কাজলদিঘী (২০৩ নং কিস্তি)

❝কাজলদীঘি❞

BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

২০৩ নং কিস্তি
—————————–

বিনয়দা, তিন্নী, তিতাস এই সব দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে।

আমার দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বললো।

তোরা গাড়ি নিয়ে এসেছিস?

বুঝতে পারলাম কথা বলতে গিয়ে গলাটা ধরে এসেছে। ভেতর ভেতর ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে।

মাথাটা আস্তে করে দুলিয়ে বললাম। হ্যাঁ।

আমাকে একটু ওর কাছে নিয়ে চল।

তুমি গেলে যদি গণ্ডগোল করে। কনিষ্ক বললো।

কিচ্ছু করবে না। আমি ওকে ভাল করে চিনি।

আমরা তিনজনেই মাসির মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি।

চল না, আমি বলছি, কিচ্ছু হবে না। তোরা বৃথা ভয় পাচ্ছিস।

অবশ্যাই তোমাকে নিয়ে যাব মাসি। আগে বলো এখন তোমার শরীর কেমন বোধ করছো। কনিষ্ক বললো।

ভালো।

এই মুহূর্তে তোমার কিছু হলে আমাদের সকলকে জ্যান্ত পুঁতে দেবে। তখন ওর কাছে বউ-বন্ধু আত্মীয়-স্বজন বলে কিছু নেই।

কনিষ্ক মাসির হাত ধরে প্রায় কেঁদে ফেলে।

আমি ঠিক আছি, তুই বিশ্বাস কর।

তোমায় ঠিক থাকতে হবে। তুমি এখন আমাদের লড়াই করার শক্তি।

কনিষ্কর চোখ জলে ভড়ে গেল।

ও জীবনে কারুর কাছে কোনওদিন মুখ ফুটে কিছু চায়নি। কালকে ওর চোখে মুখে তোমাকে চাওয়ার আর্তি ফুটে উঠেছে।

কনিষ্কর গলা বুঁজে এলো। আস্তে করে ধরা গলায় বললো।

তাই ম্যাডামরা আজ এই সাত সকালে তোমার কাছে ছুটে এসেছে।

এ্যালবাম তখন মাসির হাত থেকে বিনয়দার হাতে চলে গেছে।

মাসি কনিষ্কর কাপালে হাত ছোঁয়াল।

তুমি শুধুমাত্র একবার লড়াই করার সুযোগ দাও।

মাসির চোখ ছল ছল করে উঠলো।

মাসি কোনও কথা বলছে না।

কথা দিচ্ছি আমরা বন্ধুরা কেউ সহজে হার স্বীকার করবো না। আজকে আমরা যে যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সবার পেছনে ওর অবদান রয়েছে। এইটুকু ওকে ফিরিয়ে দেওয়ার সুযোগ তুমি আমাদের দাও।

মাসি কান্না ভেঁজা চোখে হেসে ফেললো। তোরা ওকে ভীষণ ভালোবাসিস।

না মাসীমনি ঠিক তা নয়, তার ওপরে যদি কিছু থাকে তাহলে তাই।

কনিষ্ক কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো।

তুমি অনুমতি দিলে সকলকে জানাব।

কেউ জানে না?

না।

তোরা জানলি কি করে?

আমি রাত তিনটের সময় জেনেছি। ম্যাডাম ফোন করে জানিয়েছে।

মাসীমনি আমার মুখের দিকে তাকাল।

তুই জানলি কি করে?

কাল এখান থেকে ফিরে গিয়ে ওকে খুব আপসেট দেখলাম।

কি করে বুঝলি?

আমাদের এখানে ছেড়ে ও আগে আগে চলে গেছে। আমরা যে পথে এখান থেকে রিক্সায় গেছি সেই পথে যায়নি। আমরা পৌঁছবার বেশ কিছুক্ষণ পড় ও যায়। তখনই ওর চোখ মুখটা ঠিক ভাল লাগেনি।

নিজের খুব কাছের মানুষ না হলে ওর চোখে মুখের পরিস্থিতি এরকম হয় না।

গাড়িতে বৌদি যখন চেপে ধরলো। শুধু বললো আমার মাসীমনি, এর বেশ কিছু নয়।

তনু বার বার খোঁচাল, মিত্রাদি এই সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। নিশ্চই মাসীমনি ওর জীবনে গুরুত্বপূর্ণ কোনও ব্যক্তিত্ব, তাই ও এতটা আপসেট। আমরা এতদিন ঘুণাক্ষরেও এই ব্যাপারটা জানিনি। আজ যে ভাবেই হোক জানতে হবে।

সারাক্ষণ ওর পেছন পছন ঘুর ঘুর করলাম। কারুর সঙ্গে ঠিক মতো ভল করে কথা বলছে না। সুযোগ খুঁজছিলাম কখন ওকে একা পাবো। পেয়েও গেলাম। ও বললো একটু বেরবে। আমি তনু ওর পেছন ধরলাম।

গাড়িতে বসে আমি তনু, নরমে গরমে ওকে বেশ কথা শোনালাম।

দেখলাম ও রেসপন্স করছে। অন্য সময় হলে ও পাত্তাই দিত না আমাদের। রাতে আমি তনু চেপে ধরলাম। তখন ও সব স্বীকার করলো।

মাসি হেসেফেললো। তনু তোর সূত্রধর।

আমি হেসে ফেললাম।

আগে কখনও শুনিসনি।

তুমি বিশ্বাস করো। এই এ্যালবামটা ছাড়া আর কিছু দেখিনি।

মাসি আমার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে।

আমাকে যেদিন পীরসাহেবের থানে নিজের স্ত্রী হিসাবে স্বীকৃতি দিল, সেদিন মায়ের গলার একটা চেন আমাকে দিয়েছিল। ফিরে এসে আলমাড়ি থেকে মায়ের সিঁদুর কৌটটা দিয়েছিল।

মা, অনি মাসীমনির ছেলে! বিনয়দা চেঁচিয়ে উঠলো।

মাসীমনি বিনয়দার দিকে তাকিয়েছে।

মুখটা দেখে বুঝতে পারছি ভেতর ভেতর ভীষণ ষন্ত্রণা পাচ্ছে, হেসে মাথা দোলাল।

আস্তে করে বললো, ও ঝুমুর ছেলে।

এতবড়ো সত্যিটা ও এত বছর চেপে ছিল!

মাসীমনি কোনও কথা বললো না। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরলো।

তুমি অনুমতি দিলে সকলকে জানাই। কনিষ্ক বললো।

ওর কাছে কে আছে?

আমাদের বন্ধুরা।

ঘুম থেকে উঠে ওদের যদি দেখতে না পায়।

ও ঘুমলে সহজে জাগে না। জেগে থাকলে ঘুময় না। ওকে নিয়ে আমাদের বড়ো জ্বালা বুঝেছ মাসীমনি।

কনিষ্কর কথা শুনে মাসীমনি হেসে ফেললো।

হ্যাঁগো মাসীমনি, ওর মতো টিপিক্যাল মানুষ দুটো নেই। মাঝে মাঝে আমরাই হিমসিম খেয়ে যাই। ওর সব কিছু উল্টো। বিশ্বাস করো। ওর শরীরে অর্গানগুলোও সব উল্টো। আমাদের যেগুলো ডানদিকে ওর সেগুলো বাঁদিকে। আমাদের যেগুলো বাঁদিকে ওর সেগুলো ডানদিকে।

যাঃ।

সত্যি বলছি মাসীমনি ওর শরীরে সমস্ত ডেটা আমার কাছে আছে। উইথ ফটোগ্রাফ। তুমি দেখতে চাইলে তোমাকে দেখাব।

এরকম হয় নাকি?

সেই জন্য ওকে মিরাকেল বলছি।

কনিষ্ক আমার মুখের দিকে তাকাল।

তুমি একবার বৌদি, ছোটোমাকে জানাও। বড়োমাকে জানালে এখুনি লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়ে দেবে।

আমি সুরোকে জানিয়েছি। বলেছি বৌদিকে ডেকে আস্তে করে বল।

কখন!

তুমি যখন মনার সঙ্গে আলাদা ভাবে কথা বলছিলে।

এখন একবার বৌদি আর ছোটোমার সঙ্গে কথা বলো।

বৌদি কে, সুতপা? মাসীমনি বললো।

কনিষ্ক মাথা দোলাল।

বৌমা একটু চা কর। ওদের একটু দে।

আমার কেমন যেন সব গুলিয়ে যাচ্ছে মা। তিন্নি বললো।

এতো কাছে, তবু কতো দূরে। তোরা কেউ বুঝতে পেড়েছিলি। মাসীমনি বললো।

এরকম মানুষ জীবনে দুটো দেখিনি। একবার দেখা হোক।

তিন্নীর কথা শুনে আমরা দু-জন হাসি।

এদের দুটোকে দেখেছিস। ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আছে। এটা স্বাভাবিক নয়। তবু দেখ ওরা দু-টোতে বেশ রয়েছে। কেন?

তিন্নী মুখ নীচু করে নিল।

বোঝার চেষ্টা কর।

বৌদিকে ফোন করতেই বললো, আমি রওনা দিয়ে দিয়েছি। তোরা ওখানে থাক। বড়দি, ছোটোকে ও বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি। সামন্তদা বলেছে তোমাদের ভাবতে হবে না, তোমরা নিশ্চিন্তে যাও, আমি এদিকটা সামলে নিচ্ছি।

দাদারা কোথায়?

সব ও বাড়ির দিকে রওনা হয়েছে।

জ্যেঠিমনি?

সব একসঙ্গে আছে।

কনিষ্ক, নীরুকে ফোন করতেই বলে, কিরে এ্যামবুলেন্স দরকার নাকি?

না। একটা হুইল চেয়ার নিয়ে আয়। জয়ন্তীকে খবর দিয়েছিস?

ও রওনা হয়ে গেছে। শ্রীনিবাস ওর সঙ্গে আছে।

ও কি বলে?

সব শুনে আমাদের মতো আকাশ থেকে পড়ে।

স্যার পৌঁচেছে।

এখনও পৌঁছয়নি। আমার সঙ্গে কথা হয়েছে। এলেই আমরা বেরবো। অনিকেত আগে বেড়িয়ে যাচ্ছে। তুই মাসির পাল্সটা কনটিনিউ দেখে রাখ।

ঠিক আছে।

মনা, বেচা এতক্ষণ বাইরে অপেক্ষা করছিল। তিতাস গিয়ে মনে হয় খবর দিয়েছে। ওরা ভেতরে এসে মাসীমনির পা ধরে কেঁদে ফেলে প্রায়।

তারপর মনাই মাসীমনিকে বললো, জয়ন্তীদি ফোন করেছিল মোরের মাথায় এসে পৌঁচেছে।

ওদের নিয়ে আয়। কনিষ্ক বললো।

ওখানে ভ্যান রিক্স রেখে দিয়েছি। এই রাস্তায় ঢোকা মানেই এই বাড়িতে আসা।

মাসীমনি হাসছে।

প্রথমে ঝিমলি, শ্রীনিবাসন এলো। ঝিমলি, মাসীমনিকে জড়িয়ে ধরে প্রথমে একচোট কেঁদে নিল।

শ্রীনিবাসন বললো কাঁদবে পরে, নীরুদা কি বলেছে খেয়াল আছে। আগে তোমার কাজ শেষ করো।

ঝিমলি কাঁদো কাঁদো মুখে বললো, কনিষ্কদা আছে।

আরে তুমি করো না। কিচ্ছু হবে না। কনিষ্ক বললো।

ঝিমলি একে একে সব দেখলো। নোট করলো। প্রেসারটা সামান্য উঁচুর দিকে।

ঝিমলি বললো, সকালে ওষুধটা খেয়েছিলে?

মাসি বললো, এই গণ্ডগোলে খাওয়া হয়নি।

ঝিমলি আবার তিন্নীকে বললো, ওষুধটা দিতে।

আমার দিকে তাকিয়ে বললো, অনিদাটি কি না?

তারপর নিজেই বললো, সত্যিতো তোমরাই বা কি করবে। আমার কিছুটা কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা আছে।

মাসি বললো, কোথায় দেখেছো?

ঝিমলি হাসলো। আজ আমি ডাক্তার হয়েছি অনিদার জন্য। অনিদা হেল্প না করলে হয়তো বাড়ি তৈরি করার মিস্ত্রী হতাম।

কই তোমার সঙ্গে এতো কথা হতো একবারও বলোনি।

কি করে জানবো, তুমি জানো না।

আমি কি আর বলি ঝিমলির মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ ওদের কথা শুনলাম।

শ্রীনিবাসন, কনিষ্ক বাইরের বারান্দায় বেরিয়ে গেল।

চা এলো। তখন সবাই অনেকটা স্বাভাবিক। চা খেতে খেতে আমি, তনু মাসিকে সমস্ত হিস্ট্রী ব্রিফ করলাম।

অনিমেষদা, সুরো, বৌদি, দামিনীমাসি হাজির। রতন নিয়ে এসেছে। তার কিছুক্ষণের মধ্যে নীরুরা সব পৌঁছে গেল। সে এক হই চই ব্যাপার।

অনিমেষদার এ্যাপিয়ারেন্সটা বলো। তনু বললো।

ঠিক বলেছিস।

কেন তুমি বলতে পারছো না। আমি বললাম।

আমি দিদির মতো গুছিয়ে বলতে পারি না।

খালি খোঁচাতে পারো, আর গুছিয়ে খেতে পারো।

আমার হাতটা কোথায় আছো বুঝতে পারছো।

উঃ শোন না।

মিত্রা খিঁচিয়ে উঠলো। আমি ওর মুখের দিকে তাকালাম।

বৌদি ঘরে ঢুকেই মাসিমনির মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো।

মাসীমনিও হাসছে।

বৌদি সটাং খাটের কাছে চলে এসে মাসীমনিকে প্রণাম করলো।

অমি যে তোমাকে চিনতে পেড়েছি তাহলে সেটা সত্যি হলো।

মিথ্যে হতে যাবে কেন।

অনিমেষদা বেশ কিছুক্ষণ গেটের মুখে দাঁড়িয়ে রইলো। দু-জনেই দু-জনের মুখের দিকে তাকিয়ে।

সুরো এগিয়ে এসে মাসীমনিকে প্রণাম করলো।

বিভাস তুমি দাঁড়িয়ে রইলে কেন। ভেতরে এসো।

অনিমেষদার বিভাস নামটা শুনে আমরা সকলে মুখ চাওয়া চাওয়ি করি।

বৌদি ফিক করে হেসে উঠলো।

অনেকদিন পর ওকে কেউ এই নামে ডাকলো।

তারপর মাসীমনি নিজেই হাসতে হাসতে বললো, তাও ঠিক, তুমি তো এখন বিভাস নও। তুমি অনিমেষ বিশ্বাস। এই রাজ্যের পার্টির হর্তাকর্তা বিধাতা।

অনিমেষদা হাসতে হাসতে এগিয়ে এসে পায়ে হাত ছোঁয়াতে গেল।

সুরো এ সব দেখে অবাক ও তো এতোসব জানতো না।

না থাক। মাসীমনি ঝুঁকে পড়ে অনিমেষদার হাতদুটো ধরলো।

সত্যি তাহলে আপনি মনে রেখেছেন?

তোমাকে সকাল বিকেল টিভিতে দেখছি মনে রাখবো না বললে হয়।

তাহলে বিভাস নামটা মুখে আসতো না, অনিমেষ নামটাই উচ্চারণ করতেন।

এই দেখ তুমি কিন্তু আমাকে পর পর মনে করছো।

অনিমেষদা হেসে ফেললো।

দেখছিলাম আমাদের রুমাদি এখনও সেইরকম আছে কিনা।

কি মনে হচ্ছে?

অনিমেষদা হাসছে। সুরোর দিকে তাকাল।

অনির বোন, আমার মেয়ে। অনিমেষদা সুরোর মাথায় হাত ছোঁয়াল।

তনু তখন খাট থেকে নেমে পড়েছে। ইশারায় বলছে বাথরুম।

বিশ্বাস করো তখন আর চাপতে পারছিলাম না।

আমি জোরে হেসে উঠলাম।

শয়তান নিজের যখন পায়। তনু দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে আমাকে থাপ্পর মারলো।

তোমার মতো পায় না।

বলবো মিত্রাদিকে আমার ওখানে গিয়ে জানলা দিয়ে কি করেছিলে।

তারমানে! মিত্রার চোখ গোল গোল।

তনু মুচকি মুচকি হাসছে।

কই তুই এতদিন বলিস নি!

দূরছাই মনে থাকে না-কি। কতো কীত্তি আছে। কথা প্রসঙ্গে মনে পড়েগেল।

দাঁড়া পরে শুনছি, মিত্রা আবার শুরু করে দিল।

তনু আমার ঘাড়ে মুখ গুঁজে দিল।

নীরু ঘরে ঢুকেই মসীমনির পায়ে মথা দিয়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম।

আমি নির্মল অনির কাছে নীরু, কনিষ্ক যেমন কনি…।

তোমার নামটা ওর মুখে শুনেছি। তোমাকে নিয়ে ওর একটা কীর্তি রয়েছে।

ঝাঁটা পেটা।

আমরা সকলে হাসি।

জানো মাসি ওই ঘটনা নীরুর জীবন রেখাটাই বদলে দিয়েছিল।

মাসীমনি নীরুর মুখের দিকে তাকিয়ে।

জানো মাসীমনি, এতদিন অনি খালি মাথায় রোদ-জল-বৃষ্টিতে ঘোরাঘুরি করতো। ওর ছাতার একটা বড়ো অভাব ছিল। এতদিনে ওর মাথায় একটা ছাতা উঠলো।

মিলি, টিনা অবাক হয়ে মাসীমনির দিকে তাকিয়ে।

নীরু বলে উঠলো তুমি একে চিনতে পারছো। শ্রীপর্ণাকে ধরে কাছে আনলো।

মাসীমনি অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো, ঠিক মনে করতে পারছি না।

বাঃ তোমার মনে নেই, তোমার যখন গাইনীর প্রবলেম হলো জয়ন্তী ম্যাডাম ওঁকে রেফার করলো। তিন্নী বললো।

মাসী হাসলো।

আমার বিয়ে করা বউ বুঝলে মাসি।

এই হাসি শুরু হলো।

তুমি অনির মুখ থেকে কার কার নাম শুনেছো বলো।

অতো কি মনে আছে।

নাম বললে লোকেট করতে পারবে।

তা পারবো।

ইনি হচ্ছেন মিলি ম্যাডাম। কনিষ্কর বউ। এর মেয়েটাকে অনি বকলমা নিয়েছে।

আমরা সবাই হাসি।

কত বছর বয়স বলতো?

চার পেড়িয়ে পাঁচে দৌড়চ্ছে।

মাম্পি?

তবে, মনে পরবে না মানে।

মিকিটা কার?

বৌদি জোড়ে হেসে উঠলো।

সুরোর। তুমি জানলে কি করে?

একদিন দুটোকে নিয়ে আমার এখানে এসেছিল।

ঠাম্মা সেই বিঁচকে দুটো। তিতাস বললো।

মাসীমনি হাসছে।

কি টরটরিগো আধঘণ্টার বেশি অনিকাকাকে বসতেই দিল না। বলে মাছ ধরবে।

মনেহয় সেই ভাবে বলে কয়ে নিয়ে এসেছিল।

তিতাস, সুরোর দিকে তাকিয়েছে। সুরো হাসছে।

হ্যাঁগো, অনিকাকার ওপর কি দাপট। প্যান্ট প্রায় কোমর থেকে খুলেই দেয়। তারপর তো ওদের নিয়ে চলে গেল। অনিকাকা যেন লিলিপুটের দেশে গ্যালিভার।

যাওয়ার সময় বললো কাল-পর্শুর দিকে একবার আসবো। এলো দু-মাস পর। গতকাল।

জানো পিসী, তোমার বিয়ের দিন তোমার নামটা প্রথম জানতে পেড়েছিলাম।

আমরা সবাই তখন তিতাসের গল্প শুনছি। তিতাস কলকল করছে।

বাবা কি একটা দরকারে বিকাশ কাকার কাছে পাঠাল। গিয়ে দেখি অনিকাকা কালীঝুলি তুলছে। মনাকাকা, টনাকাকা হেল্পার। তাদেরও একই অবস্থা। আমকে দেখে বললো তুই এখন ভাগ। আমি একটু পরে যাচ্ছি, তারা আছে।

ধোপ-দুরস্ত হয়ে, গেরুয়া পরে প্রায় একঘণ্টা পরে এলো। ঠাম্মা চেপে ধরতে বললো, বনের বিয়ে ছিল। নেমন্তন্ন খেতে গেছিলাম।

কালী ঝুলি মেখে নেমন্তন্ন খেতে গেছিলি!

যা একখানা গল্প দিল না। ঠাম্মা ফ্ল্যাট। ব্যাশ ফুরুত পাঁচবছর।

সুরোর চোখ ছলছল করে উঠলো।

তোমরা কিছু বুঝতে না। আমি বললাম।

তাহলেই হয়েছে। অনিকাকা দেশ ছেড়ে চলে যাবার মাসখানেক পর ঠাম্মার হুঁশ হতো, সত্যিতো অনি শ্রেফ গুল মেরে চলে গেল। ঠাম্মার দাপাদাপি শুরু। ডাক মনাকে। তাও আবার কি, সেইরকম কোনও সিকোয়েন্স তৈরি হলে মনাকাকার ডাক পরতো। সাত চরে রা করে না। মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ আর হুঁ এই দুটো শব্দ ছাড়া কিছুই জানে না। শেষে বলবে বুঝলে মাসীমা দক্ষিনা বাতাস খেতে খুব ভালোলাগে যদি সহ্য করতে পার। তখন ঠিক ঠিক বুঝতাম না। এখন বুঝি কথায় কি প্যাঁচ বলোতো!

অনিমেষদা পর্যন্ত তিতাসের কথা শুনে হাসে।

তারপর অনিমেষদাই বললো। আর দেরি করে লাভ নেই। ওখানে সবাই ব্যস্ত হয়ে পরেছে। কনিষ্ক একবার মনাকে ডাক।

ডাকতে হবে না, ও সব গুছিয়ে নিয়েছে।

ঠাম্মা তুমি এখন অনিকাকার কাছে যাবে?

মাসীমনি হাসছে।

এ মা আমার আজ ফর্ম ফিলাপ।

ঠিক আছে তুই যা তোরটা তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। অনিমেষদা বললো।

না অনিমেষ, ওটা কোরো না।

কেন!

না।

তাহলে কালকে ফর্ম ফিলাপ করুক।

ও যদি দু-ঘণ্টা পড়া যায় কোনও অসুবিধে নেই। দু-ঘণ্টায় মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না।

জানিস, মাসীমনি কারুর সাহায্য ছাড়া খাট থেকে নামলো। একটু সময় নিল বটে। ঝিমলি দেখে অবাক।

তোমার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না।

না।

মাথা ঘুরছে না।

না।

তিন্নী কাপর এনেদিল। আমাকে তনুকে বললো।

তোরা দুটোতে দু-পাশে দাঁড়া আমি কাপরটা পরি।

দেখলাম শরীরটা সামান্য কাঁপছে।

তারপর কনিষ্করা চেয়ার আনলো। মাসিকে নীরুই ঠিক-ঠাক ভাবে বসিয়ে দিল। বটা, অনিকেত কিন্তু এতক্ষণ একটা কথাও বলে নি। শুধু দেখে গেছে।

বাড়ির বাইরে আসতে বটা বললো, তোমরা ভ্যানে করে বড়ো রাস্তায় যাও। আমি, নীরু মাসীমনিকে নিয়ে যাচ্ছি। অনিকেত এ্যাম্বুলেন্সে সব গুছিয়ে নিয়ে এসেছিস।

এ্যাম্বুলেন্সের কথা শুনে মাসীমনি বললো, আমি সুস্থ আছি।

গাড়িতে যেতে পারবে?

এতদিন গাড়িতেই যাতায়াত করেছি।

ঠিক আছে তোমায় এ্যাম্বুলেন্সে যেতে হবে না। নীরু বললো।

আমি, বৌদি, মাসীমনি, তনু, তিন্নী একটা গাড়িতে। রতন চালাচ্ছে।

রতন এতক্ষণ ভেতরে যায়নি। ঠায় বাইরে দাঁড়িয়ে থেকেছে।

বাইরে আসতে রতন প্রণাম করলো। আমি পরিচয় দিলাম।

সেই সময় মাসীমনির তাকান দেখিসনি। এখানে এসে এক ফাঁকে রতন বললো, ম্যাডাম ইনি তো অনিদার থেকেও বড়ো খেলোয়াড়। ধারে কাছে কোথাও ইসলামভাইকে দেখতে পেলাম না। বুঝলাম অনিমেষদা নিশ্চই কোনও কাজে পাঠিয়েছে।

আমি মুচকি মুচকি হাসছি।

তনু বললো, দাঁড়াও দিদি আর রাখা যাবে না।

আমি জোরে হেসে উঠলাম।

দাঁড়াও ঘুরে আসি। তারপর দেখাচ্ছি।

তুই এলে আমি যাব।

তনু বাথরুমে দৌড়লো।

মিত্রা আমার গলা জড়িয়ে ধরলো।

জানিস বুবুন আমার থেকে তনুর কষ্ট আরও বেশি।

মিত্রার মুখের দিকে তাকালাম।

তুই সবাইকে সময় দিস শুধু আমাদের বেলায় লবডঙ্কা।

তনু তোকে বলেছে।

তনু বলবে কেন, আমাদের বোঝার বয়স হয়নি। আমরা কি পেলাম বলতো।

হাসলাম।

হাসিস না আমাদের দিকটা একবার বোঝার চেষ্টা কর।

এবার সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে একবারে গৃহী হয়ে যাব। তনু, মিত্রা ছাড়া পৃথিবীতে আর কাউকে চিনব না।

অমনি তোর রাগ হয়ে গেল।

যা বাবা কোথায় রাগ করলাম।

আমরা মাম্পি, মিকি যা বলবি তাই বুঝে যাব।

দিদি যাও। মিত্রা আমাকে ছেড়ে উঠে বসলো।

বাথরুমের দিকে তাকালাম। তনু ম্যাক্সি দিয়েই মোছা মুছি শুরু করেছে। মিত্রা খাট থেকে নেমে দাঁড়াল।

তোমার কি দিদির হাওয়া লেগেছে।

সব দিকে চোখ কেন শুনি।

চোখ বন্ধ করে রাখি।

তনু খাটে উঠে শরীরটাকে আমার ওপর ছুঁড়ে দিল। গালে গাল ছুঁইয়ে বললো।

ছোটোমা কি বলেছে জানো।

কি।

তোকে আর ওখানে যেতে হবে না। সুন্দরকে বুঝিয়ে দে ও সামলাবে।

সেই শুনে তুমি ওমনি নাচতে শুরু করে দিয়েছ।

বুড়ো বয়সে নাচা যায়, কোমর ভেঙে যাবে। ভীষণ আনন্দ হচ্ছে।

হুঁ বুঝেছি চারিদিকে খালি স্কিমের ছড়া ছড়ি।

আমাকে এখানে একটা কাজ বুঝিয়ে দাও। সেটা করবো। তাছাড়া অংশুকে একটা সাহায্য করার লোক দরকার। আমাকে এ্যাপয়েন্টমেন্ট দাও ফটোগ্রাফার হিসাবে।

বাথরুমে গিয়ে মাথায় এই পোকাটা নরলো বুঝি।

সব সময় ফিচলেমি না। তনু ঘুষি পাকালো।

আবার ঘুষো ঘুষি কিসের।

মিত্রা বথরুমের মুখে দাঁড়িয়ে।

দেখো না। ছোটোমার ওই কথাটা বললাম, ওমনি শুরু করে দিয়েছে।

মিত্রা এসে পাশে শুল।

এবার ঘুমো।

দাঁড়া এখনও অনেক বাকি।

তার মান!

একদিন না ঘুমলে শরীর খারাপ হবে না। কয়েকদিন ভাল ঘুমিয়েছিস। অনেক এনার্জি সঞ্চয় করেছিস এবার একটু খরচ কর।

হবে না, আমি এখন ঘুমবো।

চোখে লঙ্কা ডলে দেব।

ভালই শুরু করেছিস।

তনু জানলা কেসটা বল। এরপর আবার ভুলে যাব।

তনু খিল খিল করে হেসে আমার শরীরে ঢলে পরলো।

কিরে হাসছিস কেন!

শুনলে তুমিও না হেসে থাকতে পারবে না।

মিত্রা মুচকি মুচকি হাসছে।

মাথায় যে কত দুর্বুদ্ধি আছে তোমাকে কি বলবো।

তনুর হাসি থামে না।

সেবার শীতের সময় আমাদের ওখানে গেছে।

আমরা যে সময় গেছিলাম।

না তার থেকেও টেম্পারেচার অনেক বেশি লো ছিল। সাতদিন ঘর থেকে বেরতে পারিনি। চারদিক সাদা।

সুন্দর উইকেণ্ডে বন্ধুদের সঙ্গে গিয়ে আটকে পড়েছে। ঘরে আমরা দু-জন।

খিচুড়ি রাঁধো আর খাও।

কে করতো, তুই না বুবুন।

নিজে খিচুড়ি রাঁধতো।

মিত্রা হাসছে।

ও কিভাবে খিচুড়ি রাঁধে জানো তো?

নেপলা বলছিল।

তনু হাসে।

বলতে পারো আমার সারাজীবনে এখনও পর্যন্ত ওই সাতটা দিন ওকে নিজের মতো করে পেয়েছিলাম। তখন তোমার ঘটনাটা ও ডিটেলসে আমাকে বলেছিল।

মনাকাকার কথা, দামিনীমাসীর কথা, ছোটোমা-বড়োমা সবার কথা ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেছিল।

সারাদিন ঘরে রুম হিটার জ্বলছে। রাতে দু-জনে শুয়েছি। কথা বলতে বলতে আমি কখন ঘুমিয়ে পরেছি জানি না।

হঠাৎ ভীষণ শীত করতে ঘুমটা ভেঙে গেল। দেখলাম ও বিছানায় নেই। ভাবলাম বাথরুমে গেছে।

এত শীত করছে কেন? চারদিক বন্ধ তবু ঘরটা এত ঠান্ডা কেন?

হাল্কা বরফের আওয়াজ শুনতে পেলাম। শিলা বৃষ্টি পরলে যেমন আওয়াজ হয় সেরকম।

চারদিক বন্ধ, আওয়াজ আসছে কোথা থেকে! তাকিয়ে দেখি বারান্দার দরজাটা সামান্য ফাঁক করা।

ভাবলাম নিশ্চই ও রাতে বরফ পড়া দেখতে উঠেছিল বন্ধ করতে ভুলে গেছে।

উঠে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করতে যেতে দেখি ও ওই কনকনে ঠাণ্ডায় দাঁড়িয়ে বাথরুম করছে।

মিত্রা খুব জোড় হেসে উঠলো। বললো।

বরফ হয়ে পড়ছে।

ওরা দুজনে হেসে আমার শরীরে লুটোপুটি খাচ্ছে ওদের সঙ্গে আমিও হেসে ফেললাম।

হাসতে হাসতে তনু বললো। বয়সটা দশ-এগারো হলে মনকে বোঝাতাম যে ঠিক আছে। কিন্তু ওর তখন পঁয়তাল্লিশ বছর। ওই বয়সে….।

প্যান্টের পাছু ফাটানোটা ভাব এই তো সেদিনের ঘটনা।

হ্যাঁ, বেমালুম গল্প ঝেরে দিল।

তারপর শোনো না।

শেষ হতেই আমার দিকে তাকিয়ে লজ্জা পেয়ে গেছে।

তুই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলি!

হ্যাঁ।

তাড়াতাড়ি ভেতরে এসে বললো। দরজাটা বন্ধ করো বহুত ঠাণ্ডা।

তারপর রুমহিটারের কাছে গিয়ে কাপরটা সামান্য তুলে দাঁড়াল।

আমি গম্ভীর হয়ে ওকে লক্ষ করছি। বেদম হাসি পাচ্ছে। হাসতে পারছি না।

কি করছো।

গরম করছি। সব ছোটো হয়ে গেছে কিছু খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

ওখানে কি করছিলে।

বরফ পড়া দেখছিলাম।

তখন আমি আর থাকতে পারিনি হেসেফেলেছি।

বলে কি, জানো তনু জীবনে অনেকগুলো সখ অপূর্ণ রয়েছে। তার মধ্যে এই একটা সখ ছিল। আজ সেই সখটা পূর্ণ হলো।

সখটা কি শুনি।

তুমি তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলে। লিকুইড থেকে কিভাবে তাৎক্ষণিক বরফে পরিণত হয় সেটা এক্সপিরিমেন্ট করলাম।

ওরে বাবারে তুই থাম তনু, হাসতে হাসতে আমার পেট ব্যাথা করছে।

তুমি একবার ভাবো।

তারপর সুন্দর ফিরে আসতে তাকে গল্প করে বলা হলো। সে আবার একদিন এক্সপিরিমেন্ট করে বললো, ড্যাড তুমি গ্রেট।

আমাকে বলে কি, তুমি আর বাকি থাকবে কেন লোকচক্ষুর অন্তরালে তুমিও একবার এক্সপিরিমেন্ট করতে পারো। ভারি মজা বুঝলে।

তুই করেছিলি নাকি?

ধ্যুস, তুমিও যেমন।

দাঁড়া কালকেই মাসীমনিকে বলতে হবে। তোমার বনপোর কীর্তিকাহিনী শোনো।

ছাগল, আমি মিত্রার গালটা টিপে দিলাম।

সেদিনের কথাটা মেয়ে শুনে কি বললো, তোমরা বাবার এ্যাচিভমেন্টগুলো ঠিক এনকারেজ করতে পারো না। তনু বললো।

ওদের হাসি আর থামে না। খনে খনে হেসে ওঠে।

তিনজনে জড়ামরি করে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলাম।

কিরে ঘুমলি নাকি। মিত্রা বললো।

চেষ্টা করছি।

কান কামরে ছিঁড়ে দেব।

কালা হয়ে যাব।

বিধানদা কি বলেছে শুনেছিস।

মিত্রা মুখের কাছে মুখ নিয়ে এলো। আমি ওর মুখের দিকে তাকালাম।

তুই বিধানদার জীবনের অমূল্য জিনিস ফিরিয়ে দিয়েছিস। মাসীমনিকে দেখে সেদিন কেঁদে ফেলেছিল। ভাবতেই পারেনি।

ওখানে ওই কাক ভোরে নেমে প্রথমে তো একচোট সবাইকে বোঝাতেই সময় চলে গেল। তারপর কনিষ্ক মনাদের সঙ্গে একটু দূরে গিয়ে আলাদা করে কথা বলছিল। তনু বললো, এবার বৌদি, ছোটোমাকে জানিয়ে দাও।

আমি সুরোকে ফোন করলাম। সুরো প্রথমে ভয় পেয়েছিল। সেই এক কথা অনিদা ঠিক আছে।

বললাম ঘুমচ্ছে। আমরা এখন এখানে।

তার মানে!

তারপর ওকে আস্তে আস্তে সব বললাম।

ও তো শুনে নাচানাচি শুরু করে দিল।

বৌদিগো এই সাত সকালে এ তুমি কি শোনালে!

বললাম খুব সাবধানে, বৌদিকে ডেকে গুছিয়ে বল।

দাঁড়াও আগে নিজে ঠিক ঠাক হজম করি, ওর সঙ্গে একটু কথা বলি।

অংশু ঘুমচ্ছে?

না। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। ফোনের আওয়াজ পেয়ে উঠে বসেছে।

পুঁচকে দুটো?

অঘোরে ঘুমচ্ছে।

তুই আমাকে ফোন করবি না। কেউ আমাকে যেন ফোন না করে। প্রয়োজনে আমি ফোন করবো।

আচ্ছা।

বৌদি সেদিন বড়োমা, ছোটোমার সঙ্গে আমার ঘরে শুয়েছিল। সুরো গিয়ে বৌদিকে ডাকতে তিনজনেই জেগে যায়। ওই কাকভোরে সুরোকে ঘরের সামনে ডাকতে দেখে সবাই চমকে উঠে বসে।

প্রথমেই তোর খবর, কেমন আছিস। তারপর সুরো যেই সমস্ত কথা ধীরে ধীরে বলেছে, তখন বড়োমা বলে, ছোটো আগে সামন্তকে ডেকে তোল। ও ছাড়া কেউ ওকে এই সময় সামলাতে পারবে না।

তারপর সবাই উঠে মিটিং করে। বিধানদা ছিল না। অনিমেষদা সব শুনে বলে, তুমি ঠিক বলছো সুতপা এই রুমাদি আমাদের সেই কলেজ লাইফের রুমাদি।

তাই শুনে বৌদি বলেছে। আমার চোখে এতোটা ছানি এখনও পরেনি।

তাহলে বিধানবাবুর সঙ্গে অনি যে ফিচলেমি করতো সেটার একটা তাৎপর্য আছে।

সেই শুনে ডাক্তারদাদা বলে তুমি ওনাকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করো অনিমেষ। বাকিটা আমি নিজে অনি আর বিধানবাবুর সঙ্গে বুঝে নেব।

ছোটোমা আমাদের বলে আর হাসে।

তখন যদি তুই সামন্তদাকে দেখতিস। যেন টগবগ করে ফুটছে।

দাদা নাকি সব শুনেটুনে বলেছিল। নামটা খুব শোনা শোনা মনে হচ্ছে। স্মরণ শক্তিতে মরচে পড়েছে। ঠিক খেয়াল করতে পারছি না। ভাষা ভাষা মনে হচ্ছে সেই প্রিয়েডে এইরকম একটা কিছু হয়েছিল। বড়োমার পেটেন্ট মরণ তার সঙ্গে এ্যাড করে নে।

আমরা যখন বাড়ির গেটে তখন দেখি মাঠে লোকে লাকারণ্য। ডাক্তারদাদা, আন্টিকে দেখতে পেলাম না। অদিতি, নির্মাল্য, দেবাশীষকে দেখে মনে হলো সবে মাত্র ঘুম থেকে উঠে এসেছে।

আমাদের দেখে তিনজনেই হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এসেছে।

নীরুই পরিচয় করালো মাসীমনির সঙ্গে।

তোর সব ছেলেরা কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।

আমি গাড়িতে আসতে আসতেই সব মোটা মুটি সিনপসিস করে রেখেছিলাম।

তারা ঠাম্মাকে পেয়ে প্রায় কোলে করে নামায়। নীরু বাধা দিল।

তোরা তাড়াহুড়ো করিস না। পরে সব বলছি।

উঁকি মেরে দেখলাম আমার ঘরের দরজা জানলা সব বন্ধ।

বুঝলাম বাইরের কোনও আওয়াজ যেন ভেতরে প্রবেশ না করে।

বড়োমা, মাসীমনিকে জড়িয়ে ধরে ফঁস ফঁস করে কিছুটা কেঁদে নিল।

নীরুর স্নেহের ধমক।

নিস্তব্ধে কাজ করো। ছেলে উঠলে আমার ঘারে মাথা থাকবে না। সেটা খেয়াল রেখ।

বটা, অনিকেত মাসিমনিকে ধরে ধরে চেয়ারে বসাল।

মাসীমনি আমাকে ডাকল। কাছে গেলাম। তুই, তনু আমাকে একবার অনির কাছে নিয়ে চল।

ও এখনও ঘুমচ্ছে।

তা হোক।

কনিষ্কর দিকে তাকালাম। কনিষ্ক আবার অনিমেষদার দিকে তাকাল।

ওখানে কে আছে? অনিমেষদা, বড়োমার দিকে তাকাল।

সামন্ত, সোনাকে বসিয়ে রেখেছি। আসাতক আমরা কেউ ও ঘরে ঢুকিনি।

অনিমেষদা হেসে ফেললো।

ওই সময় রূপায়ণদা ফোন করেছে।

বলো রূপায়ণ।

কি কথা হলো জানি না। অনিমেষদা শুধু বললো, আমরা এই ঢুকলাম। তারপর মনে হয় বিধানদার সঙ্গে কথা হলো। শুধু বললো আপনি একবার আসুন। সবাই ঠিক আছে।

আমার দিকে তাকিয়ে বললো।

তোরা বরং দিদিকে নিয়ে যা। আমরা এই ঘরে অপেক্ষা করি। বেশিক্ষণ থাকিস না।

আমরা নিয়ে যেতে যেতে কনিষ্ক, নীরু গিয়ে ডাক্তারদাদার সঙ্গে কথা বললো।

মাসীমনিকে নিয়ে তোর ঘরে গেলাম।

তুই তখন চাদর মুড়ি দিয়ে পাস ফিরে অঘোরে ঘুমচ্ছিস।

তোকে দেখে মাসীমনি কেঁদে ফেললো।

ডাক্তারদাদা মাসীমনির হাতটা ধরে ইশারায় বললো, এখন না।

কিছুক্ষণ ছিলাম। মাসীমনি তোর ফটোটার সামনে নিয়ে যেতে বললো। নিয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ চুপচাপ তোর ফটোটার দিকে তাকিয়ে থাকলো।

ডাক্তারদাই বললো, এখন ও ঘরে যাও। সোনা তুমিও যাও। একটু পরে এসো।

আবার তোর ঘরের দরজা বন্ধ।

এ ঘরে তখন লোকে লোকারণ্য।

তোর ঘরের বাথরুম পর্যন্ত কেউ ব্যবহার করতে যেতে পারবে না। বড়োমার হুকুম।

ইকবালভাই, ইসলামভাই এলো। সুরোর শ্বশুর মশাই এলেন।

তিতাস, বিনয়দা ইউনিভার্সিটি গেল।

মিলিরা বললো, মিত্রাদি আমরা ঝপ করে অফিসের কাজ সেরে আসি।

কনিষ্ক, নীরুরা নার্সিং হোমে গেল।

বড়োমাকে বললাম, ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। তোমার ঘরে শুয়ে একটু ঘুমিয়ে নিই।

আর ঘুম।

রূপায়ণদা, বিধানদা, অনুপদা হাজির।

বড়োমা ইশারায় বললো তোরা যা।

মাসীমনি তখন অনেকটা স্বাভাবিক।

বাইরের বারান্দায় দুজনে যেতেই অনুপদা পেছন থেকে ইশারায় বললো, কিছু জানে না। তোরাও কিছু বলিস না।

বিধানদা এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলো, কিরে কি হয়েছে! অনির শরীর খারাপ?

না।

তাহলে অনিমেষ ওরকম তারা লাগাল।

ওরা দিল্লীতে এসে পৌঁচেছে।

তাই বল। সবাই এসেছে।

হ্যাঁ।

অনি কি আবার কোনও ঘোঁট পাকিয়েছে?

কি জানি। ও তো এখনও ঘুম থেকে ওঠে নি।

বিধানদা আগে হন হন করে হাঁটছে আমরা পেছনে। রূপায়ণদা আমার হাতটা ধরে টিপে দিল।

ইশারায় বললো, কিরে সব ঠিক আছে।

মুচকি হাসলাম।

ঘরে ঢুকেই মাসীমনিকে দেখে কেমন থমকে দাঁড়াল। অনেকক্ষণ মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল।

মাসীমনিও বিধানদার মুখের দিকে তাকিয়ে। কারুর চোখের পাতা পরে না।

আন্টি, দাদা, অনিমেষদা সোফায় বসে। আর এক দিকের সোফায় জ্যেঠিমনি।

বড়োমারা সব রান্নাঘরের কাছে ছিল।

বৌদি ছিটকে বেরিয়ে এসে বিধানদার সামনে দাঁড়াল।

বিধানদা কোনও কথা বলতে পারছে না। চোখদুটো ছল ছল করে উঠলো।

আমার মুখের দিকে তাকাল।

আমি, তনু দুজনেই মুচকি হেসে মাথা নীচু করে নিলাম।

বিধানদাও হাসল। কি বলবো তোকে বুবুন, কান্না ভেঁজা হাসি হাসি মুখটা এত সুন্দর দেখতে লাগছিল। তোকে বলে বোঝাতে পারব না। যেন কতকাল পড়ে হারান জিনিষ খুঁজে পেয়েছে।

আস্তে করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, অনি কোথায়?

ঘুমচ্ছে।

কেন!

তুমি বোস তোমাকে সব বলছি।

বিধানদা এগিয়ে এসে মাসীমনির সামনে দাঁড়াল।

মাথায় হাতটা রাখল।

এই শেষ বয়সে তোমার সঙ্গে দেখা হবে ভাবিনি। অনি মাঝে মাঝে ফাজলামো করতো, তখন অতটা আমল দিইনি। সেটা কতটা সত্য আজ এই মুহূর্তে উপলব্ধি করছি।

তোমার মতো আমারও একই দশা। মাসীমনি বিধানদার হাতটা চেপে ধরলো।

বড়ো, সামন্ত কোথায়? বিধানদা, বড়োমার দিকে তাকিয়েছে।

ডাক্তারকে পাহাড়ায় বসিয়েছি।

বিধানদা নিজের মনে হাসলো।

তারমানে আরও অনেক ঘটনা ঘটেছে।

সারারাত ধরে চলছে।

তোমায় একটু প্রণাম করি। মাসীমনি বললো।

এখন থাক, তোমায় দেখে মনে হচ্ছে তুমি সুস্থ নও।

বয়স হয়েছে।

তোমার একার হয়েছে। আমাদের হয়নি?

দাদা একটু চা দিই। বৌদি বললো।

একটু দাও। দু-একটা কচুরী থাকলে দাও। বড্ড খিদে লেগেছে। কাল সেই যা তোমাদের সঙ্গে দুপুরে খেলাম। তারপর আর খাওয়া জোটেনি।

বড়োমা ব্যস্ত হয়ে পরলো।

সোফায় এসে বসে অনিমেষদার মুখের দিকে তাকাল।

তোমরা রুমাকে খুঁজে পেলে কোথায়?

কালকে আপনাকে সুতপা বলেছিল, অনির এক মাসীমনির কাছে গেছিল। তিনি আমাদের পার্টি পুরনো কর্মী।

সুতপা কাল রুমার কাছে গেছিল!

রাতে ওর মুখ থেকে সব শুনলাম। আমরা বহু চেষ্টা করেও রুমাদিকে খুঁজে পাইনি।

বিধানদা, অনিমেষদার মুখের দিকে তাকিয়ে!

আজ ভোর রাতে আবিষ্কৃত হল। অনি অনাথ নয়। এই মুহূর্তে ওর একজন পরম আত্মীয়া ওর মায়ের দিদিভাই বেঁচে আছেন। তারপর গিয়ে আবিষ্কার করলাম তিনি আমাদের পরম আত্মীয়া রুমাদি। এও জানলাম তিনি আমাদের পার্টি কর্মী টনা, মনা, বেচার হেপাজতে গচ্ছিত ছিলেন। অনি তাদের দায়িত্ব দিয়েছিল আমার মাসীমনির যেন কোন অসুবিধে না হয়।

বিধানদা একবার অনিমেষদার মুখের দিকে তাকায়, একবার মাসীমনির মুখের দিকে তাকায়।

আপনার মতো আমিও কয়েকঘণ্টা আগে জেনেছি। তাও হয়তো জানতাম না। যদি তনু, মিত্রা কাল ওকে চেপে না ধরতো। শুনলাম কাল ও নিজে মুখে সব স্বীকার করেছে।

চলবে —————————–



from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/HEtJ04q
via BanglaChoti

Comments