কাজলদিঘী (১৮৫ নং কিস্তি)

❝কাজলদীঘি❞

BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

১৮৫ নং কিস্তি
—————————–

সবাই হাঁটতে শুরু করলাম। মিত্রাকে বললাম জলের বোতলটা একটু দে।

তনু ব্যাগ থেকে বোতলটা বার করে দিল।

একটু খেয়ে আবার বোতলটা ওদের ফিরিয়ে দিলাম।

তোর কাছে সিগারেট আছে।

সিগরেট লাই চুট্টা আইছে।

দে।

শ্যাম একটা চুট্টা আর দেশলাইটা আমার হাতে দিল।

এইটা চুট্টা! তনু চোখ বড়ো বড়ো করলো।

হ। বিড়ি ছুটো হয়। চুট্টা দেখতি বড়ো।

এটা বিড়ি? এ্যাঃ তোকে খেতে হবে না। মিত্রা বললো।

শিবু হাসছে।

অনিদা আইগে কইতো খাছে।

আমি চুট্টা ধরালাম। একবার টানার পর দ্বিতীয়বার টানতেই খক খক করে কেশে উঠলাম।

শিবুর হাতে দিয়ে বললাম আর খাব না। তুই খা।

বুঝলাম আগের থেকে সহ্য শক্তি অনেক কমে গেছে।

বউমনিরা আকার ঘরে শু যাক। শ্যাম বললো।

কেন?

এতটা পথ ভাইঙে নিচে যাতি হবেক নাই।

বড়োমারা কি ভাববে।

তান্যে ঘুমাইতিছে। কুছু জানবেনি।

মিত্রার দিকে তাকালাম।

আমরা নিচে যাব।

শ্যামের দিকে তাকালাম।

বউমনি যখন মন করতিছে তাইলে চ।

আমরা নিজেদের মধ্যে গল্প করতে করতে তাড়াতাড়ি হেঁটে চলে এলাম। একটু দূরেই মেলাটা টান টান হয়ে হাত, পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। সারাদিনের ক্লান্তি। এখন একবারে ঘুমিয়ে পড়েছে। চারদিক শুনশান। যে কজন মাঠে পড়ে আছে তারাও বেহুঁস। প্রত্যেকের শরীরের অর্গল খসে পরেছে। চারদিক অন্ধকার। আকাশ থেকে যেটুকু আলো ছড়িয়ে পরেছে তাতে বেশি দূর চোখ যায় না।

তোরা ভেতরে গিয়ে বড়োমার কাছে শুয়ে পর। আমি এখানে শুয়ে পরছি।

কেন ভেতরে চল। চূড়া আমাদের জন্য আলাদা বিছানা করে রেখেছে।

আমি একটু এখানে বসি, তারপর যাচ্ছি।

মিত্রারা আর দাঁড়াল না।

যাওয়ার সময় রতনদের বাইরের খাটিয়াতে যেভাবে দেখেছিলাম সেইভাবেই পরে রয়েছে।

শিবু ভেতর থেকে একটা খাটিয়া বার করে নিয় এলো।

কিরে একটা নিয়ে এলি তোরা শুবি না।

তুই কি এখুন ঘুমাইবি।

না। তা নয়।

তাইলে?

আমি খাটিয়াতে বসেই টান টান হয়ে শুলাম।

বেশ ক্লান্তি লাগছে। খোলা আকাশের তলায় শোবার মজাই আলাদা। চারিদিকে পাহাড়।

চাঁদের আলোটা বেশ ভালো লাগছে। মাঝে মাঝে সাদা মেঘ চাঁদটাকে ঢেকে দিচ্ছে। মেঘটা সরেগেলেই চাঁদের আলোটা আবার আছাড় খেয়ে পরছে চারদিকে। অনেকক্ষণ মেঘের দিকে চেয়ে থাকলে মনে হয় আমিও ওই মেঘের সাথে ভেসে চলেছি।

গরম আছে কিন্তু সেইরকম ভ্যাপসানি নেই। যেটা কলকাতায় আছে। এই মুহূর্তে এখানে এসিও লাগবে না। পাখাও লাগবে না। যে টুকু হাওয়া দিচ্ছে তাতে শরীর জুড়িয়ে যায়।

শিবু দেখতো তোর বউমনি, তনুদি আশে পাশে কোথাও ঘাপটি মেরে আছে না দরজা বন্ধ করেছে।

শিবু হাসছে। তুর সব তাতে সন্দহ।

ব্যাটা যা বলি শোন না। আগে বোকা ছিল, এখন ভীষণ চালাক।

শিবু হাসতে হাসতে উঠে গেল।

শ্যাম আমার পায়ের কাছে বসেছে।

ওর মুখের দিকে তাকালাম।

খবর কি?

ভাল লয়, তুর কথা ঠিক।

কে পাঠিয়েছে?

এ সেই এসপির যে ফউটা আইছে তার লুক।

মনীশকুমার।

হ।

জানলি কি করে?

মন্যে চিনতি পারি লাই। ছুড়কিরে কইতে চাপি ধরলো। কিছু কইছে, পুরা কয়নি।

থাকে কোথায়?

শালবনি।

রেখেছিস কোথায়?

দিবাকরের সেউখানে পঠাইছি।

একা না আর কেউ আছে।

তুকে তখন কই লাই। মেলা শুরুর মুখে লইখ্যা একজনাকে ধরছিল, তার কাছনু অস্ত্র পাইছে। তারপর তুই মোকে ডাইকা কইলু তখন চারদিক বাঁধলি।

তখন বলতে পারতিস।

মেলা হয়ঠে তুই তো কুনদিন আনন্দ করুনি, তাই কইনি।

ছুড়কি ওটাকে জিজ্ঞাসা করেছে।

মোকে কিছু কয় লাই। কইছে আইজকের দিনটা যাউক কাল সকালনু দেখবে। আকাকে অখন কিছু কইতে হবেনি।

কিছু ঘটলে?

হইতোনি, তোনকার পাইশে পাইশে লুক ছ্যাল। ছুড়কি বাঁধি দিছে।

শিবু আর একটা খাটিয়া নিয়ে এলো। পাশে রেখে বসলো।

দারু কই?

শুইছে।

আশেপাশে কারা আছে।

লুক আছে।

ঠিক আছে তোরা ঘুমিয়ে পর। আমাকে একাট চুট্টা আর দেশলাইটা দে।

সিগরেট লেই আসি। শিবু বললো।

আছে?

হ।

নিয়ে আয়।

তুই ঘুমাইবিনি। শ্যাম আমার মুখের দিকে তাকাল।

হ্যাঁ, একটু গুছিয়ে নিই। কাল সকালে বেরবো। দিবাকরের কাছে যাব, রেডি থাকবি।

অনুপদা কইছে বুইসবে।   

তুই, দারু বসবি শিবুকে নিয়ে যাব। মোটর বাইক রেডি রাখিস।

তুই থাকলি ভালো হইতো।

আমার হয়ে সুরো-বৌদি থাকবে, তোকে চিন্তা করতে হবে না।

শিবু সিগারেটের প্যাকেট দশলাই নিয়ে এলো।

বৌদিরা কোথায়?

দরজা ভেজাই দিছে। মুনে হইলো দু-জনে কথা কইতিছে।

আমি উঠে একটু দূরে গেলাম।

চারদিক নিস্তব্ধ। চাঁদটা পাহাড়ের পেছন দিকে হেলে পড়েছে। এর অর্থ ভোর হতে বেশি দেরি নেই। সিগারেট ধরিয়ে ফোনটা পকেট থেকে বার করলাম।

একে একে সকলের সঙ্গে কথা বললাম। ধীরে ধীরে সবাইকে কাজ বুঝিয়ে দিলাম। শুতে যখন এলাম, দেখলাম পূব আকাশটা সামান্য ফর্সা হয়েছে। শ্যাম-শিবু ঘুমিয়ে পরেছে।

আমি খাটিয়াতে টান টান হয়ে শুলাম।

সাত-পাঁচ চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পরলাম।

হাসাহাসির শব্দে ঘুম ভাঙলো।

দেখলাম উপুর হয়ে শুয়ে আছি। আমার চারপাশে অনেকগুলো খালি খাটিয়া। রোদের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে আটটা সাড়ে আটটা বেজে গেছে।

উঠে বসলাম। মিত্রারা ধারে কাছে নেই।

ইসলামভাইদের হাতে দেখলাম শালপাতার ছোট ছোট থালাতে মুড়ি-ঘুগনি।

হেসে ফেললাম।

টিফিনটা দারুন, বুঝলি অনি।

মেনুটা কার।

বলতে পারবো না। তবে চূড়া বেশ ভাল রেঁধেছে।

তোমাদের খাওয়া দেখেই বুঝতে পারছি।

ইসলামভাই হাসছে।

বড়োমারা কোথায়?

পূজো দিতে গেছে।

আবার পাহাড়ে চড়েছে!

কি করবি। বারন করলাম, শুনলো না।

আন্টিও গেছে?

সবাই।

অনুপদার দিকে তাকালাম। মিটি মিটি হাসছে।

কালকে খুব মজা দেখলি। কি বল?

আমি কোথায় দেখলাম, তোমরা বরং দেখলে, দেখালে দুটোই করলে।

ইকবালভাই জোড়ে হেসে উঠলো।

রতনরা কোথায়?

স্নান করতে গেছে।

কোথায়?

কাছা কাছি নদী আছে বললো।

জল নেই।

যে টুকু আছে ওতেই করবে।

তোমরা?

আমরা ইঁদারার জলে করে নিয়েছি। কি ঠাণ্ডরে। শরীরটা একবারে ঝড়ঝড়ে হয়েগেল।

আমি উঠে দাঁড়ালাম।

শ্যাম বললো, তুই কোথায় বেরবি? অনুপদা বললো।

ছোট্ট একটা কাজ আছে।

তুই থাকলে ভালো হতো।

আমি থাকলে যা হবে, না থাকলেও তাই হবে। কথা বলো।

কখন ফিরবি?

দুপুরে খেয়ে দেয়ে রওনা হবো।

ঠিক আছে।

আমি ভেতরে এলাম। দেখলাম ময়না-চূড়া আদল গায় রান্না করছে।

তুই কতবা উঠলু? চূড়া আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

এই তো কিছুক্ষণ আগে।

বউমনি জামা-প্যান্ট গুইছে রাইখছে।

কোথায়?

ঘরকে খাটের উপর।

ওদের সঙ্গে কে আছে?

সে আর দারু গেছে, চম্পা-বিষাণ আইছে।

আমাকে একটু চা দে।

মু ধো আইগে।

ময়না হাসছে।

হাসছিস কেন?

বউমনি ঠিক কইছে।

কি বলেছে, উঠেই চা চাইবে, দিবি না।

ময়না হাসছে।

আমি ঘরের ভেতরে এলাম। জামাপ্যান্ট খুলে টাওয়েলটা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে এলাম।

যাক শ্যামের কিছুটা বুদ্ধি হয়েছে। বাথরুম না বানালেও চট দিয়ে কিছুটা জায়গা ঢেকে দিয়েছে। একটা নিমডাল ভেঙে দাঁতটা একটু ঘসে নিলাম। ইঁদারার জলে ভাল করে স্নান করলাম।

ঘরে এলাম। ছোট্ট চৌকির ওপর জামাকাপর ডাঁই করা আছে। আমারটা যদিও আলাদা করে রাখা আছে দেখলাম। গেঞ্জি, প্যান্ট চরালাম। ময়না ঘরে উঁকি মারল।

চা লেইসি।

চল বাইরে যাচ্ছি।

ছেড়ে রাখা জামা প্যান্টের পকেট থেকে সমস্ত মালপত্র বার করে পকেটে ভরলাম। মোবাইলটা অন করলাম। সুকান্ত ম্যাসেজ করেছে। পড়ে নিলাম। নিজেই ফোন করলাম সুকান্তকে।

হ্যাঁ দাদা বলো।

সব গুছিয়ে নিয়েছিস?

হ্যাঁ।

সব তোর পকেটের লোক?

হ্যাঁ।

মনীশ কোথায়?

শুনলাম কাল রাতে ফেরেনি।

মোবাইলে ধরার চেষ্টা করেছিস?

স্যুইচ অফ পাচ্ছি।

বাকি কাজ?

সব সেরে নিয়েছি।

অর্ক, অরিত্র যোগাযোগ করেছিল?

অর্কদা করেছিল। অরিত্রদা ম্যাসেজ করেছে।

আমার ওখানকার কোনও খবর?

আমর পকেটের ওসিকে ওই থানায় আপাততঃ বসিয়েছি। আজ সঙ্গে আছে।

ভীমপুরের খবর?

কাল রাতে বডি পোস্টমর্টেম করে হ্যান্ডওভার করে দিয়েছি।

কেশ স্টার্ট করেছিস?

ওরা একটা ডাইরী করেছে।

কার কার নাম আছে?

সব ফালতু ছাড়ো।

তোর টিমটা ঠিক ঠিক কাজ করবে?

তুমি যখন দায়িত্ব দিয়েছো। সুকান্ত এক বিন্দু মাটি বিনা যুদ্ধে ছাড়বে না।

মাথায় রাখবি জীবন্ত ধরতে হবে।

তাই হবে।

ভালো স্যুটার আছে?

আছে।

খবর লিক হয়নি?

আমি ছাড়া এখনও কেউ জানে না।

ঠিক সময় ম্যাসেজ পাঠাব।

আচ্ছা।

ফোনটা অফ করে বাইরে এলাম। বেশ হইচই-এর শব্দ পেলাম।

ময়না আমার দিকে তাকাল। ফুন হলো।

হ্যাঁ। আবার কে এলো?

কেউ আসে লাই, বড়োমা ফিরছে। তাই সক্কলে চেঁচায়ঠে।

একটা চাটাই দে এখানে বসি।

ময়না উঠে এলো।

তোর ছেলেটাকে দেখালি না।

তুর পাশে পাশে ঘুরেঠে।

না চেনালে চিনব কি করে।

ঠিক আছে আইসু দেখাইঠি।

শিবুরটা।

সেও তানকার সঙ্গি আছে। চা লেই আসি।

দাঁড়া বড়োমা পূজো দিয়ে এলো, প্রসাদ খাই।

আমাদের কথা বলার মধ্যেই বড়োমারা সবাই ভেতরে এলো।

সবার মাথায় লাল টিপ। রতনরাও বাদ নেই।

আমি দেখে হেসে ফেললাম।

হাসবে না। ধর্ম কি তোমার একার। রতন বললো।

তোরা নাকি নদীতে স্নান করতে গেছিলি?

কি ঠাণ্ডা জল গো। চাঁদ বললো।

শীত করছিল নাকি?

এই শুরু করলে।

ওখানের থেকে এখানে শ্রোতটা একটু বেশি। চিনা বললো।

তোরা একা না আর কেউ ছিল?

ভাইপোরা ছিল।

আমার কথা বলার ফাঁকেই বড়োমা তার কাজ সেরে যাচ্ছে। মাথায় ফুল ছুঁইয়েছে। টিপ পরিয়েছে। অটোমেটিক হাঁ করেছি। শুকনো চিঁড়ে একটু জল ঢেলে দিয়েছে। তারপর গিঁট মারা কাপরের খুঁটটা মাথায় বুলিয়ে দিল।

হেসে ফেললাম।

মারাংবুরুর কাছে কি চাইলে?

তোর মাথাটা ঠান্ডা করে দিক।

ব্যাস।

ছোটোমা পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।

তার পেছনে দামিনীমাসি, জ্যেঠিমনি। বৌদি, আন্টিকে দেখতে পেলাম না।

সুরোরা হই হই করতে করতে ঢুকলো। বড়োমাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াল।

দাঁড়া না সেই তখন থেকে শুরু করেছিস। কোস্তাকুস্তি আর বন্ধ হয় না।

তোমার ছেলেটা যে তেঁদর সেটা বোঝ না।

সুরো ঝগরুটে মেয়ের মতো কোমড়ে কাপর পেঁচিয়ে কথা বলতে শুরু করেছে।

বড়োমা হেসে ফেললো।

কাল রাতে অতোটা গিললি কেন। কে বলেছিল গিলতে।

সুরো ফিক করে হেসে ফেললো।

মিলিরা যে মোশান নিয়ে কথা বলতে এসেছিল থেমে গেল।

ইসারা করছে বড়োমা যাক তারপর তোমাকে ধোব।

মুন্না বললো তুই কোথায় যাবি। ছোটোমার দিকে তাকালাম।

একটু ডোবাগিরি যাব।

সেটা কোথায়?

ওই পাশের পাহাড়ে।

কেন?

দরকার আছে।

কখন ফিরবি?

দুপুরে খেয়ে বেরবো। রাতের মধ্যে কলকাতা ফিরবো।

দামিনীমাসি হাসছে।

হাসছো কেন?

যাওয়ার পথে একটু মনসামন্দিরে পূজো দেব।

ঠিক আছে দিও।

ময়না চায়ের কাপ নিয়ে এলো।

কিরে চূড়া মুড়ি ঘুগনি গেল কোথায়?

নীরুর গলা পেয়ে তাকালাম। আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।

তোর সঙ্গে হিসেবটা পরে করবো।

মিত্রা তনুকে এখনও দেখতে পেলাম না। বুঝলাম তারা বাইরের খাটিয়াতে বসে পরেছে।

ময়না আমার দিকে তাকাল।

তুই দুটা খাবি?

একটু মুড়ি দে, আর কিছু খাব না।

চম্পারা ভেতরে এলো। ধুপ ধুপ করে সব পায়ে পরে গেল।

দেখতি চাইছিলু এবার দ্যাখ।

ময়না আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।

সবকটা তোর?

ময়ন হেসে গড়িয়ে পরে।

সব মোর হতি যাবে কেন। মোর দুটো শিবঠাকরের একখান।

শিবুরটা কোনটা।

একটা কালো মতো ছেলে কাছে এগিয়ে এলো।

মাথা নীচু করে দাঁড়াল। একবার চম্পার মুখের দিকে তাকাই একবার শিবুর ছেলেটার মুখের দিকে তাকাই। দু-জনেই মিটি মিটি হাসে।

চূড়া আজ কি মুরগী না ছ্যাগল?

আমার কথা শুনে সবাই হেসে উঠলো।

চম্পা ওর নাম কি?

চম্পা মাথা নীচু করে হাসে।

দু-জনে দু-জনের দিকে তাকায় আর হাসে।

নাম কইতে পারুনি। বোবা হয়ে মরছু। ময়না চেঁচিয়ে উঠলো।

আকা জানে।

এইবার শিবুর ছেলের গলা পেলাম।

ময়নার ছেলে দুটো হাসে।

তনু আজ বাবু ঠিক ঠিক জামাপ্যান্ট লাগিয়েছে। নিজের ইচ্ছে মতো পরেনি।

এতক্ষণে তনু, মিত্রা ভেতরে এলো।

ময়নারে, ভীষণ খিদে লেগেছে।

তুমান্যে এক জাগাতে বুইসো দেইঠি।

তোকে আর বুইসতে হবেনি হাতে হাতে দে খেয়ে নিই।

আমি মিত্রার দিকে তাকিয়ে হাসলাম।

ময়নাও হাসছে।

কখন উঠলি।

ঘড়ি দেখিনি।

ছোটোমা দেখলাম কাপর ছেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।

চূড়া বার করে দে সকলকে দিই।

তুমি বুইসো মন্যে দেইঠি।

বক বক করিসনা। দে, হাতে হাতে দিয়ে দিই।

ছুড়কি ভেতরে এলো। কাছে এসে দাঁড়াল।

আকা বরাইবো।

হ্যাঁ। তোরা রেডি।

হ।

একটু চাঁদ আকাকে ডাক।

ছুড়কি বেরিয়ে গেল।

মিত্রা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

আমি পাত্তা না দিয়ে চায়ে চুমুক দিচ্ছি।

তনু, মিত্রার মুখের দিকে তাকিয়ে।

এখন বেরবি? মিত্রা বললো।

হ্যাঁ।

এখুনি ফিরে আসবি?

ঘণ্টা খানেক পর ফিরবো।

চাঁদ ভেতরে এলো।

ডেকেছো।

হ্যাঁ। খেয়েছিস?

চাঁদ মাথা দলালো।

রতন, চিনা কোথায়?

বাইরে।

ওরা খেয়েছে?

খাচ্ছে।

তোরা তিনজনে আমার সঙ্গে একটু যাবি।

আমার গলার স্বরে চাঁদ আমার মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকাল।

রেডি হয়ে নিই?

যা।

চাঁদ দাঁড়াল না।

মিত্রা আমার চোখ থেকে চোখ সরায়নি।

নম্রতা কোথায়?

বাইরে।

নয়না?

সবাই বাইরে বসে গল্প করছে।

আমি চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম।

মিত্রা আমার হাতটা চেপে ধরলো। সবাই সবার মতো ব্যস্ত। কেউ খেয়াল করলো না।

তোর চোখটা ভাল লাগছে না। মিত্রা চাপা স্বরে বললো।

হেসে ফেললাম।

হাসিস না। তোর এই চোখটা কাল রাতের থেকেও হিংস্র লাগছে।

বাবাঃ খুব পড়তে শিখেছিস দেখছি।

আমি তোর সঙ্গে গেলে অসুবিধে আছে?

তোকে নিয়ে যাবার ইচ্ছে ছিল। ঠিক আছে, যদি প্রয়োজন পরে লোক পাঠাব।

প্রমিস করছিস।

বললাম তো, প্রয়োজন পরলে, নিশ্চই লোক পাঠাব।

বেরিয়ে এলাম।

রতন দেখেই এগিয়ে এলো।

রেডি।

হ্যাঁ।

ইসলামভাই দেখলাম তাকিয়ে আছে আমার মুখের দিকে। পাত্তাই দিলাম না। নীরুরা দেখলাম মুড়ি খাচ্ছে। হাত তুলে বললাম, আমি একটু ঘুরে আসছি।

কনিষ্ক আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলো।

ছুড়কি কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।

শিবু কোথায়?

সেউঠি চলি ইছে।

চল। গাড়ি কোথায় রেখেছিস?

এখাননু ছোটো ঝোড়া পর্যন্ত হাঁটি যাই, সেঠিনু গাড়ি লিয়ে যাব।

তাই চল।

শ্যাম, দারু দুজনের কেউ কাছে এলো না। চেয়ে চেয়ে দেখলো।

আমরা পাঁচজন হাঁটতে শুরু করলাম।

কিছুটা এগিয়ে এসেই পাহাড়ে চড়তে শুরু করলাম।

হাঁটতে হাঁটতেই ছুড়কিকে জিজ্ঞাসা করলাম।

কিছু পেলি?

হ।

কি পেলি?

চন্দ্রের লোক।

তোর বাপ যে অন্য কথা বলে।

মিছে কথা কইছি।

আর একটাকে যে ধরেছিস।

চিনতি পারি লাই।

আশেপাশে আর আছে।

দেখি লাই, ভলিকে কয়া দিছি চেনা মুখ না দেখলি কথা কইবি, বুইঝতে না পারলি মারি দিবি।

বিষাণ কোথায়?

সকালনু মোর সাথে দেখা হয় লাই। একবার ফোন করছিলি কইলো কাজ আছে।

আমি যে ওখানে যাব, বলেছিলি?

কইছে সেরকম বুঝলি খপর দিতে।

একটু ওপরে উঠে আসতেই দেখলাম অনেকগুলো ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ খালি হাতে নেই।

গতকাল আসার সময় এদের গাড়ির মাথায় দেখেছি।

আমাকে দেখেই সব নড়ে চড়ে দাঁড়াল।

চাঁদ আকা তুমান্যে এক একটাতে বুইসে পরো। আমি অনি আকাকে লিতেছি।

চাঁদের মুখের দিকে তাকালাম। চোখ মুখের পরিবর্তন হয়েছে।

হেসে ফেললাম।

সব সময় গরম খেলে চলে।

কেশটা কাল রাত থেকে চলছে। নেহাত লোভে পরে খেয়ে ফেলেছিলাম।

তোকে কে খবর দিল?

সকালবেলা ঘুম ভাঙতে দেখি তুমি আমার মাথার শিয়রে খাটে শুয়ে। ধরফর করে উঠে বসলাম।

তারপর দেখি শ্যামদা, শিবুদা তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে বসে আছে।

চোখ মুখটা ভাল দেখলাম না। তারপর চেপে ধরলাম, কাল রাতের ঘটনা শুনলাম। রতনদা, চিনাকে সব বললাম। আবিদকে বললাম খোঁজ লাগা, আমাদের দলের কেউ কিনা। ও বলতে পারল না। ওমরও বলতে পারল না। এখন ছুড়কি বলছে চন্দ্রশেখরের লোক।

রতন যেখানে যাচ্ছিস পরিচিত কাউকে দেখলে মাথা গরম করবি না। মাথা ঠাণ্ডা রাখবি।

তারমানে তুমি যেখানে নিয়ে যাচ্ছ সেখানে আমাদের পরিচিত লোক আছে।

থাকলেও থাকতে পারে।

ধৈর্যের একটা সীমা আছে।

ওটা আরও বাড়াতে হবে।

তুমি পার আমাদের রক্তে সে কথা লেখা নেই।

তাহলে তিনজনে এখান থেকে ফিরে যা।

এসেছি যখন ফিরে যেতে নয়।

চিনা আমার দিকে তাকিয়ে।

আমি হেসেফেললাম।

আমি ছুড়কির বাইকের পেছনে উঠলাম। গঁ গঁ শব্দ করতে করতে বাইক চড়াই উতরাই পেরিয়ে চলতে শুরু করলো। কখনও খুব ধীরে ওপরের দিকে উঠছে, নামার সময় একটু তাড়াতাড়ি নামছে। পাথর বেছানো পাহাড়ি পথ। এঁকে বেঁকে চলেছে।

চারিদিক সবুজ। নিস্তব্ধ। একমাত্র গাড়ির গোঁ গোঁ শব্দ ছাড়া কিছুই শোনা যাচ্ছে না।

আমি ছুড়কির কাঁধটা ধরে রয়েছি।

ডোবাগিরিতে আসতে প্রায় মিনিট পনের সময় লাগল।

এখান থেকে গাড়ি আর ওপরের টিলাটায় যাবে না। হেঁটে ওপরে উঠতে হবে। খাঁড়াই পথ।

অরণ্যের এই অঞ্চলটা অনেক গভীর। একা এই অঞ্চলে আসা সত্যি বিপজ্জনক।

বিষধর সাপ আছেই, অনেক নাম না জানা পোকা মাকড়ও আছে, কামড়ে দিলে শরীর বিষিয়ে যায়। তারওপর ভালুকের উপদ্রব এই অঞ্চলে অত্যাধিক বেশি।

গাড়ি থেকে সকলে নামলাম।

চাঁদ, চিনা, রতন চারদিক চেয়ে চেয়ে দেখছে। যত দেখছে তত ওদের চোখে মুখে বিষ্ময় ফুটে উঠছে।

বড় বড় শালগাছের মধ্যে দিয়ে শরু পথ ওপরের দিকে উঠে গেছে।

ছুড়কি ঠোঁট দুটো চেপে ধরে জোড়ে সিটি বাজাল। একবার, দুবার, তিনবার।

তিনটে শব্দ তিনরকম। কিছুক্ষণের মধ্যে চারদিক থেকে সিটির প্রতিধ্বনি এলো। চোখ মেলে তাকিয়েও কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। ভাঁজ করা পাহাড়ের শরীরে শব্দের মূচ্ছর্ণা আছাড় খেতে খেতে মিলিয়ে গেল।

আকা হানিফ আকাকে এইকবার ফুন করবে?

কেন, তুই বলিসনি।

কাইল রাতে আসছিলি তুমি আইসছো কইছি, এইখানে আইসবে কইনি।

ওদের সম্বন্ধে কিছু বলেছিস।

না।

সিগন্যাল কি ওর কাছে পৌঁছেছে?

খপর চলি যাবে।

আমি এসেছি সেটা জানবে?

তান্যে জানি দিবে।

চল ওপরে উঠি।

রতন, চাঁদ, চিনা আমাকে ঘিরে রয়েছে। ওরা এক দৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে ছুড়কির দিকে।

আমরা লাইন করে সকলে ওপরে উঠতে শুরু করলাম। একটু ওপরে আসতেই ঝোড়াটা পেলাম।

তির তির করে আপন খেয়ালে বয়ে চলেছে। কোনখান থেকে বয়ে আসছে কোন খানে গিয়ে মিশেছে বলা মুস্কিল। মুখে চোখে জল দিলাম। আর একটু ওপরে উঠতেই সামান্য সমতল ভূমি।  চারদিক নিবিড় অরণ্যে ঢাকা পড়েছে। ছোট ছোট তিনটে ঘর। আমি ওপরে উঠতেই হানিফ ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো। আমিও ওকে জড়িয়ে ধরেছি।

তোমাকে দু-বছর পর চোখের দেখা দেখছি।

মুখ থেকে কথা বার হলো না। কিছুক্ষণ ওকে বুকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।

তোকে অনেক কষ্ট দিলাম।

তুমি আছো, কষ্ট কিসের।

আজ থেকে তোর ছুটি।

আমি ছুটি চাই না।

দূর পাগলা সে বললে চলে। আমার কাজ হয়ে গেছে। এবার অন্য কাজ করতে হবে। অনেক বড়ো কাজ। তার দায়িত্ব নিতে হবে।

হানিফ আমার বুকের থেকে মুখ তুললো।

এদের চিনিস?

রতনরা হানিফের দিকে তাকিয়ে।

রতন এ হচ্ছে হানিফ। তোদের মতো ও আমাকে ভীষণ ভালোবাসে। ভালোবাসে বলেই এই গহীণ অরণ্যে আজ এত বছর কাটিয়ে দিল।

হনিফ এরা হচ্ছে রতন, চাঁদ, চিনা।

হানিফভাইয়ের নাম নেপলার মুখ থেকে শুনেছি। চাঁদ বললো।

তোকে তবু নেপলা দু-একটা কথা বলে, আমাকে কিছুই বলে না। রতন বললো।

আমি রতনের দিকে তাকিয়ে হাসলাম।

ওরা কোথায়? হানিফের দিকে তাকালাম।

সব ওপরের টিলায়।

ঠিক ঠাক আছে?

মস্তিতে আছে।

তাহলে তোর কোনও টেনসন নেই?

না।

কাল যে দুটোকে ছুড়কি রেখে গেছে।

ও দুটোকে সামনের ঘরে রেখেছি।

স্নান-খাওয়া দাওয়া করেছে?

হ্যাঁ। রেডিও শুনছে।

ছুড়কি আমার ঘরটা খোল।

তোমার আবার এখানে ঘর আছে নাকি? চাঁদ বললো।

কেন থাকবে না। একটা সময় এখানে কম বেশি আসতাম।

ছুড়কি ঘর খুললো। একটা ছোটো কাঠের টেবিল, ছোটোখাট একটা কাঠের চেয়ার, আর তিন বাই ছয় একটা খাট। সবই এই অরণ্যের কাঠে তৈরি।

টেবিলের ওপর সেই সোলার ল্যাম্পটা রয়েছে।

মাটির তৈরি ছোট ঘরটা যেমন দেখেগেছিলাম সেরকমই আছে। খাটটায় একটা মাদুরের ওপর টান টান করে একটা পাতলা বেডসিট পাতা। বুঝলাম খুব একটা ব্যবহার হয় না।

রতনরা চারদিক চেয়ে চেয়ে দেখছে। যত দেখছে তত অবাক হয়ে যাচ্ছে। ওদের চোখের তৃষ্ণা যেন আর মেটে না।

আমি খাটে একটু টান টান হয়ে শুয়ে পড়লাম। হানিফ আমার পায়ের কাছে বসলো।

তুমি এই ঘরে থাকতে! চাঁদ চারদিক চেয়ে চেয়ে দেখছে।

হ্যাঁ।

কবে!

বছর দু-এক আগে শেষ এসেছিলাম সেবার দিন পনেরো ছিলাম।

রতনের আর কিছুতেই ঘোর কাটছে না।

হানিফ।

বলো।

তোর বউমনি, তনুদি আসতে চাইছে নিয়ে আসবো।

কেন নিয়ে এলে না। বউমনিকে এখনও দেখিনি। তনুদিকে সেই দুবাইতে শেষ দেখেছি।  

ঠিক আছে আজ তোকে সবাইকে দেখিয়ে দেব।

বউমনিকে তুমি নিয়ে এসো। অন্ততঃ নিজের চোখে দেখে যাক তুমি একটা সময় কোথায় এসে রাতের পর রাত কাটাতে।

ফোনটা পকেট থেকে বার করলাম। মিত্রাকে ডায়াল করলাম। সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা রিসিভ করলো।

হ্যালো, কোথায় আছিস!

যেখানে আসার ছিল সেখানে এলাম। তুই কি করছিস?

কি করবো। তুই যাবার পর থেকে আমার মাথার একটা চুলও কেউ আস্ত রাখল না। যতো দোষ আমার আর তনুর। আমি আর তনু যুক্তি করে তোকে এই পথে চালিত করেছি।

শোন, আসবি এখানে?

এখুনি যাব।

বাইকে করে আসতে হবে। পারবি?

পারবো।

তাহলে এক কাজ কর।

বল।

তুই, তনু, নম্রতা আর নয়না চলে আয়। আমি লোক পাঠাচ্ছি। রেডি হয়ে নে, পাঁচ মিনিটের মধ্যে ওরা পৌঁছে যাবে।

আমি রেডি তুই লোক পাঠা।

হাসলাম।

বড়োমা কথা বলবে।

এখন না, তোরা এলে কাজ শুরু করবো। কাজ শেষ করে এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে।

আচ্ছা।

আমি ফোন অফ করার সঙ্গে সঙ্গে হানিফ ছুড়কি বলে চেঁচিয়ে উঠলো।

ছুড়কি ঘরের কাছে এসে বললো, অনি আকার জন্যি চা করতি কইছি।

আমি ওকে ভেতরে আসতে বললাম। ছুড়কি ভেতরে এলো।

তুই একটা কাজ কর।

বইলো।

ওখানে গিয়ে মামনিকে নিয়ে আয়। ওরা চারজন আসবে। বোনকে বলে দে বোন যেন ওদের এগিয়ে দিয়ে যায়।

ছুড়কি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল।

রতন তোদের ফোনগুলো অফ করে আমাকে দে।

কেন!

দরকার আছে।

তুমি আবার নতুন কোন ঘুটি বসাচ্ছ।

বসাচ্ছি।

ওর হাসতে হাসতেই ফোনগুলো পকেট থেকে বার করে স্যুইচ অফ করে আমার হাতে দিল।

আমি হানিফের হাতে দিয়ে বললাম টেবিলের ওপর রাখ।

হানিফ হাসছে।

হানিফ বাইরে বেরিয়ে যাদের কাছে মোবাইল আছে। সবকটার মোবাইল অফ করে আমার কাছে দিয়ে যেতে বল।

ছুড়কিরটা?

এই মুহর্তে ওর কাছে থাক। ফিরে এলে নিয়ে নিবি।

হানিফ হেসে যায়। বাইরে বেরিয়ে গেল। রতনরা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

জরুরি ফোন এলে কি করবো? রতন বললো।

এলে আসবে। যার দরকার সে পরে আবার যোগাযোগ করে নেবে।

আমি ফোনটা বার করে আবার ডায়াল করলাম। বিষাণ বেশ কিছুক্ষণ রিং বাজার পর ধরলো।

কোথায় আছিস?

লিচে এয়েছি। উপরকে উঠতিছি।

দাদার সঙ্গে দেখা হলো?

হ। কইলো তুমি কাই যাইতে কইছো।

তোর সঙ্গে যাদের আসার কথা ছিল তারা এসেছে?

হ আসছে।

আর কাউকে খুঁজে পেলি?

না পাই লাই।

চারদিক শিল করে দিয়েছিস?

করছি।

আমি ফোনটা কেটে দিলাম।

হানিফ দু-হাত ভরে মোবাইল নিয়ে এসে টেবিলের ওপর রাখলো। হেসেই যায়।

এটা তোমার কি স্কিম বলো? চাঁদ বললো।

দাঁড়া শেষ পর্যন্ত দেখতে দে তারপর বলছি। রতন বললো।

আমি মুচকি মুচকি হাসছি। চা এলো। সবাই চা খাচ্ছি। গল্প করছি।

একটু হৈ হৈ-এর শব্দে বাইরের দিকে তাকালাম। হানিফ বেরিয়ে গেল। এই তো হানিফভাই।

অভিমন্যুর গলা পেলাম।

দাদা কোথায়?

ভেতরে।

বাবাঃ এ কি জায়গারে। পুলিশের বাবার ক্ষমতা নেই কাউকে এখান থেকে তুলে নিয়ে যায়। আলতাফের গলা পেলাম।

ওরা সকলেই মারাঠি-হিন্দীতে কথা বলছে।

দাদা সব শুনছে। হানিফ বললো।

ছাড়তো। আলতাফ হাসছে।

একে একে সব ভেতরে এলো।

আপ্পে দাদাকে দেখবি আয়। কি বিন্দাস হয়ে শুয় আছে। আলতাফ চেঁচিয়ে উঠলো।

আমি শুয়ে ছিলাম উঠে বসলাম।

আলতাফ ঘরে ঢুকে টেবিলের দিকে চোখ পড়তে হেসে ফেলল।

ভিকু দাদার অবস্থা দেখ। আলতাফ বললো।

ওরা সকলেই হাসছে।

বাবাঃ তুমি কি মোবাইলের দোকান করবে নাকি? ভিকু বললো।

হ্যাঁ। তোদের মোবাইলগুলো স্যুইচ অফ করে ওখানে রাখ।

কেন! শুনি আগে?

তাহলে নিচে চলে যা।

তোমার বন্ধুটার সঙ্গে আলাপ করাবে না?

কোন বন্ধু?

তোমার যে বন্ধুকে এখানে গচ্ছিত করে রেখেছ।

করাবো।

আলতাফ রতনের দিকে তাকাল।

তোমাদের মোবাইল কোথায়?

টেবিলের ওপর। সব স্যুইচ অফ।

তাই বলি ফোন করে তোমাদের পাচ্ছি না কেন।

আলতাফ আর ভিকু আমার দু-পাশে দু-জনে বসলো।

জল খেয়েছিস?

হ্যাঁ ঝর্ণার জলটা কি মিষ্টি। মুখে চোখে দিতে শরীরটা ঠাণ্ডা হয় গেল।

ফোনটা টেবিলে রাখ।

রাখছি। খোলা থাক। বস ফোন করতে পারে।

ম্যাসেজ করে বলে দে ঘণ্টা খানেক ফোন বন্ধ থাকবে।

তুমি না বহুত….।

অনিদা আমি রেখে দিলাম। অভিমন্যু হাসতে হাসতে বললো।

এই যে ঘরে ঢুকলি আমি না বলা পর্যন্ত বেরতে পারবি না।

সকলে হাসা হাসি করছে।

হানিফভাই এখানে চা পাওয়া যাবে না?

হচ্ছে দাঁড়াও, চলে আসবে।

বিষাণ ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। আমি ওর দিকে তাকালাম।

কিছু বলবি?

হ। তুমি বাইরকে এইসো।

আমি উঠে বাইরে এলাম।

খোলা আকাশের তলায় এসে দঁড়ালাম। ঝিরঝির করে বাতাস বইছে। গাছের পাতায় শির শির আওয়াজ তুলে জানান দিচ্ছে আমরা সকলে বহাল তবিয়েতে আছি। তুই কেমন আছিস?

বিষাণ ফিস ফিস করে উঠলো।

হাইরুডে অনেকগা গাড়ি দেখলি।

কিসের গাড়ি?

বুঝি লাই।

লোকজন দেখলি?

ভাল ঠেইকলো নি। তুমান্যে আজ যেউ পাশ দিয়ে আসছো, সেউ পাশ দিয়ে যাও।

ও পাশের খবর নিয়েছিস?

সেউপাশে কেউ লাই।

তোর লোক জন ওখানে আছে?

আইছে।

শিবু কোথায়?

শিবুআকা উপরে।

ঠিক আছে একটু চায়ের ব্যবস্থা কর।

ওন্যে করতিছে।

তুই এখন যা।

তবু বিষাণ মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলো।

কিছু বলবি?

না থাক পরকে কইবো।

জরুরি থাকলে বল।

ওনকার সঙ্গি আরও লুক আসছে। তান্যে ধূলাগড়ির দিকে চলিইছে।

ঠিক দেখেছিস!

হ।

তুই দেখেছিস না কেউ খবর দিল।

আমার লোক হাইরুডে আইছে।

ঠিক আছে। তুই খবরা খবর নে।

আমি ভেতরে এলাম।

আলতাফরা খুব হাসাহাসি করছে।

আচ্ছা অনিদা তোমাকে একটা কথা বলবো?

বল।

কালকের ওই একটা ছোট্ট ঘটনার জন্য তুমি এখানে সকলকে ডাকলে কেন। চাঁদ, চিনাই তো যথেষ্ট ছিল। আলতাফ বললো।

তুই এখানে আগে কখনও এসেছিস?

হাইওয়ে পর্যন্ত।

তারপর।

ফিরে চলেগেছি।

প্রথমবার এসেছিলি শ্যামের সঙ্গে মিটিং করতে সেই সময় চিকনা ছিল।

সে তো এই জায়গা নয়।

এই জায়গা। আর একটা পথ দিয়ে তোকে ঢোকান হয়েছিল।

আলতাফ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

দ্বিতীয়বার এসেছিলি প্রিয়দর্শিনী আর ন্যান্সিকে রাখতে।

সেটাও এই জায়গা!

আলতাফের দিকে তাকিয়ে হাসলাম।

শ্যাম একটা টিলার ওপর দাঁড়িয়েছিল। তোমার কথা মতো আমি ওর হাতে পৌঁছে দিয়ে চলে যাই।

হুঁ। তুই এই রাস্তায় কখনও এসেছিস?

বললাম তো হাইওয়ে দিয়ে গেছি ভেতরে ঢুকিনি।

এখন তোকে বাইক দিয়ে ছেড়ে দিলে ফিরে যেতে পারবি।

আলতাফ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

কি ভাবছিস?

ভাবছি বস কেন তোমাকে এত ভালোবাসে। আর তোমাকে কোনও প্রশ্ন করবো না।

কেন প্রশ্ন করবি না। প্রশ্ন না করলে জানবি কি করে?

তুই যেখানে বসে আছিস এটা এক তলা। পেছনের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একটা রাস্তা আছে ওই রাস্তায় গেলে পরবে দু-তলা। ঠিক ওইভাবে আর একটা রাস্তা আছে সেটা তিনতলা পর্যন্ত গেছে।

তুই যাদের সেদিন হ্যান্ডওভার করে গেছিস তাদের আমি তিনতলায় রেখেছি।

তারা এখানে আছে!

আলতাফ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

তারা ওপেন এয়ারে আছে। এইরকম দুটো ঘর আছে। নিচ থেকে তুই যেমন এই ঘরগুলো দেখতে পাসনি। ওপরেরগুলোও দেখতে পাবি না। তার ওপর চারিদিকে রয়েছে বিষধর সাপ। একটা ছোবল মারলে মিনিট পাঁচেক আয়ু। আর ভাল্লুক….। না থাক।

রতন মুখ টিপে হাসছে।

রতনকে জিজ্ঞাসা কর আসার সময় দেখেছে। নদীতে জল খেতে নেমেছিল, পুরো পরিবার।

আলতাফ, রতনের দিকে তাকিয়েছে।

তোর ওই সব রিভালবার-টিভালবার এখানে চলবে না বুঝলি আলতাফ।

অভিমন্যু, ঝিনুক আমাকে যেন গিলে খাচ্ছে।

হানিফকে আজ ছুটি দিয়ে দেব, পারলে ওর কাছ থেকে গল্প শুনে নিস।

নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত গোটা পঞ্চাশ ছেলে আছে, কজনকে চোখের সামনে দেখলি?

সব কিন্তু এই সব বড় বড় গাছে মাচা করে রয়েছে। তুই যে এসেছিস তা ওরা জানে। অপরিচিত কেউ হলে সিগন্যাল দেবে। যদি তুই সিগন্যালে সারা না দিস ওখানেই তোর শরীরটা পড়ে থাকবে। নড়বার সময় পাবি না।

আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম। আলতাফ খাট থেকে উঠে এসে জড়িয়ে ধরলো।

আর তোমাকে বলবো না।

আমি আলতাফকে জড়িয়ে ধরে খাটে এসে বসলাম।

বিষান চায়ের মগ মাটির ভাঁড় নিয়ে এসেছে।

তুই বাইরে থাক। চাঁদ ওর হাত থেকে মগটা নিয়ে সকলকে দে।

মামনি আইসেঠে।

কতদূর পর্যন্ত এসেছে?

ঝোড়া পর্যন্ত আইসে বুইসে পরছে।

যা ধরে ধরে নিয়ে আয়।

বিষাণ চাঁদের হাতে মগটা দিয়ে চলে গেল।

বৌদি আসছে। আলতাফ আমার মুখের দিকে তাকাল।

হ্যাঁ।

চাঁদ চা দিল।

ওরা আসছে, একটু রাখিস।

অনেক আছে।

হানিফ, শিবুকে খবর পাঠা ওদের নিয়ে আসুক।

আগে একতলার কাজটা সেরে দাও।

নিয়ে আয়। আর শোন।

বলো।

ওর কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে আয়।

তুমি তো ওকে কাল রাতে দিতে বললে।

দিয়ে দিয়েছিস?

হ্যাঁ।

ভাল করেছিস।

মিত্রা, তনু ঘরের ভেতরে এলো। নম্রতা, নয়না তখনও ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে।

কপালে চিক চিক করছে ঘামের বিন্দু। এই টুকু ওপরে উঠতে হাঁপিয়ে পড়েছে।

আঁচল দিয়ে মুখ মুছলো।

ভেতরে ঢুকেই আমার মুখের দিকে একবার তাকাল তারপর চারদিক লক্ষ্য করছে।

আলতাফ, ভিকুরা উঠে দাঁড়িয়েছে।

এরা কোথা থেকে এলো!

মিত্রার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলাম। তুই এদের চিনিস?

মেয়ের কাছে সবার ছবি দেখেছি।

দিদি ফোনটা টেবিলে রেখে দাও। না হলে যদি ঢিসুম হয়ে যাই। তনু বললো।

কেন!

টেবিলটা একবার লক্ষ্য করো।

তনু কথাটা বলতেই চাঁদরা শরীর কাঁপিয়ে হেসে উঠলো।

চা খাবেন। রতন হাসতে হাসতে মিত্রার দিকে তাকাল।

দাঁড়াও, আবহাওয়াটা একটু বুঝে নিই।

মিত্রারা চারজন খাটে এসে আমার পাশে বসলো।

আলতাফরা দাঁড়িয়ে রয়েছে। এদের কথা বিন্দু বিসর্গ বুঝতে পারেনি।

আলতাফ, ছুড়কিকে বল ও ঘর থেকে একটা বেঞ্চি নিয়ে আসতে।

না আমরা দাঁড়িয়ে আছি। ভিকু বললো।

নয়না তুমি গিয়ে ওই চেয়ারটায় বসো।

না। আমি এখানে বসছি।

আমি বলছি বসো।

নয়না উঠে চেয়ারে গিয়ে বসলো।

অভিমন্যু, অনিদার বউকে দেখার সখ মিটেছে।

অভিমন্যু আমার মুখের দিকে তাকাল।

আমি একটু ছোঁব।

ছোঁ।

অভিমন্যু হাসছে। মিত্রা আমার মুখের দিকে তাকিয়েছে। বুঝতে পারেনি। মারাঠী হিন্দী মিশিয়ে ওদের সঙ্গে কথা বলছি। ওকে অভিমন্যুর সঙ্গে কি কথা বললাম বলতে ওরা হাসছে।

আপ্পে।

আপ্পে আমার মুখের দিকে তাকাল।

তোর ভাইঝি আর অনিকা সেদিন তোদের যে সব ছবি তুলেছিল সেই সব ছবি ধরে ধরে তোদের সবার বায়োডাটা দিয়েছে বৌদিকে।

আপ্পে জিভ বার করে ঝিনুকের পেছনে লুকিয়েছে।

ছুড়কি একটা বেঞ্চ নিয়ে এলো।

আকা বাইরকে বুইসলে হতোনি।

না থাক। আমি বললে ওদের নিয়ে আসবি।

আইচ্ছা।

আলতাফ সাগরের ডটার আর ওয়াইফকে আগে দেখেছিস?

না। এই প্রথম দেখছি।

তোকে যে কথা ওর সঙ্গে বলতে বলেছিলাম বলেছিস?

বলেছি।

কি বলেছে?

অস্বীকার করেছে।

অনাদি?

ন্যাকা সাজলো এইরকম কিছু একটা হয়েছে জানেই না।

আমি নয়নার দিকে তাকালাম। ওদের সঙ্গে কি কথা হলো তা বললাম। নম্রতার দিকে তাকালাম।

চলবে —————————–



from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/ekuDPfW
via BanglaChoti

Comments