❝কাজলদীঘি❞
BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়
১৮১ নং কিস্তি
—————————–
মিত্রা-তনু একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে। আবার বড়োমার মুখের দিকে তাকালাম।
আমরা তুলসী মঞ্চকে যেমন পবিত্রতার বন্ধনে বেঁধে রাখি এটাও খানিকটা তাই।
তুমি যদি এর সত্য অসত্যের কথা যাচাই করতে চাও বলতে পারবো ন।
বার বার এখানে এসে এদের উৎসব অনুষ্ঠানে নিজেক মিশিয়ে দিয়ে আমার এই অনুভূতিটুকু হয়েছে। তারপর একটু আধটু পড়াশোনা করেছি। বলতে পারো এটা আমার নিজস্ব ব্যাখ্যা।
সুখলাল কাকাও এর রহস্য তোমাকে বলতে পারবে না। জিজ্ঞাসা করলে বলবে প্রথাগতভাবে চলে আসছে তাই মেনে চলেছি।
সুখলাল কাকার পর যদি অন্য কেউ মোড়ল হয় তার বাড়িতে এই পবিত্র ঢিপি প্রতিষ্ঠা হবে। এই ঢিপি গ্রামের দলপতির নিশানা।
তোমাকে একদিন কথায় কথায় বলেছিলাম। এই সেব দেব দেবীরা তফশিলী জাতি উপজাতিদের মতো নিম্ন বর্ণের মানুষের জন্য, তোমার আমার মতো উচ্চবর্ণের মানুষের দেবতা নয়। এরা….।
এইজন্য শিব কমিউনিস্ট, নারায়ণ ক্যাপিটেলিস্ট।
মিত্রার কথায় বড়োমা হেসে ফেললো। আমিও হেসে ফেললাম।
হঠাৎ চোখ পড়েগেল চম্পার দিকে। ডাগর চোখে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
চোখা-চুখি হতেই মুচকি হেসে মিলির পেছনে মুখ লোকাল।
ধীরে ধীরে ওরা সকলে সুখলালকাকার ভিটে ছেড়ে বেরিয়ে এলো।
আমি সুখলাল কাকার খাটিয়ার সামনে এসে দাঁড়ালাম।
পিসির মতো অতোটা অথর্ব এখনো হয়নি। তবে বয়স মানুষকে নুব্জ করে দেয়।
সুখলাল কাকার এখন তাই অবস্থা।
আমি এখন যাই পরে আবার ওদের সঙ্গে আসবো।
হ যা বেলা হছে দুটা খায়ে লে।
পিসী তুমি যাবে না।
আমি এউঠি রই, বৈকালে যাব।
বাড়ির বাইরে পা দিতেই দেখলাম আমি দল-ছুট হয়ে পড়েছি। ওরা সবাই নিজেদের মতো এগিয়ে গেছে।
যারা আমার আশে-পাশে রয়েছে তাদের কাউকেই চিনতে পারছি না।
চড়াই ভেঙে একটু সমতলে আসলেই শ্যামদের বাড়ি পরবে।
ছোট্ট গ্রাম ডুলুং।
চারপাশে পাহাড়। মাঝখানে খানিকটা সমতল জায়গা। কতটা হবে তরিশ-চল্লিশ একর।
তার মধ্যেই গড়ে উঠেছে বসতি। পাহাড়ের গা কেটে কিছুটা জমি তৈরি করা হয়েছে সেটা পর্যাপ্ত নয়। সারাটা বছর আকাশের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে হয় কবে বৃষ্টি হবে। বৃষ্টি নেই, যেটুকু ফসল ফলতো, তাও নেই। চরম দুঃসময়।
এই একটু খানি জায়গায় গোটা পঞ্চাশেক ঘর, সাকুল্যে তিন চারশো লোক।
বিশাল বিশাল শালগাছের তলা দিয়ে এঁকে বেঁকে হাঁটতে হাঁটতে উৎসব মঞ্চকে ডানদিকে রেখে শ্যামের ঘরের সামনে চলে এলাম।
আমার আগেই বড়োমারা সবাই চলে এসেছে।
পরিবেশই বলে দিচ্ছে মোচ্ছব শুরু হয়ে গেছে।
চারিদিকটা চেয়ে চেয়ে দেখছি। না সেরকম কোনও পরিবর্তন হয়নি। যেমন ছিল ঠিক তেমনি আছে। গাছের সংখ্যা আগের থেকে কিছুটা কমেছে। ছোট্ট পাহাড়ের কোল ঘেঁষে যে সব বাড়ি ঘর ছিল। তারা সব সমতলে নেমে এসে একটা পাড়ায় পরিণত হয়েছে।
শ্যামের বাড়ির কাছেই মূল উৎসবের মঞ্চ তৈরি হয়েছে। চারটে বাঁশের ওপর একটা সামিয়ানা টান টান করে বাঁধা চলছে। বিদ্যুৎ নেই। জেনারেটর এতটা ওপরে নিয়ে আসা সত্যি খুব কষ্টের। তাও যদি রাস্তা ঘাট ঠিক থাকতো। গোটা চারেক বড়ো বড়ো ডে-লাইট দেখলাম। আর হ্যাজাক।
উৎসব বলতে মোড়লের বাড়িতে নাচগান, মারাংবুরুর থানে গিয়ে নিজের মতো পূজার্চনা। সাদা মোরোগ, ছাগল কিংবা পায়রা বলি দেওয়া। তারপর সবাই চলে আসবে উৎসব মঞ্চে।
এবার খাওয়া দাওয়া আনন্দ ফুর্তি।
আজ রাতটুকু যে যেরকম ভাবে পারো শুধু মজা লুটে নাও।
বছরের কয়েকটা দিনই তো এই নিখাদ আনন্দ উপভোগ করতে পারে এই জঙ্গল পাহাড়।
বাকি সময়টা শুধু দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই।
একটা দড়ির খাটিয়াতে নীরু-কনিষ্ক টান টান হয়ে শুয়ে রয়েছে।
খোলা আকাশের নিচে এইভাবে অনেকদিন পর ওদের শুয়ে থাকতে দেখলাম। একটা সময় এই ভাবেই এখানে রাতের পর রাত কাটিয়ে কলকাতা ফিরে গেছি।
অনিকেত, সাত্যকি, বটা, দেবা আর একটা দড়ির খাটিয়াতে বসে।
আমাকে দেখে কনিষ্ক আধশোয়া অবস্থায় পাশ ফিরলো।
গল্পটা ভালোই ঝারলি।
ওর দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
তখন কোনও ইন্টারাপ্ট করিনি। মাঝে মাঝে জল মিশিয়েছিস। নীরু বললো, ফাঁকা জায়গাগুলো অনিকে পরে শূন্যস্থান পূর্ণ করতে বলবো।
নীরু আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
মালটা ভাল দিলি ঠিক, জল যে মিশিয়েছিস এটা অস্বীকার করতে পারবি না। বটা বললো।
ফেনিয়ে ফেনিয়ে বেশি বললে বোড় হয়ে যেত।
সে ঠিক আছে। রাতে শুনে নেব।
খাওয়ার কি ব্যবস্থা হয়েছে?
খিচুরি হচ্ছে বসে যাতে পারিস।
শ্যাম আমাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করেছে। শরীরটা গরম হয়েগেছিল তিনখানা পেল্লাই ডাব মারলাম। তোর সালাইন। নীরু বললো।
শরীরে বল এসেছে।
এই তুই অন্য রাস্তায় হাঁটতে শুরু করলি। নীরু চেঁচিয়ে উঠলো।
হেসে ফেললাম।
কুত্থা অনিদা, উকে একটুক দেখি কেমনে দেইখতে হইছে।
গলার শব্দ শুনে পেছন ফিরে তাকালাম।
দুটো মেয়ে ঘরের ভেতর থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো। পেছনে আরও কয়েকজন।
হুটো-পুটি করে এদিকে এগিয়ে আসছে। চোখে মুখে উত্তেজনার ঝলক।
অনি এবার তোর দফা-রফা শেষ। কনিষ্ক বলে উঠলো।
ওর এসব অভ্যাস আছে। বটা বললো।
দু-জনেই সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। পরিশ্রান্ত। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। কষ্ঠি পাথরের মতো কালো।
একটুক্ষণ মুখের দিকে তাকিয়েই চিন্তে পারলাম ময়না আর চূড়ামনি।
শ্যাম আর দারুর বউ।
সবাই যে যার মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে। গো-গ্রাসে গিলে চলেছে প্রকৃতির অকৃপণ দান।
দু-জনেই আমাকে জড়িয়ে ধরলো। দুষ্টুমির কাজল মেখে দু-জনেই চোখে চোখ রেখেছে।
বয়স হলেও শরীরের বাঁধুনিটা এখনো অটুট। রাখবে নাই বা কেন। পাহাড় যে ওদের কোনওদিন বুড়িয়ে যেতে দেয় না। তার অকৃপণ দানে ওরা চির সবুজ।
দু-জনেই আজ ঝকঝকে রঙীন কাপর পড়েছে। এর আগে ওদের দু-টোকে কখনও ব্লাউজ পরতে দেখিনি। আদল গায়ে কাপর জড়িয়েছে তাও সেটা হাঁটুর ওপর।
আজও তাই পরেছে। খোঁপায় বনমোরগের পালক গুঁজেছে। কপালে বিন্দির মতো কুমকুমের টিপ। মাথায় সিঁদুর।
চিনতে পারিস লাই।
হাসলাম। ওদের সঙ্গে ওদের ভাষাতেই কথা বলতে শুরু করলাম।
ওদের খিল খিল করে হাসির শব্দ চারদিকে ছড়িয়ে পরছে।
মিত্রা-তনু-ইসি আমাদের ওই অবস্থা দেখে কাছে এগিয়ে এসেছে। প্রত্যেকের হাতেই ডাব।
ওরা অবাক চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে।
আমাদের একটা কথাও ওরা বুঝতে পারছে না। পাহাড়ী ঝর্ণার মতো ওরা দু-জন আমাকে জড়িয়ে ধরে শুধু হেসেই চলেছে।
আমি দু-জনের কোমর জড়িয়ে ধরেছি ওরাও আমার কোমড় জড়িয়ে ধরলো।
তারপরেই ওদের ভাষায় সুর করে গেয়ে উঠলাম।
ল্যাড়ে দাদা ঘটির জল, ল্যাড়ে দাদা দাঁতন কাঠি, মুখ ধুইয়েঁ ভাত খেইয়েঁ লে….।
ময়না চূড়া দু-জনেই খিল খিল করে উঠলো। আমার কোমড় দুলে উঠলো। পা দুটো ক্রমাগত সামনে পেছনে গানের তালে তালে নড়া-চড়া করতে শুরু করলো। একবার সামনের দিকে ঝুঁকে পরি আবার পেছন দিকে হেলে পরি।
ময়না-চূড়াও গেয়ে উঠলো গান। ল্যাড়ে দাদা ঘটির জল….।
আমরা কোমড় জড়া-জড়ি করে ধরে সাপের মতো দুলছি।
কখনও ওরা আগে গাইছে আমি পড়ে গাইছি, কখনো আমি সুরটা ধরার পর ওরা গলা মেলাচ্ছে।
পায়ে পা ঠিক মিলছে না। তবু শরীর দোলে, মন দোলে। ময়না চূড়ার গালে রং লেগেছে।
এক অদ্ভূত অনুভূতি আমাদের তিনজনকে আবেশে মাতিয়ে তুললো। আমাদের চারপাশে কেউ যে আছে, তারা যে আমাদের দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে পারে সেটাই ভুলে গেলাম। আমরা তখন আমাদের মতো। এক অন্যজগতের বাসিন্দা। এই অনুভূতির কাছে ভাষা পৌঁছতে পারে না। শুধু অনুভব করতে হয়। মনের রঙ এখানে আসল রঙ। সেই রঙ মিলে মিশে একাকার হয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে চার পাশে। চারিদিকে সবুজ। সবুজে সবুজে মেশা মিশি হয়ে সব একাকার।
একসময় গান থামলো। আমাদের শরীরের দুলুনিও থেমে গেল।
দুজনেই আমার শরীরে হাসতে হাসতে ঢলে পরেছে।
তিনজনেই সামান্য হলেও হাঁপিয়ে পরেছি।
সবাই হই হই করে হাততালি দিয়ে উঠলো।
নীরু ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে গালে একটা চকাত করে চুমু খেয়ে নিল।
উৎসবের সূচনাটা ভালই করলি।
হঠাৎ মিত্রা তনুর দিকে চোখ পড়ে গেল। বিষ্ময়ে আমাদের তিনজনের দিকে তাকিয়ে।
বউমনি মোদের কথা কিছছু বুঝেক লাই।
আমি চূড়ার কথায় হাসলাম।
বউমনি ইদিকে আয়।
ওরা তিনজন সম্মহিতের মতো ধীরে ধীরে কাছে এগিয়ে এলো।
ওরা কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না, আমি এরকম কিছু একটা করতে পারি।
চূড়া হাসতে হাসতে মিত্রাকে জড়িয়ে ধরলো।
অনিদা মোনকাকে কি কইতিছে জানু।
মিত্রা ওদের দিকে তাকিয়ে।
ডাগর লাগতিছে।
আবার কল কল করে দু-জনে হাসে।
মন্যে দু-জন কদবার অনিদার সইঙ্গে লাইচছি।
চম্পা মিত্রার পাশে দাঁড়িয়ে হাসছে। ওর মতো আরও গোটা কতক মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
হঠাৎ ভিড়টার দিকে নজর পড়তে খেয়াল পরলো শিবু, দারু, শ্যাম হেসে গড়া গড়ি খাচ্ছে।
কে নেই। আমাদেরকে ঘিরে সবাই গোল করে দাঁড়িয়ে।
বার বার মিত্রা-তনুর দিকে চোখ পরে যাচ্ছে। ওরা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
অনেকদিন পর তোকে ভীষণ লাইভ দেখাচ্ছে। কনিষ্ক হাতটা এগিয়ে দিল।
দারুণ গাইলি গানটা। নাচ আর গান শুনে মন ভরে গেল।
আমিও হাতটা এগিয়ে দিলাম।
তুই কিছু ভুলিসনি। সব মনে রেখেছিস।
কনিষ্ককে জড়িয়ে ধরলাম।
অনিকেত, বটা, সাত্যকি এগিয়ে এসেছে। হাসছে।
সত্যি অনি দারুণ। আমদের আর বন্ধুরা খুব মিশ করছে। অনিকেত বললো।
আবার আমরা কুড়ি পঁচিশ বছর আগে ফিরে যাচ্ছি নারে কনি? নীরু বলে উঠলো।
যাচ্ছি কিরে, অলরেডি চলেগেছি।
কনিষ্ক চূড়ার দিকে তাকাল।
কি-রে চূড়া, কতদিন পর অনিদার সঙ্গে নাচলি?
হা সে বিয়ার দিন লাচছিলি।
কেন ছুড়কি হওয়ার সময়?
অন্যে লাচছিল আমি লাচি লাই।
ময়না তুই?
ত্যাখন মুই পোয়াতি ছিলি লাচতে পারি লাই। যা লাচছি চূড়ার বিয়াতে।
দু-জনেই হাঁপিয়ে পরেছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। বুকটা অনবরতো ওঠানামা করছে।
ময়না কাপরের আঁচল দিয়ে মুখ মুছলো।
সুন্দর শুভ ছুটে কাছে এলো।
বাবা তুমি গান করছিলে?
ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
ইস কি মিস করলাম। তখনই তোকে বললাম, আঙ্কেলের চোখ-মুখটা কিন্তু আজ অন্যরকম দেখছি, খুব ভাল মুডে আছে, এখন কাছা কাছি থাকি, দূর…. বোচনটাও একটা গাড়ল।
আমি হেসে ফেললাম।
শুভ গজ গজ করতে করতে চলে যাচ্ছিল। তারপর থেমে বললো।
কিছু পেতে গেলে, কিছু ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, শুধু খাই খাই করলে হয় না।
শুভ ভিড়ের মধ্যে উধাও হয়ে গেল।
সুন্দর মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে।
আমি মুভি তুলেছি, আমার কাছ থেকে কপি করে নে। মিত্রার কথায় সুন্দর তাকালো।
তুমি তুলেছো বড়োমা!
সুন্দর এগিয়ে গেল মিত্রার দিকে।
মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
সুরো, মিলি, অদিতিরা ভিড় ঠেলে ভেতরে এলো।
কিগো বৌদি, শেষ! সুরোর চোখ গোল্লা গোল্লা।
তনু হেসে উঠলো।
সবাই হাসছে।
দেখলাম বড়োমারাও শ্যামের বাড়ির ভেতর থেকে বাইরে এলো।
কইরে ছোটো, ওতো সং-এর মতো দাঁড়িয়ে আছে দেখছি। নাচছে কই।
বড়োমার কথায় হাসির শব্দটা একটু জোড়েই হলো।
রাতে দেখো। এখন একটু খানি চিড়িক দিল। নীরু বড়োমার কাছে এগিয়ে গেল।
সত্যি ও নাচছিল!
আলবাৎ নাচছিল। বটা পুরোটা মোবাইলে ক্লিপ করেছে।
নীরু বড়োমার দুটো কাঁধে হাত রেখে ঝাঁকিয়ে দিয়ে বললো।
তোমরা রিয়েল অনিকে এতদিন দেখোনি। দেখেছো অনির ছায়াটুকু। আজ হয়তো কয়েকঘণ্টা জন্য তোমরা রিয়েল অনিকে দেখতে পাবে। তাও সেটা ঝলক। এই অনি তোমাদের একেবারে অচেনা অজানা। আমরা বন্ধুরা খুব কাছ থেকে দেখেছি। ওকে দেখেই তো ভালোপাহাড়ের ভালোবাসায় পড়েগেছি।
নীরুর কথায় চারিদিকটা হঠাৎ কেমন নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
বড়োমা নীরুর মুখের দিকে তাকিয়ে।
জানো বড়োমা, হস্টেলে বসে যেদিন ও প্রথম বললো এরকম একটা জায়গা আছে, বিশ্বাস করিনি।
বন্ধুদের মধ্যে যা হয়, ওর পেছনে একটু লাগলাম। বললাম কবে নিয়ে যাবি।
বললো, তোরা যেদিন যেতে চাইবি নিয়ে যাব।
তারপর নিজেই বললো, কষ্ট সহ্য করতে পারবি?
মাঝে মাঝে ও কেমন ভাবুক হয়ে যায় না। সেরকম আর কি। দিলাম গালাগাল। তখন বললো, পরে আমাকে দোষ দিস না।
দেখো অনিকেত, কনিষ্কর গায়ে গ্রামের গন্ধ কিছুটা পাবে। তবে অনির গ্রামের মতো নয়। বটা আধা শহরের ছেলে। সাত্যকি মিশেল। একমাত্র আমি শোহুরে পুত। বাপের লালু ছেলে। পড়াশুন ছাড়া একমাত্র লুডো খেলতে পারতাম। তা সেই নীরুকে ভূতে ধরতেই পারে।
বড়োমা হাসলো।
হ্যাঁগো বড়োমা। তুমি বিশ্বাস করো।
ট্রেণ থেকে যখন নামলাম তখন রাত দশটা।
স্টেশনটা তখন এত ঝক ঝকে ছিল না। টিকিট কাউন্টারে যেটুকু লাইট সেইটুকু।
বাকি সব ভোঁ-ভাঁ।
স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে এসে দেখলাম আধো অন্ধকারে দুটো ভ্যান রিক্সা দাঁড়িয়ে। আর ছ-জন ষন্ডা মার্কা ছেলে। একটা ভ্যানরিক্সায় আমরা উঠলাম। আর একটা ভ্যানরিক্সায় আমাদের যারা আনতে এসেছিল তারা। তার সঙ্গে অনি।
আমরা সামনে, অনিরা পেছনে।
অন্ধকারেও যে কিছু কিছু মানুষের চোখে টর্চ ফিট করা থাকে সেদিন দেখলাম। স্টেশন থেকে নেমে দেড়শো-দুশো হাত দূরে যেতেই আলো ফুরুত। ঘন অন্ধকার। সেদিনটা আকাশে চাঁদ ছিল না। কোথা দিয়ে যাচ্ছি কিভাবে যাচ্ছি কিছুই জানি না।
অনিকে যে জিজ্ঞাসা করবো তার উপায় নেই। অনি ওদের ট্রলিতে আমরা পাঁচজন এই ট্রলিতে। বিশ্বাস করবেনা একটা ট্রলি থেকে আর একটা ট্রলি দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু দূরত্ব বেশি নয়। শুধু চাকার ক্যাঁচর ক্যাঁচর আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি।
মাঝে মাঝেই দেখছি আমাদের ট্রলির ছেলেটা চেঁচিয়ে ওঠে, লামি আয়।
ওরা নেমে আসছে।
পেছনের ট্রলি থেকে দুটো ছেলে এসে আমাদের ট্রলিটা ঠেলছে। বার কয়েক এরকম হবার পর, জিজ্ঞাসা করলাম ভাই ব্যাপারটা কি?
বললো উপরকে উঠতিছি।
মানে।
পাহাড়ে চড়ছু কুনো দিন।
আজ বলছি বটে সেদিন ওদের কথা বুঝিনি। অনি বুঝিয়ে দিয়েছিল।
শ্যাম, শিবু, দারু সেদিনও সঙ্গে ছিল আজও আছে।
তখন পাঁচ কিলোমিটার আসতে হতো এখন সেখানে এক কিলোমিটার আসতে হয়।
এই এক কিলোমিটার তোমাকে হেঁটেই আসতে হবে।
রাস্তায় আসতে আসতে তিনবার ওরা থামাল। কেন থামাল কি কারণে থামাল তখন জানিনি। জানলে হয়তো সেখানেই সলিল সমাধি হতো। পরে অনির মুখ থেকে শুনেছি কখনও ভাল্লুক কখনও হাতি পথ আটকে দাঁড়িয়েছিল।
এখানে যখন এসে পৌঁছলাম তখন রাত বারোটা। বলতে পারো নিশুত রাত।
এখন এখানে এতগুলো মাটির বাড়ি টালির চাল দেখতে পাচ্ছ তখন একমত্র মোড়লের বাড়িটা ছিল মাটির, আর সব শালপাতার ছাউনি বাড়ি। বেড়া দেওয়া।
দুটো গরমভাত, ছাগলের দুধ, মধু, আলুসেদ্ধ, নুন, কাঁচালঙ্কা। এই ছিল আমাদের প্রথম রাতের মেনু। জীবনে প্রথম এই ধরণের খাবার খেলাম। মনে হল যেন অমৃত।
অনি শ্যামকে ডেকে বললো, ওদের বিছানা করেছিস।
শ্যাম বললো হ্যাঁ।
তারপর আমাদের বললো যা শুয়ে পরগে যা।
তুই।
তোরা যা পরে যাচ্ছি।
সেই রাতে আর দ্বিতীয়বার ওকে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করেনি। আমরা চারজন যে যার জামাকাপর ছেড়ে পরিপাটি করা বিছানায় শুয়ে পরলাম। পাখার তলায় শোয়া অভ্যাস এখানে আলো পাখা হীন অবস্থায় প্রথম রাত। আলো বলতে জোনাকীগুলো মিট মিট করে জলছে। পরে শ্যাম কিছু শুকনো পাতা জড়ো করে জালিয়ে দিল। কতক্ষণ? মিনিট দশেক, তারপর সে নিভে কাদা। এতোটা জার্নি ক্লান্ত ছিলাম। কখন ঘুমিয়ে পরেছি জানি না।
হঠাৎ দেখি বেশ শীত শীত করছে। ঘুম ভেঙে গেল। কনিষ্ককে ডাকলাম।
দেখলাম ধারে কাছে কোথাও অনি নেই।
আমরা যেখানে শুয়ে আছি। সেখান থেকে হাত দশেক দূরে চারটে ছেলে দুটো খাটিয়াতে শুয়ে।
কনিষ্ককে বললাম কিরে অনি কোথায়?
ওতো খ্যাঁক করে উঠলো। মেয়েছেলে মার্কা কথা না বলে ঘুমিয়ে পর।
ওরা পাশ ফিরে শুয়ে পরলো। আমি ঘুমতে পারলাম না। জেগে বসে থাকলাম।
মাঝে মাঝে অদ্ভূত এক একটা শব্দ পাচ্ছি।
ঝিঁঝি পোকার আওয়াজ। জোনাকীর আলো ছাড়া চোখে আর কিছু পরছে না। বেশ কিছুক্ষণ অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকর পর মনে হলো গাছপালা দেখতে পাচ্ছি। আস্তে করে মশারির ভেতর থেকে বাইরে এলাম। ভয় যে করছে না তা নয়। করলে কি করবো। দেখার লোভ।
ওরা যেখানটা শুয়ে ছিল সেখানে এসে দাঁড়ালাম। আকাশের দিকে তাকালাম।
কি বলবো বড়োমা আকাশে এতটুকু জায়গা ফাঁকা দেখতে পেলাম না। এতো তারা। চুপ চাপ দাঁড়িয়ে আছি। প্রথমটা একটু গা ছম ছম করছিল। তারপর মর্গের কথা চিন্তা করতেই সব ভয় কেটে গেল। অন্ধকারটা আস্তে আস্তে আলোয় পরিণত হচ্ছে। তারাগুলো ধীরে ধীরে আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছে। পাখি ডাকছে। চারদিকে এতো সবুজ দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। চারিদিকে আঁকা-বাঁকা পাহাড়।
এখানে আসার আগে পাহাড় বলতে দার্জিলিং দেখেছি।
নিজের চোখকে নিজে বিশ্বাস করতে পারছি না। পাহাড় ঘেরা ছোট্ট একটুকরো গ্রাম। যারা বাইরে শুয়ে ছিল তাদের মধ্যে শিবু ছিল।
আলো ফুটতেই ওরা জেগে উঠেছে।
ওকেই জিজ্ঞাসা করলাম অনি কোথায়।
বললো সেই পাশে শুইছে।
কনিষ্করা উঠলো। তারপর অনিকে আবিষ্কার করলাম। একটা বড়ো শাল গাছের তলায় খাটিয়াতে শুয়ে আছে। আমাদের সঙ্গে যে জামাকাপর পরে এসেছিল পরনে সেটাই রয়েছে।
সেদিন জীবনে প্রথম শাল গাছের কচি ডালে দাঁতন করেছিলাম। ব্যাগে টুথ-ব্রাস পেস্ট থাকতেও বার করিনি। অনির সঙ্গে ঘুরলাম। চরম দারিদ্রতার মধ্যেও মানুষ যে কতটা খুশী থাকতে পারে নিজের চোখে আমরা দেখলাম।
কথা প্রসঙ্গেই অনি বললো, জানিস কনিষ্ক ওষুধের অভাবে আর অপুষ্টি জনিত রোগে এরা পটা পট মরে যায়। ডেথ সার্টিফিকেট দরকার লাগে না। গর্ত খুঁড়ে মাটিতে পুঁতে দেয়। আমাদের সরকার এদের জনগণনার মধ্যেও ফেলে না। ভোটার আইডি দূর কি বাত।
বিশ্বাস করো ওর কথাটা শুনে আঁতকে উঠেছিলাম। তখন আমাদের সেকেন্ড-ইয়ার।
নিজেকে সামান্য খোলসা করলো। তাতেই জানতে পারলাম। ও এখানে নিজের সামার্থ্য অনুযায়ী টাকা দেয়। ভালোপাহাড়ের প্রেমে পরেগেলাম।
পরের সপ্তাহে শনিবার আবার এলাম। এবার ওষুধ-পত্র সঙ্গে নিয়ে এলাম। দিনে দিনে এলাম। দেখলাম অনি ঘাটশিলা বাজার থেকে চাল, ডাল, তেল, নুন কিনলো।
কনিষ্ক বলেছিল আমি কিছু কন্ট্রিবিউট করি।
বললো, না। যেদিন ইনকাম করবি সেদিন করবি।
এমন ভাবে বললো ও যেন লাখ টাকা ইনকাম করে।
সেই যে শুরু আজও বর্তমান।
কথায় কথায় অনি বলেছিল ভালোবাসা, সম্মান, শ্রদ্ধা এই তিনটে জনিস পয়সা দিয়ে কিনতে পারবি না। এই জঙ্গলের মানুষগুলো তোদের হয়তো পয়সা দিতে পারবে না। তবে যে ভালোবাসা, সম্মান, শ্রদ্ধা এদের কাছে পাবি তা কোটি টাকা দিয়েও কিনতে পারবি না।
ওর অন্তরের সেই সত্যটা আমাদের মানসিক বল। লড়াই করার শক্তি। এখনও পর্যন্ত অনির এই জায়গাটাকে আমরা সব বন্ধু দেবতার মতো পূজো করি।
বিষাণের কথা তোমায় কনিষ্ক বললো। ও-তো মরেই গেছিল। ওর তাৎক্ষণিক বুদ্ধিমত্তা ওকে বাঁচিয়েছে। আজ দেখ ও তোমাকে কাঁধে করে নিয়ে এলো। দেখেও ভালো লাগে।
আমি কাছে এগিয়ে গেলাম। নীরুর পিঠে হাত রাখলাম।
চল বেলা হয়ে যাচ্ছে, খেয়ে নিই। ওরা এবার সকলে সুখলালকাকার বাড়ি যাবে।
নীরু আমার মুখের দিকে তাকাল।
হ্যাঁ ঠিক বলেছিস।
বড়োমার দিকে তাকালাম।
তোমাদের খাওয়া হয়েগেছে?
বড়োমা আমার মুখের দিকে শূন্য দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে।
ঠিক আছে রাতে আবার নাচবো তখন দেখে নিও।
বড়োমা, ছোটোমা দু-জনকে দু-হাতে জড়িয়ে ধরে শ্যামের বাড়ির ভেতরে এলাম।
অনুপদা একটা দড়ির খাটিয়াতে টানটান হয়ে একাশি হয়ে শুয়ে। আর একটা খাটিয়াতে ইকবালভাই, ইসলামভাই বসে। আমাকে দেখে হাসছে।
সব শুনলাম। রাতে ভালোকরে দেখবো। অনুপদা বললো।
তুই খেয়ে নে আমরা একটু পাড়াটা ঘুরে আসি। বড়োমা বললো।
তোমাদের খাওয়া হয়ে গেছে?
খেতে গিয়েই তো তোর নাচ দেখতে পারলাম না। খাওয়া ছেড়ে উঠতেও পারছিলাম না।
আমি বড়োমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
তাহলে এক কাজ করো। ঘুরতে ঘুরতে সুখলাল কাকার বাড়ি চলে যাও। ওখানে এবার উৎসবের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। না হলে মারাংবুরুর থানে চলে যাও। ওরা ওখানে সকলে পূজো দিতে যাবে। তারপর এখানে সন্ধ্যেবেলা মেলা বসবে নাচগান হবে।
তুই যাবি না!
আমি একবার মারাংবুরুর থানে যাব।
তাই যাই।
এক কাজ করো।
বল।
যাওয়ার সময় চম্পাকে সঙ্গে নিয়ে যাও।
বড়োমারা চলে গেল।
কনিষ্করা মিলিদের নিয়ে ভেতরে এলো। সকলেরি চোখমুখ কথা বলছে। কনিষ্ক হাসলো।
তোর কথা বলছিলাম।
কেন সব আজগুবি কথা বানিয়ে বানিয়ে বলিস।
টিনা আমার দিকে তাকিয়ে।
কি হয়েছেরে মিলি। মিত্রা ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো।
এখানে এসে অনিদার আর একটা জিনিষ আবিষ্কার করলাম।
ওতো কখনও নিজের মুখে বলে না। তোরা একটু বলিস।
মিত্রার মুখের দিকে তাকালাম। চোখ নামিয়ে নিল।
আমি ওর দিকে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে।
আমাদের গরমভাত, তোর পান্তা কেন?
মিত্রা আমার মুখের দিকে তাকাল।
তোদেরও দেবে।
একমুঠো।
আমার থেকে নিস।
শ্যাম বারান্দায় এসে মুখ বারালো।
এইখানে নিয়ে আয়।
না, আজ দুয়ারে বসি খাবি।
আমি স্নান করিনি, জামাকাপর ছাড়িনি।
কেনে সেউঠি স্নান করিস লাই।
না।
খায়ে লিএ ছান কর।
সবাই একসঙ্গে খেতে বসলাম।
সবাই বলতে কনিষ্করা সকলে, আমি, তনু, মিত্রা, ইসি আর শ্যাম, দারু, ময়না, চূড়া।
ওরা সব শালপাতার থালায়। ডাল ভাত মুরগীর মাংসের ঝোল। আমি এ্যালমোনিয়ামের বাটিতে পান্তা নিয়ে বসেছি। কাঁচা শালপাতার তৈরি বাটিতে পেঁয়াজ লঙ্কা একটু নুন। কয়েকটা কচি লাউপাতার বড়া ভেজে দিয়েছে।
সবাই মিলে ভাগাভাগি করে খাচ্ছি।
এই খাবারের স্বাদ কিন্তু তোমাদের ওখানকার মতো নয়। তনু বললো।
হবে কি করে, এখানকার জলটা যে আলাদা। ঘণ্টা খানেক বাদেই দেখবে তোমার আবার খিদে পেয়ে যাবে।
তখন কি খাব?
চিঁড়ে, মধু, ছাগলের দুধ।
ধ্যাৎ।
ময়না হসে চূড়ার গায়ে ঢলে পরেছে।
তুমি তো এখানে চাউমিন ফ্রায়েড রাইস পাবে না। না হলে আবার ভাত খেতে হবে।
খালি বাজে কথা।
তুই ওকে জিজ্ঞাসা করছিস কেন। মিত্রা বললো।
আর একটা জিনিষ চাইলে পেতে পার।
কি।
মুড়ির ছাতু।
দেখছো দিদি, কিরকম করে।
মিত্রার পাতে দেখলাম ভাত সব শেষ। আমার মুখের দিকে তাকাল।
ভাত নিবি।
তোর পান্তায় ভাগ বসাব।
অনি।
ইসির ডাকে ওর মুখের দিকে তাকালাম।
তখন যে তুই গানটা করছিলি তার কথাগুলো কি?
কেন বুঝতে পারিসনি।
সুরটা খুব ভাললাগছিল কথাগুলো ঠিক ধরতে পারিনি।
চূড়া হাসছে।
ওর মুখের দিকে তাকলাম। বল।
মুই তুর মতো বলতি পারবেক লাই।
মিত্রার দিকে তাকালাম। তুই?
দাদা, দাঁতন কাঠি এই দুটো শব্দ বুঝতে পেরেছিলাম।
কথার থেকে কোমর দোলানটা এতো সুন্দর লাগছিল। তখন কথা বোঝার মতো মন ছিল না।
এর সঙ্গে মাদল আর ধমসাটা যখন বাজবে দেখবি আরও ভালোলাগবে।
আজ সরারাত ধরে হবে! তনু বললো।
মাঝরাত পর্যন্ত হবে। তারপর সব ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পরবে। আজ ওরা হাত-পা ছড়িয়ে আনন্দ করবে। প্রত্যেকে প্রত্যেকের মতো।
গানটার অর্থ কি? ইসি বললো।
বাড়িতে গুরুজন অতিথি এসেছে। তাকে সম্ভাষণ করা হচ্ছে।
ল্যাড়ে দাদা ঘটির জল।
এদের সমাজে রীতি হচ্ছে বাড়িতে কেউ আত্মীয়-স্বজন কিংবা গুরুজন এলে তাকে হাত-মুখ ধোয়ার জন্য ঘটিতে কর জল দেয়। কেউ যদি দাঁত মাজতে চায় এখানে টুথ পেস্ট পাবে কোথায় তাই ঘুঁটের ছাই কিংবা কাঠ কয়লা সর্বপরি দাঁতন কাঠি।
দাঁতন কাঠি বলতে নিমডাল, না পেলে, শাল গাছের কচিডাল।
তাই ল্যাড়ে দাদা দাঁতন কাঠি।
তার পরের লাইনটা হচ্ছে, মুখ ধুঁইয়ে ভাঁত খেঁইয়ে লে।
তারমানে অর্থ দাঁড়াল ভালো করে দাঁতন কাঠি দিয়ে দাঁত মেজে মুখ ধুয়ে ভাত খা।
মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে।
জানিস মিত্রা, ময়না চূড়ার যখন ছয়-সাত বছর বয়স তখন থেকে আমাদের বাড়িতে ওরা ওদের বাবা-মার হাত ধরে ধান কাটতে যেত। আমাদের খামারে যে খরের টংটা বানান থাকতো তাতেই ওরা থাকতো। মাস দুয়েক আমাদের ওখানে থাকতো। তারপর আবার চলে আসতো।
দলে ওরা কম থাকতো না। প্রায় তিরিশ চল্লিশ জন।
গ্রামে প্রায় সব ঘরেই ওরা কাজ করতো।
মাঠ থেকে ফিরে এসে দুপুরে কাকীমার কাছে এসে বলতো, বড়কি সিধা দে।
সবাই আমার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়।
কাকীমা ওদের কুনকে দিয়ে যতজন মাঠে কাজ করতে গেছিল প্রত্যেকের এক কুনকে করে চাল। এক মুঠো করে ডাল, ছোটো সিসির এক সিসি করে তেল। কাকা হাট থেকে নুনটা কিনে এনে দিত। ওরা বাড়ির পেছনে আমাদের খেত থেকে যে সব্জি চাষ হতো তার থেকে বেগুনটা কফিটা শাকটা তুলে নিত।
তখন তুই কোন ক্লাসে পরিস।
সবে ক্লস এইটে উঠেছি।
মাঝে মাঝে ওই খামরটাতে আমরা সকলে মিলে লুকোচুরি খেলতাম আমি, দারু, শিবু, শ্যাম, ময়না, চূড়া আরও অনেকে, নাম মনে নেই।
কখনও কখনও আমার সঙ্গেই ওদের কলাইকরা বাটিতে চূড়া, ময়না একটু দূরে বসে পান্তা খেত।
টেন পর্যন্ত বেশ ছিলাম। ইলেভেন টুয়েলভটাও খারাপ কাটেনি। তারপরেই সব কেমন গোলমাল হয়ে গেল। অনির জীবনটাই বদলে গেল। আমার বুকের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
মন্যে সীতা হরণ খেলতিনি? ময়না বলে উঠলো।
আমি ময়নার দিকে তাকালাম।
তোর মনে আছে?
থাকবেক নাই কেনে। হা সে দীঘাআড়ির বাঁধ নু বঁইচ কুল তুইলা আনতি, সেউ তুর ঘরের পিছনে যেউ বাঁশ ঝাড়টা ছ্যাল সেউঠি বুইসে বুইসে খাতি।
দীঘাআড়ির কথা শুনে মিত্রা হাসছে।
খামারের সামনে যে খেতটা, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হলেই কয়েকটা খড় বিঁড়ে নিয়ে ওরা চলে যেত, তারপর আগুন জালিয়ে মাদলটা আর ধামসাটা একটু গরম করে নিত। তারপরেই ঘণ্টা খানেক ঘণ্টা দেড়েক ওদের নাচগান চলতো।
মাসির বড়ের নাম ছিল কালী। কাকা ডাকতো কাইল্যা বলে। গায়ে কি জোর ছিল। বাঁকে করে প্রায় দুপোন ধান বয়ে নিয়ে আসতো।
কতবার মাসিকে কোমড় জড়িয়ে ধরে নাচতে দেখেছি।
প্রথম প্রথম ওদের ভাষা বুঝতে পারতাম না। তারপর বুঝে ফেললাম। শিশু মন নেশা ধরে গেল। ওই সময়টা আমি গাঙ্গুলী ঘরের পুকুরের ধারে যে বাঁশ ঝাড়টা সেখানে চুপটি করে বসে থাকতাম। মাঝে মাঝে মাসি ডাকতো, তুই চইলে আয় অনি মোদের সঙ্গে লাচবি।
আমি হাসতাম।
সুরের তালে তালে ওদের শরীর দুলছে। একবার সামনে ঝুঁকে পরছে আবার পেছনে হেলে পরছে। পা-দুটো কি সুন্দর নড়া-চড়া করছে।
তখন তোর বয়স কতো। মিত্রা বললো।
মা মনে হয় বেঁচে ছিলেন। ওই কয়েক মাসের মধ্যেই মাসীর বর কালীচরণ আমার মা-বাবা সব এক সঙ্গে পটাপট মারা গেল।
তারপর বল।
একদিন ময়না আর চূড়াকে নিয়ে আমাদের বাড়ির পেছনের বাঁশ ঝাড়ে লুকিয়ে লুকিয়ে কোমড় দোলালাম, সে হয় নাকি, ওরা হেসে মরে, তারপর আস্তে আস্তে রপ্ত করলাম।
তখন এই নাচটা ছিল আমাদের একটা খেলা। উঁ উঁ করে ওদের সঙ্গে গান গাইতাম।
একদিন কাকা দেখতে পেয়ে বেদম পিটে দিল।
তখন অতটা বুঝিনি। আজ বুঝি। কাকা ভেবেছিল হয়তো আমি সাঁওতাল মেয়েগুলোর সঙ্গে ঢলা ঢলি করছি। কিছু হয়ে গেলে সাঁওতালকে ঘরে তুলতে হবে।
ময়না, চূড়া দুজনেই শব্দ করে হেঁসে যায়।
শিবুরাও হাসছে। কনিষ্করা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
জানিষ মিত্রা আজ আমি একটা কথা তোদের কাছে স্বীকার করছি। আমি জীবনে দু-দিন ময়না, চূড়াকে জড়িয়ে ধরে হাপুস নয়নে কেঁদেছিলাম। বলতে পারিস ওই দুটো দিন আমার জীবনে সবচেয়ে কালো দিন।
তনু-মিত্রার চোখ দুটো কেমন যেন হয়ে গেল।
তখন ওদের দুজনের বিয়ে হয়নি। তবে প্রেম পর্ব চলছে। ঘোটুলে গিয়ে নিজের মনের মানুষকে বেছে নিয়েছে।
ঘোটুল! সেটা আবার কি?
তনু বলে উঠলো।
ময়না, চূড়া দুজনেই শব্দ করে হেসে চলেছে।
তুই কইসনি? ময়না বললো।
মাথা দোলালাম না।
পরে বলছি।
তারপর বল। মিত্রা বললো।
সেদিন আমি একা একাই এখানে এসেছিলাম নিজেকে ভীষণ বিভ্রান্ত লাগছিল।
শুনলাম তোর বিয়ে হয়েছে। নিজে ঠিক বিশ্বাস করতে পারিনি। শ্যামবাজারে তোদের বাড়িতে গেছিলাম। কাউকে দেখতে পাইনি। ভেতরে ঢোকার মতো সাহস সঞ্চয় করতে পারিনি। তোদের পাড়ার কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পেরেছিলাম ঘটনাটা সত্যি। এবং তোদের পরিবারে ভাঙন দেখা দিয়েছে।
সেই দিনই কাউকে কিছু না বলে এখানে চলে এসেছিলাম।
আমার মুখ চোখ দেখে কেউ কিছু বোঝেনি। তবে চূড়া-ময়না আমার কিছু একটা হয়েছে ধরতে পেরেছিল। তারপর দিন বিকেলের দিকে একা একাই মারাংবুরুর থানে গিয়ে বসেছিলাম।
খেয়াল করিনি চূড়া-ময়না আমার পেছন পেছন গেছে।
ওদিকটা ফাঁকা ফাঁকা। বড়ো একটা কেউ যায় না।
ওদের দেখে প্রথমে চমকে উঠেছিলাম।
তারপর ওরা আমার পাশে বসলো।
একথা সেকথা বলার পর দু-জনে চেপ ধরলো।
কেন জানিনা নিজেকে সেই মুহূর্তে ভীষণ অসহায় লেগেছিল, আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না।
সেদিন মারাংবুরুর থানে বসে ওদের জড়িয়ে ধরে অঝোড়ে কেঁদেছিলাম। বলেছিলাম, তোরা অন্ততঃ শ্যাম, দারুকে এ ভাবে আঘাত করবি না।
দিন সাতেক এখানে ছিলাম। তারপর কলকাতায় ফিরে গেলাম।
ধাতস্থ হতে একটু সময় নিলাম। তারপর আবার গড্ডালিকা প্রবাহ।
মিত্রা মুখ নিচু করে নিল। বুঝলাম চোখদুটো ছল ছল করে উঠেছে।
কাগজের অফিসে গিয়ে তনুকে পেলাম। ওকে ভালো লাগলেও ওর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতাম না। যদি মিত্রার মতো বিট্রে করে। তারপর ভয়ে ভয়ে জলে গা ভাসালাম। আবার ডাঙায় উঠে জলের দিকে তাকিয়ে দেখি ঠিক জলে গা ভাসিয়েছি কিনা।
ওমা হঠাৎ দেখি তুই আবার এসে হাজির।
মিত্রা-তনু দুজনেই মুচকি হাসলো।
বড়ো যন্ত্রণা।
তারপরেই তনু হঠাৎ একবুক অভিমান নিয়ে লন্ডন চলে গেল।
তখন তুই আবার আমার হতে চাইছিস।
আর তনু আমার হতে চেয়েছিল, আমি সময় চেয়ে নিয়েছিলাম।
সেদিনও আমি আঘাত পেয়েছিলাম। আমি হয়তো তনুর সঙ্গে প্রতারণা করলাম।
এখানে এসে ময়না, চূড়ার সঙ্গে তনুর কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেছিলাম। সেই দিন এই দুটো আদিবাসী মেয়ে আমাকে বুঝিয়েছিল আমি কোনও অন্যায় করিনি।
ওরা ওদের অনিদাকে অনেক ছোটো অবস্থা থেকে দেখছে।
পরে শুনেছিলাম ওরা দুজনেই দারু, শ্যামকে সমস্ত ব্যাপারটা জানিয়েছিল।
অবশ্য শ্যাম-দারু এই ব্যাপার নিয়ে আমাকে কোনওদিন কোনও প্রশ্ন করেনি।
বাইরে মাদল বাজতে শুরু করেছে। মিহি সুরে সাঁওতালী ভাষায় গান ভেসে আসছে।
আমরা সকলে হুড়ো-হুড়ি করে উঠে পরলাম। কোনওপ্রকারে হাত-মুখ ধুয়ে জামাকাপর বদল করে বেরিয়ে এলাম। পশ্চিমদিকের আকাশটা গাঢ় কমলা রং-এর। সূর্যের আলো নেই তবে তার রেশ চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে এক মায়াবী রূপ ধারণ করেছে।
মেলায় লোক আসতে শুরু করেছে একটু একটু করে ভিড় বারছে।
চলবে —————————–
from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/vm5WR1d
via BanglaChoti
Comments
Post a Comment