কাজলদিঘী (১৬৮ নং কিস্তি)

❝কাজলদীঘি❞

BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

১৬৮ নং কিস্তি
—————————–

কেউ কিন্তু একটাও বাজে কথা বলেনি তাই না দিদি। তনু বললো।

বুঝে গেছি। আমি একটা বিশাল হাই তুললাম।

বুবুন।

মিত্রা আমার বুকে মাথা দিয়ে।

বল।

বললি না আগামীকাল আমাদের কোথায় নিয়ে যাবি।

ভালোপাহাড়।

সত্যি! দু-জনেই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। চোখে মুখে খুশী ছড়িয়ে পড়েছে।

হ্যাঁ। শ্যামকে বলেছি। ও এ্যারেঞ্জ করে রাখবে।

অনুপদা যাবে?

যাবে।

তাহলে ঘুরবো কখন?

ওরা মিটিং করবে, আমরা ঘুরবো।

তুই কিন্তু কোনও মিটিং করতে পারবি না।

একটু আধটু ওদের সঙ্গে বসতে হবে। সারাদিন ঘোরা যায় নাকি।

না হবে না। আমাদের কে ঘোরাতে নিয়ে যাবে?

তোদের ঘোরাবার জন্য প্রচুর লোক আছে।

কিরে তোর চোখটা এরকম ঘোলাটে ঘোলাটে লাগছে!

ভীষণ ঘুম পেয়ে যাচ্ছে।

ঘুমিয়ে পর। আর কথা বলতে হবে না। তনু তুই ওর মাথাটায় একটু হাত বুলিয়ে দে। আমি বাথরুম থেকে আসছি। ও ঘুমলে আমরা বাগানে যাব।

মিত্রার ডাকে ঘুম ভাঙলো।

ওঠ মেয়েরা রেডি হচ্ছে এবার বেরবে।

উঠে বসলাম। তুই রেডি হোস নি?

এবার হবো।

তনু কোথায়?

ও ঘরে সব এসেছে সামলাচ্ছে।

আবার কে এলো?

আমার ভাগ্নে এসেছে।

পিকু অফিসে যায় নি?

মিত্রা হাসলো। পিকু নয় সুনীতদা।

ও হারামী সকালে কি করতে এসেছে।

আমার কথা শুনে মিত্রা হেসে ফেললো।

আবার বল।

সরি।

টাকা দিতে এসেছে। তোকে একবার চোখের দেখা দেখতে চায়।

রতন আছে।

না। চাঁদ আর চিনা নিয়ে এসেছে।

ছেলে মেয়েরা দেখল?

এতদিন নাম শুনেছে, এই প্রথম দেখছে, অনিসা তবু রয়ে-সয়ে কথা বলছে, অনিকা খেপে লাল। পরিষ্কার বলে দিল মামা বলে আপনি এখনও বহাল তবিয়েতে হাঁটা চলা করছেন, আমাদের সময় হলে, এটুকু সুযোগ পেতেন না।

হেসে ফেললাম।

শুভ কি বললো জানিষ।

কি।

আন্টি, কাগজপত্র বার করে তাড়াতাড়ি সই করে ছেড়ে দাও। আমাদের এখন অনেক কাজ।

তুই কিছু বললি না?

জানিষ বুবুন, কাল থেকে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করছি।

কি!

ছেলে-মেয়ে, অনিকা, শুভ, সুন্দর সবার চাল-চলন কথা-বার্তা কেমন বদলে গেছে।

কোনও ঔদ্ধত্য লক্ষ্য করছিস?

না।

তাহলে?

ওরা এটুকু বুঝিয়ে দিচ্ছে সকলকে, তুই যাকে যে দায়িত্ব দিচ্ছিস তা পালন করার জন্য ওরা মেন্টাল ব্যালেন্স তৈরি করে নিয়েছে। এখন ওরা ফুললি কনফিডেন্ট।

অনন্য কবে যাবে?

আফতাবভাইদের সঙ্গে প্রথমে দুবাই। তারপর বসির, সুন্দর, অনন্য তিনজনে ইংলন্ড চলে যাবে।

তনু এখন যাবে নাকি?

ওরা যাবার দিন পনেরো পড়ে যাবে। ভিসার ব্যাপারে কি একটা সমস্যা হয়েছে ওটা ঠিক করতে দিয়েছে।

তুইও ওর সঙ্গে চলে যা।

দু-জনে এক সঙ্গে গেলে তোকে দেখবে কে?

হাসলাম।

এখন যাব না। মিলিরা মাস কয়েক পর যাবে বলেছে। তখন যাব।

মিত্রা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

তুই কিছু একটা ভাবছিস।

না।

তোর চোখ বলছে।

এমনি। যাই বাথরুমের কাজ শেষ করে নিই। অনিমেষদারা ও বাড়ি থেকে এসেছে?

এসেছে।

বিধানদা?

তোর সঙ্গে কথা বলবে বলে বসে আছে। দু-জনে মিলে দুই নাতনিকে সকাল থেকে ধরে কি সব বোঝাল। দু-জনে বেশ মন দিয়ে শুনে মাথা দোলাচ্ছিল।

মিত্রা আলানা থেক টাওয়েলটা আমার হাতে দিল।

আজ প্যান্ট-গেঞ্জি বার করি?

কেন!

এয়ার পোর্ট থেকে একবার নার্সিংহোম যাব।

আবার নার্সিংহোম কিসের জন্য?

নীরু বললো, কি সব চেক করবে।

আজ থাক।

ওরকম করছিস কেন। তারপর ওখান থেকে একসঙ্গে অফিস যাব।

চিকনারা চলে গেছে?

হ্যাঁ।

আমি বাথরুম চলে গেলাম।

বাথরুম থেকেই টের পেলাম, আমার ঘরে সকলে এসে জড়ো হয়েছে। কল কল করছে সকলে।

আমি নিজের কাজ সেরে বেরলাম। দেখলাম অনিকা, অনিসা দু-জনেই রেডি। আমি অনিসাকে দেখে যত না অবাক হয়েছি তার থেকে অনেক বেশি অবাক হয়েছি অনিকাকে দেখে।

ঘরে সবাই আছে। টিনা, মিলি, অদিতি, বড়োমা, ছোটোমা, বৌদি, ঘণ্টা, পক্কেরা এমন কি নম্রতাও।

অনিকা একটা সর্ট জিনসের প্যান্ট ঢল ঢলে টপ পড়েছে। মেয়েও তাই। কালারটা একটু অন্যরকমের। চোখের পাতায় আই লাইনার লাগিয়েছে। একবারে অন্যরকম দেখতে লাগছে।

অনিকাকে জীবনে প্রথম এই পোষাকে দেখছি। ওরাও আমার চোখের ভাষা বুঝতে পেরেছে।

মামা, দিদি কিন্তু এলাকা গরম করে দিচ্ছে। পক্কে চেঁচিয়ে উঠলো।

অনিকা একবার পক্কের দিকে কট কট করে তাকাল। তারপর আমার দিকে।

আমি মুচকি মুচকি হাসছি। আনিকা কাছে এগিয়ে এলো।

প্রথম বিদেশে যাচ্ছি ড্রেসটা ঠিক লাগিয়েছি কিনা বলো?

কি করে বলবো। আমি হলে….।

অনিকা আমার মুখ টিপে ধরলো।

সরি সরি তুমি হলে কৌপিন পড়ে চলে যেতে। আমি মেয়ে পারবো না।

ঘরের সকলে হাসছে।

অনিকা, অনিসার দিকে তাকাল।

দেখলি তোকে বলেছিলাম।

ছাড়ো তো, প্রথম বার বলে বাবা এইরকম বলছে। মাকে, ছোটোমাকেও বাবা বলেছে।

পক্কে। আমি হাসতে হাসতে পক্কের দিকে তাকালাম।

পক্কেরা হাসছে।

দূর আমি খুলে ফেলবো। অনিকা বললো।

মিত্রারা সকলে হাসছে।

জানিস অনেকদিন পর একটা কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।

মামা খুব খারাপ হয়ে যাবে বলে দিচ্ছি। অনিকা হাসি হাসি চোখে আমার দিকে তাকিয়েছে।

আমি অনিকার দিকে তাকালাম।

খারাপ লাগছে না, বেশ ভাল লাগছে। অনেকদিন পর অদিতির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।

অনিদা খুব খারাপ হয়ে যাবে বলছি। অদিতি চেঁচিয়ে উঠতেই জোড় একটা হই চই পড়ে গেল। কে কি বললো শোনাই গেল না। শুধু ঘণ্টা তারস্বর চেঁচিয়ে বললো।

মামা, সুন্দর কাজ সেরে দিয়েছে।

অনিকার দিকে তাকালাম। চোখে মুখে রং ছড়িয়ে পরেছে। আমাকে জড়িয়ে ধরলো।

তুমি সুন্দরকে কিছু বলো।

আমার কাজটা ও করে দিয়েছে।

সুন্দর আমার কথা শুনে চেঁচিয়ে উঠলো।

দিদিভাই।

অনিকা তাকাতেই, একটা ফ্লাইং কিস দিল।

ধর ধর ধর না হলে উড়ে ঘরের মধ্যে ঘোরা ঘুরি করবে। ঘণ্টা চেঁচিয়ে উঠলো।

কথা চালা চালি হাসা হাসি চলতেই থাকল।

ওরা ভাইবোনেরা একে অপরের সঙ্গে লেগে পড়েছে। অনিকা, অনিসা দু-জনেই ছুটে ঘণ্টাদের কাছে চলে গেল।

আমি জামা প্যান্ট পড়লাম।

নেপলা ঘরে ঢুকলো। সবাই বেরিয়ে গেল। ছোটোমাকে বললাম একটু চা দেবে।

তুই ওই ঘরে আয়।

যাও যাচ্ছি।

নেপলার দিকে তাকালাম।

বল।

এবার তিনমাসের নিই।

তোর ওখানে ব্যবসা আছে না লাটে তুলে দিয়েছিস।

দেবাদাদের তো কোনও পেমেন্ট বাকি নেই। উপরন্তু আগের থেকে বেশি মাল যাচ্ছে।

ও। সুনীত আছে না চলে গেছে।

চলে গেছে। সত্যি সত্যি ও নোট নিয়ে এসেছে?

না দিয় যাবে কোথায়। কামাই কম আছে নাকি।

টাকা কি দাদার হাতে দিয়েছে।

না। ম্যাডামের হাতে। ব্যাগটা মনে হয় বড়োমার ঘরে রেখেছে।

গুনেটুনে নিয়েছে।

ও সব চাঁদ, চিনা করে নিয়েছে।

হাবভাবে বুঝলাম নেপলা কিছু বলতে চায়। বলতে পারছে না। আমিই বললাম।

কিছু বলবি?

নেপলা হাসলো।

তোমাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না।

ব্যাটা ছক বাজি। কি হয়েছে বল।

আলতাফভাই ইকবাল, হাফিজকে কলকাতায় পাঠিয়েছে।

কেনো?

বলতে পারবো না।

তুই জানলি কি করে?

আপ্পে বললো।

আপ্পে কিছু জানে না?

খালি হিন্টস দিল। ওই দলের তিন-চারজন কলকাতায় ঢুকেছে।

ভিকু কোথায়?

রাতে অভিমন্যু, ঝিনুককে নিয়ে ঢুকবে।

অর্জুন?

কলকাতায় আছে। একসঙ্গে একটার ফ্লাইটে উঠবে।

ওরা কি চাইছে আফতাবভাই যাতে এখানে না আসে?

সেরকম কিছু না।

তাহলে আমাকে টাঁসাবার ধান্দা করছে।

নেপলা একটা অর্থপূর্ণ হাসি হাসলো।

পাগলা এতটা কলজের দম এখনও কারো হয়নি। প্রত্যেকেই বাঁচতে চায়। তুই কি ভাবছিস আমাকে মেরে সবাই বহাল তবিয়েতে বেঁচে থাকবে।

জাস্ট প্রিকয়েসন, চাঁদ-চিনা তোমার সঙ্গে থাকলে অসুবিধে আছে?

যা পাকামো করতে হবে না।

আমি জানি তোমার কাছে সব খবর আছে। তোমারটা তুমি বুঝে নেবে। তবু তোমার কাছে থাকলে এতটা ভাবতাম না। সাগির, অবতার আগে চলে আসতে চাইছে।

ঘটনাটা কজন জানে?

চাঁদ-চিনা ছাড়া আর কেউ জানে না।

এতো ভাবিস না। আমি এখন অনেক হিসেব করে পা ফেলছি।

আমি জানি, তবু মন মানে না। এমন একটা পজিসন না গেলেও নয়। আফতাবভাই-এর কানে গেলে সে আর এক কেলোর কীর্তি।

এসে উঠেছে কোথায়?

লাস্ট আপডেট নিইনি।

ঠিক আছে তোকে টেনসন করতে হবে না আমি বুঝে নিচ্ছি। সাগরের খবর?

শুনলাম ও ফাইনান্স করেছে।

কাজটা অনাদি করছে?

মনে হয়।

ছেলেগুলো নতুন না পুরনো।

একবারে আনকরা। সেই জন্য ভিকুভাই ঠিক ধরতে পারেনি। তাই নিজে আসছে।

চল ও ঘরে চল।

এ ঘরে আসতেই দেখলাম মেলা ভিড়। ফাদার, উসমান, আর ডা. ভট্টাচার্য এসেছেন।

আমি ফাদারকে গিয়ে প্রণাম করলাম।

তুই তো আর নেমন্তন্ন করলি না। তোর মেয়ে ডেকে পাঠাল তাই চলে এলাম।

তোমার সেই সোমবার আসার কথা ছিল।

এসেছিলাম। এখানে আসতে পারিনি। অনিসারা সবাই গিয়ে দেখা করেছিল।

আমাকে কেউ বলেনি। জিজ্ঞাসা করো।

শোনার মতো ফুরসৎ তোর আছে?

আমি হাসলাম।

অনিকার বাবার সঙ্গে আলাপ হয়েছে?

ফোনে কথা বলেছিলাম, আজ সাক্ষাৎ দেখলাম।

ভালো লোক না মন্দ লোক?

তুই বলতে পারবি।

তুমি আজ হঠাৎ এলে?

মেয়ে প্রথম বিদেশ যাচ্ছে। শুনলাম এখন কি সব বড় বড় কোম্পানির মালিক-টালিক হয়েছে। আমি তো ভিক্ষারী। মেয়েদের কাছে হাত পাততে এসেছি।

পক্কে-ঘণ্টা?

ওদের এখন বড়ো বড়ো লেজ গজিয়ছে। দেখছিস না ধারে কাছে কেউ আসছে না।

তুমি কান ধরতে পারছো না?

এখন সব বড়ো হয়ে গেছে। ডা. ভট্টচার্যকে সঙ্গে নিয়ে এলাম। তুই কথা দিয়ে এসেছিস। এক কাজে যাতে দু-কাজ হয়।

ডাক্তারদাদার সঙ্গে আলাপ হয়েছে?

শুধু তোর সঙ্গে আলাপ হওয়ার বাকি ছিল, সেটা এই করলাম।

আজ থেকে যাও।

হবে না। চার্চের কাজ আগের থেকে এখন তুই বারিয়ে দিয়েছিস। এতগুলো টাকা পাঠিয়েছিস। কাজগুলো শেষ করতে হবে।

আমি দিই নি। আমার টাকা নেই।

নেপলা আমাকে চিনলো কোথা থেকে?

হাসলাম।

তুই একটু ডা. ভট্টাচার্যের ব্যবস্থা কর। তাহলে আমার একটু সুবিধে হয়। বাচ্চাগুলোর ট্রিটমেন্ট একটু ফ্রিতে করাতে পারি।

কেন ডা. ভট্টাচার্য এতদিন করতেন না।

ফাদার হাসছে।

ফাদার এখন আর কথা নয়। মেয়ের সঙ্গে খেতে বসে যাও। তনু ফাদারের হাত ধরেছে।

তুই বসবি না।

আমি একটু চা খাই।

ডা. ভট্টাচার্য সোফায় বসে ডাক্তারদাদাদের সঙ্গে কথা বলছে। অনিমেষদা, বিধানদা, দাদা, মল্লিকদা রয়েছে। অনিকা, অনিসা, ফাদার, নেপলা খেতে বসেছে।

আমি টেবিলের কাছে এগিয়ে গেলাম।

ফাদার তুমি অনিকাকে চিনতে পেরেছো?

প্রথমে ঠিক ধরতে পারিনি। পরে বুঝলাম হ্যাঁ এ-তো সেই মেয়ে।

ফাদার তুমি মামার কথায় কান দিওনা।

ফাদার ওদের দু-জনের দিকে তাকিয়ে হাসছে।

বড়োমা এসে সামনে দাঁড়াল। কয়েকটা লুচি ভেজেছি খাবি।

দাও।

আমার ঘরে গিয়ে বস।

আমি বড়োমার ঘরে এলাম, দেখলাম সেখানে জ্যেঠিমনিরা সব বসে আছে।

দামিনীমাসি বললো, তুই কখন ফিরবি।

রাত হয়ে যাবে।

আজকে একবার আমার ওখানে তোকে যেতে হবে।

কেন!

গেলেই দেখতে পাবি।

তাহলে অফিস থেকে ফেরার পথে যাব।

তাই যাস। বেশি রাত করিস না।

সন্ধ্যের দিকে যাব।

আচ্ছা।

বড়োমা খাবার নিয়ে এলো।

আজকে আর কেউ ঝামেলা করতে এলো না। খেয়ে নিলাম। জ্যেঠিমনির কাছ থেকে ও বাড়ির সবার খোঁজ-খবর নিলাম। ইসির স্কুলে কি সব ঝামেলা হয়েছে। তাই আসতে পারবে না। পিকু, বরুণদা অফিসে গেছে। ফোনে কথা বলে নিয়েছে।

অনিমেষদা, বিধানদা গেটের কাছে এসে দাঁড়াল।

তোর খাওয়া হয়েছে।

হ্যাঁ। চায়ে চুমুক দিয়েছি।

বারান্দায় আয় একটু কথা বলে নিই।

চায়ের কাপ হাতেই উঠে পরলাম। বিধানদাদের পেছন পেছন বারান্দায় এলাম।

বাগানে চারখানা গাড়ি দাঁড়িয়ে। চাঁদ, চিনাকে দেখলাম। অনিমেষদার মুখের দিকে তাকালাম।

আজকের কোনও কাগজ দেখেছিস?

না।

অনাদি স্টেটমেন্ট দিয়েছে। আমরা বাইরে থেকে টাকা আনার গল্প ফাঁদছি।

কোন কাগজে?

যেটা ওর পেটোয়া।

করতে দাও। আর কি লিখেছে?

তোর নাম উল্লেখ না করে বলতে চেয়েছে তুই একজন মাফিয়া ডনকে নিয়ে আসছিস।

কাল থেকে ও থেমে যাবে। আবার ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া ওর পেছন পেছন দৌড়বে।

ও কি কোনও গণ্ডগোল করতে চাইছে?

কেন!

সেরকম একটা কানা ঘুসো শুনতে পাচ্ছি।

কিসের গণ্ডগোল?

যা হয় আর কি।

তোমার পুলিশকে বলো পিটে দিতে।

সে তো বললেই হয় না। তোর কাছে কি খবর আছে?

আমার কাছে কোনও খবর নেই।

অনিমেষদা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। কিছু বলতে চায়।

কি হয়েছে তুমি বলো না। তারপর দেখছি, তার কতটা সত্যতা আছে।

এসবির রিপোর্ট আছে। বম্বের থেকে কয়েকজন এসেছে।

কোথায়?

কলকাতায়।

কি করতে এসেছে?

তোকে মারতে চায়।

আমাকে তো আগেও মারতে চেয়েছে। তোমার গোয়েন্দারা ট্রেস করতে পেরেছে?

এখনও খবর নিইনি।

আগে দেখ খবরের সত্যতা কতটা।

আমরা তোর জন্য যদি পুলিশ প্রটেকসন দিই।

তুমি বৃথা চিন্তাভাবনা করছো। এর থেকেও অনেক টাফ প্রিয়েড আমার গেছে।

সেই প্রিয়েড আর এই প্রিয়েডের মধ্যে অনেক তফাৎ।

আমি কোনও তফাৎ বুঝতে পারছি না।

কাল কখন বেরবি?

সকালে।

কোথায় যাবি?

ভালোপাহাড়। শ্যামদের সঙ্গে বসবো।

ঠিক আছে।

একটু হই হই করে সব এক সঙ্গে বেরিয়ে এলাম। অনিকারা সব ভাই-বোন একটা গাড়িতে বসেছে। আর একটা গাড়িতে আমি, তনু, মিত্রা, নেপলা। ড্রাইভিং সিটে রতন সামনের সিটে আবিদ। পেছনে চাঁদ, চিনা, নেপলা।

আর একটা গাড়িতে ইসলামভাই, ইকবালভাই। আর কেউ এলো না।

রাস্তায় আস্তে আস্তে রতনকে জিজ্ঞাসা করলাম, আজ থেকে এই গাড়িটা আমার জন্য বরাদ্দ তাই তো রতন।

রতন মুখ টিপে হাসলো।

যথা সময়ে এয়ারপোর্টে পৌঁছলাম। অর্জুনকে দেখলাম। ব্যাটা আজ পাঞ্জাবী সেজেছে। পাগড়ি-টাগড়ি লাগিয়ে একাকার। একবার মোবাইলে মিসকল করে যাচাই করে নিলাম। দেখলাম ফোনটা বার করে লাইনটা কেটে দিল। একবারের জন্যও আমার দিকে তাকাল না।

অনিকারা চেকআউট করে ভেতরে চলে গেল। যথাসময়ে প্লেন উড়েগেল।

ইসলামভাই সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। চোখটা সামান্য ছল ছল করছে।

আবার কি হলো?

এই জায়গায় যে কোনওদিন পৌঁছতে পারবো স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনি।

স্বপ্ন নিশ্চই দেখেছিলে, বাস্তবটা আজ দেখছো। তাই মনখারাপ করছো। ওরা যথেষ্ট বুদ্ধিমান।

মাঝে মাঝে ভয় হয়।

ভয়ের কাজ করলে আজ এই জায়গায় থাকতে পারতে না।

কিছু অন্যায় কাজ তো করেছি।

আমিও করেছি, আজও করছি। ভবিষ্যতেও প্রয়োজনে করতে হবে। অনিমেষদা করেছে, আজও করছে।

তোর আর আমার মধ্যে অনেক তফাৎ।

একটুও তফাৎ নেই। তুমি তোমার স্ফেয়ারে করেছো, আমি আমার স্ফেয়ারে। বাইরে থেকে দেখলে যেটা অন্যায় ভেতরে ঢুকে দেখ সেটা অন্যায় নয়। সুনীতদা বলবে আমি অন্যায় কাজ করেছি। ভয় দেখিয়ে ওর কাছ থেকে জোড় করে টাকা আদায় করেছি। সাগর বলবে আমি অন্যায় কাজ করেছি। সত্যি কি অন্যায় কাজ করলাম। আমার প্রাপ্য জিনিষটা আমি বুঝে নিয়েছি। তার বিনিময়ে তাকে অরিজিন্যালটা দিয়ে দিয়েছি। এটাকে নিয়ে কেউ যদি বিরোধ করতে চায়, তাকে তুমি অন্যায় বলবে।

ইসলামভাই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো।

তুই এখন কোথায় যাবি? ইকবালভাই বললো।

নার্সিংহোমে যাব।

আবার কি হলো!

মিত্রা, তনু দুজনে চেপে ধরেছে। চেক আপ করাবে। নীরুও তালে তাল দিল।

আবার কি কোনও সমস্যা?

না। মাঝে মাঝে মাথাটা ঝিম ঝিম করে, তাই।

রবীনকে ছেড়ে দে। তোর সঙ্গে যাই, তারপর বাড়ি যাব। ইসলামভাই বললো।

অগত্যা রবিন অফিসে গেল, আমরা নার্সিংহোমের দিকে যাত্রা করলাম।

মিত্রা ফোন করে নীরুর সঙ্গে কথা বলে নিল।

সময়মতো নার্সিংহোমে এলাম। প্রচুর ভিড়। প্রায় মাস চারেক পর আসছি।

আমাকে নিয়ে দুই মক্কেল বেশ ভাল রকম কসরৎ করলো। দিলাম গালাগালি। প্রায় ঘণ্টা তিনেক টানা-হ্যাঁচড়ার পর মুক্তি পেলাম। খিদেও লেগেছিল। সকলে বসে নার্সিংহোমের খাবার খেলাম।

দেখলাম বিকেল হয়ে গেছে।

মিত্রাকে বললাম অফিসে যাবি নাকি।

পাঁচটার সময় অফিসে গিয়ে কি করবো।

তাহলে এক কাজ কর, তুই, তনু ইসলামভাই-এর সঙ্গে চলে যা।

না তোর সঙ্গে ফিরবো।

আমার কয়েকটা কাজ আছে।

আমাদের নিয়ে কর।

হাসলাম।

বলছে যখন কর না। ইসলামভাই বললো।

তাহলে তুমি, ইকবালভাই বাড়ি চলে যাও।

ও বলতে ভুলে গেছি, নাসরিন ফোন করেছিল।

কখন!

তখন তোর এমআরআই হচ্ছিল।

কি বললো?

বম্বে থেকে প্লেনে উঠছে।

মিত্রার দিকে তাকালাম। তোদের ফোন করে নি?

প্লেনে উঠে এসএমএস করেছিল। এখনও ঘনো ঘনো করে যাচ্ছে।

তোরা আয় তাহলে। আমরা এগোই।

ইসলামভাই, ইকবালভাই চলে গেল।

আমরা ডক্টর চেম্বারের বাইরের লবিতে এসে দাঁড়ালাম।

টিয়াকে কোথায় রেখেছিস?

আজ সকালে ছেড়ে দিয়েছি। কনিষ্ক বললো।

এখন ঠিক আছে?

আর এক সপ্তাহের মধ্যে জয়েন করতে পারবে।

বিতান?

ওইই তো সাইন করে নিয়ে গেল।

বটা কই?

সকাল থেকে অপারেসন থিয়েটারে ঢুকেছে। নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে না।

আমাকে কি রকম দেখলি?

ছবি দেখে যা বুঝলাম এখনও সামান্য সমস্যা আছে। স্যারের সঙ্গে একটু কথা বলি। যদি স্যার ওষুধ দিতে বলেন তাহলে আরও দিন পনেরো খেতে হবে।

রাতে যাবি নাকি?

আজ আর যাব না। অনেকদিন নিজের ঘরে শুইনি।

ঠিক কথা, এটা মনে ছিল না। আমি তো সব সময় নিজের ধান্দাতে রয়েছি। সরি।

হারামী। কনিষ্ক আমার পেছনে একটা থাপ্পর মারলো।

মেয়েকে আমার কাছে রেখে দিই, তাহলে শোয়াটা আরও বেশি জোরদার হবে।

নীরু হাসছে।

দেখছো ম্যাডাম তোমার বন্ধুর ডায়লগ শুনতে পাচ্ছ। কনিষ্ক বললো।

মিত্রা সুন্দর করে হাসলো। তোমাদের সাধু ভাষায় বললো, আমাদের দু-জনকে চলিতে বলে।

সবাই হাসছি।

আমি কাল সকালে বেরচ্ছি।

শুনলাম। জুনিয়র ছেলেগুলোকে গতকাল পাঠিয়েছি।

আমি কাউকে চিনব না।

তোর চেনার দরকার নেই।

হাসলাম। ফাদারের ওখানে সেই নার্সিংহোমের কথা বলেছিলাম মনে আছে।

ডা. ভট্টাচার্য?

হ্যাঁ।

সকালে কথা হয়েছে। এখানে এসেছিলেন।

বাবাঃ।

তোর ব্যাপারটা তুই যেমন ভাল বুঝিস, আমাদের ব্যাপারটাও আমরা ভাল বুঝি।

কথা বলতে বলতে, আমরা পাঁচজন নিচে নেমে এলাম।

চাঁদ, চিনাকে দেখলাম রিসেপসন রুমের সোফায় বসে ফোনে কথা বলছে।

আমাদের দেখে উঠে এলো।

কিরে তোরা দু-জন! রতন, আবিদ কই?

অনিকেতদার সঙ্গে ভেতরে গেল। কি দরকার আছে। চিনা বললো।

কনিষ্ক বললো, বুঝেছি।

কি হয়েছে! আমি কনিষ্কর দিকে তাকালাম।

আমাদের সিকিউরিটি, ওয়াশিং, কিচেন এখন আবিদ আর রতনের কোম্পানী দেখা-শোনা করে।

চাঁদ, চিনা হাসলো।

আমি ওদের মুখের দিকে তাকালাম।

গত তিন-চারদিন ওরা বেশ সমস্যা করছে। ম্যানেজারটাকে বলেছি, ব্যাটা ঠিক গা করছিল না। তাই মনে হয় অনিকেত আবিদকে ধরে নিয়ে গেছে।

নীরু ফোন করতে যাচ্ছিল। বললাম, করিস না। কনিষ্কর দিকে তাকালাম।

নতুন মেশিনগুলো কাজ করতে শুরু করেছে।

তিনটে শুরু করেছে, আরও তিনটে এখনও পড়ে আছে। পেছনে একটা কনস্ট্রাকসন চলছে, শেষ হোক, ওই ইউনিটটা ওখানে বসাবো।

যেগুলো বসালি সেগুলো কেমন কাজ করছে?

কলকাতায় আমাদের ছাড়া ওই মেশিন কারুর নেই। রেটটাও খুব নমিন্যাল রেখেছি। প্রচুর ভিড় হচ্ছে। সামাল দেওয়া যাচ্ছে না।

অন্যান্য নার্সিংহোমে যেগুলো ইমপ্লিমেন্ট করবি বললি।

ধীরে ধীরে করছি। একটু সময় লাগবে।

কনিষ্কদা আমার কথাটা দাদাকে বলো। চাঁদ বললো।

কি বলতো! কনিষ্ক তাকাল চাঁদের দিকে।

আমাদের ওখানে একটা করবে বলেছিলে।

ও। ঠিক কথা মনে করিয়েছিস।

কনিষ্ক আমার দিকে তাকাল।

তোর কি মনে আছে, একবার হয়তো তোকে বলেছিলাম।

কি?

চাঁদ আর রতনদের পরিবার রাস্তার ধারে আমাদের জায়গা দেবে। একটা নার্সিংহোম বানাতে হবে। ওই তল্লাটে কোনও ভালো নার্সিংহোম নেই।

তুই নীরু গিয়ে দেখে আয়।

রতনের সঙ্গে গেছিলাম।

কোথায়?

পলাশী।

ডাক্তারদাদাকে বলেছিস?

একবার কানে তুলেছিলাম। বললো, অনেক ইনভেস্টমেন্ট।

তোরা দিবি কেন! চাঁদ, রতনের এখন অনেক টাকা। ওরা ইনভেস্ট করবে, তুই ইনফ্রাস্ট্রাকচার তৈরি করে দিবি। আমাদের ফ্র্যাঞ্চাইজি দিবি।

দাদা কি বলছেগো কনিষ্কদা? রতনের গলা পেলাম।

পেছন ঘুরে দেখলাম দু-জনে আমার গায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে।

শুনলাম দু-জনে মিলে বহুত কামাচ্ছিস।

বা রে কামাবো না, তুমি পাশে আছো, না কামালে লোকে কি বলবে, ছি ছি করবে না।

সবাই হাসছে। আমি রতনের মুখের দিকে তাকিয়ে। আবিদ জাপ্টে ধরলো।

আমরা কামাবো তুমি হিংসে করবে তা তো হয় না। তুমি তোমার আনন্দটা এই ভাবে প্রকাশ করো, এখন আর গায়ে মাখি না। আর যাই হোক তুমি সাগর দাধিয়া নও।

এখানে ঝাঁপি মেরেছিস। অফিসের গাড়ি-ঘোঁড়া কে দেখছে?

বকলমে চাঁদ-চিনাকে দিয়েছি। তুমি ম্যাডামকে জিজ্ঞাসা করো কোনও অসুবিধে হচ্ছে কিনা। কিংবা এনি কমপ্ল্যান। আচ্ছা ম্যাডামকে জিজ্ঞাসা করতে হবে না। টিনাদিকে জিজ্ঞাসা করো।

ঠিক আছে খোঁজ খবর নিচ্ছি।

কথা বলতে বলতে বাইরে বেরিয়ে এলাম।

রতনকে বললাম মাসির ওখান যাব।

এখন!

হ্যাঁ।

তুমি যে বললে অফিসে যাবে।

এখন অফিসে গিয়ে আর কাজ নেই।

গাড়িতে উঠে বসলাম, কনিষ্কদের হাত নাড়িয়ে বেরিয়ে এলাম।

রতন ড্রাইভিং সিটে। চাঁদ, চিনা তাদের জায়গায়।

আবিদ, আয়েষাকে ভর্তির ডেট কবে দিয়েছে?

গতকাল নীরুদা দেখেছে। বললো দেরি আছে সেরকম হলে নিয়ে চলে আসবি।

তারমানে তোর এখন বাইরে থাকা উচিত নয়।

বাড়িতে লোক আছে। অসুবিধে নেই। গাড়িও একটা সব সময়ের জন্য রেখে দিয়েছি।

নীরু কি বললো?

নর্মাল।

বেবির পজিসন?

ভালো আছে।

তোকে কাল যেতে হবে না।

তাই বলি এতো খোঁজ খবর কিসের জন্য?

আবিদের কথায় মিত্রারা জোড়ে হেসে উঠল।

ভিউংগ্লাস দিয়ে দেখলাম পেছনে চাঁদ-চিনাও হাসছে।

চাঁদ গল্পগুলো শুনছিস, শিখে নে। আবিদ চেঁচাল।

রতন নকুরের মিষ্টির দোকানের সামনে এসে গাড়ি দাঁড় করালো।

ম্যাডাম কি কি মিষ্টি নেবে নাও। রতন বললো।

বুবুন নেবে।

দাদার পয়সা নেই। গরীব মানুষ। আমরা বড়োলোক।

রতনের মাথায় একটা চাঁটা মারলাম।

আজ বড়োমার কাছ থেকে পঞ্চাশটাকা ধার করোনি?

ওরা সবাই জোড়ে হাসছে। আমি মুচকি মুচকি হাসছি।

চাঁদ, চিনা পেছনের গেট খুলে নেমে গেছে। তনু, মিত্রা দু-জনেই নেমেছে। গাড়িতে আমি রতন।

কাল কখন বেরবে?

সাতটা নাগাদ।

সোজা ভালোপাহাড়?

না। মাঝে নার্সিংহোমের ওখান থেকে চিকনা, বাসু, মীরচাচা উঠবে।

তাহলে দু-খানা গাড়ি নিতে হবে।

কেন এই গাড়িতে হবে না। একটু চাপাচাপি করে বসে পড়বে।

না।

যা পারিস কর। তোদের সব কিছুতে একটা মোচ্ছব চাই।

এই নে।

ঘার ঘুরিয়ে দেখলাম মিত্রা একটা শালপাতার বাটিতে কয়েকটা সন্দেশ নিয়ে এসেছে।

এই তো কিছুক্ষণ আগে খেলি।

ধর না, কেন ঝামেলা করিস। সবাই খাচ্ছে তুই খাবি না হয়।

আবিদ একটা শালপাতার বাটি রতনের হাতে নিয়ে এসে দিল।

দিদি আর কয়েকটা খেলে হয় না। তনু, মিত্রার কাছে এসে বললো। আমার দিকে তাকাল।

আমি ওর দিকে তাকিয়ে।

একবারে তাকাবে না। নিজেরা কলেজ লাইফে বেশ খেয়েছো, আমি কোনওদিন খেয়েছি।

তনুদি দাদা খাক আর নাই খাক আমরা আর কয়েকটা করে খেতেই পারি। রতন বললো।

চাঁদরা দোকানের সামনেই দাঁড়িয়ে। তিনজনে মিলে বেশ ভালই মিষ্টি সাঁটাচ্ছে।

আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসছে। রতনরা আরও কয়েকটা সন্দেশ খেল।

মিষ্টি গাড়ির পেছনে তুলে রওনা হলাম।

গাড়ি ছাড়তেই রতন বললো।

আবিদ মাসিকে একটা ফোন করে দে।

কেন? আমি বললাম।

কে কে যাচ্ছি বলতে হবে না।

কিসের জন্য?

মাসি তোমাকে যেতে বলেছে আমাদের যতে বলেছে?

চাঁদ, চিনা দু-জনেই পেছন থেকে হাসছে।

দিদি আজ আমি মাসির বাড়িতে প্রথম যাচ্ছি।

তুমি আগে কখনও আসোনি তনুদি? আবিদ পেছন ঘুরে তাকাল।

না। আসবো কি করে। আগের বার যখন এলাম তখন ওরা ওকে মারলো। দিল্লী থেকে ফিরেই চলে গেলাম।

আমিও কত যুগ পড়ে যাচ্ছি ঠিক নেই। মিত্রা বললো।

বিয়ের আগে তিন-চারবার এসেছি। এনজিওটা উদ্বোধনের সময় ডাক্তারদাদা জোড় করে নিয়ে এসেছিল। তখন ছেলে-মেয়ে পেটে। ও মরে গেছে।

সত্যি ম্যাডাম সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে এখনও শিউরে উঠি।

আর মনে করিয়ো না আবিদ।

আমি মিত্রার দিকে তাকালাম। তনুও মিত্রার দিকে তাকিয়।

আমি মিত্রার কাঁধে হাত রাখলাম।

ছাড়।

মিত্রা আমার হাতটা সরিয়ে দিল।

তুই আমাকে সব দিয়েছিস। শুধু একটু শান্তি দিসনি। আর তনুকে কিছুই দিসনি।

মুহূর্তের মধ্যে পরিবেশটা বেশ থম থমে হয়ে গেল। আমিও গুম হয়ে গেলাম।

ও পাড়ায় যখন ঢুকলাম সন্ধ্যে হয়েছে। রাস্তার নিওন আলোগুলো জ্বলে উঠেছে। আগে যদিও দু-একটা মেয়ে চেনা ঠেকতো এখন সব আনকোরা।

এই সময় নতুন খদ্দেরদের আগমন ঘটে। হাসাহাসি ঢলাঢলি শুরু হয়ে গেছে। তনু জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে। আমি মাঝখানে। আমার দু-পাশে দু-জন। মিত্রাও জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে।

আজ রতন পেছন পাশ দিয়ে ঢোকেনি। সামনে দিয়েই ঢুকেছে। রূপের হাট বসে গেছে। উচ্ছে, বেগুন, পটল, মূলোর মতো গায়ে হাত দিয়ে গাল টিপে থুতনিতে হাত দিয়ে দর কষাকষি চলছে। রতন একবারে এনজিওর অফিসের সামনে এসে গাড়িটাকে দাঁড় করালো।

একে একে সবাই নেমে এলাম।

তনু চারদিক চেয়ে চেয়ে দেখছে। ওর যেন চোখের আশ মেটে না।

মাসি কোথায়? রতনের দিকে তাকালাম।

বাড়িতে আছে আমাকে এখানে দাঁড়াতে বললো।

মাসিকে একটা ফোন কর।

চলে আসবে।

মিত্রা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

আমি বাড়িটার দিকে তাকালাম। অনেকদিন আগে দেখেছি। এর মধ্যে আর আসা হয়নি। আগের থেকে অনেক বেশি ঝক ঝক করছে। ভেতরে অনেকেই আছে। কাউকেই চিনি না।

ক্লিনিকের ভেতর দু-তিনজনকে বসে থাকতে দেখলাম। ভেতরে আরও অনেক মেয়ে।

তোরা আয় আমি এদের নিয়ে এগোচ্ছি। রতনের দিকে তাকালাম।

ভেতরে যাবে না?

ফেরার সময় যাব।

হাঁটতে শুরু করলাম। বহুদিন পরে এই পাড়ায় পা রেখেছি। মেয়েগুলোর সাজ পোষাক শরীরেও অনেক পরিবর্তন। নিজেকে সাজিয়ে তোলার কি ভীষণ কমপিটিসন। তনু, মিত্রা দুজনেই আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরেছে। বিকি কিনির হাটে আমরা তিনজন একবারে আনকোরা মানুষ।

আমাদের দেখে অনেকেই হাঁসা হাঁসি করছে। টিপ্পনিও কাটছে।

গলির বাঁকে আসতেই মাসির সঙ্গে দেখা।

মাসিকে দেখে মিত্রা, তনুর ধরে যেন প্রাণ এলো।

তোরা এলি, ওরা কোথায়?

ওরা ওখানে দাঁড়িয়ে।

বেশ লক্ষ্য করলাম আশেপাশের মেয়েগুলোর চোখের রংয়ে পরিবর্তন হলো।

কি আজব ছেলে বল। বললাম বাড়িতে আসতে, চলে গেল অফিসের সামনে।

গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে আসতে বলো।

মাসি রতনকে ফোন করলো।

আমরা আবার সামনের রাস্তায় হাঁটতে শুরু করলাম। একটু খানি হাঁটতেই মাসির বাড়ির দোরগোড়ায় এসে হাজির হলাম। বাড়িটার গায়ে রংয়ের পোঁচ লেগেছে। বেশ দেখতে লাগছে।

তোকে কেমন শুকনো শুকনো লাগছে।

কই না। আমি ঠিক আছি।

মাসির মুখের দিকে তাকালাম।

বাড়িটার শ্রী ফিরিয়েছ মনে হচ্ছে।

হ্যাঁ।

আমি কতো কিছু জানিনা দেখেছো।

মাসি মুখ টিপে হাসলো।

মাসির বাড়ির পেল্লাই দরজার সামনে এসে হাজির হলাম। না কাঠের শিঁড়িটা এখনও আছে। অন্ধকার শিঁড়িটায় এখন দিনের আলোর ঠিকানা লেখা। গুটি গুটি পায়ে খদ্দেরদের আনাগোনা শুরু হয়েছে।

আমাদের সাজ পোষাক চলাফেরায় এই এলাকায় আসা যাওয়া করা মানুষরা বুঝতেই পারছে, আমরা এখানে অন্য কারনে এসেছি।

শিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে দোতলার বারান্দায় এলাম। মিত্রাকে নিয়ে প্রথম যেদিন এসেছিলাম। সেদিন এই বারান্দাতেই সবাই হই চই বাধিয়ে দিয়েছিল। সেদিনের তুলনায় আজ অনেক বেশি ঝক ঝকে। আমাদের দেখে দু-একজন এগিয়ে এলো।

পোষাক পরিচ্ছদ দেখে মনে হলো না। এরা ব্যবসা শুরুর তোরজোড় করছে।

একজন বলে উঠলো, মাসি তুমি যে বললে অনিদা আসবে, এলো না।

মিত্রা, তনু আমর মুখের দিকে তাকাল।

আমি মেয়েটির দিকে তাকালাম। বয়স একুশ-বাইশের মধ্যেই হবে। ঝকঝকে চোখমুখ। চুলটা এলো করে পিঠময় ছড়িয়ে রয়েছে। পাটভাঙা একটা দামী প্রিন্টের শাড়ি পড়ে রয়েছে। কপালে সিঁদুরের টিপ। সারাটা শরীর লালে লাল।

মাসি ওদের দিকে তাকাল। আসবার সময় হয়েছে এবার চলে আসবে।

এনারা তোমার গেস্ট।

মাসি মাথা দোলাল।

তোরা ওপরে আয়।

যাচ্ছি, তুমি যাও।

আবার শিঁড়ি ভাঙা শুরু।

তিন তলায় এসে মাসির ঘরের দিকে পা বাড়াতেই মাসি হাতটা চেপে ধরলো।

কোথায় যাচ্ছিস?

তোমার ঘরে।

আমি এখন আর ও ঘরে থাকি না।

কেন!

আমি এখন তোর ঘরে থাকি।

হাসলাম।

তাই বলি এতো পরিপাটি করে মাসি কাকে সঙ্গে নিয়ে ঢুকছে।

গলার শব্দ পেয়ে পেছনে তাকালাম। হুড়মুড় করে কাঠের শিঁড়িতে ধুপ ধাপ আওয়াজ তুলে সেই মেয়েটা ওপরে উঠে আসছে। ওর পেছন পেছন সকলে। ওদের চেঁচামিচিতে এবার তিনতলার ঘর থেকেও কয়েকজন বেরিয়ে এলো।

মেয়েটি নাম ধরে ধরে ডাকছে, এই শনকা, মালিনী, মিতু….ছুটে আয় অনিদাকে দেখবি আয়।

মুহূর্তের মধ্যে আমাদের ঘিরে ধরলো সকলে। শুরু হয়ে গেল মাসির সঙ্গে তর্ক যুদ্ধ।

কেন তুমি মিথ্যে কথা বললে, তোমার গেস্ট। তোমার ছেলেকে আমরা কেরে নিতাম।

মাসি হাসছে, তনু-মিত্রা হাসছে। আমিও হাসছি।

মেয়েটি আমার কাছে এগিয়ে এলো। ডাগর চোখে তকাল আমার দিকে।

জানো অনিদা আমি এই বাড়ির উর্বশী। তোমাকে এতদিন স্বপ্নে দেখেছি। আজ চাক্ষুষ দেখছি।

কথা বলতে বলতে মেয়েটি মাথা নিচু করে নিল।

তোমার ভাল নাম কি?

মেয়েটির থুতনি ধরে মুখটা তুলে ধরলাম। চোখের পাতা থিরি থিরি কাঁপছে।

জানিনা। তুমি একটা নাম দাও।

ঠিক আছে তোমাকে আমি বাসন্তী বলে ডাকবো।

বাসন্তীর ঠোঁটে প্রতিপদের চাঁদ।

তোমাকে একটু ছোঁব।

কেন! কেউ বারন করেছে?

তুমি মাসির সাক্ষাৎ শিবঠাকুর, নারায়ণঠাকুর। তোমাকে এতো সহজে ছোঁয়া যায় নাকি।

এবার সকলে কল কল করে উঠলো। পা ছোঁয়ার হিরিক পড়ে গেল। তারপরই ওদের বলতে হলো আমার সঙ্গের দু-জন কে। পরিচয় পাওয়ার পর আর একচোট হই হই হলো।

আমি ওদের দিকে তাকিয়ে আছি। বেশ ভালো লাগছে। এই নির্মল আনন্দের ভাগীদার আমিও।

আমি কিন্তু এখনও জানি না মাসি আমাকে কেন আজ এখানে আসতে বলেছে।

রাঙা হয়ে উঠলো বাসন্তীর মুখ।

তোমায় মাসি কিছু বলে নি!

আমি মাথা দোলালাম, না।

আজ মাসির নতুন ঘরের উদ্বোধন। তুমি তার ফিতে কাটবে। তারপর পূজো হবে।

তাই! চলো চলো শুভ কাজে আর দেরি করতে নেই।

মিত্রা, তনু দু-জনে এখন আর আমার কাছে নেই।  

ধীর পায়ে ওপরে উঠে এলাম। আরও অবাক হলাম। আমার ঘরটা যেমন ছিল তেমন আছে। একটু যা পরিষ্কার করা হয়েছে। শুধু চালে ফাটা টিনের জায়গায় নতুন টিন লাগান হয়েছে।

পাশেই একটা ছোট্ট শিবমন্দির করেছে মাসি। বিগ্রহটা বেশ সুন্দর। এখনও পূজো হয়নি। ব্রাহ্মণ দেখলাম ফলটল কেটে নিজের মতো করে গুছিয়ে নিচ্ছে সব।

বয়স বেশি নয়। কুড়ি বাইশের মধ্যে। গেড়ুয়াবর্ণ চেলি পড়েছে।

মাসি আমার পরিচয় দিতেই আসন ছেড়ে উঠে এলো।

প্রণাম করতে যাচ্ছিল হাতটা ধরে ফেললাম।

আপনার কথা মাসির মুখ থেকে প্রায়ই শুনি। আপনি আমার দেশের লোক।

হাসলাম। বাড়ি কোথায়?

ভঞ্জেরপুকুর।

আমার গ্রাম থেকে বেশকিছুটা দূরে।

তিন ক্রোশ।

হ্যাঁ।

আপনার গ্রামের পাশের গ্রামে আমার কুটুম ঘর।

কোথায়?

বীরকটা।

কাদের ঘর।

কেনারাম চক্কতী।

ওরা তো বীরকটার শিব মন্দিরের পুরোহিত।

হ্যাঁ।

মাসি ওই শিবকে দর্শন করে এসেছে।

সেই শিবের গল্প করতে গিয়েই তো মাসির সঙ্গে পরিচয়।

মাসির দিকে তাকালাম। হাসছে।

এখানে কোথায় থাকেন?

আমাকে আপনি বলবে না। আমি অনেক ছোটো।

ঠিক আছে তুমি বলবো।

সামনে একটা মন্দির আছে। আমি সেখানকার পুরোহিত।

কে জোগাড় করে দিল?

আমার এক দূর সম্পর্কীয় আত্মীয়।

বাড়ি থেকে কেউ বাধা দেয় নি?

ছেলেটি হাসলো।

অসুবিধে হচ্ছে না?

প্রথম প্রথম হয়েছিল এখন শয়ে গেছে।

নাও তোমার কাজ কর, বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করবে তো?

হ্যাঁ। মাসিকে বলেছি, তোমরা সবাই তোমাদের মতো করে পূজো করবে। আমি প্রতিদিন এসে নিত্য পূজো করে দিয়ে যাব।

প্রায় আধঘণ্টা পর রতনরা এলো মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে।

মিত্রা, তনু বাসন্তীদের সঙ্গে নিচে ঘুরতে গেল। আমি ওপরেই থাকলাম। প্রায় ঘণ্টা তিনেক থাকার পর একসঙ্গে সবাই মিলে প্রসাদ খেলাম।

এর মধ্যেই আমার কাজ কিছুটা করে নিলাম। মাসি ফেরার সময় সবার জন্য প্রসাদ দিয়ে দিল। বড়োমার সঙ্গে ফোনে কথা বললো।

আসার সময় মাসির চোখটা একটু ছল ছল করছিল।

ঘিরে ধরা মেয়েগুলো অবাক হয়ে আমাকে দেখছিল।

আজ তো তুমি অনেক ভালো আছো। তোমার ভরা সংসার।

মাসি চোখ নামিয়ে নিলো।

নাই বা হলো নিজের। ক্ষতি কি?

আগামী সপ্তাহে লক্ষী আসবে। তার ওপর তোমার অধিকার আছে। সে তো আজ পর্যন্ত তোমাকে অশ্রদ্ধা করেনি। তাহলে? কেঁদো না। তুমি যেখানে আছো, আমিও সেখানে আছি।

তখন তুই মামনির কথায় রাগ করেছিস।

কচু, তোমায় কে বলেছে।

মাসি আমার দিকে তাকিয়ে। মিত্রা, তনুর চোখ দুটো সামান্য ছল ছল করছে।

চলবে —————————–



from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/MLjDTkr
via BanglaChoti

Comments