কাজলদিঘী (১৬৪ নং কিস্তি)

❝কাজলদীঘি❞

BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

১৬৪ নং কিস্তি
—————————–

অনিকার মুখের দিকে তাকালাম। অনিকা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। অনিসা আরও গভীর ভাবে কাছে এগিয়ে এলো। ধীরে ধীরে আমার বুকের কাছে নেমে এলো।

তুমি তো পিকুদাকে ভালোবাসো তাই না? অনিসা বললো।

চুপ করে রইলাম।

মামা তুমি নিজে ভেতর ভেতর ভীষণ কষ্ট পাচ্ছ। সত্যি কথা বলো। অনিকা বললো।

আমি একবার অনিসার মুখের দিক তাকই একবার অনিকার মুখের দিকে তাকাই।

নম্রতাদি সত্যি পিকুদাকে ভীষণ ভালোবাসে। তুমি বলো না ভালোবাসা অপরাধ? অনিসা বললো।

তুমি তো অনেককে ক্ষমা করে দিয়েছো। আমাকে, পক্কেকে, ঘণ্টাকে দোষ করলেও শাস্তি দাওনি।

আমি অনিকার মুখের দিকে তাকালাম।

ওরা দু-জনে বলেছে এখন বিয়ে করবে না। তুমি যখন বলবে তখন বিয়ে করবে।

আমি অনিসার মুখের দিকে তাকালাম।

বলো না বাবা, তুমি এমন করছো কেন। আমি যদি এই ভুল করতাম তুমি আমাকে ক্ষমা করতে না। দাদা, সুন্দরদা যদি এই ভুল করতো তুমি ক্ষমা করতে না। অনিসার চোখ আমার চোখে।

কেউ কাউকে ভালোবাসতেই পারে। তোমার মতামত তার ওপর তুমি চাপিয়ে দিতে পারো না।

আমি অনিকার মুখের দিকে তাকালাম।

সত্যি ও ইমোসন্যালি একটা ভুল করে ফেলেছে। মেয়েটা খারাপ নয়। যথেষ্ট ভালো। তাছাড়া ও সোনাদিদাই-এর কাছে থাকবে বলেছে। নিজের বাড়িতে আর ফিরে যাবে না।

প্লিজ বাবা তুমি কিছু বলো। ওইভাবে তাকিয়ে থাকবে না।

মেয়ে আমার বুকের ওপর আরও ঘন হয়ে নেমে এসেছে।

আচ্ছা বাবা তুমি তো বলো, পরিবেশ পরিস্থিতি মাঝে মাঝে মানুষকে ভুল করতে বাধ্য করে। সেই ভুল মানুষ ইচ্ছে করে করে না। হয়ে যায়। আমরা এই ভুলগুলোকে জীবনের চরমতম ভুল বলে ধরি না।

কিন্তু ভুলটা যেহেতু ভুল, আপ্রাণ চেষ্টা করি তাকে শোধরাবার জন্য। অনিকা বললো।

তুমি পিকুদা-নম্রতাদিকে একটা চান্স দাও।

আমরা ভাইবোনেরা তোমাকে কথা দিচ্ছি। পিকু আর কোনওদিন ভুল করলে আমরা কেউ তোমার কাছে এসে বলবো না। তুমি ওকে যা শাস্তি দেবে মেনে নব। অনিকা বললো।

আমার চোখ অনিসার মুখের ওপর থেকে অনিকার মুখের ওপর চলেগেল।

নম্রতাকে ডাকি। তুমি ওর মুখ থেকে শোনো। আমরা একটুও মিথ্যে কথা বলছি না।

অনেকক্ষণ গম্ভীরভাবে থেকেছি আর থাকতে পারলাম না। এদের সঙ্গে অভিনয় করা সত্যি খুব মুস্কিল। মিত্রা তনুকে আমি ভালোবাসি। কিন্তু সেই ভালোবাসার সঙ্গে এই ভালোবাসার অনেক পার্থক্য। ওদের জোর আর এদের জোরের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। মিত্রা তনু হলে এতক্ষণে ফুৎকারে উড়িয়ে দিতাম। এদের ওইভাবে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। পিকুকে আমি যথেষ্ট স্নেহ করি কিন্তু তার ভুলগুলো অন্ধভাবে স্নেহ করতে পারি না। তার জন্য তার শাস্তি পাওয়ার দরকার আছে।

তাছাড়া পিকু ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে বড়ো হয়ে ওঠেনি। জীবন সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা স্বল্প। বড্ডো বেশি বাড়া বাড়ি করে ফেলেছে।

কিগো বাবা। তোমার চোখের মনিগুলো কেমন চুপ করে রয়েছে। তুমি কি ভাবছো বলো না।

অনিসার মুখের দিকে তাকালাম।

তোদের দু-জনকে কে পাঠিয়েছে, ছোটোমা না মা। একটু গম্ভীর থাকার চেষ্টা করলাম।

কেউ পাঠায়নি, আমরা নিজেরা এসেছি। অনিসা বললো।

এতো পাকা বুদ্ধি তোদের হয়নি।

হয়েছে, তুমি বুঝে না বোঝার ভান করো।

আমি না পারছি গম্ভীর হয়ে থাকতে না পারছি হাসতে। মেয়ে আমার হাতদুটো বুকের কাছে চেপে ধরে ঝুঁকে পরেছে। মুখটা একেবারে মুখের কাছে নিয়ে এসেছে।

অনিকা।

বলো।

তুই হচ্ছিস পালের গোদা।

খালি আমার দোষ না।

মেয়ের মুখের দিকে তাকালাম। চোখে মুখে হাসছে। আমার দুর্বল জায়গাগুলো ধরে ফেলেছে।

নম্রতাকে ডাক।

মেয়ে আমার নাকে নাক ঘষে দিল। অনিকার দিকে তাকাল।

দিদিভাই নম্রতাদিকে একটা ফোন করো।

অনিকা মোবাইলে ডায়াল করে নম্রতাকে এঘরে আসতে বললো।

তোরা যা বললি আমি তা মানতে পারি। কিন্তু আমি যা বলবো তোদের তা মানতে হবে।

বলো।

পারবি।

পারবো। আমি দিদিভাই কথা দিচ্ছি।

নম্রতা যদি না মানে।

মানবে। নম্রতাদি দিদিভাইকে কথা দিয়েছে। ও কাল থেকে তোমাকে দেখছে। আগে তোমার নাম শুনেছে, দেখেনি। সাগর আঙ্কেল ওর ওপর আন্টির ওপর ডিক্টেটরশিপ চালায়। তুমি তাকে পর্যন্ত কালকে ধমকে দিয়েছ। আন্টি, নম্রতাদি দু-জনেই খুব আনন্দ পেয়েছে।

রাতে তুমি পার্টিটা সবার সঙ্গে শেয়ার করেছো।

ওরা ভাবতেই পারেনি। এরকম কিছু একটা ঘটতে পারে। তুমি নিজে সার্ভিস করেছো। ওরা দু-জনে ভীষণ ভীষণ এনজয় করেছে।

ওর বাবা ছিল না?

কিছুক্ষণের জন্য ছিল তারপর চলে যায়।

তোদের সঙ্গে কথা বলেনি?

না বলার মতো। শুধু যাওয়ার সময় বলে গেল রাতে ফিরে আসবে।

ওরা ফিরে গেছিল?

নম্রতাদি যায়নি। আন্টি গেছিল। আবার সকালে চলে এসেছে।

নম্রতার বাবা কিছু বলেনি?

আন্টি সোনাদিদাই-এর সাথে কথা বলেছে।

আয় ভেতরে আয় মামা কিছু বলবে না।

অনিকার কথায় অনিসা পেছন ফিরে তাকাল। আমি অনিসার শরীরের ফাঁক দিয়ে দেখলাম, নম্রতা মাথা নিচু করে এগিয়ে আসছে।

মামাকে ভয় পাবি না। বোল্ড হবি। আর কোনও অন্যায় কাজ করলে সরাসরি স্বীকার করে নিবি। দেখবি মামা তোকে ক্ষমা করে দেবে, কিচ্ছু বলবে না।

নম্রতা অনিকার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।

মামা তুমি মাথাটা একটু তোলো। আমি সরে বসি। নম্রতা এখানে বসুক।

আমি মাথাটা একটু তুললাম। নম্রতা অনিকার পাশে বসলো।

আমি একঝলক নম্রতার মুখটা দেখে নিলাম। মুখটা থম থমে। বেশ বুঝতে পারছি, বুকের ভেতরের লাবডুব শব্দটা দ্বিগুন হয়ে গেছে। একটা আড়ষ্ট ভাব ওর চোখেমুখে। সারাটা শরীরে তা ছড়িয়ে পড়েছে।

অনিসা আমার বুকের ওপর হেলান দিয়ে শুয়েছে।

তুমি নম্রতাদিকে কি জিজ্ঞাসা করবে করো।

মেয়ের মুখের দিকে তাকালাম। জয় করার হাসি ওর চোখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে।

তোদের সামনে জিজ্ঞাসা করলে ও লজ্জা পয়ে যাবে।

ঠিক আছে আমি দিদিভাই চলে যাচ্ছি।

মেয়ে উঠে বসলো। নম্রতার দিকে তাকাল।

বাবাকে সব খোলাখুলি বলবে, দেখবে তোমার সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

নম্রতা মাথা নিচু করে বসে আছে।

তুমি মাথা তোলো আমি উঠি। অনিকা বললো।

অমি মাথা তুললাম, অনিকা উঠে দাঁড়িয়ে কাপরটা ঠিক করে নিল।

দু-জনে একটু চা তৈরি করে নিয়ে আয়। আমি ওর সঙ্গে কথা বলে নিই।

অনিকা, অনিসা দু-জনেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

কিছুক্ষণ দু-জনেই চুপচাপ থাকলাম। আমি নিজেই নিস্তব্ধতা ভাঙলাম।

নম্রতা।

নম্রতা আমার মুখের দিকে তাকাল।

তোমাকে যা যা জিজ্ঞাসা করবো তুমি তার সঠিক উত্তর দিতে পারবে?

নম্রতা মাথা দোলালো। পারবে।

তুমি পিকুর বাড়িতে কখনও গেছ?

একবার।

কবে?

মাস ছয়েক আগে।

পিকুর মা-বাবার সঙ্গে তোমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল?

নম্রতা মাথা দোলাল, দিয়েছিল।

তুমি জানতে পিকু কি করে?

জানতাম।

হঠাৎ পিকুকে তোমার ভালো লাগলো?

প্রথম প্রথম ওকে পাত্তা দিইনি। তারপর কেন জানি না ওকে ভালো লেগে গেল।

এই ভাললাগাটা কখন থেকে?

যখন ওর সম্বন্ধে পুরো জানতে পারলাম।

তারমানে তোমাদের স্ট্যাটাসের সঙ্গে ওর স্ট্যাট্যাসটা যখন মিলতে পারে বুঝলে তখন থেকে।

নম্রতা চুপ করে রইলো।

আচ্ছা তুমি যেদিন প্রথম ওদের বাড়িতে গেলে তখন তোমাদের রেজিস্ট্রি হয়ে গেছিল।

সেইদিনই রেজিস্ট্রি করেছিলাম।

ম্যারেজ রেজিস্টার তোমার পরিচিত না পিকুর।

আমাদের দু-জনেরি পরিচিত।

আগে থেকে চিনতে।

বাবার সঙ্গে কয়েকবার লিগ্যাল এইডের ব্যাপারে গেছি। তারপর কথায় কথায় জানলাম উনি অনুপ আঙ্কেলকে চেনেন, সমস্যায় পরলে উনি অনুপ আঙ্কেলের সঙ্গে কনসাল্ট করেন।

সাক্ষী কে কে ছিল?

আমার বন্ধুরা আর ওর বন্ধুরা।

এদের মধ্যে আমার পরিচিত কেউ ছিল?

হ্যাঁ।

কে?

বিতানদা।

বিতানদা তোমাদের ব্যাপারটা প্রথম থেকে জানতো।

জানতো।

তোমার বাবা-মা রেজিস্ট্রির ব্যাপারটা জানতো।

পড়ে জেনেছিল।

তখন কি বললো?

মেনে নিয়েছিল।

কেন?

বলতে পারবো না।

তুমি যে পিকুর সঙ্গে মিশতে তোমার বাবা জানতো।

জানতো।

তোমাকে কখনো বাধা দেয়নি?

প্রথমে দিয়েছিল। পরে দেয়নি?

কেন?

বলতে পারবো না।

তোমার বাবা তার এক বিজনেস পার্টনারের ছেলের সঙ্গে তোমার বিয়ে ঠিক করে রেখেছিল। সেই বাড়িতে তোমার যাতায়াত ছিল। সেই ছেলেটিও তোমাদের বাড়িতে আসা যাওয়া করতো।

আমি তাকে কোনওদিন মন থেকে মেনে নিতে পারিনি।

তোমার মা-বাবা সেটা জানতো?

মা জানতো। বাবা জানতো না।

তুমি যে এরকম একটা কাজ করতে চেলেছো সেটা তোমার পরিবারের ক-জন জানতো।

দিদা আর মা।

দিদা, মা তোমাকে সাপোর্ট করতো।

হ্যাঁ।

তুমি দিদার বাড়িতে কোনওদিন পিকুকে নিয়ে গেছ?

একদিন।

কবে?

যেদিন পিকুর বাড়িতে গেছিলাম।

তখন আমি তোমার দিদার বাড়িতে যাতায়াত করি এটা জানতে।

দিদা কোনওদিন বলেনি।

দিদার জীবনে যে এরকম একটা ঘটনা ছিল জানতে।

মায়ের মুখ থেকে শুনেছিলাম। পরে দিদা সামান্য বলেছিল।

নাতনি হিসাবে দিদাকে কখনও জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করেনি।

সে সুযোগ দিদা কখনও দেয়নি।

দিদা তোমাদের ব্যপারটা খুশী মনে মেনে নিল কেন, তা জানার উৎসাহ হয়নি।

নম্রতা চুপ করে রইলো।

আচ্ছা তোমাদের রিলেসনসিপটা যখন বিল্ড করলো তোমার বাবা কিছু বলেনি?

পিকুকে হুমকি দিয়েছিল।

পিকু তখন ইসলামভাই-এর নাম করে। নিজের পরিচয় দেয়। তাইতো?

হ্যাঁ।

তোমার বাবা তখন চুপ করে যায়।

চাঁদ আঙ্কেলকে বাবা বলে। চাঁদ আঙ্কেলের সঙ্গে বাবার খুব ভাল রিলেসন।

চাঁদ আঙ্কেল পিকুদের বাড়িতে কবার গেছে?

একবার।

তোমরা সেটা জানতে?

যাওয়ার পর পিকু বলেছে।

এতোসব ঘটনার পরও তুমি পিকুকে কেন ছেড়ে দিচ্ছ না।

আমার কোনও উপায় নেই।

চুপ করে রইলাম। নম্রতা আমার মেয়ের মতো। ওকে জিজ্ঞাসা করতেও ইচ্ছে করছে না। তবু পিকুর ব্যাপারটা আমাকে জানতেই হবে। ও কতদূর এগিয়েছে। নিজের প্রতি নিজের বিতৃষ্ণা আসছে। শালা ঘরামীর ঘরের চাল ফুটো। পিকুকে একবারে আমি খেয়াল করিনি। ভীষণ আলগা দিয়ে দিয়েছিলাম। দোনোমোনো করে জিজ্ঞাসা করে ফেললাম।

রেজিস্ট্রির আগে তোমরা কোনও একদিন কলকাতার বাইরে গেছিল।

গেছিলাম।

অফিসের গাড়ি নিয়ে।

হ্যাঁ।

যা যা করেছিলে সব ক্যামেরা বন্দি করেছো।

নম্রতা চুপ করে থাকলো।

এই ব্যাপারটা ক-জনে জানে?

আর কেউ জানে না।

জিনিসগুলো কার কাছে আছে?

পিকুর কাছে আছে।

পিকু এগুলো নিয়ে তোমায় যদি ব্ল্যাক মেল করে?

আমি ওকে ভালোবাসি। ও করবে না।

ও তো তোমার কাছ থেকে তোমার বাবার অবর্তমানে তোমার প্রাপ্য সম্পত্তি তোমার কাছে লিখিয়ে নিয়েছে।

ও এটা কন্ডিসন করে নিয়েছিল।

কেন! যৌতুক?

নম্রতা চুপ।

তুমি তো ওকে ভালোবাসো। ভালোবাসলে কি যৌতুক দিতে হয় নাকি।

তখন আমার কোনও উপায় ছিল না।

ব্ল্যাক মেল করতে চেয়েছে।

নম্রতা কোনও উত্তর দিল না।

রেজিস্ট্রি হওয়ার আগে?

হ্যাঁ।

তোমার কিছু সন্দেহ হয়নি।

আমি ওকে অন্ধের মতো ভালোবেসে ফেলেছিলাম।

পিকু যে তোমায় ল্যাজে খেলাচ্ছিল তুমি সেটা বুঝতে পারনি।

অনেক পরে বুঝেছি।

তখনই তুমি তোমার বাবাকে সব ঘটনা খুলে বলো। তাই তো?

হ্যাঁ।

তোমার বাবা পিকুকে সড়িয়ে দেওয়ার প্ল্যান করেছিল তুমি সেটা জানতে।

জানার পর আমি পিকুকে বলেছি।

তখন কি হলো?

পিকু বলেছিল ও বাবাকে দেখে নেবে।

তারপর?

আমার সঙ্গে ওর বেশ কয়েকদিন কথাবার্তা বন্ধ হয়ে যায়।

আচ্ছা আমি যে ওর মেসোমশাই, এটা তুমি কবে জানলে?

তুমি তখন নার্সিংহোমে ভর্তি ছিলে।

আমি কে কি বৃত্তান্ত তুমি জানতে?

হুঁ। পিকুর ওয়াইফ হিসাবে তোমার ফ্লেভারটা ভীষণ এনজয় করতাম।

পিকু তোমাকে তার মালিকানার ব্যাপারে কিছু বলেনি?

ও যে ওই হাউসের একজন পার্টনার সেটা জানতাম। বাবা সেটা শোনার পর আমাদের বিয়েটা মেনে নিয়েছিল।

বাবা কি আগে জেনেছিল না পরে জেনেছিল?

সেটা বলতে পারব না।

আমি নম্রতার মুখের দিকে তাকিয়ে।

একদিন কথায় কথায় বাবা ড্রিংক করা অবস্থায় আমাকে নিয়ে মাকে কিছু নোংরা কথা বলে। তখন আমি বাবাকে মুখের ওপর বলে দিয়েছিলাম, আমি এমন কোনও ছেলের সঙ্গে মিশছি না যে আমাদের ফ্যামিলির স্ট্যাটাস নিচে নেমে যেতে পারে।

তখন তোমাদের রেজিস্ট্রি হয়নি।

না।

এরপর বাবা তোমাকে কখনও এই ব্যাপারে কোন কথা বলেনি।

না।

তুমি বাবাকে না জানিয়ে রেজিস্ট্রি করতে গেলে কেন?

বাবা পিকুর সঙ্গে মিশতে বাধা দিতেন না। তবে বিয়ে করার ব্যাপারটা বাবা যে মেনে নেবে না সেটা বাবার কথাবার্তায় বুঝতাম।

চাঁদকে মনে হয় তোমাদের রেজস্ট্রি হওয়ার আগেই পাঠিয়েছিল।

হ্যাঁ।

বাবা মাকে এসে সব বলতেন, মা তোমাকে বলতো।

মায়ের এক বান্ধবীর সঙ্গে বাবার….। নম্রতা জিভ বার করে ফেললো।

কি হলো বলো।

নম্রতা চুপ করে রইলো।

ঠিক আছে বলতে হবে না। আচ্ছা তুমি কি মনে করো তুমি পিকুকে যতটা ভালোবাসো পিকু তোমাকে ততটা ভালোবাসে?

নম্রতা চুপ।

ধরো পিকু তোমাকে ডিভোর্স করে দিল। তুমি কি করবে?

ও চাইলেই আমি ডিভোর্স দেব কেন। আমি ওকে ভালোবেসে সব দিয়েছি।

ঠিক। ধরো তোমাকে ও বিয়ে করলো। কিন্তু ওর যা স্বভাব তাতে ও আর একটা মেয়ের সঙ্গে রিলেসনসিপে জড়িয়ে পরলো। তখন তুমি কি করবে?

তুমি থাকতে ও কোনওদিন এসব করতে পারবে না।

কেন?

ও তোমাকে ভীষণ ভয় পায়। বাবা যেমন ভয় পায় পিকুও পায়।

কি করে বুঝলে?

গত তিন দিন আমাকে একশো বার ফোন করেছে। বার বার আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে। ওকে আমি এই ভাবে কোনওদিন আমাকে রিকোয়েস্ট করতে দেখিনি।

তুমি ওকে জিজ্ঞাসা করোনি?

প্রথমে বললো তুমি বকেছো। তারপর সব খুলে বলেছে। বার বার বলেছে মশাই সব জানতে পারলে আমাকে মেরে দেবে। মশাই কোনওদিন নোংরামো পছন্দ করে না।

তখন তোমার কি মনে হলো?

খুব ভালো লাগছিল, তোমাকে দেখার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল।

ওকে বলেছিলে?

ও বলেছিল আমি পারব না। আমি মশাই-এর সামনে দাঁড়াতে পারব না।

আচ্ছা পিকু যে তোমাকে রেজিস্ট্রি করলো ওর বাড়িতে কে জানতো।

প্রথমে কেউ জানতো না। পরে আঙ্কেল, আন্টি, দিদা জানতে পেড়েছিল।

আঙ্কেল তোমাকে কিছু বলেনি।

আঙ্কেল শুধু বলেছিল তোমরা আমাকে একবার জানাতে পারতে।

আন্টি, দিদা?

আন্টিকে পিকু পাত্তা দিত না। দিদার সঙ্গে মিস বিহেভ করতো।

তুমি কিছু বলতে না।

আমি বলতে বলেছে তুমি আমাদের ফ্যামিলির ব্যাপারে মাথা ঘামাবে না।

তুমি ওর মালিকানার ব্যাপারে কিছু জানো?

কালকে ডিটেলসে শুনেছি।

তার আগে?

জানতাম ও ওই হাউসের ওয়ান অফ দেম পার্টনার।

ধরো ওর মালিকানা চলে গেল। ও একজন সাধারণ কর্মচারী হিসাবে ওই হাউসে কাজ করছে। তুমি ওকে বিয়ে করবে?

তোমাকে পাশে পাবো। মায়ের স্কুল আছে, মার স্কুলে একটা টিচারির এ্যাপ্লিকেসন করবো। তাছাড়া আমি তো এমবিএ পড়ছি। তুমি আমাকে একটা চাকরী জোগাড় করে দেবে। দু-জনের ঠিক চলে যাবে। সমস্যা হলে দিদা আমাকে সাহায্য করবে বলেছে।

দিদার তো আরও নাতি নাতনি আছে।

দিদার সঙ্গে মামাদের সম্পর্ক ভালো নয়। যা দেখছো সব ওপর ওপর।

কেন?

নর্সিংহোমের ব্যাপারে দিদার সঙ্গে মামাদের একটা মামলা চলছে।

কিসের!

দিদা নার্সিংহোমের ওয়ান অফ দেম পার্টনার কিন্তু মামারা দিদার অনুমতি না নিয়ে মামীদের পার্টনার করে। দিদাকে বিগত সাত বছর কোনও রেমুনারেসন দেয়নি।

আচ্ছা তুমি এতো ভোগ বিলাসে মানুষ হয়েছো। কষ্ট সহ্য করতে পারবে?

তোমার কতো টাকা, কতো ক্ষমতা, তুমি এইভাবে থাকতে পারলে, আমি পারবো না কেন?

এটা তুমি মুখে বলছো। বাস্তবে সম্ভব নয়।

একবার চান্স দাও দেখ নম্রতা পারে কিনা।

পিকু যা অন্যায় করেছে তার শাস্তি কি হবে?

তুমি যা শাস্তি দেবে ও মাথা পেতে নেবে। তুমি ওকে মেরো না।

শেষের কথাটা বলতে গিয়ে নম্রতার গলা ধরেগেল, ঝড় ঝড় করে কেঁদে ফললো।

আমি খুব অপ্রস্তুতে পড়ে গেলাম। শুয়ে ছিলাম, উঠে বসলাম। খাটে পা ঝুলিয়ে বসলাম। একবার করে ওর মুখের দিকে তাকাই আবার মাথা নিচু করে নিই।

নম্রতা হাপুস নয়নে কেঁদে চলেছে। ভাবলাম একবার ওকে কাছে টেনে নিই। বুকে জড়িয়ে ধরি। খুব বেশি হলে অনিসার থেকে দু-এক বছরের বড়োই হবে।

তারপর ভাবলাম শাসনের ক্ষেত্রে দুর্বলতার কোনও স্থান নেই। দুর্বলতা মানুষকে প্রশ্রয় দেয়। মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে সামলে নিলাম। এখানে কোনওমতেই আমি দুর্বলতা দেখাব না।

নম্রতা কান্না আমি একবারে পছন্দ করি না।

আমার গলাটা একটু কঠিন শোনালো।

নম্রতা কান্নাভেঁজা চোখে আমার দিকে চমকে তাকাল।

অনিকা, অনিসা চা নিয়ে ঘরে এলো। নম্রতার কান্নাভেঁজা চোখ দেখে প্রথমে একটু ঘাবড়ে গেল। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা জরিপ করার চেষ্টা করলো।

অনিসা চায়ের কাপটা আমার হাতে দিয়ে নম্রতার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। আমি চায়ের কাপটা নিয়ে সেন্টার টেবিলে রাখলাম।

নম্রতার দুটো কাঁধে হাত রেখে বললো।

কেঁদে বাবার কাছ থেকে তুমি কোনও সিমপ্যাথি আদায় করতে পারবে না। তোমাকে এই কথাটা এই ঘরে আসার আগে বহু বার বলেছি। আমি দিদিভাই জীবনে বহু কেঁদেছি। কিছু পাইনি। কিন্তু না চাইতে বাবার কাছে আমরা দু-বোন যা পেয়েছি আমাদের চাওয়ার থেকে তা শতোগুণ বেশি।

বাবা তোমাকে বকেছে?

নম্রতা চুপ করে রইলো।

তোমার কথা শেষ হয়েছে?

নম্রতা তবু চুপ করে থাকল।

আমি নির্বিকার মুখে অনিসার দিকে তাকালাম। চায়ের কাপটা সেন্টার টেবিল থেকে তুলে নিয়ে ঠোঁটে ছোঁয়ালাম।

নম্রতা।

আমার গলার স্বরে যে পরিবর্তন হয়েছে তিনজনেই সেটা বুঝলো।

নম্রতা চমকে আমার মুখের দিকে তাকাল।

আজ রাতের মধ্যে পিকু আর তোমার যা ডকুমেন্টস আছে সব একটা খামে ভরে মুখটা ভাল করে সিল করে ইসির হাতে দিয়ে দেবে। তোমাদের দু-জনের কোনও ডকুমেন্টস যেন তোমাদের কাছে না থাকে। আমি ছাড়া ওই খামটা দ্বিতীয় ব্যক্তি যেন না খোলে।

আজ রাতে কিংবা কাল সকালে দু-জনে আমার সঙ্গে দেখা করবে।

এখন চলে যাও।

আমার এই কথা বলার পর তিনজনে এক মুহূর্ত দাঁড়াল না। বেরিয়ে গেল।

আমি চায়ের কাপটা শেষ করে সেন্টার টেবিলে রাখলাম। উঠে গিয়ে টেবিলের ওপর পড়ে থাকা সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বার করে ধরালাম। ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে আবার বিছানায় এসে এক কাত হয়ে শুলাম।

মাথাটা কেমন যেন শূন্য শূন্য লাগছে। অঙ্কগুলো কিছু মিলছে কিছু মিলছে না।

পাটিগণিত, বীজগনিত সব একাকার।

অর্ক সাগরের একটা বায়োডাটা তৈরি করেছে। ওর সঙ্গে ইমিডিয়েট বসতে হবে। অরিত্রকে যে কাজটা করতে দিয়েছিলাম করলো কিনা কে জানে।

কেমন অস্থির অস্থির লাগছে।

আবার উঠে বসলাম, টেবিলের ওপর থেকে ফোনটা নিয়ে এসে অন করলাম। সকাল থেকে বন্ধ অবস্থায় পড়েছিল খেয়াল করিনি। বহু ম্যাসেজ বহু মিসকল।

অর্ককে ফোনে ধরলাম।

বলো। সকাল থেকে শুধু মিটিং করে চলেছো।

তা করছি। তুই কি করছিস?

পাতা ছাড়বো, একবার চেক করছি।

তার মানে ব্যস্ত আছিস। থাক পরে কথা বলবো।

মাইরি, প্রচুর নক্সা করতে শিখেছ। অরিত্র টেবিলের ওপাশে বসে আছে শোনাব কথাগুলো।

না থাক।

সাগরের ফাইলটা ক্লোজ করেছিস?

আর একটু বাকি আছে।

আমাকে একটু তাড়াতাড়ি দে।

একটা ভালো আর্টিকেল তৈরি হয়ে যাবে, ঝেড়ে দেব।

এখন নয়, সময় মতো বলবো তখন দিবি। অনাদি চুপ চাপ আছে, ওটাকে রগড়ে দে।

শোনো না কাল যখন বড়োমার সঙ্গে নাচছিলাম। শালা ফোন করেছিল। ঠিক খবর পেয়ে গেছে। বলে কিনা খুব মস্তি করছিস।

দিয়েছি খিস্তি। বললাম তুমি যদি দুগ্গীবাজি না করতে, এখন আমার মতো নাচতে পারতে।

কিছু বলেনি।

চুপ করে ছিল। তারপর একটা বেশ বড়ো নিঃশ্বাস ফেলে বললো, নে তুই এনজয় কর।

তুই কিছু জিজ্ঞাসা করলি না।

জিজ্ঞাসা করার দরকার আছে নাকি, হারামী সাগরটা ওখানে বসে বসে মাল খাচ্ছিল।

তুই ধরলি কি করে?

আমর নাক টিপলে এখনও দুধ বেরোয় জান অনিদা।

আমি জোড়ে হেসে উঠলাম।

ওই দেখো আবার ডিস্টার্ব করে, অনিদার সঙ্গে কথা বলছি। হয়েছে।

কে রে?

এ্যাকটিং এডিটর মিঃ সন্দীপ….উ লাগছে সন্দীপদা।

আমি হাসছি।

বুঝলে অনিদা বেশ কয়েকদিন ধরে দেখছি, সন্দীপদা বেশ খুশ খুশ।

হ্যালো অনি। সন্দীপের গলা পেলাম।

বুঝলাম অর্কর হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নিয়েছে।

বল।

অর্কর কথা বিশ্বাস করিস না। লাগাতর ফাঁকি মেরে যাচ্ছে। তিন ঘণ্টা হয়ে গেল। দ্বীপায়ন তিনবার এসে ফিরে গেল, এখনও পেজ ছাড়তে পারলো না। এবার বলবে অনিদার সঙ্গে কথা বলছিলাম তাই একটু দেরি হলো।

শুনলাম কাল নাকি মাল খেয়ে খুব নেচেছিস।

মালকিন ছিল না একটু নেচে নিলাম।

রাতটা বেশ পাশ বালিশ জাপটে ধরে সুখ নিদ্রা দিলি।

তুই দিসনি?

আমি তো দিই, স্বীকারও করি। তুই স্বীকার করিস না।

ধর অর্কর সঙ্গে কথা বল।

দে।

বীট দিলে না। তাই আমার হাতে ফোনটা দিয়ে কেটে পরলো। অর্ক বললো।

শোন সাগরের ফাইলটা আমাকে দে। একটু স্টাডি করতে হবে।

দেখি যদি রাতের দিকে যেতে পারি দিয়ে দেব। নতুন কোনও নিউজ হবে নাকি?

আছে, কালকে ঝাড়িস।

তাহলে অবশ্যই যেতে হবে।

শোন অরিত্রকে একটু দে।

ধরো।

হ্যালো।

অরিত্র।

বলো।

আঙ্কেল। তারস্বর চিৎকার দরজার বাইরে।

দাঁড়া ধর বিচকে দুটো এসে গেছে।

অরিত্র হাসছে।

খোলা আছে, ভেতরে আয়।

দড়াম করে দরজা খুলে গেল, দু-জনে ছুটতে ছুটতে কাছে এলো।

খাওয়া হয়ে গেছে?

হ্যাঁ।

দাঁড়া আমি ফোনে কথা বলছি।

গাড়ি চালাই।

আস্তে।

আমি উপুর হয়ে খাটে শুলাম ওরা আমার পিঠে উঠে পড়ে গাড়ি চালাতে শুরু করলো।

অরিত্র হাসছে।

হাসছিস কেন?

তুমি বেশ ভালো ম্যানেজ করতে পারো।

কি করবো সকাল থেকে দেখতে পায়নি। স্কুলে গেছিল। তারপর সুরোর কড়া শাসন।

দু-জনেই কনটিনিউ বুরুর বুরুর করে চলেছে। মাম্পি আমার মাথার চুল খামচে ধরে আছে।

তোকে যে কাজটা দিয়েছিলাম হয়েছে?

পুরো কেলো হয়ে আছে। তোমার সঙ্গে একটু বসতে হবে।

কেনরে জণ্ডিস নাকি!

তা বলতে পারো। তবে উদ্ধার করেছি। একটু সাজাতে হবে।

অর্কর সঙ্গে রাতে আয়।

ঠিক আছে।

পিকু অফিসে?

একটু আগে মিলিদি এসেছিল। বললো অনিদা পিকুকে মনেহয় ইঞ্জেকসন দিয়েছে। খুব জোড় পেইন হচ্ছে তাই তাড়াহুড়ো করে চলে গেল। যাওয়ার সময় বলে গেল নাও আসতে পারি।

বিতান?

একবারে আন্টারটিকা। টিনাদির বাধ্য ছেলে। যেচে যেচে টিনাদির কাছ থেকে কাজ চেয়ে নিচ্ছে।

কিছুটা উপকার হয়েছে বল।

তা হয়েছে।

রাতে আয় কথা হবে।

ফোনটা বন্ধ করে মাথার শিয়রে রাখলাম। মাম্পি-মিকি সমান তালে পিঠে দাপিয়ে চলেছে। বেশ আরাম লাগছে। মাঝে মাঝে মাম্পি চুলটা এতো জোরে চেপে ধরে গাড়ির স্টিয়ারিং ঘোরাচ্ছে ব্যাথা লাগলেও খারপ লাগছে না।

মাঝে মাঝে লাফালাফি চলছে।

এবার আমি গাড়ি চালাই তুই পেছনে বোস। মিকির গলা পেলাম।

মাম্পি না বলছে।

বুঝলাম যুদ্ধ এবার অনিবার্য। ইদানীং মিকি, মাম্পির ওপর কতৃত্ব ফলাচ্ছে।

একবার বলার পর যখন মাম্পি সরে বসলো না। মিকি ঠেলে ফেলে দিল।

আমি চুপচাপ মরার মতো শুয়ে আছি।

দু-জনে ঝগড়া শুরু হয়ে গেল। কতো কথা বলে, বোঝা দায়।

শেষে মাম্পি বলে বসলো, ঠাস করে একটা থাপ্পর মারবো। দেখবি।

আমি চোখ বন্ধ করে হাসছি।

মার না দেখি কতো সাহস।

বুঝলাম যুদ্ধ বাধার উপক্রম হয়েছে আমি চোখ চাইলাম।

কি হয়েছেরে মাম্পি।

দেখ না মিকি গাড়ি চালাতে দিচ্ছে না।

তুই অনেকক্ষণ চালিয়েছিস এবার মিকি একটু চালাক তারপর আবার তুই চালাবি।

তুই একা চালা। আমি সিটে বসবো না। মাম্পি বললো।

তোকে বসতে হবে না। আমি একা গাড়ি ড্রাইভ করবো।

মাম্পি রাগের চোটে আমার মাথার শিয়রে খাটের দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসলো।

মাম্পি।

মাম্পি আমার দিকে গম্ভীর হয়ে তাকলো।

আজ মা পিট্টি দিয়েছে।

না। ঝাঁজিয়ে উঠলো।

মিকি গাড়ি চালাতে শুরু করেছে। বুরুরর বুরুরর করে চলেছে। চুলের মুঠি শক্ত করে ধরেছে।

আস্তে চালা। লাগছে।

তুই চালাতে পারিস নাকি। বোকা কোথাকার। মাম্পি রাগে গড় গড় করছে।

মিকি এবার নেমে পর, গাড়ি এখন ব্রেকডাউন। বরং দু-জনে আমার পিঠে মাথা দিয়ে শুয়ে পর।

মিকি তবু পিঠে বসে আছে।

নাম। আঙ্কেল বলছে শুনতে পাচ্ছিস না। মাম্পি ধমকালো।

জোড় হাসির শব্দে মুখ ঘোরালাম। দেখলাম মিত্রা, তনু, ইসি সোফায় বসে।

মিলির মেয়েটার কি তেজ দেখেছিস। ইসি বললো।

তোরা কখন এলি?

ততক্ষণে মাম্পি, মিকির যুদ্ধ লেগে গেছে।

যুদ্ধ করলে ক্যান্ডি পাবি না।

আবার দু-জনে পিঠে বসে পড়েছে।

যে গাড়ি ড্রাইভ করবে সে একটা ক্যান্ডি পাবে। যে গাড়ি ড্রাইভ করবে না সে দুটো পাবে।

দু-জনের কেউ আর গাড়ি ড্রাইভ করার রিক্স নিল না।

কিরে তোরা এখানে, আমি সারা বাড়ি তোলপাড় করে ফেললাম। চল ঘুমবি চল। সুরোর গলা।

না ক্যান্ডি খাব। মাম্পি বলে উঠলো।

দাঁতগুলো সব নোড়া দিয়ে ভেঙে দেব।

সুরোর দাঁত খিঁচুনিতে দু-জনেই চুপ।

যা ঘুমিয়ে পর। বিকেলে ক্যান্ডি পাবি।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও দুজনে পিঠ থেকে নেমে গেল। দু-জনেই সুরোকে যথেষ্ট ভয় পায়।

তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে। দাঁড়াও দু-টোকে ঘুম পারিয়ে আসি।

সুরো দু-টোকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

ওরা তিনজনেই আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।

কিরে তনু কিছু বুঝছিস।

মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে। চোখে হাসি।

খাবারের ডাক পড়ছে না।

তোর খিদে পেয়ছে? ইসি বললো।

কেন তোর একার পেট আছে, আমার নেই।

আমি জানতাম কর্পোরেসনের কলের জল, আর হাওয়া খেলে তোর পেট ভরে যায়।

মিত্রাকেও মাঝে মাঝে খাই।

সে তুই আর কিছু অবশিষ্ট রাখিস নি। মিত্রা বললো।

রাখলে কাউকে দিতিস নাকি?

ভেবে দেখতাম।

আমি শরীরটা ভাঁজ করে আধশোয়া অবস্থায় ওদের দিকে তাকিয়ে আছি।

নম্রতাকে কাঁদালি কেন।

শুধু এই টুকু উদ্ধার করার জন্য মিছিল করে তিনজন এই ঘরে এসেছিস।

তনু, কথার ভাঁজগুলো শুধু লক্ষ্য করে যা।

ট্রেনিং দিচ্ছিস। মিত্রার দিকে তাকালাম।

দেওয়া হয়ে গেছে, এখন হাতে কলমে কাজ করছে।

ভুলভাল হলে ধরিয়ে দেয়। ইসি বললো।

সাহায্য করি। মিত্রা বললো।

মাস্টারনী।

কপট গাম্ভীর্যের অর্গল খসে পড়লো। তিনজনেই জোড়ে হেসে উঠলো। মিত্রা সোফা ছেড়ে উঠে আমার কাছে এগিয়ে এলো, আমার হাতদুটোকে শক্ত করে ধরে, ধস্তা ধস্তি শুরু করে দিল।

মিত্রাদি আমি সাহায্য করবো।

তুই রেফারি ফাউল করলে পেনাল্টি দিবি।

আমি চোরা গোপ্তা ফাউল করবো। রেফারি দেখতে পাবে না।

শয়তান খালি গণ্ডগোল। নয় এটা নয় সেটা লেগেই রয়েছে। থামার কোনও বালাই নেই।

ইসি দেখছিস তোর ছুটকির বুড়ী বয়সে গায়ের জোড় দেখছিস। একবারে কচি।

একচোট হাসা হাসি হলো। মিত্রা সামান্য হাঁপিয়ে পড়েছে। কাপরটা সামান্য ঠিক করে নিয়ে আমার গায়ে হেলান দিয়ে বসলো।

নম্রতাকে কোথায় পাঠালি? ইসি আমার দিকে তাকাল।

আমি! না, কোথাও পাঠাই নি!

তাহলে?

কি করে বলবো।

ছুটকিকে বললো, মনি তোমার গাড়িটা নিয়ে একটু বেরবো, দেবে। ছুটকি বললো, যা, নিয়ে যা। রবীনের কাছ থেকে চাবি চেয়ে নিয়ে হুস করে চলে গেল।

খেয়ে যায়নি।

বললো এসে খাচ্ছি।

ওর মা কোথায়?

আন্টির সঙ্গে বসে কথা বলছে।

আন্টি কিছু বলেনি?

কতোবার বললো, ওরে কিছু মুখে দিয়ে যা। কে কার কথা শোনে।

তারপর?

কিছুক্ষণ পর দেখি পিকু এসে হাজির।

তিনি কোথায়?

বাইরের গেটে দাঁড়িয়ে।

কেন। ঘরে বসার জায়গা নেই?

বললো নম্রতা এখুনি ফিরে আসবে।

মিত্রার দিকে তাকালাম।

তোর তো বহু সোর্স, জেনে নে।

জানার পর তোকে কি আস্ত রাখব।

মেয়েকে অনিকাকে কে পাঠিয়েছিল সাউকিরি করার জন্য।

ওটা ওরা বোর্ড মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত নেয়।

ম্যানেজিং ডিরেক্টর কে?

অনিকা।

চেয়ারম্যান।

কখনও আমি কখনও তনু।

এখানে আসার আগে ফাইলটা কে সাইন করেছিল।

এখনও সাইন হয়নি।

আমি হাসছি, সঙ্গে ওরাও হাসছে।

শয়তান খালি তেঁয়েটেমি না। মিত্রা দিলো এক থাপ্পর।

মেয়ে কোথায়?

মেয়ে তোমাকে বেশ ভালো বোঝে। অনিকা একটু ঘাবড়ে গেছিল। তনু বললো।

অনিমেষদা এসেছে।

সব ডাক্তারদার বাড়িতে। খুব জোড় মিটিং হচ্ছে।

এ বাড়িতে আসেনি।

এসেছিল খেয়ে দেয়ে আবার চলে গেছে।

দাদা?

দাদা, মল্লিকদা সব। পরে বৌদিকে পর্যন্ত ডেকে নিল।

নম্রতা কাঁদছিল কেন? মিত্রা আবার খোঁচা মারলো।

তুই তো শ্বাশুড়ী জিজ্ঞাসা করতে পারছিস না শ্বশুড় কি বললো। না পারিস বোনপোকে জিজ্ঞাসা কর। দেখ কি বলে।

জিজ্ঞাসা করবে কি রে? তোর ঘর থেকে বেরিয়েই বাগানে দাঁড়িয়ে কাকে ফোন করলো, দু-চারটে বেশ কড়া কড়া কথা বললো শুনলাম। তার আধাঘণ্টার মধ্যে পিকু এসে হাজির। বুঝলাম তখন ফোনটা পিকুকেই করেছিল।

ছুটকি পিকুকে জিজ্ঞাসা করলো। বললো পরে বলছি। তারপরই নম্রতার কথা জিজ্ঞাসা করলো, সেই থেকে গেটের মুখে দাঁড়িয়ে ঘন ঘন ফোন করছে।

ইসি থামলো। হাসছে।

বুঝে গেলি, আমাকে আর নতুন করে জিজ্ঞাসা করার দরকার আছে। মিত্রার দিকে তাকালাম।

মিত্রা চোখে হাসছে।

দেখ তোর দিদিভাই কততো খুশী। তবু আমাকে একটু দেয় না।

মিত্রা আবার হাত তুললো, আমি হাতটা ধরে ফেললাম।

শালি মানে কি। আধা ঘরবালী। আধা ছেড়ে দিলাম, কোয়াটার দিক। সেটাও দিল না।

তনু, ইসি দু-জনেই হাসতে হাসতে সোফায় গড়িয়ে পরে।

মিত্রার হাতটা ধরেই উঠে বসলাম।

চল খিদে লেগেছে। কাল থেকে অনেক বকেছি। এবার আবার বকা শুরু করতে হবে। চলবে রাত অবধি। আমার নিস্তার নেই বুঝলি।

অনিসা-অনিকা গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি একবার চোখ তুলে ওদের দিকে তাকালাম। ইসারায় বললাম, ভেতরে আয়।

দু-জনেই পায়ে পায়ে ভেতরে এলো। পাশে বসে জড়িয়ে ধরে গালে গাল ঘসে বললো, তোমার কাছে অভিনয়টা শিখতে হবে।

অনিকা মিত্রার পাশে বসে আমার দিকে তাকিয়ে।

আমি হাসতে হাসতে বললাম, কিরে ছিরিক ছিরিক ছোরো বিবি, ছিরিক ছিরিক ছোরো।

মামা খুব খারাপ হয়ে যাবে বলে দিচ্ছি। অনিকা হেসে ফেললো।

তারমানে! মিত্রা গোল্লা গোল্লা চোখ করেছে।

একবারে বলবে না। অনিকা চট করে উঠে এসে আমার মুখ চেপে ধরেছে।

অনিকার হঠাৎ ওরকম ব্যবাহারে সকলে হেসে গড়িয়ে পরে।

অনিকা উঁ উঁ করছে প্লিজ মামা, তুমি বোনকে বলো, মামীদের বলবে না।

কেনো বলবে না আমরা শুনবো। মিত্রা হাসতে হাসতে বললো।

না তোমরা শুনবে না। মামার সব দুর্বুদ্ধি।

আমার দুর্বুদ্ধির জন্য কতটা আনন্দ পেয়েছিলি সেটা বললি না।

অনিকা আবার মুখ চেপে ধরেছে।

প্লিজ মামা।

কি দিবি বল।

গাঁট্টা দেব।

বলে দেব।

মিত্রা চোখের ইসারায় বলছে বল বল, অনিকা মুখ টিপে রয়েছে।

নাগো মামী বাজে কথা।

অনিকার হাতটা একটু আলগা হতেই আমি চেঁচিয়ে উঠলাম। ম্যায় মোতেঙ্গে।

ব্যাস হাসির চোটে ঘরটা ম ম করে উঠলো।

বুঝতে আর কারুর বাকি রইল না। ঘটনাটা কি ঘটেছিল।

যাও তোমর সঙ্গে কথা বলবো না। অনিকা পা দাপাতে দাপাতে ঘরের বাইরে চলেগেল।

মাথায় রাখিস খাওয়ার টেবিলে বেশ রসিয়ে রসিয়ে মেনুটা দেব। ঘণ্টা, পক্কে টেবিল বাজাবে।

অনিকা একবার পেছন ঘুরে হেসে বেরিয়ে গেল।

মেয়ের দিকে তাকালাম।

কিরে তোর নম্রতাদির শরীর ঠিক আছে।

মায়ের গাড়ি নিয়ে বেরলো। পিকুদাকে যা দিল না।

হাসতে হাসতে মেয়ের চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

পক্কেদা বলে কি, পিকুদা মাইরি তুমি যা খেল দেখালে না।

মেয়ে হেসেই চলেছে।

আমি হলে বলতাম, বাবা তুমি কেটে পরো, আগে আমি প্রাণে বাঁচি, তারপর তুমি।

জানো বাবা, পক্কেদা ছোটো ছোটো করে এমন দেয় না, তোমার হাড়ে গিয়ে বিঁধবে।

দিদিভাই-এর পেছনে দুজনে কি লাগে।

আমি মেয়ের দিকে তাকিয়ে। বুঝলাম ওপরে বেশ জমপেশ আড্ডা বসে।

সুন্দরদা বলে কি জানো, দ্যাখ পিকুদা, ড্যাড আমাকে একটা কথাই বলেছে, ক্যারিয়ার তৈরি কর, মেয়ে তোর পেছন পেছন ঘুরবে, তুই মেয়ের পেছনে ঘুরবি কেন?

আর তুই বেমক্কা ফেঁসে গিয়ে ফাঁসি কাঠে ঝুলে পড়লি।

যদিও আমি সুন্দরদাকে চেইজ করলাম, কি কড়া কড়া যুক্তি দিল, ধোপে টিঁকলাম না।

বলে কি প্রথমে ছাগল হবি, তারপর গাধা, কিছুদিন জেব্রা হয়ে এপাশ ওপাশ ঘুরবি, শেষে টাট্টু ঘোড়ার মতো দৌড়বি।

দেখ পিকুদা এলিফেন্ট সবচেয়ে বড়োসড়ো প্রাণী। প্রচুর শক্তি। ঘোঁড়ার থেকেও শক্তি বেশি। কিন্তু তুই কখনও কাউকে বলতে শুনেছিস এলিফ্যান্ট পাওয়ার। ফিজিক্স পর, দেখবি সেখানে লেখা আছে ওয়ান হর্স পাওয়ার, টু হর্স পাওয়ার, থ্রি হর্স পাওয়ার, ফোর হর্স পাওয়ার…।

ড্যাড বলেছে কখনও এলিফ্যান্ট হবিনি। প্রথমে ছাগল শেষে ঘোড়া। তোর সঙ্গে ছুটে কেউ পারবে না। এতো এ্যানিমেল প্ল্যান্ট দেখিস, কখনও ঘোঁড়াকে বাঘ বা সিংহ শিকার হিসাবে ধরতে পেড়েছে দেখাতে পারবি। যদি দেখে থাকিস, সেটাও হাতে গোনা।

আর তুই এলিফ্যান্ট হতে গেলি, ধরা খেয়ে গেলি। সচরাচর দেখবি বাঘ বা সিংহ কখনও ফক্স আর হর্সকে খায় না। যাক ড্যাডের পায়ে পরে যা দেখবি কেশ গাইব, না হলে এর পরে আরও চার পাঁচটা ধাপ আছে, তোকে ফার্স্ট স্টেজে ছাগল বানিয়ে দেবে।

চলবে —————————–



from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/MATDvY4
via BanglaChoti

Comments