❝কাজলদীঘি❞
BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়
১৬৫ নং কিস্তি
—————————–
তনু, ইসি হেসে গড়া গড়ি খায়। মিত্রা আমার চোখে চোখ রেখে হাসছে। চোখের ভাষা, সত্যি তুই তোর ছেলে-ময়েগুলোকেও সেইরকম তৈরি করেছিসি।
চল খিদে পেয়েছে।
খেয়ে-দেয়ে আবার একটা ছক তৈরি করতে হবে, তাই না।
তনু কথাটা বলে আমার দিকে তাকাল।
মন ভালো হয়েছে।
সকালেই হয়েছে। বাকিটা তুমি শুনলে না।
শুনে নেব সেই তো এক ব্যাপার কিছু দিতে হবে, এই তো।
তনু মাথা নিচু করে নিল।
তোর পাঞ্জাবীটার কি হালরে। ইসি বললো।
সকালে নতুন বার করে দিয়েছি। তনু বললো।
আমি একবার তনুর দিকে তাকালাম। হাসলাম।
সবাই এই ঘরে এলাম। দেখলাম অনিমেষদা, বিধনদা, ডাক্তারদাদা, মল্লিকদা, দাদা খেতে বসেছে।
অনিমেষদা আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো। পাক্কা দুটো।
আমি রেডি তুমি এখুনি বসতে পারো।
খেয়ে নে।
আমি সোফায় বসলাম।
বড়োমা, বৌদি খেতে দিচ্ছে। ছোটোমাকে দেখতে পেলাম না। পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখলাম, জ্যেঠিমনি-আন্টি বড়োমার ঘরের খাটে পা ঝুলিয়ে বসে।
বড়োমা আমার দিকে তাকাল।
একটু দই খাবি?
দই খেলে ভাত খাব কখন!
তুই তো ভাতের পাতে খাস না।
ঠিক আছে আজ দিও।
দাদা খেতে খেতেই মুখ নিচু করে বললো, তুই আবার গণ্ডগোল পাকিয়েছিস।
আমি দাদার দিকে তাকালাম। ও তো সব সময় পেকে আছে।
অনিমেষদা চশমার ফাঁক দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
সুনীত ফোন করেছিল। প্রথমে মল্লিককে, পরে আমাকে।
আমি নির্বিকার।
কথাটা শুনে রান্নাঘরের সামনে থেকে মিত্রা, তনু, ইসি এগিয়ে এলো।
আমার চোখে মুখে না বোঝার ভান।
এগুলো মিত্রা জানে? দাদা আমার দিকে তাকিয়ে।
তুমি কি বলছো আমার মাথায় ঢুকছে না।
মল্লিক ওর মাথায় ঢুকিয়ে দে।
মল্লিকদা হাসছে।
তা হঠাৎ এতদিন বাদে সুনীতদার তোমাকে মনে পড়ে গেল?
কি করবে, বিপদে পড়ে গেছে।
তুমি কি ওকে বিপদ থেকে উদ্ধার করবে?
আমি কেন করবো! তুই করবি—
আমি ভগবান নই। ওকে মন্দির-টন্দির যেতে বলো।
একটু কম সম নিয়ে ছেড়ে দে। ও দেবে বলেছে।
যে টুকু কম পড়বে তুমি দিয়ে দেবে।
আমি কেন দেব!
তাহলে সুনীতদার হয়ে বলছো কেন।
দাদা হেসে ফেললো।
তুই একবারে গলা পর্যন্ত চালিয়ে দিয়েছিস। একটু নিঃশ্বাস নিতে দে।
তোমারও গলা পর্যন্ত চালিয়ে দিয়েছিল। নিঃশ্বাস নিতে পেরেছিলে।
বড়োমা আমার মুখের দিকে তাকাল।
অক্সিজেন সিলিন্ডারও হাতের কাছে ছিল না। ভুলে গেলে সেই সব দিনের কথা।
এই কথাগুলো শোনার জন্য এতক্ষণ ছটফট করছিলে। হয়েছে এবার। মল্লিকদা খিঁচিয়ে উঠলো।
দাদা হাসছে। তুই রাগ করছিস কেন। ও এরকম বলে দেখবি কাজটা করে দেবে।
আমার দিকে তাকাল।
দেখছিস, আজকাল মল্লিকও আমাকে ধমকাচ্ছে।
আবার খেতে শুরু করলো।
সবাই আমার দিকে তির্যক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। বিধানদা, অনিমেষদা হাসছে।
ওদের একটু কম্প্রমাইজ করতে বলে দে। ওরও বয়স হয়েছে। তুই বললে, সব ঠিক হয়ে যাবে। কেউ আর ঝামেলা করবে না।
দাদা এমনভাবে কথাটা বললো, সবাই হেসে ফেললো।
বড়োমা দেখলাম আজ চুপচাপ, কোনও কথা বললো না।
তুমি এমনভাবে বললে, জিনিষটা যেন আমার।
দাদা খাওয়ার থালা থেকে মুখ তুললো। হাসি হাসি মুখে আমার দিকে তাকাল। ব্যাপারটা এরকম, এবার আমি শুরু করছি।
সত্যিই তোর কিছুই নেই!
আমি দাদার দিকে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে।
মেয়েটা একসময় খাতা কলমে তোর ছিল, এখন কানাঘুষো শুনছি সেটাও তোর নয়। কিন্তু দিব্যি তোর পেছন পেছন ঘুরছে। কেউ কিছু তোর নামে বললে, মুখটা ভাড়ি হয়ে যায়, চোখ দুটো ছলছল করে। কোনটা আসল, কোনটা নকল বোঝা মুস্কিল।
কাল রাতে প্রবীরকে অনুপকে কি বললি কে জানে, সেই থেকে অনিমেষ, বিধানবাবু, আর যারা সাঙ্গো-পাঙ্গো সব দৌড়ো দৌড়ি করছে…, দূর সেগুলো বাদই দিয়ে দিলাম, তোর জন্য কয়েকদিন ধরে যারা চরকি নাচন নেচে নিল, মুহূর্তে মুহূর্তে মত পরিবর্তন করে একটা সিদ্ধান্তে এলো, বল সেটাও তোর নয়।
সবাই চুপ, দাদা থেমে থেমে কথা বলে চলেছে।
আমি তোর বড়োমা, ছোটো, মল্লিক লাইন দিয়ে একটার পর একটা ধরে ধরে উইথ ডেফিনেসন সব নাম বলে যাব, কেউ তোর নয়, তহলে সবাই তোকে নিয়ে এতো মাতামাতি করছে কেন। আমাকে একটু বুঝিয়ে বল।
মিত্রা তনু আমার দুই পাশে এসে বসেছে, মুখ নিচু করে ফিক ফিক করে হাসছে।
দাদা মুখে খাবার তুললো। বড়োমা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ইশারায় জিজ্ঞাসা করলো কিছু লাগবে। দাদা ইশারা করেই ঘার দোলাল, এখন না। বড়োমা চলে গেল।
বেশি কিছু বললে হুমকি ঝাড়িস, রইলো ঝোলা চললো ভোলা। গিয়েছিলি, আবার ফিরে এলি। কেন কি বৃতান্ত এখানে আলোচনা করা বৃথা। কারন সেটা তোর নয়।
দেখলাম জ্যেঠিমনি, আন্টি বড়োমার ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে খাবার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে পরলো। আমার দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসছে।
যতদিন ছিলি না, তোর আশে পাশে যারা আছে কেউ মাথার দিব্যি দিয়ে বলতে পারেনি তুই ছিলি না। প্রতিটি পদে পদে তুই সকলকে বুঝিয়ে দিয়েছিস আমি স্ব-শরীরে আছি, থাকবো। যদিও তোর কিছুই নেই।
তোর যদি কিছুই না হয়, ছেলেগুলো ওকে ওই বিদেশ থেকে ধমকাবেই বা কেন, আর সুনীত আমার কাছে ফোনে মরা কান্না কাঁদবেই বা কেন।
ছোটো আমাকে দুটি ভাত দিও।
ছোটোমা দাদার দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসলো।
এই কয়েক ঘণ্টা আগের ঘটনা। বাচ্চা মেয়ে প্রজাপতির মতো এই বাড়ির আনাচে কানাচে ফুরুত ফুরুত করে উড়ছিল। সবে মাত্র কাল এসেছে, দঙ্গলের মধ্যে রয়েছে, আমাকে কেউ কিছু বলে না, যা খবর পাই মাঝে মাঝে উড়ে আসে, খবর নিয়ে জানলাম ও সোনার নাতনি। শুনলাম পিকুকে বিয়ে করেছে, দু-একবার কথা বললাম, নরম-সরম মেয়ে খারপ লাগলো না।
বাপটা কি করেছে না করেছে জানার দরকার নেই, যাহান্নামে যাক, ফাঁক পেয়ে সোনা একটু আধটু ফিসফাস করলো, ডাক্তার তো মুখে কুলুপ এঁটেছে, বেশি কিছু জিজ্ঞাসা করতে গেলে চোখ বড়ো বড়ো করে। সেই মেয়েটা তোর ঘরে মিনিট পনেরোর মতো ছিল, কি ফুস মন্ত্রণা দিলি, কেঁচো হয়ে গেল ফনা তোলা বিষধর সাপ।
সকলে হে হে করে হেসে উঠলো।
কি তার তেজ, কি তার ফোঁস ফোঁসানি, কি তার দাপা দাপি, মাঠে বসে বসে আমি, অনিমেষ, বিধানবাবু সারাটাক্ষণ তার দাপাদাপি দেখলাম, ওটাও তোর নয়।
বয়স হয়েছে, অনেক কিছুই বুঝি না। স্মৃতি শক্তিতেও মরচে পড়েছে। সব কথা মনেও রাখতে পারি না সেই ভাবে। সব কেমন যেন গোলমাল হয়ে যায়। ডাক্তারও একসময় উঠে পড়ে লেগেছিল, হালে পানি না পেয়ে এখন হাল ছেড়ে দিয়েছে।
ও ডাক্তার তো আবার তোর কেউ হয় না। তবু খুঁজেপেতে সোনালিকে ধরে আনলি। কাক পক্ষী কেউ টের পেল না। পরে শুনলাম ডাক্তার নাকি সব জানত। একটু আধটু কথাবার্তাও হতো। আমাকে একটু বুঝিয়ে দে কোনটা তোর কোনটা আমাদের।
কেউ আর গম্ভীর হয়ে নেই সকলেই মুচকি মুচকি হাসছে।
ও হ্যাঁ ভুলে গেছিলাম, তোর জ্ঞাতার্থে জানাই, অনিমেষ-সুতপা এখন পাকাপাকি ভাবে ডাক্তারের বাড়িতে থাকছে, তবে ডাক্তার বলেছে ভাড়া নিতে পারবে না, ফাউ হিসাবে বিধানবাবুকে ধরে নিয়ে এসেছি, বেচারা এই বুড়ো বয়সে একা একা থাকে, ঠিক সহ্য হচ্ছিল না, যদিও এটা তোর নয়।
ছোটোমা রান্নঘর থেকে ভাত এনে দাদার পাতে দিল।
বিধানবাবু আসতে চাননি। তুই বলেছিস নাকি দোকা ছাড়া থাকা যাবে না।
ঘরের সকলে হো হো করে হসে উঠলো।
জোর করে নিয়ে এসেছি। যেহেতু তোর জিনিষ নয়, তোর মতি গতিও মাঝে মাঝে ভালো ঠেকে না, কোনদিন হয়তো বলে বসলি বিধানদা কাল থেকে এখানে থাকতে কোনও আপত্তি আছে, তাই আগেভাগে নিয়ে এলাম।
বিধানদা, অনিমেষদা আরও জোড়ে হেসে উঠলো।
কিগো অনিমেষ হাসলে যে আমি কি ভুল বললাম।
অনিমেষদা মাথা দোলাচ্ছে। আর সবাই নির্বাক শ্রোতা।
আচ্ছা আমাকে একটা ব্যাপার একটু ব্যাখ্যা করে বলতে পারবি, ধরে নিচ্ছি অনিমেষ তোকে অনেক কম বয়স থেকে দেখছে, অনেক কম বয়েস থেকে ওই পরিবারে তোর যাতায়াত। তোর প্রতি ওদের একটা মায়া-মমতা, স্নেহ-ভালবাসা জম্মাতেই পারে।
বিধানবাবু তোকে বেশিদিন দেখেনি, প্রবীর, রূপায়ণ, অনুপ একই পর্যায়ে, সবার সঙ্গেই তোর একটা চোরা টাসেল আছে, যতটুকু বুঝি কেউ কারুর জমি বিনা যুদ্ধে এক ফোঁটা ছেড়ে দেয় না, তবু ওরা তোর প্রেমে পড়ে গেল কি করে? শুধু কি স্বার্থ? বল এটাও তোর নয়।
আস্তে আস্তে ভিড় বারছে। সকলে বেশ দাদার কথা শুনে মিটি মিটি হাসছে। দাদা বেশ রসিয়ে রসিয়ে কথা বলছে। বড়োমা, ছোটোমা, দামিনীমাসি একবার করে আমার দিকে তাকায়, মুচকি হাসে, আবার মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
আমি দাদার মুখের দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছি।
আজকে খুব ভাল ব্যাট করছো মনে হচ্ছে।
তা বলতে পারিস। আজ আমি ডন ব্র্যাডম্যান প্রত্যেকটা বোলারকে নির্দয় ভাবে মাঠের বাইরে আছড়ে ফেলে দিতে পারি।
গুছিয়ে লিখে ফেলো এডিট করে ছাপিয়ে দেব।
এটা তোর দ্বারা হবে না। তোর নয় তো।
সবাই আবার উচ্চস্বরে হেসে উঠলো।
দাদার চোখে-মুখে অদ্ভূত একটা প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়েছে। সর্বপরি পরিতৃপ্ত মানুষ। প্রত্যেকটা শব্দের মধ্যে স্নেহ চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঝরে পড়ছে। অনেকদিন পর দাদাকে এত সুন্দর মুডে দেখতে পাচ্ছি। এ ঘরের সবাই সেটা অনুভবও করছে। তাই কেউ দাদার কথার মাঝখানে কথা বলছে না।
জানিস অনি তোকেও আমি নাই নাই করে তিরিশ বছর দেখছি। মাঝের কুড়িটা বছর তুই ছিলি না, তবে প্রতিটা মুহূর্ত তোর উপস্থিতি গভীর ভাবে অনুভব করেছি।
তোর বড়োমা আমার সঙ্গে সুখে-দুঃখে প্রায় পঞ্চাশ বছর হতে চললো আছে। যেদিন তোর বড়োমাকে নিয়ে প্রথম রাতটা কাটালাম, সেদিন তোর বড়োমার চোখে মুখে যে ঝক ঝকে ভাবটা দেখেছিলাম, তার থেকে কাল রাতে তোর বড়োমার চোখমুখ হাজার গুণ বেশি ঝকঝকে ছিল।
সারাটা ঘর নিস্তব্ধ, কেউ একফোঁটাও হোসলো না।
সারা জীবন মুখে রক্ত তুলে প্রাণপাত করেও আমি তোর বড়োমার এইরকম ঝকঝকে মুখ একদিনের জন্যও দেখতে পাইনি। মল্লিকের অবস্থা, অনিমেষের অবস্থা আমার থেকে কম এটা হলফ করে বলতে পারব না।
বলতে পারিস জীবনে দ্বিতীয়বার চাকরিতে জয়েন করার দিনটাও কাল রাতের ওই কয়েক ঘণ্টার কাছে ম্লান হয়ে গেছে। এই শেষ বয়সে এসে, কাল অনেক কিছু শিখলাম তোর কাছ থেকে। শুধু আমি বললে ভুল হবে, আমার মতো সব বুড়ো-বুড়ীরা।
তুই তোর মতো সার্ভিস দিয়েছিস, তার আড়ালে প্রতিটা মুখের অভিব্যাক্তি তুই নিত্তি দিয়ে মেপে নিয়েছিস। তোর সাধনা বিফলে গেল কিনা।
সারা জীবন লড়াই করে শেষ বয়সে এসে একটু সুখ-টুখ উপভোগ করছি। আমি একা বললে ভুল হবে। কম বেশি আমি এবং আমার আশেপাশে যারা আছে সকলে। এটাও তুই এক নিমেষে ফুৎকারে উড়িয়ে দিবি, বলে দিবি তোর নয়। তোর জন্য নয়।
তুমি থামবে।
তুই থামতে বললে থামবো। না হলে আরও ঘণ্টা খানেক চালিয়ে যেতে পারি।
বহুত স্টক করেছো মনে হচ্ছে।
হ্যাঁ, তোর কথা মতো প্রথমে কিনলাম, এবার বেচতে বসেছি।
বেচবে যে, কেনার লোক আছে।
এই যে যারা ঘিরে দাঁড়িয়ে কথা শুনছে, এরা কারা।
সব ফোঁকটসে, ফুটো কানাকড়ি মিলব না।
তাহলে আবার শুরু করি।
না।
ঘড় ভর্তি সবাই জোড়ে হেসে উঠলো।
মিত্রা-তনু চোখ দিয়ে আমাকে শাসন করছে।
বড়োমা খেতে দেবে, না আমি….।
এই আবার শুরু করলি।
দাদার কথায় আবার সকলে হেসে উঠলো।
বাবাঃ এই ঘরে দেখছি আর দাঁড়াবার জায়গা নেই।
রতনের গলা পেলাম। পেছনে নেপলা, আবিদ।
ছোটোমা হাঁড়িগুলো ধরো হাত ব্যাথা হয়ে যাচ্ছে। নেপলা বলে উঠলো।
কে রে নেপলা? ডাক্তারদাদা পেছন ফিরে তাকাল।
হ্যাঁ।
কি আনলি?
রসগোল্লা, আর দই।
ডাক্তারদাদা বড়োমার দিকে তাকাল। একটু দাও। টাটকা জিনিষ খেয়ে মুখটা পরিষ্কার করি।
যা খেলে সব কি বাসি। বড়োমার চোখেমুখে স্নেহের শাসন।
তা নয়। এটা সদ্য আনল কিনা।
বড়োমা মুখ টিপে হাসছে।
তাছাড়া এডিটর অনেক দিন পর বেশ ভালো ওপেন করলো, আমি রানার। সেই অনারে…।
বড়োমা, বৌদির দিকে তাকাল।
সুতপা বসি তাহলে। ডাক্তারদাদা বললো।
বৌদি ছোটোমা রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।
আমার কথাটা তাহলে একটু কষ্ট-শিষ্ট করে রাখিস। যদিও তোর নয়….।
আবার সকলে দাদার কথায় একচোট হেসে উঠলো।
আস্তে আস্তে ঘরের ভিড়টা ধীরে ধীরে সারা বাড়িতে ছড়িয়ে পড়লো।
আমি সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালাম।
দুপুরের খাওয়া দাওয়া বেশ হই হই করে হলো। অনিকার পেছনে চূড়ান্ত লাগল পক্কে আর ঘণ্টা। আজ আমাকে কেউ কিছু বলতেই দিল না। পিকু-নম্রতা এখনও ফেরেনি। বড়োমারা ওদের জন্য অপেক্ষা করলো।
আমি বাইরের বাগানে এলাম। নেপলা, রতন, আবিদ সঙ্গে এলো।
নেপলা একটা সিগারেট আমার হাতে দিল।
তোর কাজ শেষ করলি।
করেছি। তোমার পাসপোর্টটা দিও ঠিক করতে হবে।
হ্যাঁ। মনে করে নিয়ে যাস।
ওখানকার এ্যাকাউন্টটা কি করবে।
এখন থাক। কিছু টাকা জমা দিয়ে দিস। চালু থাকবে।
আচ্ছা।
ঘর দেখলি?
সবে মাত্র ভিঁত হচ্ছে।
কোথায়?
সর্বেশ্বরজ্যেঠুর দুটো বাড়ি আগে। প্রমোটার আবার চাঁদের পরিচিত। রতনদাকে চেনে। মাঝে মাঝে রতনদার কাছ থেকে টাকা নিয়ে যায়।
কেমন দেখলি?
অফিস পার্পাসে খারপ হবে না। আর একটা এ্যাডভান্টেজ পদুদাকে পাবো।
পয়সা গড়ি কি চাইছে?
রতনদাকে বললো যেটা খরচ লাগে সেটা দিলেই চলবে।
ব্যাটা বহুত চালাক।
রতন হাসছে।
তোর পছন্দ?
আমার পছন্দ, আবিদের পছন্দ নয়। রতন বললো।
কেন!
পাড়ার মধ্যে অফিস।
দূর ব্যাটা, এখন কাজ চালা না। যখন অনেক পয়সা হয়ে যাবে, তখন অফিস পাড়ায় বেশি পয়সা দিয়ে নিয়ে নিবি।
আমি আবিদদাকে তাই বললাম। নেপলা বললো।
কতটা দিতে পারবে?
আমি হাজার স্কয়ার ফিট চেয়েছি। রতন বললো।
কোন ফ্লোর?
ফার্স্টফ্লোরে হবে না। সেকেন্ড ফ্লোরে হবে।
গাড়ি রাখার জায়গা।
আছে। তবে রাস্তায় থাকলেও অসুবিধে নেই।
এমনি কতো স্কয়ার ফিট বেরচ্ছে প্রত্যেকটা ফ্লোরে।
বারশো তেরশো মতন।
কতদিনে রেডি করে দেবে বলছে।
মাস ছয়েক সময় চাইছে।
কিরে আবিদ তোর মনের কথা বল।
ডবল ইনভেস্টমেন্ট।
পরে যখন জায়গা লাগবে তখন কি করবি। তারপর দেখ অফিস পারার ইনভেস্টমেন্ট আর এখানকার ইনভেস্টমেন্ট অনেক পার্থক্য। যাক নিজেরা ঠিক কর।
রতন। রতনের দিকে তাকালাম।
সুনীতদা দাদাকে ফোন করেছিল।
নেপলা হেসে উঠলো।
তুই হাসিস না নেপলা। তোর আর আবিদের জন্য এটা হলো।
আবিদ দেখলাম মুচকি মুচকি হাসছে।
কি হয়েছে কি ব্যপারটা বল।
সকাল বেলা তোমার কাছ থেকে বেরিয়ে চাঁদ বললো, অনিদা তোকে কি কাজ দিয়েছে রতনদা সত্যি করে বল। না হলে আমি কিন্তু পুরো ব্যাপারটা গজব করে দেব।
আমি ব্যাপারটা নেপলা, আবিদের সঙ্গে আলোচনা করেছিলাম।
ওরা চাঁদকে বললো ব্যাপারটা এই।
চাঁদ, ওমর, চিনা তিনজনেই খেপে গেল। বললো দাদা আমাদের কাজ দেবে, টাকা জোগাড় করে দবে, আবার টেনসন নেবে, কেন? এটা কি ওদের জিনিস, দাদা তার হকের জিনিস চেয়েছে দেবে না কেন, দাদা টাকাটা নিজের ভোগে লাগাচ্ছে না। আমরা যাতে ঠিক মতো কাজ করতে পারি তার জন্য দাদা ব্যবস্থা করছে, আর ওরা ঘুঁটি বসাবে, মানবো না।
তিনজনে একচোট আমাকে ঝেড়ে নিল। আবিদ, নেপলা পিন করলো।
ব্যাশ যাবে কোথায়, চাঁদ সঙ্গে সঙ্গে অবতারকে ফোন করে সব জনাল।
অবতার, সাগির সব শুনে খেপে লাল। বললো আমরা যাচ্ছি তোদের চিন্তা করতে হবে না।
রতনদাকে দে। ওরাও আমাকে কিছুক্ষণ ওরাল। তারপর যা হয়।
সুনীতদাকে মনে হয় অবতার ফোন করেছিল, বলেছে কাল সকালের মধ্যে টাকা যেন পৌঁছে যায়। ভাইঝিরা কাল দুপুরের ফ্লাইটে উঠছে। আমি ওদের হাতে রাতে খবরটা পেতে চাই।
সুনীতদা তোকে ফোন করেছিল।
আমাকে বললো তুই কুড়ির মধ্যে একটু রফা কর। এর বেশি পারবো না।
চাঁদ কোথায়।
চাঁদ, ওমর, চিনা বারাসতে গেছে। জোড় করে আমার কাছ থেকে দলিল নিয়ে গেছে।
সাগরের বাকি টাকা।
দিয়ে দিয়েছে। দাদাভাই-এর হাতে দিয়েছি। ও পিট দলিলটা চাইছিল।
দেখিয়েছিস?
হ্যাঁ।
হিমাংশুকে দিয়ে ট্রান্সফারের ব্যবস্থা কর। হিমাংশুর খরচ ওখান থেকে দিয়ে দিবি।
ম্যাডামের সই লাগবে।
করিয়ে নিবি। আমি পর্শু একটু বাইরে যাব তিন চারদিনের জন্য।
আমরাও পর্শু ওখানে যাব ঠিক করেছি। তুমি যাবে তোমার সঙ্গে কে যাবে।
কাউকে যেতে হবে না।
তোমাকে একা ছাড়া যাবে না। আমি আবিদ তোমার সঙ্গে যাব বলেছিলাম।
সবাই চলে গেলে এদিকটা সামলাবে কে?
তুমি এখন এসব নিয়ে আর ভাববে না।
এক কাজ কর না।
বলো।
পর্শু না গিয়ে দু-দিন পর যা। আমিও ওখানে চলে আসতে পারবো।
ঠিক আছে আমি দাদাভাই-এর সঙ্গে বসে প্রোগ্রাম ঠিক করে নিচ্ছি।
কিরে তোর এখনো দুটো বাজেনি।
অনুপদার গলার স্বরে ফিরে তাকালাম।
দেখলাম বাগানের অপর প্রান্তে অনুপদা, রূপায়ণদা সঙ্গে দু-জন অপরিচিত ব্যক্তি।
আজ আর তোদের সঙ্গে বসা হবে না। রতনের দিকে ফিরে তাকালাম।
রতন হাসলো, যাও এবার যুদ্ধে বসে পরো। ওই নতুন দু-টোর মধ্যে একটা কিন্তু বহুত হারামী।
কেনো রে!
শালা শ্রমিক সংগঠনের নেতা। রাজ্য কমিটিতে আছে। বহুত ধান্দাবাজ, যেখানে যা হবে প্রথমেই ঝাণ্ডা পোঁতার ব্যবস্থা করবে। তরপরে প্রচুর প্রমোটার সঙ্গে আছে। সাগরের বড়ো খুঁটি।
তোদের চেনে?
চিনবে না মানে। ওর জন্য চাঁদ ঝুলে আছে।
ঠিক আছে।
আমি পায়ে পায়ে অনুপদাদের কাছে এগিয়ে এলাম।
তোমাদের খাওয়া হয়ে গেছে।
অনেকক্ষণ।
প্রবীরদা এলো না?
ঘণ্টা খানেক বাদে আসছে।
প্রবীরদা প্রথম থেকে থাকবে না, কিছু ভাববে না?
কেন ভাববে। ওর কিছু অজানা আছে নাকি। না তোকে চেনে না। তাছাড়া ফাইলগুলো রেডি করতে হবে। অন্য ডিপার্টমেন্টের এ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসারদের নিয়ে আসতে হবে।
আমি অনুপদার দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
বারান্দায় উঠতেই দেখলাম মিত্রা ওই ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
আমাকে দেখে মুচকি হাসলো।
আজ জবাই করবো বুঝলি। অনুপদা মিত্রার দিকে তাকিয়ে বললো।
একবার অনিসা, অনিকাকে পাঠিয়ে দে।
ওরা কি করবে! অনুপদা আমার দিকে তাকাল।
দরকার আছে।
কথা বলতে বলতে আমার ঘরে চলে এলাম। দেখলাম দাদা, মল্লিকদা, ডাক্তারদাদা, অনিমেষদা, বিধানদা বসে আছে। ঘরে আরও বেশ কিছু চেয়ার রয়েছে। নতুন অতিথিরা চেয়ারে বসলো।
আমি খাটে বসলাম। আমার দু-পাশে রূপায়ণদা, অনুপদা।
কোথায় পেলে ওকে। অনিমেষদা রূপায়নদার দিকে তাকাল।
ওই কর্নারে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল।
দাদার কথাটা তাহলে রাখলি।
হাসলাম।
ওদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছো। বিধানদা, রূপায়নদাকে বললো।
ডাকা মাত্রই গট গট করে চলে এলো।
বুঝলি অনি উনি হচ্ছেন কেষ্ট মিত্র। আমাদের শ্রমিক সংগঠনটা দেখেন। অনিমেষদা বললো।
আমি উঠে ওনাকে প্রণাম করতে গেলাম। উনি আমার হাতটা ধরে ফেললেন।
তোমাকে তুমি করে বলবো। আমার থেকে বয়সে অনেক ছোটো।
দূর তুমিও আছো কেষ্ট। ওর যখন গোঁফদাড়ি বেরয়নি তখন থেকে অনিমেষ ওকে দেখছে। ও তখন সুরোর মাস্টার। বিধানদা বললেন।
ওর নাম শুনেছি, চাক্ষুষ এই প্রথম দেখলাম। কেষ্টদা বললেন।
আমাদের পার্টির অনেক লিডারই ওকে দেখেনি।
অনিকা, অনিসা বেশ মোটা মোটা চারটে ফাইল নিয়ে ঘরে ঢুকলো।
দু-জনেই সবার দিকে তাকিয়ে ফিক ফিক করে হাসছে।
কিরে এগুলো কি! অনুপদা দু-জনের দিকে তাকাল।
দেখতে পাচ্ছ না ফাইল। অনিসা কট কট করে উঠলো।
বাবা টেবিলে রাখি।
রাখ। খাটে উঠে বোস।
আবার নিচে নেমে ফাইল গুলো নিয়ে আসতে হবে।
তাহলে সঙ্গে নিয়ে বোস। পক্কে, ঘণ্টা, সুন্দর গেল কোথায়?
ল্যাপটপটা রেডি করে নিয়ে আসছে।
নেটের চিপটা নিয়ে আসতে বলেছিস?
হ্যাঁ।
তোর ব্যাপার স্যাপার কি বলতো? একবারে সৈন্য সামন্ত রেডি করে বসছিস। অনুপদা বললো।
তোমাদেরও তো সৈন্য সামন্ত আনতে বলেছি।
আমিনদা এরা হচ্ছে অনির মেয়ে এবার ছেলেদের দেখতে পাবে। তোমাকে গল্প বলেছি।
অনুপদা বললো।
রূপায়ণদা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।
বুঝলি অনি আমিন সাহেব আমাদের পার্টিগত ভাবে ইন্ডাস্ট্রি সেলটা দেখেন। আমি আবার খাট থেকে উঠে দাঁড়ালাম। আমিনসাহেবও আমার হাতটা চেপে ধরলেন।
ঘণ্টা, পক্কে, সুন্দর ঢুকলো। ল্যাপটপ, প্রিন্টার নিয়ে। যেভাবে ওদের প্রিপারেসন নিতে বলেছিলাম ঠিক সেইভাবে ওরা প্রিপারেসন নিয়েছে।
সবার সঙ্গে সবার পরিচয় হলো। ওরা পায়ে হাত দিয়ে সকলকে প্রণাম করলো।
বৌদি এলো। সবাইকে দেখে হাসছে।
কিরে, তোরা সব এই ঘরে ঢুকে পরলি?
বাবা ডাকলো। অনিসা বললো।
সুন্দররা কিন্তু তাদের নিজেদের কাজ শুরু করে দিয়েছে।
তুই একটা এক্সক্লুসিভ খেলা খেলে দিলি। এই ব্যাপারটা একবারে এক্সপেক্ট করিনি। বিশ্বাস কর। রূপায়ণদা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।
কি হলো রূপায়ণ! বৌদি তাকাল।
অনিমেষদা, বিধানদা ঘরের সবাই অবাক। রূপায়ণদার মুখের দিকে তাকিয়ে।
আপনারা কেউ কিছু ধরতে পারছেন না?
অনিমেষদার চোখে অবিশ্বাসের ছোঁয়া।
সামন্তদা আপনি?
এতটা তলিয়ে দেখিনি।
ওই মোটা মোটা ফাইলগুলো দেখেছেন।
সে তো দেখতেই পাচ্ছি। অনিমেষদা বললো।
এই প্রজেক্টের সঙ্গে অনি ইনভলভ নেই। এরা পাঁচজন এই প্রজেক্টের সঙ্গে ইনভলভ। ও এই প্রজেক্টের সূত্রধর। আপনাদের যাবতীয় কথা বার্তা ওদের সঙ্গে বলতে হবে। ও শুধু বসে বসে মজা দেখবে।
ওদের সঙ্গে কি কথা বলবো! অনিমেষদা বললো।
বলতে আপনাকে হবে। ভাববেন না এরা এলেবেলে। ভালোকরে হোমওয়ার্ক করে এখানে বসছে। সেই ভাবেই এরা নিস্তব্ধে এই কদিনে তৈরি হয়েছে। এমনি এমনি আফতাবভাই অনিকা, অনিসার সঙ্গে রেগুলার ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলে। আপনার কাছে যা ডেটা আছে, তার থেকে ওদের কাছে অনেক বেশি আছে।
তোমার শরীর ঠিক আছে? অনিমেষদা বললো।
আমি ঠিক আছি। এরা আপনাদের শরীর খারাপ করে দেবে।
বৌদি অনিকার দিকে তাকাচ্ছে।
নাগো কুট্টিদিদা রূপায়ণমামা ওরকম বলে।
সেদিন ঘরে ঢুকেছিলাম যদি একবার প্রিন্টআউটটা দেখে নিতাম। রূপায়ণদা মাথা দোলাচ্ছে।
দেখতেই পারতে। অনিসা বললো।
তুই তো বললি শুভর প্র্যাক্টিকাল খাতা বানাচ্ছি।
তোমায় মিথ্যে কথা বলিনি।
ও কোথায়?
বিকেলের মিটিং এ্যাটেন্ড করবে।
রূপায়ণদা আমার দিকে তাকাল।
তোর যেখানে দুর্বলতা এদের এখনও সেই জায়গায় দুর্বলতা তৈরি হয়নি। এরা এক বিন্দু জমি ছেড়ে দেবে না। তাতে প্রজেক্ট হলে ভালো, না হলে অন্য জায়গা দেখবো।
না না তুমি এসব ভাবছো কেন। ওরা খুব লিবারাল। আমি বললাম।
অনি তুই বোঝাস না। এই সব বাচ্চা বাচ্চা ছেলে মেয়েকে আমাদের সামনে বসিয়ে তুই খেলা করছিস, এটা আমাকে বুঝে নিতে হবে।
মামা শুরু করে দিই।
অনিকার কথায় রূপায়ণদা হাসছে। অনিমেষদার দিকে তাকাল।
কি কিছু বুঝছেন।
শুনি ওরা কি আলোচনা করতে চায়। তারপর বলবো।
বৌদি দেখলাম একটা চেয়ারে বসে পরলো।
পক্কে আমার ফাইলটা দে।
পক্কে অনিকার সামনে ফাইলটা এগিয়ে দিল।
মামা আমরা কি এখন ভার্বাল ডিসকাসান করছি না অফিসিয়াল ডিসকাসান করছি।
সরকারী অফিসারদের সঙ্গে যখন ডিসকাসান করবে তখন ওরা যদি চান তাহলে অফিসিয়াল, না হলে পুরোটই ভার্বাল। তবে তোমরা পুরো মিটিংটাই নোট করবে। পড়ে যদি প্রজেক্টটা ম্যাচুয়র করে এই নোটিংটা কাজে লাগবে।
ড্যাড।
সুন্দরের দিকে তাকালাম।
পুরো ডিসকাসানটা পয়েন্ট ওয়াইজ নোট করি।
করে নাও।
পক্কে প্রিন্টার নিয়ে এসেছিস। অনিকা বললো।
হ্যাঁ।
দাদাই। অনিকা তাকাল অনিমেষদার দিকে।
মামা বললো এটা ভার্বাল ডিসকাসান তাই অফিসিয়াল ডেকোরাম এবং টার্ম এখানে ইউজ করছি না। তোমাদের সকলকে এতদিন যেভাবে যে নামে ডেকেছি সেইভাবেই ডাকছি। ওনাদের আজ প্রথম দেখলাম। দেখে মনে হচ্ছে তোমাদের কাছ কাছি বয়স তাই আমি ওনাদের দাদাই বলছি, তোমাদের কোনও অসুবিধে আছে।
অনিমেষদা হাসছে। তুই বল না শুনি।
আমরা এখানে যারা তোমাদের সঙ্গে কথা বলবো তারা প্রত্যেকেই এই প্রজেক্টের ওয়ান অফ দেম ডিরেক্টর।
দেখলাম অনিমেষদার চোখ ছোটো ছোটো হয়ে এলো। বিধানদার চোখে মুখে খুশীর ছোঁয়া, দাদা, মল্লিকদার চোখে মুখে জিজ্ঞাসা।
আমি তোমাদের সঙ্গে পেট্রক্যাম নিয়ে কথা বলবো। বোন কথা বলবে পাওয়ার স্টেসন নিয়ে। পক্কে-ঘণ্টা ইকো-ট্যুরিজম। সুন্দর তিনটে কোম্পানীর কো-অর্ডিনেটর। মামা আমাদের টোটাল বিজনেসের চিফ এ্যাডভাইসার। পরবর্তী সময়ে কান্ট্রি ম্যানেজার।
রূপায়ণদা, অনুপদা মুচকি মুচকি হাসছে।
পক্কে কোম্পানীর প্রোফাইলটা দাদাইদের হাতে দিয়ে দে।
আমি উঠে দাঁড়ালাম।
তুই কোথায় যাচ্ছিস? বিধানদা বলে উঠলো।
আমি ও ঘরে আছি। প্রয়োজন পরলে ওরা ডাকবে আমি চলে আসবো।
না তুই বোস।
আমার বসাটা ঠিক হবে না। তোমরা কথা বলো। আশারাখি অসুবিধে হবে না। ওরা তোমাদের সঙ্গে বিজনেস ভিউ থেকেই কথা বলবে। এর বাইরে একটি কথাও বার্তি বলবে না।
দাদা, মল্লিকদা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। ডাক্তারদাদা হাসলো।
আমি ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলাম। বৌদি ঘাড় ঘুরিয়ে আমাকে দেখল।
সোজা এই ঘরে চলে এলাম। দেখলাম বড়োমারা খেতে বসেছে। সঙ্গে পিকু-নম্রতা।
সোফায় মিত্রা, তনু, ইসি।
আমি সোজা বড়োমার ঘরে ঢুকে পরলাম। বুঝতে পারছি সকলে মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে। মাম্পি-মিকি শুয়ে ঘুমচ্ছে। আমি ওদের পায়ের কাছে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম।
বাইরে চাপা স্বরে সবাই কথা বলছে। অস্পষ্ট একটা হাল্কা আওয়াজ এই ঘরে ভেসে আসছে। কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
নিজের মনে নিজে হাসছি। রূপায়ণদা ধরে ফেলেছে। পার্টিগত ব্যাপারে ওদেরও কিছু ডিমান্ড আছে যেটা হয়তো চাপ দিয়ে বার করতে পারতো। ওদের কাছে সেটা চলবে না, যুক্তি দিয়ে বোঝাতে হবে। তবে মানবে।
অনিকা, অনিসা কিছু কিছু ক্ষেত্রে মার্সি করলেও পক্কে, ঘণ্টা, সুন্দর মেনে নেবে না। বিকেলে বেলা শুভ থাকবে। তার মানে ওই ডেটাটা তুলে আনতে গেছে।
কিরে ওঘর থেকে চলে এলি! মিত্রারা তিনজন ঘরে ঢুকলো।
ওরা সোফায় বসলো।
শরীর খারপ লাগছে?
না।
তাহলে চলে এলি! মিটিং হচ্ছে না?
হ্যাঁ।
তুই এসে শুয়ে পরলি, ও ঘরে মিটিং হচ্ছে, ঠিক বুঝতে পারছি না!
আমি মিত্রার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
বিরক্ত করিস না। একটু ঘুমিয়ে নিই।
তনু, ইসি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
মেয়ে, অনিকা, পক্কেরা সব ল্যাপটপ প্রিন্টার এই মোটা মোটা চারটে ফাইল নিয়ে ঢুকল। আর তুই চলে এলি!
আমি কোনও কথা বললাম না।
সকাল থেকে যে মিটিং নিয়ে এতো হুলুস্থূলুস কাণ্ড, এই করেঙ্গা সেই করেঙ্গা পরিস্থিতি আর তুই কিনা নিশ্চিন্তে টান টান হয়ে শুয়ে আছিস! মিত্রা বললো।
অনি কোথায়গো দিদি। বৌদির গলা পেলাম।
তনু, বৌদির গলা পেয়ে গেটের কাছে উঠে গেল।
আমার ঘরে। কি হয়েছেগো সুতপা? বড়োমার গলা পেলাম।
কিছু না।
ওই ঘরে কোনও গণ্ডগোল করেছে? বড়োমা বললো।
তুমি হাতটা ধুয়ে এসো তারপর বলছি। দামিনী তুমি চায়ের জল বসিয়ে এসো।
এরই মধ্যে চায়ের তেষ্টা পেয়ে গেল? বড়োমা বললো।
এ ছাড়া গতি নেই।
অনি কোথায়রে তনু?
শুয়ে আছে।
বৌদি গেটের মুখে এসে দাঁড়ালো। মুখটা চক চক করছে।
তনু, ইসি বৌদির মুখের দিকে তাকিয়ে।
বৌদি আমার পাশে বসে হাতটা শক্ত করে ধরলো। সত্যি এরা তোর যোগ্য উত্তরসুরী।
আমি হাসছি।
বড়োমা, ছোটোমা, দামিনীমাসি, আন্টি, জ্যেঠিমনি গেটের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।
চোখে মুখে চাপা টেনসন।
দামিনী তাড়াতাড়ি চা করো, তনু দিয়ে আসুক। মিটিং এখন আপাতত স্থগিত। প্রবীরকে ডেকে পাঠাল। ওরা এলে আবার মিটিং স্টার্ট হবে।
ও এখানে শুয়ে, মিটিং করছে কে? ছোটোমা বললো।
যারা প্রজেক্টের মালিক, তারা করছে।
ছোটোমার চোখ ছোটো হয়ে গেল, বড়োমা বলে উঠলো। তোমার কথা কিছু বুঝছি না।
দাঁড়াও এখন কিছু বলো না। চা-টা আগে পাঠিয়ে দিই। দামিনীমাসি বেরিয়ে গেল।
দিদি তুমি সরে এসো, ওর পেট থেকে তুমি কথা বার করতে পারবে না। ছোটোমা এগিয়ে এল।
বার করবি কি রে। ও এই প্রজেক্টের বুদ্ধিদাতা, মালিকরা সব ও ঘরে বসে।
বড়োমা-জ্যেঠিমনি, মিত্রা-ইসির মাঝখানে সোফায় বসে পড়লো।
বুঁচকিরা মালিক! ছোটোমা বললো।
সেইরকমই কাগজ পত্র দেখাল তোর দাদাকে। আমিও দেখলাম। অবিশ্বাস করি কি করে। সব আফতাবভাইয়ের সইকরা কাগজ। কোম্পানির প্রোফাইল শো করাল।
ছোটোমা আমার মুখের দিকে তাকিয়েছে। এখানেও কিছু একটা দুর্বুদ্ধি খাটিয়েছিস?
একবারে না।
তাহলে গাছ থেকে পরেই সব মালিক হয়ে গেল।
ওদের জিজ্ঞাসা করো।
ওদের কজন চেনে।
ঘুম পাচ্ছে, একটু ঘুমতে এলাম। সঙ্গে সঙ্গে সব বিরক্ত করতে চলে এলে।
বিরক্ত করবো না। তুই ঠিক ঠাক বলে দে চলে যাই।
ও ঘরে চলে যাও, সব জানতে পেরে যাবে।
বৌদি হাসছে।
তনু, মাসি ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল।
মিত্রাদি পাঁচ ভাইবোনে কি যুদ্ধ করছে গো! তনু বললো।
দুই বোনে দারুণ স্পিচ দিচ্ছে না। বৌদি বললো।
অনুপদা, রূপায়ণদা পুরো ফিউজ। কোনও কথা বলতে পারছে না। চুপ চাপ শুনে যাচ্ছে।
তোর দাদা? বৌদি বললো।
দাদা, বিধানদা শুধু হেসে যাচ্ছে।
মিত্রা, তনুর দিকে তাকিয়ে আছে।
এখন একটা ল্যান্ড ম্যাপ নিয়ে বসেছে। প্রজেক্টটা একচ্যুয়েলি কোথায় হবে, সেখানকার পুরো ডেটা ধরে ধরে বোঝাচ্ছে কেন ওখানে হবে।
তনু। অনুপদার গলা পেলাম।
তনু ঘরের বাইরে গেল।
অনি কোথায়?
শুয়ে আছে।
ওকে শোয়াব।
পর্দা সরিয়ে অনুপদা ঘরে ঢুকলো। আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
দখছেন বৌদি কেমন মজা দেখছে শুয়ে শুয়ে। কাল রাতে প্রায় ঘুমোইনি। সব কিছু প্ল্যান প্রোগ্রাম তৈরি করলাম, আর ও টোটাল মেটেরিয়াল নিয়ে ওদের বসিয়ে দিয়েছে। কি না সব মালিক। আর উনি কোম্পানীর চাকর। চল ও ঘরে, দাদা ডাকছে।
আমার গিয়ে কোনও লাভ নেই।
অনেক লাভ আছে।
কেন ওদের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছো না।
পারা যায়, তুই জানিস না।
জানলেও কিছু করার নেই। ওরা কিন্তু সত্যি এক একজন মালিক।
তার কাগজপত্র দেখেছি।
তাহলে? ওরা সেটিসফায়েড না হলে প্রজেক্ট ক্যানসেল হয়ে যাবে।
ক্যানসেল হয়ে যাবে বললেই হলো। এতদিনের পরিশ্রম সব মাটি।
ওরা কি তোমাদের অহেতুক বিরক্ত করছে।
তা করবে কেন। যুক্তি দিয়ে বুঝতে চাইছে।
তোমরা বোঝাও।
আমাদের কম্ম নয়। দফতরের লোক আসছে, তাদের কাছ থেকে বুঝে নেবে।
কে ঝামেলা করছে বেশি?
তোর দুই মেয়ে।
তোমরা দাদাই, মামারা বসে আছো, সামলাতে পারছো না।
ভেবেছিলাম পটকে দেব, তারপর দেখলাম নিজেরাই পটকে যাচ্ছি।
মিত্রা মুখ নিচু করে হেসে ফেললো।
তোমরা তবু চা পেলে আমি চা পেলাম না।
ও ঘরে ফ্লাক্স বসিয়ে দিয়ে এসেছে। চল তোকে দিচ্ছি।
অনুপ। প্রবীরদার গলা পেলাম।
এই ঘরে রে। বাবু শুয়ে আছেন। ধরে নিয়ে যেতে এসেছি।
প্রবীরদা উঁকি মারলো। আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো।
আবার একটা ঘুঁটি বসিয়ে দিলি। সুস্থভাবে বাঁচতে দিবি না।
আমি বসাইনি অরিজিন্যাল মালিক বসিয়েছে। আমি হুকুম তামিল করছি।
বকিস না, চল।
তোমার লোকজন এসেছে।
এসেছে। ওদের সঙ্গে কথা বলছে। ছোটোবৌদি কিছু খাবার দাও, বহুত খিদে লেগেছে।
ছোটোমা প্রবীরদার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।
আমি উঠে বসলাম।
এবার আসল লড়াই শুরু হবে কি বল? মিত্রা আমার দিকে তাকাল।
আমি হাসলাম।
এরকম একটা কিছু ঘটবে তুই কিছু আগে বুঝতে পেরেছিলি। অনুপদা মিত্রার দিকে তাকাল।
সেরকম কিছু বুঝতে পারিনি। তবে পাঁচজন মিলে সারাদিন রাত নেট ঘেঁটে কিসব করছিল সেটা দেখেছি। আর দু-জন খেয়ে দেয়ে বেরিয়ে গেল। বললো ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে ফিরবে।
কারা?
বোচন আর শুভ।
বুঝেছি। চল। অনুপদা আমার দিকে তাকাল।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। ঘরের বাইরে এলাম। বারান্দায় পা রাখতেই দেখলাম, নেপলারা বাগানে বসে। সঙ্গে চিকনারা। আমার দিকে তাকিয়ে ওরা হাসলো।
আমি এ ঘরে এলাম। সবাই একসঙ্গে হেসে উঠলো। নতুন অতিথিদের সঙ্গে পরিচয় হলো। এরা স্টেটের সব বাঘা বাঘা অফিসার। আগে এদের দেখিনি। নাম শুনেছি। সারা খাটময় কাগজপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সুন্দর ল্যপটপে টাইপ কর চলেছে।
আমি খাটে বসে অনিমেষদার দিকে তাকালাম। অনিমেষদা হাসছে।
চলবে —————————–
from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/SWimoXD
via BanglaChoti
Comments
Post a Comment