীর হয়ে বললাম।
কথাটা আঁচলে গিট্টু দিয়ে রাখো। সময়ে জবাব পাবে।
ছোটো ওকে ঘা দু-চার দে তো।
কেন তুমি তো পাশে দাঁড়িয়ে আছ।
মিত্রা, তনু খিক খিক করে উঠলো।
ছোটোমা, বৌদি মুচকি হাসছে।
আমি মাসিমনির দিকে তাকালাম।
ওষুধ খেয়েছ?
মাসিমনি মাথা দোলাল। না।
আজ সব গড়বড় হয়ে গেল।
হোক।
ডাক্তারদাকে সমস্যাগুলো বলেছো।
তোকে কেউ সাউকিরি করতে বলেছে। ছোটোমা খ্যাড় খ্যাড় করে উঠলো।
বাবাঃ দলটা বেশ পাকাপোক্ত হয়েছে মনেহচ্ছে।
কতোবার বলেছি ছোটো তোমরা ওর কথায় রিঅ্যাক্ট করবে না। তাহলেই ধরা পরে যাবে। ডাক্তারদাদা বললো।
অনুপদারা আবার জোরে হেসে উঠলো।
মাসীমনি আমার পিঠে হাত রেখেছে। মুচকি মুচকি হাসছে।
তুই ওদের সঙ্গে এইরকম করিস।
আমি মাসীমনির দিকে তাকালাম।
বিশ্বাসযোগ্যতার মাপকাঠিগুলো ফেরত এনেছ না রেখে এসেছো।
মাসিমনি আমার মুখের দিকে তাকাল। হাসি হাসি মুখটায় অনেক না বলা কথা।
আমিও চোখের থেকে চোখ সরালাম না।
সঙ্গে আছে। চাইলে ফেরত দেব। তোর কাছে থাকা যা, আমার কাছে থাকাও সেই এক ব্যাপার।
ডাক্তারদাদা খুব জোড় হেসে উঠলো। একমাত্র ডাক্তারদাই হাসছে। আর সবাই ডাক্তারদাদার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সবাই একবার আমাকে, মাসীমনিকে দেখে একবার ডাক্তারদাদাকে দেখে।
রূপায়ণদারা এবার একটু অবাক হয়েছে।
আমি মুচকি মুচকি হাসছি। মাসিমনির স্নেহের হাত আমার পিঠে।
সত্যি দিদি ওকে আপনি চিনে ফেলেছেন। আপনি ওর গোড়াটা ধরে ফেলেছেন।
আমি পেটে ধরিনি তো কি হয়েছে, আমার মায়ের পেটের বোন ওকে পেটে ধরেছে। রক্তটা যাবে কোথায়।
আমি হাসছি।
দেখুন আপনার আর অনির কথা এরা কেউ ধরতে পারেনি। ফলো করেনি।
ডাক্তারদাদা হাসতে হাসতেই বললো।
ও প্রত্যেকটা কথায় খুব রূপক ব্যবহার করে। একটা শব্দের অনেক অর্থ। চট করে কেউ ধরতে পারে না। ব্যাপারটা এরকম তুমি যেটা ভাবতে পার।
একটু বড়ো হয়ে আমার বাবার মুখে গল্প শুনেছি, বনমালী দাদুর যারা সমসাময়িক ছিলেন তাঁরা যখন গড়গড়া নিয়ে বৈঠকী মেজাজে আড্ডায় বসতেন, কবিতায় কথা বলতেন।
ভাবতাম এরকমটা সম্ভব নাকি!
ওনার কিছু হাতে লেখা পুঁথি এখনও আমার কাছে আছে। সেগুলো পড়লে বোঝা যায় এইভাবে কথা বলা সম্ভব। রূপক শব্দগুলো স্টক থাকতে হব। সঠিক ভাবে ব্যবহার করতে জানতে হবে।
আমি মসিমনির দিকে তাকালাম।
আজ থেকে তুই আমাকে যতটা দিবি, আমি ঠিক ততটাই তোকে ফেরত দেব।
দেওয়া নেওয়ার মধ্যে আমি নেই। আমি খুব স্বার্থপর। হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়ালাম।
যাচ্ছিস কোথায়?
মসিমনি আমর হাতটা ধরেছে।
আমি মাসিমনির মুখের দিকে তাকালাম।
তোর ছেলেরা তাদের কাজ সঠিক জায়গায় পৌঁছে দিয়েছে।
এবার প্রবীরদারা খুব জোড়ে হেসে উঠলো।
ডাক্তারদাদা হেসেই যাচ্ছে। দাদা, মল্লিকদাও হাসছে।
এরা খেতে দেবে না। একটু ঘুমিয়ে পরি।
রমেশদা ভাল মানুষ ছিলেন। তার ছেলেটা বদ তৈরি হয়েছে। সবাই ভাল হয় না। কেউ কেউ একটু বেশি নিজের স্বার্থ দেখে। তুই কি করবি।
প্রবীরদার মুখের দিকে এক ঝলক তাকিয়েই মাসিমনির মুখের দিকে তাকালাম।
বাবাঃ তুমি তো অনেক খবর জোগাড় করে ফেলেছ দেখছি?
মাসিমনি হাসছে।
গোড়ায় এতদিন কেউ জল দেয়নি। তাই গাছটা শুকিয়ে গেছিল।
আজ জল পেল তাই কচি পাতা বেরিয়েছে।
মাসীমনি আমার মুখের দিকে হাসিহাসি মুখে তাকিয়ে।
বেশি ঝামেলা করে শরীরটা আর গড়বড় করো না।
তারও ব্যবস্থা তুই করেছিস।
মিত্রার দিকে তাকালাম। তারপর মাসিমনির দিকে।
খুব ভাল ব্রিফ করেছে।
অন্যায় করেছে।
আমি মাসিমনির দিকে হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে।
তুই ওদের সামনে একটা স্বচ্ছ পর্দা ফেলে রেখেছিস। ওদের দোষটা কোথায় বল।
এদের চোখমুখ দেখছো। তোমার আমার কথা শুনে এরা ঘাবড়ে যাচ্ছে।
ডাক্তারবাবু, প্রবীররা ঘাবড়ায় নি। ওরা ঠিক বুঝে ফেলেছে।
ডাক্তারদাদা, তোমার জুড়িদার পেয়ে গেছ। এবার সবকিছুর মুস্কিল আসান হয়ে যাবে।
আমি ডাক্তারদাদার মুখের দিকে তাকালাম।
শুধু আমার একার? প্রবীর, অনুপ, রূপায়ণ বাদ যাবে কেন।
রাখ, রাখ, রাখ, রাখ। চাঁদের গলা পেলাম।
কেন? রতনের গলা।
হাত পুরে যাচ্ছে।
তোকে বললাম একটা ন্যাকড়া নে। নিলি না কেন।
তুই তো নিজেরটা গুছিয়ে নিলি।
একে দেরি হয়ে গেছে। বড়োমা ঝ্যাঁটা মেরে বাড়ি থেকে বিদায় করবে।
ওদের কথা শুনে বড়োমা হাসতে হাসতে গেটের দিকে এগিয়ে গেল। ইসলামভাই, ইকবালভাই বড়োমার পেছন পেছন এগিয়ে গেছে।
দিদি, ফসকে বেরিয়ে গেল। ডাক্তারদাদা হাসতে হাসতে বলে উঠলো।
মাসিমনি হাসছে।
আমি মাসিমনির গলা জড়িয়ে ধরলাম।
বিনয়দা, তিতাস আসল না?
ইউনিভার্সিটি গেছে। আজ তিতাসের ফর্ম ফিলাপ।
রতনরা বেশ কয়েকটা বড়ো ডেচকি নিয়ে এসে ঘরের এক কোনে রাখল।
বড়োমা, বোচনরা কোথায়? রতন বললো।
ওপরে আছে।
রতন আমাকে দেখেও দেখল না।
প্রবীরদাদের দিক তাকিয়ে একবার হাসল।
বারান্দায় বেরিয়ে বোচন বলে তারস্বরে চিৎকার করলো।
চাঁদ আমার দিকে তাকিয়ে একবার হাসল।
বড়োমা শালপাতা ভাল পাইনি। কলা পাতা নিয়ে এসেছি। আবিদ বললো।
পরিষ্কার।
একটু ধুয়ে দিচ্ছি।
ভজুকে ডাক।
আসবে না বললো। শাকতলায় জল দিচ্ছে।
তখন থেকে এসে ও এই কাজ করছে!
তুমি জান না!
দামিনীমাসি হাসছে।
মিত্রা যা না মা ছেলেটাকে ডাক। কি পাগল ছেলে বল।
আমি আবার উঠে দাঁড়ালাম।
মাসিমনি আমার হাতটা ধরলো।
তুই বোস তোকে যেতে হবে না। ওরা ঠিক গুছিয়ে করে নবে।
ছোটোমা, বৌদি, দামিনীমাসি, আমার দিকে তাকিয়ে জোড়ে হেসে উঠলো। জ্যেঠিমনি চুপচাপ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
তিন্নী। মাসিমনি ডাকল।
তিন্নী কাছে এগিয়ে এল।
বিনয়ের সঙ্গে কথা বলেছিস?
মিত্রাদির সঙ্গে কথা হয়েছে।
কখন আসবে বললো?
সময় হয়ে গেছে।
এখন আমার যে ওষুধটা খাওয়ার কথা দে।
কনিষ্কদা বারন করেছে। বিকেলে তোমাকে কি সব চেকআপ করবে। তারপর নতুন ওষুধ দেবে।
তোরা এতো বোকা কেন? মাসির চোখে-মুখে বিরক্তি। তিন্নীর মুখ থমথমে।
তিন্নী মাসিমনির মুখের দিকে তাকিয়ে। একটু অবাক।
আমারই ভুল হয়েছে। মাসি স্বগতোক্তির স্বরে বলে উঠলো।
ঠিকই তো, তোরাই বা এত-সত বুঝবি কি করে।
আমি ডাক্তারদার মুখের দিকে তাকালাম।
ঠিক আছে তুই যা।
মাসিমনি তিন্নীর মুখের দিকে তাকাল।
তিন্নী মন খারপ করে লাভ নেই। এদিকে আয়। ছোটোমা বললো।
তিন্নী মুখটা শুকনো করে ছোটোমার দিকে এগিয়ে গেল।
দিদি, বড়দির ঘরে আপনার জায়গা করি।
তোমাদের সঙ্গে খাব।
আমাদের অনেক দেরি হবে।
তখন অতগুলো কচুরী খাওয়ালে।
কথা বলতে বলতে মাসিমনি আমার দিকে তাকাল।
তুই তো দেরি করে উঠলি। মিত্রা, তনু তোর ভাগেরটা খেয়ে নিয়েছে।
আমি হাসছি।
আপনি বরং খেয়ে একটু শুয়ে পরুন।
আজ আর শুতে ভালোলাগছে না ছোট।
এবার সব আসতে শুরু করবে। তখন আপনার ঠিকমত খাওয়া হবে না।
দাদা আপনারা খাবেন না।
মাসিমনি দাদাদের দিকে তাকাল।
আমরা এখানে বসে পরবো। দাদা বললো।
ছোটো তাহলে এখানে দাও সবাইকে।
ছোটোমা তাকিয়ে আছে মাসিমনির দিকে।
কিছু হবে না। তুমি দাও না। মাসিমনি হাসছে।
তোমরা খাওয়া-দাওয়া করো, আমি একটু গড়িয়ে নিই।
আমি উঠে সোজা বারান্দায় চলে এলাম।
আমার ঘর থেকে তনু, মিত্রা, ইসি বেরল।
রতনরা বাগানে চেয়ার পেতে গোল হয়ে বসেছে। আমার দিকে তাকাল।
এই ঘরে ঢুকছো? রতন বললো।
মাথা দোলালাম।
যাও যাচ্ছি।
মিত্রা পথ আগলে দাঁড়াল।
এ ঘরে কি করতে ঢুকছিস।
একটু শুই।
যা তোকে শোয়াচ্ছি। তনু আমার মুখের দিকে ডাগর চোখে তাকিয়ে। ইসি হাসছে।
ঘরে ঢুকলাম।
বিছানার চাদরটা বেশ টান টান করে পাতা।
টেবিলের ওপর থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা নিয়ে একটা সিগারেট বার করলাম।
দেশলাইটা নিয়ে সোজা চলে এলাম জানলার ধারে।
আজকে আর ওপাশটা গেলাম না। পেছন পাশের জানলার ধারে এলাম।
পেছন দিকটা অনেকটা ফাঁকা জায়গা।
একটা বড়ো জামগাছ একটা কাঁঠাল গাছ একটা আমগাছ। তাতেই পেছন দিকের অংশটা ঢাকা পরে গেছে। সামনের আমগাছটার থেকেও এটা বেশ বড়ো। এই গাছেই একটা বড়ো মৌচাক আছে। ভানু আগের বার এসে মধু পেরেছিল।
এছাড়াও ছোটো-বড়ো অনক গাছ। দাদা তার খেয়াল খুশি মতো এক সময় পুঁতেছিল। এখন এদের দেখভালের দায়িত্ব ভজুরামের। প্রথম দিন যখন ওকে নিয়ে এসেছিলাম সেদিন এই বাড়িতে মাত্র চারটে প্রাণী গেটে ছগনলাল। আমি, মল্লিকদা, দাদা না থাকর মতো।
তাও দাদা, মল্লিকদা রাতে ফিরত। আমি কোনওদিন ফিরতাম, কোনওদিন ফিরতাম না।
সেই ভজু আস্তে আস্তে সমস্ত দায়িত্ব ধীরে ধীরে বুঝে নিয়েছে।
এখন বড়োমা, ছোটোমা ভজুছাড়া কানা। ভজু এই বাড়ির আনাচে-কানাচে কি আছে না আছে সব জানে। ও এই পরিবারের একজন হয়ে উঠেছে।
বোচন, বুঁচকির ভজুমমা। অনিকারাও ভজুকে অন্যচোখে দেখে।
প্রথম দিন এ বাড়িতে পা দেওয়ার পরই দাদা ওকে বাগানের দায়িত্ব দিয়েছে।
বাগানের শেষ প্রান্তে দেয়াল ঘেঁষে নতুন নতুন অনেকগুলো মাচার মতো দেখছি।
ওগুলো কি? এখান থেকে ঠিক ধরতে পারছি না।
আবিদ বললো, ভজুদা শাকতলায় জল দিচ্ছে। ও তো দেখছি মাচার মধ্যে ঢুকে কি সব ছেঁড়া ছিঁড়ি করছে। মনে হচ্ছে আগাছাগুলো ছিঁড়ে একজায়গায় জড়ো করছে।
ভানু এসে মাঝে শাকতলা তৈরি করে দিয়েছিল।
ভজু। চেঁচিয়ে ডাকলাম।
একবার পেছন ফিরে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। ঘেমে নেয়েগেছে। গেঞ্জির হাতায় মুখটা মুছে ওখান থেকেই চেঁচাল।
দাঁড়াও যাচ্ছি।
ভজুকে দেখে মাঝে মাঝে বুকের ভেতরটা টন টন করে। আমারই বয়সী। খুব বেশি হলে আমার থেকে বছর দেড়েকের ছোট।
প্রথম দিন ওকে দেখেই কেমন যেন লেগেছিল। অতোবড়ো ছেলে। হাফ প্যান্ট খালি গা। মুখ দিয়ে কেমন লালা গড়িয়ে পরছে। চলা-ফেরা কথাবলা কেমন যেন অস্বাভাবিক। কেন জানিনা ও আমাকে ভালোবেসে ফেললো। আমার নেওটা হয়ে গেল। তারপর সেই মারাত্মক ম্যারেঞ্জাইটিসের ছোবল ওকে একেবারে পঙ্গু করে দিল। না হলে ও হয়তো আর দশটা মানুষের মতো সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারতো। মাঝে মাঝে ওই রাত কয়টার কথা মনে পড়ে যায়। সবাই আশা ছেড়ে দিয়েছিল। তবু ও বেঁচে ফিরলো। ভজু কখন যে আমার এত আপন হয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। এখানে আসার পর ও একটা নতুন জীবন পেয়েছে। নিজের মতো করে।
বলো, কি বলছিলে?
ভজুর দিকে তাকালাম। হাসছে।
গাছে জল দিচ্ছিলাম।
মাচাগুলো কিসের?
উচ্ছে পোয়া লাগিয়েছি।
বিষ্ময়ে তাকালাম ভজুর দিকে। পোয়া! এই গাঁইয়া ভাষাটা শিখল কোথা থেকে?
পোয়া কথাটা শিখলি কোথা থেকে!
ভানুদা বলে।
হাসলাম।
আর কি লাগিয়েছিস?
লঙ্কা পোয়া, বেগুন পোয়া, খসলা শাক, নটে শাক, পালং শাক।
হয়!
কেন তুমি খাও নি?
খেয়েছি?
কতদিন বড়োমা রান্না করে তোমাকে দিয়েছে। ডাক্তারদাদা প্রত্যেকদিন একটা না একটা শাক খাবেই। জানো বেগুন গাছে দশটা বেগুন হয়েছে। এই-ই-আ বড়ো বড়ো সাইজ।
ওর সাইজ দেখান দেখে আমি হাসলাম।
কি করবি?
বুঁচকি এলে তুলব। বড়োমা বেগুন ভাজা করবে।
তোর লঙ্কাগাছে লঙ্কা হয়েছে?
কাল একমুঠো তুলেছি।
ঝাল আছে?
একটা খেয়ে দেখো না, চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে যাবে। জান, আমি চারটে লঙ্কা পাকিয়ে বীজ তৈরি করে আবার ছড়িয়ে দিয়েছি। চাড়া বেরিয়েছে।
সার পাস কোথায়?
সকালে যে দুধ দিতে আসে ওর কাছ থেকে বস্তায় করে গোবর নিয়ে আসি।
যা এবার স্নান করে খেয়ে নে।
আর একটু বাকি আছে।
আজ আর করতে হবে না। বেলা হয়ে গেছে।
তা-লে যাই।
হাসলাম। যা।
ভজু চলে গেল।
আমি এইপাশের জানলার ধারে এসে দাঁড়ালাম।
আমগাছটার ডাল মনেহয় ছাঁটা হয়েছে। পেয়ারা গাছটায় অনেক পেয়ারা হয়েছে।
একটা সময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা এই আমগাছটা আর পেয়ারা গাছটার দিকে তাকিয়ে আমার সময় কেটে যেত। কত কথা মনে পরে যায়। স্মৃতি সততই সুখের।
কিরে ভজুর সঙ্গে গল্প হলো?
পেছন ফিরে তাকালাম।
তিনকন্যা ভেতরে এসে দাঁড়িয়েছে।
আয় তোর সঙ্গে একটু গল্প করি।
মিত্রার দিকে তাকালাম। আজ ওকে ভীষণ খুশি খুশি দেখাচ্ছে।
এগিয়ে এসে খাটে বসলাম। ওরা সোফায় বসেছে।
খাওয়া হয়েছে। কথাটা ছুঁড়ে দিলাম।
সকাল থেকে বহুবার খাওয়া হয়ে গেছে, আগে হজম হোক।
হজমলা খা।
সেইজন্য তোর কাছে এলাম।
আমি কবে থেকে হজমলা হলাম।
হলি কোথায়, ছিলি তো।
হাসলাম।
শরীরটা এলিয়ে দিলাম। ইসি, তনু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।
তোরা এখন যা। আমি একটু গড়িয়ে নিই।
চিকনা কোনা বাইপাসে ঢুকেছে। আর আধঘণ্টা।
আমি মিত্রার মুখের দিকে তাকালাম।
যেখানে যেখানে, যাকে যাকে খবর দেওয়ার দরকার সকলকে দিয়ে দিয়েছি।
আমি হাসছি।
সুজিতদা সপরিবরে একটু পরে এসে হাজির হবে।
আমি মিত্রার দিকে তাকিয়ে আছি।
মামা-মামীরা বসিরহাট থেকে বেরিয়ে পরেছে। আর ঘণ্টা খানেক।
তনু বালিসগুলো আলমাড়িতে ঢুকিয়ে রেখেছ?
তনু হাসছে।
আমি খাটের সইডে মাথাটা রাখলাম।
মিত্রা সোফা থেকে উঠে এসে আমার পেটের কাছে বসে শরীরে হেলান দিল।
তিনজনে হেসেই যাচ্ছে।
ছুটকি ওকে চেপে না ধরলে ও মুখ খুলবে না। ইসি বলে উঠলো।
মিত্রা আমার মুখের দিকে তাকাল। হাসছে।
তুই আমাকে তনুকে ঢিসুম ঢিসুম করবি না।
কেন?
এতবড়ো একটা অন্যায় করলাম।
আমি এর মধ্যে অন্যায় দেখছি না।
জানিস বুবুন আজ জীবনে প্রথম বেঁচে থাকার অন্তর্নিহিত অর্থটা উপলব্ধি করতে পারলাম।
কেন, আগে করিস নি?
যেদিন মা হলাম সেদিন একটু একটু উপলব্ধি করেছিলাম।
আমি মিত্রার দিকে তাকিয়ে।
আজ মাসিমনির মধ্যে দিয়ে আমি, তনু মাকে উপলব্ধি করলাম।
তনুর দিকে চোখ চলেগেল। মাথা নীচু করে বসে কাপড়ের আঁচল পাকাচ্ছে।
আজ আঠার মাস পর মাসীমনি নিজে নিজে খাট থেকে নেমে কাপর পরেছে। আমি তনু একটুও সাহায্য করিনি, বিনয়দা, তিন্নী দেখে অবাক। আমাদের দুজনকে বললো, তোরা দুজনে দুপাশে দাঁড়িয়ে থাক। তাহলেই হবে। এ বাড়িতে পা দিয়েই প্রথমে তোর খোঁজ করেছে। তুই উঠেছিস কিনা। তারপর যখন জানলো তুই উঠিসনি, আমাকে বলেছে মিত্রা আমাকে তোর ঘরে নিয়ে চল। কনিষ্করা মাসীমনিকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে দিল। তনুকে বললো তুই চেয়ারটা ধর।
এই ঘরে ঢুকে তোর ফটোটার সামনে কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে ছিল। খাটের কাছে এসে তোকে দেখে কিছুক্ষণ নিস্তব্ধে কাঁদল। তুই তখন অঘরে ঘুমচ্ছিস। ডাক্তারদাদা তোর মাথার শিয়রে বসে। আন্টি পায়ের কাছে। দু-জনে আজকে হেবি সার্ভিস দিয়েছে। তারপর নয়না, নম্রতা।
নম্রতা বার বার ফোনে বলেছে তুমি দিদাকে আগে নিয়ে এসো মশাই-এর সঙ্গে আমি ফাইট করবো। তারপর দিদিভাই, অনিসা আছে। তিনজনে মিলে ফাইট করলে মশাই হেরে যাবে। সেদিনের ওই ঘটনার পর থেকে তোর প্রতি ওর কনফিডেন্স বেড়ে গেছে।
মাসীমনি এই ঘরে এসে কারুর সঙ্গে কোনও কথা বলে নি। শুধু তোর মুখের দিকে তাকিয়ে বসেছিল। বড়োমা একবার মাসীমনির কাঁধে হাত রেখে বলেছিল।
কেঁদে কি করবে। ওকে পাওয়ার পর থেকে আমি প্রতিদিন একবার করে কাঁদি। ওর ছোটোমা, সুতপা, দামিনী, দিদির অবস্থাও একইরকম।
দিন কয়েক আগেও বেশ হাসি খুশি ছেলে হঠাৎ যুদ্ধ বাধিয়ে দিল। আমরা সকলে ভয়ে মরি। উনি দিব্যি আছেন। ডাক্তার ওকে বেশ বোঝে। তারপর দামিনী। দামিনীও সেদিন ধরতে পারে নি। ওর বুকে ব্যাথা শুরু হয়ে গেল।
তারপর তনুকে বললো আমাকে বড়োর ঘরে নিয়ে চল।
সেই থেকে ওই ঘরে। তারপর….।
বাবাঃ তোমরা কি ইন্টরোগেসন শুরু করে দিয়েছ?
কনিষ্ক বলতে বলতে ঘরে ঢুকলো।
পেছনে নীরু, অনিকেত, বটা, সাত্যকি আমার সব ডাক্তার বন্ধুরা যারা এখন নার্সিংহোমের সঙ্গে এ্যাটাচ।
ওরা তিনজনেই হেসে উঠে দাঁড়ালো।
হাসছো যে ম্যাডাম। কনিষ্ক বললো।
সবে একটুখানি ভূমিকা দিয়ে শুরু করেছিলাম।
আর ভূমিকা। আজ দু-বছর হলো ফিরেছে। আঠার বছরের ইতিহাস কিছু বার করতে পেরেছ। কাজে কর্মে ধীরে ধীরে জানতে পারছো। এতবড়ো একটা খবর মানুষ একটু আনন্দ করে বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে, আত্মীয় পরিজনের সঙ্গে শেয়ার করে। আর ও….। কনিষ্কর গলাটা ভারি ভারি লাগল।
আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি।
জয়ন্তীর সঙ্গে কথা বললাম, শুনে ভীষণ আপসেট।
আমাদের থেকে ওনাকে নিয়ে ও-ই বেশি নাড়াচাড়া করেছে। বললো, কি বলছো কনিষ্কদা! আমি আজ বছর চারেক মাসিকে দেখছি। কিছুই জানতে পারলাম না। বোঝ একবার।
আর দশজন পেসেন্টের মতো মনা নিয়েগেছে জয়ন্তী দেখছে। যেহেতু মনা নিয়ে গেছে, তাই জয়ন্তী একটু আলাদা কেয়ার করেছে। নিজের গরজে স্যারকে দেখিয়েছে। শ্রীপর্ণাকে দেখিয়েছে। মনা এটুকু শুধু বলেছে, টাকা পয়সার ব্যাপারে চিন্তা করবে না। যা প্রয়োজন যা করণীয় তা করবে।
জয়ন্তী সেইভাবে স্টেপ নিয়েছে। বোনম্যারো কারুর সঙ্গে ম্যাচ করেনি তাই অপেক্ষা করে আছে। খোঁজ খবর নিচ্ছে। মিলে গেলে অপারেসন করে শেষ চেষ্টা করবে। ও নিজে জয়ন্তীকে কথায় কথায় একবার বলেছে মাসিমনি ওর বিশেষ পরিচিত। এর বেশি কিছু নয়।
বলতে গেলে অনেক কথা বলা হয়ে যাবে বুঝলে ম্যাডাম। কনিষ্ক দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়লো।
তোমরা দাঁড়িয়ে পরলে কেন? নীরু বললো।
তোমরা সবাই সোফায় বসো, আমরা খাটে বসছি।
সবার হবে নাকি?
যে কজনের হয়, বাকি খাটে বসবে।
ইসি একটু চা খাওয়াবে। কনিষ্ক বললো।
খাবে না?
একটু পরে খাচ্ছি। ও ঘরে এখনও মাসিমনি, দাদা, স্যার টেবিল থেকে ওঠে নি। সুন্দররা জমিয়ে মাসিমনিকে চেপে ধরেছে। রসভঙ্গ করি কেন, এখনও এক ঘণ্টা।
ওরা যে যার ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে পরলো।
ইসি উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের বাইরে পা বাড়াল। গেটের কাছে যেতে নীরু বললো।
ইসি ম্যাডাম দামিনীমাসি বড়া ভাজছে দেখলাম।
ইসি হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
নীরু আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
বুঝলি নীরু, কনিষ্ককে আগামী ইলেকসনে ক্যন্ডিডেট বানাব। আমি বললাম।
কেন সত্যি কথা বললে গায়ে চুলকুনি হয়। বটা খ্যাঁক করে উঠলো।
অনিকেত, সাত্যকিরা সকলে হাসছে।
নীরুকে ইসারাতেই বললাম, টিনা কোথায়?
বটা ধরে ফেলেছে। হাসছে। তনু, মিত্রাও হেসে ফেললো।
কনিষ্ক আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে। মিত্রার দিকে তাকাল।
সকাল থেকে কপচায় নি?
আজ একবারে চুপচাপ।
নিজের লোক এসেছে না। বেশি বক বক করলে বুদ্ধি ধরা পরে যাবে।
ওরে বাবা, মাসিমনি ওর থেকে আর এক কাঁটা ওপরে। তখন অনুপদাকে কি কথায় বললো, তোমরা পার্টি করো, রাজনীতি করো না। তাই তোমাদের সমস্যা। সেই কথা শুনে অনিমেষদার কি হাসি।
কি সুন্দর কথাটা বলেছে বলো।
ও যেমন তখন বললো, বিশ্বাসযোগ্যতার মাপকাঠিগুলো ফেরত এনেছ না রেখে এসেছো?
মাসিমনি হেসে বললো।
সঙ্গে আছে। চাইলে ফেরত দেব। তোর কাছে থাকা যা, আমার কাছে থাকাও তা।
ডাক্তারদা একচোট হাসল।
আমরা প্রথমে বোকার মতো এ ওর মুখের দিকে তাকাই।
কি কথা বলে দুজনে!
বুবুন এ ঘরে আসতে ছোটোমা, ডাক্তারদাকে ধরলো। সামন্তদা তখন আপনি, অনি আর দিদির কথা শুনে অতো জোরে হাসলেন কেন।
আমরাও মাসিমনিকে ধরলাম। ব্যাপারটা কি বলো।
মাসিমনি হাসতে হাসতে বললো, তোরা এখনও ওর কথা ঠিক মতো ধরতে পারিস না, তাই না?
বললাম, কি করে ধরবো বলো?
তার আগে মাসিমনি কথায় কথায় ওই দুটো চিঠির কথা বলেছিল।
আমাকে যেটা সকালে দেখালে। কনিষ্ক বললো।
হ্যাঁ।
চিন্তা করো একবার! সেই জন্য বলেছে, বিশ্বাসযোগ্যতার মাপকাঠিগুলো ফেরত এনেছ কিনা। তারমানে সঙ্গে তুমি আরও অনেক কিছু নিয়েগেছিলে, শুধু ওই দুটো চিঠি নয়।
ঘরের সকলে হাসছে।
রতনে রতন চেনে বুঝলে ম্যাডাম।
মাসিমনি যখন ওকে বললো, একটা কথাও বলে নি। খালি বোকার মতো তাকিয়ে তাকিয়ে হেসেছে। মিত্রা বললো।
তারমানে সকালে ছোটখাট একরাউন্ড বোঝাপড়া হয়ে গেছে। কনিষ্ক হাসতে হাসতে বললো।
মিত্রা হাসতে হাসতে আমার গায়ে ঢলে পরেছে। তনু আমার মাথার শিয়রের কাছে বসেছিল। আমি মাথাটা ওর কোলে রাখলাম। আমিও হাসছি।
ইসি চায়ের ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকলো। তনু উঠতে যেতেই ইসি বলে উঠলো।
তুই বোস, তোকে উঠতে হবে না। বেচারা একটু কোলে মাথা রেখে শুয়েছে।
চায়ের সঙ্গে বড়াভাজা এসেছে।
ইসি ট্রে-টা সেন্টার টেবিলে নামিয়ে রাখার আগেই নীরু একটা বড়া তুলে নিয়ে মুখে দিল।
দাঁতে কামড়েই বলে উঠলো, কিসের বলোতো, দারুণ টেস্ট।
ইসি, নীরুর দিকে তাকিয়ে হাসছে।
হাসছ যে।
মোচার বড়া।
দামিনীমাসির দিমাক আছে। বোঝাই যাচ্ছে না।
এটা কি মাসীমনি স্পেশ্যাল। কনিষ্ক একটা তুলে নিল।
মাসীমনি নিরামিষ। তাই সব আলাদা।
তিন্নী এসে ঘরের সামনে দাঁড়াল।
মিত্রা তাকাল।
ঠাকুরপোকে মা একবার ডাকছে।
নীরু কথাটা শুনে দমফাটা হাসি হেসে উঠলো। কনিষ্করাও হাসছে। বটা হাসতে হাসতেই তিন্নীকে ঘরের ভেতরে আসতে বললো। আর সকলে হেসেই চলেছে।
তিন্নীও হাসছে। ভেতরে এলো।
তুমি এই নামটা জোগাড় করলে কোথ থেকে? বটা বললো।
দূর, আর বলবো না।
তোমাকে অনি চাটে নি? নীরু বললো।
তিন্নী নীরুর দিকে তাকিয়েছে।
কিরে তুই এতো ভদ্র হলি কবে থেকে? নীরু আমার দিকে তাকাল।
আমি হাসছি।
শালা নিজের আত্মীয় বলে সাতখুন মাপ। সাত্যকি বললো।
নীরু আবার তিন্নীর দিকে তাকাল।
আজ থেকে ঠাকুরপো-ফাকুরপো অফ, স্ট্রেইট অনিদা।
তখন আমরাও খুব হাসাহাসি করেছিলাম। তনু বললো।
শালা তিন্নীর মুখ থেকে ঠাকুরপো শুনে খুশবু নেওয়া হচ্ছে। বটা নোট করে রাখ।
নীরু তরপাচ্ছে।
নোট করা হয়ে গেছে।
আমি বটার দিকে তাকালাম।
সাত্যকি একটা নতুন লুঙ্গি কিনে আনিস। আমি বললাম।
সাত্যকি, কনিষ্ক দুজনেই জোরে হেসে উঠল।
তুই এখনও মনে রেখেছিস, আমি ভুলেই গেছিলাম। কনিষ্ক বললো।
বটা, নীরু শরীর কাঁপিয়ে হাসছে। তনুরা কনিষ্কর দিকে তাকিয়ে।
লুঙ্গি কেশটা কি! মিত্রা কনিষ্কর দিকে তাকিয়ে।
কনিষ্ক হেসেই যাচ্ছে। বটাও হাসছে।
তোমায় কতো বলি বলো ম্যাডাম। এইরকম কতো ঘটনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
কনিষ্ক হাসতে হাসতে কেশেই ফেললো।
যাই বল নীরু ওই লাইফটা আর আমাদের ফিরে আসবে না। অনিকেত বললো।
চলবে —————————–
from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/JhK2R4i
via BanglaChoti
Comments
Post a Comment