কাজলদিঘী (২০১ নং কিস্তি)

❝কাজলদীঘি❞

BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

২০১ নং কিস্তি
—————————–

নম্রতা কিছুতেই শুভকে একলা ছাড়তে চাইল না।

শুভ একবার ঝাঁজিয়ে উঠলো। তারপর থম মেরে গিয়ে আবার কাকে ফোন করলো।

তখন ও কার সঙ্গে বেশ উত্যক্ত ভাষায় তুই তাকারি করে কথা বলছে। শেষে বললো আধ ঘণ্টা সময় দিলাম তারমধ্যে কোনও রেজাল্ট না পেলে বাড়ি সমেত উড়িয়ে দেব। তোর মন্ত্রীকে বল তোকে বাঁচাতে।

শুভর এইসব কথা শুনে তখন আমার হাত-পা কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে।

কেশটা যে এতটা জটিল হয়ে দাঁড়াবে বুঝতে পারিনি।

শুভ একটু এগিয়ে গিয়ে কার সঙ্গে ফিস ফিস করে কি কথা বললো।

তখন শুভ একবারে অন্য মানুষ। আমাদের দুজনের একবারে অপরিচিত। ওর চোখের দিকে তাকাতে তখন ভয় হচ্ছে।

ওই খালের ধারে আমরা তখন দাঁড়িয়ে। শুভর মোবাইলটা খালি ঢং ঢং করে বাজে একবার দেখে আবার পকেটে রেখে দেয়।

জায়গাটা বেশ ফাঁকা ফাঁকা আমরা ওই কয়েকজন রয়েছি।

মিনট দশেক পর শুভর মোবাইলটা বেজে উঠলো। হ্যালো বলার পর কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।

তারপর ফোনটা পকেটে রেখে ওই ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে বললো, চল এগিয়ে দিয়ে আসবি। কতো বড়ো বাপের ব্যাটা আমি দেখব।

যেতে যেতে ওদের সঙ্গে কি কথা বললো, আমি ঠিক বুঝলাম না। খালি এটুকু বুঝতে পারলাম এক ঘণ্টার মধ্যে শুভ যদি কোন রেসপন্স না করে ওরা এ্যাকসন শুরু করবে।

জীবনে এইরকম মুহূর্ত কখনও আসেনি।

তোমাকে এই বাড়িতে দেখেছি। সুরোর মুখে তোমার কাণ্ড কারখানা শুনেছি। আজ কি তার সাক্ষী হবো নাকি ? নিজের মনে তখন হাজার প্রশ্ন।

শুভকে বলতে পারছি না চল ফিরে চল। তাহলে হয়তো ও আমাকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে।

কিছুদূর যাওয়ার পর ছেলেগুলো ইশারায় শুভকে কি বলে চলে গেল।

শুভ আগে আমরা দুজন পেছন পেছন হাঁটছি।

পাকা রাস্তা শেষ আমরা ইঁটের তৈরি রাস্তায় পড়লাম। ওদিকটায় কিন্তু খুব একটা বাড়ি ঘর নেই। মাঝে মাঝে মাথার ওপর দিয়ে ইয়া বড়ো বড়ো প্লেন উঠছে নামছে। কি বিকট আওয়াজ। কানে তালা ধরে যায়। এই মনে হয় ঘারে এসে পরলো।

সত্যি অনিদা দারুণ এক্সপিরিয়েন্স।

আমি অংশুর কথা শুনে মনে মনে হাসছি।

একটু এগিয়ে শুভ কাকে ফোন করলো। তখন দেখলাম আপনি আজ্ঞে করে কথা বলছে। ফোনটা পকেটে রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর দেখলাম দুটো ছেলে এসে হাজির হলো। আমাদের তিনজনকে একবার ভাল করে মেপে নিয়ে বললো, আসুন।

হাঁটতে আরম্ভ করলাম। কিছুটা যাওয়ার পর বুঝলাম আমরা বাড়িটার পেছনের পোর্শানে ছিলাম। সামনের দিকে একটা পাকা রাস্তা আছে। বেশ শরু।

গল্পে ভুতুড়ে বাড়ি পড়েছি। আজ চাক্ষুষ দেখলাম। বাড়িটার সারাটা শরীরে বট আর অশ্বত্থ গাছ। আগাছাও যে নেই তা নয়। শিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠছি মনে হচ্ছে যেন এই ভেঙে পরলো। দোতলার একটা ঘর দেখলাম একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। কয়েকটা চেয়ার পাতা। আমাদের বসতে বলে ছেলে দুটো চলে গেল। জানলা আছে, পাল্লা নেই, খালি ফ্রেম আর কয়েকটা লোহার শিক।

নম্রতা একবার আমার মুখের দিকে তাকায় একবার শুভর মুখের দিকে।

শুভ দেখলাম খোলা জানলাটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। একবার নীচু হয়ে কিছু দেখার চেষ্টা করলো। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ পেলাম। একজন নয় বেশ কয়েকজন আসছে মনে হল।

মিনিট তিনেকের মধ্যেই সাতজন এসে হাজির। প্রত্যেকের হাতে আর্মস। দেশী নয় বিদেশী।

গেটের বাইরে দুজনকে লক্ষ্য করলাম।

আমার গলা শুকিয়ে কাঠ। নম্রতার চোখমুখ ফ্যাকাশে।

আমরা কেউ বসিনি। দাঁড়িয়ে ছিলাম।

একজন বলে উঠলো তখন কে ফর ফর করছিলি।

শুভ জানলার দিক থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো, বিনদকে ডাক। বোঝাপড়াটা ওর সঙ্গে। তোরা সব ফাউ।

শুভর কথা শুনে আমার ভিরমি খাওয়ার দশা।

আমি মুচকি মুচকি হাসছি।

হ্যাঁগো অনিদা। শুভর সে কি ডায়লগ। পুরো দাদা।

মাল গুলো সব ভেতরে ঢোকা। দেখছিস না খালি হাতে এসেছি। তোদের বিনদকে বল, একঘণ্টার মধ্যে কাজ মিটিয়ে এখান থেকে বেরতে না পারলে আমরা তিনজন সমেত বাড়িটা মাটিতে মিশে যাবে।

তুই বিনদকে চিনিস। একজন বললো।

কেন ও কি ভারতবর্ষের প্রাইমিনিস্টার, না ফিল্মের হিরোইন যে চিনতে হবে।

শুভ যে এরকম ট্যারা ট্যারা কথা বলতে পারে জানতাম না।

একজন বলে উঠলো তোদের যদি দানা করে দিই।

শুভ ফিক করে হেসে উঠলো।

তোদের দাদাগিরি না করে বাজারে সব্জি বেচা উচিত ছিল। যা যা মেলা বকিস না। টাইম কিল করছিস। বিনদকে ডাক।

একজন দাঁত মুখ খিঁচিয়ে দৌড়ে গিয়ে শুভর কপালে আর্মস ঠেকাল।

আমার বুকটা তখন ধড়াস ধড়াস করছে।

নম্রতা ছুটে যেতে চেয়েছিল ওর হাতটা চেপে ধরলাম।

শুভ নির্বিকার।

হাসতে হাসতে বললো, শোন এইসব চমকানিতে শুভ ভয় পায় না। শুভ যে পরিবারে বড়ো হয়েছে। যে পরিবারে চলাফেরা করে সেখানে তোদের মতো হাজার খানা দাদা দিনে জন্মায়।

তোদের থেকেও অনেক বড়ো বড়ো দাদাদের সঙ্গে শুভর ওঠাবসা।

স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ছেলেটা তখন ট্রিগারে আঙুল রেখেছে। হাত পাঁচেকের দূরত্ব।

শুভ হাসছে। কলজেতে দম থাকলে ঠুকে দেখ।

আমার হাত পা তখন ঠান্ডা। নম্রতা কেমন মরার মত শক্ত হয়ে গেছে।

তুমি বিশ্বাস করো অনিদা পুরো হিন্দী ফিল্মের শ্যুটিং।

ছেলেটা আর্মস নামিয়ে শুভর চোখে চোখ রাখল। শুভও দেখি চোখ থেকে চোখ সরাল না।

ঠোঁটের কোনে ক্রূর হাসি হেসে বললো, কিরে শুকিয়ে গেল।

সে কি চোখ নাচান কি ব্যঙ্গ করছে।

যা বিনদকে ডাক।

বিনদভাইয়া নেই।

আছে আছে। পালাবার সমস্ত পথ শিল করে দিয়েছি। পালাতে গেলে দানা খেতে হবে।

ছেলেটা আর্মসের বাঁটটা দিয়ে শুভকে মারতে গেল।

শুভ হাতটা ধরে হাসতে হাসতে বললো, বে ফালতু তখন থেকে তরপাচ্ছিস। যা বলছি শোন।

ছেলেটা কেমন মিইয়ে গেল।

চোখ থেকে চোখ সরায়নি।

মেয়েটাকে যদি তোর চোখের সামনে রেপ করি।

নম্রতা চেঁচিয়ে উঠলো।

শুভ কিন্তু তখনো নির্লিপ্ত। তখনও ও হাসছে।

আস্তে করে বললো, এই পৃথিবীতে প্রত্যেকটা মানুষ বাঁচতে চায়। তুইও বাঁচতে চাস আমিও। তুই যদি ভেবে থাকিস এই সব করে তুই বুক ফুলিয়ে বেঁচে থাকবি তাহলে ভুল।

তারপর ঘরিটার দিকে তাকিয়ে বললো। আর পাক্কা আধাঘণ্টা সময় আছে।

আচ্ছা ছেলেটা কি বাংলায় কথা বলছিল। আমি বললাম।

না। হিন্দীতে। কুচকুচে কালো দেখতে। বছর তিরিশেক বয়স হবে। একটা ঘনো মেরুন কালারের সাফারি পরেছিল। চুলগুলো ছোট ছোট করে ছাঁটা।

ছেলেটা গট গট করে বেরিয়ে গেল।

নম্রতা ছুটে গিয়ে শুভকে জড়িয়ে ধরে বললো, তুই এখান থেকে ফিরে চল।

শুভ ঝাঁজিয়ে উঠলো। সিনক্রিয়েট করবি না। এখানে খেলা করতে আসিনি।

এক ঝটকায় নম্রতাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে জানলাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

তখন শুভ একবারে অন্যমানুষ। আমি কুলকুল করে ঘেমে যাচ্ছি। সারাটা শরীরে একটা অস্বস্তি। গা-টা কেমন গুলিয়ে উঠছে।

আর সব ছেলেগুলো কেমন ভাবে যেন আমাদের দিকে তাকিয়ে।

হাড় হিম করা চাহুনি।

শুভ জানলার দিক থেকে ফিরে তাকায় না। সত্যি বলছি অনিদা তখন শরীরটা বেশ আনচান করছিল। ঘন ঘন বাথরুম পেয়ে যাচ্ছে।

কিছুক্ষণ পর সেই ছেলেটার সঙ্গে একজন এল। পরনে সাদা পাজামা সাদা সার্টের মতো পাঞ্জাবী। কালো কুচকুচে গায়ের রং। বয়স তোমার কাছাকাছি। মাথার কাঁচা-পাকা চুলগুলো ছোট ছোট করে ছাঁটা। হাইট পাঁচফুট কিংবা তার কাছাকাছি। নিখুঁত ভাবে দাড়ি গোঁফ কামান।

নিস্তব্ধে ঘরে ঢুকে কিছুক্ষণ আমাদের দিকে ঠাণ্ডা চাহুনি মেলে তাকাল।

হিন্দীতে বলে উঠলো কে বেশি ফর ফর করছিল, এটা না ওটা।

কথাটা শুনে শুভ ঘুরে দাঁড়াল।

শুভর চাহুনি তখন পুরো চেঞ্জ, বুঝলাম ও ঠিক স্বাভাবিক নেই।

নতুন মানুষ ঘরে এসেছে। শুভ চোখে চোখ রেখেছে।

শুভর চোখের দিকে তাকাতে পারলাম না। মাথা নীচু করে নিলাম। হাত পা কাঁপছে।

এই মনে হয় কিছু একটা অঘটন ঘটল।

শুভ ধীর পায়ে ভদ্রলোকের কাছে এগিয়ে এসে মাথা নীচু করে ইংরজীতে বললো।

বিনদ আঙ্কেল আমাকে ক্ষমা করুন। আমি অনেক নোংরা কথা বলে ফেলেছি। তারপর নীচু হয়ে ভদ্রলোকের পায়ে হাত ছোঁয়াল।

ভদ্রলোক নির্লিপ্ত চোখে শুভকে দেখছে। চোখের ভাষা বোঝা মুস্কিল। কোনও মুভমেন্ট নেই।

আমার সঙ্গে এই দুজন এসেছে। একে একে আমাদের পরিচয় দিল।

ভদ্রলোক ভাবলেশহীন মুখে আমাদের দিকে একবার তাকাল।

শুভ একটাও বাংলা কথা বলছে না। সম্পূর্ণ ইংলিশে।

আমি কোনও অপরাধ করে থাকলে আপনি আমাকে শাস্তি দিতে পারেন।

শুভ যে মুহূর্তের মধ্যে এতটা চেঞ্জ হয়ে যাবে, এতটা নীচু স্বরে কথা বলতে পারে, আমি ভাবতে পারিনি।

শুভ ওরকম ঢ্যাঙা ভদ্রলোক শুভর বুকের কাছে।

কেউ চোখ থেকে চোখ সরাচ্ছে না। নিস্তব্ধ ঘর।

তুমি আমাকে চিনলে কি করে। ভদ্রলোক ইংলিশে বললেন।

যিনি আমাকে আপনার শরীরের, আপনাকে দেখতে কেমন কি জামা কাপর আপনি বেশিরভাগ সময় পরতে পছন্দ করেন তার বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি অবশ্য আমাকে বলেছিলেন। তোকে যদি দেখা করার পার্মিশন না দেয় তাহলে আমার পরিচয় দিবি। আমার ম্যাসেজটা তুই খালি ওর কাছে পৌঁছে দিবি।

আমি সেই সাহায্যটুকু নিইনি। ডাইরেক্ট আপনার কাছে পৌঁছবার চেষ্টা করেছি।

ভদ্রলোক কেমন যেন অধৈর্য হয়ে উঠলেন। চেঁচিয়ে উঠলেন কে তিনি?

আমার আঙ্কেল।

কে তোমার আঙ্কেল।

অনি ব্যানার্জী।

তুমি বিশ্বাস করো অনিদা তোমার নামে যে এত যাদু। সেই প্রথম উপলব্ধি করলাম।

আমি অংশুর কথা শুনে মুচকি মুচকি হাসছি।

তুমি হাসছ। দেখ আমার গায়ের লোমগুলো কেমন খাঁড়া হয়ে উঠেছে।

ভদ্রলোকের চোখমুখ মুহূর্তের মধ্যে চেঞ্জ হয়ে গেল। কেমন যেন উস-খুস করে উঠলো।

তুমি অনিদার….!

না। আমি শুভ। শুভ মুখার্জী।

ভদ্রলোকের ভ্রু-দুটো কেমন ছুঁচলো হয়ে গেল।

শুভ মুখার্জী! লেট মিঃ এস. মুখার্জী তোমার কে হন?

আমার বাবা।

ভদ্রলোক শুভকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলেন, ও মাই গড আমি কি ভুল করছিলাম।

তারপর শুভকে ছেড়ে দিয়ে নিজেই পকেট থেকে মোবাইলটা বার করে একটা নম্বর ডায়াল করে কানে দিলেন। কিছুক্ষণ পর স্বগোতক্তির সুরে বলে উঠলেন।

শুভ স্যুইচ অফ।

আঙ্কেলের মনটা ভাল নয়, শরীরটাও ইদানীং ভাল যাচ্ছে না।

কি হয়েছে অনিদার! ভদ্রলোকের কন্ঠে স্পষ্ট উৎকণ্ঠা।

সেই এ্যাক্সিডেন্টের পর থেকে আঙ্কেলের শরীরটা কেমন ভেঙে গেছে। তারপর পারিপার্শিক এত চাপ আঙ্কেল ঠিক সামলে উঠতে পারছে না।

কে ডিস্টার্ব করছে অনিদাকে।

দুজনেই আঙ্কেলের বাল্য বন্ধু। একজন এক্স মিনিস্টার মিঃ অনাদি চন্দ, আর একজন দিবাকার মন্ডল ওরফে বাচ্চে সিং।

কি বললে!

শুভ হাসলো।

এই তো দেখুন না….। শুভ চুপ করে গেল।

কি বলছিলে বলো।

আমি সঠিক বলতে পারবো না। তবে আঙ্কেলের কথাবার্তা শুনে যতটুকু গেইজ করেছি যিনি আপনাকে এই কাজের দায়িত্ব দিয়েছেন তাঁর মেয়ে আপনার সামনে দাঁড়িয়ে। তাঁর স্ত্রী-শ্বাশুরিমা আঙ্কেলের বাড়িতে রয়েছেন। বলতে পারেন ওই ভদ্রলোকের হাত থেকে বাঁচাতে নিজের কাছে নিয়ে এসে রেখেছেন।

তার মেয়ের পরিচয় একটু আগে আপনাকে দিয়েছি। আপনার সামনে সে দাঁড়িয়ে।

ভদ্রলোক কেমন যেন অবাক হয়ে নম্রতার দিকে তাকাল।

তারপর মুখটা কেমন শুকনো করে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন তোমরা বসো। খুব বড়ো একটা ভুল করে ফেলছিলাম। অনিদার কাছে জীবনে মুখ দেখাতে পারতাম না।

তারপর কেমন যেন হয়ে গেলেন, নিজেই চেয়ার এনে নম্রতাকে বললো, বোস বেটি বোস। ডর মাত।

তখন আর যে সব ছেলেপুলেরা ছিল সব আর্মস কোমরে গুঁজে নিয়েছে।

ওনাকে চেয়ার আনতে দেখে আর দুজন এগিয়ে গেছে।

ভদ্রলোক কেমন যেন ঘোরের মধ্যে কথা বলছেন।

তোরা একটু ওদের জন্য ঠান্ডা নিয়ে আয়।

নম্রতা সেই সময় লজ্জার মাথা খেয়ে বলে ফেলেছে।

আঙ্কেল আমি বাথরুমে যাব।

তুই বাথরুমে যাবি। যা।

তারপর একটা ছেলের দিকে তাকিয়ে বললো, ওকে একটু বাথরুমটা দেখিয়ে দে।

নম্রতার দিকে তাকিয়ে বললো ভয় পাবি না। আমি আছি।

শুভর ফোন বেজে উঠলো।

বিনদভাই শুভর দিকে তাকিয়েছে।

আঙ্কেল ফোনটা রিসিভ করছি।

কর।

শুভ ইংরাজী বাংলা মিশিয়ে কথা বললো। সামান্য কথা।

মিটিং চলছে। তোমরা যে যে জায়গায় আছ দাঁড়াও। সিগন্যাল না পেলে কাজ শুরু করবে।

বিনদভাই শুভর কথা শুনে হাসল।

তুই সত্যি….।

হ্যাঁ আঙ্কেল। এটা আঙ্কেলের স্ট্র্যাটিজি।

বিনদভাই হাসছে। অনিদা তার সাম্রাজ্য রক্ষার জন্য ঠিক লোককে চুজ করেছে।

আপনি কি একবার অর্জুন আঙ্কেলের সঙ্গে কথা বলবেন।

মুহর্তের মধ্যে বিনদভাই-এর চোখ মুখের পরিবর্তন হলো। ঝাঁজিয়ে উঠলো। কেন?

আঙ্কেল এই ম্যাসেজটুকু আপনাকে পৌঁছে দিতে বলেছে।

বিনদভাই কেমনভাবে যেন শুভর দিকে তাকাল। কথাট যেন ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না।

তুই ফোনে এই ম্যাসেজটা দিতে পারতিস না।

ফোনটা আপনি ধরেননি।

কি করে বুঝলি।

আপনার গলার রেকর্ডিং আঙ্কেল শুনিয়েছে।

বিনদভাই ফ্যাল ফ্যাল করে শুভর দিকে তাকিয়ে।

আপনি পার্মিশন দিলে আমি আমার ফোন থেকে অর্জুন আঙ্কেলকে ফোন করবো।

অনিদা কি করতে চাইছে ঠিক বুঝতে পারছি না।

আঙ্কেল ভাঙা সম্পর্ক জোড়া লাগাতে চাইছে।

বিনদভাই-এর গালে কে যেন কষে একটা থাপ্পর মারলো।

তুই সব জানিস!

ভাষা ভাষা।

নম্রতা ফিরে এলো। পাঁচজন আমাদেরকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

আপনি কি মিঃ ঘোষ, মিঃ চ্যাটার্জীকে এখানে নিয়ে এসেছেন।

তুই জানলি কি করে!

আঙ্কেলের কাছে সেরকমই ইনফর্মেসন আছে।

ওনাদের সঙ্গে অনিদার পরিচয় আছে?

না।

ওনারা অনিদার নাম কখনও শুনেছেন।

হয়তো শুনে থাকবেন। তবে ওনারা এর মধ্যে ইনভলভ নন। আমি যাদের কাছ থেকে ডাটা নিয়ে এসেছি তারা ওই অফিসের ক্লার্ক। তারা আঙ্কেলকে চেনেন।

বিনদভাই মুচকি হাসলেন।

একজন চিপসের প্যাকেট আর কোলড্রিংকসের বোতল নিয়ে এলো।

বিনদভাই নম্রতার দিকে তাকিয়ে বললেন, একটু জল খা। এখানে হাতের কাছে আর কিছু নেই।

অংশুবাবু আপনি খান।

তারপরই শুভর দিকে তাকিয়ে বললো।

অনিদার আর ফোন নম্বর নেই।

যে দুটো আছে তার সিম আঙ্কেলের মানিপার্টস-এ আছে। প্রয়োজনে সেগুলো অপারেট করে। তারপর আবার খুলে রেখে দেয়।

তুই সব জানিষ!

কিছু কিছু।

অর্জুনের নম্বরটা দে?

আপনার কাছে আছে।

পুরনো না নতুন?

বলতে পারবো না। আঙ্কেল যা বলেছে তাই বললাম।

নিজেই পকেট থেকে ফোন বার করে ডায়াল করলো।

হ্যালো বলার আগেই বুঝলাম ও প্রান্ত থেকে খুব জোড়ে কিছু বলে চলেছে কেউ। বিনদভাই চেয়ার ছেড়ে উঠে বাইরে বেরিয়ে গেল। প্রায় পনের মিনিট কি কথা হলো জানি না। দূর থেকে খালি একটা কথাই বার বার ভেসে এলো, তুই বিশ্বাস কর….তুই শুভকে জিজ্ঞাসা কর….

ঘরে যখন এলো তখন দেখলাম চোখ মুখ একবারে পরিবর্তন হয়ে গেছে। চোখ দুটোয় আগুন ঝরে পড়ছে।

একজনকে বললো, আলমকে বুলাও।

ছেলেটি রুদ্ধশ্বাসে দৌড়লো।

আমাদের মুখের দিকে তাকাতে পারছে না। বেশ বুঝতে পারছি ভেতরে ভেতরে উনি প্রচণ্ড অস্বস্তিতে ভুগছেন।

কিছুক্ষণ পর বছর পঁচিশের একটা ছেলে ঘরে এসে ঢুকলো।

বিনদভাই ঠান্ডা চোখে ওর দিকে তাকাল।

উস মোবাইল মে কাল কোয়ি ম্যাসেজ আয়া।

হ্যাঁ।

কোন কিয়া?

ঝিনুক নে কিয়া।

তু-নে মুঝকো বুলায়া।

ছেলেটা মাথা নীচু করে নিল।

কেয়া লিখ্যা থা।

কেশ উইথড্র করনেকে লিয়ে বুলায়া। এক নম্বর ভি দিয়া থা উস নম্বর মে ফোন করনেকে লিয়ে বুলায়া। ম্যায় উস নম্বর মে ডায়াল কিয়া নো রেসপন্স হুয়া। বাদ মে এক ম্যাসেজ আয়া। রাত দেড় সে দো বাজতক অন্দর ফোন করনেকে লিয়ে বুলায়া। উস টাইম আপ শো গায়া ম্যায় ফোন কিয়া উসনে মুঝে বহুত ডাঁটা। বোলা ম্যায় বিনদ নেহি। ম্যায় ভি উসকো বোল দিয়া দেখ লুংগা।

বিনদভাই নিজে নিজেই কেমন সারাটা শরীর কাঁপিয়ে জোড়ে হেসে উঠলো।

আলমের চোখে মুখে একরাশ বিষ্ময়।

হাসি থামিয়ে ধীর স্থির ভাবে বললো।

আলম, তেরা অউর মেরা নসীব বহুত আচ্ছা থা। ইসলিয়ে আভিতক ম্যায় অউর তু দোনো জিনদা হুঁ। আজতক ম্যায়নে জো ভি গলদ কাম কিয়া, দাদা কো গুসসা নেহি আতা, মেরে কো সামঝায়া, গলদ কাম সে বাহার হোনেকো রাস্তা ভি বাতা দিয়া। মেরে শির পর দাদাকো হাত নেহি রহতা তো বিনদ আভি তক জিনদা নেহি থা।

ভাষা ভাষা চোখে ছেলেটার দিকে তাকাল।

অউর কোই আদমি ফোন কিয়া।

ভিকি ফোন কিয়া।

কেয়া বোলা।

আলম মাথা নীচু করে রইলো।

ইস মকান মিট্টি মে মিলা দেঙ্গে।

আলম চুপ করে রইলো।

তারপর যা বললো, আমি শুনে অবাক।

বললো ভিকির ছেলেরাই ওদের শেল্টার দিয়েছে। এই বাড়ির বাইরে যারা আছে তারা সবাই ভিকির ছেলেপুলে।

আলমের মুখটা কেমন শুকিয়ে গেল।

তোকে অনিদার গল্প বলেছি।

আলম মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে।

কাল তুই অনিদার সঙ্গে কথা বলেছিস।

আলম তখন বিনদভাইয়ের দিকে বিষ্ময়ে তাকিয়ে রয়েছে।

ওই নম্বরটা অনিদার। অনিদা আমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিল।

ভুল হয়ে গেছে বস। আমি এখন একবার ফোন করি।

বিনদভাই হাসল। শুভর দিকে তাকাল।

শুভ অনিদা তোকে আর কি বলেছে?

আমাকে আর কিছু বলে নি।

অনিদাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।

আমাকে আপনার ফোন নম্বরটা দিন। আমি ঠিক সময়ে আপনাকে খবর দিয়ে দেব।

আমি আজই চলে যাব।

না।

কেন?

আঙ্কেলের হুকুম।

তোকে দায়িত্ব দিয়েছে।

হ্যাঁ।

এরা কোথায় যাবে?

আঙ্কেল সব ব্যবস্থা করে রেখেছে।

তুই সবাইকে চিনিস!

কিছু কিছু।

আলতাফ, ভিখু এদেরে দেখেছিস?

আলতাফ আঙ্কেল, ভিখু আঙ্কেলর সঙ্গে পরিচয় আছে।

তুই সব বুঝতে পারছিস?

একটু একটু।

খবরটা অনিদার কাছে কি করে পৌঁছল বলতো।

সঠিক বলতে পারবো না। তবে গেইজ করেছি।

কি রকম!

পর্শুদিন যখন আপনি কলকাতায় নেমেছেন সেই সময় আঙ্কেলকে একজন ফোন করেছিল। আমি আঙ্কেল বসে কথা বলছিলাম। আঙ্কেলের কথা শুনে মনে হল উনি হানিফ আঙ্কেল।

তুই হানিফভাইকে চিনিস!

পিসাই, নম্রতাদিও দেখেছে।

বিনদভাই আমাদের দিকে তাকাল।

জানিস শুভ আজ একটা দিনের কথা বার বার মন পড়ে যাচ্ছে।

বিনদভাই-এর গলাটা কেমন ভারি হয়ে এলো।

তখন আমরা সবাই আফতাবভাই-এর হয়ে কাজ করতাম।

তুমি আফু আঙ্কেলকে চেন! নম্রতা বলে উঠলো।

ভাবছিস তাহলে আমি কেন আফতাবভাই-এর এ্যান্টি।

শুভ বিনদভাই-এর দিকে তাকিয়ে।

তখন কিন্তু আমরা বেশ স্বাভাবিক। আমাকে বললো, অংশুবাবু একটু র-চা খাবেন।

আমি হ্যাঁ বললাম।

কথাবলার ফাঁকেই চা স্ন্যাক্স এলো।

বিনদভাই বললো, হ্যাঁরে শুভ আধঘণ্টা হয়ে গেল, আমরা আবার উড়ে যাব না তো?

শুভ হেসেই বললো, আমি সেই ভাবেই খবর পাঠিয়েছি।

তুই বাংলায় বললি, বুঝব কি করে?

শুভ আবার ইংরেজী তর্জমা করে বলে দিল তখন কি কথা হয়েছিল।

তখন দাদা আফতাবভাই-এর পরিবারের একজন।

সেদিন দুপুরের দিকে আমরা আড্ডা মারছিলাম। আমি, ভিখু, আলতাফ, হানিফ। তখনও অর্জুন, ঝিনুক, অভিমন্যু আমাদের দলে আসে নি। হঠাৎ নেপলা ফোন করলো। তুমি ইমিডিয়েট এই জায়গায় এসো।

তুমি নেপলা আঙ্কেলকে চেন? নম্রতা বললো।

নেপলা, অবতার, সাগির সবাইকে?

হুড়মুড় করে সবাই সেই জায়গায় গেলাম।

দেখলাম একজনের বডি পড়ে আছে। সারাটা শরীর বুলেটে ঝাঁজরা করে দিয়েছে। দাদা স্থানুর মত দাঁড়িয়ে। মুখটা অসম্ভব গম্ভীর। আমরা যেতেই বললো।

আলতাফ, তুই বিনদ আমার সঙ্গে একটু চল।

নেপলা বললো, আমি যাব।

দাদা দেখলাম কোনও কথা বললো না।

আমরা তিনজনে বেরিয়ে এলাম। ওরা ওখানে থেকে গেল।

ওখান থেকে বেরিয়ে একটা ফ্ল্যাটে এলাম। দেখলাম দরজা হাট করে খোলা। দাদা হন্ত-দন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলো। দেখলাম একজন মহিলা মুখ থুবড়ে ঘরের মধ্যে পড়ে রয়েছে। চারদিকে রক্ত ভেসে যাচ্ছে। দাদা কিন্তু ভদ্রমহিলার দিকে না তাকিয়ে কাকে যেন খুঁজে বেরাচ্ছে। তারপর ভেতরে গিয়ে একটা দরজা খোলার চেষ্টা করলো। কিছুতেই পারলো না। আমাকে বললো দরজাটা ভাঙ। আমি নেপলা জোড়া পায়ে দরজায় সজরে লাথি মারলাম।

দরজাটা খুলতেই দাদা ছুটে ভেতরে গেল। একটা বাচ্চাছেলে বিছানায়। বয়স কতো হবে দশ এগার মাস। দাদা প্রথমেই বাচ্চাটার গলায় হাতদিল তারপর পাগলের মতো বুকে কান পাতলো। তারপর কানের তলায় হাতদিল। কিছুতেই যেন বিশ্বাস হচ্ছে না বাচ্চাটা বেঁচে আছে। আমরা দেখলাম বাচ্চাটা কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়েছে। চোখের কোলে স্পষ্ট জল শুকিয়ে যাওয়ার আভাস। দাদা বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো। সেদিন জীবনে প্রথম দাদাকে ওইরকম ভাবে হাপুস নয়নে কাঁদতে দেখলাম।

নেপলা, আফতাবভাইকে ততক্ষণে ফোন করে দিয়েছে। আফতাবভাই, দিদি এলো। দিদির কোলে বাচ্চাটাকে দিয়ে বললো, ভেবে নাও এ তোমার ছেলে। আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত একে তোমার কাছে রাখবে।

দেখলাম শুভর চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে জল পড়ছে। চোখমুখ লাল হয়ে গেছে। নম্রতা উঠেগিয়ে শুভর পিঠে হাত রাখলো। বিনদভাইও কেমন যেন চুপ করে গেল।

জানিস শুভ, তারপর তিনদিন দাদাকে হন্যে হয়ে খুঁজেছি। পাইনি।

আফতাবভাই নিজের যতদূর সোর্স ছিল কাজে লাগাল। অনিদাকে খুঁজে পাওয়া গেল না। দাদাকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। দিদি, আফতাবভাইকে যা নয় তাই বলছে। আবুভাইকে বললো যেখান থেকে পারো অনিকে খুঁজে নিয়ে এসো। তিনসপ্তাহ অনিদার কোনও ট্রেস নেই। তেইশ দিন কি চব্বিশ দিনের মাথায় অনিদার ফোন পেলাম। বিনদ আমি এয়ারপোর্টে, এখুনি চলে আয়।

আফতাবভাইকে বললাম।

আফতাবভাই বললো, তুই যা আমাকে টাইমে টাইমে খবর দিবি। আলতাফকে বললো, তুই ওর সঙ্গে যা। দুজনে চলে এলাম।

এয়ারপোর্টে এসে অনিদাকে দেখে ভয় পেয়েগেলাম। একটা চেয়ারে শরীরটা এলিয়ে বসে আছে। ঝোড়ো কাকের মতো দেখতে লাগছে। চোখগুলো কেমন গর্তে ঢুকে গেছে। জবাফুলের মতো লাল। মাথার চুলগুলো কেমন উসকো খুসকো, যেন কতদিন ঘুময়নি।

তোমার কি হয়েছে!

কিছু না। একটা কাজ করতে পারবি।

বলো।

একটা স্পট বেল দিল। বললো এই জায়গায় এইরকম দেখতে পাঁচজন থাকবে উইথ ফ্যামিলি। মেয়ে কিংবা বাচ্চাদের ওপর কোনও এ্যাকসন করবি না। খালি লোকগুলোকে মেরে দিবি।

তুই একা যাবি আর কেউ যাবে না।

চুপ করে থাকলাম। বললাম শুভর দাদু-ঠাকুমা-পিসি এসেছেন।

কোথায় আছেন?

আফতাবভাই-এর বাড়িতে।

উঠে দাঁড়াল।

আমাকে খোঁজার চেষ্টা করবি না। কাল কাজটা হলে আমাকে খবর দিবি।

পরদিন দাদার দেওয়া টাইম মতো ওখানে পৌঁছলাম। একটা টেবিলে বসেছি। কছুক্ষণ পর একটা বয় জলের ট্রে আর মেনু কার্ড নিয়ে এসে হাজির। মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম। অনিদা!

ইসারায় খালি টেবিলটা দেখিয়ে চলেগেল।

বুঝে গেলাম দাদা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে অপারেট করবে।

দাদার সিগন্যাল মতো কাজ করলাম। দুর্ভাগ্য তিনটেকে মারতে পেরেছিলাম। বাকি দুটো পালিয়ে গেল। দাদাই বেরিয়ে আসার পথ দেখিয়ে দিল। বললো এয়ারপোর্টে চলে যা, আমি যেখানে কাল বসেছিলাম, সেখানে একজন ভদ্রলোক বসে থাকবেন। ইন্ডিয়া চলে যা, উনি তোকে সব ব্যবস্থা করে দেবেন।

দাদার কথা মতো কাজ করলাম। অনেকদিন পরে জানতে পারলাম বাকি দুটোকে ইন্ডিয়াতে অর্জুন মেরেছে। তখন আমি অর্জুনকে দেখিনি। অর্জুনের সঙ্গে পরিচয়ও হয়নি। দাদাই তখন আমার সংসার চালাত।

আফতাবভাই, দিদি ঘরে ঢুকলো।

দিদির চোখ ছলছলে। আফতাবভাই-এর চোখে আগুন।

আমি উঠে বসলাম।

দিদি এসে আমার পাশে বসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।

দেখলাম গেটের মুখে বড়োমা, ছোটোমা, বৌদি।

এতদিন তুই এই কথা আমার কাছে গোপন রেখেছিলি কেন?

আফতাবভাই-এর গলাটা গম গম করে উঠলো।

অংশু কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে।

তুই নিজেকে শের মনে করিস।

আমি হেসে ফেললাম।

দিদি আমাকে জড়িয়ে ধরেই আফতাবভাই-এর দিকে তাকাল।

তোমরা সব সময় ওকে শেল্টার দাও।

বৌদি মুখ নীচু করে মুচকি হাসলো। ছোটোমা, বড়োমা একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে।

আমি দিদির দিকে তাকালাম।

সব জেনে ফেলেছে তাই না? তাই এতো গরম।

দিদি কান্নাভেঁজা চোখে হেসেফেললো।

তুই আমাকে একবার বলতে পারতিস।

যে লোকটা দাদার এতবড়ো এ্যান্টি সে গত পঁচিশ বছরে দাদার কোনও ক্ষতি করেছে? করে নি। এমনও অনেকবার হয়েছে, দাদার পক্ষে ওইরকম পজিসন থেকে বেরিয়ে আসা খুব টাফ। তুমি আমাকে ফোন করে বলেছো। দাদা স্মুথলি সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছে। কোনও অসুবিধে হয়নি। কি করে হলো? কই তখন তোমরা আমাকে কোন প্রশ্ন করোনি। আজ তাহলে কেন করছো?

মনে রাখবে বিনদ যেটা করে ফেলেছে না জেনে করেছে। আমার ম্যাসেজ যদি ঠিক সময় ওর কাছে পৌঁছে যেত তাহলে এই ঘটনা ঘটতো না। তোমরাও এতোটা টেনসনে ভুগতে না।

কেন তুই বিনদকে আমার কাছ থেকে সরিয়েছিলি।

এটাও আমাকে খুলে বলতে হবে। নম্রতা, শুভর মুখ থেকে এতো গপ্প শুনলে এটা ধরতে পারলে না।

সত্যি বলছি অনিদা, বিনদভাই এব্যাপারে কিছু বলেনি। অংশু বললো।

সবাই এবার অংশুর মুখের দিকে তাকিয়েছে।

শেষে শুধু একটা কথাই বলেছে, জানিষ শুভ আমার কাছে অনিদা আছে। আফতাবভাই না থাকলেও আমার কোনও ক্ষতি নেই।

হবে কি করে, জানে আফতাবভাই-এর কাছে সহজে মাল বাগাতে পারবে না। অনিদার কাছে যখন যা চাইবে পেয়ে যাবে। তাই বলি তোর এতো টাকা কিসে লাগে।

তুমি অনেকক্ষণ থেকে গরম দেখাচ্ছ, একটা কথাও বলিনি। এবার দিদির সামনে সব বমি করে দেব। লঙ্কাকাণ্ড বেঁধে যাবে।

আফতাবভাই হেসে ফেললো।

আফুআঙ্কেল তুমি এখানে, চলো চলো শুভর লাস্ট এপিসোডটা শুনবে চলো, ভেরি ইন্টারেস্টিং।

অনিকা, অনিসা গেটের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেললো।

বাবা, মা-ছোটোমা বলেছে তোমাকে হাত-পা বেঁধে পিট্টি দেবে।

আর কেউ দেবে না?

পিসী বলেছে আলাদা করে দেবে।

সেই বল।

কেন, অন্যায় করবে? আফতাবভাই চেঁচিয়ে উঠলো।

যাও বাকিটুকু শুভর মুখ থেকে শুনে নাও। ও খুব ভালো গল্প বলতে পারে।

আফতাবভাই-এর মুখ থেকে ছোটোমার মুখের দিকে তাকালাম।

একঘণ্টা হয়েগেল এক কাপ চা পেলাম না।

কে দেবে রে। সবাই ও ঘরে গল্প শুনছে।

আমি দিদির অর্গল মুক্ত হয়েছি। মুখের দিকে তাকালাম।

নিজেরা তো বেশ বিরিয়ানি পিটলে, আমার কথা মনেছিল?

তুই দেখেছিস!

এখানে শুলে পর্দার ফাঁক দিয়ে সব দেখা যায়।

তোকে বলেছে।

ওরা তিনটের সময় আসবে বলেছে মিটিংয়ে বসবি। আফতাবভাই বললো।

কেন আমি কি মালিক? যারা মালিক আর যে ইনভেস্ট করবে সে বসবে। ফালতু বিরক্ত করবে না।

আফতাবভাই হেসে ফেললো।

দিদির মুখের দিকে তাকালাম। হাসছে।

নোটটা দিতে বলো। এখুনি হিসেব নিচ্ছিল।

আফতাবভাই এগিয়ে এসে আমার ঘারটা ধরতে গেল দিদি হাতটা ধরে ফেললো।

অনিকারা হাসছে।

বড়োমা চা পেলাম না। বেলাও অনেক হয়েছে। এবার খেতে দাও।

আফতাবভাই বড়োমার মুখের দিকে তাকাল। ব্যাপারটা এরকম অনি কি বললো।

অনিকা ইংরাজী তর্জমা করলো।

আফতাবভাই আমার মুখের দিকে তাকাল।

তোমার খিদে পায়নি?

উর্দুমে বোল।

কেন। বাংলাটা শেখো। এখানে ব্যবসা করবে আর উর্দু-হিন্দীতে কথা বলবে তা হয় নাকি।

অনিকা আবার ইংরাজী তর্জমা করলো।

আমি হাসছি।

নাজমা এখন বসবে নাকি? বড়োমা তাকাল দিদির দিকে।

মিঃ রাঘবন আসছেন।

সে কি এখানে এসে খাবে নাকি?

আমাকে সেরকমই বললো।

সে তো ভীষণ পিট পিটে।

তা জানিনা, বললো, ম্যাডাম পৌঁছে সকলে একসঙ্গে লাঞ্চ করবো।

অনিমেষ জানে?

কেন সেদিনই ডেট টাইম ফাইন্যাল করেছিলেন।

তুমি আবুর সঙ্গে কথা বলেছিলে?

আফতাবভাই দিদির দিকে তাকাল।

অনিকার সঙ্গে লাস্ট কথা হয়েছে।

আফতাবভাই আমার পাশে এসে বসতে গেল।

তোমাকে বসতে হবে না। তুমি শুভ আর নম্রতার এন্ডিং-পার্টটা শুনে এসো।

আফতাবভাই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে।

অনিসা আবার তরবর করে উঠলো, কিগো।

দাঁড়া যাচ্ছি। নাসরিন একটু চা কর না তোর মামার মাথাটা একটু ঠাণ্ডা করি।

ছোটোমারা গেটের মুখে দাঁড়িয়ে হাসছে।

এখনও মিত্রা, তনু এসে ভিড় করেনি।

আফতাবভাই-এর দিকে তাকালাম।

বিনদের সঙ্গে কথা বললে?

আফতাবভাই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে।

বয়স হয়ে যাচ্ছে, এবার সব ব্যবসাপত্র বসিরকে বুঝিয়ে দাও।

আগে বিয়েটা দিই।

আমি আফতাবভাই-এর মুখের দিকে তাকালাম। দিদি আমার পাশে বসে হাসছে।

আমি উঠে দাঁড়ালাম।

আফতাবভাই আমার হাতটা চেপে ধরলো।

কোথায় যাবি?

কাজ আছে।

চল আমিও যাই।

দিদি জোড়ে হেসে উঠলো।

ঘরের বাইরে এলাম। ছোটোমারা একপ্রস্থ খাওয়ার ব্যবস্থা করছে।

তনু, মিত্রা দুজনে মাসীমনিকে ধরে ধরে নিয়ে ঘরে ঢুকলো। আমি একটু অবাক হয়ে তাকালাম।

তোমার চেয়ার কোথায়?

এখন হাঁটতে পারছি।

সে তো দেখতেই পাচ্ছি।

তুই তো আর খোঁজ খবর রাখিস না।

অতি সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট।

উত্তর পেলে। মিত্রা মাসীমনির মুখের দিকে তাকাল।

মাসীমনি হাসছে।

তোরা ওর কথা গায়ে মাখিস না।

মাখলে এতদিন আমি তনু মরে হেজে যেতাম।

ওরা দুজনে মাসীমনির দু-হাত ধরে আস্তে আস্তে চেয়ারে বসাল।

মাসীমনি একটুতেই হাঁপিয়ে পড়েছে।

আফতাব কিছু বার করতে পারলে।

না মাসী, ওর দিদিকে হয়তো পরে বলবে। তারপর আমি জানবো।

দিদাই একটা জিনিষ খাবে?

অনিকা রান্নাঘরের গেটের মুখ থেকে চেঁচাল।

মাসীমনি একবার ওদের দিকে তাকিয়ে মাথা দোলাল, না হ্যাঁ কিছুই বোঝা গেল না।

তুমি একটু খাও তারপর আমি বোন।

মিত্রা তনু হাসছে।

ছোটোমা-বৌদি রান্নাঘরের গেটের মুখে দাঁড়িয়ে হাসছে।

দিদান দাও না।

দাঁড়া খালি তরবর তরবর।

এখুনি ওরা চলে এলে আর পাওয়া যাবে না।

গুচ্ছের দিয়ে গেছে প্রাণ ভরে খাস।

অনিসা প্লেটে করে অনেকগুলো গলদা চিংড়ির ভাজা নিয়ে এসে আমার আফতাবভাই-এর সামনে দাঁড়াল।

তোলো তোলো দেরি করো না।

আগে ঠাম্মাকে দে।

ঠাম্মারটা দিদান ভাজছে।

তারমানে!

এইটা একটু কম ভাজা ঠাম্মারটা কড়া করে ভাজা হচ্ছে।

আমি আফতাবভাই একটা করে তুলে নিলাম। আমাদের ঠিক পেছনে দিদি দাঁড়িয়ে ছিল একটা তুলে নিল।

আফতাবভাই দাঁতে কেটে খেতে খেতে বললো।

জানিস অনি সকালে যখন নিয়ে এল তখন নরছিল। ভীষণ লোভ হলো, বললাম রেগুলার দিয়ে যাবে। আমাদের ওখানে অর্ধেক পাই গোটা পাই না।

আমি বুড়ো আঙুলে নোটের ইসারা করলাম।

মাসীমনি চেয়ারে বসেই জোড়ে হেসে উঠলো। মিত্রারাও হাসছে।

দিদি পেছন থেকে আমার পিঠে থাপ্পর মারল।

আফতাবভাই খেতে খেতেই মিত্রার দিকে তাকিয়ে বললো।

তোরা খালি ওকে দেখে যা। একটু শান্তিতে খাব….।

অনিমেষদা ফোনে কথা বলতে বলতেই ঘরে ঢুকলো। আমরা হাসাহাসি করছি। একটু থমকে দাঁড়াল।

….তোমার সঙ্গে পরে কথা বলছি।

ভালোদাদাই একটা খাও। অনিসা রান্নাঘরের দরজা থেকে চেঁচাল।

দাঁড়া পাগলি, খাওয়া এখন মাথায় তুলে দিয়েছে তোর বাপ। আগে সেটা সামলাই তারপর খাওয়া।

মুহূর্তের মধ্যে হাসাহাসি থেমে গেল।

আবার কি হলো অনিমেষবাবু! আফতাবভাই বললো।

তুই দিদির ঘরে চল।

এখন কোনও মিটিং-ফিটিং হবে না।

অনিমেষদা মিটি মিটি হাসছে।

চলবে —————————–



from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/o5swqfc
via BanglaChoti

Comments