কাজলদিঘী (১৪৮ নং কিস্তি)

❝কাজলদীঘি❞

BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

১৪৮ নং কিস্তি
—————————

মেরিনাদি যেদিন মারা যায় সেদিন আমি কলকাতায় ছিলাম না। দাদা একটা কাজে কলকাতার বাইরে পাঠিয়েছিল। ফিরে এসে জানলাম দিদি নেই। মাথার মধ্যে বাজ ভেঙে পড়লো। অনিকার তাহলে কি হবে? দুধের শিশুটা কাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচবে। দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে বেরিয়েছি। শেষে দাদার পায়ে-হাতে গিয়ে ধরেছি। আমাকে একটা সুযোগ দাও। দাদা দিয়েছিল। কলম তুলে নিলাম। মেরিনাদির মৃত্যুর ঠিক সাতদিনের মাথায় অনির আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল কাগজের প্রথম পাতায়, “সোনাগাঁয়ের সোনা মেয়ে”। প্রাণ দিয়ে লিখেছিলাম। ছেপে বেরবার আগে বৌদিকে দিয়ে পড়িয়েছিলাম প্রতিটা ইনস্টলমেন্ট। তোমার দুজনে সেদিন প্রথম আঁচ করেছিলে ওই পাড়ার সঙ্গে আমার একটা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে।

গত সাতমাস অনিকা হঠাৎ আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছিল। গত সাতদিন আমি ওকে পাগলের মতো খুঁজেছি। আমার খুব ভয় হয়েছিল যদি ও হারিয়ে যায়, তাহলে হয়তো আমাকে আবার একটা সোনামেয়ের কথা লিখতে হবে। আমার কলম দিয়ে কিছুতেই সেই লেখা বেরবে না। যে কোনও মূল্যে তাই ওকে আমায় খুঁজে বার করতে হবে।

কাল রাতে আমি ভীষণ ভয় পেয়ে যাই। বলতে পারো জীবনে প্রথম ভয় পেলাম।

অর্জুনের কথা তোমরা আমার মুখ থেকে শুনেছো। আমি তখন দুবাইতে একরাতে অনিকার সঙ্গে ফোনে কথা বলছি। পাশে অর্জুন ছিল। ভয়েজ অন করে জোর করে ও আমার সঙ্গে অনিকার কথা শুনলো। পরে আমার কাছ থেকে অনিকার গল্প শুনলো। একবার কৃষ্ণনগরে এসে অনিকার সঙ্গে দেখাও করে গেল। তারপর ও যেদিন এ্যাডাল্ট হলো সেদিন অর্জুন আমার সঙ্গে ছিল।

ফিরে গিয়ে আমাকে বললো, অনিদা অনিকা আমার বোন। জীবনে অনেক খারাপ কাজ করেছি। একটা পুন্য কাজ আমাকে করতে দাও। তোমার দিদিকে যে মেরেছে তার নাম ঠিকানাটা একবার আমাকে দাও। বাকিটা সম্পূর্ণ আমার দায়িত্ব।

এতদিন ওকে কিছু বলিনি। কেন জানিনা কাল মনটা হঠাৎ কু গেয়ে উঠলো। তাহলে কি জাফর কোনও খবর পেয়েছে। অনিকার মুখটা বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। ধৈর্য ধরে রাখতে পারলাম না। বাধ্য হয়ে কাল আমি অর্জুনকে ফোন করি। সময় নষ্ট করিস না।

আজকে বারোটার সময় খবর দিয়েছে ও ওর কথা রেখেছে।

তোমাদের পুলিশ আজ পঁচিশ বছরে তাকে খুঁজে পায়নি। বটতলা থানায় যাও, দেখবে এখনও তাকে পুলিশ খুঁজে বেরাচ্ছে। হয়তো সারাজীবন খুঁজে বেরাবে?

আজকের তারিখে রাত দুটো চল্লিশ মিনিটে মেরিনাদিকে মারা হয়েছিল। ঠিক পরের সপ্তাহের এই দিনে ভোর রাতে অনি প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক হিসাবে জন্মগ্রহণ করেছিল।

অনিমেষদা উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।

আজ দিদি নেই, তোমরা দুজন আছো। আমার কাছে এসে থাকলে অসুবিধে কোথায়?

ছোটোমা পেছন থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।

বৌদি উঠে এসেছে।

বড়োমা, জ্যেঠিমনি ছল ছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে।

নিস্তব্ধ ঘরে একটা ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ।

বিধানদা উঠে দাঁড়ালো। এই অনিমেষ এ কি করছো?

অনিকার দিকে তাকালাম। ইসলামভাইকে জড়িয়ে ধরে আমার দিকে তাকিয়ে। মুখ চোখ দুমড়ে মুচড়ে একাকার। চোখ দিয়ে জল বেরয়নি। ঘন ঘন চোখের পাতা পড়ছে।

রূপায়ণদা এগিয়ে এলো।

অনিমেষদা চলুন। আমরা বাইরে গিয়ে বসি।

অনুপদা, রূপায়ণদা আমার বুকের থেকে অনিমেষদাকে ছিনিয়ে নিয়ে বাইরে চলে গেল।

মিত্রা। বিধানদা ডেকে উঠলো।

মা তোরা এবার বেরিয়ে পর। দেরি করিস না।

বুবুন যাবে বলেছে।

বিধানদা আমার দিকে তাকাল।

আমি যাব।

তাহলে দেরি করিস না। তুই এলে আমরা বেরবো।

আমি কারুর দিকে তাকালাম না। সোজা ঘর থেকে বেরিয়ে লম্বা বারান্দা পেরিয়ে, আমার ঘরে এসে ঢুকলাম। ফাঁকা ঘর। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকটটা বার করে ধরালাম। জানলার কাছে এলাম। ঘরের আলো জানলা দিয়ে বাগানের একটু খানি জায়গায় আছড়ে পরেছে। বাকিটা ঘুট ঘুটে অন্ধকার।

ওইটুকু জায়গাতেই আলো ছায়ায় মাখামাখি। কে যেন কানের কাছে এসে ফিস ফিস করে বললো, অনি সত্যি তুই আমার ভাই। আজ তুই আমার ভাইয়ের মতো কাজ করলি। এ জন্মে তোর সঙ্গে আমার রক্তের সম্পর্ক থাকল না। তাতে কি হয়েছে। আগামী জন্মে তোর সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক পাতাবো।

চোখের পাতা টেনে সরিয়ে মনি দুটো চোখের ভেতর থেকে বার করে আরও কাছ থেকে দেখার চেষ্টা করলাম। না মেরিনাদি কোথাও নেই। আমার কানের কাছে পঁচিশ বছর আগের শোনা মেরিনাদির গলা রিনিঝিনি করে বাজছে।

কিগো তুমি যাবে না। চমকে তাকালাম।

অনিসা, অনিকা দুজনে ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে।

একজন শাড়ি পরেছে। আর একজন জিনসের প্যান্ট আর একটা টপ। দু-জনকে দু-রকম সুন্দর লাগছে। একজন সেজেছে। একজন সাজেনি। একজনের শরীরে আধুনিকতার মধ্যেও প্রাচীনের মিশেল, আর একজনের শরীর আঁকড়ে ধরেছে বনেদী গৃহস্থ বাড়ির নরম স্পর্শ।

সিগারেটটা জানলা দিয়ে ফেলে এগিয়ে গেলাম।

দু-জনকে জড়িয়ে ধরলাম। অনিকার গলায় লক লক করছে মেরিনাদির হার।

জানিস অনিকা, অনিসা তাড়া না লাগালে তোকে আনতে আরও একবছর সময় নিতাম।

দু-জনেই আমার দিকে তাকিয়ে।

তোর খবর প্রথম কে পেয়েছে জানিস?

অনিকার চোখে প্রশ্ন।

অনিসা। ফ্ল্যাটে গিয়ে চুরি করে আমার পুরনো সব ডাইরী পড়ে ফেলেছে।

অনিকা চোখ নামিয়ে নিল।

দু-জনেই আমাকে জাপ্টে ধরে আছে। হাজারো প্রশ্ন দুজনের চোখে।

দু-জনের গালে গাল ঘোসলাম।

যা মাকে ডেকে আন। অনিসার দিকে তাকালাম।

আমাকে ছেড়ে দিয়ে দুজনেই চলে গেল।

আমি বাথরুমে গিয়ে মুখ-হাত-পা ধুয়ে বেরিয়ে এলাম। ঘরের মাঝখানে তনু, মিত্রা, ইসি দাঁড়িয়ে।

আমার পাজামা-পাঞ্জাবী বার করেছিস?

ওরা কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।

বড়োমার ঘরে। মিত্রা বললো।

নিয়ে আয়। একটা চাদর-টাদর দে বেশ শীত শীত করছে।

কিরে শরীর খারাপ লাগছে নাকি? মিত্রা এগিয়ে এলো।

না-রে বাবা না। শীত কি একবারে চলে গেছে।

ফাল্গুন মাসে আবার শীত কিসের?

তোদের রক্ত গরম। আমার ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।

মিত্রা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে।

তনু তোর গালটা ওর কপালে ঠেকা, দেখতো গাটা গস গস করছে নাকি।

তনু এগিয়ে এসে আমার মাথাটা চেপে ধরে গাল ঠেকালো।

মিত্রার দিকে তাকিয়ে বললো, সেরকম বুঝলাম না—

আমি হাসছি। শান্তি।

যাও পাজামা-পাঞ্জাবীটা নিয়ে এসো।

তনু বেরিয়ে গেল।

একটা গেঞ্জি অন্ততঃপক্ষে দে। মিত্রার দিকে তাকালাম।

মিত্রা আলনা থেকে বার করে আনলো। আমি পড়ে নিলাম।

একটা শাল বার করে দিই।

তোদের ছোটো শাল দে।

কেনো!

ওই বড়ো শাল সামলাতে পারবো না। তোরা গায়ে কিছু দিবি না?

সাজ নষ্ট হয়ে যাবে।

চটকানো শুরু করলি, আমিও কিন্তু চটকে দেব।

ইসি হাসছে। মন ঠিক হয়েছে?

কোনওদিন হবে না। একটা শেষ তো আর একটা শুরু।

তনু ঘরে ঢুকলো। পাজামা পাঞ্জাবীর সঙ্গে একটা জহর কোট নিয়ে এসেছে।

এটা কি?

বড়োমা দিল বললো চাদর লাগাতে হবে না। এটা পরলেই হবে।

এটা আবার কার!

মনে হয় দাদার।

কনিষ্ক, নীরুদের দেখতে পাচ্ছি না।

বেরিয়েছে। ডাইরেক্ট ওখানে চলে যাবে, বার তিনেক ফোন হয়ে গেছে। তনু বললো।

আমি টাওয়েলটা পরে খাটে বসে পাজামাটা গলালাম।

মিত্রা আলমাড়ি খুলেছে।

কিরে ফস ফস?

গায়ে বুনো বুনো গন্ধ বেরচ্ছে। গা তো ধুলি না।

পাঞ্জাবীটা লাগিয়ে গায়ে দাদার জহরকোট চড়ালাম। মিত্রা মিত্রার কাজ করলো।

একবারে নিউ লুকে অনি ব্যানার্জী তাই না তনু। ইসি বলে উঠলো।

মিত্রা, তনুর গভীর চোখ আমার সারাটা শরীর হরণ করছে।

তোদের পাশে বে-মানান। তোরা যা ঝক ঝক করছিস।

বিয়ের রিসেপশনে গেলে একটু ঝকমকে পরতে হয়। ইসি বললো।

নিজের বিয়ের সময় পরেছিলি?

ইসি চুপ করে রইলো।

তনু টেবিলে ফোনটা রয়েছে নিয়ে এসো।

তনু এগিয়ে গেল।

কিছু পয়সা গড়ি দে। মিত্রার দিকে তাকালাম।

ঢং করিস না।

বিশ্বাস কর।

লাগলে দেব।

এতগুলো ক্যাশবাক্স আছে তোর চিন্তা কি। ইসি বললো।

ঘর থেকে বেরিয়ে দাদার ঘরে এলাম। সাবই চা খাচ্ছে।

বড়োমা তোমার ছেলেকে পঞ্চাশ টাকা ধার দাও। মিত্রা বললো।

বড়োমা আমার দিকে একবার তাকাল।

কেন চিমটি কাটছিস এখুনি কিছু বললেই ওর দোষ হয়ে যাবে। অনুপদা মিত্রার দিকে তাকালো।

তনুকে, দিদিভাইকে জিজ্ঞাসা করো। আমি মিথ্যে বলছি কিনা?

বড়োমা মুখ নিচু করে হাসছে।

অনিমেষদা চায়ে চুমুক দিতে দিতে আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো।

বড়োমা তোমার প্লেটে একটু ঢেলে দাও। গা গরম করি। আমি বললাম।

চুলটা আঁচড়া। কেমন ঝোড়োকাকের মতো লাগছে। বিধানদা বললো।

আমি বড়োমার ঘরে ঢুকলাম। টেবিল থেকে চিরুনিটা নিয়ে দুটো টান মেরে নিলাম।

বড়োমার কাছে গিয়ে প্লেটে চুমুক দিয়ে চা খেলাম।

অনুপদা উঠে এসে পকেটে থেকে পঞ্চাশটাকা আমার দিকে এগিয়ে দিল।

থাক।

তুই ভাবিসনা তোকে এমনি এমনি দিচ্ছি। প্রজেক্টটা হলে তোর কমিশন থেকে বাদ দিয়ে দিস।

হাসলাম।

ছোটো, পকেটটা একবার দেখতো রুমাল আছে কিনা। নাহলে খেয়েদেয়ে পাঞ্জাবী তুলে পাজামায় হাত মুছে চলে আসবে। বড়োমা বললো।

জ্যেঠিমনি, বৌদি দুজনেই জোরে হেসে উঠলো।

হ্যাঁগো কতোবার যে তেলের দাগ তুলতে তুলতে ছোটো আর দামিনীর হাতে ফস্কা পড়ে গেছে কি বলবো। বাবু আবার লন্ড্রিতে ধোয়া জামা কাপর পরেন না। মাড় দেয়। মনে হয় যেন কাগজ পরেছেন।

বড়োমার কথায় বিধানদারা হাসছে। কিরে মিত্রা রুমাল দিয়েছিস?

আমার কাছে আছে।

সবাই বেরিয়ে এলাম।

ছোটোমারা পেছন পেছন এলো।

মিলি, মাম্পি-মিকি কোথায়?

বেরিয়ে গেছে।

কার সঙ্গে গেলো?

রতনদা নিয়ে গেছে।

সুরো?

গাড়িতে বসে আছে।

পর পর চারটে গাড়ি। গেট পেরিয়ে রাস্তায় নামলো।

আমি ছেলে-মেয়েদের গাড়িতে উঠলাম। যেতে যেতে গাড়িতে ভীষণ হইচই করলাম। প্রথমে ইসলামভাই গম্ভীর থাকলেও তারপর না হসে পারলো না। ঘণ্টা রেগে গিয়ে বললো, যাও আসার সময় তোমার গাড়িতে উঠবো না।

গাড়ি থেকে নামতেই অনিসা, মিত্রাকে জড়িয়ে ধরে হেসে আটখান।

কিরে এতো হাসি কিসের? মিত্রা বললো।

বাবা ঘণ্টাদা আর পক্কেদার পেছনে যা লাগলো না। ঘণ্টাদা রেগে বলেছে ফেরার সময় বাবার সঙ্গে ফিরবে না।

কনিষ্করা সবাই বাইরেই ছিল। আমাদের দেখে এগিয়ে এলো।

কিরে, শুনলাম বাড়িতে নাকি গণ্ডগোল করছিলি?

নারে, কাপালিক সেজেছিলাম।

ইসলামভাই এসে পাশে দাঁড়াল।

ইসলামভাই—

বল—

একটা অনুরোধ করবো রাখবে?

তোর অনুরোধগুলো বড়ো যান্ত্রণার। তবু বল, শুনি।

আবিদ ড্রিংকসের ব্যবস্থা নিশ্চই করেছে?

সফ্ট না হার্ড—

হার্ড।

কেন!

আজ সবাই মিলে একটু খাবো।

অনিসা ওপরের দিকে হাত তুলে তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো। থ্রি চিয়ার্স ফর বাবা।

ঘণ্টারা তার স্বরে চেঁচিয়ে উঠলো হিপ হিপ হুররে।

কনিষ্ক, নীরু, বটারা কানে আঙুল দিয়েছে।

ইসলামভাই আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।

সবাই এক সঙ্গে ভেতরে এলাম।

ব্যাপারটা কি হলো! কনিষ্ক ইসলামভাইয়ের দিকে তাকালো।

পরে বলছি।

অনিকা, অনিসা দু-জনে দু-হাত ধরেছে। এরই মধ্যে হিসাব শুরু করে দিয়েছে।

মিত্রা, তনু, ইসি সামনে সামনে হাঁটছে।

রিসেপশন রুমটা বিরাট বড়ো। ভীষণ সুন্দর সাজিয়েছে।

আমি চেয়ে চেয়ে চারদিকটা দেখছিলাম। অনেক লোকের আয়োজন করেছে। কাউকে চিনি, কাউকে চিনি না। আবিদ, আয়েষা এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো।

একটা প্রণাম করি?

এখানে করিস না কে কি ভাববে।

দুর ভাবা। তুমি না এলে আমার এই রিসেপশন অসম্পূর্ণ থাকতো।

কে বললো, আমি আসবো না।

সকাল থেকে যা হলো। ভীষণ ভয়ে ভয়ে ছিলাম।

কথা বলতে বলতেই নিচু হয়ে দু-জনে পায়ে হাত ছোঁয়াল।

বহুত চাকমা দিয়েছিস দু-জনে।

তোমার থেকে কম। আবিদ বললো। আয়েষা মুচকি মুচকি হাসছে।

আবিদ অনি একটা জিনিষ চেয়েছে। ইসলামভাই বললো।

দাদা চাইলে আমি সব কিছু দিয়ে দেব।

আমি আবিদের দিকে কুত কুত করে তাকালাম। হাসছি।

নেপলা, চাঁদ, চিনা, রতন জোড়ে হেসে উঠলো।

কেশ খেলি আবিদ। চিনা চেঁচালো।

সরি সরি ভুল হয়ে গেছে। এডিট করা উচিত ছিল।

আয়েষা লজ্জা পেয়ে গেছে।

অনিকা হাসছে।

বলো তোমার কি চাই? আবিদ আমাকে ছাড়ে নি।

ও আজ একটু ড্রিংক করবে বলেছে। ইসলামভাই বললো।

অনিদা! হতেই পারে না।

কেন আমি খেতে পারি না?

তুমি খাবে!

আমি একা না সবাই।

আবিদ হাসছে। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। তুমি নাচাচ্ছ। আবার কোথাও ভুল করেছি মনে হচ্ছে।

না না ও খেতে চেয়েছে—মিত্রা বললো।

তুমি চেয়েছো! আমি দেব, আমি নিজে হাতে সব ব্যবস্থা করবো।

ব্যাটা এখানে আলাদা ঘর আছে?

সব আছে, তোমাকে চিন্তা করতে হবে না।

মিত্রা, তনু আমার দিকে তাকিয়ে। দু-জনে মুচকি মুচকি হাসছে।

অনেকদিন পর। সেই তুই আমি কবে খেয়েছিলাম। মিত্রার দিকে তাকালাম।

বমি করবি না?

বেশি খাবো কেন। নাচা গানা করতে গেলে যতটুকু খাওয়া দরকার ততটুকু খাবো।

অনিসা এগিয়ে এলো। আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে দুটো।

ভিকট্রি।

না দু-গ্লাস।

মিত্রা চেঁচিয়ে উঠলো। না।

বাবা সবাইকে নিয়ে খাবে বলেছে।

বাড়িতে দিদাই আছে মনে থাকে যেন।

বাবা আছে।

সুন্দর চারটে আঙুল তুলেছে, অনন্য তিনটে আঙুল তুলেছে, শুভও তিনটে দেখাচ্ছে।

কনিষ্ক আমার কানের কাছে এসে বললো, শেষে সামলাতে পারবি।

সামলাবার আমি কে, বেশি খেলে বমি করবে।

তুই তো ওস্কালি।

চিকনা কানের কাছে এসে বললো—ভানু, মীরচাচা ভীমরি খেয়েছে।

ঠিকমতো সামলাস। গণ্ডগোল করে না যেন। নীপা, সুবীর কোথায়?

কাছা কাছিই আছে।

নাগেশ এসে আমার হাতটা চেপে ধরে বেশ কয়েকবার নাড়িয়ে বলে উঠলো সুইট থিংকিং। এই পরিবেশে এটা দরকার ছিল।

বনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।

দেবা, হিমাংশুরা আগেই চলে এসেছিল। একসঙ্গে সবাই আমার কথা শুনে হইহই করে উঠলো।

অনুপ কাছে এসে বললো, বাড়িতে একটা গণ্ডগোল বাধিয়ে এলি, এখানে আবার একটা গণ্ডগোল বাধাবি।

আজ আমি মুক্ত বিহঙ্গ।

অনুপ, হিমাংশু হাসছে।

কনিষ্ক, শ্রীপর্ণাকে কচি কচি লাগছে না।

আরি শালা বুঁচকি, বোচনরা আছে একটু এডিট কর। নীরু কানের কাছে ফিস ফিস করলো।

আমি হাসছি।

আবিদ কথা রাখলো, আমাদের একটা বড়ো ঘরের ব্যবস্থা করে দিল। আমরা সবাই একসঙ্গে সেই ঘরে ঢুকে পরলাম।

দুটো ঘণ্টা নিখাদ আনন্দ। কেউ বাদ যায়নি। সবাইকে নিয়ে নাচলাম খাওয়া দাওয়া করলাম। মাম্পি, মিকি, পিপটুকেও একটু খাওয়ালাম। খুব খুশী ওরা। মদ খেয়েছে।

সুরো, মিলি, বনি তিনজনেই মুখ করলো, কে কার কথা শোনে। কিছুটা নেচে দেখে নিল অনিসা, শুভ, পিকু, সুন্দর, ঘণ্টা, পক্কে। অনিকাও বাদ গেল না। প্রথমে একটু জড়তা ছিল। তারপর সবার সঙ্গে মিশে গেল। দেখলে বোঝাই যাবে না প্রত্যেকে এক একটা আলাদা দ্বীপের বাসিন্দা।

আবিদ, আয়েষাও মাঝে এসে যোগ দিলো। অর্ক, অরিত্ররা প্রথমে একটু অবাক হয়েছিল পরে মেতে উঠলো।

আমি যেমন ইসিদের কোমর ধরে নাচলাম ঠিক তেমনি ইসলামভাই, ইকবালভাইয়ের কোমর ধরেও নাচলাম। ছেলে মেয়েদের সঙ্গে একটু বেশি হই হই করলাম। শেষে নেপলা, চাঁদ, চিনা, রতন আমাকে কোলে করে নাচলো। চূড়ান্ত আনন্দের একটা নিদর্শন তৈরি হয়ে রইলো আবিদের বিয়ে।

শেষে ঘণ্টা এগিয়ে এসে বললো, মামা রসোগোল্লা খাওয়ার কমপিটিশন হোক, সেবার দিদি জিতেছিল এবার কে জেতে দেখি।

সুন্দর, শুভ চেঁচিয়ে উঠলো।

শুভ বলে উঠলো, আঙ্কেল একবার হ্যাঁ বলো, প্লিজ।

ঠিক আছে মিষ্টি খেতে খেতে চাটনি লেবু খাওয়া যাবে না।

থিতিয়ে যাওয়া হইহই আবার শুরু হলো।

শুরু হলো রসোগোল্লা খাওয়া।

গুনে গুনে খাওয়া চলছে। সুন্দর সবার আগে তারপর অনিকা, ঘণ্টা, পক্কে, শুভও কম যায় না।

হঠাৎ অনিসা চেঁচিয়ে উঠলো বাবা মা কুড়িটা পার করে দিলো, বনিমনি পঁচিশটা, মিলি মনি তেইশটা চলছে। কনিষ্কমামা তিরিশটা পার করে দিল।

বুঁচকি আমার একত্রিশ নম্বর চলছে। নীরু চেঁচিয়ে উঠলো।

হাসাহাসির চূড়ান্ত চলছে।

তনু হির হির করে ইকবালভাই, ইসলামভাইকে টেনে নিয়ে গেল। দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে না, পার্টিসিপেট করতে হবে।

আস্তে আস্তে সবাই থেমে গেল সুন্দর, অনিকা তখনও চালিয়ে যাচ্ছে। দু-জনেই হাফ সেঞ্চুরি করলো। আমি হাসতে হাসতে বললাম এবার থাম।

ইসলামভাই বললো কেন থামবে চলুক কমপিটিশন।

ইকবালভাই কাছে এসে বললো তুই যে এত মজা করেত পারিস জানতাম না।

ইসলামভাই হাতটা চেপে ধরে বললো, জানিস অনি ওর মাও খুব খেতে পারতো।

আমি ইসলামভাইয়ের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললাম।

চাঁদ এসে বললো, অনিদাগো আমরা সব শিশু।

কেন!

ভাই, বোন কিরকম টানছে দেখছো।

ওদিকে তখনও চেঁচিয়ে চলেছে ওরা, দিদি আর একটা। শুভ চেঁচাচ্ছে সুন্দরদা দিদির কাছে হেরে গেলে চলবে না। জালার মতো পেট করেছিস।

হিমাংশু, লতা, শ্রীপর্ণা, দেবা, নির্মাল্য, অদিতিরা উৎসাহ দিয়ে চলেছে।

হঠাৎ একটা হই হই শব্দ হলো।

বুঝলাম শেষে হল কমপিটিশন।

সুন্দর হাত মুছতে মুছতে আমার কাছে এসে বললো। বাবা, মাত্র এক পিসের জন্য দিদিকে বিট করতে পারলাম না। গাটা গুলিয়ে উঠলো।

আবিদ আমার পাশে দাঁড়িয়ে হাসছে।

আবিদ আঙ্কেল কাল বিরিয়ানি পাঠাবে। দিদির সঙ্গে আবার লড়বো।

ইসলামভাইয়ের বিকট হাসিতে সারাটা ঘরের সবাই চমকে উঠলো।

ভাইদাদাই তুমি ওভাবে হাসছো কেনো! অনিসা বলে উঠলো।

কাল বিরিয়ানির কম্পিটিশন।

তাহলে আমি ফার্স্ট।

বাসু, চিকনা হাসতে হাসতে কাছে এসে বললো, অনিরে কেলো করেছে।

কি হলো আবার!

চাচা, ভানু আউট।

ইসলামভাই চেঁচিয়ে উঠলো, কোথায়?

চিকনা হেসে চলেছে।

নীপার মুখ শুকিয়ে গেছে।

কি হলো তোমার মুখ শুকিয়ে গেল কেন?

কি লজ্জা বলো অনিদা, আমরাও তো সবাই খেলাম।

বক বক করো না। কিচ্ছু হবে না। খুঁজলে ওদের মতো আরও অনেককে এখানে পাবে। সেই জন্য আবিদ বড়োমাদের আসতে বারণ করেছে। ইসলামভাই চলো দেখি।

তোমাদের যেতে হবে না, আমরা তুলে আনছি। চিনা, চাঁদ এগিয়ে এলো।

চিকনার দিকে তাকিয়ে বললো, চলো চিকনাদা।

আমি মিত্রার দিকে তাকালাম, তোরা এবার আসতে আসতে এগো। দেখ রবীনরা খেয়েছে নাকি।

দাঁড়া ফিনিসিংটা দেখি।

আমরা সবাই হাসা হাসি করছি।

নেপলা হাসতে হাসতে সবার আগে ঘরে ঢুকলো।

কি হলো রে।

মীরচাচ বলছে অনিকে বোলো না, বেইজ্জত হয়ে যাব।

তাহলে তোরা আউট বললি কেন?

আসুক দুটো দেখাচ্ছি। ইসলামভাই বললো।

একবারে কিছু বলবে না। আজ অনন্দের দিন। তোমরা খাওনি?

কিছুক্ষণ পর চাঁদ, মীরচাচাকে আর চিনা, ভানুকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে এলো।

দু-জনেই চূড়ান্ত ভুল বকছে।

চাঁদ, চিনা আনতে গিয়ে হাঁপিয়ে গেছে। দু-জনকেই সোফাতে বসিয়েছে।

আমি কাছে গেলাম।

কিগো মীরচাচা কোনও অসুবিধে হচ্ছে না?

দেশে গিয়ে সবকটাকে কেটে মালঞ্চের জলে ভাসি দিব। অনির গায়ে হাত।

কথা বলতে গিয়ে আর্ধেক মুখের মধ্যেই আটকে রইলো।

মিত্রারা হেসে গড়িয়ে পরে।

মীরচাচা বকে চলেছে।

বুঝলি চিকনা গলা পর্যন্ত খেয়ে ফেলেছে। ওখানে গেল কি করে? আমি বললাম।

তোর সামনে খেতে লজ্জা পেয়েছে, তাই ওখানে চলে গেছে।

পেটে কিছু দিয়েছে?

কি করে জানবো। তোর সঙ্গে একটু নাচছিলাম তারপর দেখি দু-জনেই নেই। খুঁজতে গিয়ে পেলাম।

এই চিকনা। ভানু তরপাচ্ছে।

গলাকে পা ডলি দিব।

অনেকদিন পর ইংলিশ খাছি। ময়নাকে লিয়ে আয়।

দাঁড়া অনি যাক, লঙ্কা বাটবো।

অনি চলিইছে। ভানু মুচকি মুচকি হাসছে।

লা লালা লা লালা…..

উঠে নাচতে গিয়ে ভানু ধুপ করে পড়ে গেল। চিকনা গিয়ে আবার ধরে তুললো।

কাল সকালবেলা যাঁতা গাড়বো, দাঁড়া।

ইংলিশ! পেরাণ ভইরে খাছি বুঝলু।

তখন চূড়ান্ত দেশের ভাষায় কথা চলছে চিকনা, ভানুর মধ্যে। অনিসা, অনিকারা সামনে থেকে শোনে আর বিড় বিড় করে। বুঝলাম শব্দগুলো মুখস্থ করার চেষ্টা করছে।

বাসু, মীরচাচাকে—চিকনা, ভানুকে সামলায়।

রতন ঘরে ঢুকলো।

দাদা গেলো কোথায় দুটো?

কারা?

মীরচাচা, ভানুদা?

তারপর ওদের দেখে আমাকে হাসতে হাসতে জড়িয়ে ধরলো।

ওদের কিছু বলো না।

কেনো!

আমি নিয়েগেছি।

তারমানে!

ওদের এখানে খুব অসুবিধে হচ্ছিল। তুমি সকলকে মেপে মেপে খাওয়াচ্ছিলে। ঠিক মতো আনন্দ করতে পারছিল না। আমি নিজে গিয়ে বসিয়ে দিয়ে এসেছিলাম। ওদের বলে এসেছিলাম যখন অসুবিধে হবে আমাকে ফোন করবে।

ওদের ফোন করার মতো অবস্থা আছে।

তুমি আজকের দিনটার জন্য পার্মিশন দিয়েছো।

নেপলা, রতনের শাস্তি কি হবে?

একটা বোতল দিয়ে বসিয়ে দিতে হবে, পুরোটা খেতে হবে।

দাদাগো আমাকে এই শাস্তিটা দাও না। চিনা বলে উঠলো।

তুই শাস্তি পাওয়ার অপেক্ষায় থাকবি?

চাঁদ কোমর দোলায় আর হাঁসে।

ইসলামভাই বড়ো বড়ো চোখ করে।

ভাইদা আজ কোনও কথা নয়, অনিদা নিজে খাইয়েছে সকলকে। আমরা নিজেরা ঠিক করেছিলাম আজ কেউ এক ফোঁটা ছোঁব না।

চাঁদ আমাকে জড়িয়ে ধরলো।

অনিদা আজ দিল খুশ, অনেকদিন পর এতো আনন্দ করলাম। আবিদের বিয়েতে আনন্দ করবো ভেবেছিলাম, এতোটা করবো কল্পনা করিনি। বুঁচকি—

অনিসা তাকিয়েছে চাঁদের দিকে।

অনিদা—

সবাই চেঁচিয়ে উঠলো হিপ হিপ হুররে। অনিদা—হিপ হিপ হুররে।

চাঁদ ওদের বাড়ি নিয়ে যেতে হবে।

তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। তুমি চলে যাও, ঠিক সময় পৌঁছে যাবে।

ভাইদাদা। হিপ হিপ হুররে। ভাইদাদা। হিপ হিপ হুররে।

বুঝলাম চাঁদেরও লেগে গেছে।

অংশু, বরুনদা এগিয়ে এলো। কেমন করে যেন হাসছে দু-জনে।

কিগো গণ্ডগোল পাকালে নাকি?

না। বেশ ভালো লাগছে। একটার বেশি খাই না, লোভের মাড়ে তিনটে খেয়ে ফেলেছি।

তুমি তো খেলেই না। অংশু আমার দিকে তাকিয়ে বললো।

সুরো কিছু বলে নি?

আজ ফূর্তি, কাল আবার কাজ।

দু-জনেই বোকার মতো হেসে যাচ্ছে।

বেশ মজা লাগছিল দেখতে।

কনিষ্ক এসে বললো, অনি দেরি করিস না। স্কচের ওপর মিষ্টি পরেছে, বেশ ঝিম ঝিমানি লাগছে।

নীরু কোথায়?

শালা আজ গণ্ডগোল করবে।

ইসলামভাই আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। তুই বেটা বহুত ঘোরেল। সবাইকে খাইয়ে দিয়ে তুই একটা নিয়ে চলে এসেছিস।

কি মজা বলো।

অনিকা আর অনিসাকে দেখ, স্টেপিং ঠিক পরছে না।

হাসলাম।

চল আর দেরি করিস না।

সবাই বেরিয়ে এলাম।

মিত্রাকে বললাম, সুরো কোথায় রে?

মাম্পি, মিকিকে নিয়ে এগিয়ে গেছে।

বনি, নাগেশ?

সব এক গাড়িতে করে গেছে।

আবিদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা সবাই বেরিয়ে এলাম।

গাড়িতে সবাই হাসা হাসি করছে। কারুর মুখ বন্ধ নেই কেউ গান গায় কেউ বক বক করে।

বাড়িতে এসে ঢুকতেই আবার একচোট হইচই। সবাই কম বেশি ভুল বকছে।

বড়োমারা সবাই বারান্দায় দাঁড়িয়ে। অনিসারা নেমেই বড়োমাদের গিয়ে জড়িয়ে ধরলো।

ইস কি গন্ধ—বড়োমা নাক সিঁটকালো।

তারপরেই শুরু করে দিল, দিদান ঝিং কু-রু কুর, ঝিং কু-রু কুর অনিকা, অনিসা সবাই নাচছে।

ছোটোমা, বৌদিরা ওদের কীর্তি দেখে হেসে গড়িয়ে পরে।

বড়োমা বারান্দায় দাঁড়িয়েই আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে।

পালের গোদাগুলোর মুখ একবার দেখি।

মিত্রা আমার হাতটা ধরলো।

কিরে!

বেশি না আমি চার, তনু চার, দিদিভাই তিন। বনি, নাগেশ আমাদের থেকে একটা করে বেশি খেয়েছে। সেই কবে খেয়েছিলাম বল। ঠিক আছে, তোকে চিন্তা করতে হবে না। তুই শুধু বড়োমাকে একটু ম্যানেজ করে দে। আমরা ঘরে ঢুকে পরি।

ছেলে-মেয়ের অবস্থা দেখেছিস?

তুই পুরো কেলো করে দিলি।

বেশ মজা লাগছে, তাই না। তনু কেমন ভাবে যেন বললো।

অনিসা আর নয়, অনেক রাত হয়েছে। আমি চেঁচালাম।

প্লিজ বাবা আর একটু।

আমি এগিয়ে গিয়ে বারান্দায় উঠলাম।

কোনও কিছু বোঝার আগেই অনিসা, অনিকা দু-জনে আমাকে জড়িয়ে ধরে দুই গালে দু-জনে চকাত করে চুমু খেল, তারপর আবার ঝিং কু-রু কুর, ঝিং কু-রু কুর করে কোমড় নাচাতে নাচাতে চলে গেল।

এই তো জীবন যাক না যেদিকে যেতে চায় প্রাণ, চালাও ফোয়ারা….

বাগানের দিকে ফিরে তাকালাম। চিকনা, বরুনদাকে ধরে নিয়ে আসছে।

তোমরা ভেতরে যাও—আমি বললাম।

ছোটোমা, জ্যেঠিমনি মুখে কাপর চাপা দিয়েছে।

তুই কি কাউকে বাদ দিসনি! বড়োমা আমার দিকে তাকাল।

তাহলে তোমাকে তখন ফোনে কি বললাম। আর দুটো ওখানে রাতে থাকবে, তাদের উঠে আসার ক্ষমতা নেই। ইসলামভাই বললো।

কারা! ছোটোমা বললো।

মীরচাচা, ভানু।

মিত্রা, তনু, ইসি, মিলি, টিনারা এদিকে আর ঘেঁষলো না। সোজা আমার ঘরের দিকে চলে গেল।

চিকনা, বরুনদাকে নিয়ে ওপরে চলে গেল।

জ্যেঠিমনি, বৌদি, দামিনীমাসি হেসেই চলেছে।

তুই খাস নি? ছোটোমা কাছে এসে বললো।

আমি ছোটোমাকে জড়িয়ে ধরে ঘরে ঢুকলাম আমার পেছনে সবাই।

কেনো খাব না!

ও একটা গ্লাসে জলভরে একটু ছুঁয়েছে, বলতে পারো ফিতেটা কাটলো। ইসলামভাই বললো।

তুই মাম্পি, মিকি, পিপটুকেও বাদ দিস নি!

আমি ছোটোমার দিকে তাকিয়ে হাসছি।

কি লজ্জা, কি লজ্জা। এসে সবার সামনে বলে, দাদাই আজ মদ খেয়েছি।

তারপর কোমড় দুলিয়ে আঙ্কেলের নাচ দেখাল।

এইটা হচ্ছে ওদের আসল রূপ, তোমরা ধমকে ধামকে সবাইকে চুপ করিয়ে রাখ।

বৌদি হাসছে।

সুরো, বনি কোথায়?

এসে সেই যে ওপরে উঠেছে আর নামেনি।

তুমি যাও নি?

লজ্জা পেয়ে যাবে।

চিকনা ওপর থেকে নেমে এলো।

বরুনদা নামলো, অংশু কোথায়?

গাড়িতে ঘুমচ্ছে।

বাসু।

অংশুর পাশে বসিয়ে রেখে এসেছি।

যা তারাতারি রেখে আয়। ছোটোমা তোমাদের মেনু কি?

কেন তুই খেয়ে আসিস নি!

সাতটা রসোগোল্লা খেয়েছি। ইসলামভাইও তাই খেয়েছে।

ইকবাল কোথায়? বড়োমা বললো।

ওখানে রয়ে গেছে। সামলাবে কে? ইসলামভাই বললো।

ওরা সবাই খেয়েছে, না শুধু মদ গিলেছে? বড়োমা বললো।

মদ তো এমনি এমনি গেলা যায় না, তার সঙ্গে খেতে হয়। তাছাড়া প্রচুর রসোগোল্লা খেয়েছে। আমি বললাম।

ছোটো, বুঁচকি যে ওরকম কোমর দুলিয়ে নাচতে পারে জানতম না তো! বৌদি বললো।

দূর ছাই আমিও কি আগে দেখেছি।

চলো দেরি করবো না। খেয়ে নিই। আমি বললাম।

জামা কাপর ছেড়ে আয়।

যাচ্ছি।

আমি এই ঘরে ঢুকে অবাক। ছোটো লাইটটা জ্বলছে। মিত্রা, তনু, ইসি, মিলি, টিনা, নীপা সবাই কোনওপ্রকারে শাড়িটা কোমর থেকে খুলেছে। অতো বড়ো বিছানায় চিত্তাল হয়ে শুয়ে আছে। পরনে শায়া ব্লাউজ। ভীষণ হাসি পাচ্ছে। এরই মধ্যে ঘুমিয়েও পড়েছে। কোনওপ্রকারে চেঞ্জ করে বেরিয়ে এলাম।

নিজের মনে নিজে হাসছি। এ ঘরে এলাম।

দেখলাম সোফায় বাসু, চিকনা বসে। আমায় দেখে হেসে ফেললো।

তুই ওরকম ভাবে হাসছিস কেন!

ও ঘরের অবস্থা দেখে।

ছোটোমা এগিয়ে এলো, কি হয়েছে?

তুমি গিয়ে আজ ও ঘরে শোও। আমি বড়োমার কাছে শুয়ে পড়বো।

দাঁড়া ছোটো, গিয়ে একবার দেখে আসি। বৌদি বললো।

সুতপা যেও না। অনিমেষদা বললো।

দাঁড়াও, এই সুযোগ আর আসবে নাকি।

তোর মাথায় এতো বদ বুদ্ধি আসে কোথা থেকে বলতো। ডাক্তারদাদা বললো।

কেনো?

ছোটোমা হাসছে। তুই পালের গোদা।

ওপরটা একবার দেখে আয়। অংশু, কনিষ্কদা, বরুনদা, বটাদা, সুবীর, নাগেশ কেউ প্যান্ট জমা খোলে নি, যে অবস্থায় গেছিল সেই অবস্থায় এসে শুয়ে পড়েছে।

চিকনা হেসেই চলেছে।

ওরা কতো খেয়েছে?

যতটাই খাক মিষ্টি খাওয়াটা ঠিক হয় নি। তুই না বলতে পারতিস। চিকনা বললো।

তখন ও না বললেও ওরা খেত। ইসলামভাই বললো।

অনিমেষদা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।

কতো মিষ্টি খেয়েছে ইসলাম। ডাক্তারদাদা বললো।

সবচেয়ে কম আমি অনি। গোটাসাতেক হবে। অনিকা একাত্তর না বাহাত্তর, সুন্দর সত্তরটা মতন, অনিসা, অনন্য….

দাঁড়াও, দাঁড়াও ওরা কি কমপিটিশন করে খেয়েছে?

তাহলে বলছি কি আপনাকে, অংশু, বরুন, নাগেশরা খুব কম করে কুড়ি পঁচিশটা।

অনিমেষদা, ডাক্তারদা, দাদা, মল্লিকদা হেসেই চলেছে।

তুই শেষ পর্যন্ত সুরোকেও খাওয়ালি। অনিমেষদা বললো।

খাওয়া দেখলে, ওর নাচ তো দেখোনি।

নেচেওছে!

তোমার মেয়ে জামাইয়ের সে কি নাচ, জানিনা ওরা ভিডিও করেছে কিনা।

করেছে। তাছাড়া সবাই মোবাইলে তুলেছে। কি উদ্দাম নাচ অনিমেষদা। ইসলামভাই বললো।

কে নাচেনি—ইসলামভাই, ইকবালভাই পর্যন্ত কোমর দুলিয়েছে। চিকনা বললো।

অনিমেষ এই রস থেকে আমরা বঞ্ছিত হলাম। ডাক্তারদাদা বললো।

বুড়ো হয়ে গেছি। অনিমেষদা বললো।

বৌদি হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকলো।

ছোটো একবার গিয়ে দেখে আয়, এ দৃশ্য তুই চেষ্টা করলেও আর দেখতে পাবি না।

ছোটোমা দৌড় লাগাল।

বৌদি দাদাদের বলবে কি, হেসেই গড়াগড়ি খায়।

তুই সত্যি, কি বজ্জাত, কি বজ্জাত।

দেখো এই ঘটনা না ঘটালে ওরা এতটা আনন্দ করতে পারতো? অনিসারা এতো বড়ো হয়েছে, জীবনে তোমাদের সামনে কখনও কোমড় দুলিয়েছে। আজ কিন্তু দোলাল, আর হয় তো কোনওদিন দোলাবে কিনা জানিনা। অনিকার কথা ছেড়ে দাও। চার্চে এই সব অনুষ্ঠান হয় না। ঘরানাটাই আলাদা। একটা দমবন্ধ করা পরিবেশ। এক ঘেয়ে একটা জীবনে, একটু ব্রেক। দেখবে এই ব্রেকটা ওদের এনার্জি লেবেল অনেকটা বাড়িয়ে দেব।

ছোটোমা হাসতে হাসতে ঢুকলো।

কিরে ছোটো যা বললাম ঠিক বলেছি?

ছোটোমা, বৌদি দু-জনে দু-জনকে জড়িয়ে ধরে হাসছে।

ওই কটা লোভের মাড়ে সবচেয়ে বেশি খেয়েছে। আমি বললাম।

বড়োমা, দামিনীমাসি টেবিলে খাবার নিয়ে এলো।

আমরা সবাই ভাগাভাগি করে খেলাম। অনিমেষদা, মল্লিকদা, ডাক্তারদাদার বাড়িতে শুতে গেল; চিকনা, বাসু ইসলামভাইয়ের ঘরে শুতে গেল, দামিনমাসি সুরোর ঘরে গেল, খাটে আমি, বৌদি, বড়োমা, জ্যেঠিমনি। বড়োমা, দাদাকে সোফায় বিছানা করে দিল। ছোটোমা আমার ঘরে চলে গেল।

প্রচণ্ড চেঁচামিচির শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল। বিছানায় উঠে বসলাম। জানলা দিয়ে সূর্যের আলো বিছানায় এসে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। বাইরে এতো চেঁচামিচি কিসের? বোঝার চেষ্টা করলাম, বুঝতে পারলাম না।

ঘরে কেউ নেই। দরজাটাও ভেজানো।

বিছানা থেকে উঠে এলাম।

দরজা খুলতেই দমকা হাওয়ার মতো চেঁচামিচি আমাকে গ্রাস করলো।

কারুর কোনও কথা শুনতে পাচ্ছি না।

ছোটোমা তার মধ্যেই অনিকাদের দিকে তাকিয়ে বলছে, ওরে তোরা থাম, পাড়ার লোকেরা এবার আমাদের বাড়ি ছাড়া করবে।

কেন, আমরা কি ওদের বাড়ির উঠোনে গিয়ে চেল্লাচ্ছি। আমরা আমাদের ঘরে আনন্দ করছি। ছোটোমার গলার ওপরে অনিসার গলা। চোখ পাকিয়ে তালে তাল ঠুকছে অনিকা, ঘণ্টা, পক্কেরা।

সবাই এরই মধ্যে চলে এসেছে। ঘরে তিল ধারণের জায়গা নেই। নীরু ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসে। ওকে ঘিরে মিত্রারা।

নীরু মাঝে মাঝে তারস্বরে চেঁচাচ্ছে।

অনিসা আমাকে দেখতে পেয়ে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো।

বাবা নীরু মামা গিও।

সেটা আবার কিরে!

কাল রাতে….।

কেন, বাসি মুখ…. না বললে চলছে না। নীরু খিঁচিয়ে উঠলো।

শ্রীপর্ণাকেও দেখলাম এসেছে। নীরুর মেয়েটা খিল খিল করে হাসছে।

মিত্রার দিকে তাকালাম চোখ নামিয়ে নিল।

ছোটোমা এগিয়ে এলো, তাড়াতড়ি মুখ ধুয়ে ফেল, ঠিক সময় উঠেছিস।

দাদাদের কাউকে দেখতে পেলাম না। বরুনদা, অংশু, কনিষ্ক, বটা, নাগেশ সোফায় এলিয়ে রয়েছে।

অনিকাদের ক্যাচর ম্যাচর কে কি বলছে বোঝা মুস্কিল।

দাঁড়া, আমি মুখটা ধুয়ে আসি।

আবার বড়োমার ঘরে ঢুকে পড়লাম।

বড়োমার ঘরের বাথরুমে সব থাকে। আঙুলে পেস্ট নিয়ে দাঁত মেজে মুখ ধুলাম। টাওয়েল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলাম। জ্যেঠিমনি, বড়োমা রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে। ভেতরে দামিনীমাসি, বৌদি।

কাছে গেলাম।

কিগো খুব খুশী খুশী মনে হচ্ছে?

বড়োমার থুতনিটা ধরে নাড়িয়ে দিলাম। আমার হাতটা সরিয়ে দিল।

স্বার্থপর।

হাসলাম। বৌদি, মেনু কি?

তোর বাটি চচ্চড়ি আছে।

রুটি না লুচি।

লুচি।

বাঃ বাঃ। সকালটা চা দিয়ে শুরু করি।

কর।

জামাইকে কালকের কথা জিজ্ঞাসা করলে?

বৌদি ঠোঁটে আঙুল তুলেছে। চুপ চুপ।

কেন!

সকাল থেকে ধারে কাছে ঘেঁসেনি।

জামাই বলে কথা, সকাল থেকে চা-টা দিয়েছো?

সে সব খাওয়া হয়ে গেছে।

জ্যেঠিমনি হাসছে।

নাতি কি বলছে?

ওতো এইসবই চায়, বারন করি বলে ঝগড়া করে।

না না তোমরা ভুল করছো। তোমরা যতটা ভাবছো ও ততটা নয়।

অনি শোন। বৌদি ডাকলো।

আমি রান্নাঘরের মধ্যে মুখ ঢোকালাম।

আসতে করে বললো, ওদের গল্প শুনে আমাদেরও খুব খেতে ইচ্ছে করছে।

বড়োমার দিকে তাকালাম। মুখটা লাল হয়ে গেছে।

দাঁড়াও খুব তারাতারি ব্যবস্থা করবো।

কবে বল।

দিনক্ষণ বলতে পারবো না।

ডাক্তারটা ওখানে কি খাওয়ালো কে জানে, শুধু গা গরম হলো, শীতের হাত থেকে একটু বাঁচলুম। বড়োমা বললো।

তারমানে তোমার খাওয়া হয়ে গেছে! খালি অনি চেপে যায়, না—

বড়োমা হাসছে।

তোর সঙ্গে কথা হলো কই যে বলবো।

কিগো দিদি। ছোটোমা পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।

অনিকে বললাম। বৌদি বললো।

ধ্যুস তুমি যে কি।

কি হয়েছে, লুকিয়ে চুড়িয়ে খেলে কোনও দোষ নেই।

দামিনীমাসি, বৌদির পেছনে দাঁড়িয়ে হেসে যাচ্ছে।

দামিনীকে বললাম, দামিনী বললো হবে না। বড়োমা বললো।

দাদা শুনলে ঠ্যাঙাবে। আমি বললাম।

ওতো তবু খেয়েছে, আমরা কেউ চেঁখেও দেখি নি।

দাঁড়াও তোমার মনের সাধ পূর্ণ করে দেব।

মিত্রা গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এলো।

চলবে —————————



from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/HDbEyP0
via BanglaChoti

Comments