❝কাজলদীঘি❞
BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়
১৪১ নং কিস্তি
—————————
একটু থামলাম। সারাটা ঘর নিস্তব্ধ। পিন পরলে তার শব্দ হবে।
তোর বৌদিকেও বা আমি কি দিতে পেরেছি। বিয়ের পর একদিনের জন্যও তাকে কোথাও নিয়ে যেতে পারিনি। যা কিছু এই পরিবারের সঙ্গে শেয়ার করে নিয়েছি।
তার জন্য মাঝে মাঝে ও যে ক্ষোভ প্রকাশ করেনি তা নয়। করেছে। বুঝিয়েছি। ও বুঝেছে। তারপর ছেলেমেয়ে হলো। আমি হারিয়ে গেলাম। সব কেমন যেন গোলমাল পাকিয়ে গেল।
সেই থেকে নিজেকে কিছুতেই আর রিকভার করতে পারছি না।
একসময় ইসলামভাইকে ক্ষমতাবান মনে হতো। তখন আমি কুয়োর ব্যাং, সমুদ্র দূর কি বাত, পুকুরই দেখি নি। এখন ইসলামভাইকে চুনোপুঁটি মনে হয়।
ইসলামভাইয়ের থেকেও ক্ষমতাবান মারান। তাকেও দেখলাম। তার কাঁধে চেপে চলেগেলাম দুবাই। সেখানে আফতাবভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হলো। ঘনিষ্ঠতা হলো। আফতাবভাইয়ের স্ত্রীর সঙ্গে ভাই-বোনের সম্পর্ক গড়ে উঠলো। দুনিয়াটা একচোট দেখে নিলাম। তারপর দেখলাম আফতাবভাইয়ের থেকেও দু-চারজন ক্ষমতাবান এই পৃথিবীতে আছে। সময়ে সব জানতে পারবি।
ইন্ডিয়ার টপ লিডারদের খুব কাছ থেকে দেখলাম। সব যেন এক একটা কেঁদো বাঘ।
সরকারী দফতরের টপ টপ আমলাদের দেখলাম।
জানিষ সুরো, ভারি অদ্ভূত এই জগতটা।
শেষে সিদ্ধান্তে এলাম নোট যার ক্ষমতা তার।
নিজে কিছু না করে বুদ্ধি খরচ করে সাগির, অবতার, নেপলাকে দাঁড় করিয়ে দিলাম। তবে ওরাও পরিশ্রম করেছে। আজ ওদের দেখলে কেউ বলবে, মাজায় বাঁট (পিস্তল) গুঁজে একসময় কলকাতার অলিতে গলিতে তোলা তুলে বেড়াত। আজ কেউ যদি ওদের কাছে তোলা তুলতে আসে? ….
সুরো আমার কপালে ঠোঁট ছোঁয়াল।
আমি সুরোর মুখের দিকে তাকালাম। শান্ত মুখটা প্রশান্তিতে ভরে গেছে।
তোরা সব হাঁ করে গিলে যাচ্ছিস একটু হ্যাঁ হুঁ কর।
মিলি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লো।
আমি মিলির দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
তোমাকে এইভাবে এত কাছ থেকে কোনওদিন পাইনি। এমন ভাবে আমাদের কখনও বলো নি। তোমার কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে তাই গিলছিলাম।
রয়ে-সয়ে খাও, বদহজম হয়ে যাবে।
ইসি এতক্ষণ বাদে ঠোঁট ফাঁক করলো।
সুরো তুই এখুনি যা করলি, অংশু যদি দেখত তেলেবেগুনে জ্বলে যেত।
সুরো আমার নাকটা টিপে ধরে নাড়িয়ে দিল।
কখনই না। ও জানে তুমি কে। এমনকি আমার শ্বশুর পর্যন্ত টের পেয়ে গেছে।
তাই! কিরকম একটু শুনি?
নিজের প্রশংসা নিজেকে শুনতে হবে না।
আমি তোর মুখ থেকে শুনছি।
তোমাকে কনিষ্কদা নার্সিংহোমে নিয়ে গেল। খবর পাওয়া মাত্র ঘণ্টায় ঘণ্টায় ফোন। একবার শ্বশুর করে আর একবার শ্বাশুরী। ওতো সারাদিন নার্সিংহোমের রিসেপশনে বসেই কাটিয়ে দিল। সবাইকে ফোনে ফোনে তোমার কথা বলে। আমরা কেউ ঘর থেকে নরিনি।
একবার মাসিকে সামলাই একবার জ্যেঠিমনিকে।
ওদিকে ইসলামভাইকে, ইকবালভাই সামলেছে।
সন্ধ্যের দিকে যখন কনিষ্কদা বললো, না সেরকম কিছু বুঝছি না। জ্ঞান হারিয়েছে ঠিক, তার কোনও ব্যাখ্যা আমার জানা নেই।
চিকনাদা তখন তোমার আর একবার অজ্ঞান হওয়ার কথা বললো।
কনিষ্কদা কেমন ভাবে যেন ঘার নারলো।
বললো, মনে হয় হঠাৎ উত্তেজনার ফলে ঘটনাটা ঘটেছে। তখন একটু শান্তি পেলাম।
পিকু ইসিদিকে কাপর কাচার মতো আছাড় মেরে প্রায় মেরেই ফেলে। শেষে নীরুদা ধমক লাগাতে থামল।
টিনাদি, অদিতিদি তোমার ঘরের ছায়া পর্যন্ত মারায় নি। রিসেপশনে বসে বসেই শেষ। কতোবার যে কাপর ছেড়েছে কি বলবো তোমায়।
যাঃ সব আজেবাজে কথা। মিলি বললো।
তুই?
কি জানি কেমন যেন লাগছিল। হাত-পা কেমন ঠাণ্ডা হয়েগেছিল।
দামিনীমাসি এসে দরজার সামনে দাঁড়াল।
আমাকে ওইভাবে শুয়ে থাকতে দেখে হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে এলো।
কিরে তোর….
আমার কপালে হাত দিয়েছে।
না-না, দাদা এমনি শুয়ে আছে। সুরো বললো।
তাই বল, আমার বুকটা এখুনি ধড়াস করে উঠেছিল।
আমি হাসছি।
তুই হাসিস না বাবা। কাল দিদি এসে গেলে শান্তি।
কাল আসবে না পর্শুদিন আসবে।
সেটা আবার কখন বললো!
তখন ফোন করে বললো না। রাঘবন স্যার দিল্লীতে আটকে দিয়েছে। সুরো বললো।
তোদেরও বলি। মাসি, মিলিদের দিকে তাকালো। কখন এই ঘরে এসেছিস—
অনিদার না বলা কথা শুনছিলাম।
নিশ্চই আমার নামে দুর্নাম করছিল।
মাসি আমার পায়ের কাছে বসলো। আমি পা সরিয়ে নিলাম।
তা একটু করছিল বইকি। মিলি চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বললো।
মাসি হাসলো।
ছেলে কখনও মার নামে দুর্নাম করতে পারে।
তাহলে তুমি জিজ্ঞাসা করলে কেন?
ইসি, দিদি বলছিল বিকেলে তুই কি করবি বলেছিলি।
এই যা ভুলে গেছি, মিলি চল চল চল।
কি করবি? আমি বললাম।
আগে করি, তারপর দিয়ে যাচ্ছি।
আমি যাব ইসিদি—সুরো বললো।
তুই বোস।
না, তুই ভাগ, থাকলেই জালাতন করবি। আমি ওর কোল থেকে মাথা তুললাম।
সুরো চুপ চাপ বসে রইলো।
ওঠ।
না উঠবো না।
দেখছো মাসি দেখছো।
মাসি হাসছে।
আচ্ছা চিকনারা গেল কোথায়?
একটু আগে ফোন করেছিল বললো আসছে। মাসি বললো।
আজ কি সুরোমাসিকে পুরো কলকাতাটা দেখিয়ে দিল?
সুরোদি কখনও আসে নি এই প্রথম কলকাতায় এলো।
রতন ঘরের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলো।
এক হাতে মাম্পি আর এক হাতে মিকি। বগলে ফাইল।
দু-জনের হাতে দুটো ললিপপ। চুষতে চুষতে ভেতরে ঢুকলো।
সুরো রাতে কিছু খেতে দিস না। রতন বললো।
ওরা কি তোমার সঙ্গে গেছিল?
জানতিস না!
না।
দেখছো মাসি, কি সাহস। বলে যাওয়ার পর্যন্ত দরকার মনে করে না। সুরোর চোখ বড়ো বড়ো।
কে কার কথা শোনে। দুজনে মুখ নিচু করে কিচ কিচ করছে। এ বলে তুই দে ও বলে তোরটা দে। রতন ওদের দিকে তাকিয়ে হাসে।
কি খাইয়েছো?
পনির রোল কিনে দিয়েছিলাম। দেব না বলতে ঝুল পেরে কান্না।
পুরোটা খেয়েছে?
না কিছুটা বাকি ছিল আমি খেয়ে নিয়েছি।
আমাদের জন্য নিয়ে আসো নি?
জ্যেঠিমনির কাছে দিয়ে এসেছি।
দুজনে তখনও ঠেলা ঠেলি করছে।
কিরে অনিদাকে দে।
রতনের কথায় দু-জনেই রতনের মুখের দিকে তাকাল।
ওর পকেটে। মাম্পি, মিকিকে দেখাল।
পকেটে নেই। মিকি শুকনো মুখে বললো।
কোথায় ফেললি?
ও খেয়ে নিয়েছে।
গাড়িতে ফেলিসনি?
দুজনেই ছুটলো।
মাসি, সুরো হাসছে।
আয়। তোর সঙ্গে কাজ সারি। এতো দেরি করলি?
দুর এখানে কোথাও কালার জেরক্স নেই। বাধ্য হয়ে গড়িয়াহাটে গেলাম।
ফালতু খরচ করতে গেলি।
জিনিষটা দেখার পর লোভ সামলাতে পারলাম না। তাই কালার জেরক্স করলাম, স্ক্যান করলাম। পেনড্রাইভে তুলে নিলাম।
বাবাঃ এতো কাণ্ড করলি! পেনড্রাইভে তুলে কি করবি?
নিজের মেসিনে ভরে নেব।
কি হবে?
কাজে লাগবে।
সুরো তাহলে আর বসে লাভ নেই। চল আমরা আমাদের কাজ করি।
মাসি হাসতে হাসতে বললো।
মাসি একটু চা পাঠাবে।
আগে কিছু মুখে দাও, তারপর চা পাঠাব। সুরো বললো।
ওরা সবাই বেরিয়ে গেল।
রতন আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
আবিদরা বেরিয়ে গেছে?
ওরা সবাই বেরিয়েছে। ফিরে আসবে। কিছু কেনাকাটা আছে।
আজ থেকে শুরু হয়ে গেল।
রতন হাসছে।
অরিজিন্যালগুলো আমাকে দে। জেরক্সগুলো তোর কাছে রাখ।
ফাইলের ভেতর থেকে একটা বড়ো খাম বার করে নিয়ে, ফাইলটা আমায় ফেরত দিল।
দেখেছিস?
গাড়িতে বসে বসে যতটুকু দেখার দেখেছি।
কি করতে হবে বুঝলি।
ভালোকরে খোঁজ খবর নিতে হবে। এই তো?
হ্যাঁ। তবে বহুদিন আগেকার ব্যাপার। ইসলামভাইও কিছু গণ্ডগোল করে রেখেছে। আমার ডিটেলস চাই। এমন কি সরকারি খাতায় জমির হাল হকিকত কি অবস্থায় আছে সেটাও।
আর তোমাকে বোঝাতে হবে না।
কে করবে কাজটা?
চাঁদের চেনটা এখন অনেক বেশি স্ট্রং হয়েছে।
না ওকে দেওয়া যাবে না।
কেন? রতন হাসছে।
তুই একবার ভেবে দেখার চেষ্টা কর।
আচ্ছা তোমার এতো সোর্স থাকতে তুমি আমাকে দিচ্ছ কেন?
দরকার আছে। ঘাঁটতে গেলে জানতে পারবি।
তুমি বলো কাকে দিয়ে কাজটা করাতে পারি। কমবেশি সকলকে চেনো।
একবারে নতুন লোককে দিয়ে কাজটা করা। এমন লোক আমাদের কেউ তাকে চেনে না। দেখবি ভারি মজার ব্যাপার হবে। তোরই হাসতে হাসতে পেট ফেটে যাবে।
সত্যি!
শুধু তোকে ওয়াচে রাখতে হবে। তোর দিন পনেরো সময় লাগবে।
রতন হাসছে।
যাকে দিবি সে যেন তোর নাম ঘুণাক্ষরেও না জানায়।
ওটা নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না।
আমাদের কেউ জানবে না, এটা নিশ্চই তোকে আলাদা করে বলতে হবে না।
আচ্ছা আমার কি একটুও বুদ্ধি হয় নি?
দূর ব্যাটা, আমি কি সেই কথা বলেছি। যদি তোর কারুর প্রতি দুর্বলতা এসে গিয়ে বেফাঁস বলে ফেলিস, তাই বললাম।
কেন সেরকম কি সম্ভাবনা আছে?
থাকতে পারে।
তুমি বহুত ঘাঘু মাল। মালটা তুমি সব জানো, আমাকে দিয়ে শুধু ভেরিফাই করাচ্ছ।
নারে, বিশ্বাস কর। কুড়ি বছর আগে ব্যাপারটা নিয়ে ভাববো ভেবেছিলাম। হয় নি। তাই এখন একটু ভাবনা-চিন্তা করতে শুরু করেছি।
রতন হাসছে।
তুই একবার দেখে নিয়ে বলতে পারবি জমিগুলো কোথায় কোথায় হতে পারে।
দুটো বারাসাতের আশে পাশে। একটা গড়িয়াতে। আর একটা আলিপুরে।
আমারও তাই মনে হচ্ছিল।
সব জায়গাতেই আমার লোক আছে।
বলেছি না ওই সব লোক নয়, একবারে নয়া মাল।
মিলিরা হাসতে হাসতে খাবার নিয়ে ঢুকলো। পেছনে দেখি হুড়মুড় করে সবাই চলে এলো।
ইসলামভাই ঢুকেই চোখ বড়ো বড়ো করে বললো। শুয়ে আছিস কেন?
তোমরা সব ঝামেলা করবে। শুয়ে থাকবো নাতো কি করবো।
ওঠ।
আমি উঠে বসলাম।
অদিতি, টিনা আমার কাছে এসে বসলো।
দুজনেই হাসছে।
সব ঠিক আছে। টিনা আমার দিকে বাঁকা চোখে তাকালো।
আপাততঃ আছে। জানিনা কখন আবার বিগড়ে যায়। তোমরা ঠিক আছো?
না ঠিক থাকার কি হলো!
শুনলাম কাপর চোপর নাকি নষ্ট করে ফেলেছো?
কে বলেছে! টিনা বড়ো বড়ো চোখ করে মিলির দিকে তাকাল।
সুরোর আমাশা হয়েছে।
টিনা হাসছে।
তুমি ঠেসান দিয়ে ভালো করে বসো, আমি একটু তোমার কোলে শুয়ে পরি।
টিনা আমার কথা মতো খাটে হেলান দিল।
নেপলা হাসছে।
তুই হাসছিস কেন?
তুমি আজ সারাটা দিন বাড়িতে থেকে গেলে। ভাবলেই কেমন যেন লাগছে।
তোকে নিয়ে যেতে বলেছিলাম, নিয়ে গেছিস?
আবিদদা ধরলো। কি করবো বলো।
আবিদ কোথায়?
বৌদিকে নিয়ে বেরবে, কিছু কেনা কাটা আছে।
রতন যে বললো তোরা কি সব কিনতে গেছিস।
দাদাভাই, ইকবালভাই কিনেছে।
আবিদের বৌ এসেছিল?
হ্যাঁ বাড়ি থেকে তুলে নিলাম।
বাবাঃ অনেক কাজ করেছো দেখছি। ইসলামভাইয়ের দিকে তাকালাম।
একটু একটু করে সেরে রাখি।
কথার মাঝেই খাওয়া দাওয়া হলো, আমি টিনার কোলে শুয়ে পরলাম।
তোর শরীর খারাপ লাগছে? ইসলামভাই বললো।
না। কেমন যেন আলিস্যি লাগছে। শুধু শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে।
সুবীর আমার দিকে তাকিয়ে।
কি সুবীরবাবু, বৌকে বাদাম খাওয়ালে।
সবাইকে ছেড়ে দিয়ে এবার আমাকে ধরেছো না। নীপা চেঁচিয়ে উঠলো।
যা বাবা বৌকে বাদাম খাওয়াবে তাতে অপরাধ কোথায়?
তোমাকে সবার সামনে চেঁচিয়ে বলতে হবে না।
চিকনা, নীপাকে চিড়িয়াখানায় শুকুন দেখিয়েছিস?
সবাই জোড়ে জোড়ে হাসতে শুরু করলো। নীপার মুখ লাল হয়ে গেছে।
সুরো হাসতে হাসতেই বললো, তুই তখন বলতেই পারতিস সুবীরদা বাদাম খাইয়েছে।
বললেও এই কথা বলতো, না বললেও এই কথা বলতো।
টিনা আমার মাথায় হাত রেখে বললো। সত্যি অনিদা তোমার মাথায় এই সব আসেও বটে।
এটা দারুর ডায়লগ। চিকনা চেঁচিয়ে উঠলো।
ঠিক বলেছিস, প্রথমবার ফিরে এসে রাতে গল্প বলছিল।
ইসলামভাইয়ের কথায় চিকনা মাথা দোলাচ্ছে।
গেটের মুখে দেখলাম দুই বুড়ী হাজির।
এতো হাসি কিসের রে। জ্যেঠিমনি বললো।
অনিদার ডায়লগে। মিলি চেঁচিয়ে উঠলো।
পেছনেই দেখলাম নীরু এসে দাঁড়িয়েছে। আমাকে এই অবস্থায় দেখে দরজার মুখ থেকেই চেঁচিয়ে উঠলো।
কনিরে, বটা ফিনিশ।
ভেতরে ঢুকে এসে মোবাইল তাক করলো।
তুই ওইভাবে থাকবি, আমি একখান ছবি নেব।
কনিষ্ক, বটা দুজনে এসে দাঁড়িয়েছে। দু-জনেই হাসছে।
এতো সাবিত্রী, সত্যবান কেশ। কনিষ্ক বললো।
দু-জনেই হাসছে।
জ্যেঠিমনি খুব জোড় খিদে লেগেছে। বটা চেঁচালো।
দু-জনে ভেতরে ঢুকলো।
নীরু কিছু বলার জন্য উসখুশ করছে। তার আগেই কনিষ্ক বললো।
নীরু।
বল।
আমার বটার গাইপ হয়ে গেল বাকি থাকলো তোরটা। দেখ এর মধ্যে গাইপ হয়ে গেছে কিনা। তুই হয়তো জানিসই না।
কেন চুলকে ঘা না করলে চলছে না।
ফাইলটা ওপেন করলি তুই আমি শেষ করি। বটা বললো।
তোমায় আর এই উপকার করতে হবে না। টিনা বললো।
একবার শ্রীপর্ণাকে ফোন করে আপডেট নিই। কনিষ্ক বললো।
কেন একটু সুখে আছি সহ্য হচ্ছে না।
ওদের তরজায় হাসতে হাসতে এ ওর ঘারে ঢলে পরে।
তিনজনেই আমাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে আমার গা ঘেঁষে বসলো
নীরু আমার হাতটা নিয়ে কব্জিটা টিপে ধরলো।
সারাদিন কোনও অসুবিধে হয়নি?
তোরা গেলি সেই যে এসে এ ঘরে ঢুকেছি। বাগানে পর্যন্ত যাই নি। শুয়েই আছি।
কেন!
কি করবো?
একটু হাঁটা চলা করতে পারতিস।
শুয়ে শুয়েই এদের সঙ্গে গল্প করছিলাম।
কনিষ্ক মিলির দিকে তাকাল।
যাও কিছু নিয়ে এসো। মেয়ে কোথায়?
ভজুদার কাছে।
সারাদিন আঙ্কেল বাড়িতে, জ্বালায় নি।
ঘণ্টা খানেক ছিল। তারপর রতনদার সঙ্গে বিকেলে বেরিয়েছিল। ঝুলপেরে দু-জনে কান্নকাটি করে, রতনদার কাছ থেকে পনিরের রোল খেয়ে এসেছে।
রতন হাসছে। না-গো কনিষ্কদা।
মিলি এক্সট্রা হবে। নীরু বললো।
কি!
কি সব পনির-টনির শুনলাম।
বাপরে বাপ। নীপা, যা-তো নিয়ে আয়।
নীরু, ইসি কিসব স্পেশাল বানাবে বলছে। আমি বললাম।
আমি করছি না। সুরোমাসি লেগে পরেছে। ইসি বললো।
তাহলে আগে ছোটো দিয়ে শুরু করি, তারপর বড়ো করে শেষ করবো।
কাল সকালে উঠতে পারবি?
নীরু খিক খিক করে হাসছে।
দামিনীমাসির তারস্বর চিৎকারে ইসিরা উঠে গিয়ে ওঘর থেকে খাবার নিয়ে এলো।
খাবার খাওয়া হলো। অনেকক্ষণ ওদের সঙ্গে গল্প করলাম। রাতের খাওয়া সেরে নিজের ঘরে শুতে এলাম। ভজুরাম আমার ঘরে। চিকনা, ইসলামভাইয়ের সঙ্গে শুল। যথারীতি ভজুরাম তেল গরম করে নিয়ে এসেছে। ঝাঁজিয়ে উঠলাম।
তোর এক ঢপের কাজ হয়েছে পায়ে তেল মাখান।
আমাকে বলছো কেনো মাকে বলতে পারছো না।
চুপ করে গেলাম।
বিছানায় শুয়ে পরলাম।
ভজু তার কাজ শুরু করে দিল।
তেলটা ভজু খারাপ মাখায় না। শরীরটা বেশ গরম হয়ে যায়। চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছি। ভজু একবার নিজের কোলের ওপর আমার পা তোলে আবার বিছানায় রেখে জোড়ে ঘষে।
অনিদা।
চুপ করে রইলাম।
ঘুমিয়ে পরেছো।
না।
আজ সকালে আমি আর নেপলা ওপাড়ায় গেছিলাম।
কেনো?
মা বললো, ঘরটা একটু পরিষ্কার করে আয়, অনেকদিন যাওয়া হয় নি।
চুপ করে রইলাম।
জানো নেপলা কাঁদছিল।
কেনো!
সকাল বেলা যখন গাড়ি করে যাচ্ছি তখন বললো, ভজুদা তুই কতদিন দাদার সঙ্গে আছিস? তা আমি বললাম, অনিদা যেদিন আমাদের বাড়িতে এলো সেদিন থেকে।
দাদার ঘরটা এখন আছে?
হ্যাঁ। ছাদের ওপর। এখন আর একজনকে মা থাকতে দিয়েছে।
ওই ঘরে যাওয়া যাবে?
বললাম, হ্যাঁ যাবে।
আমাকে নিয়ে যাবি?
চলো তামাকে নিয়ে যাব।
বাড়িতে যেতে সবিতা বললো, ভজুদা মাসি কবে আসবে রে?
কে সবিতা!
তুমি চিনবে না।
নতুন।
হ্যাঁ এখন লক্ষ্মীর ঘরে থাকে। বহুত দেমাক।
তাই।
নেপলাদাকে দেখে তো ওরা ভেবেছে খদ্দের।
আমি বললাম একবারে কাছে আসিস না। অনিদার ভাই। ধরলে মেরে ফেলবে।
আমাকে ওরা চেনে?
মা গল্প করেছে। তোমাকে দেখে নি। এখন কবিতাদি সব দেখাশুন করে। মা তোমার হাসপাতাল নিয়ে পরে থাকে। তোমার হাসপাতালটা দারুন সুন্দর। মা ওখানে একটা স্কুল করেছে জানো। তখন তুমি যদি করতে একটু লেখাপড়া শিখতে পারতাম।
এখন বুঁচকির কাছে শিখতে পারিস।
লজ্জা করে। দাও ওই পা টা দাও।
এগিয়ে দিলাম।
ঘর পরিষ্কার করলি?
করলাম। নেপলা বললো। ভজুদা তুই মেরিনাদিকে দেখেছিস। বললাম, দেখেছি।
আমাকে একটু মেরিনাদি যে ঘরে থাকতো নিয়ে যাবি।
ও ঘরে এখন সবিতা থাকে।
একবার বল না যদি একটু ঢুকতে দেয়।
তোমার বিছানা বালিশ মা সব একটা প্লাস্টিকে মুড়ে রেখে দিয়েছে জানো। তোমার সেই ভাঙাবাক্সটা মা এখনও যত্ন করে একটা বাক্সের ঢাকা কিনে রেখে দিয়েছে। সব দেখলো। তারপর সবিতাকে বলে ওর ঘরে নিয়ে গেলাম।
চারদিক চেয়ে চেয়ে দেখল।
তারপর বললো, চল ছাদের ওপর দাদার ঘরটা দেখি।
নিয়ে গালাম। তোমার ঘরটা দেখ কেঁদে ফেললো।
বললো দাদা এই ঘরটায় থাকতো!
বললাম হ্যাঁ। আমিও অনিদার সঙ্গে থাকতাম। দাদা এই জায়গায় শুতো আমি এইখানে শুতাম। ওকে জায়গাটা দেখালাম।
জানো মা না ওটাকে আর ঠিক করে নি। যেমন ছিল তেমন রেখে দিয়েছে। শুধু চালের টিনটা ফুটো হয়েগেছিল, ওটা সারিয়েছে।
আমি ভজুর দিকে তাকিয়ে আছি।
মাকে বলেছি, ওটাকে এবার একটু ঠিক করো না।
বলে কি, তোর অনিদা এসে আর থাকবে না। থাকলে ওটা মোজাইক করতাম। ওটা যেমন আছে তেমন থাক।
এখন কে থাকে?
এমনি বন্ধ থাকে। আমি যদি কখনও গিয়ে রাতে থাকি, শুই। আর ওই বাড়িতে যে ছেলেটা কাজ করে সে শোয়।
নেপলা বার বার শুধু তোমার কথা জিজ্ঞাসা করছিল।
কি জিজ্ঞাসা করছিল?
তুমি কোথায় বসে পড়তে। কোথায় চান করতে। কবিতাদিকে কেন মেরেছিলে। মেরিনাদি তোমার কাছে এলে কোথায় বসতো।
তুই বললি।
সব বলিনি একটু একটু বলেছি। তোমার কথা বললেই চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।
কবিতার সঙ্গে দেখা হয় নি?
কবিতা তখন হাসপাতালে ছিল।
কি করছিল ওখানে?
মা না থাকলে ও সকলের দেখাশুনো করে। সপ্তাহে একদিন করে সকলকে চেক করায়। ওষুধপত্র দেয়।
বাবা, তাহলে অনেক কাজ বল।
তুমি জানো না?
আমি জানতাম ডাক্তাররা এসব করে।
ডাক্তাররাই করে, কবিতাদি সবার খোঁজ খবর নেয়। এখন আর সেরকম খারাপ খারাপ রোগ হয় না। তুমি তখন এসবের জন্য কতো করেছো।
আমি ভজুর মুখের দিকে তাকিয়ে।
তারপর নেপলা কি বলে জানো?
কি!
ভজুদা, তুই অনিদা যে হোটেলে কাজ করতিস সেটা এখনও আছে।
কেন থাকবে না। এখন একটু বড়ো হয়েছে। বেশ সাজিয়েছে। কেবিন করেছে।
তাই! কৃষ্ণদা এখন কেবিন বানিয়েছে?
আগে সকাল বিকেল খাওয়া হতো, এখন সব সময় খোলা। ভালো ভিড় হয়।
ওই কাপরের হাটটা বসে?
বসে। এখন কৃষ্ণদা দোকানে বসে না। ওর ছেলে বাপি বসে।
তুই যাস?
বাড়িতে যখন যাই তখন একবার ঢুঁ মেরে আসি। এককাপ চা বানিয়ে খেয়ে আসি।
আমি হাসছি।
জানো আমি গেলেই কৃষ্ণদা তোমার নাম করে। তোমায় খুব ভালোবাসে। বলে কি, বুঝলি ভজু, অনির মতো ছেলে লাখে একটা নয়, কটিতে একটা পাওয়া যায়। ও হচ্ছে আসলি হীরে।
তোকে বাড়িয়ে বলেছে।
একটুও না। তোমার সমস্ত খোঁজ খবর রাখে। তুমি যখন নার্সিংহোমে ভর্তি ছিলে, বৌদিকে নিয়ে এসেছিল। ঢুকতে দেয় নি। মার সঙ্গে কথা বলে দিদিমনির সঙ্গে দেখা করে ফিরে এসেছে।
কৃষ্ণদার ছেলের নামটা যেন কি?
বাপি।
বাপি যেদিন জন্মালো সেদিন আমরা সবাই ফোঁকটে মাংস ভাত খেয়েছিলাম, তাই না?
আমি গেলেই বাপিকে বলি। জানিস সেদিন অনিদা মাংস রান্না করেছিল। যা বানিয়েছিল না।
বলে কি তোমরা খেয়েছো আমাকে তো আর খাওয়াও নি। গল্প করে কি হবে।
বাপি তোকে চেনে?
যা বাবা, চিনবে না—তুমি যাও না তো কি হয়েছে। আমি এখনও যাই।
দাঁড়া দেখি এর মধ্যে একবার যাবো। কৃষ্ণদাকে অনেক দিন দেখি নি।
আমি যাবো তোমার সঙ্গে।
তোকে না নিয়ে গেলে আমাকে কেউ চিনবে না।
খুব চিনবে।
কখন বাড়ি ফিরলি?
ফিরলাম কোথায়? ওখান থেকে গেলাম কৃষ্ণদার হোটেলে।
বাপি ছিল?
হ্যাঁ। ওইরকম একটা ঢাউস মার্কা গাড়ি থেকে আমি নামছি দেখে বাপি প্রথমটা একটু ভিমরি খেয়ে গেছিল। ঢুকেই বললাম বাপি অনিদার খাস লোক নেপলা। দুটো চা বল।
বাপি কিছুক্ষণ নেপলার দিকে তাকাল।
তারপর বলে কি বাবাকে ডাকি।
তখন নেপলা বললো, সেই ভাল, আমি ওনার সঙ্গে একটু কথা বলবো।
নেপলাকে বললাম, কেবিনে বসবি না বাইরের টেবিলে বসবি।
বলে আমি এখানেই বসছি।
ব্যাটা বাপি দুটো করে কাটলেট দিলো।
নিজে এনে দিলো?
তাহলে কি, নেপলা তোমার খাস লোক না। তারপর অতোবড়ো গাড়ি নিয়ে গেছে।
আমি হাসছি।
তবে তোমার মতো বানাতে পারে নি।
বাপি চা খাওয়ালো?
অনেকক্ষণ পর কৃষ্ণদা এলো। নেপলাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব জিজ্ঞাসা করলো। যেই শুনেছে নেপলা দুবাইতে থাকে ওখানে ব্যবসা আছে। সে কি তেল গো নেপলাকে। নেপলা সব শুনেটুনে বললো, আমাকে একটু আপনার রান্নাঘরে নিয়ে যাবেন, যেখানে অনিদা রান্না করতো। কৃষ্ণদা অবাক। তারপর অবশ্য নিয়ে গেল। এখন অনেক পরিষ্কার, তখন এরকম ছিল না।
নেপলাকে সব বললাম।
নেপলা শুধু চারদিক দেখে যায়।
তারপর বাইরে এসে কৃষ্ণদাকে বলে, আপনি এই হোটেলটা কতদামে বেচতে চান।
কৃষ্ণদা নেপলার কথা শুনে অবাক।
কেনো?
আমি কিনবো।
কৃষ্ণদা বলে, আমি খাব কি?
নেপলা বলে আপনিই চালাবেন। যেদিন পারবেন না সেদিন আমাকে বলবেন, আমি চালাবো। এটাকে আমি আরও সুন্দর করতে চাই।
তারপর কৃষ্ণদা নেপলাকে কেবিনে নিয়ে গেল। অনেকক্ষণ কথা বললো। তারপর চলে এলাম।
আসার সময় একটা কথাও আমার সঙ্গে বলে নি। শুধু রুমাল দিয়ে চোখ মোছে।
বাড়িতে এসে গাড়ি থেকে নেমে বললো—অনিদা আমাদের থেকেও অনেক কষ্ট করেছে তাই না-রে ভজুদা?
আমি কিছু বলি নি। বলো ঠিক করিনি?
আমি ভজুর দিকে তাকিয়ে আছি।
আমাকে নিতে গেছিল যে।
ওই তো ফিরে এসে গেল। যাবে না বলছিল। ইসলামদা বললো চলে আয়।
যা এবার শুয়ে পর।
তোমার মাথাটা একটু টিপে দিই।
দে।
ভজু মাথায় হাত রাখলো। ঘুমে চোখ জুড়িয়ে এলো।
দামিনীমাসির ডাকে ঘুম ভাঙলো। কিরে ওঠ, ওরা এয়ারপোর্টে চলে এসেছে।
আমি ধড়ফড় করে উঠে বসলাম।
আবার তারাহুরা করে।
না মাসি, আমি ঠিক আছি।
মিত্রা বললো, ওকে ঠেলে তোলো।
হাসলাম। কখন ফোন করেছিল?
এই তো এখুনি। তাই তোকে ডাকতে এলাম।
ওদের কে আনতে গেছে?
সবাই।
বাড়িতে তুমি আর আমি?
না দিদি আছে।
তাহলে রেডি হয়ে নিই কি বলো।
মাসি হাসছে।
খাট থেকে নেমে ব্রাসে মাজন লাগিয়ে বাথরুমে চলে গেলাম।
কাল রাতে ফিরতে বেশ দেরি হলো। স্যারের শ্রাদ্ধের কাজ শেষ হতেই বেশ দেরি হলো তারপর নিজের বাড়ি। বেরতে বেরতে দেরি হয়ে গেল। সবার এতো চাহিদা মেটাতে গিয়ে সমস্যায় পড়ে যাই। গ্রামের মানুষের প্রচুর অভিমান। পান থেকে চুন খসলেই দশ কথা শুনতে হয়। তাই যতটা সম্ভব চেষ্টা করি সমস্যার সমাধান করতে। না হলে বলবে ‘ছেলে পাইরা উঠেছে’।
দুপুরের দিকে মেয়ে ফোন করেছিল। তখন ওরা দিল্লীতে। রাঘবন সব ব্যবস্থা করেছে। মেয়ের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বললাম। ওরা রাঘবনের বাড়ি গেছে। খুব জোড় খাওয়া দাওয়া হচ্ছে। আমাকে নিয়েও জোর আলোচনা চলছে।
মিত্রার সঙ্গেও কথা হলো।
ওর কথাবর্তায় মনে হলো গর্বে বুক ভরে যাচ্ছে। বললো, জানিস বুবুন দিল্লীতে বেশ ঠাণ্ডা, তবে আমাদের শীত কম লাগছে। যে ঠাণ্ডায় কাটিয়ে এলাম তার থেকে যথেষ্ট কম। কাল সকালের ফ্লাইটেই আসবো। আজ ওরা বিকেলের দিকে কনওয়ার্ড প্লেসে ঘুরতে যাবে কিছু কেনা কাটা করবে।
রাঘবনের সঙ্গে কথা হলো। বললো, দাদাকে সেবার যা দেখে এসেছিলাম। তার থেকে আশিভাগ এখন ভালো হয়ে গেছে।
ভীষণ ভালো লাগলো।
তোর ওখানে পাঠানো সার্থক।
রাঘবন দাদারা যেতে ভীষণ খুশি। সবচেয়ে খুশি হয়েছে, ডাক্তারদাদা গেছে। রাঘবন ওর মার সঙ্গে ডাক্তারদাদার পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।
ঋজু, ঋজুর বৌকে একবারে অন্যভাবে দেখলাম। এই কয়দিনে যে এত পরিবর্তন হতে পারে ভাবিনি। বিশেষ করে কাকীমা যখন জড়িয়ে ধরে কেঁদে বললো।
তোর জন্য আমার ছেলেটাকে ফিরে পেলাম।
বেশ ভালোলাগছিল। যাক একটা ভালোকাজ অন্ততঃ জীবনে করতে পেরেছি। আমার নিজের কিছু চাই না। এই কথা শুনে স্যারের আত্মা নিশ্চই শান্তি পেয়েছে।
ঋজুর সেই শালি-জামাইবাবু আসে নি। তবে ওর শ্বশুর বাড়ির লোক জন সব এসেছিল। সবার সঙ্গে আলাপ হলো। বলতে পারি নতুন ভাবে আলাপ। সবার এক কথা তোমাকে সেই কবে ছোটো সময়ে দেখেছি।
ভানু মন খারাপ করলো। মীরচাচা দুধ দিয়েছে, আমার ঘরে কি ছিল না। আমি কি দিতে পারতাম না। ওর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বোঝালাম। ঠিক আছে আজ যাওয়ার সময় দিয়ে দে, নিয়ে যাব। এই কথা বলার পর ভানুর অভিমান ভাঙলো।
শ্যাম, শিবু, দারু তিনজনেই এসেছিল। চিকনা নিয়ে গেল সেই গোপন ডেরায়। আমার সঙ্গে কনিষ্ক নীরুরাও গেল। অনেকদিন পর তিনজনকে একসঙ্গে দেখে ভীষণ ভালোলাগছিল।
প্রথমে তিনজন আমার সঙ্গে বেদম ঝগড়া করলো। আমি চুপ করে ওদের কথা শুনেগেলাম। ওদের অনেক অভিমান। সব অভিমানের সমাধান আমর পক্ষে করা সম্ভব নয়।
শ্যামের ছেলে ছুড়কি শুধু হেসে যায়।
শেষে কনিষ্ক বললো, ওর সঙ্গে ঝগড়া করবি, না কাজের কথা বলবি। শেষে কনিষ্ককেই ওরা সাক্ষী মানলো। নীরু ওদের রকম সকম দেখে হেসে গড়িয়ে পরে।
ঘণ্টা খানেকের ওপর ওদের সঙ্গে কাটালাম। শেষে ওদের রাজি করাতে পারলাম মূল শ্রোতে ফিরে আসার জন্য। তবে ওদের কিছু শর্ত আছে সেগুলো আমাকে মানতে হবে। আমাকে মানে প্রবীরদাদের মানতে হবে।
বাড়িতে গিয়ে বেশিক্ষণ থাকতে পারিনি। কাকীমার সঙ্গে যেটুকু কথা বলতে পেরেছি। তার অর্ধেক সময় কাকীমা কেঁদে ভাসিয়ে দিয়েছে।
মীরচাচাদের বলে এসেছি, আমি কতটা কী করতে পারি না পারি জানি না। তোমরা বুঝে শুনে সব সামলে দাও। যতটা পারো ধৈর্য ধরে সহনশীলতার পরিচয় দাও। দেখবে কাজ হবে। হয়তো একটু সময় লাগবে, তবে হবে।
বাড়িতে ফিরে দেখলাম মাম্পি, মিকি দুজনেই ঘুমিয়ে পরেছে।
খেতে ইচ্ছে করছিল না। তবু খেতে হলো। আজ দেখলাম ভানুও দু-জার দুধ পাঠিয়েছে। প্রায় কুড়ি লিটার। খেতের সব্জি তুলে গাড়ির পেছন ভর্তি করে দিয়েছে।
আসার সঙ্গে সঙ্গে ভজু সেগুলো নামালো। মাসি, জ্যেঠিমনি মহাখুশী।
অনেক কষ্টে দু-জনকে বুঝিয়ে শুনিয়ে আমি এক গ্লাস দুধ খেলাম। আর কিছু খেতে ইচ্ছে করলো না। কনিষ্ক ওষুধ গেলালো।
কিরে কতোক্ষণ বাথরুম করতে লাগে—ঘুমিয়ে পরলি নাকি—ওরা এখন বাইপাসে—বড়দি ফোন করলো, তুই উঠেছিস কিনা—
মাসি দরজা ঢক ঢক করছে।
তারাতারি বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলাম।
বাবা তোমরা সব যেন ঘোড়ায় জিন দিয়ে রয়েছো।
খাটে পাজামা, পাঞ্জাবী রেখেছি।
তুমি সব রেডি করে ফেলেছো দেখছি।
অনেকে আসছে।
তার মানে!
তনু আসছে, সুন্দর আসছে, রাঘবনের মেয়ে-জামাই-নাতি আসছে। অনুপ আসছে।
তাই নাকি! খেয়েছে। রাঘবন ঝামেলা বাড়িয়ে দিল।
তোকে ও সব ভাবতে হবে না। ওটা অনিমেষদার দায়িত্ব।
বাবা তুমি মনে হচ্ছে আরও অনেক কিছু জেনে ফেলেছো।
মাসি হাসছে।
এতো লোকজন সামলাতে পারবে? কবিতাকে ডাকতে পারতে।
আসতে বলেছি, ওদিককার কাজ সেরে আসবে।
আজ বাড়িতে বড়ো ভোজ, কি বলো?
ছোটো আর দিদি এসে রান্না করবে বলেছে।
তারমানে ফুল এনার্জি নিয়ে আসছে।
মাসি আমাকে হাসতে হাসতে জড়িয়ে ধরলো।
দাঁড়া দিদি আসুক।
কুটকুট করে লাগিও অনি এই করেছে, অনি তাই করেছে।
মাসি আমাকে ছেড়ে চলে গেলো। আমি রেডি হয়ে এই ঘরে এলাম। ভজু ব্যাটা পর্যন্ত গেছে।
গেটে দেখলাম ছগনলাল বসে খৈনি টিপছে।
জ্যেঠিমনি রান্নাঘরে ছুঁকছাঁক করছে। মাসি বড়োমার ঘরে।
আমি সোফাতে এসে বসলাম।
জ্যেঠিমনি বেরিয়ে এলো।
চা খাবি?
এখন দেবে না ওরা এলে একসঙ্গে খাব।
একটু খা। তারপর ওরা এলে আবার খাবি।
তাহলে দাও।
আজ ছয় মাস ওদের সঙ্গে দেখা হয় নি। প্রায় কুড়িটা বছর এখানে ছিলাম না। তখন এরকম নিজেকে শূন্য শূন্য মনে হয় নি। আজ হঠাৎ কেন এরকম মনে হচ্ছে।
নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে কোনও উত্তর পাই না।
মিত্রা এসেই হয়তো বলবে, বেশ আছিস। বৌ-ছেলে-মেয়েকে পাঠিয়ে দিয়ে দিব্যি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেরাচ্ছিস। বিন্দাস বাদশা।
সারাটা জীবনই তো আমার ওপর দিয়ে চালিয়ে গেলি, আর কতদিন এইভাবে চালাবি।
আমি ওর কথা শুনে হাসছি।
মাথায় রাখবি তনুর কাছ থেকে সব খবর নিয়েছি। এবার শাঁড়াসি আক্রমণ।
জ্যেঠিমনি চা নিয়ে এলো।
সকালবেলা কোনও ওষুধ নেই জ্যেঠিমনি?
কনিষ্ক কিছু বলে যায় নি। দাঁড়া দামিনীকে জিজ্ঞাসা করি।
জ্যেঠিমনি দামিনীমাসির কাছে গেল। ফিরে এসে বললো, না সকালে কোনও ওষুধ নেই।
সবেমাত্র চায়ে চুমুক দিয়েছি। গেটে তারস্বরে হর্ণ বেজে উঠলো।
দামিনমাসি ছুটে বড়োমার ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। জ্যেঠিমনিও বাইরের বারান্দায় চলে গেল। আমি চা ডিসে ঢেলে ফুঁ দিয়ে কোনও প্রকারে খেয়ে নিয়ে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম।
একটা একটা গাড়ি ভেতরে ঢুকে আসছে।
একবারে প্রথম গাড়িটাই ইসলামভাই নিয়ে ঢুকলো।
গাড়ি থেকে বড়োমা, ছোটোমা, দাদা, মল্লিকদা, ডাক্তারদা, অনিমেষদা, বৌদি সব এক একে নামলো।
আমার চোখ প্রথমেই দাদার দিকে চলে গেল। আমি অবাক হয়ে দাদাকে দেখছিলাম।
দাদা কারুর সাহায্য ছাড়াই একা একা গাড়ি থেকে নেমে এলো। পরিধানে সেই পোষাক ধুতি আর পাঞ্জাবী। চোখের চশমাটা মনে হয় চেঞ্জ করেছে। আগের থেকে অনেক বেশি গাম্ভীর্যপূর্ণ লাগছে। সেই শুকনো শুকনো ভাবটা আর নেই। অনেক বেশি তরতাজা।
গাড়ি থেকে নেমেই আমার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো।
যাওয়ার সময় দাদার একহাতে লাঠি। আমি নিজে ধরে ধরে গাড়িতে তুলে দিয়েছি। আজ দাদা নিজে গাড়ি থেকে একলা নামলো। কারুর সাহায্য নিল না। আমি পায়ে পায়ে বাগানে নেমে এলাম। গাড়ির সামনে গিয়ে আবেগে দাদাকে জড়িয়ে ধরলাম।
চলবে —————————
from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/nIdpcyk
via BanglaChoti
Comments
Post a Comment