কাজলদিঘী (১২৬ নং কিস্তি)

❝কাজলদীঘি❞

BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

১২৬ নং কিস্তি
—————————

তনু বলছে, তোমাকে ভালোবেসে আমি কি অন্যায় করেছি? সুন্দর বলছে, আমি তোমাকে কতটুকু পেয়েছি? মিত্রা বলবে, আমি তোর জিনিসকে এতদিন আগলে রাখলাম। এবার তোর জিনিস তোকে ফরত দিলাম, তুই বুঝে নে। ছোটোমা, বড়োমা বলবে, এই পৃথিবীতে আমাদের কে আছে বল তুই ছাড়া। দাদা, মল্লিকদা, ডাক্তারদাদা বলবে তুই বটগাছ তোকে আঁকড়ে ধরে শেষ কটা বছর বাঁচতে চাই। একটু শান্তি পেতে চাই। ইসলামভাই, ইকবালভাই, রতন, আবিদ, সাগির, নেপলা, অবতার সবাই সমস্বরে বলবে, কেন তুমি আমাদের এইভাবে বাঁচতে শেখালে, বেশতো ছিলাম।

আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি সন্দীপ। মনে হচ্ছে অনির মৃত্যু এর থেকে অনেক ভালো ছিল। তাই অনিকে নিজে হাতে মেরে ফেলতে চাই। অনির আবার পুনরজন্ম হোক।

আমি থামলাম। সন্দীপ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

জানিনা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ও কি পড়তে পারছে।

বুঝলি অনি, আমাদের জীবনটা একটা রঙ্গমঞ্চ। তুই তার একজন কুশীলব, রঙ্গমঞ্চের প্রয়োজনে তোকে অভিনয় করে যেতে হবে। কখনও তুই প্রেমিক, কখনও তুই পিতা, কখনও তুই স্বামী, কখনও তুই সন্তান, প্রত্যেকটা আলাদা আলাদা চরিত্র। সামাজিক দায়বদ্ধতায় এই চরিত্রগুলো নির্দিষ্ট করা আছে, তোকে এই চরিত্রগুলোয় নিপুন ভাবে অভিনয় করে যেতে হবে।

সন্দীপের দিকে তাকালাম।

পারছি না।

সেই জন্য মেয়ে তোর বুকের ভেতরের ঘুমিয়ে থাকা মানুষটাকে জাগিয়ে তুলছে।

জানিনা, তবে সেই মানুষটাকে আমি এখনও খুঁজছি।

মেয়ে চলে যেতে তুই খুব আপসেট হয়ে পরেছিস।

বলতে পারবো না। তবে সন্তান মাতৃহারা হলে যেমন দিশে হারা হয়ে পরে, আমিও যেন সেরকম কিছু একটা অনুভব করছি। যতক্ষণ প্লেনটা এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়েছিল কিছু মনে হয় নি। যখন প্লেনটা ডানামেলে আকাশে উড়লো, তারপর ধীরে ধীরে চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল, বুকের ভেতরটায় কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো। দাদারা যাওয়ার সময় এই অনুভূতিটা উপলব্ধি করিনি।

তুই তখন ঠিক বলেছিলি। এখন আমার মেয়ে, মিলির মেয়ে আর সুরোর ছেলে এই তিনজনকে চোখের আড়াল করতে ইচ্ছে করে না। মনে হয় এই যেন ওদের কিছু হয়ে গেল। মনে মনে ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়ি।

সন্দীপ আমার কথা শুনে মিটি মিটি হাসছে।

তুই তো বিশাল রোগ বাধিয়ে বসে আছিস। এই ধরণের রোগে পড়তে তোকে আগে কখনও দেখিনি। আমি এর ট্রিটমেন্ট করতে পারবো না, আমি কেন, বিশাল মাপের কোনও ডাক্তারই পারবে না।

সেই ছেলেটির কথা মতো একজন এসে ভাঁড়ে করে চা দিয়ে গেল। দুজনে চা খেলাম, তারপর একটা করে সিগারেট ধরালাম।

সন্দীপ বেশ কয়েকটা সুখটান দিল।

ম্যাডাম কবে ফিরবে?

এখন ফিরবে না। দাদাদের সঙ্গে এক সঙ্গে ফিরবে।

কবে?

আগামী মাসের শেষের দিকে। হয়তো আরও একটু দেরি হতে পারে।

তারমানে এখনও প্রায় চল্লিশ দিন?

ওইরকম হবে। তবে ইসলামভাই, ইকবালভাই আগামী সপ্তাহে ব্যাক করে আসছে।

এই কদিন হিসেব মতো তুই একা?

হ্যাঁ। কিছু কাজ আছে সেরে ফেলবো।

তোর সঙ্গে ম্যাডামের কথা হয়?

দিনে একবার রুটিন করে কথা বলতে হয়, খোঁজ খবর নিতে হয়।

দাদার সঙ্গে?

কেন জানিনা দাদার সঙ্গে কথা বলতে ভয় করে। দাদার জড়িয়ে যাওয়া অনি ডাকটা আমার কানে রাইফেলের বুলেটের মতো লাগে।

সন্দীপ চুপ করে রইলো।

অনেকক্ষণ দুজনে চুপ চাপ বসে থাকলাম। কেউ কারুর সঙ্গে কোনও কথা বললাম না। কত কথা মনে আসছে। আবার মুহূর্তের মধ্যেই সব মিলিয়ে যাচ্ছে। দুজনেই গঙ্গার বুকে বয়ে যাওয়া জলের দিকে চেয়ে বসে রইলাম। এখন আস্তে আস্তে ভাটার টানে জল নিচে নেমে যাচ্ছে। আবার গঙ্গার পাড়ের সেই রুগনো চেহারাটা বেরিয়ে আসছে।

পশ্চিম আকাশটা অনেকক্ষণ আগে অন্ধকার হয়ে গেছে। গঙ্গার ধারের নিওন আলোগুলো জ্বলে উঠেছে, ছায়াছায়া আলোর স্পর্শ জলে এসে পরেছে। চিক চিক করছে গঙ্গার বুক। মাছ ধরার নৌকগুলো এরই মধ্যে মাঝ গঙ্গায় চলে গেছে জাল টানার জন্য।

চল এবার উঠি। রাত হলো।

সন্দীপ আমার দিকে তাকালো।

তুই এখন অফিসে যাবি?

একবার ঘড়ির দিকে তাকালো।

নটা বাজে। না আজ যাবো না। দায়িত্ব যখন দিয়েছি তখন ওরাই করুক।

সেই ভালো। চল তোকে নামিয়ে দিয়ে বাড়ি যাই।

আমার বাড়ির সামনে থেকে তুই ফিরে আসবি, এটা কেমন হবে?

আর একদিন যাব। আজ তোর বাড়ি গেলে আমার শরীরটা যাবে, মনটা যাবে না।

আমি ট্যক্সি করে চলে যাই, তুই বরং বাড়ি যা। ওরা হয়তো চিন্তা করবে।

যতটা যাওয়া যায় ততটা চল, তারপর না হয় ট্যাক্সি করে যাবি।

তাই চল।

রাস্তায় বেরিয়ে এলাম। দেখলাম আবিদের গাড়িটা মাঠে পার্ক করা আছে।

এগিয়ে গেলাম। ধারে কাছে কাউকে দেখতে পেলাম না।

দুজনে দুটো সিগারেট ধরিয়ে খাচ্ছি। একটি অপরিচিত ছেলে এগিয়ে এলো।

আবিদদা এখুনি আসছে। একটু চা খাবেন?

ছেলেটির মুখের দিকে তাকালাম। চিনতে পারলাম না।

নিয়ে এসো।

চিকেন প্যাটিস নিয়ে আসি?

যাও। আবিদকে একটু খবর দিও।

আপনারা গাড়িতে বসতে পারেন খোলা আছে।

তাই!

নিজেই দরজাটা খুলে দিল। আমরা ভেতরে উঠে বসলাম। সন্দীপ পকেট থেকে মোবাইলটা নিয়ে অন করলো।

তুইও কি বন্ধ করে রাখিস নাকি?

না তোর সঙ্গে কথা বলছিলাম, তাই বন্ধ করে রেখেছিলাম। ভীষণ ডিস্টার্ব হয়।

ফোনটা খুলতেই অনেকগুলো ম্যাসেজ ঢুকলো।

দেখ কতগুলো মিশ কল আছে। তোর বৌ হয়তো দু-চারবার ফোন করে ফেলেছে।

সন্দীপ হাসলো।

তোরটা অন কর?

এখন থাক। বাড়িতে গিয়ে অন করবো। আমাকে না পেলে আবিদকে ফোন করে জেনে নেবে।

ছেলেটি খুব চটপট চা আর প্যাটিস নিয়ে চলে এলো। আমাদের হাতে দিল।

তোমার কই?

আমি একটু আগে খেয়েছি।

আমি নিজের থেকে হাফ ভেঙে ওর হাতে দিলাম। প্রথমে নিচ্ছিলো না, তারপর নিল।

তোমার নাম কি?

নিসার।

কোথায় থাকো?

মসজিদে।

তোমার বাড়ি কোথায়?

জানি না। আব্বা আমাকে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পেয়েছে।

তোমার আব্বার নাম কি?

ইকবাল হায়দর।

বুঝলাম ইকবালভাইয়ের কথা বলছে।

তুমি আমাকে চেনো?

ছেলেটি মাথা দোলালো। হ্যাঁ।

আগে দেখেছো?

একবার, আমাদের মসজিদে।

তুমি ওখানে কি করো?

মসজিদে যারা আমার মতোন রয়েছে তাদের পড়াই।

তাই! খুব ভালো কাজ। কতদূর পড়াশুনা করেছো?

এমএসসি পার্ট ওয়ান দিয়েছি, পার্ট টু বাকি আছে।

কি নিয়ে পড়ছো?

মাইক্রোবায়োলজি।

সন্দীপ আমার দিকে তাকালো।

আমি আপনার মতো হতে চাই। একটা সুযোগ দেবেন।

কেন আমি কি খুব ভালোমানুষ?

তা জানি না। তবে আপনি যে পয়সা মসজিদে দান করেন সেই পয়সায় আমাদের পড়াশুনা খাওয়া দাওয়া হয়। আর অন্যান্যরা যা দান করে, তাতে প্রত্যেক দিন পাঁচশোজনকে খাওয়ান হয়। তাছাড়া আরও কিছু ডোনেশন আসে।

তাহলে শুধু আমার পয়সার কথা বলছো কেনো। মসজিদে আরও মানুষ ডোনেশন দেয়।

নিসার মাথা নিচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো।

তুমি মাইক্রোবায়লোজি নিয়ে পড়ছো, তার মানে তুমি ভালো ছেলে। আগে পড়াশুনা শেষ করো। তারপর দেখবে এই পৃথিবীতে অনেক ভালো কজা করার আছে। তার আগে তোমাকে নিজেকে রোজগার করতে হবে।

আমি এখনই এক জায়গায় চান্স পেয়েছি। আব্বুকে বলেছিলাম, আব্বু বলেছে তোকে আরও পড়াশুনা করতে হবে। তারপর আপনার নাম করে বলেছে ও যা বলবে তাই করবি।

নিসারের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই আবিদ চলে এলো।

বাড়িতে আসতে আসতে প্রায় দশটার কাছা কাছি বাজলো।

বাইরের ঘরে ঢুকতেই সুরো, মিলির কিছুটা মুখ ঝামটানি খেলাম। ফোন বন্ধ করে রাখার জন্য। বাচ্চাদুটোকে দেখতে পেলাম না। হয়তো ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। মাসি রান্নাঘরের সামনে বসে কি করছিল।

চা খাবে? সুরো আমার দিকে তাকাল।

না।

হাতমুখ ধুয়ে তারাতারি এক সঙ্গে খাওয়া দাওয়া করে নিজের ঘরে শুতে এলাম। কনিষ্ক, অংশু আসতে পারবে না বলে দিয়েছে। ওদের জন্য আর অপেক্ষা করতে হয় নি। সুরো ওষুধ দিয়ে গেল। খেলাম।

দরজাটা খুলে রাখবে।

কেন!

ঘুমলে ডেকে সাড়া পাওয়া যায় না। অন্ততঃ ঠেলে তুলতে পারবো।

হাসলাম।

বাচ্চাদুটো কোথায় শুয়েছে?

বড়োমার ঘরে।

ঠিক আছে যা।

জিজ্ঞাসা করলেনা ওরা পৌঁছেছে কিনা?

রাতে মেয়ে বলেছে ফোন করবে। ফোনটা অন করে রেখেছি।

তোমার ফোন বন্ধ ছিলো, ওরা ফোন করেছিল, ভালো ভাবে পৌঁছে গেছে। ওরা সবাই ভালো আছে। হয়তো দিন পনেরোর মধ্যে সবাই চলে আসবে।

মাথা নিচু করে রইলাম।

কয়েকদিন ধরে তোমাকে ঠিক স্বাভাবিক দেখছি না। কি হয়েছে বলবে।

কিছু হয়নি। এমনি একা একা থাকতে ভালো লাগছে।

তুমি তো এইরকম ছিলে না?

কি জানি, হয়তো আবার ঠিক হয়ে যাবে।

জ্যেঠু তোমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিল।

দাদা তোর সঙ্গে কথা বলেছে!

সুরোর দিকে তাকালাম।

হ্যাঁ। এখন অনেক ভালো ভাবে কথা বলতে পারছে। ডাক্তার জ্যেঠুও কথা বলেছে।

একটা ভালো খবর দিলি।

ওদেরকে দিয়ে ফেরার সময় গাড়িতে বসে কাঁদছিলে কেন?

না না কাঁদি নি, জানলা দিয়ে খুব হাওয়া আসছিল, হাওয়ার ধাক্কায় চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে গেছিলো। আবিদ সেটা দেখে ভুল ভেবেছিল।

সুরো আমাকে এসে জড়িয়ে ধরলো।

কেন অনিদা তুমি আমাকে মিথ্যে বলছো। আমি জানি তোমার অনেক কষ্ট, সেই কষ্ট আমি হয়তো লাঘব করতে পারবো না। একবার বলে দেখো না। একটু তো হাল্কা হবে।

চুপ করে রইলাম।

সুরোর যখন দশ বছর বয়স তখন থেকে ওকে দেখছি। আমি তখন ফার্স্ট ইয়ারে পরি। আজ সুরো এক সন্তানের মা। আমার অনেক গোপন কথা ও জানে। ছোটোবনের মতো ওকে অনেক কথা বলেছি।

আমি কি তোমাকে কোনও আঘাত দিয়ে কথা বলেছি?

কেন একথা বলছিস!

তাহলে? তোমাকে আমি এই ভাবে দেখতে চাই না।

সুরো কান্নাভেঁজা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।

একটু অপেক্ষা কর সব ঠিক হয়ে যাবে। মনের মধ্যে একটা ঝড় উঠেছে। কেন উঠেছে, তার কারণ খোঁজার চেষ্টা করছি। ঝড়টাকে কিছুতেই সামলাতে পারছি না।

কি সেই ঝড় তুমি বলো?

ঠিক তোকে বলে বোঝাতে পারবো না। এই ব্যাপারটা আগে কখনও অনুভব করিনি। আগে নিজেকে একটু সামলিয়ে নিই, তারপর তোকে বলবো।

ঠিক বলবে?

বললাম তো বলবো। যা এবার শুতে যা।

সুরো চলে গেল।

দরজাটা ভেজিয়ে দিলাম। হাল্কা করে ছিটকিনিটা দিলাম। কেউ ধাক্কাদিলেই খুলে যাবে।

বাথরুমের কাজ সেরে আলমাড়িটা খুললাম। নার্সিংহোমে থাকার সময় মিত্রা একটা ডাইরী দিয়েছিল। বলেছিল পড়িস, তোর সঙ্গে তো গল্প করার সময় পাইনা, তাই লিখে রেখেছি।

ডাইরীটা বার করে আনলাম।

মেয়ের টেবিল ল্যাম্পটা টেবিলের ওপর থেকে নিয়ে এলাম। ঘরের বড়ো লাইটা অফ করে ছোটো লাইটটা জ্বালিয়ে দিলাম।

ফোনদুটো পাশে রেখে, লাইটটা জ্বালিয়ে নিলাম।

অনেক যন্ত্রণা বুকে নিয়ে লিখতে বসলাম। গত সাতটা দিন শরীরের ওপর দিয়ে একটা ঝড় বয়ে গেল। মাঝে মাঝে নিজেকে ভীষণ সহায় সম্বলহীন বলে মনে হতো, মনে হতো এখুনি আত্মহত্যা করি। তাহলে হয়তো সব জ্বালা জুড়িয়ে যাবে। ঈশ্বর আমাকে পার্থিব সব কিছু দিয়েছেন শুধু শান্তিটুকু দেন নি। যে টুকু পাই তাও উড়ো মেঘের বৃষ্টির মতো।

জানিস বুবুন, মাঝে মাঝে মনে হয় তুই আমার জীবনে না জড়ালেই পারতিস। আমি তিলে তিলে নিজেকে শেষ করে দিতাম। আজ যা কিছু ঘটছে সব আমার জন্য, আমি যদি নিজেকে তোর জীবনের সঙ্গে না জড়িয়ে ফেলতাম, তহলে হয়তো এতগুলো জীবনকে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে হতো না।

একটা মানুষের জন্য এতগুলো মানুষের প্রতিটা মুহূর্ত টান টান উত্তেজনায় কাটছে।

তোর কাছে স্বীকার করছি। আর কাউকে জানাই নি। জানানো যায় না। এ যে বড়ো লজ্জার।

সেদিন তোর সঙ্গে কথা না বলে অফিসে চলে এলাম। মনটা কেমন খুঁত খুঁত করছিল, কেন জানিনা মনটা খালি কু গাইছিল। ছোটোমাকে কতবার ফোন করেছি। তুই কি করছিস। এতো চাপ সহ্য করতে পারছিলাম না। তারপর সোয়া এগারোটা নাগাদ ছোটোমার ফোন পেলাম। গলাটা কেমন কান্নাভেঁজা।

কি হয়েছে! কাঁদছো কেন।

অনিকে সাদা পোষাকের পুলিশ জিপে করে নিয়ে গেল।

কথাটা শোনার পর সারাটা শরীরে বিদ্যুতের শিহরণ। হাত-পা কেমন যেন ঠাণ্ডা হয়ে গেল।

নেপলা কোথায়!

পেছন পেছন দৌড়েছে।

বাড়িতে কে আছে?

আমি, দিদি, দামিনীদি।

ঠিক আছে যাচ্ছি। তুমি একটু অপেক্ষা করো।

ছোটোমার ফোনটা কেটে দিয়েই, অর্ককে ফোনে ধরলাম। ভাগ্যিস ও তখন অফিসে চলে এসেছে। আমার ফোন পেয়েই নিচে এলো, সব বললাম।

সত্যি বুবুন সেদিন অর্কর স্ট্যামিনা দেখলাম। মুহূর্তের মধ্যে ওর চোখে মুখের রং বদলে গেল।

নেপলাদা কোথায়?

ও বুবুনের পেছেন পেছন গেছে।

তুমি বাড়ি চলে যাও।

তারপর আমার ঘরে দাঁড়িয়েই পর পর অরিত্র, সুমন্ত, শুভ, সায়ন্তন, সুগতকে ফোনে সব জানালো, এক একজনকে এক একটা দায়িত্ব দিল। ফোনটা পকেটে রেখে বললো।

চলো তোমাকে ছেড়ে দিয়ে আসি।

আমি রবীনকে নিয়ে চলে যাচ্ছি।

না। এ সময়ে তোমাকে একা ছাড়তে পারবো না।

গলার স্বর একবারে পরিবর্তন হয়ে গেছে।

কেন জানিনা অর্ককে না বলতে পারলাম না। ভাবলাম একটা ছেলে সঙ্গে থাকা ভালো।

জনিস বুবুন অর্কর একটা ব্যাপার আমার খুব ভালো লাগে, যখন একা থাকি ও আমাকে তুমি বলে, আবার যখন সকলের সঙ্গে বসে কথা বলে তখন ম্যাডাম আপনি। কি দারুণ মেইনটেন করে।

অফিসর কেউ টেরই পেল না। কি ঘটলো।

নিচে নেমে এসে গাড়িতে উঠলাম। গাড়িতে আসতে আসতেই মোবাইলটা পকেট থেকে বার করে ফোনটা ডায়াল করলো, তারপর রিং হতে ভয়েজ অন করলো।

হ্যালো।

অনাদিদা, আমি অর্ক।

চমকে উঠলাম। ফিরে তাকলাম অর্কর দিকে।

বল।

তোমার লোক কাজটা ভাল করলো না।

বুঝলাম না।

অনিদাকে তুলে নিয়ে গেছে।

তাই! কেন?

অনাদির গলায় বিষ্ময় যেন ঝড়ে পরছে।

সেটা আমার থেকে তুমি ভালো জানবে।

হয়তো ওদের কোনও দরকার আছে তাই নিয়ে গেছে। ছেড়ে দেবে।

ছেড়ে তো দিতেই হবে, অনিদাকে আটকে রাখার ক্ষমতা তোমার পুলিশ প্রশাসনের নেই এটা তুমি ভালো করে জানো।

তোর গলার স্বরটা একটু অন্যরকম মনে হচ্ছে।

হওয়াটা স্বাভাবিক।

ঠিক আছে আমি ফোন করে দিচ্ছি।

ফোন করতে হবে না। তোমাকে একটা কথা জানিয়ে রাখলাম, যদি দাদার কিছু হয় তুমি সামলাতে পারবে?

তুই কি বলতে চাইছিস!

যা বলছি তা খুব পরিষ্কার। একটুও গল্প কথা নয়। তোমার সঙ্গে প্রিয়দর্শিনী ম্যাডামের বহু ছবি আমার ক্যামেরায় বন্দি হয়ে আছে। মুভি প্লাস স্টিল।

অর্ক মুখ সামলে কথা বল।

সে সময় চলে গেছে। তুমি মন্ত্রী আমি সাংবাদিক। ক্ষমতার লাড়াইয়ে নামবে নাকি? চব্বিশ ঘণ্টা সময় নেব। তোমায় তোমার কুর্সি থেকে আছাড় মেরে ফেলে দেবো।

তোর এতোবড়ো সাহস!

আমার দাদার গায়ে হাত পরেছে। এটা তোমাকে শুধু মনে করিয়ে দিতে চাই।

অনাদি ফোনটা কেটে দিল।

ফোনটা পকেটে রাখলো। জানলার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে আছে।

গাড়িতে আমার পাশে বসে অর্ক এলো, আমার সঙ্গে একটা কথাও বললো না।

বাড়িতে ঢুকতেই দেখলাম নেপলা কাদের সঙ্গে যেন কথা বলছে।

আমি ছুটে এসে ভতরে ঢুকলাম।

দুজনে সোফায় বসে কাপর দিয়ে চোখ মুছছে।

ছোটোমাকে জড়িয়ে ধরলাম।

এককাপ চা খেয়ে চলে গেলো। লুচি খেতে চেয়েছিল, ভাজলাম। ওরা খেতে দিল না।

বড়োমা হাউহাউ করে কেঁদে উঠলো।

কজন এসেছিল?

মরারা দশখানা গাড়ি করে এসেছিল, সব নবাবের পুত্র। বলে কিনা না গেলে কোমড়ে দরি বেঁধে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে যাব। বড়োমা কাঁদো কাঁদো গলায় বললো।

চুপ করে গেলাম। মাথাটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা মনে হচ্ছে। কি করবো আমি। চাড্ডি ফোন করা ছাড়া আমার কি-ই বা করার আছে।

দেখলাম বাইরের বাগানে গাড়ি এসে দাঁড়াল।

দাদারা সেই সকালে বেরিয়েছিল, ফিরলো।

আমি বড়োমার দিকে তাকালাম। বললো ফোন করেছিল।

দাদাদের মুখ চোখ শুকিয়ে গেছে। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো, অনিমেষকে ফোন করেছিলে?

করেছিলাম।

কি বললো?

বললো, ব্যবস্থা করছে।

ওকে আবার টানা টানি করতে শুরু করলো কেন। এরকম তো হবার নয়।

তিনজনে সোফাতে বসলো আমিও বসে আছি।

অর্ক দেখলাম বাগানে দাঁড়িয়ে কথা বলেই চলেছে। একবার কান থেকে ফোন নামায়, আবার ডায়াল করে কথা বলে। ভীষণ উত্তেজিত শোনাচ্ছিল ওর কথাবার্তা।

ছেলে-মেয়ে মুখ শুকনো করে ঘরে ঢুকলো।

মেয়ে বললো, মা অর্ক আঙ্কেল কার সঙ্গে ভীষণ রাউডলি কথা বলছে। শুধু বলছে, দেখে নেব তোমার কতো দম।

মেয়ের চোখের দিকে তাকালাম। মুখটা পাংশু।

বার বার টয়লেট পেয়ে যাচ্ছে।

বড়োমার ঘর থেকে টয়লেট করে বেরোতেই অর্ক আমাকে বললো, তুমি আমার সঙ্গে চলো, ডাক্তারদাদা আপনি আসুন।

সবাই অর্কর দিকে কেমনভাবে যেন তাকাল। দাদা ধমকিয়ে উঠলো।

কি হয়েছে বলবি তো।

কিছু হয় নি।

আমি যাবো।

না। আমি এখুনি ফিরে আসছি।

বাইরে বেরিয়ে দেখি নেপলা নেই।

রবীনকে জিজ্ঞাসা করলাম নেপলা কোথায়?

বললো, আপনি যখন এসেছেন তক্ষুনি বেরিয়ে গেছে।

মনটা কু গেয়ে উঠলো, তাহলে নিশ্চই কিছু একটা সিরিয়াস ঘটনা ঘটে গেছে।

গেটের বাইরে আসতেই অর্ক রবীনকে বললো, তারাতারি পিজিতে চলো।

চমকে উঠলাম, পিজিতে কেন অর্ক?

অনিদাকে ওরা ওখানে ভর্তি করেছে।

ভিউইং গ্লাস দিয়ে দেখলাম ওর চোখ টলটল করছে।

তখন আমার হাত-পা কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে।

কি হয়েছে কি, বলবি তো? ডাক্তারদাদা বলে উঠলো।

ওরা অনিদার গায়ে হাত তুলেছে। অর্কর গলাটা বুঁজে এলো।

এ্যাঁ।

বাক-রুদ্ধ হয়েগেলাম।

পিজিতে কে নিয়ে এলো? ডাক্তারদাদা বললো।

ওরা ফেলে দিয়ে চলে গেছে।

তুই জানলি কি করে?

আমি আধঘণ্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট আগে জানতে পেরেছি। যখন ওরা অনিদাকে গাড়িতে করে নিয়ে আসছে।

এতক্ষণ কি করছিলি?

ফলোআপ করছিলাম, অনিদাকে নিয়ে ওরা কোথায় যায়।

কে আছে ওখানে?

শুভ, সুগতো।

পিজিতে নিয়ে এসেছে কে বললো?

নেপলাদা।

নেপলা ওখানে!

হ্যাঁ। সবাই আছে।

ডাক্তারদাদার সঙ্গে অর্ক কনটিনিউ কথা বলে চলেছে। আমার নড়াচড়ার শক্তি হারিয়ে গেছে।

হাসপাতালে এসে দেখলাম ভিড়ে ভিড়। কনিষ্ক, নীরুরা পর্যন্ত সব চলে এসেছে। আমাদের নার্সিংহোমের এ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে আছে। তোর ফুল টিম হাজির। অনিমেষদা, বিধনদা আছেন।

আমি গাড়ি থেকে নামতে পারলাম না। সারাটা শরীর অবস, কেমন যেন গা গুলিয়ে উঠছে।

ইসলমভাই চোখ মুছতে মুছতে আমার হাতটা এসে চেপে ধরলো।

তখন আমি যেন কাঁদতেও ভুলে গেছি। কথা বলতে পারছি না। বুকের মধ্যে কি ভীষণ যন্ত্রণা।

স্ট্রেচারে করে তোকে এ্যাম্বুলেন্সে তোলা হলো। গাড়িতে বসেই তোর নিথর শরীরটা দেখলাম। মাথাটা ব্যান্ডেজে মুড়ে দিয়েছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে। ডুকরে কেঁদে উঠলাম।

অদ্ভূত তখন আমার সামনে কেউ নেই। আমি যে একটা মানুষ গাড়িতে ওই ভাবে বসে আছি কারুর হুঁস নেই। অর্ক অনবরতো কাদের সঙ্গে খুব বিচ্ছিরি ভাবে ফোন কথা বলে চলেছে।

তোকে নিয়ে এ্যাম্বুলেন্স বেরিয়ে গেল। রবীন ছুটতে ছুটতে এসে গাড়ি স্টার্ট দিল। কেউ আমার গাড়িতে নেই। আমি একা। বড়োমাকে একটা ফোন করবো তার কোনও উপায় নেই। ফোনটা পাশেই পরে আছে। ফোনের দিকে হাতটা পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারছি না।

মনে মনে খুব রাগ হলো। আমি ফোন করতে পারছি না, তোমরা একটা ফোন করতে পার। আমি না হয় পরের বাড়ির মেয়ে। তোমরা বুবুনকে ছেলের মতো ভালোবাসো। তাহলে একবার ফোনকরে বুবুনের খোঁজ নিতে পারো না। ছলে মেয়েকেও তখন মনে হচ্ছে দুনিয়ার বেইমান।

নার্সিংহোমে এসে দেখি, লোকে লোকারণ্য। অফিস থেকে সবাই চলে এসেছে। এমনকি বড়োমা, ছোটোমা, ছেলে, মেয়ে, জ্যেঠিমনি, দিদিভাই সব নার্সিংহোমে।

গাড়ি থেকে নামার শক্তিটুকু আমার নেই।

মেয়ে এসে পাশে বসে গলা জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো।

মা, বাবাকে ওরা মারলো কেন?

মেয়ের কথা যেন কানে শুনতে পাচ্ছি না।

ছোটোমা আমাকে ধরে নামাল। ভেতরে নিয়ে এসে বসালো।

বোবা চোখে সকলকে দেখছি। মুখে কোনও কথা বলতে পারছি না। ভালো মানুষটাকে সকালে দেখে গেলাম।

তখন কে কাকে দেখে। মিলি একগ্লাস জল নিয়ে এসে আমাকে দিলো। জলটাও কেমন তেঁতো তেঁতো মনে হলো। খেতে পারলাম না। যেন বমি হয়ে আসছে।

কেউ এসে তোর খবরটুকু পর্যন্ত দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করতে পারছে না।

দুপুরের দিকে অনুপদা, রূপায়ণদা এলো। মুখ চোখ একবারে শুকিয়ে গেছে।

কানে শুধু এটুকু কথা এলো। তোর জেলায় আগুন লেগে গেছে। শ্যামেরা প্রচুর সরকারি বাসে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। পুলিশের সঙ্গে খণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।

ঘন ঘন পুলিশের সব বড় অফিসাররা আসছে। খবর নিচ্ছে। আমার সঙ্গে কথা বলতে এসেছিল। অনিমেষদারা কথা বলতে দিল না।

সন্ধ্যের দিকে ডাক্তারদাদা নিচে নেমে এলো।

বললো তোমরা বাড়ি চলে যাও। যতক্ষণ ও ঠিক না হচ্ছে আমি নার্সিংহোমেই থাকবো।

তখনই বুঝলাম তোকে হয়তো আর ফিরে পাব না। রাতে বাড়ি ফিরে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে প্রাণভরে কাঁদলাম। জীবনে প্রথম এতো কাঁদলাম। প্রতিটা মুহূর্ত মনে হচ্ছে, এই বুঝি তোর মৃত্যু সংবাদ এলো।

বাড়িতে ঘন ঘন পুলিশ আসছে। দাদাকে নিয়ে টানা টানি শুরু হয়ে গেছে।

তনু দিল্লী থেকে ফিরে চলে এসেছে। ওর দশা আমার থেকে আরও খারাপ।

কে কাকে দেখব।

সুন্দর যেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না কি করবে।

দাদা এরই মধ্যে অফিসে যাচ্ছে।

তৃতীয় দিনের ঠিক দুপুরে। নার্সিংহোমে বসে আছি। সুন্দর দাদাকে নিয়ে পাঁজা কোলা করে ছুটতে ছুটতে ঢুকলো। বড়োমা ওই অবস্থা দেখে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো।

কিছু বুঝে ওঠার আগেই দাদাকে নিয়ে ওরা ওপরে চলে গেল।

আমি, ছোটোমা, বড়োমা, জ্যেঠিমনি নিচে বসে।

দামিনীমাসি কনটিনিউ কাদের সঙ্গে ফোনে কথা বলে চলেছে। বুঝলাম একটার পর একটা এ্যাকসনের নেতৃত্ব দিয়ে চলেছে। এই দামিনীমাসির চাউনি চলাফেরা একেবারে অন্য। দেখলে যে কেউ ভয় পয়ে যাবে।

তখন নার্সিংহোমটা আমাদের ঘর বাড়ি।

চতুর্থ দিনের দিন, হঠাৎ নিউজ চ্যানেলে সন্ধ্যের দিকে খবর পেলাম। তিনটা বাচ্চাকে কারা যেন অপহরণ করে নিয়ে গেছে। তারা জানতে পেরেছে তোকে কারা মেরেছিল। তাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য তাদের বাচ্চাগুলোকে তুলে নিয়ে গেছে।

আবার হই হই পরে গেল চারদিকে।

নার্সিংহোমে তুই দাদা আছিস।

একজনের সেরিব্রাল আর একজনের মাথায় আঘাত, চোয়াল ভেঙে চৌচির।

অনুপ দিল্লী থেকে এলো। এসেই তনুদের বললো কালকের ফ্লাইটে তোমরা ফিরে যাও। তনু কিছুতেই যাবে না। নেপলাদেরও বললো, তোরা এখুনি যে যার যেখানে পারিস চলে যা। পারলে দেশের বাইরে চলে যা।

তুই বল কেউ এই সময় যেতে চায়?

অনুপ ওদের জোড় করে পাঠিয়ে দিল।

ওরা সবাই কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল।

বাড়িতে ফিরে এলাম। আজ রাতে মেয়ে ছেলে দুজনেই নার্সিংহোমে থাকলো। বাড়িতে আমি, বড়োমা, ছোটোমা। এই কটা দিন দামিনামাসি বাড়িতে রাতে থাকে নি। ঘনো ঘনো ফোন করে খবর নিয়েছে। রাতে নিজের ঘরে এলাম। লিখছি। হঠাৎ দামিনীমাসি ফোন করলো।

গলাটা ভীষণ ভারী ভারী।

মনকে বোঝালাম, মিত্রা তোর হারাবার আর কিছু নেই। কেন ওরকম করছিস।

তারপর দামিনীমাসি কাঁদতে কাঁদতে বললো, ইসলামভাইকে ওরা এ্যারেস্ট করে নিয়ে গেছে। সঙ্গে আবিদ, রতনও আছে। কোনও কথা বলতে পারছি না। মাসি অঝোড়ে কেঁদে চলেছে।

শুধু বললাম, বড়োমা ছোটোমা জানে কিনা।

বললো না ফোন করে নি। অনিমেষদাকে জানিয়েছে।

আমার ঘরের দরজার সামনে ভজু শুয়ে আছে। একবার ওর দিকে তাকালাম। দেখলাম ঘুমচ্ছে।

আজ সাতদিন তোর মুখ দেখি নি। এমনকি দাদাকেও ওরা দেখতে দেয় নি। শুধু বলে গেছে সব ভালো আছে। সব বুঝতে পারছি কিন্তু মন মানে না।

ওই মুহূর্তে ডিসিশন নিলাম, আর নিজেকে বাঁচিয়ে রেখে লাভ কি। সব শেষ হয়ে গেছে। ঈশ্বর আমার কপালে সুখ লিখে রাখে নি। এর থেকে মরে যাওয়াই ভালো। এই সুবর্ণ সুযোগ। সারাটা বাড়ি নিস্তব্ধ। সবাই ঘুমচ্ছে। যেন আমি পাতাল পুরীতে একা বসে আছি।

তোর টেবিল থেকে অনেক খোঁজা খুঁজি করে একটা মর্চে পড়া ব্লেড বার করলাম।

হাতের শিরাটা কেটে দিলেই সব শেষ।

মনে মনে প্রিপারেশন নিলাম, আর বেঁচে থেকে লাভ নেই। তোকেই যখন পাব না। তখন এই জীবন রেখে লাভ কি।

বাথরুমে গিয়ে স্নান করলাম, নতুন জামাকাপর পরলাম।

শুনেছি মরার সময় নাকি মৃতদেহকে খুব সুন্দর করে সাজাতে হয়। নিজেকে সাজিয়ে তুললাম। সিঁথিতে ডগডগে সিঁদুর লাগালাম। খুব সুন্দর করে সাজলাম।

তারপর ব্লেড নিয়ে মনে শক্তি এনে বাঁহাতের শিরাটায় রাখলাম চোখ বন্ধ করলাম।

তোর মুখটা ভেসে এলো। তুই হাসছিস।

আমি জানি তুই পাগলামি শুরু করবি।

তোর হাসি ভরা মুখটার দিকে তাকালাম।

এ কি করছিস! এর জন্য আমি আমার জীবনটাকে নষ্ট করলাম।

কেন করতে গেলি, আমি তোকে বলেছি।

তুই বলবি, কেন আমি তোকে ভালোবেসেছি, আমার ভালোবাসার মানুষের জন্য যদি এইটুকু করে থাকি, ক্ষতি কি?

সারাটা জীবন তোকে ভালোবেসে আমি কি পেলাম।

আমাকে একবার বোঝার চেষ্টা কর।

মনকে অনেক বুঝিয়েছি। আজ উনিশটা বছর নিজেকে তিলে তিলে শেষ করে ফেলেছি। জীবন মৃত হয়ে বেঁচে আছি। শুধুমাত্র ছেলেটা আর মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে।

ঠিক আছে আমার জন্য তোকে বাঁচতে হবে না। ছেলে মেয়ের জন্য তোর বেঁচে থাকা জরুরি। একটা অনাথ ছেলের জীবনটা তুই চোখের সামনে দেখেছিস, কেন নিজের গর্ভজাত সন্তানকে তুই অনাথ করে দিতে চাইছিস।

তোর বাবা মাও তোকে এইভাবে এই পথ অনুসরণ করে অনাথ করে দিয়ে চলে গেছে।

তোর মুখটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

তোর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলাম না।

কথাটা বলার পর নিজে ভীষণ অনুতপ্ত বোধ করলাম।

তুই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলি। আমার কোনও কথার জবাব দিলি না।

দেখলাম তুই কাঁদছিস।

নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না।

তোকে যে আমি ভীষণ ভালোবাসি বুবুন। তোর সব কিছু আমি সহ্য করতে পারি। শুধু তোর চোখের জলটা আমি রক্তের থেকেও বেশি ভয় পাই। তুই কতটা আঘাত পেলে চোখের জল ফেলিস আমি ছাড়া এই পৃথিবীতে আর কেউ জানে না।

সারাটা শরীরে একটা প্রচণ্ড কাঁপুনি অনুভব করলাম। শরীরটা কেমন অবসন্ন হয়ে এলো। পারলাম না। বার বার তুই, ছেলে, মেয়ে আমার চারপাশে এসে ঘিরে ধরে দাঁড়িয়ে পরছিস।

তোদের চোখের সামনে আমি এই কাজ করি কি করে।

রেখে দিলাম।

অবসন্ন দেহটা টেবিলে ঝুঁকে পরলো।

চোখ মেলে তাকালাম।

দেখলাম ছোটোমা আমার মুখের ওপর হুমড়ি খেয়ে রয়েছে। মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে।

চারিদিক চেয়ে চেয়ে দেখলাম। ঘরে কেউ নেই।

একটু পরে বুঝলাম আমি নার্সিংহোমের বিছানায় শুয়ে আছি।

বুকের ভেতর ভীষণ যন্ত্রণা শুরু হলো। ছোটোমা কথা বলছে না। শুধু চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরছে। আমি ছোটোমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলাম।

তোরা সবাই মিলে এরকম করলে, আমরা দুটোতে যাই কোথায় বলতো।

ছোটোমার চোখে চোখ রাখতে পারলাম না। মুখ ঘুরিয়ে নিলাম।

দেখলাম স্যালাইনের বোতল ঝুলছে।

ছোটোমা আমাকে একটু জল দাও।

কনিষ্ক আসুক, ও জল দিতে বারণ করে গেছে। ছোটোমা চোখ মুছছে।

বুবুন কেমন আছে?

এখনও জ্ঞান আসে নি।

দেখেছো?

ছোটোমা মাথা দোলাল। না।

দাদা?

ভালো আছে।

সত্যি কথা বলো। আমার আর কিছু হবে না।

তোদের সবার হেঁপি মারা অভ্যাস।

ছোটোমার হাতটা আবার চেপে ধরলাম।

বড়োমা কোথায়?

দাদার ঘরে।

ওর ঘরে কে আছে?

কনিষ্করা কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না।

ওর কি এখনও সেন্স আসে নি?

না। সামন্তদা বলেছে আসবে কিনা বলতে পারছে না। সব ঠাকুরের ইচ্ছে।

বুকের ভেতরটা আবার যান্ত্রণা করতে শুরু করলো। মনে মনে বললাম, এটা যন্ত্রণা নয়, এটা আমার ভ্রম। আমি ঠিক আছি।

ছেলে মেয় কোথায়?

নিচে আছে। ওই টুকু টুকু মনগুলো নিয়ে তোরা এ কি খেলা শুরু করলি।

চুপ করে গেলাম।

অনেকক্ষণ কথা না বলে চুপ চাপ শুয়ে রইলাম।

কতো চিন্তা মাথার মধ্যে। কিন্তু আমি কিছুই করতে পারবো না। ছোটোমাকে বললাম, কনিষ্ককে একবার ফোন করো।

কতো দৌড়য় বলতো ছেলেগুলো। সকাল থেকে এই তিনটে ঘরে দৌড়োদৌড়ি করছে। একটু আগে এসে বলে গেলো, ম্যাডামের খুব শিগগির সেন্স আসবে তুমি বসো ছোটোমা, আমি অনির কাছ থেকে আসি।

চুপ করে গেলাম।

সত্যি বুবুন, তোর বন্ধুগুলো কি অমায়িক। এই বিপদের মুহূর্তে বুঝতে পারছি ওরা কতটা তোকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে।

আমাকে একটু উঠে বসাবে ছোটোমা।

একটু কষ্টকরে শুয়ে থাক। ওরা আসুক—

ছোটোমা আমার কপালে হাত রাখলো।

নিজের মায়ের হাতে কোনও দিন এই ভাবে স্পর্শ সুখ অনুভব করিনি। মনে পড়ে যাচ্ছিল প্রথম দিককার সেই ঘটনাগুলো। আমার শরীর খারাপ, তোর উৎকণ্ঠিত মুখ। ছোটোমা, বড়োমা আমার দু-পাশে বসে। তখন অবশ্য ছেলেমেয়ে হয়নি। আমি স্থান করে নিয়েছি দাদার কাছে।….

চোখ দিয়ে হয়তো জল গড়িয়ে পরেছিল।

ছোটোমা কাপর দিয়ে মুছিয়ে দিল।

আর জ্বালাস নি। সত্যি বলছি, পারছি না। ড্যাবা-ডেবী, ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে লেগে পরেছিস।

এতো কষ্টের মধ্যেও হেসে ফেললাম।

ছেলে-মেয়েকে একটু ডাকো না, দেখি।

ওই রকম পাগলামি করতে গেছিলি কেন। একবারও ছোটোমা, বড়োমার কথা মনে পরলো না। তারা কি নিয়ে বাঁচবে। পেটে ধরি নি, এটাই কি সবচেয়ে বড়ো অপরাধ।

ছোটোমার কথাটা শুনেই বুকের ভেতরটা আবার মোচড় দিয়ে উঠলো। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। ছোটোমাকে জড়িয়ে ধরে অঝোড়ে কেঁদে ফেললাম।

ছোটোমা আমার মাথায় হাত রেখেছে। ছোটোমার বুকে আমি মুখ গুঁজে আছি।

যার সঙ্গে ঘর বেঁধেছিস, তার মনের হদিস এখনও পেলি না। কি মিশলি তার সঙ্গে এতদিন।

ছোটোমার গলাটা ভারি ভারি, বুঝলাম ছোটোমাও কাঁদছে।

ছোটোমা চুপ করে রইলো। আমার মাথায় হাত বোলাচ্ছে।

আমি ছাড়া পৃথিবীতে আর কেউ জানে না। কাউকে বলতে যাস নি কখনও।

আমি ছোটোমার মুখের দিকে তাকাতে পারছি না।

কি কেলেঙ্কারিটা করছিলি বলতো।

আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো।

ভাগ্যিস মর্চে পড়া ব্লেড, যদি নতুন ব্লেড হতো। কারুর কাছে মুখ দেখাতে পারতাম।

ছোটোমার বুকে মুখ গুঁজেই মুখটা চেপে ধরলাম।

তোর থেকেও অনেক কষ্ট এই বুকে ধরে রেখেছি। কিন্তু কখনও হেরে যাই নি। হারব কেন। জীবনের শেষ বিন্দুটুকু দিয়ে লড়ে যাব।

ছোটোমা থামছে আর বলছে।

বাংলাদেশে যুদ্ধ লাগলো। পরিবার সমেত ঘর ছেড়ে পথে বেরিয়ে এলাম।

তখন কাঁচা বয়স।

বাঁচার তাগিদে হাঁটতে হাঁটতে সপরিবারে চলে এলাম বর্ডারে। পেছনে পরে রইলো আমাদের ঘর-বাড়ি, বাবার চালের ব্যাবসা। একান্নবর্তী পরিবার কোথায় ছিটকে গেলাম সকলে। আমরা পাঁচ ভাইবোন আশ্রয় পেলাম বর্ডারের লঙ্গরখানায়। লোভী ক্ষুধার্ত মানুষের চোখ। শকুনের মতো আমার ওপর সকলরে নজর পরলো। আমি একমাত্র সোমত্ত মেয়ে।

বাঁচতে হবে।

চলবে —————————



from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/xFbcWjn
via BanglaChoti

Comments