কাজলদিঘী (১৮৭ নং কিস্তি)

❝কাজলদীঘি❞

BY- জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

১৮৭ নং কিস্তি
—————————–

নিস্তব্ধে সকলে এসে নিচে দাঁড়ালাম।

ছুড়কি ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।

আকা তুমাকে একটা পেন্নম করি।

কেন!

তুমি বড়ো ধরিবাজ লোক, কেউ বুঝতি পারেক লাই।

তুই আগে তোর মামনিদের পৌঁছবার ব্যবস্থা কর। রাতের মধ্যে কলকাতা ফিরতে হবে।

তুমি তো সব গুইছে রাখছ।

খালি পাকা পাকা কথা।

ছুড়কির মাথায় একটা চাঁটা মারলাম।

রতনরা সবাই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

এখান থেকে স্পষ্ট না হলেও শোনা যাচ্ছে গুলির আওয়াজ।

মিত্রার দিকে তাকিয়ে বললাম, তোরা ওঠ।

তুই যাবি না?

কেন যাব না!

তুই আগে ওঠ তারপর আমরা উঠব।

তাই হলো, আমি সামনের একটা বাইকে গিয়ে উঠলাম।

ফেরার পথে থেমে থেমে গুলির আওয়াজ পাচ্ছি।

ছোট্ট গ্রামটাতে ঢুকতে দেখলাম, শ্যামের বাড়ির সামনে সকলে ভিড় করে আছে।

কাছে এসে গাড়ি থেকে নামতেই বড়োমা জড়িয়ে ধরলো। ছোটোমা দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে কানটা ধরতে যাচ্ছিল, হাতটা ধরে ফেললাম। হাসছি।

সব সময় তেঁদরাম তাই না। বয়স হচ্ছে না, দিন দিন কচি হচ্ছ।

বৌদি হাসছে। জ্যেঠিমনি, দামিনীমাসি, আন্টির মুখটা কেমন শুকনো শুকনো।

সুরো, ইসি, নীপারা সকলে টেরিয়ে টেরিয়ে দেখছে।

পেছন দিকে চোখ চলেগেল। দেখলাম আলতাফরা সকলে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে।

অবাক হয়ে এদিকে তাকিয়ে। আমাকে দেখছে।

ইসলামভাইরা একটু দূরে দাঁড়িয়ে। আমার দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে।

তোমাদের খাওয়া হয়ে গেছে?

বড়োমা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কোনও কথা বলছে না।

তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও, সন্ধ্যের মধ্যে কলকাতা ফিরতে হবে। দাদারা একলা আছে।

বৌদি, ছোটোমা ফিক করে হেসে উঠলো।

ছোটো কাকে কিভাবে ম্যানেজ করতে হয় ও খুব ভাল করে জানে। বৌদি বললো।

বড়োমা তবু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

আরে এতো টেনসন করলে চলে। ছোটখাট কাজে টেনসন করলে শরীর খারাপ করবে।

বড়োমার চোখ ছল ছল করে উঠলো।

এই ঝামেলা শুরু করছো।

কেন তুই এই সব করিস।

ধর তোর অর্ক ফোন করেছে। কাজ তো সেরে ফেলেছিস এবার সকলে ফোন করতে শুরু করেছে। মিত্রা কানের কাছে ফোনটা ধরলো।

অট্ট হাসির শব্দ হলো। অর্কর গলা। বুঝলাম মিত্রা ফোনের ভয়েজ অন করে রেখেছে।

বড়োমা মিত্রার দিকে তাকাল।

ভয়েজটা অফ কর।

শুনুকনা ক্ষতি কি।

মিত্রার হাতেই ফোন। আমি চেঁচিয়ে বললাম, বল অর্ক নেমন্তন্ন খেলি?

খেয়ে দেয়ে হাত ধুলাম।

কেমন খেলি?

সব কিছুই ঠিক ঠাক ছিল? তবে…

মাংসটা কেমন খেলি?

টেস্ট খুব ভাল, একটু ঝাল হয়ে গেছে। শুকনো লঙ্কাটা কম দিলে পারত।

পরিমাণ বোঝেনি। নতুন রাঁধুনী। শোন।

বলো।

আজকের কাগজটায় আমার জন্য একটু জায়গা রাখিস।

অর্ক আবার জোড়ে হেসে উঠলো।

কখন আসবে?

এখান থেকে ফিরে অফিসে ঢুকবো। দু-প্যারা লেখার ইচ্ছে আছে।

তুমি লিড স্টোরিটা নামাও, আমরা সাইড স্টোরিগুলো লিখে ফেলি।

না না তোরা এতো কষ্ট করলি।

আবার ভ্যানতারাম শুরু করলে। সবাই শুনছে তাই কিছু বললাম না।

ওদিককার খবর?

তোমারগুলো সব জ্যান্ত, বাকিগুলো মৃত।

অনাদি, সাগর গুলি খেয়েছে।

আদর করে গালে চুমা দিয়েছে।

ঠিক আছে, তোর সঙ্গে পরে কথা বলছি।

আচ্ছা।

লাইনটা কেটে গেল।

অনুপদারা কি কথা বলি তা শোনার জন্য এগিয়ে এসেছিল।

আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।

তোমার ছেলের কথা কিছু বুঝলে। মিত্রা বড়োমার দিকে তাকাল।

অর্করা নেমন্তন্ন খেতে এসেছিল! বড়োমা বললো।

হ্যাঁ নেমন্তন্ন খেতে এসেছিল, শুনলে না। মাংসটা ঝাল হয়েছিল। লঙ্কাটা বেশি দিয়ে ফেলেছে। জিজ্ঞাসা করো তোমার ছেলেকে, রাঁধুনিটা কে? মিত্রা খ্যাড় খ্যাড় করে উঠলো।

কেন তুই খাবি না। ঝাল লাগলে জলে ডুবিয়ে খাস।

মিত্রা বড়োমার দিকে তাকিয়ে। চোখে হাসি।

না গো, যতো সব ফালতু কথা।

আমি বড়োমার দিকে তাকালাম।

সেদিন বলছিলে না অনিমেষদাকে, ছেলেটার জন্য ওদের বড্ড ভোগান্তি। মিত্রা বলে উঠলো।

ও তো ভালো কাজও করে।

থামো। মিত্রা গট গট করে শ্যামের বাড়ির ভেতরে চলেগেল।

এরপর আলতাফদের কাছে ডাকলাম। সকলের সঙ্গে একে একে বড়োমাদের আলাপ করিয়ে দিলাম। বড়োমা ওদের এক একজনকে দেখে আর চোখে মুখে হাত বুলিয়ে কিছু অনুভব করার চেষ্টা করে।

ওরা ভারি মজা পাচ্ছে।

আমার মুখ থেকে এতদিন গল্প শুনেছে এবার চাক্ষুষ দেখছে।

আন্টিকে প্রণাম করে বললো, তোমার রিসেপসনের মাংসটা খুব ভাল খেয়েছি। তোমাকে দেখলাম, ডাক্তারদাদাকে এত কাছ থেকে দেখিনি। দূর থেকে দেখেছি।

আন্টি হাসছে।

দামিনীমাসির হাতদুটো ধরে মাথায় রেখে বললো, দাদার হুকুম ছিল তাই বাসন্তীকে তুলে নিয়ে এসেছিলাম। তুমি রাগ করো না।

দামিনীমাসি হাসছে।

কনিষ্কদের কাছে ডাকলাম। ওরা এগিয়ে এলো।

কনিষ্ককে বললাম।

তুই আলতাফের নাম শুনেছিস ওর হাতের লেখা দেখেছিস, চোখের দেখা দেখিসনি।

আলতাফ কনিষ্কর সামনে হাতজোড় করে দাঁড়িয়েছে।

ইংরেজীতেই বললো, দাদা তুমি আমাকে ক্ষমা করো। সেদিন না জেনে ভুল করে ফেলেছিলাম। অর্জুনের মনের অবস্থাটা সেদিন ভাল ছিল না।

কনিষ্ক আলতাফকে বুকে জড়িয়ে ধরেছে।

তোমরা দাদার জন্য এতো করেছো বলেই দাদাকে ফিরে পেয়েছি।

কেনো তোমরা করোনি। নীরু বলে উঠলো।

না নীরুদা, আমরা যা করেছি তোমরা তার হাজারগুণ বেশি দাদার জন্য করেছো। দাদা সব সময় আমাদের হাতে বেড়ি পরিয়ে রাখে। খুব প্রয়োজন না হলে কিছু চায় না। দেখো কাল রাতে ফোন করে বললো, সকালের মধ্যে চলে আসবি, চলে এলাম। শ্রেফ বসিয়ে রেখে দিল।

সব বুঝছি কিন্তু বোকার মতো বসে আছি।

আলতাফ আমারও তাই অবস্থা বুঝলে। ইসলামভাই চেঁচিয়ে উঠলো।

না আঙ্কেল, আপনি তবু দাদার জন্য কিছু করেছেন, আমাদের কিছুই করতে দেয়নি। শুধু দু-হাত ভরে দাদার কাছে থেকে নিয়েছি।

সুরোকে কাছে ডেকে নিলাম।

সুরো আলতাফের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে।

তুই আমার থেকে অনেক ছোট। তবু তোকে সুরোদি বলে ডাকবো। আমার কোনও বোন নেই, তুই দাদার একমাত্র বোন। তাই তুই আমাদের সকলের দিদি।

আলতাফই একে একে অভিমন্যু, ঝিনুকদের ডেকে নিল। সুরোর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল।

জানিষ সুরোদি দাদার কথায় আমরা সবাই খারাপ-ভালো ছেলে।

সুরো হাসছে।

তোমার বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করালে না?

আলতাফ আমার দিকে তাকাল।

সত্যিতো, সুরো ওরা গেল কোথায়! আমি সুরোর দিকে তাকালাম।

অনেক কষ্টে খাইয়ে দাইয়ে একটু শুইয়েছি।

তোদের খাওয়া, ঘুম ছাড়া জীবনে আর কিছু নেই?

সকাল থেকে তিনবার পরিষ্কার করেছি।

অনেক বেশি করে ফেলেছিস।

মিলিদি দেখো তো জেগে আছে কিনা।

সুরো মিলির দিকে তাকাল।

আলাতাফ, মিলি হচ্ছে কনিষ্কর বৌ।

আর একটা পরিচয় আছে।

অভিমন্যু-ঝিনুক খুব জোর হেসে উঠলো।

কনিষ্কদা কিছু মনে করবে না। দাদার এই সব ছোট ছোট গল্প আমাদের লাইফের বোরনেস কাটায়।

কনিষ্ক হাসছে।

মিলি কপট চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

দেখো, দুটো কোথায়?

খাটে বসে দুজনে খেলছে। মিলি বলছে আর হাসছে।

আঙ্কেল। চেঁচানর শব্দে ভিড়ের দিকে তাকালাম।

দখলাম চম্পার দুই হাতে দু-জন। কে আগে এসে বুড়ি ছোঁবে তার প্রতিযোগিতা চলছে।

ছুটে এসে আমার ঠ্যাং জড়িয়ে ধরলো।

আমি দুটোকে কোলে তুললাম।

জানো তিতি কাঁদছিল। মাম্পি বললো।

একবার সুরোর দিকে তাকালাম। তারপর মাম্পির দিকে।

কেনো!

তোমাকে খারাপ লোকগুলো ধরে নিয়েগেছিল।

নাগো মাকে দিম্মা বকেছে। মিকি বললো।

কেনো!

মদ খেয়েছে।

শয়তান ছেলে।

সুরো ফটাস করে মিকির পেছনে একটা চড় বসালো। আমি ঘুরে যেতেই চড়টা আমার পেছনে পরলো। মিকিরা হাসছে।

আলতাফরাও হাসছে।

তুইও খেয়েছিস।

আমি একটু মা এত্তো।

মিকি দুপাশে হাত বাড়ালো।

এই আঙ্কেল গুলোকে দেখেছিস।

ওরা একবার আলতাফদের দিকে তাকাল।

এরা দুষ্টু। তোমাকে ধরে নিয়েগেছিল। মাম্পি চোখ পাকালো।

অভিমন্যু, আপ্পেরা কথা বুঝতে পারছে না। কিন্তু ওদের চোখমুখ পাকানো দেখে হেসে যায়।

আমি এতক্ষণ ওদের সঙ্গে কি কথা বললাম ওদের বলতে ওরা আরও জোড়ে হেসে উঠলো।

তারপর ওদের বললাম মাম্পি কনিষ্কর মেয়ে, আর মিকি সুরোর ছেলে।

ওরা আমার কোল থেকে ওদের নিতে গেল। ওরা গলা জড়িয়ে ধরেছে। কিছুতেই যাবে না।

মিত্রা আবার ফোনটা কানে দিয়ে কথা বলতে বলতে ভেতর থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো।

ধর কথা বল।

কে?

মিত্রা আমার সামনে দাঁড়িয়ে ফোনটা কানে লাগাল।

হ্যালো।

দেখলাম এবার ভয়েজ অন করা নেই।

তোমার কথা মতো কাজ শেষ করলাম।

ও তুই! কোনও অসুবিধে হয়নি?

হয়েছে। রিকভার করলাম।

বাকি যে ছকটা বলেছিলাম।

মিলে গেছে।

ম্যাডামকে সব ব্রিফ করলি।

সুকান্ত চুপ করে রইলো। মিত্রা মুচকি মুচকি হাসছে।

তোদের দ্বারা কিছু হবে না বুঝলি।

কি করবো চেপে ধরলে।

ভালো করেছিস। আমি আর ঘণ্টাখানেক পর বেরবো। রাস্তা ক্লিয়ার।

তুমি নিশ্চিন্তে ফিরতে পারো।

প্রবীরদাকে খবর পাঠিয়েছিস?

পাঠিয়েছি। বললো, তোর জীবনের সেরা এ্যাচিভমেন্ট।

ডিটেলস কিছু বলেছিস?

না। কাজ শেষ করে সরকারি ভাবে জানালাম। তারপরই ফোন করলো আমাকে।

গাড়িতে যেতে যেতে কথা বলবো। রাস্তায় একবার দেখা করার ইচ্ছে আছে।

ঠিক আছে।

ফোনটা মিত্রার হাতে দিয়ে এদিকে তাকাতেই দেখলাম আলতাফরা তখন শুভ, সুন্দরদের নিয়ে পরেছে। ঘণ্টা-পক্কেও আছে। মাম্পি-মিকি তখনও কোলে চড়ে যুদ্ধ করে চলেছে।

খেয়েছিস?

মাম্পি মাথা দোলালো।  

কি খেয়েছিস?

মাংস।

আমার জন্য রেখেছিস?

মা রেখেছে।

মিলিরা হাসছে।

ওদের দুটোকে কোল থেকে নামালাম। চম্পা কাছেই দাঁড়িয়েছিল।

বাবা কোথায়রে চম্পা?

সেউ পাশে।

ডাক।

আবার কোথায় যাবি? বড়োমা আমার হাত ধরেছে। চম্পা আমার কথা শোনা মাত্রই চলে গেছে।

মিত্রা মুখে হাত তুলে হাসছে।

হাসিস না। বড়োমা খিঁচিয়ে উঠলো।

তুমি একবারে আমাকে মুখ করবে না।

ফোন বন্ধ করে রেখেছিলি কেন।

তোমার ছেলেকে জিজ্ঞাসা করতে পারছো না। শুধু কি আমার ফোন বন্ধ ছিল। নয়না, নম্রতা, তনু সকলের ফোন জমা নিয়ে নিয়েছিল।

বড়োমা আমার মুখের দিকে তাকাল, তারপর মিত্রার মুখের দিকে।

তোরা কিছু বলতে পারিসনি।

সে রূপ তো দেখোনি। সে রূপ এ রূপ আলাদা।

নয়না, মিত্রার দিকে তাকিয়ে হাসছে।

হ্যাঁ তোমার ছেলের দয়ায় একটা জিনিষ দেখে চোখ, মন দুটোই ভরে গেল। সেখানে ঢোকাও যেমন কঠিন বেরনোও তেমন কঠিন। আবার পৌঁছনও কঠিন।

বড়োমা আবার আমার দিকে তাকাল।

আমাদের নিয়ে গেলি না।

মিত্রা হাসলো। আমাদের চারজনের উঠতে এক হাত জিভ বেরিয়ে গেছে।

শ্যাম কাছে এসে দাঁড়াল।

ডাকতিছিলু।

একটু সুখলাল কাকার বাড়ি যাব।

শিবুর দরে আইসে বুইসছে।

মাসি?

সেউখানে আছে।

যাবে না থাকবে?

এঠি থায় নাকি। সকাল নু আইসেই তুকে খুঁজতিছে। না পাইয়ে মোকে দুটা গাল দিল।

শিবু শুয়েছে?

হ।

খাবার ব্যবস্থা কর এবার বেরতে হবে।

হইয়ে আছে, বুইসলে দে দিব।

আমি বড়োমা একটু সুখলাল কাকার সঙ্গে দেখা করে আসি।

যা।

তুই এদের বরং খাওয়াতে শুরু কর।

আইচ্ছা।

আমি বড়োমা শিবুর ঘরের দিকে চললাম। গোটা সাতেক ঘরের পর শিবুর ঘর।

সুখলালের সঙ্গে কি দরকার?

গেলেই দেখতে পাবে।

কেন আগে বলা যায় না।

না।

কাল আমাদের নিয়ে গেলি না কেন?

কোথায়?

যেখানে মিত্রাকে তনুকে নিয়ে গেছিলি।

তোমরা যেতে পারতে না। অনেক উঁচুতে।

আবার কবে নিয়ে আসবি?

মাথা খারাপ নাকি। এই জায়গায় বার বার আসা যায়।

তোর দাদা একবার আসতে চাইছে।

ঠিক আছে নিয়ে আসবো।

শিবুর বাড়িতে ঢুকতেই দেখলাম এপাশ ওপাশ কয়েকটা ছেলে ঘুর ঘুর করছে। পিসী, সুখলালকাকা দুয়ারে বসে আছে।

পিসী ফ্যাকেশে চোখেই বুঝতে পেরেছে কে এসেছে। চেঁচিয়ে উঠলো।

কেরে অনি।

হ্যাঁ।

সকাল নু কাই গেছলু।

একটু কাজে গেছিলাম।

অন্যে কইলো যুদ্ধ হতিছে।

মিছে কথা বলেছে।

পিসী, সুখলাল কাকা যে শীতল পাটিতে বসেছিল আমরাও বসলাম।

কিরে অখন বাইরবি। সুখলালকাকা বললো।

না। খেয়ে বেরবো।

অখনো খাস লাই।

তোমার সঙ্গে দুটো কথা বলে খেতে বসবো।

কি কথা!

আমি চম্পা আর শিবুর ছেলেকে নিয়ে যাব।

সুখলাল কাকা হাসলো। বড়োমাও দেখি হাসছে। পিসীও বাদ নেই।

হাসছো কেনো?

বড়োমা মোকে কইছে।

বড়োমার মুখের দিকে তাকালাম।

তখন পুজো দিতে যাওয়ার সময় চূড়া আমাকে ওদের কথা বলেছিল।

বড়োমাকে কইছি, এনকার সঙ্গে টুকু কথা কই। তুর যখন মনকে লিছে।

অসুবিধে থাকলে আমি নিয়ে চলে যাব।

লেইতে হবেনি। আমি কথা কই আইগে।

অনুপদার সঙ্গে কথা বলেছো।

বলছি।

কি বললো।

কইলো তো আমানকার কথা সেউঠি কইবে। নিজে চোখে দেখছে, লতুন করি আর কি কইবো।

সুখলালকাকা পিসীর সঙ্গে বসে কিছুক্ষণ কথা বললাম। তারপর ফিরে এলাম।

বিষাণ ফিরে এসেছে। আলতাফরা দেখলাম ওকে এঁটুলে পোকার মতো জড়িয়ে ধরেছে।

আমাকে দেখে বিষাণ যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো।

হাসতে হাসতে এগিয়ে এলো।

কিরে, কোনও অসুবিধে হয় নি তো?

বিষাণ হাসতে হাসতে মাথা দোলাল। হয়নি।

একটা নতুন অভিজ্ঞতা হলো কি বল?

হ। দেখলি। কাইজে লাগবে।

হানিফকে বলেছি এবার নিজেদের দায়িত্ব নিজেরা বুঝে নে। বাবার বয়স হয়েছে।

বিষাণ মাথা নিচু করে আছে।

আলতাফরা কয়েকদিন এখানে থাকবে। তোকে দায়িত্ব দিলাম কোনও অসুবিধে যেন না হয়।

আইচ্ছা।

আমাদের গাড়ি কোথায়?

সেউ পাশকে।

কোনও গণ্ডগোল করে নিতো?

লা।

এবার খেয়েদেয়ে একটু রেস্ট নে। আমি কলকাতা ফিরবো।

তুমার সঙ্গি টুকু কথা ছিল।

আমি দেখেছি। আগে বোনের কাজটা সারি, তারপর তোর।

বিষাণ হাসছে। বড়োমাও হেসে ফেললো।

খেয়েদেয়ে বেড়তে বেড়তে দুপুর গড়িয়ে গেল।

বিষাণ, ছুড়কিরা অনেকটা দূর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল।

হাইওয়েতে এসে সুকান্তকে একটা ফোন করলাম।

আমাকে তনু, মিত্রা যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছে। সঙ্গে ইসি। মিলি-টিনা-অদিতিও ছেড়ে কথা বলছে না। ফেরার পথে মনসামন্দিরে দাঁড়াতে হয়েছে। ব্রাহ্মণ মশাই দেখেই চিনতে পেরেছে। এবার আর খুব একটা অসুবিধে হয়নি। মিত্রারা দোকান শুদ্ধু কিনে নিয়েছে।

মনসা মন্দির থেকে গাড়ি ছাড়তে বিকেল গড়িয়ে গেল। সূর্য অনেকটা হেলে পড়েছে।

সেই গাড়িতে ওঠার মুখে সুকান্তর সঙ্গে কথা বলেছিলাম আর বলা হয়নি।

এদের ক্যাঁচর-ম্যাচর চিল-চিৎকারে মাথা খারপ হওয়ার জোগাড়। সকালবেলা যেটুকু থমথমে পরিবেশ ছিল এখন তা উধাও। হাসাহাসি কল-কলানি লেগেই রয়েছে।

আমার গাড়ির ড্রাইভার রতন।

অনিদা বুঁচকিকে ফোন করেছো। মিলি বললো।

না করিনি। আজ বাড়িতে ফিরে করবো।

দু-জনেই কিন্তু ফোরফর্টি ভোল্ট।

তোমাদের কাছে, আমার কাছে নয়।

এই নাও।

অদিতি আমার মুখের সামনে হাত বাড়িয়েছে।

হাতে একটা মুড়ির মোয়া।

পেছন ফিরে অদিতির দিকে তাকালাম।

পেছনে চারজন বসেছে। অদিতি, মিলি, টিনা, ইসি।

মাঝে আমি তনু মিত্রা। সামনে সুরো দুটোকে নিয়ে।

আমি হাতে নিলাম।

পেলে কোথায়?

বলছি। সুরো।

সুরো পেছন ফিরে তাকাল

আবার!

কেন?

ময়নাদি যখন বানাচ্ছিল তখন গোটা তিনেক খেয়েছে।

ও কিছু হবে না। দে তো।

পেট খারাপ হলে তোমার কাছে রেখে আসবো।

অনিদা ছাড়বে। তোকে পর্যন্ত গিলে খেয়ে নেবে।

সত্যিগো, তখন যে ভাবে সবার সামনে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে উঠলো, ভাবলাম দফা-রফা।

মুড ভালো ছিল। কিরে আমরা চেয়ে চেয়ে দেখব নাকি। মিত্রা বললো।

তনু পেছন ফিরে হাসছে।

মিত্রাদি দুটো মাত্র আছে। বড়োমাটা এতো কিপ্টা না। অদিতি বললো।

মিত্রা হাসছে। বললিনা কেন ছেলে আমাদের গাড়িতে উঠবে। তাহলে দেখতিস একটা প্যাকেটের জায়গায় দুটো দিয়ে দিত।

তাহলেই হয়েছে। মিলি বললো।

চাইলাম। একটা প্যাকেট দিল। আর একটা চাইলাম। দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলে উঠলো চব্বচষ্য গেলনটা তো খুব আছে। সকাল থেকে যখন ছেলেটার জন্য হাঁকপাঁক করছিলাম তখন তো কারুর দেখা পাইনি।

অদিতি বলছে ওরা হাসছে।

মাম্পি, মিকি তাদের কাজে ব্যস্ত।

তুমি ছিলে না মিত্রাদি রগড় যদি দেখতে। মিলি বললো।

মিত্রা-তনু দুজনেই একটু তেরছা হয়ে পেছনের দিকে মুখ করে বসলো।

একদিকে মৌসুমীমাসি আর একদিকে বড়োমা, পুরো খেউর গো খেউর।

বাংলা সাহিত্যের খেউর, কবিয়াল, ঝুমুর তখন চারদিকে ম ম করছে। এ বলে আমাকে দেখ ও বলে আমাকে দেখ। কে কাকে কতটা দেখাবে তার কম্পিটিশন চলছে যেন।

কেউ বাদ নেই ইসলামভাই, ইকবালভাই, অনুপদা, শ্যামদা, দারুদা। এমনকি ঘণ্টা, পক্কে, শুভ, সুন্দরও। আমাদেরগুলোর কথা বাদই দাও। সব ঝরতি পরতি।

ও শুনে গম্ভীর হয়ে বললো, নীরু বাক্সটা হাতের কাছে আছে তো।

নীরুদা হেসে বললো মারধোর করলেও আমি দম বন্ধ করে পাশে পাশে আছি, তোকে চিন্তা করতে হবে না। কেশটা কি, তুই একবার ভাল করে জানার চেষ্টা কর।

শিবুতো আমাদের সঙ্গে ছিল। মিত্রা বললো।

হ্যাঁ। তাও কি রক্ষে পেয়েছে।

আমরা টেনসনে মরছি তার ওপর বড়োমার লম্ফঝম্প। তারও ওপর তোমার ফোন বন্ধ। একবারে সোনায় সোহাগা।

প্রথম বারে ফোন করে ফুটুস করে কি একবার বলে দিয়ে খালাস হলে কে জানে।

তখন অনিদার সঙ্গে কথা বলালে না। ব্যাস মাথা ফোরফর্টি।

তোমায় কি বলবো, ওঃ রেসিপিটা তখন যা জমেছিল না মিত্রাদি।

মিলি বেশ রসিয়ে রসিয়ে বলছে।

মিলির কথায় মিত্রারা হেসে গড়িয়ে পড়ে। আমিও যে হাসছি না তা নয় মুচকি মুচকি হাসছি। সুরোও তেরছা হয়ে পেছন ঘুরে বসেছে। একবার করে আমার মুখের দিকে তাকায়। মুচকি মুচকি হাসে।

প্রথমে ফুটুস করে আওয়াজ হলো। ভাবলাম, সেদিন ছুড়কির মতো কেউ হয়তো শুয়োর মারলো। তারপর দেখলাম বেশ কয়েকটা ফুটুস ফুটুস আওয়াজ হলো। বেশ শুনতে লাগছিল। হঠাৎ দেখলাম শ্যামদা ভেতরে এলো। ঘরে ঢুকলো। তারপরেই দেখলাম একটা মেসিন হাতে বাইরে বেরিয়ে গেল।

তখন কিন্তু সত্যি আমার কাপর নষ্ট হওয়ার জোগাড়।

শ্যামদার মুখ চোখটা তখন আর শ্যামদার মতো লাগছিল না।

তারপরেই কালি পটকা ফাটতে শুরু করলো। ফ্যাট ফ্যাট ফ্যাট।

তুমি বিশ্বাস করবে না মিত্রাদি কোথা থেকে গোটা পঞ্চাশেক ছেলে জড়ো হয়ে গেল। কিছুই বুঝতে পারলাম না। কারুর হাত খালি নেই। আমাদের ওখানে কালো কালো রুমাল দেওয়া মাথায় যে পুলিশ গুলো আছে তাদের হাতে যেরকম মেসিন থাকে, সেরকম। চোখমুখ গুলো সে কি ভয়ঙ্কর লাগছিল।

এরা দুজন তখন কোথায় ছিল?

মিত্রা অদিতি-টিনার দিকে ইসারা করলো।

বাথরুমে।

বেশ বসে বসে জমিয়ে বাইরের খাটিয়াতে গল্প করছিলাম।

আমাদের খাট থেকে তুলে ভেতরে ঢুকিয়ে দিল। চারদিকটা ঘিরে ধরলো ওরা।

বড়োমা কিন্তু প্রথমে একটা কথাও বলেনি। থম মেরে বসেছিল। জ্যেঠিমনি আর আন্টি ইসিদির দুটো হাত দুজনে শক্ত করে ধরে বসে আছে।

ছোটোমা, বৌদির মুখ থম থমে।

বরুণদারা? মিত্রা বললো।

ওদের কথা ছাড়ো। তিনটেই ভীতুর ডিম। ঘরে খাটে শুয়েছিল।

ইসলামভাই, শ্যামদার পেছন পেছন ঘোরে। শ্যামদা ওদের ভাষায় কাকে কাকে বেশ উত্তেজিত ভাবে ফোন করলো।

পুরো থমথমে পরিবেশ। এদিকে তখন আর কালিপটকা নয় ফর ফর করে গুলির আওয়াজ হয়েই যাচ্ছে।

পাহাড়ে ধাক্কাটাক্কা লেগে সেটা আরও বেশ কিছুক্ষণ থাকছে।

মিনিট পনেরো পর শ্যামদা ভেতরে এলো। সোজা বড়োমার সামনে এসে দাঁড়াল।

কি হয়েছে? বড়োমার তিরিক্ষি মেজাজ।

এই গুলান অনিদা করায়ঠে।

ঝেঁটা মারো মুখে, তোরা মরদ গুলো কি করতে আছিস।

ব্যাস জ্বলন্ত আগুনে ঘৃতাহুতি।

ওমা দেখি মৌসুমীমাসি লাঠি হাতে টেম্পুর মতো টলতে টলতে শ্যামদাকে মারতে তেরে এসেছে।

কি দুমোড়ো গালাগালি গো মিত্রাদি তোমাকে কি বলবো। কানের খোল পুরো পরিষ্কার।

হাই ভোল্টেজ কাকে বলে। না পারছি প্রাণ খুলে হাসতে, না পারছি কিছু বলতে।

দম বন্ধ করা পরিস্থিতি।

এর মধ্যে সুরো মনে হয় ফুট কেটেছে।

আর যায় কোথায়, দাদা সোহাগী হয়েছো। দাদা সোহাগী। সে কি গলার স্বর গো।

আমি বলেছিলাম, তুমি এতো চিন্তা করছো কেন, দাদা নিশ্চই ঠিক আছে। সুরো বললো।

তারপরেই সটাং উঠে পরে বলে ছোটো ফোনটা দেতো ওই দুটো ধিঙ্গি ওখানে কি করতে গেছে দেখি। তু করলো আর ফু করে উড়ে গেল। সঙ্গে আবার দুটো নেওটা জড়িয়েছে।

ছোটোমা একবার বড়োমার মুখের দিকে তাকাল।

নয়না, নম্রতা? তনু বললো।

হ্যাঁ।

তখন ইসলামভাই ফোন করে যায়, আর মুখ বিকৃতি করে ধ্যুস ধ্যাস আওয়াজ করে।

তারপর ছোটোমা আস্তে করে বললো, ওদের ফোনের স্যুইচ অফ।

যুদ্ধ করতে গেছে, যুদ্ধ। মিনষে গুলো আজ আসুক। মুড়ো ঝেঁটা দেখাব।

খালি একবার বাইরে বেরিয়ে যায়, আবার ফিরে আসে। ছোটোমা, নীরুদা পেছন পেছন।

এই জন্য ডাক্তারকে বলেছিলাম তুমি সঙ্গে চলো। তুমি থাকলে ও বেয়াদপি করতে সাহস পাবে না। তোমাকে তবু একটু আধটু মানে। শুনলে আমার কথা।

ও ছোটো, ছেলেটার কিছু হলে কি করে মুখ দেখাব।

আন্টির তখন চোখ মুখ শুকিয়ে আমসি। জীবনে এরকম পরিবেশে কোনওদিন পরেনি।

শুরু হলো কান্না।

ছোটোমা ধরাধরি করে এনে কোনওপ্রকারে বসালো। বুকে পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়।

তুমি শান্ত হও দেখবে ও ঠিক আছে। কিচ্ছু হয়নি।

তুই ঠিক বলছিস।

আমি ঠিক বলছি। ও আগেও এরকম করেছে। তারপর তোমাকে আমাকে এসে সব বলেছে।

মনসা মন্দিরে মানত কর, যাওয়ার সময় পূজো দেব।

করেছি।

তখন ছোটোমা ছাড়া বড়োমা কাউকে চেনে না।

তোরা তখন কোথায় ছিলি?

কাছা কাছি আছি, স্পিকটি নট। খেপেছো, সেই সময় কেউ কথা বলে।

একবার চিকনটাকে ফোন কর না ও যদি কিছু জানে।

চোখ মোছে আর বলে।

ও তো নিজেই অসুস্থ। ছোটোমা বললো।

তাও ঠিক।

তারপরেই অনিমেষদা ফোন করলো বৌদিকে।

বড়োমা বলে উঠলো সুতপা আমাকে শোনাও।

আমি কথা বলে নিই, তারপর তোমাকে বলছি।

বৌদি বেরিয়ে গেল। কিছুক্ষণ বাদে ফিরে এলো। মনে হয় ইসলামভাই-এর সাথেও কথা বললো।

বৌদির মুখটা কেমন ফ্যাকাশে লাগছিল।

তখন জানতো সাগর, অনাদি গুলি খেয়েছে। মিত্রা বললো।

বৌদি মনে হয় জেনেছিল, আমরা তখনও জানি না।

বৌদি আসতেই বড়োমা বলে উঠলো, অনিমেষ কি বললো।

ও সব জানে। পুলিস পাঠাচ্ছে।

শ্যামদা, দারুদা সত্যি তখন পুরো ফিউজ। দেখে কি মায়া লাগছিল।

চূড়া এসে বড়োমাকে বললো, তুমি একটু সরবত খাও।

ওই মুহূর্তে কি মনে হয়েছিল কে জানে, এককথায় রাজি হয়ে গেল, বললো, দে।

পরিবেশ কিন্তু একটুও বদলায়নি। যাকেই ফোন করে তারই স্যুইচ অফ। আর দুমুড়ো গালাগাল। কান পুরো গরম।

তারও প্রায় আধঘণ্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর তুমি ফোন করলে।

ছোটোমা ধরেই বললো, একবারে গালাগাল করবে না। কি বলে আগে শোনো।

ছোটোমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ ছলছল চোখে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো।

দেখলাম মাথা ঠাণ্ডা করে তোমার সঙ্গে ফোনে কথা বললো। তারপর ছোটোমার সঙ্গে তুমি কথা বললে। তনুদি কথা বললো।

কথা বলা শেষ হতেই বললো, ও ছোটো ডাক্তারকে ফোন কর না ও কিছু জানে কিনা।

জানবে কি করে, সামন্তদা কলকাতায় বসে আছে।

ডাক্তার সব জানে ও অনির মতো মিচকে পোরা।

এবার আন্টি হেসে ফেললো।

তুমি জানো না সোনা, ওরা দুজন দুজনকে বেশ বোঝে। সেই প্রথম থেকে।

তারপর আবার ছোটোমাকে নিয়ে পরলো।

হ্যাঁরে এখানে দিবাকরটা কি করতে মরতে এসেছিল।

ছোটোমা কি বলবে বলো। চুপ করে থাকলো।

মিত্রা মনে হয় তোকে সব বলেছে।

না কিছু বলেনি।

তাহলে তুই চুপ করে আছিস কেন?

ছোটোমা এবার কট কট করে বড়োমার দিকে তাকাল।

আবার চুপচাপ।

তারপর আস্তে আস্তে ফুট ফাট ঠুস ঠাস আওয়াজ কমে গেল। শ্যামদা, দারুদা এসে সব ঘটনাটা বড়োমাকে বললো।

তখন বড়োমা বললো ওদেরকেও নিয়ে এসেছে।

আলতাফদের? মিত্রা বললো।

হ্যাঁ।

শ্যামদা আবার কাল রাতের ঘটনা বললো।

আর যায় কোথায়।

দেখলি ছোটো দেখলি, তোকে বলছিলাম না আমার মনটা কেমন কু-গাইছে। তুই হেঁপি মারলি।

আমি কোথায় হেঁপি মারলাম!

ওই তো তখন বললি তোমার একটা বাতিক হয়ে গেছে। তুমি অনিকে কিছুতেই কাছ ছাড়া করতে চাও না। দেখলি এবার দেখলি।

এলে আচ্ছা করে দিও।

আমি কি পারি, তবু তুই দু-চার-ঘা দিস।

কি বলবো তোমাকে মিত্রাদি, তুমি যদি তখন ছোটোমা, বড়োমার মুখটা দেখতে, স্নেহ যেন চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে।

কিছুতেই হাসতে পারছি না। যদি আবার হাই ভোল্টেজ হয়ে যায়।

এখন যদি বুবুনের কিছু হয় আমি তনু মরার আগে ওরা দুজোন হার্টফেল করে মরে যাবে। মিত্রা বললো।

কেন দামিনীমাসি। টিনা বললো।

ওটা চুপচাপ থাকে। মিত্রা বললো।

চুপচাপ থাকে কি গো! মিলি আবার শুরু করলো।

ওই পিক প্রিয়েড হঠাৎ দেখলাম খালি মাটিতে কাপরটা বিছিয়ে শুয়ে পড়লো।

দেবাদা পাশে ছিল, এগিয়ে গেল। বললো, কিগো মাসি শরীর খারপ লাগছে।

না একটু শুই।

তারপর দেবাদা নীরুদাকে ডাকল। ও বাইরে ছিল ভেতরে এলো।

প্রেসার চেক করতে দেখল বেড়ে গেছে।

এবার মাসিকে নিয়ে পরা হলো। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ চোখ বন্ধ কর শুয়ে থাকর পর দেবাদাকে বললো, ইসলামকে বল, ছুড়কিকে ফোন করতে, আজকের অপারেটর ও।

একবার ভাবো, শুয়ে শুয়ে কি চিন্তা করছে।

বড়োমা শুর শুর করে উঠে দামিনীমাসির পাশে গিয়ে বসলো।

ও দামিনী।

কালকের থেকেই লক্ষ্য করেছি ওর চোখমুখটা ভাল ঠেকছিল না।

আমাকে বলো নি কেন?

বলবো কখন, যখন বলার সময় হলো তখন মহুয়া গিলিয়ে নাচালো। প্রি-প্ল্যান্ড।

তারমানে ও সব জানতো!

হ্যাঁ।

দেখছিস ছোটো দেখছিস, দামিনীর কথা শোন!

আমার কাছে অনেকদিন থেকে খবর ছিল ও দিবাকরকে সরাবে।

কিছুতেই একা ধরতে পারছি না। একটু মন খুলে কথা বলবো তার সময় পাই না। ভেবেছিলাম সেদিনেই দিবাকরকে ও সরিয়ে দিয়েছে। ও যে এখানে আছে সেটা জানতামই না।

ইসলামকে বলো নি কেন?

ওটা একটা গাড়ল। মাথাটা গোবর হয়ে গেছে। নিজের হাতে গড়া ছেলের কারসাজি বুঝিস না। ডাক্তারবাবু বোঝে কি করে।

আমরা সব যেন আকাশ থেকে পড়ি।

নীরুদা মাসির পাল্স ধরে বসে আছে।

বয়েস হয়ে গেছে। সেইভাবে আর দৌড় ঝাঁপ করতে পারি না। না হলে একাই সবকটার থোঁতা মুখ ভোঁতা করে দিতাম। এদের জন্য ছেলেটা জীবনে একটু সুখের মুখ দেখল না। সারাটা জীবন শুধু করেই গেল।

একটা কান্না স্টপ, আর একটা কান্না শুরু।

ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলে, কনিষ্ক।

বলো।

বুকটা বড্ড ধড়ফড় করছে ইঞ্জেকসন টিংজেকসন থাকলে দে তো।

কথা বোলো না। অনি এখুনি ফোন করেছিল, ওখান থেকে রওনা হয়েছে। এসে যদি এই সব অবস্থা দেখে, আমার, নীরুর মুখে নুড়ো জেলে দেবে। সেটা কি ঠিক হবে।

কি ওষুধগো মিত্রা দি!

বলে কি, তোর সঙ্গে কথা হয়েছে?

হ্যাঁ।

আমাকে একটু ধর, উঠে বসি।

কেন!

অবেলায় ও শুয়ে থাকা পছন্দ করে না।

তুমি একবার ভাব! একটু আগে বলেছিল বুক ধড়ফড় করছে ইঞ্জেকসন দে।

মুহূর্তের মধ্যে সব সেরে গেল!

আমরা হাসব না কাঁদব। বড়োমা দেখি দামিনীমাসিকে ধরে বসাল।

তারপরেই মাসির সেই বাজখাঁই খানদানি গলা। ইকবাল।

ইকবালভাই কাছে এলো। বেচারা ওই সময় কাঁঠালের আমসত্ব বনে গেছে।

ছুড়কিকে ফোনটা করে আমাকে একটু দাও তো।

ও গাড়ি চালাচ্ছে ওর পেছনে মামনি বসে আছে।

দিদি বাইরে চলো। আমাদের এইভাবে দেখলে আবার হিতে বিপরীত না হয়ে যায়।

তাই চলো।

দেখলাম শুর শুর করে চার বুড়ী বাইরে এসে খাটিয়াতে বসলো।

চূড়া চা নিয়ে এলো। কেউ না বললো না।

তারপরেই সোনা আন্টির ফোনে ডাক্তারদাদার ফোন। সোনা আন্টি দু-একটা কথা বলেছে। বড়োমা আন্টির হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নিল, কাপড় কাচা শুরু, ডাক্তারদাকে প্রায় আছড়েই মেরে ফেলে। মরণ তো কমন ওয়ার্ড। আর কি কি বললো মনে নেই।

তারপর একটু চোখ ছল ছল।

শান্তি।

কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইলো।

তারপরে বৌদি মনে হয় বললো সাগর, অনাদিকে কারা গুলি করেছে।

বড়োমা দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বলে উঠলো, মরেছে না মরেনি। ছেলেটাকে একটু নিঃশ্বাস ফেলতে দিচ্ছে না। আবার ফোঁস ফোঁসানি শুরু।

তারপরে তোমাদের গাড়ির আওয়াজ পেয়ে চনমন করে উঠলো।

এবার তোমাদেরটা বলো। কাল রাতে একটা জিনিষ দেখে চলে এলে।

এখন বলা যাবে না। ফিরে গিয়ে বসে জমিয়ে বলবো। তনু ছবি তুলেছে।

আমি মিত্রার দিকে তাকিয়ে হাসছি।

রতনও গাড়ি চালাতে চালাতে হাসছে।

আমি মোবাইলটা পকেটে থেকে বার করলাম।

আবার কাকে ফোন করবি। মিত্রা খোঁচাল।

বেশ তো রসিয়ে রসিয়ে গল্প শুনলি।

কেনো, তুই কানে তুলো গুঁজে বসেছিলি।

ফোনটা কানে তুললাম। রিং বাজছে।

হ্যালো।

আমরা খড়গপুর ছাড়িয়ে এলাম।

আমি রাস্তায় অপেক্ষা করছি, তোমার কোনও চিন্তা নেই। আমার কাছে খবর এসে গেছে তোমরা এই মুহূর্তে কোথায় আছো।

বাবাঃ তোর স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চতো বেশ স্ট্রংরে।

তোমার কাছ থেকে শিখেছি।

দাঁড়া তোর মাথা ভাঙবো।

লাইনটা কেটে দিলাম। ফোনটা পকেটে রাখলাম।

মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।

কিছু বুঝলি মিলি?

অনিদা কার সঙ্গে কথা বললো গো।

বুঝলি না।

না।

সুকান্ত।

তারমানে!

আজকে ওকে দিয়ে পুরো ব্যাপারটায় সরকারি শিলমোহর মারলো। এতদিন সুযোগ পাচ্ছিল না। একটা সুযোগ পেল, পুরোটা কাজে লাগিয়ে দিলো।

দিবাকরদাকে সুকান্তদা এ্যারেস্ট করেছে!    

শুধু এ্যারেস্ট করেনি। ওদের দলের প্রায় পনেরো জন মরেছে।

পুলিশের লোক!

না।

তাহলে?

দিবাকরকে যারা নিতে এসেছিল।

দিবাকরদাকে নিতে এসেছিল!

হ্যাঁ, দিবাকরের টিম।

টোপ।

শুধু টোপ, এর ভেতর আরও কতো কি খেলা আছে। সবাইকে এক জায়গায় জড়ো করেছে কি এমনি এমনি। তখন যদি তুই ওর অভিনয় দেখতিস।

দাঁড়াও দাঁড়াও একটু জল গিলে নিই।

মাম্পি, মিকিরা ভোঁ-ভাঁ করেই চলেছে। সুরো সেই যে পেছন ঘুরেছে।

অদিতি-টিনা হাসছে।

মিলি ঢোক গিলে বললো, তাই তখন ওকে জিজ্ঞাসা করতে বটাদা বললো, কেন শুনতে চাইছো কাপর-চোপর নষ্ট হলে কে সামলাবে।

এবার বুঝছিস অনাদি, সাগরকে কে গুলি করেছে?

আমি তো ভেবেছিলাম অভিমন্যু, ঝিনুক কাজটা করে এখানে এসে গা ঢাকা দিয়েছে।

ঘটনা ঘটার আধাঘণ্টা আগে অভিমন্যু ঝিনুক এখানে এসে পৌঁছে যায়।

তারমানে ওরা করে নি!

না।

তাহলে চিকনাদা যে ওকে বললো অভিমন্যু-ঝিনুক এই কাজ করেছে।

সেটা আমিও ভেবেছিলাম। কিন্তু অঙ্ক মেলাতে পারছিলাম না।

মাথায় ঢুকছে না মিত্রাদি।

দিবাকরকে দিয়ে করিয়েছে।

এ্যাঁ! 

আগে ও বহুবার লিখেছে বম্বের একজন আন্ডার ওয়ার্ল্ডের ডনের সঙ্গে অনাদির খুব ভাল রিলেসন। দিবাকর যে সেই ব্যক্তি এতদিন কেউ সেইভাবে জানতো না।

আভাসে ইঙ্গিতে বুঝতো।

এবার প্রমাণ করে দেবে দিবাকরের সঙ্গে অনাদির বিজনেসের ব্যাপার নিয়ে ঝামেলা হয়েছে তাই গুলি খেয়েছে। অনাদির সঙ্গে সাগরও জড়িয়ে আছে।

সাগর সব জানতো তাই সাগরও গুলি খেয়েছে। আর অনাদি একটা ফিগার প্রাক্তন মন্ত্রী তাকে গুলি করে পালাতে গিয়ে দিবাকার ধরা পরেছে। উইথ টিম। এনকাউন্টারে দিবাকরের টিমের লোক মরেছে। ওকে জীবিত ধরা গেছে।

সুকান্ত এসপি হয়েই একটা বড়ো কাজ করে দেখাল। অতএব এ্যান্টি লবির পক্ষে ওকে সরানো খুব মুস্কিল হয়ে গেল। প্রবীরদা এবার ফোর ফন্টে ব্যাট করবে।

বিরোধীরা এখন কোনও টেঁ-ফুঁ করতে পারবে না।

টাইম ক্যালকুলেসন ও সেইভাবেই করে রেখেছে।

বলছো কি! দাঁড়াও দাঁড়াও আর একটু জল গিলি। মিলি বললো। চোখ গোল গোল।

অদিতি, টিনারা হেসেই যায়।

টিনা, সেই জন্য বটাদা তখন বলেছে কাপর নষ্টহলে কে সামলাবে। মিলি বললো।

আবার প্রিয়দর্শিনী দেবার বউ বন্ধুর বউকে ভাগিয়ে এনে অনাদি বিয়ে করেছে, ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে। আর দিবাকর তার বিয়ে করা বউকে অনাদির কাছ থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় অনাদি ঝামেলা করেছে তাই গুলি খেয়েছে। দু-জনেই দু-জনের পূর্ব পরিচিত।

বড়ো মজার অঙ্ক বুঝেছিস মিলি।

দিবাকরের সঙ্গে সাগরেরও একটা রিলেসন আছে। সাগর টাকা পয়সা নিয়ে ঝামেলা করছিল তাই ন্যান্সিকে দিবাকর তুলে এনেছিল। ন্যান্সিই সমস্ত ব্যাপারটায় দিবাকরকে মদত দিয়েছে।

তাছাড়া ন্যান্সির সঙ্গে দিবাকরের পূর্ব পরিচয় আছে।

তুমি এতসব জানলে কি করে?

আমি মিত্রার দিকে তাকালাম।

তিনতলায় ঘুরতে যাব।

মিত্রা খোঁচাতে শুরু করেছে। তনুও বাদ যায় না। পেছন থেকে ওরাও শুরু করে দিয়েছে।

রতন তোমার দাদার কথা শুনছো। মিত্রা বললো।

রতন হাসছে। দাদা গল্পটা কি সুন্দর লিখেছে একবার ভাবুন।

ও-তো চিরদিনই ভালো গল্প লেখে।

সবাই হাসাহাসি করছে।

চলবে —————————–



from বিদ্যুৎ রায় চটি গল্প কালেকশন লিমিটেড https://ift.tt/cd7v5GD
via BanglaChoti

Comments