কাজলদিঘী (১৯৩ নং কিস্তি)

❝কাজলদীঘি❞

BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

১৯৩ নং কিস্তি
—————————–

এতো বছর হয়ে গেল তুই এখনও নিজের ভেতরর মানুষটাকে সেই ভাবে কখনও আমাদের সামনে আনিস নি। খুব সন্তর্পনে আগলে রেখেছিস। কাউকে তার সঙ্গে পরিচয় করাস নি।

অস্বীকার করতে পারবি?

আমি একটা মেয়ে।

একটা মেয়ে আর একটা মেয়ের দুর্বলতা খুব তাড়াতাড়ি বুঝতে পারে। একটা ছেলে সহজে ধরতে পারে না। এটা প্রকৃতি দত্ত।

আমি মিত্রার অর্গল থেকে নিজেকে মুক্ত করে, খাট থেকে উঠে দাঁড়ালাম।

সোজা জানলার কাছে এসে দাঁড়ালাম।

আমগাছটা নীরবে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

ঘরের আলো জানলা দিয়ে আমগাছের তলায় ছড়িয়ে পরেছে।

চোখ চলেগেল পাঁচিলের দিকে। উঁচু পাঁচিলটার ওপাশে কর্পোরেশনের নিওন আলো জ্বলছে। তার আলো আমগাছের ফাঁক দিয়ে বাগানের মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে।

মাথার ভেতরটা কেমন শূন্য শূন্য মনে হচ্ছে।

আমি যেন ফুর ফুরে হাওয়ায় ডানা মেলে আকাশে উড়ছি।

এ কি উভয় সঙ্কটে পরলাম?

আমি জানতাম একদিন না একদিন আমাকে এই প্রশ্নের মুখো মুখি হতে হবে।

সেটা এতো তাড়াতাড়ি আমার জীবনে এসে পরবে বুঝতে পারিনি।

কি উত্তর দেব আমি।

উত্তর তোকে দিতে হবে অনি।

এরা দুজন তোর শরীররে সঙ্গে শরীর মিশিয়েছে। একজন তোর সন্তান গর্ভে ধারণ করেছে। আর একজন তোকে পাওয়ার জন্য তার সারাটা জীবন স্যাক্রিফাইশ করেছে।

তুই কিছুতেই অস্বীকার করতে পারবি না। অস্বীকার তুই করিসও না।

তাহলে তোর সঙ্কোচটা কোথায়?

নিজের কথা নিজের মুখে বলতে কেমন বাধ বাধ ঠেকে।

মিত্রা তোকে কি করে বললো। ও তো নাও বলতে পারতো।

নিজর মনে নিজে হাসলাম।

এটাই মানুষের জীবন। তোকে মেনে নিতে হবে, মানিয়ে নিতে হবে।

চোখদুটো ভীষণ জ্বালা জ্বালা করছে।

অনেক যত্ন করে তুই তোর এই গোপন কথা গোপনেই রেখেছিলি। এখনও পর্যন্ত তুই মিলিয়ে উঠতে পারিসনি। মাসিমাকেও তুই তোর পরিচয় এখনও গোপনে রেখেছিস।

আলতো ছোঁয়ায় ধ্যানভ্রষ্ট হলাম। ফিরে তাকালাম।

মিত্রা-তনু দুজনে আমার সামনে দাঁড়িয়ে।

জড়িয়ে ধরলো।

কেন তুই এতো কষ্ট পাচ্ছিস?

আমি স্থবীরের মতো মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ।

বুঝতে পারছি চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে চাইছে। আমি কিছুতেই কাঁদতে চাই না। ঘন ঘন চোখের পাতা পড়ছে।

আজ তুই মাসীমার বুকের কাপরটা ঠিক করে দিলি। মাসীমার কোনও সঙ্কোচ বোধ নেই। তোকে একটুও বাধা দিল না। পুত্র স্নেহে তোর আদর-যত্ন সাদরে মেনে নিল। তোর কিছু মনে হয়নি। একটা ময়ে হিসেবে ব্যাপারটা আমার তনুর চোখে লেগেছে। এটাই স্বাভাবিক।

এই রকম সিচুয়েসন বহুবার বড়োমার ক্ষেত্রে, ছোটোমার ক্ষেত্রে ঘটেছে। তুই ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিস। আমাকে বলেছিস বড়োমার বুকের কাপরটা একটু ঠিক করে দে, তারপর আমি আসছি।

মাসীমাকে দেখার পরই তোর চোখে মুখে চাপা উত্তেজনা ছড়িয়ে পরেছে। অসম্ভব পরিতৃপ্ত একটা মুখ ওই উত্তেজনাময় মুখের আড়ালে ভেসে উঠেছে। তুই কি নিবিড়ভাবে মাসীমার কপালে হাত রেখেছিলি। মাসীমার চোখের চাহুনি, তোর চোখের চাহুনি তখন মিলে মিশে একাকার।

তখন তোর মনেই ছিল না। আমরা দু-জন তোকে মাইক্রোস্কোপের তলায় ফেলে দেখছি। তুই আপন মনে মাসীমার মধ্যে নিজেকে সঁপে দিয়েছিস। মাসীমা শুধুমাত্র তোর একজন পরিচিতা মহিলা হলে এটা তুই করতে পারতিস না। তোর সেই ইমোশানটাই আসত না।

যে দুটো চিঠি আমি পড়েছি, সেই দুটো চিঠির তলাতেই রুমাদি নামটা লেখা ছিল। ইনি কি সেই রুমাদি? ঠিকানা লেখা ছিল গ্রামঃ মালতীপুর, পোঃ কাজিডাঙা, ভায়াঃ নবদ্বীপ, জেলা নদীয়া।

আমি মিত্রার দিকে অপলক নয়নে তাকিয়ে আছি

বল না বুবুন চুপ করে আছিস কেন, কে এই মাসীমা? মায়ের কে হন উনি?

মিত্রা আমার দুই হাত ধরে প্রচণ্ড জোর ঝাঁকুনি দিল।

আমি মিত্রার মুখের দিকে ভাসা ভাসা চোখে তাকিয়ে।

ভীষণ কষ্ট হচ্ছে বুকের ভেতরটায়।

আমি ওদের থেকে নিজেকে মুক্ত করে আবার জানলার দিকে মুখ করলাম। জানলার ধাপিটায় দু-হাতে ভর দিয়ে ঝুঁকে পরলাম।

অস্পষ্ট আলোয় পরিষ্কার দেখতে পেলাম, একটা ব্যাঙ লাফিয়ে লাফিয়ে আমগাছের তলা দিয়ে চলে যাচ্ছে। হয়তো খাবার খুঁজতে বেরিয়েছে।

কাকে খুঁজতে গিয়ে কাকে পেলাম!

আমার জীবনটাই মনে হয় এইরকম। একটা জটিল অঙ্ক। আমি সারাজীবন এই জটিল অঙ্ক মিলিয়ে যাবার চেষ্টা করে যাব। হয়তো মিলবে হয়তো মিলবে না।

আম গাছের ডালটা সামান্য দুলে উঠলো। হয়তো কোনও কাক তার ডানা দুটো সজোরে ঝাপ্টাল। একবার ওই অন্ধকারেই চোখ মেলে তাকালাম। দেখতে পেলাম না।

অনি তুই আর চুপ থাকতে পারবি না। বলে দে। তুই যতটুকু জেনেছিস ততটুকুই বলে দে।

কতদিন তুই এই বোঝা বয়ে বেড়াবি? তুই নিজেও জানিস মসীমার আয়ু আর বেশি দিন নেই। অন্ততঃ শেষ সময়টুকু তাকে সব কিছু জেনে যেতে দে। একটু শান্তিতে মরতে দে।

শুনবি সে কাহিনী—

হ্যাঁ শুনব। শোনার জন্যই আজ ও বাড়ি থেকে এ বাড়িতে চলে এসেছি।

স্পষ্টতই মিত্রা, তনুর চোখে মুখে উত্তেজনা ছড়িয়ে পরেছে।

অনি ব্যানার্জী মরে যাবার পর, অনিন্দ ব্যানার্জী যখন প্রথম কলকাতায় এলো। তখন তার একটা লোককে ভীষণ সন্দেহ হতো।

বিধান বসু।

কি বলছিস তুই!

হ্যাঁ আমি ঠিক বলছি।

খোঁজ খবর নিয়ে জেনেছি, সিকিভাগ হলেও রাজনাথের প্রতি তার দুর্বলতা ছিল।

রাজনাথ যে সেই রাতে অনি ব্যানার্জীকে মারতে চেয়েছিল সেটা অনি ব্যানার্জীর কাছে তখন জলের মতো পরিষ্কার। হয়তো অনি ব্যানার্জী মরে যেত। কিন্তু সাগির, নেপলা, অবতারের জন্য সেই যাত্রায় অনি ব্যানার্জী বেঁচে যায়।

মিত্রা তনুর চোখ মুখে একরাশ বিষ্ময়।

আর বিধান বসু এই খবরটা জানত না সেটা হতে পারে না।

অনিমেষ বিশ্বাসের সঙ্গে বিধান বসুর একটা ঠাণ্ডা লড়াই ছিল। যেটা সাদা চোখে আমরা বলি লবি বাজি। প্রত্যেকেই তার নিজস্ব ক্ষমতা জাহির করে পার্টির ঊর্দ্ধে উঠতে চায়।

আমি রাজনাথ, প্রবীরদাকে ওইভাবে এ্যাটাক করেছি বিধান বসু ওপর ওপর মেনে নিলেও ভেতর ভেতর বিধানদা মেনে নিতে পারেনি। তার ওপর বিধানদা সিনয়ার হওয়া সত্ত্বেও বিধানদাকে টপকে অনিমেষদা পার্টির কর্ণধার। অনেক অঙ্ক বুঝলি। আজ যদিও এই বিষয়টার কোনও গুরুত্ব নেই। কিন্তু তখন এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।

রাজনীতিটা বড়ো অদ্ভূত। সেখানে ক্ষমতা শেষ কথা।

তাই অনি ব্যানার্জী চেয়েছিল যেটা ঘটে গেছে সেটা স্থিতাবস্থায় থাক। আর সামনে এসে কাজ নেই। বরং বিধান বসুর রাজনৈতিক কেরিয়ারটা শেষ করে দাও।

খোঁজ শুরু করো তার দুর্বলতা।

ধীরে ধীরে ঘুঁটি সাজালাম। আবার নতুন করে পথ চলা শুরু করলাম। এই পৃথিবীতে একটা মানুষ পাবি না, যার কোথাও না কোথাও টিকি বাঁধা নেই। থাকতেই হবে।

বিধানদা অবিবাহিত। সৎ নিষ্ঠাবান। পার্টিতে ক্লিন ইমেজের লোক। পার্টিগত ব্যাপার ছাড়া কেউ কোনও খুঁত খুঁজে পায় না। কথাটা আমার ঠিক বিশ্বাস যোগ্য মনে হলো না।

গরু খোঁজার মতো খোঁজ খবর শুরু করলাম।

বিধানদা কৃষ্ণনগরের ছেলে। অনেক কষ্টে খুঁজে বার করলাম। কলেজ লাইফে বিধানদার সঙ্গে একজন মহিলা পার্টি কর্মীর খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। এও শুনলাম ব্যাপারটা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল সবাই ভাবত তারা পরবর্তী কালে স্বামী-স্ত্রী হিসাবেই জীবন কাটাবে।

মিত্রাদের চোখে মুখে উত্তেজনার পারদ মুর্হূ মুর্হূ চরতে শুরু করেছে।

তাহলে হঠাৎ বিধানদা সারাজীবন কুমার থেকে গেল কেন?

আবার খোঁজা শুরু করলাম। শুনলাম পার্টিতে দু-জনেরই অবদান অপরিসীম। দু-জনেই পুলিসের চোখে ধুলো দিয়ে আণ্ডারগাউণ্ডে ছিলেন বেশ কিছুদিন।

তখন পশ্চিমবাংলার বামপন্থী রাজনীতির খুব উত্তাল অবস্থা। পুলিশের চরম অত্যাচার। পায়ের তলায় জমি কারুর নেই। যে যেদিকে পেরেছে ছুটে চলে গেছে। যারা সহ্য করতে পারেনি, তারা সামাজের মূল স্রোতে মিশে গেছে। একদিন বিধানদা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে জেলে গেলেন। পাঠিয়ে দেওয়া হলো তামিলনাড়ুর একটা জেলখানায় (এখন সংশোধানাগার বলা হয়)। তখন এরকমই হতো।

আর সেই মেয়ে, সে ডিস্ট্রিক্ট জজের বদানুকুল্যে সে যাত্রায় রেহাই পেলেন, জজের গলায় বরমাল্য দিয়ে সুখে ঘর সংসার করা শুরু করলেন।

এই টুকু খোঁজ-খবর জোগাড় করে ফাদারের কাছে গেলাম। তখন অনিকার বয়স মাত্র পাঁচ বছর। ঘণ্টা পক্কে পিঠোপিঠি দুই আড়াই বছর হবে।

ফাদারের কাছে কনফেস করলাম। ফাদার সব শোনার পর কিছুক্ষণ গুম হয়ে থাকল।

শেষে বললো, ঠিক আছে আমি খোঁজ খবর নিয়ে তোকে সব জানাব।

দিল্লী হয়ে দুবাই চলে গেলাম।

মাস ছয়েক পর ফাদার জানাল তুই একবার ইন্ডিয়াতে আয় তোর সঙ্গে দরকার আছে।

বললাম, কিছু খোঁজ পেয়েছ।

বললো, হ্যাঁ।

ফিরে এলাম।

সারারাত ফাদারের সঙ্গে কথা বললাম।

জানলাম ভদ্রমহিলার নাম নিবেদিতা মুখার্জী।

ফাদার শুধু আমাকে নাম-ধাম ঠিকানা দিতে পেরেছিল। আর কিছু নয়।

ফেরার সময় রাজনাথকে মের দিয়েগেলাম। যে ভাবে ব্যানার্জীকে শেষ করেছিলাম।

এবং এও জানতাম এই খবরটা বিধানদার কানে পৌঁছে যাবে।

কেননা একমাত্র রাজনাথই জানতো আমি মরিনি।

ফিরে গিয়ে সেবার প্রথম লণ্ডন গেলাম তনুর কাছে। কয়েকদিন ছিলাম। তনুকে কিছু বলিনি। শুধু বলেছিলাম তোমার কাগজের একটা প্রেস কার্ড আমাকে জোগাড় করে দিতে পারবে, আমি ইন্ডিয়ার করেসপন্ডেন্ট হব।

তনু নিজের কাগজের জন্য ব্যবস্থা করে দিতে পারল না। আর একটা কাগজের জন্য ব্যবস্থা করে দিল। আমি ইন্টারভিউ দিলাম। পাশ করলাম। প্রেস কার্ড মিললো।

লেখার ওপর রেমুনারেসন।

বিনিময়ে তনু আমার কাছে সন্তান চাইল। বার বার এক কথা তোমার মতিগতি দেখে মনে হচ্ছে তুমি আর কোনওদিন মিত্রাদির কাছে ফিরে যাবে না। তাহলে কেন আমাকে বঞ্ছিত করবে।

সেবার তনুকে কোনও কথা দিতে পারিনি। বলেছিলাম আমাকে মাস কয়েক সময় দাও। আমি তোমার কাছে ফিরে আসব।

তনু প্রথমটায় বিশ্বাস করতে পারেনি। ওকে অনেক বুঝিয়ে শুঝিয়ে ফিরে এলাম।

আবার কলকাতায় এলাম। ফাদারের সঙ্গে দেখা করলাম।

ফাদার বললেন উনি এখন ভাগলপুরের এই জায়গায় থাকেন ওনার শ্বশুরের প্রপার্টি নিয়ে অন্যান্য শরিকদের সঙ্গে সমস্যা চলছে। রিসেন্ট ওনার স্বামী মারা গেছেন। ওনার স্বামী কয়েকবছর হলো ভাগলপুর কোর্ট থেকে অবসর নিয়েছিলেন।

অনিকাদের সঙ্গে কয়েকদিন কাটিয়ে চলে গেলাম সেই জায়গায়।

তার আগে নিজে কিছুটা হোম ওয়ার্ক করে নিলাম।

প্রথম দিন সাংবাদিক হিসাবে পরিচয় দিয়ে পৌঁছে গেলাম।

বিদেশী কাগজের সাংবাদিক তাও আবার বৃটিশ কাগজের। রিসেপসনটা খারাপ পেলাম না।

আলাপ হওয়ার পর নিজে থেকেই জিজ্ঞাসা করলেন আপনি আমার কথা জানলেন কি করে।

বললাম দিল্লীতে আমার এক বন্ধু থাকে সে আপনাদের পার্টির ভাবধারায় ভাবিত তার সঙ্গে বেঙ্গলের অনেকের পরিচয় আছে সেই সূত্রে জেনেছি।

আমি এখন আর বাংলায় থাকি না।

আমি কিন্তু পার্টির এখনকার অবস্থান জানতে চাইছি না।

এরপরই আমি ওনাকে বললাম, আপনি আমাকে ভীষণ সম্মান দিয়ে ফেলছেন আর নয়। আমি আপনার পুত্রের সমতুল্য।

উনি হাসলেন।

তুমি বেশ ভালো বাংলা কথা বলো। তোমার বাড়ি কোথায়?

বললাম আমার রুট একসময় এই জেলাতে ছিল। নিজের জেলার নাম বললাম। তারপর বেঙ্গলের বাইরে। আমি আজ পাঁচ বছর হলো বিদেশে আছি।

বাবা-মা।

খুব ছোট অবস্থায় গত হয়েছেন। ঠিক মনে পরে না।

উনি আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন।

তাহলে!

আমি আমার এক কাকার কাছে মানুষ হয়েছি। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন।

পরিচয় পর্ব আর বেশি দূর এগোয় নি।

কি নিয়ে লিখবে।

আমি বাংলার বামপন্থী আন্দোলনের গোড়ার ইতিহাসের ওপর একটা আর্টিকেল লিখতে চাই।

উনি প্রথমটায় এরিয়ে গেলেন।

তারপর এই কথা সেই কথায় বুঝিয়ে দিলাম আমি যথেষ্ট হোম ওয়ার্ক করে এসেছি। আপনি যদি আমাকে একটু গাইড করেন।

সেদিন আর বেশি দূর এগোই নি।

উনি ওনার পুত্র-পূত্রবধূর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন।

দু-জনকেই খুব লুক্রেটিভ লাগল। পুত্র আমারই সমবয়সী।

তারপর আর একদিন গেলাম। উনি কিছুটা হেল্প করলেন।

ফিরে এলাম।

একটা আর্টিকেল লিখলাম। কপি পাঠালাম। সঙ্গে একটা চিঠি। যা যা ডাটা জোগাড় করেছিলাম সব। সেখানে বিধানদার কথাটা উল্লেখ করে দিলাম। বললাম দিল্লীতে আলাপ হলো। আমি আপনাকে নিয়ে একটা আর্টিকেল লিখতে চাই।

উনিও আমাকে একটা চিঠি দিলেন। জানতে চাইলেন নেক্সট ইন্ডিয়াতে আমি কবে আসছি।

তখন উনি জানতেন তুই কলকাতার ছেলে?              

ওই যে বললাম শুধু আমার ডিস্ট্রিক্টের নামটা বলেছিলাম।

মাসিমনিকে প্রায়ই চিঠি লিখতাম। একটা চিঠিতে একবার আমার গ্রামের নামটা উল্লেখ করেছিলাম। কিভাবে এসেছি জানাই নি।

তনুর সঙ্গে একমাসের কথা বলে গেলাম ছ-মাস পর। 

তার মধ্যে তনু অন্ততঃ পক্ষে লক্ষবার বলেছে। বিয়ে, সন্তান।

গিয়ে ওকে সব বোঝালাম। দেখলাম বরফ গললো।

তখন তনু জানতো?

তনুকে অনি ব্যানার্জীর মৃত্যুর কথা বলেছিলাম।

তনু, মিত্রার দিকে তাকিয়ে।

তুমি একবার ভাবো মিত্রাদি!

তুই এই আর্টিকেলগুলো দেখিসনি!

হ্যাঁ।

তখন ও কি অনি ব্যানার্জী না অনিন্দ ব্যানার্জী?

অনিন্দ ব্যানার্জী।

তারমান তখন কাগজপত্র গোছান হয়ে গেছে।

কি করে জানব। তার ইতিহাস কিছুই জানি না। আজ শুনি।

আমি দুজনের দিকে তাকিয়ে আছি।

তনু টেবিলের ওপর থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা একটু এনে দেবে।

চা খাবে?

আবার তৈরি করতে হবে।

ফ্লাক্সে করে নিয়ে এসেছি।

দাও।

তনু টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল।

চল খাটে গিয়ে বসি।

মিত্রা আমার মুখের দিকে তাকিয়েছে।

বড়োমারা আসবে না?

না।

তুই যে বললি ফিরে আসবে।

বললো কাল আসবে।

ফিরে আসতে বল।

আজ যদি তিনজনে একটু একা থাকি খুব অসুবিধে আছে?

তারমান তুই বারন করেছিস।

হ্যাঁ।

খাটে এসে বসলাম।

তনু চা ঢেলে দিল।

তারপর?

কি হবে তোর বুবুনের কথা শুনে।

বুবুনের কথা শুনতে চাই না। অনি ব্যানার্জী, অনিন্দ ব্যানার্জী আর সেই ভদ্রমহিলা।

আমি ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে।

কলকাতায় এলাম।

একটু ইন্টারাপ্ট করবো। মিত্রা সরাসরি আমার দিকে তাকাল।

বল।

এই সময় অনুপ কি দিল্লীতে?

হ্যাঁ। তখন অনুপের দু-বছর দিল্লীতে কাটান হয়ে গেছে।

কারা তোকে খোঁজ খবর দিত।

নাই বা জানলি।

আজ বলতেই বা দোষ কোথায়।

তোদের পরিচিতরাই ছিল। তখন ওরা আমাকে ভীষণ হেল্প করতো।

চায়ে চুমুক দিলাম। ওরা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। বলতে ইচ্ছে করছে না। তবু বলতে হবে। ওরা যে শুনতে চায়।

তারপর?

সেই বার তনুকে সঙ্গে করে দিল্লীতে পৌঁছে প্রথমে চিঠিতে লেখা ওনার নম্বরে ফোন করলাম। বললাম পার্লামেন্ট সেশন চলছে। কাগজের হয়ে এসেছি। আপনার সময় থাকলে একবার কয়েকদিনর জন্য ভাগলপুরে যাব আপনার সঙ্গে দেখা করতে।

বললেন, আমি এই মুহূর্তে এখন ভাগলপুরে আছি তবে এক সপ্তাহের মধ্যে এখানকার পাততাড়ি গুটিয়ে কলকাতায় সিফ্ট করছি।

তাই!

কোথায়?

আমার শ্বশুরের ভিটেতে।

ঠিকানা নিলাম।

আসতে বললো।

দিল্লীর কাজ শেষ করে কলকাতা এলাম। দিল্লীতে প্রথম তনুকে রেস্ট্রি করলাম। অনুপ করাল।

কলকাতায় এসে মনার কাছ থেকে সুন্দরকে দত্তক নিলাম। অনুপ সঙ্গে ছিল। ওইই সব ব্যবস্থা করলো। তখন সুন্দর আদো আদো কথা বলতে পারে। তনুকে অনুপের সঙ্গে দিল্লীতে পাঠিয়ে কলকাতায় থেকে গেলাম।

মনার কাছে?

হ্যাঁ।

মনাকে ঠিকানাটা বললাম। তুই একবার খোঁজ খবর করে আমাকে একটু জায়গাটা বল ঠিক কোথায় হবে। ও এসে আমাকে জায়গাটা বললো।

কোথায় সেটা।

আমি মিত্রার দিকে তাকিয়ে হাসলাম।

বল না। সাসপেন্সে রাখিস কেন।

বলছি তো। যেখানে গেছিলি।

ওনার সঙ্গে দেখা করলাম।

তখন কাকা বেঁচে না মারা গেছেন।

কাকা বেঁচে আছে।

ওরা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

বিশ্বাস করো মিত্রাদি আমি কিছুই জানতাম না।

কিরে তোরা দুজন কাউকে রেকর্ড করে শোনাচ্ছিস নাকি?

বিশ্বাস কর।

জানিস মিত্রা, মাঝে মাঝে বুকটা ভীষণ যন্ত্রণা করে। ঈশ্বর কেন যে আমায় এ ভাবে সৃষ্টি করলেন কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারি না।

মিত্রা, তনুর চোখ দুটো ছল ছল করে উঠলো।

কিছুক্ষণ তিনজনেই চুপ চাপ বসে থাকলাম।

একটা সিগারেট ধরালাম।

সেবার কলকাতায় এসে পরপর তিনদিন ওনার কাছে গেছিলাম।

প্রথম দিন যেতেই ভদ্রমহিলা আমার লেখার খুব প্রশংসা করলেন।

তারপর বিধনদার কথা উঠলো।

তুমি চিঠিতে লিখেছ বিধান বসুর সঙ্গে তোমার আলাপ হয়েছে।

মাথা দোলালাম।

কোথায়?

দিল্লীতে। অনুপের নাম করলাম। ও আমার ঘনিষ্ট বন্ধু। এখন সুপ্রীমকোর্টে প্র্যাক্টিশ করে।

ওরকম একটা ফিগার ব্যস্ত মানুষ।

কথা বলি আর ওনার চোখের দিকে লক্ষ্য করি।

তুমি এই লেখাটা লেখার সময় ওনার সঙ্গে দেখা করেছিলে?

না।

তাহলে!

উনি আমাকে সময় দেননি। লোকের মুখে যে টুকু শুনেছি। তবে পলিটব্যুরোর অনেকে আমাকে হেল্প করেছেন। তারপর নিজে একটু পড়াশুনো করলাম।

ওনার মুখের দিকে তাকালাম।

তুমি বিধান বসুকে চেন?

তারপর নিজেই বললাম। কি বোকা বোকা কথা বললাম দেখ। তুমি একসময় এই রাজনীতিটা খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে করেছো। শুনেছি এই আন্দোলনের তুমি একজন পিলার ছিলে।

ওনার চোখে মুখে হাসির ছটা।

চা খেতে খেতে গল্প শুরু হলো।

আমার সঙ্গে একসময় খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়েছি। বিয়ের পর চলে গেলাম ভাগলপুর। সব কেমন ওলট পালট হয়ে গেল।

কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করলো তুমি চিঠিতে তোমার গ্রামের নাম লিখেছো। ওটা ঠিক কোথায়?

কেন, তুমি গেছ?

না। এমনি একটু আধটু পরিচয় আছে।

আমি কি ভাবে যেতে হয় বললাম।

তুমি কাজদীঘি চেন!

হ্যাঁ। আমার নিজের গ্রাম চিনবো না।

তাই!

আমি ওনার দিকে তাকিয়ে।

কতদিন গ্রামের বাইরে আছো?

বহুদিন। আমার খুব ছোট বয়সে মা-বাবা মারা গেলেন। সম্পর্কে কাকা দিল্লী নিয়ে এলেন। তারপর বার কয়েক কাকার হাত ধরে গেছি। একবার একলা গেছি।

সেদিন আর বেশি দূর এগোয় নি। এ কথা সে কথা বলার পর উঠে চলে এলাম।

ফিরে আসার পথে মনাকে নিয়ে জায়গাটা ভাল করে ঘুরে ঘুরে দেখলাম। আমার কেমন যেন চেনা চেনা লাগল মনে হলো আমি যেন আগে এখানে এসেছি।

পরদিন আবার গেলাম।

আমার উদ্দেশ্য তখন একটাই যে ভাবে হোক বিধানদার রাজনৈতিক কেরিয়ার ডুম করা। আমাকে ভদ্রমহিলার পেট থেকে সব কিছু উদ্ধার করতে হবে। তারপর একটা মশালা লেখা।

একটু হলেও বিধানদার নিখাদ চরিত্রে দাগ লাগবে।

ধীরে ধীরে খোঁচা মারতে শুরু করলাম।

কেন জানিনা আমাকে ওনার ভালো লেগেগেছিল।

তখন উনি আমার সঙ্গে একটা শর্ত করলেন। আমি ঘুনাক্ষরেও কাউকে এই সব কথা বলতে পারব না। লেখা দূর কি বাত। আর আমাকে শর্ত দিলেন আমি তোমার কাছ থেকে কিছু জিনিষ ডিটেলসে জানতে চাই তোমাকে জানাতে হবে।

আমি রাজি হলাম।

তারপর একবারে তুইতে এসে ঠেকল।

তোর নামটা যদি একটু কেটে-ছেঁটে ছোট করে দিই কোনও অসুবিধে আছে?

একবারে না।

অনিন্দ নামটা খুব সুন্দর তবে ‘ন্দ’-টা বাদ দিয়ে যদি অনি বলে ডাকি তোর আপত্তি আছে?

বুকটা ধক করে উঠলো। বুকের লাবডুব শব্দটা কেমন বেরে গেল।

ভাবলাম তাহলে কি উনি সব জেনে ফেলেছেন!

নিজেকে আরও বেশি সতর্ক করলাম। একটা কথাও যেন মুখ ফস্কে বেড়িয়ে না যায়।

হঠাৎ তোমার এই খেয়াল হল।

আমার এক নিকট আত্মীয়ের এই নামটা ছিল, তোর নামের সঙ্গে মিলে গেল তাই।

হাসলাম।

হ্যাঁ রে।

তোমার কথা বলো।

তখন আমি কৃষ্ণনগর কলেজে পড়ি। প্রথমবর্ষ বিধানদা তখন আমাদের কলেজ থেকে সদ্য পাশ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ-তে রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে ভর্তি হয়েছে। আমাদের কলেজের ইউনিটটা দেখাশুন করত। প্রায়ই যাওয়া আসা করে আমাদের কলেজে। উঠতি বয়স। সকলের যা হয়। আমারও তাই হলো। আমাদের ক্লাস রিপ্রেজেনটিভ একদিন ওনার সঙ্গে আলাপ করিয় দিল।

কি ভূত ঢুকলো মাথায় পার্টির প্রেমে পরে গেলাম।

তখন এতো খোলামেলা ছিল না। সব চুপি চুপি। বলতে পারিস নিষিদ্ধ।

লুকিয়ে লুকিয়ে গ্রামে গ্রামে গিয়ে মিটিং করতাম। বিধানদা সঙ্গে থাকত। বলতে পারিস হাতে ধরে কি ভাবে সংগঠন তৈরি করতে হয় শেখাল। ধীরে ধীরে ব্রাঞ্চ বারতে শুরু করলো।

আমি মেয়ে তাই একটু এ্যাডভান্টেজ পেলাম।

বিধানদা আসা যাওয়া কমাল আমাকে এই ডিস্ট্রিক্টের সমস্ত দায়িত্ব দেওয়া হলো। আমি সেই দায়িত্ব গোপনে পালন করতে শুরু করলাম।

কলেজের গণ্ডী পেরিয়ে ইউনিভার্সিটির গণ্ডী। তখন কলেজে কলেজে ইউনিট তৈরি করি। আমি বিধানদা লুকিয়ে-চুরিয়ে মিটিং করি। এখনকার সব পার্টির অনেক বড় বড় মাথা তখন কলেজের স্টুডেন্ট।

তোমার বাড়িতে কেউ জানত না?

জানত না আবার, সেই নিয়ে কত কাণ্ড।

ওটা পরে শুনব, আগে তোমার এই পর্বটা শেষ করো।

তুই আমাদের এখানকার লিডিং নিউজ পেপারটার নাম জানিষ।

বললাম।

তার সম্পাদকের সঙ্গে তোর পরিচয় আছে।

না। কি নাম বলো।

অমিতাভ চক্রবর্তী।

বুকের ধুকপুকুনি আবার বাড়তে শুরু করলো। মনে মনে ভাবলাম আমার জন্য খুব সুন্দর একটা ফাঁদ পাতা হয়েছে। নিজেকে বড্ড বেশি শেয়ানা মনে করি। যে ভাবেই হোক আমাকে এই ফাঁদ কেটে বেরিয়ে যেতে হবে।

উনি তখন আমাদের বুদ্ধিদাতা। সিনিয়ার। তাছাড়া সাংবাদিকতা করেন বলে প্যারালাল একটা ইমেজ তৈরি হয়েছে। সচরাচর কেউ ছুঁতে পারেন না। উনি তখন আমাদের কলেজে কলেজে ইউনিট গড়ার কাজে ভীষণ হেল্প করতেন।

আমার বুকের ধুক পুকুনি আবার বারলো। তখন আমি মনে মনে ধরে নিয়েছি। উনি আমাকে নিয়ে ভালোরকম হোম ওয়ার্ক করে নিয়েছেন।

অগত্যা যা কপালে থাকে।

তখন তুমি কলকাতায় কোথায় থাকতে?

কলকাতা না বেলঘরিয়াতে একটা মেসে থাকতাম আমরা চার বন্ধু।

তারমানে বাড়ি থেকে টাকা পাঠাচ্ছে। তুমি পড়াশুনর নামে পার্টি করে বেরাচ্ছ।

কখনই না। পার্টি করার সাথে সাথে পলিটিক্যাল সাইন্স নিয়ে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিলাম।

তাহলে তুমি বেশ করিতকর্মা ছিলে।

উনি হাসছেন।

এখন যিনি পার্টির সর্বেসর্বা অনিমেষ বিশ্বাস সেই সময় তার সঙ্গে আলাপ হয়। ওর বউটাও তখন সবে পার্টিতে জয়েন করেছে। দুজনে মিলে চুটিয়ে প্রেম করছে। প্রায় আমার কাছে আসে। সিডিউল তৈরি করে দিই। তখন কিন্তু আমার ভাল নাম কেউ জানে না। আমার ডাক নামেই সকলে চিনত।

কি সেই নামটা?

তোকে জানতে হবে না।

হাসলাম।

বেশ ভালো ছিল সেই লাইফটা বুঝলি। তারপর সব কেমন গোলমাল হয়ে গেল।

উনি কেমন গুম হয়ে গেলন।

সেদিন ওনাকে প্রণাম করে বললাম। আজ তোমার মুড ঠিক নেই আমি যাই।

তাই যা।

আমি আজ রাতের ফ্লাইটে ফিরে যাচ্ছি। তুমি তোমার সর্তটা বললে না। নেক্সট যখন আসব, তখন তোমার সর্তটা রাখার চেষ্টা করবো।

চিঠি দেব, উত্তর দিস।

আচ্ছা।

ওনার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। ঠাকুর রাম বাঁচান বাঁচিয়ে দিয়েছে।

বার বার মনে হচ্ছিল এই বুঝি ধরা পরে গেলাম। আমার সমস্ত মিশন ভেস্তে গেল।

ফিরে গেলাম। যাওয়ার সময় মনাকে সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে গেলাম।

লণ্ডনে পৌঁছে তনুর সমস্ত ব্যবস্থা ঠিক ঠাক করে আমি দুবাই এলাম। আফতাবভাই-এর সঙ্গে দেখা করলাম। বললো তোর একটা চিঠি এসেছে ইন্ডিয়া থেকে।

দেখলাম ওনার চিঠি।

চিঠি বললে ভুল হবে। প্রায় গোটা পনেরো পাতায় নিজের জীবন কাহিনী লিখেছেন।

একটু বল।

চিঠিটায় কি লেখা ছিল বলছি। জীবন কাহিনীটা পড়ে নিস। চিঠিটা আমার কাছে আছে।

লাইন বাই লাইন হয়তো বলতে পারবো না। বয়ানটা এরকম ছিল।

স্নেহের অনি,

ভাল থাকিস।

তুই চলে যাবার পর মনটা ভীষণ ভারাক্রান্ত। একজন স্বল্প পরিচিত ছেলে এতদিন এইভাবে আমার মনে দাগ কাটতে পারেনি। যা তুই করে গেলি।

কেন জানিনা তোকে মন মনে ভীষণ স্নেহ করে ফেলেছি। তুই আমার মনের বন্ধ দুয়ারে কড়া নেরেছিস। প্রথমে খুলতে মন চায়নি। ভেবেছিলাম তুই একটা উটকো ছেলে। সুযোগ নিতে এসেছিস। কয়েকদিন বসে বসে তোর কথা ভাবলাম।

তারপর কি যেন মনে হলো। মনে হলো তুই আমার ভীষণ আপন।

যাক তুই যা জানতে চেয়েছিস নিজে মুখে কিছু বলতে পারিনি। কেমন যেন সঙ্কোচ বোধ হয়েছে। কিন্তু তোর উৎসাহ দেখে মনে হয়েছে। তুই অনেকটাই উদ্ধার করে ফেলেছিস। তাই বাকিটুকু আর গোপন রাখি কেন। তোকে লিখে জানলাম।

এই জীবনে কাউকে এখনও পর্যন্ত এই কথা জানাইনি। আমার স্বামী মৃত্যুর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত এই কথা জানতে পারেনি। ছেলে বৌ দূরের কথা।

গোপন কথা গোপন থাক। তুই কথা দিয়েছিলি তুই ব্যাপারটা নিয়ে লেখা লিখি করবি না। শুধুমাত্র তোর মনের উৎসাহ নিবারণ করতে চেয়েছিস। আমি সেইটুকু তোকে সাহায্য করলাম। আমার ব্যক্তিগত কিছু চাহিদা আছে। বলতে পরিস সেই শর্তে তোকে জানালাম। তুই আমাকে আমার মতো ফাঁকি দিবি না। সব জানাবি।

তুই কিন্তু তোর নিজের কথা এখনও বলিসনি।

ভাল থাকিস।

তোর মাসীমা।

চিঠিটা এখানে আছে?

হ্যাঁ।

তোর সেই চোরা কুঠরিতে?

হ্যাঁ।

চাবিটা দে।

এখনই পড়তে হবে?

হ্যাঁ।

পরে পড়িস।

না।

বাধ্য হয়ে আমি খাট থেকে উঠলাম।

মিত্রাদি।

মিত্রা তনুর দিকে তাকাল।

অনেক রাত হয়েছে। খাবর গরম করে নিই।

যা তাই কর। ছগনলালকে বলে দে গেটে তালা দিয়ে দিতে।

তুমি এর মধ্যে বাথরুমের কাজ সেরে ফেলে চেঞ্জ করে নাও। তোমার হলে আমি যাব। শেষে ও।

ওর তো দেরি হবে ততক্ষণে আমাদের চিঠি পড়া হয়ে যাবে।

তনু, মিত্রার দিকে তাকিয়ে হাসলো। ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

মিত্রা কোনও কথা বলছে না। আমার দিকে চেয়ে চেয়ে দেখছে।

আমি আলমাড়ি খুলে সমস্ত কিছু টেনে নামিয়ে সেই খামটা বার করলাম।

তনু ফিরে এসে ঝটপট সব গুছিয়ে নিয়ে খাবার রেডি করে ফেললো।

নিজেরাও বাথরুমের কাজ শেষ করে জামা-কাপর চেঞ্জ করে নিল।

আমি ওদের চিঠিটা দিয়ে বাথরুমে গেলাম।

কতক্ষণ বাথরুমে কাটিয়েছি জানি না। একরাশ চিন্তা মাথার মধ্যে কিলবিল করছে। যা এতদিন খুব সন্তর্পনে গোপন রেখেছিলাম তা আজ উন্মোচিত হবে। বড়োমা জানলে কি মনে করবে। দাদা-ই বা কি ভাববে। ছোটোমা, মল্লিকদা, ডাক্তারদাদা!

একে একে সব নামগুলো তাদের মুখমণ্ডল চোখের সামনে ভেসে উঠছে। সর্বপরি মিত্রা, তনু…আমার সন্তানরা। তাদের আমি কি জবাব দিহি করবো?

এই জিনিষটা নিয়ে আমি এতটা ঘাঁটা ঘাঁটি না করলেই পারতাম। বরং সেটাই ভালো ছিল।

মনাকাকা সেই জন্যই হয়তো আমাকে কোনওদিন নিজের মুখে কিছু বলতে চায়নি।

তোর জিনিষ তুই খুঁজে নে।

মনের দিক থেকে আমরা কতটা আধুনিক। কিন্তু এমন কিছু কিছু ব্যাপার আছে। সেখানে আধুনিকতার ছোঁয়া কোনও দিন স্পর্শ করতে পারবে না। কোথায় যেন বাধ বাধ ঠেকে। জানিনা সেই অন্ধকারটা কোনদিন কাটিয়ে উঠতে পারব কিনা।

মনে মনে বললাম, হে ঈশ্বর আলো দাও।

সামনা সামনি কেউ কিছু না বললেও আড়ালে আবডালে আলোচনা হবে।

হয়তোবা একটু ….।

ভাবতে ভালো লাগছে না।

বাথরুমের দরজা খুলে ঘরে এসে দাঁড়ালাম।

মিত্রা তনু আমর দিকে তাকিয়ে। চোখ দুটো কেমন ছল ছল করছে। স্খলিত পায়ে দুজনে সোফা থেকে উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমি ওদের দিকে তাকিয়ে। ওরা কথা বলছে না। জলের তলায় চোখের মনি ভাসছে। মুখদুটো কেমন বেঁকে চুড়ে দুমড়ে যাচ্ছে। লতাপাতার মতো আমি ওদের দুজনকে আঁকুড় করে জড়িয়ে ধরলাম। আমার কণ্ঠ থেকে খুব ক্ষীণ স্বর বেরিয়ে এলো।

মাসীমা মায়ের বড়ো বন।

বুবুন!

বুকের ভেতরটা ভীষণ ষন্ত্রণা হচ্ছে।

তবু কথাটা বলতে পেরে নিজেকে ভীষণ গর্বিত বোধ করলাম। এতদিন যে কথাটা কাউকে বলতে পারিনি। আজ নিজে মুখে সেটা স্বীকার করে একটু যেন শান্তি পেলাম।

মিত্রা, তনু দুজনে আমার বুকে মুখ গুঁজেছে। আমি ওদের বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে জানলার কাছটাতে গিয়ে দাঁড়ালাম। সেই আমগাছ। নিচটা অন্ধকার। ঘরের সামান্য আলো গাছের তলায় এক আলোছায়ার আল্পনা এঁকেছে। সেই পাঁচিল। কর্পোরেশনের নিওন আলো। এখন যেন কিছুটা উজ্জ্বল। তার আলো আমগাছের তলায় এসে মাথা খুঁড়ছে। ঘরের আলো রাস্তার আলোয় সব যেন মিলে মিশে একাকার।

আমার বাবা মাসীমার আর এক মাসীর সন্তান। আমার ঠাকুমা আর দিদা দুই বোন। একই মায়ের গর্ভজাত সন্তান। ঠাকুমার একমাত্র সন্তান আমার বাবা। দিদার দুই ময়ে, মা-মাসীমা।

আমার পৈতৃক ভিটে নবদ্বীপ, পোড়ামাতলা মন্দিরের পাশে।

মায়ের বাড়ি কৃষ্ণনগর, কাঁঠালপাড়া।

সম্পর্কে মা-বাবা দুজনে মাসতুতো ভাই-বোন।

দিদার যেহেতু কোনও পুত্র সন্তান ছিল না। তাই বাবাকে দিদা খুব ভালোবাসতেন।

আবার ঠাকুমার যেহেতু কোনও কন্যা সন্তান ছিল না। মা-মাসীমাকে আমার ঠাকুমা খুব ভালোবাসতেন।

দু-জনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। দুজনের ঘনিষ্ঠতা নিয়ে দুই পরিবারের কেউ যে প্রশ্ন তোলেনি তা নয়। তুলেছিল। কিন্তু সামনে সাইন বোর্ডের মতো খাঁড়া করাছিল দু-জনে ভাই-বোন। তাই ততটা কেউ আমল দেয়নি। শুভঙ্করবাবু-মনাকাকা-বাবা তিন অভিন্ন-হৃদয় বন্ধু। তিনজনেই আমাদের কলেজে একসঙ্গে পড়াশুন করেছে।

বাবার সঙ্গে মায়ের সম্পর্কের ব্যাপারটা শুভঙ্করবাবু-মনাকাকা কেউ জানতেন না।

ডা. রায় যে বছর আমাদের কলেজে প্রফেসারিতে ঢুকলেন সেই বছর এরা তিনজন আউটগোয়িং ছাত্র। মাত্র কয়েকমাস ডা. রায়ের কাছে এরা পড়াশুন করেছিল। মনাকাকার এম.এ পড়া হয়নি। পারিবারিক সমস্য। গ্রামে ফিরে গেছিলেন।

শুভঙ্করবাবু পরবর্তীকালে আমাদের কলেজেরই প্রফেসার হয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিন বন্ধুর যোগাযোগের মাধ্যম চিঠিপত্র। এম.এ পড়া শেষ হতেই দুই পরিবর থেকে দুজনে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভালোবাসার টানে ঘর বাঁধলেন। বলতে পারা যায় নিখোঁজ হয়ে পরলো দুজনে। একমাত্র সুতোর মতো সম্পর্ক থাকলো মাসীমার সঙ্গে। বাবা-মাসীমা দুজনে প্রায় সমবয়সী। হয়তো কয়েক মাসের ছোট বড়ো।

বাবা মায়ের থেকে বছর দুয়েকের বড় ছিলেন।

সেই সময় মাসীমা চুটিয়ে পার্টি করছেন। পশ্চিমবাংলার রাজনীতি তখন টালমাটাল। পুলিশ প্রশাসনের একটা বিশাল চাপ রয়েছে। মাসীমা তখন পালিয়ে পালিয়ে বেরাচ্ছেন। তুই যে ঠিকানা দেখেছিস সেটা মায়ের মামার বাড়ি। মাসীমা সেখানকার কোনও একটা অজ গ্রামে কিছুদিন গা ঢাকা দিয়েছিলেন।

তারপর মাসীমার জীবনটাও ইতিহাসে মোড়া।

বিয়ের পর বাবা খুব আর্থিক সঙ্কটে পরলেন। বাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ফলে সেখান থেকে টাকা পয়সা আসা বন্ধ হয়ে গেল। টিউসনির ওপর দুজনের পেট চলে? বাবা সেই সময় কলকাতার মলঙ্গা লেনে একটা ঘর ভাড়া করে থাকতেন। এই সময় মনাকাকাকে বাবা চিঠি লিখে সব জানালেন। মনাকাকা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। বাবাকে নিজের গ্রামে নিয়ে এসে আমাদের স্কুলে চাকরি দিলেন। থাকার জায়গা দিলেন।

মনাকাকার তখন আমাদের গ্রামে প্রচণ্ড দাপট। গ্রামের সর্বেসর্বা। কলকাতার কলেজে পড়া শিক্ষিত ছেলে। অতএব বাবার খুব একটা অসুবিধে হয়নি। গ্রামের কেউ জানল না, আমার মা-বাবা ভাই বোন। তাহলে হয়তো তখন কার সমাজ এটা কিছুতেই মেনে নিত না। আজও মেনে নেয় কিনা সন্দেহ। বেশ চলছিল। আমি পৃথিবীর আলো দেখলাম। সুখের সংসার।

স্কুল সরকারের অনুমতি পেল। বাবা, উনামাস্টার, মনাকাকা তখন স্কুলের মাস্টার।

কাকার পরামর্শে বাবা ধীরে ধীরে ওখানে জমি-জমা কিনলেন। কাকাই সব দেখা শুন করতো।

পাঁচ-ছয় বছরের সুখের সংসার।  

কোথা থেকে কি হলো কে জানে। হঠাৎ একদিন দুজনে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করলো। মনাকাকার দয়ায় সকলে জানল মা-বাবার কলেরা হয়েছিল।

মিত্রা, তনু দুজনেই আমার মুখের দিকে তাকাল।

ছল ছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে। মুখের ভাষা চোখের জলে।

ওরা এগিয়ে এসে আমাকে দুজনে জড়িয়ে ধরলো।

হ্যাঁরে। ঘটনাটা জানার পর প্রথমে খুব কষ্ট পেয়েছি। এখন আর কষ্ট হয় না। মাঝে মাঝে বুকের ভেতরটা চিন চিন করে। খুব কষ্ট হলে কেমন যেন গা গুলিয়ে ওঠে।

দু-জনে আমার বুকে মুখ ঢাকল।

তোরা আমার কথা শোনার পর আমায় ছেড়ে চলে যাবি না?

দু-জনেই আষ্টে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো।

আমাদের সমাজটা ভারি অদ্ভূত বুঝলি। তার থেকেও অদ্ভূত মানুষের মন।

একথা কাউকে গলা ফাটিয়ে বলা যায় বল।

আজ পিকু যদি অনিসাকে বিয়ে করে তুই কাউকে বলতে পারবি। না আমি বলতে পারব। এই সমাজটা কোথায় যেন আমাদের গলার টুঁটিটা চেপে ধরেছে। দম বন্ধ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে না পরা পর্যন্ত সে তার হাতের অর্গল কিছুতেই আলগা করে না। তারপর মৃত্যুর কোলে ঢলে পরলে ক্রূড় হাসি হেসে বিদায় নেয়। তার দায়িত্ব শেষ। এবার তোরা সামলা।

আমি এখনও পর্যন্ত কিছুতেই কনক্লুসনে আসতে পারিনি। তবে একটা সন্দেহ হয়।

চলবে —————————–



from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/cNHBFMh
via BanglaChoti

Comments