কাজলদিঘী (১৭৯ নং কিস্তি)

❝কাজলদীঘি❞

BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

১৭৯ নং কিস্তি
—————————–

শুধু লড়াই করলে হবে না অনুপদা। এই জায়গাটাকে নিয়ে অনেক রাজনীতি। সেই রাজনীতি কতটা নোংরা তুমিও বোঝ, আমিও বুঝি। তোমাকে কাজ করে দেখাতে হবে। এদের যদি একবার বিশ্বাস অর্জন করতে পার, এরা সারাজীবন তোমার কেনা গোলাম হয়ে থাকবে। ক্রীতদাস প্রথার গল্প তুমি বিদেশী উপন্যাসে পড়েছ, কালোমানুষের লড়াই তুমি বিদেশী গল্পে পড়েছ, তোমার রাজ্যেই যে কতো কালো মানুষ আছে, তার খোঁজ তোমরা কেউ রাখ না।

ভেবে দেখ আজ থেকে পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছর আগে মৌসুমি মাসি এই অঞ্চল থেকেই মনাকাকার কাছে কাজ করতে গেছিল। বছরে একবার ধান কাটার সময় ওরা যেত। সেই প্রথম যাওয়া আসার সূত্রপাত, এখনও তা বর্তমান।

তুমি মৌসুমিমাসিকে জিজ্ঞাসা করো, সেইই হয়তো তার গ্রামে পা রাখছে বছর পনেরো পর। কেন? এই কেনর প্রশ্নের কোনও উত্তর নেই।

এখানে তার ভাই আছে, ভাইপো আছে। তার সব কিছু এখানে। মৌসুমীমাসি পড়ে রয়েছে আমদের ওখানে। কিসের টানে?

আজ চিকনার ধান ভাঙা কলে আমার গ্রামের ছেলে-মেয়েরা ছাড়াও এখানকার বহু ছেলে-মেয়ে কাজ করে। চিকনার সঙ্গে ঝগড়া করে মৌসুমি মাসি তাদের নিয়ে গিয়ে কাজ দিয়েছে। চিকনাকে বলে ধান থেকে চাল ভাঙিয়ে সেই ছেলেগুলোকে হাটে হাটে চাল বেচতে পাঠাচ্ছে। কেন? কিসের জন্য।

এদের হাতের তৈরি জিনিষ হানিফ কিনে নেয়। যেটাকে তোমরা বলতে পারো হ্যান্ডিক্র্যাফ্ট সামগ্রী। তোমাদের সরকারী পলিসি নেই তা নয়, আছে। সেগুলো পঙ্গু হয়ে গেছে। বম্বেতে আলতাফের, আপ্পের, ভিকুর এককথায় বলতে পারো কমবেশি সকলের শো-রুম আছে, সেখান সেই সব জিনিষ বিক্রী হয়। তাদের কি পয়সার অভাব? আমার অনুরোধে তারা এটা করছে। বেশ ভালো বিক্রী হয়।

এখনও এখানকার পঞ্চাশ শতাংশ মানুষ বনের ফলমূল, ইঁদুর পোড়া, শুয়োর পোড়া, পিঁপড়ের ডিম, গেঁড়ি-গুগলি খেয়ে বেঁচে আছে।

হঠাৎ চারিদিকের নিস্তব্ধতা খান খান করে ফটাস, ফটাস করে তিন-চারটে গুলির আওয়াজ হতেই চমকে তাকালাম।

আমার মতো এখানে উপস্থিত সবাই চমকে উঠেছে।

ইসলামভাই, অনুপদার চোখে মুখে বিষ্ময়ের ছোঁয়া।

একটু দূরে দেখলাম দারু পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

চেঁচিয়ে ডাকলাম, দারু।

দারু কাছে এলো।

গুলির আওয়াজ পেলাম মনে হলো।

ছুড়কি সেঠি শোর টোর মারছে হয়তো।

দারু আমার দিকে তাকাল।

শ্যাম তানকাকে মটর বাইক লিয়ে পাঠাইতিছে। মনে হতিছে কিছু ঘটনা ঘটিছে।

দারু বড়োমার দিকে তাকাল।

বড়োমা দেরি করলি হবেক নাই। বাইরতে হবে। হাবয়া বেগতিক আইছে।

দারুর কথা শুনে সবাই আমার মুখের দিকে তাকাল। আমি দারুর মুখের দিকে।

হাতির পালগা এউপাশে মুখ ঘুরাইছে।

তুই ঠিক দেখেছিস?

মোর তাই মনে হতিছে।

চল দেখি। উঠে দাঁড়ালাম।

দলে কতগুলো আছে?

শ্যাম কইলো গোটা পঞ্চাশ।

কোন দিক দিয়ে ঢুকেছে?

খয়ড়াশোল হয়ে ঢুকছে।

বাচ্চা আছে?

সাতখন।

পেটিগুলো ফেলিস না। গাড়ির মাথায় তুলে নে। পারলে গাড়ি থেকে খালি জলের বোতলগুলোয় কিছুটা ডিজেল বার করে নে। রাস্তায় কাজে লেগে যাবে।

শিবুকে কইছি, রতনদা হাত লাগাইছে।

এখন কোথায় আছে?

এখান নু দেখা যায়ঠে।

এদের চেঁচামিচি করতে বারন কর। আমি পায়ে পায়ে দাড়ুর সঙ্গে এগিয়ে যেতে গেলাম।

বড়োমা আমার হাত ধরে ফেলেছে।

দূর তোমরা এখানে বসো না। দেখি না কোন দিক থেকে আসছে।

ইসলামভাই আমার মুখের দিকে ফ্যাকাশে চোখে তাকিয়ে।

এখানে তোমার মাস্তানি টিকবে না।

সবাই আমার কথা শুনে হাসলো।

বাইরে এসে দেখলাম সবাই একসঙ্গে টিলার মাথায় জড়ো হয়ে হাতির পাল দেখছে। শিবু আছে। কেউ মুখে টুঁ শব্দটি করছে না। দারু ঠিক বলেছে। প্রায় গোটা ষাটেক হাতি আছে। নিচের রাস্তা দিয়ে দুলকি চালে বন বাদার দাপিয়ে ধ্বংস করতে করতে এগিয়ে চলেছে। যেন যুদ্ধ করতে বেরিয়েছে।

মাঝ মাঝে হুংকার ছাড়ছে। এই অরন্যে আমরাই রাজা তোমরা সবাই প্রজা।

এখান থেকে প্রায় বারোশো ফিট নিচ দিয়ে চলেছে। দেখে যা বুঝলাম এতটা ওপরে উঠে আসা ওদের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে বিশ্বাস নেই।

পালের গোদাটা মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে পেছনের যারা তারা দাঁড়িয়ে পড়ছে। বাচ্চাগুলো মায়ের পায়ের তলায় আশ্রয় নিচ্ছে।

শৃঙ্খলা পরায়ণ জীবন। রাজা একটা, দলপতি একজন। আর সবাই প্রজা।

দলপতির কথা সকলে মেনে চলে। এই জঙ্গলের রাস্তা যে তার চেনা।

এটা ওদের রাজত্ব। কোনও সভ্যতা-ভব্যতা ধোপে টিকবে না। ওদের কথাই শেষ কথা।

আমি অনেকক্ষণ দেখার পর বললাম, না-রে দারু ওরা এই পথে ওপরে আসবে না। বরং চল আমরা এগিয়ে যাই।

গাড়ির শব্দ পাইলি যদি তাইড়া করে।

তুই বড়োটাকে দেখ ব্যাটা যেদিকে মুখ ঘুরিয়ছে সেটা এদিকে নয় পশ্চিম দিকে।

মনতো তাই কয়ঠে, টুকু রইয়ে যাই।

আমকে দেখে মিত্রারা এগিয়ে এলো। সবাই চাপা স্বরে কথা বলছে।

সুরো কাছে এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়ালো। ডাগর চোখে আমার দিকে তাকাল।

তুমি আগে কখনও দেখেছো।

কদবার অনিদা মোনকার সঙ্গি হাতি তারাইছে। দেখলিনি, কইলো দারু পেটিগুলান ফেলিস লাই। গাড়ি নু টুকু তেল বাইর কইরে লে। কেনে? উপরকে উঠতি শুরু করলে তেলে ঢেলে আগুন জ্বালি দেবে, কিছু গাছ পুরবে, হাতির দল আগুন দেখলি পলায়ে যাবে। দারু বললো।

তুমি এগুলো জানো!

আমি হাসছি।

মোনকরা সঙ্গে রয়ে রয়ে জানি লিছে।

নীরু এসে বললো, সত্যি অনি এতদিন এখানে এলাম জীবনে প্রথম এরকম হাতির পাল দেখছি। কাগজে ছবি দেখি, আজ চাক্ষুষ দেখছি।

যদি তারা করে কি করবি?

গাছে উঠে পরবো।

শ্রীপর্ণা?

আপনি বাঁচলে বাপের নাম।

শ্রীপর্ণা হাসছে। বটার দিকে তাকালাম।

এখন কিছু বলবো না। আগে ঠিকঠাক পৌঁছই তারপর ওর ব্যবস্থা করছি। একবার মুখে যখন বলেছে তখন গাছে উঠিয়ে ওর শখটা মেটাব।

দেখলি এই হচ্ছে বটার দোষ, আগা নেই মাথা নেই একটা কথা বলে দিলেই হলো।

আমাদের কথা বলার ফাঁকেই দেখলাম দশখানা বাইকে কুড়িটা ছেলে এসে ভড়ভড় করতে করতে পৌঁছে গেল।

বিষান, হুইতো দারু আকার পাইশে অনি আকা দাঁইড়ে আছে।

পেছন ফিরে তাকাতেই দেখলাম বড়োমারা সব সারিবদ্ধ ভাবে পেছনে দাঁড়িয়ে।

চোখ মুখটা কেমন শুকনো শুকনো।

ভয় নেই ওরা অন্য পথে যাচ্ছে, আমাদের যাওয়ার পথ আটকাবে না।

আমার কথা শুনে বড়োমারা যেন কিছুটা আশ্বস্ত হলো।

অনুপদা, ইসলামভাইরা তখনও একদৃষ্টে নিচের দিকে তাকিয়ে।

কথা বলার ফাঁকেই ওরা এসে আমার পায়ে হুমড়ি খেয়ে পরেছে। কাউকে চিনি না।

শুধু আমি নয়। কারুর পায়েই হাত ছোঁয়াতে ওরা বাকি রাখলো না।

দারু আকা, শ্যাম আকা মোনকাকে গাড়ি চালায়ে লিয়ে যাতি কইছে।

কেন তোরা চালাবি! আমি বললাম।

জানিনি। তুমি শ্যাম আকাকে কও।

হেসেফেললাম।

ইসলামভাই-এর দিকে তাকতে ইসারয় বললো ওরা চালালে চালাক।

রতনরা তখনও বিষ্ময় চোখে হাতির পালের দিকে তাকিয়ে। আমাদের পেছনে ফেলে তখন হাতির পাল অনেকটা এগিয়ে গেছে সামনের দিকে।

অনিদা আর দেরি করিসলাই। চল, এঠিনু চলি যাই। বেলা হতিছে ভালু আসতি পারে ঝোরার জল খাতি। দেখলিনি। শোরটা এউ পথে আসতিছেল ছুড়কি মারি দিল। শিবু এসে বললো।

আমি মিত্রাদের দিকে তাকালাম। সবার চোখেই বিষ্ময়।

কিরে, শিবু কি বলে! বড়োমা বললো।

হাসলাম। এখানে আর অপেক্ষা করা যাবে না। একটু রিক্স হয়ে যাবে। তোমরা তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে বসে পরো।

রবীন তোদের আর এই পথটুকু চালাতে হবে না, ওরা এসে পরেছে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

বোচন কাছে এসে বললো।

বাবা ছুড়কিদাকে বলেছি ওদের বাইকে করে যদি যাই তুমি রাগ করবে?

হাসলাম। এই বুদ্ধিটা তোকে কে দিল?

ওরা পাঁচজন গাড়ি চালাবে পেছনটা….।

ঠিক আছে যা।

মিত্রা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে।

দুই মেয়ে তোর ওপর ফুঁসছে।

কেন!

কেন, তুই বুঝছিস না। ওরা রানিং কমেন্ট্রির মতো ম্যাসেজ করে চলেছে।

ওদের রকম সকম দেখে বেশ লাগছে। বুঝলাম ভীষণ এনজয় করছে ব্যাপারগুলো।

ওখানে আর অপেক্ষা করলাম না। সবাই গাড়িতে উঠে বসলো।

মিত্রা ইসারায় ডেকেছিল আমি বললাম, এখন না।

একবার নিচের দিকে তাকালাম। হাতির পালটাকে আবঝা দেখাচ্ছে।

আমার গাড়ির মাথায় দারু, মাঝে শিবু একবারে পেছনের গাড়িতে ছুড়কি, তারমানে মিত্রাদের গাড়িতে। সামনে পাঁচটা বাইক পেছনে পাঁচটা।

গাড়ি জোরে চালাবার কোনও উপায় নেই। কাঁচা রাস্তা। বনের কাঠ বোঝাই লড়ি চলে চলে যে টুকু রাস্তা তৈরি হয়েছে। কখনও খাঁড়াই পথ, কখনও নিচে নেমেছে। কখনও বাঁদিকে কখনও ডানদিকে গভীর খাদ দেখতে পাচ্ছি।

শম্বুক গতিতে গাড়ি এগিয়ে চলেছে ঘন শালবেনের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে।

রতন চিনাদের সঙ্গে পেছনে বসেছে। জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

কারুর মুখে কথা নেই। নিস্তব্ধ। গাড়ির ইঞ্জিনটা গঁ গঁ করে যাচ্ছে।

দেবা।

বল।

থতমার মতো বসে আছিস কেন?

যেভাবে যাচ্ছি এতো দার্জিলিংয়ের রাস্তা থেকেও ডেঞ্জার। আমাকে চালাতে দিলে সিদে খাদে ভিড়িয়ে দেব।

সেই জন্য চালাতে দিইনি।

এখন চাটা চাটি করিস না।

কনিষ্ক, দেবার দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসছে।

নীরু।

ডোন্ট ডিস্টার্ব বোর্ড ঝুলিয়ে রেখেছি।

প্রকৃতির সঙ্গে প্রেম করছিস।

তোর অসুবিধে আছে।

মোটেই না।

কনিষ্ক ওকে একটা সিগারেট দে টানুক।

ঢ্যামনা। বটা নীরুর মথায় চাঁটা মারল।

অনি সামনে যেটা বসে গাড়ি চালাচ্ছে সেটাকে চিনতে পারছিস। কনিষ্ক বললো।

অনি আকার মনে থাকবি কি করে আমি অনি আকাকে প্রথম দেখিঠি। ছেলেটি বললো।

আমি ছেলেটার দিকে তাকালাম।

কুচকুচে কালো। পেটানো চেহারা।

এটা বিষাণ, ছুড়কির ভাই, শ্যামের দু-নম্বর। মনে পরছে, ব্যাটা সালাইনের অভাবে মরে যাচ্ছিল, তোর কথা শুনে কচি ডাবের জল সালাইন হিসাবে পুশ করেছিলাম। সঙ্গে নীরুর কাঁচা খিস্তি।

এবার বিষানের মুখের দিকে ভালোকরে তাকালাম। হ্যাঁ শ্যামের থেক চূড়ার মুখের আদলটাই বেশি করে ছাপ ফেলেছে ওর মুখমণ্ডলে। আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।

সেদিন আমাদের ডাক্তারি শাস্ত্র ফেল। নীরু বললো।

ডাবের জল! বটা বললো।

কেনো তোকে ফিরে এসে গল্প বলিনি?

সেটা এই পোলা জানব কি করে?

তখন ব্যাটার মাস পাঁচেক বয়স। আমি, অনি, নীরু ঘুরতে এসেছিলাম। এসে দেখি ব্যাটার কলেরার মতো হয়েছে। সালাইন পাই কোথায় তখন ব্যাটা শুধু বমি আর পায়খানা করে চলেছে।

নুন চিনির জল ব্যাটা মুখেই তুলছে না। দু-চারবার যদিও মুখে তুললো বমি করে বার করে দিল।

এই সব দেখে অনি গুম হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলো, তারপর শিবুকে নিয়ে এক কাঁদি ডাব পেরে আনল কোথা থেকে। একবারে ছোটো ছোটো।

চোখের সামনে দেখছি বাচ্চাটা আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে।

নিজেদের বিদ্যাবুদ্ধি দিয়ে আমি নীরু যতটুকু লড়ার লড়লাম।

ফল কিছু হলো না। মনটা খারাপ হয়েগেল।

অনি আমাকে বাইরে ডেকে নিয়ে এলো।

কিরে কি বুঝছিস?

এক বোতল সালাইন পেলে কিছুটা লড়তে পারতাম।

যদি না পাস তাহলে বাচ্চাটা মরে যাবে?

কি করবো তুই বল। যা ওষুধ দেওয়ার দিয়েছি। ভেতরে জল শুকিয়ে যাচ্ছে।

এক কাজ কর।

বল।

মরে যখন যাবে একবার শেষ চেষ্টা কর।

আমি ওর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে।

আজ তোদের বলতে গিয়ে হাসি পাচ্ছে তখন সেই মুহূর্তে হাসিনি।

বলে কি আমদের গ্রামে কানাই হাতুড়েকে দেখেছি সালাইনের বদলে শালা ডাবের জল সালাইন হিসাবে চালাত। একবার দিয়ে দেখ না। আমি কচিডাব নিয়ে এসেছি।

তুই কি শিবুকে নিয়ে সেই জন্য ডাব পারতে গেছিলি!

হ্যাঁ।

বিশ্বাস কর বটা, তখন ওর ওই পাগলাম দেখে আচ্ছা করে মারতে ইচ্ছে করছিল।

আমাদের এত খরচ করে ডাক্তারী পড়া তখন পুরো জলাঞ্জলি।

তবু ওর মুখ চোখ দেখে কি মনে হলো কে জানে। নীরুকে ডাকলাম। ওকে বলতে ও তখন অনিকে এই মারে সেই মারে অবস্থা।

ও কিন্তু নীরুকে একটা কথাও বলেনি। একটাও গালাগাল দেয়নি। শুধু বললো, মরে যখন যাবে ঠাকুরের নাম করে একবার চালিয়ে দে না। যা হয় হবে।

নীরু মুখ ঝামটে বললো আমার দ্বারা হবে না। তুই পারলে চালা।

আমি বললাম, চ্যানেলটা অন্ততঃ করে দে।

নীরু তাই করলো। অনি কোথা থেক বাঁকারি দড়ি-টরি নিয়ে এলো। সাজিয়ে গুছিয়ে দিল।

ঠাকুরের নাম করে ড্রিপ চালালাম।

জীবনে কোনও দিন যা করিনি সেদিন প্রথম করলাম। ড্রিপ চালিয়ে দিয়ে বাইরে চলে এসে আমি নীরু একটা দড়ির খাটিয়াতে শুয়ে আছি।

অন্ধকার রাত্রি। সেদিন আবার চাঁদ ওঠেনি। সে কি বিভৎস অন্ধকার, হাত পাঁচেক দূরের মানুষকে পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছি না।

নীরু ফিস ফিস করে বললো, এই প্রথম নিজে ইচ্ছে করে কোনও প্রাণকে হত্যা করছি।

নীরু তখন ভুলভাল বকা শুরু করেছে। আমার যে টেনসন হচ্ছে না তা নয়।

বিশ্বাস কর বটা অনি শালা একফোঁটা ওখান থেকে নরলো না। সারারত বিষাণের দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে বসে থাকলো। আমরা ঘরের বাইরে। বলতে পারিস গ্রাম শুদ্ধু।

চূড়া কেঁদে যাচ্ছে। শ্যাম, শিবুরা গুম হয়ে বসে।

চুট্টার গন্ধে চারদিক ম ম করছে।

চুট্টা কি? দেবা বললো।

এক ধরণের বিঁড়ি তুই টানতে পারবি না একবার টানলেই কেশে মরবি।

সারারাতে ব্যাটা তিনটে কচি ডাব খেল। আমাদের হিসাব মতো এক বোতল সালাইন। ভোরের দিকে মুতের কি তেজ, ওর মার মুখ পর্যন্ত ভিজিয়ে দিল। তখন বুঝলাম ডাবে কাজ হয়েছে। সেদিন দুপুরের দিকে ব্যাটা মায়ের দুধ মুখে দিল।

সে কি হঁ হঁ আওয়াজ, যেন ওর মাকে শুদ্ধু টেনে খেয়ে নেবে।

দুপুরের দিকে আমরা দুটো খেয়ে ঘুমচ্ছিলাম। উঠে দেখি বাবু হাওয়া।

ফিরে এলো রাতের দিকে।

কোথায় গেছিলি?

একটু ঘুরতে গেছিলাম।

ওর মুখ চোখ দেখে ভালো লাগলো না। সারারাত জাগলো।

অনেক কসরত করার পর বললো, মারাংবুরুর থানে গেছিলাম।

কই আমরা এতোবার এলাম দেখিনি। বটা বললো।

আজ দেখবি। আমি বললাম।

কেনো?

আজ তো ওনারই উৎসব।

হয়তো কুড়ি বাইশ বছর আগে কোনও মানত-টানত করেছিল, আজ শোধ করতে যাচ্ছে।

আমি কনিষ্কর দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললাম।

আমি শুধু একা গল্প ঝাড়ি না, তুইও ঝাড়িস।

তোর মনে আছে। আচ্ছা বটা; আমি, তুই, নীরু, ডা. দাসের কাছে গেছিলাম এই ব্যাপারটা নিয়ে।

হ্যাঁ। মনে পড়ছে।

গিয়ে যখন ঘটনাটা বললাম তখন কি বলেছিল।

ওটা প্রাকৃতির দান, তবে একবারে কচি হওয়া চাই। তোরা খেয়ে দেখিস ওই ডাবের জল মিষ্টি নয় নোনতা নোনতা।

সালাইনের কনসেপ্ট ওখান থেকে। বটা বললো।

আজ বিষাণ অনির পাশে বসে অনিরই গাড়ি চালাচ্ছে। কনিষ্ক বললো।

এই ব্যাটা, নেমে তোর অনি আকাকে পেন্নাম ঠুকিস, ওর জন্য তুই এখনও বেঁচে আছিস। বটা ধমকে উঠলো।

নীরু হাসছে।

মা মোকে গপ্পটা কইছে। তাই অনি আকাকে মা দেবতা মানে। মন্যেও মানি।

আজ অনি আকার জন্য ওইরকম এক কাঁদি ডাব পেরে আনবি।

বিষাণ মুচকি মুচকি হাসছে।

গাড়ি গড়াতে গড়াতে একবারে নদীর ধারে চলে এসেছে। এবার কিছুটা নদীর ধার দিয়েই যেতে হবে। তারপর ধীরে ধীরে নদীর বুকে নেমে যেতে হবে। নদী গর্ভই যাওয়ার রাস্তা।

এই রাস্তাতেই সুবর্ণরেখার বুক থেকে বালি তুলে বালি বোঝাই লড়ি যাতায়াত করে।

বর্ষাকালে এই পথে আসা যায় না। নদী তখন ফুলে ফেঁপে টই টুম্বুর। ভয়াল ভয়ংকর।

অনিদা। দারু ওপর থেকে চাঁচাল।

আবার জানলা দিয়ে মুখ বার করলাম। বল।

বড়োমা গাড়ি থামাইতে কইতিছে।

কেন!

কি জানি, শিবু কইতিছে।

থামা।

যেখান নু মনকাকে হাঁটতি হবেক সেঠি থামাইঠি।

না। নদীতে নেমে থামিয়ে দে একটু ঝোপ-ঝাড় দেখে থামাস।

আইচ্ছা।

বুঝেছিস।

বুঝছি।

দারু মনে হয় চেঁচিয়ে পেছনের গাড়িতে শিবুকে বলে দিল।

বিষানের দিকে তাকালাম।

দারুর কথা শুনলি

শুনছি।

টাল খেতে খেতে গাড়ি নেমে এলো নদীর গর্ভে।

এখন সুবর্ণরেখাকে নদী বলা যাবে না। মাঝখান দিয়ে ছেঁড়া ছেঁড়া সুতোর মতো তীব্র স্রোত ছুটে চলেছে মোহনার দিকে।

পাথরের গায়ে ধাক্কা খেয়ে একটা সাঁই সাঁই আওয়াজ হচ্ছে। দূর থেকে মারাংবুরুর থানের লাল পতাকা উড়তে দেখা যাচ্ছে।

একটু এগিয়ে এসে নদীর চড়াই-এ একবারে ধার ঘেঁষে গাড়ি দাঁড় করাল বিষাণ।

সূর্য এখন মধ্য গগণে। বিশাল বিশাল শালগাছের ছায়া ঝুঁকে পরেছে নদীর বুকে।

এলোমেলো ভাবে যে যার ইচ্ছে মতো আগু পিছু করে গাড়ি দাঁড় করাল।

আমি নামেতেই দেখলাম গাড়ি থেকে মিলিরা নেমে আমাদের দিকে দৌড়ে আসছে।

বেশ লাগছে, যেন একশো মিটারের স্প্রিন্ট টানছে। 

কনিষ্ক একটু অবাক হয়ে বললো, কিরে অনি এদের হলো কি?

কাছে আসতে দে জানতে পারবো।      

আমরা সকলেই ওদের অবস্থা দেখে হেসে ফেললাম।

কনিষ্কর দিকে তাকিয়ে বললাম, তোর বউ-এর দশ বছর বয়স কমে গেছে।

তুই এর ডাক্তার।

মিলি হাঁপাতে হাঁপাতে কাছে এসে বললো, আমরা নদীতে স্নান করবো।

এখানে!

হ্যাঁ।

নীরুদের হাসি আর ধরে না।

মাত্র এক হাঁটু জল কি স্নান করবে।

আমরা তাতেই করবো বড়োমারাও করবে।

তোমাদের কি মাথা খারাপ!

হ্যাঁ মাথা খারাপ।

জামা কাপর ছাড়বে কোথায়?

গাড়িকে আড়াল করে ঠিক ছেড়ে নেব।

আমরা ছবি তুলবো। নীরু বললো।

যতো ইচ্ছে তুলো।

মিত্রা, তনু, ইসি কাছে এসে হাঁপাচ্ছে।

তুই না বলিস না। তাহলে সব গুবলেট হয়ে যাবে। ইসি বললো।

তোর বড়ের পার্মিসন নিয়েছিস?

রাখ তোর পার্মিসন। তুই হ্যাঁ বল না।

আমি কি তোর বড়?

তুই বললেই হয়ে যাবে এরা বারণ করছে।

দেখ বন–বাদার কোথায় কি হয়ে যাবে।

এতোগুলো ছেলে আছিস কি করতে, আমরা কয়েকটা মেয়ে।

এরা আছে ঠিক। তাছাড়া ওখানে পৌঁছতে দেরি হয়ে যাবে।

কিচ্ছু হবে না। মাত্র এক ঘণ্টা তার মধ্যেই সেরে নেব।

ওরকম করিস কেন। জীবনে তো আর এখানে নিয়ে আসবি না। এই প্রথম এই শেষ। মিত্রা এসে হাতটা ধরলো।

বড়োমারা সকলে হেলতে দুলতে কাছে এলো।

ও কি বলেরে মিত্রা?

দেখ না, না-ও বলছে না হ্যাঁ-ও বলছে না। তোরা রেডি হ। যা গরম, আচ্ছা করে একটু গা ডুবিয়ে নিই।

আমি ছবি তুলে দাদাকে দেখাব।

দেখাস।

ভেসে চলেগেলে কেউ বাঁচাবে না।

বাঁচাস না।

শুভরা দেখলাম সব রেডি হয়েই চলে এসেছে।

দিদান, তোমরা এই কাপর পরে নামবে, না চেঞ্জ করবে? বোচন আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বললো। আজ তোমার কথা শুনছি না। আজ আমরা আমাদের মতো।

দারুর দিকে তাকালাম।

বড়োমার যখন মন করতিছে লামতি দে, মন্যেও সঙ্গে রইবো।

অনুপদারাও দেখলাম যা পরে এসেছিল ছেড়ে-ছুড়ে চলে এসেছে।

আমি ওদের দিকে তাকিয়ে হাসছি।

তার মানে তোমরা প্রি-প্ল্যান্ড করেই এসেছো।

তা একটু-আধটু করেছি। ছুড়কি বললো, এই পথ দিয়ে সচর আচর কেউ আসে না। এদিকটা নাকি ঘনো জঙ্গল। মজা যখন করছি একটু বেশি করেই করি। ফাঁকি দেব কেন। অনুপদা বললো।

ছবি তুলে কাগজে ছাপবো।

কেন! নেতারা কি মানুষ নয়।

অনুপদারা আর অপেক্ষা করলো না, এগিয়ে গেছে। শুভ, সুন্দররা ততক্ষনে জলে নেমে পরে হুটো-পুটি শুরু করে দিয়েছে। মিত্রারা রেডি হয়ে দৌড় দিল।

নীরুর দিকে তাকালাম।

আমি যাব না। ওরা যাক।

তুই যাবি না মানে। বটা তেরে গেল।

হাসা-হাসি শুরু হয়ে গেল।

আর কেউ সময় নষ্ট করলো না। যে যার রেডি হয়ে নেমে গেল।

আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দূর থেকে ওদের দেখছি। ছেঁড়া ছেঁড়া হাসাহাসির আওয়াজ। পরিবেশটাকে আরও যেন মোহময়ী করে তুলছে। বাঁধ ভাঙা আনন্দে সকলে ভেসে যাচ্ছে। এক হাঁটুর একটু বেশি জল, ওদের কাছে এক কোমড়ের সমান। এক একটা গ্রুপে সকলে জলে ভাসছে। তনু-মিত্রারা বড়োমাদের কাছা কাছি। মিলিরা কখনও বড়োমাদের সঙ্গে কখনও ছুটে চলে যাচ্ছে কনিষ্কদের কাছে। পিকু, নম্রতাকে দেখলাম শুভদের সঙ্গেই আছে। মিকি-মাম্পিদের দারু একবার কোলে করে নামিয়েছিল তারপর আবার নদীর পাড়েই দাঁড় করিয়ে রেখেছে। ওরা নদীর বালি নিয়ে মাখা মাখি করছে।

মিত্রা একবার হাত তুলে ডাকলো। কাছে যাওয়ার জন্য।

আমি হাত তুলে হাসলাম।

গাড়ির আড়ালে এসে একটা সিগারেট ধরালাম। কয়েকটা ছেলে দেখলাম গাড়ির মাথায় বসে। দারু মনে হয় ওদের এখানে ডিউটি দিয়ে গেছে।

আলতাফদের সঙ্গে একবার ফোনে কথা বলে নিলাম। ওরাও হাসাহাসি করছে।

কথায় কথায় বললো কিছু কিছু আনন্দ থেকে আমরা বঞ্ছিত হচ্ছি, সময় সুযোগ হলে সুদে আসলে তুলে নেব। তখন বারন করতে পারবে না।

ওদের সমস্ত খবর নিলাম। আপাতত এখনও পর্যন্ত ঠিক আছে।

আরিত্র অর্কদের সঙ্গে কথা বলে নিলাম। এখন পরিবেশ অনেকটা অনুকূল। মিডিয়া সাগর, অনাদিকে নিয়ে কনটিনিউ চটকে যাচ্ছে।

এক ঘণ্টার জায়গায় ওরা দু-ঘণ্টা পার করে দিল।

দারু, ছুড়কি বেশ কিছু সাঙ্গপাঙ্গকে দেখলাম ওদের সঙ্গে জলে নেমে পরেছে।

সবাই আজ বাঁধন ছেঁড়া আনন্দে মেতে উঠছে। আমি মাঝে মাঝে চেঁচিয়েছি, একঘণ্টা হয়ে গেল, দেড়ঘণ্টা হলো।

বেশ বুঝতে পারছি বড়োমা ওখান থেকে দাঁত, মুখ খিঁচিয়ে বৌদি, ছোটমাকে কিছু বলছে, এখান পর্যন্ত সেই শব্দ এসে পৌঁছচ্ছে না। চোখে মুখে সকলের খুঁশির ছোঁয়া। মাঝে মাঝে অট্টহাসির মতো সকলে হেসে উঠছে।

বিষাণ নদীর ধারেই ছিল। ছুটতে ছুটতে কাছে এসে বললো, বাবা তুমার সঙ্গে কথা কইবে কইতিছে।

আমার হাতে নিজের ফোনটা দিল।

হাতে নিয়ে হ্যালো বলতেই, হো হো হাসির শব্দ। কিছুক্ষণ হেসে নিয়ে শ্যাম বললো।

ফানদে পরিইছু।

কি করি বল। এই সবে মাত্র সকলে জল থেকে উঠতে শুরু করেছে।

ঘন ঘন আনলি এউটা হইতোনি।

তুই কোথায়?

আমি মোড়লের ঘরকে আসছি।

কেন?

তন্যে আসুনি, ডাইকা পঠাইল।

আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর পৌঁছে যাব।

সে তন্যে যদবা আইসু ক্ষতি লাই, অখন মোর দরের কাছে চইলে আসছু।

অনুপদা এসেছে। কাজটা আজই সেরে নিবি। কাল দশটা সাড়ে-দশটার সময় বেরিয়ে যাব।

হবেক লাই।

কেন!

আজ তনকাকে আতিথ্য দেখাইতে পারবোনি। আজ পরব।

তোকে আর আতিথ্য দেখাতে হবে না।

হবেনি। বড়োমারা প্রেত্থম আসছে। কাল ছ্যাগল কাটব দুফুরে খ্যায়া তারপর যাইস।

এখন রাখি ওদের তাড়া লাগাই, না হলে বিকেল গড়িয়ে যাবে।

ওন্যে আনন্দ করতি আইসছে, টুকু আনন্দ করতি দে।

রাখি।

লাইনটা কেটে বিষাণের হাতে দিলাম।

বড়োমারা একে একে ওপরে উঠে আসছে। এইরকম ভাবে কোনওদিন স্নান করেছে বলে মনে পরছে না। গঙ্গায় স্নান করেছে ঠিক। তবে এইভাবে নয়। সবাই হাসাহাসি করতে করতে হেলতে দুলতে উঠে আসছে। জ্যেঠিমনি, সোনাআন্টি, বৌদি একসঙ্গে রয়েছে। বড়োমা, ছোটমা, দামিনীমাসি এক সঙ্গে। ওদের ঠিক পেছনেই মিত্রারা দঙ্গল বেঁধে।

ভিঁজে জামাকাপর গায়ের সঙ্গে লেপ্টে আছে। সবার চোখে মুখে খুশির ঝিলিক। আমার দিকে হাত নেড়ে যে যার গাড়ির আড়ালে চলে গেল।

ছোটোমার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বললাম।

মল্লিকদাকে ফোন করছি।

ছোটোমা দাঁত মুখ খিঁচিয়ে কিছু একটা বললো বটে কিন্তু সেই শব্দ এখান পর্যন্ত পৌঁছল না। তবে সমস্বরে হাসির শব্দটা শুনতে পেলাম।

দারুণ এনজয় করলাম বুঝলি বুবুন। মিত্রা ওখান থেকেই চেঁচাল।

ভিঁজে জামাকাপর শরীরের সঙ্গে আটার মতো সেঁটে আছে। কারুর মনে কোনও সংকোচ নেই। অবিরত চেনা মুখগুলো আজ কেমন সব অচেনা। বার বার কালকের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। কালকে এই সময় কি অবস্থা ছিল। আর আজ? একবারে উল্টো। এটাই মনে হয় মানুষের জীবন। এই জীবনকে মনে নিয়ে মানিয়ে নিয়ে আমাদের অবিরত এগিয়ে চলা।

হারামী আমারটা কেন নিজের বউ-এর টা গিয়ে টিপতে পারছো না।

নীরুর কথা শুনে পেছন ফিরে চমকে তাকালাম।

শরীরে একটা বস্ত্র নেই শুধু ড্রয়ারটা পরা।

ওর দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললাম।

অনিকে দেখে শেখ।

হাত ধরাধরি করে স্নান করছে। ঢ্যামনা যেন হনিমুন করতে এসেছে।

অনিকেত নীরুর কোমরটা খামচে ধরেছে।

কনিষ্ক, বটা, দেবাশীষ হাসতে হাসতে টাল খাচ্ছে।

তুই দেখ অনি। কনিষ্কটার বয়স বারছে না। যেন দিন দিন কচি হয়ে যাচ্ছে। নীরু নালিশ করলো।

কেন তুই শ্রীপর্ণার হাত ধরে জলে বসে থাকিস নি? ভেবেছিলি কিছু দেখছি না। জলের তলায় পায়ে পা ঘষা, ইন্টু-মিন্টু। রস চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে, তাই না। কনিষ্ক বললো।

নীরু একটা অদ্ভূত মুখ করে কনিষ্কর দিকে তাকিয়ে হাসছে।

বটা ছবি তুলেছে। অনিকে দেখাব।

দেখাস।

তোদের চোখ তো লাল হয়ে গেছে। আমি বললাম।

জলটা কি ঠাণ্ডারে। বেশ ভালোলাগছিল, উঠতেই ইচ্ছে করছিল না। আমি তো বেশ কিছুক্ষণ ওই পাথরের গায়ে হেলান দিয়ে জলে শুয়ে ছিলাম। দেবাশীষ বললো।

অদিতি কি বললো।

ধারে কাছেই এলো না। তবে চোখমুখ দেখে বুঝলাম দারুণ এনজয় করেছে।

শালা এতোবার এসেছি। একবারও সুবর্ণরেখায় স্নান করিনি। টিউবওয়েল, ইঁদারা। বটা বললো।

সখ মিটিয়ে নিলি। আমি বললাম।

হ্যাঁ। মনের সুখে স্নান। টিনাকে এতদিন গল্প বলেছি। আজ নিজের চোখে সব দেখছে।

তাহলে আজ রাতে অনেকটা সময় তোকে বেশি দেবে, কি বল?

বটা এমন একটা মুখ ভঙ্গি করে আমার দিকে তাকাল, হেসে ফেললাম।

তবে, এই না হলে অনি। নীরু চেঁচিয়ে উঠলো।

যাব দেখবি। বটা গম্ভীর হলো।

কেন, এখন তো শ্রীপর্ণার হাত ধরে জলে বসে নেই।

দেবাশীষ হাসতে হাসতে বালির ওপর বসে পড়লো।

তনু চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে আমার কাছে এসে দাঁড়াল। এরই মধ্যে পোষাক বদলে ফেলেছে। একটা সাধারণ সারি আটপৌরে করে পড়েছে। বেশ লাগছে। এলো চুল হাওয়ায় উড়ছে।

আবার শুরু করে দিয়েছো? এতক্ষণ ওখানে একটুও….।

এদিকে কেন। এটা জেন্টস জোন। নীরু চেঁচিয়ে উঠলো।

বলবো ওকে, জলে কি করছিলে।

বটা, কনিষ্ক খুব জোড়ে হেসে উঠলো।

দেখলি। ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। দেবাশীষ বললো।

তনু আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।

দিদি বললো, একটু কফি খাবে। যে টুকু আছে সবাই মিলে শেষ করে দিই।

এখনও আছে!

তনু ম্যাডাম আমাদের ফ্লাক্সটা দেখো, মনে হয় কিছুটা পড়ে আছে। কনিষ্ক বললো।

ক-কাপ হবে?

তিন-চার কাপ হবে।

তাহলে ওটা ঢালো, কিছুটা নিয়ে আসি। স্ন্যাকস কিছু আছে?

দুটো বিস্কুটের প্যাকেট আছে মনে হয়।

নেই। নীরু বললো।

খেয়ে নিয়েছিস! কনিষ্ক বললো।

গাড়ি এতো টাল খেলে হজম তাড়াতাড়ি হয়।

শুনলে ওর কথা।

তনু হাসছে।

দূরে তাকিয়ে দেখলাম চাঁদ, চিনা, রতন সবে মাত্র জল থেকে উঠলো ওদের সঙ্গে দারু, শিবু।

ওখান থেকেই আমার দিকে হাত তুললো, অনিদা।

আমি হাত তুললাম।

তুমি চলো, ওরা রেডি হয়ে আসুক।

তনু, কনিষ্কর দিকে তাকাল।

ফ্লাক্সটা নিয়ে এসো। ওই গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে সবাই এক সঙ্গে খাব।

যাও যাচ্ছি।

ভিঁজে জামাকাপর একটা প্যাকেটে রাখবে, গিয়ে শুকতে দেব।

কনিষ্ক হাসছে।

আমি তনুর পাশে হাঁটতে শুরু করলাম। দূরত্ব বজায় রেখে গাড়ি দাঁড় করানো রয়েছে।

বড়োমাদের গাড়িটা একবারে বনের ধার ঘেঁষে রাখা হয়েছে। গাড়ির দরজা খোলা তার ওপর জামাকাপরের বোঝা দেখতে পাচ্ছি।

তনুর দিকে তাকালাম। মাঝখানে সিঁথি করেছে। এলো চুল হাওয়ায় উড়ছে। নিরাভরণ মুখ মণ্ডলে উচ্ছ্বাসের রং।

দারুণ এনজয় করলাম। মেয়েরা থাকলে আরও ভালো লাগতো।

ওদের নিয়ে একবার আসবো।

আমরাও আসবো।

না। শুধু আমি আর দুই মেয়ে। খুব বেশি হলে ছেলেরা থাকবে।

তা কেন, আমাদের জন্যই ওরা।

তনুর দিকে তাকিয়ে হাসলাম।

তুমি নামলে না কেন?

কি জানি, মন চাইল না।

বুঝেছি, মেয়েরা নেই তাই।

না না সেরকম কিছু নয়।

ওরা ভীষণ এনজয় করছে।

নম্রতা, নম্রতার মা ঠিক আছে?

এখন অনেকটা স্বাভাবিক।

আজ তোমরা সবাই এই জায়গাটাকে পঁচিশ বছর পর দেখছো। পঁচিশ বছর আগে দেখলে ভয় পেতে।

কেন!

তখন এই অরণ্যের গভীরতা অনেক বেশি ছিল। এখন তো অরণ্যের সেই নিবিড় ভাবটাই নেই। কতোবার বাইকে করে যেতে গিয়ে ভাল্লুকের তাড়া খেয়েছি।

তনু থমকে দাঁড়াল।

হাসলাম। ভাবছো গল্প বলছি।

না তা নয়।

এই জায়গাটাই এরকম। তোমাকে এদের সঙ্গে থাকতে গেলে এদের মতো হয়ে যেতে হবে। না হলে তুমি অতিথি হয়ে যাবে, ঘরের লোক হবে না।

তনু মাথা নিচু করে আমার পাশে হাঁটছে।

ছেলে কি বললো?

বাবার কাছে অনেক কিছু পাওয়ার আছে বুঝলে মা, নিয়ে শেষ করতে পারব না।

হাসলাম।

জিজ্ঞাসা করলে না আমি কি বললাম?

বলো।

বললাম, কখনো চাইবি না, তাহলে কিছুই পাবি না। আমি চেয়েছি বলে আমাকে শূন্য হাতে ফিরতে হয়েছে।

আমি একবার তনুর মুখের দিকে তাকালাম।

জীবনে এরকম হয়েছে নাকি?

হয়েছে বলেই ছেলেকে সাবধান করলাম।

হাঁটতে হাঁটতে বড়োমার গাড়ির কাছে এলাম। গাছের ছায়ায় সকলে দাঁড়িয়ে।

এরই মধ্যে সকলে রেডি হয়ে নিয়েছে। দামিনীমাসি মুখ টিপে হাসলো।

খুব হাসছো যে মনে রাখবে….

আমি সব মনে রেখেছি। তুই একটুও মনে রাখিসনি।

ভজু এসে বললো আমি, মাম্পি, মিকি সাঁতার কাটলাম।

ভজুর ইনোসেন্ট মুখটা ভীষণ ভালো লাগল। টেরি বাগান চুলটা ঘেঁটে দিলাম।

ভজু হাসতে হাসতে চলে গেল।

ছোটোমার কানে ফোন। আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।

ইসলামভাই, ইকবালভাই সাদা ধবধবে একটা সেরওয়ানি পড়েছে। দারুণ লাগছে দেখতে।

মুঠো মুঠো রোদ সকলের চোখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে।

বহু বছর পরে নদীতে স্নান করলাম, বুঝলি অনি, সেই কবে মেঘনার জলে শরীর ডুবিয়েছিলাম আজ আর মনে নেই। দিদিকে তাই বলছিলাম….।

ধর তোর মল্লিকদা কি বলে শোন।

ছোটোমা আমার হাতে ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে তরতর করে বড়োমার কাছে চলে গেল।

ইসলামভাই হেসে ফেললো। ওরাও তোর কাছ থেকে শুনতে চায়।

ফোনটা কানে তুললাম।

হ্যালো।

হনিমুনটা ভীষণ মিশ করলাম।

জোড়ে হেসে উঠলাম। ইসলামভাই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে।

ছোটোমা আমার হাসির শব্দে একবার মুখ ঘুরিয়ে তাকাল।

ছোটোমাকে বলবো।

এখুনি জুতোর বাড়ি মারবে।

কি বলছে রে? ছোটোমা ওখান থেকেই চেঁচাল।

তরপাচ্ছে না। মল্লিকদা বললো।

হ্যাঁ।

কখনও ছোটোগল্প লিখতে জানে না বুঝলি। সব সময় বড়ো বড়ো উপন্যাস লিখবে।

তুমি এখন কোথায়?

রান্নাঘরে খুন্তি নারছি। বিধানদা, অনিমেষদা এই এলো।

এতো দেরি!

ঠোক্কর খেতে খেতে এলো।

খবর কি?

সাংবাদিকরা এসে ভিড় করেছিল। অনিমেষদা ভাগিয়ে দিল, বললো যা বলার বিকেলে প্রেস কনফারেন্স করে বলবো।

কাগজের হাল?

সকালে অরিত্র এসেছিল। দাদাকে দুটো লেখা দেখাল। দাদা বললো অনিমেষ আসুক, একটু কথা বলে নিই। তুই বিকেলে এসে নিয়ে যাস।

এখন কোথায়?

দাদার ঘরে মিটিং চলছে।

ডাক্তারদাদা?

একটু আগে সোনাদির সঙ্গে কথা বললো। বহুত খুশ।

কলকাতার রিপার্কেসন?

অনাদি, সাগর দুটোকেই শুইয়ে দেবার তোড়জোড় চলছে। যেটুকু কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছি অনিমেষদা একটু নরম মনোভাব দেখালেও বিধানদা খেপচুয়াস। তারওপর বৌদি আগুনে ঘি ঢেলেছে।

কেন!

বিধানদাকে বলেছে, এই সুযোগ যদি হাতছাড়া হয়েছে আমি রাজ্যকমিটি থেকে রিজাইন দেবো।

হঠাৎ!

মনে হয় ওখানকার কিছু আপডেট দিল।

হাতীর গল্প শুনলে?

শুনলাম কিরে! দেখলাম, তোর ছোটোমা যেভাবে রানিং কমেন্ট্রি করলো।

তাহলে উপন্যাসটা ভালই লিখেছে বলো।

এই তো ছোট্ট করে দিয়ে দিলি। জানি তুই তোর ছোটোমার দলে।

আমি হাসছি। নাতনির সঙ্গে কথা বললে?

সকাল থেকে ফোন করেনি। কাল রাতে কথা হয়েছিল।

বড়োমা যে বললো কাকে রেখে এসেছে রান্নার জন্য। তুমি রান্না করছো?

দাদা ভাগিয়ে দিয়েছে। বললো তুমি বাপু ঘরদোর একটু পরিষ্কার করে দাও। আমরা ঠিক ম্যানেজ করে নেব। তোমাকে ভাবতে হবে না। কেটে কুটে দিয়েছে। আমি নেড়ে নিচ্ছি।

দোকান থেকে রেডিমেড নিয়ে আসতে পারতে।

রাতে নিয়ে আসবো। এ বেলাটা কোনও প্রকারে ম্যানেজ করে নিই।

দাদা টেনসন করছে না।

আগে দেখতাম একটু হলেই তোকে নিয়ে কেমন টেনসন করতো। এখন কেমন খোস মেজাজে থাকে। কাল এতো ঘটনা ঘটলো। আমি তবু একটু টেনসন করেছিলাম। সামন্তদা, দাদা বেশ খোস মেজাজে, চা খেল গল্প করলো।

কনফিডেন্স বেড়ে গেছে।

ঠিক বলেছিস।

এখন রাখি। তাড়া না লাগালে এদের নড়া-চড়ার মন নেই।

একটু আনন্দ করতে দে। আমরা দু-জন কোনওদিন পারলাম না। তবু তোর জন্য একটু আধটু আনন্দ করতে পারছে।

এই সেন্টু মারতে শুরু করলে।

নারে তোর ছোটোমা কথা বলতে বলতে গলা ভাড়ি করে ফেলছিল। কি বলবো বল। অনেক সাধ্য সাধনা করে তোর মতো ছেলেকে পেয়েছি।

ফালতু কথা কম বলো।

তোর মল্লিকদা যা সত্যি তা চিরদিন গলাফাটিয়ে বলেছে। আজও ঠিকটাই বলছে। নাহলে দামিনীমাসির মতো মেয়ে দাদার সঙ্গে কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলবে কেন।

আমি চুপ।

ভজু কি বললো জানিষ।

কি।

দাদা তোমার জন্য একটা শাল গাছের চাড়া তুলেছি বাড়িতে গিয়ে পুঁতবো।

হাসলাম।

চলবে —————————–



from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/WXHS4e8
via BanglaChoti

Comments