কাজলদিঘী (২০৫ নং কিস্তি)

❝কাজলদীঘি❞

BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

২০৫ নং কিস্তি
—————————–

এরপর একদিন অনুপের দিল্লীর বাড়িতে বসে বিনদকে সব ব্যাপারটা বললাম।

শুনেই ও খেপে গেল। এখুনি গিলে নিই। বললাম অপেক্ষা কর। তুই আমাকে ধীরে ধীরে সব জানা। যেদিন তোকে আমি সিগন্যাল দেব সেদিন কাজ করবি। একটাই কথা মনে রাখবি আফতাবভাই—এর কেশ নিয়ে যখনই ও মাথা ঘামাবে আমাকে খবর দিবি।

আফতাবভাইও জানতে পারলো বিনদ নিজে বাঁচার তাগিদে আফতাবভাই—এর এ্যান্টি হয়ে গেছে। আমাকে যে দু—একবার এই বিষয় নিয়ে বলেনি তা নয়, আমি গা করিনি।

বিনদকে দিয়েই দেবাকে ধরলাম। বললাম দেবার সঙ্গে একটা আন্ডার স্ট্যান্ডিংয়ে আয়।

আমার কথা মত বিনদ কাজ করলো।

এরমধ্যে বিনদ যে আফতাবভাই—এর কয়েকটা ক্ষতি করে নি তা নয়। আমার কথা মতো করেছে। আফতাবভাই চেঁচা—মিচি করেছে। বুঝিয়েছি তোমার বিজনেসের আড়াই পার্সেন্ট ওয়েস্টেজ মানি। বিনদ যেটা করছে ওটা ওই আড়াই পার্সেন্টের মধ্যে পরে। তুমি একটু হিসেব করো বুঝতে পারবে। আবুভাইকে অংকটা বুঝিয়ে দিলাম। অফতাবভাই মেনে নিল।

আমার তখন ধ্যানজ্ঞান টোডিকে বেঙ্গলে নিয়ে আসা। আমার হাতের মুঠোয় নিয়ে এসে ওকে শেষ করবো।

বিনদ তখন টোডির একনম্বর এজেন্ট। দেবার সাহায্যে বিনদ তখন অনাদি, সাগর পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। বেঙ্গলের সঙ্গে তখন ওর ভালই হোল্ড। আমিও ওকে সাহায্য করছি। আমার টিপসগুলো বিনদ টোডির কানে তোলে। টোডি মিলিয়ে দেখে বিনদ যা বলছে সব মিলে যাচ্ছে। আরও বেশি করে টোডি বিনদকে আঁকড়ে ধরে।

আমি শুধু বিনদকে বলেছিলাম তুই যে ভাবে হোক টোডিকে বেঙ্গলে ঢোকা। বাকিটা আমি বুঝে নেব। এর মধ্যে টোডি অনাদির মারফৎ অস্ত্র ব্যবসা করলো। বিনদ ভাল টাকা কামাল। বড়ো একটা স্ক্যাম আমার ঝুলিতে চলে এলো। তারপর সমস্ত কাগজ পত্র বিনদ আমাকে সাপ্লাই করলো। রাঘবনের থ্রু দিয়ে বিনদকে বেশ কয়েকবার আমি বাঁচিয়েছি। ওর প্রত্যেকটা কাজের প্ল্যান প্রোগ্রাম আমি করে দিয়েছি।

অর্জুনের সঙ্গে বিনদের হিঁচ থাকলেও কেউ কখনও কারুর সঙ্গে ঝামেলায় জড়ায়নি।

তার পেছনেও আমি। দুজনকেই আলাদা করে বোঝাতাম।

বলতে পারিস সবার সঙ্গে সবার একটা স্থিতাবস্থা বজায় রাখতাম। মাঝখান থেকে আমার কার্যোদ্ধার। সবচেয়ে বড়ো কথা আমি ওদের কারুর কাছে কোনও দিন কিছু চাইতাম না।

বিনদ কতবার বলেছে। দাদা এই টাকাটা তুমি রাখ। আমি বলেছি না। তোর কাছে থাক। যখন আমার প্রয়োজন হবে চেয়ে নেব।

সেই চাওয়াটা এদের কাছ থেকে কোনও দিন হয়ে ওঠেনি। ফলে যা কিছু এই বিশাল সাম্রাজ্য সব ওদের নিজস্ব। তাই ওরা সকলে আমার জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত। তাই আমার ছোট ছোট চাওয়াগুলো ওর ভীষণ গুরুত্ব দিত। আমার কেউ ক্ষতি করতে চাইলে ওরা তার আগেই টের পেয়ে যেত। ওরাই তাকে সরিয়ে দিত।

আফতাবভাই এখানে এসেছে। সেটা ও জানে। আফতাবভাই যে এই প্রজেক্ট করতে চাইছে সেটাও ও জানে। কিন্তু আমি যে এই প্রজেক্টের সঙ্গে ইনভলভ সেটা ও জানতো না। আমিও বলি নি। কারণ আমি জানতাম সই সাবুদ হয়ে গেলে বিনদকে বলবো। অনাদি—সাগর যে এই ছুটকো ব্যাপারটার জন্য ওর হেল্প নেবে সেটা বুঝিনি। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওকে ম্যাসেজ করি। দুর্ভাগ্য সময় মতো ওর কাছে ম্যাসেজটা পৌঁছয়নি।

তাই ভিকিকে বললাম ব—কলমায় তুই বিনদের টিমটাকে হেল্প কর। তারপর আমি বুঝে নিচ্ছি।

শুভকে তাই বেছে নিলাম। ওকে সব বললাম ও শুনেই চার্জড হলো। বললো আমি যাব আঙ্কেল। তুমি আমার ওপর বিশ্বাস রাখতে পারো।

একদিন আমিও এইভাবে আস্তে আস্তে ঢুকে পড়েছিলাম এই জগতে। ওকে সব ব্যাপারটা বোঝালাম। বললো আমি পারব। আমি কোনওদিন ডিমান্ড করবো না।

বললাম খুব যদি মনে করিস তাহলে অংশু, নম্রতাকে নিয়ে কাজটা কর।

শুভ কথা রেখেছে। ওর নার্ভটা এদের থেকে স্ট্রং।

তোরা একটা কথা মনে রাখবি। তুই যদি কারুর কাছ থেকে কিছু না চাস তাহলে সে নিজে উপযাচক হয়ে তোকে হাতভরে দেবে। আর তোর চাহিদাটা যদি সীমিত থাকে তাহলে এরা তোকে মাথায় করে রাখবে।

আমার বিশ্বাস শুভ একদিন এই জায়গাটায় বিলংস করবে।

আমি ব্যক্তিগতভাবে ওকে যাচাই করেছি। ও পরীক্ষায় সফল ভাবে উত্তীর্ণ হয়েছে।

ওরা দুজনেই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। ওদের চোখ মুখ দেখে বুঝতে পারছি। ওরা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে ঠিক কিন্তু অন্য কথা ভাবছে।

আমি দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে জোড়ে ঝাঁকুনি দিলাম।

মিত্রা হেসে ওর গালটা আমার কপালে ছোঁয়াল। তনুর মুখ আমার বুকে।

তুই শুভকে ভীষণ ভালোবাসিস।

মিত্রার ঠোঁট আমার ঠোঁটের কাছে। চোখে চোখ। তনু আমার বুকে মাথা রেখে তাকিয়ে।

ভালোবাসি কিনা বলতে পারবো না তবে ওর প্রতি ভীষণ একটা টান অনুভব করি। ওর মুখের দিকে তাকালেই সেদিনকার ছবিটা আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

খবরটা পেয়েই ছুটে গেছিলাম। বিছানায় আদল গায়ে উপুর হয়ে শুয়ে আছে। অবিন্যস্ত এক মাথা কোঁকড়ান কালো চুল। হয়তো মা মা বলে কেঁদে কেঁদে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। তখন ওই দুধের শিশুটা জানেই না। ওর মাকে কারা গুলি করে মেরে রেখে গেছে।

যখন বিছানা থেকে ওকে কোলে তুললাম ও ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে উঠলো। চোখে জল ভরে উঠেছে। ভাগ্যিস আমাকে ও তার আগে দেখেছিল। মুখ চিনতো। কচি কচি হাতে আমার গলা জড়িয়ে ধরে। হয়তো পরে ওর মাকে অনেক করে খুঁজেছিল। পায়নি।

তাই পরিচিত মুখের দেখা পেয়েই গলা জড়িয়ে ধরেছে। অস্ফুট স্বরে একবার মা বলে ডেকেও উঠে ছিল। বুকের ভেতরটা দম বন্ধ হয়ে এসেছিল। তারপর সব ইতিহাসে লেখা রয়েছে। সারা জীবন চেষ্টা করেও ওর মাকে ফিরিয়ে দিতে পারিনি। আমার থেকেও ছোট বয়সে ও মাতৃ—পিতৃ হারা হলো।

আর বলতে পারলাম না চুপ করে গেলাম।

ওরা আমাকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ চুপ চাপ শুয়ে থাকল। আমিও কেমন চুপচাপ হয়ে গেলাম।

অনেকক্ষণ পর বুঝলাম আমার বুকটা কেমন ভিঁজে ভিঁজে লাগছে।

একটু নড়েচড়ে উঠলাম।

ওরা আমার মুখের দিকে তাকিয়েছে। দুজনেরি চোখ দুটো জলে ভেঁজা।

আমি ওদের দিকে তাকিয়ে রয়েছি। আমার যে খারাপ লাগছে না তা নয়। ওদের সান্তনা দেওয়ার ভাষা আমার নেই। তবু বললাম।

কেঁদে কি করবি। আমি এরকম অনেক ঘটনার সাক্ষী। তাই কাজের মাঝে সব কিছু ভুলে থাকতে চাই।

তবু ওরা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। চোখ ছল ছল করছে।

তোরা আমাকে কি বলবি বললি, বললি না?

তনু কান্নাভেঁজা চোখে হাসলো।

তনু তুই বল। মিত্রা বললো। গলাটা ধরা ধরা।

তনু বুক থেকে মুখ তুলে আমার মুখের কাছে এগিয়ে এলো।

তোমার মন ভাল নেই।

না না বলো। আমি সব সময় এরকম। তোমরা দেখছো তো।

তনুর চোখমুখ দেখে বুঝলাম নিজে মনে মনে গুছিয়ে নিল। একবার মিত্রার মুখের দিকে তাকাল।

অনিসার সঙ্গে শুভর একটা রিলেসন তৈরি হয়েছে, এটা তুমি জান।

কথাটা শুনলাম ঠিক কিন্তু আমার মনে সেরকম একটা আলোড়ন তুললো না। এটাই যেন ভবিতব্য ঈশ্বরের অসীম ইচ্ছা। বললাম।

জানি না বললে ভুল হবে। আবার সম্পূর্ণ জানি এটা বলাও ভুল।

এই তুমি ডিপ্লমেসি করতে শুরু করলে।

বিশ্বাস করো। এই ব্যাপারটা নিয়ে আমি মাথা ঘামায়নি। তবে দুজনের মধ্যে খুব ভাল একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং আছে সেটা বুঝি।

সেই আন্ডারস্ট্যান্ডিং—এর ব্যাপার নিয়েই সেদিন ছোটোমা ছিপ ফেলেছিল। তারপর ছোটোমা আমাদের সব বলে। তোরা একবার অনির কানে তোল। পরে শুনলে হয়তো ও একটা রনংদেহি মূর্তি ধরলো, তখন আবার আর এক বিপদ।

বিপদের কি আছে। সব তোমার আমার হাতে নেই। তাদের নিজেদের একটা স্বাধীন মতামত আছে। তাকে গুরুত্ব দিতে হবে। আমার জীবনটা তোমরা দেখছো। আমি চাই না, আমার জন্য ওদের জীবনটা নষ্ট হোক। শুধু একটা ব্যাপার মনে রাখবে নোংরামি আমি পছন্দ করি না। এটা তোমাদের আলাদা করে নিশ্চই বলতে হবে না।

না না সে ব্যাপার নিয়ে তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পার। তুমি ওদের সবার কাছে আইডল। ওরা এমন কোনও কাজ করবে না। যাতে তুমি আঘাত পাও। সেদিকে ওদের টনটনে জ্ঞান আছে। পিকু যে ভুল করেছে ওরা সেই ভুল কখনো করবে না।

কি বলেছে ছোটোমা।

দিদি তুমি বলো, আমি তোমার মতো গুছিয়ে বলতে পারি না।

সেদিন কথা প্রসঙ্গে ছোটোমা বললো, হ্যাঁরে বুঁচকি আর শুভর মতিগতি তোরা কিছু বুঝিস।

আমি হাসতে হাসতে বললাম।

কি আর বুঝব। প্রেমে যদি পড়ে ওর বাবা বুঝবে।

তারপর ছোটোমাই বললো, আমার ভাল ঠেকছে না। সেদিন নাকি দুটোকে ডেকে আলাদা কথা বলেছে।

কবে?

প্রথম মিটিংটা যেদিন হলো তার পরদিন।

কি জিজ্ঞাসা করেছিল।

ছোটোমার যেমন কথা। তোরা দুটোতে কি শুরু করেছিস। জানিস তো এই বাড়িতে একটা রয়েল বেঙ্গল টাইগার আছে। তার চোখে পরলে রক্তারক্তি হয়ে যাবে।

তখন শুভ বলেছে তুমি ঠিক কি বলতে চাইছো দিদান, বুঝতে পারছি না।

কেন বয়সটা কি এখনও ছোট আছে।

তখন শুভ বলেছে। অনিসা কি ভবেছে আমি বলতে পারবো না। আমি আমার কথা বলি, অনিসা অনিসার কথা বলবে। বাকিটা তুমি আমাদের দুজনের কথার মধ্যে থেকে জাজ করে নেবে।

অনিসা আমার খুব ভালো বন্ধু। ছোটোমা, বড়োমা, আঙ্কেলও খুব ভালো বন্ধু ছিলেন। পরবর্তীকালে সময় সুযোগ তাদের এক ছাদের তলায় থাকার অধিকার দিয়েছে।

এই অধিকার এমনি এমনি আসেনি। অর্জন করতে হয়েছে।

আমরা দুজনে সেই সুযোগ পাব এটা কখনও ভাবি না। যদি সেই সুযোগ কখনও হয় আমরা মেন্টালি প্রস্তুত আছি। না হলে যেমন আছি তেমন থেকে যাব। আপত্তি নেই।

তবে তোমায় একটা কথা বলে রাখি, আঙ্কেলের কথার অবাধ্য হয়ে বেঁচে থাকতে চাই না। সেই বেঁচে থাকার মূল্য অর্থহীন। এটা বুঝেছি নেপলা আঙ্কেলদের দেখে, ভাইদাদাইকে দেখে। তারা তো কেউ খারাপ ভাবে বেঁচে নেই।

চিনা আঙ্কেল, চাঁদ আঙ্কেল, ওমর আঙ্কেলকেও খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হলো। সেই অর্থে এরা কেউই সাধারণের চোখে ভালো লোক নয়। কিন্তু আমরা ব্যাপারটা সব জানি। তারাও আঙ্কেল অন্তঃপ্রাণ। কেন? সেটা বোঝার বয়স আমাদের দু—জনের হয়েছে। তোমার চোখে কি আমাদের কোনও ব্যবহার দৃষ্টিকটু লেগেছে।

না।

তাহলে?

তোরা মিশছিস সেটা অনি জানে কিনা। তোরা দুজনেই এখন এ্যাডাল্ট।

একটা কথা তোমায় বলে রাখি দিদান। যে মানুষটা নিজের সারাটা জীবন বাজি ধরে তিলে তিলে এই বিশাল কর্মযজ্ঞ তৈরি করেছে, আমাদের এইটুকু এক গুয়েমিতে তা নিমেষে ধুলিস্যাত হয়ে যাবে। তা চাই না। তাতে সারাজীবন যদি কুমার থাকতে হয় আমি রাজি। আমি অনিসাকে হারাতে পারি। আঙ্কেলকে কোনও মূল্যে হারাব না। এক জন্মে মানুষের সব ইচ্ছে পূরণ হয় না।

এবার তুমি অনিসাকে জিজ্ঞাসা করতে পার। আমার আর কিছু বলার নেই।

অনিসা তার দিদানকে বলেছে।

এ বাড়িতে দাদান, দুদুনের থেকেও তুমি মা, বাবার সবচেয়ে বড়ো বন্ধু। এমন অনেক কথা আছে যা দাদান, দুদুন জানে না। তুমি জানো। আমার জন্মের সময় বাবা কাছে ছিল না। আমরা জন্মেছি। তোমার কোলে পিঠে মানুষ হয়েছি। যাকে তুমি নিজের হাতে এতো বড়ো করলে তার ওপর তুমি ভরসা রাখতে পারছো না।

আমি তোমার মনের অবস্থা বুঝি দিদান। কোনও মূল্যেই বাবাকে কেউ কষ্ট দিক তুমি তা সহ্য করতে পারবে না। এমন কি তার ছেলে—মেয়রাও যদি এইরকম কোনও অন্যায় করে থাকে তুমি বাইরে থেকে হয়তো মেনে নেবে, মন থেকে মেনে নেবে না।

দিদান তুমি আমার কথায় কষ্ট পাবে না। তোমায় কথা দিচ্ছি জীবনে এমন কোনও কাজ করবো না যা বাবার মনে আঘাত করবে। তোমার কাছ থেকে এই শিক্ষাটা পেয়েছি।

আমার দৃঢ় বিশ্বাস বাবা সব কিছু জানে। বাবা নিজে যেদিন আমাদের সঙ্গে আলোচনা করবে সেদিন আমরা মুখ খুলবো। না হলে যেমন চলছে তেমন চলবে।

হ্যাঁ, শুভর প্রতি আমার উইকনেস আছে। দাদা কিছু বললে অভিমান হয় না। মন খারাপ হয় না। শুভ কিছু বললে আমার ভীষণ অভিমান হয়। ভেতর ভেতর ভীষণ কষ্ট পাই। সেই কষ্টটা একমাত্র শুভকে জানাই আর কাউকে নয়।

তোমাকে এইটুকু বলে রাখি শুভর সঙ্গে আমার কোনও ফিজিক্যাল রিলেসন নেই। বাবার কাছ থেকে এটুকু শিখেছি ওটা পবিত্র জিনিষ। আমরা কেউ কারুর ক্ষতি করতে চাই না।

তারপর তিনজনে মিলে একটু কান্নাকাটি করেছে।

এটা গেল। তোর একটা এক্সক্লুসিভ।

আর একটা এক্সক্লুসিভ হচ্ছে তোর আর এক মেয়ে।

আমি মিত্রার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছি।

মিত্রা এক নিঃশ্বাসে বমি করে চলেছে।

আফতাবভাই, দিদি দুজনেই খেপে উঠেছে। ওখান থেকেই নাকি ইসলামভাই, ইকবালভাইকে ফোন করেছিল। ইসলামভাইকে বলেছে অনিকার সঙ্গে বসিরের নিকাহ করাতে চায়।

ইসলামভাই সরাসরি বলে দিয়েছে। ওর শরীরে আমার রক্ত আছে ঠিক, কিন্তু ও খাতা কলমে অনির মেয়ে, আপনি নিশ্চই ওর মুখ থেকে ওর অতীতের ইতিহাস শুনে থাকবেন। এখানে আমার কিছু বলার নেই। অনি শেষ কথা। অনি যা ডিসিসান দেবে তাই হবে। আলাদা করে আমার কোনও মতামত নেই। তবে ছোটদি, বড়দি যদি অনিকে কিছু বলে অনি কখনও না করবে না।

এরপর একে একে কাউকে সে আর বলতে বাকি রাখে নি। এমন কি আমাকে, তনুকেও বলেছে।

দেখ আমার কোনও মেয়ে নেই তোরা নাসরিনকে আমায় দে। তোদের একটা থাকুক আমার একটা থাকুক। কি বলি বল, তারপর বললাম, এখানে এসো, এলে তোমার সঙ্গে আলোচনা করবো। এখানে আসার পর থেকে কানের খোল বার করে দিয়েছে। কিরে ওকে বলেছিস।

বললাম তুমি বলতে পারছো না।

বলে, বললেই না বলে দেবে। আরও কতো হিসেব দেবে। মাথায় ঢুকবে না।

মাসীমনি সেই কথা শুনে কি হাসি।

তারপর ডাক্তারদাকে ধরেছে ডাক্তারবাবু আপনি ব্যাপারটা ম্যানেজ করুণ।

তবে অনিকার হাবেভাবে মনেহয় বসিরের ওপর ও বেশ দুর্বল। ঘণ্টা, পক্কে তো অনিকার পেছনে আদা জল খেয়ে পড়ে রয়েছে। সুন্দরও কম যায় না।

এবার তোর ডিসিসান।

আমি মিত্রার দিকে তাকিয়ে আছি।

দুজনেই মুচকি মুচকি হাসছে।

শ্বাশুড়ী হওয়ার বড্ড সখ হয়েছে।

কেন তুমি শ্বশুড় হবে না। তনু খিঁচিয়ে উঠল।

এই দেখো মুখ থাকতে হাত কেন।

হাতটা আমার তাই।

তুই হাত দিয়েছিস। মিত্রা বললো।

একটু।

তুইও পারিস তনু।

আচ্ছা তুমি বলো দিদি এইভাবে আমাদের কখনও সময় দিয়েছে।

রাত কিন্তু শেষের পর্যায়।

ঘুমতে হবে না। মিত্রা বললো।

দিদি এখনো মাসিমনি, মৌসুমী মাসির অধ্যায় শেষ হয়নি।

না ওটা এখন বলবো না, ওখানে গিয়ে বলবো।

কেন এখনও ঘণ্টা খানেক বাকি আছে বলে ফেলতে পারিস।

ওর থেকেও আর একটা জরুরী কেশ আছে।

সেটা কি। আমি মিত্রার মুখের দিকে তাকালাম।

বাসন্তী সেদিন আমাদের বাড়িতে এসেছিল, তুই জানিস?

চিকনার গুলি খাওয়ার দিন।

হ্যাঁ।

আমাকে ম্যাসেজ করেছিল।

তারপরেও সে দু—দিন এসেছে।

কেন!

মাসীমনিকে প্রণাম করতে এসেছিল। বড়োমাকে বলতে এসেছিল।

কি?

তোর কানে কোনও খবর আসে নি?

না।

তাহলে হয়তো রতন তোকে পরে বলবে।

কি হয়েছে বল!

সে ভিকিকে বিয়ে করবে। এই পর্ব নাকি অনেক দিন থেকে চলেছে।

আমরা মাসির শিব মন্দির প্রতিষ্ঠার দিন গেছিলাম।

হ্যাঁ।

আমরা চলে আসার পর, সেদিন নাকি দুজনে বেরিয়েছিল। তারপরই বাসন্তী হাওয়া।

মাসি কবিতার সঙ্গে ভিকি, বাসন্তীর ব্যাপারটা নিয়ে একবার কথা বলেছিল। কবিতা পরিষ্কার বলে দিয়েছে, এ আমার কম্ম নয়। তার মামাকে বলবে। সে যদি মত দেয় করবে। নাহলে বাড়ি থেকে দূর করে দেব। আমার পেটের ছেলের থেকে অনিদা আগে।

এরপর কবিতা রতনকে বলে। রতন বলে তুমি এখন থেমে যাও। দাদার মাথার ঠিক নেই, দেবে দু—মুড়ো গালাগাল। তারপর ভিকিকে ডেকে বলেছে। তুই সব জেনে—শুনে পা বারিয়েছিস। পরে যদি কোনও অঘটন ঘটে জানিষ তো তার শাস্তি কি।

সে তখন লক্ষ্মীর উদাহরণ দিয়েছে।

আর বাসন্তীকে বলেছে তুমি বড়দিদার পায়ে গিয়ে পড়ে যাও। মামা কিছু বলবে না।

বাবা তুই তো সারারাত ধরে সব প্রেম কেশ শোনাচ্ছিস। সুন্দর, ঘণ্টা, পক্কে, অনন্যর কিছু নেই।

নাঃ তাদের কথা হচ্ছে বেশ আছি। খাল কেটে কেন কুমির আনব। খালে সব সময় জল থাকে না। তখন কুমীর আমার মাথা চিবিয়ে খাবে।

তনু হাসছে।

সত্যি তোমার পাশে থেকে থেকে ছেলেগুলোও চাঁচা ছোলা কথা বলতে শিখে গেছে।

এখন আবার অংশুটাও মাঝে মধ্যে টুকটাক দিচ্ছে। মিত্রা বললো।

দিদি অংশুর কেশটা এই ফাঁকে বলে ফেল না হলে ভুলে যাবে।

ওকে কতো কথা বলার আছে বল।

এই তো মনে করিয়ে দিচ্ছে। তুই বলে ফেল। প্রম্পটার ভাল জোগাড় করেছিস।

তনু আবার তোমার হাত কাজ করছে। আমি বললাম।

তোর কি হয়েছে বলতো। মিত্রা তাকাল তনুর দিকে।

তনু মুচকি মুচকি হাসছে। ভীষণ চটকাতে ইচ্ছে করছে।

জানিস অংশু যেদিন রিজাইন দিল। সুরো, অংশু দুজনে গিয়ে প্রথমে বৌদিকে সব বলে। বৌদি বলে, এ ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। তোমরা যেটা ভাল বুঝবে করবে।

দু—জনে বৌদির ডায়লগ মাথা নীচু করে হজম করে নিয়েছে। তারপর বৌদি বলেছে।

শুধু মাথায় রাখবে। এমন কিছু করবে না, অনি কষ্ট পায়। সুরোকে বলেছে তুই তোর দাদাকে অংশুর থেকে অনেক বেশি চিনিস। দুজনকে যে দায়িত্ব দেবে পালন করার চেষ্টা করবি।

তোর কথা মত আমি অংশুকে এ্যাপয়েন্টমেন্ট দিলাম।

খবরটা চাপা থাকে নি। রাষ্ট্র হতেও বেশি সময় লাগে নি।

এরি মধ্যে অংশুর বাড়িতে নাকি লেখকদের লাইন পড়ে গেছে। যারা ওর পেছনে এতদিন কাঠি দিচ্ছিল, তারাও ভিড় করতে শুরু করে দিয়েছে।

মিষ্টির বাক্স, ফুলের তোড়া, সঙ্গে একটা করে লেখা।

মেসোমশাই বিরক্ত হয়ে বলেছে। আমি অনিকে গিয়ে বলবো তোকে তারিয়ে দিতে।

সেই শুনে সুরোর কি হাসি।

দেখো তো বৌমা। অনি বলেছিল লোক সমেত বাড়িটা কিনবে ওকে আজই গিয়ে বলবে বাড়িটা ওকে কিনতে হবে না। আমি এমনি এমনি দিয়ে দিচ্ছি। ডাক্তারবাবুর বাড়িতে আমাকে তোমার শ্বাশুড়ীমাকে একটা ঘর দিলেই চলবে।

পরদিন সুরো এসে হাসে আর বড়োমাকে বলে। মাসীমনি শুনে হাসে বলে অনি একটা বৃদ্ধাশ্রম গড়ার দিকে এগোচ্ছে।

জানিস মাসীমনি আমাকে তনুকে দুটো জিনিষ দিয়েছে।

আমি মিত্রার মুখের দিকে তাকিয়ে!

তনু নিয়ে আয়। মিত্রা, তনুর মুখের দিকে তাকাল।

তনু তরাক করে বিছানা ছেরে লাফিয়ে উঠে নিচে নামলো।

আলমাড়ি খুলে একটা ছোট্ট ব্যাগ নিয়ে এলো। দেখেই মনে হলো বহু পুরনো। এ ধরণের ব্যাগ এখন আর দেখা যায় না। অনেকটা বটুয়ার মতো দেখতে।

কি আছে এতে!

খুলে দেখ।

তোদের জিনিষ আমি দেখবো কেন?

তোর একটুও ইচ্ছে হয় না।

তোরা দেখাচ্ছিস তো।

তুই খুলবি।

বাধ্য হয়ে নিজে খুললাম।

একজোড়া মিনে করা সোনার বালা, একটা হার, একটা আংটি, দুটো কানের দুল।

আমি অনেকক্ষণ চেয়ে চেয়ে দেখলাম। বহুদিন পরে থাকার ফলে কেমন ম্যাড়—মেড়ে।

দাদু মায়ের বিয়ের আগে থেকেই দুই বনের জন্য গয়না গড়িয়ে রেখেছিলেন। মাসীমনিকে তার ভাগেরটা দেওয়ার পর মাসীমনিকেই এটা রাখতে দিয়েছিলেন। দেওয়ার আগে বলেছিলেন, জানিনা ঝুমুটার সঙ্গে এ জন্মে দেখা হবে কিনা। যদি দেখা না হয় তুই দিয়ে দিস। সেই থেকে এই গয়নাগুলো মাসিমনির কাছে।

তোর চোখ মুখ দেখে বুঝতে পারছি তুই অনেক কথা বলতে চাস।

ঠিক তা নয়।

বিশ্বাস কর আমি একটা কথাও মাসীমনিকে জিজ্ঞাসা করিনি। কেন জানি মাসীমনির মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে সঙ্কোচ বোধ হচ্ছিল।

তনুর গলায় যে হারটা দেখছিস ওটা মাসিমনির নিজের গলার হার।

আমি তনুর গলার দিকে তাকালাম। একটা বিছে হার। সেই আদ্যি কালের ডিজাইন।

তনুকে দেওয়ার সময় বললো, বাপের দেওয়া সম্পত্তি বলতে এই টুকু আমার কাছে আছে এটা তোকে দিলাম। ফিরিয়ে দিস না।

এরপর তুই বল মাসীমনিকে কিছু বলা যায়।

এখানে এসে তনু বললো, ওই ব্যাগ যেমনটি আছে তেমনটি ধরে রেখে দাও। ঠাকুমার জিনিষ নাতনিকে দিয়ে দেবে। আমরা ভাগা ভাগি করে মাসীমনির জিনিষ পড়বো।

আমি ব্যাগের মধ্যে সব রেখে দিলাম। মিত্রার হাতে ব্যাগটা দিয়ে তনুকে বললাম, আমাকে জলের বোতলটা একটু দাও জল খাই।

তনু জলের বোতলটা এগিয়ে দিল।

ঢক ঢক করে কিছুটা জল খেলাম। বিছানা ছেড়ে নিচে নেমে এলাম।

বাথরুমে গেলাম।

একটা সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে। তারপর ভাবলাম না ওরা আছে। ওদের অসুবিধে হতে পারে। ইচ্ছে থাকলেও খেলাম না।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখলাম দুজনে মুখো মুখি বসে।

আমার দিকে তাকাল।

বাগানে যাবি?

না। ভালো লাগছে না।

আবার খাটে উঠে শুলাম।

দুজনে আমার শরীরে নেমে এলো।

সকালে সুজিতদা এসেছিল। তুই তখন ঘুমচ্ছিলি।

আমাকে ডাকলি না কেন?

সুজিতদা নিজেই বারন করলো। তারপর বললো।

ছেলেটা আমাদের মধ্যে রয়েছে এটাই কত সৌভাগ্যের ব্যাপার, অন্য কেউ হলে এতদিনে পটকে যেত।

আফতাবভাই—এর সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে কথা বললো। খানিকটা কেঁদেও নিল। সুজিতদাকে এর আগে কখনও এইভাবে কাঁদতে দেখিনি। কেন কাঁদল বলতো?

মিত্রা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

আমি চোখের ইশারাতেই বললাম, কি করে জানবো।

আজ তোর আর একটা ইতিহাস জানলাম। তোর কথা শুনতে শুনতে আমাদের দুজনের বুকটাও বেশ ভারি হয়ে গেল। দিদির চোখ ছল ছল।

আমি মিত্রার চোখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে।

কথার পৃষ্ঠে কথা এলো।

তুই সুজিতদার কাছ থেকে টাকা চেয়েছিস। বড়োমা জিজ্ঞাসা করলো।

সুজিতদা হাসতে হাসতে বললো। জানো দিদি তোমরা এখন আমার আত্মীয়। তোমাকে আমার জীবনের অনেক কথা গোপন করেছি। আজ সেই গোপন কথার একটা বলি। সব তো আর বলা যায় না।

সবাই সুজিতদার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে। সুজিতদা এভাবে কখনও কথা বলে না।

তোমার বোনের মেয়ে আমার পুত্র বধূ। নির্দিধায় তোমাকে আজ একটা কথা বলছি। অনি যদি আমার বিজনেসটা ওর নিজের নামে লিখে দিতে বলে, আমি নিজে বাঁচার তাগিদে যতটুকু দরকার তা রেখে দিয়ে সব ওর নামে লিখে দিতে পারি। শুধু ওকে একটা রিকয়েস্ট করবো, তোর ভাইপোটাকে তুই তোর কাছে রেখে দে।

ছোটোমা বললো, এটা তুমি একটু বাড়িয়ে বললে।

বিশ্বাস করো ছোটদি আমি একটুও বারতি কথা বলছি না। আজ সুজিত মুখার্জী যেখানে বিলংস করছে, সে জায়গাটুকুর জন্য অনি ব্যানার্জীর যথেষ্ট অবদান আছে।

একটা পয়সার একপিঠে হেড আর এক পিঠে টেল। সুজিত মুখার্জী, অনি ব্যানার্জী হচ্ছে হেড আর টেল। অনি ব্যানার্জী হেড সুজিত মুখার্জী টেল। আমি মৃত্যুর মুহূর্ত পর্যন্ত জানবো আমার ছেলের গাড়ি বাড়ি না হলেও ভাত—কাপরের অভাব তার কোনও দিন হবে না।

কেন বলছি? সে অনেক কথা, এতদিন বলিনি, আজ বলছি। অন্যভাবে নেবে না।

জানো দিদি, তখন আমি, বুলা বিয়ে করিনি। প্রেম নিবেদন চলছে। নিজে একটা এ্যাড এজেন্সি করেছি। অফিস আমার এ্যাটাচি। আমার ক্লায়েন্ট বলতে তখন একটা ছাতু ওয়ালা আর একটা চানাচুর ওয়ালা। অনেক কাঠ—খড় পুড়িয়ে দুটোকে ফিট করেছি। একটা খোঁট্টা, একটা তেলি। পকেট থেকে পয়সা বার করা বেশ টাফ।

সুজিতদা কেমন করে কথা বলে না। সবাই হাঁসছে।

ছাতু ওয়ালার খুব ইচ্ছে কাগজে সে বিজ্ঞাপন দিতে পারে তবে তার সম্বন্ধে দু—চার কথা লিখতে হবে। ওই ফিচার গোছের আর কি। মহা মুস্কিল। ছাতু নিয়ে কি লিখব?

সে অনেক পরিকল্পনা—টরিকল্পনা করে হোটেল ক্যানিলওয়ার্থে একটা পার্টি দিলাম। ছাতুর পার্টি। সব কাগজে গিয়ে ইনভিটেসন দিয়ে এলাম।

সেদিন প্রথম অনিকে দেখলাম।

মিত্রাদের কাগজের তো নাক উঁচু। ছাতুর ক্যাম্পেনিংয়ে আসবে ভাবিনি। অনেক কাগজের সাংবাদিক এসেছে। পার্টি যা হয়। খাওয়া দাওয়া হই—হুল্লোড়। নিজের খরচে ফটোগ্রাফার ভাড়া করে নিয়ে এসেছি। ছবি—টবি তোলা হচ্ছে। কিছু সাংবাদিক যে আসে নি তা নয়।

আমি ভেতর সামলাই বুলা বাইরেটা।

অনির সেই মার্কামারা পোষাক। ছেঁড়া ছেঁড়া জিনসের প্যান্ট আর গেঞ্জি। সবার মধ্যে ওকে আলাদা করে চিনে নিতে বেশি অসুবিধে হয় না। তার ওপর তালপাতার সেপাই। মিত্রার পাল্লায় না পড়লে ওই জামাকাপর পরে ও সারাটা জীবন কাটিয়ে দিত।

আমরা সুজিতদার কথায় হেসে মরি।

তুই হাসিস না মিত্রা।

এখন তো তবু একটু খড়ের ওপর মাটি লেগেছে। তখন কুমরটুলির কাঠমা। মাটি পরেনি।

তা এসে সোজা ঘরে ঢুকে একপাশে সেঁটে গেল। আমি কিন্তু দূর থেকে লক্ষ্য করছি। হয়তো কোনও ছোট পত্রিকা থেকে এসেছে। পত্রিকা যেমন খেতে পায় না ও তেমনি খেতে পায় না। আমাকে কাগজের কাটিং দেখাতে হবে পার্টিকে। তাই এই পথ বেছেছি, না হলে মাল আসবে না। অনেক ছোটো কাগজ, ম্যাগাজিনকেও ইনভাইট করেছি। ভাবলাম হয়তো ওইরকম কোনও কাগজ থেকে এসেছে।

কেউ কেউ তো আবার যেচে যেচে ইনভিটেসন নিয়েছে। দুটো বড়ো কাগজ গোটা দশেক ছোটো কাগজ হলেই আমার কেল্লাফতে। মদ তো এই সব পার্টিতে কমন ব্যাপার।

একজনকে বললাম ওনাকে একটু ড্রিংকস দিয়ে এসো।

ও কিন্তু হল ঘরে ঢুকে সেই যে সাইডে সেঁটে গেছে। আর নড়ে চড়ে না। হাভ—ভাব দেখে বুঝলাম ও কাউকে চেনে না। ওকেও অনেকে চেনে না। লক্ষ করলাম ড্রিংকসের ছেলেটাকে ও ফেরত পাঠাল। আমার মনে ফার্স্ট স্ট্রাইক করলো, পার্টিতে এসে ড্রিংক করবে না এ কেমন সাংবাদিক। যা হয় আর কি।

সারাটাক্ষণ কাজের ফাঁকে ফাঁকে ওকে মেপে গেলাম। পার্টি শেষের মুখে একজন এসে বললো, আপনাকে ওই ভদ্রলোক ডাকছেন। অনির দিকে আঙুল তুলে তাকাল।

আমি এগিয়ে গেলাম।

আপনি সুজিত মুখার্জী?

হ্যাঁ। আমার গদ গদ হাসি।

আমি অনি ব্যানার্জী কাগজের নাম বললো।

আমার শিরদাঁরা দিয়ে একটা ঠান্ডা শ্রোত বয়েগেল। বিশ্বাস করো দিদি প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারিনি মিত্রাদের কাগজ থেকে কেউ আসতে পারে। তখন সব ব্যাটাকে ছেড়ে দিয়ে ওর পেছনে লেগে পড়লাম।  ও যদি চারলাইনও লেখে তাহলে আমার কেল্লা ফতে। একে বলি সরবত দে ওকে বলি কফি আন। আপনার কোনও অসুবিধে হয়নি তো। তার উত্তর হলো….।

এই প্রোডাক্টের ওনার কে?

কথাটা কানে যেতেই কেমন খটকা লাগল।

সঙ্গে সঙ্গে আমার ছাতুওয়ালেকে ডাকলাম। সে আলাপ করে একবারে গদ গদ।

আপনার সঙ্গে আমি একটু কথা বলতে চাই। তারপর ওর সঙ্গে বসে বেশ কিছুক্ষণ কথা বললো। কি কথা হলো জানি না। যাওয়ার সময় আমাকে বললো। প্রোডাক্টটা নিম্নবিত্ত পরিবারের জন্য এই প্রোডাক্টের জন্য এই ধরণের পার্টি নাও করতে পারতেন।

ভাবলাম আমার আর নিউজ হলো না।

ওইরকম চেহারায় কি ওদ্ধত্য। লম্বা লম্বা পা ফেলে হল ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। এক গ্লাস জল পর্যন্ত মুখে দিল না।

ফোর্থ ডে—তে তোদের কাগজের বিকিকিনি পাতায় পাঁচশো শব্দের একটা লেখা বেরলো।

লেখাটা পরে আমি স্টান্ট। ছাতু নিয়ে কেউ যে ওইভাবে লিখতে পারে আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। আমি আমার ছাতু ওয়ালাকে সব কাগজের কাটিং ফাইল বন্দি করে দিলাম।

সে আবার কাকে দিয়ে বাংলা নিউজগুলো হিন্দী করিয়ে পড়িয়েছে। কে কেমন লিখেছে।

এ্যাডের ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে তার মুখ থেকে শুনলাম অনি ব্যানার্জী কে?

বললাম, কেন?

ওনাকে একবার ডাকুন কথা বলতে চাই।

পার্টির দিন সে তো আপনার সঙ্গে কথা বলেছে।

সে কি মনে আছে, ওনাকে ডাকুন আলাপ করবো।

আমাকে ভাত কাপর দিচ্ছে, অতএব খুঁজে বার করতেই হবে। ঠোক্কর খেতে খেতে মল্লিকদার দরজায়। সব কথা খুলে বললাম। মল্লিকদা হেসে বললো, সম্ভব নয়।

কেন!

ও আমাদের কাগজের ফ্রি—ল্যান্সার।

তখন ছাতু ওয়ালার পয়সায় আমি পার্কস্ট্রীটে একটা অফিস ভাড়া নিয়ে ফেলেছি। ফোন নম্বর দিয়ে বললাম, আপনি এলেই ওকে বসিয়ে রেখে আমাকে একটা ফোন করবেন, আমি ওকে এসে নিয়ে যাব।

এরপর মোমবাতি নিয়ে বসে আছি। কতগুলো মোমবাতি যে পুরে গেল কে জানে। অনির দেখা নেই।

একদিন আমার অফিসে বসে ছাতু ওয়ালার সঙ্গে কথা বলছি। কোন কাগজে কত টাকার বিজ্ঞপন দেওয়া হবে তাই নিয়ে। মল্লিকদা ফোন করলো। অনি এসেছে। তুমি পারলে এসো। ছুটে গেলাম। যাওয়ার আগে ছাতু ওয়ালাকে বললাম তোমার অনি ব্যানার্জীকে ধরে আনতে যাচ্ছি। শুনে সে বললো তুমি আমার অফিসে ওকে নিয়ে এসো। আমি আমার অফিসে যাচ্ছি।

গিয়ে দেখি সেই এক পোষাক একই রকম মুখ। শুকনো শুকনো।

আমি যে কতদিন ওকে ওই পোষাকে দেখেছি বলে শেষ করতে পারবো না।

ওই যে তোমাকে বললাম বিয়ের আগের দিন ওই পোষাকে আমর অফিসে গিয়ে ব্যবসা তুলে দিয়ে এসেছিল।

নতুন করে আলাপ পরিচয় হলো।

ওকে ধরে নিয়ে এলাম।

ট্যাক্সিতে আসতে আসতে বললো, আপনার কপি কে লেখে।

বললাম লোক আছে।

আমাকে কিছু কপি লেখার কাজ দিতে পারেন।

আগে কখনও লিখেছো।

না।

ঠিক আছে।

বিশেষ কথা হলো না। বাচ্চাদের মতো জানলা দিয়ে রাস্তা দেখে। সব সময় কি যেন ভাবছে।

ছাতু ওয়ালা ওকে দেখে গদ গদ। বললো কি খাবেন অনিবাবু।

নির্লিপ্ত ভাবে বললো, আপনার বেস্ট কোয়ালিটির ছাতুর একটু সরবৎ বিটনুন আর লেবু দিয়ে নিয়ে আসুন।

উনি প্রথমটায় একটু ঘাবড়ে গেছিলেন, ভেবেছিলেন হয়তো অনি ইয়ার্কি ফাজলামো করছে।

ও কিন্তু ওর জায়গায় রিজিড থাকলো।

কথাবার্তা হলো।

কিন্তু সব কিছুর মধ্যেই কেমন যেন নির্লিপ্ততা।

আমার অফিসে যাওয়া আসা শুরু করলো।

ওকে কপি লিখতে দিতাম। আমি দুশো টাকা পেতাম। ওকে কুড়ি টাকা দিতাম।

জানো দিদি, তখন তো জানতাম না। ওর কোনও দিন খাওয়া জোটে কোনওদিন জোটে না। দশটা টাকা বেশি দিলে আমার হয়তো খুব একটা কম পড়তো না। তবু ওকে দিইনি।

সুজিতদা ঝড় ঝড় করে কেঁদে ফেললো।

ছোটোমা উঠে গিয়ে সুজিতদার পাশে বসলো। বুলা বৌদিও মাথা নীচু করে কাঁদছে। সুজিতদা কাঁদতে কাঁদতে বললো।

ও আমার কাছে পঞ্চাশ কোটি চেয়েছে। ও যদি দেড়শো কোটি চায় আমি যেখান থেকে পাড়ি ওকে জোগাড় করে দেব। না হলে নিজের সর্বস্ব বেচে দেব।

আমি যে এখনও সেই দিনগুলোর কথা ভুলতে পারিনি দিদি।

কি খারাপ লাগছিল। সুজিতদা কাঁদছে।

আমরা যারা বসেছিলাম আমাদেরও খারাপ লাগছে।

ছেলেটা কোনও দিন আমার কাছে ডিমান্ড করেনি। কেন কম পয়সা দিচ্ছি, তার কোনও প্রতিবাদ করেনি। ওটাই যেন ওর প্রাপ্য। হাসি মুখে নিয়ে চলে গেছে।

ছোটোমা আমার মুখের দিকে তাকাল। ইশারায় বললো এক গ্লাস জল নিয়ে আয়।

নিয়ে এলাম। সুজিতদা ঢক ঢক করে কিছুটা জল খেল।

আস্তে আস্তে ওকে জানলাম। তখন নিজেকে সব চেয়ে বেশি অপরাধী মনে হয়েছিল।

বুলাকে বিয়ে করলাম। ওকে অনেক খুঁজেছি। বুলাকে ও ভীষন ভালোবাসতো। খুঁজে পাইনি।

দূর ছাই তখন কি জানতাম ওই বয়সেই এতগুলো ছেলে মেয়েকে ওকে পালতে হয়।

আমরা মুচকি মুচকি হাসছি।

চলবে —————————–



from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/M8YsQdO
via BanglaChoti

Comments