কাজলদিঘী (১৪৫ নং কিস্তি)

❝কাজলদীঘি❞

BY-জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

১৪৫ নং কিস্তি
—————————

এখনও ঠিক ঠিক সকাল হয়নি। রাস্তার নিওন আলোগুলো এখনও বেশ উজ্বল। কর্পোরেশনের লোক রাস্তা ঝাঁট দিতে শুরু করেছে। সকালের কলকাতার অনেকটাই ওদের দখলে চলে যায়। তখন ওরাই রাজ করে কলকাতার শরীরে।

দাদা, কোথায় যাবে?

নেপলার দিকে তাকালাম।

কৃষ্ণনগর।

কৃষ্ণনগর!

কেন ভয় পেলি?

না।

গাড়িতে তেল আছে?

কাল রাতে ফুল ট্যাঙ্কি করেছি।

চল গড়িয়াহাটে একটু চা খেয়ে নিই। তারপর নন স্টপ।

তোমাকে একটা কথা বলবো বলবো করে বলা হয়নি।

নেপলার চোখ রাস্তার দিকে।

বল।

আবিদদার অফিসের সামনে দু-দিন চিনাকে ঘোরা ফেরা করতে দেখেছি। সঙ্গে চাঁদের নতুন দুটো ছেলেকেও দেখছি।

নেপলার দিকে তাকিয়ে হাসলাম।

হেসো না, একটু বলো না, কি হয়েছে?

আমার মেয়ে আমার ওপর অভিমান করে বসে আছে। তাকে খুঁজে পাচ্ছি না।

তুমি কি তাকে খুঁজতে বেরিয়েছ?

মাথা দোলালাম।

আবিদের অফিসের সামনে তাহলে চিনা কেন?

চুপ করে রইলাম।

গড়িয়াহাটে চায়ের দোকানের সামনে এসে নেপলা গাড়িটা দাঁড় করালো। দু-জনে চা খেলাম। চা খেতে খেতেই খুব সংক্ষেপে নেপলাকে গল্পটা বললাম। নেপলার চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল।

আবিদদাটা সেইরকম ঘাউড়াই রয়ে গেল।

ওকে নিয়ে আমার অনেক চিন্তা বুঝলি নেপলা।

ওতো রতনদার সঙ্গে একবার আলোচনা করতে পারতো।

হয়তো করেছে, আমি তুই জানবো কি করে।

তাহলে আমি একটা আওয়াজ পেতাম।

কে দিত!

সাগির।

হাসলাম।

আমি একটু পেছনের সিটে পরে পরে ঘুমোই তুই একা একা চালাতে পারবি?

কেন পারবো না, তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমোও, তোমার চোখ মুখটা ঠিক নেই।

কৃষ্ণনগরে ঢোকার আগে আমাকে ডাকবি।

ঠিক আছে।

আমার ফোনটা তোর কাছে রাখ। একটা ঝড় উঠবে, সামলাতে পারবি?

আমি তখন অনিদা হয়ে যাব।

হতেই হবে, কথাটা মাথায় রাখবি।

তোমার হাত আমার মাথায়, নেপলা কোনওদিন বিনা যুদ্ধে হারতে জানে না।

আমি পেছনে উঠে লম্বা করে শুয়ে পড়লাম। নেপলা গাড়িতে স্টার্ট দিল।

জানলা বন্ধ থাকলেও বেশ শীত শীত করছে। তবু ঘুমিয়ে পড়লাম।

নেপলার ডাকে যখন ঘুম ভাঙলো চারিদিকে আলোয় আলো। তারাহুরা করে উঠতে গিয়ে টাল খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম। কোনওপ্রকারে সিটটা ধরে ফেললাম।

এই দ্যাখো এখুনি গণ্ডগোলে ফেলছিলে। নেপলা আমাকে ধরে ফেললো।

ঘুমচোখ পরিষ্কার হওয়ার আগেই দেখলাম সামনে উসমান দাঁড়িয়ে।

কিরে তুই এখানে?

বাবাঃ তোমার ঘুম বটে। তোমাকে ফোন করলাম, দেখলাম নেপলা ধরলো। নেপলাই বললো কৃষ্ণনগর মোড়ে যেতে, চলেগেলাম। তারপর গাড়িতে উঠে নেপলাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এলাম। তোমার আর ঘুম ভাঙে না।

নেপলার দিকে তাকালাম।

একটু জলের বোতলটা দে, চোখে মুখে দিয়ে নিই।

নেপলা জলের বোতলটা সামনের সিটের তলা থেকে বার করে দিল।

আমি গাড়ি থেকে নেমে মুখে চোখে জলের ঝাপটা দিলাম। চোখ দুটো কেমন জ্বালা করছে।

নেপলা, কটা বাজে রে?

পৌনে নটা।

ঠিক সময়ে পৌঁচেছি। উসমান ফাদার আছে?

থাকবে না মানে, কে আসছে দেখতে হবে তো—

তোকে আগের থেকে বেশ চকচকে লাগছে।

পয়সার গরম, বুঝলে অনিদা।

এই তো মুখে খই ফুটেছে।

উসমান হাসছে।

একটু চায়ের ব্যবস্থা কর, তারপর চার্চে যাব।

নেপলা গাড়িটা চার্চের ভেতরে ঢুকিয়ে দিল। আমরা সামনের দোকানে দাঁড়িয়ে চা খেলাম।

তারপর চার্চের গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলাম।

উসমান—

বলো—

তুই তো বললি, ফোনে সব বলা যায় নাকি, সামনা সামনি বলবো। কি কথা আছে বল?

তুমি কি জানতে চাও বলো?

নাসরিন এখন আপাতত কোথায়?

আমাকে কিছু বলে নি। ফাদার সব জানে।

বেশ।

তুই নাসরিনকে লাস্ট কবে দেখেছিস?

কাল এসেছিল।

আচ্ছা একটা সত্যি কথা বলতে পারবি?

বলো।

আজ তো নসরিনের বিয়ের রিসেপশন?

হ্যাঁ।

তোকে যেতে বলেছে?

না।

কেনো?

এখন সব বড়ো হয়ে গেছে, উসমান চাচাকে মুছবে কেন?

এইজন্য তোকে বলেনি?

উসমান আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

বল না আমি ঠিক বলছি কিনা?

উসমান হাঁ করে রয়েছে।

আচ্ছা তোর একটুও মনে হয়নি। নাসরিনের তখন বছর দুয়েক বয়স, আমি যেদিন যেদিন আসতে পারতাম না, নাসরিন কেঁদে উঠলে তুই তাকে কোলে নিয়ে হল ময় ঘুরতিস, তোর কাঁধে মাথা দিয়ে দিনের পর দিন একটা শিশু ঘুমিয়েছে। যাদের জন্য তুই সারাজীবন চাচা থেকে গেলি, বিয়েই করলি না, তারা এতো বড়ো একটা কাণ্ড করবে আর তোকে বলবে না, তা হয়?

উসমান আমার মুখের দিকে তখনও তাকিয়ে।

কাল বললি, নাসরিন তোকে হাতখরচ দিয়ে গেছে।

দিয়েছে তো।

যে তোকে হাতখরচ দিতে পারে মাসের পর মাস, তাও মানি অর্ডার করে পাঠায় না। এখানে এসে তোর সঙ্গে দেখা করে তোর হাতে দিয়ে যায়। আর তার জীবনের এতোবড়ো একটা ঘটনা সে তোকে বলবে না। তা হয় কখনো!

ঘণ্টা, পক্কেও হাত খরচ দেয়।

নেপলা হেসে ফেললো। নেপলার দেখা দেখি উসমানও হেসে ফেললো।

এতো কথা মথায় আসে নি।

হাসলাম। এবার একটা সত্যি কথা বল।

বলো।

নাসরিনকে তুই খুব ভালোভাবে দেখেছিস।

কালকে আমি, ফাদার, নাসরিন তিনজনে বসে কথা বলেছি।

নাসরিন কি মা হতে চলেছে?

কি পাগলের মতো বকছো!

নেপলা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। দাঁড়িয়ে পড়লো।

কি হলো তুই দাঁড়িয়ে পড়লি কেনো?

এইটুকু জানার জন্য তুমি উসমানভাইকে এতক্ষণ গল্প শোনালে!

উসমানও দাঁড়িয়ে পড়েছে। ব্যাপারটা ও ঠিক ধরতে পারে নি।

আবার হাঁটা শুরু করলাম।

আমাদের শরু পথের দু-ধারে সারি সারি তাল গাছের মিছিল। ইঁট বেছান রাস্তাটা ফাদারের ঘরের দিকে এঁকে বেঁকে চলে গেছে। তালবাগানের ভেতর দিয়ে আমরা তিনজন কথা বলতে বলতে হাঁটছি। গ্রাম নয়, তবু যেন গ্রামের পরশ চারিদিকে মাখামাখি হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। মূল চার্চ বাঁদিকে, ডানদিকে ফাদারের ঘর। চার্চের পেছনে স্কুল, ছাত্রাবাস। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের, চার্চের কর্মচারীদের থাকার জায়গা।

প্রথম থেকেই পয়সার অভাবে ধুঁকছে চার্চটা। তবু যতটা পারি সাহায্য করি। যারা অর্ফান তারা মাঝে মাঝে গাছপালা সাফাই অভিযানে নামে। দিন পনেরো ঠিক থাকে, তারপর আবার যেই কে সেই। এতো বড়ো জায়গা মেইনটেইন করাও সমস্যা।

ফাদারের ঘরের সামনে যে ছেলেটি থাকে সে আমাদের দেখে উঠে দাঁড়ালো।

উসমানকে বললাম যা ফাদারকে গিয়ে বল আমি এসেছি।

ফাদার তোমার জন্য আজ কলকাতা গেল না, আবার জিজ্ঞাসা করতে যাব।

কাছে আসতে বাইরে বসে থাকা ছেলেটি বললো, ফাদার ভেতরের ঘরে আছেন। আপনারা এলে ভেতরে যেতে বলেছেন।

আমি ভেতরে এলাম।

এই সব জায়গার কোনও পরিবর্তন হয় না। আবহমান কাল ধরে যেমন চলে আসছে, তেমনি চলছে। চারিদিকে ঘন কুয়াশার মতো দারিদ্র্যতা, কিন্তু এই দারিদ্র্যতার মধ্যেও চির শান্তি বর্তমান। ফাদারের সেই ঘর, সেই আসবাব এখনও অটুট। আমি বছর দুয়েক আগেও এই অবস্থায় দেখে গেছি। এখনও বর্তমান। আমি চারদিক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম। নেপলাও আমার মতো অবাক হয়ে দেখছে।

কিরে ভাগ্নীকে খুঁজতে বেরিয়েছিস?

চমকে ফাদারের দিকে তাকালাম। ফাদার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। আমি কাছে গিয়ে নিচু হয়ে ফাদারকে প্রণাম করলাম।

হাসছি।

ওর শরীরে তোর রক্ত নেই। তবে তোর কথাবার্তা, চালচলন বেশ ভালো রপ্ত করেছে।

আমি উঠে দাঁড়াতে নেপলা ফাদারকে প্রণাম করলো।

এটা কে?

নেপলা।

সেই ব্যক্তি যে তোকে ডিটো কার্বন কপি করে?

না না সেরকম কিছু নয়।

নেপলা হাসছে।

ক্রিস।

ফাদারের ডাকে বাইরে বসে থাকা ছেলেটি ঘরে এলো।

অনিকা কোথায়?

বুকের ভেতরটা সামান্য কেঁপে উঠলো।

প্রেয়ার হলে।

যা আগে মেয়েকে নিয়ে আয়, তারপর কথা হবে।

ও কখন এসেছে!

নেপলা, উসমান অবাক হয়ে ফাদারের মুখের দিকে তাকিয়ে।

আমার থেকে তুই ভালো জানবি।

ফাদারের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

দোষ ওদের নয়। তোকে দুবছর ও চোখে দেখে নি। তোর অসুস্থতার খবর পেয়ে আমাকে পাগল করে দিয়েছিল। একদিন অনিকা, ঘণ্টা, পক্কে তিনজনে মিলে নার্সিহোমে গেল, ফিরে এলো। তুই তখন একুশদিনের কোমায় আচ্ছন্ন। খবর পাই, আমার হাত-পা বাঁধা।

তোর কিছু হলে এই পৃথিবীতে ওদের আপন বলে কে আছে বল। ওই সময় তোকে দেখার অধিকারটুকু কি ওদের ছিল না। আমি সামনে যেতে পারি না। গোপনীয়তা রক্ষা করা যাবে না। সত্যি শব্দটা যে কতটা নিষ্ঠুর সেদিন অনুভব করেছিলাম। তোর জন্য ওই সময় প্রার্থনা করা ছাড়া আমাদের কি উপায় ছিল বল। তোকে শুধু চোখের দেখা দেখার জন্য তিনটে প্রাণ আজ দিনের পর দিন কলকাতায় পড়ে আছে। তোর বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে তোর অলক্ষে তোকে দেখতে চেয়েছে। তাও ওদের ভাগ্যে জোটে নি।

তোর গেটের দারোয়ানের সঙ্গে গল্প করে জেনেছে তুই টনা-মনার কাছে যাস। অনিকা সেখান পর্যন্ত ধাওয়া করেছে। কাছাকাছি কোথাও একটা ঘর ভাড়াও নিয়েছে। তোকে একটু চোখের দেখা দেখবে। আগে ফোন করতিস, সেটাও বিগত সাত-আট মাস বন্ধ করে দিয়েছিস। জানি তোর হরেক সমস্যা। তবু ওদের মনের কথাটা তোর বোঝা উচিত ছিল। যদি বলিস সময় পাইনি, তা এগুলোকে মাথায় ঢুকিয়েছিলি কেন—আবেগ?  আবেগ দিয়ে কখনও সেবা ধর্ম পালন করা যায় না। তার জন্য অনেক স্বার্থত্যাগ করতে হয়।

তুই এখানে আসবি জানতে পেরে কাল রাতে ওকে ফোন করেছিলাম। আজ সকালের ফার্স্ট ট্রেনে এখানে ছুটে এসেছে। তোর আগে এসেছে।

যা, মেয়েটা সকাল থেকে প্রার্থনা ঘরে একা রয়েছে, নিয়ে আয়।

ধীর পায়ে ফাদারের ঘর থেকে বাইরে এলাম। সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে মাথাটা কেমন যেন একটু টাল খেল, নেপলার হাতটা ধরে কোনও প্রকারে সামলে নিলাম।

অনিদা!

কিছুnনা, পায়ে পা জড়িয়ে গেছিল।

তবু নেপলা আমার দিকে সন্দেহের চোখে তাকাল।

চার্চটা সামনে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু মনে হচ্ছে যেন শতেক যোজন দূরে। পথ যেন আর শেষ হচ্ছে না। বুকের ভেতর কাঁপুনিটা কেমন যেন ধীরে ধীরে বেড়ে যাচ্ছে।

কেন এমন হচ্ছে?

অনিকার সঙ্গে আমার কোনও রক্তের সম্পর্ক নেই। ও মেরিনাদির মেয়ে। আমার তাতে কি? সত্যি তো! এতে মিথ্যের কোনও রং নেই।

মেরিনাদির মৃত্যুর পর আমি ওর দায়িত্ব নিয়েছি। তিলে তিলে ওকে তিলোত্তমা করে তুলেছি। আমি ছাড়া এই পৃথিবীতে ওর আত্মীয়স্বজন কেউ নেই। থাকলেও, এতদিন ও তা জানতো না। আজ হয়তো ও নিজের চেষ্টায় জেনে ফেলেছে। এতদিন আমিই ওর মা-বাবার রোল প্লে করেছি। আমাকে আঁকড়ে ধরে আজ ও এই পৃথিবীতে চলাফেরা করছে। আমার কাছে ওর দাবি অসীম।

অনিসা ওর বাবাকে কাছে না পেলেও মাকে পেয়েছে। বড়োমা, ছোটোমা, দাদা, মল্লিকদাকে দাদু-দিদাই হিসাবে পেয়েছে। অনিকা কিছু পায়নি। ওর সব কিছু আমাকে কেন্দ্র করে।

ঘণ্টা, পক্কে?

অনিকার থেকে বছর দুয়েকের ছোট। অনিকা ওদের দিদি। তিন ভাইবোন এক সঙ্গে বড়ো হয়ে উঠেছে। আয়েষা, দময়ন্তী ওদের সাবর থেকে বছর তিনেকের বড়ো। এখানে এসে ওদেরও কাছে টেনে নিয়েছিলাম।

দময়ন্তীকে অফিসে কাজে লাগিয়েছিলাম। নিজের কাজও যে করাইনি তা নয়। সেই সময় আমাকে একটু স্বার্থপর হতে হয়েছিল, বাঁচার তাগিদে।

তবে আমি কখনও মিথ্যের আশ্রয় নিইনি। যা করেছি ফাদারকে সব জানিয়েছি।

ফাদারের অনুমতি নিয়েই এগিয়ে গেছি।

তাহলে জটটা পাকলো কোথায়?

আমার এ্যাবসেন্স? না ইনভিজিবল কোনও পার্সেন?

আবার নতুন করে পথ চলা শুরু করতে হবে।

কেন আয়েষা এই মিথ্যের আশ্রয় নিল? লোভ? প্রতিহিংসা?

চার্চের গেটের কাছে চলে এলাম।

প্রেয়ার হলের এই ক-টা শিঁড়ি যেন মনে হচ্ছে চারতলা বাড়ির সমান।

ধীরে ধীরে ওপরে উঠে এলাম।

হলঘরের ভেতরে ঢুকে দেখলাম একবারে সামনে অনিকা নীলডাউন হয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে। ছুটে গিয়ে ওকে ছুঁতে ইচ্ছে করলো। স্থবিরের মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম।

বুক থেকে একটা দার্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

অনিকা একটা সাদা তাঁতের শাড়ি পড়েছে। শাড়ির জলপাই রংয়ের পাড়ের সঙ্গে ম্যাচ করা ব্লাউজে ওর শরীর ঢাকা। এই মুহূর্তে ওর শান্ত মুখটা ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে।

যীশুর ক্রুশবিদ্ধ অবয়বটা ওর নিবিড় প্রার্থনার কাছে নতি স্বীকার করেছে।

শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম, অনিকা।

ফাঁকা হলঘরটায় আমার গলার আওয়াজ চারদিক থেকে রিনিঝিনি করে ছড়িয়ে পড়ছে।

অনিকা আমার ডাকে ঘাড় ঘুরিয়ে এক পলক তাকাল। নিমেষের মধ্যে উঠে দাঁড়িয়ে রুদ্ধশ্বাসে ছুটে এসে বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। ওর দুটো নরম হাত বুকের ওপর এলোপাথারি আছড়ে পড়ছে। চোখে কেমন যেন ঝাপসা দেখছি। মাথার ঝিন ঝিনানিটা ক্রমশঃ বারছে। শরীরটা ক্রমশঃ যেন হাল্কা হয়ে যাচ্ছে। পা-দুটোয় তেমন জোড় পাচ্ছি না। সারাটা শরীরে একটা কাঁপন অনুভব করলাম।

কেনো তুমি এখানে এসেছো—

অনিকা অঝোড়ে কাঁদছে।

আমি আষ্টে পৃষ্ঠে অনিকাকে জড়িয়ে ধরে ওর কাঁধে মাথা রাখলাম।

ওর সারাটা শরীরে এক অদ্ভূত কাঁপন অনুভব করলাম। সমানে ফুঁপিয়ে চলেছে।

আমার চোখদুটো কেমন অন্ধকার হয়ে আসছে। অনিকার বলা শব্দগুলো ‘কেন তুমি এখানে এসেছো’ কেমন যেন আস্তে আস্তে ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে।

ভীষণ ভয় পেয়েগেলাম।

আমি প্রাণপনে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে অনিকাকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরলাম। শরীরটা কেমন যেন হাল্কা হয়ে গেছে। আমি যেন আকাশে উড়ে বেরাচ্ছি।

অনিমামা….অনিমামা। তারপর প্রচণ্ড একটা ঝাঁকুনি অনুভব করলাম।

চোখের সামনেটা কেমন যেন অন্ধকার হয়ে গেলো।

দূর থেকে অনিকার কান্নাভেঁজা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো অনিমামা….উসমানচাচা…. ফাদার….।

চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলাম চার্চের ছাদে বড়দিনে লাগানো রাংতা-কাগজের তৈরি বড়ো বড়ো সেকল। এইসব সেকল এখানকার অরফ্যানদের হাতে তৈরি। এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত ঝুলছে। এই তো কটা দিন আগে বড়দিন গেছে। এখনও বেশ চক চক করছে। মৃদু হাওয়ায় সেগুলো দুলছে।

আমি চার্চের ভেতর একটা বড়ো বেঞ্চে অনিকার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি।

অনিকার নরম হাত আমার কপালে।

আমি ওর মুখের দিকে তাকালাম। ছল ছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

অনিকা, ছোটোমার মতো গায়ের রং পেয়েছে। একবারে পাকা গমের মতো। দেখলেই মনেহয় খানদানী রক্ত ওর শরীরে বইছে। অনিকা সুন্দরী নয়, তবে ওর মুখশ্রীর মধ্যে অদ্ভূত একটা আকর্ষনীয় শক্তি আছে। একবারে ছোটোমার মুখ বসানো। এরই মধ্যে মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে।

হেসে ফেললাম।

আমি জিতে গেছি, তুই হেরে গেছিস।

অনিকার মুখটা কেমন দুমড়ে মুচড়ে একাকার হয়ে গেল। গাল বেয়ে জলের ধারা নেমে এসে আমার চোখ মুখ ভিঁজিয়ে দিল।

ওর হাতটা চেপে ধরলাম।

কাঁদিস না। আর কোনওদিন ভুল করবো না। এবারের মতো ক্ষমা করে দে।

অনিকা দু-চোখের পাতা বন্ধ করলো। একবার দীর্ঘনিঃশ্বাস নিল।

নিচু হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো।

কাঁদিস না। তুই কাঁদলে আমি ভালো থাকি কি করে।

ওঠ অনেক কাজ। তারাতারি ফিরতে হবে। তুই এক কাজ কর, নেপলা আঙ্কেলের কাছ থেকে আমার ওষুধগুলো দে। সকালে খেতে ভুলে গেছি। তাই এই বিপত্তি।

হয়তো কথা বলতে গিয়ে আমার চোখটাও ছল ছল করে উঠেছিল।

অনিকা নিজের কাপরের আঁচল দিয়ে আমার মুখ মুছিয়ে দিলো।

এইবার মাথা ঘুরিয়ে চারদিক দেখার চেষ্টা করলাম।

ফাদার, নেপলা সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। উসমান, ক্রিস পেছনে। ঘরে আরও অনেকে রয়েছে।

ওরা কেমনভাবে যেন আমার দিকে তাকিয়ে।

ফাদারের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললাম।

আমার কিছু হয় নি ফাদার। এটা একটা নতুন ব্যামো। ডাক্তার এখনও ধরতে পারেনি। বলে কিনা ফিটের ব্যামো।

কিরে নেপলা, বাড়িতে ফোন করেছিস নাকি?

নেপলা কোনও কথা না বলে এক দৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।

দাদার চেলা হতে গেলে নার্ভকে আরও বেশি স্ট্রং করতে হবে।

তবু নেপলা কথা বলে না।

তুই সকালে একবার মনে করিয়ে দিতে পারতিস, দাদা তোমার ওষুধ খাওয়া হয়নি।

তুমি তখন ঘুমচ্ছিলে।

কৃষ্ণনগরের মুখে দাঁড়িয়ে একবার ডাকলেই কিছু মুখে দিয়ে ওষুধটা খেয়ে নিতাম।

আমি পাশফিরে ধীরে ধীরে উঠে বসলাম। অনিকা আমার শরীরটাকে জাপটে ধরলো।

লাগবেনারে পাগলি, আমি ঠিক উঠে পরবো।

অনিকাকে ধরেই ধীরে ধীরে উঠে বসলাম।

পেঁচির মতো মুখ করে আছিস কেন, একটু হাস। অনিমামা ভালো হয়ে গেছে।

ওকে জড়িয়ে ধরলাম।

বাবাঃ ঘরে তো দেখি অনেক লোক!

ফাদার একটু প্রসাদ নিয়ে এসো না। খেয়ে ওষুধগুলো খাই।

ফাদার আমার দিকে তাকিয়ে। ভ্রু-দুটো কেমন ছুঁচলো হয়ে গেছে।

দেখবে জাস্ট ফিফটিন মিনিটের মধ্যে আমি দাঁড়িয়ে পড়েছি।

এই রোগটা কবে থেকে হয়েছে?

যেদিন থেকে মাথা ফাটলো। তারপর তিনমাস মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই। সেখানেও আমি জিতে গেলাম। মৃত্যু আমার কাছে হার মেনে চলে যাওয়ার সময় এইটুকু আমাকে দান করে গেছে। বইবারও শক্তি দিয়েছে।

তোর পীরবাবা কোথায় থাকেন?

ফাদারের মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকালাম। আজ পর্যন্ত কোনও দিন ভুলকরে ফাদারকে এ কথা বলিনি। যদি কিছু মনে করেন। ফাদারের চোখে মুখে এক অদ্ভূত দীপ্তি ছড়িয়ে পড়েছে।

তুমি এখানে দাঁড়িয়ে….!

সব এক, আমরা তাঁকে আলাদা রূপে দেখি।

আমার গ্রামের একটা অশ্বত্থগাছ। শুনেছি আমার বাবা তাঁকে ওই গাছের তলায় দেখেছিলেন। আমি আজও তাঁকে আমার চর্মচক্ষে দেখার সৌভাগ্য লাভ করিনি।

ফাদার আমার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে।

কেন ফাদার আমি নিশ্চই ভুল বকছিলাম?

তুই অনিকাকে নিয়ে ওখানে একবার যাবি।

অবশ্যই নিয়ে যাব।

ক্রিস।

হ্যাঁ ফাদার।

অনির জন্য ওখান থেকে একটা পাঁউরুটি, আর এক গ্লাস জল নিয়ে আয়।

ফাদার একবার ব্যাঙ্কে যাব।

আমি জানি তুই কি করতে এখানে এসেছিস।

প্লিজ ফাদার তুমি রাগ করো না। তুমি তো সব জানো।

এতদিন একমাত্র আমি জানতাম, আজ অনিকা জানবে।

অনিকা আমার কাঁধে মাথা রেখেছে।

ক্রিস প্লেটে করে একটা পাঁউরুটি এক গ্লাস জল নিয়ে এলো।

আমি পাঁউরুটি ছিড়ে অনিকার মুখের দিকে হাত বাড়ালাম।

ওই টুকরোটা তুই খেয়ে একটু জল খা তারপর ওদের দুজনকে দে।

আমি ফাদারের দিকে অবাক হয়ে তাকালাম। কেন? প্রশ্নটাও করতে পারলাম না।

সম্মোহনের মতো পাঁউরুটির টুকরোটা মুখে তুললাম। একটু জল খেলাম।

ফাদার, বুকে ঝুলে থাকা ক্রশটা চোখ বন্ধ করে একবার কপালে একবার বুকে, তারপর দুই কাঁধে ছুঁইয়ে ঠোঁটে ছোঁয়ালেন।

আমি অবাক হয়ে ফাদারের দিকে তাকিয়ে।

জানিস অনি, আজ আমার প্রার্থনা সার্থক।

কেন ফাদার?

তোকে বলতে পারবো না। এতক্ষণ শুধু অনুভব করলাম। আমি একটু একটু করে পাঁউরুটি ছিঁড়ে একবার অনিকাকে দিলাম, আর একবার নেপলাকে দিলাম।

নেপলা কপালে ছুঁইয়ে মুখে দিল।

আমি গোগ্রাসে পাঁউরুটি খেলাম। ঢক ঢক করে জল খেলাম। তারপর নেপলার হাত থেকে ওষুধ নিয়ে পটাপট জল দিয়ে গিললাম।

নেপলা হেসে ফেললো।

অনিকা অবাক হয়ে আমাকে দেখছে।

দেখছিস কি? গত সাতমাস ধরে গিলে যাচ্ছি। ডাক্তার বলেছে আরও একমাস খেতে হবে। আর তুই গাল ফুলিয়ে গোবিন্দর মা হয়ে বসে আছিস।

আমার মুখ ভ্যাঙচানো দেখে, অনিকা হেসে ফেললো।

কি ফাদার ভদ্রলোক কেমন আছেন?

কথাটা শুনে পেছন ফিরে তাকালাম।

গট গট করে একজন ভদ্রলোক ভেতরে ঢুকে এলেন।

আমার সামনে এসে হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়ালেন।

আপনি আচ্ছা লোক মশাই, সবাইকে একবারে নাচিয়ে একশা করে দিলেন। ফাদার না বাধা দিলে আপনাকে নার্সিংহোমে টেনে নিয়ে যেতাম।

আমি ফাদারের দিকে একটু অবাক হয়ে তাকালাম।

ডা. ভট্টাচার্য।

তবু আমার ঘোড় ভাঙতে সময় লাগছে।

এখানে যে নতুন নার্সিংহোমটা হয়েছে, উনিই তার পরিচালক। ফাদার বললেন।

আমি উঠে দাঁড়ালাম। হাত বাড়িয়ে দিলাম।

আমি অনি ব্যানার্জী।

আর বলতে হবে না। এতদিন নামে চিন্তাম, আজ চাক্ষুষ দেখছি। আপনার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় সারাজীবন মনে রাখবো।

আমি হাসলাম।

ডা. ভট্টাচার্য নেপলার দিকে তাকালেন।

কি নেপলাবাবু, দাদা এবার ফিট। আর চিন্তা নেই।

আমার দিকে তাকালেন।

খুব ঘাবড়ে গেছিল। ভারি অদ্ভূত, ডাক্তারি শাস্ত্রে এমন বিরল রোগের অধিকারী আপনি।

রোগটা কি?

জানি না।

ভদ্রলোক এমনভাবে বললেন সবাই হেসে ফেললো। আমিও হাসলাম।

ডাক্তারদাদাও তাই বলেন। নেপলা বললো।

ডাক্তারদাদা!

ডা. সামন্ত।

উরি বাবা, উনি আমার প্রফেসার।

ডাক্তারদাদা আপনারও প্রফেসার? আমি বললাম।

ওই লেবেলে আর কে আছেন বলুন।

একদিন আসুন না কলকাতায়।

আসবো মানে! এবার আপনার ঘাড়ে চেপে বসবো। নেপলার মুখ থেকে সব শুনেছি।

ফাদার কাজগুলো সারতে হবে।

বেলা হয়ে গেছে, সব কাজ হবে না।

কি বলুন না ফাদার, আমি যদি সাহায্য করতে পারি। ডা. ভট্টাচার্য বললেন।

সব ব্যাঙ্কের কাজ।

করবে না মানে। আপনি চলুন ফাদার, চব্বিশঘণ্টার কাজ একঘণ্টায় করিয়ে দেব।

একমিনিট, একটু প্রণাম করে নিই।

যান।

আমি পায়ে পায়ে যীশুর মূর্তির সামনে এসে দাঁড়ালাম। অনিকা আমার পাশে। আমি আমার সনাতন নিয়মে সাষ্টাঙ্গে মাটিতে কপাল ছুঁইয়ে প্রণাম করলাম।

কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে দাঁড়ালাম।

একসঙ্গে সবাই চার্চ থেকে বেরিয়ে এলাম।

এখন অনিকা এবং নেপলার মুখটা অনেকটা পরিষ্কার।

চার্চ থেক বেরিয়ে ফাদারকে বললাম, আমি উসমানকে সঙ্গে নিয়ে যাব।

ওখানকার কাজ কিছুটা বাকি আছে উসমান থাকলে সুবিধা হবে।

ফাদারের কথায় আমি হাসছি।

অনিকার দিকে তাকালাম।

মুখটা একবারে হাগু করে রেখেছিস। কাপরজামা কিছু এনেছিস?

মুখ নামিয়ে নিল।

নেপলা ওকে নিয়ে দোকানে যা। ও পছন্দ করে যা কিনবে কিনে দে।

অনিকার দিকে তাকালাম।

নেপলামামার সঙ্গে চলে যা। রেডি হয়ে নে। আমি ফাদারের সঙ্গে এদিককার কাজ সারি।

আমি ফাদার আর ডা. ভট্টাচার্য ওনার গাড়ি করেই ব্যাঙ্কে এলাম।

আসার সময় ফাদারের মুখ থেকে আয়েষার সমস্ত ঘটনা শুনলাম। যত শুনেছি তত অবাক হয়ে গেছি। শেষে ফাদার দুঃখ করে বললেন। অনি আমারই ভুল।

সবাই মিলে ব্যাঙ্কে এলাম।

ডা. ভট্টাচার্যকে দেখা মাত্রই সবাই হই চই করে উঠলো। তারপর সঙ্গে ফাদার রয়েছেন।

সত্যি ভদ্রলোকের পরিচিতির লেভেলটা যথেষ্ট। তারপর আমার পরিচয় যখন ব্যাঙ্ক ম্যানেজারকে দিলেন কেমন যেন হুলুস্থূলুস কাণ্ড পড়ে গেল।

সত্যি সত্যি আমার এক দিনের কাজ এক ঘণ্টার মধ্যে সারলাম। তবু কিছুটা বাকি রইল। ব্যাঙ্ক ম্যানেজারকে অনুরোধ করলাম, যদি আমি না আসি, তাহলে কাজটা হবে তো? উনি হাসতে হাসতে বললেন, যে কেউ এলেই হবে। আপনি যাকে পাঠাবেন তার নামে একটা অথরাইজ করে দেবেন।

নিশ্চিন্ত হলাম।

ডা. ভট্টাচার্য আমাদের একবারে চার্চের গেটের কাছে নামিয়ে দিলেন।

ওনাকে বিদায় দিয়ে আমি ফাদার তাল বাগানের ভেতর দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। আস্তে আস্তে ফাদার অনেক কথা বললেন, সব মন দিয়ে শুনলাম। ফাদারের ঘরে এলাম।

দেখলাম উসমান, নেপলা রেডি হয়ে বসে আছে। অনিকাকে দেখতে পেলাম না।

আমার হাতের বিরাট ব্যাগ দেখে নেপলা আঁতকে উঠলো।

এটা কি গো!

হাসলাম। আমার সম্পত্তি, নিয়ে যাচ্ছি।

ব্যাঙ্কে ছিল!

ব্যাঙ্কের লকারে।

ওই হলো।

অনিকা কোথায়?

কখন থেকে তাড়া লাগাচ্ছি, ওর আর হয় না।

চল এবার বেরিয়ে পরবো।

কিছু একটু মুখে দিয়ে যা—ফাদার বললেন।

অতো বড়ো পাঁউরুটি খেলাম তাতে হলো না?

ফাদার হাসলেন, একটু মিষ্টি মুখে দিয়ে যা।

তাই দাও।

ফাদার ক্রিসকে বললেন।

তুমি কলকাতা কবে যাচ্ছ?

আজকে যাওয়ার কথা ছিল। দেখি আগামী সপ্তাহে যাব।

গেলে একবার ফোন করবে, আমি দেখা করবো।

এরা কবে আসবে?

এদের মর্জি।

তুই তো অন্য প্ল্যান ভেঁজে রেখেছিস।

এতদিন আড়ালে আবডালে ছিল এখন ডাইরেক্ট আমার মুঠোয়। একটু ঝাড়াই পোঁছাই করে নিই আগে। তারপর।

যা বললাম মাথায় রাখবি।

ও নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না।

ক্রিস মিষ্টি নিয়ে এলো। আমার আর ফাদারের হাতে প্লেটটা দিল।

ভেতরের ঘর থেকে অনিকা বেরিয়ে এলো। আমি ওর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। বাসন্তী রংয়ের তাঁতের শাড়িতে নিজেকে আপাদ মস্তক মুরে ফেলেছে। মুখে প্রসাধনীর চিহ্ন মাত্র নেই। কাপরটা পরাতে ওর গায়ের রং যেন আরও ফেটে বেরিয়ে আসছে। আমি হাঁ করে দেখছি।

ওরকম করে দেখছো কেনো, আগে দেখো নি?

ফাদার সত্যি করে বলো ওকে যদি কেউ অপহরণ করে নিয়ে যায় আমি বাঁচাতে পারবো।

ফাদার জোড়ে হেসে উঠলো।

ও জানে ওর অনিমামা আছে। কেউ ওর গায়ে হাত দিতে পারবে না।

অনিকার দিকে তাকাল।

তোকে বেছে বেছে এই রংটাই কিনতে হলো।

নেপলামামা বললো তুই এই রংটা কেন, দেখবি দারুণ লাগবে।

নেপলা ব্যাটা ফিক ফিক করে হাসছে।

ফাদার আমার বাক্স এখানে রয়েছে। অনিকা বললো।

নিয়ে যা।

এখন না।

কেন?

অনিমামা যদি তারিয়ে দেয়, আবার চলে আসবো।

তোর এখনও সন্দেহ আছে?

তুই চল, তোর অনেক শাস্তি তোলা আছে। পাকা বুদ্ধি? তোর মাথা ভাঙবো।

অনিকা মাথা নিচু করে মুখ টিপে হাসছে।

ফাদারের কাছ থেকে সব খবর নিয়েছি। মাথায় রাখিস।

কেন তুমি কিছু করনি। তোমাকে কে শাস্তি দেবে?

আমি মিষ্টি খেতে খেতে হাসছি।

ওমনি চুপ করেগেলে—তাই না?

নেপলা হাসছে।

আমি, তুই এবার এক দলে। আমরা সবাই মিলে এবার অনিদার শাস্তির ব্যবস্থা করবো।

খাওয়া শেষ হতে ফাদারকে প্রণাম করে আমরা বেরিয়ে এলাম।

নিজেকে এখন অনেকটা হাল্কা লাগছে। কয়েকদিন শরীরটার ওপর দিয়ে যেন রোলার চালিয়ে দিয়েছি। এমন একটা দিন আমার জীবনে আসবে কস্মিন কালেও ভাবিনি।

তবে অনিকা বড়ো হতে ওকে একটু একটু করে সব বলেছি। বুঝিয়েছি।

শেষবার এসেও ওকে বলেছি, আমাকে একটু সময় দে, তোকে আমি আমার কাছে নিয়ে যাব। কিন্তু কোথাও যাতে তোর মাথা হেঁট হয়ে না যায় তা আগে আমি পাকা করি, তারপর।

অনিকা কখনও কেঁদেছে, কখনও আর্গুমেণ্ট করেছে। চোখা চোখা যুক্তি আমার সামনে খাঁড়া করেছে। কখনও কেঁদে বলেছে কেন আমাকে বাঁচিয়ে রাখলে, মেরে ফেললে বরং ল্যাটা চুকে যেত, তোমাকে আর আমার ভার বইতে হতো না।

ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে, দুজনেই কেঁদেছি।

অনিমামা।

এ্যাঁ।

ওষুধ খাবে না?

ঠিক মনে করেছিস। চল গাড়িতে বসে খেয়ে নেব। নেপলা?

বলো।

তোরা কিছু খেয়েছিস?

তিনজনেই পেট পুরে খেয়ে নিয়েছি। ড্রাই ফুডও কিছু নিয়ে নিয়েছি।

ওদিককার কোনও খবর আছে?

ও নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। আমি আজ অনি ব্যানার্জী।

যাক বেঁচে গেলাম শাস্তির হাত থেকে।

অনিকা আমার দিকে তাকাল।

তাকাস না তোর গাল এখুনি লাল হয়ে গেছে।

হোক, তোমার কি?

গাড়িতে উঠে ভালোকরে বাবু হয়ে বসবি। আমি তোর কোলে মাথা দিয়ে ঘুমতে ঘুমতে যাব।

হবে না।

উসমান।

বলো।

তোকে মুখ ঝামটানি দিতো তাই না।

মুখ ঝামটানি কি গো, আরও কতো কিছু।

কিরকম?

আমি যা খুশি করি তোমার কি? কালও বলেছি নাসরিন চল, অনিদার টাকাটা ব্যাঙ্কে পড়ে আছে তুলে দিই। কি দেমাক? লাগবে না। আমার অনেক টাকা।

কান ধরলি না কেন?

বড়ো হয়ে গেছে। সে কি আর ছোট্টটা আছে, কোলে মুতে দিল, দিলাম একটা থাপ্পর।

উসমানচাচা।

অনিকা গম্ভীর হয়ে উসমানের দিকে তাকালো।

আর রিপোর্ট করবো না, হয়েছে।

গাড়ির কাছে এলাম। নেপলা আগে আমাকে ওষুধটা দে। খেয়ে নিই।

নেপলা আমার ব্যাগ থেকে ওষুধ বার করে দিল, সিটের তলা থেকে জলর বোতলটা বার করলো আমি ওষুধটা মুখে দিয়ে, বোতলটা খুলতেই অনিকা আমার হাত চেপে ধরলো।

তুমি এই জল খাবে নাকি?

তাহলে কি!

না তোমার খাওয়া হবে না। আমার ব্যাগে জলের বোতল আছে।

ধ্যুস কর্পোরেশনের জল খেয়ে পেট হেজে গেল আর তুই….।

আমি দেখি নি। তুমি খাবে না।

ঠিক আছে তোর বোতল বার কর।

অনিকা জলের বোতল দিল, আমি ওষুধ খেলাম।

আমরা দুজনে পেছনের সিটে বসলাম।

ব্যাগ কোথায় রাখবে? অনিকা বললো।

আমার কাছে থাকবে।

যখের ধন নাকি? নেপলা হাসতে হাসতে বললো।

হ্যাঁ।

নেপলা গাড়ি স্টার্ট করলো।

কৃষ্ণনগর মোড়ে আসতে মিনিট দশেক সময় নিল।

নেপলাকে বললাম জলের বোতল কিনে নে।

কেন? অনিকা আমার মুখের দিকে তাকাল।

তুই তো আবার ওই বোতলের জল খাবি না।

আমার লাগবে না।

ততক্ষণে নেপলা নেমে গেছে। দুটো জলের বোতল নিয়ে এলো।

নেপলা।

বলো।

আমি এবার শুলাম, রানাঘাট এলে ডাকবি একটু চা খাব।

আচ্ছা।

আমি জুতো খুলে প্যান্টের কোমড়টা ঢিলে করে। অনিকার কোলে শুয়ে পড়লাম।

নেপলা গাড়ি ছোটাল হু হু করে।

আমি অনিকার কোলে মুখ গুঁজে ওর কোমরটা জড়িয়ে ধরলাম।

অনিমামা।

বল।

তোমার মাথায় কোথায় কেটেছিল।

পেছনে হাত দে বুঝতে পারবি। নেপলা বললো।

মাথাটা একটু টেপ। গত সাতদিন আমার মাথাটাকে একবারে ছাতু করে দিয়েছিস।

অনিকা চুপ করে রইলো। ওর হাতের নরম আঙুল আমার মাথার কাটা জায়গা খুঁজে বেরাচ্ছে।

আমার চোখে তখন রাজ্যের ঘুম। ওরা কথা বলছে নিজেদের মধ্যে, আমি কখন ঘুমিয়ে পরেছি জানি না। হঠাৎ অনিকার মৃদু কণ্ঠস্বরে ঘুমটা ভাঙলো, তবু চোখ থেকে ঘুম যাচ্ছে না। কেমন যেন চোখটা জ্বালা জ্বালা করছে। একটু তাকিয়েই আবার চোখ বন্ধ করলাম।

অনিমামা, অনিমামা।

উঁ।

ওঠো।

নেপলাকে বল কড়া করে চা আনতে।

আমরা এসেগেছি।

দূর পাগলী, খালি ভ্যাড় ভ্যাড় করে, নেপলাকে বল একটু চা আনতে। চা আনলে ডাকিস, আমি আর একটু ঘুমই।

আমি একটু নড়া চড়া করে ওকে আরও জোরে চেপে ধরলাম।

মাথাটা টেপ।

আমরা এসে গেছি।

খালি এসে গেছি, এসে গেছি করে। নেপলা। চেঁচিয়ে উঠলাম।

বলো। নেপলাও চেঁচালো।

একটা মৃদু হাসির শব্দ কানে ভেসে এলো। আমি চোখ বন্ধ করে আছি। চাপা ফিস ফিসানি।

কি বলছি শুনতে পাচ্ছিস না।

উঠে পরো, ঘরে এসে চা খাবে।

এ্যাঁ।

পৌঁছেগেছি। এটা রানাঘাট নয়। ট্র্যাঙ্গুলার পার্ক।

অনিকার কোল থেকে মুখ তুললাম। আমার পায়ে কে যেন সুরসুরি দিল।

কে রে?

ওঠ ওঠ আর ঘুমতে হবে না, রাজ্য জয় করে ফিরলি, চারদিকটা একটু চেয়ে দেখ। মিত্রার গলা।

আমি এবার চোখ খুললাম।

গাড়ির দুটো দরজাই হাট হয়ে খোলা। চারদিকে লোক। আমার পায়ের গেটে মিত্রারা সকলে দাঁড়িয়ে হাসাহাসি করছে। বনি, নাগেশও আছে। মেয়েও দেখছি কম যায় না।

সবার চোখ অনিকার ওপর। মাথার দিকে তাকাতে দেখলাম ছোটোমা, অনিকার গলা জড়িয়ে রয়েছে। বড়োমা ঠিক তার পেছনে। জ্যেঠিমনি, দামিনীমাসি আমার দিকে তাকিয়ে। চোখে হাসি।

তোর প্যান্ট খোলা। মিত্রা চেঁচিয়ে উঠলো।

তোর কিরে—

খেঁচাচ্ছিস কেন?

মিত্রার দিকে কট কট করে তাকালাম।

তাকিয়ে লাভ নেই। দু-দিনে তৈরি করে দেব। আমরা এখন মেজরিটি।

সবাই হাসছে।

বড়োমার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললাম। অনিকার দিকে তাকালাম।

চিনতে পেরেছিস। বহুবার তোর সঙ্গে গল্প করেছি।

অনিকা মাথা নিচু করে নিল।

তারাতারি নাম, বিকেলে নেমন্তন্ন আছে।

তুই আগে প্যান্টের চেন লাগা।

মিত্রার কথায় অনিকা হেসে ফেললো। ওরা সকলেই আমার এই অবস্থা দেখে নিজেরা হাসাহাসি করছে, কথা বলাবলি করছে।

আমি মিত্রার দিকে তাকালাম।

বড়োমা আছে তাই কিছু বললাম না।

কেন ছোটোমা নেই—

অনিকা হাসছে। ওর দিকে তাকালাম।

তাকিয়ে লাভ নেই, সব ঘেঁটে গোবর বানিয়ে দিয়েছি। মিত্রা চেঁচাল।

আমি উঠে বসলাম।

এই আমার ব্যাগ কোথায়? অনিকার দিকে তাকালাম।

ওটা তোমার ব্যাগ নয়, আমার ঘণ্টা আর পক্কের।

তোকে কে বলেছে?

অনিকা হাসছে।

নাম নাম—

ছোটোমা আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

যে ভয়টা সকালে পেয়েছিলে সেটা এ নয়।

ছোটোমা কোনও কথা বললো না। মুখ নিচু করে শুধু হাসলো।

অনিকা ছোটোমার হাত ধরে নামলো। আমি পেছন পেছন।

বড়োমা জড়িয়ে ধরলো আমাকে।

ওর জন্য তুই সাতদিন নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলি?

কে বললো তোমাকে!

অনিকা আমার হাত ধরে আছে।

ছোটো বললো।

দেখো সকাল থেকে অনেক খাটাখাটনি গেছে। মন মেজাজ ঠিক নেই। খিদেও লেগেছে, কানের কাছে একবারে ভ্যাড়ভ্যাড় করবে না।

আ মোলো, ধমকাচ্ছিস কেনো—

শুরু করে দিয়েছো কিন্তু।

অনিকা, ছোটোমা দুজনেই হেসে ফেললো।

বড়োমা এবার অনিকাকে জড়িয়ে ধরে গালে গাল ঘোষলো। আমার দিকে তাকিয়ে।

চাঁদপানা মুখটাকে আগে নিয়ে আসতে পারিস নি। বড়োমা বলে উঠলো।

অনিকা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

পেন্নাম করবি?

অনিকার মুখটা লালহয়ে গেল। মুখ নিচু করে হাসছে।

ওভাবে হবে না। কোমরে কাপরটা ভালো করে গিট্টু বেঁধে নে। না হলে খুলে যাবে।

ছোটোমা হাসলো।

অনিকা নিচু হয়ে বড়োমা, ছোটোমাকে প্রণাম করলো।

ছোটোমা আমার দিকে তাকিয়েছে।

সম্পত্তি বুঝিয়া পাইছো।

ছোটোমা আমাকে জড়িয়ে ধরে আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।

এই দেখো, আবার গড়বড়ি চালু। আমার কিন্তু প্যান্ট নষ্ট হয়ে যাবার সম্ভাবনা প্রবল।

ছোটোমা কাঁদতে কাঁদতে হেসে ফেললো।

বড়োমা আমার মুখটা চিপে ধরলো।

মুখটা একটু পরিষ্কার কর না। বড়োমা দাঁতে দাঁত চিপে কথা বললো।

ওভাবে হবে না বড়োমা, ব্লিচিং লাগবে। কনিষ্ক বারান্দা থেকে চেঁচাল।

ওপরের দিকে তাকাবার আগেই নীরু চেঁচালো।

অনি ফরসেপ দুটো নিচে আছে।

বাগানে অনেক মানুষের ভিড়। কমবেশি সকলেই পরিচিত। দূরে চেয়ারে দেখলাম চাঁদ, চিনা, রতন বসে। আবিদ, ইসলামভাইকে দেখতে পাচ্ছি না। তখন আমার খুব জোড় বাথরুম পেয়ে গেছে। দৌড় লাগালাম।

আমার দৌড় দেখে মাঠ ময় সকলে হাসছে।

ঘরে এসে দেখলাম খাটময় কোপর চোপর ছড়িয়ে আছে। আমার সেদিকে দেখার আর সময় নেই। বাথরুমে ঢুকলাম।

বাথরুম থেকে সাফ সুতরো হয়ে টাওয়েল পরে বেড়িয়ে এলাম।

তখনও দেখলাম ঘড় ফাঁকা।

আলমাড়ির কাছে গিয়ে মনে পরলো চাবি প্যান্টের পকেটে। আবার বাথরুমে ঢুকলাম। ভাগ্যিস জামা প্যান্ট জলে ভিঁজিয়ে দিই নি।

চাবি নিয়ে এসে আলমাড়ি খুললাম।

একটা পাজামা পাঞ্জাবী বার করলাম।

চলবে —————————



from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/okByj3x
via BanglaChoti

Comments