❝কাজলদীঘি❞
BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়
১৫৭ নং কিস্তি
—————————–
তুমি সব সময় আমাকে সন্দেহ করো কেন বলো তো। মিত্রা বললো।
তোমাদের চালচলনে ও ধরে ফেলে, ওকে কষ্ট করে বুঝতে হয় না। ডাক্তারদাদা বললো।
তুমি আর বক বক করো না। যত নষ্টের গোড়া তুমি।
সব ব্যাটাকে ছেড়ে দিয়ে এবার বেঁড়ে ব্যাটাকে ধর। ডাক্তারদা বলে আর মিটি মিটি হাসে।
আন্টি বেশ মজা পাচ্ছে আমাদের কথায়। চোখেমুখে তা ফুটে উঠেছে।
অনিমেষদা কালকের মিষ্টি গুলো কেমন খেলে? আমি অনিমেষদার দিকে তাকালাম।
ছোটো ওকে দিসনি? বড়োমা তাকাল ছোটোমার দিকে।
এখনও দেওয়া হয় নি, এবার হবে।
দেখছিস অনিমেষকে কিরকম জিজ্ঞাসা করছে।
আন্টি হেসে উঠলো।
সকাল থেকে অনেক বলে কয়ে একটু চা পেলাম বুঝলে বড়োমা। এখনও কচুরী এলো না।
তোর ঘারটা এবার মটকাব। ছুঁড়ে ছুঁড়ে কথা বলা বার করে দেব। ছোটোমা দাঁতে দাঁত চিপল।
বৌদি, দামিনীমাসি, জ্যেঠিমনি হাসছে।
আন্টি দেখছো কেউ আমাকে চায় না। এই জন্য কুড়িটা বছর সন্ন্যাস নিয়েছিলাম। তুমি তখন জিজ্ঞাসা করেছিলে, সঠিক উত্তর দিতে পারিনি। এখন নিজের চোখে দেখে নাও।
ছোটোমা তেড়ে আসতে আমি উঠে দাঁড়ালাম।
মেয়ে, অনিকা জড়িয়ে ধরেছে।
মা-রে, সুরো পিসী কোথায়?
মিকিকে নিয়ে স্কুলে গেছে, ওখান থেকে পিসেমশাইয়ের সঙ্গে কোথায় যাবে। তারপর মিকিকে আর মাম্পিকে নিয়ে আসবে।
মাম্পি কাল রাতে ছিল না!
মিলিমনি নিয়ে গেছিল।
ও।
নিশ্চই মিলিকে টাইট দেওয়ার কোনও প্ল্যান ভেঁজে নিলি। অনিমেষদা আমার দিকে তাকাল।
বড়োমা, জ্যেঠিমনি, দামিনীমাসি বড়োমার ঘরে ঢুকলো।
কেন?
তোর ওই ‘ও’ বলাটা ঠিক রিদিমিক শোনাল না।
সুরোর শ্বশুরকে জিজ্ঞাসা করো তো বাড়িটা বেচবে কিনা।
মানুষ সমেত কিনবি না মানুষ ছাড়া কিনবি।
মানুষ সমেত।
বৌদি, বিধানদারা সকলে জোরে হেসে উঠলো। অনিমেষদা মাথা দোলাচ্ছে।
কি ডাক্তারবাবু এরকম বাড়ি কেনার গল্প আগে কখনও শুনেছেন।
ওর মাথাতেই এইসব আসে।
নাঃ এরা কচুরী দেবে না। চলো তোমার আর বিধানদার সঙ্গে একটু বসি। অনিমেষদার দিকে তাকালাম।
বারোটা থেকে।
টাইম ঠিক করে ফেলেছ?
হ্যাঁ।
আমার সময় নেই আমি ঘণ্টাখানেক পর বেরবো।
গেটের চাবি বড়দির কাছে। ছগনলালের কাছে নেই। বৌদি বললো।
তাহলে বুড়ো বয়সে পাঁচিল টপকাতে হবে।
আমি গেটের দিকে এগিয়ে গেলাম। ভজুরাম ঝুড়ি নিয়ে ঘরে ঢুকলো। পেছন পেছন অনন্য, সুন্দর। ঘণ্টা, পক্কের হাতে নৌকো।
এই সব বড়ো বড়ো নৌকায় কি আছে! আমি বলে উঠলাম।
তুমি কিছু জান না? অনন্য বললো।
আমি ওদের দিকে বিষ্ময়ে তাকিয়ে আছি।
ও ঘরে গিয়ে বসো সব বলছি। সুন্দর বললো।
আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। অনিসা, অনিকা আমার পেছন পেছন বেরিয়ে এলো।
মাঠে দেখলাম রতন, নেপলার সঙ্গে আবিদ, ইসলামভাই বসে।
খুব ফাঁসান ফেঁসে গেছিস। ইসলামভাই আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বললো।
আমি ওদের দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
অনিকা আমার হাতটা টেনে ধরলো। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম।
ও বাবা, মামাকে বলো। অনিকা ইসলামভাইয়ের দিকে তাকাল।
আমি অনিকার দিকে তাকালাম। কি হয়েছে বল!
বাবা বলবে।
ঠিক আছে আমি শুনে নেব।
এখন।
ইসলামভাই হাসতে হাসতে চেয়ার ছেড়ে উঠে এলো।
মেয়ে-অনিকা দুজনেই মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে।
তোর কি বিকেলের দিকে একটু সময় হবে?
কেন!
আমি, বুঁচকি, নাসরিন, তুই একটু বেরবো। ঘণ্টাখানেকের জন্য।
কোথায় যাবে!
সেটা বলা যাবে না।
আমি অনিকা, অনিসার দিকে তাকিয়ে হাসলাম, বাড়িতেই থাকবো। গেলেই হলো।
দুজনে আবার ও ঘরে ফিরে গেল। আমি এই ঘরে এলাম।
টেবিলের ওপর রাখা সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বার করে ধরালাম। জানলার ধারে এসে দাঁড়ালাম। হুড়মুড় করে অনেক প্রশ্ন মনে জড়ো হচ্ছে। সব কেমন গোলমাল পাকিয়ে যাচ্ছে। দাধিয়া, আন্টির জামাই হয়ে গেল! পিকু, দাধিয়ার মেয়েকে রেজিস্ট্রী করে ফেললো!
সকাল বেলা পিকু, বরুণদাকে দেখলাম না? তাহলে কি ওরা আসে নি?
মেয়েটা অনিকার সাথে বাংলায় কথা বলছিল, খারাপ বাংলা বলে না।
অনিমেষদা, বিধানদা কি ওদের সঙ্গে কোনও মিউচ্যুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিং করেছে।
এতোটা ঘনিষ্টভাবে ওরা কথা বলছিল! আন্টি যদিও তার একটা কারণ।
মিত্রা, তনু সব কথা আমাকে বলেনি। শুধু দাধিয়ার নামটা বলে আমার চোখমুখের এক্সপ্রেশন বুঝতে চেয়েছিল। অজন্তার কাছ থেকেও এই ইনফর্মেশনটা পাইনি।
চারিদিকে একটা কুল পরিবেশ। তাহলে কি ওরা আমার মনোভাবটা বোঝার চেষ্টা করছে? সেই ভাবেই কি অনিমেষদা, বিধানদা ইনস্ট্রাকশন দিয়েছে?
কিরে এইভাবে দাঁড়িয়ে আছিস?
পেছন ফিরে তাকালাম।
ঘরের দরজা বন্ধ। তনু, মিত্রা দু-জনেরই চোখ চক চক করছে।
মেঘ কেটে গেছে বুঝলি বুবুন।
মিত্রার দিকে তাকালাম। হাসলাম।
আজ আমি নিশ্চিন্ত হলাম ভবিষ্যতে বড়োমা, ছোটোমার জায়গাটা তোরা সামলাতে পারবি।
মিত্রা চোখ দিয়ে হাসছে। তনু আমার দিকে তাকিয়ে। কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে মিত্রা, তনুর দিকে তাকাল।
তোকে কি বললাম তখন? মিত্রা বললো।
তনু, মিত্রার দিকে তাকাল।
বুঝলি এবার, ও ঘরে এতক্ষণ যা করে এলো সবটা অভিনয়।
মিত্রা আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
প্লিজ তুই আর ঝামেলা করিস না। এইটুকু মনে নে। সাগর, অনিমেষদাকে কথা দিয়েছে, তুই যা বলবি উনি তা মনে নেবেন। আন্টিও সাগরের ওপর মনোক্ষুন্ন।
পিকু কোথায়?
ওপরে। ভয়ে তোর সামনে আসছে না।
বরুণদা?
অফিসে। বার বার ফোন করে তোর মনের কথা জানতে চাইছে।
দাধিয়ারা কখন এসেছে?
আটটা নাগাদ।
তোরা আগে থেকে জানতিস?
কালরাতে আন্টিকে নয়না ফোন করেছিল, তখন বুঝিনি, সাগর দাধিয়া আন্টির জামাই।
আজ সকালে নিজেদের স্বার্থে ব্যাপারটা ক্যাশ করতে চলে এসেছে?
কথাটা বলেই মিত্রার দিকে তাকালাম।
আমি কি বলবো বল। তুই আমার থেকে ভাল বলতে পারবি। তবে ওদের যা আলোচনা হয়েছে তা তোকে বলতে পারি। মিত্রা মুখ নিচু করে।
তুই প্রেজেন্ট ছিলি?
আমাকে তনুকে সামনে রেখে আলোচনা হয়েছে। তখন দিদিভাই বরুণদাও ছিল।
সেইজন্য সকালে আমাকে ডাকিসনি?
বিশ্বাস কর, তনু বার বার এসে দেখে গেছে। তুই ঘুমচ্ছিস। তোকে বিরক্ত করতে মন চাইছিল না। শেষবার এসে তনু দেখেছে তুই বাথরুমে গেছিস। আমি এ ঘরে চলে এলাম, তনু ছিল।
মামীমা দরজা খোলো। অনিকা বাইরে থেকে চেঁচালো।
তনু এগিয়ে গেল। দরজা খুললো।
মনিমা বললো সবাই মিলে এ ঘরে বসে খাবে। আমরা সবাই মিলে ওঘরে বসে রান্নার জোগাড় করবো।
চল যাচ্ছি।
তনু, অনিকার সঙ্গে বেরিয়ে গেল।
আমি জানলার ধার থেকে খাটে এসে বসলাম।
আন্টি বলেছে বিকেলে সকলকে খাওয়াবে।
আমি মিত্রার দিকে তাকালাম।
তুই আমাকে তনুকে দায়িত্ব দিয়েছিলি।
হাসলাম।
আন্টির কিছু পরিচিত লোকজন, নিজের ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনিরা আসবে।
তুই একবারে গিন্নী হয়েগেছিস।
মিত্রা হাসলো। সব ব্যবস্থা অনিমেষদা নিজে হাতে করছে। অনুপদা, রূপায়ণদাকে দায়িত্ব দিয়েছে। ইসলামভাই হেল্পার।
আজ রাতে মদ খাবি?
যাঃ। মিত্রার গালে রং লাগলো।
একে একে সবাই এ ঘরে এলো। আন্টি ঘরে ঢুকে চারদিক দেখছে। সবাই সোফায় খাটে বসেছে।
তোর ঘরটা এরকম কেন? আন্টি আমার দিকে তাকাল।
কিরকম?
কেমন যেন একটা লাগছে। এই বাড়ির সব ঘরের সঙ্গে এটা কেমন যেন বেমানান।
আমি যেমন আমার ঘরও তেমন।
টেবিলের ওপর রাখা আমার সেই সাধুবাবার পোষাকের ছবিটা আন্টির চোখে পড়ে গেছে।
আন্টি ধীর পায়ে এগিয়ে গেল। হাত জোড় করে প্রণাম করলো।
মিত্রার দিকে তাকাল। কার গুরুদেব? তোর না তনুর।
দু-জনেই মুচকি হসছে। ছোটোমা জোড়ে হেসে উঠলো।
দেখছিস, সকাল থেকে যাইই বলি ছোটো হেসে গড়িয়ে পরে। আন্টি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
দিদি আপনি ভাল করে ছবিটা দেখুন। বৌদি বললো।
আন্টি ছবিটা দেখে বৌদির দিকে তাকাল।
চিনতে পারছেন না?
না।
আপনার গুনমন্ত্র অনির ছবি। এই পোষাক পরে নীরুর ভূত ছাড়িয়েছিল কলেজ লাইফে। ওর বিয়ের দিন কনিষ্করা সবাই মিলে জোড় করে সাজিয়েছিল তখন তোলা হয়েছিল।
আন্টির চোখে মুখে বিষ্ময়। তাই!
আন্টি এগিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
আপনাকে তার গল্প বলবো। ওদের কাছে ভিডিও করা আছে দেখবেন।
ভজু, অনিকা, অনিসা কচুরীর প্লেট নিয়ে এসে হাজির হলো।
কিগো দিদাই, তুমি বাবাকে ওইভাবে ধরে দাঁড়িয়ে আছো কেন? অনিসা বললো।
তোর আন্টিদিদাই বাবাকে চিনতে পারছে না। বৌদি বললো।
ও এই কথা। নাও নাও শুরু করে দাও।
ওরা টেবিলের ওপর সব ট্রে রাখলো। হাতে হাতে সকলকে দিচ্ছে।
অনিসা, অনিমেষদার দিকে তাকাল।
দাদাই বাবাকে কিন্তু আমাদের সঙ্গে আধঘণ্টা ছাড়তে হবে, আগে থেকে বলে দিচ্ছি। কোনও ঝগড়া চলবে না।
অনিমেষদা হাসছে।
আন্টির মেয়ে-জামাই ছবিটার কাছে এগিয়ে গিয়ে ভাল করে দেখে এলো।
খাটে এসে বসলাম, আন্টি আমার পাশে বসলো।
বৌদি, জ্যেঠিমনি, ছোটোমা, বড়োমা, দামিনীমাসি সকলে আছে।
খাওয়া শুরু হলো। বেশ বুঝতে পারছি বেড়ালের গলায় ঘণ্টাটা কে বাঁধবে। তার হিসেব নিকেষ চলছে। এ ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে। আমার বেশ মজা লাগছে। আমি চুপ চাপ খেয়ে যাচ্ছি।
অনি।
আন্টির দিকে তাকালাম।
তোকে আমার ব্যাপারে সব বলেছি।
আমি আবার খাবারে মনোনিবেশ করলাম।
তোকে আমি একটা রিকয়েস্ট করবো।
রিকয়েস্ট করবে কেন? আমি এখনও তার যোগ্যতা অর্জন করিনি।
ঠিক আছে রিকয়েস্ট করছি না। আমার একটা কথা রাখবি।
আমার সামর্থ থাকলে অবশ্যই রাখবো।
তুই তো জানিস অজুকে আমি কেন বিবাহ করতে পারিনি।
আমি আন্টির দিকে তাকালাম।
নম্রতা-পিকু একটা ভুল করে ফেলেছে। ওদের ক্ষমা করে দে। আমার, অজুর সম্পর্কটা ওদের মধ্যে দিয়ে বেঁচে থাকুক।
দেখলাম ঘরের সবাই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
আমার খাওয়া হয়ে গেছিল, প্লেটটা সেন্টার টেবিলে রেখে নিচু হয়ে পাজামার নিচের অংশে হাতটা মুছে নিলাম।
বড়োমা তুমি ওর অবস্থাটা দেখলে। মিত্রা গম্ভীর হয়ে বললো।
বড়োমা একবার মিত্রার দিকে কট কট করে তাকাল।
ছোটোমা, দামিনীমাসি ছাড়া ওর জামাকাপর কেউ কাচে না। তাদের কষ্ট হয় না?
ডাক্তারদা, বিধানদা জোড়ে হেসে উঠলো। আর সবাই মুচকি মুচকি হাসছে।
আন্টি আমার দিকে একবার ভাল করে দেখে নিল।
কই ওর জামায় কিছু পরেনি! আন্টি, বড়োমার দিকে তাকাল।
টেবিলে প্লেটটা রাখতে গিয়ে পাজামায় মুছেছে, তোমরা কেউ দেখতে পাবে না। শুধু ওরা দু-টোতে দেখেছে।
আন্টি হেসেফেললো। আমার দিকে তাকাল।
হ্যাঁরে মিত্রা ঠিক কথা বলছে?
ছাড়ো তো ওদের কথা। নেই কাজ তো খই ভাজ।
মিত্রার দিকে তাকালাম। একটু চা ঢেলে দে।
চোখ পড়েগেল সাগর-নয়নার দিকে। আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে।
হ্যাঁ আন্টি, তোমার কথায় আবার ফিরে আসি।
বল।
ডাক্তারদাদা-তোমার ব্যাপারটার সঙ্গে নম্রত-পিকুর ব্যাপারটা গুলিয়ে ফেলবে না। তোমাদের দুজনের মধ্যে ছিল পবিত্রতা, আমি সেটা অন্তর দিয়ে অনুভব করেছিলাম বলে, নিজের তাগিদে তোমার কাছে ছুটে গেছিলাম। তার আগে তোমাকে, ডাক্তারদাদাকে নিয়ে বেশ কিছুটা সময় স্টাডি করেছিলাম।
আপাত দৃষ্টিতে এদের দুজনের মধ্যে রয়েছে লোভ-লালসা-জিঘাংসা। আজ যদি ঘটনাটা পরিপূর্ণতা না পায় দু-জনের কিছু যায় আসে না। কয়েকদিন হয়তো মনটা খারপ হবে, নাও হতে পারে। আবার যেই কে সেই, বছর কয়েক পর তুমি দেখবে দু-জনে অন্য দু-জনের সঙ্গে ঘুরছে। বিয়ে করে সুখে সংসার করছে।
আন্টি আমার দিকে তাকাল।
কথাটা তুমি যখন তুললে, আমি কিছু কথা বলতে পারি কি?
অবশ্যই বলবি। শুনব বলেই সকাল থেকে আমরা সকলে বসে আছি।
দেখ এই বাড়িতে এই মুহূর্তে যারা উপস্থিত আছে, অনিসা, অনন্য ছাড়া কারুর সঙ্গে আমার কোনও রক্তের সম্পর্ক নেই। হয়তো ডাক্তারদাদা আমার সম্বন্ধে অনেক রাত পর্যন্ত তোমাকে অনেক গল্প বলে থাকবে। আমি এই, আমি সেই, আমি তাই….
ডাক্তারদাদা মুচকি হাসল।
আমি সেই প্রসঙ্গে যাব না।
অনিমেষদা, বিধানদার মুখ থেকেও তুমি হয়তো এতক্ষণে বেশ কিছুটা জানতে পেরেছ বা আভাসে ইঙ্গিতে আঁচ করতে পেরেছো। এছাড়া বড়োমা, ছোটোমা, বৌদি তো আছে। আর সবার কথা বাদ দিলাম। সবচেয়ে বড়ো কথা দামিনীমাসির সঙ্গে আমার কি সম্পর্ক তোমাকে ডাক্তারদাদা সবিস্তারে নিশ্চই বলেছে।
সবাই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
তুমি গতকাল রাতে এখানে পা রাখার পর থেকে একবারও বুঝতে পেরেছো এরা কেউ আমার আত্মীয় নয়? এদের সঙ্গে আমার কোনও রক্তের সম্পর্ক নেই? এমনকি আমার নিজের দুটো বাদ দিয়ে অন্যান্য ছেলে মেয়েদের কাছ থেকেও কি তুমি কোনও কিছু আকারে ইঙ্গিতে বুঝতে পেরেছো?
অনিকা, পক্কে, ঘণ্টার পরিচয় তোমাকে দিয়েছি। তোমার কি কখনও মনে হয়েছে ওরা আমার কেউ নয়। এক একটার বয়স ছাব্বিশ/সাতাশ, এখনও কিছু করতে গেলে দশবার ভাবে। তিনবার এসে জিজ্ঞাসা করে, মামা এটা করবো? হ্যাঁ বললে করে, না বললে সেই পথ পর্যন্ত মারায় না।
কেন জানো? ওরা কেউ আমাকে ভয় পায় না। আমার স্নেহের মর্যাদা দিতে জানে।
তুমি তো নিজে মুখে স্বীকার করে নিয়েছো তোমার ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনির সঙ্গে তোমার সেরকম কোনও সু-সম্পর্ক নেই। কম-বেশি সকলেই স্বার্থপর।
একথা আপনি কি…।
দাধিয়া কিছু বলতে যাচ্ছিল আমি হাত দেখিয়ে বললাম, থামুন।
আমার এইরকম ব্যবহারে দেখলাম চোখ মুখ লাল হয়ে গেল।
দেখো তোমার খোঁজ খবর নিতে গিয়ে আমি তোমার পরিবারের সেরকম ভাবে কোনও খোঁজ খবর নিই নি। ভাষা ভাষা যেটুকু নিয়েছিলাম তাতেই আমার কাজ হয়ে গেছে। কারণ আমি তোমাদের দু-জনের সঙ্গে কথা বলে এটুকু অনুভব করেছিলাম, তোমরা দু-জনেই কোথাও যেন ভীষণ একা। এই একাকীত্বের যন্ত্রণা আমি একসময় অন্তর দিয়ে অনুভব করেছি। এই বয়সে তোমাদের নতুন করে পাওয়ার কিছু নেই। অবসর সময়ে যদি একটু সময় কাটাবার জন্য মনের মতো একটা সঙ্গী জোগাড় করে দিই তাহলে অন্ততঃ পক্ষে তোমারা অনেকটা ফুরফুরে থাকবে।
তুমি বলবে, তোর ডাক্তারদাদার জীবনে আমি যে একসময় ছিলাম সেটা বুঝলি কি করে?
মিত্রা অসুস্থ হওয়ার পর থেকে ডাক্তারদাদা এই বাড়ির ঘনিষ্ঠ সদস্য হয়েছে। সেটাও বিশ বছর আগের কথা। এমনকি অনেক কঠিন সিদ্ধান্তের ব্যাপারেও ডাক্তারদাদার মত প্রাধান্য পেয়েছে। এখনও পায় এবং সেটা একতরফা। আমাদের পারিবারিক আড্ডায় ডাক্তারদাদা যখন বড়োমার সঙ্গে কথা বলতো ভীষণ ভালো লাগতো। এমন কি খাবার টেবিলে ডাক্তারদাদা, বড়োমা, দাদা যখন এক সঙ্গে বসতো আমরা কেউ গম্ভীর হয়ে থাকতাম না। খাওয়ার টেবিলটা আমাদের আনন্দের হাট।
আমার কেমন কেমন যেন মনে হতো। ডাক্তারদাদাকে কখনও কখনও একা দেখেছি।
বিশেষ করে বড়োমার অবর্তমানে ডাক্তারদাদার চোখমুখে আমি যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট দেখেছি। কোথায় যেন একটা শূন্যতা। কিন্তু কোনওদিন সাহস করে ডাক্তারদাদাকে আমি জিজ্ঞাসা করিনি। আমি যখন নার্সিংহোমে তিনমাস ভর্তি ছিলাম তখন মিত্রা রোজনামচা লিখেছিল। বলতে পারো ডেলি ডাইরী।
আন্টি, মিত্রার দিকে তাকিয়েছে। মিত্রা মাথা নিচু করে নিল।
সেখানে প্রথমে তোমার কথা জানতে পারলাম।
নাম ধামে নয়। আমার কোমা স্টেজের সমাপ্তির দিন মিত্রা, ডাক্তারদাদার হাত ধরে আমায় দেখতে যায়। ডাক্তারদাদা আমাকে দেখে আবেগে নিজের মুখে স্বীকার করেছিল তিনি একসময় কাউকে ভালোবাসতেন। ডাক্তারদাদার ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন ডা. আর.এল. দাস এবং রথীন চ্যাটার্জী দু-জনেই এই বাড়িতে এসেছেন, আমায় ভীষণ স্নেহ করেন।
এরপর রথীন ডাক্তারের পেট থেকে কথা বার করি। তারপরের ঘটনা তুমি জানো।
আন্টি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলো।
এটা তুমি বিলক্ষণ জানো, তোমার জামাই সুবিধার নয়।
আন্টি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। হাসিটা সামান্য হলেও ফিকে হয়ে গেল।
তোমার জামাই গোটা ঘটনাটা জানে। তার সব রিপোর্ট আমার কাছে আছে।
বিশ্বাস করুণ অনিবাবু আমি কিছুই জানি না। কাল মেয়ে বলতে সব জানলাম।
আমি স্থির চোখে দাধিয়ার দিকে তাকালাম। এ চোখের ভাষা মিত্রা-তনু চেনে।
আজ সকালে রতনের সঙ্গে চলে এলেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। এসে দেখলেন আপনার শ্বাশুড়ী আমার বাড়িতে। আপনি একটা গেম খেলে দিলেন।
না না আপনি মন গড়া কথা বলছেন।
আপনি নিরঞ্জনবাবুর নাম শুনেছেন।
দাধিয়া আমার দিকে বিষ্ময়ে তাকিয়ে।
অনাদি আপনাকে এতো গল্প করেছে এটা করেনি তা হয় না।
অনাদির নামটা শুনে সবাই আবার চমকে উঠলো।
আমি অনিমেষবাবুকে সব বলেছি, সব স্বীকার করে নিয়েছি। আপনি যা বলবেন আমি সেই মতো সব বন্দবস্ত করে দেব।
আলতাফ কাল কখন ফোন করেছিল? আমার গলার স্বর সম্পূর্ণ পরিবর্তন হলো।
সাগর দাধিয়া উঠে এসে আমার পায়ের কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়লো।
আন্টি আমার হাতটা চেপে ধরলো।
আমি আন্টির দিকে তাকালাম।
দেখো তোমার জামাই এখুনি বললো না তোমাদের সব বলেছে। তোমাদের কাছে সব কিছু স্বীকার করে নিয়েছে। এখন বুঝতে পারছো ব্যাপারটা। আজ ও কোনও মতেই এখানে আসতো না। যদি আলতাফ কাল ওকে ফোন না করতো।
তুমি ভাবছো জামাই তোমার কাছে এসেছে তোমার খোঁজ নিতে। একবারে না। নিজে বাঁচার তাগিদে এখানে এসেছে। এবার জলের মতো পরিষ্কার হচ্ছে ব্যাপারটা।
রূপায়ণদা, অনুপদা ঢুকলো।
সব্বনাশ সব এই ঘরে দেখছি। সাগর আবার অনির পায়ের সামনে বসে কি করছে। রূপায়ণ ওটাকে তোল ওখান থেকে। অনুপদা বলতে বলতে ভেতরে চলে এলো।
এই সাগর ওখানে বসে কি করছো, ওঠো ওঠো। রূপায়ণদা বললো।
অনুপদা, মিত্রার দিকে তাকাল। সব ব্যবস্থা করে এসেছি বুঝলি। দুপুর থেকে খাওয়া-দাওয়া শুরু হয়ে যাবে। বুঁচকিকে কচুরীর কথা বললাম, চায়ের কথা বলতে ভুলে গেছি। তুই একটু নিয়ে আয়।
সাগর চোয়ারটা খালি পড়ে আছে ওখানে গিয়ে বসো। রূপায়নদা বললো।
অনুপদা, ছোটোমার দিকে তাকাল। ছোটোবৌদি সরে বসো অনির সঙ্গে এখন হাতাহাতি হবে। তোমরা শুধু দেখে যাবে কোনও কথা বলবে না।
অনুপদা, আন্টির দিকে তাকাল।
আন্টি টেনশন করছো নাকি?
আন্টি, অনুপদার দিকে তাকিয়ে থাকলো।
টেনশন করে কি করবে বলো।
অনুপদা নিজে নিজেই হাসলো।
নো টোনশন ডু ফুর্তি। তুমি এখন আমাদের সম্পত্তি।
আবার সাগর দাধিয়ার দিকে তাকাল।
সাগর তোমার মেয়েকে এখানে রেখে তুমি চলে যাও। আজ থেকে তোমার দায়িত্ব তুমি নিজে নেবে। আমরা কেউ তোমাকে প্রোটেকশন দিতে পারবো না। তুমি আমাদের কাছের মানুষ। প্রবীর তোমার হয়ে অনির কাছে রিকোয়েস্ট করেছে, তুমি আমাদের ওপর বিশ্বাস রাখতে পারনি।
সাগর মাথা নিচু করে নিল।
তনু।
হ্যাঁ দাদা।
রতনকে বল, ওকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসতে।
রূপায়ণদা ঘরে ঢুকে সাগরকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বাথরুমে গেছিল।
বেরিয়েই বললো, আপনাদের দু-জনের ফোন বন্ধ কেন? রূপায়ণদা জামা ঠিক করছে।
রূপায়ণ। বৌদি তাকাল।
এই বাড়িতে আমি কোনওদিন ভদ্র হতে পারবো না। সে আপনি আমাকে যাই বলুন।
ছোটোমা মুখ নিচু করে হাসছে।
অনিমেষদা, অনিকা-অনিসা কবে যাচ্ছে? রূপায়ণদা বললো।
অনুপদা, অনিমেষদার মুখের দিকে তাকাল।
পর্শু।
ওদের বডিগার্ড সকালে পৌঁছে গেছে। পর্শু একইপ্লেনে যাবে দুবাই পর্যন্ত, হ্যাণ্ডওভার করার পর তার ছুটি।
অনিমেষদা হাসছে।
হাসবেন না দাদা। সকাল থেকে প্রবীর আপনাদের দু-জনকে ফোন করে করে পাগল হয়ে গেছে। ওকে আবার টেনশন মুক্ত করে এলাম।
কেন?
ওর সব উদ্ভট কীর্তি কলাপ।
সাগর এবং তার স্ত্রী দাঁড়িয়ে রয়েছে। রতন গেটের মুখে।
এখন যাও সাগর। বিকেলে ফোন করবো তখন আসবে। অনুপদা তাকাল সাগরের দিকে।
ওরা দু-জনে মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেল।
মিত্রা কচুরীর প্লেট নিয়ে এলো রূপায়ণদা, অনুপদার জন্য। আমার দিকে তাকাল।
তোকে মেয়ে একবার ডাকছে।
কেন?
আমি যাচ্ছি তুই বোস। মাসি উঠে দাঁড়াল।
পরিমান মতো ভাগটা একটু করে দাও ওরা ঠিক পারবে। আমি বললাম।
মাসি তুমি বসো, ও যাক। এখুনি দুই বোনে এসে ঝড় তুলে দেবে। রূপায়ণদা বললো।
মাসি মুচকি হাসল।
তুই যা আমরা ততক্ষণ কচুরীটা খাই। অনুপদা বললো।
আমি উঠে এই ঘরে চলে এলাম। বারান্দা দিয়ে আসতে দেখলাম সাগর দাধিয়ার গাড়িটা গেট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল।
এই ঘরে আসতেই সবাই হই হই করে উঠলো। নম্রতা আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে।
দেখলাম ইসলামভাই সোফায় গা এলিয়ে বসে আছে। আমায় দেখে হাসলো।
রতন খুব টেনশন করছিল, বুঝলি….
কেন!
শেষ পর্যন্ত কি হয়। বেচারা ফেঁসে গেছে। তুই যে এরকম ব্যাক গিয়ারে গিয়ে স্পিড তুলবি কেউ বুঝতে পারেনি। মামনি বলার পর একটু টেনশন মুক্ত হলো।
নেপলা কোথায়?
এরা কি সব আনতে পাঠালো। তোর মেয়ে, আমার মেয়ের হুকুম।
হাসলাম।
বেশ ভালো লাগছে বুঝলি অনি। একটা নতুন অনুভূতি।
তুমি তো এদের একটু হেল্প করতে পারতে।
আমার হেল্প এরা নেবে নাকি। ধারে কাছেই ঘেঁষতে দিচ্ছে না।
ও ঘরে গেলে না কেন?
অনিমেষদা বারন করেছে।
আমি ওদের দিকে গেলাম।
কিরে ভজু?
সব কেটে কুটে রেখেছি। তুমি একটু ভাগ করে দাও।
কতটা নিয়ে এসেছিস?
সেদিনের মতো।
পক্কে।
বলো।
মাখতে পারবি?
আমি, ঘণ্টা দুজনে মাখবো বলেছি।
বেশি জায়গা না করে একটা জায়গায় মাখ। দুজনে একসঙ্গে হাত লাগাবি।
ঠিক আছে।
অনিকা।
বলো।
একটু গরম জল বসিয়ে দে। রাইসের সব কেটেছিস?
একটু বাকি আছে।
নম্রতা হাত লাগিয়েছে?
ও পারে না।
পারে না, শিখিয়ে নে। তুই আর বোন দুজনে মিলে রাইসটা বানাবি। ওকে সঙ্গে নিবি।
ঠিক আছে।
সুন্দর।
বলো।
তুই আর ভাই দুজনে মিলে টিকিয়া বানাবি। শুভ কোথায়?
নেপলামামার সঙ্গে বাজারে গেছে।
ভজু ট্রে আছে।
আজ বেশি করে নিয়ে এসেছি।
সাজাতে পারবি।
পারবো।
সাজাবার পর সেদিন যেভাবে ওভেনে ঢুকিয়েছিলাম মনে আছে।
ভজু মাথা দোলালো।
সেইভাবে সাজিয়ে টেম্পারেচার আড়াইশো করে পনেরো মিনিট।
তুমি একটু আসবে।
ঠিক আছে। সুন্দর।
বলো।
ওই সময় তুই অনন্য ভজুমামাকে সাহায্য করবি।
ঠিক আছে।
আর কিছু।
বাকিটা আমরা করে নেব। অনিকা বললো।
মা-রে একটু চা খাওয়াবি। অনিসার দিকে তাকালাম।
তুমি যাও করে নিয়ে যাচ্ছি।
ঘরের বাইরে এলাম। ইসলামভাই ফোনে কার সঙ্গে কথা বলছে।
আমাকে হাত দেখাল। একটু দাঁড়া। কথা বলা শেষ করে ফোনটা পকেটে রাখল।
চিকনারা হাইওয়ে ছেড়ে কোনা বাইপাশে ঢুকেছে।
ওদের কে খবর দিল?
মামনি।
ইকবালভাই এলো না।
এবার সব চলে আসবে। তুই তো বড়ো খেলা খেলে দিয়েছিস। কেউ জানেই না।
কে বললো?
চিকনা বললো।
তোমার ডাক পরবে এখুনি, অপেক্ষা করো।
আমি এ ঘরে এলাম।
ঢোকা মাত্রই আমাকে দেখে অনুপদারা একটা বিটকেল হাসি হাসলো।
বলুন আন্টি, ওর মুখ চোখ দেখে আপনি কিছু বুঝতে পারছেন। রূপায়নদা বললো।
আন্টি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে।
কেন, আমি কি করেছি!
তুই কিছুই করিস নি। আমরা এমনি এমনি সবাই এখানে হত্যে দিয়ে বসে আছি। এবার বলুন আন্টি আমরা অনিকে সাপোর্ট করবো, না আপনার জামাইকে সাপোর্ট করবো?
আমি অনুপদার পাশে বসলাম।
কেন শুধু শুধু আন্টিকে ভড়কে দিচ্ছ?
একবারে না। আন্টি তার জামাইকে খুব ভাল করে চেনে।
ফোনটা বেজে উঠলো।
পকেটে হাত ঢোকাবার আগেই মিত্রা হাতটা চেপে ধরলো।
কি হলো।
ও সব ঠান্ডা চোখ অন্য কাউকে দেখাবি। আমরা শুনবো।
এই টুকুতে কাপর চোপর নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, আবার শুনবে।
আমরা শুনবো।
তনু পকেট থেকে ফোনটা বার করে বললো, কোড নম্বর ব্লিঙ্ক করছে, ভয়েজ অন করে দিল।
আমি হাতে নিয়ে রিসিভ করলাম।
বল।
ভাইঝিরা মাংস রান্না করছে পাঠাবার ব্যবস্থা করবে না?
আলতাফ উর্দুতে বলছে। অনিমেষদা ইসারাতে তনুকে বললো তাড়াতাড়ি ইসলামকে ডাক। তনু লাফিয়ে খাট থেকে নেমে দরজায় দাঁড়িয়ে ইশারা করলো।
পাঠাব। আমার খবর?
সব ঠিক আছে। দাধিয়া গেছিল?
এসেছিল।
কি বলতে চাইছে?
চুপ করে রইলাম।
তুমি না বললেও ওকে এবার রাখবো না।
কি হয়েছে বল?
প্রবীরদার ঘরের কনফিডেন্সিয়াল ফাইল বাইরে আসে কি করে। সেখানে যে স্পট গুলোর কথা বলা হয়েছে দাধিয়া, অনাদি সেখানে জায়গা কিনতে শুরু করেছে।
কতটা কিনেছে?
প্রায় পঁচশো একর।
তুই এক কাজ কর…
বলো।
ফোরে লাগিয়ে দে। দামটা একটু বারিয়ে দে।
খেলাটা তুমি খেলেছো!
হ্যাঁ।
ধন্য তোমাকে। তোমার মতলব বোঝা মুস্কিল।
তুই একটুও কিনিস নি তো?
তুমি বলোনি, কিনবো কেন!
তুই কোন পার্টে হাত দিয়েছিস?
আমি শ্যামেদের পার্টে হাত দিয়েছি, আর লোয়ার পার্টে।
শ্যামের সঙ্গে কথা বলেছিস?
দিয়েছি কালকে গালাগাল।
কটা সিটের দায়িত্ব নেবে বলেছে?
তিরিশটা।
নিজে দাঁড়াবে?
শ্যাম, শিবু, দারু কেউ দাঁড়াবে না। সব ওদের লোক দাঁড়াবে।
আর কে ছিল?
চিকনাদা এসেছিল।
ও কি করতে গেছিল!
শ্যাম ডেকে পাঠিয়েছিল, তোমার পার্ট নিয়ে কথা হলো।
কি বলছে?
বাসুদাকে চিকনাদা চাইছে না।
কেন?
নীপা ম্যাডামকে সামনে রাখতে চাইছে। মীরচাচা সাপোর্ট করলো।
তাহলে বাসু কি করবে?
টেবিলে সামলাবে। পেপার ওয়ার্ক করবে।
হুঁ।
তুমি কিছু বললে না।
ও আসুক কথা বলবো।
সত্যি অনিদা আমরা তোমাকে কি ভালোবাসি, চিকনাদা আমাদের থেকে ঢের বেশি তোমাকে ভালোবাসে। কালকে চিকনাদাকে জীবনে প্রথম দেখলাম। একবারে তোমার কার্বন কপি।
বেশি বক বক করিস না।
তোমাকে আর দরকার নেই, চিকনাদাকে পেলেই সব কাজ গুছিয়ে নেব।
পর্শুদিন মেয়ে, অনিকা যাচ্ছে।
দাদা খবর পাঠিয়েছে। দাদার খাস লোক চলে এসেছে, তোমাকে ভাবতে হবে না।
এই খবরটা বাইরে বেরয় কি করে?
যা শুনছো সেটা ঠিক নয়।
ঠিক তো।
হান্ড্রেড পার্সেন।
মাংস ঠিক সময়ে পৌঁছে যাবে।
শোনো শোনো।
বল।
কিছু নাম দাও না।
কেন!
সব নাম শেষ হয়ে গেছে।
ঠিক আছে রাতে মেল করবো। টাকা আছে?
দাদা ট্রান্সফার করেছে।
ওদিকটা খুঁচিয়ে দে।
এখুনি দিচ্ছি।
ফোনটা অফ করে পকেটে রাখলাম।
ইসলাম তুমি এদিকে এসো। অনিমেষদা বললো।
ইসলামভাই আমার দিকে তাকিয়ে হেসেই চলেছে।
অনিসা, নম্রতা, অনিকা ঘরে ঢুকলো। হাতে চায়ের পট। টিকিয়া।
কিরে এখন ভাজলি? অনিকার দিকে তাকালাম।
ভাই বললো দিদি কয়েকটা ভেজে দিই বাবা চায়ের সঙ্গে খাবে।
মিত্রা, তনু দু-জনেই হাসলো। একবার বড়োমার দিকে টেরিয়ে দেখলো।
কেন, তুই খাবি না? তোর জন্য পাঠায় নি? বড়োমা খ্যাঁক করে উঠলো।
খাবো তো। আমি কি কিছু বলেছি।
তোর চোখ দেখে বুঝি না।
সকলেই মুচকি মুচকি হাসছে।
এখন থেকে খেতে আরম্ভ করলে সব শেষ হয়ে যাবে। ওদের দিকে তাকালাম।
শুভ আবার নিয়ে এসেছে। অনিসা বললো।
মামা চারটের সময় বেরবো। ছটার মধ্যে ফিরে আসবো।
অনিকা একটা টিকিয়া আমার হাতে দিল।
আমাকে দে। মিত্রা, অনিকার দিকে তাকাল।
অনিকা প্লেটটা এগিয়ে দিল।
অনিসা চা ঢেলে সকলের দিকে এগিয়ে দিল।
আঙ্কেল। আঙ্কেল। তারস্বর চিৎকারে বাইরের দিকে তাকালাম।
মাম্পি, মিকি গেটের কাছে, গাড়ি থেকে নেমে দৌড়চ্ছে। রবীন মনে হয় গাড়ি নিয়ে ওদের আনতে গেছিল।
আমি উঠে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম।
হয়ে গেল বিধানবাবু, আজ আর ধরা গেল না। অনিমেষদা বলে উঠলো।
বৌদি হাসছে।
দেখলাম সুরো, মিলি দুজনেই বাগানের পথে হাঁটতে হাঁটতে আসছে।
ওরা এসে আমার লম্বা ঠ্যাং জড়িয়ে ধরেছে।
মা অইসক্রীম দেয়নি। পরক্ষণেই টেবিলের দিকে নজর পড়ে গেছে। সোজা ভেতরে ঢুকে প্লেট থেকে একটা করে টিকিয়া তুলে নিল।
আমি গিয়ে আমার জায়গায় বসলাম। দুজনে আমার ঠ্যাংয়ের মধ্যে ঢুকে পড়লো। নিজেদের মধ্যে কল কল করছে।
বাবাঃ সবাই এই ঘরে। রান্না করবে না! কখন খাব? বড়োমার দিকে তাকিয়ে সুরো বললো।
মিলি আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
অনিকা একটা করে টিকিয়া ওদের মুখে ঢুকিয়ে দিল।
কে বানাল? মিলি বললো।
বোচন, সুন্দর। অনিকা বললো।
আজ কি তোরা রান্না করছিস?
অনিকা মাথা দোলাল।
মেনু।
সেদিন মামা যা বানিয়েছিল।
বড়োমা তোমার আর চিনতা নেই, চিকনাদার ডায়লগ, এন্যে পাইরা উঠছে রে।
মিলির কথায় সকলে হাসে।
মিলিমনি চা খাবে? অনিসা বললো।
খাব।
পিসী তুমি।
ঢাল।
সুরো, বৌদির দিকে তাকাল। গরম না ঠাণ্ডা?
ঠাণ্ডা।
সমস্যা মিটল?
মেটার পথে।
মর্কটটা কোথায়?
মনে হয় বোচনের ঘরে।
সুরো, ইসির দিকে তাকাল। প্রেসার ঠিক আছে?
ভেবে কি করবো বল।
বৌদি ঝাড়টার কিছু হয়েছে? সুরো, মিত্রার দিকে তাকাল।
তুই তো ভয়ে আগে কেটে পরলি। ভাবলাম তোকে ঢাল করবো।
আজ ঢাল, তরোয়াল সব ভেঙে দিত। কনিষ্কদা যা আওয়াজ দিল। আর একটার খবর?
স্থিতা বস্থা, বড়োমা দেখে এসেছে।
আমি কুট কুট করে ওদের সঙ্গে কথা বলছি। ওরাও আমার সঙ্গে চোখ মুখ বেঁকিয়ে কথা বলে চলেছে। কানটা সুরো, মিলির দিকে। আন্টি আমাকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে দেখছে।
এই, এবার চল, অনেকক্ষণ আঙ্কেলের সঙ্গে বক বক করেছিস। সুরো চেঁচাল।
মিলিদি তোমার ব্যাগে জামাকাপর আছে বার করে আনো।
দু-টোতে আমার ঠ্যাংয়ের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এলো।
আমি সুরোর দিকে তাকালাম।
তাকিয়ে লাভ নেই। আমি জানি আমার কপালে আজ দুঃখ আছে। রেডি হয়ে নিই।
ওরা সবাই বেরিয়ে গেল।
ইসলামভাই, অনিমেষদা, বিধানদার সঙ্গে ফিসফাস করছে। বুঝলাম আমার ফোনের ব্রিফ করছে। অনুপদা, রূপায়ণদা পাশে গিয়ে বসেছে। দাদা, ডাক্তারদাদা মনোযোগ দিয়ে সব শুনছে।
সবারই চোখ চক চক করছে।
বাইরের গেটে হর্ণ বেজে উঠলো। দেখলাম চিকনারা ঢুকছে।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। চায়ের কাপ হাতেই রয়েছে।
অনুপ আজ আর হলো না। চলো আমরা ওই ঘরে গিয়ে বসি। পারলে চিকনাটাকে ধরি।
অনিমেষদা আমার দিকে তাকিয়ে শুকনো মুখে বললো।
আমি বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম।
দেখলাম ভানু ড্রাইভিং সিট থেকে নামলো। সামনে চিকনা, বাসু। পেছন থেকে সুবীর, মীরচাচা, নীপা নামলো। পাঁচু, পচাকেও দেখলাম।
চিকনা এগিয়ে এলো। পেছনে ভানু, বাসু।
কাছে এগিয়ে এসে আমার হাত থেকে কাপটা নিল একটু প্লেটে ঢেলে নিয়ে কাপটা ভানুকে দিল। প্লেটের চা টুকু নিজে খেয়ে ভানুকে প্লেটটা ধরিয়ে দিল।
এটা কি হলো চিকনা? মিত্রার গলা পেলাম।
দেখলাম মিত্রা পেছনে দাঁড়িয়ে।
প্রসাদ। চিকনা আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
দু-টাকে পিটছু।
তনু হেসে উঠলো।
তনুদি হেসো না। ও বলে সহ্য করে, আমরা সহ্য করতে পারি না।
ও চিকনা এগুলো কুথা রাখবো। পচা চেঁচিয়ে উঠলো।
দেখলাম হাতে এক বোঝা শাক। সবাই ধুপ ধাপ পায়ে পড়ে যাচ্ছে।
চিকনা, ডাক্তারদাদার দিকে তাকিয়ে হাসলো।
ওরা তোমায় কি দেবে খুঁজে পাচ্ছিল না। আমি বললাম ন-রকমের শাক নিয়ে চল। ডাক্তারদাদা শাক খেতে ভালবাসে।
ডাক্তারদাদা মাথা দোলাচ্ছে। আন্টি জোড়ে হেসে উঠলো।
আরও আছে। পাঁচু তোমার জন্য সকালে জাল টেনে মাছ ধরেছে। ভানু দু-জাড়, মীরচাচা দু-জাড় দুধ নিয়ে এসেছে। চল্লিশ লিটার। তাছাড়া ঘরের ডাব, কলা। পরীদার ছেলে ছানার জিলিপি, রসগোল্লা, সন্দেশ বানিয়ে দিয়েছে।
সকলে হই হই করে উঠলো।
অনিসা, চিকনাকে এসে জড়িয়ে ধরেছে। অনিকা, চিকনার পেছনে লাগছে।
বুঝলি অনি এই দুটা মোকে একবারে পাত্তা দেয় না। ফোনে এমন সব কথা বলে কান গরম হয়ে যায়।
নাগো বাবা, চিকনাদা মিথ্যে কথা বলছে। অনিসা চোখ পাকালো।
বাবাকে শোনাব।
আমিও বাবাকে শোনাতে পারি রেকর্ড করে রেখেছি।
তোর সঙ্গে কি আমার সেই চুক্তি ছিল। চিকনা তিনশো ষাট ডিগ্রী ঘুরে গেল।
হাসির ফোয়ারা চলছে চারধারে।
ডাক্তারদাদা, আন্টিকে দেখাও। চিকনা বললো।
নীপা, আন্টিকে জড়িয়ে ধরে আছে।
চিকনাদা আমি প্রথম খুঁজে পেয়েছি।
ও চিকনা দুধের জাড়গুলো নিয়ে আয়, না হলে এবার নষ্ট হয়ে যাবে। বড়োমা বললো।
তোমায় এ নিয়ে ভাবতে হবে না। জায়গাটা দাও পাঁচু, পচা সব ঠিক করে দিচ্ছে।
ভানুর দিকে তাকাল।
বড়োমার কাছ থেকে বঁঠি জোগাড় করে মাছটা কাটার ব্যবস্থা কর। এরপর নষ্ট হয়ে যাবে।
আবার বড়োমার দিকে তাকাল।
বড়োমা, তুমি বরং জিলিপি আর রসগোল্লা সকলকে বেঁটে দাও। এরপর নষ্ট হয়ে যাবে।
দুই বোনে চিকনাকে ছেড়ে গাড়ির দিকে চলে গেল। মিত্রা, তনু পেছন পেছন গেল।
দাঁড়া গাড়িটা সেউ পাশে রাইখে আসি। ভানু বাগানে নেমে গেল। মীরচাচাকে নিয়ে ইসলামভাই পরেছে। আমার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো।
চলবে —————————–
from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/0xgAbs2
via BanglaChoti
Comments
Post a Comment